Bangla - প্রেমের গল্প

চরিত্রের বাইরে

Spread the love

পর্ব ১

আনন্দবাজারের শেষ পাতায় ছোট একটা বিজ্ঞাপন ছিল—“থিয়েটার ওয়ার্কশপ: কেউ যদি মঞ্চের আলোয় হাঁটতে চান, আসুন। বয়স, পেশা, অভিজ্ঞতা—সব এক পাশে সরিয়ে রাখুন।” রুদ্রর চোখে পড়েছিল বিজ্ঞাপনটা এক শনিবারের সকালে, যখন সে অফিস যাওয়ার আগেই হাঁপিয়ে উঠছিল জীবনের নিয়মে বাঁধা পড়ে। কর্পোরেট অফিসের কাঁচের জানালা দিয়ে সে প্রতিদিন শহরটাকে দেখে, কিন্তু তাতে কিছুই দেখা হয় না। ফাইল, মিটিং, টার্গেট—সব কিছুর মধ্যে কোথাও যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। নাটকের সাথে তার কোনো যোগাযোগ ছিল না, কিন্তু শব্দটা ‘চরিত্র’ যেন কেমন করে তার গায়ে লেগে গিয়েছিল। নিজের চরিত্রটা কেমন, সেটাই সে বুঝতে পারছিল না।

ওয়ার্কশপের প্রথম দিন ছিল রবিবার। গলফ গ্রিনের একটা পুরনো কমিউনিটি হলে, কাঠের গন্ধমাখা ঘর, হালকা কুয়াশায় ঢাকা সকাল। রুদ্র ভেবেছিল, সবাই বুঝি তরুণ ছাত্রছাত্রী, ক্যাম্পাসে নাটক করা ছেলে-মেয়ে। কিন্তু সেখানে পৌঁছে সে অবাক হয়ে গিয়েছিল। পাঁচজনের ছোট্ট দল—একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক, একজন গৃহবধূ, একজন কলেজের ছাত্র, একজন বাস কন্ডাক্টর এবং মৃণালিনী।

সে প্রথমে চোখে পড়ে যায়, কারণ মঞ্চের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল সে, আর হাতে ধরা ছিল একটা পরিত্যক্ত রুমালের টুকরো। “এটা আমার সংলাপ নয়,” সে বলছিল, “এই রুমালটা আমার চরিত্রের স্মৃতি।” তার গলা ভারী ছিল না, বরং ধীরে গলা নামিয়ে বলছিল যেন নিজেকেই বোঝাচ্ছে। তার পরনে ছিল সাধারণ সালোয়ার-কামিজ, চুল খোলা, চোখে ছিল একধরনের ধরা না পড়া ক্লান্তি। রুদ্র বুঝে গিয়েছিল—এই মেয়েটা আলাদা।

ওয়ার্কশপটা পরিচালনা করছিলেন প্রদ্যুত বসু, কলকাতার একজন বয়স্ক থিয়েটার পরিচালক, যার নাটক এখন আর শহরের মঞ্চে চলে না, কিন্তু ভেতরে আগুন এখনো বেঁচে আছে। প্রথম দিনের কাজ ছিল—‘নিজের নাম বাদ দিয়ে নিজের পরিচয় দাও।’ কেউ বলল—“আমি ভাঙা সময়ের রাধা।” কেউ বলল—“আমি অপেক্ষার চায়ের কাপ।” রুদ্র কিছু বলতে পারছিল না। অবশেষে সে বলল, “আমি ভুল চরিত্রে জন্ম নেওয়া একটা মানুষ।”

প্রদ্যুত একটুও হাসলেন না, শুধু বললেন—“ভালো শুরু।”

এরপরের এক ঘণ্টা কেটেছিল নীরব অভ্যস্ততা ভাঙার খেলায়। চেয়ারে বসে একে অপরকে খেয়াল করা, শব্দ ছাড়া গল্প বলা, চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকা—সবই যেন অচেনা এক অস্পষ্টতার মধ্যে জন্ম নিচ্ছিল। মৃণালিনী বারবার চোখ রাখছিল রুদ্রর দিকে, আর রুদ্র চেষ্টা করছিল যেন সেটা সে না টের পায়।

লাঞ্চব্রেকে ওদের সঙ্গে কিছু কথা হয়। মৃণালিনী বলল, “তুমি কি আগে কখনো থিয়েটার করেছো?” রুদ্র মাথা নেড়ে না বলল।
“তাহলে এসেছো কেন?”
রুদ্র একটু থেমে বলল, “জানি না, কিন্তু মনে হচ্ছে নিজের কিছু কথা অন্য চরিত্রের মধ্যে গিয়ে বললেই হয়তো ভালো লাগবে।”
মৃণালিনী হেসে বলল, “তবে তো তুমি ঠিক জায়গায় এসেছো।”

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে রুদ্র টেবিলে রাখা নিজের অফিস ফাইলগুলো দেখল, যেন ওগুলো কারও আর লাগছে না। তারপর সে বের করল একটা পুরনো ডায়েরি। অনেক দিন পর কলম হাতে নিল, এবং লিখল—“আজ আমি নতুন একটা চরিত্রে পা রাখলাম। চরিত্রের বাইরে একটা নতুন মানুষ দেখা যাচ্ছে কি?”

এখনও কেউ জানত না, এই দুই মানুষ, রুদ্র আর মৃণালিনী, থিয়েটারের ছায়ায় দাঁড়িয়ে এক এমন নাটকে জড়িয়ে পড়তে চলেছে—যেটা লেখা নেই কোনো স্ক্রিপ্টে, নেই কোনো ক্লাইম্যাক্সেও। গল্পটা ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে, মঞ্চের আলোয় নয়, বরং চরিত্রের বাইরের অন্ধকারে।

পর্ব ২

পরের কয়েকটা দিন যেন রুদ্রর জীবনের ছন্দ বদলে দিল। অফিসের কাজ আগের মতোই ছিল—সকাল ন’টা থেকে সন্ধে ছ’টা অবধি ডেডলাইন, কনফারেন্স কল, আর একঘেয়ে প্রেজেন্টেশন। কিন্তু মনের মধ্যে কেমন যেন একটা অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করত। বিকেল নামলেই তার চোখে ভেসে উঠত সেই পুরনো হলঘরের কাঠের গন্ধ, প্রদ্যুতদার গলা, আর মৃণালিনীর চোখ।

ওয়ার্কশপের তৃতীয় দিন ছিল “ইম্প্রোভাইজেশন এক্সারসাইজ”। কোনও স্ক্রিপ্ট ছাড়াই নিজেদের মনের গভীর থেকে চরিত্র তুলে আনতে বললেন প্রদ্যুত। দুজনকে একজোড়া করে একটানা তিন মিনিট সংলাপ বলার নির্দেশ দেওয়া হল। রুদ্রর জুটিতে পড়ল মৃণালিনী।

দুইজন চুপচাপ একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ মৃণালিনী নিজের সুরে বলল, “তুমি দেরি করে এসেছো। জানো না, আমি অপেক্ষা করতে পারি না?”
রুদ্র একটু থমকে গিয়ে বলল, “আমি দেরি করিনি। সময়ই হয়তো ভুল জায়গায় পৌঁছেছে।”
তারপর তারা কথা চালিয়ে গেল—কারো হাতে লেখা স্ক্রিপ্ট ছাড়া, নিজের অভিজ্ঞতা ও কল্পনাকে চরিত্র করে। দর্শক বলতে বাকিরা—কিন্তু ঘরটা তখন থমথমে, নিঃশব্দ।

শেষে প্রদ্যুত বললেন, “এই তো, শুরু হল। মঞ্চের ভাষা তখনই জন্ম নেয়, যখন মনের কথা আর বাস্তবের সংলাপ একে অপরকে চেনে না, অথচ জড়িয়ে ধরে।”

ওয়ার্কশপ শেষে বেরিয়ে রুদ্র আর মৃণালিনী একসঙ্গে হাঁটছিল গলফ গ্রিনের ফাঁকা রাস্তা ধরে। বাতাসে শীতের হালকা ছোঁয়া, চারপাশে পল্লবী ফুলের গন্ধ।
রুদ্র জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী করো, থিয়েটার ছাড়া?”
মৃণালিনী বলল, “স্কুলে পড়াই, বাংলার টিচার। কিন্তু ছুটির পর এই হলটাই আমার সত্যি ক্লাসরুম।”
রুদ্র হাসল, “আর আমি দিনের বেলা হেড অফিসের ঘোরে থাকা একটা ম্যানেজার, সন্ধ্যায় একটা হারিয়ে যাওয়া মানুষ। মঞ্চে এসে খুঁজে ফিরি—আমি কে।”

তখন মৃণালিনী থেমে গিয়ে বলল, “তোমার চোখে মাঝে মাঝে কুয়াশা জমে, ঠিক যেমন মঞ্চে আলো পড়লে ছায়াটা স্পষ্ট হয় না।”
রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তুমি আমার চোখের ছায়া দেখছো?”
“হ্যাঁ,” মৃণালিনী বলল, “কারণ আমি নিজেও ছায়া। দিনের আলোয় কেউ দেখে না, শুধু সন্ধ্যার পর দেখা যায়।”

সেই রাতে রুদ্র নিজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক কাপ চা হাতে ভাবছিল—এই মেয়েটা ঠিক কী? সে কি একজন অভিনেত্রী? নাকি এমন একজন, যে জীবনের ভাঙা জায়গাগুলোকে সংলাপে রূপ দেয়? তার মনে হল, মৃণালিনী যেন এক চলমান নাটক, যার প্রতিটা দৃশ্য নতুন, অথচ কোথাও গভীরভাবে পরিচিত।

তারপর সে ফোনটা নিয়ে একটা মেসেজ টাইপ করল—
“আজকের সংলাপটা শুধু সংলাপ ছিল না, একটা জানালা খুলেছিল। ধন্যবাদ।”
আর পাঠানোর আগে, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল ‘Send’ বোতামে।

শেষে মেসেজটা না পাঠিয়েই, সে ড্রাফট রেখে ঘুমাতে গেল।

কিন্তু মনের মঞ্চে সংলাপ চলতেই থাকল।

পর্ব ৩

ওয়ার্কশপের পঞ্চম দিন ছিল “চোখে চোখ রাখার” অনুশীলন। প্রদ্যুত বসু বোর্ডে চক দিয়ে লিখেছিলেন—“তোমার চরিত্রের মন খারাপ কোথায় লুকিয়ে থাকে, জানো?”
তারপর তিনি বললেন, “আজ আমরা মুখ নয়, চোখ দিয়ে অভিনয় করব। শব্দ নিষিদ্ধ। চেহারার ভাষা খুঁজে আনতে হবে চোখের ভিতর থেকে।”

দু’জন দু’জন করে সবাইকে বসিয়ে দেওয়া হল। নিয়ম সোজা—এক মিনিট তাকিয়ে থাকতে হবে একে অপরের চোখে। না হাসা, না মুখ ঘোরানো, না কিছু বলা।

রুদ্রর সামনে বসেছিল মৃণালিনী।

প্রথম ক’সেকেন্ড যেন দুইজনেই শীতল। তারপর ধীরে ধীরে ভেতরের কিছু খুলে যেতে লাগল। মৃণালিনীর চোখে ছিল একধরনের গোপন ক্লান্তি, যেন একা যুদ্ধ করা কারও দীর্ঘ নিঃশ্বাস। রুদ্রের চোখে জমেছিল অভ্যস্ত একাকিত্ব, যার গায়ে কর্পোরেট শার্ট পরে প্রতিদিন সে নিজেকে ভুলে যায়।

তাদের মাঝখানে কোনও সংলাপ ছিল না, তবুও অনেক কিছু বলে দেওয়া হয়ে যাচ্ছিল।

অভিনয়ের শেষে, প্রদ্যুত বললেন, “ভালোবাসার সংলাপ চিৎকার করে বলা যায় না। ওটা চোখ দিয়ে আসে। আজ কেউ কেউ সেটা করেছে। কেউ কেউ লুকিয়েছে। আর কেউ কেউ—হারিয়ে ফেলেছে।”

ওয়ার্কশপ শেষে মৃণালিনী বলল, “তোমার চোখে একটা গল্প আছে।”
রুদ্র বলল, “তুমি কি সেটা পড়তে পারো?”
“হয়তো না,” মৃণালিনী হেসে বলল, “কিন্তু আমি সেটা বুঝতে পারি।”

দু’জন হাঁটছিল পার্ক স্ট্রিটের ফুটপাথ ধরে, চায়ের দোকান পেরিয়ে, ট্র্যামে ওঠার মতো দোলা খেতে খেতে।

“তুমি জানো?” মৃণালিনী হঠাৎ বলল, “আমি আগে কখনো কারো চোখে এত নির্জনতা দেখিনি। সেটা ভয়ংকরও, কিন্তু সুন্দরও।”
রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আসলে, নিজের সঙ্গে কথা বলার আর কেউ ছিল না।”
“তাই তো থিয়েটারে এসেছো?”
“হয়তো। চরিত্রে ঢুকলেই নিজের থেকে বেরিয়ে আসা যায়। চরিত্রের বাইরে হাঁটা মানে তো নিজের ভিতরটায় ফিরে যাওয়া।”

মৃণালিনী থেমে গেল, তার মুখে যেন অদ্ভুত প্রশান্তি।
সে বলল, “আমার প্রথম প্রেম থিয়েটারে এসেই হয়েছিল। কিন্তু সে আমাকে নয়, আমার অভিনয়কেই ভালোবেসেছিল। আমি যেই চরিত্র থেকে বেরিয়ে এলাম, সে চলে গেল।”
রুদ্র তাকিয়ে রইল তার দিকে। মেয়েটার কথার মধ্যে যেন সব শব্দ ঢুকে যাচ্ছে দৃষ্টির গভীরে।
সে বলল, “তুমি কি তখন থেকে চরিত্রেই আছো?”
মৃণালিনী মাথা নাড়ল, “হয়তো। হয়তো আমি নিজেকেই ভুলে গেছি কোনটা আমার আসল চরিত্র।”

সেই রাতে দু’জনেই ঘুমাতে পারল না। একজন বারান্দায় দাঁড়িয়ে চাঁদের আলোয় নিজের হাতের ছায়া দেখছিল, অন্যজন খাতা খুলে লিখছিল—
“চোখ দিয়ে শুরু হওয়া গল্প কি শব্দে শেষ হয়? নাকি সে চুপ থেকেই বড় হয়ে ওঠে?”

চরিত্রে তারা দুজনেই ঢুকে পড়ছিল, কিন্তু কে কার ভূমিকায়—তা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না।

পর্ব ৪

সপ্তাহ পেরোলো। ওয়ার্কশপের প্রতিটি দিন যেন একটু একটু করে বদলে দিচ্ছিল রুদ্র আর মৃণালিনীর ভেতরের পৃথিবিকে। কর্পোরেট ফাইল আর মঞ্চের আলো—এই দুই বিপরীত জগতে যাওয়া-আসার মধ্যে এক অদ্ভুত টান তৈরি হচ্ছিল। ওদের মাঝে কোনও চুক্তি ছিল না, কোনও কথা হয়নি ‘ভালোবাসি’ শব্দটা নিয়ে, কিন্তু প্রতিটি অনুশীলন যেন তাদের আরো কাছে এনে দিচ্ছিল, সংলাপ ছাড়াই।

সেদিন প্রদ্যুত বসু বললেন, “আজকের অনুশীলন—দুটো চরিত্র, যারা প্রেমে পড়ে, কিন্তু কোনোকালে তা বলা হয়নি। তারা একটি বেঞ্চে বসে আছে, এবং কেউ কথা বলছে না। পাঁচ মিনিট—কেবল উপস্থিতি।”

রুদ্র ও মৃণালিনী আবার একসঙ্গে। মঞ্চে একটি কাঠের বেঞ্চ রাখা। হলঘরে সব আলো নিভে গেল, শুধু একটি স্পটলাইট পড়ল বেঞ্চের ওপর।

তারা বসে পড়ল, ঠিক এক হাত ফাঁকে। রুদ্রর ডান হাত তার হাঁটুর ওপর রাখা, মৃণালিনীর বাঁ হাত তার ওড়নার ভাঁজে গুঁজে। তাদের চোখ সামনের দিকে, অথচ মনের ভিতরে যেন কথার ঝড়। দর্শক বলতে বাকি ওয়ার্কশপের ছাত্রছাত্রীরা, কিন্তু সকলের নিঃশ্বাসও যেন ধরা ছিল।

এক মিনিট। দুই। তিন…

হঠাৎ মৃণালিনী খুব ধীরে তার পায়ের জুতো খুলে ফেলল, পায়ের আঙুল দিয়ে মেঝের ওপর বৃত্ত আঁকছিল। রুদ্র তাকাল না, কিন্তু চোখ নড়ে উঠল সামান্য।

চতুর্থ মিনিটে, রুদ্র তার হাত একটুখানি সামনের দিকে এগিয়ে আনল, যেন কিছু বলবে, কিন্তু থেমে গেল।

পাঁচ মিনিট শেষে আলো নিভে গেল।

ঘর নিস্তব্ধ। প্রদ্যুত দাঁড়িয়ে বললেন, “বেশি শব্দ প্রয়োজন হয় না। দু’জন যদি সত্যিই কাছে আসে, নিঃশব্দও দর্শনীয় হয়ে ওঠে।”

চলতে চলতে, বেরিয়ে আসার পথে, রুদ্র জিজ্ঞেস করল, “তুমি তো ওই জুতো খোলার ব্যাপারটা প্ল্যান করোনি, করেছিলে?”
মৃণালিনী হেসে বলল, “না, কিন্তু ওটা হয়েই গেল। হয়তো আমার চরিত্র চাইছিল একটু হালকা হতে।”
রুদ্র বলল, “তুমি জানো? আমি সত্যিই ভুলে গিয়েছিলাম আমরা অভিনয় করছিলাম।”

মৃণালিনী তাকাল তার দিকে। গলায় ছিল কৌতুক মেশানো কোমলতা।
“তাহলে তো তুমি ঠিক পথে এগোচ্ছো। একদিন যখন তুমি নিজের জীবনটা মঞ্চ ভেবে নেবে, তখনই বুঝবে—সব চরিত্রই আসলে তুমি।”

সে চলে গেল ট্যাক্সিতে চেপে। রুদ্র রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।

আকাশে মেঘ ছিল। হঠাৎ করে হালকা বৃষ্টি নামল। রুদ্রর মনে হল—এই বৃষ্টিটাও হয়তো আজ সংলাপ। কেউ উচ্চারণ করছে না, অথচ সে ঠিক বুঝতে পারছে।

ঘরে ফিরে সে সেই পুরোনো ডায়েরি খুলে লিখল—
“আজ আমরা একসাথে নীরব ছিলাম। হয়তো সেইটাই আমাদের প্রথম প্রেমের দৃশ্য।”

পর্ব ৫

শহর তখন ধীরে ধীরে শীতের চাদরে ঢাকছে। সন্ধ্যা নামলেই বাতাসে হালকা ঠান্ডা, ফুটপাথে গরম ভুট্টার গন্ধ, আর কুয়াশার মতো জমে থাকা শব্দহীনতা। ওয়ার্কশপ এখন গড়িয়ে চলেছে মূল রিহার্সালের দিকে। নতুন একটি নাটক মঞ্চস্থ হবে—নাম “জলরঙের সংলাপ”, একটি সমসাময়িক গল্প, যেখানে ভালোবাসা, একাকিত্ব, এবং বেছে নেওয়ার সাহস একে অন্যের সঙ্গে লড়ে যায়।

রুদ্র ও মৃণালিনী, অবধারিতভাবেই, প্রধান চরিত্রে।

রুদ্রের চরিত্র—এক বিবাহিত পুরুষ, যার বিবাহিত জীবন নিঃস্ব, অথচ সে সাহস করে না কিছু বদলাতে। আর মৃণালিনীর চরিত্র—এক স্কুল শিক্ষিকা, যার মধ্যে কবিতার মতো প্রেম আছে, কিন্তু তা প্রকাশে বিশ্বাস করে না।

প্রতিদিন সন্ধ্যায় রিহার্সাল শুরু হয়, কিন্তু শেষ হয় না কেবল মঞ্চে। রুদ্র আর মৃণালিনী অনেকদিন ধরে রিহার্সালের পরে পাশাপাশি হাঁটে, কথা বলে না অনেক, কিন্তু বুঝে ফেলে অনেক কিছু।

সেদিন মঞ্চে একটি দৃশ্য ছিল—যেখানে মৃণালিনীকে বলতে হয়,
“তুমি জানো, আমি কখনও কাউকে বলিনি যে আমি ভালোবাসি। আমি শুধু তার পাশে বসে থেকেছি। দিনের শেষে যদি কেউ পাশে থাকে, সেটাই তো প্রেম, তাই না?”

রুদ্র সেটা শোনার সময় এক মুহূর্ত ভুলে গিয়েছিল, এটা নাটক। মৃণালিনী যখন সংলাপটা বলছিল, তার গলার কাঁপুনি সত্যি ছিল, চোখের কোণ ঝাপসা।

দৃশ্য শেষে রুদ্র চুপ করে ছিল অনেকক্ষণ। মঞ্চ থেকে নামার পর মৃণালিনী হেসে বলল, “বেশি ডুবে গেছো মনে হচ্ছে।”
রুদ্র কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “হয়তো। কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
“করো।”
“এই সংলাপটা কি শুধু নাটকের?”
মৃণালিনী তাকাল রুদ্রর চোখে। তারপর মুখ ঘুরিয়ে নিল।
“সব সংলাপ নাটকের নয়। কিছু কিছু সংলাপ, মঞ্চে বলে দিলে নিজের কাছেও সত্যি হয়ে যায়।”

সেই রাতে রুদ্র প্রথমবার নিজের স্ত্রীকে ফোন করে বলেছিল—
“আজ একটু দেরি হবে। আমি একটা নাটকে কাজ করছি।”
ওপাশ থেকে স্ত্রীর গলা এসেছিল, কৌতূহল ও ক্লান্তিতে মেশানো—“নাটক? হঠাৎ?”
রুদ্র বলেছিল, “হঠাৎ নয়, বরং অনেকদিন পরে কিছু সত্যি করতে ইচ্ছে করছে।”

মৃণালিনীর সঙ্গে তার সম্পর্কের নাম ছিল না, কিন্তু প্রতিদিন একটু করে তা রক্তে মেশে যাচ্ছিল।

নাটকের শেষে যেমন পর্দা নামে, তেমনি কি এই গল্পেরও একদিন পর্দা নামবে?

না কি এটাই সেই গল্প—যেটা রিহার্সালের পরেও থামে না?

পর্ব ৬

নাটকের প্রস্তুতি তুঙ্গে। মঞ্চ, আলো, পোশাক—সব কিছু চূড়ান্ত পর্বে। প্রদ্যুত বসুর গলায় সেই পুরনো তেজ ফিরে এসেছে।
“মনে রেখো,” তিনি বলতেন, “শেষ দৃশ্যটা যদি ঠিক মতো না হয়, তাহলে গোটা নাটকটাই ভেঙে পড়ে। আর ভালোবাসার দৃশ্য—ওটা কখনো অভিনয় হয় না, ওটা অনুভব।”

সেই শেষ দৃশ্যটা নিয়েই যত টানাপোড়েন। রুদ্র আর মৃণালিনীর চরিত্র—অবশেষে নিজেদের ভালোবাসার কথা স্বীকার করে, কিন্তু তারা জানে—এ সম্পর্ককে বাঁচানো যাবে না। মঞ্চে শেষ সংলাপ:
“ভালোবাসি, তাই তোমায় হারাই। যদি না হারাতাম, তবে সত্যি করে বাসতে পারতাম না।”

প্রদ্যুত এই দৃশ্যটা রিহার্সাল করতে করতে ক্লান্ত, কারণ রুদ্র সেই সংলাপ ঠিকঠাক বলতে পারছিল না। তার গলায় কোথাও যেন আটকে যাচ্ছিল। হয়তো বাস্তব ও মঞ্চের সীমারেখা তার মধ্যে গুলিয়ে যাচ্ছিল।

একদিন রাতে, রিহার্সালের পর মৃণালিনী বলল,
“তুমি তো বলছো সংলাপটা, কিন্তু তুমি শুনছো না। তুমি কি সত্যিই মানো কথাগুলো?”
রুদ্র চুপ।
তারপর বলল, “হয়তো মানি, তাই বলাটা আরও কঠিন।”

মৃণালিনী তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল, “আমি জানি, তুমি একটা চরিত্রে ঢুকেছো। কিন্তু চরিত্রটা কি শুধু মঞ্চেই থাকবে?”
রুদ্র জবাব দিল না। শুধু বলল, “তুমি কি চাইছো আমি চরিত্র থেকে বেরিয়ে আসি?”
মৃণালিনী একটু হাসল, “না, আমি চাই তুমি বুঝো—কখন নিজেকে মঞ্চে রাখবে, আর কখন জীবনে। কারণ দুটো এক করে ফেললে, একদিন চরিত্রটাই তোমার বাস্তব হয়ে দাঁড়াবে। আর বাস্তব তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে।”

তারপর তারা নীরবে হেঁটে গেল—কাঁধে কাঁধ ছোঁয়াছুঁয়ি, কিন্তু মনে হাজার মাইল ফাঁক।

সেই রাতে রুদ্র দীর্ঘ সময় নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। সে দেখতে চাইছিল, এই মুখটা কার? একজন স্বামীর? একজন অভিনেতার? একজন প্রেমিকের?

নাকি একজন মানুষ, যে নাটকে নিজের মনের কথা খুঁজছে?

অগোছালো বিছানার পাশে রাখা ডায়েরিতে সে লিখল—
“আজ প্রথম বুঝলাম, কিছু সংলাপ না বললেই হয়তো ভালো ছিল। কিন্তু আমি ঠিক কোন অংশে থামতে জানি না।”

পর্ব ৭

নাটকের দিন এগিয়ে আসছিল। মহড়া চলছিল জোরকদমে, কিন্তু রুদ্র বুঝতে পারছিল—তার নিজের ভিতর কিছু একটায় ফাটল ধরছে। প্রতিটি সংলাপ যেন আয়নায় নিজের মুখ দেখতে বাধ্য করছে তাকে। আর মৃণালিনী? সে যেন প্রতিদিন একটু একটু করে চরিত্রের আড়াল থেকে সরে আসছিল। মুখে কিছু না বলেও তার চোখ, তার হাঁটার ছন্দ—সব বলে দিচ্ছিল।

সেদিন ওদের রিহার্সালের শেষে প্রদ্যুত বসু বলে উঠলেন, “চলো, আজ শুধু শেষ দৃশ্যটা করি। আলো, সাউন্ড, সব রেডি থাকবে। মনে রেখো, তোমরা যা বলছো সেটা শুধু চরিত্রের নয়—তোমাদের মনেরও।”

আলো পড়ল মঞ্চের কেন্দ্রে। রুদ্র ও মৃণালিনী মুখোমুখি দাঁড়াল।

রুদ্র বলল, “তুমি জানো না, আমি কতবার বলতে গিয়েছি—ভালোবাসি।”
মৃণালিনী ধীরে বলল, “আমি জানি। কিন্তু বললে তো সব বদলে যাবে। আর বদল আমাদের গল্পে মানায় না।”
রুদ্র বলল, “তবে কি সবটাই অভিনয় ছিল?”
মৃণালিনী চুপ করে রইল। তার চোখে জল টলমল করছিল। তারপর বলল, “না। মঞ্চে যা বলেছি, তার চেয়ে বেশি সত্যি কিছু নেই।”

প্রদ্যুত বসু হাত তালি দিলেন। “এই তো! এবার হয়েছে!”

সবাই হাততালি দিল, কিন্তু রুদ্রের কানে কিছুই ঢুকল না। তার হৃদস্পন্দন কেবল একটা শব্দে আটকে ছিল—বেশি সত্যি কিছু নেই।

রাত্রে ওরা একসঙ্গে ফিরছিল না। মৃণালিনী একা চলে গিয়েছিল। রুদ্র অফিসের পেছনের পার্কে বসে রইল অনেকক্ষণ। তার ফোন vibrate করল—একটা নতুন মেসেজ:
“শেষ সংলাপটা আজও কাঁদিয়ে দিল। কাল আর মহড়া নেই। এবার আমাদের সত্যি মঞ্চ।” – মৃণালিনী

রুদ্র বারবার পড়ছিল মেসেজটা। সে ফোনের রিপ্লাই লিখল:
“সেই মঞ্চে আমরা কারা থাকব—চরিত্র? না আমরা?”

সেন্ড করল না।

পরদিন সকালে রুদ্র প্রথমবার নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি কেমন আছো?”
মেয়েটি চমকে তাকাল।
“এই প্রশ্ন অনেকদিন পর করলে,” সে বলল।

রুদ্র ভাবছিল—সে কি এবার নাটক থেকে বেরোতে পারবে? নাকি নাটকই হয়ে গেছে তার বাস্তব?

সে জানে না, কেবল জানে—মঞ্চের আলো একবার জ্বলে উঠলে, কিছু সত্যি আর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না।

পর্ব ৮

শহরের এক পুরনো থিয়েটার হলে নাটকটা মঞ্চস্থ হল। “জলরঙের সংলাপ”—নামটা দর্শকদের মধ্যে আগ্রহ জাগিয়েছিল, কিন্তু নাটকের শেষে চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। যেন কেউ শ্বাস ফেলে বসে আছে, আর চোখের জল মুছে নেবার আগেই আলো নিভে গেছে।

রুদ্র আর মৃণালিনী যখন শেষ দৃশ্যে দাঁড়িয়ে সংলাপ বলছিল, তখন তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছিল—ঠিক যেভাবে একটা অসমাপ্ত চিঠি পড়ে ফেলা হয় বারবার।
মঞ্চের শেষ সংলাপের আগে রুদ্র একটু থেমে গিয়েছিল, সেটা কেউ বুঝতে পারেনি, শুধু মৃণালিনী দেখেছিল। সে তার দিকে এগিয়ে এসে গলা নামিয়ে বলেছিল,
“তুমি পারবে। এবার শুধু বলো, সত্যিটা।”

রুদ্র বলেছিল—
“তোমার পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছি অনেক দিন। হয়তো ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু এই ভালোবাসার জায়গা হয়তো মঞ্চেই। বাস্তব ওটা ভাঙবে। তবুও যদি কখনও চরিত্র থেকে বেরিয়ে এসে কাউকে জিজ্ঞেস করো—ভালোবাসো? আমি বলব—হ্যাঁ। কারণ আমি একদিন মঞ্চে বলেছিলাম, আর তখন আমি সত্যিই ছিলাম।”

আলো নিভে গিয়েছিল। পর্দা পড়েছিল।

সেই রাতে অনেকজন এসে অভিনন্দন জানাল, ছবি তুলল, ফুল দিল। রুদ্র চুপচাপ বসে ছিল গ্রীনরুমের কোণে। মৃণালিনী পাশে এসে বলল, “তুমি জানো তো, এই নাটকটা হয়তো আমার শেষ কাজ।”
রুদ্র তাকাল, “মানে?”
“আমি নতুন স্কুলে যোগ দিচ্ছি। অন্য শহরে। নাটকটা করতে চেয়েছিলাম নিজের জন্য, শেষবারের মতো। আবার নিজের চরিত্রে ফিরতে হবে তো!”
রুদ্র কিছু বলল না। শুধু জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকল। রাত নামছিল, শহর ঝিমিয়ে পড়ছিল, কিন্তু মনের ভিতর সেই আলো নিভছিল না।

মৃণালিনী বলল, “তুমি থাকো, নাটক করো। অনেক গল্প বাকি তোমার মধ্যে। শুধু মনে রেখো—সব চরিত্রেই একটু সত্যি থাকে। তাকে আঁকড়ে ধরে রেখো।”

রুদ্র তার হাত ছুঁয়ে বলল, “তুমি কি ফিরে আসবে?”
মৃণালিনী হেসে বলল, “স্মৃতির মঞ্চে আমি থাকব সবসময়। শুধু জানবে—তোমার জীবনের সবচেয়ে সত্যি সংলাপটা তুমি মঞ্চে বলেছিলে।”

সে চলে গেল।

রুদ্র দাঁড়িয়ে রইল মঞ্চের একপাশে। আলো নিভে গেছে, দর্শক সরে গেছে, কিন্তু কাঠের মেঝেতে সেই পায়ের শব্দগুলো থেকে গেছে।

সেই রাতে ডায়েরিতে রুদ্র লিখল—
“আজ নাটক শেষ হল। কিন্তু একটা ভালোবাসার গল্প শুরু হল, যেটা মঞ্চে লেখা, বাস্তবে বাঁচা যায় না। তবুও আমি বাঁচব, কারণ আমি একবার সত্যি বলেছিলাম।”

পর্ব ৯

নাটকের পর কেটে গেছে এক সপ্তাহ। রুদ্র ফের তার অফিস, মিটিং, ক্লায়েন্ট, এবং নিঃস্ব রাতের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু এখন আর আগের মতো সব কিছু ঠিকঠাক চলে না। শব্দের ফাঁকে মঞ্চের সংলাপ ঢুকে পড়ে, রিপোর্ট টাইপ করার মাঝেও মনে পড়ে যায় মৃণালিনীর চোখের ভাষা।

সে একবার তাকে ফোন করেছিল। ফোন বাজছিল, কিন্তু কেউ ধরেনি।

তারপর একরাতে একটি খাম এলো রুদ্রর ঠিকানায়। ভিতরে ছিল একটি ছবি—মঞ্চের শেষ দৃশ্যের, যেখানে মৃণালিনী তার দিকে তাকিয়ে আছে, আলোয় ভিজে মুখ। আর নিচে ছোট করে লেখা—
“আমি ঠিক ওই মুহূর্তেই সত্যি ছিলাম।”

তারপর থেকে আর কোনও খোঁজ নেই। ফোন বন্ধ, কোনও চিঠি না, সামাজিক মাধ্যমে নিস্তব্ধতা।

রুদ্র প্রথমদিকে খুঁজতে চেয়েছিল, কিন্তু পরে বুঝে গিয়েছিল—এই চলে যাওয়াই মৃণালিনীর সংলাপ। এমন এক সংলাপ, যা বলা হয় না, কিন্তু বেজে থাকে চুপচাপ।

একদিন থিয়েটার হলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল রুদ্র। ভেতরে নতুন নাটকের পোস্টার ঝুলছে। সে গেটের ধারে বসল, কাঠের বেঞ্চে, ঠিক যেখানে তারা দুজন একদিন বসেছিল। চোখ বন্ধ করল। শুনতে পেল মৃণালিনীর গলা—
“সব চরিত্রেই একটু সত্যি থাকে। আর আমি তো শুধু চরিত্রই ছিলাম, তাই না?”

সে নিজেকেই প্রশ্ন করল, “তবে আমি কে?”

উত্তর এলো না। কিন্তু তার মনে হল, সে আর আগের রুদ্র নেই। চরিত্র থেকে বেরিয়ে এসে, সে এখন এমন একজন, যে অনুভব করতে পারে। যে সংলাপ মনে রাখে, আর ভালোবাসাকে মনে রেখেও ছেড়ে দিতে শেখে।

সে নিজের অফিস ডেস্কে বসে একদিন হঠাৎ করে একটি ফোল্ডার খুলল—নতুন নাটকের খসড়া। নাম দিল—”চরিত্রের বাইরে”।

প্রথম পাতায় লেখাল—
“এই নাটক উৎসর্গ করা হলো তাকে, যে একদিন সত্যি বলেছিল, মঞ্চের আলোয় দাঁড়িয়ে—আমি পাশে থেকেছি, তাই ভালোবাসি।”

পর্ব ১০

নতুন নাটকের প্রথম রিহার্সাল শুরু হয়েছে। রুদ্র এখন নির্দেশক—এই প্রথমবার সে অন্য কারও মুখে নিজের লেখা সংলাপ শুনছে। তার নাটক “চরিত্রের বাইরে” এখন আর শুধু অনুভূতি নয়, হয়ে উঠেছে ভাষা, দৃশ্য আর স্পটলাইটের ভেতর ঘুরে বেড়ানো সত্যি।

নতুন অভিনেত্রীর নাম স্রোতস্মিতা। চেহারায় মৃণালিনীর ছায়া নেই, কিন্তু তার চোখের গভীরে আছে সেই একই প্রশ্ন—“তোমার সংলাপ কি তোমার সত্যি?”

সেদিন রুদ্র নির্দেশ দিচ্ছিল একটা দৃশ্যে, যেখানে একজন নারী চরিত্র তার ভালোবাসাকে ছেড়ে চলে যায়, কিন্তু তাকে একটা চিঠি রেখে যায়।

চিঠিতে লেখা—
“ভালোবাসা মানে সবসময় সঙ্গে থাকা নয়। কখনও কখনও দূরে থাকা, আর তবুও অনুভব করানো—তুমি একা নও।”

স্রোতস্মিতা এই সংলাপটা যখন বলছিল, রুদ্রের গলা শুকিয়ে আসছিল। হলঘরের মধ্যে যেন কোথাও বসে কেউ তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলছে—“তুমি এখনও আমার সংলাপ মনে রেখেছো?”

রাতের দিকে, হল ফাঁকা হয়ে গেলে রুদ্র একা মঞ্চে বসে রইল। আলো নিভে গেছে, কেবল জানলার ফাঁক দিয়ে হালকা চাঁদের আলো পড়ছে কাঠের মেঝেতে।

হঠাৎ একটা আওয়াজ—দরজা খোলার শব্দ। রুদ্র চমকে তাকাল। কেউ নেই। কিন্তু কেমন যেন মনে হল, মৃণালিনী আস্তে হেঁটে এসে পাশে বসেছে।

সে চোখ বন্ধ করল।

তখনই মনে পড়ল—একটা দৃশ্য, যে দৃশ্য তারা কোনোদিন অভিনয় করেনি।

একটি বেঞ্চ। দুজন মানুষ। একজন বলছে,
“তুমি ফিরে এসেছো?”
আরেকজন হাসছে, বলছে—
“না। আমি কখনো যাইনি। আমি ছিলাম তোমার চরিত্রের ভেতর।”

রুদ্র চোখ খুলল। সামনে ফাঁকা মঞ্চ।

সে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল হলের বাইরে।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে, সে ফোন বের করে খোলা স্ক্রিপ্টের শেষ পৃষ্ঠায় একটা লাইন যোগ করল—
“শেষ সংলাপ বলে শেষ হয় না সব নাটক। কিছু গল্প চলতেই থাকে—চরিত্রের বাইরেও।”

এটাই ছিল তার প্রেমের শেষ দৃশ্য।

নাটকের আলো নিভে যায় একসময়।

কিন্তু কিছু সম্পর্ক আলোর মতোই—জ্বলে উঠে অন্ধকারকে মনে রেখে যায়।

 

শেষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *