নন্দিতা দাস
১
শীতলপুর নামের ছোট্ট গ্রামটি যেন সময়ের স্রোতকে অগ্রাহ্য করে দাঁড়িয়ে আছে। মাটির বাড়ি, কাঁচা রাস্তা, চারপাশে গাছপালা আর মাঝে দিয়ে বয়ে চলা শান্ত কুশাবতী নদী—সব মিলিয়ে গ্রামের এক সহজ, নিরিবিলি ছবি। দিনের বেলায় নদীর ধারে হাট বসে, গ্রামের ছেলে-বুড়ো সেখানে বসে গল্প করে, গৃহিণীরা আসে কলসি ভরতে। কিন্তু রাত নামলেই এই কুশাবতী নদীর চেহারা যেন অন্যরকম হয়ে ওঠে। আকাশজোড়া চাঁদ উঠলে নদীর কালো জলের ওপর ঝিলমিল আলো পড়ে, গাছের ছায়া জলে মিশে যায়, আর সেই নির্জনতাকে ভেঙে কখনও শোনা যায় এক অচেনা কান্নার শব্দ। গ্রামবাসী অনেক বছর ধরে সেই কান্নাকে চন্দ্রাবতীর অভিশাপ বলে মানে। কারণ বহু আগে, সমাজের অপমান আর শ্বশুরবাড়ির নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে এক তরুণী বিধবা, নাম তার চন্দ্রাবতী, এই কুশাবতীর বুকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে নাকি তিনি সবাইকে শুনিয়েছিলেন তার অভিমানের আর্তি—“আমি ফিরব, এই অন্যায় মেনে নেব না।” সেদিনের সেই আর্তনাদ গ্রামজুড়ে কিংবদন্তি হয়ে আছে। মানুষ বলে, পূর্ণিমার রাতে তার আত্মা নদীর ধারে ঘুরে বেড়ায়, আর্তনাদের মতো কান্না শোনায়, যেন সে এখনও মুক্তি পায়নি।
গ্রামের প্রবীণদের মুখে শোনা যায়, চন্দ্রাবতী ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী, তবু জীবনের ছলনা আর মানুষের নিষ্ঠুরতায় তিনি বিধ্বস্ত হয়েছিলেন। বাল্যবিবাহের শিকার হয়ে শ্বশুরবাড়িতে আসা, স্বামীর অল্প বয়সেই মৃত্যু, আর তারপর সমাজের কঠোর বিধিনিষেধ তাকে এক অমানবিক জীবনে ঠেলে দিয়েছিল। শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার, সমাজের দৃষ্টি আর নিঃসঙ্গতা তাকে ধীরে ধীরে গিলে খাচ্ছিল। এক রাতে, পূর্ণিমার চাঁদে নদীর ঢেউ রুপোলি হয়ে উঠেছিল। তখনই তিনি নদীর ধারে গিয়ে শেষবারের মতো দাঁড়িয়েছিলেন। কেউ কেউ বলে, তিনি নিজের চুল খুলে দিয়ে নদীতে ভেসে দেন, যেন শেষ বিদ্রোহের চিহ্ন রেখে যান। তারপর নদীর কালো জলে মিলিয়ে গেলেন তিনি। সেই থেকে গ্রামবাসীরা নদীর ধারে রাতে যেতে ভয় পায়। অনেকে শপথ করে বলেছে—তারা দেখেছে সাদা শাড়ি পরা এক নারীকে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে, চুল খোলা, মুখ দেখা যায় না, শুধু বুক ফাটা কান্নার শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। কেউ আবার বলে, সেই কান্না শুনলেই শরীরে হিম নেমে আসে, পা জমে যায়, মনে হয় নদী নিজেই টেনে নিচ্ছে ভেতরে।
তবে ভয় আর গুজব সত্ত্বেও গ্রামের মানুষদের মধ্যে চন্দ্রাবতীর প্রতি অদ্ভুত এক সহানুভূতি আছে। গ্রামের মেয়ে-বউরা প্রায়ই বলে—“ওঁর দুঃখটা কেউ বুঝল না, তাই হয়তো তিনি শান্তি পাননি।” শিশুরা ছোটবেলায় গল্প শুনে ঘুমোয়, আর রাত নামলে খোলা আকাশের নিচে বসে চাঁদের দিকে তাকিয়ে ভাবে, নদীর ধারে এখন হয়তো তিনি হেঁটে বেড়াচ্ছেন। কেউ কেউ চন্দ্রাবতীর আত্মাকে অভিশাপ নয়, বরং এক চিরন্তন প্রতিবাদ বলে মানে। গ্রামের পুরোনো কবরখানায় গেলে দেখা যায়, একটি ছোট্ট বেদির মতো জায়গায় মোমবাতি জ্বালানো থাকে—গ্রামবাসীরা বিশ্বাস করে, ওখানেই চন্দ্রাবতীর আত্মা শান্তি খোঁজে। পূর্ণিমার রাতে যারা সাহস করে নদীর ধারে যায়, তারা ফিরে এসে ভাবে—এ যেন শুধু ভূতের ভয় নয়, বরং ইতিহাসের কান্না, এক নারীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ, যা সময়ের স্রোত মুছে দিতে পারেনি। আর এইভাবেই শীতলপুরের মানুষ আজও কুশাবতীর ধার ঘেঁষে হাঁটলে চন্দ্রাবতীর কান্না শুনতে পায়, যা তাদের মনে একদিকে ভয় জাগায়, অন্যদিকে গভীর সহানুভূতিও জন্ম দেয়।
২
চন্দ্রাবতীর মৃত্যুর পরদিন থেকেই শীতলপুরের মানুষ যেন বুঝে গিয়েছিল, এ মৃত্যু নিছক সাধারণ মৃত্যু নয়। গৃহস্থের উঠোন থেকে মাঠের আল, চায়ের দোকান থেকে শ্মশানের ধারে—যেখানেই বসা হতো, আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠত চন্দ্রাবতী। প্রবীণেরা বলতেন—“ও মেয়ে তো অন্যরকম ছিল, দুঃখ সহ্য করে গিয়েছিল দিনের পর দিন। কিন্তু যে সমাজ তাকে বাঁচতে দিল না, সেই সমাজকেই সে শাস্তি দিয়ে গেল।” কেউ কেউ বলত, নদীর ধারে সেদিনের পূর্ণিমা অস্বাভাবিক রকম উজ্জ্বল ছিল, যেন চাঁদ নিজেই তার কান্নার সাক্ষী হয়েছিল। কয়েকজন কৃষক নাকি ভোরে হাল নিয়ে মাঠে যাওয়ার সময় কুশাবতীর ধার থেকে ভেসে আসা হাহাকার শুনেছিল। গ্রামের মহিলারা নিজেদের অন্দরমহলে ফিসফিস করে বলত—চন্দ্রাবতীর আত্মা শান্তি পায়নি, তাই সে প্রতি পূর্ণিমায় ফিরে আসে। এইভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কেটে যেতে যেতে, তার আত্মহত্যা ধীরে ধীরে পরিণত হল এক কিংবদন্তিতে। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করল, চন্দ্রাবতীর মৃত্যুর মধ্যে আছে এক অভিশাপ, আর সেই অভিশাপ গ্রাম থেকে মুছে যাবে না যতদিন না তার আত্মা মুক্তি পাচ্ছে।
শীতলপুরের কিশোরেরা এই গল্প শুনে একদিকে ভয় পেত, অন্যদিকে এক অদ্ভুত কৌতূহলে ভরে উঠত। তারা দুপুরবেলায় একসঙ্গে বসে বৃদ্ধদের মুখ থেকে শুনত চন্দ্রাবতীর কাহিনি—কীভাবে তাকে শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে দিন কাটাতে হতো, কীভাবে সমাজের চোখে তিনি হয়ে উঠেছিলেন কলঙ্ক, আর শেষমেশ কীভাবে নদীর কালো জলে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। রাতে ঘরে ফেরার পর তারা ভয় পেত, কাঁথা মুড়ে শুয়ে থাকত, বাইরে বাতাসের শব্দ পেলেই মনে হতো নদীর ধার থেকে হয়তো কান্না ভেসে আসছে। আবার তাদের মধ্যে কেউ কেউ সাহসী হয়ে উঠত—বন্ধুদের নিয়ে ঠিক করত, একদিন পূর্ণিমার রাতে তারা যাবে নদীর ধারে, দেখবে সত্যিই কিছু আছে কিনা। এভাবেই ভয়ের সঙ্গে কৌতূহলের মিশ্রণে চন্দ্রাবতীর কাহিনি গ্রামের কিশোরদের কল্পনাশক্তিকে উসকে দিত। অনেক সময় তারা নিজেরাই গল্প বানিয়ে নিত—কেউ বলত নদীতে গেলে নাকি চন্দ্রাবতী সাদা শাড়ি পরে ডেকে নেয়, কেউ বলত তার ছায়া জলে ভেসে ওঠে। গ্রামের অন্ধকার অলিগলি জুড়ে এভাবেই ছড়িয়ে পড়তে লাগল সেই কাহিনির নানা রূপ।
ধীরে ধীরে এই কিংবদন্তি শুধু ভয়ের গল্প হয়ে রইল না, হয়ে উঠল গ্রামের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পূর্ণিমার রাত এলেই মানুষ দরজা-জানলা বন্ধ করে দিত, পুকুর বা নদীর ধারে যেত না, গৃহস্থরা বাচ্চাদের কড়া শাসন দিত যাতে বাইরে না বেরোয়। তবু গোপনে, কিছু মানুষ নদীর ধারে গিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে আসত, বিশ্বাস করত এতে চন্দ্রাবতীর আত্মা একটু শান্তি পাবে। কেউ কেউ আবার বলত, এ সবই নিছক মানুষের কল্পনা, প্রকৃতির শব্দ আর অন্ধকারকে ভুল বোঝা ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু যারা একবার কান্নার শব্দ শুনেছে বলে দাবি করত, তাদের চোখেমুখে এমন আতঙ্ক ফুটে উঠত যে অন্যরা চুপ করে যেত। ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্রাবতীর আত্মহত্যা আর কান্নার গল্প গ্রামের ইতিহাস হয়ে দাঁড়াল। প্রবীণরা নতুন প্রজন্মকে সাবধান করে দিত—“কখনও পূর্ণিমার রাতে কুশাবতীর ধার ঘেঁষো না।” আর শিশুরা মায়ের কোলে শুয়ে সেই গল্প শুনে বড় হতে হতে বুঝে গেল, শীতলপুরের বুকে যেমন আছে মাঠ, গাছ, নদী, তেমনই আছে এক অদৃশ্য অভিশপ্ত ছায়া, যার নাম—চন্দ্রাবতী।
৩
শীতলপুরের বছরের প্রথম পূর্ণিমা নিয়ে সবসময়ই গ্রামের মানুষদের মধ্যে এক বিশেষ আবহ তৈরি হতো। আকাশভরা চাঁদ, কুশাবতীর কালো জলে রুপোলি আলোর নাচন, আর চারপাশে ভুতুড়ে নীরবতা—সব মিলিয়ে গ্রাম যেন থমথমে হয়ে যেত। সেই রাতে সাধারণত কেউ ঘরের বাইরে বেরোত না, বিশেষত নদীর ধার তো নয়ই। কিন্তু কিশোরদের মন তো চিরকালই কৌতূহলী। বয়স্কদের মুখে গল্প শুনে শুনে তাদের বুকের ভেতর জমে উঠেছিল এক অদ্ভুত আকর্ষণ—সত্যিই কি চন্দ্রাবতী পূর্ণিমায় ফিরে আসে? নাকি সবটাই গাঁজাখুরি কাহিনি? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই গ্রামের চার-পাঁচজন তরুণ ঠিক করল, তারা এই পূর্ণিমার রাতে যাবে নদীর ঘাটে। বন্ধুদের মধ্যে একধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হলো—কে সাহস দেখাতে পারে, কে ভয় পেয়ে পিছু হটে। শেষ পর্যন্ত তারা দলে মিলে মশাল হাতে, হাসিঠাট্টা করতে করতে নদীর দিকে রওনা দিল। প্রথমে সবাই গলায় দাপট দেখালেও, কুশাবতীর কালো জল আর অদ্ভুত নীরবতা কাছে আসতেই তাদের হাসি ধীরে ধীরে স্তব্ধ হয়ে গেল।
নদীর ঘাটে পৌঁছে তারা চারপাশে চোখ মেলে তাকাল। রাত গভীর, গ্রামের সব আলো নিভে গেছে, শুধু আকাশের পূর্ণচাঁদই নদীর জলে ঝিকমিক করছে। গাছপালার ফাঁক দিয়ে হাওয়ার দোলা আসছে, তাতে পাতার মর্মর শব্দ হচ্ছে, আর সেই শব্দ যেন অকারণে ভয় জাগাচ্ছে। হঠাৎ তাদের মধ্যে একজন চিৎকার করে উঠল—“ওই দেখো!” বাকিরা তাকিয়ে দেখল, সত্যিই নদীর ঘাটের ঠিক মাঝ বরাবর, জলের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে এক সাদা শাড়ি পরা ছায়ামূর্তি। মাথা নিচু, চুল খোলা, আর ধীরে ধীরে আঁচড়াচ্ছে, যেন নদীর জলে নিজের প্রতিবিম্ব সাজাচ্ছে। বাতাস এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল বলে মনে হলো, শুধু কিশোরদের বুকের ধুকপুকানি আর নদীর গর্জন শোনা যাচ্ছিল। ভয় চেপে ধরল তাদের। কারও মুখ দিয়ে আর কথা বেরোলো না। ছায়ামূর্তিটি হঠাৎ মাথা তুলে তাকাতে চাইছে বলে মনে হলো, আর সেই দৃষ্টির আগেই ছেলেরা একসঙ্গে চিৎকার করে ছুট লাগাল। মশাল ফেলে দৌড়ে পালাতে লাগল গ্রামের ভেতরে। ভয়ে তাদের গা কাঁপছিল, চোখেমুখে আতঙ্ক জমে ছিল, আর পেছনে ফিরে তাকানোর সাহস তাদের কারও হল না।
পরদিন ভোর হতে না হতেই শীতলপুরে খবর ছড়িয়ে পড়ল—চন্দ্রাবতী নাকি সত্যিই ফিরে এসেছে! নদীর ঘাটে সাদা শাড়ি পরা এক নারীর ছায়া দেখেছে কয়েকজন তরুণ। খবরটা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল। কেউ বলল—“ওই তো প্রমাণ, এতদিনের গল্প মিথ্যে নয়।” কেউ আবার বলল—“ও কেবল মায়া, পূর্ণিমার আলোতে ছায়া খেলা।” তবু ভয়ের চেয়ে বিশ্বাসটাই জিতে গেল। গ্রামের গৃহিণীরা কেঁপে উঠল, শিশুদের শক্ত করে আঁকড়ে ধরল, আর প্রবীণরা মাথা নেড়ে বলল—“আমরা তো আগেই বলেছিলাম, চন্দ্রাবতীর আত্মা শান্তি পায়নি।” সন্ধ্যা নামতেই মানুষ দরজা-জানলা বন্ধ করল, আর পূর্ণিমার রাতের আতঙ্ক আরও গভীরভাবে ছড়িয়ে পড়ল গ্রামে। কিশোরদের চোখেমুখে আতঙ্ক স্পষ্ট, তারা শপথ করে বলল—যা দেখেছে তা মিথ্যে নয়। তাদের কণ্ঠের কম্পনই গ্রামের মানুষকে আরও নিশ্চিত করে দিল যে চন্দ্রাবতী সত্যিই ফিরে এসেছে। সেই রাত থেকে শীতলপুরে পূর্ণিমার আলো আর শুধু চাঁদের সৌন্দর্য নয়, হয়ে উঠল এক ভয়াল সতর্কবার্তা—নদীর ধারে কান্না আর ছায়ার খেলা আবার শুরু হয়েছে।
৪
পূর্ণিমার সেই রাতের ঘটনার পর শীতলপুরের পরিবেশ বদলে গেল। যেন অদৃশ্য এক ভয়ের পর্দা গ্রামটিকে ঢেকে ফেলল। দিনের বেলায়ও মানুষের চোখেমুখে আতঙ্ক স্পষ্ট হয়ে উঠল, আর রাত নামলেই সেই ভয় যেন দ্বিগুণ হয়ে যেত। কেউ আর সাহস করে নদীর ঘাটের দিকে যেত না। কুশাবতীর জলের ধারে যে কোলাহল, হাসি-গান বা গল্পগুজব একসময় শোনা যেত, সেখানে এখন নীরবতা রাজত্ব করছে। সন্ধ্যা নামলেই মুরুব্বিরা সন্তান-সন্ততিদের ঘরে ডেকে আনত, দরজা-জানলা বন্ধ করে দিত, যেন বাইরের অন্ধকারের ভেতরে কোনো অশুভ শক্তি ওঁত পেতে আছে। গ্রামের মহিলারা পর্যন্ত কলসি নিয়ে নদীতে জল তুলতে যাওয়া বন্ধ করে দিল, তারা দিনের বেলা গ্রামের কূয়ো বা পুকুরের জলেই নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে শুরু করল। এভাবে ধীরে ধীরে গ্রামবাসীর ভেতরে গড়ে উঠল এক অদৃশ্য বিভীষিকা—একটা অশুভ ছায়া, যেটাকে সবাই চন্দ্রাবতীর অভিশাপ বলে মানতে শুরু করল।
সময় গড়াতে গড়াতে সেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল মানুষের দৈনন্দিন জীবনে। কৃষকরা দেখতে পেল তাদের ফসল ঠিকমতো বেড়ে উঠছে না। আগের মতো মাঠে সবুজের সমারোহ দেখা যাচ্ছে না, ধান বা সবজির গাছে কোনো না কোনো রোগ দেখা দিচ্ছে। সেচের জন্য কুশাবতীর জল ব্যবহার করলেও তাতে যেন প্রাণ নেই, জমি শুকিয়ে যাচ্ছে, গাছপালা নুয়ে পড়ছে। কৃষকদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হলো—চন্দ্রাবতীর আত্মা নাকি জমিকে অভিশাপ দিয়েছে। অন্যদিকে মৎস্যজীবীরা জাল ফেলে হতাশ হয়ে ফিরতে লাগল। নদীতে আগের মতো মাছ নেই, ছোট ছোট কাঁকড়া বা অচেনা কিছু অদ্ভুত মাছ জালে ধরা পড়লেও বাজারে তার কোনো দাম নেই। অভাব-অনটন গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে লাগল, আর মানুষরা সব দোষ চাপাল চন্দ্রাবতীর আত্মার ওপর। প্রবীণরা বলল, নদীর ধারে আত্মা আটকে আছে বলে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ থেমে যাচ্ছে, জমিও শুকিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের লোকেরা তখন পূজো-অর্চনা শুরু করল, নদীর ঘাটে মন্ত্রপূত জল ছিটাল, ব্রাহ্মণ ডেকে যজ্ঞ করল—কিন্তু ভয় কমল না, বরং আরও বাড়ল।
এই ভয় ও কুসংস্কারের আবহ গ্রামজীবনকে ধীরে ধীরে অসাড় করে দিল। শিশুদের খেলার মাঠ ফাঁকা হয়ে রইল, কারণ নদীর কাছাকাছি যেতে তাদের পরিবার অনুমতি দিত না। গ্রামের মেলায় লোকসমাগম কমে গেল, রাতের আড্ডা বন্ধ হয়ে গেল। মানুষের হাসি-আনন্দ যেন হারিয়ে গেল কুশাবতীর অদৃশ্য ছায়ার আড়ালে। বয়স্করা বারবার বলত, “এটা ওঁর অভিশাপ ছাড়া আর কিছু নয়। আমাদের পাপের বোঝা বইছে গোটা গ্রাম।” ভয় এতটাই গভীরে ঢুকে গেল যে, কেউ অসুস্থ হলে ডাক্তার ডাকার বদলে সবাই বলত—এ চন্দ্রাবতীর ছায়ার ফল। কোনো শিশু কান্নাকাটি করলে মায়েরা ফিসফিস করে বলত—“চুপ কর, না হলে নদীর ধারের মা এসে নিয়ে যাবে।” ফলে আতঙ্ক শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের মনে নয়, শিশুদের মনেও স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিল। কুশাবতীর পাড়, যা একসময় ছিল জীবনের উৎস, এখন হয়ে উঠল মৃত্যুভয় আর অভিশাপের প্রতীক। শীতলপুরের মানুষ বুঝে গেল, তাদের গ্রাম আর আগের মতো নেই—এখন গ্রামটিকে গ্রাস করেছে ভয়ের ছায়া, যা চন্দ্রাবতীর কান্নার সঙ্গে মিশে চিরকাল বয়ে চলবে।
৫
শীতলপুরের গ্রামে যেদিন নতুন মুখ দেখা গেল, সেদিন গ্রামের মানুষ প্রথমে বিস্মিত, তারপর কৌতূহলী হয়ে উঠল। আধুনিক পোশাকে, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে এক তরুণ এসে উপস্থিত হয়েছেন গ্রামের একমাত্র ডাকবাংলোয়। নাম তাঁর অভীক মুখার্জি, কলকাতার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক। লোকগাথা ও গ্রামীণ কিংবদন্তি নিয়ে তাঁর গবেষণা চলছে, আর সেই সূত্রেই তিনি এসেছেন শীতলপুরে। কলকাতার কোলাহল ছেড়ে এই নিরিবিলি গ্রামে প্রথম পা রাখতেই তাঁর মনে হল—এ জায়গার বুকের ভেতর যেন লুকিয়ে আছে অজস্র অদ্ভুত কাহিনি। ডাকবাংলোয় উঠেই তিনি গ্রামের কয়েকজন প্রবীণের সঙ্গে আলাপ জমালেন। আলাপের ফাঁকে চন্দ্রাবতীর নাম শুনে তিনি থমকে গেলেন। সবাই সতর্ক গলায় সেই কাহিনি বলতে শুরু করল—কীভাবে এক বিধবা নারী নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন, কীভাবে তাঁর মৃত্যুর পর থেকে পূর্ণিমার রাতে নদীর ধারে কান্না শোনা যায়। বৃদ্ধদের কণ্ঠে ভয়, মহিলাদের চোখেমুখে আতঙ্ক দেখে অভীক বুঝতে পারলেন, এ নিছক লোকগাথা নয়, গ্রামবাসীর হৃদয়ের ভেতরে গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে আছে এক অদৃশ্য বিশ্বাস।
তবে অভীক পেশায় গবেষক, তাই কৌতূহল তাঁর রক্তে মিশে আছে। তিনি চন্দ্রাবতীর গল্প শোনার পরই স্থির করলেন, তিনি অবশ্যই খুঁজে বের করবেন এই কাহিনির আসল সত্য। গ্রামের লোকেরা তাঁকে বারবার সতর্ক করল—“শোনো বাবু, রাতে নদীর ধারে যেয়ো না। আমরা নিজেরা যাই না, তোমাকেও বারণ করছি।” এক প্রবীণ কৃষক বললেন—“অনেককে দেখেছি পূর্ণিমার রাতে ঘাটে গিয়ে ভয়ানক অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরতে। কারও শরীর অসুস্থ হয়ে গেছে, কারও আবার মাথা বিগড়ে গেছে। তুমি শহরের লোক, তোমার পক্ষে এসব সহ্য করা মুশকিল।” অভীক মৃদু হেসে তাঁদের আশ্বস্ত করলেন—“আমি ভূতের ভয় করি না। আমি শুধু জানতে চাই, এই গ্রাম এত বছর ধরে কেন এই গল্পকে আঁকড়ে আছে।” তাঁর চোখে একরাশ দৃঢ়তা ঝলসে উঠল। তবে তিনি কারও কাছে অশ্রদ্ধা দেখালেন না, বরং সব কথা ধৈর্য ধরে শুনলেন, নোটবুকে টুকে রাখলেন, কখনও প্রশ্ন করলেন—“চন্দ্রাবতীর মৃত্যুর সময় কে ছিলেন? কোন বছর?” আবার কখনও চুপচাপ নদীর দিকে তাকিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন। গ্রামের কিশোরেরা তাঁর চারপাশে ভিড় জমাল, মনে হল এ শহুরে অধ্যাপক তাঁদের মতোই কৌতূহলী, শুধু একটু বেশি সাহসী।
দিন কয়েকের মধ্যেই অভীক গ্রামে বেশ পরিচিত হয়ে উঠলেন। গ্রামের লোকেরা একদিকে তাঁকে ভদ্র-শিক্ষিত মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা করল, অন্যদিকে তাঁর কৌতূহল আর প্রশ্নোত্তরে অস্বস্তিও অনুভব করল। বিশেষত যখন তিনি বললেন—“আমি রাতে নদীর ধারে যাব, নিজে দেখে আসব।” তখন এক বৃদ্ধা কাঁপা গলায় বললেন—“বাবা, তুমি যদি নদীর ধারে যাও, তবে আর ফেরা হবে না।” কিন্তু অভীকের সংকল্প ভাঙল না। তাঁর মনে হচ্ছিল, এ গল্পের ভেতরে হয়তো চাপা পড়ে আছে কোনো সামাজিক সত্য, কোনো অজানা ইতিহাস, যা আজও আলো পায়নি। তাই তিনি ঠিক করলেন, পূর্ণিমার রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন না—যে কোনো অন্ধকার রাতে তিনি নদীর ঘাটে যাবেন, কান পাতবেন, দেখবেন আদৌ কিছু ঘটে কিনা। মানুষের ভয়কে ভেদ করে সত্যকে আবিষ্কার করার তাগিদই তাঁকে চালিত করছিল। এভাবেই শীতলপুরের চন্দ্রাবতী-অভিশপ্ত কিংবদন্তির সঙ্গে মিশে গেল এক নতুন চরিত্র—কলকাতা থেকে আসা তরুণ অধ্যাপক অভীক, যিনি ভয় নয়, সত্যের খোঁজকে বুকে ধারণ করে শীতলপুরের অচেনা রাতগুলিকে আবিষ্কার করতে উদ্যত হলেন।
৬
শীতলপুরে আসার পর অভীকের দিনগুলো কাটতে লাগল খোঁজখবর আর পর্যবেক্ষণে। সকালে তিনি বেরিয়ে পড়তেন, গ্রাম ঘুরে বেড়াতেন, কারও উঠোনে বসে গল্প শুনতেন, আবার কারও সঙ্গে মাঠে কাজ করতে করতে আলাপ জমাতেন। তিনি খেয়াল করলেন, চন্দ্রাবতীর নাম উচ্চারণের সময় মানুষের চোখেমুখে ভয়ের পাশাপাশি এক অদ্ভুত শ্রদ্ধার ছাপ ফুটে ওঠে। যেন সেই নারী মৃত্যুর পরও তাঁদের জীবনে অদৃশ্য এক ছায়ার মতো বিরাজ করছেন। গ্রাম্য মহিলারা বলত, “ওঁর দুঃখটা আমরা বুঝি, কিন্তু ভয়ও পাই। তিনি মায়ের মতোই, আবার অভিশাপের মতোও।” শিশুরা গল্প শোনার পর চুপ করে থাকত, তবে তাঁদের চোখে ঝিলিক থাকত কৌতূহলের। প্রবীণরা বলত, “চন্দ্রাবতীর কষ্টের শেষ হয়নি, তাই তাঁর আত্মা শান্তি পায়নি।” এসব শুনে অভীক নোটবুক ভরতে থাকলেন। তিনি বুঝলেন, শুধু ভূতের গল্প নয়, এখানে আছে সমাজের ইতিহাস, একটি নারীর সংগ্রাম আর অবহেলার প্রতিচ্ছবি। আর সেই কারণেই চন্দ্রাবতীর কাহিনি আজও এত জীবন্ত হয়ে আছে।
দিনভর মানুষের গল্প শোনার পর অভীক একদিন বিকেলের দিকে নদীর ধারে গেলেন। কুশাবতীর পাড়ে দাঁড়িয়ে তিনি নদীর জলে চোখ রাখলেন। গোধূলির আলোয় নদী যেন অন্য রকম লাগছিল—অর্ধেক আলো, অর্ধেক অন্ধকার। চারপাশে নিস্তব্ধতা, কেবল দূরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। তিনি হাঁটতে হাঁটতে ঘাট পর্যন্ত গেলেন। সিঁড়িগুলো পুরোনো, শ্যাওলায় ঢাকা, কিছু জায়গা ভেঙে গেছে। তিনি নীচে নেমে জলে হাত দিলেন, ঠান্ডা স্রোতের ছোঁয়া শরীর শিরশির করে তুলল। মনে হল, এই নদীই একদিন চন্দ্রাবতীর শেষ আশ্রয় হয়েছিল। চারপাশে বাতাসে একটা চাপা ভৌতিক গন্ধ টের পেলেন তিনি, যদিও তাতে ভয় নয়, বরং গবেষণার আগ্রহ আরও বাড়ল। গ্রামবাসীর ভয়কে ভেদ করতে হলে তাঁকে নিজেকেই অন্ধকারের মুখোমুখি হতে হবে—এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলেন তিনি। তাই সেই রাতেই তিনি স্থির করলেন নদীর ঘাটে বসে থেকে সবকিছু নিজ চোখে দেখবেন, কান পেতে শুনবেন।
রাত নামল। আকাশে চাঁদ উঠেছে, চারপাশ নিস্তব্ধ। অভীক চুপচাপ ঘাটের সিঁড়িতে বসে আছেন। পাশে শুধু তাঁর নোটবুক আর টর্চলাইট। বাতাস মাঝে মাঝে এসে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করছে মনে হলেও আসলে সময় যেন থমকে গেছে। প্রথমে কিছু শোনা যাচ্ছিল না—শুধু নদীর ঢেউয়ের শব্দ, দূরে মাঝে মাঝে কুকুরের ডাকে সাড়া। হঠাৎ করেই কানে এল এক ক্ষীণ শব্দ। অভীক প্রথমে ভেবেছিলেন বাতাসের খেলা। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই পরিষ্কার হল—এটা মানুষের কান্না। অদ্ভুত, হৃদয়বিদারক, বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা কান্না। শব্দ এতই ক্ষীণ যে যেন নদীর গভীর থেকে ভেসে আসছে। অভীক স্থির হয়ে বসলেন, চোখ খোলা, কান খাড়া। তাঁর বুকের ভেতর হালকা শীতল স্রোত বয়ে গেল, তবু তিনি ভয়ে পিছিয়ে এলেন না। বরং মনে হল, এটাই সেই সত্য, যেটার খোঁজ তিনি করতে এসেছেন। ক্ষীণ অথচ অসহায় সেই কান্না তাঁর গবেষণার সূচনা ঘোষণা করল—যা কেবল কাহিনি নয়, বাস্তবেও কোনো অদৃশ্য উপস্থিতি শীতলপুরের বুকে বেঁচে আছে।
৭
পূর্ণিমার রাত। কুশাবতী নদীর ওপর সাদা আলো ছড়িয়ে পড়েছে, যেন নদী আর আকাশ একাকার হয়ে গেছে। শীতলপুর নিস্তব্ধ, শুধু মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক কিংবা দূরে কুকুরের হুঁক্কাহুঁক্কি শোনা যাচ্ছে। অভীক সেদিনও তার ছোট্ট খাতাটি হাতে নিয়ে নদীর ঘাটে বসে ছিলেন। আগের কয়েক রাতের মতো তিনি নোট নিচ্ছিলেন, বাতাসের বেগ, পানির স্রোত, গ্রামবাসীর কথিত শব্দের সাথে বাস্তব শব্দের তুলনা। হঠাৎই সবকিছু যেন থমকে যায়। বাতাস থেমে যায়, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক মিলিয়ে যায়, এমনকি নদীর ঢেউয়ের শব্দও স্তব্ধ হয়ে পড়ে। অভীকের বুকের ভেতর ধকধকানি বাড়তে থাকে, কিন্তু চোখ ফেরাতে পারেন না। নদীর মাঝখানে চাঁদের প্রতিফলনের ভেতর থেকে যেন ধীরে ধীরে উঠতে থাকে এক অবয়ব। প্রথমে অস্পষ্ট, ধোঁয়ার মতো, তারপর ক্রমশ স্পষ্ট। তিনি দেখেন—সাদা শাড়ি পরা এক দীর্ঘকায়া নারী, তার সারা গা ভিজে, শাড়ি আঁকড়ে ধরেছে শরীর, লম্বা চুল ভিজে গিয়ে কাঁধ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। যেন জলের শরীর থেকে জন্ম নিয়েছে সে। অভীক হঠাৎ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যায়। এতদিন যে কাহিনি শুনে তিনি সন্দেহ করেছিলেন, সেটি আজ তাঁর চোখের সামনে সত্যি হয়ে উঠেছে। ভয় আর বিস্ময়ে তিনি শরীর নড়াতে পারছেন না।
সেই অবয়ব ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে নদীর ঘাটের দিকে। তার পদক্ষেপে জলে ঢেউ খেলে যায়, অথচ কুলে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই চারদিক কেমন অন্ধকারে ঢেকে যায়। অভীক প্রথমবার নারীর মুখ দেখতে পান—চোখ দুটো যেন চিরন্তন বেদনায় ভরা, ঠোঁট কাঁপছে কিন্তু কোনো শব্দ বেরোয় না। তারপরেই হঠাৎ অদ্ভুতভাবে সেই ছায়া তার দিকে তাকায়। অভীক অনুভব করেন, শরীরের প্রতিটি স্নায়ু যেন জমে গেছে। শীতল হাওয়ার মতো তার বুক বেয়ে নেমে যায় এক অচেনা ভয়ের ঢেউ। ঠিক তখনই সেই নারীর ঠোঁট খুলে যায়। স্বরটা এত ক্ষীণ, তবু যেন নদীর প্রতিটি ঢেউ বয়ে নিয়ে আসে—“আমার মুক্তি দাও…”। এই চারটি শব্দ যেন অভীকের অন্তরে শিকড় গাড়ে। তিনি বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ চারদিক ঝাপসা হয়ে আসে। বাতাসে অদ্ভুত এক গন্ধ, কাঁচা মাটি আর ভেজা কাপড়ের মিশ্র গন্ধ ভেসে বেড়ায়। চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে যায়, শুধু সেই কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনির মতো বাজতে থাকে। অভীক বুঝতে পারেন না তিনি অচেতন হচ্ছেন নাকি অন্য জগতে টেনে নেওয়া হচ্ছে।
যখন তিনি হুঁশ ফেরান, তখন ভোর হয়ে গেছে। সূর্যের প্রথম আলো নদীর জলে পড়েছে, পাখিরা ডাকছে। অভীক নিজেকে খুঁজে পান ঘাটের পাথরে শুয়ে থাকতে। তাঁর খাতা মাটিতে পড়ে গেছে, কলম ছড়িয়ে আছে একপাশে। শরীর ঠান্ডায় জমে আছে, কিন্তু মন আরও অদ্ভুত অবস্থায়। তিনি যা দেখেছেন তা কি সত্যি? নাকি নিছক ভ্রম? কিন্তু বুকের গভীরে তিনি জানেন, এটা ভ্রম নয়। তাঁর কানে তখনও বাজছে সেই স্বর—“আমার মুক্তি দাও।” অভীক খাতার পাতা উল্টে তড়িঘড়ি কিছু নোট করেন, যদিও হাত কাঁপছিল। তিনি উপলব্ধি করেন, এ আর শুধু লোকগাথা নয়। চন্দ্রাবতীর আত্মা সত্যিই এখানে আবদ্ধ, আর তাকে মুক্তি দেওয়ার আর্জি নিয়ে ফিরে আসছে। প্রশ্ন একটাই—মুক্তি কি? কেমন করে? এই রহস্যই এখন তার গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল। ভয়ের ছায়া সত্ত্বেও কৌতূহল তাকে পিছু ছাড়ল না, বরং আরও প্রবল হয়ে উঠল। অভীক বুঝলেন, তাঁর সামনে শীতলপুরের কিংবদন্তি উন্মোচনের নতুন দরজা খুলে গেছে, যার ওপারে হয়তো আছে ভয়ঙ্কর সত্য।
৮
অভীকের সেই রাতের অভিজ্ঞতার কথা খুব বেশিদিন গোপন থাকেনি। ভোরবেলা যখন তিনি ঘাট থেকে ফিরছিলেন, তখনই কয়েকজন তাকে অস্বাভাবিক অবস্থায় দেখতে পায়—মাটিতে কাদা মেখে, মুখ ফ্যাকাশে, চোখে আতঙ্কের ছাপ। গ্রামবাসীরা তাকে ঘিরে ধরে প্রশ্ন করতে থাকে। অভীক প্রথমে কিছুই বলতে চাননি, কিন্তু গ্রামের প্রবীণ মহাশয় রঘুনাথ মণ্ডল জোর দিয়ে জানতে চাইলে তিনি ভাঙা গলায় বলেছিলেন—“আমি ওকে দেখেছি… নদীতে, সাদা শাড়ি… সে বলছিল মুক্তি দাও…”। এই কয়েকটি শব্দ যেন আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে শীতলপুরে। লোকেরা দলে দলে এসে তার কথা শুনতে চায়। কারও মুখে বিস্ময়, কারও চোখে ভয়, আবার কেউ কেউ মনে মনে সন্দেহ করছিল—কলকাতা থেকে আসা এই অধ্যাপক হয়তো লোককে ভয় দেখিয়ে নাম কামাতে চাইছেন। কিন্তু অচিরেই ঘটতে শুরু করে এমন কিছু ঘটনা, যা গ্রামবাসীর সন্দেহকেও ভয়ঙ্কর বাস্তবে রূপান্তরিত করে। প্রথমে শোনা যায়, হরিপদ মল্লিকের বাড়ির গরুটি হঠাৎ এক রাতে মরে গেছে। গরুটিকে আগের দিন পর্যন্ত একেবারে সুস্থ দেখা গিয়েছিল, অথচ সকালে গোয়ালঘরে পাওয়া যায় নিথর দেহ। এরপর কয়েকদিনের মধ্যে আরও দু-একটি বাড়িতে একই ঘটনা ঘটে। গ্রামের মহিলারা ফিসফিস করে বলতে শুরু করে—“চন্দ্রাবতীর অভিশাপ আবার শুরু হয়েছে।”
দুর্ঘটনা শুধু গরু-মোষেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। গ্রামের বেশ কয়েকজন হঠাৎ জ্বরে পড়ে যায়। সাধারণ জ্বর নয়—শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বেড়ে গিয়ে রোগীরা অজ্ঞান হয়ে পড়ে। চিকিৎসার জন্য ডাক্তার ডাকা হয় পাশের শহর থেকে, কিন্তু ডাক্তারও প্রথমে কোনো কারণ খুঁজে পাননি। গ্রামের ভেতরে ভয়ে ভয়ে মানুষ চলাফেরা করতে লাগল। রাত নামলেই কেউ আর বাইরে বেরোতে সাহস করত না। মাঠে কৃষিকাজ বাধাপ্রাপ্ত হলো, মাছ ধরার নৌকা অর্ধেক ফাঁকা রইল ঘাটে। অভীক এই ঘটনাগুলো সব খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। তিনি নোটবুকে প্রতিদিনের ঘটনা লিখে রাখতেন—কে কখন অসুস্থ হলো, কোন বাড়ির গরু কখন মারা গেল, কোন জমির ফসল শুকিয়ে গেল। তিনি ক্রমশ বুঝতে পারছিলেন, এসব কেবল কাকতালীয় ঘটনা নয়। গ্রামের মানুষও ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে শুরু করল যে, চন্দ্রাবতীর আত্মা সত্যিই এই দুর্ভাগ্যের কারণ। বিশেষ করে যখন হঠাৎ একদিন দেখা গেল, মন্দিরের পুকুরের জলে অদ্ভুত লালচে আভা ছড়িয়ে আছে, যেন কারও রক্ত মিশে গেছে। তখন থেকে ভয়ের স্রোত গ্রামজীবনে আরও প্রবল হয়ে উঠল।
এই অবস্থায় গ্রামের পণ্ডিত ভোলানাথ চক্রবর্তী সামনে এগিয়ে এলেন। তিনি গ্রামবাসীদের ডেকে বললেন—“দেখছ না, এ সবই চন্দ্রাবতীর আত্মার অশান্তির ফল। সে শান্তি চায়, মুক্তি চায়। বহু বছর ধরে তার কান্না আমরা শুনছি, কিন্তু কেউ তার আর্তি বোঝার চেষ্টা করিনি। এখন সে আমাদের কষ্ট দিয়ে সেই দাবি জানাচ্ছে।” ভোলানাথের এই ব্যাখ্যা গ্রামবাসীর মনে আরও দৃঢ়ভাবে বসে গেল। অনেকেই বলল, অভীক যদি সত্যিই তাকে দেখে থাকে, তবে হয়তো তিনিই এর সমাধান খুঁজে বের করতে পারবেন। কিন্তু সবাই জানত, চন্দ্রাবতীর মুক্তি মানে কী, তা কেউই সঠিকভাবে জানে না। কেউ বলল, পুজো-অর্চনা করলে আত্মা শান্তি পাবে; কেউ বলল, তাকে যে অপমান করা হয়েছিল, তার প্রতিশোধ না হলে কিছুই থামবে না। এভাবেই গ্রামের ভেতর এক অস্থিরতার বাতাস ছড়িয়ে পড়ল। মানুষজন দিন কাটাতে লাগল আতঙ্কে, সন্দেহে আর অনিশ্চয়তায়। অভীক বুঝলেন, তিনি শুধু লোকগাথা নয়, জীবন্ত এক আতঙ্কের সাক্ষী হয়ে উঠেছেন। তাঁর সামনে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—চন্দ্রাবতীর আত্মা আসলে কী চাইছে, আর তিনি কি সেই মুক্তির পথ খুঁজে দিতে পারবেন? শীতলপুর গ্রাম যেন অশান্তির এক অদৃশ্য বেড়াজালে আটকে গেল, যেখান থেকে মুক্তির চাবিকাঠি হয়তো লুকিয়ে আছে সেই নদীর ধারে, পূর্ণিমার আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা সেই কান্নার ছায়ার কাছে।
৯
শীতলপুর গ্রামে টানটান উত্তেজনা। প্রতিদিন নতুন নতুন বিপদ এসে গ্রামবাসীর মনে ভয়ের স্রোত বইয়ে দিচ্ছিল। একদিকে অজানা অসুখ, অন্যদিকে হঠাৎ করে গৃহপালিত পশুর মৃত্যু বা ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়া—সবই যেন এক অভিশপ্ত ছায়ার প্রভাব। এই অবস্থায় অভীক সিদ্ধান্ত নিলেন যে, কেবল গবেষণা বা পর্যবেক্ষণ যথেষ্ট নয়, কিছু একটা করতেই হবে। তিনি গ্রামের প্রবীণদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় বসেন। রঘুনাথ মণ্ডল, ভোলানাথ চক্রবর্তী, এমনকি গ্রামে যাঁরা চন্দ্রাবতীর গল্প দীর্ঘদিন ধরে শুনে এসেছেন, তাঁদের সবাইকে ডেকে তিনি বলেন—“চন্দ্রাবতী মুক্তি চাইছে, আর মুক্তি মানে শুধু প্রার্থনা নয়, তাকে মর্যাদা দেওয়া। আমরা যদি ইতিহাসে তার সত্যিটা তুলে ধরি, হয়তো সে শান্তি পাবে। তবে তার আগে একটি পূজার আয়োজন দরকার, যাতে পুরো গ্রাম একসঙ্গে অংশ নেয়।” প্রবীণরা প্রথমে দ্বিধাগ্রস্ত হলেও শেষে রাজি হয়ে যান। নির্দিষ্ট হলো, পরবর্তী পূর্ণিমার রাতে কুশাবতীর ঘাটেই হবে এই পূজা। কয়েকদিন ধরে প্রস্তুতি চলল—মাটির প্রদীপ বানানো হলো, ফুল আর বেলপাতা জোগাড় হলো, পুরোহিত ভোলানাথ চক্রবর্তী মন্ত্রোচ্চারণের ব্যবস্থা করলেন। গ্রামের মহিলারা একত্র হয়ে ভোগ রান্না করলেন। সেই রাত যেন সবার কাছে হয়ে উঠল এক বিশেষ প্রতীক্ষার রাত।
পূর্ণিমার চাঁদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নদীর ধারে জড়ো হলো প্রায় পুরো গ্রাম। বাতাসে মিশে আছে আতঙ্ক আর আশার অদ্ভুত সংমিশ্রণ। নদীর জলে চাঁদের প্রতিফলন ঝিলমিল করছে, চারপাশে প্রদীপের আলো মৃদু কাঁপছে। অভীক সামনের সারিতে বসে আছেন, চোখের সামনে খাতা খোলা। তিনি প্রতিটি ঘটনার নোট নিচ্ছেন, কিন্তু মনে মনে জানেন, আজকের রাত কেবল গবেষণার বিষয় নয়, বরং জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। পূজা শুরু হতেই ভোলানাথের কণ্ঠে মন্ত্রোচ্চারণ নদীর ওপারে প্রতিধ্বনিত হলো। ধূপ আর প্রদীপের ধোঁয়া মিশে বাতাস ভারী করে তুলল। প্রথমদিকে সবকিছু স্বাভাবিক লাগছিল, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই অদ্ভুত এক পরিবর্তন ঘটে গেল। হঠাৎ নদীর বুকে তীব্র হাওয়া বইতে শুরু করল, ঢেউগুলো অস্বাভাবিকভাবে উঁচু হয়ে উঠল, যেন কারও অদৃশ্য ক্রোধে উত্তাল হয়ে উঠেছে কুশাবতী। প্রদীপগুলো দুলে উঠল, কারও কারও হাত থেকে পড়ে গিয়ে নিভেও গেল। শিশুরা ভয়ে মায়ের আঁচল আঁকড়ে ধরল, পুরুষেরা ভীত-দৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে রইল। ঠিক তখনই অভীক অনুভব করলেন—হ্যাঁ, চন্দ্রাবতী তাঁদের উপস্থিতি টের পাচ্ছেন। তাঁর আত্মা এখানে আছে, এই অনুষ্টানের প্রতিটি সুরে, প্রতিটি প্রদীপের জ্বলনে।
অভীক তখন উঠে দাঁড়িয়ে মৃদু গলায় বললেন—“চন্দ্রাবতী, আমরা তোমার কষ্টের কথা জানি। আমরা তোমার কান্না শুনেছি। তুমি যে অপমান আর যন্ত্রণা সহ্য করেছ, সেই সত্য আমি লিপিবদ্ধ করব, ইতিহাসে তুলে ধরব। তোমাকে সমাজ যে অন্যায় করেছিল, তা আর চাপা থাকবে না।” তাঁর কণ্ঠ দৃঢ় হয়ে উঠল, আর গ্রামের মানুষ স্তব্ধ হয়ে তার কথা শুনতে লাগল। ভোলানাথ তখনো মন্ত্র পড়ছেন, আর সেই শব্দ যেন বাতাসের সঙ্গে মিশে নদীর ওপারে বয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ সবাই একসঙ্গে দেখতে পেল, নদীর ওপরে যেন হালকা কুয়াশার মতো এক সাদা অবয়ব ভেসে উঠেছে। কেউ স্পষ্ট দেখতে পেল না, কিন্তু সবার মনে হলো—সে এসেছে। বাতাস আরও প্রবল হলো, ঢেউ ঘাটের সিঁড়ি ভিজিয়ে দিল। তারপর এক অদ্ভুত মুহূর্তে হাওয়া থেমে গেল, ঢেউ শান্ত হলো, আর বাতাসে এক অচেনা সুবাস ছড়িয়ে পড়ল—কাঁচা ফুল আর ভেজা মাটির মিশ্র গন্ধ। সবাই নিঃশব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পূজা শেষ হলে মানুষজন ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরে গেল, কিন্তু সবার মনে একই প্রশ্ন—চন্দ্রাবতী কি শান্তি পেল? অভীক জানতেন, এই উত্তর এখনই পাওয়া যাবে না। তবে তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, তিনি চন্দ্রাবতীর সত্যিকারের কাহিনি, তাঁর যন্ত্রণা আর অপমান, তাঁর আত্মার আর্তি—সবই লিখবেন। সমাজ যেন মনে রাখে, ইতিহাস যেন বিস্মৃত না হয়। সেই রাতের পূজার পর শীতলপুরের বাতাসে ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে এক নতুন আশার সুরও বাজতে শুরু করল।
১০
পূর্ণিমার সেই রাত যেন গোটা শীতলপুর গ্রামের জন্য এক অলৌকিক অধ্যায় হয়ে উঠল। নদীর ধারে অভীক ও কয়েকজন প্রবীণ যে পূজা-অর্চনা করলেন, তার পরদিন থেকেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল অদ্ভুত প্রশান্তি। কুশাবতীর ঢেউ আর অশান্ত নয়, যেন শান্ত ভাবে গেয়ে চলেছে। কৃষকেরা দেখল, শুকনো ধানের গাছ হঠাৎ নতুন কুঁড়ি ছাড়ছে। মৎস্যজীবীরা বলল, জালে আবার মাছ ধরা পড়ছে। অসুস্থ মানুষদেরও যেন ধীরে ধীরে আরোগ্য ফিরে আসছে। গ্রামের মহিলারা সন্ধ্যায় উঠোনে প্রদীপ জ্বালিয়ে বসে বলাবলি করতে লাগল—“চন্দ্রাবতীর আত্মা শান্তি পেয়েছে।” অভীক এক কোণে বসে এইসব দেখছিলেন। তিনি জানতেন, পূজার সময়কার সেই প্রবল ঝড়ো হাওয়া, নদীর ঢেউয়ের অস্থিরতা নিছক প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, ওসব ছিল স্পষ্ট ইঙ্গিত—কেউ, অথবা কিছু, তাদের উপস্থিতি অনুভব করেছিল। কিন্তু তবুও গ্রামবাসীর চোখেমুখে যে স্বস্তির হাসি ফুটে উঠল, অভীক তাদের সে বিশ্বাস নষ্ট করতে চাইলেন না। তিনি নিজের ডায়েরিতে লিখলেন—“গ্রামের আতঙ্ক আপাতত থেমেছে। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেল—অভিশাপের আসল সমাপ্তি কি সত্যিই হলো?”
দিন কেটে গেল আরও কয়েকটি। শীতলপুরে আবার যেন আগের মতো জীবন ফিরে এল। মেলায় ভিড় বাড়ল, শিশুরা বিকেলে মাঠে খেলতে শুরু করল, আর নদীর ধারে আর কোনো ছায়ামূর্তি দেখা গেল না। অভীকও কিছুটা স্বস্তি পেলেন। তিনি প্রায় প্রতিদিনই নদীর ঘাটে গিয়ে বসতেন, খাতায় নোট লিখতেন, কুশাবতীর জলের দিকে তাকিয়ে ভাবতেন চন্দ্রাবতীর অপূর্ণ জীবনের কথা। মাঝে মাঝে মনে হতো, হয়তো পূজা-অর্চনার ফলেই সে মুক্তি পেয়েছে, হয়তো এই শান্তিই তার চিরকালের আকাঙ্ক্ষা ছিল। কিন্তু যতবারই তিনি মনে মনে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতেন, ততবারই বুকের গভীরে এক অদ্ভুত অস্বস্তি দানা বাঁধতে থাকত। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন, কিছু একটা এখনও অপূর্ণ রয়ে গেছে। এই সন্দেহকে চেপে রেখেই তিনি ডায়েরির প্রতিটি পাতা পূর্ণ করছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল, গ্রামে শান্তি ফিরলেও নদীর বুকে এখনও এক অদৃশ্য অস্থিরতা বেঁচে আছে, যা শুধু কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেছে।
তারপর এল সেই রাত, যে রাত অভীককে চিরতরে বদলে দিল। পূর্ণিমার পরবর্তী সপ্তম রাতে তিনি ঘরে বসে নিজের ডায়েরি উল্টাচ্ছিলেন। বাইরে নিস্তব্ধতা, শুধু দূরের বাঁশবনের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো ঢুকছিল জানালায়। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল খাতার একেবারে শেষ পাতায়। আশ্চর্যের বিষয়, তিনি তো সেখানে কিছু লেখেননি। অথচ পাতার মাঝখানে অচেনা অক্ষরে আঁকা রয়েছে কয়েকটি শব্দ—“আমি এখনও আছি।” অভীক বুকের ভেতর ঠান্ডা স্রোত বয়ে যেতে অনুভব করলেন। হাতের আঙুল কাঁপতে লাগল, চোখের সামনে যেন অন্ধকার নেমে এল। তিনি খাতা উল্টে-পাল্টে দেখলেন, কিন্তু বাকিগুলো সব তার নিজের হাতের লেখা। শুধু শেষ পাতার এই শব্দগুলো অচেনা, তবু অদ্ভুতভাবে নারীকণ্ঠের করুণ সুর যেন মিশে আছে সেই অক্ষরে। ঠিক তখনই বাইরে থেকে কুশাবতীর ঢেউয়ের শব্দ ভেসে এল—সাধারণ ঢেউ নয়, বরং যেন ফিসফিস করে কেউ কথা বলছে। অভীক জানালা খুলে তাকালেন নদীর দিকে। নদীর জলে চাঁদের প্রতিফলন ভেঙে ভেঙে পড়ছে, আর প্রতিটি ভাঙনের ফাঁক দিয়ে যেন শোনা যাচ্ছে একই কথা—“আমি এখনও আছি…”। শীতলপুরে মানুষ তখনো মনে করছিল অভিশাপ কেটে গেছে, কিন্তু অভীক জানলেন—এ কেবল শুরু। কুশাবতীর বুকের গোপনীয়তা এখনও শেষ হয়নি, বরং আরও গভীর অন্ধকারে ডুবতে চলেছে।
শেষ




