Bangla - প্রেমের গল্প

চাঁদের আলোর ঘর

Spread the love

অনন্যা দত্ত


কলকাতার ভিড়ভাট্টা, ট্রাফিকের হর্ন, অফিসের শেষ না হওয়া মিটিং আর সময়ের পেছনে দৌড়তে থাকা জীবন—এই সব মিলিয়ে সৌভিক ও অভিসারিকার সংসার যেন এক অদৃশ্য যান্ত্রিক চক্রে আটকে গেছে। সৌভিক সকালেই বেরিয়ে যায়, অফিসের নথি, ক্লায়েন্ট কল আর প্রেজেন্টেশনের মধ্যে ডুবে থাকে, ফেরে রাত অবধি; তখন ক্লান্ত মুখে একমুঠো হাসি দেওয়ার শক্তিও থাকে না তার। অভিসারিকা, একসময় যার দিন কাটত রঙতুলি আর ক্যানভাসের মাঝে, এখন নিজের শিল্পকর্মের থেকে অনেকটাই দূরে সরে গেছে। স্কুলে আঁকা শেখানোর ফাঁকে ফাঁকে মন চলে যায় বহু বছর আগের সেই দিনগুলিতে—যখন সৌভিক হঠাৎ সন্ধ্যায় এসে তার জানালার নিচে দাঁড়িয়ে ডাক দিত, কিংবা রঙিন চিঠি লিখে দিত অফিসের ফাঁকে। এখন তারা একই ছাদের তলায় থাকে বটে, কিন্তু কথোপকথন সীমাবদ্ধ থাকে রান্নার মেনু, ইলেকট্রিক বিল, কিংবা ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পর্যন্ত। অভিসারিকা মাঝে মাঝে খেয়াল করে, সৌভিক আর তার চোখে সেভাবে তাকায় না; একসময় যে দৃষ্টি তাকে কাঁপিয়ে দিত, এখন তা অনুপস্থিত। সন্ধ্যার পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা হাতে সমুদ্রের বাতাসের মতো হালকা কোনো কথা বলার সুযোগ খোঁজে সে, কিন্তু কথাগুলো এসে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়—যেন দু’জনের মাঝখানে এক অনুচ্চারিত দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে।

এই একঘেয়েমির মধ্যে একদিন, বৃহস্পতিবার বিকেলে, সৌভিক হঠাৎ ঘরে ফিরে আসে একটু আগেই। অভিসারিকা অবাক হয়ে তাকায়—বছরে এক-দুই দিনই সে এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে। সৌভিকের চোখে তখন অদ্ভুত এক ঝিলিক, যা অনেকদিন পরে সে দেখল। ব্যাগ নামিয়ে, টাই খুলে সোফায় বসেই সৌভিক বলল, “অভি, আমরা উইকএন্ডে বাইরে যাব। শহর ছেড়ে, কাজের ঝামেলা ছেড়ে, শুধু আমরা দু’জন।” অভিসারিকা প্রথমে ভেবেছিল, হয়তো কাছাকাছি কোথাও, কিন্তু সৌভিক মোবাইল বের করে বুকিং কনফার্মেশন দেখাল—সমুদ্রতটে এক গোপন রিসোর্ট, নাম “চাঁদের আলোর ঘর”। নামটা শুনেই অভিসারিকার মনে কেমন যেন দোলা লাগল—কবিতার মতো, স্বপ্নের মতো, অথচ অপরিচিত। সে প্রশ্ন করল, “এখানকার কথা তুমি জানলে কেমন করে?” সৌভিক শুধু হেসে বলল, “এক পুরনো বন্ধুর কাছ থেকে শুনেছি, যারা এখানে যায় তারা নাকি নতুন করে একে অপরকে চিনে ফিরে আসে।” অভিসারিকার বুকের ভেতর তখন মৃদু শিহরণ—এ কি শুধু একটা বেড়ানো, নাকি কিছু ফিরিয়ে আনার চেষ্টা?

সেই রাতে অভিসারিকা শোবার ঘরের জানালা দিয়ে শহরের আলো দেখছিল, অথচ মনে হচ্ছিল সেই আলো একেবারেই পৌঁছাচ্ছে না তার ভেতরে জমে থাকা অন্ধকারে। সৌভিক পাশে শুয়ে ছিল, মোবাইলে কিছু দেখছিল চুপচাপ, কিন্তু তার হাত হঠাৎ এসে স্পর্শ করল অভিসারিকার হাত। বহুদিন পর সেই স্পর্শে উষ্ণতা আর একটুখানি অস্থিরতা ফিরল। “চাঁদের আলোর ঘর”—নামটা ঘুরেফিরে বারবার মনে আসছিল তার, যেন সেই জায়গাটা শুধুই কোনো রিসোর্ট নয়, বরং এক অব্যক্ত প্রতিশ্রুতি, যা হয়তো তাদের সম্পর্কের হারানো রঙ ফিরিয়ে দেবে। শহরের গরম, ভিড়, শব্দ সব মিলিয়ে তাদের জীবন ধূসর হয়ে গিয়েছিল; অভিসারিকা ভাবছিল, হয়তো সেই সমুদ্রের ধারে, চাঁদের আলোয় ভেজা কোনো নীরব রাতেই তারা খুঁজে পাবে পুরনো দিনের হাসি, সেই প্রথম দিনের আবেগ, আর সেই চোখে চোখ রাখার সাহস, যা বহু বছর ধরে হারিয়ে গেছে। তার অজান্তেই মনে হলো, এই যাত্রা শুধু সমুদ্রের দিকে নয়—বরং নিজেদের ভেতরের দিকে ফেরার এক দীর্ঘ পথচলা হতে চলেছে।

শুক্রবার ভোরে ঘুম ভাঙতেই জানলার বাইরের আকাশ এখনও হালকা ধূসর, শহরের কোলাহল এখনও পুরোপুরি জেগে ওঠেনি। কিন্তু অভিসারিকার বুকের ভেতর ইতিমধ্যেই হালকা কাঁপুনি শুরু হয়েছে—এক অদ্ভুত প্রত্যাশা আর অজানা আশঙ্কা মিলেমিশে। ট্রেনে ওঠার সময় সৌভিকের চোখে সেই চেনা গম্ভীরতা, তবে তার ভেতরে কি চলেছে সেটা বোঝা কঠিন। সিটে বসে জানলার বাইরে শহরের ধীরে ধীরে পেছনে সরে যাওয়া দৃশ্য দেখছিল অভিসারিকা—রাস্তার ধারের চা দোকান, বাসস্টপে অপেক্ষমাণ মানুষ, রঙিন পোস্টার, সবকিছুই যেন আজ আলাদা লাগছিল। ট্রেনের ছন্দময় ঝাঁকুনির মাঝে মাঝে তারা দু’জন কিছু কথা বলছে—পথের ধারের গাছপালা দেখে হঠাৎই সৌভিক বলে উঠছে, “মনে আছে, কলেজের সময় একবার ঠিক এমন ভোরে ট্রেনে চেপে পুরী গিয়েছিলাম?” অভিসারিকা হাসছে, কিন্তু সেই হাসির ভেতরে লুকিয়ে আছে কিছুটা দ্বিধা—পুরনো স্মৃতি মনে পড়ছে ঠিকই, কিন্তু তাদের এখনকার সম্পর্কের দূরত্ব সেই স্মৃতিকে পুরোপুরি উজ্জ্বল হতে দিচ্ছে না। অথচ মাঝে মাঝে সৌভিকের চোখে এমন এক দৃষ্টি ধরা পড়ছে, যা অনেকদিন পর অভিসারিকার মনকে নাড়িয়ে দিচ্ছে।

দুপুর নাগাদ তারা স্টেশনে নেমে ভাড়া করা গাড়িতে চেপে বসল। রাস্তাটা সরু, দুইপাশে অচেনা গাছের সারি, কোথাও কোথাও ধানক্ষেতের ফাঁকে ছোট নদীর ধারা বয়ে যাচ্ছে। জানালা দিয়ে সমুদ্রের গন্ধ আসতে শুরু করতেই অভিসারিকার বুকের ভেতর হালকা কাঁপুনি—ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে সমুদ্র দেখার প্রথম অভিজ্ঞতা মনে পড়ে গেল। কিন্তু আজকার এই যাত্রা অন্যরকম, কারণ আজ সে যাচ্ছে সৌভিকের সঙ্গে, এবং তাদের গন্তব্য কেবল পর্যটকদের ভিড়ভাট্টা নয়, বরং এক রহস্যময় রিসোর্ট, যা নাকি মানুষকে বদলে দেয়। গাড়ির ভেতরে অদ্ভুত নীরবতা—সৌভিক মাঝে মাঝে মোবাইলে তাকাচ্ছে, কখনও দূরের দিকে চেয়ে আছে, যেন কিছু ভাবছে গভীরভাবে। অভিসারিকা খেয়াল করছিল, আগের মতো সে আর একটানা গল্প করছে না, হালকা খুনসুটি করছে না; বরং এক ধরণের সংযম নিয়ে চলেছে। এই অস্বাভাবিক চুপচাপ ভাবটা অভিসারিকার মনে প্রশ্ন জাগাল—এ কি শুধু ক্লান্তি, নাকি এই যাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কোনো অপ্রকাশিত অনুভূতি?

বিকেলের শেষ আলোয় তারা পৌঁছাল সেই নির্জন সমুদ্রতটে। শহরের ভিড় থেকে হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে এখানে যেন এক অন্য জগতে পা দিল তারা। সামনে অসীম নীল জলরাশি, দূরে সাদা ঢেউয়ের গর্জন, মাথার ওপর খোলা আকাশে সোনালি রোদ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। পায়ের নিচে নরম বালি, বাতাসে লবণাক্ত গন্ধ—সব মিলিয়ে এক ধরণের স্বপ্নময় পরিবেশ তৈরি হয়েছে। গাড়ি থামতেই অভিসারিকা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে শুধু ঢেউয়ের শব্দ শুনতে লাগল, যেন সেই আওয়াজ তার বুকের ভেতর জমে থাকা সব দ্বিধা ধুয়ে মুছে দিচ্ছে। সৌভিক কিছু বলল না, শুধু হালকা হাসি দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল, এবং অভিসারিকা সেই হাত ধরল—বহুদিন পর এই স্পর্শে উষ্ণতা ফিরে এলো। তারা দু’জন ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল সমুদ্রের ধারে দাঁড়ানো কাঠের তৈরি সেই রিসোর্টের দিকে, যার নাম “চাঁদের আলোর ঘর”—এখনও যা তাদের কাছে এক অজানা রহস্য, কিন্তু যার চৌকাঠ পেরোতেই হয়তো শুরু হবে তাদের জীবনের নতুন অধ্যায়।

সূর্য ডুবে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রতটের আলো যেন একেবারে বদলে গেল। পশ্চিম আকাশে রঙিন আভা মিলিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল নরম নীলচে অন্ধকার, আর তার মধ্যেই দূরে চোখে পড়ল সেই রিসোর্ট—“চাঁদের আলোর ঘর”। কাঠ ও সাদা পাথরে তৈরি এই স্থাপনাটি যেন প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গেছে, তবু তার উপস্থিতি আলাদা করে চোখে পড়ে। চারপাশে জ্বলজ্বল করছে ছোট ছোট লণ্ঠন, যা সমুদ্রের বাতাসে দুলে হালকা আলোছায়ার খেলা তৈরি করছে। বাইরের দেয়ালগুলো সাদা পাথরের, যেগুলোর ওপর সন্ধ্যার প্রথম চাঁদের আলো পড়তেই তারা যেন রুপোলি ঝিলমিল করে উঠল—ঠিক যেন আকাশের চাঁদ তার টুকরো টুকরো আলো ছিটিয়ে দিয়েছে এই বাড়ির গায়ে। ছাদ কাঠের তক্তায় তৈরি, যেখান থেকে সমুদ্রের নোনা বাতাসের গন্ধ ভেসে আসছে। চারপাশের পরিবেশ এমন শান্ত যে, ঢেউয়ের গর্জন আর মাঝে মাঝে সমুদ্রপাখির ডাক ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। অভিসারিকা চুপ করে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে রইল—তার মনে হচ্ছিল, এতদিন ধরে যেই আবেগ সে খুঁজে ফিরছিল, হয়তো এই দরজার ওপারেই তার উত্তর আছে। সৌভিকও মুহূর্তখানেক কিছু বলল না, কেবল গভীর দৃষ্টিতে সেই বাড়ির দিকে তাকিয়ে রইল, যেন নিজেকে প্রস্তুত করছে ভেতরে পা রাখার জন্য।

তাদের আগমনের মুহূর্তেই দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন একজন লম্বা, গাঢ় শ্যামলা মানুষ—তার চোখে অদ্ভুত উজ্জ্বলতা, আর ঠোঁটে এক আশ্বাসজনক হাসি। তিনি নিজেকে পরিচয় দিলেন—“ইরফান মল্লিক, এই রিসোর্টের মালিক।” তার গলায় একধরনের নরম অথচ গভীর স্বর, যা শুনে মনে হয়, তিনি বহু মানুষের গল্প জানেন এবং সেগুলো নীরবে বয়ে বেড়ান। ইরফান করমর্দন করতেই সৌভিক অনুভব করল, তার হাতে অদ্ভুত এক উষ্ণতা আছে। ঠিক তখনই পিছন থেকে এগিয়ে এলেন এক তরুণী—গায়ে হালকা নীল শাড়ি, চুল খোলা, চোখে রহস্যময় দীপ্তি। ইরফান পরিচয় করিয়ে দিলেন, “এ নীলা, আমাদের কেয়ারটেকার। এখানে আসা অতিথিদের জন্য প্রায় সব ব্যবস্থাই ও দেখে।” নীলা এক মিষ্টি হাসি দিয়ে অভিসারিকার দিকে তাকাল, কিন্তু সেই হাসির গভীরে যেন কিছু লুকিয়ে আছে—কোনো না বলা গল্প, যা সময় এলে হয়তো বেরিয়ে আসবে। অভিসারিকা হালকা অস্বস্তি অনুভব করল, কিন্তু একই সঙ্গে নীলার মধ্যে এক ধরনের আন্তরিকতার আভা টের পেল। ইরফান তাদের ভেতরে নিয়ে যাওয়ার আগে বলল, “আপনারা জানেন কি, এখানে যারা আসে, তারা সবাই নিজেদের নতুন করে খুঁজে পায়? সমুদ্র আর চাঁদের আলো, মিলে মিশে যেন মানুষকে তার নিজের ভেতরের দরজা খুলে দিতে শেখায়।” কথাগুলো শুনে সৌভিক ও অভিসারিকা দুজনেই একে অপরের দিকে তাকাল—এ কি কেবল কথার কথা, নাকি এই জায়গায় সত্যিই কিছু আছে যা তাদের বদলে দেবে?

ভেতরে ঢুকতেই রিসোর্টের পরিবেশ যেন এক অদৃশ্য আবরণে মোড়া মনে হলো। মেঝেতে কাঠের তক্তা, যার ওপর হালকা ল্যাভেন্ডারের গন্ধ ছড়ানো। দেয়ালে ঝোলানো আছে সমুদ্রতটে তোলা সাদা-কালো ছবি, কিছু পুরনো দম্পতির, কিছু একাকী মানুষের—যেন এই জায়গা বহু গল্পের সাক্ষী। প্রতিটি কক্ষের দরজার ওপর নীল রঙে লেখা নাম, যা হয়তো প্রতীকী অর্থ বহন করে—“তরঙ্গ”, “রূপালী রাত”, “প্রথম প্রভাত”। তাদের জন্য রাখা হয়েছে “রূপালী রাত” নামের কক্ষটি। ঘরের ভেতর নরম আলো, বড় জানালা দিয়ে দেখা যায় সোজা সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে তটে। বিছানায় সাদা চাদর, টেবিলে রাখা একটি ছোট লণ্ঠন, আর একপাশে পুরনো কাঠের আলমারি। জানালা খুলতেই সমুদ্রের নোনা বাতাস এসে মিশে গেল তাদের নিঃশ্বাসে। অভিসারিকা ধীরে ধীরে ঘরের ভেতর পা রেখে অনুভব করল, এই জায়গাটা যেন নিছক থাকার জন্য নয়—বরং কিছু অনুভব করার জন্য তৈরি। সৌভিক দরজার কাছে দাঁড়িয়ে নীরবে তাকিয়ে রইল, তারপর অভিসারিকার দিকে হেসে বলল, “দেখছো? মনে হচ্ছে, আমরা সত্যিই এক অন্য জগতে চলে এসেছি।” অভিসারিকা কোনো উত্তর দিল না, শুধু জানালার দিকে তাকিয়ে রইল—সমুদ্রের ওপরে উঠতে থাকা পূর্ণিমার চাঁদের দিকে, যা ধীরে ধীরে এই ঘরটিকে সত্যিই চাঁদের আলোর ঘরে পরিণত করে দিচ্ছিল।

সন্ধ্যার প্রথম চাঁদ তখন সমুদ্রের ওপরে উঠতে শুরু করেছে, আর তার আলো ধীরে ধীরে ঢেউয়ের গায়ে ছড়িয়ে পড়ছে। রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে সরু বালুকাবেলায় পা রাখতেই অভিসারিকার পায়ের নিচে ঠান্ডা, নরম বালি চেপে বসে। দূর সমুদ্রে ঢেউ আছড়ে পড়ছে, আর সেই গর্জনের মধ্যে এক ধরণের সঙ্গীত বেজে চলেছে—যা মনকে শান্তও করছে, আবার অদ্ভুত এক টানটান ভাবও তৈরি করছে। সৌভিক কয়েক কদম এগিয়ে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দিকে তাকাল, হাতে পকেটে রাখা মোবাইল, কিন্তু স্ক্রিন অন করা হয়নি। অভিসারিকা তার কিছুটা পেছনে হেঁটে আসছে, নিজের চুল কানে গুঁজে দিচ্ছে, সমুদ্রের বাতাসে শাড়ির আঁচল বারবার উড়ে যাচ্ছে। তারা পাশাপাশি হাঁটলেও কথোপকথন খুব কম—কেবল বালি চিরে পায়ের শব্দ আর দূরের ঢেউয়ের আওয়াজই তাদের সঙ্গ দিচ্ছে। মাঝেমধ্যে অভিসারিকা সৌভিকের দিকে তাকায়, কিন্তু চোখ মিললেই দ্রুত অন্যদিকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। এই লুকোচুরি দৃষ্টি বিনিময়ে এমন কিছু আছে, যা হয়তো দু’জনেই বুঝতে পারছে, কিন্তু কেউই মুখে আনছে না।

হাঁটতে হাঁটতে সৌভিকের মনে একের পর এক প্রশ্ন ভিড় করছে—সে কি এখনও অভিসারিকার জন্য ঠিক সেই মানুষ, যে ছিল তাদের বিয়ের প্রথম বছরগুলোতে? এই যাত্রা কি সত্যিই তাদের হারানো সেতুবন্ধন ফিরিয়ে আনতে পারবে? সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে সে মনে মনে কিছু কথা সাজাতে শুরু করল—যা আজকের রাতেই বলতে চায়, যদিও জানে, এতদিনের জমে থাকা নীরবতার পর হঠাৎ সব বলে দেওয়া সহজ হবে না। তার পাশে অভিসারিকা নিজের ভেতরে অন্য এক লড়াই চালাচ্ছে—তার মনে এখনও সাম্প্রতিক বছরগুলোর অবহেলা ও দূরত্বের ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেছে, কিন্তু আজকের এই সমুদ্রতট, চাঁদের আলো, আর সৌভিকের মাঝে মাঝে বদলে যাওয়া দৃষ্টি যেন সেই ক্ষতের ওপর নরম হাত রাখছে। তারা হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে থেমে দাঁড়ায়, পায়ের কাছে এসে ভেঙে পড়া ঢেউয়ের ফেনা দেখার জন্য। কোনো শব্দ নেই, শুধু প্রকৃতির সঙ্গীত আর ভেতরের অনুচ্চারিত আবেগের ঢেউ।

একসময় তারা সমুদ্রতটের এক নির্জন কোণে এসে দাঁড়াল—যেখানে চারপাশে কেবল ঢেউয়ের গর্জন আর উজ্জ্বল চাঁদের আলো। সৌভিক অভিসারিকার দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। সেই মুহূর্তে, কথার চেয়ে তাদের নীরবতাই যেন বেশি অর্থবহ। অভিসারিকা চোখ নামিয়ে বালিতে পায়ের আঙুল দিয়ে ছোট ছোট দাগ কাটছিল, যেন ভাবছে, এই নীরবতার মধ্যে কিছু খুলে বলা যাবে কি না। হঠাৎ এক ঝাঁক সাদা সমুদ্রপাখি চাঁদের আলোতে উড়ে গেল, আর তাদের ডানার শব্দ ভেঙে দিল সেই টানটান নীরবতা। সৌভিক মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—আজ নয়, তবে খুব শিগগিরই সে সেই সব কথা বলবে, যা এতদিন বুকের ভেতরে আটকে রেখেছিল। অভিসারিকা সেই মুহূর্তে কেবল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইল, আর মনে হলো, এই প্রথম সন্ধ্যায় তারা দু’জনেই একে অপরের দিকে না তাকিয়েও একই পথে হাঁটছে—একটি পথে, যা হয়তো আবার তাদের কাছাকাছি নিয়ে আসবে।

বিকেলের রোদ তখন সমুদ্রের গা বেয়ে ধীরে ধীরে নেমে আসছে, ঘরের ভেতরে এক ধরণের নরম সোনালি আভা তৈরি হয়েছে। অভিসারিকা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দিকে তাকাচ্ছিল, হঠাৎই তার চোখে পড়ল বিছানার পাশে কাঠের ছোট্ট টেবিলে রাখা একটি পুরনো চামড়ার বাঁধানো অ্যালবাম। ধুলো জমে নেই, বরং যত্নে রাখা হয়েছে, যেন প্রায়শই কেউ এটিকে হাতে তুলে নেয়। সে অ্যালবাম খুলতেই দেখতে পেল প্রথম পাতায় সাদা-কালো একটি ছবি—সমুদ্রতটের পটভূমিতে এক তরুণ দম্পতি, দু’জনের মুখে পরিপূর্ণ হাসি, চোখে সেই চেনা অনাবিল উচ্ছ্বাস। পাতা উল্টাতেই আরও কিছু ছবি—কেউ রিসোর্টের বারান্দায় চা খাচ্ছে, কেউ নৌকায় বসে গান গাইছে, কেউবা কেবল একে অপরের দিকে চেয়ে আছে। সৌভিক এসে পাশে দাঁড়াল, তাকিয়েই বলল, “দেখো তো, এরা কারা? মনে হচ্ছে এই রিসোর্টের পুরনো অতিথি।” অ্যালবামের পাতাগুলো যেন সময়ের ভাঁজে আটকে থাকা কিছু মুহূর্ত, যেগুলো ধীরে ধীরে খুলে দিচ্ছে এই বাড়ির গল্প। প্রতিটি ছবিতে অদ্ভুত এক উষ্ণতা, যেন এখানে আসা মানুষগুলো সত্যিই নিজেদের নতুন করে খুঁজে পেয়েছে।

পাতা উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎ সৌভিকের হাতে পড়ল একদম হলুদে ছোপ ধরা একটি পুরনো পোলারয়েড ছবি—সেখানে একজন মহিলা নৌকায় বসে মাথা পেছনে হেলিয়ে হাসছেন, আর পাশে একজন পুরুষ তার হাত ধরে আছে। ছবিটার ভেতরে এমন এক প্রাণবন্ততা যে, অভিসারিকা অনিচ্ছাসত্ত্বেও মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। “জানো, আমাদের প্রথম পুরী ভ্রমণের সময় তোলা কিছু ছবিও এমন ছিল,” সৌভিক হঠাৎ বলল, আর তাতে অভিসারিকার মনে যেন বহুদিন পর এক চিলতে উষ্ণ আলো এসে পড়ল। সেই কলেজের দিনগুলো, বৃষ্টির মধ্যে ভিজে ঘুরে বেড়ানো, শাড়ির আঁচলে লুকিয়ে রাখা চটপটি—সব একে একে মনে পড়ে গেল। তারা হাসতে হাসতে নিজেদের বিয়ের অ্যালবামের মজার ছবি মনে করতে লাগল—সৌভিকের বেঁকা গলাবন্ধ, অভিসারিকার ভুলে ভুলে মেকআপের গল্প, বা বন্ধুদের সঙ্গে তোলা সেই অগোছালো গ্রুপ ফটো। তাদের মধ্যে হঠাৎ করেই কিছুটা সহজতা ফিরে এলো, যা বহুদিন ধরেই হারিয়ে গিয়েছিল।

কথার ফাঁকে ফাঁকে ছোটখাটো খুনসুটি শুরু হলো—সৌভিক মজা করে বলল, “তোমার ওই নীল শাড়িটা মনে আছে? যেটা তুমি বলেছিলে আমার জন্যই কিনেছো, কিন্তু পরে স্বীকার করলে যে অর্ধেক কারণ ছিল মলতিকে জেলাস করার জন্য।” অভিসারিকা হেসে চড় মারল তার হাতে, “তুমি সব কথাই মনে রাখো, তাই না?” সেই হাসি যেন ঘরের ভেতরের বাতাসকে আরও হালকা করে দিল। জানালার বাইরে তখন সূর্য ডুবে গিয়ে চাঁদের আলো ধীরে ধীরে বাড়ছে, আর ভেতরে তারা দু’জন পুরনো ছবির পাতা উল্টে উল্টে নিজেদের ভেতরের সেই হারিয়ে যাওয়া সুর খুঁজে পাচ্ছিল। অ্যালবামের শেষ পাতায় একটি ফাঁকা পাতা, যেখানে হয়তো তাদের ছবিও একদিন এসে জায়গা নেবে—অতীতের অ্যালবামের গল্পের সঙ্গে মিলেমিশে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে, তাদের মনে হলো, হয়তো এই যাত্রা কেবল ছুটি কাটানোর জন্য নয়, বরং অতীতকে ছুঁয়ে বর্তমানে নতুন কিছু গড়ে তোলার জন্যই।

রাত তখন গভীর হতে শুরু করেছে, রিসোর্টের চারপাশে কেবল সমুদ্রের ঢেউয়ের মৃদু শব্দ আর দূরে কোথাও ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। অভিসারিকা বারান্দায় একা বসে চা খাচ্ছিল, আকাশে পূর্ণিমার আলো সমুদ্রের উপর ছড়িয়ে যেন রুপোলি নদী বানিয়ে দিয়েছে। সেই সময় নীলা এসে চুপচাপ পাশে দাঁড়াল, হাতে এক কাপ কফি। দু’জন কিছুক্ষণ কোনো কথা না বলেই বসে রইল, যেন এই নীরবতাই তাদের মধ্যে এক ধরণের বোঝাপড়া তৈরি করছে। হঠাৎ নীলা নরম স্বরে বলল, “জানো, আমি একসময় এখানে অতিথি হয়ে এসেছিলাম। তখন আমারও সম্পর্ক প্রায় ভেঙে যাচ্ছিল। আমরা একে অপরের সঙ্গে থাকলেও যেন খুব দূরে ছিলাম।” অভিসারিকা বিস্মিত হয়ে তাকাল, কারণ নীলাকে সে সবসময়ই এক রহস্যময়, শান্ত স্বভাবের মানুষ বলে ভেবেছিল। নীলা কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “এই রিসোর্টে কাটানো কয়েকটা মুহূর্ত আমার ভিতরের জমে থাকা রাগ, অভিমান, এমনকি ভয়ও বদলে দিয়েছিল।”

নীলা গল্প বলতে শুরু করল—সেটা ছিল এক গ্রীষ্মের বিকেল, যখন সে ও তার সঙ্গী প্রথমবার এই রিসোর্টে পা রাখে। প্রথম দু’দিনে তাদের মধ্যে কোনো কথাবার্তা হয়নি, শুধু বাধ্যতামূলক সৌজন্য বিনিময়। কিন্তু তৃতীয় দিনের রাতে, চাঁদের আলোয় সমুদ্রতটে হাঁটতে হাঁটতে তারা হঠাৎ পুরনো কিছু স্মৃতি মনে করেছিল—যা একসময় তাদের একত্র করেছিল। সেই রাতেই তারা বুঝতে পারে, যতটা সহজে তারা একে অপরকে হারাতে চাইছিল, ততটাই সহজে হয়তো আবার ফিরে পাওয়া সম্ভব। নীলা বলল, “এই বাড়ি, এই বাতাস, এই সমুদ্র—সব যেন তোমাকে নিজের গভীরে ডুব দিয়ে দেখতে বাধ্য করে। বুঝিয়ে দেয়, ভালোবাসা হয়তো হারিয়ে যায় না, শুধু ধুলো জমে যায়, আর দরকার হয় একটুকরো আলো সেই ধুলো ঝাড়ার জন্য।” নীলার চোখের কোণে যেন হালকা আভা জ্বলজ্বল করছিল, যা অভিসারিকার মনে অদ্ভুত এক উষ্ণতা ছড়িয়ে দিল।

অভিসারিকা হঠাৎ টের পেল, নীলার এই গল্প যেন কেবল তার নিজের কথা নয়—এটা এমন এক অভিজ্ঞতা, যা এই জায়গার সঙ্গে মিশে আছে। তার মনে হলো, হয়তো সৌভিকের সঙ্গেও এই নীরবতার দেয়াল ভেঙে ফেলার সময় এসেছে। নীলা শেষ চুমুক দিয়ে কফি নামিয়ে রেখে বলল, “তুমি যদি মন খুলে নিতে চাও, এই জায়গা তোমাকে বদলে দেবে। কিন্তু বদলটা শুরু হবে তোমার ভেতর থেকেই।” অভিসারিকা হাসল, সেই হাসিতে ভয়ের চেয়ে আশার রং বেশি ছিল। সমুদ্রের ঢেউ যেন এক ছন্দে এসে বারান্দার নিচে আছড়ে পড়ছিল, আর পূর্ণিমার আলোয় নীলার মুখে ফুটে থাকা উষ্ণতা অভিসারিকার হৃদয়ে নতুন এক স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়ে দিল—একটি বিশ্বাস, যে ভালোবাসা, যতই ফিকে হয়ে যাক না কেন, আবার রঙ ফিরে পেতে পারে।

সন্ধ্যার আকাশে প্রথমে হালকা মেঘ জমেছিল, কিন্তু তারা কেউই ভাবেনি যে এত তাড়াতাড়ি বৃষ্টি নেমে আসবে। রিসোর্টের বারান্দায় বসে অভিসারিকা তখনো সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিল—দূরে ঢেউগুলো একটার পর একটা ভেঙে পড়ছে, আর বাতাসে লবণাক্ত গন্ধ ভেসে আসছে। হঠাৎ এক ঝাপটা হাওয়ার সঙ্গে আকাশ ফেটে নেমে এলো বৃষ্টি। ছাদের টিনের উপর টুপটাপ শব্দে চারপাশ এক ধরণের সজীবতায় ভরে উঠল। সৌভিক পাশের চেয়ার থেকে উঠে বারান্দার রেলিংয়ের কাছে গেল, দু’হাত রেলিংয়ে রেখে গভীরভাবে সমুদ্রের দিকে তাকাল। অভিসারিকা সেই দৃশ্য দেখছিল—তার চোখে তখনো বহু অজানা প্রশ্ন, কিন্তু সেই মুহূর্তে চারপাশের এই সজীবতা যেন কিছু বলার ইঙ্গিত দিচ্ছিল। বৃষ্টির ফোঁটা হাওয়ায় উড়ে এসে বারান্দায় পৌঁছাচ্ছিল, মাঝে মাঝে অভিসারিকার গাল ছুঁয়ে যাচ্ছিল, আর সেই ঠান্ডা স্পর্শে তার মনে অদ্ভুত এক কাঁপন উঠছিল।

হঠাৎ সৌভিক ফিরে এসে ধীরে ধীরে অভিসারিকার কাছে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে সে এক মুহূর্ত দ্বিধা করল, তারপর আলতো করে অভিসারিকার হাত ধরল—যেমন বহু বছর আগে, তাদের প্রথম সমুদ্র ভ্রমণে ধরেছিল। সেই পুরনো স্মৃতি যেন হঠাৎ করে দুইজনের ভেতর দিয়ে বয়ে গেল, আর অভিসারিকার শরীরের ভেতর দিয়ে উষ্ণতার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল। দু’জনেই কিছু বলল না, শুধু একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। বৃষ্টির ধারা ক্রমশ ঘন হচ্ছিল, তবু আকাশে কোথাও কোথাও চাঁদের আলো মেঘ ভেদ করে এসে সমুদ্রের উপর পড়ছিল, আর সেই আলো ঢেউয়ের গায়ে পড়ে রুপোলি রেখা এঁকে যাচ্ছিল। হাতের উষ্ণতা, ঠোঁটে জমে থাকা অদেখা কথা, আর চারপাশের প্রকৃতির এই মিলন—সব মিলিয়ে মুহূর্তটা যেন তাদের জন্য থমকে গেল।

সেই নীরব স্পর্শে যেন বহু বছরের জমে থাকা অভিমান, অভিযোগ, আর দূরত্বের প্রাচীর ভেঙে যেতে লাগল। বৃষ্টি সমুদ্রের সাথে মিলেমিশে ঢেউয়ের গর্জন আরও তীব্র করছিল, আর চাঁদের আলো তাদের চারপাশে এক ধরণের যাদুর মতো ছড়িয়ে পড়ছিল। সৌভিকের চোখে অভিসারিকা প্রথমবার আবার সেই আগের মানুষটিকে দেখল—যে ভালোবাসত, যত্ন করত, আর প্রতিশ্রুতি রাখতে চাইত। অভিসারিকার ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল, আর সেই হাসি সৌভিককে আরও কাছে টেনে নিল। তাদের নীরবতা আর প্রয়োজনীয় ছিল না, কারণ প্রকৃতির এই মঞ্চে তাদের আবেগের বাঁধ ইতিমধ্যেই ভেঙে গেছে। বৃষ্টি, চাঁদের আলো আর ঢেউয়ের গর্জন মিলে যেন ঘোষণা করে দিল—তাদের গল্প আবার শুরু হচ্ছে।

রাতের খাবারের জন্য রিসোর্টের ডাইনিং রুমে ঢুকতেই চারপাশের পরিবেশ যেন একেবারে অন্যরকম হয়ে উঠল। বড় জানালা দিয়ে সমুদ্রের অন্ধকার আর দূরে চাঁদের আলো ভেসে আসছিল, কাঠের টেবিলের উপর রাখা মোমবাতির আলো তাদের মুখে নরম আভা ফেলছিল। টেবিলে সাজানো ছিল সাদামাটা কিন্তু যত্নে বানানো খাবার—গরম ভাত, ডাল, তাজা মাছের ঝোল, আর মিষ্টি দই। প্রথমে তারা শুধু চুপচাপ বসে খেতে শুরু করেছিল, কিন্তু খাবারের স্বাদ আর সেই শান্ত পরিবেশ ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে কথা খুলে দিল। সৌভিক মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “মনে আছে, আমাদের প্রথমবার একসঙ্গে ডিনার করার সময়ও এমনই আলো ছিল?” অভিসারিকা মাথা নাড়ল, চোখে এক ঝলক উজ্জ্বলতা ফুটে উঠল, যেন বহুদিন পর এই স্মৃতিচারণ তার ভেতরে উষ্ণতা ফিরিয়ে আনছে। মোমবাতির আলোয় তাদের হাসি, গল্প, আর ছোটখাটো ঠাট্টা যেন পুরনো দিনের মতো ফিরে এল, একেবারেই অপ্রত্যাশিতভাবে।

খাওয়া শেষ হওয়ার পর সৌভিক গভীর শ্বাস নিয়ে টেবিলের উপর হাত রাখল, তার চোখে তখন এক অদ্ভুত আন্তরিকতা। সে ধীরে ধীরে বলল, “অভি, আমি জানি আমি অনেক ভুল করেছি। কাজের অজুহাতে তোমাকে সময় দিইনি, তোমার অভিমান বোঝার চেষ্টা করিনি। হয়তো ভাবছিলাম, ভালোবাসা নিজে থেকেই টিকে থাকবে… কিন্তু এখন বুঝছি, ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে যত্ন, মনোযোগ, আর একে অপরের জন্য সময় দেওয়া দরকার।” তার গলায় কোনো নাটকীয়তা ছিল না, বরং কেবল খোলাখুলি অনুশোচনা। অভিসারিকা কিছুক্ষণ চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর ধীরে ধীরে বলল, “আমি রাগ করেছি, অভিমান করেছি… কিন্তু আসলে আমি কখনও তোমাকে ভালোবাসা ছাড়িনি। শুধু মনে হচ্ছিল তুমি আর আগের মতো নেই।” এই স্বীকারোক্তির পর তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল, যেন চোখের গভীরে সব উত্তর লুকিয়ে আছে।

মোমবাতির শিখা হাওয়ায় হালকা কেঁপে উঠছিল, কিন্তু তাদের চোখের দৃষ্টি তখন স্থির। সৌভিক আলতো করে অভিসারিকার হাত নিজের হাতে নিল, আর সে হাত ছাড়িয়ে নিল না। সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, পুরনো সব কষ্ট, ভুল বোঝাবুঝি, আর দূরত্ব ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে, জায়গা নিচ্ছে এক নতুন প্রতিশ্রুতি। বাইরে সমুদ্রের ঢেউ এখনও তীরে আছড়ে পড়ছে, যেন তাদের এই মিলনের সাক্ষী হয়ে আছে। অভিসারিকার চোখে তখন এক নতুন উজ্জ্বলতা, আর সৌভিকের মুখে সেই পরিচিত হাসি—যে হাসি একসময় তাকে প্রেমে ফেলেছিল। এই ডিনার শুধু খাবারের পর্ব ছিল না, বরং ছিল তাদের হারানো আবেগের পুনর্জন্মের প্রথম ধাপ। তারা জানত, সামনের দিনগুলোতে অনেক কিছু ঠিক করতে হবে, কিন্তু অন্তত আজ, তারা আবার একে অপরকে খুঁজে পেয়েছে।

রাত গভীর হয়ে এসেছে, তবু সমুদ্রতটে ঢেউয়ের গর্জন থামেনি। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ, তার আলো ঢেউয়ের ওপর ছড়িয়ে পড়ে রুপোলি রেখা এঁকে দিয়েছে। রিসোর্টের সীমানা পেরিয়ে সৌভিক আর অভিসারিকা ধীরে ধীরে বালুর উপর হাঁটছিল, পায়ের নিচে ভিজে বালি নরম অনুভূতি দিচ্ছিল। বাতাসে লবণাক্ত গন্ধ আর দূরের ঢেউয়ের ছন্দ তাদের নিঃশ্বাসের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। হঠাৎ সৌভিক থেমে দাঁড়াল, তার চোখ সমুদ্রের দিকে নয়—সরাসরি অভিসারিকার চোখে। সেই দৃষ্টিতে ছিল নির্ভেজাল আন্তরিকতা, যা অভিসারিকার বুকের ভেতরে এক অদ্ভুত উষ্ণতা ছড়িয়ে দিল। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সৌভিক মৃদু গলায় বলল, “শহরে ফিরে গিয়েও এই মুহূর্তের উষ্ণতা আমরা হারাব না, অভি… আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।”

অভিসারিকা গভীরভাবে শ্বাস নিল, সমুদ্রের হাওয়া তার চুল উড়িয়ে দিচ্ছিল। সে জানত, প্রতিশ্রুতি শুধু মুখের কথা নয়, বরং প্রতিদিনের যত্নে তৈরি হয়। তবু সৌভিকের এই কথাগুলো তার মনে আশার আলো জ্বালিয়ে দিল। সে ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে সৌভিকের হাত ধরল এবং বলল, “আমিও শপথ করছি… যত ব্যস্ততাই আসুক, আমরা একে অপরের কাছে ফিরব।” তাদের কণ্ঠে কোনো নাটকীয়তা ছিল না, শুধু ছিল সত্যিকারের অনুভূতির সুর। চারপাশে শুধু সমুদ্রের শব্দ, যেন ঢেউগুলোও তাদের প্রতিশ্রুতির সাক্ষী হয়ে আছে। চাঁদের আলোয় তাদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, আর সেই আলো যেন মিলনের নতুন অধ্যায় লিখে দিচ্ছিল। তারা দু’জনেই জানত, শহরের জীবন কঠিন হবে, তবু এই মুহূর্তের সত্য তাদের পথ দেখাবে।

দূরে, রিসোর্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ইরফান মল্লিক নিঃশব্দে সবকিছু দেখছিল। তার ঠোঁটে এক তৃপ্ত হাসি খেলে গেল—আবার এক দম্পতি এই রিসোর্টের জাদুতে নিজেদের হারানো সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছে। ইরফান জানত, “চাঁদের আলোর ঘর” শুধু একটা রিসোর্ট নয়, বরং এক ধরনের আশ্রয় যেখানে মানুষ নিজেদের হৃদয়ের হারিয়ে যাওয়া সুর ফিরে পায়। সমুদ্রের শপথের এই দৃশ্য তার কাছে নতুন কিছু নয়, তবুও প্রতিবারই তার মন ছুঁয়ে যায়। তিনি চুপচাপ ভেতরে ফিরে গেলেন, আর দূরে বালুর উপর দাঁড়িয়ে সৌভিক আর অভিসারিকা একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল, হাত শক্ত করে ধরে। তাদের চারপাশে সমুদ্র, চাঁদের আলো, আর অদৃশ্য এক প্রতিশ্রুতি—যা শহরের ভিড়েও তাদের একসঙ্গে রাখবে।

১০

সকালের সমুদ্রের হাওয়া ছিল অদ্ভুত শান্ত। ঢেউগুলো তীরে এসে নরমভাবে আছড়ে পড়ছিল, যেন সারা রাতের গর্জনের পর ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। রিসোর্টের বাগানে দাঁড়িয়ে সৌভিক ও অভিসারিকা শেষবারের মতো চারপাশের দৃশ্যটাকে চোখে ভরে নিচ্ছিল। কাঠের বারান্দায় পাখির কিচিরমিচির, বাতাসে ভেসে আসা নোনা গন্ধ, আর দূরে রুপালি বালির উপর সূর্যের প্রথম আলো—সবকিছু মিলিয়ে এক নীরব মায়াজাল তৈরি করেছিল। ঠিক তখনই নীলা এগিয়ে এল, তার হাতে ছিল দুটো ছোট্ট খাম। মিষ্টি হেসে বলল, “এটা রিসোর্টের তরফ থেকে আপনাদের জন্য… ফিরে গিয়ে খুলে দেখবেন।” সৌভিক ও অভিসারিকা অবাক হলেও কিছু বলেনি; নীলার চোখে যে উষ্ণতা ছিল, তাতে প্রশ্ন করার প্রয়োজনও পড়েনি। নীলা বিদায়ের সময় অভিসারিকার হাত শক্ত করে ধরল, আর মৃদু স্বরে বলল, “আপনারা যে আলো এখানে খুঁজে পেয়েছেন, সেটা যেন কখনও নিভে না যায়।”

গাড়ি রিসোর্ট ছেড়ে ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে অভিসারিকা দেখল, রিসোর্টের সাদা পাথরের দেয়াল আর কাঠের ছাদের কোণ ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। সকালের আলোয় রিসোর্ট যেন ধীরে ধীরে স্বপ্নের মতো ম্লান হয়ে যাচ্ছে। চাঁদের আলোর ঘরের নামটা মনে পড়তেই তার বুকের ভেতর এক অদ্ভুত শূন্যতা তৈরি হল, কিন্তু সেই শূন্যতার সঙ্গে মিশে ছিল এক গভীর তৃপ্তি। পাশে বসা সৌভিকও নীরবে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল; তাদের মাঝে কোনো কথা হচ্ছিল না, কিন্তু এই নীরবতা আগের মতো ভারী ছিল না—বরং ছিল এক ধরনের শান্ত আশ্বাসের নীরবতা। দূরে সমুদ্রের শব্দ মিলিয়ে গিয়ে রাস্তার গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছিল, যেন বাস্তব জীবনের দিকে ফেরার পথ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

যাত্রাপথে তারা দু’জনেই একসময় একে অপরের দিকে তাকাল, আর সেই দৃষ্টিতে ছিল অসংখ্য অপ্রকাশিত কথা। তারা বুঝতে পেরেছিল, “চাঁদের আলোর ঘর” শুধু একটি রিসোর্ট নয়—এটা ছিল তাদের সম্পর্কের নতুন জন্মভূমি, যেখানে পুরনো ক্ষত সারিয়ে নতুন করে ভালোবাসা ফুটে উঠেছে। অভিসারিকা হালকা হেসে বলল, “জানো, আমার মনে হয় এই জায়গাটা আমাদের জীবনের অংশ হয়ে থাকবে।” সৌভিক মাথা নাড়ল, তার ঠোঁটে সেই পরিচিত হাসি—যে হাসি বহু বছর আগে তাকে জয় করেছিল। গাড়ি যখন বাঁক নিয়ে সমুদ্রের শেষ রেখাটাও হারিয়ে ফেলল, তখন তাদের মনে হচ্ছিল, এই যাত্রা আসলে শেষ নয়—বরং এক নতুন গল্পের শুরু।

শেষ

1000051964.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *