Bangla - ছোটদের গল্প - প্রেমের গল্প

চন্দ্রমল্লিকার দিনগুলি

Spread the love

নীলাঞ্জনা রায়


বর্ধমান শহরের জানুয়ারির সকালগুলোয় কুয়াশা যেন চাদরের মতো শহরটাকে ঢেকে রাখে। স্কুলের মাঠটা তখনো ঘুমঘুম, কেবল কয়েকটা কাক আর গাছের ডালে বসে থাকা রংচটা ধোঁয়াশার ভেতর কিছু চেনা-অচেনা আওয়াজ। সেই রকম এক সকালে ঊর্মিলা সাইকেল ঠেলে স্কুলে ঢুকল, কানটুপি ঢাকা মুখে একরাশ মনোযোগ—তবে বাইরের নয়, তার নিজের ভিতরের কোনো অজানা ভাবনায়। ভেতরের কাঁপুনি ঠেকিয়ে সে সাইকেলটা লাইব্রেরির পাশে রেখে ক্লাসরুমের দিকে হাঁটতে লাগল, মেঝেতে জমে থাকা শিশিরে পা পিছলে যাবার মতো টান, আর জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলেকে দেখে হঠাৎ থেমে গেল। ছেলেটা, নীল টুপি আর ধূসর সোয়েটারে আবৃত, জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল—হয়তো কুয়াশার ভেতর কিছু একটা খুঁজছিল, অথবা তার ভেতরের গল্পগুলোকে জমিয়ে তুলছিল চোখের দৃষ্টিতে। সে ফিরে তাকাল না, কিন্তু ঊর্মিলার মনে হলো, ঠিক সেই মুহূর্তে তারা একে অপরকে দেখে ফেলেছে—একটা নিঃশব্দ দৃষ্টি, যা প্রশ্ন করে না, কিন্তু মনোযোগ চায়।

ঊর্মিলার স্কুলজীবন বরাবরই শান্ত, নিয়মমাফিক। সারা বছর সে মেধাবী ছাত্রী হিসেবে পরিচিত, শিক্ষকরা চেনে তার লেখা, বিশেষত কবিতা প্রতিযোগিতায় তার অংশগ্রহণ। কিন্তু এই বছরটা আলাদা। হায়ার সেকেন্ডারির শেষ বছর—বোর্ডের চাপ, ভবিষ্যতের দোলাচল, পরিবারের অতিরিক্ত প্রত্যাশা—সব মিলিয়ে তার ভেতরের ছায়ারা যেন একটু বেশিই মুখ তুলে তাকায়। এই টানাপোড়েনের মধ্যে, ওই জানালার ধারে দাঁড়ানো ছেলেটি—নিলয় মৈত্র—এক অচেনা টান তৈরি করেছিল, যার ব্যাখ্যা সে নিজেও খুঁজে পায়নি। সুদীপ্তা বলত, “তুই তো কেবল লেখাপড়া আর কবিতা নিয়ে থাকিস, একবার ছেলেটার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই না হয় ভালোবাসার কবিতা লেখ!” ঊর্মিলা হেসে ফেলত, কিন্তু মনে মনে জানত, সুদীপ্তার কথার মধ্যে যে হালকা রসিকতা, তার নিচে সত্যি একটা কাঁপুনি আছে। সেই প্রথম দিনের চোখাচোখির পর, সে লক্ষ্য করল—নিলয় তাকে এড়িয়ে যায় না, আবার খোলাখুলিও নয়। একটা লুকোচুরি খেলা শুরু হয় দুজনের মাঝে, যেখানে কথার দরকার পড়ে না, কেবল ক্লাসরুমের কাচের ফাঁক দিয়ে চেয়ে থাকা কিংবা করিডোরে চলতে চলতে এক সেকেন্ডের থেমে যাওয়া যথেষ্ট।

নিলয়, হোস্টেলে থাকে—স্কুল ক্যাম্পাসের পেছনে, গাছপালার মধ্যে ঘেরা তিনতলা ভবনের দ্বিতীয় তলার জানালার ধারে তার বিছানা। বন্ধুদের মধ্যে সে সবচেয়ে শান্ত, তবে পড়াশোনায় চমৎকার। শিক্ষকরা যেমন ভালোবাসে, তেমনি তার একটু গম্ভীর স্বভাব নিয়ে কিছুটা ভয়ও পায়। তার খাতায় লেখা থাকে অদ্ভুত সব লাইন—”যে প্রশ্ন করে না, তার চোখে উত্তর খোঁজো”, বা “কুয়াশার ভিতরে কিছু ছায়া চিরকাল নিজের নামে ভুল হয়”। ওর বন্ধু অয়ন মাঝেমধ্যেই বলে, “নিলয়, তুই কবি হবি না তো!” কিন্তু সে কিছু বলে না, কেবল মুচকি হাসে। সেই হাসি একদিন ঊর্মিলার দিকে ফিরিয়ে দিয়েছিল, চুপচাপ, কোনও শব্দ ছাড়া। সেদিন ছিল পনেরোই জানুয়ারি, স্কুলে বসন্ত উৎসবের প্রস্তুতি চলছিল। ঊর্মিলা লাইব্রেরির কোনে বসে রবীন্দ্রনাথ পড়ছিল, হঠাৎ টেবিলের উপর এসে পড়ল একটি সাদা কাগজ। তাতে লেখা: “তুমি কি সত্যি জানো, জানালার কাচের ওপারে তোমার মুখ কেমন আলো ফেলে?” সই নেই, কিছুই নেই—শুধু একরাশ কুয়াশা মাখা অনুভব। সে জানত কে লিখেছে, আবার জানতও না।

সেই দিন থেকেই শুরু হয় চিঠির খেলা। প্রথম দিকে একটা ফুল, একদিন বইয়ের ফাঁকে রাখা পাতাঝরা পেঁজো, তারপর এক কাগজে লেখা ছয় লাইনের কবিতা। সুদীপ্তা সব জানত, সে-ই গোপনে চিঠি পৌঁছে দিত নিলয়ের কাছে, লাইব্রেরির পুরনো তাকের নিচে রাখা বইয়ের ভিতরে। ঊর্মিলার লেখা ছিল সাবলীল, আবেগপ্রবণ, কিন্তু মেপে নেওয়া। যেমন একবার লিখল: “আমরা যদি কোনোদিন কথা না বলি, তাহলে কি আমাদের চোখে জমে থাকা কথাগুলো মরবে?” নিলয় সেই উত্তরে লিখেছিল: “কথা না বললেই তো মনে রাখা সহজ হয়। মুখের শব্দ মুছে যায়, চোখের শব্দ থেকে যায়।” ধীরে ধীরে, তাদের চিঠি আর নিঃশব্দ চোখাচোখি হয়ে উঠল এক গোপন প্রেমের নীল ডায়েরি। এর মাঝে কেউ কিছু জানত না, কেউ কিছু বুঝত না, কিন্তু শহরের কুয়াশা যেন সাক্ষী হয়ে থাকত সেই প্রতিটা মুহূর্তের। জানালার ধারে রাখা চন্দ্রমল্লিকা ফুল, কিংবা বইয়ের পাতার ভাঁজে শুকনো চিঠি—সবই সেই ভালোবাসার ইতিহাস, যা হয়তো শব্দে লেখা হয়নি, কিন্তু অনুভবে গাঁথা ছিল।

ঊর্মিলার সকালগুলো এখন আর আগের মতো থাকে না। ঘুম থেকে উঠে দাঁতের ব্রাশ করার আগেই তার মনে পড়ে—কাল সে কী লিখেছিল, আজ কী লিখবে। মায়ের চোখে যেন সব বুঝে ফেলার এক ধরনের তীক্ষ্ণতা—”তুই কি কিছু লুকোচ্ছিস রে, ঊর্মি?”—ঊর্মিলা হেসে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু জানে, তার মন এখন আর কেবল পড়াশোনার দিকে ঘোরে না, বরং চিঠির প্রতিটি লাইনের পেছনে কোনও মুখ, কোনও দৃষ্টি, কোনও অচেনা ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যায়। প্রতিটি সকালে সে স্কুলে পৌঁছায় সাইকেলে, কাঁপা কাঁপা আঙুলে বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে আনে চিঠির টুকরো। লাইব্রেরির দ্বিতীয় তাকের কোণটা এখন যেন তার গোপন মঞ্চ, যেখানে প্রতিদিন নতুন দৃশ্য রচনা হয়। সুদীপ্তা একমাত্র তার এই নাটকে সহচর—চোখ মেরে বলে, “আজ কী লিখেছিস? কবিতা না প্রশ্ন?” আর নিজের গার্জেন হওয়ার ভঙ্গিতে কখনো বলে, “সাবধানে খেল, এই প্রেম একদিন হোস্টেল ও হোমরুম দুটোই পুড়িয়ে ফেলবে।”

নিলয় সেইসব চিঠি পায় প্রতি বিকেলে, ক্লাসের পর নিঃশব্দে লাইব্রেরিতে গিয়ে। সাদা পাতায় লেখা অল্প কথাগুলোকে সে পড়ে ধীরে, যেন প্রতিটি অক্ষর পাণ্ডুলিপির মতো। মাঝে মাঝে শুধু ‘তুমি কেমন আছো?’—এই পাঁচটি শব্দে যে আবেগ, তা কেবল সে বোঝে। তার নিজের জবাবগুলোও তেমনই—ছোট, ভাবুক, তীব্র। যেমন একদিন লিখেছিল, “আজ ক্লাসে যখন তুমি তাকিয়েছিলে, মনে হলো—সময়টা একটু থেমে গেল। জানি না তুমি লক্ষ্য করেছিলে কি না।” সে জানত, এই চিঠিগুলো শুধু লেখা নয়, বরং একধরনের আত্মপ্রকাশ—যা হয়তো কথায় সম্ভব নয়। ঊর্মিলা সেইসব পড়ে কখনো চুপচাপ হেসে ফেলে, কখনো জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকে। একরকম শীতল শান্তি নেমে আসে, যেন চন্দ্রমল্লিকার ফুলপাঁপড়ির মতো কোমল।

তবে কেবল চিঠি নয়, এখন তাদের প্রতিদিনের রুটিনের মাঝেও একটুকরো ছায়া খেলা করে। ক্লাসে পড়ার সময়, শিক্ষক পড়াচ্ছেন, অথচ চোখের এক প্রান্ত দিয়ে ঊর্মিলা বুঝতে পারে নিলয় তাকিয়ে আছে। কখনো ল্যাবের কাঁচের বোতলের আড়ালে সে চায়ে তাকাতে, কখনো করিডোরে হাঁটার সময় পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মুহূর্তটুকু দীর্ঘতর হয়। এমনকি খেলার মাঠে একদল ছেলেমেয়ে ব্যস্ত ক্রিকেটে, আর এক কোণায় নিলয় কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, নজর রাখে—ঊর্মিলা তাকাল কি না। একদিন, ছুটির পর ঊর্মিলা আবিষ্কার করল, তার সাইকেলের বেলটায় একটি হলুদ চন্দ্রমল্লিকা গুঁজে রাখা। সে কিছু বলেনি কাউকে, কিন্তু সাইকেল চালানোর সময় তার গাল লাল হয়ে ছিল বাতাসের ছোঁয়ায়, কিংবা হয়তো কিছু অনুভবে। সে রাতটা সে কাটায় রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্র’ পড়ে, যেন সেই চিঠিগুলোর মধ্যে নিলয়ের শব্দ খুঁজে পায়।

এভাবে দিনে দিনে তাদের চিঠি-প্রেম আরও গভীর হতে লাগল। কোনও দিনে নিলয় লেখে অঙ্কের সমস্যার কথা, আবার কোনও চিঠিতে সে লেখে—“তুমি কি জানো, আমি তোমাকে না দেখলে সারাদিন অদ্ভুত ফাঁকা ফাঁকা লাগে?” ঊর্মিলা জবাবে লেখে—“তুমি কি জানো, আমি তোমার লেখা পড়ে যতটা কাঁদি, তার অর্ধেকও হাসি না।” তারা জানত, এই সম্পর্কের কোনও নাম নেই, কোনও স্বীকৃতি নেই, এমনকি ভবিষ্যৎ নিশ্চিত নয়। কিন্তু দিনের শেষে, সেই সাদা কাগজে হাতে লেখা লাইনগুলো তাদের পৃথিবী। সেই প্রেমে কোনও ছবি নেই, কোনও কথা নেই—শুধু শব্দ আর চোখের ভাষা। কুয়াশা ঢাকা সেই স্কুল ক্যাম্পাস, লাইব্রেরির নির্জনতা, হোস্টেলের জানালা—সব মিলিয়ে তাদের প্রেম যেন এক অদৃশ্য কবিতার ছায়াপথ।

ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বর্ধমান শহরের কুয়াশা কিছুটা পাতলা হতে শুরু করে, কিন্তু ঊর্মিলার মনে যেন কুয়াশার পরত আরও ঘন হয়ে ওঠে। প্রতিদিনের চিঠিগুলি আর শুধু অনুভূতির আদান-প্রদান নয়, বরং এক ধরনের অভ্যাস, আত্মবিশ্বাস, নির্ভরতার জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে এখন প্রতিটি ক্লাসে জানালার ধারে বসতে চায়, যেন দূর থেকে নিলয়ের উপস্থিতি অনুভব করতে পারে। কোনওদিন সে দেখে নিলয় একমনে ক্লাস করছে, কোনওদিন দেখে বইয়ের ভাঁজে কিছু একটা লিখছে, হয়তো পরবর্তী চিঠির খসড়া। একদিন, ক্লাস শেষে লাইব্রেরি যাওয়ার পথে হঠাৎ ঊর্মিলা এক কোণে দাঁড়িয়ে দেখতে পায়—নিলয় জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে, চোখে একটা আলগা উদাস ভাব। তখন বাতাসে ছিল হালকা ফুলের গন্ধ, আর জানালার পাশেই রাখা ছিল একটি ছোট্ট সাদা চন্দ্রমল্লিকা। ফুলটার ডাঁটা একটা পাতলা কাগজে বাঁধা, তাতে লেখা—“আজ কিছু লিখিনি, শুধু এইটুকু দিয়ে দিলাম। যদি বোঝো, আমি কি বলতে চেয়েছি।” সেই মুহূর্তে ঊর্মিলার মনে হলো, শব্দ না থাকলেও ভালোবাসার ভাষা থেমে যায় না, বরং তখনই সে সবচেয়ে গভীর হয়ে ওঠে।

চন্দ্রমল্লিকা ফুলটা সে খাতার ভাঁজে রেখে ঘরে নিয়ে যায়, আর রাত্রে আলো নিভিয়ে, জানালার পাশে বসে, বার বার সেই চিঠি আর ফুলের দিকে তাকায়। সুদীপ্তা পরদিন দেখে বলে, “তুই তো দেখি একেবারে ফুল পাগল প্রেমিকের মতো রোম্যান্টিক হয়ে যাচ্ছিস!” ঊর্মিলা হেসে ফেলে, কিন্তু ভিতরে এক অজানা শিউরে ওঠা চলে আসে—সে অনুভব করে, এই প্রেমটা কেবল একজনের প্রতি নয়, এই প্রেম তার নিজের মধ্যেও এক আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। এখন আর সে আগের মতো নির্লিপ্ত থাকে না, রাস্তায় হাঁটার সময় খেয়াল করে কোনদিকে নিলয় যায়, হোস্টেলের কোন জানালা তার ঘর, এমনকি কখন নিলয় মাঠে নামে ক্রিকেট খেলতে, সেগুলোও জানা হয়ে গেছে তার। এই জানতে চাওয়ার মধ্যে কোথাও কোনও প্রশ্ন নেই, কেবল নিঃশব্দভাবে জেনে রাখা, অনুভব করে যাওয়া।

নিলয়ের জন্যও এই সময়টা একধরনের পরিবর্তনের সূচনা। হোস্টেলের ঘরটা সে নিজে সাজিয়ে তোলে—বইয়ের পাশে রাখে শুকনো ফুল, জানালার ধারে রেখে দেয় কাগজে লেখা কিছু পংক্তি, যেগুলো হয়তো ঊর্মিলার উত্তর নয়, তবুও তার প্রতিধ্বনি। সে কখনও কোনও বন্ধুকে বলে না কিছু, এমনকি অয়নের সঙ্গেও ভাগ করে না তার মনের কথা। বরং, নিজের ভিতরে এক অদ্ভুত শূন্যতায় প্রেমের তরঙ্গ তৈরি হতে থাকে। তার প্রতিটি চিঠি যেন নিজেই নিজের সত্তাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা। যেমন একদিন সে লেখে—“যখন তুমি চুপ করে থাকো, তখন আমার চারপাশের শব্দগুলোও থেমে যায়। জানো, সেই চুপ করে থাকাটাই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি কথা।” এই ধরনের চিঠি পেয়ে ঊর্মিলা রাতে বিছানায় শুয়ে চুপ করে থাকে, চোখ বন্ধ করে যেন শব্দের মধ্য দিয়ে অনুভবের জলরেখা আঁকে।

এরই মাঝে বসন্ত উৎসবের তারিখ ঘোষণা হয়—স্কুলে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, কবিতা পাঠ, গান, আবৃত্তি—সব কিছুতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সবাই। ঊর্মিলার স্কুলজীবনের এই শেষ উৎসবে সে কবিতা পাঠে অংশ নিতে চায়, কিন্তু এবার কোনও সাধারণ কবিতা নয়—সে নিজের লেখা কবিতা পড়বে। চিঠির ভাষা থেকে উঠে আসা এক ব্যক্তিগত প্রেমগাথা, যা কেউ বোঝে না, তবু সবার হৃদয়ে চেপে বসে। সে কবিতার নাম দেয়—“জানালার ধারে চন্দ্রমল্লিকা।” সুদীপ্তা মুগ্ধ হয়ে শোনে কবিতাটা আর বলে, “তুই তো প্রেমে পড়েই সত্যিকারের কবি হয়ে গেলি রে।” বসন্ত উৎসবের সেই বিকেলে, স্কুলের অস্থায়ী মঞ্চে দাঁড়িয়ে, ঊর্মিলা যখন সেই কবিতাটা আবৃত্তি করে, নিলয় পিছনের সারিতে দাঁড়িয়ে শোনে চুপচাপ—তার চোখে একধরনের অদ্ভুত আলো, যেন বহুদিন পরে নিজের গল্পকে কারো মুখে শুনছে। প্রেম তখন কেবল দুজনের মধ্যে নয়, বরং এক বৃহত্তর নীরব দর্শকের অংশ হয়ে ওঠে।

বসন্ত উৎসবের কবিতা পাঠের পর অনেক কিছু যেন বদলে গেল। কেউ কিছু বলেনি সরাসরি, তবু ক্লাসে, করিডোরে, এমনকি লাইব্রেরির ধারে হঠাৎ হঠাৎ কিছু দৃষ্টির সম্মুখীন হতে থাকল ঊর্মিলা—সেই দৃষ্টি যে কৌতূহলী, একটু প্রশ্নবোধক, একটু ঈর্ষান্বিত। “জানালার ধারে চন্দ্রমল্লিকা”—এই নামেই যেন প্রেমের গন্ধ পেয়ে ফেলল স্কুলের কিশোর মনগুলো। কেউ বলল, কবিতার সেই “চোখে শান্তি খোঁজা ছেলেটা” নিশ্চয়ই ক্লাসের কাউকে নিয়ে লেখা, কেউ আবার বলল, “ঊর্মিলা তো নিলয়ের দিকেই বেশী তাকায়, বুঝতেই তো পারা যায়!” সুদীপ্তা প্রথমে এসব নিয়ে হাসাহাসি করলেও ধীরে ধীরে বিষয়টা যখন শিক্ষকদের কানে যেতে লাগল, তখন সে একটু চিন্তিত হয়ে পড়ল। একদিন সে চুপচাপ বলল, “ঊর্মি, তোদের এই খেলা একটু বেশিই নজরে পড়ে গেছে। সাবধানে থাকিস।” কিন্তু ঊর্মিলা তখনও বিষয়টা হালকাভাবে নেয়। তার মনে হয়, যদি ভালোবাসা এতটা নির্দোষ হয়, তবে সে লুকোতে যাবে কেন? অথচ, মন বলে অন্য কথা—মনের জানালায় এখনো নিলয়ের সেই চুপচাপ মুখ, চিঠির লেখা, আর হোস্টেলের জানালার ধারে রাখা ফুলের গন্ধ বাজতে থাকে।

তবে সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি ঘটল এক বুধবারের দুপুরে। অয়ন, যে কিনা নিলয়ের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু, হঠাৎ লাইব্রেরিতে একদিন বই খুঁজতে গিয়ে পেয়ে গেল একটা খোলা চিঠি—ঊর্মিলার হাতে লেখা একটি অপ্রেরিত কবিতা। হয়তো সুদীপ্তা রেখে দিতে ভুলে গিয়েছিল, অথবা নিলয় পড়ে রাখেনি সাবধানে। চিঠিটা পড়ে অয়নের চোখ ছলকে উঠল—অভিমানে, কষ্টে, কিংবা ভেতরে জমে থাকা একরাশ না বলা কথার কারণে। সে জানত না কেন, কিন্তু চিঠির শব্দগুলো যেন তাকে অকারণে আহত করল, কারণ তার নিজের মনে বহুদিন ধরে যে অনুভব ছিল, তাকে কেউ তো কখনও এমনভাবে শব্দে গেঁথে পাঠায়নি। সে কিছু না বলে চিঠিটা নিজের খাতার মধ্যে রেখে চলে যায়, কিন্তু সেই সন্ধ্যায় বন্ধুর চোখে মুখে কিছুটা বদল লক্ষ করে নিলয়। “তুই ঠিক আছিস তো?”—জিজ্ঞাসা করলে সে কেবল বলেছিল, “ভালো।” কিন্তু নিলয় টের পায়, কিছু একটা ফাঁটল তৈরি হয়েছে, কোনও অজানা কষ্ট ফেটে বেরোতে চাইছে।

এই ঘটনার পর থেকেই স্কুলে এক অদ্ভুত গুজব ছড়াতে থাকে। বলা হতে থাকে, নাকি নিলয় ও ঊর্মিলার মধ্যে ‘কিছু একটা চলছে’। কারও কারও মতে, তারা লাইব্রেরিতে একসঙ্গে দেখা যায়, কেউ আবার বলে, তারা হোস্টেলের পেছনের রাস্তা ধরে হাঁটে। এসব কথার কোনও ভিত্তি না থাকলেও, শব্দের ধার এতই তীব্র যে একদিন পদার্থবিদ্যার শিক্ষক বিধান স্যার ক্লাসে বলেই ফেললেন, “ছেলেমেয়েরা পরীক্ষার সময়ে অপ্রয়োজনীয় জিনিসে মন দেবে না—বিশেষ করে যাদের কাছ থেকে আমরা বেশি আশা রাখি।” স্যারের এই মন্তব্যে ঊর্মিলা সেদিন সারা ক্লাস চুপ করে বসে থাকে, আর নিলয় জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে এমনভাবে যেন পৃথিবীর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। সুদীপ্তা পরে বলে, “এবার সত্যিই সাবধান হওয়া দরকার।” তাদের সেই চিঠির খেলা, যেটা এতদিন নীরব সৌন্দর্য ছিল, এখন যেন বিপদের সংকেত হয়ে দাঁড়ায়। এবং সেই বিপদের সবচেয়ে অন্ধকার ছায়া ছিল—ভয়। যদি কেউ তাদের ধরা পড়িয়ে দেয়? যদি কেউ সেই চিঠিগুলি শিক্ষকদের হাতে তুলে দেয়?

নিলয় নিজেও যেন একটু একটু করে সরে আসতে শুরু করল। আগের মতো চিঠি দেওয়া কমে গেল, করিডোরে চোখাচোখি হলেও সে চোখ সরিয়ে নিত। একদিন ঊর্মিলা লাইব্রেরিতে অপেক্ষা করেও চিঠি পায়নি। সুদীপ্তা চুপ করে ছিল, বুঝতে পারছিল, সম্পর্কটা কোনও চোরাস্রোতের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। এই দূরত্বটা খুব সহজে বোঝা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায় গভীরভাবে। চিঠির ভাষা, ফুলের গন্ধ, জানালার ধারের শান্তি—সব কিছু মিলিয়ে তৈরি হওয়া এক কোমল প্রেম হঠাৎ যেন হেঁটে যায় রুক্ষ বাস্তবতার দিকে। কিন্তু তারপরেও, এক সন্ধ্যায় ঊর্মিলা নিজের খাতার মাঝে পায় একটি একপাক্ষিক লেখা—নিলয়ের হাতের লেখা: “যদি কোনওদিন এই শব্দগুলো কারও কানে না পৌঁছায়, জানবে আমি চেষ্টা করেছিলাম চুপ থেকে ভালোবাসতে।”

শীত পড়ার আগেই বর্ধমানের আকাশে হালকা কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। স্কুলের শেষ বছর হলেও ঊর্মিলাদের ক্লাসে পড়াশোনার পাশাপাশি একটা অজানা আতঙ্ক কাজ করে—যেন সব কিছু হঠাৎ শেষ হয়ে যাবে, সেই নির্ধারিত ছাড়পত্রের দিনটায়। কিন্তু নিলয় আর ঊর্মিলার জন্য দিনগুলো কেবল গণিত আর রসায়নের সমীকরণে সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রতিটি সকাল যেন এক নতুন আশ্বাস নিয়ে আসে। ওই ব্যস্ত সকালে, ছুটির ঘণ্টা পড়ার আগেই, নিলয় হঠাৎই হোয়াটসঅ্যাপে লেখে—“আজ বিকেল পাঁচটার সময় স্টেশন রোডের সেই পুরনো বইয়ের দোকানের পেছনের গলিটায় দেখা হবে?” ঊর্মিলা কিছুক্ষণ উত্তর না দিলেও তার বুকের ভিতর যেন ছোট ছোট বাজ পড়ে। সে জানে, ওখানে গেলেই হয়তো কথাগুলো একটু গাঢ় হয়ে উঠবে, হয়তো কিছু অপ্রকাশ্য কথার ভাষা মিলবে।

বিকেলটা যেন অসহ্য ধৈর্যের পরীক্ষা। বাড়িতে মিথ্যে বলে বেরোতে গিয়ে মায়ের সন্দেহ এড়ানোটা কঠিন হয়ে পড়ে। “বই কিনতে যাচ্ছি”—এই অজুহাতটা এবারো ভরসা দিলো তাকে। ছিপছিপে সালোয়ার কামিজে, সাদা শাল কাঁধে জড়িয়ে, ঊর্মিলা বইয়ের ব্যাগে চিঠির জবাবটা নিয়ে হাঁটে স্টেশন রোডের দিকে। নিলয় আগে থেকেই দাঁড়িয়ে, এক পায়ে ভর দিয়ে বাইসাইকেল ঠেলছে। তার চোখে এক ধরনের টান—যেটা সোজা হৃদয়ে গিয়ে ঠেকে। তারা দুজনেই কিছুক্ষণ নীরব থাকে। তারপর হালকা হেসে ঊর্মিলা বলে, “চিঠিটা পড়েছি… কিছু বলার ছিল…” নিলয় থেমে যায়, “তুমি কি সত্যিই বিশ্বাস করো এই অনুভূতিটা? স্কুলের পরেও থাকবে?” ঊর্মিলা তাকিয়ে থাকে নিলয়ের চোখে—চোখে সেই অসংখ্য প্রশ্ন, উত্তরহীন টানাপড়েন, অথচ আশ্বাসও লুকিয়ে আছে। সে হালকা মাথা নাড়ে—“ভালোবাসা পরীক্ষার রেজাল্টের মতো নিশ্চয়তা দেয় না, কিন্তু কোনো এক বিকেলের বাতাসে যদি কারো নাম বারবার মনে পড়ে, তাহলে বুঝে নিতে হয়…।”

ওই দেখা করার মুহূর্তটা তাদের কাছে স্বপ্নের মতো। কিন্তু ঠিক তখনই পাশের গলিপথে দুজন সহপাঠীকে দেখতে পায় ঊর্মিলা, যারা তাদের ক্লাসেরই ছেলে—একটা হঠাৎ চমকে ওঠার মতো মুহূর্ত। নিলয় তাড়াতাড়ি সরে যায়, যেন এমন কিছু ঘটেনি। ঊর্মিলা মুখ নিচু করে হাঁটতে শুরু করে। তার মনে হয়, যেন কেউ আজ তাদের গোপন বাগানটায় উঁকি দিল। সেদিন সন্ধ্যাটা ভারি হয়ে যায়। বাড়ি ফিরে চুপচাপ বই খুলে বসে ঊর্মিলা, কিন্তু তার চোখ দুলছে অক্ষরের ওপরে—প্রেম যেন সব কিছুতে ছায়া ফেলেছে, এমনকি শব্দেও। নিলয়েরও সন্ধ্যেটা কাটে একটা অজানা অস্থিরতায়—যদি ছড়িয়ে পড়ে এই খবর? যদি বন্ধুরা জেনে ফেলে? কিন্তু সেই ভয় ছাপিয়ে কিছু একটা স্পষ্ট হয় তাদের মধ্যে—এই সম্পর্কটা যতই গোপন থাকুক, যতই আপাত নীরবতায় গাঁথা থাকুক, তার গভীরতা অস্বীকার করা যায় না।

পরদিন স্কুলে কেউ কিছু বলে না, কিন্তু সহপাঠীদের চোখে কিছু একটা কৌতূহল দেখা যায়। ঊর্মিলা বুঝে যায়, “এত সহজে সব কিছু লুকিয়ে রাখা যায় না।” রাশিমালা ম্যাডামের বাংলা ক্লাসের সময় সবাই যখন কবিতা লিখছে, তখন নিলয় একটা প্যাজে ঊর্মিলার খাতায় গোপনে লিখে দেয়—“তুমি কি সত্যিই ভাবো… আমরা পারব?” উত্তর আসে না। শুধু একটা চুপচাপ কবিতার লাইন লেখা থাকে ঊর্মিলার পাতায়—“যতই পায়ে কাঁটা ফুটুক, আমি হেঁটে যাব… কারণ এ পথেই তোমার ছায়া পড়ে।” সে দিনটাও শেষ হয়, কিন্তু প্রথমবার তাদের মনে দোলা দিয়ে যায়—এ সম্পর্ক কেবল চিঠি বা গোপন দেখা-সাক্ষাতের নয়; এটা একটা দায়—নিজের অনুভবের প্রতি, একে অপরের প্রতি এবং ভবিষ্যতের প্রতিও।

ভোরবেলাটাই এখন ঊর্মিলার সবচেয়ে প্রিয় সময়। বর্ধমানের সেই অদ্ভুত নীরবতা, মাটির গন্ধ, কুয়াশার আস্তরণে ঢাকা স্কুল রোড—সবকিছু যেন এখন তার ভালোবাসার সাক্ষী। স্কুলে যাবার সময় সে যখন সাইকেল নিয়ে বেরোয়, তখন মনে হয় যেন প্রতিটি মোড়, প্রতিটি গাছ তার মনের গোপন অনুভব জানে। এই দিনগুলির মধ্যে এক আশ্চর্য প্রহেলিকা জড়িয়ে যাচ্ছে, কারণ প্রতিদিনই স্কুল শেষে লাইব্রেরি ঘরের পিছনে সেই পাঁচ মিনিটের দেখা—নিলয় ও তার মধ্যে। কিছু বলা হয় না, শুধু নীল চিঠির ভাঁজ বদল হয় হাতে হাতে। চিঠিগুলিতে এখন যেন জাদু লেগে থাকে—তার প্রতিটি শব্দ হৃদয়ে লেপটে থাকে। আজকের চিঠিতে নিলয় লিখেছে, “তোর হাসিটা যেন আমার সবচেয়ে সুন্দর সকাল।” ঊর্মিলার গালটা লাল হয়ে উঠেছিল।

আজ স্কুলে ‘সাংস্কৃতিক সপ্তাহ’-এর প্রস্তুতি পুরোদমে চলছে। কবিতা আবৃত্তি, গানের রিহার্সাল, দেওয়াল পত্রিকা—সব কিছুতেই কিশোর হৃদয়গুলো উথালপাথাল করছে। ঊর্মিলা আর নিলয় দুজনেই ‘স্মৃতির ছায়া’ নামে দেওয়াল পত্রিকার দায়িত্বে রয়েছে। সুযোগটা যেন ঈশ্বর নিজেই এনে দিয়েছেন তাদের জন্য। দুপুরবেলা, পুরো স্কুল যখন অস্থির, তখন তারা দুজনে পত্রিকার কনটেন্ট ঠিক করতে বসেছিল স্কুলের পুরনো ভাঙাচোরা ঘরের এক কোণে। নীল রঙা পেনটা নিয়ে নিলয় বলল, “এই ছন্দটা দেখ, তুই লিখিস না?” ঊর্মিলা মাথা নেড়ে বলল, “তুই পড়, আমি শুনি।” দুজনেই জানে, এই ছায়ার মত সুযোগে তারা একে অপরকে ছুঁয়ে থাকতে পারছে—কথার মধ্যে, হাসির মধ্যে, শব্দের ভিতরে। বাহ্যিকভাবে তারা ক্লাসমেট, সহকর্মী। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা এখন গোপন প্রেমিক-প্রেমিকা।

তবে সম্পর্ক মানেই শুধু রোমান্স নয়। প্রতিযোগিতা আর অনিশ্চয়তার চাপও একসাথে আসছে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কড়া দৃষ্টি, বাড়ির কঠিন নিয়ম সব যেন তাদের ভালোবাসার ওপরে ছায়া ফেলতে চাইছে। আজই সায়েন্স ক্লাসের পরে অঙ্কন স্যার খুব সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা দুজনেই দেওয়াল পত্রিকায় এত সময় দিচ্ছ, পড়াশোনার ক্ষতি হবে না তো?” এক মুহূর্তের জন্য নিলয়ের চোখে একরাশ অস্বস্তি দেখা গিয়েছিল। কিন্তু ঊর্মিলা তখন মৃদু হেসে বলেছিল, “স্যার, আমরা সব সামলে নিচ্ছি।” তবু সন্দেহের বীজ যেন পড়ে গেল। পরে, সাইকেলের প্যাডেল মারতে মারতে নিলয় বলেছিল, “সব ঠিকঠাক থাকবে তো ঊর্মিলা?” মেয়েটি কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বলল, “জানি না, কিন্তু এই মুহূর্তটুকু তো আমাদের।”

এমনই এক সন্ধ্যায়, স্কুল ছুটির পর ঊর্মিলা বাড়ি ফিরছে, হঠাৎ পেছন থেকে এক খাম দেওয়া চিঠি এনে দিল সুকুমার, লাইব্রেরির পুরনো কর্মচারী। সে হাসতে হাসতে বলল, “তোর জন্য রেখে গিয়েছিল নিলয়, খামটা যেন বৃষ্টি না খায়—এই ছিল তার চিন্তা।” চিঠিটা খুলে দেখে ঊর্মিলার চোখ ছলছল করে উঠল—নিলয় লিখেছে, “চন্দ্রমল্লিকা ফুলের গন্ধে তুই আসিস যেন আমার প্রতিটি স্বপ্নে। জানি না সামনে কী আছে, কিন্তু যতদিন আছে, ততদিন এই চিঠিগুলোয় আমি তোকে লিখে যাব।” সেদিন রাতে চন্দ্রমল্লিকার গন্ধে ঊর্মিলা জানলার পাশে বসে রইল অনেকক্ষণ, ভাবল, হয়তো এই গোপন ভালোবাসার দিনগুলোই একদিন তাদের জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল স্মৃতি হয়ে থাকবে—যেখানে শুধু কুয়াশা নয়, শব্দ, নীরবতা আর অপেক্ষার মধ্যেই ভালোবাসা গাঁথা থাকবে।

দুই সপ্তাহ ধরে ঊর্মিলা স্কুলে আসেনি। প্রথমদিকে ভাবা গিয়েছিল হয়তো সর্দি-জ্বর কিংবা ঘরোয়া কোনো সমস্যা, কিন্তু এক সপ্তাহ গড়াতেই সহপাঠীদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়। নিলয় চুপচাপ ছিল, তবে তার চোখের নিচের কালি, ক্লাসে অমনোযোগী থাকা, মাঝেমাঝে হঠাৎ করেই একা মাঠে গিয়ে বসে পড়া—সবই তার ভেতরের অস্থিরতার প্রমাণ দিচ্ছিল। স্কুলের বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তার চোখ মাঝে মাঝে ক্লাস এইটের পাশের ঘরটার দিকে চলে যেত, যেখানে কোন এক সময়ে তারা বসে একসাথে টিফিন খেত, গানের খাতায় লাইন লিখত, কিংবা দু’জনের অগোচরে একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসত। এখন শুধু ফাঁকা বেঞ্চ আর মেঝেতে পড়ে থাকা কাগজের ঠুনকো শব্দ। একটা বিকেলে, স্কুল ছুটির পর নিলয় সাহস করে সাইকেলে চেপে বসে ঊর্মিলাদের পাড়ার দিকে রওনা দেয়, যদিও তার মনে তীব্র দ্বন্দ্ব চলছিল—এটা কি উচিত হবে?

বর্ধমান শহরের সেই পুরনো গলিটা দিয়ে সাইকেল নিয়ে ঢোকার সময় তার বুক ধুকপুক করছিল। ঊর্মিলাদের দুইতলা ছাইরঙা বাড়িটার সামনে এসে থেমে গেল সে। একটা কুয়াশা ঢেকে রেখেছে যেনো চারপাশের সব আলো-আঁধারিকে। গেটটা বন্ধ, কিন্তু তালা নেই। ভেতরে ঢুকে নিচের বারান্দায় দেখা গেল ঝাঁপসা আলো জ্বলছে। সাহস করে কলিং বেল টিপতেই ওপাশ থেকে কে যেন বলল, “কে?”—নিলয় উত্তর দেয়, “আন্টি, আমি নিলয়… ক্লাসমেট। ঊর্মিলার খবর জানতে চেয়েছিলাম…” কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর দরজাটা খোলে। চোখেমুখে ক্লান্তি আর অভিমান মিশিয়ে দাঁড়িয়ে ঊর্মিলার মা। তিনি জানালেন, ঊর্মিলার শরীর খারাপ, মানসিক চাপের কারণে সে কিছুদিন কাউকে দেখতে চায় না। নিলয় মাথা নিচু করে চলে আসে, কিন্তু যাওয়ার সময় একটুখানি ফিসফিস করে বলে, “বলবেন আমি এসেছিলাম, খুব চিন্তায় আছি।”

পরের দিন হঠাৎ করেই ঊর্মিলা একরাশ নীরবতা নিয়ে ক্লাসে ফিরে আসে। সে আর আগের মতো নয়—চোখের নিচে ক্লান্তির ছাপ, চুল এলোমেলো, আর কথার মধ্যে সেই সুরটা হারিয়ে গেছে। কিন্তু নিলয়ের দিকে তাকালে এখনো যেন একটুখানি কোমলতা ভেসে ওঠে। টিফিনে সে কারো সঙ্গে খায় না, ব্যাগে থাকে একটি মাত্র বই, আর ক্লাস শেষে সে একা হেঁটে বাড়ি ফেরে। একদিন ফাঁকা লাইব্রেরির কোনে নিলয় সাহস করে বলল, “আমি জানি আমার জন্যই তুমি এত কষ্টে… আমি চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলিনি। শুধু ভয় পেয়ে গেছিলাম।” ঊর্মিলা চোখ তুলে তাকাল, মুখে কিছু বলল না, কিন্তু তার চোখে যে যন্ত্রণার জল জমে ছিল, সেটা এক ফোঁটা হয়ে গড়িয়ে পড়ল তার গাল বেয়ে। সেই মুহূর্তে নিলয়ের হৃদয় ভেঙে গেল—সে বুঝল, প্রায়শ্চিত্ত কেবল ক্ষমা চেয়ে নয়, প্রেমটাকে নতুন করে আগলে রাখার মাধ্যমেই হতে পারে।

এরপর দিনগুলো একটু একটু করে বদলাতে লাগল। শীত পড়তে শুরু করল, মাঠে চন্দ্রমল্লিকা ফুটতে শুরু করল, আর শহরের বাতাসে ভেসে এল উৎসবের গন্ধ। স্কুলে একদিন ঘোষণা এলো—শেষ বছরের সাহিত্য প্রতিযোগিতা হবে, আর এবার প্রধান থিম: ‘অপ্রকাশিত ভালোবাসা’। নাম লেখাল ঊর্মিলা আর নিলয় দু’জনেই, আলাদা আলাদা। কেউ কাউকে কিছু বলল না, কিন্তু লেখার মাধ্যমে এক অদৃশ্য আলোচনার শুরু হলো যেন। প্রতিটি বাক্যে, প্রতিটি কবিতায় তারা একে অপরকে খুঁজে পেল—কুয়াশার আড়াল, গোপন চিঠি, হারিয়ে যাওয়া বিকেল, এবং একরাশ অপেক্ষা। এক সন্ধ্যায় স্কুলের পুরনো অডিটোরিয়ামে যখন দুইটি লেখা একে অপরের বিপরীতে পড়া হল, সবাই স্তব্ধ হয়ে শুনল। দুজনেই পুরস্কার পেল না, কিন্তু ফিরে পেল নিজেদের হৃদয়ভরা অনুভবের সেই চাবিকাঠি—চুপচাপ ভালোবাসার, বিনা শব্দে ক্ষমা চাওয়ার, আর নিঃশব্দে আবার ফিরে আসার দিনগুলির।

শীতের ছোঁয়ায় ভেজা সেই সকালের বাতাসে ঊর্মিলার কাঁধে নেমে এসেছিল ক্লান্তি আর উত্তেজনার এক অদ্ভুত মিশেল। এক মাসের মধ্যে স্কুলের বিদায় ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা—একসাথে দুটো বিদায় যেন ধেয়ে আসছিল তার দিকে। ক্লাসে পড়াশোনার চাপ, টিউশনের ব্যস্ততা, আর তার মাঝেই নিলয়ের সঙ্গে চিঠির যোগাযোগে যেন একটা অদৃশ্য সুতোয় গাঁথা ছিল সে। সকালে স্কুলে ঢুকেই আজ সে লক্ষ্য করল, মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে নিলয়, জানলার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে রইল সে কিছুক্ষণ, তারপর ধীরে ধীরে হেঁটে গেল নীল কাঁথার মত আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছেলেটির কাছে। নিলয় হাতে ধরিয়ে দিল একটি ছোট খামে মোড়া চিঠি, খামে শুধু একটা ছবি আঁকা — দুটো চন্দ্রমল্লিকা পাশাপাশি। না কোনো শব্দ, না কোনো নাম — কিন্তু তাতেই সমস্ত অনুভব যেন প্রাণ পেয়েছিল।

ঊর্মিলা সেই চিঠিটি খুলল বসন্তের প্রজাপতির মত নরম স্পর্শে, আর এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলল। “এইসব দিন আর আসবে না, জানিস তো? তুই হয়তো শহরের বাইরে পড়তে যাবি, আমি হয়তো অন্য শহরে, কিন্তু আমি চাই, আমাদের এই মুহূর্তগুলো যেন অক্ষয় থেকে যায়। তুই যদি কখনো ভুলে যাস, আমি ঠিক মনে রাখব এই জানালার পাশে দাঁড়িয়ে তোর তাকানো, এই গাছের তলায় দাঁড়িয়ে প্রথম হাত ধরা, আর এই কুয়াশা ভেজা সকালের হাসি।” — এই কয়েকটি লাইনে যেন ঊর্মিলার বুক ভরে উঠল আনন্দে, ভয়েও। ভয়ের কারণ, এই চিঠি হয়তো কারও হাতে পড়ে যাবে, অথবা হয়তো এই প্রেমের রঙ আর স্থায়ী হবে না পরীক্ষা আর বিদায়ের চাপে। কিন্তু সে ঠিক করল, অন্তত বিদায় পর্যন্ত সে এই ভালবাসাকে ধরে রাখবে বুকের কাছে।

পরবর্তী দিনগুলোয় কেবল পড়াশোনা আর পরীক্ষার প্রস্তুতি নয়, ছিল প্রচুর আবেগের দোলাচল। স্কুলে শেষ দিনগুলোতে বন্ধুদের হাসিঠাট্টা, বিদায়ী অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি, প্রিয় শিক্ষকদের চোখের জল — সব কিছু যেন বুকে ছাপ ফেলে যাচ্ছিল। বিদায়ী অনুষ্ঠানের দিন ঊর্মিলা সেজেছিল সাদা-নীল শাড়িতে, চুলে একটা ছোট্ট চন্দ্রমল্লিকা গুঁজে দিয়েছিল বন্ধু সোনালী। অনুষ্ঠান শেষের পর শিক্ষকদের আশীর্বাদ নিয়ে, ছবি তুলে, যখন সবাই একে একে স্কুলের বাইরে চলে যাচ্ছিল, তখন নিলয় এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল, “তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব, একবার চলবি?” ঊর্মিলা কিছু না বলে হাঁটতে লাগল তার সঙ্গে। তারা পৌঁছল স্কুলের পেছনের পুরোনো লেবু গাছটার কাছে, যেটা তাদের ‘গোপন ঠিকানা’ হয়ে উঠেছিল এতদিনে।

সেখানে দাঁড়িয়ে নিলয় পকেট থেকে বার করল একটি ছোট্ট কাগজের বাক্স। খুলতেই ঊর্মিলার চোখ ছানাবড়া—ভেতরে শুকনো চন্দ্রমল্লিকার পাঁপড়ি আর তাদের প্রতিটি চিঠির কপি যত্ন করে গুঁজে রাখা। “যদি ভবিষ্যতে আমরা দূরে যাই, যদি তুই আমাকে ভুলে যাস, আমি চাই না এই চিঠিগুলো ভুলে যাস। এরা সাক্ষী থাক আমাদের দিনগুলোর। যদি তোকে কোনোদিন খুঁজে না পাই, তাহলে এই বাক্সটা দেখেই বুঝে নিস—আমি ছিলাম, আমি আছি।” — নিলয়ের কণ্ঠে কম্পন। ঊর্মিলা একটুও কথা না বলে তার হাত ধরল — শুধু শক্ত করে। সময় যেন সেখানে থেমে গিয়েছিল, কুয়াশার চাদরে মোড়া সেই বিকেলে চন্দ্রমল্লিকার দিনগুলো যেন চিরতরে গেঁথে গেল তাদের দুজনের হৃদয়ে।

শীতের সেই সকালটা ছিল অন্যরকম। শহরের কুয়াশা একটু একটু করে সরে যাচ্ছিল সূর্যের কোমল আলোয়। বর্ধমান রেলস্টেশন থেকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত ছায়াপথের গাছগুলো যেন সেই আলোয় ধুয়ে নিচ্ছিল তাদের পুরোনো ধুলো। ঊর্মিলা স্কুলে যাওয়ার বদলে এদিন একাই বেরিয়ে পড়েছিল এক অজানা ঠিকানার সন্ধানে — যেখানে সে শুনেছিল নীলয় তার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে বসে কবিতা লেখে, গান গায়। নামটাই ছিল আশ্চর্য— “নীলঘর”, এক পুরনো কাঠের বাড়ি শহরের প্রান্তে, যার দেয়ালে সব সময় হালকা নীল রঙের পাটিনার মতো আবেশ জড়িয়ে থাকে। বহুদিন ধরে চিঠিপত্র, খোলা ডায়েরি আর কবিতা আদানপ্রদান হলেও তারা কখনোই এমন প্রকাশ্যে কোথাও একসঙ্গে দেখা করেনি। ঊর্মিলার মনে হঠাৎ এক টান উঠেছিল — সে দেখতে চেয়েছিল, শুনতে চেয়েছিল, নীলয় তার অনুপস্থিতিতে কেমন করে নিজের দুনিয়া সাজায়। এই কৌতূহল, অভিমান আর অপেক্ষার মধ্যে লুকিয়ে ছিল প্রথম ভালোবাসার সেই না-বলা তৃষ্ণা।

নীলঘরে পৌঁছে কিছুটা সময় দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল ঊর্মিলা। ভিতরে থেকে ভেসে আসছিল গানের আওয়াজ, যেন রবীন্দ্রসংগীতের কোন নির্যাস ঠেকছে মনের ভেতরকার অন্ধকার কোনায়। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখে নিল — নীলয় মৃদু হেসে তবলায় হাত রাখছে, পাশে সায়ন্তন কবিতা পড়ছে, আর পিছনের বেঞ্চিতে বসে থাকা মেয়েটা, নাম নন্দিনী, ঠোঁটে এক চঞ্চল উৎসাহ নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ঊর্মিলার বুকের ভিতর যেন হঠাৎ কিছুটা চাপ পড়ল। সে জানত, নীলয় হয়তো সেইরকম মেয়ে নয় যে মুখ লুকিয়ে রাখে বা পালিয়ে যায়, কিন্তু এই দৃশ্য তার ভিতরের এক নিঃশব্দ ভয়কে জাগিয়ে তুলল। নিজের অজান্তেই সে পেছন ফিরে হাঁটা দিল, আর তখনই দরজা খুলে গেল। নীলয়, যেন বহুদিনের চেনা অপেক্ষার মধ্যে পড়ে, তার নামটা হালকাভাবে বলল — “ঊর্মিলা?” সেই ডাকে যে কি ছিল, ব্যাখ্যা করা যায় না। প্রেম, আশ্চর্যতা না অনুশোচনা — কে জানে!

সেই দিন বিকেলে তারা হাঁটছিল ঘাসে ঢাকা পুরোনো কলেজ মাঠে, যেখানে এখন আর কেউ পড়াশোনা করে না — শুধু হাঁস আর ঘুড়িরা খেলা করে। দু’জনে নীরবে বসে ছিল এক দীর্ঘ সময়, যেন শব্দগুলো আর মুখ খুলতে চাইছিল না। ঊর্মিলা বলল, “তুমি চিঠিতে অনেক কথা লেখো, কিন্তু সামনে এসে সব চুপ করে যাও কেন?” নীলয় তাকিয়ে ছিল আকাশে, বলল, “কারণ চিঠিতে আমি নিজেকে দেখতে পাই, কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে আমি নিজেকেই হারিয়ে ফেলি।” এই এক লাইনেই যেন ঊর্মিলা বুঝে নিল, সে কেন এতদিন এই ছেলেটিকে নিয়ে ভাবতে থাকে। কুয়াশার ভেতর সেই বর্ধমানের ধূলিধূসর সন্ধ্যায়, তাদের চোখের ভাষায় লেখা হল একটি নতুন অধ্যায় — যা উচ্চারণের প্রয়োজন পড়ে না, শুধু উপলব্ধির গভীরতায় জন্ম নেয়।

পরদিন স্কুলে ইংরেজির ক্লাসে মিসেস ঘোষাল একটা প্রবন্ধ পড়তে দিলেন — “My Last Evening Before the Board Exams”। সবাই লিখল পড়াশোনার চাপ আর ক্লাস টেস্টের কথা, কিন্তু ঊর্মিলা লিখেছিল — “That evening I learnt the language of silences, where words fail, and only eyes speak.” শিক্ষকতা জীবনে অনেক প্রবন্ধ পড়েছেন ঘোষালদেবী, কিন্তু এই লেখাটা পড়ে তিনি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। কী গভীর অনুভব, কী অসমাপ্ত অথচ সম্পূর্ণ প্রেম! আর এদিকে, নীলয় তার ডায়েরিতে লিখছিল — “আজ যদি তাকে একবারও ছুঁতে পারতাম, হয়তো কুয়াশার মতো হালকা হতাম আমি — নিঃশব্দ, নির্ভার, নিখুঁত।” স্কুলের পড়াশোনা, পরীক্ষার প্রেশার, স্যারদের তিরস্কার — সবকিছু পেরিয়ে এক নিস্তব্ধ প্রেম ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল, যা বাইরে থেকে বোঝা যায় না, কেবল অনুভবেই ধরা পড়ে।

হেমন্তের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে বর্ধমানের আকাশ যেন অভিমানী হয়ে উঠেছিল। পাতাঝরা বিকেলগুলো দিন দিন বেশি নিস্তব্ধ আর বিষণ্ণ হয়ে উঠছিল। স্কুলের শেষ দিনের আগে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অদ্ভুত এক আবেগ ঘোরাফেরা করছিল—কেউ ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর, কেউ আবার অতীতকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছিল। নীলয় সেই দিন স্কুলে আসতে কিছুটা দেরি করেছিল। কাঁধে ব্যাগ, চোখে অব্যক্ত ক্লান্তি, আর পকেটের ভাঁজে ঊর্মিলার শেষ চিঠি। ছাদের ধারে দাঁড়িয়ে সে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল—তারা কি আজও সেই পুরোনো সময়টায় ফিরে যেতে পারত? যেখানে ঊর্মিলার খামে ভরা অক্ষর আর নীলয়ের কবিতার খাতা ছিল তাদের ভালোবাসার একমাত্র সাক্ষী? এখন তারা একে অপরকে ভালোবাসে বলেই কি দূরে যেতে হচ্ছে? নীলয় ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না।

ঊর্মিলা আজ সাদা সালোয়ার পরে এসেছিল—চোখের নিচে ঘুমহীন রাতের ছাপ, তবু ঠোঁটে এক গম্ভীর শান্তি। সে জানত, আজকের পর হয়তো তারা প্রতিদিন দেখা করবে না, একসাথে রিকশায় বাড়ি ফেরা হবে না, কিংবা শীতের সকালের কুয়াশার ভিতরে দাঁড়িয়ে একে অপরের অপেক্ষা করার সেই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোও আর ফিরে আসবে না। সে তাই নীলয়ের সঙ্গে শেষবারের মতো স্কুল ছাদে দেখা করার কথা ঠিক করেছিল। দুজনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থেকেও যেন একে অপরের চোখে মুখ লুকিয়ে রেখেছিল। বহু কথা বলার ছিল, কিন্তু সে কথাগুলো যেন কণ্ঠে এসে জমে গিয়েছিল। নীলয় চিঠিটা বের করে ঊর্মিলার হাতে দেয়। চিঠিতে লেখা ছিল—”ভালোবাসার মানে তোমার সঙ্গে হেঁটে যাওয়া নয়, মাঝে মাঝে দূরে দাঁড়িয়ে তোমার স্বপ্নগুলোকে উড়তে দেখা।”

ঊর্মিলা ধীরে ধীরে চিঠিটা ভাঁজ করে রাখে, চোখ নামিয়ে বলে, “তুই তো বড় হবি, অনেক বড়। শহরের বাইরে যাবি, নাম করবি। আমি হয়তো এখানেই থেকে যাব—এই স্কুল, এই লাইব্রেরি, এই বর্ধমান শহরটাতে। কিন্তু আমাদের ভালোবাসাটা তো এখানেই থেকে যাবে, তাই না?” নীলয় কিছু বলে না। সে শুধু এক পা এগিয়ে এসে ঊর্মিলার হাতে হাত রাখে—হাতটা খুব ঠান্ডা, কিন্তু মুঠোটা দৃঢ়। দুজনেই জানত, এই বিদায়টাই তাদের প্রথম যৌবনের সবচেয়ে নিরব চিৎকার। তারা একে অপরকে কথা দিয়েছিল, লিখবে, পড়বে, অপেক্ষা করবে—যতদিন না জীবন তাদের নতুন গল্পের পাতায় নিয়ে যায়। সেই মুহূর্তে ছাদে কুয়াশার ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা দুটো কিশোর হৃদয় যেন সমস্ত গোধূলিকে ছুঁয়ে একটা ছোট্ট চুম্বনে মুখর করেছিল।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। স্কুল প্রাঙ্গণে ছেলেমেয়েরা ক্যামেরায় স্মৃতি ধরছে, শিক্ষক-শিক্ষিকারা বিদায়ের কথা বলছেন। নীলয় আর ঊর্মিলা সবার ভিড় থেকে সরে গিয়ে সেই পুরনো লাইব্রেরির জানালার ধারে কিছুক্ষণ চুপ করে বসেছিল। জীবনের প্রথম প্রেম, প্রথম পত্র, প্রথম ছোঁয়া—সবটাই কি এত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়? না, ফুরায় না। তারা বিদায় নেয়নি, শুধু একটু দূরে সরে দাঁড়িয়েছিল। অনেকদিন পরে, হয়তো কোনো হেমন্তের দুপুরে বা মাঘের ভোরে, তারা আবার মিলবে এই স্কুল প্রাঙ্গণের কোনো কোণে, হয়তো তখন চুলে রুপালি রেখা থাকবে, চোখে জীবনের ক্লান্তি, কিন্তু হৃদয়ের সেই চন্দ্রমল্লিকাগুলো ঠিক তখনও অটুট থাকবে। কারণ কোনো কোনো ভালোবাসা শেষ হয় না, শুধু বদলে যায় তার রঙ, ছন্দ আর সুর।

***

1000045418.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *