মৈনাক ভৌমিক
১
পুরুলিয়ার চন্দনবন — নামটি আজও অনেকের কাছে অজানা, যদিও লোকমুখে ছড়িয়ে থাকা বহু গল্পের কেন্দ্রবিন্দু এই অরণ্য। পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তঘেঁষা এই অঞ্চলটি আদিবাসী জনপদের আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা ঘন জঙ্গলে ভরপুর, যেখানে আজও সূর্যাস্তের পর কেউ একা পথ মাড়ায় না। অথচ সেখানেই, এক শতাব্দী পুরনো ব্রিটিশ জরিপ মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া এক দাগচিহ্ন—“K.T. Akhra (Abandoned)”—ডঃ ঋত্বিক বসুর চোখে পড়ে। বহুদিন ধরে প্রাচীন ভারতীয় তন্ত্রচর্চা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে আসা এই প্রত্নতত্ত্ববিদ তার টিম নিয়ে রওনা দেন চন্দনবনের উদ্দেশ্যে। তাঁর দলের সঙ্গে ছিলেন ইতিহাসের গবেষক ইরা সেনগুপ্ত, ফিল্ড কো-অর্ডিনেটর অভীক মণ্ডল, তথ্যলিপিকার তৃষা দে এবং স্থানীয় গাইড হিসেবে নিযুক্ত হন নিতাই মাহাতো, যিনি আদিবাসী পরিবার থেকে উঠে আসা এক প্রবীণ অথচ প্রচণ্ড অভিজ্ঞ জঙ্গলচেনা মানুষ। রওনা হওয়ার আগেই নিতাই সাবধান করে বলেন, “ওই জায়গার নিঃশ্বাসেও মৃত্যু আছে… কেউ টিকতে পারে না বেশিদিন।” কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিশ্বাস হারানো দলের কেউ তেমন গুরুত্ব দেননি কথাটিকে। যাত্রার দ্বিতীয় দিনেই তাঁরা পৌঁছান সেই স্থানটিতে—যেখানে ঝোপঝাড়ের আড়ালে ঢাকা ছিল এক অর্ধভগ্ন ইটের গাঁথুনি, মাটি চেরা এক গোলকধাঁধার মতো ঘেরাটোপ, এবং এক কেন্দ্রীয় গহ্বর, যা দেখে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকেন ডঃ ঋত্বিক। তাঁর অনুভব—এই গহ্বরই ছিল সেই তান্ত্রিক আখড়ার হৃদয়, যেখানে কৃষ্ণানন্দ অঘোরী তাঁর গোপন সাধনায় লিপ্ত থাকতেন।
খননকাজ শুরু হয় পরদিন সকাল থেকে। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে যখন তারা গহ্বরের কেন্দ্রে পৌঁছান, তখনই প্রথম ধরা পড়ে অস্বাভাবিক এক দৃশ্য। একটি অর্ধদগ্ধ কাঠের পাটাতন, যার নিচে পাওয়া যায় কালো রঙের পোড়ামাটির পাত্র, কয়েকটি কঙ্কালের টুকরো এবং সবশেষে—একটি সম্পূর্ণ মানব কঙ্কাল। কিন্তু এটি যে সাধারণ কোনও মৃতদেহ নয়, তা পরিষ্কার বোঝা যায় তার মুদ্রা থেকে—শরীর বসা অবস্থায়, দুই হাত চক্রাকারে বুকে ভাঁজ করা, আর মাথার চারপাশে আঁকা অশুভ চিহ্ন। মুখটা যেন কোনও চিৎকারে থেমে গেছে, ফাঁকা চোখের কোটরে জমে থাকা মাটি যেন কথাও বলতে চায়। অভীক কৌতূহলবশত সেই কঙ্কালের মাথার খুলি উঁচু করে তুলতেই এক অদ্ভুত ঠান্ডা হাওয়া চারপাশে বয়ে যায়। গহ্বরের আলো যেন এক নিমিষে ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে। ইরা ছবিগুলো তুলতে তুলতে ফিসফিস করে বলে ওঠে, “এটা কী হতে পারে? এত নিখুঁতভাবে সংরক্ষিত!” ডঃ ঋত্বিক যদিও তখনও সবকিছুকে ‘ঐতিহাসিক ধর্মীয় প্রতীক’ বলেই ব্যাখ্যা দেন। তবে পরের ঘটনাগুলোতে তার যুক্তিবাদ ধাক্কা খেতে শুরু করে। সন্ধ্যায় ক্যাম্পে ফিরে এসে তৃষা ক্যামেরা চেক করতে গিয়ে দেখে, ঠিক ৩:১৫ মিনিটে তোলা একটি ছবিতে ঝাপসা ছায়ামূর্তি, যেন কেউ গহ্বরের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে—যার শরীর নেই, কেবল ছায়া।
রাত্রি বাড়তেই আরও অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকে। ক্যাম্পের চারপাশে শুরু হয় কুকুরের হুংকার, অদ্ভুত শোঁ শোঁ আওয়াজ, আর দূরের গাছের ফাঁক দিয়ে যেন কারও নড়াচড়া। অভীক যিনি কঙ্কালটি প্রথম স্পর্শ করেছিলেন, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন—তার মুখ থেকে অনর্গল কিছু অচেনা ভাষায় শব্দ বেরোতে থাকে ঘুমের মধ্যে। পরদিন সকালে দেখা যায় অভীকের হাত পুড়ে গেছে, যদিও আগুন কোথাও লাগেনি। নিতাই মাহাতো তাঁকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বলেন, “আপনারা কিছু খুলে ফেলেছেন যা ঘুমাচ্ছিল।” ডঃ ঋত্বিক প্রথমবারের মত চুপ করে যান। ঐ সন্ধ্যায় আখড়ার ধ্বংসাবশেষ ঘিরে রাখার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সেই রাতেই ঘটে এমন এক ঘটনা, যা গোটা অভিযানের গতিপথ বদলে দেয়—ভোররাতে এক আতঙ্কিত চিৎকারে সবাই ঘুম ভাঙে। গহ্বরের কেন্দ্রস্থলে দেখা যায়, কঙ্কালটি তার আগের অবস্থানে নেই। মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে তার হাড়গুলো, আর মাঝখানে এক সর্পিল আঁকাবাঁকা মাটির দাগ—যা দেখে ইরার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। সে বলে, “এটা তো প্রাচীন পঞ্চতত্ত্ব বৃত্তের ছায়া… তান্ত্রিক মণ্ডল! এটা যদি জেগে ওঠে…” তার বাক্য অসমাপ্ত থাকে। চন্দনবনের নিঃশব্দ জঙ্গলে যেন আবারও কিছু জেগে উঠছে, ধীরে ধীরে, অদৃশ্য শরীর নিয়ে, কঙ্কালের হাত ধরে, তন্ত্রের জগতে ফিরতে প্রস্তুত।
২
সকালের আলোয় যখন গহ্বরের মাটি থেকে সরিয়ে রাখা সেই কঙ্কাল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়, তখন সবার মধ্যে একরকম নিঃশব্দ আতঙ্ক নেমে আসে। ডঃ ঋত্বিক প্রথমে ভাবলেন কোনও বন্যপ্রাণী হয়তো রাতে ঢুকে পড়েছিল খননস্থলে, কিন্তু সেই ভাবনাও মাটি হয়ে যায় যখন ইরা তার ল্যাপটপে ক্যামেরার রাত্রিকালীন ফুটেজ চালায়। ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যায়, গভীর রাতের ঠিক ৩:১৫ মিনিটে কঙ্কালটি নিজে নিজেই নড়ে ওঠে—প্রথমে তার ডান হাত, তারপর গোটা শরীর। কোনও অশরীরী ঠাণ্ডা বাতাস যেন গহ্বরের ভেতর ঘোরাফেরা করে, এবং ঠিক ভিডিও শেষ হবার আগ মুহূর্তে ক্যামেরার লেন্স ঝাপসা হয়ে যায়—এক মুহূর্তের জন্য যেন কারও মুখ কাছে এসে দাঁড়ায়, তারপর নিঃসাড় অন্ধকার। ডঃ ঋত্বিক অবিশ্বাসে চুপ করে যান, কপালে হাত ঠেকিয়ে বসে থাকেন। অভীক, যিনি এখনও অর্ধ-জ্ঞান অবস্থায়, বিছানার চাদরে আঁকিবুঁকি কেটে যাচ্ছেন আঙুলের ডগায়। সেই আঁকিবুঁকিগুলোর মধ্যে কয়েকটি অদ্ভুত সাদৃশ্য খুঁজে পায় তৃষা—তা প্রাচীন তান্ত্রিক চিহ্নের সঙ্গে মিলে যায়, যেগুলি সাধারণত মৃতদেহ সংরক্ষণ বা আত্মা ধরে রাখার মন্ত্রে ব্যবহৃত হতো। নিতাই মাহাতো এক কোণে বসে মাথা নাড়েন, যেন যা হওয়ার ছিল তা শুরু হয়ে গেছে।
এদিন দুপুরেই ইরা ও তৃষা পুরাতন কাঠ ও পোড়ামাটির পাত্র খতিয়ে দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করেন এক রহস্যময় তাম্রলিপি। সেই লিপিতে প্রাচীন বাংলা ও সংস্কৃতের এক মিশ্র ভাষায় খোদাই করা কয়েকটি বাক্য—“জন্মহীনের মন্ত্রে যাহার হাড় সংরক্ষিত, তাহার প্রাণও নিষ্প্রভ নয়। বীজে বন্দি, কালের প্রহরে পুনরাবির্ভূত।” ইরা ব্যাখ্যা করে বলেন, এটি সম্ভবত একটি ‘আত্মাবন্ধ’ মন্ত্র—যেখানে শরীর পচে যায় কিন্তু আত্মা রয়ে যায় এক সীমার মধ্যে বন্দি, অপেক্ষায় থাকে পুনর্জন্মের চক্রের। ঋত্বিক যদিও আবারো এটিকে একটি ধর্মীয় রূপক হিসেবে ব্যাখ্যা করতে চান, কিন্তু তার ভিতরের যুক্তিবাদী মন ধীরে ধীরে চুপ হয়ে যাচ্ছে। সেই রাতেই আবার ঘটে নতুন এক বিস্ময়। তৃষা ঘুম ভাঙার পর চিৎকার করে ওঠে, কারণ তার পিঠের নিচে বিছানায় আঁকা ছিল এক জ্বলন্ত ত্রিভুজ—যা ত্বকে ছেঁকা পড়ার মত লাল দাগ রেখে গেছে, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে আশপাশে আগুনের কোনও চিহ্ন নেই। ক্যাম্পে থাকা সকলে এবার বুঝতে পারে, এ শুধু অতীতের মৃত কোনও তান্ত্রিকের হাড় নয়—এ এক জীবন্ত বৃত্তে বন্দি শক্তি, যার জাগরণ শুরু হয়েছে তাদের অজ্ঞাতসারে।
নিতাই তখন মুখ খোলে, খুব ধীর কণ্ঠে বলে, “এই আখড়ার নাম ছিল কঙ্কালতন্ত্র পীঠ। এখানেই কৃষ্ণানন্দ অঘোরী তার শেষ সাধনা করেছিল। ও চাইতো মৃত্যুর পরেও যাতে আবার ফিরে আসা যায়, নতুন শরীরে প্রবেশ করে আবার তন্ত্রজগতে রাজত্ব করা যায়। আপনাদের কেউ একজন হয়তো সে শরীর হতে চলেছে।” এই কথায় ক্যাম্পে নেমে আসে হিমশীতল নীরবতা। কেউ কিছু বলে না, কেউ চোখে চোখ রাখে না। অভীক তখন বিছানায় আধচোখে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “আমি দেখেছি ওকে… সে পাঁজরের ফাঁক দিয়ে আমাকে দেখতে পায়… ওর মুখটা নেই, শুধু গর্ত, আর গর্তের ভিতর আগুন।” সেই রাতের পর কেউ একা ঘুমায় না, কেউ কঙ্কালের কাছে যায় না, আর কেউ বিশ্বাস রাখতে পারে না এ শুধু ‘ঐতিহাসিক খনন অভিযান’। যে গহ্বরটি ছিল একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান, তা যেন এখন পরিণত হয়েছে একটি জীবন্ত, নিশ্বাস নেয়া, অশরীরী অস্তিত্বের আখড়ায়—যার তন্ত্রের ছায়া এবার ছড়িয়ে পড়ছে জঙ্গলের ঘন অন্ধকার থেকে মানব শরীরের মধ্যেও।
৩
ইরার হাতে পাওয়া তাম্রলিপিটি ছিল খানিকটা ঘষা, জং ধরা ও অর্ধেক ভাঙা, কিন্তু তাতে খোদাই করা প্রতিটি অক্ষর ছিল যেন সময়কে চ্যালেঞ্জ করে টিকে থাকা এক অভিশপ্ত বার্তা। রাত্রির নিঃশব্দে, কেরোসিন ল্যাম্পের আলোয়, সে ও তৃষা মিলে অক্ষরগুলোর অনুবাদে লেগে পড়ে। কিছু শব্দ তাদের অপরিচিত, কিছু আবার চন্দ্রবিন্দুর মত ঘুরপ্যাঁচানো। “বীজে নিহিত, শরীরমুক্ত, চক্রে পূর্ণতা” — এই বাক্যগুলো বারবার পুনরাবৃত্ত হচ্ছিল। ইরার গবেষণালব্ধ জ্ঞানে মনে হল, এটি কোনও আত্মাবন্ধ বা পুনর্জন্মকামী তান্ত্রিকের রচনাকর্ম, যেটির মূল উপজীব্য হল ‘কর্মজ শুদ্ধতা’ না থাকা সত্ত্বেও, আত্মাকে পৃথিবীতে বেঁধে রাখা। সেই বীজমন্ত্র ছিল একটা গহীন স্তরের ধ্বনি-তাল, যেটি মানুষের বোধগম্যতার বাইরে। তৃষা একটু ভয়ে বলল, “আমরা কি এই বীজমন্ত্র জাগিয়ে ফেলেছি?” ইরা চুপ করে রইল, কিন্তু ভিতরে ভিতরে অনুভব করল—তারা কেবল জাগায়নি, বরং সেই মন্ত্র এখন তাদের মধ্যেই প্রবাহিত হতে শুরু করেছে। রাত গভীর হতেই আবার শুরু হয় অদ্ভুত শব্দ, গহ্বরের দিক থেকে যেন কেউ মাটি আঁচড়ে চলেছে, বাতাসে ভেসে আসে পোড়া মাংসের গন্ধ। অভীক ঘুমের মধ্যে উচ্চারণ করতে থাকে সেই মন্ত্র—যেটি কেউই কখনও উচ্চারণ করেনি। ঘুমন্ত অবস্থায় তার কণ্ঠ থেকে ভেসে আসে এক ভয়াবহ সুর: “ওঁ ক্রাঁ কঙ্কালেশ্বরায় নমঃ…” ইরার গায়ে কাঁটা দেয়।
সকালের আলোয় ঋত্বিক এবার কঙ্কালটিকে আবার পরীক্ষা করতে মন দেন। তিনি লক্ষ্য করেন, কঙ্কালের কপালে একটি সূক্ষ্ম খোদাই—একটি ত্রিকোণ যার মাঝে আগুনের প্রতীক। সেটি আগের দিন তারা কেউই খেয়াল করেনি। আর আশ্চর্যজনকভাবে, কঙ্কালটির হাড় এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি উজ্জ্বল, যেন ভেতর থেকে আলো ছড়াচ্ছে। নিতাই মাহাতো তখন একটা ছোট্ট কাপড়ে মোড়া পুরনো মুড়ির মত কিছু বের করেন, বলেন, “আমার ঠাকুরদা এটা রেখে গিয়েছিলেন… বলেছিলেন কঙ্কালতন্ত্রী যদি জেগে ওঠে, এই হাড়ের গুঁড়ো আগুনে দিতে হবে। না দিলে সে শরীর খুঁজে পাবে।” কিন্তু গুঁড়োর রং দেখে ইরা বুঝতে পারে—এটা সাধারণ কিছু না, সম্ভবত কোনও পূর্বতন সন্ন্যাসীর হাড় ভষ্ম, যা প্রতিরোধের উপকরণ হিসাবে রাখা হতো। ঠিক সেই সময়ে ক্যাম্পে আবার দেখা দেয় আতঙ্ক—তৃষার মুখে দেখা যায় তিনটি কালো দাগ, যার বিন্যাস সেই একই ত্রিকোণ। তার মনে কিছু নেই, অথচ সে বলল, “আমি একটা সিঁদুর-মাখা গুহার মধ্যে ছিলাম, সেখানে কেউ বসে ছিল কঙ্কালের পাশে। আমার নাম নিয়ে ডেকেছে।” সবার মধ্যে তখন স্পষ্ট ধারণা জন্মায়—তৃষাই হতে পারে সেই ‘নতুন শরীর’ যাকে কৃষ্ণানন্দ বেছে নিয়েছে। ঋত্বিক সিদ্ধান্ত নেন কঙ্কালটিকে মাটির নিচে ফের পুঁতে রাখার, কিন্তু তখনই আবার হঠাৎ ঝড় উঠে যায়, এবং এক নিমিষে ক্যাম্পের চারপাশ অন্ধকারে ডুবে যায়, যেন কোনও শক্তি চায় না কঙ্কালকে মাটি চাপা দেওয়া হোক।
সন্ধ্যায় নিতাই পুরুলিয়ার এক প্রাচীন গাঁথা শোনান—এক তান্ত্রিক, যে মৃত্যুকে অস্বীকার করে জীবনের বাইরে আত্মাকে বেঁধে রাখে, তার শরীর নষ্ট হলেও কঙ্কাল অক্ষত থাকে। তার পুনরাগমন ঘটে শতাব্দী পরে, যখন কোনও ব্যক্তি সেই কঙ্কাল স্পর্শ করে। ঋত্বিক এবার নিজের ধারণায় ধাক্কা খায়—তিনিই অনুমতি দিয়েছিলেন অভীককে কঙ্কাল তুলতে। ইরা বলে, “আমরা হয়তো ভুল জায়গায় খুঁড়েছি… কিন্তু সঠিক জিনিস জাগিয়ে ফেলেছি।” সেই রাতটা ছিল আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষ, আর তান্ত্রিক গ্রন্থ অনুযায়ী, এই রাতেই ‘জাগ্রত কঙ্কাল’ সর্বাধিক শক্তিশালী হয়। ক্যাম্পে বসে থাকা সকলের মধ্যে তখন এক নিঃশব্দ চুক্তি হয়—এটা আর কেবল প্রত্নতত্ত্বের অভিযান নয়, বরং আত্মার যুদ্ধ, জীবিতদের শরীর আর মৃতের তন্ত্রের মধ্যে এক নিঃশ্বাসে বাঁধা লড়াই। কেউ কিছু বলে না, কিন্তু জানে—আগামী রাতেই শুরু হতে পারে আসল যুদ্ধ, যেখানে কেউ হয়তো ফিরতে পারবে না।
৪
রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চন্দনবনের নিস্তব্ধতা যেন গা ছমছমে অশান্তিতে পরিণত হতে লাগল। ক্যাম্পে কেউ আর নিশ্চিন্তে শুয়ে নেই। অভীককে নিয়ে সকলের উদ্বেগ চরমে উঠেছে। সে দিনের পর দিন ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়ছে—মুখ শুকিয়ে গেছে, চোখ কোটরে ঢুকে গেছে, আর তার কথা ও আচরণ ধীরে ধীরে এক অচেনা ছায়ামূর্তির মতো হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে রাতের বেলায় সে বিড়বিড় করে এমন সব শব্দ বলে যা কারোর পক্ষে বোঝা যায় না—কিন্তু সেই শব্দগুলোর ছন্দ, উচ্চারণ, ও ধ্বনি শুনে ইরার মনে পড়ে যায় তাম্রলিপির সেই অমোঘ বীজমন্ত্র। তৃষা তাকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে, কিন্তু অভীক মাঝেমধ্যে তার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকায়—যেন সে তৃষার মধ্যে কিছু খুঁজছে, কিছু চিহ্ন মিলিয়ে নিচ্ছে। নিতাই মাহাতো ক্যাম্প থেকে দূরে দূরে থাকছে, মাঝে মাঝে গিয়ে গহ্বরের চারপাশে চুন-গোলাপজল ছিটিয়ে আসে, মুখে গুনগুন করে কোনো আঞ্চলিক মন্ত্র। সে বলে, “এখনও সময় আছে… একটা আত্মা জেগে উঠেছে, কিন্তু সম্পূর্ণ প্রবেশ করতে পারেনি… যদি এরা কাউকে নিয়ে যেতে পারে, তবেই সে সম্পূর্ণ মুক্ত হবে।” ডঃ ঋত্বিক তখনও ঘটনাগুলিকে যুক্তির ফ্রেমে ধরতে চাইছিলেন, কিন্তু তার নিজের শরীরও ক্লান্ত ও দুর্বল হয়ে পড়ছিল—রাতের ঘুমে স্বপ্ন নয়, যেন জীবন্ত দুঃস্বপ্ন দেখা দিচ্ছিল। সেই স্বপ্নে, তিনি নিজেকে দেখতেন এক পাথরের ঘরে বসে, সামনে এক কঙ্কাল যার মুখে দাহন চিহ্ন, সে বলছে—“আমি শেষ হইনি। আমি শুরু।”
তারপর আসে সেই ভোর—যে ভোর বদলে দেয় পুরো অভিযানের চেহারা। ভোর ৪টা নাগাদ ক্যাম্পের এক প্রান্ত থেকে তৃষার চিৎকার ভেসে আসে। সবাই ছুটে গিয়ে দেখে—অভীকের খাট খালি। তার কম্বল, তার ব্যাগ, তার জিনিসপত্র যেমন ছিল, তেমনই রয়েছে—কেবল নেই সে নিজে। আশপাশে খোঁজাখুঁজির পর নিতাই গহ্বরের দিকে দৌড়ে যায়, আর বাকিরা তার পিছু নেয়। গহ্বরের কেন্দ্রস্থলে—যেখান থেকে কঙ্কালটি তোলা হয়েছিল—সেই জায়গাতেই অভীককে পাওয়া যায়। কিন্তু সে তখন জীবিত নয়। তার দেহ মাটিতে বসা অবস্থায়, চোখ খুলে রয়েছে, মুখে যেন অবর্ণনীয় আতঙ্ক জমে আছে, ঠোঁট ফাঁক হয়ে কাঁপছিল হালকা বাতাসে। তার চারপাশে ছাই ছড়ানো, ছাইয়ের মধ্যে আঁকা রয়েছে একটি তান্ত্রিক চক্র—যার প্রতিটি রেখা মাটি থেকে উঁচু হয়ে আকাশে মিলিয়ে গেছে। তার কপালে লাল রঙের একটি প্রতীক, ঠিক সেই ত্রিভুজ যা কঙ্কালের কপালে ছিল। তৃষা হঠাৎ হাঁটু ভেঙে পড়ে যায়, তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে দমবন্ধ করা কান্না। ইরা তখনো কিছু বুঝে উঠতে পারছে না, কেবল একটাই চিন্তা তার মাথায় ঘুরছে—অভীক কি নিজে এখানে এসেছে? না কি কেউ তাকে টেনেছে? তার মৃত্যুর কোন শারীরিক চিহ্ন নেই, কোন রক্তপাত, বিষক্রিয়া বা ঘা নেই—কিন্তু চেহারাটা যেন মৃতর নয়, বরং এমন এক আত্মার বাহক যে কিছু দিয়ে গিয়েছে, কিছু পেয়েছে, কিছু ছেড়ে দিয়ে গেছে।
ঋত্বিক সেই মুহূর্তে নিজেকে চূড়ান্ত ব্যর্থ মনে করলেন—একজন সহকর্মী হারালেন, একজন মানুষ যাকে তিনি বহু বছর ধরে চিনতেন। কিন্তু তার চাইতেও বেশি তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছিল সেই সত্য, যে এই মৃত্যুর ব্যাখ্যা তার কাছে নেই। পুলিশে খবর দেবার পর ওসি সুব্রত পাল ঘটনাস্থলে পৌঁছান। তিনি অভীকের দেহ পরীক্ষা করে বলেন, “এটা আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনা না—কিন্তু এটা খুনও নয়। এমন দেহভঙ্গিমা আমি আগে কোনও মৃতদেহে দেখিনি।” তৃষা তখনও সংজ্ঞাহীন, আর ইরা খাতা ও ল্যাপটপে সমস্ত কিছু নোট করতে শুরু করে। তার লক্ষ্য একটাই—এই মৃত্যু যেন শুধু হারিয়ে না যায় রিপোর্টে, বরং এ যেন এক প্রমাণ হয়ে দাঁড়ায় ইতিহাসের সামনে। কিন্তু সেই মুহূর্তে কঙ্কালটির হালকা নড়াচড়া তাদের নজর এড়িয়ে যায়—যেন অভীকের আত্মা দিয়ে সে আরও কিছু পাওয়ার শক্তি সঞ্চয় করছে। আর দূরের জঙ্গলে, বাতাসে মিশে যায় এক অজানা কণ্ঠ—ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে ওঠা এক কণ্ঠস্বর, যেন বলছে, “একজন যথেষ্ট নয়… পূর্ণতা চাই…”
৫
আকাশে গাঢ় কালো মেঘ জমে উঠছিল, যেন চন্দনবনের মাটির নীচে ঘুমন্ত কোনো অতীত আজ ফুঁসে উঠতে চলেছে। বিক্রম, পূর্ণিমা এবং অর্ঘ্য মিলে ওই দিন বিকেলে পুরনো শিবমূর্তির গায়ে খোদাই করা প্রতীকের উৎস সন্ধান করতে গিয়েছিল। কাঠ আর পাথরের মাঝখানে লুকিয়ে থাকা এক ফাটলে তারা এক ভাঙা ধূপদানি দেখতে পায়, যার গায়ে লেখা ছিল প্রাচীন লিপিতে—”স্মশানবায়ুর প্রবেশ নিষিদ্ধ”। বিক্রম উৎসাহী হয়ে পড়ে। “এটা নিছক কোনো ধর্মীয় সাবধানবাণী না,” সে বলল, “এটা হয়তো কোনো প্রতিরক্ষা—কোনো কিছু আটকানোর জন্য।” সেই রাতেই ক্যাম্পে ফিরেই সে ধূপদানিটি পরিষ্কার করে গবেষণা শুরু করে, এবং মধ্যরাতে যখন সবার ঘুম ভেঙে যায় এক প্রচণ্ড ঝড় আর এক সঙ্গে জ্বলে ওঠা ল্যাম্পের আলোয়, তখন তাঁবুর বাইরে দেখা যায়, বনভূমির ভেতর থেকে এক ধোঁয়াটে ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে।
সেই রাতে পূর্ণিমা অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখে—সে দেখে একজন অর্ধনগ্ন, রক্তমাখা তান্ত্রিক মাটি খুঁড়ে কোনো কিছু বের করছে, আর চারপাশে ছড়িয়ে আছে মানুষের কঙ্কাল, চোখে ভয়ংকর উন্মাদনা। ঘুম ভাঙার পর সে দেখে, তার হাত রক্তে মাখামাখি। জ্ঞান হারানোর ঠিক আগে তার চোখে পড়ে, ক্যাম্পের পাশে থাকা গাছগুলোতে যেন কেউ মানুষের খুলি ঝুলিয়ে রেখেছে। পরদিন সকালে সেই জায়গায় গিয়েও তারা কিছুই খুঁজে পায় না, কিন্তু বনের ভেতর থেকে ভেসে আসে কণ্ঠরুদ্ধ এক নারীকণ্ঠের হাহাকার। বিক্রম বুঝতে পারে, এটি কোনো স্বাভাবিক প্রাকৃতিক অভিজ্ঞতা নয়—চন্দনবনের বুকে লুকিয়ে থাকা কোনো শক্তি জেগে উঠেছে। অর্ঘ্য প্রস্তাব দেয়, “আমরা যতক্ষণ না বুঝছি, এটা কার আত্মা বা কী তান্ত্রিক শক্তি, ততক্ষণ আমাদের এখান থেকে না যাওয়াই ভালো—নইলে সেটা আমাদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়বে।”
দলের চতুর্থ সদস্য নিধি, যিনি ইতিহাসবিদ ও মৃতসভ্যতা নিয়ে কাজ করেন, তিনি রাত্রিবেলা নিঃশব্দে ধূপদানি ও খোদাই করা প্রতীকগুলোর পাশে ধ্যানস্থ হন। হঠাৎ তার শরীর কাঁপতে শুরু করে, মুখ দিয়ে বেরোয় এক অজানা ভাষার মন্ত্র। বাকিরা এগিয়ে গিয়ে দেখে, তার চোখ সম্পূর্ণ সাদা, আর মুখ দিয়ে শুধু একটি শব্দই বার বার বেরোচ্ছে—”কঙ্কালতন্ত্রী, কঙ্কালতন্ত্রী…”। বিক্রম তখন তার ল্যাপটপে খুঁজতে থাকে পুরুলিয়ার কিংবদন্তি—এক শতাব্দী আগের এক তান্ত্রিক, যার নাম ছিল ভৈরবপদ, যিনি মৃত্যুর পরেও নিজের আত্মাকে বাঁধা রেখে গিয়েছিলেন এক বিশেষ কঙ্কাল-যন্ত্রে। পূর্ণিমা বুঝতে পারে, তাদের হাতে থাকা ধূপদানিই সেই “যন্ত্র”—এবং ভুল করে তারা সেটির সুরক্ষা ভেঙে দিয়েছে। আর এবার চন্দনবনের বুকে, ইতিহাস নয়—ভয়ই হয়ে উঠবে তাদের একমাত্র উত্তরাধিকার।
৬
চন্দনবনের ভেতরে সময় যেন অন্য এক ছন্দে বইছিল—দিনরাত্রির হিসাব গুলিয়ে গিয়ে টিমের সদস্যদের মনে হচ্ছিল, তারা ধীরে ধীরে বাস্তবতা থেকে সরে গিয়ে প্রবেশ করছে এমন এক জগতে, যেখানে মৃত্যুরা কথা বলে, আর নিঃশ্বাসের ভেতরেও জমে থাকে ভয়। অভীকের অদ্ভুত ও অকারণ মৃত্যুর পরে ঋত্বিক সিদ্ধান্ত নেন, এবার ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে এসে স্থানীয় পুরাতন রাজবাড়ির লাইব্রেরি ঘেঁটে দেখতে হবে, এমন কোনো প্রাচীন দলিল আছে কিনা যেখানে ‘কঙ্কালতন্ত্রী’ বা এই অঞ্চল ঘিরে থাকা অতিপ্রাকৃত ঘটনার উল্লেখ আছে। ইরা তাঁর সঙ্গে যান, আর বাকি টিম ক্যাম্পে থেকে যায় তৃষার দেখাশোনার জন্য। রাজবাড়ির সেই পোকামাকড়ে ভরা লাইব্রেরির এক কোনায় ধূলিধূসরিত কাঁচের আলমারিতে পেয়ে যান একটি খাতা—যেটি ছিল ১৮৭৪ সালের, রাজপুরোহিত গঙ্গাধর শাস্ত্রীর লেখা। খাতার ভেতরে ছিল এক ব্যক্তির উল্লেখ—“শ্রী কৃষ্ণানন্দ অঘোরী, যিনি নিজ কঙ্কাল রক্ষার মাধ্যমে আত্মা সংরক্ষণ করিবার সাধনা করিতেন। তিনি বিশ্বাস করিতেন, মৃতদেহ পচিলেও তান্ত্রিক মন্ত্র ও তেজ কঙ্কালে শোষিত হইয়া থাকে, এবং নির্দিষ্ট সময় পর পুনর্জন্ম সম্ভব।” আরও লেখা ছিল, “যদি বীজমন্ত্র অপূর্ণ থাকে, তবে তান্ত্রিক অন্য শরীর দখল করিবে। সাধনার জন্য দরকার অন্তত একটি জীবন্ত মাধ্যম—যে হইবে তাহার নবতান্ত্রিক অবতার।” ঋত্বিক ও ইরার শরীর দিয়ে হিম বইয়ে যায়—তৃষা কি সেই ‘মাধ্যম’? অভীকের মৃত্যু কি ছিল তার জন্য দরজা খোলা?
অন্যদিকে ক্যাম্পে তখন পরিস্থিতি দ্রুত অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে। তৃষা দিন দিন যেন তৃষা থাকছে না—তার চোখ গভীর হয়ে উঠছে, কণ্ঠে অচেনা আওয়াজ, মুখে এক অদ্ভুত নিরাসক্ত হাসি। নিধি লক্ষ্য করে, সে দিনে প্রায় কিছু খায় না, রাতে দীর্ঘসময় মাটিতে বসে থাকে নিরব, যেন কারও সঙ্গে কথোপকথনে লিপ্ত। সবচেয়ে ভয়ের বিষয় হলো, অভীকের মৃত্যুর আগের রাতে যে মন্ত্র সে উচ্চারণ করছিল, হুবহু একই মন্ত্র এখন ঘুমের মধ্যে তৃষার কণ্ঠ থেকে ভেসে আসছে। অর্ঘ্য বলে ওঠে, “তাঁর মধ্যে ও ঢুকে পড়েছে… কৃষ্ণানন্দ ফিরে আসছে…”। কেউ তখন আর যুক্তির কথা তোলে না। বিক্রম সিদ্ধান্ত নেয়, তাম্রলিপির বীজমন্ত্রের বিপরীতে কোনও ‘প্রতিরোধমন্ত্র’ আছে কিনা, তা খুঁজে দেখতে হবে। সে ইরাকে ফোন করে, ইরা জানায়, খাতার এক পৃষ্ঠায় ‘নিগ্রহমন্ত্র’-এর উল্লেখ আছে—যা বিশেষ দশমি রাতে, আগুন, জল, বায়ু ও মৃত্তিকার সংমিশ্রণে উচ্চারিত হলে আত্মার বন্ধন ছিন্ন করতে পারে। কিন্তু সেই মন্ত্র সফল করতে গেলে সময় লাগবে, উপকরণ লাগবে, এবং সবচেয়ে বড় কথা—তৃষা যদি সম্পূর্ণরূপে তান্ত্রিকের কবলে চলে যায়, তবে শরীরটি রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে উঠবে।
সন্ধ্যা নামার আগেই এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। বিক্রম ক্যাম্পে ফিরে দেখে, তৃষা মাটি থেকে গাছের ডালে উঠেছে, চোখ দুটো সম্পূর্ণ উল্টে গেছে, এবং তার গলা দিয়ে বেরোচ্ছে এমন এক গম্ভীর আওয়াজ, যা কোনও নারী কণ্ঠ নয়—বরং যেন একজন বৃদ্ধ তান্ত্রিকের নিঃশ্বাসভরা কণ্ঠ। “আমি জাগ্রত… আমি এই শরীর গ্রহণ করিব।” বাকিরা পেছনে সরে আসে। নিধি কাঁপা কণ্ঠে বলে, “এটা আর ও নেই।” সেই মুহূর্তে গগনবিদারী এক বজ্রপাত হয়, এবং জঙ্গলের একদিক থেকে উঠে আসে শয়ে শয়ে পাখির কান্নাজনিত ডাক—যেন প্রকৃতিও আতঙ্কিত। সবাই জানে, এবার সময় নেই। চন্দনবনের গহীন বুকে যেই পিশাচতান্ত্রিক সাধক চিরশান্তিতে ঘুমিয়ে ছিল, সে জেগে উঠেছে। কিন্তু সে শুধু নিজেকে ফেরত চায় না—সে চায় নতুন রূপ, নতুন শরীর, এবং এক নতুন তন্ত্রসাম্রাজ্য।
৭
চন্দনবনের অন্ধকার গহীনে রাত যেন থমকে থাকে, নিঃশব্দতা যেন চিৎকার করে। রাত তখন দুটো পার হয়েছে, তবু শিবিরে কারও চোখে ঘুম নেই। অরণ্যের বুকে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত সব মৃত্যুর ধাঁধা যেন প্রতিটি মানুষের মনে বিষাক্ত শিকড় গাঁথছে। অনিন্দিতা ব্যস্তভাবে তন্ত্র-লিপির প্রাচীন কাগজগুলো পড়ছে—হঠাৎ সে চিৎকার করে উঠল, “এই ছন্দটা…! এই তো সেই তন্ত্রের মন্ত্র যা নিশীথে মৃতকে জাগায়!” অর্ঘ্য, রঞ্জন এবং ভাস্কর ছুটে এল। অনিন্দিতার কাঁপা কণ্ঠে জানা গেল, এই নির্দিষ্ট মন্ত্র প্রাচীন কঙ্কালতন্ত্রের ‘জীবন-মৃত্যু সেতুবন্ধ’ নামক অধ্যায়ের অন্তর্গত। ওদিকে, ভাস্কর তার ক্যামেরায় ধরা এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখায়—জঙ্গলের ভেতরে কঙ্কালাকৃতি এক ছায়া যেন ধীরে ধীরে হাঁটছে, তার চোখদুটি আগুনের মতো জ্বলছে। রঞ্জনের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। “ওইটা মানুষের কঙ্কাল নয়,” সে বলে ওঠে, “ওটা কোনও আত্মা নয়, কোনও এক তান্ত্রিক আত্মা—যে নিজের মৃত্যুর পরও তার সাধনার পূর্ণতা পায়নি।” শিবিরজুড়ে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে, এবং ঠিক তখনই, চারপাশ থেকে শোনা যায় ঢাক, কাঁসর আর নৃত্যের ছন্দ। হাওয়ার মধ্যে গন্ধ ভেসে আসে—চন্দনের সাথে পুড়ে যাওয়া হাড়ের। তারা বুঝতে পারে, এই গভীর রাতে, চন্দনবনের ভেতর শুরু হয়েছে কোনও অদৃশ্য নৃত্য—একটি নিশীথের নৃত্য।
বিপদ ঘনিয়ে আসে যখন তারা খেয়াল করে, কুসুম হঠাৎ নিখোঁজ। রাতের অন্ধকারে লণ্ঠনের আলোয় তারা জঙ্গলের ভেতরে তাকে খুঁজতে বের হয়। সেই পথে কুয়াশার ফাঁকে তারা দেখতে পায়, কুসুম যেন ঘোরের মধ্যে হাঁটছে, তার ঠোঁট নড়ছে, এবং আশেপাশে বক্রহস্ত মুদ্রায় একঝাঁক কঙ্কাল নাচছে তাকে ঘিরে। হাওয়ায় ভেসে আসে সেই মন্ত্র—”জগৎ মাঝে সংহার যজ্ঞে, আমি তন্ত্রজীবি প্রাণ…” রঞ্জন চিৎকার করে কুসুমকে ডাকলে সে আচমকা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তারা কুসুমকে নিয়ে ফিরে আসে শিবিরে, কিন্তু তখনও তার চোখ খোলা, আর ঠোঁট অনবরত কিছু বলে যাচ্ছে। অনিন্দিতা বলে ওঠে, “ওর শরীর দখল করেছে কেউ। আমরা যতক্ষণ না ওকে মুক্ত করতে পারছি, ততক্ষণ এই তান্ত্রিক শক্তি আমাদের পিছু ছাড়বে না।” ভাস্কর তার ক্যামেরায় নতুন কিছু ফুটেজ ধরে—চন্দনবনের কেন্দ্রস্থলে এক প্রাচীন চক্রাকার শ্মশান, যেখানে ছায়ামূর্তি নাচছে আগুন ঘিরে। তারা বুঝে যায়—এই চক্রের কেন্দ্রে আছে সেই কঙ্কালতন্ত্রী, যিনি মৃত্যুকে হার মানিয়ে ফিরে এসেছে শুধুমাত্র প্রতিশোধ নিতে, এবং পূর্ণতন্ত্র সাধনার পরিসমাপ্তি ঘটাতে।
সকাল হতেই, কুসুম জ্ঞান ফিরে পায়, কিন্তু তার মুখে কথা নেই, শুধু চোখে আতঙ্ক। সে ফিসফিস করে বলে, “আমি ওর চোখে চোখ রেখেছিলাম। আমি দেখেছি সেই রাত, সেই যজ্ঞ, সেই রক্ত, সেই মন্ত্র।” অনিন্দিতা এবার সিদ্ধান্ত নেয়, যে করেই হোক, কঙ্কালতন্ত্রের মূলশক্তিকে থামাতে হবে। দল আবার চন্দনবনের ভিতরে ঢোকে, এবার উদ্দেশ্য—চক্রাকারের সেই শ্মশান এবং তার কেন্দ্রে থাকা সেই কঙ্কালতান্ত্রিক শক্তির আসল কেন্দ্রবিন্দু। পথে তারা আবিষ্কার করে পাথরের এক খোঁদাই করা শিলা—যেখানে লেখা, “যে তন্ত্রে মৃত্যু নেই, সে তন্ত্রেই কালের পুজা হয়।” রঞ্জনের মুখ বিবর্ণ হয়ে যায়, “আমরা মৃতের রাজ্যে পা রেখেছি।” তারা এখন জানে, সামনে শুধুই অন্ধকার, রক্ত, আর তন্ত্রের অতল বিস্তার—যার মধ্য দিয়ে বের হতে গেলে চাই চরম আত্মবলিদান, নইলে চন্দনবন চিরকাল তাদের আত্মা শুষে নেবে, ঠিক যেভাবে শুষেছিল বহু বছর আগে সেই তান্ত্রিককে।
৮
চাঁদের আলোয় ভিজে থাকা রাতের নৈঃশব্দ্যে চন্দনবনের ভেতরে ছড়িয়ে পড়েছিল এক বিভীষিকাময় অনুভূতি। বাকি চারজন সদস্য—রোহিণী, অমর্ত্য, মুকুল ও দিয়া—চোখে মুখে অবসাদ আর আতঙ্ক নিয়ে বসেছিল কাঠের তৈরি পুরনো সেই ছাউনির নিচে, যেখানে একসময় তান্ত্রিক বিষাণাথ মুণ্ডমাল পরিহিত হয়ে ধ্যান করত বলে স্থানীয় কিংবদন্তি বলে। প্রায় প্রতিরাতে ঘুম ভেঙে যেত দিয়ার, সে দেখতে পেত ছায়ার মতো এক কঙ্কালতন্ত্রী তাকে ডাকছে, তার কানে একাধিক প্রাচীন সংস্কৃত মন্ত্র প্রতিধ্বনিত হতো, যেগুলোর অর্থ আজ আর সহজে বোঝা যায় না। মুকুল মাটির নিচে খোঁজ করে করে একদিন সন্ধান পায় একটি পিতলের বাক্স, যার ভেতরে ছিল একটি মানুষখেকো চক্রযন্ত্র, চক্রের মাঝখানে খোদাই করা ছিল একটি মুণ্ডহীন মানবদেহ। চক্রযন্ত্র স্পর্শ করার মুহূর্তেই অমর্ত্যর নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বেরোতে শুরু করে, এবং সে অজ্ঞান হয়ে যায়। পরের দিন স্থানীয় ওঝা গঙ্গাধরকে ডাকা হয়, যিনি জানিয়ে দেন, “এই চক্র কেবলমাত্র সেই আত্মা ফেরাতে পারে, যাকে বন্ধন থেকে মুক্তি দেওয়া হয়নি। বিষাণাথ এখনও ধ্যানস্থ, কেবল এই কারণেই তার শরীর ভস্ম হয়নি। আর যদি কেউ তার ধ্যান ভঙ্গ করে, তবে সে দেহ রেখেই পুনর্জীবিত হবে।” কথাগুলো শুনে রোহিণী এবং দিয়া সিদ্ধান্ত নেয়, ওঝার সহায়তায় তাঁরা শেষ চেষ্টা করবেন—তান্ত্রিক বিষাণাথের আত্মাকে মুক্তি দেওয়ার।
গঙ্গাধরের কাছে জানা যায়, বিষাণাথ ছিলেন একজন অঘোরী তান্ত্রিক, যিনি জীবিত অবস্থায় মরণ-সাধনার শেষ ধাপে পৌঁছেছিলেন কিন্তু যজ্ঞ পূর্ণ হওয়ার আগে গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হন। তাঁর আত্মা তখনও অপেক্ষা করছে সেই যজ্ঞ সমাপ্তির জন্য, কারণ না হলে সে এই ভূমি ছেড়ে যেতে পারবে না। গঙ্গাধর তাদের বলে, “তোমাদের মধ্যে একজনকে ওই স্থানে বসে যজ্ঞ শেষ করতে হবে, তবে সেটা করতে গেলে তন্ত্রের দীক্ষা না থাকলে আত্মা সেই ব্যক্তিকে গ্রাস করবে।” এই শুনে সবাই চুপ করে যায়, কিন্তু দিয়া এগিয়ে আসে—সে জানায়, তার ঠাকুরদা ছিলেন একজন বৈষ্ণব তান্ত্রিক, এবং ছোটবেলায় সে কিছু মন্ত্র শিখেছিল। অন্ধকার ঘনাতে ঘনাতে সেই রাত নির্ধারিত হয় যজ্ঞের জন্য। গঙ্গাধর প্রস্তুত করে দেয় যজ্ঞের দ্রব্য, বাকি সদস্যরা মাটির খোপে বসিয়ে দেয় সেই চক্রযন্ত্র, পাশে রাখা হয় বিষাণাথের কঙ্কাল। শুরু হয় সেই তান্ত্রিক যজ্ঞ, যার প্রতিটি স্তবক উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে বাতাস ভারী হতে থাকে, পাখিরা গাছ ছেড়ে পালায়, আর চাঁদের আলো কালচে হয়ে আসে। হঠাৎ চারদিক ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে, কঙ্কাল যেন নড়ে উঠল, আর দিয়া গলার গভীর থেকে এক অজানা আওয়াজে মন্ত্র আওড়াতে থাকে, তার চোখ লাল হয়ে ওঠে।
যজ্ঞ যত এগোয়, বিষাণাথের কঙ্কাল থেকে উঠে আসে এক দেহহীন আলোর বলয়। সেই বলয় দিয়া-কে ঘিরে ঘুরতে থাকে, যেন পরখ করছে তার যোগ্যতা। গঙ্গাধর বলে ওঠে, “শেষ স্তবকটা এখনি পড়ো! এখন না পড়লে তার আত্মা গিলে ফেলবে তোমার সত্তা!” দিয়া চোখ বন্ধ করে, কাঁপতে থাকা কণ্ঠে উচ্চারণ করে: “অঘোরেশ্বরং নমঃ, শিবায় ধ্যানং, আত্মা মুচ্যতাং।” এবং সঙ্গে সঙ্গেই সেই বলয় এক বিশাল আলোয় বিস্ফোরিত হয়, কঙ্কালটি ধীরে ধীরে ভস্ম হয়ে বাতাসে মিশে যায়। পুরো চন্দনবন যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে, হাওয়া হালকা হয়, পাখিরা আবার ডাকে। গঙ্গাধর জানান, যজ্ঞ সমাপ্ত হয়েছে, আত্মা মুক্ত হয়েছে। কিন্তু তখনই দেখা যায়, দিয়া নিঃসাড় পড়ে আছে যজ্ঞবেদীর পাশে। সবাই মিলে তাকে তুলে আনে ছাউনির ভেতরে। ঘণ্টা দুয়েক পর সে জ্ঞান ফিরে পায়, কিন্তু তার কণ্ঠ থেকে এখন শুধু একটাই বাক্য বারবার বের হয়—”সে ফিরছে… সে আবার ফিরবে… কারও দ্বারা সম্পূর্ণ হয়নি তার যজ্ঞ…” বাকিরা কিছুই বুঝে উঠতে পারে না, কেবল বাতাসে হালকা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে—কাঠে পোড়া লাশের গন্ধ।
৯
অরণ্যের ভেতরে গভীর নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে, শুধু মাঝে মাঝে ঝোপঝাড়ের ফাঁক গলে ভেসে আসছে অদ্ভুত এক শোঁ শোঁ শব্দ, যেন বাতাস নয়—কোনো শ্বাসপ্রশ্বাস, কোনো অদৃশ্য সত্তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে নিজেকে। সোহিনী, শুদ্ধতোষ ও সনাতন—এই তিনজন এখন চন্দনবনের সেই মূল তান্ত্রিক আস্তানার প্রবেশপথে পৌঁছে গেছে। মাটির নিচে যে বেদির অবস্থান তারা আগেই টের পেয়েছিল, এবার তা সামনে উপস্থিত। পুরনো, ধ্বংসপ্রাপ্ত এক দরজা—যার গায়ে লাল সিঁদুরে আঁকা ত্রিকোণ এবং বীভৎস মুখাবয়ব—তা দেখে সনাতনের মুখ রক্তহীন। শুদ্ধতোষ দৃষ্টি রাখে সোহিনীর দিকে, যার চোখে এখন ভয়ের চাইতেও বেশি বিস্ময়ের ছাপ। তারা দরজা ঠেলে ঢুকতেই গা শিউরে ওঠে—অন্ধকার, সাপের খোলস, কাঠের পুরনো যন্ত্রপাতি, আর দেয়ালের গায়ে রক্ত দিয়ে আঁকা মন্ত্র। সেখানে কঙ্কালের স্তূপের মধ্যে একটি বিশেষ কঙ্কাল রয়েছে—দাঁত কিড়মিড় করে যেন এখনও জীবিত। আর ঠিক তখনই এক অদৃশ্য ঝাপটা সনাতনকে ফেলে দেয় মাটিতে, তার মুখ ঘুরে যায় এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে—মুহূর্তে নিথর দেহ! সোহিনী কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে আসে, কঙ্কাল যেন তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। শুদ্ধতোষ, আতঙ্ক চেপে ধরে তার হাত, কিন্তু তখনই দেওয়ালজোড়া এক বিস্ফোরণের শব্দ।
বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে এক আগুনের শিখা উঠে আসে ভেতর থেকে, আর সেই আগুনের আলোয় দেখা যায়, এক প্রাচীন তান্ত্রিক মূর্তি—যার মুখোশের ফাঁকে লাল চোখ জ্বলজ্বল করছে। এই চোখে চোখ পড়তেই শুদ্ধতোষ কেমন এক ঘোরে ঢুকে পড়ে। সে দেখতে পায়, চন্দনবনের অতীত, সেই তান্ত্রিক যজ্ঞের রক্তমাখা দৃশ্য, যেখানে মানব বলির বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে কালতন্ত্রের শক্তি। শুদ্ধতোষ নিজেকে দেখতে পায় সেই বলিপীঠে, মাথায় পট্টি বাঁধা, চোখ বন্ধ, এবং এক বীভৎস আওয়াজে তার নাম ধ্বনিত হচ্ছে—“শুদ্ধতোষ…পূরণ করো প্রতিজ্ঞা!” হঠাৎই সে ঘোর থেকে বেরিয়ে আসে, কিন্তু তার চোখ বদলে গেছে, সোহিনী আঁতকে ওঠে। শুদ্ধতোষের ভিতর যেন অন্য এক সত্তা প্রবেশ করেছে। সে ধীরে ধীরে বলে—“আমার নাম এখন চণ্ডনানন্দ। আমি ফিরেছি, আমার সাধন সম্পূর্ণ করতে।” সোহিনী পেছনে সরতে থাকে, কিন্তু ঠিক তখনই বেদির পাশ থেকে উঠে আসে ধোঁয়ার মেঘ, তার ভিতরে দাঁড়ানো এক নারীমূর্তি—দেবী নাকি দৈত্য, বোঝা যায় না। সে শুদ্ধতোষের দিকে হাত বাড়ায়, আর বলে, “বলি পূর্ণ হলেই মিলবে তন্ত্রমোক্ষ।” তখনই ঘরের কোণে পড়ে থাকা সনাতনের নিথর দেহ কেঁপে উঠে উঠে বসে।
সোহিনীর চোখের সামনে যা ঘটছে, তা যেন বাস্তব নয়—সনাতন, যে মাত্র কিছুক্ষণ আগে মারা গিয়েছিল, এখন আবার বেঁচে উঠেছে, কিন্তু তার চোখে আর কোনো চেনা ভাব নেই। সনাতন হেসে ওঠে, গলায় অদ্ভুত গর্জন। শুদ্ধতোষ তাকে নির্দেশ দেয়, “তুমি বলি দেবে, আমি তন্ত্র সম্পূর্ণ করব।” সোহিনী পেছনে ছুটতে থাকে, কিন্তু গুহার পথ যেন বদলে গেছে, যেন জ্যামিতির নিয়ম বদলে গেছে চন্দনবনের তলদেশে। সে বারবার একই জায়গায় ফিরে আসে, এবং প্রতিবারেই সেই আগুনের বেদি তাকে আরো কাছে টেনে নেয়। তখনই সে ব্যাগ থেকে বের করে ফেলে দেয় সেই খণ্ডিত ব্রোঞ্জ তান্ত্রিক মুখোশ, যেটি শুরু থেকেই এই অশুভ ঘটনাগুলির কেন্দ্রবিন্দু। মুখোশ মাটিতে পড়তেই এক বিকট চিৎকার, যেন কোনো সত্তা যন্ত্রণায় কাঁপছে। মুহূর্তে ধোঁয়া, আগুন, কঙ্কাল সব যেন স্তব্ধ হয়ে যায়, শুধু শুদ্ধতোষের গলা—“তুমি কি জানো, কে ছিল সেই মুখোশের আড়ালে?” তখনই সেই মুখোশের ভিতর থেকে ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ে এক শিশু কঙ্কালের ছোট হাত। সোহিনী কাঁপতে কাঁপতে বুঝতে পারে—তন্ত্রশক্তি কোনো সাধারণ জিনিস নয়, আর এই মুখোশ কার, তা জানতে হলে তাকে আরও গভীরে নামতে হবে। কিন্তু কাদের বলি দিয়ে গড়ে উঠেছিল এই সাধনার সাম্রাজ্য? উত্তর লুকিয়ে আছে শেষ অধ্যায়ে, যেখানে ইতিহাসের ছদ্মবেশে দাঁড়িয়ে আছে এক পৈশাচিক সত্য।
১০
রাত পেরিয়ে প্রায় ভোর, কুয়াশার চাদরে ঢাকা চন্দনবনের গাছেরা নিঃশব্দ সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা দেবদারু কাঠের প্রাচীন তন্ত্রমঞ্চটি তখন আগুনের ছটায় দাউ দাউ করে জ্বলছিল। অভিজিৎ, চোখে রক্তবর্ণ ঘুমহীনতা ও ক্লান্তির রেখা নিয়ে, দাঁড়িয়ে ছিল আগুনের সামনে—হাতে কঙ্কালতন্ত্রীর আধপোড়া কঙ্কাল। স্নিগ্ধা তখনো নিস্তেজ, মাটিতে পড়ে আছে তার শরীর। নীহারিকাও দমবন্ধ হওয়া নিঃশ্বাসে তাকিয়ে আছে সামনে, যেখানে কিছুক্ষণ আগেও একটা অপরূপ ভয়ঙ্কর দৃশ্য তাদের সামনে খুলে গিয়েছিল। কঙ্কালতন্ত্রী, যার নাম ছিল ‘ভৃগুনাথ’, তার চূড়ান্ত আত্মপ্রকাশ হয়েছিল আগুন জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে। দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা হিংসা, ভয়ানক তন্ত্রমন্ত্র, এবং এক অতৃপ্ত আত্মা—সব মিলিয়ে সেই রাতে যেন চন্দনবনের বুকে মহাপ্রলয়ের ঢেউ উঠেছিল। অভিজিৎ, নিজের প্রাণের তোয়াক্কা না করে, সেই মুহূর্তে তন্ত্রমঞ্চে উঠে পড়ে, পাণ্ডুলিপি ছুঁড়ে ফেলে আগুনে। “তুমি তোমার শক্তি পেয়েছো অন্যায় উপায়ে, এখন সেই তন্ত্রই তোমার শ্মশান হবে!”—চিৎকার করে বলেছিল সে। আগুনের লেলিহান শিখা যেন তন্ত্রীর আত্মাকে গ্রাস করে নিয়ে যায়, একটা আর্তচিৎকারে বাতাস ছিঁড়ে ফেলে সে, তারপর চারিদিকে এক নিঃশব্দ বিস্ফোরণ ঘটে।
সকালের আলো যখন বনভূমিতে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অন্যান্য সদস্যরা আস্তে আস্তে ফিরে আসতে থাকে সচেতন অবস্থায়। অর্ণব আর রোহন, যারা কঙ্কালতন্ত্রীর প্রভাবে প্রায় শারীরিকভাবে বিকৃত হয়ে পড়েছিল, তারা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে—যদিও মনে রয়ে যায় এক অব্যক্ত আতঙ্ক। স্নিগ্ধা, অগ্নিকুণ্ডের তাপ থেকে রক্ষা পেয়ে, ধীরে ধীরে চোখ মেলে দেখে অভিজিৎকে—তার চোখে জল, কণ্ঠে ফিসফিসে স্বর, “তুমি বেঁচে আছো?” অভিজিৎ হাসে, তবে ক্লান্ত। নীহারিকা তখন পেছনে দাঁড়িয়ে, বনের নিঃস্তব্ধতার মাঝে শুনতে পায় এক অপার্থিব শব্দ—কোনো প্রাচীন সানাইয়ের সুর, যা মিলিয়ে যায় আলো ছড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে। যেন কঙ্কালতন্ত্রীর প্রেতাত্মা, শেষবারের মত বিদায় নিচ্ছে এই পৃথিবী থেকে। তারা সবাই জানত, চন্দনবনের এই অধ্যায় শেষ হলেও ইতিহাসের গাঢ় ছায়া থেকে সবকিছু কখনোই পুরোপুরি মুছে যায় না। তবে তারা বুঝতে পেরেছিল, একমাত্র সাহস, আত্মত্যাগ আর যুক্তির আগুনই পারে প্রাচীন অন্ধকারকে দহন করতে।
কয়েক সপ্তাহ পর, অভিজিৎ, স্নিগ্ধা, নীহারিকা ও দলের বাকিরা কলকাতার এক প্রেস কনফারেন্সে চন্দনবনের উদ্ধার অভিযানের কথা তুলে ধরে। তারা প্রমাণ সহ জানায় কিভাবে তারা তন্ত্রচর্চার ভয়াল ইতিহাস, এক আত্মাকে শান্তি দেওয়া এবং এক গোপন রীতি-প্রথার অবসান ঘটিয়েছে। সরকার সেই অঞ্চলটিকে ‘সংরক্ষিত প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা’ ঘোষণা করে, সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়। কঙ্কালতন্ত্রীর পাণ্ডুলিপি ও ধ্বংসাবশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কাইভে স্থান পায়—তবে কোনদিনই আর সেগুলো পরীক্ষা করা হয়নি। স্নিগ্ধা ও অভিজিৎ একসাথে নতুন করে জীবন শুরু করার কথা ভাবে, আর নীহারিকা ফিরে যায় তার পুরনো কাজে—তবে এক পরিবর্তিত মনন নিয়ে, ইতিহাসকে কেবল অধ্যয়ন নয়, বোঝার ইচ্ছায়। চন্দনবনের কঙ্কালতন্ত্রী হয়তো শেষ হয়েছে, কিন্তু সেই রাতের অভিজ্ঞতা তাদের জীবনের প্রতিটি কোণে রয়ে যায় এক চিরস্থায়ী দাগ হয়ে। কারণ কেউ কেউ বলে, পূর্ণিমার রাতে যখন কুয়াশা জমে চন্দনবনের উপরে, তখনো নাকি শোনা যায় এক প্রাচীন তন্ত্রমন্ত্রের স্তব—অতল অন্ধকারের ভিতর থেকে আসা, এক আত্মা যা সত্যিই পুরোপুরি বিদায় নিতে পারেনি।
—–