সমীর দাস
১
শহরের কোলাহল থেকে অনেক দূরে, নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে এক প্রাচীন কুঠিবাড়ি—জমকালো অতীতের ক্লান্ত ছায়া যেন তার শরীরজুড়ে বসে আছে। কাঁচা রাস্তা ধরে বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ঈশান ও মিতালি প্রথম দিন বাড়িটায় পা রাখল। চারপাশে নির্জনতা, কেবল পাখির ডাক, আর মাঝেমধ্যে ঝোপের মধ্যে কী যেন সরসর শব্দ। দূরে ধীরে বয়ে চলেছে একটি অলস নদী—তার পাড়ে শাল, সেগুন আর করমচা গাছে ঘেরা এই প্রাসাদসমান কাঠামোটি যেন নিঃশ্বাস ফেলে। ঈশান, একজন শহরের স্থপতি, পুরনো স্থাপত্য ভালোবাসে। বহুদিন ধরেই ওর ইচ্ছে ছিল এমন এক নিঃসঙ্গ জায়গায় থাকা, যেখানে আধুনিক দুনিয়ার ছোঁয়া কম, এবং নিজের কাজের জন্য নির্মল নিঃশব্দতা পাওয়া যাবে। মিতালি, একজন তরুণ লেখিকা, তার সাম্প্রতিক উপন্যাসের প্লট খুঁজতে খুঁজতেই স্বামীর সঙ্গেই চলে এসেছে এই অজানার দিকে। যদিও স্থানীয় লোকেরা বারবার সাবধান করেছিল—”ও বাড়িতে রাত নামলে বাতাস পাল্টে যায়”, “সেই বাড়ি কুলক্ষেত্র, খারাপ কিছু আছে…”—তবু তারা কান দেয়নি। ঈশান তো এই ধরণের কথাকে কুসংস্কার ছাড়া কিছুই মনে করত না, আর মিতালি বরং একে রহস্যময় রসদ হিসেবে নিচ্ছিল। তাদের ঠিকানাটি ছিল বিশাল এক লোহার ফটক পেরিয়ে, দুই পাশে আগাছায় ভরা বাগান, মাঝখানে সরু এক ইটের রাস্তা ধরে, ধূসর রঙা তিনতলা এক কাঠ ও ইঁটের প্রাসাদ—যার জানালাগুলোর শার্সি ভাঙা, বারান্দার রেলিং জং ধরা, আর ছাদে বুনো লতা ছড়িয়ে পড়েছে বিস্তৃতভাবে।
প্রবেশমুহূর্তে মিতালি একটু থমকে গিয়েছিল। তার মনে হয়েছিল যেন কেউ ওদের আসার অপেক্ষায় ছিল—একটা দৃষ্টি, যেন চুপি চুপি তাকিয়ে আছে ওপরে দাঁড়িয়ে। সে এক মুহূর্তের জন্য উপরের বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখেছিল—সেখানে এক শাড়িপরা মেয়ের ছায়ামূর্তি যেন দাঁড়িয়ে ছিল, যদিও ঈশান মজা করে বলেছিল, “তোমার লেখক-মনের কল্পনা এটা।” ঘরের ভেতর ঢুকে তারা দেখতে পেল, দেয়ালগুলোতে ন্যাড়া পলেস্তারা, মেঝে ধুলোতে ঢাকা, বাতাসে পুরনো কাঠের গন্ধ ও ছত্রাকের ছাপ। মিতালি জানত, এই ধরনের জায়গা হয়তো তার লেখার জন্য পারফেক্ট, তবু তার বুকের ভেতর অজানা একটা অস্বস্তি জমে উঠছিল। তারা প্রথম দুদিন ঘর গোছানো, জিনিসপত্র বসানো এবং আশপাশ ঘুরে দেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকল। কিন্তু তৃতীয় দিন থেকেই কিছু কিছু অদ্ভুত ব্যাপার ঘটতে শুরু করল—রাতের বেলা রান্নাঘর থেকে বাসন নড়ার শব্দ, আলমারির ভেতর রাখা জিনিসের স্থান পরিবর্তন, অথবা মিতালির লেখার খাতায় এমন কিছু লাইন উঠে আসা, যা সে লিখেনি। এক রাতে মিতালি স্বপ্নে দেখতে পেল, সে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে, তার সামনে দাঁড়িয়ে এক তরুণী—সাদা থান পরা, কপালে সিঁদুর, চোখে অদ্ভুত দুঃখ—সে বলল, “তুই কি ফিরেছিস আমার হয়ে?” সেই দিন সকালে উঠে মিতালি লেখার খাতায় আবিষ্কার করল—একটা কবিতা লেখা, যেটা পুরনো ব্রজবুলি মিশ্রিত বাংলায় লেখা, এবং তার কোনো স্মৃতি নেই যে সে এটা লিখেছে।
ঈশান তখনও এসব ব্যাপারকে হালকা করে নিচ্ছিল, ব্যাখ্যা করছিল ‘মানসিক ক্লান্তি’, ‘নতুন জায়গার মানিয়ে নেওয়ার চাপ’ ইত্যাদি বলে। কিন্তু মিতালির মধ্যে একরকম পরিবর্তন তিনি টের পাচ্ছিলেন—তার চোখে হতবাক চাউনি, মাঝেমাঝে চুপ করে থাকা, হঠাৎ নদীর দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে যাওয়া, এবং মাঝে মাঝে এমন কিছু কথা বলা যেগুলো তার স্বাভাবিক ধ্যানধারণার বাইরে। একদিন সন্ধ্যায়, তারা যখন বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিল, হঠাৎই মিতালি বলে উঠল, “তুই জানিস, আমি এখানেই মরি… এই নদীতেই… রাত ছিল, পূর্ণিমার… ও আমার প্রেমিক ছিল… কিন্তু ওর শরীর খুঁজে পাওয়া যায়নি।” ঈশান স্তম্ভিত হয়ে তার দিকে তাকিয়েছিল, মিতালি তখন চোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে সেই কথাগুলো বলছিল—যেন কোনো স্মৃতির গভীর পুকুর থেকে উঠে আসা স্বর। সেই মুহূর্তে দূরে নদীর পাড়ে একটি বাঁশি কিংবা কান্নার মতো শব্দ শোনা গেল—একটা দীর্ঘ, করুণ আওয়াজ, যা শুনে ঈশান নিজেও কেমন করে উঠল। প্রথমবার সে অনুভব করল, হয়তো এই কুঠিবাড়িতে কিছু আছে—যা কেবল ইট-কাঠের গাঁথুনির বাইরেও বিস্তার করেছে নিজেকে, এবং যা একদিন তাদের নিঃসঙ্গতাকে হঠাৎই ছিঁড়ে ফেলে এক অন্য জগতের দরজা খুলে দিতে পারে। সে জানত না, এটা কেবল শুরু… চন্দ্রাবতী এখনও অপেক্ষা করছে—অন্ধকারে, প্রতিটি পূর্ণিমায়, প্রতিটি পদক্ষেপে।
২
রাত যত গভীর হয়, কুঠিবাড়ির গা ছমছমে নিঃশব্দতা যেন আরও ঘন হয়ে আসে। চারপাশের পাখির ডাকা থেমে যায়, নদীর ঢেউয়ের শব্দে ভেসে আসে এক অজানা সুর—মৃদু, কিন্তু মনখারাপ-করা এক কান্নার মতো। মিতালি ঘুমাতে পারছিল না। ঘরের জানালায় আলো এসে পড়ছে—পূর্ণিমার চাঁদের আলো। হঠাৎ তার মনে হল, কার যেন পায়ের শব্দ আসছে করিডোরে—ধীরে ধীরে হেঁটে যাওয়া, একসুরে টিক টিক টিক… মিতালি উঠে দরজার কাছে গিয়ে দেখল, করিডোর একেবারে ফাঁকা, অথচ সেই শব্দ থেমে নেই। বুকের ভেতর কেমন যেন জমাট বেঁধে গেল। সে আবার বিছানায় ফিরে এল। তখনই স্বপ্ন না বাস্তব, ঠিক বোঝা গেল না—সে দেখতে পেল, ঘরের কোণে এক নারী দাঁড়িয়ে আছে—সাদা থান পরা, মাথা নিচু, চুল ভিজে জট পাকানো, আর হাতের আঙুলে একটা প্রাচীন বালা। নারীটি ধীরে ধীরে মুখ তোলে, তার চোখে হাহাকার, কপালে রক্তরেখা—সে বলল, “আমার শেষ কথা শুনেছিল ও?” তারপর হঠাৎই যেন ছায়াটা মিলিয়ে গেল বাতাসে। মিতালি চিৎকার করে উঠে বসল, ঈশান পাশ থেকে উঠে পড়ল, “কি হয়েছে?” মিতালি কিছু বলতে পারল না, কেবল কাঁপতে লাগল।
পরদিন সকালে ঈশান তাকে বোঝানোর চেষ্টা করল—এইসব নতুন জায়গায় গিয়ে এরকম দুঃস্বপ্ন হওয়া স্বাভাবিক। “তুমি তো নিজেই অতিপ্রাকৃত গল্প লেখো, ওইসব ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খায়, তাই এমন হচ্ছে,” বলে সে মৃদু হাসল। মিতালি কিছু বলল না, কিন্তু তার ভেতরে একটা কিছু যেন নাড়া দিচ্ছিল। সে বারবার স্বপ্নের সেই মেয়েটার চোখদুটো মনে করতে চাইছিল—যেন কোথাও আগে দেখেছে, হয়তো কোনো ছবিতে, অথবা পুরনো বইয়ের পাতায়। দুপুরে সে একা ঘরের পুরনো আলমারিগুলো খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। একটা কাঠের আলমারির নিচের তাকে একটা জীর্ণ, ধুলো ধরা খাতা পেল—যেখানে হাতের লেখা কবিতা। বেশিরভাগই প্রেম আর বিচ্ছেদ নিয়ে। কিন্তু একটা কবিতা তার গায়ে কাঁটা দিয়ে দিল—”তুমি যদি আর ফিরে না আসো, আমি নদীতে ভেসে যাব। আমি কথা দিয়েছি, জানো? আমি কথা দিয়েছি চাঁদকে…” মিতালি হঠাৎই থেমে গেল, তার মনে পড়ল—এই লাইনটা সে আগের রাতে তার স্বপ্নে শুনেছিল, অথচ সে কখনও এটা পড়েনি। তখনই সে বুঝতে পারল, এটা শুধু দুঃস্বপ্ন নয়—এটা যেন কিছু মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা।
ঈশান তখনও ব্যস্ত ছিল বাড়ির কিছু কাঠামোগত সমস্যা নিয়ে, সে স্থানীয় এক রাজমিস্ত্রি ডেকে কাজ করাচ্ছিল। কিন্তু মিতালির চোখে মুখে যে পরিবর্তন সে লক্ষ্য করছিল, তাতে চিন্তা হচ্ছিল তার। একরাতে, সে যখন কাজ শেষে বারান্দায় বসে ছিল, মিতালি ধীরে ধীরে তার পাশে এসে বসে, চোখেমুখে এক অদ্ভুত নীরবতা। সে বলল, “তুমি জানো, একটা নদী অনেক কথা গোপন করে রাখে। রাতের নদী সব জানে, ঈশান… সব।” ঈশান কিছু বলার আগেই সে আবার বলল, “কাল রাতে আমি এক ঘাট দেখলাম—যেখানে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম… আমার পরনে সাদা কাপড়… আমি জানি না এটা আমি কেন ভাবছি।” ঈশান তাকে জড়িয়ে ধরে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল, কিন্তু তার ভেতরেও এক অস্থিরতা জন্ম নিচ্ছিল। রাতে ঈশান ঘুমিয়ে পড়লেও মিতালি বিছানায় শুয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকল—চাঁদের আলো নদীর গায়ে পড়ে রূপালি রেখা তৈরি করেছে। আর সেই আলোয় সে যেন স্পষ্ট দেখতে পেল—দূরে ঘাটের ধারে এক মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে… সে-ই মেয়েটি… এবং তার ঠোঁটে অল্প হাসি। কিন্তু সেই হাসিতে শান্তি নেই, আছে শুধু দীর্ঘ প্রতীক্ষা আর অসমাপ্ত ভালোবাসার যন্ত্রণা। মিতালি জানত না কেন, কিন্তু সে যেন ধীরে ধীরে ওই মেয়েটির মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিল… অথবা বলা ভালো, মেয়েটি যেন ধীরে ধীরে তাকে নিজের মধ্যে টেনে নিচ্ছিল।
৩
ঝরা পাতার মতো করে দিনগুলো ঝরে যাচ্ছিল। মিতালির রাতগুলো হয়ে উঠছিল অস্থির ও বিভ্রান্তিকর—জেগে থাকা আর ঘুম, স্বপ্ন আর বাস্তব, নিজের মধ্যে থাকা আর অন্য কারও হয়ে ওঠার সীমারেখাগুলো গুলিয়ে যাচ্ছিল। সে দিনে দিনে আরও চুপচাপ হয়ে পড়ছিল, মাঝে মাঝে পুরনো ধাঁচে কবিতা বলত, আর সন্ধের পর একা বারান্দায় বসে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকত দীর্ঘক্ষণ। ঈশান এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছিল ঠিকই, কিন্তু নিজের যুক্তিবাদী মনকে সে বোঝাতে চাইছিল যে এসব কেবল মানসিক ক্লান্তির বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু একদিন এমন কিছু ঘটল, যেটা তার বিশ্বাসের মাটিকে কাঁপিয়ে দিল। সেইদিন বিকেলে সে কুঠিবাড়ির দোতলার এক ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে আলমারির পেছনে খুঁজে পেল একটি পুরনো ধুলোমলিন কৌটো—ভেতরে ছিল হলদে হয়ে যাওয়া কাগজের মোড়কে বন্দি কিছু চিঠি, এবং একটি ছোট চামড়ার বাঁধানো নোটবুক। চিঠিগুলো পড়ে সে থমকে গেল। লেখা ছিল—“প্রিয়তমা চন্দ্রাবতী, আমি কথা দিয়েছিলাম, আমি তোমার জন্য ফিরে আসব, কিন্তু তারা আমার পথ রক্তে ভাসিয়ে দিয়েছে…” আরেকটি চিঠিতে লেখা—“তুমি যদি এই চিঠি পড়ো, বুঝবে, আমি মরে গেছি। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম বাঁচতে—শুধু তোমার জন্য।” ঈশানের গলা শুকিয়ে এল। চিঠিগুলো তারিখ অনুযায়ী ছিল ১৮৭৯ থেকে ১৮৮১ সালের মধ্যবর্তী সময়ের। চিঠিগুলোর নিচে নাম লেখা ছিল—‘নলিন’।
চামড়ার নোটবুকটি খুলতেই ঈশান দেখতে পেল, সেখানে একের পর এক হাতে লেখা কবিতা, যার প্রতিটি শব্দ থেকে যেন বিষাদ ঝরে পড়ছে। প্রথম পাতায় লেখা ছিল—”আমার নাম চন্দ্রাবতী, আমি লিখি কারণ আর কিছু করতে পারি না। আমার প্রেম আমাকে বাঁচাতে পারেনি, আমার কবিতা আমাকে হয়তো বাঁচিয়ে রাখবে…” প্রতিটি কবিতায় প্রেম, বিচ্ছেদ, প্রতারণা ও মৃত্যু গেঁথে আছে। ঈশান সেই কবিতাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তে পড়তে দেখতে পেল এক অদ্ভুত সাদৃশ্য—এই লাইনগুলো কিছুদিন আগে মিতালি নিজের লেখা বলে বলেছিল, অথচ তার কোনো উৎস ছিল না। এখন সে বুঝতে পারল, সেই কথা ও ভাষা আসলে চন্দ্রাবতীর আত্মার স্মৃতি থেকে এসেছে। সেই মুহূর্তে তার মনে পড়ে গেল আগের রাতে মিতালির বলা কথা—”আমি জানি না আমি এসব কেন ভাবি”, কিংবা তার বলা লাইন—”আমি নদীতে ভেসে যাব।” ঈশান অনুভব করল, সে আর তার স্ত্রী কেবল একটি পুরনো বাড়িতে নয়, বরং একটি অতীতের ব্যথা, অসমাপ্ত প্রেম ও প্রতিশোধের বৃত্তে ঢুকে পড়েছে, যেখান থেকে ফিরে আসা সহজ নয়। সে সিদ্ধান্ত নিল, যত দ্রুত সম্ভব এ বিষয়টা বুঝে উঠতে হবে, কারণ মিতালি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে—আর সেই শূন্যস্থানে চন্দ্রাবতীর আত্মা প্রবেশ করছে।
ঈশান সেই রাতেই মিতালিকে কিছু না জানিয়ে শৈলবালা ঠাকরুনের কাছে যায়—সেই বৃদ্ধা যিনি গ্রামে সবাইকে ভয় ধরিয়ে দেন, কারণ তিনিই একমাত্র জীবিত মানুষ যিনি ‘চন্দ্রাবতী’র নাম উচ্চারণ করতে ভয় পান না। ঠাকরুন অন্ধকার ঘরের এক কোণে বসে ছিলেন, চোখ দুটো কেমন জানি ঘোলা কিন্তু তীক্ষ্ণ। ঈশান তার সামনে চিঠিগুলো ও কবিতার খাতা রাখে। শৈলবালা একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন, তারপর মৃদুস্বরে বলেন, “ওর নাম এখনও কাঁদে বাতাসে। এই কবিতাগুলোর শব্দ নদীর ঢেউয়ে বাজে রাতে… তুমি বুঝতে পারছো না বাবু, মেয়েটা শুধু ভালোবাসত না, ওর ভেতরে আগুন ছিল, আর সেই আগুন আজও নিভেনি।” ঈশান জানতে চায়, নলিন কে ছিল? শৈলবালা বলে, “এক ব্রাহ্মণ যুবক… গরিব, কিন্তু শিক্ষিত, কবিতা লিখত… চন্দ্রাবতী আর ওর প্রেম গ্রামের মুখে মুখে ফিরত। জমিদার তা মেনে নেয়নি, ওকে মেরে পুঁতে ফেলেছিল বাগানের এক কোনে। আর চন্দ্রাবতী… ও মরে গিয়েছিল নদীতে ঝাঁপ দিয়ে। কিন্তু আত্মারা তো এমনি এমনি চলে যায় না, বাবু।” সেই মুহূর্তে ঈশান বুঝতে পারল, এই প্রেমের কাহিনি কেবল অতীত নয়—এর উত্তরাধিকার এখনও বেঁচে আছে, এবং এখন তার স্ত্রী, তার ভালোবাসা, তার জীবন এই অভিশপ্ত পরিণতির দিকেই এগিয়ে চলেছে।
৪
শৈলবালা ঠাকরুনের ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় ঈশানের মনে হচ্ছিল যেন তার ভিতরটা হঠাৎ বহু শতকের ইতিহাসে ভরে গেছে—অতীত আর বর্তমানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে যেন বুঝতে পারছিল, সময় কেবল ক্যালেন্ডারের পাতায় লেখা নয়, সময় ছায়া ফেলে যায় মানুষের শরীরে, ভালোবাসায়, দুঃখে আর প্রতিশোধে। সে রাতে সে মিতালিকে কিছু বলল না, কিন্তু ঘুমোনোর সময় তার বুকের মধ্যে একটা ভার জমে রইল—একটা ভয়, একটা অপরাধবোধ। ভোররাতে ঈশান ঘুম ভেঙে দেখল, মিতালি বিছানায় নেই। সে উঠে দরজার দিকে ছুটে যায়, তারপর দেখে বারান্দার এক কোণে বসে আছে মিতালি—চুল খোলা, পরনে শাল, হাতে সেই কবিতার খাতা। তার চোখ ফাঁকা, ঠোঁটে ফিসফিস শব্দ—কিছু আওড়াচ্ছে। ঈশান কাছে গিয়ে দেখে, সে বলছে, “ওর শরীর নদীতে ভেসে গিয়েছিল, কিন্তু চিঠি আমার কাছে ছিল… তারা চিঠি ছিঁড়ে ফেলেছিল, ওর কণ্ঠকে তারা মুছে দিতে চেয়েছিল…” ঈশান স্তব্ধ। মিতালির গলায় যে কণ্ঠ, তা যেন ঠিক তার নিজের নয়—সুরটা যেন পুরনো, ধীরে ধীরে ভেসে আসছে, অনেক দূর থেকে। সে তাকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় ফিরিয়ে আনে, আর মনে মনে স্থির করে, কাল সকালে শৈলবালার মুখে পুরো কাহিনি সে ফের শুনবে—শুধু সত্য জানার জন্য নয়, বরং মিতালিকে রক্ষা করার জন্য।
সেই পরদিন দুপুরে, ঈশান আবার হাজির হয় শৈলবালার কুঁড়েঘরে, হাতে নিয়ে আসে কবিতার খাতা, পুরনো চিঠি, আর কিছু প্রশ্ন—যার উত্তর তাকে যেকোনো মূল্যে পেতেই হবে। ঠাকরুন আজ একটু বেশি চুপচাপ, চোখ দুটি নদীর মতো স্থির, গলার স্বর গভীর। তিনি ধীরে ধীরে বলতে শুরু করেন—“চন্দ্রাবতী ছিল আলাদা… তার চোখে ছিল আগুন, আর মনে ছিল কবিতা। গ্রামের সব মেয়ে তখন পুতুল খেলত, সে লিখত, আঁকত, আর সেই নলিন নামের ব্রাহ্মণ ছেলেটার সঙ্গে নদীর ঘাটে কবিতা বিনিময় করত। ওরা ভালোবেসেছিল—নিঃস্বার্থভাবে। কিন্তু জমিদার, মানে চন্দ্রাবতীর বাবা, রুদ্রনারায়ণ রায়… সে ছিল অভিমানী, আধিপত্যবাদী মানুষ। তার একমাত্র কন্যা যেন এক গরিব কবির প্রেমে পড়েছে, এটা সে মেনে নিতে পারেনি। তাই একদিন সন্ধ্যাবেলা, ঘাট থেকে ফেরার পথে নলিনকে ধরে নিয়ে গিয়ে, তার শরীর নদীতে ফেলে দেয়। কেউ কিছু জানে না, শুধু কয়েকজন চাকর আর আমি দেখেছিলাম—আমার বয়স তখন বারো।” ঈশানের গা শিউরে ওঠে। ঠাকরুন কথা চালিয়ে যান—“তারপর থেকেই চন্দ্রাবতী পাল্টে যায়। চুপচাপ থাকে, নদীর পাড়ে বসে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এক পূর্ণিমার রাতে সে উপরের ঘর থেকে নদীতে ঝাঁপ দেয়। কিন্তু তার আত্মা… থেকে যায়। তারা চেয়েছিল, এই প্রেম মুছে যাবে, সময় সব গিলে ফেলবে। কিন্তু তুমি জানো, ঈশান বাবু—যে প্রেম স্বীকার পায় না, সে অভিশাপ হয়ে বেঁচে থাকে।” ঠাকরুনের চোখে জল এসে যায়, সে ফিসফিস করে বলে, “এই কুঠিবাড়ি আজও তার প্রিয় জায়গা, আর যে আসুক এখানে, যদি তার হৃদয়ে ভালোবাসা থাকে—সে চন্দ্রাবতীর ডাকে সাড়া দেবে… চাইলেও সরে আসতে পারবে না।”
ঈশান স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। তার কানে যেন শব্দ হচ্ছিল না, বরং চারপাশে নেমে আসছিল ভারি এক নীরবতা। চন্দ্রাবতীর গল্প শুধু এক প্রেমের বেদনা নয়, এটা এক জীবন্ত ইতিহাস, যা এখন মিতালির শরীরে ও মনে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে বাসা বাঁধছে। ফিরতে ফিরতে ঈশান ভাবছিল—মিতালির এই পরিবর্তনের পেছনে যদি সত্যিই চন্দ্রাবতীর আত্মা থাকে, তাহলে কীভাবে সে তাকে বাঁচাবে? নাকি সে নিজেও চন্দ্রাবতীর খেলা-ঘরের একটি অংশ হয়ে পড়বে? সন্ধে নামছিল। কুঠিবাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে ঈশানের মনে হচ্ছিল, যেন বাতাস ভারি হয়ে এসেছে, গাছের পাতাগুলো নিঃশব্দে সরে যাচ্ছে, আর দূরের নদী ধীরে ধীরে এক অদ্ভুত সুরে বয়ে যাচ্ছে। সেই সুর যেন কোনো এক ফেলে আসা কণ্ঠের কান্না, কিংবা অসমাপ্ত এক কবিতার শেষ লাইন—যা আজও লেখা হয়নি। ঘরের দরজায় এসে ঈশান দেখে, মিতালি আবার জানালার পাশে বসে, সেই খাতাটি খুলে রেখেছে, আর তার ঠোঁটে ধরা সেই লাইন—“তুমি যদি ফিরে না আসো, আমি আবার ঝাঁপ দেব…” ঈশান বুঝে গেল, সময় খুব কম। মিতালি এখন আর শুধু তার স্ত্রী নয়, সে এখন এক আত্মার বার্তাবাহক—যার গল্প এখনও বলা বাকি।
৫
বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামছিল কুঠিবাড়ির আকাশে। নদীর ওপার থেকে আসা হালকা কুয়াশা যেন জলভরা চোখের পর্দা হয়ে ভেসে আসছিল জানালার ধারে। মিতুল রান্নাঘরে খুন্তির আওয়াজ তুলছিল, আর অভিজিৎ বসল ঘরের কোণে রাখা পুরনো রেকর্ড প্লেয়ারের সামনে। মিতুল পুরনো কলকাতার গানের প্রতি এক অদ্ভুত দুর্বলতা পোষণ করে, সেই শখে সে কুঠিবাড়িতে কিছু রেকর্ড এনেছিল। অভিজিৎ একটিকে চালু করতেই ঘরে ভেসে উঠল “তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা…”—বিভা সেনের কণ্ঠে এক বিষণ্ন প্রেমগীতি। গানের সুরে এক অচেনা চাপা কান্না মিশে ছিল, যেন কেউ তার দীর্ঘ অপেক্ষার অভিমান ঢেলে দিচ্ছে সুরের শরীরে। হঠাৎই ঘরের মেজেতে একটি মৃদু আওয়াজ, যেন কাঠের নীচে দিয়ে কেউ পায়ে পায়ে হাঁটছে—অভিজিৎ চমকে উঠল। কিছুক্ষণের জন্য গান থেমে গেল নিজে থেকেই, ঘড়ির টিকটিক শব্দ একমাত্র সঙ্গী হয়ে রইল ঘরে। এই প্রথমবার, অভিজিৎ কুঠিবাড়ির ভিতরকার এক ঘনীভূত নীরবতাকে অনুভব করল—যা কেবল নির্জন নয়, বরং প্রতীক্ষার মত চেপে বসে থাকে বুকের উপর।
রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে মিতুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখ নদীর দিকেই, কিন্তু মনে কোথাও যেন অস্বস্তি। অভিজিৎ তার পাশে এসে দাঁড়াতেই মিতুল বলল, “তুমি কি জানো অভি, আমি মাঝে মাঝে ভাবি কেউ যেন আমাদের দেখছে… জানলার ফাঁক দিয়ে, দরজার ছায়া থেকে, কিংবা ঘড়ির কাঁটার গোপন ছন্দে…” অভিজিৎ হাসল, “ভূতের গল্প পড়া কমাও, রাতে বাজে চিন্তা হবে না।” মিতুল গম্ভীর মুখে তাকাল, “গল্প নয়… আমি আজ সন্ধ্যায় একজনকে দেখেছি, সামনের বাগানে দাঁড়িয়ে ছিল, সাদা শাড়ি পরা একটা মেয়েকে।” অভিজিৎ চুপ করে গেল। ঘুমোতে যাবার আগে সে আলমারির খোলা ড্রয়ারে খুঁজে পেল একটি পুরনো সোনালি চিঠি—চিঠির কাগজে চন্দ্রাবতীর নাম, এবং লেখা, “আমি ফিরে আসবো… আমার ভালোবাসা আর আমার অভিশাপ নিয়ে।” এ যেন নিছক কবিতা নয়, বরং একটি অভিশপ্ত ইচ্ছার ঘনিষ্ঠ দলিল, যা সময়ের মধ্যে থেকেও সময়ের বাইরে ছিল। রাতে শুয়ে অভিজিৎ বারবার সেই সুরটার কথা ভাবছিল, বিভা সেনের গান, যেন কণ্ঠটা কারও নয়—চন্দ্রাবতীর নিজস্ব।
রাত বারোটার সময় আবার সেই গান বাজতে শুরু করল, অথচ রেকর্ড প্লেয়ার বন্ধ ছিল। অভিজিৎ ঘুম ভেঙে শুনতে পেল শব্দটা আসছে উপরের বন্ধ তালাবদ্ধ ঘর থেকে, যেখানে তারা এখনও যায়নি। মিতুল ততক্ষণে উঠে বসেছে, কাঁপছে। অভিজিৎ বলল, “আমি যাচ্ছি উপরে, দেখতে হবে।” মিতুল বাধা দিলেও সে থামল না। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে তার মনে হচ্ছিল প্রতিটি ধাপ যেন ভারী হয়ে উঠছে, যেন কেউ তাকে টেনে নিচ্ছে। উপরের ঘরের দরজা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল ধীরে ধীরে, কাঠের কর্কশ শব্দে। ঘরে ঢুকতেই সে দেখল—ঘরের মাঝখানে একটি আয়না, তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সাদা শাড়ি পরা এক মেয়ে, যার চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে, কিন্তু মুখ দেখা যায় না। মেয়েটির ছায়া পড়ছে না—এই অসম্ভব অনুভূতিই প্রথম তাকে স্তব্ধ করে দিল। আর ঠিক তখনই আয়নার ওপাশ থেকে ভেসে এলো একটা গলা—কিন্তু বিভার নয়, বরং রাগে, অপমান আর অভিমানে ছেয়ে থাকা এক কণ্ঠ, “আমি প্রতীক্ষা করছিলাম… তুমি আমার উত্তরাধিকারী… আমি ফিরে এসেছি, ভালোবাসার প্রতিশোধ নিতে।” সেই মুহূর্তে আয়নায় সে নিজের প্রতিচ্ছবির বদলে চন্দ্রাবতীর চোখ দেখল—লাল, আগুনের মত জ্বলছে। আর তখনই ঘর নিভে গেল সম্পূর্ণ অন্ধকারে।
৬
কুঠিবাড়িতে আসার পর থেকে প্রতিটি দিন যেন আরেকটু ঘন হয়ে উঠছে অন্ধকারে। প্রতিটি কোণ, প্রতিটি দেওয়ালের ফাটল, এমনকি প্রতিটি বাতাসের ধাক্কাও যেন আজকাল কিছু বলতে চায় তৃষা আর অরিন্দমকে। চতুর্থ রাতের সেই দগদগে লাল চোখের স্বপ্ন, সেই সুর ধরার শব্দ — কিছুই আর কল্পনার মতো লাগছে না তৃষার কাছে। অরিন্দম তাকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছে যে সবটাই মানসিক চাপের ফল, কিন্তু আজ সকালে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তৃষা যখন নিজের মুখে চন্দ্রাবতীর মতো জুলপির মতো চুল দেখে, তখন তার শরীর জুড়ে এক অজানা স্রোত বয়ে যায়। আয়নার কাচে দেখা যায় দুটি চোখ — একটি তার, আরেকটি… নয়। সেই চোখ ছিল ভয়ংকর, ক্ষুব্ধ, আর অভিশপ্ত! সে চিৎকার করে উঠে পড়ে, কিন্তু অরিন্দম এসে দেখে কেবল তৃষার নিজের ছায়া।
দিনের আলোয় সব স্বাভাবিক মনে হলেও তৃষা অনুভব করে এই কুঠিবাড়ির প্রতিটি বস্তু তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে। বাগানের নারকেল গাছ, বারান্দার লোহার ঝাঁপ, এমনকি চন্দ্রাবতীর সেই পুরনো প্রিয় আয়নাটি — সব যেন তৃষার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, অপেক্ষায় আছে কোনো এক পূর্ণতার। আজ সন্ধ্যায় অরিন্দম কলকাতায় ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে কারণ তাকে আগামীকাল অফিসে ফিরতেই হবে। তৃষা অনুরোধ করে একরাত আর থাকতে, কিন্তু অরিন্দম অনড়। “সবটা তোমার মনের ভুল, তৃষা। কাল ফিরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নাও, ভালো লাগবে,” বলেই সে বাইরে গাড়ি সার্ভিস ফোন করে। ঠিক সেই মুহূর্তে চন্দ্রাবতীর ঘরের দরজাটা আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে যায়, আর আয়নার কাচে ফুটে ওঠে আগুনের শিখা।
রাত নেমে আসে ভয়াল নিস্তব্ধতায়। অরিন্দম পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছে আর তৃষা জেগে থাকে আয়নার সামনে। সেই আয়না, যেটা আজ তাকে নিজের থেকে আলাদা করে রেখেছে। হঠাৎ আয়নার কাচ ফেটে যায়, আর তৃষা দেখে — আয়নার ওপারে একটা ঘর, সেখানে বসে আছে চন্দ্রাবতী, সাদা শাড়িতে, চোখে অদ্ভুত তৃষ্ণা। “তুই এসেছিস… অনেক দেরি করলি,” বলে মেয়েটি। তৃষা যেন ধীরে ধীরে টানা পড়ছে সেই ভিন্ন জগতে, আয়নার ভিতরে। হঠাৎ তৃষার গলা শুকিয়ে যায়, শরীর থরথর করে কাঁপে। আর আয়নার মধ্যে থেকে চন্দ্রাবতী বলে ওঠে, “তোর শরীর চাই… আমার প্রেম, আমার মৃত্যু, আমার প্রতিশোধের পূর্ণতা চাই… তুই দিতে পারবি?” তৃষা নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে, কারণ তার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে — সে আর একা নেই। চন্দ্রাবতী ফিরে এসেছে।
৭
রাত্রির গভীরে কুঠিবাড়ির শূন্য বারান্দায় বসে অর্ণব একা একা ধোঁয়ায় ভরা সিগারেটের দিকে তাকিয়ে ছিল, যেমনভাবে তার মনের ভিতরে জমে উঠছিল সন্দেহের ধোঁয়া। ইলা ঘুমিয়ে পড়েছে, অথচ অর্ণবের চোখে ঘুম নেই। বারবার তার মনে পড়ে যাচ্ছে সেই অদ্ভুত স্বপ্নটা—চন্দ্রাবতী নামটা, নদীর পাশে সাদা শাড়ি পরা এক মেয়ের মুখ, আর তার চোখের ভিতরের নীল আলো। কে এই মেয়ে? কেন সে অর্ণবের কাছে আসে? আর কেনই বা তার চোখের ভিতরে এত গভীর প্রতিহিংসার ছায়া? হঠাৎ একটা ঠান্ডা হাওয়া বারান্দা দিয়ে ঢুকে পড়ল, যেন অদৃশ্য কোনো অস্তিত্ব পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্ণব উঠে দাঁড়াল, চোখ রাখল সামনের অন্ধকার বাগানের দিকে। দূরে নদীর তীর, যেখানে মাঝেমাঝে আলো দপ করে জ্বলে উঠছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। ঠিক তখনই তার কানে এল মেয়েলি গানের সুর—একটা পুরনো বাংলা পদাবলির ছায়া, যেন শতাব্দীর পেছন থেকে উঠে আসা কোনো আত্মার কান্না।
পরদিন সকালে ইলা খুব অস্বাভাবিকভাবে চুপচাপ ছিল। তার মুখে কোনো কথা নেই, চোখে ক্লান্তি আর এক ধরনের শূন্যতা। অর্ণব তাকে প্রশ্ন করলে সে হেসে এড়িয়ে যায়, কিন্তু তার চোখে লুকানো আতঙ্ক স্পষ্ট বোঝা যায়। কুঠিবাড়ির দালান ঘরটিতে যাওয়ার পর ইলা হঠাৎই থমকে দাঁড়াল। দেওয়ালে ঝুলে থাকা একটি অদ্ভুত পুরনো ছবি—চন্দ্রাবতীর ছবি, যেটা তারা আগে কখনও দেখেনি। ছবির ফ্রেমের নিচে লেখা ছিল একটি ছোট লাইন: “আমি এখনও অপেক্ষা করি।” ইলা গম্ভীর হয়ে পড়ে, যেন কোনো পরিচিত চেহারা তার মনের কোনো অতীত স্মৃতিকে জাগিয়ে দিয়েছে। এরপর সারাদিন ইলার শরীর ভালো ছিল না। ঘন ঘন মাথা ঘোরানো, বমি ভাব, আর মাঝে মাঝে তার চোখের রঙ বদলে যাওয়া—সবকিছুই অর্ণবকে চিন্তিত করে তোলে। সে এক পল্লি চিকিৎসক ডেকে আনে, কিন্তু সে কিছুই বুঝতে পারে না। রাতে ইলা আবার ঘুমাতে গেলে সে আবার সেই মেয়েটিকে স্বপ্নে দেখে—চন্দ্রাবতী, যে এবার তার ঘাড়ে হাত রেখে বলে, “তুই আমার শরীর নিয়েছিস, এবার আমিও তোকে নেব।”
রাত তিনটে নাগাদ অর্ণব ঘুম থেকে চমকে ওঠে। ইলার ঘর খালি। সারা কুঠিবাড়ি খুঁজেও তার হদিস পাওয়া যায় না। ঠিক তখন, দালানের পেছন দিক থেকে এক অদ্ভুত শব্দ আসে—জলের গড়গড়, যেন কেউ নদীতে নেমে যাচ্ছে। অর্ণব ছুটে যায় সেদিকে, আর দেখতে পায়—ইলা, সাদা শাড়ি পরে, ধীরে ধীরে নদীর দিকে হাঁটছে। তার চোখে কোনো জ্ঞান নেই, মুখে এক ঠান্ডা নিষ্পৃহতা। “ইলা!”—অর্ণব চিৎকার করে, কিন্তু ইলার কোনো সাড়া নেই। সে একটানা হেঁটে যায় নদীর দিকে, যেন তাকে কেউ ডাকছে, টানছে। নদীর ধারে পৌঁছে ইলা থেমে যায়, পিছন ফিরে অর্ণবের দিকে তাকায়, আর তখনই তার চোখের ভিতর দিয়ে ঝলকে ওঠে সেই নীল আলো—চন্দ্রাবতীর চোখ। অর্ণব স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, বোঝে যে সে এখন আর তার পরিচিত ইলার সঙ্গে নয়—এই ইলা এখন চন্দ্রাবতীর শরীরী রূপ। নদীর হাওয়া ঘনিয়ে আসে, জলে কুয়াশার আস্তরণ জমে, আর অর্ণব বুঝতে পারে—এ লড়াই কেবল প্রেমের নয়, এ লড়াই আত্মা ও প্রতিশোধের, সময় ও সত্যের বিরুদ্ধে এক নিরন্তর সংগ্রাম।
৮
ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়েছে কুঠিবাড়ির জানালার পাতায়, কিন্তু রুদ্র আর কৃশার চোখে ঘুম নেই। বিগত রাতের সেই বীভৎস অভিজ্ঞতা এখনও তাদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। রান্নাঘরের পেছনের দেয়ালে আঁকা সেই রহস্যময় প্রতিকৃতি, যার চোখ যেন নিঃশব্দে চেয়ে থাকে, আর সেই চঞ্চল বাতাস—সব মিলিয়ে কুঠিবাড়ির পরিবেশ হয়ে উঠেছে আরও বিভীষিকাময়। কৃশা ধীরে ধীরে রুদ্রর কাছে গিয়ে বলে, “আমি জানি চন্দ্রাবতী এখনও এখানে আছে… কিন্তু ওর গন্তব্য কী?” রুদ্র কিছু না বলে উঠে দাঁড়ায়, যেন ভেতরে কোনো সিদ্ধান্ত পাক খাচ্ছে। সকালে দুজনে মিলে বাড়ির পিছনের দিকটা ঘুরে দেখতে বের হয়। তারা দেখতে পায়, এক ঝোপের পাশে পাথরের গায়ে এক পুরনো দোর—ছোট কিন্তু বিশিষ্ট, চারদিকে মাটি জমে গেছে, যেন বহু বছর কেউ স্পর্শ করেনি। কৃশা সেখানে হাত রাখতেই ঠান্ডা একটা বাতাস ছুঁয়ে যায় তার আঙুল। রুদ্র সেই দরজার পাথরের কিনারা হাতড়ে খুঁজে পায় একটা কাঁটা, যা টানতেই খুলে যায় দোর, নেমে যায় এক সরু সিঁড়ি পাতালের দিকে।
নিচে নামতেই ধুলো আর সোঁদা গন্ধে ভরে যায় তাদের শ্বাসপ্রশ্বাস। মোবাইলের আলোয় দেখা যায়, প্রাচীন কিছু প্রতীক—সুন্দরী নারীর অবয়ব, কপালে চন্দ্র, আর তার নিচে কিছু অদ্ভুত রক্তাক্ত চিহ্ন। এটা কোনো সাধারন কুঠিবাড়ির গোপন ঘর নয়—এ যেন এক চরম তান্ত্রিক স্থল। কৃশা এক মুহূর্তে বুঝে যায়—এখানেই চন্দ্রাবতীকে বলি দেওয়া হয়েছিল, তার সম্মান, তার প্রেম—সবকিছু কেড়ে নিয়ে তাকে উৎসর্গ করা হয়েছিল জমিদারের গোপন কৌশলের জন্য। দেয়ালের এক কোনায় একটি পাথরের খোপে তারা দেখতে পায় একটি প্রাচীন পুঁথি, যার কভারে লেখা ‘পঞ্চম পত্র’—তাতে বিস্তারিত আছে এক নিষিদ্ধ প্রেমকাহিনির, এক বিশ্বাসঘাতকের, এবং এক অভিশপ্ত আত্মার কাহিনি। রুদ্র ধীরে ধীরে পাতা উলটে পড়তে শুরু করে, আর প্রতিটি লাইনে যেন কৃশার শরীর কেঁপে ওঠে। এই পুঁথিতে লেখা আছে, জমিদারের মন্ত্র ও আত্মরক্ষা করার উপায়ও। কিন্তু সেই মন্ত্র পড়ে ফেললে ঘুমন্ত আত্মা জেগে উঠবে—এ হুঁশিয়ারিও লেখা।
রুদ্র আর কৃশা বুঝতে পারে, এখন পিছু হটার উপায় নেই। এই কুঠিবাড়ির গহীনে যে সত্য লুকানো আছে, তা জানলেই মিলবে মুক্তি অথবা ধ্বংস। কৃশার মনে পড়ে যায় গতরাতের স্বপ্ন, যেখানে সে নিজেকে দেখেছিল এক পুকুরের ধারে লাল বেনারসি পরে দাঁড়িয়ে—পেছনে দাঁড়ানো চন্দ্রাবতী যেন তাকেই আহ্বান করছিল। বাস্তব আর কল্পনা মিশে একাকার হয়ে গেছে তাদের জীবনে। হঠাৎই নিচের সেই সুনসান গুহার ভেতর থেকে এক নিঃশব্দ কান্না ভেসে আসে, যা ক্রমে রুদ্রর নাম নিয়ে ফিসফিস করতে থাকে। কৃশা ভয়ে জড়িয়ে ধরে রুদ্রকে, আর তারা দু’জনেই বুঝে যায়—এ কেবল অতীত নয়, এ এক প্রতিশোধের বর্তমান, যা আর অপেক্ষা করবে না।
৯
চন্দ্রাবতীর কুঠিবাড়ির চারদিকে তখন থমথমে নিস্তব্ধতা। মেঘলা আকাশ ধীরে ধীরে সন্ধ্যার গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছিল, যেন প্রকৃতি নিজেই ভয় আর প্রতীক্ষার আচ্ছাদন হয়ে উঠেছে। মৃণালিনী দাঁড়িয়ে ছিল বাড়ির পুরনো বারান্দায়, হাতে ধরা একটি পুরনো চিঠি—যেটি তারা আগের রাতে চন্দ্রাবতীর ঘরের দেয়ালের ফাঁক থেকে খুঁজে পেয়েছিল। চিঠির লেখা ছিল ঝাপসা, তবে সেখানে বারবার উঠে এসেছিল একটি নাম—বিজয়। চিঠি থেকে স্পষ্ট হয়েছিল, বিজয় নামের সেই যুবক চন্দ্রাবতীর প্রথম প্রেম, আর তাঁর মৃত্যুর পিছনে এই বিজয় ও তাঁর পরিবার জড়িত ছিল। মৃণালিনী চিঠির প্রতিটি শব্দ পড়ে যেন অনুভব করেছিল চন্দ্রাবতীর দীর্ঘ প্রতীক্ষার ক্ষরণ, যার প্রতিটি অক্ষর প্রতিহিংসায় মিশে আছে। পেছনে দাঁড়িয়ে অরিত্র বলল, “আমরা এখানে এসেছি সংসার করতে, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, এ বাড়ি কাউকে মুক্তি দেয় না। কেবল শিকল পরিয়ে রাখে।”
সন্ধ্যার পরেই হঠাৎই শুরু হয় বিদ্যুৎ চমকানো এক ঝোড়ো হাওয়া, যেন কুঠিবাড়ির ভেতরে কেউ বা কিছু জেগে উঠেছে। ঘরের বাতিগুলো একবার জ্বলে, একবার নিভে যায়। সেই আলো-আঁধারির খেলায় তারা দেখে—দেয়ালের ছবির মধ্যে চন্দ্রাবতীর মুখ স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তার ঠোঁট কাঁপছে, চোখে রাগ ও কান্নার অদ্ভুত মিশ্রণ। মৃণালিনী ভয়ে পিছিয়ে আসে, কিন্তু যেন সেই মুখ তাকে টেনে নিয়ে যায়, তার মনে হয় সে নিজেই হয়ে উঠছে চন্দ্রাবতী—তার কণ্ঠস্বরে চিৎকার করে বলে ওঠে, “তুমি কেন ফিরলে, বিজয়? তোমার প্রতিশ্রুতি ছিল!” অরিত্র হতবাক হয়ে স্ত্রীকে দেখে, তার মনে সন্দেহ হয়—এ কি শুধুই ভৌতিক উপদ্রব, না কি তার মৃণালিনী চন্দ্রাবতীর আত্মার সঙ্গে মিশে গেছে? এরই মাঝে তারা শুনতে পায় পেছনের বাগানে কারও পায়ের শব্দ, আর সঙ্গে সেই চেনা গন্ধ—রক্তের। অন্ধকারে আলোর ঝলকানিতে দেখা যায় সাদা শাড়িতে মোড়া এক মেয়ের ছায়া, তার পায়ের নিচে শুকনো পাতা ভাঙছে না, সে যেন মাটি ছুঁয়েই না।
অরিত্র তখন দৌড়ে যায় পুরনো আলমারির কাছে, যেখানে তারা আগের দিন চন্দ্রাবতীর লেখা আরও কিছু চিঠি পেয়েছিল। একটিতে লেখা ছিল, “যেদিন প্রতিশোধ সম্পূর্ণ হবে, সেদিনই আমি শান্তি পাব। যতদিন না সত্য প্রকাশ পায়, আমার ছায়া থাকবে এই কুঠিবাড়ির প্রতিটি ইটের ফাঁকে।” মৃণালিনী, তখন এক অজানা শক্তির প্রভাবে, ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে সেই প্রাচীন কুয়োর দিকে, যেখানে বলা হয় চন্দ্রাবতী নিজের জীবন শেষ করেছিলেন। অরিত্র বুঝতে পারে, কিছু একটা ঘটতে চলেছে, যা ঠেকানো না গেলে সব শেষ হয়ে যাবে। সে দৌড়ে গিয়ে স্ত্রীকে ধরে ফেলে, কিন্তু তখন মৃণালিনীর চোখ দুটি সম্পূর্ণ বদলে গেছে—তাতে আছে যুগ যুগ ধরে জমে থাকা কষ্ট, প্রেমঘৃণা আর প্রতিশোধের আগুন। অরিত্র চিৎকার করে বলে, “তুমি মৃণালিনী, তুমি চন্দ্রাবতী নও!” তার চিৎকারে হয়তো কিছুটা হলেও সেই আত্মা থমকে যায়, কিন্তু প্রকৃতি তখনও থেমে নেই—বজ্রপাতের এক আলোয় আবার ভেসে ওঠে সেই মেয়ে, সাদা শাড়ি রক্তে লাল, চোখে দীর্ঘকাল অপেক্ষার তীব্র প্রতিশোধ।
১০
দরজার চৌকাঠ পেরোনোর মুহূর্তে চন্দ্রাবতীর কুঠিবাড়ি যেন নিশ্বাস চেপে রেখেছিল। দীপ্তিমান ও সোহাগীর শরীর জুড়ে কাঁপুনি, চোখে ধোঁয়ার মতো অদ্ভুত কিছু। দেওয়াল বেয়ে রক্তের ছোপ, আয়নায় প্রতিফলিত হচ্ছিল এক মৃত মেয়ের ক্রন্দন। বাইরে তখন মেঘে ঢাকা আকাশ, বিদ্যুৎ চমকে উঠছে বারবার, যেন কেউ কুঠিবাড়ির অতীত উন্মোচনের প্রত্যক্ষদর্শী। সোহাগী ঘরের মাঝখানে হঠাৎই হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়, আর সেই মুহূর্তে তাঁর মুখ ঘিরে ঘুরতে থাকে এক মৃত মেয়ের কণ্ঠস্বর—”আমার রক্ত দিয়ে যে বেদনা শুরু হয়েছিল, আজ তার শেষ সময় এসে গেছে।” দীপ্তিমান চেষ্টা করে স্ত্রীকে তুলে ধরতে, কিন্তু ঠান্ডা হাওয়া আর এক অদৃশ্য শক্তির চাপে সে নিজেও মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ঘরজুড়ে চারপাশে মোমবাতি জ্বলে ওঠে, আগুনের শিখায় ফুটে ওঠে শতবর্ষ পুরনো ইতিহাস। চন্দ্রাবতীর আত্মা এবার পুরোপুরি প্রকাশ পায়। সে শুধু একটি আত্মা নয়, সে একটি যন্ত্রণাদগ্ধ প্রেম, প্রতিশোধ, আর চিরন্তন অপেক্ষার মূর্ত প্রতীক।
চন্দ্রাবতী দাঁড়িয়ে ছিল দীপ্তিমানের সামনে, ধবধবে সাদা শাড়ি, মাথায় লাল সিঁদুর, কপালে রক্তের দাগ। “তুই আমার প্রভাসের উত্তরসূরি… তোর রক্তেই আমার প্রতিশোধ সম্পূর্ণ হবে,” তার কণ্ঠ ছিল ক্রোধে টগবগে। দীপ্তিমান বুঝতে পারে, তার শরীরের রক্তে আছে সেই প্রভাসের পরিচয়—যে যুগে চন্দ্রাবতীর প্রেম আর বিশ্বাসকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল। সোহাগী তখন নিথর, তার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে, চন্দ্রাবতীর ছোঁয়া যেন তার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু হঠাৎই সোহাগীর চোখ দুটো খুলে যায়—তাতে চন্দ্রাবতীরই দৃষ্টি। আত্মা প্রবেশ করেছে সোহাগীর শরীরে, এবং সেই শরীর থেকেই এবার ঘটবে শেষ অধ্যায়। দীপ্তিমানের চোখে জল, তার স্ত্রী যে আর নেই, এটা বুঝে উঠতে না উঠতেই সোহাগী-চন্দ্রাবতী ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে তার দিকে। একটা ছুরি উঠে আসে বাতাসের ফাঁক থেকে, সেই পুরনো কুঠিবাড়ির পুরনো অস্ত্র, যেটা দিয়েই একদা প্রভাস নিজের প্রণয়িনীকে শেষ করেছিল। ইতিহাস এবার নিজেকেই পুনরাবৃত্তি করছে, কিন্তু বদলে গেছে ভূমিকা।
শেষ মুহূর্তে দীপ্তিমান হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। “আমার দোষ ছিল না, আমি তোমার প্রভাস নই,”—সে চিৎকার করে ওঠে। কিন্তু চন্দ্রাবতী জানে, আত্মার প্রতিশোধ সময় চেনে না, রক্তের সংযোগই যথেষ্ট। ঠিক সেই সময় বাইরে বজ্রপাত হয়, আর কুঠিবাড়ির মাথার উপর থেকে ছাদের এক অংশ ভেঙে পড়ে যায়। সেই ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে যায় দীপ্তিমান। সোহাগীর শরীর ধীরে ধীরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, এবং চন্দ্রাবতীর আত্মা হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে থাকে, মুখে শান্তির হাসি। প্রতিশোধ শেষ, অভিশাপ মুক্ত। পরদিন সকালে স্থানীয় এক বৃদ্ধ দেখেন, কুঠিবাড়ির দরজাটা খোলা, ভিতরে স্তব্ধতা, আর বাতাসে শুধু একটি কন্ঠস্বর—”এই ঘর আমার নয় আর…” কুঠিবাড়ি আবার নিঃসঙ্গ, কিন্তু এবার শান্ত, চিরতরে।
সমাপ্ত




