Bangla - ভূতের গল্প - রহস্য গল্প

ঘুমন্ত শহরের কান্না

Spread the love

অধ্যায় ১

ড. শৌনক ভট্টাচার্য বসেছিলেন নিজের স্টাডি রুমে, জানলার বাইরে কুয়াশা নামছিল ধীরে ধীরে। কলকাতার ডিসেম্বরে এমন হিমেল সন্ধ্যা যেন তার প্রিয় — নিঃশব্দে পুরনো বইয়ের পাতা উল্টে দেওয়ার মতো। কাঁপা আলোয় টেবিলের উপর ছড়িয়ে ছিল কিছু নীলচে বিবর্ণ মানচিত্র, কয়েকটি পুরনো পাণ্ডুলিপি আর একটি হলুদ হয়ে যাওয়া খাম। সেই খামের ভেতর থেকে বেরিয়ে ছিল একটি চিঠি, যা সম্ভবত ১৯২০ সালের দিকে লেখা — পাঠক ছিল ‘নলিনীপ্রসাদ ভট্টাচার্য’, যিনি ছিলেন তাঁর প্রপিতামহ। চিঠিতে লেখা ছিল এক প্রাচীন শহরের নাম — ‘বোধানগর’। শহরটির নাম ইতিহাসে প্রায় উধাও, কিন্তু লোককথায় মাঝেমাঝে ওঠে আসে; বলা হয়, “বোধানগর আজও জেগে ওঠে কাঁদতে।” শৌনকের দাদি ছোটবেলায় সেই শহরের গল্প বলতেন, বলেন, “সেখানে নাকি রাত গভীর হলে বাতাস কাঁদে, আর ছায়ারা দেয়ালে হেঁটে চলে।” বড় হয়ে শৌনক যুক্তিবাদী, প্রমাণসিদ্ধ ইতিহাসবিদ হলেও তার ভেতরের কৌতূহলী বালক একরকম আজও সেই রহস্যময় ডাক শুনে যায়। কয়েক সপ্তাহ ধরে সে চেষ্টা করছিল বোধানগরের অবস্থান খুঁজে বের করতে। আধুনিক ম্যাপিং সিস্টেমে শহরটির কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় না, অথচ ব্রিটিশ যুগের কিছু নথিতে তার ভগ্নাংশ পাওয়া যায়। নলিনীপ্রসাদের সেই চিঠির একটি বাক্য যেন শৌনকের স্নায়ুকে ছুঁয়ে দেয় — “যদি কেউ আমাদের কথা শোনে, তবে আমরা হয়তো মুক্তি পাবো।” এই ‘আমরা’ কারা? শহরের মৃতেরা? নাকি চিঠির লেখক নিজেই এক মৃত মানুষের আত্মা? প্রশ্নগুলোর ভারে শৌনকের মাথা ঘুরছিল, কিন্তু উত্তর জানার আগ্রহ তার মধ্যে দিনকে দিন বাড়ছিল।

এক সন্ধ্যায়, অজানা এক ইমেইল আসে শৌনকের ব্যক্তিগত ঠিকানায়। তাতে একটি মাত্র লাইন — “বোধানগর এখনও আছে, শুধু ভুল জায়গায় খুঁজছ।” সঙ্গে সংযুক্ত একটি স্যাটেলাইট ইমেজ, যেখানে একটি নির্জন উপত্যকার মাঝে দেখা যাচ্ছে অদ্ভুত কাঠামো — যেন ধ্বংসস্তূপ, কিন্তু স্পষ্ট নগরের চিহ্ন বহন করছে। লোকেশন অনুযায়ী, এটি ছিল পশ্চিমবঙ্গ-ঝাড়খণ্ড সীমান্তে, পাহাড়ঘেরা এক ভূখণ্ডে। শৌনক দ্বিধা না করে পরদিনই রওনা দেন। সেই পথে যাওয়ার সময় স্থানীয় এক গাড়িচালক জানায়, “ওখানে কেউ যায় না বাবু। পুরোনো রোগ লেগে আছে বাতাসে।” শৌনক হাসে, বলে, “রোগ এখন ইতিহাস, আর আমি ইতিহাসেরই লোক।” কিন্তু তার হাসিতে ভয় মিশে থাকে। শহরে পৌঁছে সে দেখে – কেবল নিঃস্তব্ধতা। বাড়িগুলি কঙ্কালসার, কিছু পুরনো নামফলক, কিছু ভাঙা ছাদ। একটা সময় ছিল, যখন এই শহরে জীবনের ছন্দ বাজত — এখন তার জায়গা নিয়েছে কেবল নীরবতা। একটা বিশাল পোড়োবাড়ির ভেতর ঢুকতেই সে অনুভব করে ঠান্ডা একটা শ্বাস যেন তার ঘাড়ে পড়ল। জানলার বাইরে তখন সূর্য ডুবে যাচ্ছে। হালকা বাতাসে শোনা যায় পাতা ওড়ার শব্দ, কিন্তু তার মধ্যে মিশে যায় এক কান্নার সুর — মৃদু, ক্ষীণ, যেন কেউ হারিয়েছে সব। প্রথমবার শৌনকের হাত কেঁপে ওঠে। সত্যিই কি সে শুনছে কিছু? নাকি কল্পনা করছে? রাত বাড়তেই তার কুঁচকে থাকা হোটেল ঘরে ফেরার পথে হঠাৎই রাস্তার ধারে দেখতে পায় এক বৃদ্ধকে — বসে আছেন এক পাথরের উপর, একদম নড়ছেন না। চোখে নেই কোনো দৃষ্টি, কিন্তু মনে হয় সে যেন তাকিয়ে রয়েছে তারই দিকে। শৌনক ভয় না পেয়ে সামনে এগোয়, বলে, “আপনি এখানেই থাকেন?” বৃদ্ধ কোনো উত্তর দেয় না, কেবল নিঃশ্বাসের আওয়াজ শোনা যায়। ঠিক তখনই পাশের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একটা ছায়া দৌড়ে যায় — খুব দ্রুত, খুব নিঃশব্দে। শৌনক বিস্মিত হয়, কিন্তু তার মধ্যে এখন ভয় নেই, বরং অদ্ভুত এক আকর্ষণ — এই শহরের মধ্যেই যেন লুকিয়ে আছে কোনো চিরন্তন আহ্বান, যা কেবল তাকেই ডেকে নিচ্ছে।

রাত গভীর হলে শৌনক ঘরে বসে তার ক্যামেরা, নোটপ্যাড, আর রেকর্ডার নিয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকে পরদিন শহরটা ঘুরে দেখার জন্য। জানলার পর্দা খানিকটা সরে গেলে দেখা যায় বাইরের পূর্ণিমার আলোয় জেগে থাকা ভাঙা মিনারের ছায়া, আর তার পেছনে যেন এক মহিলা হেঁটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। হঠাৎই তার মনে পড়ে — তার দাদি বলেছিলেন, “যদি কেউ সেই শহরে গিয়ে কান্না শোনে, জানবি সে ডাক কারও ব্যক্তিগত নয় — সেটা যুগ যুগ ধরে আটকে থাকা আত্মাদের প্রার্থনা।” শৌনক জানে না, সে কি সত্যিই ইতিহাস জানার জন্য এখানে এসেছে, নাকি নিজের নিঃসঙ্গতা মুছে ফেলার জন্য। তার স্ত্রী মধুমিতা মারা গেছে পাঁচ বছর আগে, এক অ্যাক্সিডেন্টে। সেই রাতে, সে ছিল মিউজিয়ামে; ফিরেছিল অনেক দেরি করে। অনেক সময়ই সে ভাবে — যদি একটু আগে ফিরত… সেই অপরাধবোধ তাকে তাড়িয়ে নিয়ে আসে এমন শহরের দিকে, যেখানে সবাই কিছু না কিছু হারিয়েছে। বাইরে আবার শোনা যায় সেই কান্না — এবার একটু জোরে, একটু কাছে। শৌনক জানলার দিকে তাকায়, আর তখনই দেখতে পায় — জানলার অপর পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণী। সে চুপচাপ তাকিয়ে আছে, পরনে পুরনো ধরণের সাদা শাড়ি, চোখে অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা। ঠিক তখনি বাতাসের ধাক্কায় জানলা বন্ধ হয়ে যায় নিজে থেকেই। শৌনক ছুটে গিয়ে খুলে দেখে — কেউ নেই। কিন্তু জানলার কাঁচে দেখা যাচ্ছে — আঙুলের ছাপ, যেন কেউ বাইরে থেকে ছুঁয়ে গিয়েছিল। সেই মুহূর্তে তার মনে হয়, শহরটি তাকে স্বাগত জানিয়েছে — এক অদ্ভুত, অন্ধকারময় আলিঙ্গনে।

অধ্যায় ২

পরদিন ভোরবেলা শৌনক ঘুম থেকে উঠেই রেকর্ডার আর ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়ল শহর ঘুরে দেখার জন্য। সূর্যের আলো ছুঁয়ে ফেলে দেওয়া শহরটি কিছুটা উন্মোচিত হয়ে উঠেছিল। গলির ধারে ঝুরঝুরে ইঁটের দেয়াল, উপড়ে যাওয়া রাস্তা, গাছপালার মাঝে চাপা পড়ে থাকা ঘরের দরজা — সবকিছুতেই যেন স্তব্ধতার এক দীর্ঘশ্বাস লেগে ছিল। বাড়িগুলোর দরজা-জানলা খোলা, অথচ কোনো মানুষ নেই; যেন কেউ সব ফেলে হঠাৎ চলে গিয়েছে, বা হয়ত আর ফেরা হয়নি। একটি বাড়ির দেওয়ালে হঠাৎ তার চোখে পড়ে একটি মলিন পোস্টার — “চিকিৎসা শিবিরে আসুন, আপনারা বাঁচতে পারেন।” তারিখটি ১৯২৪। সেই সময়টাই ছিল সেই ভয়ানক মহামারির কাল। শৌনক মনে মনে বলেন, “তবে কি এই শহরের ধ্বংস আসলে প্রাকৃতিক নয়, মানুষী অবহেলার ফল?” ক্যামেরায় তিনি একটার পর একটা ছবি তুলতে থাকেন — ফাটলে ভরা ঘরের মেঝে, পুরনো খাট, ধুলোমাখা আয়না, অদ্ভুতভাবে সাজানো কাটা ফলের মতো কিছু — যেন কেউ মাঝপথে থেমে গেছে। এমনই এক বাড়িতে ঢুকে তিনি দেখতে পান ভেতরের একটা ঘরের মেঝেতে ছড়ানো আছে কিছু কাঠের পুতুল আর শিশুর খেলনা। মনে হয় যেন শিশুরা কিছুক্ষণ আগে খেলছিল। হঠাৎ বাতাসে ভেসে আসে একটি কিশোরীর হাসি — মৃদু, তীক্ষ্ণ, যেন কারও স্মৃতির মর্মরধ্বনি। তিনি তাকিয়ে দেখেন, জানলার পাশে একটি ভাঙা পুতুল, তার চোখ যেন তাকিয়ে আছে তাঁর দিকেই।

তীব্র কৌতূহল নিয়ে তিনি এগিয়ে যান শহরের এক প্রান্তের দিকে, যেখানে একটি বড় অট্টালিকা— সম্ভবত পুরনো টাউন হল বা হাসপাতালে পরিণত হয়েছিল মহামারির সময়। দোতলার সিঁড়ি উঠতেই পা থেকে ধুলোর ঝাঁক উঠে আসে, আর বাতাসে হালকা অ্যাসিডিক গন্ধ— যেন ওষুধ আর পচে যাওয়া শরীরের মিশ্র স্মৃতি। এক কোণে পৌঁছে তিনি দেখতে পান একটি কালো চেয়ারে কেউ বসে আছে — সেই আগের দিনের সেই বৃদ্ধ। এবারও তার মুখ সেই একই নিষ্প্রাণ, চোখের দৃষ্টি নেই, কিন্তু ঠোঁটে একটি অমোঘ শব্দ — “ফিরে এসো না।” শৌনক চমকে ওঠে। এই প্রথম সেই বৃদ্ধ কথা বলল। তিনি প্রশ্ন করেন, “আপনি কে?” বৃদ্ধ মাথা নেড়ে বলেন, “আমরা তো ছিলাম, আছি… তবে কেউ কথা বলে না আমাদের সঙ্গে।” হঠাৎই দেয়ালের ওপারে হেঁটে যায় একটা ছায়ামূর্তি — নারীমূর্তি, ধবধবে সাদা পোশাক, পা মেঝেতে লাগছে না, যেন বাতাসে ভেসে চলে যাচ্ছে। শৌনক ক্যামেরা তুলতে না তুলতেই তা মিলিয়ে যায়। সেই মুহূর্তে চারপাশে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। যেন অতীত আবার ফিরে এসেছে — আর এই শহর, এই ধ্বংসস্তূপ, তার মধ্যে জীবনের এক অসমাপ্ত অংশ আজও আটকে আছে, মুক্তির অপেক্ষায়।

সন্ধ্যা নামতেই শৌনক আবার ফিরে আসে হোটেলঘরে। জানলার পাশে বসে সে তার নোটপ্যাডে লিখতে থাকে দিনভর দেখা অভিজ্ঞতা। এমন সময় পেছন থেকে কারও পায়ের শব্দ আসে — ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে তার ঘরের দরজার সামনে। সে উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই সেখানে দাঁড়িয়ে এক তরুণী — সেই তরুণী, যাকে সে আগের রাতে জানলার বাইরে দেখেছিল। এবার সে সামনে, স্বচ্ছ রূপে। চুল খোলা, মুখে অদ্ভুত এক বিষাদ, কিন্তু চোখে কোনো ভয় নেই। সে শান্ত কণ্ঠে বলে, “আপনি এসেছেন, ঠিক করেছেন। আমাদের গল্প কেউ শোনে না। আমাদের কান্না বাতাসেই মিশে যায়।” শৌনক হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কে?” মেয়েটি উত্তর দেয়, “আমার নাম অমৃতা। আমি ছিলাম এই শহরের বাসিন্দা। সেই সময় যখন এখানে হাহাকার ছাড়া কিছু ছিল না।” শৌনক প্রশ্ন করে, “তুমি এখনও আছো এখানে?” অমৃতা মৃদু হাসে, বলে, “আছি… অনেকেই আছে। কিছু আত্মা চলে যেতে চায়, কেউ কেউ পারে না। কেউ চায় কেউ জানুক তার কথা। আমি সেই দলের।” এই বলে সে এগিয়ে আসে, শৌনকের কাঁধে হাত রাখে — স্পর্শে শীতলতা, কিন্তু তাতে কোনো ভয় নেই। বরং মনে হয়, সে এক গহীন বেদনার শরিক হয়ে পড়েছে, যেখান থেকে পালানো যায় না। অমৃতা বলল, “আপনি কি শুনতে পারবেন আমাদের কথা? সত্যিই শুনতে?” শৌনক মাথা নাড়ে। সে জানে, ইতিহাস যতই প্রমাণ-নির্ভর হোক, কিছু সত্য থাকে যাকে কেবল অনুভব করা যায়। এই শহর, তার ধ্বংসস্তূপ, আর এই মেয়েটি— তাকে এক অদ্ভুত যাত্রার দিকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে, যেখান থেকে ফিরে আসা হয়তো আর সম্ভব নয়।

অধ্যায় ৩

পরদিন সকালের আলোয় অমৃতা নেই, যেন রাতের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কিন্তু তার উপস্থিতির ছাপ যেন থেকে গেছে ঘরের প্রতিটি কোণে — জানলার কাচে, কাঠের চেয়ারে, এমনকি শৌনকের হাতের তালুতে, যেখানে সে স্পর্শ করেছিল। শৌনক জানে না, সে কি স্বপ্ন দেখেছে, না সত্যি; তবে তার মাথার ভেতর অমৃতার কণ্ঠস্বর গুঞ্জন করে — “আমাদের কথা কেউ শুনে না…”। সে বেরিয়ে পড়ে শহরের আরও গভীরে, তার রেকর্ডার আর ডায়েরি নিয়ে। শহরের মধ্যভাগে পৌঁছে সে দেখে একটি ছোট্ট গির্জা, যার ছাদ ভেঙে পড়েছে, আর ভিতরে ধুলোয় ঢাকা বেঞ্চ আর কাঠের ক্রুশ পড়ে আছে এক কোণে। দেয়ালে ফ্রেস্কোর অর্ধেক মুছে গেছে, কিন্তু তাতে এখনো এক শিশুর মুখ স্পষ্ট — করুণ আর অব্যক্ত। গির্জার ভেতরে হঠাৎই বাতাস বন্ধ হয়ে যায়, আর শোনা যায় শিসের মতো কণ্ঠস্বর — “আমাদের কথা লিখে রেখো…”। শৌনক কেঁপে ওঠে, কিন্তু এবার ভয় নয়, বরং ভিতর থেকে এক অদ্ভুত তাগিদ উঠে আসে — এই মৃত শহরের ভাষাহীনদের কণ্ঠ হতে হবে তাকেই।

গির্জার পাশেই একটি উঁচু মিনারের ধ্বংসস্তূপে গিয়ে সে দেখতে পায় – একসময় সেটি ছিল টাউন হল। সেখানে এক প্রাচীন ঘড়ির যন্ত্রপাতি এখন মরিচা পড়া ইস্পাতের মত দাঁড়িয়ে আছে, তার কাঁটা থেমে গেছে “১২:০৪” এ। আশ্চর্যজনকভাবে, শহরের বিভিন্ন দেওয়ালে একই সময় লেখা রয়েছে — ১২:০৪। শৌনকের মনে পড়ে যায়, ইতিহাসে এই শহরের মহামারির ভয়ঙ্করতম রাতটি ছিল ১২ এপ্রিল, রাত ১২টা। কি এমন হয়েছিল সেই সময়? সে চারদিক দেখতে থাকে, আর হঠাৎ সে দেখতে পায় — একদল ছায়ামূর্তি হেঁটে যাচ্ছে রাস্তা ধরে। তারা মাথা নিচু করে, যেন কোনো কিছুর প্রতীক্ষায়, কোনো শেষ যাত্রার উদ্দেশে। তাদের মধ্যে শিশু, নারী, বৃদ্ধ সবাই আছে। মুখ নেই, চোখ নেই, কিন্তু এক অদ্ভুত শোক তাদের গঠন করে রেখেছে। শৌনক ক্যামেরা তুলে ছবি তুলতে যায়, কিন্তু স্ক্রিনে কেবল ফাঁকা রাস্তা। সে বুঝতে পারে — এই ছায়ারা মৃত নয়, স্মৃতি। তারা ভেসে আছে, যাদের কেউ শোক করেনি, যাদের মৃত্যুকে কেউ মনে রাখেনি। শহরের দেয়ালের ফাঁক দিয়ে তখন ভেসে আসে হালকা সুর — যেন কোনো মায়ের লোরি, অথবা কোনো শোকগাথা, যার ভাষা জানা নেই, তবু হৃদয়ে লেগে যায়।

হোটেলে ফিরে এসে শৌনক লিখতে বসে — দ্রুত, অস্থির হাতে। তার হাতে তখন আর গবেষকের সংযত লেখনী নেই, বরং আছে একজন শোকবাহকের আর্ত কণ্ঠস্বর। সে লিখে, “এই শহরের মানুষগুলো মারা গিয়েছিল, ঠিক, কিন্তু তারা হারিয়ে যায়নি। তারা আছে, বাতাসে, ছায়ায়, কান্নায় — এবং তারা চাইছে কেউ তাদের কথা বলুক।” হঠাৎ দরজার নিচে দিয়ে গড়িয়ে আসে একটি কাগজ — হলুদ, অর্ধেক পুড়ে যাওয়া। তাতে লেখা — “আমরা সবাই ঘুমিয়েছি, কিন্তু আমাদের স্বপ্ন এখনও জেগে আছে।” কণ্ঠস্বর শোনা যায় জানলার বাইরে — “তুমি কি দেখছো আমাদের?” শৌনক জানলার দিকে তাকিয়ে দেখে, দূরে একটি বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই অমৃতা। সে এবার তার দিকে তাকিয়ে আছে — স্থির, গভীর চোখে। শৌনক জানে, এই ডাক আর উপেক্ষা করা যাবে না। পরদিন সে যাবে অমৃতার সঙ্গে, তাদের সেই সময়ের ভেতরে, যেখানে মৃত্যু আর বিস্মৃতির মধ্যে আটকে আছে এক শহরের সমগ্র আত্মা। ঘরের ঘড়িতে তখন রাত ১২টা ০৪ বাজে — সেই থেমে থাকা সময়, যেখানে পৃথিবী হয়তো একবার নিঃশ্বাস বন্ধ করেছিল।

অধ্যায় ৪

পরদিন সকালটা অস্বাভাবিকভাবে নিস্তব্ধ। পাখির ডাক নেই, বাতাস চলাচল করছে না, আর সূর্যের আলো শহরের ছায়া ভেদ করতে পারছে না যেন। শৌনক আবারও রওনা দেয় — এবার সে ঠিক করেছে অমৃতার সঙ্গে দেখা করবে। আগের রাতের সেই বার্তা, ছাদের উপর দাঁড়িয়ে থাকা সেই নিঃশব্দ চোখের দৃষ্টি, সব যেন তাকে এক অদৃশ্য সুতোয় বেঁধে রেখেছে। সে পৌঁছে যায় শহরের পুরনো প্রশাসনিক ভবনে, যেখানে অমৃতা বলেছিল সে অপেক্ষা করবে। ভবনটি প্রায় ধ্বংসস্তূপ — ছাদ ভেঙে পড়েছে, কাঠের দরজায় ঘুণপোকা, কিন্তু একরকম অদ্ভুতভাবে ভেতরের কিছু জিনিস অক্ষত। শৌনক একটি ঘরে ঢুকে পড়ে — দেয়ালে পুরনো নথি ঝুলছে, অনেক জায়গায় ভাঙা অক্ষর, কিন্তু মাঝখানে একটি নোটিশবোর্ডে খামভর্তি কয়েকটি চিঠি এখনও টিকে আছে। চিঠিগুলোর ভাষা তার চেনা — ব্যথার, হাহাকারের, একের পর এক মানুষের শেষ আবেদন। কেউ লিখেছে, “আমার ছেলে চারদিন ধরে জ্বরে, কেউ ডাক্তার পাঠান।” কেউ বলেছে, “আমার স্বামীকে জোর করে হাসপাতালের বাইরে ফেলে রাখা হয়েছে, তিনি বাঁচবেন না।” এইসব শব্দ যেন সময় ভেদ করে শৌনকের মগজে ঢুকে যায়। হঠাৎ সে অনুভব করে, দেয়ালের গায়ে হাত রাখলে ভেসে উঠছে দৃশ্য — মানুষ কাঁদছে, পাগলের মতো সাহায্য চাইছে, কেউ কাউকে জলের জন্য ডেকে কাঁপছে। এই দেওয়াল যেন ইতিহাস নয়, স্মৃতির এক জীবন্ত দরজা।

তাকে অনুসরণ করে হঠাৎ অমৃতা উপস্থিত হয় — এবার আর ছায়া নয়, বাস্তব রক্তমাংসের রূপেই যেন। সে বলে, “তুমি কি দেখতে পারছো?” শৌনক মাথা নেড়ে বলে, “হ্যাঁ। আমি দেখতে পাচ্ছি। কেমন করে তোমাদের ফেলে দেওয়া হয়েছিল।” অমৃতা কাঁদে না, কেবল একরাশ স্তব্ধতা নিয়ে বলে, “তোমরা ইতিহাসে সংখ্যার হিসেব রাখো, কিন্তু কান্নার হিসেব রাখো না। আমার বাবা একজন চিকিৎসক ছিলেন, শেষ দিনগুলোতে তিনি একাই একশো মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। শেষে তিনিও চলে গেলেন।” শৌনক চুপচাপ শোনে। সে বুঝতে পারে, সে আর কেবল গবেষক নয় — সে এখন এই শহরের এক শ্রোতা, একজন শ্রদ্ধা-প্রদানকারী। অমৃতা তাকে একটি পুরনো ঘরের দিকে নিয়ে যায়। সেখানে ছিল একটি অদ্ভুত আয়না — আয়নাটি কালো, কাঁচ নয়, যেন জলে তৈরি। অমৃতা বলে, “এই আয়নায় দেখতে পাবে, কে আসলে নিজেকে ভুলে গিয়েছে।” শৌনক প্রথমে দ্বিধা করে, কিন্তু আয়নার সামনে দাঁড়াতেই দেখে — তার প্রতিবিম্বের মুখে ভয়ের বদলে রয়েছে ক্লান্তি, দৃষ্টি অস্পষ্ট, আর কপালে ঘাম। কিন্তু তার চোখে আর নিজের পরিচয়ের বোধ নেই। সে এক মুহূর্তে বুঝতে পারে — ধীরে ধীরে তার নিজের স্মৃতিই মুছে যাচ্ছে।

সে যেন এক অদ্ভুত ভ্রমণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে তার পরিচয় বিলুপ্ত হচ্ছে আর সেই জায়গায় ঢুকে পড়ছে শহরের মানুষের কণ্ঠস্বর, ব্যথা, স্মৃতি। সে আয়নার সামনে বসে পড়ে। কাঁধে অমৃতার হাত, সে বলে, “তুমি এখন আমাদের একজন, না হলে আমাদের কেউ শুনবে না। তুমি লিখবে, তাই তোমাকে ভুলতে হবে তোমার নিজের নাম।” শৌনক ফিসফিস করে বলে, “তাহলে আমি কে হবো?” অমৃতা জবাব দেয় না, শুধু বলে, “একটি দরজা বন্ধ হলে আরেকটি খুলে যায়।” ঠিক তখনই ঘরের বাইরে থেকে আবার সেই কান্নার ধ্বনি ভেসে আসে — কিন্তু এবার তা কেবল কান্না নয়, তাতে মিশে আছে ইতিহাসের আবেদন, এক বিস্মৃত সময়ের আর্তনাদ। শৌনক বুঝতে পারে, সে এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেখান থেকে পেছনে ফেরা নেই। হয় সে ইতিহাসকে মুক্ত করবে, নয়তো সে নিজেই ইতিহাস হয়ে যাবে — আর কেউ জানবে না যে সে কখন এসেছিল, কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল।

অধ্যায় ৫

শৌনকের দৃষ্টি ধীরে ধীরে ঘোলা হয়ে আসছিল। তার নাম, তার পরিচয়, তার গবেষণার উদ্দেশ্য — সবকিছু যেন কুয়াশার মধ্যে ঢেকে যাচ্ছে। আয়নার সেই কালো প্রতিচ্ছবিতে সে নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিল না। মাথার মধ্যে কেবল ভেসে আসছিল ভাঙা-ভাঙা শব্দ — “আমরা বাঁচতে চেয়েছিলাম…”, “আমরা গল্প হয়ে যেতে চাইনি…”, “তুমি কি আমাদের কথা শুনবে?” আর তখনই অমৃতা আবার তার পাশে এসে দাঁড়ায়, এবার আর কোন ছায়ার আভাস নয়, এক পূর্ণ মানবী রূপে — কিন্তু তার শরীর যেন বাতাসের মতো হালকা, তার চোখে এমন এক দৃষ্টি, যা বহুকাল আগের বেদনার ছাপ বয়ে নিয়ে চলেছে। অমৃতা চুপচাপ শৌনকের পাশে বসে, এক নিঃশব্দ মুহূর্তের পর বলে, “তুমি অনেক দূর চলে এসেছো, এখন যদি ফিরে যাও, সব ভুলে যাবে। তুমি যদি থেকে যাও, তাহলে আমাদের সঙ্গে জড়িয়ে যাবে।” শৌনক গলার স্বর খুঁজে পায় না প্রথমে। অবশেষে বলে, “তুমি কে, অমৃতা? তুমি কি মানুষ, না…” কথা শেষ না হতেই অমৃতা তার দিকে তাকায়, বলে, “আমি ছিলাম। আমি এখন শুধু বাকী থাকা একটা সুর। এই শহরের শেষ দৃষ্টান্ত। আমাদের কেউ শোনেনি, তাই আমরা রয়ে গেছি।”

অমৃতা তার গল্প বলা শুরু করে — এক সময় বোধানগর ছিল এক সমৃদ্ধ শহর, সুর্যপুর রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র। কিন্তু এক গ্রীষ্মকালে হঠাৎই ছড়িয়ে পড়ে অজানা এক রোগ — গায়ে ফোস্কা, জ্বর, আর অজ্ঞান হয়ে মৃত্যুর আগে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মানুষের গলা দিয়ে বেরিয়ে আসত কান্নার মতো শব্দ। ডাক্তার ছিল অমৃতার বাবা, যিনি একাই সেই সময় শহরের মানুষদের সেবা করতে থাকেন। তিনি তার পরিবারকেও রক্ষা করতে পারেননি। একে একে অমৃতার মা, ছোট ভাই মারা যায়। অমৃতা নিজেও আক্রান্ত হয়, আর তার মৃত্যুর দিন — ১২ এপ্রিল, রাত ১২টা ৪ মিনিট — সেই শহরের সময় যেন চিরতরে থেমে যায়। তার মৃত্যুর কিছু সময় আগে সে একটি খাতায় লেখে, “যদি কেউ একদিন এই শহরে আসে, তাকে বলো — আমরা মরেছিলাম না, আমরা হারিয়ে গিয়েছিলাম।” সেই খাতা আজ আর নেই, কিন্তু তার আত্মা সেই কথাটাই বয়ে বেড়ায় যুগের পর যুগ। শৌনক স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। একটি আত্মা তাকে নিজের শেষ মুহূর্তের কথা বলছে — কণ্ঠে কোনো অভিযোগ নেই, নেই কোনো ভয়ের রেশ, কেবল রয়েছে এক অমোঘ আকুতি, “আমাকে মনে রেখো।”

আধঘণ্টার বেশি সময় ধরে তারা চুপচাপ বসে থাকে সেই আয়নার ঘরে। বাইরে বাতাস উঠেছে, যেন ছায়ারা জেগে উঠছে। শৌনক এবার আবার বলে, “তুমি কি আটকে গিয়েছো?” অমৃতা বলে, “না, আমি বেছে নিয়েছি থেকে যেতে। যতক্ষণ না কেউ আমাদের কথা লেখে, আমরা যাবো না। আমরা চাই, কেউ আমাদের অনুভব করুক। তুমি পারবে, শৌনক?” শৌনক জানে না কীভাবে জবাব দেবে। সে তার নিজের হাতের উপর তাকায় — আঙুলগুলো যেন কাঁপছে না, কিন্তু তার স্পর্শে কোনো উষ্ণতা নেই। সে জানে, সে এখন এক অদ্ভুত সীমারেখায় দাঁড়িয়ে, যেখানে জীবনের বাস্তবতা আর মৃতদের স্মৃতি একত্র হয়েছে। হয়তো সে এখনও বেঁচে আছে, হয়তো নয় — কিন্তু সে অনুভব করে, তার ভেতরে একটা দরজা খুলে গেছে, যা কেবল ইতিহাসের বই দিয়ে বোঝা যায় না। সে মাথা হেঁট করে বলে, “হ্যাঁ, আমি লিখব। আমি শুনেছি তোমাদের। আমি ভুলে যাবো না।” তখন অমৃতা একবার তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি এখন আমাদের একজন।” সে উঠে দাঁড়ায়, ধীরে ধীরে দরজার দিকে হাঁটে, আর সঙ্গে সঙ্গে হাওয়ার দোলা বন্ধ হয়ে যায়, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে নিস্তব্ধতা — যেন বহু বছর পরে কেউ একটি কথা শুনে নিয়েছে। শৌনক জানে না, সে আজ রাতে ঘুমোতে পারবে কিনা, কিন্তু তার মনে আছে — ১২:০৪ মিনিট, এক মৃত শহরের মধ্যরাত্রি, যেখানে এক আত্মার সত্য বলে যাওয়া, তার লেখার দায়িত্ব হয়ে উঠেছে তার নিজের অস্তিত্বের পরিণতি।

অধ্যায় ৬

শৌনক ভোররাতে জেগে ওঠে এক অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে — ঘুমিয়েছে তো ঠিক, কিন্তু যেন নিজের শরীরের মধ্যে ছিল না। তার চারপাশে বাতাসের গাঢ়তা অনেকটা বেড়ে গেছে, দেয়ালের ছায়া যেন একেকটা জীবন্ত শরীর, আর আয়নার কাঁচে তার প্রতিবিম্ব এখনও ঝাপসা। সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, চোখের দিকে তাকায় — যেন সেই চোখে আর সে নেই, বরং কারও অতীত প্রতিফলিত হয়ে আছে সেখানে। তার বুকের ভেতর থেকে শব্দহীন একটি কান্না উঠে আসে — ঠিক শব্দে প্রকাশযোগ্য নয়, কিন্তু অনুভবযোগ্য। সে বুঝতে পারে, সে বদলে যাচ্ছে — একজন পর্যবেক্ষক থেকে একজন বাহক হয়ে উঠছে, যারা ইতিহাসকে শুধু দেখে না, বইয়ে নিয়ে চলে। দরজা খুলে বাইরে বেরোতেই দেখে শহর জেগে উঠেছে — তবে জীবিত নয়, বরং স্মৃতির আলো-ছায়ায়। বাতাসে সেই পরিচিত ঘ্রাণ, যেমনটা হয় পুরনো কাগজে, ধুলোমাখা দেওয়ালে। কিন্তু এর মাঝেই একটা অস্বাভাবিকতা রয়েছে — যেন কিছু একটা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে আরও গভীরে, বোধানগরের হৃদয়ের দিকে, যেখানে ইতিহাস এখনও পচে না গিয়ে টিকে আছে, কোথাও অদৃশ্য শিকলে বাঁধা পড়ে আছে।

অমৃতা আর সামনে আসে না, কিন্তু শৌনক তার উপস্থিতি অনুভব করে, প্রতিটি পথের বাঁকে, প্রতিটি ছাদবিহীন ঘরের জানালায়, সেই চোখজোড়া যেন তাকে দেখছে, বিচার করছে — সে সত্যিই লিখবে তো? সে কি সত্যিই শোনে তাদের কথা? এমনই এক পথের মোড়ে সে পৌঁছে যায় শহরের পুরোনো হাসপাতালের প্রধান ভবনে — যেটা অমৃতার বাবা চালাতেন। ভেতরে ঢুকতেই দম বন্ধ হয়ে আসে — পচা ওষুধের গন্ধ, মরচে ধরা স্ট্রেচার, আর কাঁচভাঙা জানালার গায়ে শুকনো রক্তের মতো দাগ। দেয়ালে ঝুলে থাকা একটি বোর্ডে এখনও লেখা — “আজকের রোগী সংখ্যা: ৩৪৫, বাঁচানোর চেষ্টা চলছে”। কিন্তু তার পাশে, লাল কালি দিয়ে কেউ লিখে রেখেছে — “আমরা বাঁচিনি।” শৌনকের বুক ধ্বক করে ওঠে। এই ভবনের নিচে মেঝেতে বসেই, অমৃতার বাবা একদিন নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলেন, মৃত্যুর মুখোমুখি শত শত মানুষের চাপে। সে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে — ভূগর্ভস্থ একটি তলা আছে, যেখানে তখনকার ওষুধপত্র, ইনজেকশন, খাট রাখা হত। সেই জায়গায় গিয়ে শৌনক দেখতে পায় — একটি ভাঙা খাটে কেউ বসে আছে। ঠিক করে তাকাতেই সে বুঝতে পারে — এ সেই বৃদ্ধ, যাকে সে আগেও একাধিকবার দেখেছে। কিন্তু এবার বৃদ্ধ মুখ তোলে, এবং একদম স্পষ্ট গলায় বলে — “তোমাকে যদি স্মৃতি পছন্দ হয়, তাহলে তার দায়ও তোমাকে নিতে হবে।”

শৌনক চুপচাপ বসে পড়ে বৃদ্ধের পাশে। এবার সে আর ভয় পায় না — বরং মনে হয় এ-ই স্বাভাবিক। বৃদ্ধ বলে চলেন, “তুমি জানো, এ শহরের মানুষরা কাঁদেনি শুধু মৃত্যুর জন্য, তারা কেঁদেছিল ভুলে যাওয়া জন্য। আমরা চেয়েছিলাম কেউ একদিন আমাদের নাম মনে রাখুক। অমৃতা ছিল আমাদের শেষ আশা। কিন্তু তার গলা পৌঁছয়নি বাইরে।” শৌনক ধীরে ধীরে বলে, “আমি লিখব, আমি নামগুলো জড়ো করব, আমি শুধু সংখ্যায় তোমাদের গোনার বিরুদ্ধে দাঁড়াব।” তখন বৃদ্ধ বলে, “তাহলে শোনো — শহরের কেন্দ্রে যে চত্বর, সেখানে প্রথম মৃতদেহ ফেলা হয়েছিল। ওখানে এখনও কান্না জমে আছে বাতাসে। সেখানে যাও, তোমার শেষ প্রশ্নগুলোর উত্তর পাবে।” শৌনক উঠে দাঁড়ায়, মাথা নিচু করে ধন্যবাদ জানায়। সে জানে — তার সময় ফুরোচ্ছে। শহরের স্মৃতিগুলো তাকে নিজের মধ্যে টেনে নিচ্ছে, তার পরিচয় আর ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে। কিন্তু ভয় নেই, শুধু একটা সিদ্ধান্ত — সে শেষ অবধি যাবে। শহরের হৃদয়ে, কান্নার উৎসে। হয় সে ফিরবে ইতিহাস নিয়ে, নয়তো সে নিজেই হয়ে যাবে তার একটি নামহীন অংশ।

অধ্যায় ৭

শৌনক হাঁটছে। ধ্বংসস্তূপ পেরিয়ে, রক্তমাখা হাসপাতালের স্মৃতি পেরিয়ে, এক অপার্থিব নীরবতায় মোড়ানো পথ ধরে এগিয়ে চলেছে বোধানগরের ‘মধ্য চত্বর’-এর দিকে। এটা সেই জায়গা, যেখানে একসময় মেলা বসত, রথ টানত, শিশুরা বেলুন কিনত আর লোকজন গরম জিলিপি খেত। এখন সব স্মৃতি চাপা পড়ে আছে ভাঙা ইট, মরচে ধরা রেলিং আর এক নিঃশব্দ পাথরচাপা কান্নার নিচে। তার পা যেন একেকটা ছায়ার উপর দিয়ে হাঁটছে — যেন ভেঙে দেওয়া খেলার ঘর, ফেলে যাওয়া পুতুল, আর নিষ্প্রাণ স্বপ্নের শরীরগুলোর উপর। চত্বরে পৌঁছে সে দাঁড়ায়। এক কেন্দ্রীয় মিনার আছে সেখানে — সেটি এখন ভাঙা, মাথা নেই। তার গোড়ার কাছে পড়ে থাকা পাথরে লালচে দাগ, আর তার ঠিক পেছনে লেখা — “আমাদের কথা কেউ জানবে না।” কিন্তু সেই লেখার নিচে অমৃতার হাতের লেখা আরেকটি বাক্য — “তবে যদি কেউ আসে?”

শৌনকের চোখ জ্বালা করে ওঠে। হঠাৎই চারদিক থেকে ভেসে আসে শব্দ — শিস, কাশির গলা, বাচ্চার কান্না, নারীর আর্তচিৎকার, বৃদ্ধের দীর্ঘশ্বাস। শহর যেন এক সঙ্গে তার সমস্ত সংবেদনশীলতা নিয়ে জেগে ওঠে। সে ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ে, চোখ বন্ধ করে। শহরের বাতাস আজ যেন চিৎকার করছে, তাকে কিছু শোনাতে চাইছে। তখন এক মুহূর্তে সব শব্দ স্তব্ধ হয়ে যায়, শুধু এক কণ্ঠস্বর — অমৃতা’র। “তুমি লিখবে তো?” শৌনক চোখ মেলে দেখে, তার চারপাশে অসংখ্য ছায়া দাঁড়িয়ে আছে — ছোটো ছোটো শিশুরা, নারীরা, বৃদ্ধেরা, রোগী ও সেবক, কেউ মাথায় কাপড়, কেউ পায়ের ওপর কালি, কেউ চোখে কেবল অপেক্ষার রেখা। তারা সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাদের কোনো কথা নেই, শুধু এক অনন্ত দৃষ্টির ভাষা। শৌনকের হাত কাঁপে, ডায়েরি বের করে। সে বলতে শুরু করে — “আমার নাম শৌনক। আমি একজন ইতিহাসবিদ। কিন্তু আজ থেকে আমি তোমাদের শ্রোতা। তোমরা বলো, আমি লিখি।” একে একে তারা এগিয়ে আসে, কেউ নাম বলে, কেউ একটি ঘটনা, কেউ শুধুই একটি শব্দ — “জ্বর”, “পানি”, “মা”, “তৃষ্ণা”, “ভয়”…

তখনই সেই মিনারের পেছন থেকে অমৃতা ধীরে ধীরে হেঁটে আসে। এবার আর তার মুখে বিষণ্নতা নেই, বরং এক শান্ত প্রকাশ। সে এসে বলে, “তুমি আজ আমাদের সব গল্প শুরু করলে। এখন কেউ ভুলে যাবে না।” হঠাৎই এক তীব্র আলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে — কুয়াশা ভেদ করে, শহরের চত্বর যেন এক মুহূর্তের জন্য জীবিত হয়ে ওঠে। অদৃশ্য হয়ে যাওয়া ছায়াগুলো একে একে বাতাসে মিশে যেতে থাকে — কারও চোখে জল, কারও চোখে শান্তি। তারা বিদায় নেয়, শব্দহীনভাবে। অমৃতা শৌনকের চোখে চোখ রাখে, বলে, “আমাকে এবার যেতে হবে। তুমি ফিরে যেও।” শৌনক বলে, “তুমি কি মুক্তি পেলে?” অমৃতা মৃদু হেসে বলে, “তুমি আমাদের নাম লিখেছো — এতেই মুক্তি।” সে ধীরে ধীরে মিশে যায় বাতাসে। শৌনক তখন একা দাঁড়িয়ে থাকে সেই চত্বরে — কিন্তু আর একা নয়, কারণ তার ডায়েরিতে লেখা আছে শত শত হারিয়ে যাওয়া জীবনের নাম, শব্দ, ইতিহাস।

অধ্যায় ৮

সেই রাতের পরে বোধানগর যেন বদলে গিয়েছিল। না, শহরের ধ্বংসস্তূপ ভাঙেনি, না তার দেয়ালে নতুন রঙ উঠেছে, তবু বাতাসে কিছু একটা হালকা হয়ে গেছে — যেমন হয় দীর্ঘদিন জমানো কান্না কারও শোনার পরে। শৌনক অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল কান্নার চত্বরে, তার ডায়েরি বুকে চেপে। ভোরের দিকে যখন হালকা রোদের আঁচ পড়তে শুরু করে, তখন সে হাঁটা দেয় শহরের বাইরে — নিঃশব্দ, ধীরে, যেন সদ্য হারানো কারও শোকবিধ্বস্ত শ্রাদ্ধযাত্রার মতো। পথের ধারে পুরোনো গাছগুলো আজ যেন বেশি স্থির, বাতাস কম, পাখিরা এখনও চুপ। কিন্তু তার মনে হয়, সবকিছু তাকিয়ে আছে তার দিকে, একধরনের প্রশ্রয় দিয়ে — “তুমি আমাদের কথাগুলো বয়ে নিয়ে যাচ্ছো”। শহরের সীমানা ছাড়িয়ে যখন সে মাটির রাস্তা ধরে হেঁটে চলে, পেছন ফিরে আর একবার বোধানগরের দিকে তাকায়। সেখানেই, দূরে, হাসপাতালের ছাদে দাঁড়িয়ে অমৃতার এক ঝলক — এবার চোখ বন্ধ, শান্ত মুখ। সে হাত তোলে একবার — বিদায়, কিংবা আশীর্বাদ। তারপর মিলিয়ে যায়।

শৌনক কলকাতায় ফিরে আসে, কিন্তু সে আর আগের শৌনক নয়। তার ব্যাগে এখন শুধু জামাকাপড় নেই, আছে ইতিহাসের অদৃশ্য আখ্যান। কয়েকদিন নিঃশব্দে থাকে সে — কথা বলে না, কারও ফোন ধরে না। নিজের ঘরের জানালার পাশে বসে সে কেবল ডায়েরির পাতাগুলো উল্টে যায়, নাম, শব্দ, কণ্ঠস্বর লিখে চলে যতটা মনে আছে। প্রতিটি শব্দের পাশে সে একেকটি ছোট গল্প জুড়ে দেয় — যেভাবে অমৃতা বলেছিল। প্রথম দিন লেখে সে এক শিশুর কথা — যে তার বাবার হাত ধরে শহরের শেষ দিন পর্যন্ত বাঁচার চেষ্টা করেছিল। দ্বিতীয় দিন এক মহিলার — যিনি রান্নাঘরের মাটিতে পড়ে গিয়েও শেষ নিঃশ্বাসে বলেছিলেন, “আমার মেয়েকে যেন কেউ বাঁচায়”। দিনে দিনে তার ঘরজুড়ে শব্দ আর কান্নার স্তূপ জমে ওঠে। কিন্তু আশ্চর্যভাবে এই ব্যথা তার কাছে ভারী হয়ে ওঠে না — বরং মনে হয়, সে যেন অনেক বছর পরে ঠিক জায়গায় পৌঁছেছে, এমন এক জায়গায় যেখানে কান্নারও ঠিকানা আছে।

তার লেখাগুলো একসময় একত্রিত হয়ে একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করে — “ঘুমন্ত শহরের কান্না: বোধানগরের অশ্রুসমগ্র”। সে পাঠায় কয়েকটি প্রকাশনা সংস্থায়, কিন্তু প্রথমে কেউ নিতে চায় না। এক সম্পাদক সোজা বলেই দেয়, “ভূতের গল্প ইতিহাস হয় না।” কিন্তু এক তরুণী প্রকাশক, যিনি নিজেই ইতিহাসে পড়েছেন, বলেন, “আপনার লেখায় যা আছে, তা ইতিহাস নয়, তার অন্তর্গত জীবন। আমি প্রকাশ করব।” বই বেরোয়। পাঠক প্রথমে কৌতূহল নিয়ে পড়ে, পরে বিস্ময়ে, শেষে চোখের জল ফেলে। সবাই অবাক হয় — এই শহরের নাম তো কোথাও লেখা ছিল না! সরকারি নথিতে তো এ ধরনের কোনো রোগ বা ঘটনা নেই! শৌনক কোনো উত্তর দেয় না। সে শুধু বলে, “সব ইতিহাস কাগজে লেখা থাকে না, কিছু লেখা থাকে বাতাসে। আমি শুধু শুনেছি।” বইটির একপৃষ্ঠায় সে শুধু একটি নাম লিখে রেখেছিল — “অমৃতা”। তার নিচে লিখেছিল — “তুমি যদি না বলতেই, আমি কখনো জানতে পারতাম না।”

-শেষ-

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *