দেবাশিস রায়
২১ শতাব্দীর শেষ দিকে কলকাতা শহর অনেক বদলে গেছে। হাওড়া ব্রিজের উপর দিয়ে ভেসে চলা চৌম্বক ট্রেন, আকাশছোঁয়া কাচের অট্টালিকা, আর চারপাশে ভেসে থাকা নীয়ন আলোয় ঢাকা রাস্তা—সব মিলিয়ে পুরনো কলকাতা যেন একেবারেই অন্য রূপ নিয়েছে। কিন্তু এই শহরের ভিড়ের মাঝেই এক কোণে আছে দত্ত পরিবার—একেবারে সাধারণ মধ্যবিত্ত সংসার। বাবা অরিন্দম দত্ত পেশায় ব্যবসায়ী, নানা পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে যুক্ত, আর মা শর্মিষ্ঠা দত্ত গৃহিণী হলেও নিজের মতো করে পুরোনো বাংলা গান আর গাছপালা নিয়ে সময় কাটান। এই সংসারের সবচেয়ে আলাদা মানুষ নিঃসন্দেহে অভ্রজিত দত্ত, সবার কাছে অভ্র নামে পরিচিত, যার বয়স মাত্র ১৪ বছর হলেও কৌতূহল যেন আকাশের মতো অসীম। স্কুলের বই পড়ার পাশাপাশি সে গোগ্রাসে গিলে ফেলে পুরোনো সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস, জুল ভার্ন থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পর্যন্ত যার মনে ছড়িয়ে দেয় মহাকাশের অদ্ভুত স্বপ্ন। সে প্রায়ই ছাদের উপর বসে চাঁদের দিকে তাকিয়ে ভাবে—একদিন কি সত্যিই সেখানে যাওয়া সম্ভব হবে? মানুষের পৃথিবী তো দূষণে, যুদ্ধে, আর অনাহারে ভরে উঠছে, হয়তো আগামী দিনের আশা খুঁজে নিতে হবে সেই সাদা উজ্জ্বল গোলাকার গ্রহে।
অভ্রর এই স্বপ্নকে ঘিরে প্রায়ই বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হত। অরিন্দম দত্ত বরাবর বাস্তববাদী মানুষ, তাঁর চোখে ব্যবসার লাভ-ক্ষতি ছাড়া কিছুই বিশেষ গুরুত্ব পায় না। তিনি ছেলেকে বারবার বোঝাতেন—“তুই পড়াশোনা কর, ভালো রেজাল্ট কর, পরে বাবার ব্যবসা সামলাস। মহাকাশ-ফহাকাশ নিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখলে পেটে ভাত আসবে না।” কিন্তু অভ্রর মনকে আটকানো যায়নি। তার ঘর ভর্তি বই, দেয়ালে সোলার সিস্টেমের পোস্টার, আর জানালার পাশে ছোট্ট একটা টেলিস্কোপ—যার মধ্যে দিয়ে সে রাত্রে তারাভরা আকাশ দেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিত। মা শর্মিষ্ঠা ছেলের এই স্বপ্নকে কিছুটা উৎসাহ দিতেন, কারণ তিনি জানতেন ছেলে অন্যদের থেকে আলাদা, তার কল্পনাশক্তি প্রবল। কিন্তু তিনি-ও জানতেন সংসারের বাস্তবতা, যেখানে স্বপ্ন অনেক সময় চাপা পড়ে যায় দায়িত্বের ভারে। অভ্র ভাবত, হয়তো তার জীবনের বড় কোনো পরিবর্তন ঘটবে না, সে হয়তো পড়াশোনা শেষ করে বাবার ব্যবসার খাতা সামলাবে—কিন্তু তার ভেতরের মহাকাশ-তৃষ্ণা বেঁচে থাকবে। ঠিক সেই সময়েই এক অদ্ভুত খবর পুরো পরিবারকে চমকে দিল।
এক সন্ধ্যায় খাবার টেবিলে বসে হঠাৎ অরিন্দম দত্ত ঘোষণা করলেন—“আমরা চাঁদে যাচ্ছি।” কথাটা শুনে শর্মিষ্ঠার হাত থেকে থালা পড়ে যাওয়ার জোগাড়, আর অভ্র অবাক হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। অরিন্দম বললেন, ২১শ শতাব্দীর শেষ ভাগে এসে মহাকাশ ভ্রমণ আর কল্পনা নয়, বড় বড় ব্যবসায়ীরা এখন চাঁদে বাজার খুলেছে। সেখানে বিক্রি হচ্ছে অক্সিজেন সিলিন্ডার, কৃত্রিম নদীর জল, এমনকি পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়া গাছপালা। তিনি নাকি ইতিমধ্যেই এক ব্যবসায়িক চুক্তি করেছেন—চাঁদের বাজারে নতুন শাখা খুলবেন। অভ্রর মনে তখন দোলা লাগল প্রবল ঝড়ের মতো। এ কি সত্যিই সম্ভব? সে কি সত্যিই চাঁদে যাবে? যেটা এতদিন কেবল বইয়ের পাতায়, টেলিস্কোপে, বা কল্পনার মধ্যে দেখেছে, সেটা কি তার চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠবে? সে কিছু বলতে পারছিল না, শুধু বুকের ভেতর ধকধক করছিল। বাবা বললেন, “অভ্র, এবার তুইও দেখতে পাবি আসল মহাকাশ। কিন্তু মনে রাখিস, এটা কোনো বেড়াতে যাওয়া নয়—এটা ব্যবসা।” অভ্র মাথা নাড়ল, কিন্তু তার চোখে তখন আর ব্যবসা নেই, আছে শুধু রূপালি আলোয় ভেজা সেই অনন্ত চাঁদ, যেখানে গিয়ে হয়তো তার জীবনের স্বপ্ন পূর্ণ হবে। এই ঘোষণার পর রাতভর সে ঘুমোতে পারল না, ছাদে উঠে টেলিস্কোপে তাকাল, আর ভাবল—অচিরেই সে সত্যিই সেই জায়গায় দাঁড়াবে, যেখানে মানুষ একদিন শুধুই কবিতা লিখত, গান গাইত, আর এখন তৈরি হয়েছে এক নতুন ইতিহাসের বাজার। এভাবেই শুরু হলো অভ্রজিত দত্তর জীবনের সবচেয়ে বড় অধ্যায়—পৃথিবী থেকে চাঁদের পথে যাত্রার গল্প।
–
যখন মহাকাশযান ধীরে ধীরে চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করল, তখনই অভ্রর বুকের ভেতর এক অজানা উত্তেজনা তীব্র হয়ে উঠল। জানালার বাইরে ঝকঝকে ধূসর পাথরের বিস্তার, অসংখ্য ক্রেটার আর অন্ধকারের ভেতর থেকে উঁকি দেওয়া পৃথিবীর নীল গোলক দেখে তার মনে হচ্ছিল, সে যেন একেবারে অন্য জগতে এসে পড়েছে। কিছু সময়ের মধ্যেই তারা অবতরণ করল “লুনার সিটি”-র বন্দরঘাটে, যেখানে চারদিক ভরে আছে আধুনিক প্রযুক্তির আভা—রোবোটিক গাইড, হোভারকার, আর চকচকে ধাতব পথঘাট। সেখান থেকেই তারা সরাসরি গেল চাঁদের বাজারে। প্রথম ঝলকেই অভ্র থমকে দাঁড়াল। সে যা কল্পনায় দেখত, তার থেকেও অদ্ভুত সুন্দর সেই দৃশ্য। বিশাল কাচের গম্বুজের ভেতর আলো ঝলমল করছে, যেন মাটির পৃথিবীর কোনো শহরের মেলা। ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল সারি সারি দোকান, প্রতিটি দোকানের উপরে ঝুলছে আলোকিত সাইনবোর্ড। কোথাও লেখা—“অক্সিজেন সেন্টার,” কোথাও বা—“কৃত্রিম নদীর জল: পৃথিবীর আসল স্বাদ।” আর এক কোণে বিশাল সবুজ শেডের ভেতর সাজানো পৃথিবীর হারিয়ে যাওয়া গাছপালা—যেমন আমগাছের চারা, শাল, মহুয়া কিংবা পদ্মফুল। অভ্রর মনে হচ্ছিল সে এক স্বপ্নের রাজ্যে এসে পড়েছে, যেখানে মানুষ আবার নতুন করে হারানো পৃথিবীকে ফিরে পেতে চাইছে।
কিন্তু এই বিস্ময়ের ভেতরেই কিছু অদ্ভুত অনুভূতি তাকে অস্বস্তিতে ফেলতে শুরু করল। সে লক্ষ্য করল, অনেক দোকানদার স্বাভাবিকভাবে হাসিমুখে ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বললেও কিছু কিছু দোকানে এক অচেনা শীতলতা ছড়িয়ে আছে। সেই দোকানদারদের চোখ যেন খুব অস্বাভাবিক, নিথর আর গভীর—যেন তারা শুধু তাকিয়েই মানুষের মন পড়ে ফেলতে পারে। অভ্র তাদের দিকে একবার তাকাতেই হঠাৎ কেমন একটা ঠান্ডা শিহরণ অনুভব করল, মনে হল কারও চোখ তাকে ভেদ করে যাচ্ছে। সে বাবাকে জিজ্ঞেস করল, “ওরা এত অদ্ভুতভাবে তাকাচ্ছে কেন?” কিন্তু বাবা ব্যস্ত ছিলেন ব্যবসার হিসাব আর নতুন দোকান ঘোরাঘুরি নিয়ে। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, “এটাই ওদের ব্যবসার ধরণ, তুই বেশি কল্পনা করিস না।” কিন্তু অভ্রর মন শান্ত হলো না। সে দেখল, এক দোকানে অক্সিজেন সিলিন্ডার কেনার জন্য লম্বা লাইন পড়ে আছে, অথচ দোকানদার নির্বিকার মুখে একটার পর একটা সিলিন্ডার দিচ্ছে—তার চোখে কোনো উচ্ছ্বাস নেই, কোনো মানবিক উষ্ণতা নেই। আরেকটু দূরে, এক বিশাল কৃত্রিম নদীর ট্যাঙ্কের পাশে কিছু মানুষ হাঁসফাঁস করে জল ছুঁয়ে দেখছে, যেন তারা ভুলে গেছে এ জল একসময় পৃথিবীর নদীতেই অবাধে বইত। অথচ যিনি এই জল বিক্রি করছেন, তিনি একেবারে যান্ত্রিক কণ্ঠে শুধু দাম বলছেন, আর চোখ তুলে একবারও তাকাচ্ছেন না।
অভ্রর বিস্ময় আর অস্বস্তি মিলে মিশে এক অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি করল। সে বুঝতে পারছিল না, ঠিক কী যেন গোলমাল আছে এই বাজারে। গম্বুজের ভেতর আলো ঝলমলে, মানুষ হাঁটছে, পণ্য বিক্রি হচ্ছে, কিন্তু কোথাও যেন প্রাণ নেই। তার মনে হচ্ছিল, যেন সে কোনো বড় নাটকের মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছে—যেখানে দৃশ্য সব বাস্তব, কিন্তু অভিনেতারা কেউ মানুষ নয়। হঠাৎ তার চোখে পড়ল, বাজারের ভেতরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে এক লম্বা কালো পোশাক পরা মহিলা, যার চোখ স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে অভ্রর দিকেই। সেই চোখের দৃষ্টিতে ছিল অস্বাভাবিক শীতলতা, যেন তার ভেতরের সব গোপন কথা তিনি জেনে ফেলেছেন। অভ্র অজান্তেই কেঁপে উঠল, কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পর যখন আবার তাকাল, তখন মহিলা কোথাও নেই। চারদিক ভিড়, মানুষের হাঁটা-চলা, দোকানের আলো ঝলমল করছে, অথচ অভ্রর মনে হচ্ছিল, এই সবকিছুর আড়ালে এক গভীর অন্ধকার রহস্য লুকিয়ে আছে। চাঁদের বাজারে প্রথমবার প্রবেশ করেই সে বুঝতে পারল—এ জায়গাটা শুধু ব্যবসার বাজার নয়, এ যেন এক ধাঁধা, যার সমাধান খুঁজে বের করা তার ভাগ্যের হাতে লেখা।
–
অভ্রর মনে তখনো সেই বিস্ময় ভর করে আছে, যেদিন সে প্রথমবার সেই অদ্ভুত বাজারে প্রবেশ করেছিল। এক অচেনা জগৎ—যেখানে মানুষ চলাফেরা করলেও, যেন প্রত্যেকেই কোনো অদৃশ্য সুতোর টানে বাঁধা, আর চারপাশের বাতাসে অস্বাভাবিক নীরবতার সঙ্গে মিশে ছিল অদ্ভুত যান্ত্রিক গুঞ্জন। সে যতই ভাবতে থাকে, ততই উপলব্ধি করে যে বাজারটা আসলে মানুষের নিয়মে চলে না, যেন অন্য কোনো শক্তির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সেই ধাঁধার সমাধান খুঁজতে গিয়েই তার পরিচয় ঘটে প্রফেসর শম্ভুনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে। প্রবীণ মানুষটি, চুল পেকে একেবারে সাদা, কিন্তু চোখে যেন জ্বলছে অদম্য সতর্কতা। তিনি এক কোণে বসেছিলেন, ভাঙাচোরা কাঠের বেঞ্চে, যেন কারও অপেক্ষায়। অভ্রর চোখের সঙ্গে চোখ মেলাতেই তিনি মৃদু কণ্ঠে বললেন, “তুমি কি জানো, কোথায় পা ফেলেছ?” অভ্র একটু চমকে উঠে ভুরু কুঁচকালো। প্রফেসরের ভঙ্গি ছিল না কোনো সাধারণ কৌতূহলী বৃদ্ধের মতো, বরং এক অদ্ভুত আশঙ্কায় কাঁপা মানুষ। অভ্র উত্তর দিল না, কিন্তু মনে মনে ভেবে নিল—হয়তো তিনি কিছু জানেন। ধীরে ধীরে সে কাছে গিয়ে বসতেই প্রফেসর কাঁপা গলায় বলতে শুরু করলেন।
প্রফেসর জানালেন, বহু বছর ধরে তিনি এই বাজারকে পর্যবেক্ষণ করছেন। প্রথম দিকে তিনি ভেবেছিলেন, এটা কেবল মানুষের তৈরি কোনো গোপন বিজ্ঞান, হয়তো সরকারের পরীক্ষাগার থেকে ছড়িয়ে পড়া কোনো অজানা প্রকল্প। কিন্তু যত গভীরে তিনি অনুসন্ধান করেছেন, ততই স্পষ্ট হয়েছে যে এ বাজার মানুষের নিয়ন্ত্রণে নেই। তাঁর ভাষায়—“এখানে যে নিয়ম চলছে, তা পৃথিবীর কোনো নিয়ম নয়। তুমি কি খেয়াল করেছ, লোকগুলো চোখে চোখ রাখতে চায় না? তুমি কি বুঝতে পেরেছ, দোকানিরা একই সঙ্গে যেন এক যন্ত্র আর এক জীবন্ত ছায়া? আমি দেখেছি, ওদের শরীর বদলায় না, কণ্ঠ বদলায় না, প্রতিদিন একইভাবে পুনরাবৃত্তি ঘটে। আমি যতবারই এসেছি, এই বাজার প্রতিবার আমার সঙ্গে একই খেলা খেলেছে।” প্রফেসরের গলা কেঁপে উঠল। তিনি একটু থেমে অভ্রর দিকে তাকিয়ে আবার বললেন, “তুমি বিশ্বাস করবে না, কিন্তু এটা আসলে এক ভিনগ্রহীয় ফাঁদ। মানুষকে এখানে টেনে আনা হয়, তার ইচ্ছাশক্তি ভেঙে ফেলা হয়, আর শেষে তাকে ব্যবহার করা হয় এক অদ্ভুত পরীক্ষার অংশ হিসেবে।” অভ্র অবিশ্বাসে তাকিয়ে থাকলেও প্রফেসরের চোখের ভয় যেন তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। সে জানত না কী উত্তর দেবে। সে কেবল অনুভব করল, বৃদ্ধ বিজ্ঞানীর প্রতিটি শব্দ যেন তার ভেতরের কৌতূহলকে এক অদৃশ্য আতঙ্কে রূপান্তরিত করছে।
অভ্র চুপচাপ বসে শুনতে থাকল, অথচ মনের ভেতর অস্বীকারের একটা স্রোত চলছিল। সে বিজ্ঞানীকে যুক্তি দিয়ে থামাতে চাইল, বলতে চাইল—“আজকের যুগে ভিনগ্রহী নিয়ন্ত্রিত বাজার, এসব কি কেবল ভয়ের কল্পনা নয়?” কিন্তু যখনই সে প্রফেসরের চোখের দিকে তাকাল, সেই যুক্তি আর মুখে আনতে পারল না। কারণ ওই চোখে এমন এক গভীর আতঙ্ক ছিল, যা কৃত্রিম হতে পারে না। যেন বহু রাত জেগে, বহুবার জীবন-মৃত্যুর সীমানা ছুঁয়ে এসে তিনি এই উপলব্ধি অর্জন করেছেন। প্রফেসর বললেন, “তুমি যদি এখান থেকে বেরোতে পারো, আর কখনও ফিরে এসো না। এই বাজার একবার যে মানুষকে টেনে নেয়, তাকে আর সহজে ছাড়ে না। আমি বহুবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু প্রতিবারই আবার ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছি। মনে রেখো, এখানে প্রতিটি মুহূর্তে তোমাকে অদৃশ্য চোখে দেখা হচ্ছে।” অভ্রর শরীরের ভেতর দিয়ে ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল। তার মনে হলো, এই প্রবীণ বিজ্ঞানীর সতর্কতা অস্বীকার করা মানেই নিজের ভবিষ্যৎকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া। তবুও, তার যৌক্তিক মন এখনও প্রশ্ন তুলছিল—হয়তো বৃদ্ধ বিভ্রমে ভুগছেন, হয়তো বহুদিন একাকী থেকে তাঁর মস্তিষ্ক ভুল জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছিল, বিষয়টা তত সহজ নয়। অভ্র বুঝতে পারল, এই সতর্কবার্তা উপেক্ষা করলে সে হয়তো এক অচেনা অন্ধকারের দিকে এগোবে। আর সেই অন্ধকারে কী অপেক্ষা করছে, তা কেবল প্রফেসরের ভীত চোখই ইঙ্গিত করে দিল—এক অদৃশ্য খেলা, যার নিয়ন্ত্রণ মানুষের হাতে নেই।
–
অভ্রর দিনটা শুরু হয়েছিল বাকি দিনের মতোই, কিন্তু বিকেলের দিকে অচেনা এক মোড়ে হাঁটতে হাঁটতে তার চোখে পড়ে একটি পুরনো কাঠের সাইনবোর্ডে লেখা নাম—“মীনাক্ষী অক্সিজেন সাপ্লাই।” ছোট দোকানঘর, চারদিকে ধুলো আর লোহার সিলিন্ডারের গন্ধ, অথচ ভেতরে ঢুকতেই যেন অন্য এক জগৎ। আলো-অন্ধকার মেশানো সেই ঘরে বসে ছিলেন মীনাক্ষী সেন—প্রায় পঞ্চাশোর্ধ্বা এক মহিলা, মুখে ক্লান্তির রেখা স্পষ্ট হলেও চোখদুটো অদ্ভুত দীপ্তিতে জ্বলছিল। তিনি প্রথমেই অভ্রকে স্বাগত জানালেন অকারণে, যেন অনেকদিন ধরে কাউকে খুঁজছিলেন আর অভ্রর আগমন সেই অপেক্ষারই উত্তর। অভ্র কিছুটা অস্বস্তিতে পড়লেও মীনাক্ষীর হাসির মধ্যে এমন এক টান ছিল যে তার কাছে বসতে বাধ্য হলো। অল্প কথাতেই বোঝা গেল তিনি ব্যবসায়ী হলেও মানুষের প্রতি দয়া আর মমতাই তার বড় পরিচয়। দোকানের ভেতরে কোণে রাখা সিলিন্ডারগুলো নিয়ে তিনি সহজভাবে অভ্রকে বোঝাতে লাগলেন, কীভাবে অক্সিজেন শুধু রোগীর নয়, পুরো শহরের প্রাণবায়ুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। কিন্তু সেই ব্যস্ততাময় আলোচনার মাঝেই হঠাৎ দেখা গেল তার চোখের গভীরে এক অচেনা ভয়, যা সামান্য আলোতে খোলা বইয়ের পাতার মতো উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল।
অভ্রর কৌতূহল বেড়ে গেল। সে ভদ্রভাবে জানতে চাইল, “আপনার চোখে এমন যেন একটা আতঙ্ক দেখি… আপনি কি কিছু নিয়ে চিন্তিত?” মীনাক্ষী সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন না, বরং কিছুক্ষণ নীরব হয়ে তাকালেন বাইরের জানলার ফাঁক দিয়ে। সেই মুহূর্তে অভ্র স্পষ্ট দেখল—তার আঙুলগুলো হালকা কাঁপছে, আর ঠোঁটে চাপা কষ্টের ছাপ। অবশেষে তিনি মৃদুস্বরে বললেন, “কিছু সত্যি কথা জানলে জীবন অনেক সময় বিপদে পড়ে, আর কিছু কথা না বললেও ভেতরটা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আমি মাঝপথে দাঁড়িয়ে আছি, অভ্র।” তার এই স্বীকারোক্তি অভ্রকে আরো কাছে টেনে নিল। সে অনুভব করল, মীনাক্ষী কেবল ব্যবসায়ী নন, তার মধ্যে এক বিশাল গোপন ভার জমে আছে। দোকানের চারদিকে সিলিন্ডারের ধাতব প্রতিফলনে আলো কেঁপে উঠছিল, যেন সেগুলোও সেই গোপন কথার সঙ্গী। অভ্র বুঝতে পারল, তিনি কিছু জানেন—কোনো বিপদের, কোনো রহস্যের, যা শহরের চারপাশে ছায়ার মতো ঘুরছে। অথচ সেই সত্য উচ্চারণ করার সাহস তার নেই। মীনাক্ষীর চোখে চোখ রাখতেই অভ্রর মনে হলো, তিনি যেন তাকে সতর্ক করতে চাইছেন—কোনো বড় অন্ধকারের আগমনী বার্তা আছে সামনে।
সেদিন দোকান ছাড়ার সময় অভ্রর মনে এক অদ্ভুত টান রয়ে গেল। মীনাক্ষী তাকে এক গ্লাস জল দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে বলেছিলেন, “যদি কোনোদিন সত্যের খোঁজে খুব বিপদে পড়, মনে রেখো—সবচেয়ে নিরাপদ উত্তর হয়তো সেই জায়গাতেই আছে, যেটাকে আমরা সবচেয়ে ভয় পাই।” এই কথাগুলো অভ্রর মনে গেঁথে গেল, যেন গুপ্ত ধাঁধার মতো। দোকান থেকে বেরিয়ে আসার পর সন্ধ্যার আলোতে শহরের রাস্তাগুলোকে একেবারে অন্যরকম লাগছিল—আলো-অন্ধকারে ঢাকা, নীরব অথচ অস্থির। অভ্র জানত, মীনাক্ষী তাকে কোনো বড় কিছুর আভাস দিয়েছেন, যদিও মুখ ফুটে কিছু বলেননি। তার চোখের আতঙ্ক, কাঁপা হাত, আর গোপন ইঙ্গিত—সব মিলিয়ে অভ্র নিশ্চিত হলো, শহরের রহস্যময় ঘটনার সঙ্গে মীনাক্ষী গভীরভাবে জড়িত। কিন্তু তিনি এখনো ভয় ভেঙে তা প্রকাশ করতে প্রস্তুত নন। অভ্র ঠিক করল, সে আর পিছিয়ে যাবে না—মীনাক্ষীর আতঙ্কের উৎসকে খুঁজে বের করতেই হবে। আর সেই মুহূর্তে শহরের হাওয়ায় যেন অদৃশ্যভাবে বেজে উঠল অচেনা এক সুর, যা অভ্রকে শিহরিত করে তুলল, আর তাকে মনে করিয়ে দিল—এ যাত্রা আর স্রেফ কৌতূহলের নয়, জীবন-মরণের খেলার।
–
অভ্র যখন প্রথমবার রাহুল ঘোষের নাম শুনেছিল, তখন তার মনে ভেসে উঠেছিল একদম ভিন্ন ছবি—একজন সৎ, পরিশ্রমী ব্যবসায়ী যিনি চাঁদের বাজারে প্রথমে নিজের দোকান খুলে ধীরে ধীরে মানুষের আস্থা জিতেছিলেন এবং আজ তিনি ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক প্রভাবশালী নাম। সবাই তাকে শ্রদ্ধা করে, তার মেলামেশায় এক অদ্ভুত আন্তরিকতা থাকে, যেন তিনি শুধু ব্যবসা নয়, সম্পর্কও গড়ে তুলতে জানেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অভ্রর মধ্যে কিছু সন্দেহ তৈরি হচ্ছিল। অদ্ভুত কিছু গুজব ছড়াচ্ছিল, কেউ বলছিল রাহুল রাতের অন্ধকারে চাঁদের প্রান্তে চলে যায়, আবার কেউ দাবি করেছিল তার ব্যবসার সাফল্যের রহস্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। অভ্র স্বভাবতই অনুসন্ধানী, তাই এক সন্ধ্যায় সে সিদ্ধান্ত নেয় রাহুল ঘোষকে কিছুক্ষণ গোপনে অনুসরণ করবে। সেই দিনটা ছিল একেবারেই সাধারণ—চাঁদের পৃষ্ঠে কৃত্রিম সূর্যালোক নিভে আসছে, ব্যবসায়ীরা দোকান গুটিয়ে নিচ্ছে, আর বাজার ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। অভ্র দেখল, রাহুল হঠাৎ নিজের দোকান বন্ধ করে খুব দ্রুতগতিতে একটি সরু গলির দিকে এগিয়ে গেলেন। প্রথমে অভ্র ভেবেছিল হয়তো বাড়ি ফিরছেন, কিন্তু গলির শেষে পৌঁছে সে বুঝতে পারল, রাহুল আসলে বাজারের প্রচলিত পথে যাচ্ছেন না—তিনি এমন এক অজানা গুহার দিকে ঢুকে পড়লেন যেখানে সাধারণত কেউ যায় না।
অভ্র সাবধানে তার পিছু নিল। গুহার ভেতরটা ঠাণ্ডা আর অদ্ভুতভাবে স্যাঁতসেঁতে, যদিও চাঁদের শুকনো পরিবেশে তা একেবারেই অস্বাভাবিক। কিছুটা হেঁটে যাওয়ার পর অভ্র হঠাৎ লক্ষ্য করল, গুহার গভীরে অদ্ভুত নীল আলো জ্বলছে। সে নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে একটা বড় পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। সেখান থেকে যা দেখল, তাতে তার বুক ধকধক করে উঠল। রাহুল ঘোষ দাঁড়িয়ে আছেন একদল অদ্ভুত সত্তার সামনে—তাদের গায়ের রং ধূসর, চোখ দুটো হালকা সবুজে জ্বলছে, শরীর লম্বাটে আর মুখে কোনো স্পষ্ট অভিব্যক্তি নেই। তারা চাঁদের স্থানীয় কোনো প্রাণী নয়, আবার মানুষের মতোও নয়, যেন মহাশূন্যের এক অচেনা জাতি। রাহুল তাদের সঙ্গে হাতের ইশারায় এবং কিছু অদ্ভুত শব্দে যোগাযোগ করছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে অভ্র বুঝতে পারল, এটা কোনো সাধারণ সাক্ষাৎ নয়, বরং এক ধরনের চুক্তি চলছে। রাহুল একটি স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো বস্তু তাদের হাতে তুলে দিলেন, যার ভেতরে অজানা শক্তি কাঁপছিল। সেই সত্তারা পাল্টা রাহুলকে দিলো এক ধরনের কালো ধাতব বাক্স, যা আলো শোষণ করে নিচ্ছিল। অভ্রের শরীর কেঁপে উঠল—এমন কোনো প্রযুক্তি বা বস্তু সে আগে কখনও দেখেনি। তার মনে সন্দেহ জাগল, রাহুলের ব্যবসার অস্বাভাবিক সাফল্যের পেছনে এই অজানা সত্তাদের হাত রয়েছে। রাহুল তার সাফল্য শুধু মেধা বা পরিশ্রম দিয়ে পাননি; তিনি অন্য এক বিপজ্জনক শক্তির সঙ্গে আঁতাত করেছেন।
অভ্র নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে জানত, যদি এই খবর বাইরে ছড়িয়ে যায়, তাহলে চাঁদের বাজারে চরম অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। সবাই যার প্রতি এতটা আস্থা রেখেছে, সেই রাহুল ঘোষ আসলে গোপনে এক অচেনা শক্তির সহযোগী। কিন্তু অভ্র একই সঙ্গে ভয়ও পেল—এমন বিপজ্জনক সত্তাদের সঙ্গে চুক্তি করে রাহুল কী পেতে চাইছেন? তাদের কাছ থেকে তিনি শুধু ব্যবসায়িক সাফল্য কিনছেন, নাকি আরও বড় কোনো পরিকল্পনা আছে? অভ্রর মনে হলো, রাহুল হয়তো চাঁদের বাজারকে শুধু ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে দেখছেন না, বরং এর ভেতরে এক নতুন শক্তির খেলা তৈরি করছেন। গুহার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে অভ্রর বুক কাঁপছিল, কিন্তু সে জানল, এখন পিছু হটার সময় নেই। এই গোপন রহস্য তাকে জানতে হবে, নইলে একদিন এই শক্তি পুরো মানব সমাজকে গ্রাস করবে। সে দৃঢ় সংকল্প নিল, রাহুল ঘোষকে এখন থেকে নজরে রাখতে হবে এবং সুযোগমতো প্রমাণ সংগ্রহ করতে হবে। তবে একই সঙ্গে সে জানত, রাহুল আর তার অদ্ভুত সঙ্গীরা যদি বুঝে যায় কেউ তাদের গোপন চুক্তি দেখে ফেলেছে, তবে তার জীবন মারাত্মক বিপদে পড়তে পারে। চাঁদের নিরব প্রান্তরে দাঁড়িয়ে, গুহার শীতল অন্ধকারে, অভ্রর মনে হলো—সে এক ভয়ংকর খেলায় পা দিয়েছে, যেখানে বন্ধু আর শত্রুর সীমারেখা ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।
–
চাঁদের বাজারে সেই দিনটা অন্য দিনের মতোই জমজমাট ছিল। দূর থেকে নদীর বাতাস বয়ে এসে রূপালি আলোয় ভরে দিয়েছিল মাটিকে, আর দোকানিদের গলার আওয়াজ মিলেমিশে তৈরি করছিল এক অদ্ভুত সঙ্গীত। পাথরের মোড় ঘেঁষে সাজানো রঙিন কাপড়ের সারি, ধূপকাঠির গন্ধে ভরা অলিগলি, আর লণ্ঠনের দপদপে আলো—সব মিলিয়ে বাজারটা যেন বাস্তবের চেয়ে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল। ঠিক সেই সময়েই, ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ এক নারীর আবির্ভাব ঘটে। তাঁর নাম অরোরা। শুরুতে কেউই জানত না তিনি কে, কোথা থেকে এলেন, কিন্তু তাঁর উপস্থিতি যেন পুরো পরিবেশটাকেই বদলে দিল। তাঁর পরনে ছিল অচেনা নকশার পোশাক—রূপালি আর নীলের মিশ্রণে তৈরি যেন রাতের আকাশের এক খণ্ড, আর তাঁর চলাফেরার ভঙ্গি এতটাই নিখুঁত, এতটাই নির্ভুল, যে মনে হচ্ছিল তিনি যেন ভিড়ের মধ্য দিয়ে হাঁটছেন না, বরং ভেসে যাচ্ছেন। চোখের দৃষ্টিতে ছিল অদ্ভুত এক শীতলতা—কোনও ক্রোধ নেই, কোনও আবেগ নেই, তবু তাতে এমন কিছু লুকিয়ে ছিল, যা অচেনা ও বিপজ্জনক মনে হচ্ছিল। বাজারের মানুষরা প্রথমে মুগ্ধ হয়ে তাঁর দিকে তাকালেও, অভ্রর ভেতরে অস্বস্তির ঢেউ খেলে গেল। সে লক্ষ্য করল, অরোরার চোখে যেন মানবীয় উষ্ণতার অভাব, আর সেই চোখের গভীর থেকে ভেসে আসছে এক অদৃশ্য শীতল স্রোত, যা আশেপাশের বাতাসকেও ভারী করে তুলছে।
অভ্র চেষ্টা করল নিজেকে বোঝাতে যে হয়তো সে ভুল দেখছে। বাজারে নতুন মুখ আসা অস্বাভাবিক কিছু নয়, আর এমন সৌন্দর্যের দেখা মেলাও বিরল। কিন্তু অরোরার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি, প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন অস্বাভাবিক নিখুঁত—এমনকি তাঁর হাঁটার ছন্দও বাজারের ভিড়ের অগোছালো শব্দের সাথে মেলাতে পারছিল না। অন্যরা হয়তো মুগ্ধতার ঘোরে তা খেয়াল করেনি, কিন্তু অভ্রর কানে বারবার ধাক্কা মারছিল সেই অদ্ভুত তালবিহীনতা। আরও অদ্ভুত লাগছিল তাঁর হাসি—চোখে কোনও আলোর ঝিলিক নেই, ঠোঁটে কোনও উষ্ণতা নেই, তবু এমনভাবে হাসছিলেন যেন মানুষের ভেতরের সমস্ত দুর্বলতা তিনি দেখতে পাচ্ছেন। অভ্রর মনে পড়ল ছোটবেলার এক গল্প, যেখানে বলা হয়েছিল কিছু আত্মা মানুষের রূপ ধারণ করে আসে, কিন্তু তাদের চোখের গভীরে থাকে অমানবিক এক শীতলতা, যা প্রকাশ করে তাদের আসল সত্তাকে। তার মনে হলো, হয়তো অরোরা তাদেরই একজন—অন্য জগতের দূত, যিনি মানুষের ভিড়ে এসে নিজের রহস্যময় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চাইছেন। অথচ আশেপাশের লোকেরা তাঁকে ঘিরে কেবল সৌন্দর্যের বন্দনা করছে, যেন মন্ত্রমুগ্ধ দর্শকরা কোনও অচেনা দেবীর আগমনে ভক্তির স্রোতে ভেসে গেছে। অভ্রর বুকের ভেতর অদৃশ্য এক আতঙ্ক জমে উঠল, আর সে বুঝল, এই নারীকে সহজভাবে নিলে বিপদ আসতে দেরি হবে না।
এরপর থেকে বাজারে অরোরার প্রতিটি চলাফেরা অভ্র গভীরভাবে লক্ষ্য করতে লাগল। তিনি যখনই কোনও দোকানে দাঁড়াতেন, সেই দোকানদারের চোখে ঝিলিক ফুটে উঠত, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে লেনদেন শেষ হওয়ার পর তাদের মুখে ক্লান্তি আর শূন্যতা ছেয়ে যেত। যেন তিনি তাদের থেকে অদৃশ্য কিছু শুষে নিচ্ছেন—কেবল মুদ্রা নয়, বরং প্রাণশক্তির এক ক্ষুদ্র অংশ। অভ্রর চোখ এড়ায়নি যে তাঁর চলার পথে বাতাস ভারী হয়ে যাচ্ছে, পাখিরা আচমকা উড়ে গিয়ে নীরব হয়ে যাচ্ছে, এমনকি আলোও কিছুটা ম্লান হয়ে আসছে। এক মুহূর্তের জন্য অভ্রর মনে হলো অরোরার চারপাশে অদৃশ্য এক বলয় তৈরি হয়েছে, যেখানে সাধারণ মানুষ কেবল দর্শক হয়ে থাকে, আর অরোরা নিজের গোপন শক্তি দিয়ে সবাইকে প্রভাবিত করে। সেই শীতল দৃষ্টি বারবার অভ্রর দিকে ছুটে আসছিল, যেন তিনি বুঝতে পারছেন—এই ভিড়ে একমাত্র অভ্রই তাঁর সত্যিকারের পরিচয় আঁচ করতে শুরু করেছে। অভ্রর শরীর কেঁপে উঠল, কিন্তু সে জানত ভয় প্রকাশ করা যাবে না। এই রহস্যময় নারী সাধারণ কেউ নন, আর তাঁর উপস্থিতি ভবিষ্যতের ঘটনাপ্রবাহকে পুরোপুরি বদলে দিতে পারে। তাই অভ্রর মন স্থির হলো—যতই কঠিন হোক, তাঁকে বুঝতেই হবে অরোরা আসলে কে, আর তাঁর আগমনের পিছনে লুকিয়ে আছে কোন ভয়ঙ্কর সত্য।
–
অভ্রর মনে সেদিনই সন্দেহ জন্মেছিল যখন বাজারের ভেতর হঠাৎ অদ্ভুত আলো ঝলসে উঠেছিল, কিন্তু সবার চোখ এড়িয়ে সেটিকে যেন কেউ আর খেয়ালই করল না। শহরের ধ্বংসস্তূপের মাঝে বাজার ছিল একমাত্র জায়গা যেখানে কিছুটা হলেও মানুষের ভিড় দেখা যেত, আর সেখানেই অক্সিজেন ক্যানিস্টার, পরিশোধিত জল আর শুকনো খাবারের লেনদেন হতো। দিনভর কাজ শেষে রাতে, অভ্র প্রায়শই বাজারের কোণে বসে থেকে লোকজন পর্যবেক্ষণ করত। সেদিনও তাই করছিল। কিন্তু হঠাৎ করে সে লক্ষ্য করল—অরোরা আর রাহুল, যাদের সে এতদিন বিপ্লবী সংগঠনের অংশ বলে ভেবেছিল, তারা যেন একেবারে অন্য কাউকে খুঁজছিল। তাদের চোখে-মুখে এক ধরনের গোপন তাড়াহুড়ো, আর আচরণে এক অস্বাভাবিক সতর্কতা ছিল। অভ্র চুপচাপ বাজারের ভাঙা ছাদের ফাঁক গলে তাদের পিছু নিল। ধুলোমাখা পথ ধরে হেঁটে তারা পৌঁছাল বাজারের এক অন্ধকার কোণে, যেখানে কেউ সাধারণত আসে না। সেখানেই অভ্র প্রথমবার দেখল—দু’জন অচেনা সত্তা, যারা মানুষের মতো হলেও তাদের চোখে অদ্ভুত সবুজ আভা, আর শরীর থেকে যেন অদৃশ্য তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছিল। অভ্র শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকল।
সে দেখল, অরোরা আর রাহুল সেই ভিনগ্রহীদের হাতে তুলে দিচ্ছে অক্সিজেন সিলিন্ডার, প্লাস্টিক ড্রামে ভরা স্বচ্ছ জল, আর কিছু ছোট্ট যন্ত্র। তাদের কণ্ঠস্বর খুব নিচু হলেও অভ্রর কানে কিছু কিছু শব্দ ভেসে এল—“Transport… gateway… extraction…”। তার বুক ধকধক করতে লাগল, যেন মাটির তল দিয়ে তার শিকড় টেনে বের করা হচ্ছে। এতদিন ধরে যে সংগঠনে সে ভেবেছিল পৃথিবীর শেষ সবুজ আর শেষ নদী রক্ষার লড়াই চলছে, আসলে সেই সংগঠনেরই দুই সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মানুষ ভিনগ্রহীদের জন্য সবকিছু সংগ্রহ করছে। পৃথিবীর বাকি মানুষদের বাঁচানোর জন্য নয়, বরং অন্য এক গ্রহের বেঁচে থাকার জন্য তারা এই সম্পদ লুট করছে। অভ্রর চোখে ভেসে উঠল শুকিয়ে যাওয়া মাঠ, নিঃশেষিত বনের স্মৃতি, আর সেই একমাত্র টিকে থাকা নদীটির ধীরে ধীরে সরু হয়ে যাওয়া ধারা। সে বুঝল, আসলে পৃথিবীর শেষ সবুজ পাতাটাও, শেষ জলের বিন্দুটাও এই ভিনগ্রহীদের জন্য পাঠানো হচ্ছে। মানুষের জন্য নয়, পৃথিবীর ভবিষ্যতের জন্য নয়। সে হঠাৎ মনে করল, কয়েকদিন আগে অরোরা তাকে বলেছিল—“আমরা আসলেই বিপ্লব করছি।” তখন অভ্র ভেবেছিল বিপ্লব মানে মানুষকে বাঁচানো, পৃথিবীকে রক্ষা করা। আজ সে বুঝল বিপ্লব মানে আসলে পৃথিবীর ভেতরের মানুষকে প্রতারণা করে ভিনগ্রহীদের হাতে তুলে দেওয়া।
অভ্রর ভেতরে এক ধরনের ঝড় বয়ে গেল। সে জানত এই গোপন সত্য যদি কারও কাছে ফাঁস হয় তবে তাকে সবার আগে হত্যা করা হবে, কারণ এত বড় বিশ্বাসঘাতকতার সাক্ষী একমাত্র সে-ই। কিন্তু একইসঙ্গে তার ভেতরে এক প্রচণ্ড রাগ আর দায়িত্ববোধ জন্ম নিল। সে আর চুপ করে থাকতে পারবে না। তার বুকের ভেতর কাঁপতে থাকা আতঙ্কের সঙ্গেই সে অনুভব করল, এটা আসলে তার জন্ম নেওয়া মুহূর্ত—যখন তাকে ঠিক করতে হবে, সে কাদের পাশে দাঁড়াবে। সে বুঝতে পারল পৃথিবীর শেষ শ্বাসকে বাঁচানো মানেই এখন অরোরা ও রাহুলের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, তাদের মুখোশ খুলে দেওয়া। সে রাতের অন্ধকারে বাজার থেকে বেরিয়ে এল, কিন্তু তার মনে হল চারপাশে যেন হাজার চোখ তাকে তাড়া করছে। অরোরা ও রাহুল তখনও ভিনগ্রহীদের সঙ্গে অদ্ভুত সব আলো-ছায়ার মধ্যে লেনদেন করছিল, আর আকাশে হালকা কম্পনের মতো কিছু শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। অভ্র জানত, এখন আর পিছিয়ে যাওয়ার কোনো পথ নেই। তার সামনে শুধু একটাই রাস্তা—এই ষড়যন্ত্র উদঘাটন করা, পৃথিবীর শেষ সবুজ আর শেষ নদীকে রক্ষা করার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করা হলেও। তার শরীর কাঁপছিল, কিন্তু মনের ভেতর আগুনের শিখার মতো এক দৃঢ় সংকল্প জ্বলে উঠেছিল। এই রাতেই সে নিজের জীবনকে অন্য এক পথে চালিত করার সিদ্ধান্ত নিল—যেখানে ভয় নেই, আছে কেবল সত্য প্রকাশের দায়িত্ব।
–
প্রফেসর শম্ভুনাথ ধীরে ধীরে অভ্রর দিকে তাকালেন, তাঁর চোখের গভীরে লুকিয়ে থাকা এক অদ্ভুত মিশ্রণ—অভিজ্ঞতার গম্ভীরতা, দীর্ঘদিনের লড়াইয়ের ক্লান্তি, আর তবুও হাল না ছাড়ার এক অনমনীয় জেদ। লণ্ঠনের ক্ষীণ আলোয় বসার ঘরের দেয়ালে তাঁর ছায়া বারবার বড়ো হয়ে উঠছিল, যেন প্রাচীন কোনো যোদ্ধার অবয়ব। তিনি ফিসফিস করে বললেন, “অভ্র, বহু বছর ধরে আমি এই ভিনগ্রহীদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করছি। বাইরের চোখে এরা যেন সাধারণ মানুষের ভিড়ে মিশে থাকে, কিন্তু এরা আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি ভাবনা, এমনকি আমাদের ভবিষ্যতেরও পথ নির্ধারণ করছে। তারা বাজারের ভেতরে এক গোপন নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র তৈরি করেছে, যেখান থেকে এই পুরো শহরের মানুষের চিন্তা ও আচরণকে সূক্ষ্মভাবে প্রভাবিত করা হয়।” অভ্র হতবাক হয়ে গেল, কিন্তু প্রফেসরের চোখে মিথ্যের কোনো আভাস সে পেল না। বরং দীর্ঘদিন ধরে লুকিয়ে রাখা এক গোপন পরিকল্পনা যেন অবশেষে সামনে আসছে। প্রফেসর টেবিলের ড্রয়ার খুলে পুরনো কাগজ, হাতে আঁকা মানচিত্র আর অদ্ভুত যন্ত্রপাতি বের করলেন। প্রতিটি কাগজে বাজারের ভেতরের নকশা, কোথায় কোন দোকানদারের ছদ্মবেশে আসল ভিনগ্রহী লুকিয়ে আছে তার চিহ্ন, আর মাঝখানে একটি ছোটো কিন্তু অতি শক্তিশালী শক্তিঘর—যেটি আসলে মানুষের মনে ঢুকে তাদের অচেতন সিদ্ধান্ত পর্যন্ত প্রভাবিত করতে পারে। অভ্র অনুভব করল, এ আর কোনো সাধারণ ষড়যন্ত্র নয়, এটা আসলে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা কেড়ে নেওয়ার এক নীরব যুদ্ধ।
প্রফেসর তখন ধীর গলায় বললেন, “এই নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র ধ্বংস করতে পারলেই এদের শক্তি ভেঙে পড়বে। কিন্তু ঝুঁকি ভয়ঙ্কর। নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রের চারপাশে এক বিশেষ ধরণের চৌম্বক বলয় আছে, যা কোনো মানুষ পার হলে তার স্মৃতি মুছে যায়। আমি একবার প্রায় ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলাম, কিন্তু শেষ মুহূর্তে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হই। তারপর থেকে আমি গোপনে যন্ত্রপাতি তৈরি করছি, যাতে ওই বলয়কে অকার্যকর করা যায়।” তিনি একটি ছোটো কালো বাক্স বের করলেন, যার ভেতর জটিল তার ও আলো জ্বলছিল। “এটা হলো ‘ডিস্টরশন মডিউল’। এটা কাজ করলে পাঁচ মিনিটের জন্য বলয় ভেঙে যাবে। কিন্তু এর ব্যবহার অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এর শক্তি ব্যবহারকারীকে ভেতর থেকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে।” অভ্র গভীর মনোযোগে শুনছিল, তার চোখে স্পষ্ট দৃঢ়তা ফুটে উঠল। সে জানে, এই মুহূর্তে দ্বিধা করলে শহর ধ্বংসের পথে যাবে, মানুষের স্বাধীনতা বিলীন হয়ে যাবে। তাই কোনো দ্বিধা না করেই সে বলল, “প্রফেসর, আমি আপনার সঙ্গে যাব। আমার জীবন যদি এই শহরের মানুষের মুক্তির জন্য কাজে লাগে, তবে সেটাই আমার কর্তব্য।” প্রফেসর অভ্রর দিকে তাকিয়ে নীরবে মাথা নাড়লেন, যেন বহু বছর ধরে যে উত্তর শোনার অপেক্ষায় ছিলেন, অবশেষে তা পেয়ে গেলেন।
এরপর রাত গভীর হলে প্রফেসর অভ্রকে নিয়ে তাঁর গোপন ল্যাবরেটরিতে গেলেন। ল্যাবটি শহরের বাইরে এক পুরনো গ্রন্থাগারের নীচে লুকিয়ে আছে, যেখানে শত শত পুরনো বইয়ের মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম, অর্ধসমাপ্ত যন্ত্র, ভাঙা কম্পিউটার চিপ, আর দেওয়ালে লাগানো রহস্যময় ছবিগুলো। অভ্র প্রথমবার বুঝল, এই মানুষটি আসলে একা হাতে কত বড়ো এক যুদ্ধে নেমেছেন। প্রফেসর তাকে দেখালেন কীভাবে ডিস্টরশন মডিউল সক্রিয় করতে হয়, কীভাবে বাজারের ভিতরের জটিল গলিঘুঁজির ফাঁদ এড়াতে হবে, আর কোন কোন দোকানদার আসলে ভিনগ্রহীদের গুপ্তচর। তারা ঘন্টার পর ঘন্টা মানচিত্রের ওপর ঝুঁকে পরিকল্পনা করল, প্রতিটি পদক্ষেপ নির্দিষ্ট করল, যেন কোনো দাবার খেলায় শেষ চালের প্রস্তুতি চলছে। প্রফেসর হঠাৎ থেমে বললেন, “অভ্র, মনে রেখো, আমার জন্য নয়, নিজের জন্য নয়, মানুষের ভবিষ্যতের জন্য লড়বে। যদি কোনো কারণে আমি সফল না হই, তবে তুমি চালিয়ে যাবে। আমি যতদিন বেঁচে আছি, ততদিন এরা জিততে পারবে না।” অভ্র তাঁর হাত শক্ত করে ধরল, তার মনে ভয় নেই, শুধু এক অদম্য সংকল্প। রাতের অন্ধকারে দু’জনের ছায়া ল্যাবরেটরির আলোয় মিশে গেল, আর তারা জানল—আগামী দিনই হতে চলেছে সবচেয়ে বড়ো যুদ্ধের সূচনা।
–
মীনাক্ষী সারা রাত জেগে ছিলেন, তাঁর মনের ভেতর চলছিল এক অদৃশ্য যুদ্ধ। জানালার ফাঁক দিয়ে আসা আলোয় ছায়ারা যেন তাঁকে প্রশ্ন করছিল—তুমি কি সত্যিই মুখ খুলবে? সত্য বললে শুধু তোমার নয়, আরও কতজনের প্রাণহানি হতে পারে। কিন্তু যদি চুপ থাকো, তবে অভ্রের জীবন বিপন্ন হবে, সেই অভ্র যার চোখে তিনি বারবার ভরসার দীপ্তি দেখেছেন। ভয় তাঁকে গ্রাস করছিল; মনের মধ্যে ভেসে উঠছিল নানা দৃশ্য—অন্ধকার করিডোর, শিকল বাঁধা কক্ষ, আর সেই গোপন দরজা যা লোকে কেবল কাহিনির মতো শুনেছে, কিন্তু তিনি জানেন বাস্তব। তাঁর হাতের কাছে সেই প্রাচীন চাবি, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তাঁদের পরিবারে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু এই গোপনীয়তা ফাঁস করলে প্রতিশোধ নিশ্চিত। তাঁর বুকের মধ্যে দোলাচল চলছিল—মৃত্যুর ভয় আর ন্যায়ের আহ্বান একে অপরের সঙ্গে লড়াই করছে। তিনি মনে পড়লেন, তাঁর মা একবার তাঁকে সতর্ক করেছিলেন, “এই চাবি কেবল তখনই কাজে লাগবে, যখন মানবিকতার চূড়ান্ত পরীক্ষা আসবে।” মীনাক্ষী ভাবলেন, হয়তো এই সময়ই সেই মুহূর্ত। কিন্তু ভয় তাঁর শিরা-উপশিরা আঁকড়ে ধরেছিল, বুকের ভেতর যেন বেজে চলছিল এক অশুভ ঢাক, আর মনে হচ্ছিল প্রতিটি শব্দই তাঁকে ভেঙে ফেলবে।
ভোরের আলোয় তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, ঝুঁকি না নিলে অভ্রকে আর বাঁচানো সম্ভব নয়। অভ্রকে গতকাল তিনি গোপনে দেখেছিলেন, তাঁর চোখে অসহায়তা, কিন্তু মুখে দৃঢ়তা—যেন তিনি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত, তবু সত্যকে বিকৃত করবেন না। এই দৃশ্য মীনাক্ষীর বুক চিরে গিয়েছিল। তিনি জানতেন, চাবি কেবল লোহার তালা নয়, বরং শত বছরের অন্ধকারকে ভাঙার পথ। কিন্তু একইসঙ্গে এটিই মৃত্যুর ফাঁদ ডেকে আনতে পারে। তিনি ধীরে ধীরে লুকোনো কুঠুরি থেকে ছোট্ট পিতলের বাক্সটা বের করলেন, যার ভেতরে ছিল সেই চাবি। স্পর্শ করতেই মনে হলো ধাতুর ভেতর জমে থাকা অতীতের গোপন ব্যথা তাঁর শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি চুপিচুপি ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলেন, প্রতিটি পদক্ষেপে মনে হচ্ছিল কেউ পেছনে অনুসরণ করছে। করিডোরের অন্ধকারে তাঁর নিঃশ্বাসের শব্দও ভারী লাগছিল। অবশেষে তিনি অভ্রর কক্ষের দিকে এগিয়ে গেলেন, যেখানে তাকে শিকল দিয়ে বাঁধা হয়েছে। অভ্র তাঁকে দেখে অবাক হলো না, বরং নীরব হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিল—সে জানত, একমাত্র মীনাক্ষীই তাঁকে মুক্তি দিতে পারে। তাঁর হাতে চাবি দেখে অভ্রর চোখে জল এসে গেল, কিন্তু মীনাক্ষী নিজের চোখের ভেতর আগুন ঢেকে রাখলেন। তিনি কাঁপা হাতে তালায় চাবি ঢুকিয়ে ঘুরালেন। শব্দ হলো—একটা ঠান্ডা লোহার শব্দ, যা যেন শত বছরের নিঃশব্দতার অবসান ঘটাল। তালা খুলে পড়তেই মীনাক্ষীর বুক ধুকপুক করতে লাগল, যেন অজানা ভাগ্যের দিকে এক বিশাল দরজা খুলে গেছে।
তালা খোলার পর সেই গোপন দরজা ধীরে ধীরে কেঁপে উঠল, ভেতর থেকে ঠান্ডা বাতাস বেরিয়ে এল—যেন ইতিহাসের কোনো দীর্ঘশ্বাস। অভ্র মুক্তির প্রথম নিশ্বাস নিলেও তার চোখে ছিল দুশ্চিন্তা—সে জানত, মীনাক্ষী এখন মৃত্যুর ফাঁদে পা দিলেন। চারদিকে নিস্তব্ধতা, তবু তাঁদের দুজনের মনে হচ্ছিল—প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি ছায়া সবকিছুই তাঁদের কাজ দেখে ফেলেছে। মীনাক্ষী অনুভব করলেন, তাঁর জীবন হয়তো এখন শেষের দিকে এগোচ্ছে, কিন্তু তিনি অন্তত মানবতার পাশে দাঁড়ালেন। অভ্র তাঁর হাত শক্ত করে ধরল, যেন জানাতে চাইছে—এই সাহস বৃথা যাবে না। গোপন দরজা আস্তে আস্তে উন্মুক্ত হলো, অন্ধকারের ভেতর থেকে অদ্ভুত আলো বেরিয়ে আসতে লাগল। দুজনেই জানত, এ পথই তাঁদের নতুন যাত্রার সূচনা। মীনাক্ষীর চোখে তখন আর ভয় ছিল না, ছিল কেবল দৃঢ়তা—যেন তিনি নিজের জীবনকে বাজি রেখেও ইতিহাসের বাঁধন ছিঁড়ে দিতে প্রস্তুত। তিনি জানতেন, এই পদক্ষেপ হয়তো তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করবে, কিন্তু সত্যকে জয়ী করবে। এই মুহূর্তে মীনাক্ষী আর দ্বিধায় ছিলেন না, বরং তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক অটল যোদ্ধা, যার একটিমাত্র উদ্দেশ্য—অভ্রকে বাঁচানো আর সেই অশুভ শক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানানো, যা এতদিন অন্ধকারের আড়ালে থেকে মানুষকে বশ করে রেখেছিল। তাঁর সাহসিকতায় সত্যের পথ খুলে গেল, আর অভ্রর চোখে ভেসে উঠল মুক্ত ভবিষ্যতের আলোর রেখা।
–
চাঁদের বাজারের গভীরে লুকিয়ে থাকা নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রটা যেন ছিল এক বিশাল অদৃশ্য হৃদয়, যেখান থেকে প্রতিটি আলোর প্রবাহ, প্রতিটি যান্ত্রিক নিঃশ্বাস ছড়িয়ে পড়ছিল। অভ্র, প্রফেসর শম্ভুনাথ আর মীনাক্ষী গোপন দরজা ভেদ করে যখন সেখানে পৌঁছাল, তখন তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠল এক অচেনা দৃশ্য—অসংখ্য স্বচ্ছ নল, যার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পৃথিবী থেকে আনা অক্সিজেন ও জল। কাচের ভেতর শিকড় ছড়িয়ে থাকা গাছের টুকরো, যেন শ্বাস নিতে লড়ছে। সেই প্রবাহের প্রতিটি কণা তুলে ধরা হচ্ছিল ভিনগ্রহীদের অদ্ভুত যন্ত্রে, আর সেখান থেকে আলোর তরঙ্গ ছুটে যাচ্ছিল আকাশের অজানা গন্তব্যে। অভ্রর মনে হলো, এ যেন এক নির্মম লুটের বাজার, যেখানে মানুষের শ্বাসকেই কিনে নেওয়া হচ্ছে। প্রফেসর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় জানতেন, এই নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র ধ্বংস করতে হলে তাদের সেই মূল কোর বা হৃদয়টিকে ভাঙতে হবে, যেটা শক্তি সরবরাহ করছে। কিন্তু সে কাজ সহজ নয়, কারণ পুরো জায়গা জুড়ে ছিল অদৃশ্য শক্তির প্রাচীর, আর প্রতিটি যন্ত্র পাহারা দিচ্ছিল ভিনগ্রহী সেনারা। অভ্রর বুক ধড়ফড় করছিল, তবু সে জানত এটাই তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। মীনাক্ষী সামনে এগিয়ে গেলেন, তাঁর চোখে তখন ভয় নয়, বরং এক অদ্ভুত দৃঢ়তা। তিনি ফিসফিস করে বললেন, “এটাই আমাদের শেষ সুযোগ।”
তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রফেসর যন্ত্রের মূল শক্তি তরঙ্গ ব্যাহত করার চেষ্টা করলেন, আর অভ্র ও মীনাক্ষী একসঙ্গে এগিয়ে গেলেন নিয়ন্ত্রণ কোরের দিকে। অরোরা আর রাহুল হঠাৎই আবির্ভূত হলো—চোখে অদ্ভুত আলো, শরীর জুড়ে ভিনগ্রহীদের শক্তি। অরোরার ঠান্ডা দৃষ্টিতে ভেসে উঠল ঘৃণা, তিনি বললেন, “তোমরা ভাবছো এই শিশুসুলভ বিদ্রোহে আমাদের থামানো যাবে?” রাহুল হেসে উঠল, তার হাসি যেন এক শূন্য গহ্বরের মতো শীতল। অভ্র বুক চিতিয়ে দাঁড়াল, তার হাতে কেবল একটি সাধারণ ধাতব দণ্ড, কিন্তু মনে হচ্ছিল সেই মুহূর্তে সেটাই পৃথিবীর শেষ প্রতিরক্ষা। লড়াই শুরু হলো—আলো ও ছায়ার, মানবিক দুর্বলতা ও ভিনগ্রহী শক্তির। যন্ত্রের শব্দ কেঁপে উঠল, মাটি কাঁপতে লাগল। অভ্র ঝাঁপিয়ে পড়ে কোরের সঙ্গে যুক্ত প্রধান পাইপগুলো ছিঁড়ে ফেলল, আর অক্সিজেনের প্রবাহ হঠাৎ ছিটকে বেরিয়ে এলো, যেন মুক্ত বাতাসের আর্তনাদ। অরোরা রাগে ঝাঁপিয়ে পড়লেও মীনাক্ষী তার পথ রোধ করলেন, নিজের শরীরকে ঢাল করে। এদিকে প্রফেসর একটি শেষ সংকেত পাঠালেন, যার ফলে কোরের ভেতর জমা শক্তি উল্টোদিকে বিস্ফোরিত হলো। মুহূর্তেই নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র কেঁপে উঠল, আলো নিভে গেল, আর এক প্রবল বিস্ফোরণে ভেঙে পড়ল সেই অদৃশ্য হৃদয়। অরোরা ও রাহুলের চেহারা এক মুহূর্তের জন্য বিকৃত হয়ে গেল, যেন তাদের আসল রূপ ধরা পড়ছে—তারপরই তারা হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল, যেন কখনো অস্তিত্বই ছিল না।
বিস্ফোরণের পর বাজারের কাচের গম্বুজে ফাটল ধরল, আলো নিভে গেল, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্ক আর ধোঁয়া। কিন্তু সেই ধোঁয়ার ভেতর মানুষরা প্রথমবার দেখল আসল সত্য—তাদের বেঁচে থাকার উপকরণগুলো কেবল লেনদেনের পণ্য নয়, বরং জীবনের মূল। ভিড় জমে গেল, আর অনেকের মুখে ভেসে উঠল অনুতাপ—এতদিন তারা টাকার বিনিময়ে কেনা অক্সিজেন বা জলের মূল্য বোঝেনি। এবার তারা উপলব্ধি করল, এক বিন্দু বাতাস বা এক ফোঁটা জল আসলে পৃথিবীর চেয়েও মহামূল্য। প্রফেসর নিঃশ্বাস নিতে নিতে বললেন, “এটাই আমাদের শিক্ষা—প্রকৃতির দান বিক্রির জিনিস নয়।” অভ্র জানালার ধ্বংসস্তূপ ঠেলে উঠে দাঁড়াল, সামনে তাকাল। চাঁদের নিস্তব্ধ আকাশে ধুলো উড়ছে, দূরে দেখা যাচ্ছে ক্ষয়িষ্ণু পৃথিবী—নীল নয়, কিন্তু এখনও টিকে আছে। তার বুকের ভেতর এক নতুন প্রতিজ্ঞা জন্ম নিল। সে মনে মনে বলল, আর কোনোদিন পৃথিবীর সবুজ হারাতে দেবে না। সেই সবুজের জন্য, সেই জলের জন্য সে জীবন বাজি রাখবে। বাজারের পতন কেবল ভিনগ্রহীদের ব্যর্থতা নয়, মানুষের চোখ খোলার দিনও বটে। শেষ দৃশ্যে অভ্র দাঁড়িয়ে রইল চাঁদের জানালার সামনে, চোখ ভরা আশা নিয়ে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে—যেন প্রতিজ্ঞা করছে, “আমি সবুজ ফিরিয়ে আনব।”
____