Bangla - ভূতের গল্প - রহস্য গল্প

চন্দ্রবদনী ঘাটের নৌকা

Spread the love

এক

নদীয়া জেলার এক প্রান্তে, হুগলি নদীর ধারে, লুকিয়ে আছে চন্দ্রবদনী নামের এক ঘাট—যা আজকাল কেউ খুব একটা চেনে না। দিনের আলোয় ঘাটটা যেমন সাধারণ আর নিরীহ, ঠিক সন্ধ্যা নামার পর থেকেই তার চেহারা পাল্টে যায়। কুয়াশা নামতে থাকে এক নিঃশব্দে, নদীর জলে বয়ে আসে অদ্ভুত একটা গন্ধ, যেন শ্যাওলার ভেতরে দীর্ঘদিনের জমে থাকা কান্না। গাঁয়ের লোকেরা সন্ধ্যার পর ঘাটমুখো হয় না, এমনকি নামও মুখে আনে না। তারা বলে, “ওইখানে জল শুধু জল না, ওখানে কেউ আছে।” তমাল মল্লিক, একজন লোকসংস্কৃতি গবেষক, এসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না। কলকাতা থেকে আসা এই তরুণ ইতিহাসবিদের মনে ছিল জেদ—যেখানে ভয়, সেখানে সত্য। সে শুনেছিল চন্দ্রবদনী ঘাটে রোজ সন্ধ্যাবেলায় একটি নৌকা আসে, যেখানে এক সাদা শাড়ি পরা নারী বসে থাকেন, আর মাঝির মুখ কেউ দেখে না। সে ঠিক করে, সেই নারী কে, নৌকা কোথা থেকে আসে, মাঝি কি জীবিত না অশরীরী—সব জানবে, লেখার জন্য না, নিজের কৌতূহলের জ্বালায়।

তমাল প্রথমবার ঘাটে পৌঁছায় একটি সাইকেলে চেপে, বিকেল প্রায় চারটা নাগাদ। আশেপাশে ঝোপঝাড়, ভাঙা সিঁড়ি, আর পুরনো ঘাটের শিলালিপি দেখে বোঝা যায় জায়গাটা কোনও এক সময় জমিদারবাড়ির অধীন ছিল। সে ক্যামেরা, নোটবই আর রেকর্ডার সঙ্গে এনেছে, যদিও তার মনের গভীরে এক অজানা উত্তেজনা ঢেউ তুলছিল। একটা বুড়ো লোক ঘাটের কাছে বসে ধূপ জ্বালাচ্ছিল—পরে তমাল জানল তার নাম তর্পণী দাস। লোকটি চোখ তুলেই বলেছিল, “সন্ধ্যার আগে ফিরে যান বাবু। জলডাক এসে পড়লে আর ফেরার পথ থাকে না।” তমাল হাসি ঠেলে বলে, “আমি ভয় পাই না কাকু, আমি শুধু জানতে এসেছি, ওই নৌকাটা আসে কেন? কে থাকে ওতে?” বুড়ো মুখ গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল, “তোমার যা জানার, তা জানতেই চাইছো, না বোঝার নামে ডেকে আনছো? ওই ঘাটে এক সময়ের রানীর কান্না রোজ ফিরে আসে বাবু—তোমরা কাগজে লিখতে এসো, আর আমরা প্রাণ নিয়ে পালাই।” তমাল আর কিছু না বলে ধীরে ধীরে ঘাটের শেষ সিঁড়ির ধারে বসে পড়ে। সূর্যটা তখন নদীর ওপারে লুকিয়ে পড়ছে, আর জলের ওপর ছায়ারা দীর্ঘ হতে হতে এক রহস্যের দুলুনির মতো নড়ছিল।

সন্ধ্যা ছ’টা পঁচিশে প্রথম হাওয়ার ঝাপটা আসে। নদী হঠাৎ যেন স্তব্ধ হয়ে যায়, কোনো নৌকা নেই, মাছরাঙাও ডাকছে না। ঠিক ছ’টা পঁয়তাল্লিশে, তমাল দেখে নদীর মাঝখানে কুয়াশার মধ্যে ভেসে আসছে একটা নৌকা। সাদাটে, কাঠের, পুরনো ধরনের সেই নৌকা, যেন কোন কালেই রঙ করা হয়নি। মাঝখানে বসে আছে এক নারী—সাদা শাড়ি, আঁচল ঢাকা মুখ, কিন্তু মাথার ঝুঁকে থাকা ভঙ্গিতে একটা অদ্ভুত মাধুর্য। তাঁর পায়ের কাছে রাখা এক থলে, আর ঠোঁটদুটো যেন কাঁপছে, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোয় না। মাঝি দাঁড় টানছে নিঃশব্দে, তার মুখ দেখা যায় না, মাথা নুয়ে। সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার, নৌকাটা একদমই তরঙ্গ তৈরি করছে না নদীতে—জল যেন তার নিচ দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে, তাকে ছুঁতে চাইছে না। তমালের শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। সে চিৎকার করে ডাকার চেষ্টা করল, “কে আপনি? মাঝি, শুনছেন?” কিন্তু তার গলা যেন নদীর শব্দে গিলে ফেলল। হঠাৎ সে খেয়াল করল—তার আশেপাশে আর কেউ নেই। তর্পণী দাস, গ্রামের কুকুরগুলো, পাখিরা—সব যেন অদৃশ্য। পুরো ঘাটটা কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে, ঠিক যেন সময় স্থির।

তমাল বুঝতে পারল সে এক অচেনা সীমার মধ্যে চলে এসেছে—যেখানে বাস্তব আর লোককথা একাকার। হঠাৎ তার কাঁধে একটা হাওয়া লাগে, হিমেল, ভেজা, কিন্তু মানুষের নিঃশ্বাসের মতো। সে চমকে পেছনে তাকায়—কেউ নেই। আবার চোখ ফেরাতেই দেখে নৌকাটা ঘাটের একদম ধারে এসে গেছে। নারীটি তাকিয়ে আছে এবার সরাসরি তার দিকে। তার চোখ—এক অন্ধকার কুয়ো, যেখানে হাজার বছরের কান্না সঞ্চিত। সে বলে ওঠে একমাত্র একবার, “ফিরে যেও না… তমাল… এবার তুমি আমাদের।” এই প্রথম তমাল বিস্ময়ে বুঝতে পারে—সে তো নিজের নাম বলেনি! তাহলে… জানে কীভাবে? কে এই নারী? কেন সে বলছে “আমাদের”? তমাল দৌড়ে উঠতে চায়, কিন্তু তার পা যেন আটকে গেছে ঘাটের স্যাঁতসেঁতে সিঁড়ির গায়ে। নদীর জল এবার গা ছুঁয়ে যাচ্ছে, আর নৌকাটার ছায়া তার গায়ে এসে মিশে যাচ্ছে। সেই মুহূর্তে এক প্রচণ্ড শব্দ হয়—মাঠের দিকে বাজ পড়ে যেন, আর সবকিছু ছিঁড়ে দিয়ে আবার আগের ঘাট ফিরে আসে। নদী শান্ত, নৌকা নেই, নারী নেই, মাঝি নেই—শুধু পড়ে আছে তমালের নোটবই, ভেজা আর জলে মাখা, আর পেছনে দাঁড়িয়ে তর্পণী দাস, যার চোখে এক বদ্ধ জিজ্ঞাসা—“তুমি সত্যিই দেখেছো?”

দুই

সন্ধ্যার সেই অভিজ্ঞতার পর তমাল মল্লিক পুরো রাত ঘুমোতে পারেনি। চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠছিল সেই সাদা শাড়ি পরা নারীর মুখ—না, আসলে মুখ নয়, চোখ। সেই দুটি চোখের শূন্যতা যেন তার নিজের আত্মাকেও খালি করে ফেলেছিল। পরদিন সকালবেলা, ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই সে তার ক্যামেরা, ভেজা নোটবই আর রেকর্ডার নিয়ে আবার ঘাটের দিকে রওনা দেয়। তর্পণী দাস তখনো ঘাটে, আগুন জ্বালিয়ে ধূপ ছড়াচ্ছেন। তমাল তাঁকে এক কাপ চা হাতে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কাকু, আপনি আমাকে আগেই সাবধান করেছিলেন। কিন্তু আমি তো বুঝতেই পারিনি ওটা… ওটা এতটা ভয়ানক কিছু।” বুড়ো লোকটা মুখে চা লাগিয়ে বললেন, “তোরা যারা বই লেখ, তারা ভাবিস ভূত বললেই বোধহয় রোমাঞ্চ হবে। কিন্তু যা সত্যি, তার থেকে ভয়ংকর কিচ্ছু হয় না। তুমি যা দেখেছো—সে তো জানতো তুমি আসবে, বহু আগেই।” তমাল আঁতকে উঠল, “মানে? কে জানতো?” তর্পণী হালকা গলায় বললেন, “গিরিবালা… রাজবাড়ির রানী। তুমি তো ওঁর নাম জানো না, তাই না?” সেই প্রথম তমাল অনুভব করল, এই ঘাটের সঙ্গে যুক্ত আছে ইতিহাস নয়—একটা চাপা লেলিহান অতীত, যার স্পর্শ এখনও জলের ঢেউয়ে ঘুরে বেড়ায়।

তমাল স্থানীয় হাইস্কুলে শিক্ষিকা মাধবী পাল-এর খোঁজে যায়, যিনি লোকগাথা ও পুরনো গল্প নিয়ে আগ্রহী বলেই গ্রামে পরিচিত। স্কুল শেষে মাধবীর সঙ্গে দেখা হয়, আর সে একটু অবাক হলেও তমালকে চা খেতে ডাকে তার বাড়িতে। ছোট ছিমছাম বাড়ি, উঠোনে তুলসিতলা আর মাধবীর চোখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি। কথা বলতে বলতে তমাল যখন তার অভিজ্ঞতা খুলে বলে, তখন মাধবীর মুখের শান্তির আবরণ যেন ফেটে যায়। সে ফিসফিস করে বলে, “আমি ছোটবেলা থেকেই তাকে দেখি। ঘুমের মধ্যে, জেগে থাকতে—যখনই নদীর গন্ধ পাই, সে আসে। কাঁদতে কাঁদতে ডাকে—তমাল, এই নামে না, অন্য নামে… কিন্তু কণ্ঠটা একই।” তমাল অবাক হয়, “তুমি মানে… তুমি আগে কখনো চন্দ্রবদনী ঘাটে গিয়েছো?” মাধবী মাথা নাড়ে, “না। কিন্তু আমার মা বলতেন, আমাদের বংশে এক নারী ছিলেন, যাকে রাজবাড়ির লোকেরা ডুবিয়ে মেরেছিল… তিনি অভিশাপ দিয়েছিলেন—তার আত্মা জল পাবে না, যতক্ষণ না সত্য উন্মোচিত হয়।” তমালের গা দিয়ে হিম বয়ে যায়—সে বোঝে, মাধবী শুধু সাক্ষী না, সম্ভবত এই কাহিনির চাবিকাঠি।

মাধবী তমালকে একটি পুরনো ট্রাঙ্ক দেখায়, যার মধ্যে ছিল কিছু হলুদ হয়ে যাওয়া চিঠি, ধুয়ে যাওয়া একটা ছবি আর একটি কাঁসার আয়না। ছবিতে দেখা যায়—এক সাদা শাড়ি পরা নারী, তাঁর চোখে এক বিষণ্ণতা, মুখে এক দুর্ভেদ্য অভিমান। আয়নাটার রূপালি পিঠে লেখা ছিল একটা ছেঁড়া লাইন—“যে জলে রক্ত, সে-ই জানে ভালোবাসা কাকে বলে।” তমাল আয়নাটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে—তাঁর মনে হয়, আয়নার মধ্যে যেন কিছু দুলছে। সে দেখতে পায় নিজেকে, কিন্তু একটু পরে যেন সে দেখতে পায় মাঝি, তারপর সেই নারী, তারপর আবার শূন্যতা। আয়না নামিয়ে রেখে সে বলে, “মাধবী, আমাদের জানতে হবে এই গিরিবালার পুরো কাহিনি। কেন সে প্রতিদিন ফিরে আসে, কেন সাদা শাড়ি পরে থাকে, আর কেন সে আমাকে বলল ‘এবার তুমি আমাদের’?” মাধবী ধীরে বলে, “আমার স্বপ্নে সে বলে—এক নতুন মাঝি আসবে, যে বুঝবে দুঃখের জল কখনো শুকায় না… হয়তো সে তুমি।” তমাল আর কথা বলতে পারে না—তার মনে হয়, সে ভুল করে নয়, কোনো পূর্বনির্ধারিত সূত্রেই এখানে এসেছে।

পরদিন রাতে, তমাল একা আবার ঘাটে যায়। সে কিছু না বলে একটা ছোট ক্যামেরা সেট করে দেয়ার চেষ্টা করছিল, যেন নৌকাটি ঠিক কোথা থেকে আসে তা বোঝা যায়। কিন্তু রাত দশটা বেজে গেলেও কিছুই আসে না। হঠাৎ বাতাস বদলে যায়, গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। নীরবতার মধ্যে মৃদু ছলছল শব্দ—তমাল চমকে উঠে দেখে নদীর ওপারে দুধসাদা কুয়াশার মধ্যে আবার সেই নৌকা। এবার সে কাছে আসে না, মাঝখানে থেমে যায়। নারীটি এবার উঠে দাঁড়ায়, হাত তুলে দেখায় নদীর দক্ষিণপ্রান্তের দিকে—যেখানে এক সময় নাকি জমিদারদের ঘাট ছিল, আর এখনও একটা ভাঙা পিলার দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ চারদিক থেকে অজস্র কাক ডাকতে থাকে, বাতাস গর্জে ওঠে, আর নৌকাটা ঘূর্ণির মতো ঘুরতে ঘুরতে অদৃশ্য হয়ে যায়। তমাল ক্যামেরায় কিছুই ধরতে পারে না, শুধু অদ্ভুতভাবে ক্যামেরার গ্লাস ভিজে যায়, যেন কেউ খুব কাছ থেকে নিঃশ্বাস ফেলেছে। সেদিন রাতে সে বুঝে যায়—এই গল্প কেবল ইতিহাস নয়, এ যেন আত্মার ডাক, যা শোনার জন্য কেউ কেউ জন্মায়। তার সামনে অপেক্ষা করছে সেই সাদা শাড়ি পরা নারীর হাজার বছরের নীরবতা—যা এবার আর নীরব থাকবে না।

তিন

তমাল মল্লিকের মাথার ভিতরটা এখন যেন কুয়াশার মতো আবছা। নদীর ঘাট, সেই নৌকা, গিরিবালার চোখ, আর মাধবীর বলা কথা—সব মিলে একটি ধাঁধার মতো তার চারপাশে জড়িয়ে ধরেছে। সেই রাতে সে ঠিক করে, তাকে এবার মুখোমুখি হতে হবে একমাত্র মানুষটির, যে এই ঘাট নিয়ে কিছু জানে, এমনকি একবার ঐ নৌকায় উঠেও বেঁচে ফিরেছে। লোকটির নাম বিপ্লব হালদার। সে এখন প্রায় পাগলের মতো থাকে—ঘরের কোণে বসে সারাদিন নদীর দিকে চেয়ে থাকে, কারো সঙ্গে কথা বলে না, মাঝেমাঝে বিড়বিড় করে নিজের সঙ্গে কথা বলে, যেন কারোর অস্তিত্ব তার চোখে লুকিয়ে নেই। তমাল খোঁজ করে পৌঁছে যায় গ্রামের এক কোণের দালানে, যেখানে ভাঙা দরজা, ছেঁড়া মাদুর আর একপাশে বালতিতে জমে থাকা জল—সেই ঘরেই থাকে বিপ্লব। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তমাল ভেবেছিল, মানুষ কি সত্যিই অতীতের সামনে হার মেনে এমনভাবে বেঁচে থাকে? ভেতরে গিয়ে দেখে, এক বয়স্ক লোক, চোখ লালচে, দাঁড়ির রেখায় খসখসে চেহারা, তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। তমাল ধীরে বলে, “আপনি কি… বিপ্লব হালদার?” সে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, “নৌকা কি আবার এসেছে?”

তমাল চমকে উঠে বসে। “আপনি জানেন ওটা কী?”—জিজ্ঞেস করতেই বিপ্লব হালকা হাসে, সেই হাসিতে বেঁচে ফেরার ভয়, আবার হারানোর গ্লানি। সে বলে, “জানি? না বাবু, ওটা তো জানেই না কেউ। ওটা শুধু নেয়, ফিরিয়ে দেয় না। আমায় ফিরিয়ে দিয়েছে, কারণ আমি মাঝির মুখ দেখতে চেয়েছিলাম।” তমালের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা হাওয়া নেমে যায়। “মাঝি কে?”—জিজ্ঞেস করতেই বিপ্লব বলে, “ওর মুখ নেই। না না, মুখ আছে, কিন্তু… দেখতে গেলে নিজের মুখ দেখা যায়। আমি যেদিন উঠেছিলাম, সেদিন কুয়াশা ছিল। আমি ভেবেছিলাম কেউ খেলাচ্ছলে ঘাটে নাটক করছে। নৌকায় উঠে বসতেই দেখি সাদা শাড়ি পরা নারী একদম চুপচাপ বসে আছে। তার মুখ আড়াল করা, কিন্তু মাঝির দিকে তাকাতেই আমি দেখি… সে আমি। মানে, মাঝির মুখে আমার মুখ, আমার চোখ, আমার ভয়। বুঝলেন তো? ওরা আপনাকে ওদের মতো করে তোলে।” তমাল ঘরের মাটিতে বসে পড়ে। সে বুঝতে পারে, এই গল্পে প্রত্যেক চরিত্রের মুখে একটা মুখোশ আছে—কেউ আত্মা হারিয়েছে, কেউ দেহ; আর কেউ এখনো লড়ছে চুপচাপ।

বিপ্লব জানায়, সেই নৌকা কেবল সেইসবকেই নেয় যারা জানতে চায়, যারা অন্ধকারের গভীরে ঢুকে সত্যি খুঁজে ফেরে। “নৌকার মাঝি কে”—এই প্রশ্নই নাকি তার অভিশাপ। সে আরও জানায়, গিরিবালা রানী তার মৃত্যুর রাতে নাকি চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে অভিশাপ দিয়েছিলেন—“যে আমাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলেছে, সে যেন চিরকাল জল আর আত্মার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে, মাঝি হয়ে, পথ না খুঁজে।” তাই মাঝি এক অভিশপ্ত আত্মা, সে নিজেও জানে না সে কে, আর যাদের সে নিয়ে যায়, তারা ধীরে ধীরে তার মতোই হয়ে যায়। তমাল কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে, “তাহলে কি আমি এবার সেই পথে?” বিপ্লব বলে, “হয়ত তুমি শেষজন… নয়ত নতুন মাঝি।” কথাটা শুনে তমাল বুঝতে পারে, সে এখন শুধু এক গবেষক নয়, সে নিজেই এই গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, যেন গিরিবালার আত্মা তাকে নিজের বৃত্তে টেনে নিচ্ছে। তার মধ্যে জন্ম নিতে থাকে এক ভয়, আর সেই ভয় ধীরে ধীরে রূপ নেয় আকর্ষণে। সে বুঝে যায়, শুধু দূর থেকে দেখা নয়—তাকে এবার নিজে নৌকার পথে পা রাখতে হবে।

সেদিন সন্ধ্যায়, তমাল আবার চন্দ্রবদনী ঘাটে যায়, সঙ্গে একটা ছোট আয়না আর মাধবীর দেওয়া চিঠিগুলো। সে একা বসে থাকে সিঁড়ির ধারে, চোখে কান রাখা সেই জলছল শব্দের জন্য। আবারও ঠিক ছ’টা পঁয়তাল্লিশে নদীর বুক কেটে ভেসে আসে সেই নৌকা। এবার কুয়াশা আরও গাঢ়, আর মাঝির দেহটা আরও অস্পষ্ট। সাদা শাড়ি পরা নারী এবার নৌকার ধারে দাঁড়িয়ে, মাথা নিচু করে। তমাল আয়নাটা সামনে ধরে, এবং দেখে—মাঝির মুখে এবার তার নিজের মুখ! হ্যাঁ, সে নিজেই মাঝি, কিংবা হয়ে যাচ্ছে। আয়নার কাঁচে তার মুখ আর মাঝির মুখ এক হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই নৌকার নারীটি মুখ তুলে তাকায়, আর বলে, “তুমি প্রস্তুত তো?” তমাল জবাব দিতে পারে না। একমাত্র তার মনের ভিতর একটা আওয়াজ বাজে—“যা একবার দেখে ফেলে, তা আর নিজেকে আগের মতো রাখতে পারে না।” সে বুঝে যায়, শুধু জানার জন্য না, ভালোবাসা, প্রতিশোধ আর আত্মমুক্তির গল্পে সে নিজেই এক নতুন নৌকায় যাত্রী হয়ে উঠেছে। ঘাটে বাতাস থেমে যায়। নদী আর চুপচাপ নয়—তার জল যেন ডাকছে।

চার

চন্দ্রবদনী ঘাটে তমালের আগমন যেন এক তুষারপাতের মধ্যে আগুন নিয়ে ঢোকার মতো। প্রতিটি দিন তাকে নতুন এক অজানা রহস্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। দয়াল মাঝির কথা, সন্ধ্যাবেলার সেই অচেনা নৌকা, নারী যাত্রী আর তার চোখের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসা শীতল স্তব্ধতা — এসবের ভেতর দিয়ে সে বুঝতে পারছিল, এই ঘাটে অতীতের কোনো জটিল ইতিহাস লুকিয়ে আছে। স্থানীয়দের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ানো একটা নাম তার কানে আসছিল বারবার—”জমুনা বউ”। গ্রামের এক বৃদ্ধা — অশীতিপর গদার বউ — একদিন বিকেলে তাকে চুপচাপ ডেকে বলল, “তুমি যদি সত্যিই জানতেচাও, তাহলে আজ রাত্তিরে গঙ্গার ধার দিয়ে পশ্চিমে চলে যেও, ওখানে একটা পুরনো বাঁধানো ঘাট আছে, সেখানে দাঁড়িয়ে শুনতে পাবে কীভাবে জলের নিচ থেকে কেউ কেউ ডাকছে…” তমাল বিস্মিত হয়, ভয়ও পায়, তবু প্রবল কৌতূহল তাকে ঠেলে দেয় সেই রাতের অন্ধকারের দিকে।

রাত দশটা নাগাদ তমাল পৌঁছাল গদার বউয়ের দেখানো সেই বাঁধানো ঘাটে। চারদিকে নিস্তব্ধতা, কেবল নদীর কলকল ধ্বনি যেন হঠাৎ হঠাৎ থেমে গিয়ে জলের নিচ থেকে কারো চাপা আর্তনাদ উঠিয়ে দিচ্ছে। সে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ, গভীর মনোযোগে কান পেতে। হঠাৎ এক মুহূর্তে শোনা গেল — একটা দীর্ঘশ্বাস। যেন কেউ বহু দূর থেকে গলা ছেড়ে কাঁদছে, জল টেনে নিচ্ছে সেই কান্না। তমাল নিজেকে ধাতস্থ রেখে ফোনের টর্চ জ্বালাল, কিন্তু চারপাশে শুধু জল, ঢেউয়ের প্রতিফলন আর ছায়া। হঠাৎ অদ্ভুত এক ঠান্ডা অনুভব করল সে, যেন কারো শ্বাস তার ঘাড়ের কাছে এসে লাগল। ফিরে তাকাতেই দেখল — কেউ নেই। কিন্তু তার নাক বেয়ে একটা অদ্ভুত মাটির গন্ধ আর বালির সোঁদা গন্ধ যেন উঠে আসছে। তমাল অনুভব করল, কিছু একটা তাকে নিচের দিকে টানছে — সেই বাঁধানো ঘাটের জলের নিচে।

হঠাৎই ফোনটা হাত থেকে পড়ে গেল। টর্চের আলো জলে পড়ে এক সেকেন্ডের জন্য সে দেখতে পেল — একটা মুখ! না, কোনো জীবিত মানুষের মুখ নয় — সেটা একটা নারীমুখ, যার চোখ নেই, শুধু দুটো ফাঁপা গহ্বর। মুখটা এক অদ্ভুত বিষণ্নতায় ভরা, আর তার ঠোঁট কাঁপছে — যেন কিছু বলতে চাইছে। হঠাৎ মুখটা মিলিয়ে গেল জলের নিচে। তমাল হতভম্ব হয়ে বসে পড়ে, গলা শুকিয়ে যায়। ভয় আর কৌতূহলের এক মিশ্র আবেগে সে ফিরে আসে লজে। কিন্তু রাতে ঘুমাতে গিয়ে বারবার মনে পড়ে সেই মুখ, সেই শীতল চোখের ফাঁকা গহ্বর। সে বুঝে যায়, এই ‘জমুনা বউ’ শুধু লোককথা নয়, এই নদীতে তার অস্তিত্ব এখনও রয়ে গেছে কোনো এক অভিশপ্ত মোহনার গহ্বরে।

পরদিন সকালে তমাল আবার খোঁজ করে দয়াল মাঝিকে। দয়াল তাকে কিছুতেই কিছু বলতে রাজি হচ্ছিল না। শেষে এক কাপ চায়ের বদলে একটু মুখ খোলে সে, “জমুনা বউ নদীতে ডুবে যায়নি, বাবু। ওকে ডোবানো হয়েছিল। তার স্বামীই তাকে বেঁধে নদীতে ফেলে দেয়, সন্দেহের বশে। তখন থেকেই নাকি প্রতি সন্ধ্যায় একটা নৌকা আসে — এক যাত্রী নিয়ে — আর যে সেই নৌকায় ওঠে, সে আর ফেরে না।” তমাল শিউরে ওঠে। তার মানে, সে নিজে যে মুখ দেখেছে, তা কোনো মনের ভুল নয়। হঠাৎ সে একটা প্রশ্ন করে — “তুমি কি সেই নৌকাটা চিনো?” দয়াল কাঁপা গলায় বলে — “চিনি না বাবু, কেউ চেনে না। শুধু জানি, তার নিচে পচে গলা একটা ঘন্টা বাঁধা — যে নৌকা উঠলে সেই ঘন্টা বেজে ওঠে। আর তখনই সে এসে হাজির হয়…” তমালের বুকের ভেতর যেন কেউ বরফ ঢেলে দেয়। সে জানত, এবার তাকে নামতেই হবে — সেই নৌকায়। কিন্তু কীভাবে? সে কি ফিরে আসবে? নাকি আরেকটি নাম জুড়ে যাবে সেই হারিয়ে যাওয়া যাত্রীদের তালিকায়? তার সামনে এখন শুধুই এক জলের রহস্য… আর এক নারীর নিঃশব্দ ক্রন্দন।

পাঁচ

বিকেলবেলা চন্দ্রবদনী ঘাটে বাতাসটা একটু বেশি ঠান্ডা ছিল সেদিন। তমাল আগের রাতের সমস্ত তথ্যগুলি গুছিয়ে রেখে গ্রামের সবচেয়ে প্রবীণ মানুষ হরিপদ মুখুজ্জের খোঁজে বেরিয়েছিল। হরিপদর বয়স প্রায় নব্বইয়ের কাছাকাছি, হাঁটা চলার ক্ষমতা নেই বললেই চলে। কিন্তু লোককথা আর অলৌকিক গল্পে তার জ্ঞান অসামান্য। তিনি একসময়ে নদীয়া জেলার প্রাচীন ইতিহাসের মৌখিক সংগ্রাহক ছিলেন। তমাল যখন পৌঁছাল, তিনি উঠোনের এক কোণে বিছানা পেতে আধশোয়া হয়ে শীতের সূর্য মাখছিলেন। তমাল সালাম জানিয়ে বসতেই, একমনে বলে উঠলেন, “চন্দ্রবদনীর সেই নৌকা? ওটা তো আজও ফেরে… হুঁশিয়ার থাকিস বাবারে।” তাঁর চোখজোড়া ছিল ভয়মিশ্রিত স্মৃতিতে আঁকা, আর তমালের শরীরের লোম খাড়া হয়ে গেল।

হরিপদ মুখুজ্জে জানালেন, “আজ থেকে প্রায় ৭৫ বছর আগে, আমিও একরকম সেই ঘাটেই ছিলাম। তখনকার দিনে এক মেয়ে ছিল — নাম রোহিনী। গাঁয়ের মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে, কিন্তু তার চোখে ছিল চাঁদের আলো, আর মুখে যেন বিষ। তার প্রেমে পড়ে এক মাঝি, নাম তার গণেশ পাল। রোহিনীর পিতার নিষেধ সত্ত্বেও তাদের মধ্যে প্রেম চলতে থাকে। একদিন রোহিনী নদীর ওপারে পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু সেই যাত্রায়ই ঘটে বিপর্যয়। বলা হয়, সেই রাতে নদীতে প্রবল ঝড় ওঠে, আর তারা দু’জনেই আর ফেরে না। তারপর থেকেই প্রত্যেক পূর্ণিমা রাতে, ওই ঘাটে একটা নৌকা ভেসে আসে — এক নারী যাত্রী নিয়ে। কে সেই নারী? তার মুখে ঢেকেছে এক বর্ণহীন ওড়না, চোখ তীক্ষ্ণ, কিন্তু গলা যেন এক গলায় কাঁটার মতো আটকে থাকে। মাঝির মুখও কেউ কখনো দেখেনি। শুধু দেখা যায় — সে এক অদ্ভুত হুঁশিয়ার দৃষ্টিতে যাত্রীকে ডাকছে।”

তমাল সবকিছু খুঁটিয়ে শুনছিল, কিন্তু তার মনে তখন আরেকটি প্রশ্ন। “আপনি কি কখনও দেখেছেন সেই নৌকা?” হরিপদ এক লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, “একবার… হ্যাঁ, একবার। আমি তখন ষোল বছরের, বাড়ির বড়রা মানা করলেও, বন্ধুদের সঙ্গে ঘাটে যাই চুপি চুপি। দেখি নৌকা বেয়ে আসছে, তীব্র জ্যোৎস্নায় মেয়েটার ছায়া স্পষ্ট, কিন্তু মুখ যেন কুয়াশার মতো অস্পষ্ট। আমার এক বন্ধু সেই নৌকার দিকে এগিয়ে যায়… তার নাম ছিল বিপ্লব। সে আর ফেরেনি। পরদিন সকালে তার জুতো জোড়া পাওয়া গিয়েছিল ঘাটের ধারে। লোকেরা বলল, ‘ওর আত্মা নাকি রোহিনীর সঙ্গী হয়ে গেছে।’ তারপরে আমি আর কখনও ঘাটের দিকে তাকাইনি।” হরিপদ চোখ বন্ধ করে ফেলেন, যেন আবার ফিরে যাচ্ছেন সেই ভয়াল রাতে।

তমাল বাড়ি ফিরে গভীর চিন্তায় পড়ে যায়। রাতের আকাশে বিশাল পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। তার জানলা দিয়ে নদীর কলধ্বনি শোনা যায়, যেন দূর থেকে কেউ ডাকছে। তাঁর মনে পড়ে যায়, গত তিন দিনে এই ঘাট থেকে হারিয়ে যাওয়া দুজন মানুষ — একজন জেলে, আরেকজন সাহসী তরুণ, যারা “অলৌকিক” বলে খ্যাত নৌকায় চড়েছিল। হরিপদর গল্পটা কেবল গল্প নয়, তমালের চোখে সেটা এখন এক অলিখিত ইতিহাস — মৃত্যু ও ভালোবাসার এক অন্ধকার নদীপথ। কিন্তু তমাল থেমে যাওয়ার পাত্র নয়। সে সিদ্ধান্ত নেয়, পরবর্তী পূর্ণিমার রাতে সে নিজে চন্দ্রবদনী ঘাটে যাবে, রোহিনীর নৌকা নিজের চোখে দেখবে, সত্যি বা মিথ্যার শেষ বিন্দুটা খুঁজে আনবেই।

ছয়

সন্ধ্যার আগে নদীর ধারে পৌঁছে তমাল থেমে দাঁড়ায়। আকাশজুড়ে এক অদ্ভুত গাঢ় নীলের ছায়া যেন ধীরে ধীরে নামছে নদীর বুকে। পাখিরা উড়তে উড়তে দূরে হারিয়ে যাচ্ছে, আর বাতাস যেন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকেছে—তার নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই কানে আসছে না। সে আজ ইচ্ছা করেই সকাল থেকে প্রস্তুতি নিয়েছে। স্থানীয়দের কাউকে কিছু না জানিয়েই সে একাই পৌঁছেছে চন্দ্রবদনী ঘাটে, হাতে কেবল একটি নোটবুক, একটা পুরোনো টেপ রেকর্ডার আর মোবাইলের ক্যামেরা। এতদিনের গল্প, এতদিনের ছায়া—আজ সে নিজের চোখে দেখে নিতে চায়। সে নৌকা—যেটা নাকি সন্ধ্যায় আসে, কোনো যাত্রী নিয়ে ফিরে যায় না—তা আজ ধরা দিক তার সামনে।

আলো একদম নিভে গেলে, নদীটা যেন এক ঘন কালো দুলুনিতে ঢেকে যায়। হঠাৎ করেই নদীর ওপারে একটা মৃদু আলোর রেখা চোখে পড়ে তমালের। সেই আলো ধীরে ধীরে এগোতে থাকে, যেন মাঝনদীর বুকে একটাই ফোকাসড আলো ধীরে ভেসে আসছে তার দিকে। তমালের গলা শুকিয়ে আসে। সে গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের স্নায়ু সামলায়। হাঁটুতে যেন কিছুটা কাঁপুনি ধরেছে, কিন্তু পা দুটো জমাট বাঁধা মাটির মতই এক জায়গায় আটকে আছে। তারপর… সেই আলোটা যেন একটু কাছে এলে স্পষ্ট দেখা যায়—একটা নৌকা, আর সেই নৌকায় বসে আছে একজন নারী। গা-ঢাকা সাদা শাড়ি, অবিন্যস্ত চুল, মুখটা ঝুঁকে আছে সামনের দিকে, কিছুটা অন্ধকারে ঢাকা। মাঝি—তাকে আজও বোঝা যাচ্ছে না, যেন সে এক ছায়া, অথবা কোনো অবয়বহীন উপস্থিতি।

তমাল ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় নৌকার দিকে। তার মন তীব্র দ্বন্দ্বে পড়ে—এই কি সেই নৌকা? এই কি সেই নারী যাত্রী, যার মুখ কেউ দেখেনি, যার সঙ্গী হওয়া মানে কখনো আর না-ফেরা? তার হাতে মোবাইল থাকলেও সে ছবি তোলে না। কিছু আছে যা ক্যামেরা ধরতে পারে না, আর কিছু অভিজ্ঞতা আছে যা চোখ দিয়ে গ্রহণ করাই যথেষ্ট। হঠাৎ করেই সেই নারী মাথা তোলে। তমালের হৃৎস্পন্দন থেমে যায় এক মুহূর্তের জন্য। মেয়েটির মুখ অদ্ভুত সুন্দর, কিন্তু চোখ দুটো যেন কোনো জীবন্ত মানুষের নয়। চাহনিটা একেবারে শূন্য—তবু সে তাকিয়ে আছে তমালের দিকে। ধীরে ধীরে নৌকাটা ঘাটে এসে ভিড়ে, একটুও শব্দ না করে। মাঝি কিছু বলে না, শুধু একবার দৃষ্টিপাত করে তমালের দিকে—না রাগ, না আহ্বান, শুধু একটা নিঃশব্দ উপস্থিতি।

তমাল পা বাড়াতে গিয়েও থেমে যায়। হঠাৎ তার মনে পড়ে যায় সেই বৃদ্ধ সাধুর কথা, যে তাকে বলেছিল—”যা চোখে দেখিস, সব সত্যি নয়। আর সব সত্যি, চোখে ধরা পড়ে না।” সে পেছনে তাকায়—ঘাটটা একেবারে ফাঁকা, কোনো মানুষজন নেই, নেই কোনো শব্দ। শুধু তার শ্বাসপ্রশ্বাস, নদীর জল থই থই, আর সেই নৌকা। সেই সময় হঠাৎ করেই নারীকণ্ঠে এক প্রশ্ন ভেসে আসে—”তুমি আসবে?” কথাটা বলে মেয়েটি আর কিছু বলে না, শুধু চেয়ে থাকে। তমাল অনুভব করে সময় যেন স্থির হয়ে গেছে, চারপাশে বাতাস থেমে গেছে, এমনকি তার নিজের হৃৎস্পন্দনও আর স্বাভাবিক নয়। সে আরেকবার পা বাড়াতে গিয়েও পেছিয়ে আসে। না, আজ সে উঠবে না। তার কাজ দেখা, বোঝা, আর সেসব লেখা—নিজেকে বিসর্জন দেওয়া নয়। আর ঠিক সেই মুহূর্তে, মেয়েটির মুখের ছায়া যেন হঠাৎ বিকৃত হয়ে ওঠে—চোখদুটো কালো, ঠোঁট ফাঁক হয়ে অদ্ভুত এক বিকৃত হাসি। নৌকা নিজে থেকেই ধীরে ধীরে সরে যেতে থাকে নদীর দিকে, কোনো তরঙ্গ না তুলে, কোনো শব্দ না করে, শুধু নিঃশব্দে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।

সাত

ঘাটের দিকে যাওয়ার আগে তমাল মাথার উপরের আকাশটার দিকে তাকিয়ে ছিল। পূর্ণিমার চাঁদ নীলাভ আলো ছড়িয়ে দিচ্ছিল, আর সেই আলোয় নদীর জল যেন রুপোর মতো চিকচিক করছিল। চারদিক ছিল নিস্তব্ধ, এমন নিস্তব্ধতা যেন শব্দ গিলে খায়। হাতে শুধু লণ্ঠন নয়, আজ তার ব্যাগে ছিল ছোট একটা ক্যামেরা, একটা ডিক্টাফোন আর কিছু কাগজপত্র। বনমালীপুর গ্রাম থেকে ঘাট পর্যন্ত আসার রাস্তাটাও আজ অদ্ভুত নিস্তব্ধ। মনে হচ্ছিল, গাছের পাতাগুলোর মধ্যেও যেন কিছু একটা লুকিয়ে আছে। বন্যপ্রাণীর ভয় তমালকে কখনও তাড়ায়নি, কিন্তু আজ… আজ যেন অদৃশ্য কোনো চোখ তাকে অনুসরণ করছে এই নির্জন পথে। এই প্রথমবার তার পায়ের শব্দে নিজেকেই অপরাধী লাগছিল, কারণ প্রকৃতি যেন আদেশ দিচ্ছে — চুপ করে থাকো।

চন্দ্রবদনী ঘাটের সেই বটগাছ, যার তলায় প্রথমবার গিয়েই তমালের অস্বস্তি হয়েছিল, আজ যেন আরও রহস্যময়। নদীর ধারে দাঁড়িয়ে, সে অপেক্ষা করতে লাগল সেই নৌকার জন্য, যেটি ঠিক সন্ধের পরে আসে। ঘড়ির কাঁটা যখন সাড়ে আট ছুঁলো, ঠিক তখনই দূরে একটা ছায়ামূর্তি দেখা গেল—নৌকা। আর সেই নৌকায় বসে আছে সেই নারী—সাদা শাড়ি, কালো ঘন চুল, মাথা নিচু। মাঝি অবশ্যই সেই আগের মতোই—চুপচাপ, নিঃশব্দে দাঁড় বাইছে। কিন্তু আজ তমাল সিদ্ধান্ত নিয়েছে—এই নৌকায় সে উঠবেই, কারণ সত্যের খোঁজ তার নেশা। নদীর দিকে এগোতেই আশেপাশের বাতাস ভারি হয়ে উঠল, যেন কানের ভেতর দিয়ে হাওয়ার শব্দ ঢুকে যাচ্ছে। সিঁড়ি বেয়ে নেমে, সে নৌকার ধারে দাঁড়াল—মাঝি কোনো কথা বলল না, শুধু চোখ তুলে তাকাল। সেই চোখে কোনো সাদামাটা চাহনি নেই—ছিল ঠাণ্ডা, মৃত আবেগহীনতা।

তমাল নৌকায় পা রাখতেই যেন পুরো পরিবেশ পাল্টে গেল। নদীর জলের রঙ অন্ধকার নীল থেকে ধূসর হয়ে উঠছে, আর আশেপাশের কুয়াশা ঘনীভূত হচ্ছে। মাঝির মুখ দেখা যাচ্ছে না, নারীটি তখনও চুপচাপ বসে আছে, শুধু তার চোখের দৃষ্টি এখন ঠিক তমালের দিকে। ঠোঁটে অদ্ভুত এক অর্ধ-হাসি। তমাল বুঝতে পারল—সে এবার এমন এক জগতের সীমানায় এসেছে, যেখান থেকে ফিরে আসা হয়তো আর সম্ভব না। মাঝি নৌকা চালাতে লাগল—কিন্তু এইবার নদীর জল থমথমে, দাঁড় ছোঁয়ার শব্দ নেই, শুধু অনুভব হচ্ছে সময় থেমে গেছে। হঠাৎ করেই নারীটি বলল, “তোমার নাম তমাল… তুমি কি খুঁজতে এসেছো আমাকে?” তমাল চমকে উঠল—তার নাম জানে সে! এই প্রথম নারী কণ্ঠে সে শুনল সেই গলায় এক ধরনের অনুরণন, যা একাধারে মায়াময় আবার প্রাণহীন।

“তুমি তো জানো না, এই নদীর জল কাদের রক্তে ভেসে যায়…” — মহিলার চোখে তখন যেন শতাব্দীর দুঃখ, কান্না আর প্রতিশোধের আগুন। তমাল প্রশ্ন করল, “তুমি কে? কেন এই ঘাটে নৌকা আসে প্রতিদিন? কোথায় যায় এই নৌকা?” — নারী হেসে উঠল, সেই হাসি যেন গায়ে কাঁটা দিয়ে যায়। “আমার নাম ছিল চন্দ্রবদনী। বহু বছর আগে, আমাকে এই নদীতেই ডুবিয়ে মারা হয়েছিল—ভ্রূণসহ। তারা বলেছিল আমি ‘অপবিত্র’… সেই গ্রামের পুরুষেরা আমাকে উৎসর্গ করেছিল নদীকে শান্ত রাখার নামে। আজ আমি ফিরে এসেছি, একে একে ওদের বংশধরদের ডেকে নিতে।” তমাল বুঝে গেল, এই রহস্য কোনো সাধারণ ঘটনা নয়—এই নারী অতীতের যন্ত্রণা, প্রতারণা ও মৃত্যুর মূর্ত প্রতিচ্ছবি। ঘাট, নৌকা, মাঝি—সব কিছুই এক ভয়ঙ্কর চক্রের অংশ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সে কি এখন সেই চক্রে আবদ্ধ হয়ে গেল? নাকি কোনোভাবে এই অভিশাপ ভাঙা সম্ভব?

আট

চন্দ্রবদনী ঘাটে তখন গভীর রাত। চাঁদের আলো সরু সরু নদীর ঢেউয়ের গায়ে সোনালি রেখা ফেলে যেন রহস্যকে আরো ঘনীভূত করে তুলছে। তমাল কাঁধে টর্চ ও ব্যাগ নিয়ে নৌকার দিকে এগোচ্ছে, আর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে বিজয়, যার মুখে আতঙ্কের ছায়া স্পষ্ট। আজ সে আর তমালকে আটকাল না। তমাল জানে, এই রাতে সেই নারী ফের আসবে, আর তাকে যেতে হবে—একবার অন্তত জানতে হবে কাদেরকে নিয়ে কোথায় যায় এই নৌকা, আর কেন কেউ ফিরে আসে না। নৌকার মাঝি আগের মতোই বসে, মাথা নিচু। তমাল উঠে বসল। এই প্রথম সে নৌকায় উঠল, নারীর পাশেই। সে একবার তাকাল তার দিকে—নারীটি যেন কোনো অনুভূতিহীন মূর্তি। সাদা ধবধবে শাড়ি, ভেজা চুল, চোখদুটি যেন অতল সমুদ্র। কোনো কথা না বলেই মাঝি বৈঠা চালাতে শুরু করল। নদী পার হওয়ার বদলে এবার নৌকাটি বিপরীত দিকে যেতে লাগল—চেনা নদীর ধার গা ঢাকা দিল। মাঝ নদীতে এসে ধীরে ধীরে চারপাশ অদ্ভুত কুয়াশায় ঢেকে গেল। টর্চের আলোও অচেনা অন্ধকারে নিঃশেষ হয়ে যায়।

তমাল নৌকার এক কোণে বসে শ্বাস রোধ করে আছে। নারীটি কোনো কথা বলছে না, শুধু নিঃশব্দে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। হঠাৎ নৌকা থেমে গেল এক অদ্ভুত জায়গায়—নদীর মাঝে একটা ছোট্ট চর, ঘেরা পচা শেওলা, অদ্ভুত গন্ধ। মাঝি কোনো কথা না বলেই নৌকা বেঁধে তমালের দিকে তাকাল—কিন্তু সেই চোখ দুটি মানুষের নয়, যেন মরা চোখ! তমালের গলা শুকিয়ে আসে। সে নামল। চরটায় পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে যেন মাটি নরম হয়ে দুলতে থাকে। হঠাৎ চারদিক থেকে ভেসে আসে কান্নার আওয়াজ। একের পর এক ছায়া ভেসে উঠছে কুয়াশার ভেতর থেকে—কে যেন ফিসফিস করে বলছে, “তুই ফিরবি না… কেউ ফেরে না…”। তমাল চোখ বন্ধ করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নারীটি নামল এবার। তার মুখে একটুও অনুভূতি নেই, যেন সে এই ভূতের ভুবনের এক প্রহরী। তমাল তাকে প্রশ্ন করল, “তুমি কে?” নারীটি হঠাৎ তাকাল, এবার তার ঠোঁটে একটুখানি হাসি খেলে গেল। “আমাকে খুঁজেই তো এসেছ। এখন আমায় চিনবি কেমন করে?” সে হাত বাড়িয়ে দিল তমালের দিকে।

তমাল তার হাত ধরল না। সে পেছনে এক পা হাঁটতেই চরটা যেন ডুবে যেতে শুরু করল। এক তীব্র জলঘূর্ণি তৈরি হলো মাঝখানে। নারীটি ধীরে ধীরে সেই ঘূর্ণির মাঝে এগিয়ে যাচ্ছে। তমাল চিৎকার করে উঠল, “কে তুমি? কেন এই নৌকা?” তখনই নারীটি থেমে বলল, “এই ঘাট ছিল আমাদের অপেক্ষার স্থান। মৃত আত্মারা যেখানে আসে তাদের অসমাপ্ত প্রহর নিয়ে। আমি শুধু তাদের নামিয়ে দিই, কারণ তারা ফিরতে পারে না।” তমাল জিজ্ঞেস করল, “তাহলে আমি?” নারীটি এবার বলল, “তুই বেঁচে আছিস, কিন্তু ঘাটের রহস্য জানলে তোর জীবনে আর আলো থাকবে না।” হঠাৎ ঘূর্ণি নারীকেও গ্রাস করল। মাঝি নৌকায় উঠে বৈঠা চালাতে লাগল। তমাল কিছু না ভেবে ছুটে গিয়ে আবার নৌকায় উঠে পড়ল। নৌকা ঘাটের দিকে ফিরতে লাগল, পিছনে চরটা নিঃশব্দে ডুবে গেল নদীর অতলে।

ঘাটে এসে তমাল এক নিঃশ্বাসে নেমে পড়ল। বিজয় দৌড়ে এল—“বাঁচলি তুই! এতক্ষণ ধরে কেউ তোকে দেখতে পায়নি! ভাবছিলাম তুইও…!” তমাল কিছু বলল না, শুধু নদীর দিকে তাকিয়ে রইল। নারীটি নেই, চরটা নেই—কিন্তু তার ভিতরে যেন চিরস্থায়ী এক ছায়া তৈরি হয়ে গেছে। বিজয় কাঁধে হাত রাখল, “কী দেখলি?” তমাল ফিসফিস করে বলল, “মৃতেরা কোথায় যায়… তা আমরা কখনও জানি না। শুধু জানি কেউ যদি এই ঘাটে অপেক্ষা করে… কেউ না কেউ তাকে নিতে ঠিক আসে।” চন্দ্রবদনী ঘাটে তখন আবার সেই সুনসান বাতাস, নদী শান্ত, কিন্তু গভীর জলের অতলে কি আবারও কোনো নৌকা তৈরি হচ্ছে?

নয়

সন্ধ্যার আলতো আলোটা আজ কিছু বেশি রক্তাভ মনে হচ্ছিল। নদীর জলে রক্তরঙা ছায়া খেলছিল, আর বাতাসে ভেসে আসছিল বাঁশির মতো একটা অদ্ভুত সুর—যা কিনা ঠিক বোঝাও যায় না, অস্বস্তিও দেয় না, অথচ মনে হয় কিছু ডেকে চলেছে, টানছে, টেনে নিচ্ছে অচেনা দিকে। তমাল সেই ঘাটে দাঁড়িয়ে, বুকের মধ্যে একরাশ ধুকপুকানি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। পেছনে শুভদীপ, তার বন্ধু এবং সহকারী, এক পা পিছিয়ে থেকেও তমালের কাঁধের উপর নজর রেখেছিল। হঠাৎ করেই সেই পরিচিত শব্দ—চাপ চাপ বর্শার ছপছপানি, আর সেই ছায়াময় নৌকার আবির্ভাব ঘটল। আজ প্রথমবার, তমাল মনে মনে প্রস্তুত ছিল উঠতে। বহুদিনের গবেষণা, লোককথা, নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজ, সব আজ যেন একটা মোচড় নিতে চলেছে। শুভদীপ তাকে আটকাতে চাইল, বলল, “তমাল, এটা পাগলামি, আমরা প্রশাসনকে বলতে পারি, কিন্তু তুই… নৌকায় উঠবি?” তমালের জবাব ছিল নীরব এক চাহনি—যেখানে ভয় ছিল, কিন্তু কৌতূহল তার চেয়েও প্রবল।

নৌকায় চড়ার সেই মুহূর্তে, সময় যেন থমকে দাঁড়িয়েছিল। মাঝির মুখ ঢেকে রাখা, ঝুলে থাকা গামছা তার চোখ-মুখকে অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখেছে, যেন মুখটাই নেই। কিন্তু তার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা ক্ষীণ হাসি—তা একেবারে মানবিক ছিল না। নৌকার ভেতরে সেই নারী—দীর্ঘ কালো চুল, সাদা শাড়ি, আর চোখদুটো—যা জলের মতো স্থির, অথচ গভীরে টানে। তমাল বসে পড়ল তার সামনে, মুখোমুখি। নৌকা ধীরে ধীরে নদীর বুকে ভেসে চলল—কিন্তু আজ নদীর চরিত্র অন্যরকম। শব্দ নেই, বাতাস নেই, কোনো কুলকুল ধ্বনি নেই। কেবল চারপাশ ঘিরে থাকা কুয়াশা আর জলের ধূসর ছায়া। হঠাৎ নারীটি কথা বলল, “তুমি জানো তুমি কেন এসেছো?” তমাল ধরা গলায় বলল, “হ্যাঁ। জানতে এসেছি, কেন এই নৌকা থেকে কেউ ফিরে আসে না।” সে হাসল—হাসি নয়, যেন বাতাসের শোঁ-শোঁ শব্দ। “কারণ যারা ফিরে আসে, তারা বেঁচে থাকে না, তারা আর মানুষ থাকে না।”

নৌকা যেন একটা অচেনা নদীপথে ঢুকে পড়ল। বাঁ দিকটা যেন বিলুপ্ত কোনো পল্লীর ধ্বংসাবশেষ—ভাঙা ঘর, কুঁড়েঘর, পোড়া গাছ, আর মাঝে মাঝে একজোড়া চোখ দেখা যাচ্ছে জানালার ফাঁক দিয়ে। কেউ যেন একেবারে মুখোমুখি তাকিয়ে আছে, কিন্তু মানুষের চোখ নয়, ভয়ংকর কোনো জন্তু কিংবা আত্মার চাহনি। তমালের গলা শুকিয়ে আসছে। “এইসব কী?” সে জিজ্ঞেস করল। নারী বলল, “এইখানেই শেষ হয় যাত্রা। এখানে যারা আসে, তারা নিজেদের সত্য ভুলে যায়। নাম, পরিচয়, দেহ—সব ছুঁড়ে ফেলে, কারণ এখানে মৃতেরা শ্বাস নেয়। আর তুমিও…” কথাটা শেষ করার আগেই তমাল টের পেল তার শরীর ভারী হয়ে আসছে। চোখে ঝাপসা পড়ছে। শুভদীপ দূরে ঘাট থেকে কাঁদতে কাঁদতে ডাকছে, “তমাল! ফিরে আয়, তুই তো মানুষ!” কিন্তু সেই ডাক ক্রমে ক্ষীণ, আরও ক্ষীণ হয়ে মিলিয়ে যেতে লাগল।

তমাল হঠাৎ বুঝতে পারল, সে যদি এখনই কিছু না করে, তাহলে তার চেতনা চিরতরে হারিয়ে যাবে। সে পকেট থেকে বের করল সেই পুরোনো মণি—যেটা এক বৃদ্ধা তাকে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, “ভয় পেলে, এটা মুঠোয় রাখিস।” মণিটার উষ্ণতা আচমকা তার রক্তে ছড়িয়ে পড়ল। সে উঠে দাঁড়াল, কাঁপতে কাঁপতে বলল, “আমার নাম তমাল, আমি মরিনি। আমি এসেছি সত্য জানতে, হারিয়ে যেতে নয়!” সেই নারী এবার রেগে উঠল। তার চোখ লাল হয়ে উঠল, কণ্ঠস্বর ঘূর্ণির মতো গর্জে উঠল, “তুমি ফিরে যেতে পারো না। তুমি আমাদের মধ্যে একজন হয়ে গেছো।” কিন্তু সেই মুহূর্তেই, নদী যেন রাগে ফুঁসে উঠল, কুয়াশা ফেটে গিয়ে আলোর রেখা তৈরি করল। তমাল সেই আলো লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিল নৌকা থেকে, এবং তার চারপাশে হঠাৎ সব অন্ধকার মিলিয়ে গেল।

দশ

তিনদিন ধরে তমাল নিখোঁজ। শান্তিপুর থানা থেকে বারবার খোঁজ নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু জয়নগরের নির্জন ঘাটের লোকজন জানাচ্ছে—ওই রাতে তমাল নৌকা ধরেছিল। শুধু এক বৃদ্ধ মাঝি তাকে দেখে বলেছিল, “ওই নৌকায় আর কেউ ওঠে না হে… ওটা তো দেউলভেড়ার নৌকা।” পাড়ের কুয়াশার পেছনে নৌকাটা মিলিয়ে গিয়েছিল, তমালও। খবরের কাগজে এক লাইনের রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল, “স্থানীয় গবেষক নিখোঁজ, তদন্তে পুলিশ।” কিন্তু স্থানীয়দের মুখে-মুখে ছড়িয়ে গেল পুরোনো কথাটা নতুন করে—“যে নৌকায় সেই নারী চুপচাপ বসে থাকে, তা ফেরে না।” ঠিক সেভাবেই যেন তমালও এক নতুন গাঁথার অংশ হয়ে গেল।

ঘটনার সাতদিন পর তমালের রেকর্ড করা অডিও একবার বাজিয়ে শুনল জহর। চন্দ্রবদনী ঘাটের বাতাস, গঙ্গার ঢেউ, আর মাঝে মাঝেই একটি নারীকণ্ঠ—যেন কিছু বলছে, আবার যেন কিছু নয়। সেই কণ্ঠটা কেমন যেন করুণ, ডেকে নেওয়ার মতো। “তমাল, ফিরে এসো…”—একবার স্পষ্ট বলে ওঠে। জহরের শরীর শিউরে ওঠে। অডিও ফাইলটাই কোথা থেকে এসেছে, সে জানে না। হয়তো তমালের মুঠোফোন থেকে ক্লাউডে আপলোড হয়েছিল, আবার হয়তো কোনো অলৌকিক বার্তা। সেই ফাইল এখন বহুজন শুনেছে—যাঁরা বিশ্বাস করেন, ঘাটে এখনও সেই নারী অপেক্ষায় থাকেন, তাঁরা বলেন—“তমাল চলে গেছে, এখন ওরাই দু’জনে একসঙ্গে নৌকায় বসে আছে, আর কেউ গেলে সেই নৌকা আবার ফিরে আসবে।”

তমালের খাতায় পাওয়া শেষ নোটে লেখা ছিল—
“আমার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। চারদিক কুয়াশায় ভরে যাচ্ছে। নৌকোটা চলেছে… আমি জানি না গন্তব্য কোথায়, শুধু জানি ওই নারীর চোখের দিকে তাকাতে পারছি না। যেন অনেক যুগের শোক জমে আছে তাতে। আমি ভেবেছিলাম সব যুক্তি দিয়ে বুঝে নেব, কিন্তু হয়তো কিছু রহস্য যুক্তির বাইরে থাকে। যদি কেউ এই খাতা পায়, তাদের বলি—ঘাটে যেও না। ওখানে এখন শুধু সময় থেমে আছে।”

আজও সন্ধ্যা নামলে চন্দ্রবদনী ঘাটে কেউ-কেউ দাঁড়িয়ে থাকে, দূর থেকে তাকিয়ে দেখে—একটা নৌকা ধীরে ধীরে ভেসে আসে কুয়াশার ভেতর দিয়ে। তাতে এক নারী বসে থাকে—চুপচাপ, নিঃশব্দ। মাঝখানে বসে থাকে আরেকজন—সাদা পাঞ্জাবি গায়ে, মুখে ছাপ কৌতূহলের, কিন্তু চোখে অদ্ভুত বিষাদ। তারা কারও দিকে তাকায় না। শুধু মাঝি বলে ওঠে, “চলে যাবেন?” এবং কেউ যদি সেই প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলে… তবে, সে আর ফিরে আসে না। তখন আর লোকেরা প্রশ্ন তোলে না, শুধু বলে, “আর একটা নাম যোগ হল কাহিনিতে…”

শেষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *