ইন্দ্রনীল বসু
১
মহাকাশ গবেষণার নতুন অধ্যায়ে ভারত প্রবেশ করল “অস্ত্রযান গবেষণা কেন্দ্র” নামক সংস্থার হাত ধরে। বহু বছরের পরিকল্পনা, অগণিত পরীক্ষামূলক অভিযান আর বিপুল অর্থ বিনিয়োগের পর অবশেষে তৈরি হলো দেশের সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী মিশন—“চন্দ্রযান-অভিযাত্রী”। পরিকল্পনা ছিল সহজ, কিন্তু লক্ষ্য ছিল ভয়ানক কঠিন। পৃথিবীর মানুষ যতবার চাঁদের দিকে তাকিয়েছে, ততবারই তারা দেখেছে সেই অংশ, যেটি পৃথিবীর দিকে মুখ করে থাকে। কিন্তু এর উল্টোদিকে, অদেখা এক দিক আছে—চাঁদের অন্ধকার পিঠ, যেখানে এখনো কোনো মানুষ পা রাখেনি। এই অদেখা অংশেই পাঠানো হলো এক নতুন অনুসন্ধানী মহাকাশযান, আর তার দায়িত্ব পড়ল ভারতের অন্যতম দক্ষ নভোচারী অনির্বাণ সেনের কাঁধে। চারিদিকে এক উত্তেজনার আবহ—মিডিয়া, বিজ্ঞানী, রাজনীতি থেকে সাধারণ মানুষ—সবাই চেয়ে আছে মিশনের দিকে। মহাকাশ গবেষণার এই নতুন অধ্যায় শুধু ভারতের নয়, সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসকেই পাল্টে দিতে পারে। মহাকাশযান উৎক্ষেপণের আগের দিন রাতেই কপালের ঘামে ভিজে উঠেছিল হাজারো বিজ্ঞানীর পরিশ্রম। লঞ্চপ্যাডে যখন বিশাল রকেট প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে, মনে হচ্ছিল যেন ধাতব দানব কোনো অজানা শক্তিকে জয় করতে উদ্যত।
অনির্বাণ সেন—তিনিই এই যাত্রার প্রাণপুরুষ। বয়স তেতাল্লিশ, কিন্তু এখনো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঝলসে ওঠে অদম্য আত্মবিশ্বাস। বিমানবাহিনীর প্রাক্তন উইং কমান্ডার হিসেবে তাঁর সুনাম ছিল অটুট, পরে মহাকাশ গবেষণায় প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে মহাকাশের সীমাহীন অন্ধকার পর্যন্ত। তবে এবার যেন কিছুটা অন্যরকম। দায়িত্ব যত বড়, চাপও তত বেশি। এইবার শুধু গবেষণা নয়, ইতিহাস গড়ার সুযোগ তাঁর সামনে। মহাকাশযানের ককপিটে বসে থাকতে থাকতে চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের আলো, সব যন্ত্রপাতি নিখুঁতভাবে কাজ করছে, মিশন কন্ট্রোল থেকে নিয়মিত নির্দেশ আসছে—সবকিছু যেন বইয়ের পাতার মতো সাজানো। তবু, তাঁর ভেতরে এক অদ্ভুত অস্বস্তি কাজ করছিল। চোখে দেখা যাচ্ছিল না কিছু, কিন্তু মনে হচ্ছিল কোনো অজানা শক্তি যেন ইতিমধ্যেই নজর রাখছে তাঁর ওপর। কয়েকবার গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলেন, হেলমেটের কাচে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখলেন—একজন যোদ্ধা, একা যাত্রায় বেরোতে চলেছেন, যেখানে পথ নেই, মানচিত্র নেই, আছে কেবল অজানা।
মিশন কন্ট্রোল থেকে ঘোষণা ভেসে এলো—“তিন, দুই, এক, লিফট অফ!” প্রচণ্ড শব্দে আকাশ কেঁপে উঠল। আগুনের ঝলকানিতে রাতের আকাশ মুহূর্তেই আলোকিত হয়ে উঠল, আর ধাতব দানব ধীরে ধীরে আকাশ চিরে উড়তে লাগল মহাশূন্যের দিকে। পৃথিবীর মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা হাজার হাজার মানুষ হাততালি দিয়ে উল্লাস করল, কিন্তু অনির্বাণ তখন অনেক দূরে—শরীরের প্রতিটি অঙ্গে চাপ পড়ছে প্রবল বেগের, বুকের ভেতর থেকে শ্বাস বেরোতে চাইছে না, তবু তিনি চোখ বন্ধ করে কেবল মনে মনে বললেন, “শুরু হলো আমার যাত্রা।” কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মহাকাশযান পৃথিবীর মায়াজাল ছাড়িয়ে নিরবচ্ছিন্ন অন্ধকারে প্রবেশ করল। জানলার বাইরে তাকিয়ে অনির্বাণ দেখলেন নীলচে পৃথিবী ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে, পাশে ভেসে উঠছে তারারাজি। সবকিছু এত সুন্দর অথচ এত ভয়ানক নিঃসঙ্গ। আর সেই নিঃসঙ্গতার মাঝেই তিনি প্রথম অনুভব করলেন—এই যাত্রা শুধু বৈজ্ঞানিক নয়, এর ভেতরে যেন লুকিয়ে আছে এমন কিছু, যা ব্যাখ্যা করা যায় না। অনির্বাণের মনে হলো, সামনে যা আছে তা হয়তো কেবল আবিষ্কার নয়, বরং এমন এক সত্য, যা তাঁকে হয়তো একেবারে অন্যরকম ভাগ্যের দিকে ঠেলে দেবে।
২
মহাকাশযান ধীরে ধীরে চাঁদের অদেখা দিকের কক্ষপথে পৌঁছে যাচ্ছিল। পৃথিবীর চোখ থেকে আড়ালে থাকা অংশটি যেন এক রহস্যঘেরা মুখোশ পরে আছে—নিঃশব্দ, শূন্যতায় ভরা অথচ ভিতরে লুকিয়ে রেখেছে অজানা সব গোপন। জানলার বাইরে তাকিয়ে অনির্বাণ প্রথম যেটা অনুভব করলেন, তা হলো এক গভীর আঁধার। চাঁদের এই দিকের বেশিরভাগ জায়গাতেই সূর্যের আলো পৌঁছায় না, আর সেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা অগণিত গহ্বর যেন জীবন্ত দানবের মতো চেয়ে আছে মহাকাশযানের দিকে। হঠাৎই অনির্বাণের চোখে পড়ল এক অস্বাভাবিক খাঁজ—এক বিশালাকার গহ্বর, যা অন্য কোনো ক্রেটারের মতো নয়। সেটির বিস্তার এতটাই ব্যাপক যে দূর থেকে উপত্যকার মতো মনে হচ্ছিল। চারদিকের অন্ধকার এত ঘন যে আলো কেবল ঢেউ খেয়ে ফিরে আসছে, ভেতরে প্রবেশ করতে পারছে না। যেন পুরো অঞ্চলটা আলোর প্রতিও প্রতিরোধী। অনির্বাণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন, তাঁর প্রশিক্ষণ বা বিজ্ঞানের কোনো পাঠ্যেই এরকম গহ্বরের বর্ণনা মেলেনি। মনে হলো, এই জায়গা বহু কোটি বছর ধরে নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে, কারও আগমনের প্রতীক্ষায়।
যখন মহাকাশযান ধীরে ধীরে নেমে এল সেই অদ্ভুত উপত্যকার কাছে, তখনই প্রথম ঘটল অস্বাভাবিকতা। অনির্বাণের নিয়ন্ত্রণে থাকা যন্ত্রগুলো হঠাৎ করেই ভিন্ন ভিন্ন সিগন্যাল ধরতে শুরু করল। সাধারণত চাঁদের মাটিতে শুধু পাথুরে গঠন আর খনিজ উপাদানের তথ্যই পাওয়া যায়, কিন্তু এখানে আসতেই সেন্সরগুলো অজানা ইলেকট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ রেজিস্টার করতে শুরু করল। স্ক্রিনে ওঠা তরঙ্গচিত্র একেবারেই অচেনা—কোনো প্রাকৃতিক প্যাটার্ন নয়, বরং যেন কারও তৈরি করা সংকেত। অনির্বাণের ভেতরটা কেঁপে উঠল, কারণ এতদিন যা মানুষ কল্পনা করেছে—চাঁদে একসময় কোনো সভ্যতার অস্তিত্ব থাকতে পারে—সেই রহস্যের সূত্র হয়তো তিনি পেয়ে গেছেন। মহাকাশযানের আলো যতই গহ্বরের ভেতর ফেলতে থাকল, ততই দেখা যাচ্ছিল অদ্ভুত নকশা—মাটির গায়ে খোদাই করা রেখার মতো, যেগুলো প্রকৃতির সৃষ্টি নয়। অন্ধকারে সেগুলো কেবল খানিকটা ঝলসে উঠছিল, যেন আলোতে ধরা না দিয়ে নিজস্ব নিয়মে জ্বলছে। অনির্বাণের মনের ভেতর অদ্ভুত দ্বন্দ্ব—তিনি কি সত্যিই প্রমাণ পেলেন কোনো অজানা সভ্যতার, নাকি তাঁর চোখ তাঁকে বিভ্রান্ত করছে?
উপত্যকায় অবতরণের পর পরিস্থিতি আরও জটিল হলো। মহাকাশযান মাটি ছুঁতেই আশপাশের বাতাস—যদিও চাঁদে বায়ুমণ্ডল নেই—এক অচেনা তরঙ্গ তৈরি করল, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি চারপাশে কম্পিত হচ্ছে। অনির্বাণ হেলমেট পরে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসতেই শরীরের ভেতর যেন এক প্রবল চাপ অনুভব করলেন। বাইরে ছিল গভীর অন্ধকার, অথচ হেলমেটের ভিজারে এক অজানা আলো প্রতিফলিত হচ্ছিল, যার কোনো উৎস তিনি খুঁজে পেলেন না। চারদিকে স্তব্ধতা, শুধু তাঁর পদক্ষেপের শব্দ মাটিতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। ঠিক তখনই তাঁর কমিউনিকেশন ডিভাইস হঠাৎ করেই তীব্র শব্দে ভরে উঠল—কোনো রেডিও সিগন্যাল নয়, বরং অস্পষ্ট গুঞ্জন, যা মানুষের কণ্ঠস্বরের মতো অথচ বোঝা যায় না। অনির্বাণ থমকে দাঁড়ালেন, হৃদস্পন্দন যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে। তিনি বুঝতে পারলেন, এই অচেনা উপত্যকা নিছক ভূতাত্ত্বিক গঠন নয়, বরং এমন এক জায়গা যা বহুকাল ধরে মানুষের আগমনের অপেক্ষা করছিল। আর সেই আগমন ঘটেছে আজ, তাঁর মাধ্যমে।
৩
অন্ধকার উপত্যকার ভেতরে আরও কয়েক কদম এগোতেই অনির্বাণের চোখে পড়ল এক অদ্ভুত দৃশ্য, যা তাঁর বুকের ভেতর শিহরণ জাগিয়ে তুলল। চাঁদের ধূসর পাথুরে ভূমি হঠাৎ করেই যেন বদলে গেল এক ভিন্ন মাত্রার মঞ্চে। চারপাশের নিস্তব্ধতা ভেদ করে দাঁড়িয়ে আছে বিশালাকার কিছু স্থাপনা—উঁচু পাথরের মতো স্তম্ভ, যাদের গঠন সম্পূর্ণ অপ্রাকৃতিক। এরা প্রকৃতির খেলা নয়, বরং মানুষের মতো কোনো উন্নত সভ্যতার হাতে নির্মিত। স্তম্ভগুলো সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে, যেন এক প্রাচীন মন্দিরের প্রবেশদ্বার বা টাওয়ারের ধ্বংসাবশেষ। প্রতিটি স্তম্ভের গায়ে খোদাই করা আছে অদ্ভুত রেখা, বৃত্ত, আর জ্যামিতিক নকশা, যেগুলো প্রথমে সাধারণ খোদাই মনে হলেও আলো পড়তেই সোনালী আভা ছড়িয়ে দিতে লাগল। অনির্বাণ থমকে দাঁড়িয়ে তাকালেন—সেই প্রতীকগুলোর ভেতর যেন এক অচেনা শক্তি স্পন্দিত হচ্ছে। তাঁর মনে হলো, এগুলো নিছক অলঙ্করণ নয়, বরং কোনো বার্তা, কোনো সংকেত, যেটা বহু সহস্রাব্দ ধরে মহাকাশের শূন্যতায় লুকিয়ে ছিল। পৃথিবীর কোনো ভাষার সঙ্গে এর মিল নেই—না সংস্কৃত, না মিশরীয় হায়ারোগ্লিফ, না আধুনিক কোনো লিপি। তবুও, প্রতীকগুলো তাঁর চোখে ধরা দিতেই যেন মনের গভীরে কোনো অচেনা অর্থ তৈরি হতে লাগল, যদিও তিনি নিজেই জানতেন না তিনি কী বুঝছেন।
তিনি ধীরে ধীরে সেই স্থাপনাগুলোর দিকে এগোতে থাকলেন, প্রতিটি পদক্ষেপ যেন তাঁকে নিয়ে যাচ্ছিল এক রহস্যময় ভুবনে। চারপাশের অন্ধকার সত্ত্বেও প্রতীকগুলো নিজেরাই আলো ছড়াচ্ছিল, যেন তাঁকে পথ দেখাচ্ছে। অনির্বাণ হাত বাড়িয়ে একটি স্তম্ভ স্পর্শ করলেন, আর সেই মুহূর্তে তাঁর পুরো শরীর কেঁপে উঠল অদ্ভুত এক কম্পনে। মনে হলো, পাথর নয়, জীবন্ত কোনো সত্ত্বাকে ছুঁয়েছেন। তাঁর ভেতর দিয়ে এক স্রোত বইতে শুরু করল—অচেনা দৃশ্য, অজানা শব্দ, আর এক অদ্ভুত আলোয় ভেসে যাওয়া অনুভূতি। চোখের সামনে ভেসে উঠল অদ্ভুত আকারের মানুষের মতো সত্ত্বা, যাদের শরীর ঝলমল করছে ধাতব আভায়, তারা দাঁড়িয়ে আছে এই একই উপত্যকায়, হাজার হাজার বছর আগে। তিনি যেন তাদের হাতের কাজ দেখলেন—কীভাবে তারা এই স্তম্ভগুলো গড়ে তুলেছিল, কীভাবে তারা প্রতীক খোদাই করেছিল, আর কীভাবে তারা কোনো এক অজানা কারণে এই জায়গা ত্যাগ করে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। অনির্বাণ ভেতরে ভেতরে আতঙ্কিত হলেও তাঁর বৈজ্ঞানিক মন বলছিল—এটা কোনো হ্যালুসিনেশন নয়, বরং কোনো প্রযুক্তির ফসল। এই প্রতীকগুলো হয়তো কোনো স্মৃতিসূচক যন্ত্র, যা স্পর্শ করলেই তার ভেতরের তথ্য সঞ্চারিত হয় দর্শকের মনে।
অনির্বাণ স্তম্ভ থেকে হাত সরিয়ে নিলেও শরীরের কম্পন থামল না। মনে হচ্ছিল, তিনি এক অদ্ভুত সংযোগের মধ্যে প্রবেশ করেছেন, যেখানে সময়, স্থান আর বাস্তবতার সীমা মিলিয়ে গেছে। চারপাশের প্রতীকগুলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল, যেন তাঁর উপস্থিতি টের পেয়েছে। দূরে দেখা গেল এক বিশাল গঠন—মন্দিরের মতো একটি স্থাপনা, যার শীর্ষ ভেঙে পড়লেও এখনও দাঁড়িয়ে আছে অবশিষ্ট অংশ। গায়ের প্রতীকগুলো ধীরে ধীরে নড়তে শুরু করল, যেন জীবন্ত হয়ে ওঠছে। হঠাৎই তাঁর হেলমেটের ভেতর দিয়ে এক অচেনা শব্দ কানে ভেসে এলো—না মানুষের কণ্ঠ, না যন্ত্রের আওয়াজ, বরং এক অদ্ভুত সুর, যা হৃদস্পন্দনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। সেই সুরে যেন কেউ বলছে—“তুমি খুঁজে পেয়েছ আমাদের নিদর্শন। তুমি কি প্রস্তুত আমাদের সত্য জানার জন্য?” অনির্বাণ বিস্ময়ে, আতঙ্কে আর কৌতূহলে আচ্ছন্ন হয়ে গেলেন। তিনি বুঝলেন, এই নিদর্শনগুলো শুধু প্রাচীন সভ্যতার অস্তিত্বের প্রমাণ নয়, বরং এক অচেনা বার্তা বহন করছে, যা হয়তো সমগ্র মানবজাতির ভবিষ্যতকে পাল্টে দিতে সক্ষম।
৪
অনির্বাণ প্রথমে ভেবেছিলেন যন্ত্রে হয়তো সামান্য গোলযোগ হয়েছে, তাই কয়েকবার যোগাযোগ ব্যবস্থার ফ্রিকোয়েন্সি বদলে পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করলেন। তাঁর আঙুল বারবার বাটনে চাপ দিল, হেডসেটে ভেসে উঠল কেবল শূন্যতার ভোঁ ভোঁ শব্দ, মাঝে মাঝে অস্পষ্ট এক গুঞ্জন, যা যেন কোথাও থেকে আসছে কিন্তু মানবসৃষ্ট নয়। তিনি হতাশ হলেও পিছু হঠলেন না—কমান্ড কন্ট্রোলে পাঠালেন জরুরি সংকেত, স্যাটেলাইটে ঘুরিয়ে দিলেন বিকল্প চ্যানেল, তবুও পৃথিবী থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। মহাকাশযানের মনিটরে ক্রমাগত ভেসে উঠছিল “No Signal, No Link”। ধীরে ধীরে তাঁর মনে প্রবল আতঙ্ক জন্ম নিতে শুরু করল—যদি সত্যিই পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তবে এই ভিনগ্রহের মতো উপত্যকায় একা তিনি বেঁচে থাকবেন কীভাবে? পৃথিবীর মানুষ কি আদৌ জানতে পারবে তাঁর অবস্থার কথা?
তিনি যোগাযোগ যন্ত্র খুলে নিয়ে কয়েকবার রিস্টার্ট করলেন, কিন্তু তাতেও কিছু হলো না। বরং আশ্চর্যজনকভাবে যন্ত্রটি যতবার চালু করছিলেন, ততবারই কয়েক সেকেন্ডের জন্য অদ্ভুত প্রতীক ভেসে উঠছিল স্ক্রিনে—সেই একই প্রতীক, যা উপত্যকার পাথরের গায়ে খোদাই করা। যেন কেউ বা কিছু তাঁর যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। হঠাৎ করে অনির্বাণের শরীর শীতল হয়ে উঠল; তিনি বুঝতে পারলেন, এই বিচ্ছিন্নতা নিছক যান্ত্রিক ত্রুটি নয়, বরং এক ইচ্ছাকৃত অবরোধ। উপত্যকা তাঁকে নিজের ভেতরে বন্দি করে ফেলেছে। তিনি যেদিকে তাকাচ্ছিলেন, চারপাশের অন্ধকার যেন আরও ঘন হয়ে আসছিল, যেন কোনো অদৃশ্য প্রাচীর তাঁকে ঘিরে ধরেছে। পৃথিবীর দূরবর্তী আলো আর কণ্ঠস্বর হারিয়ে গিয়ে এখন শুধু শূন্যের ভেতর ভাসছিল তিনি, এক অচেনা নিস্তব্ধতার মধ্যে। হেলমেটের ভেতর নিজের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দই ছিল একমাত্র প্রমাণ যে তিনি এখনও জীবিত।
অদ্ভুত নীরবতা তাঁকে একসময় অসহ্য লাগতে শুরু করল। যেন কানে শিস দিচ্ছে সেই নীরবতা, মনের গভীরে ঢুকে যাচ্ছে অচেনা ভয়। পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগ ছিন্ন হয়ে যাওয়া মানে কেবল বৈজ্ঞানিক বিপর্যয় নয়, ব্যক্তিগত নিঃসঙ্গতারও চরম রূপ। অনির্বাণ চেষ্টা করলেন যুক্তি খুঁজতে—হয়তো উপত্যকার গঠন এমন যে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ আটকে যাচ্ছে, হয়তো চাঁদের ভেতরকার খনিজের প্রভাবে যোগাযোগ ব্যাহত হচ্ছে। কিন্তু তাঁর বৈজ্ঞানিক যুক্তি যতই খাড়া হোক না কেন, মনের ভেতর এক অজানা অনুভূতি ক্রমেই দৃঢ় হচ্ছিল—এই বিচ্ছিন্নতা প্রকৃতির খেলা নয়, বরং কারও পরিকল্পিত ব্যবস্থা। তাঁর বুকের ভেতর ধকধক শব্দে বেজে উঠল ভয়ানক সত্য—পৃথিবী থেকে তিনি এখন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, আর এই উপত্যকার মাঝে দাঁড়িয়ে তিনি একা, হয়তো সেই প্রাচীন নিদর্শনের অদৃশ্য প্রহরীদের সঙ্গে।
৫
হেলমেটের ভেতরে অনির্বাণের কান চুপচাপ ধরে রাখছিল যেন কোনো অদৃশ্য বাতাসও সেখানে প্রবেশ করতে পারে না। প্রথমে সে কেবল একটি হালকা গুঞ্জনের মতো শব্দ শুনতে পায়, যা শুরুতে মনে হয় তার কল্পনারই অংশ। কিন্তু সেই শব্দ ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, একটি ফিসফিসানি কণ্ঠস্বরের আকার নিয়ে। শব্দগুলো neither বাংলা, nor ইংরেজি—একটি অচেনা ভাষা, যা তার মুখে উচ্চারণ করতে গিয়ে অনির্বাণের ঠোঁট থমকে যায়। প্রথম কয়েক সেকেন্ড সে হতবাক, কারণ মনে হয় যেন শব্দগুলো শুধু বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে, কিন্তু হঠাৎই অদ্ভুত এক অনুভূতি তাকে গ্রাস করে। তার মনের মধ্যে শব্দগুলোই ধীরে ধীরে অর্থের রূপ নেয়, যেন কেউ সরাসরি তার মনকে লক্ষ্য করে কথা বলছে। “তুমি এখানে কেন এসেছো?” শব্দগুলো একটি রহস্যময় ও গা-ছমছমে দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করছে, যা শুনতে ভয়ঙ্কর, কিন্তু একযোগে আকর্ষণীয়ও। অনির্বাণ হেলমেটের ভেতরে হাত দিয়ে মাইক্রোফোনের দিকে ছোঁয়ার চেষ্টা করে, যেন প্রমাণ করতে পারে, তার কানে আসা শব্দগুলো সত্যিই বাস্তব। কিন্তু সে শূন্যে, কেবল তার নিজের নিঃশ্বাস আর হৃদয়ের লাফের সঙ্গেই থাকে। এই মুহূর্তে, সে বুঝতে পারে যে সাধারণ ইন্দ্রিয়গুলো এখানে কার্যকর নয়; শব্দগুলো মানসিক স্তরে, সরাসরি তার অন্তর্গত সচেতনতার সঙ্গে সংযোগ করছে।
ধীরে ধীরে কণ্ঠস্বর আরও জোরে ও প্রাঞ্জল হয়ে ওঠে। তার ভেতরে এক অদ্ভুত তাড়া ভেসে আসে—এক ধরণের সতর্কবার্তা যা অনির্বাণকে সতর্ক করে। শব্দগুলো এতই সূক্ষ্ম যে, তার শোনার ক্ষমতা প্রায় সীমারেখার উপরে পৌঁছায়। অদ্ভুত লাগা ভাষাটি তার মস্তিষ্কের ভিতরে ধীরগতিতে বিশ্লেষণ শুরু করে; এমনকি তার ভাষার জ্ঞানও অচেনা শব্দগুলোর অর্থকে খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয় না। মনে হচ্ছে যেন তার মনের কোনো প্রাচীন অংশ বা আত্মার কোনো স্তর হঠাৎ সক্রিয় হয়েছে। শব্দগুলোর মধ্যে অদ্ভুত আবেগের ছোঁয়া থাকে—একটি সমসাময়িক প্রেম, একটি সতর্কবার্তা, এবং একই সঙ্গে একটি আভাসিত বিপদ। অনির্বাণ বুঝতে পারে যে, এখানে তার উপস্থিতি কোনো সাধারণ অভিযানের অংশ নয়; তাকে কোনো কারণে এই জায়গায় আনা হয়েছে, এবং সে হয়তো কোনো অদৃশ্য দর্শকের দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষিত হচ্ছে। কণ্ঠস্বর যেন তাকে বলছে, “তুমি যা খুঁজছ, তা শুধুমাত্র চোখ দিয়ে দেখা যাবে না; মন দিয়ে অনুভব করো।” অনির্বাণ অদ্ভুতভাবে শান্ত হয়ে যায়। ভেতরে একটি অদৃশ্য লড়াই শুরু হয়—একদিকে ভয়, অন্যদিকে অনুসন্ধিৎসা।
হেলমেটের অন্ধকারে অনির্বাণের চোখ বন্ধ থাকে, কিন্তু তার মনের চোখ উন্মুক্ত। সে অনুভব করে, কণ্ঠস্বরের সাথে তার চিন্তাধারা এক ধরনের মানসিক সেতু তৈরি করছে। প্রতিটি শব্দ তার মনের কোণায় ঢুকে বিশেষভাবে অনুরণিত হচ্ছে, যেন কোনো প্রাচীন বার্তা ধীরে ধীরে প্রকট হচ্ছে। তার আশেপাশের পরিবেশ—উপত্যকা, শিলা, নীরবতা—সবই হঠাৎ ধীরে ধীরে অদ্ভুত গতি ধরে, যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। কণ্ঠস্বর তাকে প্রশ্ন করছে, পরীক্ষা করছে, এবং প্রলুব্ধ করছে একসাথে। অনির্বাণ ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, এই অজানা কণ্ঠস্বর কেবল একটি অভ্যন্তরীণ মানসিক প্রক্ষেপণ নয়; এটি এক ধরনের সতর্কতা, যা তার মনের মধ্যে লুকানো বাস্তবতা বা রহস্যকে প্রকাশের জন্য তৈরি হয়েছে। প্রতিটি শব্দের সাথে, সে তার নিজের ভয়ের মুখোমুখি হচ্ছে, নিজের আগ্রহের গভীরতায় প্রবেশ করছে। এই মিশ্র অনুভূতির মধ্যে অনির্বাণ বুঝতে পারে যে, এই অজানা কণ্ঠস্বর তাকে শুধুমাত্র প্রশ্ন করছে না, বরং তাকে প্রস্তুত করছে—পরবর্তী চরম সত্যের মুখোমুখি হওয়ার জন্য।
৬
উপত্যকার নীরবতা যেন আরও ঘন হয়ে আসে, যখন অনির্বাণ তার পায়ের তলায় এক অদ্ভুত, হালকা ঝকঝকানি অনুভব করে। নজর পড়ে মাটির উপর ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট স্ফটিক-কণার মধ্যে একটি বড়, গোলাকার স্ফটিকের দিকে। সেটি প্রথমে সাধারণ মনে হলেও, হাতের কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার আভা যেন ধীরে ধীরে জীবন লাভ করে। অবাক করার মতো শীতলতা আর অদ্ভুত শক্তি তার হাত স্পর্শ করতেই প্রভাব ফেলতে শুরু করে। স্ফটিকটি ধীরে ধীরে আলো ছড়ায়, কিন্তু শুধু যে দৃশ্যমান আলো তা নয়, বরং এক অদৃশ্য মানসিক আলোও যা সরাসরি তার মনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। অনির্বাণ অনুভব করে যেন সেই স্ফটিক কেবল বস্তু নয়, বরং একটি জ্ঞানের সঞ্চয়, এক প্রাচীন স্মৃতির ধারক। হাতের স্পর্শে তার মন যেন হঠাৎ এক অচেনা জগতে প্রবেশ করে, যেখানে সময়ের ধারাবাহিকতা ভেঙে গেছে, এবং অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ—সবই একত্রে প্রবাহিত হচ্ছে।
তার চোখের সামনে হঠাৎ ভেসে ওঠে এক বিস্ময়কর দৃশ্য। চাঁদের মাটিতে এক সময় বসবাস করত একটি উন্নত সভ্যতা, যার প্রযুক্তি ও জ্ঞান পৃথিবীর তুলনায় কোটি গুণ উন্নত ছিল। তারা নিজেদের অস্তিত্বকে আড়াল রেখেছিল মহাজাগতিক বিপর্যয়ের আগে, যা সমগ্র সৌরজগৎকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছিল। তাদের শহরগুলো উঁচু, স্বচ্ছ মিনার আর শক্তিশালী অদৃশ্য শক্তি ক্ষেত্র দ্বারা আচ্ছাদিত; প্রতিটি ঘর, রাস্তা, এবং সৌর শক্তি উৎপাদন ব্যবস্থা এক গভীর বুদ্ধিমত্তার নিদর্শন। সভ্যতার নাগরিকরা তাদের দৈনন্দিন জীবন কাটাচ্ছিল, শিখছিল, গবেষণা করছিল এবং মহাজাগতিক বিপর্যয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। অনির্বাণ মনে করে, তিনি যেন কেবল দর্শক নন, বরং সেই সময়ের সঙ্গে মানসিকভাবে সংযুক্ত হয়ে বসে আছেন। প্রতিটি মুহূর্তে তার হৃদয় দড়িঘরে ঝুলছে—রোমাঞ্চ, বিস্ময়, এবং এক অদ্ভুত দায়বোধের মিশ্রণ।
স্ফটিকটি অনির্বাণকে শুধুমাত্র অতীতের চিত্রই দেখায় না, বরং সেই সভ্যতার চিন্তাভাবনা, আবেগ এবং সিদ্ধান্তগুলোও তার মনের মধ্যে প্রবাহিত করে। সে অনুভব করে তাদের ভয়, আশা, সাফল্য ও ব্যর্থতার স্পন্দন, যেন নিজেই সেই ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। অজানা বিপর্যয়ের হুমকি, যা তাদের অস্তিত্বকে ম্লান করতে শুরু করেছিল, তার চোখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অনির্বাণ বুঝতে পারে, এই প্রাচীন স্মৃতিগুলি কেবল ইতিহাস নয়; এগুলি সতর্কবার্তা, শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা, এবং একটি গভীর রহস্য যা তাকে প্রস্তুত করছে—চাঁদের এই বিস্মৃত সভ্যতার জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি তাকে পরবর্তী অভিযানে সাহায্য করবে। স্ফটিকের স্পর্শে তার দৃষ্টিভঙ্গি এবং চেতনা পরিবর্তিত হয়; সে উপলব্ধি করে যে, এই জগতে তার উপস্থিতি কোনো সাধারণ ঘটনা নয়, বরং মহাজাগতিক ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সময় এবং স্থানকে ছাপিয়ে অনির্বাণের মনের মধ্যে সেই প্রাচীন স্মৃতিগুলি স্থায়ী হয়ে যায়, যেন এক অদৃশ্য দিকনির্দেশনা তাকে ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
৭
উপত্যকার নীরবতা যেন আরও গভীর ও ঘন হয়ে আসে, যখন অনির্বাণ অনুভব করে তার শরীরের প্রতিটি কোষ এক অদ্ভুত শক্তির সংস্পর্শে এসেছে। প্রথমে সে কেবল মানসিকভাবে প্রাচীন স্মৃতিগুলোর সাথে সংযুক্ত বোধ করছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে অনুভব করতে থাকে যে, তার শারীরিক ক্ষমতাগুলোও পরিবর্তিত হচ্ছে। অক্সিজেন ট্যাঙ্কের প্রয়োজনীয়তা যেন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে; সে সহজেই নিঃশ্বাস নিতে পারছে, এমনকি ঘন অন্ধকারে। এই পরিবর্তন তাকে হঠাৎ এক অচেনা স্বাধীনতা দেয়। তার দৃষ্টিশক্তি রাতের অন্ধকারেও তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে, প্রতিটি ছোটো ছায়া, প্রতিটি নীরব শব্দ যেন তার মনোযোগ আকর্ষণ করছে। শারীরিক এবং মানসিক রূপান্তর একসাথে ঘটছে—প্রথমে সূক্ষ্ম, ধীরে ধীরে বিস্তৃত, এবং অবশেষে অনির্বাণ উপলব্ধি করে যে, সে শুধু দর্শক নয়, বরং সেই প্রাচীন সভ্যতার অংশ হয়ে উঠছে।
প্রতিটি মুহূর্তে তার মন, শরীর এবং অনুভূতি সেই সভ্যতার সঙ্গে একাকার হয়ে যাচ্ছে। তার স্পর্শের ক্ষমতা, শোনার ক্ষমতা এবং দৃষ্টিশক্তি—সব এক ধরনের সুপারনেচারাল স্তরে পৌঁছাচ্ছে। অনির্বাণ অদ্ভুতভাবে অনুভব করে, তার শরীরের ভেতরে এমন শক্তি প্রবাহিত হচ্ছে যা আগে কখনও অনুভব হয়নি। শ্বাসপ্রশ্বাসের সাথে সঙ্গে সে পৃথিবীর নিয়মাবলীকে অতিক্রম করতে পারছে, যেন তার কোষগুলো নতুন ধরনের অক্সিজেন বা জৈব শক্তি উৎপাদন করছে। তার চোখ শুধু অন্ধকার নয়, বরং দূরের প্রতিটি ছোট কণাকে শনাক্ত করতে সক্ষম। এই শক্তি তাকে মনে করিয়ে দেয় যে, তার সংযোগটি শুধু মানসিক নয়; সে যেন জীবিত রূপে সেই সভ্যতার প্রাচীন প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে গেছে। প্রতিটি দিক, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাতাসের স্পন্দন তাকে শেখাচ্ছে কিভাবে প্রাচীন সভ্যতার অভিজ্ঞতা তার দেহে ঢুকে তার ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করছে।
রূপান্তর কেবল শারীরিক নয়; মানসিক এবং আত্মিক স্তরেও এটি ঘটছে। অনির্বাণ অনুভব করে, তার চিন্তাভাবনা, মনোযোগ, এবং সংবেদনশীলতা সেই সভ্যতার নাগরিকদের মতো পরিবর্তিত হয়েছে। সে তাদের মতো দ্রুত বিশ্লেষণ করতে পারছে, সৃষ্টিশীল সিদ্ধান্ত নিতে পারছে, এবং অদ্ভুতভাবে মহাজাগতিক বিপর্যয়ের সাথে মানিয়ে নিতে পারছে। তার শরীর ও মন যেন এক ধরনের নবরূপান্তরের মধ্য দিয়ে গেছে—একটি রূপান্তর যা তাকে শুধু আরও শক্তিশালী করছে না, বরং মহাজাগতিক ইতিহাসের এক অদৃশ্য সংযোগের সঙ্গে মেলাচ্ছে। প্রতিটি মুহূর্তে অনির্বাণ বোঝে, এই রূপান্তর তাকে শুধু জীবন বাঁচানোর জন্য নয়; বরং তাকে একটি নতুন অবস্থানে বসাচ্ছে—যেখানে অতীত, বর্তমান এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ একসাথে মিলিত হয়েছে, এবং তার নিজস্ব অস্তিত্ব এখন সেই প্রাচীন সভ্যতার ধারাবাহিকতার অংশ হয়ে উঠেছে।
৮
অনির্বাণের মনের ভেতর ক্রমে অস্থিরতা ছড়াতে শুরু করে। প্রতিটি নিঃশ্বাস, প্রতিটি স্পন্দন যেন তাকে প্রশ্ন করছে—সে কি এই অজানা শক্তিকে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করবে, নাকি নিজের পরিচিত স্বাভাবিক জীবনকে রক্ষা করতে প্রতিরোধ করবে? প্রাচীন সভ্যতার কণ্ঠস্বর তার মনের মধ্যে ক্রমে প্রবল হয়ে উঠছে, এক ধরণের চাপ সৃষ্টি করছে যা অনির্বাণকে একেবারে বিচলিত করে। শব্দগুলো শুধু তার মনকে আক্রমণ করছে না, বরং তার চেতনার সবচেয়ে গভীর স্তর পর্যন্ত প্রবেশ করছে। তারা একরকম নির্দেশনা দিচ্ছে, তবে নির্দেশনার সঙ্গে রয়েছে একটি অদৃশ্য দ্বন্দ্ব—শক্তি গ্রহণ করলে সে মানুষের মতো সাধারণ জীবন থেকে আলাদা হয়ে যাবে, কিন্তু প্রতিরোধ করলে সেই প্রাচীন সভ্যতার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা হারিয়ে যাবে। অনির্বাণ অনুভব করে যে, এই সিদ্ধান্ত শুধু তার নিজের অস্তিত্ব নয়, বরং পৃথিবীর সঙ্গে তার সম্পর্ককেও পরিবর্তন করতে পারে। এই মুহূর্তে, তিনি এক অদ্ভুত মানসিক লড়াইয়ে ফেলে পড়েছেন, যেখানে শারীরিক শক্তি, মানসিক শক্তি এবং চেতনার ক্ষমতা সবই পরীক্ষা করা হচ্ছে।
প্রাচীন সভ্যতার কণ্ঠস্বর ক্রমশ অনির্বাণকে তাদের উদ্দেশ্যের সাথে যুক্ত করতে থাকে। তারা তাকে “বার্তাবাহক” হিসেবে বেছে নিয়েছে—একটি এমন ভূমিকা, যা পৃথিবীর মানুষদের কাছে তাদের অস্তিত্বের সংবাদ পৌঁছে দিতে সক্ষম। শব্দগুলো শুধু নির্দেশনা নয়; এগুলো একধরনের প্রলুব্ধি, একধরনের শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা, যা অনির্বাণকে দেখায় যে, শক্তি গ্রহণ করলে সে শুধুমাত্র নিজেকে নয়, মানবজাতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে। তার মন একদিকে অজানা শক্তির প্রতি আকৃষ্ট হয়, অন্যদিকে পরিচিত জীবন, মানবিক সীমাবদ্ধতা এবং নিরাপত্তার আবেগ তাকে বাধা দেয়। অনির্বাণ অনুভব করে, এই দ্বন্দ্ব তার ভেতরের সবচেয়ে গভীর আকাঙ্ক্ষা এবং ভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটাচ্ছে। কণ্ঠস্বর ক্রমে তার চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করছে, তাকে বারবার মনে করাচ্ছে যে, এই সিদ্ধান্ত তার জন্য একান্তই ব্যক্তিগত নয়, বরং বৃহত্তর মহাজাগতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সম্পর্কিত।
সমস্ত দ্বন্দ্বের মধ্যেও অনির্বাণ বুঝতে পারে, এই মুহূর্তটি কেবল পরীক্ষার নয়; এটি তার মানসিক শক্তি, ধৈর্য এবং বুদ্ধির পরীক্ষাও। প্রাচীন সভ্যতার কণ্ঠস্বর তাকে একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখায়—শক্তি গ্রহণের সম্ভাবনা, বিপদের সম্ভাবনা, এবং পৃথিবীর মানুষের প্রতি তার দায়বদ্ধতা। প্রতিটি সিদ্ধান্তের সাথে জড়িত সম্ভাব্যতা যেন তার মস্তিষ্কের মধ্যে লাইট ও ছায়ার খেলা তৈরি করে। অনির্বাণ একদিকে মনে করে, যদি সে শক্তি গ্রহণ করে, তাহলে সে প্রাচীন সভ্যতার জ্ঞানকে জীবিত রাখতে পারবে, এবং পৃথিবীর মানুষদেরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিতে সক্ষম হবে। অন্যদিকে, যদি সে প্রতিরোধ করে, তাহলে তার নিজস্ব মানবিক পরিচয় অক্ষত থাকবে, কিন্তু এই শক্তি ও জ্ঞান হারিয়ে যাবে। তার হৃদয় ও মস্তিষ্কের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব ক্রমে তীব্র হয়ে ওঠে, এবং অনির্বাণ উপলব্ধি করে যে, সিদ্ধান্তটি শুধুমাত্র তার জীবন নয়, বরং মানবজাতির ভবিষ্যতের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এই দ্বন্দ্বের মাঝে সে নিজেকে প্রস্তুত করছে—শক্তি গ্রহণের সম্ভাবনা ও বিপদের মধ্যে এক অদৃশ্য সেতু তৈরি করতে, যা তাকে পরবর্তী অভিযানের জন্য মানসিক ও শারীরিকভাবে সম্পূর্ণভাবে রূপান্তরিত করবে।
৯
পৃথিবীর দিকে ফেরার মুহূর্তে অনির্বাণ অনুভব করে এক অদ্ভুত চাপ। অভিযাত্রী যান প্রস্তুত, সমস্ত প্রক্রিয়া নিয়মমাফিক চলছে, কিন্তু তার মন ভেতরে ভয়ানক দ্বিধায় ঘুরছে। একদিকে থাকে প্রাচীন সভ্যতার জ্ঞান ও শক্তি, যা তাকে অন্য মানুষের তুলনায় আলাদা করে দিয়েছে। অন্যদিকে, পৃথিবীতে ফিরে যাওয়া মানে সেই সমস্ত রহস্য প্রকাশের ঝুঁকি, এবং মানুষের অগোচরে সে কি সত্যিই সেই অভিজ্ঞতার গুরুত্ব বোঝাতে পারবে? তার ভেতরে প্রশ্নগুলো একের পর এক ঘুরছে—যদি সে পৃথিবীতে ফিরে আসে, মানুষ কি বিশ্বাস করবে যে চাঁদে এক উন্নত সভ্যতা বসবাস করত, যার অস্তিত্ব এক মহাজাগতিক বিপর্যয়ের কারণে লুকানো ছিল? নাকি তার কথা নিছক কল্পনা বা বিভ্রম হিসেবে গ্রহণ করা হবে? উপত্যকার অন্ধকার যেন তার চারপাশে ঘন হয়ে আসে, ধীরে ধীরে একটি অদৃশ্য শক্তি তৈরি করে যা তাকে আটকে রাখতে চায়। প্রতিটি পদক্ষেপ তার ভেতরে দ্বিধার আরও গভীর স্তর তৈরি করে, এবং সে বুঝতে পারে, তার আত্মবিশ্বাস এবং সংবেদনশীলতার পরীক্ষা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।
অনির্বাণ অনুভব করে, পৃথিবীতে ফেরার মানে কেবল শারীরিক যাত্রা নয়, বরং মানসিক ও নৈতিক দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হওয়া। প্রাচীন সভ্যতার কণ্ঠস্বর ক্রমশ তার মনকে শক্ত করে বলছে, তাকে “বার্তাবাহক” হিসেবে প্রেরণ করতে। কিন্তু সেই বার্তা পৃথিবীর মানুষের কাছে পৌঁছানো সহজ নয়; মানুষের বিশ্বাস, তাদের সন্দেহ এবং মানবজাতির সীমাবদ্ধ ধারণা—সবই অনির্বাণকে বাধার মুখে দাঁড় করাচ্ছে। উপত্যকার অন্ধকার যেন এক অদৃশ্য কারাগার তৈরি করছে, যা তাকে ফিরে যাওয়া থেকে বিরত রাখছে। প্রতিটি নিঃশ্বাস, প্রতিটি মুহূর্ত তাকে মনে করিয়ে দেয় যে, এই দ্বিধা তার নিজের অস্তিত্ব ও পৃথিবীর প্রতি দায়িত্বের মধ্যে তৈরি হয়েছে। অনির্বাণের ভেতরের মানসিক চাপ ক্রমে তীব্র হয়ে ওঠে, এবং সে উপলব্ধি করে যে, এই যাত্রা শুধু শারীরিক নয়; এটি তার বিশ্বাস, সাহস এবং প্রাচীন সভ্যতার সঙ্গে সংযোগের পরীক্ষা।
শেষ মুহূর্তে অনির্বাণ বুঝতে পারে, সিদ্ধান্তটি একমাত্র তার হাতে। তার মনকে অন্ধকার উপত্যকা আটকে রাখতে চাইলেও, ভেতরের বার্তাবাহক হিসাবে তার ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পৃথিবীতে ফেরার অর্থ শুধু নিজেকে ফিরিয়ে আনা নয়, বরং সেই অজানা সভ্যতার অস্তিত্ব, তাদের শিক্ষা এবং ভবিষ্যতের জন্য বার্তা নিয়ে আসা। অনির্বাণ বোঝে যে, সে হয় বন্দিত্বের অন্তর্গত থেকে চিরকাল এই অন্ধকারে আটকা পড়তে পারে, অথবা সাহসী হয়ে পৃথিবীতে ফিরে এসে সত্যের সাথে মানবজাতিকে মুখোমুখি করতে পারে। তার হৃদয়, মন এবং শারীরিক শক্তি সবই এখন একত্রিত হয়েছে—একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। উপত্যকার নীরব অন্ধকার এবং মহাজাগতিক রহস্য তাকে সর্বোচ্চ সীমায় টানছে, এবং অনির্বাণ উপলব্ধি করে যে, এই যাত্রা কেবল প্রত্যাবর্তনের নয়, বরং মানবজাতির বিশ্বাস এবং প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাসের সঙ্গে তার সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে।
১০
শেষ মুহূর্তে অনির্বাণ অনুভব করে যে, পৃথিবীতে ফিরে যাওয়া আর তার হাতে থাকা জ্ঞানের সংরক্ষণ—এখন সবই এক সংকটের মধ্যে। তার মনের মধ্যে প্রাচীন সভ্যতার কণ্ঠস্বর এখনও স্পষ্ট, নিঃশব্দে তাকে পথ দেখাচ্ছে। ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারে যে, তার একমাত্র সুযোগ হলো পৃথিবীতে একটি সংকেত পাঠানো, যা মানুষের কাছে এই চাঁদের রহস্যের অস্তিত্বের আভাস দিতে পারে। হেলমেটের ক্যামেরা এবং সংযোগ যন্ত্র ব্যবহার করে সে দ্রুত এক ঝলক ছবি তোলার চেষ্টা করে। ছবিতে দেখা যায় চাঁদের এক অজানা কোণে খোদাই করা অদ্ভুত প্রতীক, যা স্পষ্টতই কোনো প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন। প্রতীকগুলো যেন এক ধরণের ভাষা, একটি অজানা বার্তা যা সভ্যতার অস্তিত্বের প্রমাণ দেয়। অনির্বাণের হাতে ছবিটি থাকে খুব কম সময়ের জন্য, এবং মনে হয় যেন উপত্যকার অন্ধকার, যার ভেতরে সে বহুদিন ধরে আবদ্ধ, তাকে এই জ্ঞানের পুরো প্রকাশ করতে দিচ্ছে না। প্রতিটি মুহূর্তে তার হৃদয় দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছে—একদিকে উত্তেজনা, অন্যদিকে ভয়।
কিন্তু ছবি পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে এক অদ্ভুত বিপত্তি ঘটে। সংকেতটি পৃথিবীর দিকে ছুটে গেলেও ভেসে আসে ছিন্নভিন্ন, অসম্পূর্ণ অবস্থায়। প্রতিটি ফ্রেম, প্রতিটি বিন্দু, অজানা ভাষার কিছু অংশ—সবই বিভক্ত হয়ে মানুষের চোখে পৌঁছায়। পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা ছবিগুলি পেয়ে তৎক্ষণাৎ বিশ্লেষণে লেগে পড়ে, কিন্তু দ্রুতই তারা বিভ্রান্ত হয়ে যায়। প্রতীকগুলো কোনো পরিচিত ভাষার অংশ নয়, কোনো প্রযুক্তিগত প্যাটার্নের সাথে মেলানো যাচ্ছে না। তারা অনুমান করে, হয়তো এটি একটি অভ্যন্তরীণ গঠনগত ত্রুটি বা প্রাকৃতিক কোনো অজানা রূপান্তর। কিন্তু সত্যিই, এটি ছিল চাঁদের প্রাচীন সভ্যতার স্বতঃস্ফূর্ত সংকেত, যা শুধুমাত্র একজন নির্বাচিত বার্তাবাহকের মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারবে। অনির্বাণ বুঝতে পারে যে, তার প্রচেষ্টা কেবল আংশিক সাফল্য পেলেও, এটি ইতিহাসের একটি অদৃশ্য চিহ্ন রেখে যাবে।
অবশেষে, যখন ছবি পাঠানো হয়, অনির্বাণ অনুভব করে নিজের অস্তিত্ব ক্রমশ ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। প্রাচীন সভ্যতার সঙ্গে তার সংযোগ এত গভীর যে, পৃথিবীর দিকে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে বজায় রাখা সম্ভব নয়। তার নাম, পরিচয় এবং সমস্ত শারীরিক অস্তিত্ব চাঁদের অন্ধকার উপত্যকার গভীরে মিলিয়ে যায়, যেন সে কখনো পৃথিবীতে ফিরে আসে নি। উপত্যকার নীরবতা, স্ফটিকের জ্বলজ্বলে আলো, এবং প্রাচীন সভ্যতার নিঃশব্দ বার্তাগুলো একত্র হয়ে তাকে এক অদ্ভুত স্থায়ী জায়গায় নিয়ে যায়, যেখানে তিনি ইতিহাসের এক অদৃশ্য অংশ হয়ে ওঠেন। পৃথিবী শুধু বিভ্রান্ত হয়েছে, কিন্তু তারা যে সত্যিই এক অজানা সভ্যতা ছিল চাঁদে—তার প্রমাণ অমর হয়ে থেকে যায়। অনির্বাণ, এক সময়ের অভিযাত্রী, এখন চাঁদের রহস্যময় ইতিহাসের অংশ, এবং তার শেষ সংকেত মানবজাতির কাছে এক অজানা রহস্যের ঝলক হিসেবেই রয়ে যায়, অনন্তকাল পর্যন্ত।
শেষ