Bangla - রহস্য গল্প

চন্দ্রমল্লিকা রহস্য

Spread the love

অনিন্দ্য ঘোষ


শিউলি আর আতরের গন্ধে ভরে উঠেছিল পুরনো রায়চৌধুরি বাড়ির আঙিনা। দীপাবলির উৎসব, তাই শতবর্ষীয় অন্দরমহল আজ নতুন আলোয় আলোকিত। লালটেন থেকে ফেয়ারি লাইট, পায়রা কাঁপানো পটকা আর চিত্তাকর্ষক রকমারি মিষ্টির হাঁড়ি—সবই যেন একটা নিখুঁত নাট্য মঞ্চের পরিপাটি প্রপস। ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁতেই ছোটদের দল মেতে উঠল ফোয়ারা আর চাকরি নিয়ে, আর প্রবীণরা চায়ের কাপ হাতে স্মৃতির আলো-আঁধারিতে গল্পে মশগুল। বাড়ির কনিষ্ঠ পুত্রবধূ কবিতা তখন সবে সিঁড়ি দিয়ে নামছে—হলুদ তসর শাড়ি, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, হাতে একটা তাজা চন্দ্রমল্লিকা ফুল। চোখে চোখ রেখে কারও সঙ্গেও কথা বলছে না, কেবল নিঃশব্দে হাঁটছে—একটা নিস্তব্ধ অভিমান যেন তার চলনে ধরা দেয়। তাকে দেখে কেউ কেউ প্রশংসা করলেও, বেশিরভাগই কুণ্ঠিত হাসি লুকিয়ে নেয়। কারণ এই কবিতা, এই বাড়ির সাবেক নিয়ম মানে না, সাবেক নারীত্ব মেনে নেয় না। আজ রাতে আবার কোনো অশান্তি হবে কি? এই প্রশ্নটা যেন জেগে ছিল বাতাসে।

হঠাৎ করে ঘটে গেল অপ্রত্যাশিত ঘটনা। কবিতা, যাকে সবে একটু আগে দেখা গিয়েছিল হাতে ফুল নিয়ে, সবার সামনেই ডাইনিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ শরীর টলাতে টলাতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। তার মুখ নিস্তেজ, চোখ বিস্ফারিত, হাতে এখনো সেই চন্দ্রমল্লিকা ফুলটা ধরা, যা তার আঁচলের সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে। মুহূর্তে দৌড়ে আসে রোহন, তার স্বামী, এবং বাকিরা। ডাক্তার ডাকতে বলা হয়, পানিতে ঝাপটা দেওয়া হয়, কিন্তু কবিতার দেহে সাড়া নেই। কয়েক মিনিট পরেই পারিবারিক ডাক্তার এসে জানান—”মৃত্যু হয়েছে। খুব সম্ভাব্য কারণ বিষক্রিয়া।” ফুলের গন্ধ, যা এতক্ষণ মনোরম ছিল, এখন যেন গলায় কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। একে একে সবাই পেছনে সরে আসে—কে, কেন, কীভাবে এমনটা ঘটাল—এই প্রশ্নে শকুনের মতো ঘুরে ঘুরে বেড়ায় সন্দেহ। দীপাবলির আলো যেন ধীরে ধীরে ঢেকে যেতে থাকে অন্ধকারে।

রাত এগিয়ে চলে, পুলিশ আসে, প্রাথমিক তদন্ত শুরু হয়। বাড়ির প্রবীণ কর্তা বিমল রায়চৌধুরি, যিনি একসময় কলকাতা হাইকোর্টে ব্যারিস্টার ছিলেন, পুলিশের প্রতি পূর্ণ সহযোগিতা দেন, কিন্তু প্রস্তাব করেন—“এই কেসে একজন অভিজ্ঞ ও নিরপেক্ষ তদন্তকারী প্রয়োজন।” এবং পরদিন সকালে এসে উপস্থিত হন সৌরভ চক্রবর্তী—মিতভাষী, ধূসর কোট পরা, চশমার আড়াল থেকে ধারালো চোখে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করেন। তাঁর মুখে প্রশ্ন কম, চোখে পর্যবেক্ষণ বেশি। তিনি বাড়ির অন্দরমহল ঘুরে দেখেন, কবিতার ঘর, বাগানপথ, এবং সেই ফুলটা খুব যত্ন করে কাঁচের কৌটায় ভরে নেন। বাড়ির সদস্যদের মুখে হালকা শোকের ছায়া, কিন্তু তার নিচে যেন কিছু চেপে রাখা অভিমানের স্তর। সৌরভ জানেন, এই মৃত্যু ছিল না কেবল আকস্মিক, এটি ছিল পরিকল্পিত, এবং এই পরিবারেরই কেউ… কেউ একজন সেই বিষ মাখিয়েছিল চন্দ্রমল্লিকায়।

রায়চৌধুরি বাড়ির প্রাচীন অন্দরমহলে সকাল নামে নিস্তব্ধতার মলিনতা নিয়ে। ঝকঝকে দীপাবলির রাতের পরদিন, যেন বাড়িটা নিজেই শোক পালন করছে। মেঘে ঢাকা আকাশের আলো ধোঁয়াশা হয়ে ঢুকছিল জানালা দিয়ে, আর তার সঙ্গে ঘর থেকে ঘরে ভেসে বেড়াচ্ছিল গত রাতের শিউলি ফুলের আধামরা গন্ধ, যা মৃত্যুর মতোই নিষ্প্রাণ। সৌরভ চক্রবর্তী সকালে খুব ভোরে এসে পৌঁছেছিলেন। বারান্দার লম্বা বেঞ্চে বসে থাকা পরিচারিকা মালতির চোখে ঘুম নেই, আর উপরের ঘরে বিমল রায়চৌধুরি তখনও থানার বড় অফিসারকে ফোনে বলছিলেন, “এই কেসের চেয়েও জটিল কেস আমি কোর্টে সামলেছি, কিন্তু পরিবারে এমন মৃত্যু… এটা মানা যায় না।” সৌরভ এক কাপ কালো চা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে বাগান বরাবর হাঁটলেন। চোখ তার সবুজ ঘাসের ওপর, কিন্তু মন কাজ করছিল গত রাতের অপ্রত্যাশিত দৃশ্য বারবার ভেবে। কবিতার হাতে ছিল তাজা চন্দ্রমল্লিকা—যেটা দিয়ে কেউ বিষ প্রয়োগ করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কে, কখন, আর কীভাবে করল তা?

পরিবারের সকলকে একত্রে বসিয়ে প্রশ্ন শুরু করলেন সৌরভ। বিমলবাবু সংযত, গৌরী দেবী মুখ নিচু করে ছিলেন। কবিতার স্বামী রোহনের চোখ লাল, কিন্তু সেখানে কষ্টের চেয়ে ধাক্কার ছাপ বেশি। সুনন্দা—জ্যেষ্ঠ বউ—বেশ চটপটে ভাবে বললেন, “ও সব সময় আলাদা চলত, আমাদের নিয়ম-কানুন মানত না। এমন তো হতেই পারে…” কিন্তু তিনি কথাটা শেষ করলেন না। অর্ণব—কবিতার দেবর—চুপচাপ এক কোণে বসে ছিল। সৌরভ লক্ষ্য করলেন, সে একবারও কারও চোখের দিকে তাকাচ্ছে না। “আপনারা কেউ দেখেছেন, কবিতা কোথা থেকে এনেছিলেন চন্দ্রমল্লিকা ফুলটা?”—সৌরভের এই প্রশ্নে সবার মুখে একই উত্তর, “না, খেয়াল করিনি।” একজন চাকর বলল, কবিতা মাঝে মাঝে বাগান থেকে নিজে ফুল তুলতেন। তখন সৌরভ বাগানে যান। বাগান পরিচর্যাকারীর সঙ্গে কথা বলেন, যিনি জানান—চন্দ্রমল্লিকার গাছ মাত্র একটিই আছে, এবং সেটি ঠিক বাড়ির পশ্চিম প্রান্তে, যেখানে আলো-ছায়ার খেলা চলে সারাদিন। সৌরভ মাটি খুঁটিয়ে দেখে বলেন, “গাছের নিচে কেউ দাঁড়িয়েছিল গতকাল। পাতার গায়ে কিছু সাদা দাগ, সম্ভবত রাসায়নিক স্প্রে।”

তাঁর পরবর্তী পদক্ষেপ—কবিতার ঘর। ছোট, গোছানো, কিন্তু যেন ইচ্ছে করে সাজানো নিঃসঙ্গতায় ভরা। বিছানার পাশে একটা টেবিলে একটা ছোট্ট কাঁচের শিশি খালি পড়ে আছে—যার ঢাকনা নেই। সৌরভ গন্ধ শুঁকে বোঝেন—তা চন্দ্রমল্লিকার প্রাকৃতিক গন্ধ নয়। ঘরের ড্রয়ারে মেলে কবিতার ব্যক্তিগত ডায়েরি, কিন্তু বেশিরভাগ পাতাই খালি। শেষ পাতায় লেখা একটা লাইন: “যদি কেউ শুনত, আমি হয়তো থাকতাম আরেকভাবে।” সৌরভ বুঝে যান—এখানে সম্পর্কগুলো ছিল খণ্ডিত, ছিন্ন, আর সেই ছিন্নতার ফাটল দিয়েই ঢুকেছে বিষ। এই মৃত্যু কোনো হঠাৎ করা আত্মহত্যাও নয়, বরং এক নিখুঁত সাজানো পর্দার আড়ালে খেলা করে যাওয়া হত্যার কাহিনি। সৌরভ জানতেন, সত্য উদঘাটনের শুরু মাত্র হয়েছে।

সৌরভ চক্রবর্তী বাগানের পশ্চিম দিকের সেই চন্দ্রমল্লিকা গাছের নিচে আবারও দাঁড়ান, এবার আরও গভীর মনোযোগে। তিনি এক হাতে নোটবইতে পেন ঘোরাতে ঘোরাতে গাছের চারপাশের মাটি পরীক্ষা করলেন, পাতাগুলোর ঘ্রাণ নিলেন এবং গাছের গোড়ায় জমে থাকা জল স্পর্শ করলেন। হ্যাঁ, কিছু একটা তো ছিলই। চন্দ্রমল্লিকার পাতায় যে সাদা আবরণ ছিল, সেটা মৃগনাভি বা ছত্রাক নয়—তা নিশ্চিত। বরং তাতে ছিল এক ধরনের রাসায়নিকের গন্ধ, যা তিনি বহু আগেই চিনেছেন—একধরনের উদ্ভিদনাশক যার অল্পমাত্রাও বিষক্রিয়ায় যথেষ্ট। সৌরভ দ্রুত একটি নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন ঘরে, যেখানে একটি পোর্টেবল কিটে প্রাথমিক টেস্ট করে বুঝে ফেলেন—এটা অ্যাট্রোপিন জাতীয় বিষ, যা স্নায়ুতন্ত্রে প্রভাব ফেলে এবং প্রয়োগের ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই মৃত্যু ডেকে আনে। প্রশ্নটা ঘনীভূত হয়—এই বিষ কে, কবে, কীভাবে চন্দ্রমল্লিকায় প্রয়োগ করল? কারণ ফুল তো কবিতার হাতে এসেছিল খুব স্বাভাবিকভাবে—না সেটি কেটে কেউ দিয়েছিল, না সে বাইরে থেকে এনেছে। তাহলে গাছেই কেউ এই বিষ ছড়িয়েছিল, আর কবিতা নিজের হাতে সেটা তুলে নিয়ে নিজের মৃত্যুর ফাঁদে নিজেই পড়েছিল?

পরিবারের সদস্যদের অতীত আর সম্পর্ক এখন নতুন আলোয় পড়ে সৌরভের চোখে। তিনি সবার আগে যান অর্ণবের ঘরে। দেওয়ালে ঝুলছে আধা-আধুনিক রঙতুলির কাজ, নিঃসঙ্গতা আর নিঃশব্দ অভিমানের ছাপ স্পষ্ট। অর্ণব অন্যমনস্ক গলায় বলে, “দাদা-ভাবির মধ্যে সবসময়ই টানাপোড়েন চলত। ভাবি কখনো দিদি-মায়ের কথাও শুনত না।” সৌরভ চাপা স্বরে বলেন, “আর আপনি? আপনি কবিতাকে কীভাবে দেখতেন?” প্রশ্নটা শুনে অর্ণব একটু থমকে যায়, তার চোখে ক্ষণিকের দ্বিধা। তারপর সে বলে, “সে ভালো কথা বলত, ভিন্নধারার চিন্তাভাবনা ছিল। আমি ওর রঙ পছন্দ করতাম… কিন্তু ও আমার মতো মানুষকে পাত্তা দিত না।” সৌরভ লক্ষ করেন—এই একটা লাইনেই অনেক অপ্রকাশিত অভিমান আর প্রত্যাখ্যান লুকিয়ে আছে। তিনি উঠে পড়েন, এবার যান রান্নাঘরের দিকে, যেখানে মালতি তখন বাসনের কাজ করছে। সৌরভ ধীরে ধীরে বলেন, “তুমি তো অনেক কিছু দেখো, মালতি। কবিতা বৌদি কার সঙ্গে বেশি কথা বলত?” মালতি মাথা নিচু করে বলে, “সবাইর সঙ্গেই বলত, কিন্তু জ্যাঠাইমার সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া হতো। তবে ও যে এভাবে যাবে, তা ভাবিনি।” সৌরভ এবার খানিকটা চেপে বলেন, “তুমি কাউকে বাগানের দিকে যেতে দেখেছিলে কি?” মালতির চোখ কাঁপে, সে কেবল ফিসফিসিয়ে বলে, “হ্যাঁ, সেদিন বিকেলবেলায় সুনন্দা বৌদি গিয়েছিল… কিছু ফুল নিয়ে এসেছিল, আমি দেখেছি। তবে সে কী করেছিল, জানি না।”

সৌরভ ফিরে আসেন বৈঠকখানায়, যেখানে এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হচ্ছে। তিনি জানেন—তাকে এই মুহূর্তে একটা দৃষ্টিভঙ্গি স্থাপন করতে হবে। তাই তিনি প্রতিটি সম্ভাব্য ব্যক্তির মধ্যে উদ্দেশ্য খোঁজেন। কবিতার স্বামী রোহন—যার সঙ্গে কবিতার সম্পর্ক ঠাণ্ডা হয়ে এসেছিল, এবং যার ফোনে কিছু অজানা নাম্বার পাওয়া গিয়েছিল—সে কি সন্দেহ করছিল কিছু? নাকি নিজেই চাইছিল কবিতাকে সরিয়ে দিতে? আবার সুনন্দা—যার গৃহিণীসত্তা কবিতার আধুনিকতায় প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছিল—সে কি ঈর্ষা থেকে কাজ করেছিল? কিংবা গৌরী দেবী—যিনি একসময় বলেছিলেন, “এই মেয়েটা আমাদের মান রক্ষা করবে না।” সৌরভ জানেন, এক একটি পরিবারে মুখের হাসির আড়ালে কতখানি বিষ জমে থাকে, তা শুধুই সময় বলবে। কিন্তু এখন একটাই প্রশ্ন তার মনে ঘুরছে—এই চন্দ্রমল্লিকা আসলে কার হাতে সবচেয়ে আগে উঠেছিল? কে ছিল সেই প্রথম ছোঁয়া, যে বিষ দিয়েছিল ফুলে? এই উত্তর খুঁজে পেতেই সৌরভের পথ পরবর্তী অধ্যায়ের দিকে মোড় নেয়, যেখানে অতীতের সম্পর্ক, চিঠি ও গোপন ইচ্ছার মুখোমুখি হবে বাস্তবের নির্মমতা।

বিকেলের শেষ আলোটা রায়চৌধুরি বাড়ির জারুল গাছে হেলে পড়েছে, আর অন্দরমহলের আবছা ঘরগুলোতে যেন সময় থেমে গেছে। সৌরভ চক্রবর্তী এবার একান্তে সময় চাইল কবিতার শাশুড়ি গৌরী দেবীর সঙ্গে কথা বলার। বউ-শাশুড়ির সম্পর্ক এমনিতেই এ সংসারে দানা বাঁধেনি, এবং সৌরভের ধারণা ছিল—সেই টানাপোড়েনের ভেতরেই হয়তো লুকিয়ে আছে এমন কিছু, যা বাইরে প্রকাশ পায়নি। গৌরী দেবী মসৃণ করে আঁচল গুছিয়ে এক কাপ তুলসী চা হাতে বসে বললেন, “এই মেয়েটা সংসার করতে জানত না। আমাদের ঐতিহ্য, শিষ্টতা, বড়দের সম্মান—সব কিছুতেই যেন বিদ্রূপ করত।” সৌরভ নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার ছেলের সঙ্গে ওর সম্পর্ক কেমন ছিল?”—উত্তরে এক মুহূর্ত নীরব থেকে গৌরী বললেন, “রোহন দুর্বল ছেলে। কবিতা ওকে মানত না। বারবার বলত, ‘তুমি নিজের কথা নিজে বলো, সবসময় মায়ের পিছনে লুকিয়ে থেকো না।’ বলতে পারেন, সে আমাদের ঘরকে মঞ্চ ভেবে নাটক করত, কিন্তু কারও সঙ্গে হৃদ্যতা রাখত না।” সৌরভ অনুভব করলেন—এই কথাগুলোর ভেতর একটা অতৃপ্ত মাতৃত্বের ক্ষোভ আছে, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—এই ক্ষোভ কি ঘৃণায় রূপান্তর হয়েছিল? তিনি দৃষ্টি হালকা রেখে বলেন, “চন্দ্রমল্লিকা ফুল আপনাদের বাড়ির বাগানে কেবল একজনই ছুঁয়েছিল বলে সন্দেহ করছি।” গৌরী দেবী মুখ ফিরিয়ে জানালেন, “সেটা আমার কাজ নয়। আমি তো বাড়ির বাইরে যাই না।”

পরবর্তী আলাপ হয় সুনন্দা—জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূর সঙ্গে। সৌরভ জানতেন, এই সম্পর্কটি ছিল সবচেয়ে ঠান্ডা যুদ্ধের কেন্দ্র। সুনন্দার মুখে সবসময় হাসি, কিন্তু কথার ভেতরে লুকিয়ে থাকে ভিন্ন সুর। “কবিতা ছিল অন্যরকম,” সে বলল, “ওর নিজস্ব চিন্তা ছিল, স্বাধীনতা ছিল… কিন্তু আমার মতো গৃহিণীদের কাছে ও ছিল চোখের কাঁটা।” সৌরভ জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি ঈর্ষান্বিত ছিলেন?” সুনন্দা চমকে উঠে বলে, “না না, ঈর্ষা নয়। ওর প্রতি একটু বিরক্তি ছিল, কারণ সে কিচ্ছু না মানলে সংসার চলে না। আমি তো এই পরিবারের নিয়ম মানছি, ও কেন পারবে না?” সৌরভ হঠাৎ বলেন, “আপনি সেদিন বিকেলে বাগানে গিয়েছিলেন?” সুনন্দার চোখ কেঁপে ওঠে, মুখে কৃত্রিম অস্বস্তি আসে, তারপর সে বলে, “গিয়েছিলাম কিছু ফুল তুলতে, সন্ধ্যাবাতির আয়োজন ছিল তো। কিন্তু আমি চন্দ্রমল্লিকা ছুঁইনি।” তার গলার নিচে ঘাম জমছে, হাত ঘুরছে শাড়ির আঁচলে। সৌরভ জানেন, এমন আচরণ তখনই আসে, যখন কেউ সত্যি চেপে রাখে। তিনি অতটুকুতেই থামেন না, বলেন, “আপনার ঘরে একটা পুরনো ভেষজ বই পেয়েছি, যেখানে ‘অ্যাট্রোপিন’ বিষ সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা আছে। আপনি কি আগ্রহী ছিলেন গাছ-পাতা নিয়ে?” সুনন্দা এবার রীতিমতো কেঁপে ওঠে। সে শুধু বলে, “আমি জানতাম না… কবিতা ওই বইটা পড়ে কিনা। আমি ওর ঘরে কখনো যাইনি।” সৌরভ বুঝে যান—একটা কিছু লুকোচ্ছে, কিন্তু তার জিভ নয়, চোখই তা বলে দিচ্ছে।

সন্ধ্যার আকাশ তখন বৃষ্টিভেজা হয়ে এসেছে। বাড়ির পুরনো থামে জল টুপটাপ পড়ছে। সৌরভ এবার যান রোহনের কাছে। কবিতার স্বামী এখন নিঃশব্দ এক ভগ্নদশা, তার মুখে ক্লান্তির রেখা। “আমি জানি না কেন এমন হলো,” সে বলল। “সত্যি বলতে, আমাদের মধ্যে দুরত্ব ছিল। কিন্তু আমি ওকে মারতে চাইনি।” সৌরভ ধীরে ধীরে বলেন, “আপনার ফোনে পাওয়া নাম্বারগুলো… আপনি কি জানেন কবিতা কার সঙ্গে নিয়মিত কথা বলত?” রোহন চুপ করে যায়, চোখ সরিয়ে নেয়, তারপর মৃদুস্বরে বলে, “হয়তো কেউ ছিল ওর অতীতে। আমি সন্দেহ করতাম, কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলিনি। মায়ের সামনে মাথা নিচু করেই চলতাম।” সৌরভ এবার গাঢ় চোখে তাকিয়ে বলেন, “আপনি কি মনে করেন কবিতা আপনাকে বিশ্বাস করত?” রোহন কিছু বলেন না। সৌরভ এবার বললেন, “বিশ্বাসের অভাব, অসন্তোষ, আর সম্মানের অভাব—এই তিনটাই একসাথে থাকলে সম্পর্কটা বিষাক্ত হয়ে যায়। আর সেই বিষ যখন ফুলে মিশে আসে, তখন মৃত্যু হয় নিছক দুঃখজনক নয়, হয়ে ওঠে প্রতীকী।”

রাত প্রায় ন’টা, রায়চৌধুরি বাড়ির বাতাস ভারী, যেন অজানা আতঙ্ক জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়েছে ঘরের কোণে কোণে। সৌরভ চক্রবর্তী তখন কবিতার ঘরে একাই বসে, ডায়েরির পাতা উলটে যাচ্ছেন। প্রথমদিকে ডায়েরিটি ছিল অনেকটাই ফাঁকা, কিন্তু শেষে এসে পাতাগুলো যেন কথা বলতে শুরু করেছে। সেখানে কবিতা লিখেছিল—“এই বাড়িতে ভালোবাসা নেই, কেবল কর্তৃত্ব আর হিংসা। রোহনকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম, কিন্তু সে এখন মা আর পরিবারের সামনে একটা মুখোশ পরে থাকে। আমি এই অন্ধকার থেকে মুক্তি চাই। অর্ণব… তুমিও তো জানো, আমি কেমন করে বাঁচতে চাই।” নামটা পড়েই সৌরভ থেমে যান। অর্ণব? কবিতা কি তার দেবরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিল? নাকি এ ছিল একতরফা বিশ্বাস? এই সময়, বিছানার নিচের কাঠের প্যানেলের পেছনে একটা পাতলা খাম দেখতে পান তিনি। খামে কোনো প্রেরকের নাম নেই, কিন্তু ভেতরে লেখা—“যদি তুমি আজও একই রকম ভাবো, তাহলে পশ্চিমের বাগানে দেখা করো, দীপাবলির রাতে। ফুলের আড়ালে লুকিয়ে থাকবে তোমার উত্তর।”—এই চিঠির লেখনী কবিতার নয়, বরং অনেকটা পুরুষালী, বাঁকা হস্তাক্ষরে লেখা। সৌরভ সেটা সঙ্গে নিয়েই বেরিয়ে পড়েন অর্ণবের ঘরের দিকে।

অর্ণব তখন জানালার পাশে বসে, বাইরে তাকিয়ে। চন্দ্রমল্লিকা গাছটা দূর থেকে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে যেন সাক্ষী হয়ে আছে। সৌরভ দরজা ঠেলে ঢুকে বলেন, “তুমি কি কবিতাকে ভালোবাসতে, অর্ণব?” এক মুহূর্তের জন্য ছেলেটা নড়েচড়ে ওঠে, তারপর গলা কাঁপিয়ে বলে, “আমি তাকে শ্রদ্ধা করতাম। ও অন্যরকম ছিল। অন্যদের মতো জড়ভরতে নয়—ও প্রাণে পরিপূর্ণ ছিল।” সৌরভ এগিয়ে এসে হাতে থাকা চিঠিটা এগিয়ে দেন, “তুমি কি এটা লিখেছিলে?” অর্ণবের চোখ বড় হয়ে যায়, ঠোঁট শুকিয়ে আসে। সে প্রথমে অস্বীকার করতে চায়, কিন্তু তারপর হঠাৎ ভেঙে পড়ে। “আমি কবিতাকে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে আমার বড়ভাইয়ের স্ত্রী। আমি শুধু ওকে জানাতে চেয়েছিলাম—আমি আছি, আমি ওর পাশে আছি। আমি বলেছিলাম বাগানে আসতে, কিন্তু সেটা ভালোবাসার জন্য… ক্ষতি করার জন্য নয়।” সৌরভ চুপচাপ শুনছিলেন। তারপর বলেন, “তাহলে তোমার জানা মতে কবিতা সেই রাতে বাগানে এসেছিল?” অর্ণব মাথা নাড়ে, “হ্যাঁ, আমি দূর থেকে দেখেছিলাম। কিন্তু তারপর সুনন্দা বৌদি এসেছিলেন। আমি লুকিয়ে পড়েছিলাম। তারপর আর কিছু দেখিনি।” সৌরভ বুঝলেন—এই স্বীকারোক্তি যতটা ব্যক্তিগত, ততটাই গল্পের মোড় ঘোরানোর মত গুরুত্বপূর্ণ। কবিতা সেই রাতে সত্যিই কারও সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। কিন্তু সে অর্ণব নয়—হয়তো অন্য কেউ।

সৌরভ এবার ফিরে আসেন নিজের কক্ষে, যেখানে ছোটখাট আলাদা পরীক্ষাগার তৈরি করেছেন তিনি। খামের কাগজে থাকা কালি, লেখা এবং আঙুলের ছাপ পরীক্ষায় ব্যস্ত থাকেন। তার নিজস্ব কৌশলে তিনি নিশ্চিত হন—এই চিঠি অর্ণবের হাতের লেখা হলেও, খামের গায়ে লেগে থাকা আঙুলের ছাপ অর্ণবের সঙ্গে মেলে না। বরং তাতে আংশিকভাবে পাওয়া যায় নারীর আঙুলের ছাপ—যা সুনন্দার ঘর থেকে পাওয়া এক প্রসাধন দ্রব্যের বোতলের ছাপের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। অর্থাৎ, কেউ হয়তো চিঠিটা কবিতার নামে পাঠিয়ে, বাগানে টেনে নিয়ে গিয়েছিল পরিকল্পিতভাবে—এবং সেই ব্যক্তি ছিল একজন নারী, এবং কবিতার খুব কাছের কেউ। এই জটিল সম্পর্ক ও মিথ্যের বেড়াজাল পেরিয়ে সৌরভ একাই বলেন, “এখানে ভালোবাসা নেই, শুধু অধিকার আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এবং কেউ একজন, খুব সন্তর্পণে নিজের খেলাটা খেলেছে।”

রাত গভীর হচ্ছে, অথচ সৌরভ চক্রবর্তীর চোখে ক্লান্তির ছাপ নেই। রহস্য ক্রমশ খুলছে এক একটি স্তরে, কিন্তু সত্যের কেন্দ্রে পৌঁছাতে হলে তাকেই টানতে হবে সেই সুতোটা যা বহুদিন ধরে লুকিয়ে আছে লোকচক্ষুর আড়ালে। তিনি বুঝেছেন, এই বাড়ির সব সদস্যের মাঝেই ছিল কবিতার বিরুদ্ধে ক্ষোভ, ঈর্ষা কিংবা ভয়ের কিছু না কিছু উপাদান। কিন্তু আজ রাতে তাঁর মন টেনেছে একজনকে—যিনি থাকেন সবার আড়ালে, বলেও না, শোনেও না—পরিচারিকা মালতি। এই বাড়িতে তার বয়স ৩০ বছরেরও বেশি। বাড়ির প্রতিটি কক্ষ, প্রতিটি সম্পর্কের ভাঙা দেয়াল তার চেনা। কিন্তু এতদিন ধরে সে নীরব, অদৃশ্য এক ছায়ার মতো। সৌরভ সিদ্ধান্ত নেন, তাকে ভাঙতেই হবে। রাত দশটায়, রান্নাঘরের পাশে মালতির ছোট্ট ঘরের সামনে গিয়ে তিনি থামেন। দরজায় কড়া নাড়তেই এক নীরব মুখ দরজা খুলে তাকায়। “আমার সঙ্গে একটু কথা বলবে, মালতি?” — সৌরভ জিজ্ঞেস করেন। মালতি মাথা নিচু করে আসন নিয়ে বসে। তার কণ্ঠ শুষ্ক, চোখে গভীর ক্লান্তি। “বাবু, আপনি যা জানতে চান, সব জেনে গেছেন। আমি শুধু দাসী, আমার বলার কিছু নেই।” সৌরভ গলা নরম করে বলেন, “এই ঘরের দেওয়াল অনেক কথা শুনেছে, আমি শুধু চাই তুমি যা দেখেছো, তা বলো। কারণ একমাত্র তুমি কাউকে বিচার না করে দেখেছো।”

এক দীর্ঘ নীরবতার পর মালতি কথা বলে। “বাবু, কবিতা বৌদি ভালো মেয়ে ছিল, কিন্তু এই বাড়ি তাকে ভালোবাসেনি। উনি কথা বলতেন সোজাসুজি, কাউকে ভয় পেতেন না। আর এই বাড়িতে তো মুখ না বুজে থাকা মেয়েই ভালো… তাই না?” তার গলা ভারী হয়ে আসে। “সেদিন বিকেলে আমি ছাদে কাপড় শুকাতে দিয়েছিলাম। তখন দেখি সুনন্দা বৌদি গেছেন বাগানের দিকে। চুপি চুপি হাঁটছিলেন। তাঁর হাতে ছোট এক শিশি ছিল। আমি ভয় পেয়ে যাই, কারণ মাস তিনেক আগে ঠিক এই সুনন্দার গলায় কবিতা বৌদি বলেছিলেন—‘আপনার মতো পুরনো মানসিকতা নিয়ে এই পরিবার এগোবে না।’ তার পর থেকেই বৌদি অস্বাভাবিক রকম চুপচাপ হয়ে যান। দীপাবলির রাতে, আমি দেখেছি কবিতা বাগান থেকে ফুল নিয়ে ঘরে ফিরছিলেন, আর তার কিছুক্ষণ আগেই সুনন্দা বৌদি গিয়েছিলেন সেদিকেই।” সৌরভ মন দিয়ে শুনছিলেন, প্রশ্ন করেন, “তুমি এসব এতদিন চুপ করে রাখলে কেন?” মালতির মুখে তখন ধরা পড়ে বহু বছরের জমে থাকা অভিমান। “আমি এই বাড়িতে কেউ নই, বাবু। আমার মা এই বাড়ির রান্নাঘরে অপমানিত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে একদিন চলে গেছিলেন, আমি থেকে গেছি। আজও ভাবি, আমি কথা বললে কেউ বিশ্বাস করবে না।”

সৌরভ জানেন, সত্য সবসময় প্রমাণ চায়। মালতির কথা মন দিয়ে শোনার পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন—এবার সময় এসেছে সুনন্দার মুখোমুখি হওয়ার। কিন্তু তার আগে, তিনি একবার যাচাই করে নিতে চান মালতির দাবি। তিনি বাগানের পশ্চিম প্রান্তে গিয়ে গাছের নিচে খুঁজে পান একটি পুরনো সোনালী রঙের চামচাকৃতি ঢাকনা—যা কোনো কসমেটিক শিশির হতে পারে। সেটি পাঠানো হয় ফিংগারপ্রিন্ট পরীক্ষায়, আর ফলাফল আসে পরদিন—ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেলে সুনন্দার সঙ্গে। এরপর সৌরভ সবার উপস্থিতিতে বলেন, “চন্দ্রমল্লিকা ফুলে যে বিষ ছিল, তা হঠাৎ মিশে যায়নি। কেউ একজন ছড়িয়ে দিয়েছিল, পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী। এবং সেই ব্যক্তি চেয়েছিলেন, যেন মৃত্যুটা যেন দেখায় দুর্ঘটনাজনিত বা আত্মহত্যার মতো।” তখনই তিনি বলেন, “মালতি একজন প্রত্যক্ষদর্শী, এবং তার কথার সঙ্গে প্রমাণ মিলেছে।” বাড়ির ভেতর তখন নিঃশব্দ বিস্ফোরণ ঘটে। গৌরী দেবীর মুখ সাদা, রোহনের চোখ কাঁপছে। আর সুনন্দা? সে ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে আছে। সৌরভ তাকিয়ে বলেন, “সুনন্দা দেবী, আপনি কি কিছু বলতে চান?”

রাত গড়িয়ে প্রায় মধ্যরাত, রায়চৌধুরি বাড়ির অন্দরমহল যেন নিঃশ্বাস ফেলে চলেছে চাপা আতঙ্কে। সুনন্দার চোখে ধরা পড়া সেই মুহূর্তের থমকে থাকা অভিব্যক্তি সৌরভ চক্রবর্তীর মস্তিষ্কে গেঁথে থাকে। কিন্তু এখনও যেন একটি স্তর রয়ে গেছে যা স্পষ্ট নয়—রহস্যের ছায়ায় লুকিয়ে থাকা সেই ‘শকুন’, যে কবিতার চারপাশে ঘুরে বেড়াত কিন্তু নিজেকে আড়াল করত নিপুণ কৌশলে। সৌরভ এবার কবিতার স্বামী রোহনের দিকে মন দেন। সেই লোকটা শুরু থেকেই কিছুটা ‘অলস সত্য’-র আশ্রয়ে ছিল—কিছুই জানি না, কিছুই বুঝি না এমন এক নিঃসহায় অবয়ব। কিন্তু সৌরভ জানেন—এই ধরনের লোকই সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক, কারণ তারা নীরব থেকে পরিস্থিতি চালনা করে। তিনি রোহনের ফোনটি পুনরায় পরীক্ষা করেন, এবার ফরেনসিক সহকারীর সাহায্যে। সেখানে একটি গোপন অ্যাপে খুঁজে পান এমন কিছু বার্তা, যা কবিতা পাঠিয়েছিল—“তুমি আমাকে যেভাবে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছো, আমি বুঝে গেছি তুমি কাদের সঙ্গে রয়েছো। কিন্তু মনে রেখো, তোমার মুখোশ খসে যাবে।”

এই মেসেজের সময়টি ছিল ঠিক সেই রাতে, দীপাবলির কয়েক ঘণ্টা আগে। সৌরভ বুঝলেন—রোহনের সামনে কিছু ছিল যা সে চেপে রাখতে চাইছিল। তিনি তার সঙ্গে একান্তে বসে বলেন, “তোমার স্ত্রীর মৃত্যু দুর্ঘটনা নয়, এইটা তুমি জানো। কিন্তু তুমি বলো না। তুমি কি কিছু জানো যেটা এখন বললে নিজেই বিপদে পড়বে?” রোহন কাঁপা কণ্ঠে উত্তর দেয়, “আমি কবিতাকে ভালোবাসতাম। কিন্তু ও বদলে গিয়েছিল। ও আমার ফোনে হ্যাক করে আমার কিছু কথাবার্তা দেখে ফেলেছিল, যা ছিল সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। ও ভেবেছিল আমি কাউকে ভালোবাসছি। আসলে আমি চাইছিলাম একটা শান্তিপূর্ণ জীবন, যেখানে কোনো সংঘাত থাকবে না। সে যদি কাউকে ব্ল্যাকমেল করত—আমি জানি না। আমি শুধু চাইতাম ও আমাকে ছেড়ে চলে যাক।” সৌরভ এবার মুখ গম্ভীর করে বলেন, “তাহলে তুমি ওকে সরাতে চাওনি, কিন্তু চেয়েছিলে সে নিজেই সরে যাক? হয়তো আত্মহত্যা করুক, তাই না?” রোহনের চোখ ছলছলিয়ে ওঠে, কিন্তু সে চুপ থাকে। এই চুপ থাকা থেকেই বুঝে নেওয়া যায়—কেউ হয়তো কবিতাকে মানসিকভাবে এমন জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিল, যেখানে সে আর নিজেকে বাঁচাতে চায়নি।

তবে সৌরভ বিশ্বাস করেন না যে কবিতা আত্মহত্যা করেছে। কারণ, তার চোখে ছিল আতঙ্ক, হাতে ছিল বিষ মাখানো ফুল, যা হঠাৎ নিজে হাতে তুলে নেওয়া নয়—বরং কাউকে বিশ্বাস করে নেওয়া। এই মুহূর্তে, তিনি ফিরে যান কবিতার রচনাগুলি পড়তে—তার কবিতা, ডায়েরির খসড়া, ছোট ছোট চিরকুট। সেখানে একটা লাইনে চোখ আটকে যায়—“কেউ একজন চুপচাপ আমার প্রতিটি কষ্ট দেখে যাচ্ছিল, কিন্তু সে কোনোদিন কিছু বলল না। সে যদি আমার স্বামী না হয়ে আমার বন্ধু হতো, তাহলে আমি হয়তো এখনো বেঁচে থাকতাম।” সৌরভ বুঝে যান—কবিতা নিজেকে অসহায়ভাবে ঠেলে দিয়েছিল একাকিত্বে, অথচ তাকে ঠেলে দিয়েছিল তার সবচেয়ে আপনজনই। এই অধ্যায়ের শেষে দাঁড়িয়ে, সৌরভ ধীরে ধীরে বললেন, “এই মৃত্যু শুধুই খুন নয়, এটা এক সম্মিলিত অপরাধ। সুনন্দা হয়তো হাত নেড়েছিল, কিন্তু রোহন তার নীরবতায় সেই মৃত্যুকে সঙ্গ দিয়েছিল।” এবং এই সত্যিই যেন ছায়ার মতো লেপ্টে আছে পুরো বাড়ির গায়ে, ঠিক এক শকুনের ডানা যেমন মরা শরীরের উপর বসে থাকে—অদৃশ্য অথচ নিশ্চিত।

দুপুরের ঠিক পর, রায়চৌধুরি পরিবারের সবাইকে নিমন্ত্রণ জানানো হলো একটি “ডিনার রিক্রিয়েশন”-এ। সৌরভ চক্রবর্তী নিজের হাতে সাজালেন আগের দীপাবলির রাতের মতোই একই পরিবেশ—একই লাইটিং, একই আসবাবের বিন্যাস, এমনকি একই মেনু। কিন্তু এইবার টেবিলের মাঝখানে রাখা এক গ্লাস জলের পাশে ছিল একটি চন্দ্রমল্লিকা ফুল—নকল, তবে দেখতে অবিকল আসল। সবাইকে নিজ নিজ জায়গায় বসতে বলা হলো। সুনন্দা একটু অস্বস্তি নিয়ে, গৌরী দেবী কৌতূহলভরে, রোহন একরাশ কুণ্ঠা নিয়ে বসেন। সৌরভ বললেন, “আজ আমরা নাটকের শেষ দৃশ্য মঞ্চস্থ করবো। কিন্তু এখানে কেউ একজন জানেন, কাকে কীভাবে সাজাতে হবে যেন একটি জীবন শেষ হয়। আমি চাই, যিনি যেভাবে দাঁড়িয়েছিলেন বা বসেছিলেন সেই রাত, সেভাবেই থাকুন।” সবাই নড়েচড়ে বসল। সৌরভ এবার নকল ফুলটা তুলে বললেন, “এই ফুলে ছিল অ্যাট্রোপিন জাতীয় বিষ, আর কবিতা সেই বিষ নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল। কিন্তু কে রেখেছিল এই ফুল সেখানে?”

সেই মুহূর্তে, সৌরভ একটি চশমায় চোখ রাখলেন—যার ভেতর ছিল একটি ক্ষুদ্র ক্যামেরা, যা তিনি আগেই টেবিলের পাশে রেখেছিলেন। ক্যামেরা রেকর্ড করছিল পরিবারের প্রতিক্রিয়া। এবং তখনই ঘটে গেল ঘটনাটা। সুনন্দা, যিনি এতক্ষণ নির্বিকার ছিলেন, হঠাৎ তীক্ষ্ণ গলায় বলে উঠলেন, “তুমি যদি না বলতে, আমি আজও চুপ থাকতাম। কিন্তু কবিতাই এই বাড়িকে ছিন্নভিন্ন করছিল। আমি শুধু ওকে ওর নিজের অহংকারের জন্য একটা শিক্ষা দিতে চেয়েছিলাম।” সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে যেতে থাকে, “আমি ওই শিশিটা ব্যবহার করেছিলাম। ভেবেছিলাম, ও বুঝবে—কেউ কথা না বললেও কিছু করতে পারে। কিন্তু… কিন্তু ও মারা যাবে, সেটা আমি চাইনি।” ঘরে তখন নিস্তব্ধতা। গৌরী দেবী মুখে আঁচল চেপে ধরে কাঁপছেন, রোহন কেবল তাকিয়ে আছে, নিঃশব্দে।

সৌরভ এবার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ান। তিনি বলেন, “একটি অপরাধ কখনো একক নয়, যদি পুরো পরিবেশ তাকে পুষে রাখে। সুনন্দা হয়তো বিষ দিয়েছিল, কিন্তু ওই বিষ জন্ম নিয়েছিল বহুদিনের ঘৃণা, উপেক্ষা আর বিদ্রুপ থেকে। রোহন, তুমি ওর পাশে দাঁড়াতে পারতে। গৌরী দেবী, আপনি চাইলে ওকে গ্রহণ করতে পারতেন। কিন্তু আপনারা কেউ তা করেননি।” সৌরভ চুপ করেন এক মুহূর্ত, তারপর বলেন, “এই তদন্ত এখানেই শেষ নয়। পুলিশকে আমি সব কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু মনে রাখবেন—এই চন্দ্রমল্লিকা যেমন ফুল হয়ে বিষ হয়ে উঠেছিল, ঠিক তেমনি ভালোবাসা যখন অপমান আর অবহেলায় চাপা পড়ে, তখন সে-ও একদিন বিস্ফোরিত হয়।” ডিনার রিক্রিয়েশন শেষ হয় এক ভারী নীরবতায়। কেউ কিছু খায় না। শুধু দরজার বাইরে বাতাসে দুলে ওঠে একগুচ্ছ সত্য—যা এতদিন ছিল অন্ধকারে।

সৌরভ চক্রবর্তী পরদিন সকালে ফিরে যান কবিতার ঘরে—সেই বিছানা, সেই টেবিল, সেই দরজার পাশের দেয়ালে লাগানো চিত্রফ্রেমগুলো—সবই এখন মৃত এক নারীর স্মৃতিচিহ্ন। কিন্তু একটা কিছু যেন এখনো খুঁজে বের হবার অপেক্ষায়। তিনি আগেও দেখেছিলেন টেবিলের ড্রয়ার, কিন্তু এবার ভিন্ন চোখে দেখলেন। একপাশে একটা পুরনো হার্ডকভার বই—‘শব্দের শরীর’, কবিতার প্রিয় কবিতার সংকলন। বইয়ের মলাটের পেছনে পাতা গুঁজে ছিল এক চিঠি—হাতে লেখা, জ্যান্ত কালি, তবুও নিঃশব্দে বয়ে বেড়ানো ক্ষতর দলিল। চিঠির শুরুতেই লেখা—“যদি আমি না থাকি, কেউ একজন অন্তত জানুক—আমি কাউকে ঘৃণা করে যাইনি। শুধু প্রত্যাশা করে করে ক্লান্ত হয়ে গেছি।” পরবর্তী পংক্তিতে কবিতা লেখে—“এই বাড়ির প্রতিটি দেয়াল যেন আমার দিকে আঙুল তুলে বলত, আমি ঠিক নই। সুনন্দা বৌদিকে ভয় করতাম না, কিন্তু বুঝতাম—ওর চোখে আমার উপস্থিতি ছিল অবাঞ্ছিত। রোহন… তাকে ভালোবেসে ভুল করিনি, কিন্তু সে আমাকে ভালোবাসার ভাষায় চিনতে পারেনি।”

এই চিঠি শুধুমাত্র আত্মসমর্পণের দলিল নয়, বরং কবিতার নীরব প্রতিরোধের রেকর্ড। চিঠির শেষে সে লিখেছে—“যদি আমার মৃত্যু রহস্য হয়, তবে জেনে রেখো, আমি নিজের জীবন শেষ করিনি। আমি শুধু বিশ্বাস করেছিলাম—একটা ফুল কাউকে খুশি করতে পারে।” সৌরভ জানেন, এই লাইনটি কেবল কাব্যিক নয়, বরং জবানবন্দি। কবিতা হয়তো বুঝতেও পারেনি, যে ফুল তার হাতে উঠছে, সেটাই মৃত্যুর আমন্ত্রণ। তিনি চিঠিটা জ্যাকেটের ভেতরে রাখেন। তার চোখে আজ ক্রোধ নেই, দুঃখ নেই—শুধু গভীর শ্রদ্ধা। তিনি জানেন, সত্য প্রতিষ্ঠা করা মানেই সবসময় বিচারসঙ্গত প্রতিশোধ নয়—কখনও তা নিঃশব্দে কারও আত্মাকে মুক্তি দেওয়ার নাম।

এরপর সৌরভ থানায় যান, সমস্ত প্রমাণ—ফিঙ্গারপ্রিন্ট, চিঠি, সাক্ষ্য ও বিশ্লেষণ দিয়ে রিপোর্ট জমা করেন। কিন্তু চূড়ান্ত প্রতিবেদন লেখার আগে তিনি থমকে যান। একটি লাইন তার মনে বারবার ঘুরে ফিরে আসছে—“আমি কাউকে ঘৃণা করে যাইনি।” তাহলে কী সত্যিই সুনন্দা একা অপরাধী? নাকি পুরো পরিবারের ছায়া তাকে এই কাজ করতে বাধ্য করেছে? তিনি রিপোর্টে লেখেন—“মূল অভিযুক্ত সুনন্দা রায়চৌধুরি, বিষ প্রয়োগে যুক্ত। তবে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মানসিক অবহেলা, অবজ্ঞা ও অবদমনপরায়ণ পরিবেশ এই মৃত্যুকে উৎসাহিত করেছে। একে একক অপরাধ নয়, বরং একটি সমষ্টিগত ব্যর্থতার ট্র্যাজেডি বলা চলে।” এবং এই ভাষাটাই শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে কবিতার মৃত্যুর প্রতিধ্বনি—একটি প্রথাগত সমাজে, যেখানে একটি স্বাধীনচেতা মেয়ে টিকতে পারল না, সেখানে দায় শুধু এক হাতে নয়, বরং বহু হাতে বিভাজিত।

১০

রায়চৌধুরি বাড়ির দক্ষিণের বারান্দা, যেখানে লতানো বাগানে এখনো কয়েকটি চন্দ্রমল্লিকা রয়ে গেছে—একটিও তুলে কেউ আর ঘরে আনে না। এক সপ্তাহ কেটে গেছে তদন্তের। সুনন্দা রায়চৌধুরি বর্তমানে পুলিশ হেফাজতে, বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হবে শীঘ্রই। গৌরী দেবী বাড়ির ভেতর প্রায় নির্বাক হয়ে গেছেন। রোহন তার ঘরে নিজের ছায়ার সঙ্গেই কথা বলেন, আর অর্ণব, যে কিনা এক সময় ভালোবাসার নাম নিতে ভয় পেত, সে কবিতার পুরনো লেখাগুলো দিনরাত পড়ে চলে। সৌরভ চক্রবর্তী স্যুটকেস গোছাচ্ছেন। তিনি জানেন, তার কাজ শেষ, কিন্তু এই বাড়ির প্রাচীরে যে অদৃশ্য ফাটল রয়ে গেল, তা হয়তো কোনোদিনই সারবে না। যাওয়ার আগে তিনি আবারও গিয়েছিলেন বাগানের সেই গাছটার কাছে—চন্দ্রমল্লিকার গন্ধ আজও ঘ্রাণে তীব্র, তবে এবার আর মৃত্যুর নয়—বরং এক সতর্কতার।

বাড়ি ছাড়ার আগের সকালে সবাইকে একত্র করলেন সৌরভ, শেষবারের মতো কথা বলার জন্য। “এই গল্পের কেন্দ্রবিন্দু ছিল একটা ফুল। কিন্তু সে ফুল কেবল বাহক ছিল, আসল বিষ তো অনেক আগে থেকেই জমছিল আপনাদের মনেই,”—সৌরভ বলেন স্থির কণ্ঠে। তিনি একবার এক ঝলক তাকান গৌরী দেবীর দিকে, যিনি মুখ নিচু করে বসে আছেন। “আপনারা কেউ কবিতাকে বোঝার চেষ্টা করেননি। কেউ তাকে গ্রহণ করেননি। বরং আপনি, গৌরী দেবী, তার আত্মবিশ্বাসকে ‘অহংকার’ বলেছিলেন। রোহন, আপনি তার পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে চুপ থেকেছেন। আর অর্ণব… আপনি সত্যি ভালোবেসেছিলেন, কিন্তু নিরবতা দিয়ে তাকে রক্ষা করতে পারেননি।” ঘরে তখন কেবল বাতাস আর বেদনার স্পন্দন। সৌরভ আবার বলেন, “একটা পরিবারের সদস্যরা যখন একজনকে একঘরে করে তোলে, তখন মৃত্যুর দোষ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয় না, কিন্তু দায়বদ্ধতা ভাগ করা উচিত সবারই।”

দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সৌরভ থেমে গেলেন এক মুহূর্তের জন্য। পেছনে না ফিরে বলেন, “এই মৃত্যু একটা শেষ নয়—এটা এক শুরু। হয়তো আপনাদের মধ্যে কেউ একজন আজকের পর থেকে কাউকে সত্যিই বোঝার চেষ্টা করবেন, হয়তো কারও প্রতি নীরব অবহেলার বদলে একটুখানি শ্রদ্ধা ফিরবে। চন্দ্রমল্লিকার গন্ধ আবার কেউ ঘরে তুলবে—ভয়ের নয়, সাহসের প্রতীক হয়ে।” তারপর সৌরভ বেরিয়ে যান বাড়ির মূল ফটক দিয়ে। পেছনে পড়ে থাকে এক বদ্ধঘরের ট্র্যাজেডি, অথচ কোথাও যেন বাতাসে হালকা এক মুক্তির ঘ্রাণ—যেন কবিতা আজ, কোথাও একজোড়া চোখ খুলে নিশ্চিন্তে বলছে, “এবার অন্তত কেউ আমার কথা শুনেছে।” চন্দ্রমল্লিকার রহস্য শেষ হয়, কিন্তু রয়ে যায় প্রশ্ন—আমরা যখন কাউকে ভালোবাসি না, তাকে ঘৃণা না করেও কেমন করে ধ্বংস করে ফেলি? হয়তো এর উত্তর এখনও অজানা… হয়তো এটাও এক রহস্য।

-×-

 

1000039412.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *