দীপান্বিতা রায়চৌধুরী
১
ঘূর্ণি গ্রামটা যেন সত্যিই সময়ের বাইরে পড়ে আছে—পথের ধারে টালির ছাউনির বাড়িগুলো, পুকুরঘাটে সাদা শাড়ি পরা বধূর মুখে মেঘ জমা চোখ, আর সেই নদী, যাকে ঘূর্ণি বলে, সে যেন জলের বদলে গোপন ইতিহাস বইয়ে চলে যায়। ১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাস, দেশভাগের আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে, তবু এই গ্রামটায় একটা ভিন্ন নৈঃশব্দ্য। পাখির ডাক, নদীর ছলাৎছল, আর দুপুরের নিস্তব্ধতা—সব মিলিয়ে অচিন্ত্য সেনের চোখে প্রথম দর্শনে ঘূর্ণি এক ধরনের অদ্ভুত মায়ার মতো লাগল।
অচিন্ত্য তখন সদ্য পাশ করা একজন তরুণ শিক্ষক, কৃষ্ণনগরের ছাত্র, কিন্তু আদর্শে গাঁথা এক প্রবল দেশপ্রেমিক। আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ পুলিশের লাঠির ঘা খেয়েছে, কিন্তু বাবার অশান্ত মুখ দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবার একটু স্থির জীবন চাই। সেই স্থিরতার সন্ধানেই সে এই ঘূর্ণি গ্রামের হাইস্কুলে চাকরি নিয়েছে। কেউ বলে এখানে সেভাবে শিক্ষিত লোক আসেই না, কেউ আবার বলে জমিদারবাড়ির ছায়া গায়ে মেখে এই গ্রামের মানুষেরা আজও ভয় পায় আধুনিকতা।
স্টেশন থেকে নেমে পায়ে হেঁটে স্কুলের রাস্তা ধরতেই প্রথম যেটা তার চোখে পড়ে সেটা হলো এক বিশাল বটগাছ, গায়ে সাদা রঙের ফোঁটা আর লাল সুতোর বাঁধন—লোকমুখে শোনা যায় ওখানে এক সময় ব্রাহ্মদের সভা বসত। এরপর দেখা গেল মাটির রাস্তার শেষে একটা লাল ইটের দোতলা বাড়ি—ওটাই স্কুল। হেডমাস্টার চিত্তরঞ্জন মিত্র খুবই সাদামাটা, বিনয়ী মানুষ। তিনি অচিন্ত্যকে দেখেই বললেন, “আপনাকে দেখেই বুঝতে পারছি শহরের ছেলে, এইখানে থাকতে পারবেন তো?” অচিন্ত্য হাসল, “আমার থাকার মধ্যে তো দেশটাই নেই, এখন নতুন করে বানাতে হবে।”
চাকরির জন্য বরাদ্দ কোয়ার্টার তখনো ঠিক হয়নি, ফলে অচিন্ত্যকে গ্রামের এক প্রান্তে, পুরোনো এক কুটিরে থাকতে হচ্ছে—বাড়িটার মালিক বৃদ্ধ হরিমোহন দত্ত, যিনি একসময় জমিদারবাড়ির কেরানির কাজ করতেন। কথায় কথায় বললেন, “এই গ্রামটা আগেও ছিল, এখনও আছে, কিন্তু আপনি যদি খুব বেশি জিজ্ঞাসা করেন, মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেবে।” অচিন্ত্য জিজ্ঞেস করল, “কেন? কী এমন আছে?” বৃদ্ধ উত্তর না দিয়ে শুধু বললেন, “ঘূর্ণি নদীর ধারে বেশি যাওয়া ভালো নয় সন্ধের পর।”
পরদিন সকালে স্কুলে প্রথম ক্লাস ছিল অষ্টম শ্রেণির ছেলেমেয়েদের নিয়ে। তারা অবাক হয়ে অচিন্ত্যর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন সে ভিনগ্রহের কেউ। তবে অচিন্ত্য মন থেকে চেষ্টা করে তাদের সঙ্গে সহজ হতে। ক্লাস শেষে স্কুলের লাইব্রেরি দেখতে চাইল সে—ছোট্ট একটা ঘর, কাঠের তাক ভর্তি পুরোনো বই। একটা বই টানতেই দেখল পেছনের দেওয়ালে কেমন যেন এক ফাঁক ধরা পড়ল। দেয়াল যেন হালকা নড়ছে।
সন্ধে নাগাদ সেই কুটিরে ফিরে এসে অচিন্ত্য নদীর ধারে হাঁটতে বেরোয়। পায়ের নিচে শুকনো পাতা খচখচ শব্দ করে আর মাথার ওপরে নামছে সন্ধের অন্ধকার। দূরে দেখা যায় একটা পুরোনো ইমারত, ধ্বংসস্তূপের মতো—অচিন্ত্য প্রথমে ভেবেছিল ওটা কোনো পুরোনো মন্দির, কিন্তু পেছন থেকে কে যেন বলল, “ওটা জমিদারবাড়ি। আজকাল কেউ যায় না।” ফিরে তাকিয়ে দেখে এক বালিকা দাঁড়িয়ে আছে, বয়স বারো-তেরো হবে।
সে বলে, “আপনি নতুন এসেছেন না?” অচিন্ত্য মাথা নাড়ে। মেয়েটি বলে, “আপনি ও বাড়িতে যাবেন না তো?” অচিন্ত্য জিজ্ঞেস করল, “কেন যাব না?” মেয়েটি চোখ সরিয়ে বলে, “মা বলে ওখানে কেউ গেলে ফিরে আসে না।”
তৃতীয় দিনে হঠাৎ এক আশ্চর্য ঘটল। স্কুলে এসে অচিন্ত্য শুনল, জমিদারবাড়ির কন্যা এসেছেন স্কুল পরিদর্শনে—মৃণালিনী দেবী। হেডমাস্টার তাকে নিয়ে এলেন স্কুল লাইব্রেরিতে, আর অচিন্ত্যর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রথম দর্শনে অচিন্ত্য মুগ্ধ হয়ে গেল। সাদা মালকোচা শাড়ি, চোখে মোটা কাজল, মুখে একরকম গম্ভীরতা—মৃণালিনীর মধ্যে ছিল এক মায়াবী অহং।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কোন স্কুল থেকে পাশ করেছেন?”
অচিন্ত্য বলল, “কলেজ স্ট্রিট থেকে, প্রেসিডেন্সি কলেজ।”
মৃণালিনী হালকা হাসলেন, “ভালো জায়গা ছেড়ে এখানে এলেন কেন?”
অচিন্ত্য একটু থেমে বলল, “শুধু নাম দিয়ে তো দেশ হয় না, রক্ত লাগে। আমি সেই রক্ত দিতে এসেছি।”
মৃণালিনী তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, “ঘূর্ণি নদী বহু রক্ত দেখেছে, মশায়। আপনি কি জানেন ১৯০৫ সালে আমাদের এই গ্রামেই এক বৈপ্লবিক সভা বসেছিল, যার পরের দিন একজন মানুষ নিখোঁজ হয়েছিলেন?”
অচিন্ত্য অবাক, “কে ছিলেন তিনি?”
মৃণালিনী ধীরে বললেন, “জ্যোতির্ময় রক্ষিত। কেউ তাঁকে ভুলে গেছে, কেউ ভুলতে দেয়নি।”
সেদিন রাতে অচিন্ত্য ঘরে ফিরে আর ঘুমোতে পারল না। জ্যোতির্ময় রক্ষিত নামটা তার কানে গেঁথে গেল। লাইব্রেরির সেই ফাঁক দেওয়ালটার কথা মনে পড়ে। সে ঠিক করল পরের দিন একা লাইব্রেরিতে যাবে, আর দেখবে দেওয়ালের আড়ালে কী আছে।
তবে তার আগে, সে আরেকবার যাবে ঘূর্ণি নদীর ধারে—কারণ এখন সে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে—এই নদীর জল শুধু বয়ে যায় না, সে গল্পও বলে।
২
ঘূর্ণি নদীর ধারে দাঁড়িয়ে অচিন্ত্য যেন সময়ের এক চোরাস্রোতে পা রাখল। সন্ধে তখন নেমে এসেছে, জোনাকিরা পুকুরপাড়ে আলো ফেলছে। নদীর ধার ঘেঁষে পায়ে হাঁটা পথ, কচুরিপানার ফাঁকে ছোট ছোট ঢেউ—সেই ঢেউয়ের শব্দে অচিন্ত্যর মনে হল কেউ যেন কিছু ফিসফিস করছে, নদীর জল দিয়ে নয়, জলরেখার নিচে চাপা পড়ে থাকা কোনও অতীত দিয়ে।
সে চুপচাপ বসে পড়ল এক মোটা শিকড়ের ওপর। বাতাসে হালকা শীতের পরশ। নদীর ওপার অন্ধকার, কিন্তু আলো এসে পড়েছে একটা জায়গায়—সেখানে একটা ভাঙা কাঠের নৌকা, পাশেই কিছু পোড়া কাঠ, আর কি যেন একটা কালো মোটা বাক্সের মত পড়ে আছে। সাহস করে এগিয়ে গেল অচিন্ত্য।
বাক্সটা খুলতেই সে দেখল, পুরোনো কাগজ ভর্তি, কিছু ছেঁড়া নোটবুক, আর এক কোণে পড়ে আছে লাল মলাটের একটা পুরোনো খাতা—মোটা অক্ষরে লেখা ‘গোপন দলিল—জ্যোতির্ময় রক্ষিত’।
হাত কাঁপছিল। এতদিন যাঁর নাম শুধু ইতিহাসের আড়ালে ছিল, তাঁর লেখা দলিল হাতে পাচ্ছে সে! খাতা খুলতেই ভেতরে কয়েকটি পাতার ওপর অদ্ভুত চিহ্ন, সঙ্গে ইংরেজিতে লেখা কিছু বাক্য:
“We met under the fig tree near the river. The decision was taken. I will hide the truth where no one can look without love.”
“Love”? ভালবাসা ছাড়া সত্য উদঘাটন করা যাবে না? অচিন্ত্য আরেকটু পড়তেই একটা নাম উঠে আসে: “মৃণালিনী সেন”। তার মুখ এক মুহূর্তে সাদা হয়ে গেল।
সেই রাতের পর ঘুম আসে না। পরদিন স্কুলে গিয়ে সে সোজা লাইব্রেরিতে চলে যায়। হেডমাস্টার তখন অন্য কাজে ব্যস্ত। লাইব্রেরির সেই পুরোনো দেওয়ালটা সে আবার দেখল, ধীরে ধীরে ঠেলে একটা ছোট ফাঁক তৈরি করল। একটা টিনের সিঁড়ির মতো কিছু একটা। আলো ঢোকেনি, ধুলো আর মাকড়সার জাল।
কিন্তু সিঁড়ি নামার আগেই মৃণালিনী দেবী হঠাৎ এসে দাঁড়াল তার পেছনে।
“আপনি এখানে?”—তার গলা স্বাভাবিক, কিন্তু চোখে ছিল চাপা ধমক।
অচিন্ত্য গুছিয়ে বলতে চাইল, “আমি একটা দলিল পেয়েছি নদীর ধারে, তাতে আপনার নাম লেখা…”
মৃণালিনী সামনে এগিয়ে এসে বললেন, “আপনি যদি জানেন আমি কে, তাহলে জানেন আমি কেন এই নামটা ধারণ করেছি।”
অচিন্ত্য একদম স্তব্ধ।
“এই নাম আমার নিজের নয়, আমি সেই জ্যোতির্ময়ের আত্মজা। তিনি আমার পিতা ছিলেন না শুধু, এই গ্রামের আত্মাও ছিলেন। কিন্তু দেশ তাঁকে ভুলেছে। কারণ তিনি এক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন—তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে প্রেম দিয়ে যুদ্ধ জেতা যায়। এবং তিনি হেরে গিয়েছিলেন।”
অচিন্ত্য কিছু বলল না, শুধু তাকিয়ে রইল।
মৃণালিনী ধীরে বললেন, “এই লাইব্রেরির পেছনে আছে আমাদের গোপন সভার কক্ষ। সেখানেই প্রথম বিপ্লবীদের অস্ত্র লুকানো হয়েছিল। আপনি চাইলে দেখতে পারেন।”
দু’জনে নামল সেই টানেল ধরে। নিচে গিয়ে অচিন্ত্য যেন চোখে দেখল এক ইতিহাসের ভেতরের ইতিহাস। ছেঁড়া চিঠি, মরচে ধরা রিভলভার, দেশি বোমার খোলস, আর এক কোণে ঝুলে আছে জ্যোতির্ময়ের ছেঁড়া চাদর।
মৃণালিনী বলে চললেন, “দেশভাগ তখন আসন্ন, কিন্তু তখনও কেউ ভাবতে পারেনি, বাংলা ভেঙে যাবে। আমার পিতা চেয়েছিলেন এক পৃথক বিপ্লবী বাংলা—যেখানে হিন্দু মুসলমান একসঙ্গে থাকবে। তাঁর সেই স্বপ্ন, তারাই ধূলিসাৎ করে যাঁরা রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য সব বিক্রি করে দেয়।”
অচিন্ত্য যেন নীরব দর্শক। তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে জ্যোতির্ময়ের কণ্ঠ, যিনি হয়তো বলেছিলেন—“ভালোবাসাই আমাদের শেষ অস্ত্র।”
হঠাৎ এক অদ্ভুত গন্ধ ভেসে এলো—মাটি পচা, গন্ধগোকুলের গন্ধের মতো। মৃণালিনী বললেন, “এখানে সবসময় এমনই থাকে। অতীতের মৃতদেহ এখানে পচে না, শুধু অপেক্ষা করে ফের জেগে ওঠার।”
সেদিন সন্ধ্যায় অচিন্ত্য বাড়ি ফেরার আগে একটা কাগজ হাতে পেল, ভাঁজ করা, স্কুলের দরজার কাছে পড়ে ছিল। খুলে দেখে লেখা—
“You have seen too much. Leave the village before Kartik Purnima. Or the river will choose your silence.”
স্বাক্ষরহীন চিঠি, কিন্তু ভাষাটা পরিষ্কার হুমকি। কে দিয়েছে? কেন? সে কি সত্যিই বেশি দেখে ফেলেছে?
পরদিন স্কুলে একজন শিক্ষক অনুপস্থিত। জানলা দিয়ে তাকিয়ে অচিন্ত্য দেখে, গ্রামের কিছু লোক হঠাৎ জমিদারবাড়ির দিকে ঘুরছে, কারও হাতে লাঠি। কে যেন চিৎকার করে বলল, “বুড়ি মেয়ে এবার খেলা শেষ হবে ওর!”
অচিন্ত্য ছুটে বেরিয়ে পড়ে। সে জানে, আজ কোনও ইতিহাস নয়, আজ রক্ত ঝরতে চলেছে।
৩
অচিন্ত্য ছুটতে ছুটতে জমিদারবাড়ির দিকে পা বাড়ায়। হাঁটু পর্যন্ত ধুলোয় মাখা পথ, শালপাতার গায়ে রোদ পড়ে ধিকিধিকি করছে, আর সামনে প্রায় দশ-বারো জন গ্রামবাসী চিৎকার করতে করতে যাচ্ছেন—কেউ বলছে “জ্বালিয়ে দে”, কেউ বলছে “এবার শেষ করতে হবে।” অচিন্ত্যর বুক কেঁপে উঠছে—কী এমন হলো যে এতদিনের নিস্তব্ধতা হঠাৎ হিংসায় ফেটে পড়েছে?
জমিদারবাড়ির মূল দরজা তখন বন্ধ। পেছনের এক জানলায় দেখা গেল, মৃণালিনী দাঁড়িয়ে আছেন, চোয়ালে দৃঢ়তা, চোখে কুয়াশা। অচিন্ত্য চিৎকার করে উঠল, “আপনারা কী করছেন? একজন নারী থাকেন ওখানে!” একজন লোক থেমে তাকাল, “আপনি নতুন এসেছেন বলে জানেন না। ও হচ্ছে শয়তানের বংশধর। আগেও ওর বাড়িতে গায়েব হয়েছিল দুজন। আর কালকে রাতেও নাকি আপনাকে বশ করেছিল নদীর ধারে নিয়ে গিয়ে!”
অচিন্ত্য জিজ্ঞেস করল, “আপনারা কী জানেন আসলে কে মৃণালিনী?”
লোকটা দাঁত কামড়ে বলল, “জানি না, জানতেও চাই না। জানি, ওর বাবা দেশদ্রোহী ছিল। মুসলমানদের সঙ্গে মিলে বাংলা ভাগ করতে চেয়েছিল।”
এই কথাটা শুনে অচিন্ত্যর গা ছমছম করে উঠল। যারা জ্যোতির্ময় রক্ষিতকে ভালোবাসা ও সাম্যের ভাষা শিখিয়েছিল, তারাই আজ তাঁকে বিশ্বাসঘাতক বানিয়েছে? একবিংশ শতাব্দীর আগেই এমন ষড়যন্ত্রের শেকড় গেড়ে বসেছে এই নিঃশব্দ গ্রামে?
অচিন্ত্য সামনে গিয়ে লোকগুলোর সামনে দাঁড়াল, “যদি আগুন দিতে হয়, আমাকেও দিতে হবে। আমি মৃণালিনী দেবীর পক্ষেই দাঁড়াব। কারণ আমি ইতিহাস পড়েছি, গুজব না।”
লোকেরা একটু থেমে গেল। পেছন থেকে একজন বলল, “এই শহুরে ছেলেটা কিছু জানে না। কিন্তু সাবধান করে দেওয়া হোক ওকে।”
অচিন্ত্য বুঝে গেল, আপাতত বিদ্রোহ ঠেকানো গেল, কিন্তু মাটির নিচে আগুন আছে। সে সোজা বাড়ির ভেতর ঢুকল। দরজা মৃণালিনী খুলে দিলেন, ঠান্ডা মুখে বললেন, “সবাই যখন বিশ্বাস ভাঙে, তখন শুধু সাহসটাই থাকে শেষ অস্ত্র।”
ভেতরে ঢুকেই অচিন্ত্য দেখল—প্রাচীন ঘর, ধুলো জমা আসবাবপত্র, দেয়ালে জমিদার পরিবারের ছবির পাশে একটা আলোকচিত্র—এক তরুণ পুরুষ হাতে বই, পাশে পায়রার খাঁচা—নিচে লেখা ‘Jyotirmoy Rakshit, 1936’।
অচিন্ত্য কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, “আপনাকে আঘাত করার জন্য কেউ বাইরে থেকেই উসকানি দিচ্ছে। কারা এ কাজ করছে সেটা খুঁজে বের করতে হবে।”
মৃণালিনী মাথা নাড়লেন, “তুমি জানো, এই গ্রামে কিছু চিঠি ঘুরছে। যেখানে লেখা আছে, আমি পাকিস্তানের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করি। আমার বাবাকে ‘মোল্লাবন্ধু’ বলা হয় তাতে।”
অচিন্ত্য স্তম্ভিত। “কিন্তু আপনি তো—আপনার তো কোনও রাজনৈতিক সংযোগ নেই এখন!”
মৃণালিনী একটু হেসে বললেন, “আমার অস্তিত্বটাই সমস্যা। আমি এমন এক ইতিহাসের অংশ, যা কেউ মানতে চায় না। আমি প্রমাণ, যে কেউ ভালোবাসার জন্য দেশভাগ আটকাতে চেয়েছিল। সেটা এরা ভুলে যেতে চায়। তাই আমাকে সরিয়ে দিতে চায়।”
সেদিন বিকেলে অচিন্ত্য চলে গেল সেই পুরোনো লাইব্রেরিতে। ভেতরের সেই গোপন ঘরে গিয়ে সে খাতা নিয়ে বসে। দলিলগুলোর মধ্যে একটা পাতায় লেখা ছিল—
“The British feared unity. They knew, if Bengal remains one, it will rise beyond all.”
আরেক পাতায় লেখা—
“Even love must hide. Because love, in this world, is rebellion.”
রাত বাড়তে থাকে। দূরে নদীর জল ঘূর্ণি খাচ্ছে। হঠাৎ সে অনুভব করে, কারা যেন ছাদের উপর দিয়ে হাঁটছে। দ্রুত উপরে উঠে গিয়ে দেখল ছাদের এক কোণে সাদা ছায়া, নারীর মতো, নীচে ঝুঁকে কী যেন খুঁজছে। সে ডাকতেই ছায়াটা মিলিয়ে যায়।
পরদিন সকালে অচিন্ত্য আবার গিয়ে দাঁড়াল সেই জায়গায়—একটা ভাঙা টালির নিচে খুঁজে পেল এক ছোট বাক্স। খুলে দেখে—একটা রক্তমাখা ওড়না, কিছু গলার হার, আর একটা চিঠি—মৃণালিনীর হাতের লেখা।
“যদি আমি একদিন না থাকি, কেউ যেন জানে, আমি ভালোবেসেছিলাম ইতিহাসকে, মানুষকে, আর তাকে—যে এসেছে ঘূর্ণির পাড়ে আমার অতীতকে খুঁজতে।”
অচিন্ত্যর চোখ ভিজে উঠল। সে জানে, এখন তার আর ফেরার পথ নেই। সে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে সেই ইতিহাসের সঙ্গে, যে ইতিহাস কেউ পড়ায় না, শুধু চাপা দেয়।
ঘূর্ণি নদী সেই দিনটা ছিল অদ্ভুত নিস্তব্ধ। কিন্তু ভিতরে ভিতরে, সে হয়তো প্রস্তুত হচ্ছিল এক নতুন বিপ্লবের জন্য।
৪
সকালটা শুরু হয়েছিল শান্তভাবে। কিন্তু ঘূর্ণিতে কখনও কিছু সত্যিই শান্ত থাকে না। অচিন্ত্য এবার স্থির করেছে—সে আর শুধু পর্যবেক্ষক হয়ে থাকবে না, সে ইতিহাসে নামবে, নামবে সেই ঘূর্ণিতে যেখানে প্রেম আর প্রতারণা, বিশ্বাস আর ষড়যন্ত্র পাশাপাশি ঘুরপাক খায়।
সে সেই পুরোনো খাতাটি আবার খুলে বসে, জ্যোতির্ময় রক্ষিতের গোপন নোট। পাতার পেছনে পেন্সিলে লেখা এক কবিতার টুকরো—
“ঘূর্ণির জলে প্রেম ডুবে যায় না,
ডুবে যায় মুখোশ।
যারা ফিরে আসে,
তারা জানে ইতিহাস মুখস্থ নয়,
মুখোমুখি দাঁড়ানো!”
এই শব্দগুলো যেন অচিন্ত্যর হৃদয়ে ঝড় তোলে। মৃণালিনীর প্রতি তার আকর্ষণ এখন কেবল ব্যক্তিগত ভালোবাসা নয়, এটা হয়ে উঠছে এক নৈতিক দায়বদ্ধতা, একটি স্বপ্নের প্রতি দায়—যে স্বপ্ন ভালোবাসার ছিল, কিন্তু হারিয়ে গিয়েছিল হিংসার কোলাহলে।
মধ্যাহ্নে মৃণালিনী নিজেই দেখা করতে এলেন অচিন্ত্যর থাকার ঘরে। তাঁর চোখে ছিল ক্লান্তি, কিন্তু ঠোঁটে সংযত শক্তি।
“তুমি জানো, এই গ্রামটা এক সময় বাংলার গোপন সেন্টার ছিল। বালিয়ার বিপ্লবীরা এখানে এসে আশ্রয় নিতেন। আমার পিতা তাদের রুট বদলের জন্য এই লাইব্রেরির নিচে সুড়ঙ্গ বানিয়েছিলেন।”
অচিন্ত্য অবাক, “তাহলে সেই সুড়ঙ্গ এখনো আছে?”
মৃণালিনী মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ, কিন্তু গত কুড়ি বছরে কেউ ওদিকে যায়নি। আমার ধারণা, সেই সুড়ঙ্গেই লুকিয়ে আছে কিছু প্রমাণ, যা দেশভাগকে ঘিরে ষড়যন্ত্র ফাঁস করতে পারে।”
অচিন্ত্য স্থির করল সে আজ রাতেই যাবে।
রাত দশটা নাগাদ সে হাতে লণ্ঠন, পকেটে কাগজকলম আর একটি দড়ি নিয়ে নামল লাইব্রেরির নিচে। পেছনের ছোট গোপন দরজাটা ঠেলে দেয়, নেমে যায় নীচে। একশো বছরের পুরনো কাঠের সিঁড়ি যেন কেঁপে ওঠে তার পায়ের শব্দে।
সুড়ঙ্গটা অদ্ভুত ঠাণ্ডা, যেন এক ইতিহাসের শবঘর। মাটির দেওয়ালে খোদাই করে কিছু শব্দ লেখা:
“পূর্ব বাংলা স্বাধীন হোক, কিন্তু রক্ত ছাড়া নয়”
তার পাশেই ছেঁড়া পোস্টার, যেগুলোতে চেহারা নেই, শুধু ছায়ামানবদের ছাপ। ঘরের এক কোণে একটা ছোট ট্রাঙ্ক, ভেতরে কিছু তাম্রমুদ্রা, কয়েকটা পোড়া নথি, আর একটি চিঠি—এইবার বাংলায় লেখা:
“প্রিয় মৃণাল,
যদি কখনও তুমি এই চিঠি পাও, জানবে আমি গিয়েছি শেষবারের মতো আসামের গোপন ঘাঁটিতে। হয়তো আর ফিরব না। কিন্তু বিশ্বাস রেখো, তুমি একদিন সত্যি খুঁজে পাবে—এবং যাকে পাবে, তাকে ভালোবাসবে আমার মতো করেই।
তোমার
—জ্যোতি”
অচিন্ত্য চিঠিটা জড়িয়ে ধরে। এই চিঠি কোনো মেয়ে যদি পেত, তাহলে তার জীবন বদলে যেত। আর আজ, এত বছর পরে, সেই মেয়ের উত্তরসূরি যেন ছেলেটির সামনে দাঁড়িয়ে—এক পিতা, এক বিপ্লবী, এক ভালোবাসার প্রেরণা হয়ে।
পেছন থেকে হঠাৎ মাটির কণ্ঠস্বরের মতো শোনা গেল, “কেউ আছে?”
অচিন্ত্য চমকে উঠে তাকাল—এক ছায়ামূর্তি, হাতে লাঠি, চোখে আতঙ্ক। সে বলল, “কে আপনি?”
লোকটা ধীরে এগিয়ে এসে মুখ খোলে—চেনা মুখ, স্কুলের খণ্ডকালীন দারোয়ান, নাম রঘুবর।
সে ফিসফিস করে বলল, “আপনি যেটা করছেন, সেটা নিরাপদ নয়। আমি জানি এই সুড়ঙ্গে কী ছিল। আমি ছোটবেলায় একবার এখানে এসেছিলাম, তখন আমার কাকা জমিদারবাড়ির রান্নাঘরের কেরানী ছিলেন।”
অচিন্ত্য জিজ্ঞেস করল, “আপনি কী দেখেছিলেন?”
রঘুবর চোখ নামিয়ে বলল, “এক রাতে, আমি দেখতে পাই তিনজন লোককে এনে এখানে ফেলে রাখা হচ্ছে। তারা কেউ জ্ঞানহীন, কেউ মৃত। তাদের কথা কেউ আর শুনেনি। পরদিন সবাই বলল, ওরা পালিয়েছে। কিন্তু আমি জানি—ওরা কোনো এক সত্য জানত, যা কারও সহ্য হয়নি।”
অচিন্ত্য চুপ করে। মৃণালিনীর পরিবারও কি তবে সেই সত্য আড়াল করেছে? নাকি কেউ অন্য কাউকে ফাঁসাতে চেয়েছিল?
রঘুবর বলল, “আপনি যা জানছেন, তা সবাই সহ্য করবে না। এবার সাবধানে থাকুন। আপনি শহুরে লোক—গ্রামের কাদা বড় গভীর।”
সেদিন অচিন্ত্য ঘুমোতে পারল না। মৃণালিনীর কথাগুলো আর চিঠির বাক্য একত্র হয়ে এক অন্যরকম কাহিনি গড়ে তুলছে তার ভেতরে।
ভোরের দিকে, সে নদীর পাড়ে গিয়ে বসল। সূর্য ওঠেনি তখনও, নদীর ওপর কুয়াশা। সে দেখল, এক নারী ধীরে ধীরে নদীতে নামছে, সাদা শাড়িতে, মাথায় ঘোমটা।
সে ডেকে উঠল, “কে?”
নারী থেমে ফিরে তাকাল—মৃণালিনী।
সে শুধু বলল, “তুমি যা করছো, তা ঠিক। কিন্তু আমার একটা কথা মনে রেখো, অচিন্ত্য—যে নদী অতীত জানে, সে বর্তমানকে সহজে ক্ষমা করে না।”
৫
সূর্যের আলো তখন নদীর পাড়ে এসে পড়েছে, কিন্তু কুয়াশা পুরোপুরি সরেনি। অচিন্ত্য মৃণালিনীর শেষ কথাগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভাবছে—ঘূর্ণি নদী অতীত জানে, তাই বর্তমানকে সহজে ক্ষমা করে না। শব্দগুলো শুনতে সহজ হলেও তার ভেতর লুকিয়ে আছে এক ভয়ানক সত্য। সে কি এমন কিছু জানতে চলেছে, যা অতীতের থেকেও ভয়ঙ্কর?
স্কুলে সেইদিন কিছু অস্বাভাবিকতা চোখে পড়ে অচিন্ত্যর। ছাত্ররা কেমন যেন চুপচাপ, শিক্ষকরা কেউ কেউ কথা বলার সময় কণ্ঠ নামিয়ে ফেলে। হেডমাস্টার চিত্তরঞ্জন মিত্র অচিন্ত্যকে একান্তে ডেকে পাঠালেন। কড়া গলায় বললেন, “আপনি খুব বেশি ঘোরাঘুরি করছেন, মশায়। এই গ্রামে অনেক কিছুর উত্তর খোঁজা মানে শত্রু তৈরি করা। আমরা সবাই এখানকার নিয়ম মেনে চলি। জমিদারবাড়ির অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি বন্ধ করুন।”
অচিন্ত্য জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি জানেন না, ঘূর্ণির নিচে এক গোপন ইতিহাস চাপা পড়ে আছে?”
হেডমাস্টার চোখ সরিয়ে নিলেন। “আমি শুধু জানি, বেশি জানা বিপদ ডেকে আনে। আপনি যদি এই স্কুলে চাকরি চালিয়ে যেতে চান, তাহলে পড়ান, ছুটি হলে ঘরে যান। ইতিহাস পত্রিকায় থাকলেই ভালো।”
সেইদিন বিকেলে হরিমোহন দত্ত, যাঁর বাড়িতে অচিন্ত্য ভাড়া থাকে, এসে বললেন, “কাল রাতে কে যেন আমার উঠোনে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। আলো জ্বালাতেই পালিয়ে গেল। আপনার নাম উচ্চারণ করছিল।”
অচিন্ত্য বুঝে গেল, কারা তাকে ভয় দেখাতে চাইছে। কিন্তু তার ভয় কেটে গেছে অনেক আগেই। সে এবার সাহস করে গ্রামের এক প্রবীণ পন্ডিতের কাছে যায়—রসিকলাল ভট্টাচার্য। বছর আশির কাছাকাছি বয়স, কিন্তু চোখদুটো এখনো তীক্ষ্ণ।
পন্ডিতমশাই শুনেই বলে উঠলেন, “জ্যোতির্ময় রক্ষিত? হুঁ, ওঁকে নিয়ে তো কালে কালে কত রকম গল্প। কেউ বলে ওর প্রেম ছিল মুসলিম বিধবা বউয়ের সঙ্গে, কেউ বলে ব্রিটিশদের গুপ্তচর ছিল, আবার কেউ বলে একবার ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটকে থাপ্পড় মেরে লাপাত্তা হয়েছিল।”
অচিন্ত্য জিজ্ঞেস করল, “আপনি কী বিশ্বাস করেন?”
পন্ডিতমশাই একটু চুপ করে থেকে বললেন, “আমি মনে করি, ও এক অসময়ে জন্মানো মানুষ ছিল। সমাজ তখনও তৈরি হয়নি ভালোবাসা আর বিদ্রোহ একসাথে মানতে। ওর ভুল একটাই—ও সত্যিটাকে সামনে নিয়ে আসতে চেয়েছিল খুব তাড়াতাড়ি। আর সত্যি যেটা তাড়াহুড়ো করে সামনে আসে, তাকে লোকে গুজব বলে ছুড়ে ফেলে দেয়।”
অচিন্ত্য জানতে চাইল, “তিনি কি মুসলিমদের নিয়ে আলাদা বাংলা চেয়েছিলেন?”
পন্ডিতমশাই এক গাল হেসে বললেন, “সে কথা হয়তো একদম মিথ্যে নয়। তবে ওর বাংলা ছিল কাগজের দেশ নয়, অনুভবের দেশ। সেখানে ধর্ম ছিল না, ছিল ক্ষুধা, ভাষা, ভালোবাসা। আর এসবের দেশ বানাতে চাইলেই লোকে বলে আপনি বিশ্বাসঘাতক।”
ঘূর্ণির আকাশ তখন ঘন নীল, সন্ধ্যে নামছে। পেছনে হঠাৎ হাওয়ার ঝাপটা এসে জানালার কাঁচ টেনে দেয়। অচিন্ত্য সেই রাতে পকেটে করে নিয়ে যায় সেই চিঠিটা—জ্যোতির্ময়ের শেষ চিঠি—মৃণালিনীর উদ্দেশে লেখা।
সে চিঠি হাতে নিয়েই জমিদারবাড়িতে গেল। মৃণালিনী দরজা খুললেন, এবার তাঁর চোখে বিস্ময় নয়, প্রস্তুতি।
“তুমি জ্যোতির্ময়ের শেষ চিঠিটা পেয়েছো?”
অচিন্ত্য মাথা নাড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ। আমি জানি, তুমি ওর কন্যা। কিন্তু আমি আরও কিছু জানি এখন।”
মৃণালিনী চুপ। অচিন্ত্য চিঠির লাইন পড়ে শোনাল—
“তুমি যাকে ভালোবাসবে, সে যেন বোঝে—ভালোবাসা মানে সত্যের দায় নেওয়া।”
মৃণালিনী ফিসফিস করে বললেন, “এই গ্রামে আমি যতটা একজন নারী, তার থেকেও বেশি একজন প্রেত। আমাকে মানুষ দেখে না, দেখে এক পুরুষের ব্যর্থতা। আমি ভালোবাসা নিয়ে কথা বললে, তারা ভাবে ষড়যন্ত্র করছি। আমি যদি নিঃশব্দ হই, তারা ভাবে আমি কিছু লুকোচ্ছি।”
অচিন্ত্য হঠাৎ একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিল, “তুমি কি কখনও নিজেকে ক্ষমা করতে পেরেছো? কারণ তুমি জানো, জ্যোতির্ময় শুধু তোমার পিতা ছিল না—সে দেশের জন্য কিছু করতে চেয়েছিল। তুমি কী করেছো আজ অবধি?”
এই প্রশ্নে প্রথমবার মৃণালিনী ভেঙে পড়লেন। এক নিঃশব্দ কান্না তাঁর চোখের কোণে জমে উঠল। “আমি একবার নদীতে ঝাঁপ দিতে গিয়েছিলাম, জানো? কিন্তু ঘূর্ণি আমাকে টেনে রাখল। বলল, শেষ কথা এখনো বলা হয়নি।”
অচিন্ত্য ধীরে তার হাত ধরল। “তবে এবার বলো। সত্যি প্রকাশের সময় এসেছে। আমরা একসাথে বলব।”
বাইরে তখন ঝড়ের হাওয়া, ঘূর্ণি নদী যেন ডাকছে। এবং সেই ডাক হয়তো শুধু একজন নারীকে নয়, একজন ইতিহাসবিদ্ধ মানুষকে নতুন করে জাগিয়ে তুলতে চাইছে।
৬
ঘূর্ণি নদীর কুয়াশা আবার ঘন হতে শুরু করেছে। কার্তিক মাসের শেষ, আকাশে হালকা গাঢ় ছায়া, যেন সন্ধ্যার আগেই রাত নেমে আসে। অচিন্ত্য আর মৃণালিনী জমিদারবাড়ির ঘরের ভেতর বসে, মাঝখানে একটা পুরোনো কাঠের টেবিল, তাতে রাখা চিঠিপত্র, দলিল, ধুলোমাখা পুরনো পায়রার খাঁচা—যার একপাশে এখনো ঝুলে আছে একটি ভাঙা ঘণ্টা।
অচিন্ত্য বলল, “তুমি বলেছিলে, এই গ্রামের কিছু লোক এখনো বিশ্বাস করে তুমি দেশদ্রোহীর সন্তান। তুমি কি জানো, কাদের কাছে সবচেয়ে বড় প্রমাণ পৌঁছানো দরকার?”
মৃণালিনী ধীরে মাথা নাড়লেন, “যারা ভালোবাসা ভুলে গেছে। যারা ভাবছে ইতিহাস মানে শুধু রক্ত, শুধু লড়াই, শুধু মানচিত্রের দাগ।”
সেই সন্ধ্যায় তারা ঠিক করল—পরের দিন গ্রামে একটি জনসভা ডাকা হবে। জায়গা: স্কুল মাঠ। উদ্দেশ্য: জ্যোতির্ময় রক্ষিতের সত্যিকারের ইতিহাস সকলের সামনে তুলে ধরা।
কিন্তু পরিকল্পনার সেই রাতেই ঘূর্ণি নদী যেন নিজের ভেতরে গর্জে উঠল।
অচিন্ত্য ঘুমোতে গিয়েছিল, কিন্তু মাঝরাতে ঘরের দরজায় ধাক্কার শব্দ। খটখট করে উঠছে যেন কেউ লোহার পেরেক দিয়ে থাপ মারছে। সে উঠে গিয়ে দরজা খুলল—কেউ নেই। কেবল নদীর দিক থেকে আসছে চাপা স্রোতের আওয়াজ, যেন জল পেরিয়ে কেউ হাঁটছে পাথরের ওপর দিয়ে।
সে বেরিয়ে পড়ল। পেছনে টর্চ আর চিঠির ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেল নদীর ধারে সেই পুরোনো নৌকার কাছে। আশ্চর্য, সেই কালো বাক্সটা আবার সেখানে—যেটা কয়েকদিন আগে সে খুলে পেয়েছিল দলিল।
কিন্তু আজ তার পাশে একটা নতুন বস্তু—একটা পুরোনো রেডিও। অচিন্ত্য একটু এগিয়ে গিয়ে ধরতেই সেটা নিজে থেকেই চালু হয়ে গেল।
একটা ক্ষীণ কণ্ঠ ভেসে এল—
“ঘূর্ণি জানে, কে কাকে বিক্রি করেছে। ঘূর্ণি জানে, কারা চিঠি লেখে মুখে প্রেম রেখে।”
অচিন্ত্য শিউরে উঠল। এই কণ্ঠ কার?
হঠাৎ সে নদীর দিকে তাকিয়ে দেখল, এক মুখ ভেসে উঠছে—নারীর মুখ, কিন্তু চেনা নয়। চোখে ছিল জলের গভীরতা, ঠোঁটে এক রহস্যময় হাসি।
সে ধীরে ধীরে বলল, “তুমি জ্যোতির্ময়ের সত্য জানো, কিন্তু জানো না কে ওকে শেষ করেছিল। সে তোমার খুব কাছেই আছে।”
অচিন্ত্য চিৎকার করে উঠল, “কে? কে আছে?”
কিন্তু মুখটা আবার মিলিয়ে গেল, নদীর ঘূর্ণির নিচে।
পরদিন সকালবেলা পুরো গ্রাম উত্তাল হয়ে উঠল। কারা যেন দেয়ালে লিখে দিয়েছে—
“মৃণালিনী রক্ষিত পাকিস্তানের চর। সাড়ে সাতটায় স্কুল মাঠে সত্য প্রকাশিত হবে।”
মৃণালিনী নির্বিকার। তিনি বললেন, “তারা খেলতে চাইছে, আমরা খেলব। আমি নিজের কথা নিজেই বলব।”
অচিন্ত্য স্কুল মাঠে মঞ্চ তৈরি করতে সাহায্য করল। চারপাশে ভিড়—কেউ এসেছে কৌতূহলবশে, কেউ বিদ্বেষে, কেউ নিছক মজা নিতে।
মৃণালিনী মঞ্চে উঠে দাঁড়ালেন। হাতে জ্যোতির্ময়ের চিঠি, কণ্ঠে অদ্ভুত দৃঢ়তা।
“আমি আজ আপনাদের সামনে দাঁড়িয়েছি এই গ্রামের এক কন্যা হিসেবে, না জমিদাররক্ত নিয়ে, না বিপ্লবীর উত্তরসূরি হয়ে—আমি এসেছি শুধু একজন মানুষ হয়ে। আমার পিতা জ্যোতির্ময় রক্ষিত এই দেশের জন্য এক স্বপ্ন দেখেছিলেন—যেখানে ধর্ম নয়, ভালোবাসা ছিল মুখ্য। তিনি হয়তো সফল হননি, কিন্তু তিনি কোনো দিন দেশদ্রোহী ছিলেন না।”
গভীর নীরবতা। এক বৃদ্ধ হাত তুলে বললেন, “আপনার পিতা যদি এত মহান ছিলেন, তবে উনি মারা গেলেন কীভাবে? আমরা শুনেছি, তাঁকে তো আপনার মা-ই বিষ খাইয়ে দিয়েছিলেন।”
অচিন্ত্য এগিয়ে এসে বলল, “এই কথাটা মিথ্যে। গতকাল আমি সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে গিয়েছিলাম, সেখানে আমি পেয়েছি এক মেডিকেল রিপোর্ট—ব্রিটিশদের সিআইডি বিভাগের। তাতে লেখা—জ্যোতির্ময় রক্ষিত মারা যান হৃদরোগে, ওঁকে বিষ খাওয়ানো হয়নি। বরং মৃত্যুর পরে তাঁর দেহ লুকিয়ে রাখা হয় যেন তাঁর লেখা দলিল কেউ না পায়।”
ভিড়ের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়।
তখন হঠাৎ একজন দাড়িওয়ালা লোক মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, “আপনারা কী করে জানবেন এগুলো সত্যি? হয়তো এ সব বানানো!”
মৃণালিনী ধীরে বললেন, “আপনি কে?”
লোকটা বলে, “আমি কৃষ্ণরাম, আপনার পিতার এক সময়কার সহকারী। আমি জানি সব।”
তার কণ্ঠে ভয়ানক বিষ। “জ্যোতির্ময় যদি দেশপ্রেমিক হতেন, তাহলে তিনি আমার ভাইয়ের চিঠি ব্রিটিশদের হাতে তুলে দিতেন না। তিনি চেয়েছিলেন আমার ভাই ‘গদ্দার’ বলে চিহ্নিত হোক, যাতে উনি নায়ক হন। আমি সেই চিঠি রক্ষা করতে পারিনি, কিন্তু আমি চুপ ছিলাম, কারণ আপনিও চুপ ছিলেন।”
মৃণালিনী কেঁপে উঠলেন, “তুমি কৃষ্ণ… তুমি?”
কৃষ্ণরাম গর্জে উঠল, “হ্যাঁ। আর এবার তুমি বা এই ছোকরা কেউ পারবে না সেই মুখোশ সরাতে, যেটা ঘূর্ণি এতদিন ধরে ধরে রেখেছে।”
এতদিন পরে, গ্রামের সামনে মুখোশ খুলে গেল। একজন ব্যর্থ সহচর, একজন প্রেমে প্রত্যাখ্যাত যুবক, একজন ইতিহাসের ভুল বোঝা মানুষ নিজেই হয়ে উঠেছিল প্রতিশোধের জন্তু।
ঘূর্ণি নদী আজ শান্ত, কিন্তু তার নিচে গোপন মুখটা যেন হেসে উঠল—অবশেষে কেউ মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে।
৭
মাঠটা তখন থমথমে। কৃষ্ণরাম চলে গিয়েছেন, কিন্তু যেন তাঁর বিষাক্ত কথাগুলো বাতাসে রয়ে গেছে। গ্রামের মানুষ চুপ, কিছুর মর্ম বোঝার চেষ্টা করছে। আর মঞ্চে দাঁড়িয়ে মৃণালিনী—ধীর, ধ্বস্ত, কিন্তু ভাঙেনি।
অচিন্ত্য তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “আজ আমরা যা জানলাম, তা শুধু অতীত নয়—এটা আমাদের আত্মপরিচয়ের অংশ। ঘূর্ণি শুধু নদী নয়, এটা একটা সময়ের ঘূর্ণি, যেখানে সত্য, প্রেম, ঈর্ষা আর বিশ্বাসঘাতকতা সব একসঙ্গে ঘুরপাক খায়। আজ থেকে আমরা কেউ আর সেই ঘূর্ণিকে ভয় পেতে চাই না।”
হঠাৎ এক বৃদ্ধা এগিয়ে এসে বললেন, “আমি জানতাম মৃণালিনী দেবীর বাবা খারাপ মানুষ ছিলেন না। আমি ছোটবেলায় ওঁর বাড়িতে কাজ করতাম। উনি একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি নিজেকে ছোট মনে কোরো না, তুমি এই দেশ, এই মাটি।’”
এইটুকু কথায় যেন বাতাস বদলে গেল। লোকজন আর মুখ গুঁজে দাঁড়িয়ে রইল না, তারা আস্তে আস্তে এগিয়ে এল, মৃণালিনীর দিকে, অচিন্ত্যর দিকে, যেন বহু বছর পর কোনও অন্ধকার ঘর খুলে আলো এসে পড়েছে।
কিন্তু এমন শান্তি কখনও স্থায়ী হয় না।
সন্ধ্যার আগেই স্কুলের কেয়ারটেকার ছুটে এসে বলল, “দাদা, আপনার ঘরের তালা ভাঙা। সব ওলটপালট করে দিয়েছে কেউ।”
অচিন্ত্য ছুটে গিয়ে দেখল—হ্যাঁ, ঘর তছনছ। বিছানার গদি ছেঁড়া, বই ছড়ানো, ব্যাগ কাটা, কিন্তু আশ্চর্য—সেই লাল মলাটের দলিলটা অক্ষত। টেবিলের নিচে পড়ে আছে, কেউ যেন হাত দিয়েও দেখে যায়নি।
সে দলিলটা নিয়ে রাতেই চলে যায় জমিদারবাড়ি। মৃণালিনী তখন চুপচাপ বসে আছেন। দরজা খোলার শব্দে চমকে উঠলেন।
“তুমি?”
“হ্যাঁ, আমি,”—অচিন্ত্য বলল, “তারা আমার ঘর তছনছ করেছে, কিন্তু দলিল পায়নি। এবার সময় এসেছে, এটা প্রকাশ্যে আনার।”
মৃণালিনী বললেন, “তবে একটা জিনিস জানো, এই দলিলে কেবল ঐতিহাসিক সত্য নেই। রয়েছে ব্যক্তিগত সত্যও।”
অচিন্ত্য জিজ্ঞেস করল, “কী রকম?”
মৃণালিনী তাকিয়ে রইলেন তার চোখে, তারপর বললেন, “জ্যোতির্ময় যে ‘তাকে’ ভালোবাসতেন, সেই ‘সে’ একজন মুসলিম নারী—রোশন আরা বেগম। তাঁকে নিয়ে বাংলা ভাগ রুখে দাঁড়ানোর স্বপ্ন ছিল তাঁর। তারা একসঙ্গে চেয়েছিলেন এমন এক জায়গা, যেখানে কারও নাম, ধর্ম, পরিচয় দিয়ে বিচার হবে না।”
অচিন্ত্য কেঁপে উঠল, “তুমি কি তাহলে…”
“না,” মৃণালিনী বললেন, “আমি তাঁদের কন্যা নই রক্তের অর্থে। আমি তাঁদের আদর্শের কন্যা। আমাকে দত্তক নিয়েছিলেন রোশন আরা, বাবার মৃত্যুর পর। আমি তারাই—যারা ইতিহাসের পাতায় স্থান পায় না, কিন্তু ইতিহাসের ভিত তৈরি করে।”
ঘরের বাতি নিভে যায়। বাইরের হাওয়া জানালায় ধাক্কা দেয়। দু’জনেই নীরব। তারপর অচিন্ত্য ধীরে হাত বাড়িয়ে বলে, “তবে এবার আমরা কাগজে নয়, বাস্তবে ইতিহাস লিখি।”
সেই রাতেই তারা ঠিক করল, সেই দলিল প্রকাশ করবে পরদিন। জায়গা: নদীর ধারে একটি ছোট অডিটোরিয়াম, যেখানে ব্রিটিশ আমলে সাপ্তাহিক নাটক হতো। বহু বছর বন্ধ, ধুলোয় ঢেকে আছে, কিন্তু ইট ইট করে ইতিহাসকে চেপে রেখেছে।
পরদিন সকালবেলা অচিন্ত্য সাইকেলে করে পোস্ট অফিসে যায়। খবর পাঠাতে হবে কৃষ্ণনগরের এক সাংবাদিক বন্ধুকে—অনুরোধ করে চিঠি, “এসো, একটা গল্প আছে যা কেউ বিশ্বাস করবে না, কিন্তু শোনার পর বদলে যেতে বাধ্য।”
অডিটোরিয়াম পরিষ্কার করছিল গ্রামের কিছু কিশোর। তারা কেউ জানে না কী হচ্ছে, কিন্তু মনে হচ্ছে কিছু বড় কিছু হতে চলেছে।
সন্ধ্যার দিকে, কুয়াশার ভেতর লোকজন এসে জড়ো হতে শুরু করল। মঞ্চে রাখা টেবিলে তিনটে জিনিস—লাল মলাটের দলিল, জ্যোতির্ময়ের ছবি, আর রোশন আরার শেষ খামে রাখা স্বীকারোক্তি।
মঞ্চে উঠে মৃণালিনী বললেন, “আজ আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরছি এমন এক সত্য, যা শুনলে অনেকের অস্বস্তি হবে। আমার পিতা জ্যোতির্ময় রক্ষিত একজন হিন্দু ছিলেন, আর যাঁকে তিনি ভালোবেসেছিলেন, তিনি একজন মুসলিম নারী। তাঁরা চেয়েছিলেন এমন বাংলা, যেখানে প্রেম অপরাধ নয়। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছিলেন, কারণ এই সমাজ তখনও তৈরি হয়নি।”
অচিন্ত্য চিঠির কিছু অংশ পড়ে শোনাল—
“আমরা জানি, আমাদের ভালোবাসা গোপন রাখতে হবে, কিন্তু একদিন এমন সময় আসবে, যখন একজন শিক্ষক ও একজন নারী এই কাহিনি তুলে ধরবেন। তারা জানবে, মুখোশ পড়ে থাকা ইতিহাস যতই জোরে চেঁচাক, প্রেম একদিন জেগে উঠবে।”
সকলে চুপ। কেউ চোখ মুছছে, কেউ মুখ নিচু করে ভাবছে, কেউ শিশুর চোখে তাকিয়ে আছে মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকা এক নারীর প্রতি—যাঁকে এতদিন তারা ভয়ে, ঘৃণায় দেখেছে।
মৃণালিনী নেমে এসে নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন। তাঁর চোখে এখন আর দ্বিধা নেই।
অচিন্ত্য পিছনে এসে বলল, “তুমি জিতলে।”
তিনি বললেন, “না। আমরা জিতলাম।”
ঘূর্ণি নদী সেই মুহূর্তে নিঃশব্দ। বাতাস থেমে গেছে। যেন ইতিহাস আজ শ্রদ্ধায় নত হয়ে গেছে এক নারী ও এক শিক্ষকের সামনে—যাঁরা অন্ধকারে আলো জ্বালানোর সাহস দেখিয়েছেন।
৮
মঞ্চে সেই সন্ধ্যায় যা ঘটেছিল, তা আর নিছক ‘ঘটনা’ নয়—তা ছিল এক সময়ের বিকারগ্রস্ত স্মৃতির শুদ্ধিকরণ। পরদিন সকালে ঘূর্ণির বাজারে যে কথাটা সবচেয়ে বেশি শোনা গেল তা হল—“জ্যোতির্ময় রক্ষিত আসলে বিশ্বাসঘাতক ছিলেন না, তিনি ছিলেন প্রেমিক, আর এক বেপরোয়া স্বপ্নদ্রষ্টা।”
স্কুলে ঢুকতেই ছাত্রদের চোখে অচিন্ত্যর জন্য একটা অন্যরকম কৌতূহল দেখা গেল। কেউ কেউ এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল, “স্যার, সত্যিই কি আপনারা একটা গুপ্ত সুড়ঙ্গ পেয়েছেন?”, “আপনি কি সত্যিই ভূতের মতো কোনো মুখ দেখেছিলেন নদীতে?”
অচিন্ত্য হাসলেন, “ভূত নয় রে, অতীত কখনও মরে না, শুধু অপেক্ষা করে কেউ তাকে ডাকবে বলে। আমরা শুধু সেই ডাকটাই দিয়েছি।”
মধ্যাহ্নে পিয়ন খবর দিল—কৃষ্ণনগর থেকে এক সাংবাদিক এসেছেন, নাম রজত দত্ত, ছোট চেহারা, মুখে স্মার্ট ভঙ্গি। সঙ্গে ক্যামেরা ও ছোট নোটপ্যাড।
স্কুল মাঠে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল। মৃণালিনী সেখানে অপেক্ষা করছিলেন, তাঁর চোখে ক্লান্তি, কিন্তু মুখে অদ্ভুত এক তৃপ্তি।
রজত চেয়ারে বসেই বললেন, “আপনারা বলছেন, এই দলিলগুলো এতদিন কোথায় ছিল?”
অচিন্ত্য ব্যাগ থেকে তুলে দিল লাল মলাটের খাতা। “এই খাতা ছিল ঘূর্ণি নদীর পাশে এক পুরোনো বাক্সে। তারপর তার সূত্র ধরে আমরা যেটা পেয়েছি, তা শুধু ইতিহাস নয়—একটা ভিন্ন ধারার স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপরেখা।”
রজত মুখ গম্ভীর করে প্রশ্ন করলেন, “আপনি জানেন, এসব ছাপাতে গেলে প্রশাসনের অনুমতি লাগবে। কারণ দলিলগুলোতে কিছু নাম রয়েছে—যাঁরা আজও জীবিত, বা যাঁদের পরিবার এখন রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ।”
মৃণালিনী ধীরে বললেন, “আপনারা যদি আবার ইতিহাসকে চাপা দিতে চান, দিন। কিন্তু এবার মানুষ প্রশ্ন করবে। কারণ এবার আমরা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেছি সত্যটা। এ জিনিস কেউ আর চুরি করতে পারবে না।”
সাংবাদিক মাথা নাড়লেন। “আমি প্রতিশ্রুতি দিতে পারি না। তবে লেখাটা আমি লিখব। বাকিটা মানুষের বিবেকের দায়িত্ব।”
সেদিন সন্ধ্যায় অচিন্ত্য একা একা নদীর পাড়ে বসে। সেই জায়গায়, যেখানে প্রথম জ্যোতির্ময়ের খাতা পেয়েছিল। তার পাশে এখনো সেই কাঠের নৌকাটা পড়ে আছে, কুঁচকে যাওয়া কচুরিপানায় ঢাকা, তার পেটের ভেতর এক অন্য জীবন লুকোনো।
হঠাৎ হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে নদীর জলে ছায়া পড়ে—সেই মুখটা আবার ফুটে ওঠে। চোখে মায়া, ঠোঁটে উক্তি:
“তুমি যা করেছ, তার দাম দিতে হবে। সত্যির আলো মানে শুধু মুক্তি নয়, মানে দহনও।”
অচিন্ত্য চমকে ওঠে। কিন্তু এবার সে ভয় পায় না। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “আমি প্রস্তুত। কারণ এবার আমি সত্যকে ভালোবেসেছি, পালিয়ে যাইনি।”
মুখটা মিলিয়ে যায়।
এরপরের কয়েকদিন গ্রামে এক অভাবনীয় পরিবর্তন দেখা যায়। যারা এতদিন জমিদারবাড়ির সামনে হাঁটত না, তারাও এসে দাঁড়াতে শুরু করে। একদিন পঞ্চায়েত থেকে লোক আসে—তারা জানতে চায়, মৃণালিনী দেবী জমিদারবাড়ি পাঠাগার করতে চাইলে কি আইনত বাধা আছে?
কেউ প্রতিবাদ করে না।
মৃণালিনী বলেন, “এবার থেকে এই বাড়ি হবে পাঠাগার ও স্মারক কেন্দ্র। যেখানে শুধু বই থাকবে না, থাকবে চিঠি, দলিল, প্রতিধ্বনি। যেন যেকোনো মানুষ এসে জানতে পারে, ইতিহাস শুধু কাগজে নয়, মানুষের ভেতরেও থাকে।”
অচিন্ত্য প্রতিদিন স্কুলের কাজ সেরে সন্ধ্যেবেলায় এসে সাহায্য করে বই গোছাতে। সে জানে, তার জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সময়টা এই একবস্তা ধুলোর ভেতর কাটানোই ছিল।
একদিন বিকেলে সে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন হরিমোহন কাকু পাশে এসে দাঁড়ালেন। মুখে পানের দাগ, গলায় কাঁপুনি।
“বাবা, আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।”
অচিন্ত্য বলল, “কি কথা, কাকু?”
“জ্যোতির্ময়বাবু যেদিন মারা যান, সেদিন আমি বাড়িতে ছিলাম। আমি দেখেছিলাম উনি রোশন আরার হাতে একটা খাম দিয়ে বলেছিলেন, ‘যদি আমি ফিরে না আসি, এটা কেউ একজনকে দিও, যে আমাদের স্বপ্ন বুঝবে।’ আমি জানি, ওই খামটাই আপনি পেয়েছেন।”
অচিন্ত্য চোখ বড় করল, “তাহলে আপনি জানতেন সব?”
হরিমোহন মাথা নিচু করে বললেন, “জানতাম, কিন্তু সাহস ছিল না বলার। অনেকেই জানত। কিন্তু তখন সময় ভয়ংকর ছিল, দেশভাগের আগুনে সবাই আত্মরক্ষা চাইছিল। আমি তো কেরানি মানুষ, ইতিহাস নিয়ে ভাবিনি। কিন্তু আজ আপনি যে কাজটা করেছেন, তা দেখে আমি যেন মুক্ত হলাম।”
অচিন্ত্য কেঁপে উঠল। সেই মুহূর্তে সে বুঝল, সে শুধু একটা গল্প খুঁজে পায়নি, সে একটা জাতির অপরাধবোধের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে।
রাতে সে লিখতে বসে। লিখতে শুরু করে—“ঘূর্ণি নদীর গোপন কথা”, প্রথম লাইন:
“যখন নদী কথা বলে না, তখন মানুষ ভুল ভাবে ইতিহাস থেমে গেছে। কিন্তু সত্যি হল, নদী শুধু কথা বলে না, সে শুনতেও জানে।”
৯
নভেম্বরের মাঝামাঝি। ঘূর্ণির আকাশ এই প্রথম বার একটু আলাদা লাগল অচিন্ত্যর চোখে। কুয়াশা এখনও পড়ে, কিন্তু তার ভেতর যেন একরকম স্বচ্ছতা এসেছে, ঠিক যেমন নদীর জল ঘোলা হলেও মাঝে মাঝে তার তলায় জমে থাকা সত্যটাকে স্পষ্ট দেখা যায়।
পাঠাগার তৈরির কাজ এগিয়ে চলেছে। পুরোনো ভাঙা চেয়ার মেরামত হচ্ছে, ধুলো-ধরা বই ঝাড়ামোছা করে সাজানো হচ্ছে লোহার তাকজোড়া শেলফে। মৃণালিনী এখন আর নিঃসঙ্গ নন—গাঁয়ের ছেলেমেয়েরা আসছে, কেউ ছবি আঁকছে, কেউ খাতায় কাগজ গেঁথে বই বানাচ্ছে, কেউ মেঝে মুছে বলে, “এখানে যখন আমরা পড়তে পারব, তখন আর কেউ বলবে না, আমি অশিক্ষিত।”
এটাই ছিল জ্যোতির্ময়ের স্বপ্ন—যে স্বপ্ন ধ্বংস হয়েছিল ধর্মের দড়ি ধরে টানা-পোড়েনে, আজ তা ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে নতুন প্রজন্মের হাতে।
সেই দিনটিতে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। অচিন্ত্য স্কুল শেষে জমিদারবাড়িতে এসে দেখে, মৃণালিনী একটা পুরোনো কাঠের ট্রাংক খুলে বসে আছেন। তার ভিতর থেকে তুলে আনলেন এক কাপড় মোড়া পার্চমেন্ট পেপার।
“এটা বাবার শেষ লেখালিখি। কিন্তু কেউ এটা দেখেনি আজ অবধি। আমি চেয়েছিলাম, এটা তখনই প্রকাশ হোক, যখন কেউ থাকবে যার ভেতর সেই শব্দগুলো বুঝে নেওয়ার চোখ আছে।”
অচিন্ত্য চুপ করে কাগজের দিকে তাকায়। তাতে লেখা—
“আমি ব্যর্থ হব জানি। তবুও লিখছি। কারণ কেউ একদিন হয়তো এই লেখা পড়ে নিজেকে খুঁজবে। ধর্ম নয়, ভাষা নয়, ইতিহাস নয়—মানুষের চোখেই আমি দেশ খুঁজেছিলাম। সেই চোখ যদি মায়া না হারায়, তবে একদিন এই স্বপ্ন জেগে উঠবে।”
কাগজটা ধরে রাখতে রাখতে অচিন্ত্যর গলা শুকিয়ে এল। এক পুরুষ, যাঁকে দেশদ্রোহী বলে অপমান করা হয়েছিল, যাঁকে ভুলে গিয়েছিল কাগজের ইতিহাস, তিনি তাঁর ভবিষ্যতের প্রতি এমন এক চিঠি লিখে গেছেন, যেন জানতেন, তাঁর সময় তাঁকে ধরবে না—তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে আগামী প্রজন্ম।
সেই রাতে অচিন্ত্য ও মৃণালিনী দুজনেই ঠিক করল—এই লেখাটি ছাপা হবে, পাঠাগারের প্রথম স্মারক হিসেবে।
তিনদিন পর, একটি চিঠি এল কৃষ্ণনগর থেকে। প্রেরক—সাংবাদিক রজত দত্ত।
চিঠিতে লেখা—
“আপনার পাঠানো দলিল ও চিঠির অংশ নিয়ে আমরা একটি বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করছি। শিরোনাম: ‘এক প্রেমিক বিপ্লবীর স্মৃতিচিহ্ন’। আগামী রবিবার প্রথম পাতায় ছাপা হবে।”
মৃণালিনী সেই খবর হাতে নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারপর বললেন, “বাবা বলতেন, যা কিছু তুমি হারাও, সেটা একদিন অন্য রূপে ফিরে আসে। আমি বাবা হারিয়েছিলাম, এখন যেন তাঁকে ফিরে পেয়েছি মানুষের ভাষায়।”
রবিবারের সকালে পুরো গ্রাম চুপ করে যায়। কারও হাতে পত্রিকা, কেউ পড়ে, কেউ অন্যের মুখ থেকে শোনে। সেখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা—“ঘূর্ণি নদীর পাড়ে এক ভুল ইতিহাসের শুদ্ধি।”
ছবিতে মৃণালিনী দেবী, অচিন্ত্য সেন, আর পেছনে নদীর ঘূর্ণি। নিচে দলিলের অংশবিশেষ।
সেই সপ্তাহেই পঞ্চায়েত থেকে ঘোষণা আসে—ঘূর্ণি পাঠাগার নামে এই জমিদারবাড়িকে সরকারি স্মারক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এখানে ইতিহাসচর্চা করতে পারবে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম এসে শিখবে—কীভাবে ইতিহাস কেবল রাজাদের নয়, সাধারণ মানুষেরও হয়ে উঠতে পারে।
অচিন্ত্য একদিন মৃণালিনীকে বলল, “তুমি জানো, তুমি আমার জন্য কেবল এক ইতিহাসের ধারক নও, তুমি নিজে এক ইতিহাস হয়ে উঠেছ।”
মৃণালিনী হেসে বললেন, “এতদিন ধরে নিজেকে ছায়া ভেবেছি। আজ মনে হয়, হয়তো আমি একটা প্রতিধ্বনি, যেটা একদিন নদীর তলার সেই মৃত মুখগুলোর মধ্য থেকে উঠে এসে আজকের আলোয় পৌঁছেছে।”
সে রাতে, পাঠাগারের প্রথম অনুষ্ঠানে মঞ্চে দাঁড়িয়ে অচিন্ত্য নিজের লেখা পাঠ করল—
“এক নদী, এক নারী, এক ইতিহাস। আর এক প্রেম—যেটা মরে যায় না, ইতিহাস যতই চেপে রাখুক। এই ঘূর্ণি আজ শুধুই জল নয়, এটি এক জাতির অপরাধবোধের প্রতীক, যা এবার ক্ষমার দিকে হাঁটছে।”
সেই মুহূর্তে অডিটোরিয়ামের পেছনের দেয়ালে আলো ফেলে এক কিশোর। সেখানে হঠাৎ ধরা পড়ে ছায়া—এক পুরুষ, এক নারী, হাত ধরে নদীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
লোকে বলে, এটা আলোর খেলা। কেউ কেউ বলে, ঘূর্ণির জল আজ তার গল্প বলে উঠেছে।
১০
ঘূর্ণির আকাশে তখন শীত নামছে। পাতাঝরার শব্দে ভরা চারপাশ, নদীর জলেও যেন একটা থমকে থাকা ভাব—যেন সে দীর্ঘশ্বাস নিচ্ছে, দীর্ঘ এক ঋণ শোধ করার পর। এই গ্রামে আর কেউ জমিদারবাড়িকে ‘ভূতের বাড়ি’ বলে না। এখন সকলে বলে, “ওই বাড়ি থেকে একদিন সত্যি ফিরেছিল।”
পাঠাগার উদ্বোধনের দু’সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। আজ সেখানে প্রথম ইতিহাস চর্চার সভা। আশেপাশের তিনটি গ্রামের স্কুল থেকে শিক্ষকরা এসেছে, ছাত্ররাও। মঞ্চে বসেছেন অচিন্ত্য, মৃণালিনী, আর রজত দত্ত—সেই সাংবাদিক, যিনি প্রথম এই ইতিহাসকে কাগজে ছাপিয়েছিলেন।
রজত বললেন, “আমি বহু প্রতিবেদন লিখেছি, কিন্তু এমন গল্প খুব কম পেয়েছি, যেখানে মৃত্যু, প্রেম, প্রতারণা আর প্রতিশোধ মিলেমিশে ইতিহাস হয়ে দাঁড়ায়। আমার জন্য এটা কেবল সাংবাদিকতা নয়, এটা অন্তরের দায়।”
ছাত্ররা হাত তুলছে, প্রশ্ন করছে—“স্যার, জ্যোতির্ময় রক্ষিত কি সত্যিই দেশভাগ থামাতে পারতেন?”, “ওনার মৃত্যুর দিন কেউ কি শেষ দেখা পেয়েছিল?”
অচিন্ত্য ধৈর্য ধরে উত্তর দিচ্ছে। মৃণালিনী পাশে বসে থাকেন, চুপচাপ, মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে যেন অতীত ছুঁয়ে যাচ্ছেন।
কিন্তু সেই রাতে একটি নতুন কাহিনি জন্ম নেয়—যেটা শেষ নয়, বরং আরও এক গহীন সূচনা।
ঘূর্ণি নদীর পাড়ে, যেখানে প্রথম দলিল পাওয়া গিয়েছিল, সেখান থেকে পনেরো গজ দূরে এক কিশোর মাছ ধরতে গিয়ে দেখে মাটি আলগা। খুঁড়ে বের করে একটি ধাতব সিন্দুক। ভিতরে রয়েছে—জ্যোতির্ময় রক্ষিত ও রোশন আরা বেগমের কিছু ব্যক্তিগত চিঠি, একটি ছেঁড়া কাগজে আঁকা মানচিত্র, আর একটি সোনার আংটি—ভিতরে খোদাই: “Ekushe February, 1947 — Amar Bhubon.”
মৃণালিনী এই জিনিসগুলো হাতে নিয়ে স্থির হয়ে গেলেন। মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এটা ঘূর্ণি নয়। এটা হচ্ছে সেই জায়গার মানচিত্র যেখানে জ্যোতির্ময় ও রোশন আরা স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি স্বাধীন পাঠাগার গড়ার, কিন্তু দেশভাগে সেটা পূর্ব পাকিস্তানে পড়ে যায়।”
অচিন্ত্য বলল, “আমরা কি সেখানে যেতে পারি না?”
মৃণালিনী হাসলেন, “তুমি পারো। আমি এখন ঘূর্ণিতেই থেকে যাব। আমার কাজ এখানেই।”
সেদিন রাতে তারা দু’জন নদীর পাড়ে শেষবার হাঁটতে যায়। আকাশে পূর্ণিমার আলো, নদীর জল চকচক করে।
অচিন্ত্য বলল, “তুমি কি জানো, তুমি আমাকে বদলে দিয়েছ?”
মৃণালিনী একটু থেমে বললেন, “তুমি এসেছ বলেই আমি আর ছায়া নই। আমি এখন একজন জীবিত ইতিহাস।”
হাতের আংটি তুলে অচিন্ত্য বলল, “এই আংটি তুমি পরবে?”
মৃণালিনী একটু হাসলেন, “তুমি কি প্রস্তাব দিচ্ছো?”
“তবে যদি বলো—একসঙ্গে নদীর মতো বয়ে যাই, কখনও কাছাকাছি, কখনও দূরে, কিন্তু একই দিকে।”
মৃণালিনী আঙুলে পরালেন সেই আংটি।
“আমি রাজি।”
সেই রাত, ঘূর্ণি নদীর বুক জুড়ে জেগে ছিল হালকা ঢেউ—মায়াবী, নিঃশব্দ, কিন্তু গোপনে গেয়ে চলেছিল এক দীর্ঘ গান—যে গানে ছিল ইতিহাস, প্রেম, আর মানুষের অপরাধ বোধের ক্ষমা।
পরদিন অচিন্ত্য কলকাতার দিকে রওনা দেয়, সেই মানচিত্রে চিহ্নিত জায়গা দেখতে। যাওয়ার আগে মৃণালিনী তাকে এক চিঠি দেন—
“যদি তুমি সেখানে যাও, দেখবে আমরা কেউ কখনও সত্যিই হারাইনি। আমরা শুধু অপেক্ষা করেছি, কেউ একদিন আমাদের খুঁজে পাক বলে। তুমি যখন নদীর মুখোমুখি দাঁড়াও, মনে রেখো, ইতিহাস যদি নদী হয়, তাহলে প্রেম তার সবচেয়ে গভীর ঘূর্ণি। সেই ঘূর্ণিতে ডুবে যাও, কিন্তু উঠে এসো—কারণ তুমিই আমাদের বর্তমান।”
শেষ দৃশ্যে, ঘূর্ণি নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকে এক কিশোর, যার হাতে একটা পুরোনো দলিল—সে তাকিয়ে থাকে পাড়ের ওপারে, যেন ভাবছে—“সত্যি কি নদী কথা বলে?”
তখনই পেছনে একটা কণ্ঠ বলে ওঠে, “হ্যাঁ, যদি তুমি শুনতে চাও।”
ঘূর্ণি নদীর গোপন কথা শেষ হয় না। তা শুধু জায়গা বদলায়, শোনার মানুষ বদলায়, আর ইতিহাস নতুন রূপে ফিরে আসে—প্রেম, বিশ্বাস আর ক্ষমার ছায়ায়।
সমাপ্ত