Bangla - ভূতের গল্প

চন্দননগরের পরিত্যক্ত ফরাসি ভিলা

Spread the love

অনিৰ্বাণ দাস


গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা ভিলাটির জন্ম একেবারে ইতিহাসের গর্ভে লুকিয়ে আছে। আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে, যখন চন্দননগর ছিল ফরাসি উপনিবেশের এক প্রধান কেন্দ্র, তখন ফরাসি কনসাল জ্যঁ-ব্যাপটিস্ট দ্য ল্যাঁক তাঁর পরিবারের জন্য এই ভিলাটি নির্মাণ করেছিলেন। গঙ্গার তীরবর্তী অঞ্চল তখন ছিল বাণিজ্যের জন্য অমূল্য সম্পদ—রেশম, নীল, আফিম, মসলিনের ব্যবসায় মত্ত হয়ে উঠেছিল ফরাসি বণিকেরা। ইউরোপীয় জাহাজ এসে ভিড়ত বন্দরঘাটে, আর গঙ্গার জলে প্রতিদিন প্রতিফলিত হতো সাদা পালের ছায়া। ভিলাটি ছিল তাঁদের ঐশ্বর্যের প্রতীক—সাদা চুনে মোড়া দেওয়াল, নীল রঙে রাঙানো কাঠের জানালা, আর রোমান খিলানের মতো খোলা বারান্দা। চারদিকে ছায়াঘেরা বাগান, যেখানে ইউরোপ থেকে আনা গাছপালা যেমন ছিল, তেমনি বাংলার শিউলি, বেলী, কদম ফুলও জায়গা পেয়েছিল। ফরাসি কনসাল ভেবেছিলেন এই ভিলাকে তিনি এক নতুন জীবনের সূতিকাগার করবেন—একদিকে পরিবারকে নিরাপত্তা, অন্যদিকে উপনিবেশে তাঁর গৌরবময় পরিচয়ের প্রতীক। ভিলার প্রতিটি ইট, প্রতিটি খোদাই করা জানালার কাঠামো যেন ঘোষণা করত, “এখানেই গড়ে উঠবে ইউরোপীয় আভিজাত্যের এক চিরন্তন ছাপ।”

চন্দননগরের রাস্তায় তখন ফরাসি সংস্কৃতি ধীরে ধীরে বাংলার মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। নদীর ধারে ঘাটঘর, ফরাসি ক্লাব, ছোট ছোট ক্যাফে—সব মিলিয়ে যেন ইউরোপীয় নগরজীবনের এক ক্ষুদ্র প্রতিরূপ। ভিলার ভেতরে ঢুকলেই বোঝা যেত সেই মিলনের স্বাদ। প্রধান প্রবেশপথের দুপাশে বসানো মার্বেল মূর্তি, সিঁড়ির রেলিংয়ে ফরাসি কারিগরদের নকশা, আর উপরের কক্ষে ঝোলানো ক্রিস্টালের ঝাড়বাতি—সবই যেন বলত ইউরোপীয় আভিজাত্য ও বাঙালি কারিগরির মিলিত কাহিনি। ভিলার পেছনের রান্নাঘর থেকে ভেসে আসত গরম গরম রুটি, মাখন, চিজের গন্ধ, যা মিশে যেত বাঙালি রান্নাঘরের মাছের ঝোল আর ভাতের সুবাসে। কনসালের স্ত্রী প্রায়ই স্থানীয় বণিক পরিবারের স্ত্রীদের সঙ্গে আলাপ করতেন, তাঁদের সোনার গহনা দেখে মুগ্ধ হতেন, আবার ফরাসি লেসের শাড়ি উপহার দিতেন। শহরে চলত সাংস্কৃতিক বিনিময়—ফরাসি ভাষা শিখত বাঙালি বাচ্চারা, আবার কনসালের সন্তানরা শিখে নিত বাংলা গান। গঙ্গার তীরবর্তী এই ভিলাটি হয়ে উঠেছিল কেবলমাত্র একটি বসতি নয়, বরং এক বহুজাতিক সংস্কৃতির মিলনমেলা, যেখানে ইতিহাস ও দৈনন্দিন জীবনের রেখা এক হয়ে গিয়েছিল।

তবে ভিলার জাঁকজমকপূর্ণ অতীত কেবল কনসালের পরিবারেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এটি হয়ে উঠেছিল ফরাসি উপনিবেশিক ক্ষমতার এক প্রতীক। সন্ধ্যার পর, ভিলার খোলা বারান্দা থেকে যখন গঙ্গার জলে সূর্যাস্ত দেখা যেত, তখন সেখানে বসে হতো রাজনৈতিক আলাপ, বাণিজ্যিক চুক্তি, কিংবা নাচ-গানের আসর। ফরাসি অফিসাররা তাঁদের ইউনিফর্ম পরে, গলায় ওয়াইনের গ্লাস তুলে, উচ্চকণ্ঠে আলোচনা করতেন ইংরেজদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা, বাণিজ্যিক আধিপত্য এবং উপনিবেশ রক্ষার কৌশল নিয়ে। মাঝে মাঝে বাগানের ভেতরে আয়োজন হতো ছোটখাটো অপেরা বা নাটক, যেখানে ইউরোপীয় সুর বাজত, আর স্থানীয় বাদকরা তার সঙ্গে তবলা বাজিয়ে যোগ দিতেন। এই ভিলাটি যেন হয়ে উঠেছিল এক রূপকথার প্রাসাদ, যেখানে গঙ্গার ঢেউয়ের শব্দের সঙ্গে মিশে যেত হাসি, গানের সুর আর কূটনৈতিক ষড়যন্ত্রের গুঞ্জন। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে মনে হতে পারে এগুলো কেবল গল্প, কিন্তু চন্দননগরের গলি, গঙ্গার ধারে ভেসে আসা বাতাস, আর ভিলার প্রাচীন দেয়াল আজও সেই জাঁকজমকপূর্ণ দিনগুলির সাক্ষ্য বহন করে চলেছে—যেন সময়ের স্রোত পেরিয়েও সেই ফরাসি উপনিবেশিক দিনের প্রতিধ্বনি এখনো কানে বাজে।

এলিজ, ফরাসি কনসালের তরুণী স্ত্রী, ছিলেন একেবারেই ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ। ইউরোপ থেকে চলে আসার পর তাঁর জীবন যেন সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল এই গঙ্গার ধারের ভিলাটির দেয়ালের ভেতরে। বাইরে থেকে দেখলে তাঁর জীবন ছিল ঈর্ষণীয়—ঝলমলে পোশাক, বিদেশ থেকে আনা গহনা, ঝাড়বাতির আলোয় আলোকিত নৃত্যের আসর, অতিথিদের সঙ্গে হাসি-আড্ডা—কিন্তু অন্তরের গভীরে তিনি অনুভব করতেন এক অদ্ভুত শূন্যতা। কনসাল ছিলেন ব্যস্ত মানুষ, সারাদিন কূটনৈতিক আলোচনায়, বাণিজ্যের হিসাবনিকাশে, কিংবা ক্ষমতার প্রদর্শনে ডুবে থাকতেন। এলিজ ধীরে ধীরে বুঝতে পারলেন, তিনি তাঁর স্বামীর কাছে কেবল এক ‘প্রতীক’, যাঁর উপস্থিতি ফরাসি আভিজাত্যের পরিচয় বহন করে। সেই নির্জনতার মাঝে একদিন ভিলার বাগানে কাজ করতে আসা এক স্থানীয় যুবকের দিকে তাঁর দৃষ্টি আটকে গেল। যুবকের নাম ছিল হরিদাস—চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি, গায়ের রঙ শ্যামলা, আর গলায় গান বাঁধা। এলিজ প্রথমে তাঁর সুরেলা গলায় মুগ্ধ হলেন, পরে আলাপ জমল ফুলের যত্ন নেওয়া, কিংবা বাগানে শিউলি ফোটার গল্পে। ভাষা আলাদা হলেও অঙ্গভঙ্গি, দৃষ্টির ভাষা, আর হৃদয়ের টানে ধীরে ধীরে তাঁদের মধ্যে জন্ম নিল এক অজানা সম্পর্ক—যা ছিল নিষিদ্ধ, বিপজ্জনক, অথচ গভীরভাবে আকর্ষণীয়।

সন্ধ্যা নামলে ভিলার অন্ধকার কুঠুরিগুলো হয়ে উঠত তাঁদের আশ্রয়স্থল। গোপনে সিঁড়ির নীচের ছোট দরজা দিয়ে এলিজ ঢুকতেন, আর হরিদাস অপেক্ষা করত তাঁর জন্য, হাতে হয়তো একটি ফুল, কিংবা একটি মাটির প্রদীপ। অন্ধকারে তাঁদের ফিসফিসানি গঙ্গার ঢেউয়ের শব্দের সঙ্গে মিশে যেত, আর সেই মুহূর্তগুলো যেন এলিজকে মুক্তির স্বাদ এনে দিত। এলিজ শিখতে লাগলেন বাংলা শব্দ—“প্রেম”, “স্বপ্ন”, “আলো”—আবার হরিদাস শুনতে লাগল ফরাসি ভাষার সুরেলা ধ্বনি। সেই কুঠুরির ভেতর, যেখানে দিনের আলো প্রবেশ করত না, জন্ম নিল এক নতুন জগৎ, যেখানে কোনো কূটনীতি নেই, কোনো প্রহরীর নজর নেই, শুধু হৃদয়ের টান। কিন্তু এই সম্পর্ক ছিল বিপদের আগুনে খেলা। ভিলায় কাজ করা চাকরদের চোখে কখনো কখনো ধরা পড়ত তাঁদের একসঙ্গে থাকা, আর বাজারের গলিতে হরিদাসকে কেউ কেউ কনসালের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখত। তবু তাঁরা থামতে পারলেন না। এলিজ অনুভব করলেন, এ এক নিষিদ্ধ আনন্দ—যা তাঁকে বাঁচিয়ে রাখে, যা তাঁকে মনে করায় তিনি একজন নারী, কেবলমাত্র কনসালের স্ত্রী নন। তাঁদের প্রেম ছিল রাতের অন্ধকারে ফুটে ওঠা অদ্ভুত এক ফুল, যার সৌরভ যেমন মাদকতাময়, তেমনি সর্বনাশের বার্তা বয়ে আনে।

শহরের গুঞ্জন ধীরে ধীরে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। কনসালের অনুচরদের কানে পৌঁছতে লাগল সন্দেহজনক খবর—এক স্থানীয় যুবককে প্রায়ই ভিলার চারপাশে ঘুরতে দেখা যায়, আবার কখনো এলিজকে অদ্ভুতভাবে উজ্জ্বল চোখে ঘরে ফিরতে দেখা গেছে। এক বৃদ্ধ দাসী, যিনি বছরের পর বছর ধরে কনসালের পরিবারের সেবা করেছেন, একদিন সাহস সঞ্চয় করে কনসালের কানে তুললেন সন্দেহের কথা। কনসাল প্রথমে বিশ্বাস করতে চাননি—তাঁর স্ত্রী, যাঁকে তিনি ইউরোপ থেকে এনে এই প্রাসাদে রাণীর মতো স্থান দিয়েছেন, তিনি কি এমন বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন? কিন্তু মনের ভেতর সন্দেহের বীজ রোপিত হয়ে গেল। ভিলার অন্ধকার কুঠুরি, যা এতদিন ছিল প্রেমের আস্তানা, হঠাৎই হয়ে উঠল ষড়যন্ত্রের ছায়াঘেরা জায়গা। এলিজ আর হরিদাস জানতেন না, তাঁদের প্রতিটি পদক্ষেপ নজরে রাখা হচ্ছে, তাঁদের ভালোবাসার প্রতিটি মুহূর্ত হয়ে উঠছে বিপদের ছায়া। একদিকে এলিজের হৃদয় চাইছিল পালিয়ে যাওয়া, দূরে কোথাও স্বাধীন জীবন শুরু করা, অন্যদিকে হরিদাস বুঝতে পারছিলেন যে কনসালের ক্রোধ মানে মৃত্যুদণ্ড। তবু তাঁরা থামতে পারলেন না। তাঁদের প্রেম তখন যেন নদীর স্রোতের মতো—একবার প্রবাহ শুরু হলে আর কোনো বাঁধ তাকে আটকে রাখতে পারে না, কিন্তু সেই স্রোতের গন্তব্য যে ধ্বংস, তার ইঙ্গিত গোপনে চারদিক থেকে ভেসে আসতে লাগল।

সেই রাতটি ছিল ভীষণ ভয়ঙ্কর—আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছিল, গঙ্গার ঢেউ উথালপাথাল করে উঠছিল, আর বজ্রপাতের আলোতে ভিলার প্রতিটি জানালা যেন কেঁপে উঠছিল। বর্ষার রাতে ভিলার পরিবেশ এমনিই ভয়ানক হয়ে উঠত, তার উপর হঠাৎ ঝড়ে যেন সমগ্র প্রাসাদ দুলতে লাগল। ঠিক সেই সময়েই ঘটে গেল অমোঘ সেই ঘটনা, যা চিরকালীন অভিশাপ হয়ে ভিলার গায়ে লেগে থাকবে। এলিজকে খুন করা হলো—হঠাৎ, নির্মম, আর অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতায়। কেউ জানল না, হত্যাকারী কে। একদিকে সন্দেহ পড়ল কনসালের ওপর—সেই মানুষটি, যিনি সম্মানের আড়ালে হিংস্রতার আগুন বুকে লুকিয়ে রেখেছিলেন। হয়তো তিনি বুঝে ফেলেছিলেন স্ত্রী ও হরিদাসের নিষিদ্ধ সম্পর্ক, আর ক্রোধে অন্ধ হয়ে নিজ হাতে শেষ করে দিলেন এলিজকে। আবার অন্যদিকে শহরে গুঞ্জন রটল, ভিলার চাকরদের মধ্যে কেউ প্রতিশোধপরায়ণ ছিল—হয়তো অবহেলা, অপমান, কিংবা হিংসার প্রতিশোধ নিতে, কিংবা শুধুই নিজের ভিতরের দানবকে মুক্ত করতে কেউ এক রাতের ঝড়ে হাতে ছুরি তুলে নিল। মৃত্যুর ঠিক আগে এলিজকে শেষ কোথায় দেখা গিয়েছিল, কেউ স্পষ্ট বলতে পারল না—কেউ বলল, তিনি অন্ধকার কুঠুরিতে ছিলেন, কেউ বলল, তিনি একাকী বারান্দায় দাঁড়িয়ে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কিন্তু বজ্রপাতের আলোয় হঠাৎই চিৎকার শোনা গেল—একটি নারী কণ্ঠস্বরের শেষ আর্তনাদ, যা ঝড়ের গর্জন ভেদ করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।

পরদিন সকালের দৃশ্য ছিল যেন এক রক্তমাখা দুঃস্বপ্ন। ভিলার মেঝেতে, সিঁড়ির কাছে, এলিজের দেহ পড়েছিল নিথর—সাদা পোশাকে লাল রক্তের দাগ ছড়িয়ে ছিল চারদিকে। তাঁর চোখ দুটো খোলা, ঠোঁটে যেন এক অসমাপ্ত আর্তনাদ জমে ছিল, আর হাত দুটো প্রসারিত যেন কারো কাছে শেষ আশ্রয় চাইছিলেন। শহরের মানুষজন ছুটে এল ভিলার বাইরে, কিন্তু কেউ সাহস করে ভেতরে ঢুকতে পারল না। কনসাল তখনো ছিলেন নিস্তব্ধ, মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই—না শোক, না ক্রোধ, না বিস্ময়—শুধু এক শূন্য দৃষ্টি, যা কাউকে কিছুই বোঝাতে পারল না। চাকর-চাকরানিরা কাঁপতে কাঁপতে ফিসফিস করছিল, “মেমসাহেবকে খুন করা হয়েছে… কিন্তু কে করেছে?” কেউ সাহস করে সরাসরি প্রশ্ন তুলতে পারল না, কারণ কনসালের ক্রোধ সবাই জানত। গঙ্গার ওপার থেকে লোকেরা দেখতে পেল ভিলার জানালায় লাল আলো, আর শোনা গেল অদ্ভুত ফিসফিসানি। শহরের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল—এলিজের আত্মা শান্তি পায়নি। তাঁকে যে নির্মমভাবে শেষ করে দেওয়া হয়েছে, তার ক্ষত এত গভীর যে মৃত্যুর পরও তাঁর কান্না, তাঁর রক্ত, ভিলার গায়ে লেগে রইল।

সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল সেই দাগ—ভিলার দেয়ালে, সিঁড়ির ধাপে, মেঝের কোণায় রক্তের ছোপ যা কোনোভাবেই মুছতে পারল না কেউ। বারবার জল ঢালা হলো, চুনকাম করা হলো, এমনকি দেয়াল ঘষে তুলতে চেষ্টা করা হলো, কিন্তু লালচে দাগ আবারও ভেসে উঠল, যেন রক্ত মাটির গভীরে ঢুকে গিয়ে শিকড় গেড়ে বসেছে। রাতের বেলায় বাতাসে ভেসে আসতে লাগল এক অচেনা আতঙ্ক—ঝড় উঠলেই শোনা যেত এলিজের চিৎকার, আবার কারো কারো মনে হতো যেন সাদা পোশাক পরা এক নারী জানালার আড়াল থেকে তাকিয়ে আছেন। হরিদাস হঠাৎই উধাও হয়ে গেলেন, তাঁকে আর কেউ খুঁজে পেল না—কেউ বলল, তিনি পালিয়ে গেছেন ভয়ে, আবার কেউ বলল, কনসালের লোকেরা তাঁকে গোপনে শেষ করে দিয়েছে। কিন্তু রহস্যের সমাধান হলো না কখনো। শহরের লোকজন ধীরে ধীরে ভিলার দিক থেকে সরে গেল, কারণ তাদের বিশ্বাস হলো—ওই বাড়ি আর কেবল পাথর-চুনের নয়, ওটা রক্তের, প্রতিশোধের, আর অভিশাপের। সেই থেকে ভিলার ইতিহাস হয়ে রইল রক্তাক্ত রাত্রির কাহিনি, যা যুগের পর যুগ ধরে চন্দননগরের বাতাসে ভেসে বেড়ায়।

খুনের রাতের পরদিন থেকেই ভিলার পরিবেশ যেন এক অদৃশ্য অশুভ ছায়ায় ঢেকে গেল। গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা সেই গর্বিত প্রাসাদটি হঠাৎ করেই পরিত্যক্ত সমাধির মতো নীরব হয়ে উঠল। কিন্তু সেই নীরবতার মাঝেই ধীরে ধীরে ভেসে আসতে লাগল অদ্ভুত শব্দ—ফিসফিসানি, যেন অচেনা কণ্ঠস্বর কোনো অদৃশ্য সত্তার সঙ্গে কথা বলছে। প্রথমে ভিলার চাকররা টের পায়; গভীর রাতে, যখন সারা শহর নিদ্রামগ্ন, তখন হঠাৎ শোনা যায় ফরাসি ভাষায় ভাঙা বাক্য, কখনো করুণ সুরে, কখনো দীর্ঘশ্বাস মিশিয়ে। তাঁরা বুঝতে পারল না কী বলা হচ্ছে, কিন্তু আওয়াজের সুরে স্পষ্ট ছিল—এ যেন কারো অন্তহীন ব্যথা, কেউ অন্ধকার থেকে সান্ত্বনা চাইছে। প্রথমে লোকজন ভেবেছিল, হয়তো দুঃখে পাগল হয়ে কনসাল নিজের ঘরে বসে নিজেকেই কথা বলছেন। কিন্তু খুব দ্রুতই তারা বুঝতে পারল—এই শব্দ কোনো জীবিত মানুষের কণ্ঠ নয়। বারান্দার জানালার আড়াল থেকে, পর্দার ভেতর থেকে ভেসে আসতে লাগল সেই ফিসফিসানি, যা শুনে ভয়ে গা শিউরে উঠত।

প্রতিবেশীরা প্রথমে এ নিয়ে তেমন গুরুত্ব দেননি। তাঁরা ভেবেছিলেন, হয়তো রক্তাক্ত ঘটনার পর অতিরিক্ত ভয় ও গুজব ছড়াচ্ছে লোকজন। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই গঙ্গার ঘাটে দাঁড়ানো মানুষরাও স্পষ্ট শুনতে পেল সেই অদ্ভুত আওয়াজ। নদীর জলে ভেসে আসত ফিসফিসানি, যেন স্রোতের সঙ্গে ভেসে বেড়াচ্ছে এক অভিশপ্ত কণ্ঠস্বর। যারা ফরাসি ভাষা বুঝত, তারা পরে বলেছিল—সে কণ্ঠস্বর নাকি বলছিল, “Je souffre… aidez-moi… pourquoi?” (“আমি কষ্ট পাচ্ছি… আমাকে সাহায্য করো… কেন?”)। এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই আতঙ্ক গ্রাস করল শহরকে। কেউ আর ভিলার পাশ দিয়ে রাতে হাঁটতে সাহস করত না, বাচ্চাদের কড়া করে নিষেধ করা হলো ভিলার আশেপাশে খেলতে। এমনকি দিনের বেলায়ও জানালার ফাঁক থেকে অকারণে পর্দা দুলতে দেখা যেত, যেন অদৃশ্য কেউ ভেতর থেকে তাকিয়ে আছে। ব্যবসায়ীরা যারা আগে ভিলার বাগান ঘেঁষে যেতেন, তাঁরা রাস্তা ঘুরে অন্যদিকে চলতে লাগলেন। ধীরে ধীরে ভিলাটি হয়ে উঠল ভয়ের প্রতীক—যেখানে বাস করে না মানুষ, বরং লুকিয়ে থাকে এক অভিশপ্ত আত্মা।

কনসাল নিজেও বুঝতে পারলেন, এই গুজব আর ভয় তাঁর মর্যাদা, তাঁর ক্ষমতাকে ধ্বংস করছে। তিনি বারবার চেষ্টা করলেন, প্রহরী বসালেন, ভেতরে সন্ধান করালেন, এমনকি ফরাসি যাজক ডেকে এনে প্রার্থনাও করালেন। কিন্তু কিছুতেই থামানো গেল না সেই ফিসফিসানি। বরং প্রতি রাতেই তা যেন আরও স্পষ্ট, আরও ব্যাকুল হয়ে উঠতে লাগল। শহরের মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করল—এলিজের আত্মা শান্তি পায়নি, তাঁর অকাল মৃত্যুর যন্ত্রণা তাঁকে ফিরিয়ে এনেছে ভিলার দেয়ালের ভেতর। যারা কানে শুনেছিল, তারা শপথ করে বলত, ফিসফিসানি ঠিক জানালার দিক থেকেই আসে, বিশেষত সেই জানালা যেখান থেকে এলিজকে শেষবার দেখা গিয়েছিল ঝড়ের রাতে। ভয়ের ছায়া ক্রমশ ঘনীভূত হতে লাগল—চন্দননগরের মানুষ বুঝে গেল, এটা আর কেবল একটি হত্যাকাণ্ড নয়, এটা এক চিরন্তন অভিশাপের সূচনা। আর সেই প্রথম ফিসফিসানি শহরবাসীর মনে অমোচনীয় আতঙ্ক ছড়িয়ে দিল, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়বে।

সময় গড়াতে গড়াতে ভিলাটির রহস্যময় খ্যাতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠল। প্রথমে ফিসফিসানির কথা নিয়ে শহরে গুজব ছড়ালেও পরে মানুষ দাবি করতে শুরু করল—তারা নিজের চোখে দেখেছে এক সাদা পোশাকের নারীকে ভিলার জানালায় দাঁড়িয়ে থাকতে। গঙ্গার হাওয়া বইলে, বিশেষ করে সন্ধ্যার সময়, জানালার পর্দা অকারণে দুলতে থাকে, আর হঠাৎই দেখা যায় এক সাদা ছায়ামূর্তি—লম্বা, ঢেকে রাখা পোশাকে ঢাকা, মুখটা অস্পষ্ট, কিন্তু দৃষ্টি যেন ভেদ করে চলে আসে বাইরে দাঁড়ানো মানুষের হৃদয়ে। অনেকে বলত, তিনি কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকেন, যেন কাউকে খুঁজছেন, আবার কখনো দু’হাত তুলে ডাকেন অচেনা কারো দিকে। সেই দৃশ্য যারা দেখেছে, তাদের শরীর কেঁপে উঠেছে, হৃদস্পন্দন থেমে আসার মতো হয়েছে। আরও ভয়ঙ্কর হলো, মাঝে মাঝে দেখা যেত সেই সাদা পোশাকের নারী জানালা ছেড়ে বেরিয়ে আসছেন—ধীরপদে, ভেসে চলা হাঁটায়, যেন মাটিতে তাঁর কোনো ওজন নেই।

গঙ্গার ধারে যারা মাছ ধরতে যেত কিংবা নৌকো নিয়ে মাঝনদীতে নামত, তারাও অদ্ভুত কাহিনি বলতে শুরু করল। রাতের কুয়াশা নেমে এলে তারা স্পষ্ট দেখত, ভিলার সিঁড়ি বেয়ে এক সাদা পোশাকের নারী গঙ্গার দিকে এগিয়ে আসছেন। তাঁর পদক্ষেপ যেন জল ছুঁয়েও চিহ্ন রেখে যায় না, কিন্তু চারপাশের বাতাস অকারণে ঠান্ডা হয়ে ওঠে। কেউ কেউ বলত, তিনি গঙ্গার ঘাটে গিয়ে থেমে দাঁড়ান, বহুক্ষণ ধরে নদীর কালো স্রোতের দিকে তাকিয়ে থাকেন, তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে যান কুয়াশায়। আবার কারও দাবি, তাঁকে সরাসরি নদীর জলে ভেসে যেতে দেখা গেছে, কিন্তু কিছু দূর গিয়ে হঠাৎই অদৃশ্য হয়ে গেছেন। এমনকি নৌকোয় থাকা মাঝিরা শপথ করে বলেছে, হাওয়া স্থির হয়ে গেলেও তখন তাঁদের কানে ভেসে এসেছে হাহাকারভরা দীর্ঘশ্বাস, আর গঙ্গার ঢেউ যেন অকারণে কেঁপে উঠেছে। এই সব ঘটনা চন্দননগরের মানুষের মনে আরও দৃঢ় করে দিল বিশ্বাস—এ নারী আর কেউ নন, কনসালের স্ত্রী এলিজ, যাঁর অসমাপ্ত প্রেম, যন্ত্রণাভরা মৃত্যু, আর অশান্ত আত্মা এখনও ভিলার গণ্ডি ছেড়ে বেরোতে পারেনি।

গল্প ছড়িয়ে পড়তেই ভয় আর কৌতূহল মিশে এক অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি হলো। অনেকেই রাতে ভিলার সামনে দাঁড়িয়ে সেই সাদা পোশাকের নারীকে দেখার অপেক্ষা করত, আবার অনেকে শপথ করে বলল—যে একবার তাঁকে দেখেছে, তার জীবন আর কখনো স্বাভাবিক থাকেনি। এক বৃদ্ধ বণিক বলেছিলেন, তিনি নিজের চোখে দেখেছিলেন নারীটি জানালা থেকে তাকিয়ে ছিলেন তাঁর দিকে, আর সেই চোখের চাহনি এতটাই যন্ত্রণাভরা ছিল যে তিনি রাতের পর রাত ঘুমোতে পারেননি। শহরের মেয়েরা ভয়ে ভিলার পাশ দিয়ে যেত না, বাচ্চারা শুনত গল্প—“ওই জানালার মেমসাহেব যদি তোমাকে ডাক দেয়, আর ফিরতে পারবে না।” এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ছড়িয়ে পড়ল সাদা পোশাকের নারীর কিংবদন্তি। কিন্তু ভয়ের আড়ালে লুকিয়ে ছিল গভীর দুঃখের প্রতিচ্ছবি—যেন তাঁর আত্মা এখনও খুঁজে বেড়াচ্ছে প্রেমিককে, কিংবা ন্যায়বিচার চাইছে নিজের মৃত্যুর জন্য। আর সেই যন্ত্রণা গঙ্গার হাওয়া বইলেই মিশে যায় বাতাসে, জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে উঁকি দেয়, আর কুয়াশার পর্দার আড়ালে মিলিয়ে যায়—চিরন্তন এক রহস্য হয়ে।

সময় অনেক বদলেছে। ফরাসি উপনিবেশ আর নেই, কনসালের বংশধরও চন্দননগর ছেড়ে বহু আগেই চলে গেছে। ভিলাটি আজ ধ্বংসপ্রায়—চুন খসে পড়েছে, জানালার কাঠ ভাঙা, আর লতাগুল্মে ঢেকে গেছে বারান্দা। তবুও এর গায়ে লেগে থাকা অভিশাপ আর কাহিনি এখনও জীবন্ত। আধুনিক যুগে, শহরের ব্যস্ততা ও আলো-ঝলমলে জীবনের মাঝেও, কিছু কিছু মানুষ রয়েছেন যারা ইতিহাস খুঁজে বেড়ান, অতীতের অজানা রহস্য উন্মোচন করতে চান। তাদেরই একজন হলেন অরিত্র, কলকাতার এক তরুণ ইতিহাস গবেষক। বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউরোপীয় উপনিবেশ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেন চন্দননগরের সেই ভিলার গল্প, যাকে ঘিরে বহু কিংবদন্তি প্রচলিত। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন এগুলো নিছক লোককথা, গ্রাম্য গুজব, কিংবা প্রাচীন ভয়ের গল্প। কিন্তু ধীরে ধীরে বিভিন্ন নথি, পুরনো চিঠি, আর শহরের প্রবীণদের মুখে শোনা কথার মধ্যে তিনি খুঁজে পেলেন এক অদ্ভুত মিল—ভিলার অতীতের প্রতিটি ঘটনা যেন সত্যি হয়ে আছে, আর তার ছায়া আজও মানুষের মনে ভয় জাগায়। সেই আগ্রহ থেকেই অরিত্র সিদ্ধান্ত নিলেন—তিনি নিজে যাবেন ভিলায়, দেখবেন সত্যিই সেখানে কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে কিনা।

চন্দননগরে এসে অরিত্র প্রথমেই মিশলেন স্থানীয়দের সঙ্গে। গঙ্গার ধারে চায়ের দোকানে বসে কিংবা ঘাটে দাঁড়িয়ে তিনি অনেক গল্প শুনলেন। কেউ বলল, “বাবু, রাতে ওদিক দিয়ে যাবেন না, ওই জানালার মেমসাহেব ডাক দেন।” কেউ বলল, “আমার ঠাকুরদা শপথ করে বলতেন, ফরাসি ভাষায় ফিসফিসানি শুনেছেন।” আবার কেউ হাসিমুখে ঠাট্টা করে বলল, “ওসব ভৌতিক গল্প, ভয় পাওয়ার কিছু নেই।” কিন্তু অরিত্র বুঝতে পারলেন, এই ভয়, এই গল্পগুলো শত বছরের পুরনো, আর এগুলোতেই লুকিয়ে আছে এক অমূল্য ইতিহাস। তিনি খাতায় নোট নিলেন, প্রত্যেকের বক্তব্য লিখে রাখলেন, এমনকি ভিলার আশেপাশে বসবাসকারী পরিবারগুলোর বংশানুক্রমিক তথ্য জোগাড় করার চেষ্টা করলেন। শহরের পুরনো আর্কাইভে গিয়ে ফরাসি কনসালের নাম খুঁজলেন, পুরনো রেজিস্ট্রি বইয়ে ভিলার জমির কাগজপত্র ঘাঁটলেন। ধীরে ধীরে তাঁর ভেতরে জন্ম নিতে লাগল এক গভীর কৌতূহল—এই ভিলা শুধু ইতিহাস নয়, এটি হয়তো এক অমীমাংসিত রহস্য, যার উত্তর আজও অন্ধকারে ঢাকা।

অবশেষে অরিত্র সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি এক রাত কাটাবেন ভিলার ভেতরে। সবাই তাঁকে নিরস্ত করার চেষ্টা করল—“বাবু, ওই বাড়িতে রাতে কেউ টিকতে পারে না,” “কত লোক গিয়েছিল, কেউ ভোর অবধি থাকতে পারেনি”—কিন্তু অরিত্র ভয় পেলেন না। তাঁর বিশ্বাস ছিল, যদি ভূতের অস্তিত্ব সত্যি হয়, তবে ইতিহাস তাকে নথিভুক্ত করতে হবে; আর যদি সবই গুজব হয়, তবে তা ভাঙা দরকার। তাই এক সন্ধ্যায়, গঙ্গার ওপারে সূর্য অস্ত যাওয়ার সময়, ব্যাগে লণ্ঠন, কাগজপত্র আর একটি রেকর্ডার নিয়ে তিনি প্রবেশ করলেন ভিলার ভেতরে। চারপাশে নীরবতা নেমে এল, কেবল গঙ্গার ঢেউয়ের শব্দ আর ঝিঁঝিঁর ডাক শোনা যাচ্ছিল। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে তিনি অনুভব করলেন—এই বাড়ির প্রতিটি দেওয়াল যেন নিঃশ্বাস নিচ্ছে, প্রতিটি জানালা যেন তাঁকে লক্ষ্য করছে। ভয়ের সঙ্গে এক অদ্ভুত উত্তেজনা মিশে গেল তাঁর মনে। তিনি প্রস্তুত হলেন—রাতভর যা কিছু ঘটুক, তিনি তা প্রত্যক্ষ করবেন, লিখে রাখবেন, আর হয়তো প্রমাণ করবেন যে ইতিহাস কেবল বইয়ের পাতায় নয়, জীবন্ত থেকেও যেতে পারে ভিলার অন্ধকার দেয়ালে।

ভিলার ধুলোমাখা কুঠুরিগুলির অন্ধকারে অরিত্রর পা পড়তেই বাতাসে এক ধরনের ভারী নিস্তব্ধতা নেমে এলো। চন্দননগরের গঙ্গার তীরের এই ফরাসি ভিলা এতদিন কেবল গল্পের মধ্যে বেঁচে ছিল তার কাছে, কিন্তু এবার সে নিজেই সেই ইতিহাসের ভিতর ঢুকে পড়েছে। সিঁড়ির ধাপগুলোয় শ্যাওলা জমে গিয়েছে, দরজার চৌকাঠে বাদুড় ঝুলে আছে, আর ভেতরে মাকড়সার জালে ঢাকা ধূলোপড়া আসবাবপত্র যেন সময়ের সাক্ষ্য বহন করছে। এক কোণের কাঠের আলমারিটি খুলতেই অরিত্রর চোখে পড়ে পুরনো এক চামড়ার বাঁধাই করা ডায়েরি। পাতাগুলো হলদে হয়ে গেছে, কিন্তু কালির দাগ এখনো স্পষ্ট। ফরাসি ভাষার অচেনা বাক্যগুলির মাঝে অরিত্র লক্ষ্য করল—বারবার একটি নাম উঠে এসেছে, “Élise”। সে বুঝতে পারল, এটাই সেই কনসালের স্ত্রী এলিজের ডায়েরি, যাকে নিয়ে এত রহস্য আর ভয়ের গল্প ঘিরে আছে। অরিত্রর বুকের ভিতর ধুকপুকানি বেড়ে গেল, কারণ সে জানত—এ ডায়েরির প্রতিটি শব্দ হয়তো লুকিয়ে রেখেছে মৃত্যুর ছায়া, এক অসমাপ্ত কাহিনি।

ডায়েরির পাতা উল্টাতেই সামনে এলো এলিজের হৃদয়ের গোপন স্বীকারোক্তি। লেখা ছিল—“Je ne peux plus supporter ce silence. La nuit m’écrase.” অর্থাৎ, “আমি আর এই নীরবতা সহ্য করতে পারছি না। রাত আমাকে চাপা দিয়ে দিচ্ছে।” তার লেখার মধ্যে একটা দমবন্ধ করা আতঙ্ক লুকিয়ে ছিল। আবার পরের পাতায় উঠে এসেছে নিষিদ্ধ প্রেমের গোপন স্বপ্ন—কীভাবে এক স্থানীয় যুবকের হাসি, কণ্ঠস্বর, আর সাহস তাকে কনসালের কঠোর নিয়মের বাইরে এক নতুন পৃথিবীর স্বাদ দিয়েছিল। অরিত্র বুঝতে পারল, এলিজের দিনগুলো ছিল ভয় আর ভালোবাসার টানাপড়েনের ভিতরে আটকে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল সেই পৃষ্ঠাগুলি, যেখানে সে আগেভাগেই মৃত্যুর পূর্বাভাস লিখে গেছে। এক জায়গায় লেখা ছিল—“আজ রাতের আকাশে যে ঝড় জমছে, তা শুধু প্রকৃতির নয়, আমার ভাগ্যেরও। আমি জানি, আগামী প্রভাত হয়তো আমি দেখতে পাব না।” অরিত্রর হাত কেঁপে উঠল; যেন পাতার প্রতিটি শব্দ আজও কাঁপছে, শিউরে উঠছে। সে ডায়েরির অক্ষরে অক্ষরে শুনতে পাচ্ছিল এলিজের দমবন্ধ করা শ্বাস, যা ইতিহাসে কেবল কাহিনি হিসেবে নয়, ভয়ের জীবন্ত প্রমাণ হিসেবে রয়ে গেছে।

রাত বাড়তে থাকল, গঙ্গার হাওয়া জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে মোমবাতির শিখা দুলিয়ে দিল। অরিত্রর মনে হলো, ডায়েরির প্রতিটি লাইন যেন অন্ধকার কুঠুরির দেওয়ালে প্রতিধ্বনি করছে। এলিজ লিখেছিল—“যদি আমি হারিয়ে যাই, তবে আমার কণ্ঠস্বর রয়ে যাবে এই ভিলার দেয়ালে। আমি চাই না আমাকে ভুলে যাওয়া হোক।” এই বাক্য পড়ার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ জানালার পাশে থেকে এক অচেনা ফিসফিসানি ভেসে এলো। ভাষা ফরাসি, কিন্তু সুরে ছিল যন্ত্রণার কান্না। অরিত্রর বুকের ভেতর ঠান্ডা স্রোত বইতে লাগল। সে বুঝতে পারল, ডায়েরি শুধু কালি-কলমের লেখা নয়, এটা অভিশপ্ত সত্যের দ্বার—যেখানে এলিজের প্রেম, ভয়, আর মৃত্যুর শেষ মুহূর্তগুলো বন্দি হয়ে আছে। হয়তো সেই মুহূর্তগুলোই ভিলার প্রতিটি ইট-পাথরে আজও ছায়ার মতো বেঁচে আছে। অরিত্র জানত, সে এখন আর কেবল একজন গবেষক নয়, বরং এমন এক ইতিহাসের সাক্ষী, যেখানে জীবিত আর মৃতের মাঝের সীমারেখা ভেঙে গেছে—এবং এর কেন্দ্রে রয়েছে সেই অভিশপ্ত ডায়েরি।

চন্দননগরের গঙ্গার তীরের ভিলার ভেতর অরিত্রর সেই রাত যেন সময়কে থামিয়ে দিল। জানালার বাইরে বজ্রপাতের আলো মাঝে মাঝে পুরো আকাশকে ছিঁড়ে দিচ্ছিল, আর দূরে গঙ্গার ঢেউয়ের শব্দে যেন এক অদৃশ্য সঙ্গীত বাজছিল। ডায়েরির পাতা পড়তে পড়তে অরিত্র এতটাই ডুবে গিয়েছিল যে ঘড়ির কাঁটা কবে মধ্যরাত ছুঁয়েছে, তা সে বুঝতেই পারেনি। হঠাৎ করেই ভিলার গভীর নিস্তব্ধতার মধ্যে অস্বাভাবিক এক শীতলতা ভেসে এল, যেন হাওয়া জমাট বেঁধে গিয়ে রক্তে বরফ ছুঁইয়ে দিচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তেই অরিত্র লক্ষ্য করল—ভিলার জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে এক সাদা পোশাক পরা নারী। কুয়াশার আবছা আলোয় তাঁর মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না, তবে চোখদুটি ছিল অদ্ভুত গভীর, যেন শূন্যতার ভেতর ডুবে থাকা। অরিত্রর বুক ধকধক করে উঠল, কারণ সে জানত—এ কোনো জীবিত মানুষ নয়, এ সেই কাহিনির নায়িকা এলিজ, যার অস্তিত্ব শুধু ডায়েরির পাতায় সীমাবদ্ধ থাকার কথা।

নারীটি নীরবভাবে অরিত্রর দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর হালকা কণ্ঠে ফিসফিস করতে শুরু করল। শব্দগুলো স্পষ্ট ফরাসি ভাষায়, যা অরিত্র পড়তে জানলেও শুনে বুঝতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল। সে অনুভব করল—নারীটি কিছু বলতে চাইছে, হয়তো নিজের কষ্ট, হয়তো নিজের মৃত্যুর সত্য। শব্দগুলো ভেসে এল ভাঙা ভাঙা ভাবে—“aidez-moi… je souffre encore… la vérité… enterrée…” (আমাকে সাহায্য করো… আমি এখনো কষ্টে আছি… সত্য চাপা পড়ে আছে…)। প্রতিটি শব্দে ছিল যন্ত্রণার ভার, আর সেই যন্ত্রণার স্রোত যেন অরিত্রর শরীরের ভেতর ঢুকে পড়ছিল। তার মনে হলো, এলিজ কেবল তার সামনে উপস্থিত হয়নি, বরং তাকে এক অদৃশ্য দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছে—তার মৃত্যুর অমীমাংসিত রহস্য উন্মোচন করার। মোমবাতির শিখা কেঁপে উঠল, বাতাস হঠাৎ প্রবল হয়ে এল, যেন ভিলা নিজেই এলিজের যন্ত্রণায় সাড়া দিচ্ছে। অরিত্র তখন ডায়েরির পাতার কথা মনে করল—“আমার কণ্ঠস্বর এই দেয়ালে রয়ে যাবে।” হ্যাঁ, সেই কণ্ঠই তো এখন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, রক্তমাংস নয়, কিন্তু অদৃশ্য ব্যথার এক অবিনশ্বর প্রতিচ্ছবি হয়ে।

অরিত্র সাহস সঞ্চয় করে এক পা এগিয়ে গেল, কিন্তু নারীটির অবয়ব ধীরে ধীরে কুয়াশার মতো মিলিয়ে যেতে লাগল। তবুও তার ফিসফিসানি স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল—কণ্ঠে অনুনয়, অভিযোগ আর অদ্ভুত অভিশাপের ছায়া। ঠিক শেষ মুহূর্তে অরিত্র শুনতে পেল একটি স্পষ্ট বাক্য—“la mort n’était pas un accident…” (আমার মৃত্যু কোনো দুর্ঘটনা ছিল না…)। এই বাক্য যেন ভিলার দেয়ালে ধাক্কা মেরে প্রতিধ্বনিত হলো, আর অরিত্রর বুক কেঁপে উঠল ভয়ে ও কৌতূহলে। সে বুঝল, এলিজ তার কাছে শুধু কোনো আত্মিক উপস্থিতি নয়, বরং ইতিহাসের অন্তরালে চাপা পড়ে থাকা এক সত্যের দূত। এলিজ চায় তার সত্যি প্রকাশ পাক, তার কষ্টের অবসান হোক। জানালার বাইরে বজ্রপাত আবারও আলোকিত করল আকাশ, কিন্তু এলিজের অবয়ব ততক্ষণে অদৃশ্য হয়ে গেছে, রেখে গেছে শুধু ঠান্ডা বাতাস আর এক অভিশপ্ত প্রতিশ্রুতির ভার। অরিত্র বুঝল, এই রাত থেকে তার গবেষণা আর একাডেমিক অনুসন্ধানে সীমাবদ্ধ নেই—এখন সে জড়িয়ে গেছে ভিলার আত্মিক ইতিহাসের সঙ্গে, যেখানে তাকে উন্মোচন করতে হবে সেই মৃত্যুর লুকোনো সত্য, যা যুগের পর যুগ গোপন ছিল।

দিনের পর দিন অরিত্র ভিলার ভেতর কাটাতে লাগল, পুরনো নথি, সরকারি দলিল আর স্থানীয় কাহিনি খুঁজে খুঁজে সে একে একে ইতিহাসের অন্ধকার স্তরগুলো উন্মোচন করতে থাকল। এলিজের ডায়েরির পাতাগুলো পড়ে সে অনুমান করেছিল যে এই মৃত্যুর নেপথ্যে কেবল প্রেম আর প্রতারণার কাহিনি নেই, এর পেছনে লুকিয়ে আছে আরও ভয়ংকর সত্য। ফরাসি কনসালের অফিস সংক্রান্ত দলিলপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে অরিত্র জানতে পারল যে এলিজের প্রেমের সম্পর্ক ফাঁস হওয়ার কিছুদিন আগে থেকেই কনসাল ক্রমশ অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করেছিলেন। তিনি নাকি সভা-সমিতিতে অকারণ চিৎকার করতেন, অফিসারদের ওপর ক্ষোভ ঝাড়তেন, এমনকি গোপন রিপোর্টে লিখেছিলেন যে “পরিবারে বিশ্বাসঘাতকতা মানে রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা”। এই বাক্যই অরিত্রকে শিউরে তুলল। এলিজের ডায়েরিতে লেখা আতঙ্কের লাইনগুলো যেন এখন আরও স্পষ্ট হলো—তার ভয় ছিল একেবারেই ভিত্তিহীন নয়। অরিত্রর গবেষণা এক সময় চমকপ্রদ সত্যি সামনে আনল—এলিজকে খুন করেছিল কনসাল নিজেই, নিজের মান-সম্মান বাঁচাতে আর “বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি” দিতে।

এই সত্য আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই ভিলার প্রতিটি দেয়াল যেন অরিত্রকে সেই রাত্রির রক্তাক্ত ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিতে লাগল। সে জানতে পারল, সেই রাত ছিল এক ভয়ংকর বর্ষার রাত—যেদিন গঙ্গার জল ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল আর বজ্রপাত একটানা আকাশকে চিরে দিচ্ছিল। এলিজ তার গোপন প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল ভিলার অন্ধকার কুঠুরিতে, কিন্তু সেখানে অপেক্ষা করছিল কনসাল নিজে। ক্রোধ আর অপমানের বিষে উন্মত্ত কনসাল নির্দয়ভাবে এলিজকে হত্যা করেছিল। কিন্তু অরিত্রর আবিষ্কারের সবচেয়ে মর্মান্তিক দিক ছিল পরের অধ্যায়—খুন করার পর কনসাল সেই অপরাধ চাপা দিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। কেউ যাতে কোনোদিন এলিজের মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন না তোলে, তাই সে চাকরদের ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখে, আর এলিজের দেহ গোপনে গঙ্গার ধার ঘেঁষে সমাধিস্থ করার চেষ্টা করে। কিন্তু ঠিক তখনই ঘটে যায় অদ্ভুত এক ঘটনা—কনসাল নিজেই হঠাৎ একদিন গঙ্গায় ডুবে নিখোঁজ হয়ে যায়। কেউ জানে না সেটা দুর্ঘটনা ছিল, আত্মহত্যা, না কি অদৃশ্য কোনো প্রতিশোধের হাত। গঙ্গার বুকে সেই কনসালের দেহ আর কোনোদিন পাওয়া যায়নি।

অরিত্র এখন নিশ্চিত হলো কেন ভিলা এতদিন ধরে অভিশপ্ত রয়ে গেছে। এলিজের আত্মা মুক্তি পায়নি, কারণ তার প্রেম অপূর্ণ রয়ে গেছে, তার মৃত্যু ন্যায়সঙ্গত প্রতিকার পায়নি। সে শুধু খুন হয়নি, বরং তার ভালোবাসার কণ্ঠও চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কনসাল নিজের অপরাধ গোপন করতে চেয়েছিল, কিন্তু ইতিহাস কোনোদিন সত্যকে মুছে ফেলতে পারেনি। ভিলার অদ্ভুত ফিসফিসানি, জানালায় সাদা পোশাকের নারীর আবির্ভাব, আর রক্তের সেই অমোচনীয় দাগ—সবই ছিল সেই অসমাপ্ত কাহিনির স্মারক। অরিত্র বুঝল, এলিজ এখনো এই পৃথিবীতে বেঁচে আছে, এক অদৃশ্য কান্নার রূপে, কারণ তার আত্মা খুঁজে পায়নি মুক্তি। আর হয়তো সে-ই অপেক্ষা করছে এমন কারো জন্য, যে সত্য প্রকাশ করবে, যে স্বীকার করবে—তার মৃত্যু কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং এক নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড। অরিত্রর হাতে তাই এখন এক বিশাল দায়িত্ব এসে পড়েছে—এলিজের কণ্ঠস্বরকে জীবিত করে তোলা, তার আত্মাকে ন্যায়ের আলোয় মুক্ত করা। ভিলার নীরব অন্ধকার যেন তখন আরও গভীরভাবে ফিসফিস করে উঠল, যেন এলিজ নিজেই তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে, কারণ এত বছর পর কেউ অবশেষে তার অসমাপ্ত কাহিনির সত্যি শুনতে রাজি হয়েছে।

১০

অরিত্র বহুদিন ধরে জমে থাকা সাহস একত্র করল, আর হাতে নিল এলিজের সেই অভিশপ্ত ডায়েরি। এতদিন সে শুধু পড়ে গিয়েছিল, কিন্তু এবার সে সিদ্ধান্ত নিল ডায়েরির ভেতরের অমোঘ সত্যকে সকলের সামনে আনবে। চন্দননগরের স্থানীয় ইতিহাসচর্চার সভায় সে দাঁড়িয়ে একে একে প্রকাশ করল সেই রক্তাক্ত রহস্য, যা যুগের পর যুগ গুজব হয়ে ছড়িয়ে ছিল। ভিড় জমল—ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক, স্থানীয় বাসিন্দা—সবাই অবাক বিস্ময়ে শুনতে লাগল ফরাসি কনসালের অপরাধের কাহিনি। অরিত্র বিস্তারিতভাবে বলল কীভাবে এক নিষ্ঠুর স্বামী বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি দিতে নিজের স্ত্রীকে খুন করেছিল, আর কীভাবে সেই অপরাধ চাপা দিতে গিয়ে সে নিজেই গঙ্গার বুকে মিলিয়ে গিয়েছিল। ডায়েরির পাতাগুলো যখন প্রদর্শিত হলো, তখন সবার বুক কেঁপে উঠল—এলিজের হাতের লেখায় লেখা সেই আতঙ্ক, সেই প্রেম, আর মৃত্যুর পূর্বাভাস যেন সরাসরি শ্রোতাদের চোখের সামনে রক্তক্ষরণ করল। অরিত্রর কণ্ঠ কাঁপছিল, কিন্তু তার চোখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা ছিল—সে জানত, এই সত্য প্রকাশই হয়তো এলিজের আত্মার মুক্তির একমাত্র উপায়। আর সেই মুহূর্তে ভিলার অন্ধকারে যেন এক আলো জ্বলে উঠল, যদিও কেউ চোখে দেখতে পেল না, কেবল অনুভব করল—এক দীর্ঘ যন্ত্রণার বোঝা যেন হালকা হয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু মুক্তি কি সত্যিই এসেছে? সেই প্রশ্নই অরিত্রর মনে ঘুরপাক খেতে লাগল। সেই রাতেই সে আবার ভিলায় ফিরে এল, কারণ জানত, যদি সত্যিই আত্মা শান্তি পেয়ে থাকে তবে আজই কিছু ঘটবে। গঙ্গার হাওয়া বইছিল, আর ভিলার ভেতর নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল আগের মতো। মোমবাতি জ্বালিয়ে অরিত্র ডায়েরিটি শেষবারের মতো টেবিলে রাখল। তখনই ভেসে এলো সেই বহুচর্চিত ফিসফিসানি। কিন্তু এ রাতের শব্দগুলো আলাদা—সেখানে আর কান্না বা আতঙ্ক নেই, বরং যেন স্নিগ্ধ সুরে কারো কণ্ঠস্বর বিদায় জানাচ্ছে। “merci… enfin libre…” (ধন্যবাদ… অবশেষে মুক্ত…)—এই ফিসফিসানি যেন অরিত্রর বুক ভরে দিল অদ্ভুত শান্তিতে। জানালার পাশে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকা সাদা পোশাকের নারীটিকে সে আর ভয় পেল না। তার মুখে ছিল এক প্রশান্তির হাসি, চোখে ছিল অশ্রুর দীপ্তি। ধীরে ধীরে তিনি গঙ্গার কুয়াশার দিকে হেঁটে গেলেন, আর মিলিয়ে গেলেন ঢেউয়ের স্রোতের ভেতর। অরিত্র তখন বুঝল, হয়তো এলিজের আত্মা মুক্তি পেয়েছে, কারণ সত্য প্রকাশের আলো অন্ধকার ভেদ করে তার যন্ত্রণা মুছে দিয়েছে।

তবুও প্রশ্ন থেকে গেল—মুক্তি কি সত্যিই পূর্ণ হলো? কারণ ভিলার প্রতিটি দেয়ালে, প্রতিটি ইট-পাথরে যে রক্তাক্ত স্মৃতি গেঁথে আছে, তা কি কখনও মুছে যাবে? অরিত্র গভীর রাতে ভিলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে গঙ্গার জলে তাকিয়ে ভাবল—এলিজ হয়তো শান্তি পেয়েছে, কিন্তু ভিলার অভিশাপ কি সত্যিই শেষ হয়েছে? হঠাৎ করেই ভেতর থেকে হাওয়ার ঝাপটা মোমবাতি নিভিয়ে দিল, আর অরিত্র অনুভব করল, ভিলার নিস্তব্ধতা এখনো অস্বাভাবিকভাবে ভারী। কোনো কান্না বা আহাজারি নেই, কিন্তু সেই নীরবতার মধ্যে লুকিয়ে আছে এক অজানা ছায়া, যেন ইতিহাস এখনো পুরোপুরি মুছে যায়নি। হয়তো প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই ভিলা গল্পের মধ্যে বেঁচে থাকবে—এক অভিশপ্ত প্রেম আর মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে। অরিত্রর মনে হলো, সে এক কাজ শেষ করেছে, কিন্তু আরেক কাজ শুরু হয়ে গেছে—সত্যের আলোয় আত্মা মুক্তি পেলেও ভিলার দেয়ালে চিরকাল বাজতে থাকবে ফিসফিসানির প্রতিধ্বনি, যা সময়কে মনে করিয়ে দেবে—কিছু কাহিনি শেষ হয় না, তারা থেকে যায় ইতিহাসের ছায়ার মতো, মুক্তি আর অভিশাপের মাঝামাঝি কোথাও।

সমাপ্ত

1000068624.jpg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *