Bangla - ভূতের গল্প

চন্দ্রবিলের ডাক

Spread the love

সিঞ্জিনী চক্রবর্তী


আগমন

নদিয়ার চন্দ্রপুর গ্রামটা সময়ের দিক থেকে যেন অনেকটাই পিছিয়ে ছিল। শহরের তুলনায় এখানে সময় যেন একটু ধীরে চলে। দিনগুলো এখানে বড় শান্ত, নিঃসঙ্গ; সন্ধ্যা নামতেই ঘরবাড়ির দরজা জানলা বন্ধ হয়ে যায়, কুকুরের ডাকে চমকে ওঠে মানুষ।

গ্রামটা যেন নিজেই একটা দীর্ঘশ্বাস। পাকা রাস্তা নেই, মোবাইল টাওয়ারের সংকেত আসে-যায়। চায়ের দোকানে বিকেলের আড্ডাও যেন কেমন নিরুত্তাপ। আর সন্ধ্যে নামলেই চারপাশে এমন এক নীরবতা নামে, যেন শব্দ করাটাই পাপ।

এই চন্দ্রপুর গ্রামেই আসে রক্তিম সেন—কলকাতার যুবক, ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের ছাত্র। সে আসছে তার মামাবাড়িতে, গরমের ছুটির জন্য। পুরনো দিনের মতো চিঠি বা ফোন করে নয়, হঠাৎ করেই একদিন চেপে বসে ট্রেনে। শহরের কোলাহল, ব্রেকিং নিউজ আর ক্যাফের কড়া কফির গন্ধ থেকে দূরে যেতে মন চাইছিল তার।

মামাবাড়ি, মানে একতলা মাটির বাড়ি, উঠোনে একটা নারকেল গাছ, ঘরের কোণে কাঠের আলমারি, আর ছাদের উপর শুকনো নিমপাতার ঢিপি। রক্তিমের ছোটবেলার বহু স্মৃতি গাঁথা এই বাড়ির প্রতিটি ইটের ফাঁকে ফাঁকে।

রক্তিম যেদিন পৌঁছায়, সেই দিনটা ছিল আমসত্ত্ব তৈরির দিন। মামিমা পাটায় আম থেঁতো করছেন, মাটির হাঁড়িতে রোদে দিচ্ছেন। মামা তখন ধান খেতে গেছেন।

বিকেলে মামাবাড়ির উঠোনে বসে মামার সঙ্গে গল্প করছিল রক্তিম। মামা বললেন, “এই গ্রামে আর মানুষ নেই রে রক্তিম। যারা আছে, তারা শুধু বেঁচে আছে। ওই বিলটা না, চন্দ্রবিল, ওটাই গিলে নিয়েছে অনেককেই।”

রক্তিম চমকে উঠে বলল, “চন্দ্রবিল? সেটা কী?”

মামা গম্ভীর মুখে বললেন, “ওই বিলটা একটা অভিশাপ। সন্ধ্যার পর কেউ ওদিকে যায় না। যেকেউ গেলে ফেরে না, কিংবা ফিরে এলেও ঠিকমতো থাকে না।”

গ্রামের আরও কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হলে বোঝা গেল, চন্দ্রবিল নিয়ে একটা অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আছে। দিনের বেলা কেউ ওদিকে যায় ধান কাটতে, কচুর লতি তুলতে। কিন্তু সূর্য ডুবার আগে সব কাজ সেরে সবাই বাড়ি ফিরে আসে। কেউ কখনো সন্ধ্যার পরে বিলের কাছে যায় না।

রক্তিম, শহরের ছেলে, যুক্তিবাদী, ভূতের গল্পে একটুও বিশ্বাস করে না। সে হেসে বলল, “কী এমন আছে ওই বিলে? কারও খুন হয়েছে বুঝি?”

এক বৃদ্ধ বললেন, “শুধু খুন না বাবা, ওখানে আত্মা থাকে। স্বর্ণালতা নামের এক বউমা—রাজপরিবারের—সেই বিলেই ডুবে মরেছিল। বিয়ের দিনেই। গহনার জন্য। সেই থেকে তার আত্মা নাকি ঘুরে বেড়ায় বিলে। রাত হলেই তার কান্না শোনা যায়।”

রক্তিমের মনটা কেমন যেন কাঁপে উঠল। ইতিহাসের ছাত্র সে। সে জানে, প্রতিটি ভূতের গল্পের পেছনে একটা সত্যি থাকে। একটা না বলা অতীত, একটা চাপা দেওয়া অন্যায়। আর এই চন্দ্রবিলের গল্প শুনে তার আরও জানার ইচ্ছে হল। সে ঠিক করল, সন্ধ্যার পরে সে নিজে গিয়ে দেখবে সেই চন্দ্রবিল। সত্যি যদি কিছু থাকে, তবে সেটা আবিষ্কার করার দায়িত্ব ইতিহাসের ছাত্রের।

এভাবে চন্দ্রপুরে তার আগমন এক নতুন অনুসন্ধানের শুরু হয়ে দাঁড়াল।

বিলের ইতিহাস

রক্তিম ছিল সহজেই কৌতূহলী স্বভাবের। ছোটবেলা থেকেই ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে ওর ভালো লাগত, কারণ সেখানে লুকিয়ে থাকত হাজারো না বলা গল্প। ভূতের গল্পে সে বিশেষ বিশ্বাসী না হলেও, চন্দ্রবিল নিয়ে গ্রামের লোকেদের মধ্যে যে আতঙ্ক, সেটা ওকে ভাবতে বাধ্য করল। এ তো কেবল লোককথা নয়, এর মধ্যে কিছু একটা সত্য লুকিয়ে আছে—এই বিশ্বাসই ওকে এগিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করল।

পরদিন সকালে সে গিয়ে বসে গ্রামের প্রাচীন পাঠাগারে। সেখানে ধুলোমলিন কিছু পুরাতন দলিল ছিল, যেগুলো দেখে কেউ মাথা ঘামায় না। রক্তিম খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যায় এক পুরনো রাজপরিবারের বিবরণী—চন্দ্রপুর রাজপরিবার, যাদের শাসনকাল ছিল ১৭৯০ থেকে ১৮৭৫ পর্যন্ত।

সেখানে পড়তে গিয়ে রক্তিম জানতে পারে এক নারীর কথা—স্বর্ণালতা দেবী। ১৮৫৭ সালে বিয়ে হয় রাজা আনন্দনারায়ণের ছোটো ভাই মহীপালনারায়ণের সঙ্গে। কিন্তু বিয়ের রাতেই স্বর্ণালতা হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। বলা হয়, রাতে বিলের দিকে গিয়েছিলেন আর ফেরেননি। কেউ বলে, হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যান, কেউ বলে আত্মহত্যা করেন।

কিন্তু একখানা লিপিবদ্ধ ডায়েরিতে রক্তিম এমন কিছু পড়ে যা তার রক্ত হিম করে দেয়। সেখানে লেখা ছিল—

“…স্বর্ণালতার গায়ে ছিল রাজপরিবারের গহনার সেট। বিয়ের আগে থেকেই মহীপালের দুই দাদা সেই গহনার প্রতি লালায়িত ছিল। বিয়ের রাতে তারা মদের নেশায় স্বর্ণালতাকে চেপে ধরে এবং জোর করে গহনাগুলো নিতে চায়। স্বর্ণালতা প্রতিরোধ করায় তাকে তুলে নিয়ে বিলের দিকে যায় এবং…”

এরপর লেখাটা অসম্পূর্ণ। ডায়েরির পাতা ছেঁড়া। কিন্তু এতটুকুই যথেষ্ট ছিল রক্তিমের বোঝার জন্য। স্বর্ণালতার মৃত্যু ছিল দুর্ঘটনা নয়, নির্মম হত্যা।

গ্রামে ফিরে রক্তিম এই বিষয়ে কথা বলতে যায় হরেন দার সঙ্গে—এক প্রাচীন মানুষ, যিনি অনেক কিছু দেখেছেন, শুনেছেন। হরেন দা হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ, তারপর চোখ নামিয়ে বলেন, “আমার ঠাকুরদা বলতেন, স্বর্ণালতা দেবী খুব শান্ত স্বভাবের ছিলেন। বই পড়তে ভালোবাসতেন, রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন, আর গায়ের দিকে তাকালেই বোঝা যেত তিনি সাধারণ রাজপরিবারের কেউ নন, যেন অচেনা আলো ঝলমলে এক নারী। বিয়ের সময় পুরো রাজবাড়িতে উৎসব ছিল, আর বিয়ের রাতেই সব শেষ। পরদিন সকালে বিলের ধার থেকে একজোড়া কাঁকন পাওয়া যায়, আর তারপর রাজপরিবার চুপ করে যায়।”

রক্তিম এক দৃষ্টিতে হরেন দার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মনে হতে থাকে, এই ঘটনার পিছনে আরও অনেক কিছু লুকানো আছে।

রক্তিম ঠিক করল, সে শুধু থিসিসের জন্য নয়, স্বর্ণালতার আত্মার শান্তির জন্যও এই কাহিনির সত্য খুঁজে বের করবে।

তবে সত্যের খোঁজ সহজ নয়—বিশেষ করে যখন সেই সত্য জলেভেজা ভৌতিক বিলের অতল গর্ভে ঘুমিয়ে থাকে।

সন্ধ্যাবেলার সাহস

চন্দ্রপুরে আসার পর যত দিন যাচ্ছিল, রক্তিম ততটাই মগ্ন হয়ে পড়ছিল চন্দ্রবিল আর স্বর্ণালতার কাহিনিতে। দিনের পর দিন সে তথ্য সংগ্রহ করছিল, পুরাতন দলিল ঘাঁটছিল, হরেন দার মতো বয়স্কদের মুখে শোনা কথাগুলো মিলিয়ে নিচ্ছিল। কিন্তু যত কথাই শোনে, মনে হচ্ছিল সত্যটা যেন আরও গভীরে লুকিয়ে আছে—একটা স্তব্ধতা, এক অতৃপ্ত আত্মার আর্তনাদ যেন ডেকে চলেছে তাকে।

একদিন বিকেলে, সূর্য নামার কিছু আগে, সে নিজের ঘরে বসে ডায়েরিতে নোট নিচ্ছিল। হঠাৎ জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখে, চন্দ্রবিলের দিক থেকে একটা হালকা ধোঁয়া বা কুয়াশার রেখা বাতাসে মিশে যাচ্ছে। তখনই সে ঠিক করে, আজ আর অপেক্ষা নয়। আজ সন্ধ্যার পরে সে নিজেই যাবে চন্দ্রবিলে।

মামাবাড়ির সবাইকে না জানিয়ে, সন্ধ্যে ছ’টার সময় সে বেরিয়ে পড়ে। পকেটে টর্চ, সঙ্গে ডায়েরি ও পেন। হালকা জুতো পায়ে, হৃৎপিণ্ড যেন বুকে আছড়ে পড়ছে। রাস্তা ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় সে। চারপাশে পাখিরা থেমে গেছে, কুকুরের ডাক নেই, বাতাস থেমে গেছে বলেই মনে হয়।

চন্দ্রবিলের ধার ঘেঁষে পৌঁছতেই সে থেমে যায়। বিলটা নিঃসাড়, স্থির। জলে চাঁদের প্রতিচ্ছবি নেই, অথচ আকাশে আধখানা চাঁদ উঠেছে। চারপাশে একটা ঠাণ্ডা শীতলতা, বাতাস যেন জ্যান্ত, গাছের পাতাগুলো যেন ফিসফিস করে উঠছে। কাঁপা হাতে সে টর্চ জ্বালে, কিন্তু আলোটা কেমন যেন দুর্বল।

সে নিজের মনে বলল, “ভয়ের কিছু নেই। এগিয়ে চল।”

জলের ধারে পা রাখতেই একটা হিমেল হাওয়া গায়ে লাগে। অস্বস্তিকর একটা গন্ধ—জল-কাদার সঙ্গে যেন পুরনো কাপড় বা ধূপের গন্ধ মিশে আছে। আর সেই মুহূর্তেই, হঠাৎ করে তার চোখে পড়ে বিলের জলের উপর দাঁড়িয়ে থাকা এক ছায়ামূর্তি।

মূর্তিটি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে। সাদা শাড়ি, ভেজা চুল, চোখ ঢাকা পড়ে আছে এলোমেলো চুলে। দাঁড়িয়ে আছে এমনভাবে, যেন মাটি ছুঁয়েও নেই, জলেই ভেসে আছে। রক্তিমের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।

মূর্তিটি হঠাৎ মুখ তোলে। তারপর সেই কণ্ঠস্বর—একটা ঠাণ্ডা, দুধারে কাঁপানো কণ্ঠ—“তুমি এসেছো?”

রক্তিম প্রথমে কিছু বলতে পারে না। তার পা যেন মাটিতে গেঁথে গেছে। শরীর কাঁপছে, গলা শুকিয়ে গেছে। কিন্তু সে সাহস জোগাড় করে বলে ওঠে, “তুমি কে?”

নারীটি ধীরে ধীরে বলে, “আমার গহনা ফেরত দাও… আমি বিয়ের দিনেই… মারা গিয়েছিলাম… বিশ্বাসঘাতকতায়… আমি মুক্তি চাই…”

তার ঠোঁটের নিচ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল, যেন রক্ত-জল একসাথে। চোখের জায়গায় শূন্যতা। মুখটা কুয়াশার মতো অস্পষ্ট, কিন্তু ব্যথায় ভরা।

রক্তিমের মনে হল, সে যেন সেই কাহিনির স্বর্ণালতার মুখোমুখি। এই সেই আত্মা, যাকে হত্যা করা হয়েছিল। এই সেই আত্মা, যার গল্প সে এতদিন শুনে এসেছে—আজ সে বাস্তবে তার সামনে।

নারীটি আরও কাছে আসে। বাতাসের মধ্যে এক অদ্ভুত ঠাণ্ডা, যেন সময় থেমে গেছে। রক্তিম এক পা পিছিয়ে যায়। তার বুক ধকধক করছে। সে ডায়েরিটা শক্ত করে ধরে। “আমি শুধু জানতে চাই কী ঘটেছিল… আমি সাহায্য করতে চাই…”

নারীটি থেমে যায়। কয়েক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর সে ধীরে ধীরে বলে, “আমার কণ্ঠ কেউ শোনেনি… সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল… শুধু গহনার খোঁজে তারা আমার জীবনটা কেড়ে নিয়েছিল… যদি আমার কণ্ঠ তুমি লিপিবদ্ধ করো… তবে হয়তো আমি মুক্তি পাবো…”

এই বলে সে এক হাতে এগিয়ে দেয় একটি অদ্ভুত জিনিস—এক জোড়া কাঁকন। রক্তিম এগিয়ে নিতে গিয়েই দেখতে পায়, তার হাতে কিছুই নেই। আর নারীটিও ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে কুয়াশায়। জলের উপর তরঙ্গ ওঠে, যেন কেউ হেঁটে চলে যাচ্ছে দূরে…

রক্তিম আর দাঁড়াতে পারল না। বুকের মধ্যে এক অদ্ভুত চাপা যন্ত্রণা, চোখ ঝাপসা। সে দৌড়ে ফিরে আসে। পিছনে তাকিয়ে দেখে, বিলটা আবার নিঃসাড়। যেন কিছুই ঘটেনি। যেন কিছুই ছিল না।

ঘরে ফিরে এসে সে দরজা বন্ধ করে, টর্চ নিভিয়ে বিছানায় বসে পড়ে। কাঁপতে থাকা হাতে সে ডায়েরি খুলে লেখে—“আমি তাকে দেখেছি। স্বর্ণালতা সত্যি আছে। সে এখনো মুক্তি পায়নি।”

রাতটা জেগে কাটে রক্তিমের। চন্দ্রবিল তাকে ডেকেছিল। আর আজ সেই ডাকে সাড়া দিয়ে সে সত্যিকারের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই কাহিনির শেষ এখানেই নয়। বরং, এখান থেকেই শুরু…

অতীতের খোঁজ

পরদিন সকালে রক্তিমের জ্বর আসে। শরীরের গা-হাত পুড়ে যায়, কিন্তু তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে স্বর্ণালতার কণ্ঠস্বর—“আমার গহনা ফেরত দাও… আমি মুক্তি চাই…”

মামি বারবার গায়ে জলপট্টি দিচ্ছেন, মামা ডাক্তার ডেকে এনেছেন, কিন্তু রক্তিমের চোখে যেন কুয়াশা জমে। সে ঘুমের ঘোরে প্রলাপ বকতে থাকে—“বিল… গহনা… স্বর্ণালতা…”

ডাক্তার বললেন, “ছেলেটা সম্ভবত খুব চাপের মধ্যে ছিল। বিশ্রাম দরকার।”—কিন্তু রক্তিম জানে, এটা কেবল শারীরিক ক্লান্তি নয়। এটা মানসিক ধাক্কা। সে যেন চোখের সামনে একটা অতৃপ্ত অতীতকে ছুঁয়ে এসেছে।

তিন দিন পরে জ্বর কমে আসে। শরীরটা দুর্বল, কিন্তু মনটা ব্যাকুল। সে উঠে বসে ডায়েরিটা নেয়, স্বর্ণালতার বর্ণনা লিখে রাখে। তারপর মাথায় আসে একটা ভাবনা—এই তো ইতিহাস, এই তো থিসিসের জন্য প্রকৃত উপাদান! কিন্তু এসব শুধু গুজব নয়, রক্তিম প্রমাণ চায়। আর সেটা পেতে গেলে চাই তথ্য, দলিল, নথি।

সে যোগাযোগ করে চন্দ্রপুর রাজপরিবারের পুরনো ভৃত্য বনমালী কাকুর সঙ্গে। কাকু প্রথমে কিছু বলতে চান না, কিন্তু রক্তিম যখন স্বর্ণালতার নাম করে, তখন থমকে যান।

“তুই কোথা থেকে এই নাম জানলি?”

রক্তিম ধীরে ধীরে বলে, “সে আমার সঙ্গে কথা বলেছে… আমি তাকে দেখেছি।”

বনমালী কাকু মুখ নিচু করে বলেন, “তাহলে সে এখনো শান্তি পায়নি…”

তারপর ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে পুরনো ইতিহাস—১৮৫৭ সালে চন্দ্রপুর রাজবংশের কনিষ্ঠ রাজপুত্রের বিয়ে হয়েছিল দূরের এক জমিদার ঘরের মেয়ের সঙ্গে। নাম—স্বর্ণালতা। মেয়েটি সরল, শিক্ষিতা ও খুব সুন্দরী ছিল। কিন্তু রাজপ্রাসাদে আসার পর থেকেই একটা অদ্ভুত দূরত্ব তৈরি হয়। রাজপুত্রের বড় দুই ভাই সেই বিয়েতে খুশি ছিল না। কেননা, স্বর্ণালতার সঙ্গে এনেছিল তাদের মাতৃহার, কঙ্কণ ও এক বংশের গুপ্ত নীলপাথরের গয়না। সেই গয়নার ওপর লোভ ছিল ভাইদের।

বিয়ের রাতে হঠাৎ করে ঘোষণা হয়, নববধূ গায়ে জল ঢেলে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু কেউ কিছু স্পষ্ট বলেনি। মরদেহ পাওয়া যায় চন্দ্রবিলে। রাজপরিবার বিষয়টি ধামাচাপা দেয়। পরে সেই দুই ভাই-ই বংশের সম্পত্তি ভাগ করে নিয়ে রাজ্য ছেড়ে দেয়। আর বিল? তখন থেকেই বিল হয়ে ওঠে ‘অশুভ’। বহু বছর ধরে আশেপাশের মানুষজন বলে, সন্ধ্যার পর বিলের ধারে গিয়ে কেউ আর ফেরেনি। কেউ পাগল হয়েছে, কেউ নিখোঁজ।

রক্তিম বনমালীর কাছ থেকে সংগ্রহ করে পুরনো নথি। ধুলো জমে থাকা সেই পাতায় খুঁজে পায় বিবাহের তালিকা, স্বর্ণালতার নাম, তাঁর মৃত্যুর তারিখ। আরও মেলে একটি পরিত্যক্ত তদন্ত রিপোর্ট, যেখানে লেখা ছিল—“শরীরে জলের চিহ্ন থাকলেও আঘাতের চিহ্ন আছে ঘাড়ে ও কবজিতে।” কিন্তু রিপোর্টটি পরবর্তী তদন্তে ‘অপ্রয়োজনীয়’ বলে খারিজ করে দেওয়া হয়েছিল।

রক্তিমের রক্ত যেন ফুটে উঠল। সত্য এত বছর ধরে চাপা পড়ে আছে!

সে জানে, শুধু লেখার মধ্যে এই ইতিহাস আটকে রাখা যাবে না। স্বর্ণালতার আত্মা তাকে যে বার্তা দিয়েছে, সেটার মধ্যে কোনো গুপ্ত সংকেত আছে। সে বারবার মনে করতে থাকে সেই দৃশ্য—ছায়ামূর্তি, ঠোঁট থেকে পড়া জল, সেই কণ্ঠ—“গহনা ফেরত দাও… আমি মুক্তি চাই…”

তার মনে হয়, সেই গহনা এখনো কোথাও আছে। যদি সেই গহনাগুলো পাওয়া যায়, যদি সে সেগুলো ফেরত দিতে পারে—তবে হয়তো স্বর্ণালতা শান্তি পাবে। সে ভাবে, হয়তো বিলের গভীরে, যেখানে দেহটি ডুবে ছিল, সেখানে কিছু লুকানো আছে।

এই চিন্তা মাথায় নিয়েই সে ঠিক করে, সে আবার যাবে চন্দ্রবিলের ধারে। কিন্তু এবার সে শুধু দর্শক হয়ে যাবে না। এবার সে নামবে জলে, ঢুকে দেখবে—সত্য কোথায় লুকিয়ে আছে।

তারপর সে ব্যাগে গুছিয়ে রাখে জলরোধী টর্চ, মোটা দড়ি, নোটবুক, ছোট ক্যামেরা। আর সঙ্গে রাখে পুরনো নথিগুলো। তার মনে একটাই কথা—“স্বর্ণালতা, আমি তোমার মুক্তির পথ খুঁজে বের করব।”

বাইরে তখন আবার সন্ধ্যা নেমে এসেছে। বাতাসে সেই চেনা শীতলতা। কিন্তু এবার রক্তিম ভয় পাচ্ছে না। এবার তার মধ্যে সাহস, আগ্রহ আর একটা গভীর বেদনার টান—একটা আত্মার শান্তি এনে দেওয়ার মিশন।

চন্দ্রবিল তাকে আবার ডাকছে। এবার সেই ডাকে সে ফিরে তাকাচ্ছে না, বরং এগিয়ে যাচ্ছে সত্যের মুখোমুখি হতে।

অন্ধকারে ডুব

রাত্রি। ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে এগারোটা। রক্তিমের বুক ধুকপুক করছে, তবু সে দ্বিধা না করে ব্যাগটা কাঁধে ফেলে হাঁটতে শুরু করে বিলের দিকে। আজ সে প্রস্তুত—সাঁতার পোশাক, জলরোধী টর্চ, মোটা দড়ি, জলের নিচে ছবি তোলার ক্যামেরা। আজ সে শুধু দেখবে না, সে খুঁজবে।

চন্দ্রবিল যেন কুয়াশার চাদরে মোড়া। চারদিকে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, মাঝে মাঝে ব্যাঙের ডাক, অচেনা কোনো পাখির ডাক—সেই সব শব্দ যেন বুকে কাঁপুনি ধরায়। জলটা নিঃশ্বাস নিচ্ছে—ধীরে, গভীরভাবে। মনে হয়, কেউ যেন বিলটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে তার নিজের দেহ দিয়ে।

রক্তিম ধীরে ধীরে জামা-কাপড় খুলে ফেলে, শরীরে সাঁতার পোশাক। ব্যাগ থেকে বের করে জলরোধী টর্চ আর দড়িটা কোমরে বেঁধে। তারপর সে বসে পড়ে বিলের ধারে, একবার চোখ বন্ধ করে। তার মনে পড়ে যায় সেই শব্দ—স্বর্ণালতার ভেসে আসা কণ্ঠ—“আমার গহনা ফেরত দাও… আমি মুক্তি চাই…”

সে মাথা নাড়ে। এবার আর শুধু শোনার জন্য নয়, সে এসেছে সত্যকে ছুঁতে। তারপর সে জলে নামল। প্রথমে ঠাণ্ডা জলে শিরদাঁড়া বেয়ে কাঁপুনি উঠল, কিন্তু কিছুক্ষণ পর সে অভ্যস্ত হয়ে গেল।

জলের নিচে ঢুকতেই সে টর্চটা জ্বালায়। আলো ছড়িয়ে পড়ে এক অদ্ভুত জগতে—পানির নিচে একটা রহস্যময়, প্রায় অতিপ্রাকৃত শূন্যতা। জলের কণাগুলো আলোয় কাঁপছে, যেন হাজার হাজার ছোট্ট চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে।

সে ধীরে ধীরে ডুবতে থাকে। পনেরো ফুট, বিশ ফুট… আর তখনই কিছু একটা চকচক করে তার চোখে পড়ে। সে কাছে গিয়ে দেখে, একটা ছোট কাঠের সিন্দুক। চারদিকে শ্যাওলা জমে গেছে, ধুলোময়লা, তবুও সিন্দুকের কাঠামোটা স্পষ্ট। এটা একটা পুরনো রাজবাড়ির ধনরত্ন রাখার সিন্দুক—রক্তিম ইতিহাসের বইতে এমন সিন্দুকের ছবিই দেখেছে।

সে হাত বাড়িয়ে সেটাকে তুলতে যায়, ঠিক তখনই তার কাঁধে পড়ে এক ঠান্ডা, শীতল, জলভেজা হাত।

সে কাঁপতে কাঁপতে ঘুরে তাকায়। কিছুই নেই! কিন্তু তার কানের ঠিক পাশেই কেউ ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে—

“তুইও আমাকে ফাঁকি দিবি?”

সেই কণ্ঠস্বর। স্বর্ণালতা!

জলের নিচেই যেন চারদিক থেকে আওয়াজ আসছে। সে হাত কাঁপতে কাঁপতে সিন্দুকটা আঁকড়ে ধরে। বুক ধুকপুক করছে, চোখ অন্ধকার। সে টেনে সিন্দুকটা নিয়ে ওপরে উঠতে শুরু করে।

উঠতে উঠতে চারপাশে অদ্ভুতভাবে আলো ফিকে হতে থাকে, জল যেন ভারি হয়ে আসে। একটা ছায়ামূর্তি তার পেছন পেছন আসছে কি না, সে বুঝতে পারে না। কিন্তু সে জানে—আজ তাকে ফিরে যেতেই হবে। যেকোনো মূল্যে।

শেষমেশ জলের উপরে উঠতেই চারপাশ কেমন যেন বদলে গেছে। বাতাস স্তব্ধ, গাছ অচঞ্চল, পোকামাকড়ের আওয়াজও নেই। যেন সময় থেমে গেছে। তার হাতে কাঠের সিন্দুক, ভারী ও আর্দ্র। সে ঘাটে উঠে আসে। বাতাসে তখনও কাঁপন আছে, মনে হয়, স্বর্ণালতার দৃষ্টি যেন এখনও তাকে অনুসরণ করছে।

সে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির দিকে ফিরে আসে। চারদিকে নিঃস্তব্ধতা। মনে হচ্ছে, গ্রামের সমস্ত মানুষ ঘুমিয়ে নেই—বরং জেগে আছে, নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

ঘরে ঢুকে সে সিন্দুকটা বিছানার পাশে রেখে বসে পড়ে। চোখে ঘুম নেই, মনে শুধু একটাই প্রশ্ন—এই সিন্দুকে কি সত্যিই আছে সেই ইতিহাস, সেই যন্ত্রণা, সেই স্বপ্ন, যা এতদিন ধরে চন্দ্রবিলের জলে হারিয়ে ছিল?

সে জানে, আগামী রাত হবে সিদ্ধান্তের রাত। কিন্তু আজ… আজ শুধু রক্তিম চুপচাপ বসে থাকে, কানের মধ্যে বাজতে থাকে সেই কণ্ঠ—

“তুইও আমাকে ফাঁকি দিবি না তো?”

গহনার খোঁজ

রাত্রি প্রায় দেড়টা। বাড়ির সবাই ঘুমোচ্ছে। চারপাশে নিস্তব্ধতা, শুধু মাঝে মাঝে কুকুরের হালকা ঘেউ ঘেউ। রক্তিম একা বসে টেবিলের সামনে, কাঠের সিন্দুকটা তার চোখের সামনে পড়ে আছে।

টেবিল ল্যাম্পের আলোটা সে একটু বাড়িয়ে দেয়, তারপর ধীরে ধীরে খুলে ফেলে সিন্দুকের ঢাকনা। সঙ্গে সঙ্গে একরাশ পুরনো সোঁদা গন্ধ নাকে আসে—যেন কালের অন্ধকার থেকে উঠে এসেছে ধুলো জমা কোনো স্মৃতি।

ভেতরের জিনিসগুলো দেখে রক্তিম স্তব্ধ হয়ে যায়। তার নিঃশ্বাস আটকে আসে মুহূর্তের জন্য।

এক জোড়া খাঁটি সোনার কাঁকন, যার গায়ে খোদাই করা আছে পদ্মফুলের নকশা, যা প্রাচীন রাজবাড়ির ঐতিহ্যের পরিচয় বহন করে। সঙ্গে এক মনিকাঞ্চন পাথর বসানো গহনাগুচ্ছ, এক রাজকীয় নেকলেস—যেটা ইতিহাসের পাতায় পড়েছে বহুবার, কিন্তু চোখে দেখা এক অভিজ্ঞতা।

আর… এক খাম, যার ভেতরে একটা পৃষ্ঠা, ধূসর কাগজে লেখা কিছু কথা। কাঁপা হাতে লেখা হলেও অক্ষরগুলো স্পষ্ট। চিঠির উপর লেখা আছে—”স্বর্ণালতা”।

চিঠির ভাষা:

“যদি কেউ এই সিন্দুক খোঁজে, বুঝে নিও সে সত্যের সন্ধানী। আমাকে কেউ বিশ্বাস করেনি, কেউ ভালোবাসেনি। আমার গায়ে শুধু ছিল বংশের ঐশ্বর্য, আমার স্বপ্ন ছিল আমার নিজের। কিন্তু তারা শুধু দেখেছে গয়না। আমি শুধু আমার স্বপ্ন নিয়ে ডুবে গেছি। যদি মুক্তি দিতে চাও, আমার কথা জানিয়ে দাও।”

রক্তিম চুপ করে বসে থাকে অনেকক্ষণ। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। কত শত বই পড়ে ইতিহাস বোঝা যায় না, কিন্তু এক ফোঁটা জল, এক গহনার ছোঁয়া, এক চিঠির আকুতি—তার চেয়েও অনেক বেশি জীবন্ত ইতিহাস রচনা করে।

এই তো ইতিহাস, এই তো না বলা কাহিনি। এ তো শুধু একটা আত্মার নয়—একটা নারী-স্বপ্নের অপমান, এক নিষ্ঠুরতার দলিল। স্বর্ণালতা শুধু কোনো কনে ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক স্বপ্নদ্রষ্টা, এক সংগ্রামী, যার কথা সময় চেপে গেছিল।

রক্তিম সিদ্ধান্ত নেয়—এই সত্য চাপা থাকবে না। কিন্তু সেটা শুধু লেখায় নয়, কাজে। তাকে এখন কিছু করতেই হবে, কিছু উৎসর্গ করতে হবে।

সে চিঠিটা আবার ভাঁজ করে রাখে। তারপর ব্যাগে করে গহনাগুলো আর চিঠিটা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। রাত তখন প্রায় দুটো। রাস্তা ফাঁকা, জোনাকি পোকার আলো মাঝে মাঝে চোখে পড়ে। মন্দিরটা গ্রামের এক প্রান্তে। ছোট্ট হলেও প্রাচীন মন্দির, তার ভিতরে রয়েছে দেবী চণ্ডীর এক প্রস্তর মূর্তি।

সে পৌঁছে পুরোহিত হরিহর বাবুর ঘরে। দরজায় ধাক্কা দেয় কয়েকবার। কিছুক্ষণ পর ঘুম জড়ানো চোখে, গামছা কাঁধে নিয়ে দরজা খোলেন হরিহর বাবু। তিনি কিছুটা বিরক্ত: “এই রাতে কী হয়েছে?”

রক্তিম কোনো কথা না বলে ব্যাগ খুলে সব কিছু তার সামনে রাখে।

হরিহর বাবু প্রথমে বিস্মিত হন। তারপর চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে থাকেন। পাঠের সঙ্গে সঙ্গে তার চোখের সামনে ইতিহাসের ধূসর চিত্র ভেসে ওঠে। তাঁর মুখে অজান্তেই চলে আসে স্তব্ধতা। চোখ ছলছল করে ওঠে। তিনি কাঁপা গলায় বলেন:

“এতো সত্যি… এত বছর পর… আমি ছোটবেলায় শুনেছি স্বর্ণালতার গল্প, কিন্তু কেউ তো প্রমাণ দেখায়নি… তুমি পেয়েছো!”

রক্তিম বলে, “এই গয়না আপনি এখানে রাখুন। ওর কথা প্রচার করুন। জানিয়ে দিন সবাইকে। এ শুধু ইতিহাস নয়, এটা একটা আত্মার মুক্তির যাত্রা।”

হরিহর বাবু সিঁদুর মাখানো হাতজোড় করে বলে ওঠেন, “এই গয়না আমি দেবীর চরণে উৎসর্গ করব, যেন স্বর্ণালতার আত্মা শান্তি পায়। আর চিঠিটা দেব গবেষণার জন্যে, যেন ইতিহাসে তার স্থান তৈরি হয়। তুমি একটা পুণ্যের কাজ করেছো।”

তাঁর গলায় সত্যিকারের আবেগ। তিনি বলেন, “অনেক আত্মা ঘুরে বেড়ায় এই পৃথিবীতে, শুধু একটা স্বীকৃতি চায়। আজ তুমি সেই স্বীকৃতি ফিরিয়ে দিয়েছো।”

চন্দ্রপুরের আকাশে তখন ভোরের আলো ফোটে। মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি শোনা যায়। রক্তিম মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার মনে হয়—স্বর্ণালতার আত্মা হয়তো একটিবারের জন্যে হলেও হাসছে। মুক্তির ছায়া যেন ভেসে বেড়াচ্ছে চন্দ্রবিলের জলে।

তার বুক হালকা লাগে। বহু শতকের বোঝা যেন আজ একটু নড়ে উঠেছে।

এটা কেবল একটা সন্ধানের গল্প নয়, এটা এক আশ্চর্য আত্মত্যাগ, এক নারী-স্বপ্নের ইতিহাস, যেটা আজ চন্দ্রপুরের বাতাসে গুঞ্জন তুলবে—চিরকাল।

আত্মার মুক্তি

চন্দ্রবিলে আবার ফিরে এল রক্তিম। এইবার আর একা নয়। পুরো গ্রাম যেন তার ডাকে সাড়া দিয়েছে। ছিল পুরোহিত হরিহর বাবু, কয়েকজন প্রবীণ, গ্রামের কিশোর-কিশোরীরা, এমনকি যারা কখনো চন্দ্রবিলের ধারে যায়নি তারাও। দিনটা ছিল পূর্ণিমা। চাঁদের আলো রুপোলি চাদরের মতো ঢেকে রেখেছে বিলের জল।

রক্তিম বলেছিল, “আজ ওর মুক্তি চাই… ওর আত্মার জন্য কিছু একটা করতে হবে।”

হরিহর বাবু সঙ্গে করে এনেছেন ধূপ, প্রদীপ, গঙ্গাজল আর কিছু মন্ত্রপাঠের সামগ্রী। গ্রামের এক প্রান্ত থেকে চলে এসেছে ঢাকিরা, ধীরে ধীরে বেজে উঠল স্নিগ্ধ ছন্দে ঢাকের বাদ্য। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল ধূপের সুবাস।

বিলের ধারে সবাই দাঁড়িয়ে, নিঃশব্দে, গম্ভীর। যেন চন্দ্রবিল নিজের নিঃশ্বাস আটকে রেখেছে। হরিহর বাবু শুরু করলেন মন্ত্রপাঠ। তার কণ্ঠ গম্ভীর, দৃঢ়, এবং কোনও এক অতল আত্মিকতার ছোঁয়া নিয়ে উচ্চারিত হতে লাগল—

“ওঁ নমঃ আত্মদেভ্যৈ স্বর্ণালতা দেব্যৈ মুক্তিম দেব্যৈ নমঃ…”

ধীরে ধীরে বাতাসে পরিবর্তন আসতে লাগল। জল স্থির নয়, যেন কোনো অদৃশ্য ঢেউ উঠছে। বিলের মাঝখান থেকে মৃদু আলো ফুটে উঠল। সবাই স্তব্ধ।

হঠাৎ সেই আলো যেন রূপ নিল এক মানব আকৃতিতে। জলজ্যোৎস্নার আলোয় ফুটে উঠল এক নারী-মূর্তি—স্বর্ণালতা।

তার পরনে সাদা শাড়ি, চুল খোলা, মুখে সেই চেনা দুঃখের ছায়া নেই। বরং শান্তি, স্থিরতা। তার ঠোঁটে হালকা হাসি। সে যেন ধীরে ধীরে তাকাচ্ছে রক্তিমের দিকে।

“তুমি বিশ্বাস করেছো…”—তার কণ্ঠে ছিল কৃতজ্ঞতা।

“তুমি মুক্তি দিলে…”—কথাগুলো বাতাসে যেন ভেসে এলো।

গ্রামের প্রবীণরা হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। কেউ কেউ চোখে হাত রাখল, কেউ আবার কাঁদতে লাগল। যেন এক মহাপাপের পরিশোধ সম্পন্ন হল, যেন প্রায় দুই শতক পরে এক আত্মা সত্যি করে মুক্তি পেল।

স্বর্ণালতা ধীরে ধীরে মিশে যেতে লাগলেন বাতাসে। তার রূপ আলো হয়ে বিলের উপর ছড়িয়ে পড়ল। পাখিরা ডাকতে লাগল। গাছের পাতায় বাতাসের মৃদু দোলা ফিরে এল।

চন্দ্রবিল আবার নিস্তরঙ্গ। যেন কিছুই ঘটেনি। কিন্তু রক্তিম জানে—ঘটেছে। সে দেখে একজোড়া পদ্মফুল ভেসে উঠেছে বিলের জলে, সেই কাঁকনের মতো।

পুরোহিত বললেন, “আজ সত্যের জয় হয়েছে। আত্মার মুক্তি হয়েছে।”

গ্রামের লোকেরা নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। কেউ কেউ হাঁটু গেড়ে বসে প্রণাম করল বিলের দিকে।

রক্তিম চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল, চোখে জল। সে জানে, এই ইতিহাস সে শুধু কাগজে নয়—হৃদয়ে লিখে রাখবে। এই ছিল তার থিসিসের আসল বিষয়। এই ছিল তার জীবনের এক অধ্যায়ের সমাপ্তি।

চন্দ্রপুরের পূর্ব আকাশে তখন ছড়িয়ে পড়েছে নতুন ভোরের আলো। এক নিঃশব্দ আশ্বাস—সত্য কখনো চাপা থাকে না, বিশ্বাস কখনো বৃথা যায় না।

 চূড়ান্ত পরিণতি

কলকাতা ফিরে এসেছে রক্তিম সেন। চন্দ্রপুরের সেই কয়েক সপ্তাহের অভিজ্ঞতা তার মনোজগৎকে বদলে দিয়েছে। সে যেন এখন আর আগের মানুষ নেই—কেবল ইতিহাসের ছাত্র নয়, ইতিহাসের এক প্রত্যক্ষ সাক্ষী।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গিয়ে প্রথম কাজই সে করল তার থিসিসের নাম পরিবর্তন করা। আগের ‘চন্দ্রপুর রাজবংশ: একটি ইতিহাসগত বিশ্লেষণ’-এর পরিবর্তে এখন নাম—

চন্দ্রবিলের ডাক: ইতিহাস আর আত্মার ন্যায়বিচার

প্রথমে অধ্যাপকরা কিছুটা কৌতূহলী ছিলেন। তারপর যখন রক্তিম নিজের অভিজ্ঞতা, ঘটনাপ্রবাহ, পুরোনো দলিল, চিঠি, এবং মন্দিরে উৎসর্গ করা গহনার তথ্য দিয়ে প্রমাণসহ থিসিস উপস্থাপন করল, তখন তারা স্তব্ধ।

একজন ইতিহাসবিদ বলে উঠলেন, “তুমি শুধু ইতিহাস লেখোনি, তুমি ইতিহাসকে জাগিয়ে তুলেছো।”

রক্তিম বুঝতে পারল, ইতিহাস কেবল রাজাদের গৌরবগাথা নয়। কখনো কখনো ইতিহাস লুকিয়ে থাকে সেইসব কণ্ঠে, যাদের কেউ শোনেনি, যাদের কান্না বিলের জলে মিলিয়ে গেছে।

দিন যায়, মাস কেটে যায়। থিসিস পত্রিকায় ছাপা হয়, তাকে নিয়ে আলোচনা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। চন্দ্রপুরে ফিরে কেউ কেউ পর্যটক হয়ে আসে, কেউ কেউ গবেষক।

রক্তিমের ঘরে এখনো সেই কাঠের সিন্দুকের একটা ছোট রেপ্লিকা রাখা আছে—স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে। সে জানে, আসল সিন্দুক এখন মন্দিরের কোণে, যেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় একটি প্রদীপ জ্বলে। সেই আলোর নিচে এক চিঠি—স্বর্ণালতার নিজের লেখা।

রাত্রে যখন সে জানালার ধারে বসে থাকে, কলকাতার আলো-আঁধারিতে, তখন দূরে কোথাও পাখির ডাকের মাঝে যেন ভেসে আসে এক কণ্ঠস্বর:

“তুমি বিশ্বাস করেছো… তুমি মুক্তি দিলে…”

সে জানে, কেউ একজন তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। সে হাসে, ধীরে জানালার পর্দা সরিয়ে তাকায় আকাশের দিকে।

ভূত বলতে কিছু নেই? না কি ভবিষ্যতের প্রতি অন্যায় অতীত একদিন ঠিক ফিরিয়ে আনে?

চন্দ্রবিল এখনো আছে। চাঁদের আলোয় তা এখনো রুপোলি হয়ে ওঠে। কিন্তু সেই জলে আর কোনও কান্নার প্রতিধ্বনি শোনা যায় না। পাখিরা আসে, ফুল ফোটে, শিশুরা খেলে যায় তার ধার ঘেঁষে।

আর রক্তিম জানে—এক আত্মা এখন মুক্ত, এক ইতিহাস এখন সম্পূর্ণ।

শেষ

 

WhatsApp-Image-2025-06-08-at-3.18.45-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *