১
শীতের শুরুতে কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়া সকালটা চক্রপুর রেলস্টেশনে থেমেছিল মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য। ছোট একটা প্ল্যাটফর্ম, দুই পাশে ধানখেত, মাঝখানে লালমাটির পথ—নেমেই অরিজিৎ বুঝে গিয়েছিল, এখানে সময় একটু ধীরে চলে। তার পায়ের কাছে গুটিগুটি করে হেঁটে যাওয়া কুকুরটা যেন তাকিয়ে বলছিল, “তুমি নতুন এসেছো, বুঝি?” সল্টলেক থেকে বেরিয়ে প্রায় ছ’ঘণ্টার সফর শেষে সে পৌঁছেছে এই প্রত্যন্ত গ্রামে, গবেষণার কাজে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি বিভাগের অন্তর্গত একটি সাবজেক্ট — “লোকজ তন্ত্র এবং বাংলার গ্রামীণ সমাজে তার প্রভাব” — এর ওপর MPhil থিসিস করছে অরিজিৎ। বহু পড়াশোনার পর ও খোঁজ পেয়েছিল এই চক্রপুর গ্রামের, নদীর ধারে এক অচেনা নাম, যার পাশে ঘোরলাগা ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। আঠারো শতকে নাকি এখানে এক বিশাল তান্ত্রিক সম্মেলন হয়, যাকে বলা হয় ‘চৌরাশি’। সেই সম্মেলনে চুরাশি জন তান্ত্রিক সাধক একত্র হয়ে ‘অঘোর চক্র’ গঠন করে—এমনটাই লেখা আছে একটি পুরাতন পুঁথিতে, যা সে পেয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেয়ার আর্কাইভে। কিন্তু এরপর এই সভা হঠাৎ গায়েব হয়ে যায় ইতিহাস থেকে। কেউ লেখে না, কেউ বলে না। গ্রামের মানুষজনের মুখে মুখে কাহিনি আছে, কিন্তু সরকারী বা প্রামাণ্য কিছুই নেই। তাই সে এসেছে এখানে—এই গ্রাম, এই মানুষ, এই নিঃসঙ্গ নৈঃশব্দ্য তার গবেষণার প্রধান চরিত্র হতে চলেছে।
প্ল্যাটফর্ম থেকে হাঁটা পথে আধঘণ্টার মতো সময় লাগে গ্রামে পৌঁছাতে। পথে শুধু ধানক্ষেত, দূরে সরু নদী, আর মাঝে মাঝে ফাঁকা মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের ছায়া। গ্রামে ঢুকেই অরিজিৎ দেখে গাঁয়ের পরিবেশ ভারী—অদ্ভুত নীরবতা, যেন সকালের আলোও এখানে ফিকে হয়ে আসে। পাকা রাস্তা নেই, মাটির দালান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, আর কিছু বাচ্চা দূর থেকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে আগে থেকেই গ্রামের একটি পরিবারে থাকার ব্যবস্থা করেছিল, স্থানীয় স্কুলশিক্ষিকা দামিনী রায়ের বাড়িতে। দামিনী বয়সে অল্প, কিন্তু তার চোখে এমন একরাশ চিন্তা লুকানো থাকে, যা সহজে ধরা পড়ে না। প্রথম দিনেই রাতের খাবারে বসে দামিনী বলেছিল, “আপনি খুব সময় বুঝে এসেছেন, অরিজিৎ বাবু। পুরোহিত ধূর্জটি ভট্টাচার্য ক’দিন আগেই নিজেকে ফাঁসি দিয়েছেন। তার পরে… গ্রামটা আর আগের মতো নেই।” কথাটা শুনে অরিজিৎ চমকে গিয়েছিল। কারণ ধূর্জটির নাম সে আগেই পড়েছিল গবেষণায় — স্থানীয় ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের একমাত্র তান্ত্রিক পুরোহিত, যিনি নাকি ‘অঘোরানন্দ’ নামক এক পুরনো সাধকের শিষ্য ছিলেন। মৃত্যুর খবর সে পায়নি। কিন্তু তার চেয়েও অবাক হওয়ার বিষয় ছিল — সেই রাতেই, যখন সে জানালার পাশে বসে নোট নিচ্ছিল, হঠাৎ শুনতে পেল দূরের বাঁশবনে কেউ যেন মন্ত্র পড়ছে। অন্ধকারে স্পষ্ট উচ্চারণ — “ওঁ হ্রীং অঘোরং… চক্রং…” মৃদু গলায়, তবুও যেন কানে ছিদ্র করে ঢুকে যায়। জানালা খুলে বাইরে তাকিয়েও কিছু দেখা যায় না—কেবল সাদা ধোঁয়ার মতো কুয়াশা, তার মাঝে লালচে আভা। সেই মুহূর্তে, অরিজিৎ বুঝে গিয়েছিল, এ গ্রাম শুধু গবেষণার বিষয় নয়—এ গ্রাম এক রহস্য, যার বাঁকে বাঁকে মৃত্যুর গন্ধ, হারিয়ে যাওয়া শিশুদের কান্না, আর কোনও এক চক্রের নীরব আহ্বান… যে চক্র এখনও ভাঙেনি। সেই রাতেই তার রেকর্ডারে অজানা এক আওয়াজ ধরা পড়ে — “তুমি এসেছো, এবার চক্র পূর্ণ হবে।”
২
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙার পর অরিজিৎ দেখে গোটা গ্রামে অস্বাভাবিক এক চাঞ্চল্য—কেউ কিছু বলতে চাইছে না, কিন্তু সকলের মুখে চাপা আতঙ্ক। দুধওয়ালা ছেলে এসে জানায়, “কাল রাতে দক্ষিণপাড়ার শিবমন্দিরে কিছু একটা ঘটেছে। সকালে লোকজন দেখে চমকে গেছে।” অরিজিৎ সঙ্গে সঙ্গে নিজের নোটবুক আর ক্যামেরা নিয়ে ছুটে যায়। মন্দিরটা ছোট, ইটের গাঁথুনি, চারপাশে গাছগাছালি ঘেরা, অনেকটা পরিত্যক্তের মতোই। কিন্তু মন্দিরের দরজার সামনে মানুষের ভিড় জমেছে—চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে সকলে, যেন কারো মুখে ভাষা নেই। আর সেখানে গিয়ে যা দেখে অরিজিৎ, তা তার পড়াশোনা বা কল্পনারও বাইরে। মন্দিরের মধ্যে মহাদেবের প্রতিমার গায়ে রক্তের দাগ—ঘন, জমাট বেঁধে লেগে আছে পাথরের গায়ে। শুধু তাই নয়, প্রতিমার গলায় একটা পলিথিনে মোড়া কিছু ঝুলছে। সেটা খুলতেই দেখা যায় একটা ছোট্ট পুতুল—হাত-পা বাঁধা, মুখে কাদা লেপা। উপস্থিত গ্রামবাসীরা ফিসফিস করে বলে ওঠে, “বলি হয়েছে… আবার…” কেউ কেউ বলে, এটা কোনও ‘চিহ্ন’—চক্র আবার জেগেছে। কিন্তু কেউ খোলাখুলি মুখ খুলতে রাজি নয়। এমন সময় দামিনী এসে দাঁড়ায় অরিজিৎ-এর পাশে, তার চোখে ঘুম নেই, কণ্ঠে ক্লান্তি—“আমি আপনাকে কিছু বলিনি গতকাল। কিন্তু বলার সময় এসেছে। পুরোহিত ধূর্জটি মারা যাওয়ার আগে কয়েক রাত ধরে এ বাড়ির পেছন দিয়ে রাত একটা নাগাদ হেঁটে যেতেন। আমি জানতাম, উনি কোথায় যাচ্ছেন। দক্ষিণপাড়ার ওই শিবমন্দিরই ছিল তাঁর তান্ত্রিক সাধনার কেন্দ্র।” কথাটা শুনে অরিজিৎ অবাক হয় না—সে বরং অবাক হয়, দামিনী এতটা জেনে কীভাবে এতদিন চুপ ছিল। তখনই গ্রামের একজন প্রবীণ, মধুমঙ্গল দা বলে ওঠেন, “বাবু, এখানে একটা চক্র ছিল, এখনও আছে। চুরাশি জন সাধক ছিল একসময়, যারা একে একে জন্ম নেয় বারবার। এদের মধ্যে কেউ কেউ সাধারণ মানুষ সেজে আছে, কেউ আবার আত্মার রূপে ঘোরে।” এই বক্তব্যে হালকা হাসির ছায়া নামলেও অরিজিৎ অনুভব করে, লোকটি কিছু দেখেছে, কিছু জানে। মন্দিরে উপস্থিতরা হঠাৎ খেয়াল করে, মাটিতে আঁকা আছে ত্রিভুজাকৃতি এক মণ্ডলচিহ্ন, যার তিন কোণে পাতা রয়েছে — তুলসী, রক্তমাখা সিঁদুর, আর একটি কালো ধাতব বস্তুর টুকরো। এসব দেখে অরিজিৎ বুঝে যায়, গ্রামে কিছু ভয়ঙ্কর আচারচর্চা চলছে। আর এসব কিছুতেই হঠাৎ শুরু হয়নি। কিছু আছে, বহু পুরোনো, বহু গভীর—যার স্পর্শে আজও প্রতিমা থেকে রক্ত ঝরে, পুতুলে লেখা থাকে শিশুর চিৎকার, আর মাঝরাতে শোনা যায় অঘোরানন্দের ডাকে, “চক্র অসম্পূর্ণ, পূর্ণ করো তাকে…”
৩
সন্ধ্যেবেলায় গ্রামে আলো নামে ধীরে ধীরে—একটা ছায়ার মতো সময়, যখন পাখিরা ফিরে আসে, আর মানুষজন দরজা বন্ধ করতে শুরু করে। অথচ চক্রপুরে, সেই সন্ধ্যেটা যেন একটা ভয়ের বার্তা নিয়ে আসে। সেদিন দক্ষিণপাড়ার ঘটনার পর গ্রামের কেউ মুখ খুলছে না, এমনকি দামিনীও অরিজিৎ-এর সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে না। রাত আটটার সময় হঠাৎ দাওয়ায় এসে বসলেন এক বৃদ্ধ—রঘুনাথ পাল, গ্রামের মুখিয়া। চুপ করে অনেকক্ষণ বসে থাকার পর তিনি বলে ওঠেন, “তুমি গবেষণা করছো, ঠিক আছে। কিন্তু অত গভীরে যেও না। এই গ্রামে যেটা চাপা পড়ে আছে, সেটা চাপাই থাকুক।” সেই বাক্যটুকুই যেন ইঙ্গিত দেয় আরও কিছু লুকোনো রয়েছে, যা কেউ বলতে চায় না। কিন্তু অরিজিৎ-এর কৌতূহল আরও বেড়ে যায়। সে মনস্থির করে, আজ রাতেই সে যাবে পশ্চিমপাড়ার দিকে—সেখানে একটা পুরনো মন্দির আছে, যা এখন বন্ধ। কেউ সেখানে যায় না। গ্রামের ভাষায় সেটাকে বলে “অঘোরস্থান”। তার পাণ্ডুলিপিতে সেই মন্দিরের কথা উল্লেখ ছিল—“চক্রের কেন্দ্রবিন্দু”—যেখানে একসময় চুরাশি তান্ত্রিক একত্র হতেন।
রাত সাড়ে বারোটা। হাতটর্চ, ক্যামেরা, আর নোটপ্যাড নিয়ে অরিজিৎ ধীরে ধীরে মাটির পথ ধরে পশ্চিমপাড়ার দিকে এগিয়ে যায়। কুয়াশার আস্তরণ এত ঘন যে পা-ফেলার আগে ভালো করে দেখতে হয়। দূরে কোথাও শেয়ালের ডাক, কোথাও জোনাকির আলো। হঠাৎই সামনে এক বিশাল বটগাছ, তার নিচে কাঁটাতারের বেড়া ঘেরা জায়গা—তার ভেতরেই দাঁড়িয়ে আছে মন্দির। ছাদ ভাঙা, দেওয়ালে শ্যাওলা, কিন্তু দ্বারটি ভেতর থেকে বন্ধ। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, গায়ে কোনও ধুলো নেই—যেন কেউ এখানে নিয়মিত আসে। মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে অরিজিৎ খেয়াল করে, একজায়গায় গায়ে খোদাই করা চিহ্ন দেখা যাচ্ছে—একটি বৃত্তের মাঝে লেখা ‘অ’, তার নিচে তিনটি বিন্দু। এই চিহ্ন সে আগে পাণ্ডুলিপিতে দেখেছে—তান্ত্রিক “অঘোরানন্দ” এই চিহ্ন ব্যবহার করতেন তাঁর অনুগামীদের চেনার জন্য। সে ক্যামেরা অন করে ছবি তুলছে, এমন সময় পিছন থেকে হঠাৎ হাওয়ার ঝাপটা আসে, কিন্তু আশেপাশে কোনও গাছও নেই। ঘাড়ের পেছনে ঠাণ্ডা অনুভব করে সে। পেছনে তাকিয়ে কিছু দেখে না, কিন্তু মাটির ওপর ছায়া পড়ে রয়েছে—একটা দীর্ঘ, কুঁজো, দণ্ডধারী মানুষের মতো। তখনি দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতর থেকে আলোর রেখা দেখা যায়। কেউ যেন মোমবাতি নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মন্দিরের ভেতরে। সে এক মুহূর্ত দোনামনা করে, তারপর কাঁটাতার পেরিয়ে মন্দিরের গায়ে হাত রাখে। হঠাৎ দরজা কিঞ্চিৎ খুলে যায়, আর এক ঝলক ধূপের গন্ধ ভেসে আসে। সেই মুহূর্তে তার চোখে পড়ে মন্দিরের মেঝেতে আঁকা চক্রের চিহ্ন—বৃত্তের ভেতর চুরাশিটা ছোট ছোট পাথরের খোদাই, একটার ওপর একটায় লেখা বিভিন্ন নাম—কিন্তু নামগুলো স্পষ্ট নয়, বহু বছর ধরে ধুয়ে গেছে। একটিতে শুধু আধভাঙা লেখা, “ঘোরা…নন্দ”। সে বুঝে যায়, এখানেই ছিল সেই তান্ত্রিক চক্রের আসল সভা—এখানেই মিলিত হতেন সেই চুরাশি সাধক। হঠাৎ তার হাতে ধরা ক্যামেরা বন্ধ হয়ে যায়, ব্যাটারি সম্পূর্ণ চার্জ থাকা সত্ত্বেও। বাতাস ভারী হয়, বুক ধড়ফড় করে ওঠে। সে ফিরে তাকিয়ে দেখে দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেছে, আলো নিভে গেছে, কিন্তু দেয়ালের গায়ে তখনও স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে রক্তের মতো ছোপ, যেন মেঝেতে কেউ বসেছিল বহুক্ষণ, উঠে যেতেই ছাপ রেখে গেছে। তখনই দূরের অন্ধকার থেকে ভেসে আসে একটি নারীকণ্ঠ — “চক্র অসম্পূর্ণ… পূর্ণ করতে এসেছো?” অরিজিৎ পিছন ফিরে তাকায়, কিন্তু কুয়াশা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। সেই মুহূর্তে সে উপলব্ধি করে, এ শুধু গবেষণার ক্ষেত্র নয় — এ এক গহ্বর, যা তাকেও গ্রাস করে ফেলতে চায়।
৪
পরদিন সকালে অরিজিৎ ঘুম ভাঙতেই দেখে দরজার বাইরে দামিনী দাঁড়িয়ে। চোখের নিচে কালি, মাথায় ওড়না, হাতে কাঁপতে থাকা কাপ। গলায় কষ্টেসৃষ্টে গড়া স্বর—“আজ রাতে কি আপনি মন্দিরে গিয়েছিলেন?” প্রশ্নটা নিছক কৌতূহল থেকে নয়, যেন ভয় আর চিন্তার এক মিশ্রণ। অরিজিৎ কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই দামিনী ধীরে দরজার পাশের বেঞ্চে বসে পড়ে। “আমার ঠাকুরদা বলতেন, চক্রপুরে কিছু আত্মা জন্ম নেয় আবার আবার, যারা একদিন সেই পুরোনো চৌরাশি তান্ত্রিকের জায়গা পূরণ করবে। আপনার পাণ্ডুলিপিতে যে নাম আছে না, অঘোরানন্দ, তিনি শেষবার মন্ত্রপাঠ করেছিলেন এই মন্দিরেই। তারপর থেকে প্রতি ২১ বছর অন্তর কিছু শিশু নিখোঁজ হয়। কেউ ফিরে আসে না, কিন্তু গ্রামের মানুষ মুখ খোলে না। কারণ তারা জানে, কেউ একজন আছে—যে এই চক্র আবার গঠন করতে চাইছে।” এই কথাগুলো শোনার পর অরিজিৎ চুপচাপ বসে পড়ে। তার থিসিসের বই, তার লেখালিখি, গবেষণাপত্র—সব যেন খেলনা হয়ে যায় এই বাস্তবতার সামনে। সে বুঝে ফেলে, চক্রপুরে যা ঘটছে, তা নিছক অতিপ্রাকৃত নয়—এ এক সুসংগঠিত, গোপন প্রথা, যার অস্তিত্ব এখনও রয়ে গেছে।
সন্ধ্যাবেলায় সে গ্রামের একমাত্র লাইব্রেরির বৃদ্ধ রক্ষক মধুমঙ্গল দা-র কাছে যায়। বৃদ্ধ কাঁচা-পাকা দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে চুপ করে থাকে, তারপর একটা পাথুরে বালতিতে চা ঢেলে দেয়। “তুই বেশি জানলে বিপদ, বুঝলি?” এই বাক্যটা বহুবার শুনেছে অরিজিৎ, কিন্তু এবার সে জিজ্ঞেস করে—“আপনি ধূর্জটি ভট্টাচার্যের সঙ্গে কতদিনের পরিচিত ছিলেন?” বৃদ্ধ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে, তারপর নিচু গলায় বলে—“তোর বাবার বয়সের লোক ছিল ধূর্জটি। কিন্তু সে সাধারণ পুরোহিত ছিল না। তার ঘরে অনেক কিছু ছিল, যা আজও কেউ ছুঁয়েও দেখে না। আমার কাছে একখানা পুরনো নথি আছে, যা আমি তোকে দিতে পারি, যদি কথা দিস সেটা শুধু তোর গবেষণার কাজে ব্যবহার করবি।” হাত বাড়িয়ে কাঁপতে থাকা আঙুলে বৃদ্ধ এক কুড়ানো খাতা তুলে দেয়—জীর্ণ পাতায় লেখা, ‘চক্রাঙ্গ বিন্যাস: ৮৪ জনের চক্রের নাম ও শক্তি’। সেখানে দেখা যায় প্রতিটি তান্ত্রিকের নাম, তাদের শক্তির ধরন—কারও ছিল বিভ্রান্তির মন্ত্র, কারও অস্তিত্ব বিলীন করার ক্ষমতা, কারও ছিল মৃত্যু-স্থির-দৃষ্টি। কিন্তু কয়েকটি নাম শুধু লাল কালিতে কাটা—যাদের এখনো পূর্ণ হয়নি, বা জন্ম নেয়নি। এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়—চুরাশির মধ্যে ৭৯ জনের নাম পূর্ণ, ৫টি নাম এখনও ফাঁকা। পাতার নিচে একটি ভবিষ্যৎবাণী লেখা—“একবার চক্র পূর্ণ হলে, অঘোরানন্দের আত্মা অধিষ্ঠান নেবে মধ্যচক্রে, আর তখন আর কেউ এই গ্রামের নিয়ন্ত্রক থাকবে না।”
অরিজিৎ যখন সেই খাতা নিয়ে রাতভর বসে, তখন তার কানে ভেসে আসে দূর থেকে ঢাকের মতো আওয়াজ, আর ধুপের গন্ধ। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সে দেখে নদীর ঘাটের দিকে মিছিলের মতো কিছু ছায়ামূর্তি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে কুয়াশার মধ্যে। তারা কারা? এত রাতে? তার রেকর্ডারে আবার সেই আওয়াজ ধরা পড়ে—“তুমি এসেছো… এখন চারজন চাই… চক্রকে সম্পূর্ণ করো…” সেই মুহূর্তে, অরিজিৎ সিদ্ধান্ত নেয়—তথ্যের বাইরে গিয়ে, এবার তাকে খুঁজে বার করতে হবে সেই মানুষগুলোকে, যারা চক্রপুরের এই চক্রকে সচল রেখেছে। তাদের মধ্যেই হয়তো কেউ একজন এখনও শিশুদের বলি দিয়ে চক্র সম্পূর্ণ করার চেষ্টা করছে। আর অঘোরানন্দ? সে কি কেবল অতীত? নাকি আজও কেউ তার নামে, তার মন্ত্রে চক্রকে জাগিয়ে তোলে? গবেষণা এবার ভয়ানক বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে, আর অরিজিৎ জানে, এখান থেকে আর পিছনে ফেরার পথ নেই।
৫
চক্রপুরের আকাশ যেন দিন দিন ভারী হয়ে উঠছে। প্রতিটি দিন, প্রতিটি সন্ধ্যা যেন গ্রামটাকে আরও গাঢ় ছায়ায় ঢেকে দিচ্ছে। গ্রামবাসীদের মধ্যে একটি চাপা উত্তেজনা, কিছু একটা ঘটতে চলেছে—এমন অনুভূতি সর্বত্র। আর এই সময়েই দামিনী একরাতে ধীর পায়ে এসে দাঁড়ায় অরিজিৎ-এর ঘরের দরজায়। সে কোনো কথা না বলে হাতে তুলে দেয় একটি পুরনো কাপড় মোড়া বাক্স। কাঠের তৈরি, খোলার পর ভেতর থেকে বেরোয় কয়েকটি তামার পাত ও একটি দলিলপত্র—ধূর্জটি ভট্টাচার্যের রেখে যাওয়া ব্যক্তিগত সংগ্রহ। অরিজিৎ পাণ্ডুলিপিগুলো যত্নে উল্টাতে থাকে। প্রথম পাতায় একটা আঁকা চিহ্ন—একটি বৃত্তের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ৮৪টি বিন্দু, মাঝে তিনটি ত্রিকোণ—এটাই সেই “অঘোর চক্র”, যেটা এখন পর্যন্ত শুধু তত্ত্বেই পড়েছে সে। পরের পাতাগুলোতে হাতের লেখা অস্পষ্ট, কিন্তু কিছু শব্দ মাঝে মাঝে স্পষ্ট—”অঘোরানন্দ”, “অশরীরী শক্তি”, “চক্রদণ্ড”, “বলি”, “বৈরাগী মুখ”। এসব শব্দে একটা নির্মমতার গন্ধ আছে, যেন কেবলই সাধনা নয়—তন্ত্রের এই পথ ছিল রক্তাক্ত ও নিষ্ঠুর।
পাণ্ডুলিপির একটি পাতায় বিশেষভাবে ঘিরে রাখা কয়েকটি বাক্য:
“তন্ত্র কখনো পূর্ণ হয় না, সে চক্রের মতোই ঘুরে ফিরে আসে। যে তান্ত্রিক চক্রপুরে সাধনায় পূর্ণতা পায়নি, সে আবার জন্ম নেয়, আর ফিরে আসে নিজের অসমাপ্ত সাধনা সম্পূর্ণ করতে। চুরাশির মধ্যচক্রের জন্য চাই নির্দোষ প্রাণ, চাই নবীন রক্ত।”
এই বাক্যগুলো পড়ে অরিজিৎ-এর শরীরে কাঁপুনি ধরে যায়। পাণ্ডুলিপির শেষ পাতায় লেখা—“অঘোরানন্দ এখনও নির্জীব নয়, সে অপেক্ষা করে তার মধ্যচক্রের জন্য।” অর্থাৎ এখনও কেউ তাকে ‘জাগাতে’ চায়।
পরদিন সকালে গ্রামের এক প্রান্তে শিশু রুবেল নিখোঁজ হয়ে যায়। মাত্র আট বছর বয়স, গরিব কৃষকের ছেলে। পরিবার থানায় যায় না, শুধু কাঁদে আর বলে, “এও একদিন হতোই, বাবু… এবার আমাদের পালা।” গ্রামের সবাই যেন জানে এই ‘নিখোঁজ’ হঠাৎ নয়—এটা পূর্বনির্ধারিত। অরিজিৎ তার ক্যামেরা, রেকর্ডার, আর নোটবুক নিয়ে বের হয় পুরোহিত ধূর্জটির পুরনো বাড়িতে। সেটা এখন পরিত্যক্ত। দামিনীর সহায়তায় সে তালা ভেঙে ঢোকে। ঘরের ভেতর যেন সময় আটকে আছে। আলমারিতে ধুলো জমে থাকা জপমালা, ধূপদান, ছাই মাখানো পোড়া কাপড়, আর একটি টুকরো আয়না—যার গায়ে অদ্ভুত প্রতিচ্ছবি, যেন এক অদৃশ্য মুখ তাকিয়ে আছে তাকেই। ঘরের পশ্চিম দেয়ালে সে খুঁজে পায় একটি কাঠের খোপ। ভাঙতেই বেরোয় আরেকটি কাগজে মোড়া চিঠি। ধূর্জটি লিখেছিলেন—
“যদি কেউ কখনও এই চিঠি পড়ে, জেনো—আমি একসময় ছিলাম অঘোর চক্রের বাহক। আমি বিশ্বাস করতাম, মানব আত্মার উপরে শক্তি জাগিয়ে তোলা যায়। কিন্তু ভুল করেছি। চক্র ভাঙতে গিয়ে দেখি, আমিই তার ভিতরে আটকে গেছি। এবার একমাত্র উপায়—যে তন্ত্র শুরু হয়েছিল, তা সমাপ্ত করতে হবে। তবে তা করতে গেলে চাই আত্মবলিদান। আমি প্রস্তুত। কিন্তু অঘোরানন্দ এখনও তোমাদের মাঝে ঘুরে বেড়ায়।”
চিঠির শেষে একটা শব্দ ছিল, যা অরিজিৎ কখনও শোনেনি — “চিত্রলেখা”। এটা কার নাম? কোনও দেবীর? নাকি অঘোরানন্দের কোনো শিষ্যা? পরের কয়েকদিনে সে খোঁজ করতে গিয়ে শোনে, এই গ্রামে একসময় এমন একজন নারী ছিলেন, যাকে “চিত্রলেখা দিদিমা” বলা হতো। তিনি থাকতেন একা, নদীর ধারে, একটা পোড়োবাড়িতে। মানুষ বলত, তিনি ভবিষ্যৎ বলতে পারতেন, আর রাত হলে কেউ তার কাছে যেত না। এখন সেই বাড়িটা পড়ে আছে শুন্য, পরিত্যক্ত।
অরিজিৎ স্থির করেন, তার পরবর্তী গন্তব্য সেই চিত্রলেখার বাড়ি। কিন্তু তার আগে সে বুঝে গেছে, চক্রপুরে আজ যা ঘটছে, তা নিছক কুসংস্কার নয়। বরং এটা এক সুসংগঠিত পুনর্জন্ম, যেখানে অতীত আবার ফিরে আসছে—নতুন রক্তে, নতুন দেহে। আর সেই চক্র এখন ৭৯-এ দাঁড়িয়ে। রুবেল নিখোঁজ হওয়ায় সংখ্যাটা ৮০ তে পৌঁছেছে। এখন দরকার আরও চারজন। সে জানে, এ লড়াই শুধু গবেষণার নয়, এটা সময়ের বিরুদ্ধে এক যাত্রা—যেখানে জয় মানে জীবন, আর ব্যর্থতা মানেই চক্রের পূর্ণতা। অঘোরানন্দ আর কেবল ইতিহাসের নাম নয়, সে আজকের রাতেও ঘোরে নদীর ধারে, বটগাছের ছায়ায়, আর তান্ত্রিক ধূপে, প্রতীক্ষায়… চুরাশির পরিণতি ঘটানোর।
৬
দিনভর সূর্যের আলো থাকলেও চক্রপুরের আকাশ যেন সীসের ছায়ায় ঢাকা, আর সন্ধ্যা নামতেই প্রতিটি ঘরে, প্রতিটি মানুষে নেমে আসে নিরব আতঙ্ক। কেউ তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে, কেউ ধূপ জ্বালায়, আর কেউ নিঃশব্দে মন্ত্র পড়তে থাকে, যেন কোনো অদৃশ্য কিছুকে শান্ত রাখার প্রচেষ্টা। এমন এক সন্ধ্যাবেলায় অরিজিৎ দাঁড়িয়ে থাকে চিত্রলেখার বাড়ির সামনে। নদীর ধারে, বাঁশঝাড়ে ঘেরা, ভেঙে পড়া একটা বাড়ি—যার দরজা নেই, জানালায় কাঁচের বদলে ধুলো, আর দেওয়ালে আঁচড়ের দাগ। তার রেকর্ডার অন করে সে বাড়ির ভেতরে পা রাখে। মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা পোড়া ধূপের কাঠি, কয়েকটা পুতুল, আর এক কোনায় অদ্ভুত প্রতীক আঁকা কাঁচের বাটি—যাতে এখনো হালকা নীলাভ আলো জ্বলজ্বল করছে। হঠাৎ তার রেকর্ডারে আওয়াজ ধরা পড়ে—একটা মেয়েলি গলা, অনেকটা কান্নার মতো, আবার অনেকটা আহ্বানের মতো—“ঘোর… ঘোরে… ফিরে এসো…” শব্দটা শুনে গা ছমছম করে ওঠে। সে ঘরের এক কোণে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। বাটির পাশে রাখা একটা ছেঁড়া ডায়েরিতে লেখা—“অঘোরানন্দ-এর শক্তি পূর্ণ নয়, যতদিন না মধ্যচক্রের নারীসত্তা জাগ্রত হয়। আমি তার বাহক, চিত্রলেখা। আবার আসব। আবার শোধ করব।”
বাইরে তখন হাওয়া বাড়ছে, বাঁশঝাড়ে সোঁ সোঁ শব্দ। হঠাৎ মনে হয়, কেউ যেন কানের কাছে নিঃশ্বাস ফেলল। সে চমকে উঠে দরজার দিকে তাকায়—কেউ নেই। কিন্তু ঘরের মেঝেতে হঠাৎ একটা শব্দ—চটচট করে কিছু ভেজা পায়ের ছাপ তৈরি হচ্ছে। একজোড়া নগ্ন পা, ছোপছোপ কাদা, পেছনে রক্তরেখার মতো আঁচড়। পায়ের ছাপ এগিয়ে এসে থেমে যায় ডায়েরির সামনে। তারপর বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, মোমবাতির শিখা টলে ওঠে, আর রেকর্ডারে আবার সেই আওয়াজ—“আর মাত্র তিন… তুমি জানো না, তুমিও চক্রে আছো।”
সেদিন রাতে, ফিরে এসে অরিজিৎ সমস্ত কিছু দামিনীকে খুলে বলে। দামিনী কাঁপা গলায় স্বীকার করে—তার দেহেও জন্মচিহ্ন রয়েছে, যা এক প্রাচীন তান্ত্রিক মুদ্রার অনুরূপ। তার ঠাকুর্দা নাকি বলতেন, দামিনী “দ্বিতীয় জন্ম”-এর বাহক। সে বহুদিন ধরে দুঃস্বপ্ন দেখে—নদীর ধারে এক বৃত্তে বসে থাকা লোক, তাদের মুখ ঢাকা, আর তারা তাকেই ডাকছে মন্ত্রপাঠের জন্য।
অরিজিৎ এবার বুঝে যায়, চক্র শুধু ইতিহাস নয়—এটা বর্তমান। আর চিত্রলেখা, অঘোরানন্দ, ধূর্জটি—সবাই ছিল এক চক্রের অন্তর্ভুক্ত। এই চক্র একবার গঠিত হয়ে ছিল, ধ্বংস হয়নি, বরং তার চক্রধারীরা পুনরায় জন্ম নিচ্ছে, পুনরায় ফিরছে। সে নোটবুকে টুকে রাখে:
“চিত্রলেখা = মধ্যচক্রের নারীসত্তা
ধূর্জটি = বাহক যিনি চক্র ভাঙার চেষ্টা করেছিলেন
দামিনী = পুনর্জন্মপ্রাপ্ত শরীর
আমি = কে?”
হ্যাঁ, এই ‘আমি’ নিয়ে প্রশ্ন জাগে তার ভিতরে। কেন সে এই গ্রাম বেছে নিল? কেন তার হাতেই পাণ্ডুলিপি এল? কেন তার রেকর্ডারেই ধরা পড়ে অদৃশ্য আওয়াজ? সেই রাতে সে ঘুমাতে পারেনি। জানালার বাইরে নদীর দিক থেকে আবার সেই কণ্ঠস্বর—“চক্র অসম্পূর্ণ… চিত্রলেখা ফিরে এসেছে… এখন শুধু সময়…”
তারপর হঠাৎ নিখোঁজ হয় আরও এক শিশু—পল্লব। তার খাটে পাওয়া যায় একটি সাদা ফুল, তাতে লেগে রক্তের দাগ। গ্রাম উত্তাল হয় না। বরং সবাই চুপ করে থাকে, যেন পূর্বানুমিত ঘটনার স্বীকৃতিতে নীরব।
চক্র এখন ৮১-তে পৌঁছেছে। আর মাত্র তিন।
চিত্রলেখা জেগে উঠেছে।
অরিজিৎ জানে, আর সময় নেই।
তাঁকে খুঁজে বার করতে হবে সেই তিন আত্মাকে—পূর্বের চক্রের পূর্ণতা রুখতে হলে যাদের জাগরণ থামাতে হবে।
না হলে, মধ্যচক্রে বসবে অঘোরানন্দ নিজে।
আর তখন চক্রপুর আর গ্রাম থাকবে না—থাকবে শুধু এক চক্রের চৌরাশি বাহক, যারা রক্তে লিখবে নতুন ইতিহাস।
৭
চক্রপুরে সকাল বলতে এখন শুধুই আলো—সেই আলোর নিচে মুখ নেই, হাসি নেই, কেবল আতঙ্কের ছায়া। পল্লব নিখোঁজ হওয়ার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লেও কেউ প্রতিক্রিয়া জানায় না। শুধু মৃদু ফিসফাস—“আর মাত্র দুই…” এই কথাটাই বারবার শোনা যায়, যেন সকলে জেনে গেছে চক্রের ঘড়ি কোথায় দাঁড়িয়ে। অরিজিৎ এদিন সকালে রঘুনাথ মুখিয়ার কাছে যায়। বৃদ্ধের চোখে হতাশা, কণ্ঠে চাপা ভয়—“তুমি বলছো চক্র বন্ধ করতে হবে, কিন্তু যাদের শরীরে আগুন বইছে তারা নিজেরাই জানে না তারা কারা। আগুন একদিন তাদের দগ্ধ করবেই।” কথাটা শুনে অরিজিৎ ভাবে—চক্রের যাদের জন্ম হয়েছে, তাদের মধ্যে হয়তো কেউ কেউ নিজের পরিচয়ই জানে না। তারা স্বাভাবিক মানুষ, যারা হয়তো কেবল স্বপ্নে কিছু দেখে, কানে শোনে কিছু অচেনা মন্ত্র, আর ভাবে সেটা ভুল। এই ভুলটাই হয়তো তাদের নিয়তি।
সে দামিনীর সঙ্গে যায় নদীর ঘাটে। পল্লবের খোঁজে নয়, বরং খুঁজে ফেরে সেই চিহ্ন, যেটা চক্রের কেন্দ্র বলে পাণ্ডুলিপিতে লেখা ছিল। নদীর বাঁকে যেখানে বাঁশঝাড়ের নিচে একটা খোলা জায়গা, সেখানে খুঁজতে খুঁজতে তারা দেখতে পায় মাটিতে খোদাই করা এক মণ্ডলচিহ্ন—আটটি রেখার ঘূর্ণি, যার কেন্দ্রে খোলা একটি খোপ। দামিনী কাঁপতে কাঁপতে বলে, “আমার স্বপ্নে এই জায়গাটাই দেখি… কিন্তু তখন এখানে বসে থাকে কালো কাপড় পরা কিছু মানুষ। তারা বলে—‘তুমি এসেছো মধ্যচক্রের জন্য।’” অরিজিৎ নোট করে—এই স্থানেই সম্ভবত ‘মধ্যচক্রের বলি’ হয়, এখানে নাকি নবীন আত্মা উৎসর্গ হয় চক্রের পূর্ণতায়। ঘাটের এক কোণে তারা খুঁজে পায় পোড়া ধূপের কাঠি, আর একটি আধপোড়া খেলনা গাড়ি। পল্লব ও রুবেল দুজনেই খেলনা গাড়ি নিয়ে খেলা করত, এ গ্রামে এমন তথ্য সে আগেই পেয়েছিল। তার মানে, এ স্থানে শিশুদের আনা হয়, আর এখানেই কোনো এক প্রাচীন পদ্ধতিতে তাদের ‘উৎসর্গ’ করা হয় চক্রে।
সেই রাতে অরিজিৎ ফিরে এসে চিত্রলেখার বাড়ির ডায়েরি খুলে বসে। সেখানে একটি পৃষ্ঠা পড়ে সে স্তম্ভিত হয়ে যায়। লেখা—“চুরাশি সংখ্যাটা পূর্ণ হয় যখন চক্রে নবীন ও প্রবীণের ভারসাম্য হয়। সাতজন শিশুবলি ও সাতজন প্রাপ্তবয়স্ক আত্মা চাই, যাদের পুনর্জন্ম চক্রের জন্য নির্ধারিত। এবারকার চক্রে এখনো দুটি প্রবীণ আত্মা ঘুমিয়ে রয়েছে, আর একটি শিশুবলি বাকি।”
এই তথ্য ভয়ানক। এর মানে, শুধু শিশু নয়—প্রাপ্তবয়স্করাও জড়িয়ে আছে এই চক্রে। যারা আগে চক্রে ছিল, তারা হয়তো আজ আবার জন্ম নিয়েছে এই গ্রামে, এই সমাজে—স্বাভাবিক মানুষ রূপে। তাদের কাউকে জাগিয়ে তুলতে পারলেই চক্র সম্পূর্ণ হবে। আর জাগিয়ে তোলার চাবিকাঠি হয়তো সেই চিত্রলেখা, যার শরীরে ছিল মধ্যচক্রের মুদ্রা।
পরদিন সকালে এক ঘটনা ঘটে যা চক্রপুরকে নাড়া দিয়ে দেয়। সুদীপ্তা দে, গ্রামের স্কুলশিক্ষিকা ও দামিনীর বান্ধবী, হঠাৎ আচরণে অস্বাভাবিক হয়ে ওঠেন। ক্লাস চলাকালীন তিনি হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, “ওঁ হ্রীং অঘোরং… চক্রং…”—যা চিত্রলেখার ডায়েরির প্রাচীন মন্ত্রের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। অরিজিৎ খবর পেয়ে স্কুলে ছুটে যায়, দেখে সুদীপ্তা বেহুঁশ অবস্থায় পড়ে আছেন, আর তাঁর হাতের তালুতে অদ্ভুত আঁকিবুঁকি—যা চক্রের এক সদস্য ‘বৈরাগী মুখ’-এর চিহ্ন ছিল পাণ্ডুলিপি অনুযায়ী।
তারপর রাতে সুদীপ্তা জ্ঞান ফিরে পেলে বলে, “আমার মনে হচ্ছে আমি এখানে আগেও ছিলাম… ঘাটে… আঁকা মাটির মণ্ডলের মাঝখানে বসে ছিলাম… আমায় ঘিরে কেউ মন্ত্র পড়ছিল…” এই স্মৃতি কি তার নিজের? নাকি পূর্বজন্মের? অরিজিৎ সিদ্ধান্ত নেয়, চক্রের পুনর্জন্ম হয়েছে—আর সুদীপ্তা তাদের একজন। তার রেকর্ডারে এখন তিনজনের নাম জমা হয়—সুদীপ্তা (বৈরাগী মুখ), দামিনী (চিত্রলেখার বাহক), অরিজিৎ (অজানা ভূমিকা)।
চক্র এখন ৮২তে এসে দাঁড়িয়েছে—৬ জন শিশু বলির ৬টি প্রাণ উৎসর্গিত, একজন বাকি। আর প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেও একজন জেগে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে অরিজিৎ সিদ্ধান্ত নেয়, তাকে আর শুধু গবেষক নয়, রক্ষক হয়ে উঠতে হবে। না হলে, যে চক্র পুরোহিত ধূর্জটি ভাঙতে পারেননি, তা পূর্ণ হয়ে যাবে এবার।
চক্রপুর অপেক্ষা করছে পূর্ণিমার রাত্রির জন্য—যেদিন চক্রের কেন্দ্র আবার জ্বলে উঠবে, এবং অঘোরানন্দ নিজে এসে বসবে মধ্যবিন্দুতে।
আর ততদিনে যদি সেই শেষ শিশু হারিয়ে যায়…
তাহলে চক্র আর কখনো বন্ধ হবে না।
চক্রপুর হয়ে উঠবে এক “তান্ত্রিক অভিসার” —
যেখানে প্রতিটি দেহের নিচে থাকবে পূর্বজন্মের ছায়া…
আর প্রতিটি ছায়া থেকে গন্ধ উঠবে ধূপ, রক্ত, আর মৃত্যুর।
৮
চক্রপুরের বাতাস যেন পুরু হয়ে এসেছে—কুয়াশা শুধু চোখে নয়, মনে ঢুকে গেছে। গ্রামের প্রতিটি পথ, প্রতিটি দালান আজকাল যেন কোনো ছায়ার অংশ, যেখানে সময় চলেও দাঁড়িয়ে থাকে। অরিজিৎ এখন আর গবেষক নয়—সে এখন এই চক্রের এক অনিচ্ছুক যাত্রী, আর হয়তো একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী, যে জানে কী হতে চলেছে।
সেই রাতে, যখন চাঁদ ছিল খণ্ডিত, অরিজিৎ পৌঁছে যায় ধূর্জটি ভট্টাচার্যের পুরোনো ঘরে, আবার। কিন্তু এবার একা নয়। সঙ্গে আছে দামিনী এবং রঘুনাথ মুখিয়া—দুজনেই জানে, এই ঘরের কোথাও লুকিয়ে আছে সেই চিঠি, যা হয়তো শেষবারের মতো খুলে দেবে চক্রপুরের মুখোশ। ঘরের মেঝের নিচে একটি কাঁসার পাত্রের ভিতর তারা পায় এক মোটা খাম, যার গায়ে লেখা ‘শেষ পূর্ণিমার আগে খুলতে’। তিনজনে মোমবাতির আলোয় বসে পড়ে তা পড়তে।
চিঠি শুরু হয়েছে এইভাবে—
“আমি ধূর্জটি, চক্রের বাহক, অঘোরানন্দের প্রাক্তন শিষ্য। আমার জন্ম ছিল তন্ত্রের মধ্যে, আর শেষও হবে তন্ত্রের মধ্যেই। এই চক্রের সত্য যাদের জানা নেই, তারা শুধু ভয় পায়। কিন্তু যারা জানে, তারা বোঝে—ভয়ের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে শক্তি। এই চক্র একবার সম্পূর্ণ হলে, আমাদের পৃথিবীর নিয়ম ভেঙে যাবে। জীবন ও মৃত্যুর মধ্যকার রেখা মুছে যাবে, আর মধ্যচক্রের বাহক—সে যদি নারী হয়—তবে অঘোরানন্দের আত্মা স্থায়ীভাবে রূপ পাবে মানবদেহে। আমি তাকে আটকাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারিনি। কারণ চক্র তৈরি হয় চেতনায়, তাকে দেহ দিয়ে বন্ধ করা যায় না।”
চিঠির বাক্যগুলি একের পর এক কাঁপিয়ে দিতে থাকে অরিজিৎ-দের। তারা বুঝতে পারে, ধূর্জটি আত্মহত্যা করেননি; তিনি ছিলেন চক্রের প্রথম ভাঙনকারী—এক বিপ্লবী সাধক, যিনি বুঝেছিলেন এই চক্র একসময় উন্মাদনায় রূপ নেবে। চিঠির শেষ দিকে একটি লাইন রয়েছে—
“তোমরা যদি এই চিঠি পড়ছো, জেনো—চক্র আবার পূর্ণ হতে চলেছে। এখন দরকার একটি শিশুবলি এবং দুটি প্রাপ্তবয়স্ক আত্মার জাগরণ। তাদের একজন সেই, যার চোখে আগুনের রেখা ছিল জন্ম থেকেই—দেখো আশেপাশে। সে আছে, কিন্তু জানে না।”
চিঠির নিচে একটি খণ্ডচিত্র আঁকা—একটি চোখ, যার মণিতে রয়েছে অগ্নির আভাস। সেই চিহ্ন দেখে রঘুনাথ মুখিয়ার হাত কাঁপে। সে বলে—“এই চিহ্ন আমি কোথায় যেন দেখেছি… আমাদের গ্রামের এক যুবক, অভীক… ছোটবেলা থেকেই তার চোখে এমন রেখা দেখা যেত। কিন্তু তার পরিবার গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিল কয়েক বছর আগে।”
অরিজিৎ এই তথ্য শুনে বিচলিত হয়ে ওঠে। তাহলে কি অভীক সেই ‘দ্বিতীয় প্রাপ্তবয়স্ক আত্মা’? সে কি জানে তার ভিতরে কে বাস করে?
পরদিন সকালেই তিনজনে সিদ্ধান্ত নেয়, অভীককে খুঁজে বার করতেই হবে। কিন্তু ঠিক তখনই খবর আসে—আরও একটি শিশু নিখোঁজ। এবার গোটা গ্রামে চাপা বিস্ফোরণ। কেউ চিৎকার করে না, কিন্তু চোখে মুখে স্পষ্ট আতঙ্ক—চক্র এখন ৮৩!
এরপর, দুপুরবেলা অরিজিৎ একা যায় নদীর ঘাটে। সেই মণ্ডলচিহ্নের পাশে সে বসে থাকে কিছুক্ষণ, কানে রেকর্ডার। হঠাৎ, বাতাস ভারী হয়ে আসে। ছায়ার মতো এক আকার তার পাশে বসে। রেকর্ডারে আওয়াজ—
“তুমি শেষ বাহক। তুমিই চক্রের শেষ প্রবেশদ্বার।”
সে কাঁপা হাতে রেকর্ড বন্ধ করে উঠে দাঁড়ায়। এখন তার সামনে শুধু একটাই রাস্তা—অভীককে খুঁজে বার করা, চক্রের শেষ পাদানিতে পৌঁছনোর আগে।
রাতে দামিনী তাকে একটি পুরোনো নোট দেয়। সেটি চিত্রলেখার লেখা—
“যদি চক্র বন্ধ করতে চাও, তাহলে চক্রের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে তার নিজের ছায়াকে দেখতে হবে। প্রতিটি বাহকের ছায়া প্রকাশ পায় মধ্যচক্রে। কিন্তু তার আগে চাই আত্মোৎসর্গ।”
এই লাইনটা মনে গেঁথে যায় অরিজিৎ-এর।
এই আত্মোৎসর্গ কি আত্মাহুতি?
নাকি সেই ব্যক্তি, যার কারণে চক্র গঠিত হচ্ছে—তাকে নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে?
চক্রপুর এখন দাঁড়িয়ে আছে একটা সীমানায়। সময় খুব কম।
চক্র ৮৩ তে পৌঁছেছে।
প্রবীণ আত্মা—দুই।
শিশু বলি—একটি বাকি।
আর মধ্যচক্র?
সেই স্থান যেন অপেক্ষা করছে কারোর জন্য।
নাকি… অরিজিৎ নিজেই?
৯
চক্রপুরের আকাশে এখন সূর্য নেই, শুধু আলোহীন এক ধূসরতা। যেন প্রতিটি মুহূর্ত চক্রের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের প্রতিটি মানুষ এখন নিঃশব্দে হাঁটে, কথা বলে ফিসফিস করে, কেউ কারও চোখের দিকে তাকায় না। আর এর মধ্যেই এক বিকেলবেলা, গ্রামে পা রাখে একজন পুরুষ—উচ্চ, ছিপছিপে গড়ন, চোখে কালো চশমা, কাঁধে ব্যাগ, মুখে অনিশ্চিত এক অভিব্যক্তি। নাম—অভীক মিত্র। প্রায় আট বছর আগে গ্রামের দক্ষিণপাড়া থেকে পরিবারসহ কলকাতা চলে গিয়েছিল। এখন সে ফিরে এসেছে এক অদ্ভুত ডাকে সাড়া দিয়ে—একটি চিঠি, যা নাকি এক বৃদ্ধ তাঁকে পোস্ট করেছিলেন। চিঠিতে লেখা ছিল:
“চক্র অসম্পূর্ণ। তোমার চোখ এখন কথা বলবে।”
অভীক প্রথমে বুঝতে পারেনি—এটা মজা, নাকি কারও ফাঁদ। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে সে অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখছে—নদীর ধারে বসে থাকা মুখোশধারী লোক, চক্র আঁকা মণ্ডলে দাঁড়িয়ে থাকা এক নারী, যার চোখে আগুন। আর সবচাইতে ভয়ঙ্কর—সে নিজেকে বারবার দেখে সেই মণ্ডলের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে, দুই চোখে আগুনের রেখা, আর তার চারপাশে মন্ত্রপাঠ। তাই সে ফিরেছে চক্রপুরে।
অরিজিৎ খবর পায় যে অভীক ফিরে এসেছে। সে সঙ্গে সঙ্গে পৌঁছায় মুখিয়া রঘুনাথের সঙ্গে। অভীক তখন গ্রামের পুরনো পাঠশালার পাশে দাঁড়িয়ে, যেন হারানো স্মৃতির খোঁজে। অরিজিৎ তাঁর দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে—“তোমার চোখে সেই চিহ্নটা এখনও আছে।” অভীক অবাক হয়—“তুমি কে? তুমি জানো আমি কে?”
অরিজিৎ ধীরে ধীরে সব বলে—চক্রের কথা, চিত্রলেখা, অঘোরানন্দ, ধূর্জটির আত্মবলিদান, আর এখনো অসম্পূর্ণ থাকা ৮৪ তান্ত্রিকের সেই ভয়ঙ্কর বৃত্তের। অভীক প্রথমে কিছুই বিশ্বাস করতে চায় না। কিন্তু ঠিক তখনই দামিনী আসে সামনে। তাঁর হাতে এক পুরনো আয়না, ধূর্জটির ঘর থেকে পাওয়া। আয়নায় অভীক তাকাতেই চমকে ওঠে। নিজের চোখে সে দেখে একটি অদ্ভুত প্রতিচ্ছবি—সে নিজে, কিন্তু তার চোখদুটো জ্বলছে অগ্নিশিখায়, পেছনে দাঁড়িয়ে আছে আট জন ছায়ামূর্তি। সেই মুহূর্তে তার মাথায় একটা চাবুকের মতো শব্দ বাজে—
“তুমি ফিরে এসেছো। আমরা অপেক্ষা করেছি।”
অভীক কেঁপে ওঠে। বসে পড়ে মাটিতে। “আমি কে? আমার ভেতরে কে আছে?”
রঘুনাথ বলে, “তুমি চক্রের সেই প্রবীণ আত্মাদের একজন, যারা পূর্বজন্মে অঘোরানন্দের শিষ্য ছিলে। তোমার চোখে জন্মচিহ্ন আছে—তুমি ‘অগ্নিনেত্র’ নামে পরিচিত ছিলে। তোমার কাজ ছিল চক্রের শক্তিকে উদ্দীপ্ত করা। এখন সেই শক্তি জাগছে তোমার ভেতরেই।”
তখনই অরিজিৎ বলে, “আর তুমি একা নও। আমি নিজেও হয়তো এই চক্রের একজন, কিন্তু আমার ভূমিকা এখনো অজানা।”
সেদিন রাতে, চক্রপুরে আবার অদ্ভুত কিছু ঘটে।
নদীর ঘাটে পাওয়া যায় আরেক শিশুর পায়ের ছাপ, কিন্তু সে ফিরে আসে সকালে—কিন্তু অবসন্ন, স্মৃতিশূন্য। শিশুটির নাম কিশোর। সে কিছুই মনে করতে পারে না, শুধু বলে—“কাল রাতে কেউ একজন আমার হাত ধরে বলছিল—‘তুমি এখনো প্রস্তুত নও।’”
এই ঘটনার পর প্রথমবার চক্রপুরে এক ফাটল পড়ে—চক্র থমকে গেছে। চক্র যে পূর্ণ হওয়ার কথা ছিল ৮৪-এ, এখন থেমে আছে ৮৩ তে। কেন?
অরিজিৎ বুঝতে পারে, কেউ একজন ইচ্ছাকৃতভাবে চক্র থামাতে চাইছে। হয়তো সে-ই, যে চক্রে থাকা সত্ত্বেও চায় না এটি সম্পূর্ণ হোক।
চিত্রলেখার ডায়েরি অনুযায়ী, মধ্যচক্রে দাঁড়াতে পারে একমাত্র সেই, যে নিজের আত্মা চক্রকে উৎসর্গ করতে পারে। আর সেটাই চক্রের মূল দুর্বলতা—নিজের আত্মা দিলে, চক্র ভাঙে। না হলে তা স্থায়ী হয়।
তখনই অভীক বলে—“তাহলে আমি কি সেই আত্মা? আমার আত্মা দিলে কি চক্র থামবে?”
দামিনী তার হাত ধরে বলে, “তুমি যদি যাও, চক্র হয়তো থামবে। কিন্তু আমরা কি তোমায় হারাতে পারব?”
অভীক চুপ করে যায়।
রাতে তিনজন মিলে সিদ্ধান্ত নেয়—পরের পূর্ণিমার রাতে তারা যাবে সেই কেন্দ্রমণ্ডলে, যেখানে অঘোরানন্দ জাগ্রত হওয়ার অপেক্ষায়। এবং সেদিনই ঠিক হবে, কে চক্রকে পূর্ণ করবে, আর কে তাকে চিরতরে থামিয়ে দেবে।
চক্রপুর এখন নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে সেই রাতে—
যেদিন শেষ হবে ইতিহাসের এক প্রাচীন চক্র…
অথবা শুরু হবে তন্ত্রের এক নতুন রাজত্ব,
যেখানে সময়ও বন্দী থাকবে অঘোরানন্দের শ্বাসে।
১০
পূর্ণিমার রাত চক্রপুরে আগেও এসেছে, বারবার। কিন্তু এই রাত—এই একটি নির্দিষ্ট রাত—চক্রপুরের জন্য ছিল নিয়তির মতো লেখা, আগুনের মতো অপরিহার্য। গ্রামের আকাশ আজ রাতে ছিল আশ্চর্য রকম স্পষ্ট, অথচ কুয়াশায় ঢাকা; বাতাস ভারী, অথচ স্তব্ধ।
নির্ধারিত সময়ের আগেই দামিনী, অভীক এবং অরিজিৎ পৌঁছে যায় সেই পুরোনো নদীর ঘাটে, যেখানে এককালে চক্রের মূল মণ্ডল আঁকা হয়েছিল। আজ সেই জায়গাটাকে ঢেকে রাখা হয়েছে নতুন মাটি দিয়ে। কিন্তু দামিনী জানে, মাটির নিচে এখনো লুকিয়ে রয়েছে সেই প্রতীক—চক্ররূপী আঁকা এক বৃত্ত, যার কেন্দ্রে জেগে ওঠার অপেক্ষায় রয়েছে এক শক্তি, এক আত্মা—অঘোরানন্দ।
তারা তিনজন একসঙ্গে খনন শুরু করে, পুরোনো মণ্ডলটি বের করে আনে ধীরে ধীরে। ধুলো ঝরে যায়, পুরোনো প্রতীক গাঢ় হয়ে ওঠে। ঘড়ির কাঁটা তখন রাত ১১টা ছুঁয়েছে। হঠাৎ দূরে দেখা যায় ছায়ামূর্তির মিছিল—নিরব, মুখোশধারী, হাতে ধূপ। তারা ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ায় মণ্ডলের বাইরে। কারো মুখ দেখা যায় না, কিন্তু চোখদুটো আগুনের মতো জ্বলছে।
তখনই বাতাস বদলে যায়। একটা অদ্ভুত গন্ধ—ধূপ, রক্ত, আর পোড়া কাঠের মিশ্রণে—পুরো চক্রপুরকে ঢেকে নেয়। সেই গন্ধে মাথা ঘুরে ওঠে অভীকের, চোখ বন্ধ করে সে শুয়ে পড়ে মণ্ডলের কেন্দ্রস্থলে।
ঠিক সেই মুহূর্তে, ছায়া-মিছিল থেকে বেরিয়ে আসে একজন বয়স্কা নারী, যার শরীরে কালো শাড়ি, হাতে রক্তমাখা পুঁথি, আর গলায় ঝুলছে চিতার ছাই দিয়ে তৈরি মালা। দামিনী ফিসফিস করে বলে—
“ওই তো… চিত্রলেখা।”
কিন্তু সে চিত্রলেখা নয়, বরং তার পুনর্জাগ্রত আত্মা—চক্রের মধ্যচক্র, যে নিজের ভেতর ধারণ করেছে অঘোরানন্দের মূল শক্তি। নারী মৃদু কণ্ঠে বলে,
“শেষ একজন প্রস্তুত… এখন বলি চাই… নয়তো চক্র অপূর্ণ থাকবে…”
এই কথা শুনেই অভীক চোখ খুলে বলে,
“তবে আমার বলি নাও। আমার আগুন, আমার আত্মা—এই চক্রে শেষ হোক।”
সে উঠে দাঁড়ায়, তার চোখে সেই অগ্নিমণি এখন স্থায়ী, তার মুখে প্রাচীন মন্ত্র:
“ওঁ ঘোরে ঘোরে অঘোরমস্তু চক্রং পূর্ণং কুরু কুরু স্বাহা।”
কিন্তু ঠিক তখনই, অরিজিৎ চিৎকার করে উঠে দাঁড়ায়—
“না! চক্রে কেউ বলি না দেবে। কারণ চক্র পূর্ণ হয় আত্মাহুতি নয়, আত্মউপলব্ধিতে। আমাদের জন্ম হয়েছিল পূর্বজন্মে, কিন্তু আমাদের মুক্তি হবে এই জন্মেই।”
সে হাতের রক্ত দিয়ে মণ্ডলের কেন্দ্রস্থলে আঁকে একটি প্রতীক—তিনটি বিন্দু ঘিরে থাকা এক বন্ধ বৃত্ত। এই প্রতীক ধূর্জটির চিঠিতে ছিল—চক্রবন্ধ। প্রতীকটি আঁকা মাত্র বাতাস স্তব্ধ হয়ে যায়। ছায়ামূর্তিরা পেছনে হটে, চিত্রলেখার মুখ থেকে পড়ে যায় মুখোশ, আর বেরিয়ে আসে শীতল চোখের এক নারী—ভীষণ পরিচিত।
তিনি দামিনী।
অথচ… সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দামিনীও তো আছে!
অরিজিৎ বুঝতে পারে—দুইটি দামিনী আছে না, বরং চিত্রলেখার আত্মা তার ছায়ার রূপে বাঁধা ছিল এতদিন, আর এই প্রতীক এখন সেই ছায়া মুক্ত করছে। দামিনী মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, আর তার মুখে ফুটে ওঠে প্রশান্তি।
অভীক এগিয়ে যায়, সে বলে—
“আমি এই চক্রের বাহক, কিন্তু আমি পূর্ণতা চাই না। আমি মুক্তি চাই।”
সে চক্রের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে নিজের হাতে পুঁথিটি ফেলে দেয় নদীতে। সঙ্গে সঙ্গে আকাশে বজ্র নেমে আসে, চক্র কাঁপতে থাকে, আর সেই ছায়া-মিছিল মিলিয়ে যায় হাওয়ার সঙ্গে।
চক্রপুরে প্রথমবার পূর্ণিমার রাতে বাতাসে কাঁপন নয়, আসে প্রশান্তি।
চক্র এখন ভাঙা, কিন্তু পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি।
শেষ দৃশ্যে অরিজিৎ দাঁড়িয়ে আছে নদীর ঘাটে। তার নোটবুকে লেখা—
“চক্র ভাঙে, কিন্তু তার ছায়া থাকে। হয়তো ভবিষ্যতে আবার কেউ এই প্রতীক খুঁজে পাবে। কিন্তু সেইদিনেও কেউ একজন বলবে—‘না, চক্র নয়, জীবন বেছে নাও।’”
পেছনে দামিনী দাঁড়িয়ে বলে—
“তুমি কি ফিরে যাবে কলকাতায়?”
অরিজিৎ মৃদু হেসে বলে—
“না, এখন চক্রপুর আমার গবেষণা নয়—এ আমার দায়। আর হয়তো… ভালোবাসাও।”
—
[সমাপ্ত]