শুভ্রজিৎ দত্ত
অধ্যায় ১:
চরকালী গ্রামটি একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত, যেখানে আধুনিকতার ছোঁয়া তেমন পড়েনি। চারপাশে শুধু সবুজ ক্ষেত-খামার, নদী এবং পুরনো বাড়ি-ঘর। তবে গ্রামের সবচেয়ে রহস্যময় স্থান ছিল তার পুকুরটি। পুকুরটির পানি এমন স্বচ্ছ ছিল, যা মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করত, কিন্তু তার নিচে এক অদৃশ্য বিপদ lurked করত। স্থানীয়দের মধ্যে একটি গুজব প্রচলিত ছিল যে, পুকুরের পানিতে একটি দানবের আত্মা বাস করে। শোনা যায়, রাতের অন্ধকারে পুকুরের কাছে গেলেই শুনতে পাওয়া যায় এক অদ্ভুত হাসির গুঞ্জন, যেন কেউ বা কিছু জঙ্গলে হেসে চলেছে। কোনো এক সময়, কিছু মানুষ পুকুরের কাছে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল, আর কখনো ফিরে আসেনি। গ্রামের বৃদ্ধরা বলতেন, পুকুরের জলে এক পুরনো আত্মা বাস করে, যা এক সময় গ্রামের মন্দিরের পুরোহিত ছিল। কিন্তু এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায়, ওই পুরোহিত নিজেকে বলি দিয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকেই পুকুরে কোনো না কোনো অদ্ভুত কিছু ঘটত, আর কেউ সেখানে গেলে তাদের ফেরার পথ আর কখনো পেত না।
মুকুল, সুমি, জিতু, বিপ্লব এবং রিতা—এই পাঁচ জন যুবক চরকালীর গ্রামের এক দল বন্ধুর মতো ছিল। গ্রামে ছোট থেকেই বড় হওয়া মুকুল একসময় পুকুরের রহস্য নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে। তার কাছে এটি শুধুই এক গল্প ছিল না, এক মজার চ্যালেঞ্জ ছিল। তার মতোই সুমি, যিনি বিজ্ঞানী মনোভাবের, পুকুরের রহস্যকে শাস্ত্রীয় ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছিল, একে মনে করত যে, হয়তো কোনো জৈবিক কারণে এই অদ্ভুত ঘটনাগুলো ঘটছে। কিন্তু সুমি মুকুলের সাহস এবং আগ্রহকে উৎসাহিত করছিল, কারণ সেও জানত, কোনো কিছু গোপন রয়েছে। বিপ্লব, যারা একসময় গ্রামের সাহসী ছেলে ছিল, তখন কিছুটা ভীত এবং অস্থির হয়ে পড়েছিল, কারণ সে জানত, পুকুরে কিছু একটা রয়েছে যা সাধারণ মানুষের কাছে অবিশ্বাস্য। তবে সে দলের একজন হিসেবে সকলের পাশে থাকতে চেয়েছিল। জিতু, এক যুবক, যে প্রথমবার এই রহস্যে প্রবেশ করতে যাচ্ছিল, তার মধ্যে অদ্ভুত এক ভয় কাজ করছিল, কিন্তু বন্ধুরা তাকে আশ্বস্ত করে, তার ভুলভাল ধারণাগুলি দূর করার জন্য। আর রিতা, গ্রামের এক কিশোরী, যিনি বেশি কিছু চিন্তা না করে শুধু মজার জন্য ঘটনাগুলো জানার চেষ্টা করছিল, একসময় তাকে অদৃশ্য শক্তির টানেও দেখা যায়।
একদিন রাতে, তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা পুকুরের রহস্য উদঘাটন করতে যাবে। অন্ধকার পোকা-মাকড় আর রাতের নিস্তব্ধতার মাঝে, তারা পুকুরের দিকে হাঁটতে থাকে। প্রথমে, সবকিছুই শান্ত ছিল, গাছের পাতার পাতলা ঝরা শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। মুকুলের হৃদপিণ্ড দ্রুতপূর্বক ছুটছিল, কারণ সে জানত, এই রাতটা কোনো সাধারণ রাত নয়। এই রাতেই তাদের সামনে আসবে সেই পুরনো রহস্যের মুখ। পুকুরে পৌঁছানোর পর, প্রথমে তারা কোনো অদ্ভুত শব্দ শুনতে পায় না, তবে একটা অদ্ভুত অনুভূতি আসে—একটি ভয়, যা মনের গভীরে ঢুকে যায়। মুকুল তার বন্ধুকে আশ্বস্ত করে যে, তাদের কোনো ভয় নেই। তারা পুকুরের আশেপাশে আরো কিছু সময় কাটায়, কিন্তু তারপর হঠাৎ পুকুরের পানিতে কোনো এক অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া ঘটতে শুরু করে। পানি যেন উত্তাল হয়ে ওঠে, কিন্তু কোনো বাতাস ছিল না। প্রথমে তারা ভেবেছিল এটা কোনো প্রকৃতিক ব্যাপার, কিন্তু তারপর তারা শুনতে পায় এক অবাস্তব হাসির শব্দ, যা তাদের রক্ত হিম করে দেয়। সেই হাসি যেন কোনো মানবের না, বরং কিছু এক অজানা, অদৃশ্য শক্তির। সে হাসি এতটাই তীব্র ছিল যে, তাদের মনে হয়, তাদের চারপাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। জিতু প্রথমে ভীত হয়ে ওঠে এবং পিছু হটে, কিন্তু সুমি তাকে সাহস দিয়ে বলে, “দেখ, কিছু না কিছু ব্যাখ্যা অবশ্যই হবে।” কিন্তু হঠাৎ করেই পুকুরের পানি থেকে একটা বড় ঢেউ উঠে আসে, এবং তাদের সবাইকে ভিজিয়ে দিয়ে পুকুরের জলের মধ্যে এক ধরনের অদ্ভুত শক্তির উপস্থিতি অনুভূত হয়। তারা পালিয়ে যেতে চায়, কিন্তু তাদের কাছে কোনো পথ দেখা যায় না। সুমি, রিতা, বিপ্লব এবং জিতু সবাই একে অপরকে ধরতে শুরু করে, তবে মুকুল দাঁড়িয়ে থাকে, সেই হাসির আওয়াজ শোনার পর, তার মনে এক অদ্ভুত প্রশ্ন উঁকি দেয়—”এটা কি সত্যিই কোনো দানব? নাকি পুকুরের রহস্যের কিছু আর গভীর কিছু?”
এভাবেই শুরু হয় চরকালীর পুকুরের রহস্য—এক রহস্যময় গ্রাম, যেখানে অদ্ভুত ঘটনা প্রবাহের মধ্যে মানবিক সাহস আর বন্ধুদের একত্রে বেরিয়ে আসার গল্প।
অধ্যায় ২:
চরকালীর পুকুরের কাছ থেকে ফিরে আসার পর, মুকুলের মনে এক অদ্ভুত অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। রাতের ওই অদ্ভুত হাসির শব্দ, পানির ঢেউয়ের ভিঁড়, এবং অদৃশ্য শক্তির উপস্থিতি—সবকিছু যেন তাকে তাড়া করছিল। সুমি, রিতা, বিপ্লব এবং জিতু, সবাই মুকুলের কাছে ফিরে এসেছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে কেউই সেই রাতে ঠিকমতো কথা বলছিল না। তারা সবাই চুপচাপ, তাদের চোখে ভয় আর সংশয়ের ছাপ স্পষ্ট। তারা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিল, যেন কিছু বলা নেই, কিছু বুঝতে পারছে না, কিন্তু কেউ কিছু বলতে সাহস পাচ্ছিল না। মুকুলের হৃদপিণ্ডের বিটও যেন তখনও বাড়ছিল, মনে হচ্ছিল, কেউ তাকে অনুসরণ করছে। তার মনে তখন শুধু একটাই প্রশ্ন ঘুরছিল—”এটা কী ছিল? সত্যিই পুকুরে কোনো দানব আছে, নাকি কিছু অন্য ঘটনা ঘটছে?”
সুমি, যিনি সাধারণত সবকিছুকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যাখ্যা করতে পছন্দ করতেন, সেই রাতের ঘটনার পর প্রথমবারের মতো কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। সে বারবার নিজেকে প্রশ্ন করছিল, “এটা কি প্রকৃতিপ্রসূত কোনো ঘটনা ছিল, নাকি আমাদের সবার মনেই ভয়ের সৃষ্টি হয়েছে?” সুমি জানত, কিছু ব্যাখ্যা থাকা উচিত, কিছু যুক্তি থাকা উচিত, কিন্তু পুকুরে রাতের ঘটনার পর সে নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিল। কি জানি, হয়তো কিছু অতিপ্রাকৃত শক্তি কাজ করছে, যা তারা বুঝতে পারছে না। সে মুকুলকে শান্ত করতে চেয়েছিল, কিন্তু তার সঙ্গীরা জানত, সুমি নিজেই অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিল। এমনকি বিপ্লবও এবার ভয়ে শিউরে উঠছিল। সে জানত, পুকুরের দিকে পা বাড়ানো মানে জীবন ও মৃত্যুর লুকোচুরি খেলায় অংশগ্রহণ করা, কিন্তু সেও কি পারবে ফিরতে? সুমি তাকে বলেছিল, “আমরা হয়তো এর মধ্যে কিছু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পেতে পারি।” বিপ্লব তখন শুধু মাথা নেড়ে বলেছিল, “এটা শুধু রহস্য নয়, এটা হয়তো কোনো অভিশাপ।” কিন্তু তাদের কেউই জানত না, এই রাতে যে নতুন ভয়াবহতা তাদের মুখোমুখি হতে চলেছে।
পরের দিন সকালে, তারা সবাই নিজের নিজের ঘরে ফিরে যায়, তবে মনে এক ধরনের অস্বস্তি ছিল। সকালে সবাইকে একে একে দেখে মুকুলের মনে হয়, সেও এক অদৃশ্য শক্তির দ্বারা আচ্ছন্ন। কিন্তু সে চুপচাপ ছিল, কোনো কথা বলছিল না। তার মনে হচ্ছিল, পুরো গ্রামের মানুষ জানে না, তবে পুকুরের গভীরে কিছু ভয়ংকর, অদ্ভুত শক্তি বাস করে। মুকুলের মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত চলে আসছিল—সে এ রহস্য সমাধান করবে, এমনকি যদি তার জীবনটাও বিপদে পড়ে। কিন্তু সেই রহস্য খুঁজতে গিয়ে, গ্রামে কি তাকে বড় কোনো বিপদ অপেক্ষা করছে? সে জানত, এ পথ যদি সে নিতেই যায়, তবে তার পেছনে কোনো ছায়া অবশ্যই তাকে অনুসরণ করবে।
তারপর, বিকেল বেলা, সুমি, বিপ্লব, রিতা এবং জিতু আবার একত্রিত হয়। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, তারা পুকুরের কাছে গিয়ে আরও কিছু তথ্য সংগ্রহ করবে। সুমি চায়, তারা পুকুরের পানি পরীক্ষা করে দেখতে পারে, জিতু শুঁকতে শুঁকতে সুরক্ষা পদ্ধতি নিয়ে কথা বলছিল, কিন্তু রিতা প্রথম থেকেই ভয় পেয়ে যাচ্ছিল। সে বলেছিল, “আমরা যদি আবার পুকুরের কাছে যাই, তবে আমাদের কী হবে?” কিন্তু মুকুলের সিদ্ধান্ত ছিল পরিষ্কার—সে জানত, একদিন না একদিন, এই রহস্যের সমাধান করতে হবেই। সে সবাইকে আশ্বস্ত করেছিল। “কিছু না কিছু তো খুঁজে বের করতেই হবে, সুমির মতো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নিয়ে তো আমরা এখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারব।”
সেখানে গিয়ে, তারা প্রথমে পুকুরের চারপাশে হাঁটছিল। কিন্তু এক সময়, আবার সেই অদ্ভুত হাসির আওয়াজ শোনা গেল। শুরুতে কেউ কিছু বুঝতে পারেনি, কিন্তু একটু পরেই তারা দেখল, পুকুরের পানি আবার গড়ে উঠছে—কিন্তু এইবার সেটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। পানি যেন একেবারে পাথরের মতো শক্ত হয়ে উঠছিল, এবং সেই শক্ত পানির মাঝে দেখা যাচ্ছিল এক অদৃশ্য, অন্ধকার ছায়ার আছড়া। মুকুল তার চোখের সামনে যা দেখছিল, তা তার ধারণার বাইরে ছিল। সে চিৎকার করে বলেছিল, “এটা—এটা কি সত্যিই দানব?” সুমি তাকে শান্ত করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তখনই পুকুরের পানি যেন তাদের দিকে ছুটে আসছিল। তারা সবাই দ্রুত পালানোর চেষ্টা করছিল, তবে সেই অদৃশ্য শক্তি যেন তাদের পিছনে পড়েছিল। সুমি চিৎকার করে বলেছিল, “দৌড়াও! দ্রুত!” কিন্তু তাদের পা যেন মাটির সঙ্গে লেগে গিয়েছিল, কোনোভাবে মুক্ত হতে পারছিল না। সেই সময়, এক ভয়াবহ অনুভূতি তাদের মধ্যে চলছিল—এটা কোনো স্বপ্ন ছিল না, বরং একটি কালো সত্যের মুখোমুখি হওয়ার মুহূর্ত।
তারা কোনো মতে পুকুরের কাছ থেকে পালিয়ে আসে, কিন্তু তাদের মধ্যে কেউই পুরোপুরি মুক্ত হতে পারে না। তাদের মনে তখন শুধু একটাই চিন্তা ছিল—পুকুরের রহস্য কখনও না কখনও তাদের জীবনকে স্পর্শ করবেই। তবে কি তারা আর কখনো ফিরে যাবে সেই পুকুরে?
অধ্যায় ৩:
চরকালীর পুকুরের রহস্যের জাল আরও গাঢ় হয়ে উঠেছিল। মুকুল, সুমি, বিপ্লব, রিতা এবং জিতু—সবাই গত রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনার পর এক দারুণ অস্থিরতা অনুভব করছিল। তাদের মনে ছিল একটাই প্রশ্ন: “এই রহস্যের শেষ কোথায়?” তবে এমন এক জায়গা ছিল, যেখানে তারা কখনো একা গিয়ে কোনো উত্তর পায়নি—সেটি ছিল গ্রামটির পুরনো পণ্ডিত, দেবদাস বাবার বাড়ি। দেবদাস পণ্ডিত, বয়সের ভারে ধীরে চলা বৃদ্ধ, যিনি পুরো গ্রামকে বহু বছর ধরে নানা পুরনো গাথা এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞান দিয়েছিলেন। তার কথা শুনে গ্রামের অনেক মানুষ আজও মনে করে যে, তিনি কেবল একজন পণ্ডিত নয়, বরং এক অদ্ভুত শক্তির অধিকারী। অনেকেই বিশ্বাস করত, দেবদাসের কাছে গ্রামের পুরনো রহস্যগুলো সযত্নে রক্ষিত রয়েছে। তবে কেউ কখনো সরাসরি তার কাছে সেই রহস্য জানতে যায়নি।
তাদের দৃষ্টি একে অপরকে সোজা রেখে, সুমির মুখ থেকে একটি শব্দ বের হলো, “আমরা দেবদাস পণ্ডিতের কাছে যাবো।” মুকুল একটু ভেবেছিল, তারপর বলেছিল, “হ্যাঁ, হয়তো এখানেই কোনো কিছু আমরা জানতে পারব।” সুমি, যিনি সবসময়ই বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কিছু বোঝার চেষ্টা করছিল, জানত, দেবদাস পণ্ডিত তাদের শুধু পুরনো কাহিনীগুলি বলবেন না, বরং কিছু বাস্তবিক ব্যাখ্যা দিতে পারেন। বাকি সবার মতামতও এক। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, ওই রাতে একত্রে দেবদাস পণ্ডিতের কাছে যাবে।
রাতের দিকে, সবাই পণ্ডিতের বাড়ির দিকে রওনা হয়। গ্রামের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা এক পুরনো মাটির বাড়ি, যেখানে জানালা এবং দরজা সব কিছু এতটাই ক্ষয়প্রাপ্ত যে, মনে হতো যেন এটি আরও কয়েক শতক আগে তৈরি হয়েছিল। বাড়ির সামনে থাকা গাছগুলোর শাখা-প্রশাখা যেন এক ভয়াবহ ভূতের মূর্তির মতো ঝুলছিল। এক রহস্যময় চুপচাপ পরিবেশে, দেবদাস পণ্ডিতের বাড়ি আরও বেশি করেই অদ্ভুত মনে হচ্ছিল। মুকুলের মনে হচ্ছিল, আজকের রাতের শেষে তারা হয়তো সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে।
দেবদাস পণ্ডিতের সামনে পৌঁছানোর পর, তিনি তাদের সবাইকে গভীর দৃষ্টিতে দেখে উঠলেন, যেন তাদের আসার কথা জানতেন। তার চোখের মধ্যে এক অদ্ভুত শান্তি ছিল, কিন্তু তার মুখাবয়ব বেশ মলিন এবং একধরনের নিষ্ঠুরতা ফুটে উঠছিল। মুকুল প্রথমে কিছু বলতে পারেনি, তবে সুমি একেবারে সোজা বলে উঠল, “আমরা আপনার কাছে আসতে চেয়েছিলাম, পণ্ডিত। পুকুরের ব্যাপারে কিছু জানেন কি আপনি?”
দেবদাস পণ্ডিত কিছুক্ষণ চুপ করে ছিলেন। তারপর তিনি এক ধীর, গম্ভীর স্বরে বললেন, “পুকুর। হ্যাঁ, সেই পুকুর। বহু বছর আগে, আমার জীবনে এক ঘটনা ঘটেছিল, যা আমি এখনও ভুলতে পারি না। পুকুরটা শুধু পানি নয়, এটি এক জীবন্ত আধ্যাত্মিক শক্তির আধার। কিন্তু যে শক্তি সেখানে বাস করছে, তা তোমরা ধারণাও করতে পারবে না।” তিনি গম্ভীরভাবে তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এটা কোনো সাধারণ দানবের আত্মা নয়। এটি এক পুরনো অভিশাপের ফল।”
সুমি, যার বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা সবসময় প্রবল ছিল, সে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “অভিশাপ? এরকম কিছু থাকতে পারে?” দেবদাস পণ্ডিত মাথা নেড়ে বললেন, “তোমরা জানো না, কিন্তু পুকুরের পানিতে অনেক পুরনো ঘটনা লুকিয়ে রয়েছে। অনেক আগে, একদল পুরোহিত এখানে এসেছিল। তারা একটি রহস্যময় মন্ত্র জানত, যা দিয়ে তারা পুকুরের গভীরে এক অদৃশ্য শক্তিকে封 (বন্ধ) করেছিল। তবে একদিন, তাদের মধ্যে এক ভয়ঙ্কর ভুল হয়েছিল, যা আজও ফলস্বরূপ গ্রামবাসীদের ওপর শাপ হয়ে রয়ে গেছে।”
পণ্ডিতের এই কথা শুনে তাদের মধ্যে সবাই নীরব হয়ে গেল। মুকুল আবার প্রশ্ন করল, “তাহলে, সেই পুরোহিতদের কী হয়েছিল?”
দেবদাস পণ্ডিত এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, “তারা ভুল করেছিল। তারা পুকুরে একে অপরকে প্রতারিত করেছিল এবং সেই সময় পুকুরের জলে পুরনো এক আত্মা প্রতিজ্ঞা করেছিল, যে সে কোনোভাবেই তাদের শান্তি দিতে পারবে না। সে শক্তি তাদের মেনে নিল না, এবং গ্রামে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ শুরু হলো। সেই দুর্ভিক্ষের পরেই, পুকুরের পানিতে এক ধরনের কালো শক্তি স্থায়ী হয়ে যায়। এরপর থেকেই পুকুরে যারা এসে ঢুকত, তারা আর কখনো ফিরে আসত না।”
সুমি, এই গল্পে কতটা বিশ্বাস করবে তা নিয়ে চিন্তা করছিল, তবে সে জানত যে, দেবদাস পণ্ডিতকে অশিক্ষিত বা বোকা ভাবা ঠিক হবে না। দেবদাস পণ্ডিত তার চোখে আরো গভীর কিছু দেখাতে চেয়েছিলেন। তিনি তাদের বললেন, “সেখানে যদি যাও, তবে জানো, তোমাদের মধ্যে একজনকে সঙ্গী করতে হবে। একজনকে থাকতে হবে সেই শক্তির সঙ্গে।”
জিতু, যে এখন পর্যন্ত পুরোপুরি ভয় পেয়ে ছিল, সে কিছুটা অবাক হয়ে বলল, “তাহলে, আপনি বলতে চাইছেন যে, আমাদের কাউকে একে একে যেতে হবে?”
দেবদাস পণ্ডিত মাথা নেড়ে বললেন, “না। একবারে সবাই একসাথে যেতে হবে, তবে… কেউ একা না যাক। পুকুরের কাছাকাছি পৌঁছালে, আপনাদের সামনে পুরনো অভিশাপের সৃষ্টি হবে। কিন্তু তা না হলে, সত্যের মুখোমুখি হওয়া সম্ভব নয়।”
মুকুল অনুভব করছিল যে, তাদের সামনে শুধু রহস্যই নয়, জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা রয়েছে।
দেবদাস পণ্ডিত তাদের দিকে তাকিয়ে, এবার আবার মৃদু হাসলেন। “তোমরা যদি সত্যিকারের সাহসী হতে চাও, তবে পরবর্তী রাতে পুকুরে যাও। কিন্তু মনে রেখো, যে কেউ তার চূড়ান্ত পরীক্ষার সম্মুখীন হবে, সে আর ফিরে আসবে না।”
তাদের মনে তখন এক ভয়াবহ শীতল অনুভূতি। দেবদাস পণ্ডিত যা বলেছিলেন, তাতে অজানা বিপদ এবং দুঃসহ সত্যের অভ্যেস ছিল।
অধ্যায় ৪:
দেবদাস পণ্ডিতের কথা শুনে মুকুল আর তার বন্ধুরা কিছু সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, যেন কোন ধরনের সিদ্ধান্ত নেবে, তা নিয়ে দিধান্বিত। পণ্ডিতের কথাগুলো তাদের মাথায় গভীরভাবে ঢুকে গিয়েছিল। পুকুরের রহস্য যে এতটা জটিল এবং বিপজ্জনক, তা তারা কখনো ভাবেনি। তবে পণ্ডিতের মুখে এক ধরনের সতর্কতা ছিল, যা তাদের সকলের মধ্যে এক অদ্ভুত উত্তেজনা ও ভয়ের মিশ্রণ তৈরি করেছিল। পণ্ডিত যখন বলেছিলেন, “একবারে সবাই একসাথে যেতে হবে, তবে কাউকে একা না যেতে দিও,” তখন তার গলায় যে হুমকি ছিল, তা তারা অবচেতনভাবে অনুভব করেছিল। কিন্তু, তারা জানত, একবার এই পথ বেছে নিয়েছে, তাদের পিছু হটতে আর কোনো সুযোগ থাকবে না।
পরদিন বিকেলে, পুরো দল সিদ্ধান্ত নিল, তারা আবার পুকুরের কাছে যাবে, তবে এবার তারা যে পথ ধরবে, তা হবে একেবারে ভিন্ন। দেবদাস পণ্ডিত যে গোপন পথের কথা বলেছিলেন, সেটি ছিল পুকুরের পাশেই একটি পুরনো গুহার দিকে চলে যায়। গ্রামবাসীরা একে “অন্ধকার পথ” বলে থাকে, কারণ এখানে একবার ঢুকলে ফেরার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যদিও গ্রামের অধিকাংশ লোক একে ভয় পায়, কিন্তু মুকুল এবং তার বন্ধুরা জানত, এর মধ্যেই লুকিয়ে থাকতে পারে সেই রহস্যের আসল উত্তর।
রাত নেমে আসার সাথে সাথে, দলটি তাদের অভিযানে রওনা হয়। তাদের সাথে ছিল পুকুরের আশেপাশে কিছু সরঞ্জাম—একটি টর্চ, কিছু জল, এবং পণ্ডিতের দেওয়া কিছু তান্ত্রিক চিহ্ন। মুকুল, সুমি, বিপ্লব, রিতা, আর জিতু—সবাই একে অপরকে দৃঢ় চোখে তাকিয়ে, একে অপরকে সাহস দিতে প্রস্তুত ছিল। তারা একের পর এক অন্ধকার রাস্তা অতিক্রম করে, পুকুরের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে। তাদের মধ্যে এক ধরনের গভীর অস্থিরতা ছিল, যেন কিছু একটা আসন্ন। গাছের শাখাগুলি তাদের ওপর ঝুলছিল, আর বাতাসে মন্দ গন্ধ ভাসছিল। গ্রাম থেকে অনেক দূরে, পুকুরের আশপাশের পরিবেশ ছিল যেন এক অস্বাভাবিক। ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়লেও রাতের অন্ধকার এখনও তাদের চারপাশে গ্রাস করছিল।
পথের এক জায়গায় এসে তারা দেখতে পায়, পুকুরের পাশের এক গাছের তলায় একটি ছোট মন্দির রয়েছে। এটি পুরনো, মুছে যাওয়া পাথরের তৈরি। একদিকে এক পাথরের পিতলের মূর্তি ছিল, এবং অন্যদিকে কিছু অদ্ভুত চিহ্ন আঁকা ছিল। সুমি এগিয়ে গিয়ে কিছু সময় মন্দিরটি পরীক্ষা করে, কিন্তু কিছুই পরিষ্কার ছিল না। সে বলেছিল, “এটি শুধুমাত্র পুকুরের পাশের এক পুরনো মন্দির মনে হচ্ছে, তবে এই চিহ্নগুলো কি বোঝাচ্ছে, সেটা বুঝতে হবে।” দেবদাস পণ্ডিতের কথা মনে রেখে, তারা সকলেই এই জায়গাটি একবারে পাড়ি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও পিছু হটতে তারা প্রস্তুত ছিল না।
পুকুরের দিকে আরো এগিয়ে যাওয়ার সময়, হঠাৎ করে বাতাসে এক ধরনের অদ্ভুত হাহাকার ভেসে আসে। প্রথমে কেউ কিছু বুঝতে পারে না, কিন্তু কিছুক্ষণ পর, তারা জানত—এটা সেই হাসির আওয়াজ, যা তারা আগেও শুনেছিল। এই মুহূর্তে, পুকুরের জলের মধ্যে যেন কিছু একটা চলছিল। তারা সমস্ত সাহসকে একত্র করে, পুকুরের কাছে পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত নেয়। মুকুল, সুমি, বিপ্লব, জিতু আর রিতা সবাই একে অপরকে সাহস দেয় এবং দ্রুত পুকুরের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে।
কিছুক্ষণের মধ্যে, তারা পুকুরের পাশের এক গোপন পথ খুঁজে পায়, যা সরাসরি এক গুহায় প্রবাহিত হয়ে যায়। এই গুহাটি অনেক পুরনো, এবং এর মধ্যে প্রবেশ করতে হলে সবার একসাথে থাকতে হবে। একমাত্র তখনই তারা এই অন্ধকার পথের মধ্যে প্রবাহিত হতে পারবে। গুহার ভেতর এক ধরনের অদ্ভুত শান্তি ছিল, যেন একে অনুধাবন করতে গেলে মানুষের অন্তরের গভীরতা পর্যন্ত পৌঁছাতে হয়। কিন্তু এখানে, কোন শব্দ ছিল না। কোনো প্রাণী, কোনো পশু, কিছুই ছিল না। যেন সময় নিজেই থমকে গেছে। দলের মধ্যে কেউই কথা বলছিল না। শুধু তাদের পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। এই অন্ধকার পথে এগিয়ে যেতে যেতে, তাদের মধ্যে একটা অনুভূতি তৈরি হয়েছিল, যেন এই জায়গাটি এক বিশেষ জায়গা, যেখানে অতীত এবং বর্তমান একে অপরকে স্পর্শ করে।
গুহার ভেতরে তারা এক সময় এসে পৌঁছাল, যেখানে একটি পুরনো পাথরের দরজা ছিল। দরজার ওপর কিছু প্রাচীন চিহ্ন ছিল, যা দেবদাস পণ্ডিতের দেওয়া শর্তের সাথে মেলে। সুমি এগিয়ে গিয়ে দরজাটিকে ঠেলতে চেষ্টা করল, কিন্তু দরজা যেন একে একে তার শক্তি শোষণ করে নিচ্ছিল। সুমি কিছুতেই দরজা খুলে উঠতে পারেনি। মুকুল এগিয়ে এসে দরজার কাছাকাছি পৌঁছাতে গিয়ে, এক অদ্ভুত অনুভূতি পেল। তার হাতে অদৃশ্য কোনো শক্তি এসে লেগেছিল, আর সে যেন ঠেকে হালকা হয়ে উঠেছিল। এই অনুভূতির পর, তারা বুঝতে পারে যে, এই দরজা খুলতে হলে, তাদের একে একে ভেতরে প্রবেশ করতে হবে এবং সেই রহস্যের সত্যিকারের মুখোমুখি হতে হবে।
কিন্তু, সেই মুহূর্তে, পুকুরের জল আবার কাঁপতে শুরু করে। এবং সেই হাসির আওয়াজ—তারা শুনতে পায়, এবার আরো জোরালো, যেন পুকুরের সেই শক্তি তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
এভাবে, তারা একটি অন্ধকারের পথে প্রবাহিত হয়ে যায়, যেখানে সত্য আর মিথ্যার সীমা একে অপরকে ছিন্ন-ভিন্ন করে দিচ্ছে।
অধ্যায় ৫:
গুহার প্রবেশদ্বারটি ধীরে ধীরে খুলে গেলে, মুকুল এবং তার দলটি একে একে ভেতরে প্রবেশ করতে থাকে। দরজাটি যেন স্বাভাবিকভাবে খুলেছিল না, বরং কিছু অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে এটি একে একে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। গুহার ভেতরের বাতাস ছিল ঠান্ডা এবং ভারী, যেন তা বহু বছর ধরে না চলাচল করা অবস্থায় ছিল। মুকুল প্রথমে ভেতরে প্রবেশ করে, তার পিছনে একে একে সুমি, বিপ্লব, রিতা, এবং জিতু। তারা সবাই একে অপরের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে, একটু অস্বস্তি অনুভব করছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে এমন কিছু ছিল যা তাদের স্থির রাখছিল—যে তারা ঠিক পথেই আছো, সঠিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছি।
গুহার ভেতরে প্রবেশের পর, তারা দেখতে পায় যে, চারপাশে পুরনো পাথরের দেওয়াল, যেগুলোর উপর কিছু রহস্যময় প্রতীক খোদাই করা ছিল। কিছু প্রতীক ছিল সৃষ্টির চিহ্ন, কিছু আবার মৃত্যু এবং পুনর্জন্মের সঙ্গে সম্পর্কিত। এক এক করে তারা এগিয়ে যেতে থাকে, তবে কিছুতেই আর নির্ভুল পথ খুঁজে পেতে পারছিল না। যেন গুহার অন্ধকার তাদের পেছনে আসতে শুরু করেছে, আর প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে তাদের মনে এক অদ্ভুত চাপ সৃষ্টি হচ্ছিল। সুমি, যিনি সবসময় বাস্তব এবং যুক্তির দিকে তাকাত, এবার তার মনে হচ্ছিল, কিছু একটা দৃষ্টির বাইরে ঘটে চলেছে। “এটা কোনো সাধারণ গুহা নয়,” সুমি বলল, “এটি হয়তো এমন কিছু, যা কোনো মানুষ কখনও দেখেনি, অথবা বুঝতে পারে না।”
মুকুল তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার কি মনে হয়? এই গুহার মধ্যে কোনো কিছু লুকিয়ে আছে, না? এমন কিছু যা আমরা জানতেও পারি না?” সুমি এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “হ্যাঁ, মনে হচ্ছে। হয়তো এটা সেই পদ্ধতি, যা আমরা জানি না, অথবা অনুভব করতে পারি না।”
তাদের সামনে একটা রহস্যময় জায়গা খুলে যায়—একটি পুকুরের মতো জায়গা, যার পানি যেন সম্পূর্ণ স্থির ছিল, কিন্তু সেই স্থির পানির মধ্যে একটা অদ্ভুত উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল, পানির তলায় কিছু রয়েছে, যা সম্পূর্ণ দৃষ্টির বাইরে। মুকুলের চোখে এক নতুন আশঙ্কা দেখা দিল। সে ধীরে ধীরে পুকুরের কাছে এগিয়ে গেল। তার হাতটি ঝাঁকানো হচ্ছিল, কিন্তু সে জানত, তাকে কিছু করতে হবে। সে পুকুরের পানিতে হাত ডুবিয়ে দিল, কিন্তু তখনই কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করল। পানির নিচে একটি অবিশ্বাস্য শক্তি তাকে টেনে নেয়ার চেষ্টা করছিল। সে চিৎকার করে বলল, “সবাই, ফিরে আসো! কিছু ভুল হচ্ছে!”
তখনই, পুকুরের পানি এক অদ্ভুত সুরে ভেসে ওঠে, যেন পানির ভেতর থেকে এক ভয়াবহ শক্তি বেরিয়ে আসছে। মুকুলের হাত থেকে টর্চ পড়ে গেল এবং ধীরে ধীরে, পুকুরের তলায় অদৃশ্য শক্তি তার পায়ের দিকে এগিয়ে আসছিল। সবাই চিৎকার করে উঠে, তবে তাদের দেহগুলো যেন সেই অদ্ভুত শক্তির দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। সুমি, বিপ্লব, রিতা, জিতু—সবাই একে একে একে হাবুডুবু খেতে শুরু করেছিল। তাদের শরীর যেন একে একে পাতলা হয়ে যাচ্ছিল, যেন তারা বাস্তবে আর ছিলেন না, বরং কিছু অদৃশ্য পৃথিবী থেকে এই জগতে এসেছিলেন।
তারা যখন পুকুরের কিনারে পৌঁছেছিল, তখন তারা বুঝতে পারে, এটি কোনো সাধারণ জায়গা নয়। পুকুরের পানি আরও গভীর হয়ে উঠছিল, এবং পানির নিচে শাদা আলো হয়ে উঠছিল, যেন কোনও অতিপ্রাকৃত উপস্থিতি সেখানে বিদ্যমান। পুকুরের পানি উথলে উঠে, যেন কোনো এক কালো শক্তির আধিকারিক। একেকটা ঢেউ এসে তাদের দিকে আছড়ে পড়ছিল, তবে সেগুলোর কোনো ছায়া বা হাওয়া ছিল না। যেন পানি নিজেই একটা জীবন্ত সত্তা হয়ে উঠেছে।
এ সময়, মুকুল তার পকেট থেকে দেবদাস পণ্ডিতের দেওয়া তান্ত্রিক চিহ্নটি বের করে এবং পুকুরের পানির দিকে ছুঁড়ে দেয়। চিহ্নটি পানিতে ডুবতেই, পুকুরের পানি কিছুটা স্থির হয়ে গেল। অদ্ভুত সেই আলো এবং শক্তির উপস্থিতি একটু কমল, তবে তারপরও পুরো পুকুরের পরিবেশ ছিল এক অন্ধকার আঁধারে আবৃত।
রিতা সজাগ হয়ে বলল, “এই চিহ্ন কি আসলেই কাজ করবে?” মুকুল নিশ্চিত ছিল না, তবে সে জানত যে কিছু একটা শুরু হয়েছে। পণ্ডিতের দেওয়া চিহ্নই হয়তো তাদের জন্য একমাত্র ভরসা হতে পারে। কিন্তু যখন তারা পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন এক ভয়ানক আওয়াজ তাদের কানে এল—এটা ছিল একটি দানবীয় হাসি, যা পৃথিবী এবং আধ্যাত্মিক জগতের সীমা পেরিয়ে তাদের কাছে আসছিল।
এই হাসি, যে কোনো সাধারণ আওয়াজের চেয়ে অনেক গভীর, অনেক বেশি ভয়ঙ্কর ছিল। পুকুরের পানি আবার একদম গম্ভীর হয়ে উঠল, আর সবকিছু যেন ঠিকে গেল। মুকুল বুঝতে পারে যে, তারা ঠিক সেই জায়গায় এসেছে যেখানে অতিপ্রাকৃত শক্তি এবং মানবিক কৌতূহল একে অপরকে বাধ্য করছে—এবং তাদের সামনে আসন্ন এক কাল্পনিক কিন্তু আসল পরীক্ষা।
পুকুরের তলায় তখন এক ঝলক লাল আলো দেখা দিল, যেন এটি তাদের কাছে আসছে—একটিই উদ্দেশ্য: তাদের সত্যের সামনে ঠেলে দেয়া।
অধ্যায় ৬:
পুকুরের পানি একধরনের অদ্ভুত শীতলতা তৈরি করছিল, আর আশেপাশের পরিবেশে এক ভয়ানক নীরবতা নেমে এসেছিল। মুকুল, সুমি, বিপ্লব, রিতা, আর জিতু—সবাই দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে কেউই সরাসরি কিছু বলছিল না। তাদের মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি হয়েছিল, যেন তারা সবাই এক অজানা, অদৃশ্য শক্তির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পুকুরের পানির নিচে যে রহস্য ছিল, সেটি যেন তাদের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ এবং গভীর ছিল। কিন্তু এবার, তাদের সবাইকে একটি কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে—এতদিনের রহস্যের মধ্যে আসল সত্য কী?
বিপ্লব, যিনি সাধারণত সাহসী এবং দৃঢ়চেতা ছিল, এবার কিছুটা ভীত হয়ে গিয়েছিল। তার শরীরে এক অস্বাভাবিক অস্থিরতা কাজ করছিল, আর সে মুকুলের কাছে সোজা গিয়ে বলল, “মুকুল, আমি মনে করি আমাদের এখানে দাঁড়িয়ে থাকা উচিত না। এই পুকুর, এই গুহা—এগুলো আমাদের জন্য নয়। আমি কিছু মনে করছিলাম, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, এটি আমাদের জন্য বিপদজনক হয়ে উঠছে।” তার কণ্ঠে এক ধরনের চাপ ছিল, এবং সে পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছিল, তার সঙ্গীরা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিল, তবে কাউকেই কোনো কথা বলার সাহস হচ্ছিল না।
মুকুল বুঝতে পারছিল যে, বিপ্লবের মধ্যে একটা অস্বস্তি ছিল, যা তিনি আগেও কখনো দেখেননি। বিপ্লব কখনো ভয় পায়নি, কিন্তু আজকে তার মধ্যে একটা অদ্ভুত দোটানা ছিল। মুকুল তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল, “তুমি ভয় পেয়ো না, বিপ্লব। আমরা যদি এখানে না দাঁড়াই, তবে আমরা কখনো জানতে পারব না যে এই পুকুরের রহস্য কী। তুমি জানো, একমাত্র সাহসী হলেই আমরা এই রহস্যের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে পারব।”
বিপ্লব কিছুক্ষণ চুপ ছিল। তারপর সে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু… তুমি কি জানো, মুকুল, আমি কিছু দিন ধরে ভেবেছি। আমি এই পুকুরের কাছে একবার গিয়ে আবার ফিরে এসেছি। আমি জানি, এটা কিছু একটা—অস্বাভাবিক। আমাদের কি কখনো পেছন ফিরে দেখার সময় আসবে না?” তার কণ্ঠে আরও গভীর উদ্বেগ ছিল, যেন কিছু মনে মনে তাকে আশঙ্কিত করছিল।
সুমি, যে সর্বদা বাস্তবিক চিন্তা করতো, এবার বিপ্লবের কথা শোনার পর, তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “বিপ্লব, তুমি কি কিছু ভুল ভাবছ? আমাদের যখন এই রহস্যের সামনে দাঁড়াতে বলা হয়েছে, তখন আমাদের একসাথে এটিকে সমাধান করতে হবে।” কিন্তু সুমি নিজেও জানত, পুকুরের কাছ থেকে যে অদ্ভুত শক্তি অনুভূত হচ্ছিল, তা কোনো সাধারণ ঘটনাও হতে পারে না। তখনই, এক অদ্ভুত মুহূর্তে, সুমি অনুভব করল, এই পুকুরের পানি হয়তো তাদের জীবনকে স্থায়ীভাবে বদলে দিতে পারে।
জিতু, যে অনেকক্ষণ ধরে কিছু বলছিল না, এবার সামনে এসে বলল, “আমরা যদি এখান থেকে চলে না যাই, তবে কী হবে?” তার কণ্ঠে হতাশা ছিল, তবে সে কিছু বলতে পারছিল না। সে জানত, একবার যদি তারা এই রহস্যের গভীরে প্রবেশ করে, তাদের বের হওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। তার চোখে ভয় স্পষ্ট ছিল, কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণ করতে সে তার সহকর্মীদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা শুধু একবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আসল সত্য কখনও আমাদের সামনে আসবে না—যদি আমরা ফিরে না যাই।”
এভাবে, তারা সবাই একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিল, তাদের মনে একধরনের দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছিল—যেখানে একদিকে সাহসিকতা, অন্যদিকে বিপদের মুখোমুখি হওয়ার ভয় ছিল। বিপ্লবের মনে যেসব চিন্তা ঘুরছিল, তা তাদের সবার মনেও প্রবাহিত হচ্ছিল, তবে কেউই তা উচ্চারণ করতে পারছিল না। একে একে সবাই অনুভব করছিল, তারা যদি পুকুরের গভীরে গিয়ে পৌঁছাতে চায়, তবে তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা সেখানে অপেক্ষা করছে। পুকুরের জলে যা ছিল, তা তাদের পৃথিবীকে বদলে দেয়ার ক্ষমতা রাখত।
সুমি, মুকুল, রিতা, জিতু—সবাই কিছু না কিছু ভাবছিল। কিন্তু মুকুলের সিদ্ধান্ত ছিল স্পষ্ট। তার মনে তখন এক নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল—এই রহস্যের মুখোমুখি হওয়া ছাড়া তাদের জীবনে আর কোনো শান্তি আসবে না। মুকুল বলল, “বিপ্লব, আমি জানি তুমি ভয় পাচ্ছ, তবে আমরা সবাই এখানে একে অপরের সাথে আছি। আমরা এই পুকুরের রহস্য সমাধান করবো, একে একে। যদি সত্যিই কিছু ভয়ংকর কিছু ঘটতে থাকে, তাহলে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।”
বিপ্লব তার চোখে ভয়ের সঙ্গে একটু আত্মবিশ্বাসও দেখাল। “ঠিক আছে, মুকুল। তবে, আমি জানি, আজকে যদি আমরা এই পথটি না অনুসরণ করি, তবে কখনো আর আমাদের জীবনে স্বস্তি আসবে না।” সে মৃদু স্বরে বলল, “তাহলে, আমরা একসাথে যাত্রা শুরু করি।”
এই মুহূর্তে, দলের সবাই একসাথে পুকুরের পানির দিকে আবার এক পা বাড়ায়, তবে এই বার তাদের চোখে আর কোনো সংশয় বা ভয় ছিল না। তারা জানত, এখন তাদের জন্য একমাত্র পথ হলো পুকুরের রহস্যের সন্ধান পাওয়া, আর সেই পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের একে অপরকে আঁকড়ে ধরতে হবে।
তবে, তাদের সামনে যে বিপদ অপেক্ষা করছে, তা সবে শুরু হয়েছে।
অধ্যায় ৭:
পুকুরের পানিতে আবারও অদ্ভুত আলো ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই আলো ছিল শাদা এবং কোমল, কিন্তু এর মধ্যে এক ধরনের গভীর রহস্য লুকিয়ে ছিল। মুকুল, সুমি, বিপ্লব, রিতা, আর জিতু—সবাই পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে ছিল, তাদের চোখে এক আশ্চর্য চাহনি। পুকুরের পানি এখনও স্থির ছিল, কিন্তু তার নিচে কিছু ছিল—কিছু যা তাদের দেখার যোগ্য নয়। কিন্তু তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে, আর কোনো পথ না পেয়ে, পুকুরে ঢুকে পড়ার সিদ্ধান্ত নিল।
“তুমি কি প্রস্তুত?” মুকুল সুমির দিকে তাকিয়ে বলল। সুমি তার চোখে সাহস এবং আশঙ্কা উভয়ের মিশ্রণ দেখতে পেল, তবে সে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, তবে যদি কিছু ঘটে, তুমি জানো—আমরা একে অপরকে সাহায্য করবো।” মুকুলের চোখে এক দৃঢ়তা ছিল, সে জানত, এই পথ যে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে, তা শুধুমাত্র সাহসী হতে পারলে বের করা যাবে।
পুকুরের পানিতে ঢোকার সাথে সাথে, তারা বুঝতে পারে যে, পানি কোনও সাধারণ জলে পরিণত হয়নি। এর তলায় কিছু ছিল—এক শক্তিশালী প্রভাব, যা তাদের শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলছিল। পানি তাদের শরীরের মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছিল, তবে যেন এক অদৃশ্য শক্তি তাদের টেনে নিচে নিয়ে যাচ্ছিল। বিপ্লবের হাত একটু কাঁপছিল, সে সজাগ হয়ে বলল, “দূরে দাঁড়াও, আমাদের সবকিছু ঠিকভাবে করতে হবে।” কিন্তু তারা জানত, আর পেছন ফিরে দেখার সুযোগ নেই।
বিপ্লব, সুমি, রিতা, জিতু—সবাই একে একে পানির মধ্যে নেমে পড়ে, তবে মুকুল একটু পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল। তার মনে কিছু ভাবনা চলছিল। সে জানত, তাদের সামনে আসল বিপদ আসন্ন, এবং তাদের সকলের একে অপরের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে লেগে থাকতে হবে।
পানি যেন তাদের শরীরকে সম্পূর্ণ শোষণ করতে শুরু করল। মুকুল এবার সাহসী হয়ে পানির ভেতরে পা রাখল। এর মধ্যে, তাকে মনে হয়েছিল যেন সময় থেমে গেছে, পৃথিবী থেকে দূরে কোথাও তারা চলে গেছে। এক অদ্ভুত শূন্যতা তাদের চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই মুহূর্তে, তাদের দিকে এক অদ্ভুত শক্তি এগিয়ে আসছিল, যেন তারা আসল দুনিয়া থেকে দূরে চলে গেছে। পানির নিচে কিছু একটা ছিল, যা তাদের কাছে আসছিল।
অবশেষে, তারা এক রহস্যময় গুহার প্রবেশদ্বারে পৌঁছাল। এই গুহার মধ্যে প্রবাহিত এক ধরনের অন্ধকার শক্তি ছিল, যা তাদের সত্তাকে শুষে নেয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু সে শক্তির মাঝে কিছু ছিল—এক অদ্ভুত জাগরণ। গুহার ভিতরে প্রবেশ করেই, তাদের সবার মনে হয়েছিল যেন একটি বৃহৎ পুরাণের অন্ধকার অংশে তারা প্রবেশ করেছে।
গুহার দেওয়ালে কিছু প্রাচীন চিহ্ন খোদাই করা ছিল, যা একে একে তাদের চোখে পড়ছিল। সুমি এগিয়ে গিয়ে কিছু চিহ্ন বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করল। তার চোখে কৌতূহল ছিল, কিন্তু কিছু চিহ্ন এতটাই পুরনো এবং পরিস্কারভাবে ক্ষয়ে গিয়েছিল যে, তা বুঝতে পারা প্রায় অসম্ভব। তবে, এক সময় সে একটি চিহ্নের পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “এই চিহ্নটা—এটি কি সম্ভব?”
মুকুল এসে পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “এটা ঠিক আমাদের পুরনো মন্দিরের মতোই। মনে হচ্ছে, এই চিহ্নগুলোর মধ্যে কোনো এক আধ্যাত্মিক শক্তি লুকিয়ে আছে।” সে সুমির কথার সাথে একমত হয়ে বলল, “যদি আমি ভুল না হয়ে থাকি, তবে এই চিহ্নগুলি কোনো এক সময়ে আধ্যাত্মিক অভিশাপের অংশ ছিল।”
তাদের সামনে তখন এক দরজা খোলা ছিল, যে দরজা এক গভীর অন্ধকারে চলে গিয়েছিল। দরজার দিকে তাকিয়ে, রিতা বলল, “আমরা কি সত্যিই এখানে যেতে চাই?” তার কণ্ঠে ভয় ছিল, কিন্তু মুকুল দৃঢ়ভাবে বলল, “আমরা যদি না যাই, তবে কখনোই জানব না, পুকুরের রহস্যের শেষে কী আছে।”
তাদের একে একে গুহার গভীরে ঢুকতে হয়েছিল, এবং তাদের মধ্যে কোনো সন্দেহ ছিল না—এটা তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হতে চলেছে। গুহার ভিতরে প্রবাহিত শক্তি এবং অদ্ভুত অন্ধকার তাদের কাছে এক রহস্যময় অনুভূতি তৈরি করছিল, যেন তারা এক মহাকালিক দুনিয়ায় প্রবেশ করছে।
হঠাৎ করেই, সবার সামনে এক বিশাল গুহার দরজা খুলে গেল। দরজার ওপাশে ছিল এক শূন্যতার আচ্ছাদন—এক ভিন্ন দুনিয়া, যেখান থেকে শীতল বাতাস আসছিল। তারা বুঝতে পারল, এটাই সেই স্থান যেখানে অতিপ্রাকৃত শক্তি তাদের উদ্দেশ্য অর্জন করতে প্রস্তুত। এখন তারা যে রাস্তায় পা রেখেছে, তা তাদের জীবনের সবচেয়ে কঠিন পথ হতে চলেছে—তবে সেখান থেকে যদি তারা ফিরতে চায়, তবুও একথা তারা জানত, ওই গুহার ভেতরেই লুকিয়ে ছিল তাদের সমাধান।
তাদের মধ্যে কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তখন তাদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল, যেন তারা এটিকে অনুভব করতে পারছিল।
অধ্যায় ৮:
গুহার প্রবেশদ্বার খুলে যাওয়ার সাথে সাথে, পুরো দলটি একে একে অন্ধকারের ভেতরে প্রবেশ করল। গুহার ভেতরের বাতাস ছিল অবর্ণনীয় ঠান্ডা, আর তার মধ্যে এক অদ্ভুত বিষাক্ত গন্ধ ছিল। মুকুল, সুমি, বিপ্লব, রিতা, আর জিতু—সবাই একে অপরকে শক্ত করে ধরে এগিয়ে চলল। তাদের প্রত্যেকের চোখে এক গভীর দৃষ্টি ছিল, যেন তারা তাদের গন্তব্যের দিকে চলে যাচ্ছে, কিন্তু তাদের মনেও এক ধরনের ভয় ঘুরপাক খাচ্ছিল। গুহার ভেতরের অন্ধকার এতটাই ঘন ছিল, যে তারা একে অপরকে দেখতে পাচ্ছিল না, তবে তাদের পায়ের আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছিল না। গুহার দেয়ালগুলো এতটা পুরনো ছিল যে, কিছু কিছু জায়গায় তারা প্রায় ভেঙে পড়েছিল, আর তাতে সূর্যের আলো একেবারেই প্রবাহিত হতে পারছিল না।
কিছুক্ষণ এগিয়ে যাওয়ার পর, তারা এক জায়গায় পৌঁছায়, যেখানে গুহার দেয়ালগুলি একেবারে সোজা হয়ে উঠেছিল, এবং সেখানে কিছু বড় বড় পাথরের মূর্তি দাঁড়িয়ে ছিল। মূর্তিগুলোর চোখগুলো যেন তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল, আর তাদের মুখে এক ধরনের নিষ্ঠুরতা ছিল, যা তাদের হৃদয়ে শঙ্কা সৃষ্টি করছিল। সুমি এগিয়ে গিয়ে একটির কাছে দাঁড়াল। “এগুলো… পুরনো মূর্তি,” সুমি বলল, “এগুলো কি কোনো দেবতার বা দানবের প্রতিনিধি হতে পারে?” মুকুল তার দিকে তাকিয়ে বলল, “এগুলোর মধ্যে একটা রহস্য লুকিয়ে আছে। তবে আমি মনে করি, এগুলো সেই শক্তির অংশ, যা এখানে রয়েছে।”
পাথরের মূর্তিগুলোর সামনে এসে, তারা দেখতে পেল, একটি মূর্তির পায়ের কাছে কিছু সাদা ধুলো পড়ে রয়েছে। রিতা ধীরে ধীরে সেই ধুলোতে হাত দিয়ে দেখল। “এটা কি?” সে বলল, “এটা মনে হচ্ছে… কোনো মন্ত্র লেখা হয়েছে এখানে?” সে কিছুটা অবাক হয়ে বলল, “আমি বুঝতে পারছি না, কিন্তু এটা একধরনের মন্ত্রের চিহ্ন হতে পারে।”
মুকুল এবং সুমি মূর্তির দিকে আরও গভীরভাবে তাকাল, এবং তারা বুঝতে পারল, এখানে কিছু ছিল—কিছু গা dark ় এবং অদৃশ্য শক্তি, যা মূর্তির মধ্যে লুকিয়ে ছিল। তারা তখন একে অপরকে টেনেও সরিয়ে নিয়েছিল, কিন্তু সেই মুহূর্তে, গুহার মধ্যে একটা বিকট শব্দ শোনা গেল। একদম হঠাৎ করে, তারা দেখতে পেল, গুহার মধ্যে থেকে এক বিশাল শিয়ালসদৃশ ধোঁয়া বের হচ্ছে। গুহার দেয়ালগুলি হঠাৎ করে কাঁপতে শুরু করল, আর এক অদ্ভুত হাসির আওয়াজ শোনা যেতে লাগল—সেই হাসি, যা তারা প্রথম রাতে পুকুরের কাছে শুনেছিল।
“এটা… এটা কি?” বিপ্লব আতঙ্কিত হয়ে বলল। তার চোখে ভয় স্পষ্ট ছিল, এবং সে পেছনে হটতে শুরু করেছিল। “আমরা ভুল পথে যাচ্ছি! ফিরে যাও!” তবে মুকুল তাকে শান্ত করার চেষ্টা করল, “না, বিপ্লব। ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা যা দেখতে এসেছি, তা আমাদের সামনে আসতে হবে।”
হাসির আওয়াজ ক্রমাগত বড় হতে থাকল, এবং এক মুহূর্তে, সেই হাসির উৎসকে তারা দেখতে পেল। এক কোণ থেকে ধোঁয়ার মধ্যে ধীরে ধীরে একটি অদ্ভুত, কালো ছায়া দেখা দিল। এটি এক দানবীয় রূপ ধারণ করছিল, যার মুখে ছিল বিশাল দাঁত এবং তার শরীর কালো রঙের—যেন এক ভরাট অন্ধকার। মূর্তিগুলোর চোখগুলো হঠাৎ করে ঘুরে সেদিকে তাকাল, এবং এক ভয়ানক শব্দ বের হল।
“তোমরা কি আসলেই বিশ্বাস করেছিলে যে তোমরা এই গুহা থেকে বের হয়ে যেতে পারবে?” অদ্ভুত আওয়াজে এই কথাটি প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। দলের সবাই শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু মুকুল জানত, তারা শেষপর্যন্ত সঠিক পথে এগিয়ে এসেছে। সে গম্ভীর স্বরে বলল, “আমরা তোমার শক্তির সামনে নত হতে আসিনি। আমরা এখানে এসেছি সত্যকে জানার জন্য।”
ছায়া তখন এক মুহূর্তের জন্য নীরব হয়ে গেল, এবং পেছনের অন্ধকারে আরও গভীর হতে শুরু করল। তার পর, সে আবার বলল, “তোমরা যে চেষ্টা করেছ, তা কোনো ফল পাবে না। এখানে আসার জন্য তোমাদের জীবনের মূল্য দিতে হবে। পুকুরের পানির মধ্যে, যেখানে এক অন্ধকার দানবের আত্মা বাস করে, তোমরা তাকে অতিক্রম করতে পারবে না।”
এই শব্দগুলো শোনার সাথে সাথে, সুমি তার চোখ বন্ধ করে চিৎকার করল, “আমরা ফিরে যাব না! আমরা সাহসী। আমরা চাইলে আমরা সব কিছু জানব।” বিপ্লব তখন আরও বেশি ভীত হয়ে উঠল, কিন্তু সে সুমির কথায় কিছুটা সাহস পেয়েছিল।
ছায়া এবার আরও কাছে চলে আসছিল, এবং হঠাৎ করে, একটা প্রবল ঝলক দেখা দিল। গুহার দেয়ালগুলো কেঁপে উঠল, আর সমস্ত পরিবেশে এক অসাধারণ শক্তির অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল। তারা যখনই ওই ছায়ার দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল, তখনই গুহার মধ্যে যেন অন্ধকার আরও তীব্র হয়ে উঠছিল। একে একে, সবার মধ্যে একটাই অনুভূতি হচ্ছিল—তাদের সামনে এমন একটি শক্তি দাঁড়িয়ে আছে, যা হয়তো তাদের জীবনের একমাত্র পরীক্ষা হতে চলেছে।
বিপ্লব আর জিতু একে অপরকে দেখে সরে দাঁড়াতে চাইল, কিন্তু মুকুল জানত, এবার আর পালানো যাবে না। তাদের অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। “আমরা আর পেছনে ফিরে যাব না। এবার, সত্যের মুখোমুখি হব।” মুকুলের দৃঢ় কণ্ঠে এই কথা শোনার পর, বাকি সবাই একসাথে পুকুরের গহীন অন্ধকারের দিকে এগিয়ে গেল, যেখানে সত্য এবং বিপদ একসাথে অপেক্ষা করছিল।
এবং এইভাবে, গুহার গভীর অন্ধকারে, তারা এক নতুন ভয়াবহতার সাথে মুখোমুখি হল—যা ছিল তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।
অধ্যায় ৯:
গুহার মধ্যে সবার মাঝে এক অদ্ভুত অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছিল। মুকুল, সুমি, বিপ্লব, রিতা, এবং জিতু—সবাই একে অপরের দিকে তাকিয়ে কিছু বলছিল না। বাতাসের মধ্যে এক অদ্ভুত ভারীতা ছিল, যেন আকাশের সব আলো গুহার মধ্যে ঢুকে পড়েছিল, কিন্তু সেই আলো তলিয়ে যাচ্ছিল, অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল। গুহার দেয়ালগুলো কেঁপে উঠছিল, আর পাথরের মধ্যে থেকে কিছু অদ্ভুত আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল—এমন কিছু যা তাদের আতঙ্কিত করছিল।
তাদের সামনে এক বিশাল দানবীয় সত্তা ছিল, যার কালো শরীর এক অন্ধকার শক্তি হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল। এর চোখে ছিল ভয়ের চেয়েও বড় কিছু, যেন সেখানে এক শক্তিশালী পুরনো আত্মা বসবাস করছে। দানবের মুখ এক অদ্ভুত হাসি নিয়ে মুখরিত ছিল, যা পুরো গুহার দেয়ালগুলোতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। মুকুল সাহস খুঁজে বলল, “এটা সত্য নয়—তুমি কিছু না কিছু শক্তির প্রকাশ, তবে আমরা জানব, তোমার অভিশাপ আর কতদিন চলবে।”
দানব তার কালো চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে গভীর গম্ভীর স্বরে বলল, “তোমরা এসেছ কেন? এখানে এসেই তোমরা নিজেকে বিপদে ফেলেছ। আমি এই গুহার একমাত্র অধিকারী, আর পুকুরের পানির নিচে আমি বাস করি। আমার অভিশাপ মেনে নেওয়ার জন্য তোমরা এখানে এসেছ, কিন্তু আর ফিরতে পারবে না।”
পুকুরের গভীরতা আর গুহার অন্ধকারের মধ্যে কিছু ছিল, যা তাদের আত্মাকে শুষে নিতে চাইছিল। তাদের পায়ের নিচে আবার এক তীব্র কম্পন অনুভূত হলো, এবং পুরো গুহা যেন তাদের চারপাশে একটি দুষ্ট শক্তির জাল তৈরি করছিল। মুকুল জানত, তাদের সামনে এমন এক মুহূর্ত এসেছে, যেখানে জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে সীমারেখা এতটাই দুর্বল হয়ে গেছে যে, তাদের জন্য পেছনে ফিরে যাওয়ার আর কোনো পথ নেই।
“আমরা এসেছি কারণ আমরা সত্য জানার জন্য এসেছি,” মুকুল বলল। “যতই শক্তিশালী তুমি হও, তুমি আমাদের থামাতে পারবে না। আমরা জানব, পুকুরের রহস্য কী—এবং কেন তুমি এখানে আছো।”
দানব তার চোখে এক বিদ্ধেষী হাসি ফেলল, যেন সে মুকুলের কথায় ভ্রূকুটি করছিল। “তুমি জানো না, মানুষ। তোমরা তো কখনো ভাবো না যে, অতীতের সেই অভিশাপ তোমাদেরকে কোথায় নিয়ে আসবে। এই পুকুর, এই গুহা—এসব শুধু বাহ্যিক চিহ্ন। আসল অভিশাপ তো তুমিই বহন করছো। তোমরা যদি সত্য জানতেই চাও, তাহলে সেটা তোমাদের নিজেদের জন্য বিপদই হয়ে দাঁড়াবে।”
সুমি এবার এক পা এগিয়ে এসে বলল, “আমরা ভয়ে পালিয়ে যাব না। যদি কিছু জানতে চাই, তবে আমাদের নিজেদের জন্য সেই মূল্য চুকাতেই হবে। আমাদের সবাইকে একসাথে থাকতে হবে। আমরা ভয় পাই না।”
দানব সেই মুহূর্তে তাদের দিকে আরও গভীরভাবে তাকিয়ে তার শক্তি আরও বাড়িয়ে দিল। গুহার দেয়াল আবার কাঁপতে শুরু করল, আর তখনই একটা ভয়ানক ঝড়ের মতো বাতাস সারা গুহার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। গুহার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা মূর্তিগুলির চোখ আবার একসাথে নড়ে উঠল। পাথরের মূর্তির মুখের মধ্যে এক অদ্ভুত শব্দ বের হতে লাগল। মুকুল এবং তার দল বুঝতে পারল, তাদের সামনে এক প্রাচীন অভিশাপ ছিল—যেটি কখনো সহজে মুক্তি পেত না।
“তুমি যে অভিশাপের কথা বলছ, সেটা কি পুকুরের সঙ্গে সম্পর্কিত?” মুকুল জিজ্ঞেস করল। “আর তুমি, দানব, কেন এখানে আছো? কেন আমাদের জানাতে হবে, তুমি এখানে আছো?”
দানব এক পলক বিরতি দিয়ে বলল, “পুকুরের পানির নিচে এক অন্ধকার শক্তি ঘুমিয়ে ছিল। এক সময়, এই শক্তির ভয়ংকর অভিশাপ গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই সময়ের মানুষদের এক দুর্বিপাকে ফেলে দিয়েছিল। আমি ছিলাম তাদের কাছ থেকে দূরে, কিন্তু সেই অভিশাপ একদিন আমাকে খুঁজে বের করে এনে, আমাকে এভাবে বন্দী করেছিল। আজও আমি এখানে, পুকুরের নিচে বন্দী।”
রিতা ও জিতু একে অপরকে একদৃষ্টিতে দেখে চুপ হয়ে গিয়েছিল। তারা জানত, তাদের সামনে যে বিপদ অপেক্ষা করছে, তা শুধুমাত্র একটি খোলস খুলে বের হওয়ার মতো নয়—এটি তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হতে চলেছে।
“তাহলে, এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় কী?” সুমি বলল, “আমরা যদি জানি, আমরা সেটি করতে চাই।”
দানবের চোখে যেন এক ধরনের রুক্ষ অভিশাপের ছাপ পড়ল। “তোমরা যদি সত্যি মুক্তি চাও, তাহলে তোমাদেরকে পুকুরের গভীরে যেতে হবে। সেখানে, যেখানে আমার আত্মা ঘুমিয়ে ছিল, সেখানে তোমাদের প্রাণ বলি দিতে হবে। আর তার পর, তবেই মুক্তি মিলবে।”
তার এই কথাগুলো শোনার পর, সবার চোখে শঙ্কা ছিল, কিন্তু মুকুলের মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। “আমরা যদি এই পথে না চলি, তাহলে আমরা কখনো জানব না, পুকুরের রহস্য আসলেই কী। আমাদের একসাথে থাকতে হবে।”
এভাবে, এক ভয়ানক মুহূর্তে, তারা আবার পুকুরের দিকে পা বাড়ায়, জানত, তাদের সামনে কি বিপদ অপেক্ষা করছে। কিন্তু তারা একে অপরকে শক্তি দিয়ে দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দেয়, তাদের পিছু হটবে না। তাদের জন্য, পুকুরের গভীরে যে সত্য অপেক্ষা করছিল, তা মিথ্যা ছিল না—এটা ছিল তাদের নিজেদের সাহসের পরীক্ষা।
পরবর্তী অধ্যায়: পুকুরের মধ্যে প্রবাহিত সেই শক্তির প্রকৃতি এবং তাদের সবার সান্ত্বনা ও বিপদ—এটাই ছিল তাদের শেষ লক্ষ্য, যা তারা শেষ পর্যন্ত জানবেই।
অধ্যায় ১০:
দানবীয় শক্তির উপস্থিতি পুরো গুহায় ছড়িয়ে পড়ছিল। প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি শ্বাস, যেন তাদের জীবনের এক অদ্ভুত পরীক্ষায় পরিণত হচ্ছিল। মুকুল এবং তার দল জানত, এখন তাদের সামনে কোনো ফিরে যাওয়ার পথ নেই। তারা যদি সত্যি পুকুরের রহস্য উদঘাটন করতে চায়, তাহলে তাদের একে অপরকে ধরে এগিয়ে যেতে হবে। পুকুরের জল, গুহার অন্ধকার, আর দানবীয় শক্তির ছায়া—সবকিছু একত্রে তাদের দিকে এগিয়ে আসছিল। এখন যে পথটি তারা বেছে নিয়েছে, তার ফলাফল শুধু একটাই হতে পারে: বা তারা জিতবে, অথবা তারা হারিয়ে যাবে চিরকাল।
“তুমি যে বলেছিলে, পুকুরের গভীরে যাও, সেখানে জীবন এবং মৃত্যুর মাঝখানে এক সীমা রয়েছে। তুমি জানো, একে একে পুকুরের গভীরে প্রবাহিত হতে হবে।” দানবের আওয়াজ যেন পুরো গুহাকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। তার কথা শুনে, মুকুলের হৃদয়ে একটুও ভয় ছিল না। সে জানত, সত্যের পথে একে একে এগিয়ে যেতে হবে।
“আমরা এখান থেকে ফিরে যাব না,” মুকুল বলল, তার কণ্ঠে দৃঢ়তা ছিল। “তুমি যা বলছ, সেটা আমরা জানব। আমরা পুকুরের গভীরে গিয়ে সঠিক সত্য জানব।”
দানব তার কালো চোখে এক ধরনের হাসি ফুটিয়ে বলল, “তোমরা যখন পুকুরের মধ্যে প্রবাহিত হবে, তখন সত্যি জানবে, কিন্তু তা তোমাদের জীবন থেকে শেষ পর্যন্ত কোনো শ্বাস পর্যন্ত ছিনিয়ে নিয়ে যাবে।”
অন্ধকারের মধ্যে, গুহার এক শেষ প্রান্তে একটি ছোট সিঁড়ি ছিল, যা পুকুরের দিকে নিচে চলে যাচ্ছিল। মুকুল এগিয়ে গিয়ে প্রথমে সিঁড়ির দিকে তাকাল। “এটা আমাদের শেষ পথ। এখানে এসে আমরা যদি থামি, তবে আমরা কোনো দিনও পুকুরের রহস্য জানব না।”
একেকটি সিঁড়ি পা দিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে, আর তাদের মনে হচ্ছিল, সময় যেন এখানে থমকে দাঁড়িয়েছে। গুহার দেয়ালগুলো চিরকাল শান্ত ছিল, যেন অতীতের গভীরতা এখনও এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের চারপাশে এক মৃত সন্ন্যাসীর মতো একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ছিল।
পুকুরের কাছে পৌঁছানোর সময়, পানির স্বচ্ছতা দেখে তারা সবাই একত্রে থেমে গিয়েছিল। “এটা কি সত্যি?” রিতা বলল। “এটা এতই শান্ত, এতই পরিষ্কার—যেখানে কোনো কিছু লুকানো থাকে না?”
পুকুরের পানি যেন তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। পানির নিচে এক গভীর রহস্য ছিল, যা তাদের চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল না। মুকুল বুঝতে পারছিল, এখানে যা কিছু লুকিয়ে আছে, সেটা সবার জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। কিন্তু তারা যদি পিছু হটে, তাহলে তারা আর কখনও জানবে না। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল সেই অদৃশ্য সত্যকে আবিষ্কার করা, যা তাদের সামনে এক ধরনের অভিশাপ বা মুক্তি হতে পারে।
“এই পুকুরের জলে কী আছে?” সুমি মুকুলকে জিজ্ঞেস করল।
“এখানে কোনো সাধারণ পানি নেই,” মুকুল বলল। “এটা শুধুমাত্র পুকুর নয়, এটি অতীতের শক্তি, অতীতের প্রতিফলন। আর এখানেই আমাদের পক্ষে সফল হতে হবে।”
তারপর, মুকুল পুকুরের দিকে এগিয়ে গেল। পানির মধ্যে তার হাত ডুবিয়ে দিলে, এক অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগল—পানির মধ্যে থেকে যেন কিছু শক্তি তাকে টেনে নিচে নিচ্ছিল। সে এক পা এগিয়ে গেল, কিন্তু হঠাৎ করে, পুকুরের পানি ঘুরে উঠল এবং গাঢ় কালো হয়ে গেল।
“সাবধান!” বিপ্লব চিৎকার করে বলল। “এটা… এটা কিছু অন্য ধরনের শক্তি!”
তাদের চোখের সামনে, পুকুরের পানি ধীরে ধীরে বিভক্ত হতে লাগল এবং সেই বিভক্ত পানির মধ্যে দিয়ে, তারা দেখতে পেল—এক অন্ধকার, গাঢ় ছায়ার মধ্যে এক বিশাল আকৃতির পুতুলের মতো কিছু। পুতুলটি ঠিক যেন তাদের দিকে এগিয়ে আসছিল। মুকুল এক মুহূর্তের জন্য ভয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু সুমি তখন তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “এটা সত্য হতে পারে, মুকুল। একমাত্র যদি আমরা এই অন্ধকারের শক্তির দিকে এগিয়ে না যাই, তবে কখনো জানব না যে, এটা কি?”
বিপ্লব, যে বেশ কিছুক্ষণ ধরে ভয় পেয়েছিল, এবার জোর করে বলল, “আমরা একে অপরকে বিশ্বাস করি। এখন কিছু করতে হবে।”
মুকুল, সুমি, রিতা, বিপ্লব, আর জিতু একে একে পুকুরের দিকে আরও কাছে চলে এল। তাদের চারপাশে সেই অদ্ভুত শক্তি আরো প্রবল হয়ে উঠছিল, তবে তারা একে অপরকে শক্তি দিয়ে, শেষ পর্যন্ত পুকুরের ভেতরে প্রবাহিত হতে প্রস্তুত হয়েছিল। তাদের লক্ষ্য স্পষ্ট—তাদের একমাত্র উপায় ছিল পুকুরের গহীনতার মধ্যে যাওয়া এবং সেখানে থাকা সত্য এবং রহস্যের মুখোমুখি হওয়া।
হঠাৎ করেই, সেই বিশাল ছায়াটি যেন তাদের শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলেছিল। পুকুরের পানি তাদের চারপাশে এক অদৃশ্য শক্তির মতো আঁকড়ে ধরছিল। সুমি, বিপ্লব, রিতা, এবং জিতু একে একে পুকুরের গভীরে প্রবাহিত হতে লাগল, এবং মুকুল তাদের সাথে ছিল। পুকুরের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে তারা বুঝতে পারল—এটা তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। আর এর পর, যা ঘটতে যাচ্ছে, সেটা হয়তো তাদের জন্য এক চিরস্থায়ী সত্য হয়ে থাকবে।
তাদের একে একে পুকুরের পানির গভীরে হারিয়ে যেতে দেখে, এক মুহূর্তের জন্য গুহার ভেতর সবকিছু স্থির হয়ে যায়। সবার চোখে এখন একটাই প্রশ্ন ছিল—এই গহীনতার মধ্যে তাদের জন্য মুক্তি থাকবে, না বিপদ?
___