Bangla - প্রেমের গল্প

চাঁদের নিচে নিঃশব্দ শরীর

Spread the love

ঋতুপর্ণা দাশগুপ্ত


এক

ট্রেনের জানালা দিয়ে ভোরের আলো ঢুকে পড়েছিল দু’জনের নীরব কামনাভেজা মনোভারতিতে। শহরের ঘুমন্ত রাস্তাগুলো পেছনে ফেলে আদ্রিত ও ঋদ্ধিমা একটানা তাকিয়ে ছিল বাইরে, কুয়াশায় মোড়া মাঠ, তালগাছ, আর দূরের গ্রামের ঘরগুলোর দিকে। আদ্রিত জানালার ধারে বসে, চোখে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে, হালকা হাসি খেলিয়ে বলেছিল, “তুই জানিস, শহরের ভিড়ে আমরা যেটা খুঁজি, সেটা আসলে কোথাও বাইরের নয়—ভেতরের।” ঋদ্ধিমা তার পাশে হেলান দিয়ে চোখ বুজে ছিল, তার বুকের সঙ্গে ঠেকেছিল ব্যাগের চেইনে ঝুলে থাকা একটা ছোট্ট রুদ্রাক্ষ। সে কিছু বলেনি, শুধু আদ্রিতের হাত ধরে রেখেছিল নরমভাবে, যেন শব্দহীন বিশ্বাস। তাদের মধ্যে এমনিতেই বেশি কথা হয় না—একটা চাহনি, একটুখানি হাতের চাপ বা বাতাসের দুলে ওঠা চুলই বলে দেয় সবকিছু। আজকের দিনটা যেন অন্যরকম, অপ্রকাশ্য কিছু অপেক্ষা করছে সামনের সমুদ্রের ধারে। ট্রেনের ভিতরের কোলাহল, পাশের সিটে বসা ছেলেটির ফোনকল, কিংবা চা-ওয়ালার ডাক—সব কিছুই যেন দূরবর্তী ব্যাকগ্রাউন্ডে মিলিয়ে যাচ্ছিল। এই যাত্রা তাদের শরীরের নয়, আত্মার এক অচেনা সফর, যেখানে গন্তব্য ঠিকানা নয়—একটা অনুভব, একটা জোছনায় ভেজা নিঃশব্দ কামনা।

ট্রেন থেকে নেমে তারা পৌঁছেছিল সেই ছোট্ট সমুদ্র শহরে, যেটি পর্যটকদের চেনা নয়, যার নাম ছাপার পাতায় কম আসে। হোটেলটা বুক করা ছিল আগেই—একটা পুরোনো পর্তুগিজ ভিলার মতো, সাদা দেওয়াল, লাল টালির ছাদ, আর বারান্দা থেকে দেখা যায় সমুদ্র। ঘরে ঢুকে আদ্রিত জানালার পাশে দাঁড়িয়ে গুনগুন করছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত—“চাঁদের হাসি বৃষ্টি রাতে…”—যেন গলা নয়, বাতাসে মিশে থাকা ভালোবাসা। ঋদ্ধিমা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার চুল খুলে নিচ্ছিল ধীরে ধীরে। সে আজ শাড়ি পরেছিল—হালকা নীল রঙের, যার প্রতিটি ভাঁজ যেন জোছনার চুপিসারে হাত বুলানো। তারা কথা বলছিল না, কিন্তু দুজনেই জানত, এই নিঃশব্দতা সেই কামনার পূর্বলক্ষণ যা একসময় শরীর হয়ে উঠবে আত্মার কথা বলার ভাষা। দুপুরের খাবার পর তারা হেঁটে গিয়েছিল সমুদ্রতটে—খালি পা, বালির উষ্ণতায় শরীরের প্রতিটি স্নায়ু যেন জেগে উঠছিল। ছায়াগুলো লম্বা হয়ে যাচ্ছিল, আর তারা ধীরে ধীরে হাঁটছিল একে অপরের পাশে, মাঝে মাঝে শুধু হাত ছুঁয়ে দিচ্ছিল, যেন নিশ্চিত হতে চাইছিল—‘তুই আছিস তো পাশে?’ ওই সময়টা যেন এক দীর্ঘ প্রস্ততি ছিল রাত্রির, চাঁদের, আর সেই মূহূর্তের জন্য যা কেবল শরীর নয়, আত্মার নিবিড় মিলন।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে তারা ফিরে আসে ঘরে, জানালার পাশে বসে থাকে একসাথে—কফির কাপ হাতে, চোখে এক নিরব প্রশ্ন। “আজ রাতে যদি চাঁদ না ওঠে?” আদ্রিতের কণ্ঠ ছিল হালকা, অথচ তার ভেতরে অস্থিরতা। ঋদ্ধিমা হেসে বলেছিল, “আমরা তো ওকে ডেকেই এনেছি, তাই না?” এই নিঃশব্দ আত্মবিশ্বাসই তাদের সম্পর্কে বুনে দিয়েছে এমন এক গভীরতা, যা চেনা-অচেনা সব শব্দকে ছাড়িয়ে যায়। হোটেলের বারান্দা থেকে দেখা যায় জলে ভেসে থাকা রুপালি রেখা—সমুদ্র তখনও ছিল শান্ত, অথচ তার গর্জনের নিচে লুকিয়ে ছিল এক প্রবল কামনার ভাষা। তারা জানত, রাত যত গাঢ় হবে, এই কামনা তত বেশি নিঃশব্দ হয়ে উঠবে। সেই রাতে তারা খুব কম কথা বলেছিল, অথচ প্রতিটি চোখে চাওয়া, প্রতিটি নিঃশ্বাসে তারা একে অপরকে যতটা চিনেছিল, তা শব্দ দিয়ে বলা যায় না। বিছানায় শুয়ে তারা একে অপরের দিকে পিঠ দিয়ে শুয়ে ছিল, অথচ আঙুলগুলো একে অপরের আঙুলের ফাঁকে ঢুকে ছিল গভীরভাবে, নিঃশব্দে, এক অদ্ভুত প্রতিশ্রুতিতে—আজ রাতের শেষে হয়তো শরীর নয়, আত্মা বলে উঠবে—‘তুইই আমার চাঁদ।’

দুই

সকালটা শুরু হয়েছিল অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতায়—জানালার বাইরে সমুদ্রের নীল ছায়া, হালকা বাতাসে দুলে ওঠা নারকেল গাছ, আর দূর থেকে ভেসে আসা ঢেউয়ের একটানা গর্জন। ঘুম ভাঙার পর আদ্রিত অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল ঋদ্ধিমার দিকে—সে তখনো ঘুমন্ত, বুকের ওঠা-নামায় জেগে ছিল এক অজানা শান্তি, আর চুলের গন্ধে মিশে ছিল কফি আর জোছনার স্মৃতি। সে জানত, আজকের দিনটা অন্যরকম হবে। তারা কোনও রকম তাড়াহুড়ো ছাড়াই ধীরে ধীরে রেডি হয়েছিল, চুপচাপ সকালের নাশতা খেয়েছিল, আর তারপর নেমে এসেছিল সমুদ্রের দিকে—খালি পা, গায়ে হালকা সুতির পোশাক, চোখে সেই অভিমানী প্রশান্তি যা শরীর জানে কিন্তু মুখ বলে না। ঋদ্ধিমার চোখে সেদিন একটা অদ্ভুত আলো ছিল—তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন হাওয়ার শরীর হয়ে উঠেছে সে, স্পর্শে নয়, অনুভবে ধরা যায়। তারা খুব ধীরে হেঁটে গিয়েছিল জলরেখার কাছাকাছি, যেখানে তরঙ্গ এসে পায়ের আঙুল ছুঁয়ে আবার সরে যায়। আদ্রিত চুপ করে দাঁড়িয়ে ঋদ্ধিমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “জানিস, তোকে দেখলে আমার শব্দ ফুরিয়ে যায়।” ঋদ্ধিমা হেসে চেয়ে ছিল তার দিকে, তারপর এক পা এগিয়ে এসে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরেছিল আদ্রিতকে—হাওয়ার মতোই, যেন ছিল, আবার ছিল না।

সে আলিঙ্গন ছিল না কোনো চিরাচরিত আবেগে মোড়া, বরং এক নিঃশব্দ ভিজে অনুভব, যা শরীরের ভাষায় উচ্চারিত হয়নি কখনো, কিন্তু মন বোঝে। আদ্রিত অনুভব করেছিল ঋদ্ধিমার বুকের নরম গতি, তার চুলে জড়িয়ে থাকা নোনা বাতাস, আর তার ঠোঁটের পাশে থাকা কাঁপুনি—যেটা হয় শুধু তখন, যখন কেউ নিজেকে কারও কাছে সম্পূর্ণ খুলে দেয়, ভাঙতে ভয় পায় না আর। তারা কোনো কথা বলেনি, শুধু জড়িয়ে ছিল। তারপরে একটু সরে গিয়ে, ঋদ্ধিমা সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “আমাদের ভালোবাসা অনেকটা এই জলের মতো, তাই না? কাছে আসে, আবার ফিরে যায়, কিন্তু থেকে যায় প্রতিটা ছোঁয়ায়।” আদ্রিত চুপ করে তার হাত ধরেছিল, বুঝেছিল, সে ঠিক বলেছে। ভালোবাসা যদি শুধু স্থায়ী কিছু হতো, তাহলে তার গভীরতা থাকত না। এই আসা-যাওয়ার মাঝেই কামনা জন্ম নেয়, শরীর চায়, আত্মা জেগে ওঠে। সূর্যের আলো তখন আরও তীব্র, তাদের ছায়া বালিতে ছোট হয়ে এসেছে। কিন্তু সময় থেমে গেছে যেন। তারা বসেছিল পাশাপাশি, পাথরের ওপর, জলরেখার মুখোমুখি। আদ্রিত একটু পিছন থেকে ঋদ্ধিমার চুলে হাত রেখেছিল, তার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়েছিল ধীরে—শব্দ করেনি, কিন্তু নিঃশ্বাস ফেলেছিল খুব কাছে, এমনভাবে যাতে ছোঁয়া না দিয়েও ছুঁয়ে ফেলা যায়। সেই মুহূর্তে ঋদ্ধিমার শরীর হালকা কেঁপে উঠেছিল, কিন্তু সে সরে যায়নি।

বিকেল নেমে এলে তারা ফিরে এসেছিল হোটেলে, সূর্য তখন ধীরে ধীরে নিচে নামছে। ঘরের ভেতর আবছা আলো, বারান্দায় দাঁড়িয়ে দু’জনে একসাথে সিগারেট ধরিয়েছিল। ধোঁয়ার কুণ্ডলী বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছিল, আর সেই ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে তারা একে অপরের চোখে তাকিয়ে ছিল—চুপ করে, কিন্তু গভীরভাবে। আদ্রিত এক সময় বলেছিল, “আমরা কী করছি, জানি না—কিন্তু এটা জানি, তুই ছাড়া আমার এই সমুদ্র, এই হাওয়া, কিছুই মানে রাখে না।” ঋদ্ধিমা তখন নিজের ঠোঁটের কোণায় সিগারেটের ছাই ঝেড়ে বলেছিল, “আমি তোর ভেতরে এক অন্ধকার খুঁজি, যেটা আমার নিজের থেকেও বেশি চেনা।” এই কথাগুলো যেমন রহস্যে মোড়া ছিল, তেমনি সত্যও ছিল। তারা জানত, এই ভালোবাসা শরীর চায় ঠিকই, কিন্তু তারও ওপরে একটা গাঢ় নিঃশব্দতা, যেটা চাঁদের নিচে সত্য হয়। হাওয়ার শরীরে প্রথমবার তারা আলিঙ্গন করেছিল, কিন্তু সেই আলিঙ্গন কামনার মুখ নয়, আত্মার দরজায় প্রথম কড়া নাড়ার মতো। তারা জানত না—এই রাত কোথায় যাবে, কিন্তু এটা জানত, আজ শরীর নিঃশব্দ হবে, আর সেই নিঃশব্দতাই হবে সবচেয়ে স্পষ্ট ভাষা।

তিন

রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রতীর যেন এক নতুন রূপে ধরা দিল তাদের চোখে—দিনের আলোয় দেখা জলে এখন একটা গাঢ় নীল আচ্ছাদন, যেখানে ঢেউয়ের শব্দ আরও বেশি তীব্র, আর বাতাস আরও বেশি কাতর। আদ্রিত আর ঋদ্ধিমা তখন হোটেলের বারান্দায় পাশাপাশি বসে ছিল, হাতে কফির কাপ, চোখে এক দুরন্ত প্রতীক্ষার ছায়া। বারান্দা থেকে দেখা যায় দূরের সমুদ্ররেখা আর আকাশের মধ্যবর্তী একটা মোহময় সীমারেখা, যেখানে চাঁদ ধীরে ধীরে উঠবে—এই বিশ্বাসে তারা অপেক্ষা করছিল, একে অপরের অস্তিত্বের গভীরে ডুবে গিয়ে। হাওয়া ছিল আর্দ্র, গায়ে ছুঁয়ে দিলে মনে হচ্ছিল যেন কারও নিঃশ্বাস পড়ছে ঘাড়ের কাছে। ঋদ্ধিমা হঠাৎ চুপ করে বলেছিল, “চাঁদ উঠলে যদি সব প্রশ্ন মুছে যায়?” আদ্রিত তাকিয়ে ছিল তার দিকে, চোখে সেই পুরনো চাহনি, যেটা কোনো জবাব চায় না, শুধু অনুভব করে। তার কাঁধে মাথা রেখে ঋদ্ধিমা চোখ বন্ধ করেছিল, আর আদ্রিত তার আঙুল ছুঁয়ে বলেছিল, “তুই থাকলেই প্রশ্ন থাকে না।” সেই মুহূর্তে তারা জানত, জোছনা শুধু আলো নয়—এটা এক রকম ছায়া, যেখানে শরীর নিজেকে খুঁজে পায় আরও বেশি নগ্ন, আরও বেশি সত্য। তাদের প্রতীক্ষা ছিল শুধুই সেই জোছনার জন্য—যেখানে স্পর্শের আগে আত্মা কথা বলে।

সন্ধ্যার আলো কেটে গিয়ে রাত আরও গাঢ় হলে হোটেলের ঘরটা নরম হলুদ আলোয় ভরে উঠল, আর সমুদ্রের গর্জন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল চারপাশে। তারা ঘরের ভেতর এসে শুয়ে পড়েছিল পাশাপাশি, কেউ কারও গায়ে হাত রাখেনি, তবু নিঃশ্বাসের ওঠা-নামায় বুঝতে পারছিল, শরীর কথা বলছে নিঃশব্দে। বাইরে চাঁদের প্রথম আলো আকাশের এক কোণায় দেখা দিল, জানালার কাঁচে তার প্রতিফলন পড়ল ধীরে ধীরে। ঋদ্ধিমা উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল, তার নীল নাইটি বাতাসে দুলছিল, আর জোছনার আলোয় সে যেন রুপোর তৈরি এক জীবন্ত ভাস্কর্যের মতো দেখাচ্ছিল। আদ্রিত তাকিয়ে ছিল, নিঃশব্দে, যেন তাকানোটা কোনো কামনার অভিব্যক্তি নয়, বরং এক অজানা আশ্চর্যতা। সে উঠে গিয়ে পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরল না—শুধু ধীরে ধীরে তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “তুই জানিস, আলো যত সুন্দর হয়, ছায়াও তত গভীর হয়।” ঋদ্ধিমা হেসে বলল, “আর সেই ছায়ার ভিতরেই তো নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায়।” সেই রাতে তারা শুধু চাঁদের আলোয় নিজেদের ছায়া দেখতে চেয়েছিল, একে অপরের শরীরে নয়, আত্মায়।

রাত গভীর হতে থাকে, চাঁদ আকাশের মাঝখানে উঠে আসে—জলরেখায় তখন রুপালি রেখা নেমে এসেছে, ঢেউয়ের শব্দ আর জোছনার আলো মিলে এক ধরণের সংবেদন তৈরি করে, যা ভাষায় বলা যায় না। তারা আবার বারান্দায় আসে, আদ্রিত একটা পাতলা কম্বল গায়ে দেয় ঋদ্ধিমার, যেন চাঁদের ঠান্ডা স্পর্শ থেকে তাকে ঢেকে রাখে। তারা বসে থাকে পাশাপাশি, হঠাৎ একটা সিগারেট জ্বালায়, তার ধোঁয়া বাতাসে মিলিয়ে যায়। সিগারেটের আগুনের লাল টুকরোটা চাঁদের রুপালি আলোয় অদ্ভুত একটা বিরোধ তৈরি করে—যেখানে কামনার উষ্ণতা আর চাঁদের শীতলতা একে অপরকে ধাক্কা দেয়, আবার মিলে যায়। “আজ চাঁদের আলোতে শুধু তোকেই দেখতে চাই,” আদ্রিত বলে, আর ঋদ্ধিমা চোখ বন্ধ করে বলে, “তাহলে আমায় চোখ দিয়ে নয়, আত্মা দিয়ে দেখিস।” সেই নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞায় তারা জানে, আজকের রাত শারীরিক কোনো রোমাঞ্চ নয়—এ হল এক গভীর আত্মিক ভ্রমণ, যেখানে চাঁদের প্রতিটা আলো-ছায়া মিশে যাবে তাদের নিঃশ্বাসে। অপেক্ষা শেষ হয় না—কারণ তাদের প্রয়োজন চাঁদের আলো নয়, সেই নিরব জোছনার ভিতর একে অপরকে অনুভব করার জন্য একটু বেশি সময়।

চার

রাত তখন প্রায় এগারোটা ছুঁয়েছে। ঘড়ির কাঁটার চলাফেরা তারা ভুলেই গিয়েছিল, কারণ ঘর জুড়ে তখন কেবল একটাই সময় ছিল—চাঁদের। বাইরের বাতাস থেমে থেমে কাঁপছিল, জানালার ফাঁক দিয়ে আসা জোছনার কিরণ ঘরের মেঝেতে ছায়া ফেলছিল রুপোলি সুতোর মতো। ঋদ্ধিমা ধীরে ধীরে দরজা খুলে বাইরে বারান্দায় পা রাখল, যেন কোনো স্বপ্নের মধ্যে ঢুকছে নিঃশব্দে। তার পাতলা শাড়ির আঁচল বাতাসে দুলে উঠল, আর আদ্রিতের চোখে সেই মুহূর্তে সে হয়ে উঠল ঠিক যেন কোনো কবিতার প্রথম পঙক্তি—নির্বাক, নিঃসীম, অথচ তীব্র কামনার এক নিঃশব্দ প্রকাশ। আদ্রিত ধীরে ধীরে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল, কিন্তু কিছু বলল না। শুধু হাওয়ার শব্দে, জোছনার দীপ্তিতে, আর ঋদ্ধিমার ঘাড়ের কাছ থেকে ভেসে আসা শরীরের উষ্ণতায় সে বুঝে গেল, এই মুহূর্তটাই সেই—যেখানে স্পর্শের ভাষা প্রথম সত্য হয়ে ওঠে। তারা দু’জনেই জানত, এই রাতের শুরুতে আর কোনো আলোর দরকার নেই—চাঁদই যথেষ্ট, কারণ তার আলোয় আজ শরীর খুঁজে পাবে তার আত্মাকে।

তারা হেঁটে চলে এল হোটেলের পেছনের সরু পথ দিয়ে, যা গিয়ে মিশেছে সমুদ্রের বালিয়াড়িতে। রাতের সমুদ্র ছিল নিঃশব্দ, অথচ শব্দে পরিপূর্ণ—ঢেউয়ের ধ্বনি দূর থেকে এসে ধাক্কা খাচ্ছিল বালির গায়ে, আর সেই নরম বালি ছিল চাঁদের আলোয় রুপালি হয়ে ওঠা। তারা পা রাখছিল খুব ধীরে, যেন প্রতিটা পদক্ষেপে শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে মাটি, আর তাদের ছায়া জোছনায় লম্বা হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছিল জলে। ঋদ্ধিমা হঠাৎ থেমে গিয়ে পেছন ফিরে চাইল আদ্রিতের চোখে—চোখ দুটো কথা বলছিল এমনভাবে, যেন বলছে, “আমাকে আবিষ্কার কর, কিন্তু শব্দে নয়, অনুভবে।” আদ্রিত সেই দৃষ্টিকে অস্বীকার করতে পারল না। সে এগিয়ে গিয়ে ঋদ্ধিমার পাশে দাঁড়াল, তার মুখের খুব কাছে মুখ এনে বলল না কিছু—শুধু নিঃশ্বাস ফেলল। সেই নিঃশ্বাসে ভরে উঠল ঋদ্ধিমার গাল, তার কাঁধ, তার বুকের খাঁজ। মুহূর্তেই সে চোখ বন্ধ করল, যেন সেই নিঃশ্বাস ছিল কোনো কবিতা, যা তার শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে ঢুকে যাচ্ছে, ছুঁয়ে দিচ্ছে এমন সব জায়গা যা এতদিন নিজের কাছেই লুকোনো ছিল। তারা দু’জনেই জানত—কোনো শব্দ, কোনো স্পর্শ, কোনো চিৎকার নয়—এই নিঃশব্দতাই তাদের সবচেয়ে তীব্র কামনার উচ্চারণ।

আদ্রিত ধীরে ধীরে ঋদ্ধিমার আঙুল ধরল। সেই স্পর্শে ছিল না কোনো অধিকার, কোনো আকুতি—ছিল শুধু এক স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি। তারা বসে পড়ল বালিতে, চাঁদের আলোয় ধুয়ে যাওয়া নির্জনতায়। ঋদ্ধিমা পা মুড়ে বসেছিল, চাঁদের দিকে মুখ করে, আর আদ্রিত তার কাঁধে মাথা রেখে বলেছিল, “এই আলোয় তুই যেন আমারই একটা ছায়া।” ঋদ্ধিমা চোখ বুজে বলেছিল, “আর তুই আমার গভীরতা।” তারা একে অপরের দিকে ধীরে ধীরে ফিরে তাকাল, চাঁদের আলো ঠিক সেই সময় পড়ল ঋদ্ধিমার ঠোঁটে। আদ্রিত তার মুখের খুব কাছে এসে থেমে গেল, চুমু খেল না, ছুঁলো না, কিন্তু দু’জনের নিঃশ্বাস জড়িয়ে গেল এমনভাবে যে সময় থেমে গেল চারপাশে। তারপর হঠাৎই, শব্দহীনভাবে, ঋদ্ধিমা নিজেকে একটু এগিয়ে এনে চুমু দিল আদ্রিতের ঠোঁটে—কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই, কোনো নাটক ছাড়াই। সেই চুম্বন ছিল এক দীর্ঘ, গভীর, নিঃশব্দ কবিতা—যেখানে জোছনার আলো ছুঁয়ে গেল তাদের শরীর, কামনার উত্তাপ ছুঁয়ে গেল আত্মাকে। সেদিন রাতের প্রথম ছোঁয়ায় তারা আর একা থাকল না—তারা হয়ে উঠল এক শরীর, এক নিঃশ্বাস, এক আত্মার প্রতিচ্ছবি, ঠিক যেমন চাঁদ আর তার ছায়া সমুদ্রে গলে যায় প্রতিদিন, কোনো শব্দ না করে।

পাঁচ

রাত গভীর হয়ে উঠছিল। জোছনার আলো এখন আরও তীব্র, সমুদ্রের ঢেউ যেন তার স্পন্দনে আরও মৃদু, আরও ধ্বনিময় হয়ে উঠেছে। আদ্রিত ও ঋদ্ধিমা তখনো সমুদ্রতীরে, একে অপরের খুব কাছে বসে, নিঃশব্দে শ্বাস নিচ্ছে সমুদ্রের মতোই গভীর, ধীর, অথচ কামনাবিধুর। বাতাসে নোনা গন্ধ, ঢেউয়ের গর্জনের নিচে যেন এক অদ্ভুত সুর বাজছে—যা শুধু শরীর বোঝে, মন বোঝে না। ঋদ্ধিমার শাড়ির আঁচল ধীরে ধীরে পিছলে পড়ছিল কাঁধ থেকে, জোছনায় তার কাঁধ আর গলার রেখা যেন কোনো প্রাচীন মূর্তির মতো দীপ্তি ছড়াচ্ছিল। আদ্রিত তার চোখের দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বলল, “তুই জানিস না, তোকে দেখে কীভাবে আমি হারিয়ে যাই—নিজেকেই চিনতে পারি না আর।” ঋদ্ধিমা একটুও ভেঙে না পড়ে, ধীরে এগিয়ে এল আদ্রিতের গায়ের দিকে, তার মুখের সামনে ঠোঁট এনে থেমে গেল। তারা কেউ চুমু খেল না, কেউ কোনো কথা বলল না, শুধু নিঃশ্বাসের উত্তাপে শরীর থেমে গেল এক বিষণ্ন অভিপ্রায় নিয়ে—যা শুধু পূর্ণতা চায় না, চায় উন্মোচন।

ঋদ্ধিমা ধীরে ধীরে পায়ের আঙুলে বালি ছুঁয়ে বলল, “আমি নিজেকে তোকে দিতে চাই—কিন্তু শুধু শরীর দিয়ে না, চোখ দিয়ে, নিঃশ্বাস দিয়ে, আমার চুপ করে থাকা ভেতরটা দিয়ে।” আদ্রিত তখন এক পা এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রাখল, কোনো অধিকার নেই তাতে—ছিল শুধু ভয় মেশানো প্রেম। সে মাথা নিচু করে বলল, “আমিও তোকে পেতে চাই, কিন্তু ভাঙতে চাই না তোকে… তুই যে আমার অবচেতন কামনা।” ঋদ্ধিমা তখন নিজের আঙুল দিয়ে আদ্রিতের মুখ স্পর্শ করল—হালকা, কিন্তু গভীরভাবে। তারপর ধীরে ধীরে সে নিজের আঁচল খুলে ফেলল, যেন সেই পোশাক ছিল এক আবরণ যা আজ আর প্রয়োজন নেই। বাতাস থমকে গেল। তার নগ্ন পিঠ জোছনায় ভিজে উঠল, তার চোখে জল ছিল না, লজ্জাও ছিল না—ছিল এক অভিজ্ঞান, এক নিজেকে সম্পূর্ণভাবে কাউকে দেওয়ার সাহস। আদ্রিত বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল, তার সামনে এক নারী, এক প্রেমিকা, এক শরীর, এক আত্মা দাঁড়িয়ে আছে, পুরোপুরি উন্মোচিত, আর সেই মুহূর্তে তার ভিতরের কবি চুপ হয়ে গেল। সে তার কাছে গিয়ে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরল, শুধু কাঁধের ওপর ঠোঁট রাখল, যেন বলছে, “আমি তোর এই সাহসের কাছে মাথা নিচু করি।”

তারা তখন বালির ওপর বসে, ঋদ্ধিমার নগ্ন শরীর আদ্রিতের বুকের সাথে লেপ্টে আছে, দুই দেহের মাঝখানে শুধু উষ্ণ নিঃশ্বাস আর থেমে থেমে কেঁপে ওঠা আঙুল। কোনো তাড়াহুড়ো নেই, কোনো রোমাঞ্চ নেই, শুধু নিঃশব্দ এক উন্মোচনের সৌন্দর্য। আদ্রিত ধীরে ধীরে তার আঙুল দিয়ে ঋদ্ধিমার পিঠে আঁকতে থাকে অদৃশ্য কিছু—হয়তো কোনো নাম, কোনো অক্ষর, অথবা নিছক এক নিঃশব্দ কবিতা। ঋদ্ধিমা চোখ বন্ধ করে বলে, “তুই যখন আমাকে ছুঁস, তখন আমার শরীর আর আমার থাকে না।” আদ্রিত বলে, “তুই যখন নিজেকে খুলে দিস, তখন তোর শরীর আমার ঈশ্বর হয়ে যায়।” সমুদ্র তখন তাদের ঘিরে রেখেছে—নোনা বাতাস, চাঁদের আলো, আর শরীরের ঘ্রাণে এক নিঃশব্দ উপাসনা গড়ে উঠেছে। তারা আর কোনো চাহিদায় নেই, আর কোনো সমাজ, ভয়, শিষ্টাচার তাদের বেঁধে রাখে না—আজ তারা কেবল দেহ দিয়ে আত্মাকে স্পর্শ করে, আর সেই স্পর্শে মিলিয়ে যায় জোছনার নিচে, নোনতা বাতাসে, যেখানে শরীর নিজেই হয়ে ওঠে আত্মার সবচেয়ে পবিত্র প্রার্থনা।

ছয়

সমুদ্রতীরে রাতের নরম বাতাসে ভেসে আসছে লবণের গন্ধ। দূরে জোছনাভেজা জলের ওপর আলোর আভাস যেন দুজনের নিঃশব্দ ভালোবাসার নিদর্শন হয়ে উঠেছে। সেই নির্জনতা ও নিরবিচারে—চাঁদের আলো, ঢেউয়ের গুঞ্জন আর প্রেমিকের কাঁধে মাথা রাখা প্রেমিকার নিঃশ্বাস—মিলে সৃষ্টি করেছে এমন এক মুহূর্ত, যা ভাষার ঊর্ধ্বে। অতীত আর ভবিষ্যতের ভারহীনতায় তারা ডুবে আছে বর্তমানে, একে অপরের মধ্যে নিজস্ব ছায়া ও আলোকে খুঁজে নিচ্ছে। ওদের কেউ এখন আর একা নয়—প্রেমিক জানে, প্রেমিকার আঙুলগুলো যখন তার বুকে হালকা করে চলাচল করে, তখন সে আসলে নিজের আত্মাকে ছুঁয়ে ফেলেছে। প্রেমিকা জানে, এই পুরুষের চোখের মধ্যে তার সমস্ত অসহায়তা নিরাপদ, সমস্ত জোছনার মতোই কোমল, অথচ গভীর।

তারা কথা বলে না, শুধু ছুঁয়ে যায়। শরীরের পরতে পরতে যে অভিমানের ছায়া ছিল, তা গলে যায় লবণাক্ত বাতাসে। প্রেমিক তার ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় প্রেমিকার গলার একপাশে, যেখানে হৃদস্পন্দনের নরম ধাক্কা স্পষ্ট অনুভব করা যায়। প্রেমিকা নিজের বাহু দিয়ে ঘিরে ফেলে ওর মুখ—সেই মুহূর্তে ওদের আলাদা করে কিছু বোঝা যায় না। উষ্ণতা, কাঁপুনির টান, আর শরীরের সংবেদন মিলেমিশে যায় ঢেউয়ের অনুরণনে। যেন সমুদ্র নিজে ওদের শরীরের ভাষা বোঝে, বুঝে নেয় নিঃশব্দ কামনাগুলি, আর সেই অনুযায়ী ঢেউ তোলে—ধীরে, তারপর জোরে, আবার ধীরে। চাঁদ যেন একটু নিচে নেমে এসে জেগে থাকে ওদের ওপরে, নিরব অথচ সচেতন দর্শক হয়ে।

এই রাত তাদের কাছে আর শুধু যৌবনের উন্মাদনা নয়, বরং এক পরিণত সম্মতি, একে অপরের ভেতর মিশে যাবার এক অভাবনীয় প্রয়াস। প্রেমিকা ভাবে, এই ছেলেটিকে সে কতভাবে চেয়েছিল—কত স্বপ্নে, কত অসমাপ্ত কবিতায়। প্রেমিক ভাবে, এ মেয়েটির চোখে কতবার সে নিজের ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি খুঁজেছে। এ কোনো তাড়াহুড়োর কামনা নয়—এ এক অবিচল, আশ্রয় খোঁজার তৃষ্ণা। আর সেই তৃষ্ণা তৃপ্ত হয় সেই মুহূর্তে, যখন প্রেমিকা তার সমস্ত নির্ভরতায় প্রেমিকের বুকে মাথা রাখে। তারা দুজনেই জানে, এই চাঁদের নিচে, এই নিঃশব্দ শরীরের পরস্পরের ভিতরে মিশে যাওয়ার অভিজ্ঞতা—তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতা হয়ে থাকবে, চিরকাল।

সাত

জোছনাভেজা সে রাতটি যেন আরও বেশি নিঃশব্দ হয়ে নেমে এল তাদের মাথার উপর। সমুদ্রের গর্জনও যেন নরম হয়ে এসেছে, যেন গোপনে তাদের একান্ত মুহূর্তের সাক্ষী হতে চায় সে। রুদ্রর চোখে এক অপার বিস্ময়, তার পাশে বসে থাকা মেয়েটির মুখে খেলা করে একধরনের গাঢ় প্রশান্তি। সায়ার গাল ছুঁয়ে থাকা চুলগুলো বাতাসে নড়ছে ধীরে ধীরে, আর রুদ্রর আঙুল সেখানে স্পর্শ রাখতেই থেমে যায় যেন সময়। তারা একে অপরকে স্পর্শ করে কথা না বলে, শরীর দিয়ে অনুভব করতে থাকে—ভাষাহীন যে যোগাযোগ তার গভীরতা ভাষাকে হার মানায়। রুদ্রর হাত বেয়ে সায়ার পিঠ বেয়ে নামতে নামতে থেমে যায় তার বুকের কাছাকাছি, হৃদস্পন্দনের কণ্ঠ যেন শোনার চেষ্টা করে সে। চোখে চোখ রেখে, তারা পড়ে ফেলে একে অপরের বুকের ভিতরের পৃষ্ঠা—যেখানে লেখা রয়েছে শুধু একটাই শব্দ: “আমি”।

সমুদ্রের হাওয়ায় কাঁপে তাদের গা, কাঁপে তাদের চেতনার রেখা। দু’জনেই অনুভব করে শরীরের অতীত কিছু, এমন এক সংযোগ যা তারা আগে বুঝতে পারেনি। রুদ্রর কাঁধে মাথা রাখে সায়া, আর চাঁদের আলো এসে তাদের গায়ে ঢেলে দেয় একধরনের নিঃশব্দ উষ্ণতা। তারা আর আলাদা কেউ থাকে না, তারা হয়ে ওঠে এক নিঃশব্দ ভাষা, এক চেতনার নিরবসাদ কাব্য। এই রাতটা যেন তাঁদের শরীরের বাইরের কিছু নয়, বরং শরীরের অন্তর্গত আত্মা, কামনার সমস্ত অভিজ্ঞানকে ঘিরে। ঠোঁটের মাঝে থেমে থাকা নিঃশ্বাসেরা মিলিয়ে যায় সমুদ্রের ঢেউয়ে, স্পর্শের পরস্পরতা যেন ধীরে ধীরে বিলীন করে দেয় রাত ও দিনের প্রাচীর। তারা হারায় না, বরং খুঁজে পায় নিজেদের এক অজানা ভোরের অপেক্ষায়।

শেষরাতের বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে আসে, কিন্তু তাঁদের শরীরের ভিতর উষ্ণতা বাড়তে থাকে ক্রমাগত। তারা কোনো কথাই বলে না, কারণ শরীরের ভাষাই এখানে যথেষ্ট। সায়া রুদ্রর বুকে হাত রাখে, অনুভব করে হৃদয়ের ছন্দ—যেটা আজ তার নিজের বলেই মনে হয়। রুদ্র চুমু রাখে সায়ার কপালে, তার চোখে—যেন বুঝিয়ে দেয়, ভালোবাসা শুধু যৌনতার ছায়া নয়, বরং আত্মিক এক ঋতু যা শরীরের ভাষা দিয়েই প্রকাশ পায়। সমুদ্র ততক্ষণে বিদায় নিচ্ছে তাদের পায়ের কাছ থেকে, জোয়ারের জল ধীরে ধীরে ফিরে যাচ্ছে সাগরের গভীরে। কিন্তু তাঁদের মধ্যে যে তরঙ্গ উঠেছে, তা কোথাও যাবে না—সেটা রয়ে যাবে চিরকাল, তাঁদের শরীর আর আত্মার জ্যোৎস্নায়।

আট

রাত তখন তার সমস্ত পরিপক্বতা নিয়ে নেমে এসেছে সমুদ্রতটে। চাঁদ এখন ঠিক মাথার উপর, আকাশের নিখুঁত কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে রয়েছে, আর তার আলো নেমে এসেছে দু’টি নগ্ন শরীরের উপর, যাদের নিঃশ্বাস এখন আর আলাদা নয়—তারা একে অপরের শ্বাসে শ্বাস মিলিয়ে তৈরি করেছে এক অভিন্ন ছন্দ, এক অনুচ্চারিত সংগীত। আদ্রিত আর ঋদ্ধিমা সমুদ্রের বালিয়াড়িতে পাশাপাশি শুয়ে, একে অপরকে চোখে চোখ রেখে দেখছে, যেন প্রতিটি দৃষ্টি তাদের আরও কাছাকাছি টেনে আনছে, শরীরের গভীর থেকে আত্মার গভীরে। কোনোরকম স্পর্শ ছাড়াও তাদের মধ্যে স্পর্শের এক নিরব আলোড়ন চলছে—প্রেমের এমন এক অধ্যায়, যেখানে ভাষার আর প্রয়োজন নেই, চাহনিই যথেষ্ট। আদ্রিত ঋদ্ধিমার মুখে হাত রাখে না, বরং তার চোখে ছুঁয়ে যায় নিজের নিঃশব্দ আত্মার উত্তাপ দিয়ে। তারা বোঝে—কামনা এখানে শরীরের উপরে নয়, বরং তার গভীরতম স্তরে জন্ম নেওয়া এক প্রেমের প্রতিধ্বনি।

বাতাস এখন আর শুধু সমুদ্রের নয়—এখন তার মধ্যে মিশে গেছে দু’টি দেহের নিঃশ্বাস, ঘাম, জোছনা, আর গভীরতর ভালোবাসার ঘ্রাণ। আদ্রিত ধীরে ধীরে ঋদ্ধিমার চিবুকের কাছে মুখ নিয়ে এসে থেমে যায়। চুম্বন করে না, কারণ আজ চুম্বন অর্থহীন। সে শুধু শোনে তার শ্বাসপ্রশ্বাস, অনুভব করে তার কাঁপুনি, আর বুঝতে চায়, একজন মানুষ কতখানি নিজেকে খুলে দিতে পারে আরেকজনের কাছে। ঋদ্ধিমা মুখ ঘুরিয়ে তার কানের কাছে বলে, “আমার শরীর আজ গান গাইছে, শুনতে পারছিস?” আদ্রিত হেসে বলে, “হ্যাঁ, নিঃশব্দ গান, যেটা শুধু আমরাই শুনতে পারি।” তারা মিলিত হয় আবার, শরীর দিয়ে নয়, আত্মার প্রবাহে—যেখানে স্পর্শ নেই, আছে অনুভব; যেখানে শব্দ নেই, আছে সুর; যেখানে আলিঙ্গন নেই, আছে নিরব আশ্রয়।

রাতের শেষ প্রান্তে এসে তারা কেবল শরীর নয়, পরস্পরের অন্তরাত্মা হয়ে গেছে। চাঁদের আলো এখন তাদের গায়ে পড়ছে আরও ধীরে, যেন রাত তাদের ছেড়ে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো জড়িয়ে ধরতে চায়। সমুদ্র দূর থেকে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকে, কারণ সে এমন নিঃশব্দ আত্মসমর্পণের সৌন্দর্য আগে কখনো দেখেনি। বালিতে তাদের দেহের রেখা যেন কবিতার পঙ্‌ক্তির মতো ছাপ রেখে যায়, আর সেই ছাপেই লেখা হয়ে যায় এক অমর প্রেম—যার বর্ণনা নেই, ব্যাখ্যা নেই, কেবল অনুভূতির রেশ। আদ্রিত ঋদ্ধিমার কপালে একটা চুমু রাখে শেষবারের মতো, বলার কিছু ছিল না, চাওয়ারও কিছু নেই—তারা সব পেয়েছে এই রাতের নিঃশব্দ গানেই, চাঁদের নিচে, শরীরের ভাষায় লেখা এক অদৃশ্য কবিতায়।

নয়

জোছনার গভীরতায় ডুবে থাকা সেই সমুদ্রতীরের রাত আর এক অন্য রকম হয়ে উঠল যখন তারা দুজন – অনির্বাণ আর মেঘলা – নিজেদের শরীরের বাইরে এক ধরনের স্বপ্নে প্রবেশ করল, যেখানে স্পর্শ, নিঃশ্বাস, আর ত্বকের উত্তাপ সব মিলেমিশে এক অলীক বাস্তবতা তৈরি করছিল। জোয়ারের গর্জন যেন মেঘলার হঠাৎ উত্তাল নিঃশ্বাসে মিলিয়ে গিয়েছিল, আর সেই গর্জনের মাঝখানে অনির্বাণের ঠোঁট খুঁজে নিচ্ছিল এমন এক ভাষা, যা শব্দে প্রকাশযোগ্য নয়—শুধু অনুভবে, শুধুই আত্মার নিভৃত প্রান্তে। তাদের শরীর আর মনের সীমারেখা ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছিল; আঙুলের ছোঁয়া ছিল একেকটা কবিতা, চোখে চোখ রাখা ছিল দীর্ঘ অন্ধকার চুম্বনের প্রতিশ্রুতি। তারা বসে ছিল একমনে, নির্জন বালুর ওপর, আর প্রকৃতি যেন চুপচাপ সেই প্রেমের গীত রচনা করছিল বাতাসে, জলের ঢেউয়ে আর মেঘলার চুলের সুরভিতে।

তাদের কথোপকথন সেই রাতে আর ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। জোছনায় কেবল শরীর নয়, উন্মোচিত হচ্ছিল আত্মাও। অনির্বাণ যখন মেঘলার কাঁধে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছিল, তখন সে বুঝতে পারছিল এই মুহূর্ত কেবল কামনার নয়—এটা তার অস্তিত্বের গভীর টানাপোড়েনের সমাধান। মেঘলার চোখে জলের মত এক উজ্জ্বল বিশ্বাস দেখা যাচ্ছিল—যেন সে বুঝে ফেলেছে, এই পুরুষ তাকে শুধুমাত্র ভালোবাসে না, তাকে উপলব্ধিও করে। দুই শরীর যখন চুপিচুপি একে অপরের ছায়া হয়ে যায়, তখন কামনা এক অন্তর্মুখী সৌন্দর্যে রূপ নেয়—তারা আর শুধুই প্রেমিক-প্রেমিকা নয়, তারা তখন একে অপরের জীবনের সবচেয়ে নিঃশব্দ কবিতার পংক্তি। সেই মুহূর্তে, সমুদ্রের ঢেউয়ের নিচে তারা শুনতে পাচ্ছিল নিজেদের হৃদস্পন্দনের অনুরণন, যা সময়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে চিরন্তন হয়ে উঠছিল।

রাত তখন শেষ প্রহরে পা দিচ্ছে। আকাশে জ্যোৎস্না আরও ধূসর, আর ঠান্ডা বাতাস ধীরে ধীরে স্পর্শ করে যাচ্ছে তাদের ঘামমাখা ত্বক। কিন্তু তবু তারা আলাদা হচ্ছিল না, যেন এই নিবিড় মুহূর্ত শেষ হলে আবার হারিয়ে যাবে সব কিছু। মেঘলা তখন অনির্বাণের বুকে মুখ গুঁজে কাঁপছিল, আর অনির্বাণ তার কপালে আলতো করে হাত রেখে বলছিল, “তুই আছিস, মানে আমি আছি।” মেঘলা জানত, এই ভালোবাসা হয়তো সমাজের চোখে চুপ করে থাকবে, কিন্তু সমুদ্র, আকাশ, আর রাত এই মিলনকে সাক্ষী রাখবে। তারা জানত না পরের দিন কী হবে, কিন্তু তারা জানত—এই মুহূর্ত, এই নিঃশব্দ আত্মার মিলন, চিরকাল তাদের মধ্যে বেঁচে থাকবে, চাঁদের নিচে এক নিঃশব্দ শরীর হয়ে।

দশ

অবশেষে রাতের ঘন আঁধারে, চাঁদের নিঃশব্দ আলোয়, তারা দুজনে বসে ছিল সমুদ্রতীরে—ভেজা বালির বুকে পা ছড়িয়ে, নিঃশব্দে শুনছিলো ঢেউয়ের সুর। দীর্ঘ পথ পেরিয়ে, শরীরের প্রতিটি আলিঙ্গন, প্রতিটি নিঃশ্বাস, একে অপরকে তারা এতটাই চিনেছে যে আর কোনও কথা প্রয়োজন হচ্ছিল না। দীপ্তর কাঁধে মাথা রেখে নীলাদ্রি বলল, “জানি না এই মুহূর্তটা আবার আসবে কিনা… কিন্তু এখন যা অনুভব করছি, তা যেন চিরকালের মতো রেখে দিতে পারি।” দীপ্ত তার ঠোঁটে একটি মৃদু চুম্বন ছুঁয়ে দিয়ে বলল, “আমাদের ভালোবাসা কোনো কালের নয়, কোনও শর্তের নয়—এই সমুদ্রের মতোই বিশাল, নিরবধি।” তারা দুজনেই জানতো, বাস্তবের ভোর আসবেই, কিন্তু জোছনার নিচে এই নিঃশব্দ শরীরের ভাষা, এই একান্ত অনুভব, একে অপরের আত্মায় গেঁথে যাবে।

সমুদ্রের ঢেউ এবার একটু জোরে আছড়ে পড়ছিল, যেন শেষবারের মতো তাদের ভালোবাসার সাক্ষী হতে চাইছে। রাত গড়িয়ে যাচ্ছে, নীলাদ্রির চোখে জল, সে জানে, এই সফরের শেষে তাদের অপেক্ষা করছে আলাদা আলাদা জীবন। কিন্তু একটুও অনুশোচনা ছিল না তাদের মধ্যে। যতটুকু সময় তারা পেয়েছে, সেটুকুই ছিল নিঃসন্দেহে পূর্ণতা। তারা একে অপরের শরীরে, স্পর্শে, আদরে যে প্রশান্তি পেয়েছে, তা আর কোনও কিছুতে পাওয়া সম্ভব নয়। দীপ্ত বলল, “তুই তো জানিস, সমাজের চোখে আমরা অপরাধী হতে পারি, কিন্তু তোর চোখে আমি শুধু দীপ্ত—তোর প্রেমিক, তোর কামনা, তোর প্রশান্তি।” নীলাদ্রি বলল, “আমাদের ভালোবাসা যদি পাপ হয়, তবে আমি সেই পাপ বারবার করতে চাই।” জোছনা তখন ঠিক মাথার ওপরে, তাদের আলিঙ্গন তখন নিঃশব্দ, গভীর, জাগতিক সব নিয়ম-নীতির ঊর্ধ্বে।

একসময় তারা উঠে দাঁড়ায়, শেষবারের মতো জলের দিকে চেয়ে থাকে। সেই চেনা ঢেউ, সেই পরিচিত বাতাস, সব কিছু আজ অন্যরকম লাগছে। যেন সমুদ্রও তাদের এই শেষ রাতের সাক্ষী হয়ে রয়ে যেতে চায়। নীলাদ্রির হাত ধরে দীপ্ত বলল, “যে মুহূর্তগুলো আমরা ভাগ করে নিলাম, তা কোনওদিন ফিকে হবে না।” তারা ধীরে ধীরে ফিরে চলল, পেছনে পড়ে রইল চাঁদের নিচে তাদের নিঃশব্দ শরীর, অভিসারের স্মৃতি, ভালোবাসার নিঃশব্দ স্পন্দন। এই রাতটা যেন চিরন্তন হয়ে থাকল, তাদের জন্য, শুধু তাদের জন্য।

(সমাপ্ত)

 

 

 

1000046682.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *