Bangla - অনুপ্রেরণামূলক গল্প - ছোটদের গল্প - সামাজিক গল্প

ঘুড়ির লেজ

Spread the love

ঋতাংশু পাল


অধ্যায় ১: লাল-নীল ঘুড়ির ছেলে

ঘটনাটা শুরু হয়েছিল এক মেঘলা বিকেলে, যখন হাওয়ায় অদ্ভুত একটা টান ছিল আর বাঁশবনের পাশ দিয়ে উড়ছিল এক রঙিন ঘুড়ি—লাল-নীল ডানা ছড়িয়ে আকাশে জ্যান্ত পাখির মতো ছুটে বেড়াচ্ছিল। পুরো গ্রামে তখন মাঠ ঘাট ফাঁকা, শুধু একটা ছেলেকে দেখা গেল দূর থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে ঘুড়ির সুতোর টান ঠিক করছে, হাতের কব্জি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাতাসের গতিকে অনুভব করছে। ছেলেটির নাম রঞ্জন—বয়স তেরো, চেহারায় অস্থিরতা আর চোখে অব্যক্ত এক আলো। সে এক সময় গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ত, কিন্তু ক্লাস ফোরের পর আর পড়া হয়নি। গাঁয়ের লোকেরা বলে, “বই ধরলে ঘুম আসে, আর ঘুড়ি দেখলে চোখ জ্বলে ওঠে—এই ছেলেটা কিচ্ছু হবে না।” কিন্তু সেই যে বলে, কেউ কেউ শোনে না কারো কথা, শুধু নিজের ডানার আওয়াজে উড়ে বেড়ায়—রঞ্জন তেমনই এক ছেলে। তার জন্য স্কুল একটা বন্দিশালার মতো ছিল, যেখানে প্রশ্ন করা মানা, কল্পনা করা পাপ। তাই সে পালিয়ে এসেছে—বাঁশবনের পাশেই তার জগৎ, যেখানে সে নিজেই শিক্ষক, নিজেই ছাত্র।

রঞ্জনের ঘুড়িগুলো আলাদা। শুধু কাগজ আর বাঁশ নয়, ওদের শরীরে থাকে একরকম ছন্দ, রঙের কৌশল আর লেজের এমন ভারসাম্য, যেটা তাকে কেউ শেখায়নি। সে কখনও গাছের পাতায় ঘর্ষণ করে রং তৈরি করে, কখনও পুরোনো পলিথিন কাটাকুটি করে ঘুড়ির গায়ে টানে। তার বানানো ঘুড়িগুলোর মধ্যে একটা বিশেষত্ব থাকে—ওরা সহজে ছিঁড়ে না, হাওয়ায় দুলতে দুলতে যেন কিছু বলতে চায়। গাঁয়ের ছেলেরা অনেকেই রঞ্জনের কাছে ঘুড়ি কিনতে আসে, কেউ বিনিময়ে কলা দেয়, কেউ কয়েন, কেউ শুধু একটা “দোস্ত” বলেই চলে যায়। তবে এইসবের জন্য রঞ্জনের বাবা হেমন্তর চোখে সে হয়ে গেছে অলস, অকর্মণ্য। “বাকি ভাইয়েরা বই নিয়ে বসে, আর তুই এই পাগলামি করে বেড়াস!”—এ কথা সে প্রতিদিনই শুনে। কিন্তু রঞ্জনের চোখে এই ঘুড়ি ওড়ানোই যেন আসল পড়াশোনা, প্রতিদিন সে শিখে—বাতাস কেমন হলে কোন কৌণে ঘুড়ি ওড়াতে হয়, কোন রঙে আলো বেশি পড়ে, কোন কাগজে কম ওজন পড়ে। শুধু কেউ তাকে বোঝে না, কারণ সে বইয়ের পাতায় এসব লেখেনি—আকাশের পাতায় লিখে গেছে।

সেই দিনটাতেও রঞ্জন এক নতুন লেজ নিয়ে পরীক্ষা করছিল। সে একটা পুরোনো মাছ ধরা জালের সুতো দিয়ে ঘুড়ির লেজ বানিয়েছিল, যাতে হাওয়ার সঙ্গে কম ঘর্ষণ হয়। তখনই পাশের আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন বৃদ্ধ—দেহে ধুতি-পাঞ্জাবি, হাতে একটা লাঠি, চোখে চশমা। তিনি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলেন ছেলেটার কায়দা, সুতোর টান, কানের দিকে হাওয়ার দিক নির্ণয়—এ যেন কোনও সাধারণ খেলা নয়, একটা বিশ্লেষণ, একটা নিজস্ব পদ্ধতি। বৃদ্ধটি ছিলেন অভয় বাবু—অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞান শিক্ষক, সদ্য শহর থেকে ফিরে এসেছেন গ্রামে, বয়সের ভারে ক্লান্ত হলেও চোখে এখনও কৌতূহলের দীপ্তি। তিনি কাছে এসে শুধালেন, “এই লেজটা এমন করলি কেন রে?” রঞ্জন একটু ইতস্তত করল, বলল, “হাওয়ায় ঝাঁকুনি কম লাগে, তাই।” সেই উত্তরে অভয় বাবুর চোখে এক ঝলক চমক খেল—এই ছেলেটা জানে, বোঝে, শুধু তার ভাষা আলাদা। সেদিন বিকেলে, প্রথমবার, কেউ রঞ্জনের ঘুড়িকে খেলনা না ভেবে সম্ভাবনার প্রতীক হিসেবে দেখল। ঘুড়ির লেজ তখন নিছক দড়ি ছিল না—তা হয়ে উঠল একটা গল্পের সূচনা।

অধ্যায় ২: অবসরের শিক্ষক, নতুন ক্লাস

পরদিন সকালবেলায় অভয় বাবু আবার এলেন বাঁশবনের পথ ধরে। মাথার ওপর টলটলে রোদ, গায়ে ঝরনা ধোয়া ধুতি-পাঞ্জাবি, কিন্তু চোখে সেই একই কৌতূহল। পাশে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এগিয়ে এলেন রঞ্জনের দিকে। তখন রঞ্জন তার পুরোনো ঘুড়িটাকে সারাতে ব্যস্ত—একটা পাখির পালক কেটে লেজে বাঁধছিল। অভয় বাবু দাঁড়িয়ে থেকে বললেন, “বেশ তুই তো তোকে একাই একটা গবেষণা কেন্দ্র বানিয়ে নিয়েছিস!” রঞ্জন অবাক হয়ে তাকাল, মুচকি হেসে কিছু বলল না। অভয় বাবু তখন গামছা পেতে বসে পড়লেন তার পাশে। বললেন, “তুই জানিস তো, বাতাস চললে তার চারপাশে চাপ কেমন হয়? আর ঘুড়িটা ওপরে ওঠে কীভাবে?” রঞ্জন একটু চুপ করে বলল, “জানি না ঠিক, তবে হাওয়ার মুখে যদি পিঠ দেয় ঘুড়ি, আর টান ঠিক রাখিস, তাহলে সে হাওয়ায় ভাসে, অনেক ওপরে।” অভয় বাবু হাসলেন। তিনি বুঝলেন, বই না পড়লেও ছেলেটার মধ্যে যুক্তির বোধ আছে—এই সেই যুক্তি, যা বহু ছাত্র বই পড়ে মুছে ফেলে দেয়। অভয় বাবু তখন নিজের পকেট থেকে একটা ছোট কাগজের ঘুড়ি বার করলেন, যাতে নীচে আঁকা ছিল চারটা বক্ররেখা আর হালকা কিছু চিহ্ন। তিনি বললেন, “এই রকম করে যদি লেজ বেঁধিস, তাহলে ঘুড়িটা বারে বারে বাঁক খায় না—তুই কি ট্রাই করেছিস?” রঞ্জন প্রথমে কিছু বলল না, তারপর মুখ তুলে বলল, “না, তবে মাথায় এসেছিল এমন কিছু… কিন্তু করিনি।” অভয় বাবু তখন বললেন, “এসেছিল মানে? ওই যে, এটাই তো বিজ্ঞান। যা কেউ তোকে শেখায়নি, সেটা তুই নিজের মতো করে ভাবছিস।”

সেই বিকেল থেকে প্রতিদিন শুরু হল এক নতুন সম্পর্ক—এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আর এক স্কুল-ছাড়া ছেলের মধ্যে। অভয় বাবু রোজ এসে বসেন বাঁশবনের ধারে, সঙ্গে নিয়ে আসেন কাগজ, রঙ, বর্ণচিত্র, কিছু ছোটখাটো বৈজ্ঞানিক খেলনা—কখনও বাতাস পরিমাপক যন্ত্র, কখনও চৌম্বকবলয়, কখনও একটুখানি আয়না। রঞ্জনের মনে হয় যেন কেউ তার মনের ভেতরকার খালি পাতা গুলোতে রঙ মাখিয়ে দিচ্ছে। সে নতুন করে ভাবে—ঘুড়ির রঙ কেন আলোয় ফিকে হয়, কেন পুরোনো ঘুড়ি হঠাৎ করে ডানায় ঝাঁকুনি দেয়, কেন একটা ঘুড়ি যত ওপরে ওঠে তত বেশি চাপ লাগে সুতোর ওপর। বই ছুঁয়ে না দেখেও সে যেন পড়ে ফেলে অব্যক্ত সব সূত্র। অভয় বাবু তার কথায় কথায় বলে ওঠেন, “পাঠশালা মানে চারটা দেওয়াল না, পাঠশালা মানে যে কোথাও শেখা চলে।” রঞ্জন প্রথমে কেমন সংকুচিত থাকত, কিন্তু ধীরে ধীরে তার মুখে গল্প ফিরে আসে। একদিন সে নিজের ঘুড়িকে ‘মেঘযাত্রী’ বলে ডাকে, আর বলেই হাসে, “ও আকাশের গল্প শুনে ফেরে।” অভয় বাবু তখন গম্ভীর হয়ে বলেন, “তুই তো কবিও, রঞ্জন—যার ঘুড়ি দিয়ে ভাবনা ওড়ে।”

এদিকে গাঁয়ে গুজব শুরু হয়। হাটে, চায়ের দোকানে, দোচালা ছায়ায় লোকজন বলে, “অবয় বাবু বুঝি ঘুড়ি বানানো শেখাচ্ছেন রোজ? নাকি পাগলামি ধরেছে?” কেউ কেউ হাসে, কেউ বলে, “অর্থ নেই এসবের।” কিন্তু তারা জানে না, বাঁশবনের পাশের সেই ছোট্ট চৌচালা জগতে তখন প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে এক অলিখিত পাঠশালা, যেখানে কল্পনা, বিশ্লেষণ আর হাতের কাজ একসাথে মিশে নতুন এক শিক্ষার বীজ বুনছে। অভয় বাবুর চোখে এই বালক শুধু এক ঘুড়ির ছেলে নয়, সে এক ভবিষ্যতের শিক্ষক, যে শেখার ভাষা জানে, শুধু জানে না—সে জানে। আর রঞ্জন? সে হয়তো প্রথমবার কারও চোখে নিজেকে “অপদার্থ” ছাড়া কিছু একটা হিসেবে দেখে। সেই সন্ধ্যায় যখন ঘুড়ির লেজে সে একটা নতুন চিহ্ন আঁকে, তার মন বলে—এই লেজ শুধু ঘুড়ি সামলায় না, সে টেনে নিয়ে যায় মানুষকে তার দিশার দিকে।

অধ্যায় ৩: এক শিক্ষকের দ্বিতীয় পাঠশালা

বাঁশবনের ধারের সেই অনিয়মিত ক্লাসের দিনগুলো ধীরে ধীরে নিয়ম খুঁজে নিতে লাগল। অভয় বাবু ঠিক করে ফেললেন—সপ্তাহে তিনদিন, দুপুরের রোদ খানিকটা নরম হলে, তিনি রঞ্জনের জন্য নিয়ে আসবেন একেকটা নতুন জিনিস। কখনও বাতাস মাপার জন্য চটের ফানেল, কখনও আলোর প্রতিফলন বোঝাতে ছোট আয়না, কখনও রঙ চেনাতে তেলের শিশি, যার মধ্যে জল ফেলে দেখালে রঙ বদলায়। রঞ্জনের চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে যায়, সে তাকিয়ে থাকে ঠিক যেন সেই আয়নার মধ্যেই তার নতুন পৃথিবী ফুটে উঠছে। অভয় বাবুর হাত ধরে সে বুঝতে শেখে—ঘুড়ি শুধু খেলনা নয়, ঘুড়ি হলো একটা চলন্ত ল্যাবরেটরি। তার সুতোর টান বোঝায় টেনশন, লেজ বোঝায় ভারসাম্য, ডানার কোণ বলে দেয় বাতাসের চাপে ঘর্ষণ কেমন কাজ করছে। অভয় বাবু কোনোদিন তাকে “পড়তে বলো” বলেন না। তিনি বলেন, “তুই যা দেখিস, তা আঁক। যা অনুভব করিস, তা বল। জোর করে মুখস্থ করবি না, জেনে রাখবি।” রঞ্জনের কাছে এটা স্বপ্নের মতো—এমন শিক্ষক তো শুধু গল্পে থাকে! ক্লাস ফোরে থাকতে সে যে শিক্ষকের কাছে শুধু শাস্তি পেয়েছিল, তিনি তো তার কান মলে বলেছিলেন, “তোর মাথায় কিছু ঢোকে না, ঘুড়ির মাথা হয়েছে!” সেই একই ঘুড়িই এখন তার শিক্ষার মাধ্যম হয়ে উঠছে।

একদিন অভয় বাবু নিয়ে এলেন একটা নকশা করা খাতা। তার পাতাগুলোতে আঁকা ছিল আকাশের মানচিত্র, বাতাসের চক্র, ঘুড়ির বিভিন্ন মডেল, আর প্রতিটি পাতার নীচে লেখা ছিল ছোট ছোট প্রশ্ন—“তোর ঘুড়ির লেজে যদি তিনটা পালক লাগাস, ওড়ার ভঙ্গিতে কী বদল আসে?”, “একটা কালো ঘুড়ি আর একটা হলুদ ঘুড়ি—কে বেশি আলো প্রতিফলিত করে?”, “উচ্চতায় উঠলে হাওয়া ঠাণ্ডা লাগে কেন?” রঞ্জন প্রথমে এসব দেখে অবাক হয়ে গেছিল, পরে মনে হল—এসব প্রশ্ন তো তার মনের মধ্যেই ঘুরত সবসময়, শুধু কেউ কখনও সেগুলো লিখে দেয়নি। সে এবার খাতার পাতায় শুধু উত্তর লেখে না, সে ঘুড়ির নকশা আঁকে, তার নিজের চিন্তাগুলো রেখাচিত্রে ফুটিয়ে তোলে। অভয় বাবু তাকে একদিন বলেন, “তুই জানিস তো, যে ছেলে কল্পনা করতে পারে, তার জ্ঞান একটা নদীর মতো বয়ে চলে। তুই তো সেই নদীর ঢেউ। আমি শুধু তোর গতিপথ একটু পরিষ্কার করে দিচ্ছি।” সেই কথায় রঞ্জনের চোখ জলে ভরে যায়, কারণ প্রথমবার কেউ তাকে এত গুরুত্ব দিয়ে কিছু বলেছে।

তবে সবই যে সহজ ছিল, এমন নয়। গাঁয়ের মানুষ অভয় বাবুর এই ‘ঘুড়ি-বিদ্যালয়’ দেখে হাসাহাসি করতে থাকে। কেউ বলে, “পাগলা বুড়ো এক খ্যাপা ছেলের পেছনে সময় নষ্ট করছে।” কেউ বলে, “কাগজ-সুতো দিয়ে আর কতদূর যাবে?” এমনকি রঞ্জনের বাবাও একদিন ক্ষিপ্ত হয়ে অভয় বাবুর বাড়িতে গিয়ে বলে বসেন, “স্যার, ছেলেটা স্কুলে যায় না, পড়াশোনা তো শেখান না, ঘুড়ি নিয়ে খেলাই শেখান! ওর ভবিষ্যৎটা আপনি বুঝছেন তো?” অভয় বাবু চুপ করে শোনেন, তারপর ধীরে ধীরে বলেন, “আপনার ছেলে প্রশ্ন করতে পারে, যুক্তি দিয়ে ভাবতে পারে, নিজের তৈরি কিছুতে আনন্দ পায়। এটা যদি শিক্ষা না হয়, তবে আর কিছুই নয়।” হেমন্ত কাঁধ ঝাঁকায়, কিন্তু সেদিন রাতে সে দেখতে পায় তার ছেলে মাটিতে বসে ঘুড়ির পেট কেটে তাতে হালকা বাঁশের পাতলা ফ্রেম বসাচ্ছে, যাতে ঘুড়ি বাতাসে ভেসে বেশি সময় থাকে। ছেলের চোখে তখন এমন মনোযোগ, যেন সে কোনো মহাকাশযান তৈরি করছে। হেমন্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সে তখনও বুঝতে পারেনি তার ছেলের হাতেই গাঁয়ের একটা অন্যরকম শিক্ষার আলো ফুটছে। আর সেই আলোই ভবিষ্যতে তাদের গ্রামের আকাশে ঘুড়ির লেজের মতো জ্বলজ্বল করে দেবে।

অধ্যায় ৪: বোনের বই, ভাইয়ের খাতা

রঞ্জনের ঘুড়িগুলো শুধু আকাশে ওড়েনি, ওড়াতে শুরু করেছিল ঘরের ভেতরও। তার দিদি রিনা একদিন ঘরের কোণ থেকে দেখেছিল কীভাবে তার ভাইটা মাটি ছুঁয়ে বসে একটা পুরোনো ড্রয়িং খাতা খুলে ঘুড়ির গায়ে রং করছে। সে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করে, রঞ্জনের ঘুড়ির রঙের মানচিত্র যেন চোখের ভাষায় কথা বলে—লালের সঙ্গে সাদার যোগে তৈরি হয় বিদ্রোহ, হলুদের গায়ে নীল মানে প্রশান্তি। রিনা নিজে দশম শ্রেণির ছাত্রী, সে বুঝে গেছে—তার ভাইয়ের শেখা পড়ার পাতার বাইরে, কিন্তু তার গভীরতা কম কিছু নয়। একদিন সে নিজের গোপনে রাখা বিজ্ঞান বইটা এনে রঞ্জনের পাশে রেখে দিল। বলল, “তুই না চাইলে পড়িস না, কিন্তু মাঝে মাঝে এক-আধটু দেখে নিস।” রঞ্জন প্রথমে বইটা ছুঁয়ে ভয় পেয়েছিল, তার ভেতরে ছবির পাশে লেখা কঠিন শব্দগুলোর কাছে যেন সে অনেক দূরের কেউ। কিন্তু তারপরে সে লক্ষ্য করে—এই তো, এখানে লেখা আছে সেই বাতাসের চাপের কথা, সেই আলো প্রতিফলনের দিক, যা সে এতদিন নিজে অনুভব করে এসেছে। এবার বইয়ের পাতাগুলো তার কাছে নতুন কিছু নয়, বরং পুরোনো জিনিসের ব্যাখ্যা মাত্র। রিনা তখন তাকে ছোট ছোট দাগ কেটে পড়ে দেখায়—এই দেখ, “রিফ্লেকশন মানেই প্রতিফলন”—তুই যে ঘুড়ির সাদা অংশে আলো বেশি পড়ে দেখেছিলি, সেটাই এখানে লেখা। রঞ্জনের মুখে তখন এক আশ্চর্য হাসি—এতদিন যেটা সে অনুভব করত, তার একটা ‘নাম’ আছে!

দু’ভাইবোন তখন প্রতিদিন সন্ধেবেলা একটা বিশেষ খাতা বানাতে শুরু করে—নাম রাখে “ঘুড়ির খাতা”। এই খাতায় শুধু ঘুড়ির নকশা থাকে না, থাকে প্রতিটি ঘুড়ির আকাশে ওঠার ইতিহাস, বাতাসের আচরণ, সুতোর জ্যামিতি আর রঙের তত্ত্ব। রিনা বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে ছোট ছোট বাক্যে লেখে, আর রঞ্জন তার ঘুড়িগুলোর ছবি আঁকে, লেজের পাশে তার অনুভবের ভাষায় লিখে—“আজকের বাতাস উত্তরের দিকে ছিল, আমার ঘুড়ি বারবার ডানদিকে বাঁক খাচ্ছিল, লেজ ভারী ছিল।” অভয় বাবু একদিন এই খাতা দেখে চুপ করে বসে থাকেন অনেকক্ষণ, তারপর বলেন, “তোমরা তো একটা নতুন ভাষা বানিয়ে ফেলেছো—যেখানে বিজ্ঞান, শিল্প আর মন মিলেমিশে আছে।” তিনি বলেন, “এই খাতা একদিন শুধু তোমাদের থাকবে না, আরও অনেকের কাজে লাগবে।” সেই কথা শুনে রঞ্জনের চোখের কোণে কেমন যেন কিছু টলমল করে ওঠে, আর রিনা গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বলে, “আমরা চাই না কেউ বলুক যে ভাইটা ‘অপদার্থ’—ওর ভাষাটা শুধু আলাদা।”

তবে সেই খাতার পথ মসৃণ ছিল না। একদিন স্কুলের এক শিক্ষক রিনাকে ডেকে বলেন, “তোমার ভাই তো পড়াশোনা ছেড়েই দিয়েছে, তুমি কাকে প্রমাণ করতে চাইছো? যে ঘুড়ি বানায়, সে কি পরীক্ষায় নম্বর পাবে?” রিনা তখন শান্ত গলায় বলেন, “যে ভাবতে পারে, সে একদিন সবার চেয়ে বেশি শিখে নেয়—আমার ভাই সেটা পারে।” বাড়ি ফিরে সে দেখে রঞ্জন দড়ির গিঁট নিয়ে পরীক্ষা করছে—ঘুড়ির লেজে নতুন ধাঁচ আনছে, যাতে বাতাসে বেশি ভারসাম্য থাকে। রিনা খাতার একটা পাতা খুলে দেয় তার সামনে, আর বলে, “লিখে রাখ, আজ কী কী দেখলি—কিন্তু এবার একটু ভালো করে বানান শিখে নিস।” দুজনে হেসে ওঠে, তাদের সেই খোলা হাওয়ার শিক্ষায় এখন নতুন দিগন্ত। ঘরের এক কোণে বসে লেখা সেই খাতার পাতায় যেন শব্দেরা শুধু পৃষ্ঠা পূরণ করে না, তারা ঘুড়ির মতোই, ওড়ে—চুপিসারে, আত্মবিশ্বাস নিয়ে, ছাদের ওপরে, সমাজের জেদের গণ্ডি ভেঙে।

অধ্যায় ৫: লড়াইয়ের রঙ

আকাশে যখন মেঘ জমে, তখন যেমন হাওয়া দিক বদলায়—তেমনই এক পরিবর্তনের ঝোড়ো সময় এল রঞ্জনের জীবনে, আর সেই হাওয়ার কেন্দ্রে ছিলেন তার বাবা হেমন্ত। মাঠের কাজ ফেলে একদিন তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দাঁড়ালেন অভয় বাবুর দাওয়ায়, চোখে রাগ, গলায় ক্লান্তি, আর মনে একরাশ অভিমান। বললেন, “স্যার, আপনি বুঝতেই পারছেন না! ছেলেটা তো পাগল হয়ে গেল। ঘুড়ি-ঘুড়ি করে ঘরছাড়া হয়েছে। আমার সংসারে পাঁচজন খেতে বসে, আর ও বই না পড়েই দিনভর আপনার সঙ্গে খাতা আর কাগজে রং মাখায়! আপনি কি তাকে স্কুলে ফেরাতে পারবেন? চাকরি দিতে পারবেন? ভবিষ্যৎ গড়তে পারবেন?” অভয় বাবু চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আস্তে করে বললেন, “আপনার ছেলে এমন কিছু জানে, যা স্কুলেও শেখানো হয় না। সে প্রশ্ন করতে পারে, যুক্তি দিতে পারে, আর সবচেয়ে বড় কথা—সে তার কাজে আনন্দ খুঁজে পায়। আপনার ছেলে অলস নয়, সে তো একেবারে আলাদা ঘরানার শিশু। ওর মনের ভেতর যে আগুনটা জ্বলছে, তা যদি নিভিয়ে দেন, তাহলে শুধু ছেলেটার নয়—আপনার গোটা গ্রামেরই ক্ষতি হবে।”

হেমন্ত কিছুক্ষণ নীরব থাকেন। অভয় বাবু তাকে নিয়ে যান রঞ্জনের খুপরি ঘরের কোণটায়, যেখানে একটা দেয়ালে টানানো ঘুড়ির নিচে লেখা: “আমার ঘুড়ির পাখা হাওয়া বোঝে, আমি শুধু দিশা দিই।” পাশে রঙিন কাগজের ঘুড়ির নকশা, পাশে রিনার হাতের লেখা, খাতায় ধারাবাহিকভাবে লেখা রঞ্জনের পর্যবেক্ষণ: “আজ দক্ষিণ-পূর্ব দিকের বাতাসে ভার ছিল, লেজের পালক দুটো সরিয়ে দিলাম, ভারসাম্য ঠিক হল।” হেমন্ত সেই খাতা উল্টে-পাল্টে দেখতে থাকেন। তার চোখে ভেসে ওঠে নিজের ছোটবেলার ছবি—মাঠে নেমে বীজ ছড়িয়ে দিচ্ছেন বাবা, হাওয়া বেয়ে বৃষ্টি নামছে, কিন্তু তারা কখনও ভাবেনি যে হাওয়ার একটা যুক্তি আছে, একটা ছন্দ আছে। সেই ছন্দকে যদি কেউ ঘুড়ির পাখায় ধরে ফেলতে পারে, তবে সে কি শুধুই “খেলছে”? হেমন্তের কঠিন মুখ আস্তে আস্তে নরম হয়, গলার স্বর নিচু হয়ে যায়। তিনি বলেন, “আমরা গরিব মানুষ, স্যার। স্বপ্ন দেখতে শিখিনি। শুধু ভেবেছি, ছেলেটা যেন অন্যদের মতো হয়, কষ্ট না পায়।” অভয় বাবু তখন হাত রাখেন তার কাঁধে, বলেন, “ওকে অন্যদের মতো না বানান। ও নিজেই একটা দৃষ্টান্ত হোক।”

তবে গ্রামে পরিবর্তন সহজে আসে না। মানুষ হঠাৎ ভিন্ন কিছু দেখলে হেসে উড়িয়ে দেয়। রঞ্জনের ঘুড়ি নিয়ে গ্রামের ছেলেরা আগেও হেসেছে, এবার কয়েকজন মিলে তার বানানো ঘুড়ি ছিঁড়ে ফেলে, বলে, “ঘুড়ি দিয়ে চাকরি হয় নাকি?” রঞ্জন সে রাতে দাওয়ায় চুপ করে বসে থাকে। রিনা পাশে বসে তার ঘাড়ে হাত রাখে, বলে, “তুই তাদের জন্য করছিস না, তুই নিজের জন্য করিস। তোকে কেউ না মানলেও, তোর ঘুড়ি আকাশ মানে।” অভয় বাবুও বলেন, “বড় হতে গেলে একসময় সবাইকে পাশ কাটাতে হয়, তবেই নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায়।” সেদিন রাতেই রঞ্জন নতুন ঘুড়ির নকশা আঁকে—লেজটা এবার ভিন্নভাবে বাঁধা, আর মাঝখানে সে লেখে বড় করে—”শেখা মানেই পালটা হাওয়া, কিন্তু ওড়াটাই আসল”। সেই ঘুড়ির পাখা শুধু হাওয়ার বিরুদ্ধে নয়, গোটা সমাজের চোখে চোখ রেখে ওড়ার প্রতীক হয়ে ওঠে। সেই রাত থেকেই শুরু হয় রঞ্জনের দ্বিতীয় লড়াই—এইবার শুধু নিজের জন্য নয়, যারা পড়াশোনার বাইরে থেকেও কিছু জানে, বোঝে, তাদের জায়গা করে দেওয়ার জন্য। ঘুড়ির লেজে তখন শুধু কাগজের পালক বাঁধা ছিল না, বাঁধা ছিল এক বিস্মৃত গ্রামের স্বপ্ন।

অধ্যায় ৬: মেলার দিন, আকাশে শিক্ষা

বছরের সেই প্রতীক্ষিত দিনটি এসে গেল—পূর্বপাড়ার বার্ষিক হাট-মেলা, যেখানে সারা গ্রামের মানুষ ভিড় করে খুশির রঙে রাঙাতে নিজেদের মন। প্রতিবারের মতো এবারও কাঁসার থালা, মাটির পুতুল, জিলিপি, নাগরদোলা আর মাদুরের দোকানে ভিড়, কিন্তু এবার এক নতুন চমক রেখেছিলেন অভয় বাবু—একটা ছোট্ট প্যান্ডেল, যার মাথায় লেখা ছিল, “ঘুড়ি আর বিজ্ঞান: আকাশের পাঠশালা”। অনেকেই প্রথমে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসল—বিজ্ঞান আবার ঘুড়ির সঙ্গে কীভাবে জুড়লো! প্যান্ডেলের ভেতরে ছিল রঞ্জনের তৈরি বিভিন্ন ঘুড়ির প্রদর্শনী—সব ঘুড়ির পাশে ছিল ছোট ছোট বোর্ডে লেখা তথ্য: “এই ঘুড়িতে লেজের দৈর্ঘ্য ১.২ মিটার, ভারসাম্য ৩ পয়েন্টে বিভক্ত”, “এই ঘুড়ির পেটের বাঁশটি খেজুরপাতার পাতলা ফ্রেম, যা হাওয়ার চাপ সহজে সহ্য করে।” অভয় বাবু পাশে দাঁড়িয়ে একের পর এক দর্শককে বলছিলেন, “এই ছেলেটা স্কুলের বই পড়েনি, কিন্তু তার প্রতিটি কাজই বিজ্ঞানের ভাষায় ব্যাখ্যা করা যায়।”

রঞ্জন, তখন গা-হাত মুছে একটু চকচকে জামা পরে দাঁড়িয়ে ছিল প্যান্ডেলের ভেতরে। তার সামনে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দাঁড়িয়ে ঘুড়ির লেজ নাড়ছিল, কেউ কেউ জিজ্ঞেস করছিল, “ভাইয়া, লেজ ছোট করলে কী হয়?”, “ঘুড়ির নাক উঁচু হলে কী সমস্যা হয়?” রঞ্জন সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল হাসিমুখে, তার চোখে ছিল একরকম উচ্ছ্বাস আর ভয় মেশানো আত্মবিশ্বাস। একসময় স্কুলের হেডমাস্টারও এলেন প্যান্ডেলে, তাকিয়ে বললেন, “এই ছেলেটা তো তোদের স্কুল ছাড়ার পর একবারও ক্লাসে আসেনি, আর এখন বিজ্ঞান শেখাচ্ছে?” অভয় বাবু হেসে বললেন, “স্যার, ওর ক্লাস ছিল এই মাটিতে, এই হাওয়ায়। আজ আপনি যদি চোখ মেলে দেখেন, বুঝবেন, শিক্ষা কত রকম হতে পারে।” স্কুলের স্যার আর কিছু না বলে প্যান্ডেলের একপাশে রাখা সেই “ঘুড়ির খাতা” উল্টে দেখতে লাগলেন, যেখানে রিনার লেখায় স্পষ্ট ছিল—একটা ঘুড়ির প্রতিটি ছোট কাজ কীভাবে একটা তত্ত্বে পরিণত হতে পারে। খাতার পাশে দাঁড়িয়ে একজন মা বলছিলেন, “আমার ছেলে তো সারাদিন ঘুড়ি ওড়ায়, ভাবতাম ওর কোনও ভবিষ্যৎ নেই। এখন বুঝছি, হয়তো ভুল ভেবেছিলাম।”

মেলায় সেই ঘুড়ির প্যান্ডেল রাত নামার পরেও আলোয় জ্বলজ্বল করছিল। চারপাশের রঙিন বাতির মাঝখানে একটার পর একটা ঘুড়ি উপরে উঠছিল অভয় বাবুর ইশারায়, আর রঞ্জনের নির্দেশে—“এইটা একটু বাঁদিকে ছাড়ো, হাওয়ার দিক বদলেছে।” শিশু থেকে বৃদ্ধ, সবাই চেয়ে চেয়ে দেখছিল, কীভাবে একটা ‘অপদার্থ’ ছেলেও হয়ে উঠতে পারে দিকনির্দেশক, যদি তাকে কেউ ঠিকভাবে দেখে। রিনা মাটির পাশে বসে ছিল, তার চোখে জল টলমল করছিল গর্বে। হেমন্ত দূরে দাঁড়িয়ে ছিল ভিড়ের মধ্যে, চুপচাপ, তার চোখ তখন ছেলের দিকে নয়, সেই উড়ন্ত ঘুড়ির দিকে—যেটা শুধু তার ছেলে নয়, একদিন তার পরিবারের ভবিষ্যৎও টেনে নিয়ে যেতে পারবে এমন আকাশে, যার খোঁজ সে আগে কখনও করেনি। সেই রাতে, গ্রামে আলো নিভে যাওয়ার পরও, ঘুড়ির লেজ যেন বাতাসে বলে যাচ্ছিল—এই আকাশে শুধু যারা প্রশ্ন করতে জানে, তারাই ওড়ার সাহস রাখে।

অধ্যায় ৭: স্কুলের নতুন জানালা

মেলার সেই দিনটি যেন গ্রামের আকাশে শুধু ঘুড়ি নয়, একটা ধারণাকেও ভাসিয়ে দিয়েছিল—যে শিক্ষা কেবল শ্রেণিকক্ষে নয়, সে জন্ম নিতে পারে মাঠে, মাটিতে, আর একজন ঘুড়ির ছেলের হাতে। তারই রেশ কাটতে না কাটতেই সরকারি নিয়োগে এলেন নতুন প্রধান শিক্ষক, তরুণ, সাহসী ও ভিন্নধর্মী চিন্তার মানুষ—সঞ্জয় দে। তিনি শুনেছিলেন রঞ্জনের কথা, মেলায় ঘুড়ির প্রদর্শনীতে অভয় বাবুর উদ্ভাবনী ক্লাসের গল্প, আর গ্রামের শিশুদের উচ্ছ্বাস। তিনি স্কুলে যোগদানের পর প্রথম দিনেই বললেন, “শিক্ষা মানে মুখস্থ নয়, শিক্ষা মানে বোঝা, অনুভব করা। আর সেটা যদি ঘুড়ির সুতোর মতো সূক্ষ্ম হয়ে থাকে, তবুও তাকে বোঝা উচিত।” তার উদ্যোগে বিদ্যালয়ে শুরু হল ‘খোলা পাঠ’—একটা প্রকল্প যেখানে সপ্তাহে একদিন ক্লাস হবে খোলা আকাশের নিচে, প্রকৃতির মাঝে। আর এই প্রকল্পে পরামর্শদাতা হিসেবে ডাক পড়ল অবসরপ্রাপ্ত অভয় বাবু এবং “সহায়” হিসেবে সেই রঞ্জনের। গ্রামের লোকজন প্রথমে শুনে বিস্ময়ে চুপ হয়ে গিয়েছিল—এক ছেলেটা যে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করেছিল, সে এখন ক্লাস করাবে?

রঞ্জনের প্রথম খোলা পাঠের দিন স্কুলের মাঠে জড়ো হয়েছিল পঞ্চম থেকে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রছাত্রী। অভয় বাবু বললেন, “আজ আমরা বুঝব কীভাবে হাওয়া কাজ করে, না বই খুলে, না সূত্র লিখে—শুধু দেখে, অনুভব করে।” রঞ্জন তখন তিনটা ঘুড়ি নিয়ে এল—তিন রঙের, তিন মডেলের, তিন রকম লেজসহ। একেকটা ঘুড়ি ওড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সে বুঝিয়ে বলল, কোনটায় হাওয়ার চাপ কেমন কাজ করে, কোনটায় ভারসাম্য কম, কোনটায় বেশি। ছাত্ররা মুগ্ধ হয়ে শুনল, শিক্ষকরা চুপ করে দাঁড়িয়ে ভাবলেন, ‘এই ছেলেটা যে এত সহজ করে বোঝাতে পারে!’ সঞ্জয় দে মাথা নাড়িয়ে বললেন, “এই তো আসল শিক্ষা, যেখানে বাচ্চারা শিখছে জিজ্ঞাসা করতে, খোঁজ নিতে।” স্কুলে এবার থেকে নিয়মিত চালু হল “ঘুড়ির ঘণ্টা”—যেখানে রঞ্জন ও অভয় বাবুর তত্ত্বাবধানে প্রকৃতির সঙ্গে জুড়ে ক্লাস হবে।

রিনাও এবার নিজের ভাইকে দেখে নতুন করে গর্ব অনুভব করতে লাগল। সে স্কুলে বন্ধুদের বলত, “ভাইটা এখন আর শুধু ঘুড়ি বানায় না, ঘুড়ির মাধ্যমে শিখায়।” একদিন রঞ্জনের সেই বিখ্যাত ‘ঘুড়ির খাতা’ স্কুলের বিজ্ঞান ঘরে রেখে দেওয়া হল, যেন অন্য ছাত্ররাও দেখে বুঝতে পারে—আবিষ্কার কেবল শহরের ল্যাবরেটরিতে হয় না, মাটির ওপর, হাওয়ার সুরে, হাতের ছোঁয়ায়ও নতুন জ্ঞান জন্ম নিতে পারে। হেমন্ত আবার স্কুলের মাঠে বসে ছিল সেই ক্লাসের দিন, ছেলেকে দূর থেকে দেখে তার চোখে অদ্ভুত শান্তি। আর অভয় বাবু, তার চোখে একরাশ সন্তুষ্টি নিয়ে বললেন, “আমরা তো শুধু জানালাটা খুলে দিয়েছিলাম, আলোটা এসে গেছে নিজেই।” সেই দিন আকাশে যেসব ঘুড়ি উঠেছিল, তাদের লেজে শুধু কাগজ আর দড়ি ছিল না—ছিল এক নতুন পাঠশালার স্বপ্ন, যা গ্রামের প্রতিটি শিশুর চোখে ওড়ার ইচ্ছে জাগিয়ে দিয়েছিল।

অধ্যায় ৮: ঘুড়ির লেজ, স্বপ্নের দিশা

রঞ্জনের জীবনটা যেন একটা ঘুড়ির মতোই ছিল—যার সূতো বারবার টান খেয়েছে, হাওয়ার বিপরীতে ছুটেছে, আবার ঠিক পথ পেয়ে আকাশ ছুঁয়ে গেছে। এখন সে আবার বই নিয়ে বসে, রিনার সাহায্যে নিজে নিজে অঙ্ক করে, প্রতিদিন একটুখানি করে ইংরেজি শেখে, আর সন্ধেয় স্কুলের নতুন “ঘুড়ির ঘণ্টা”-তে পড়াতে যায়। তার ঘুড়ির খাতা এখন পুরো গ্রামের ছেলেমেয়েদের কাছে এক জাদুকরী খাতা, যেখানে লেখা আছে কীভাবে মাটির ওপর দাঁড়িয়ে আকাশের নিয়ম বোঝা যায়। আর অভয় বাবু? তিনি যেন নতুন করে প্রাণ পেয়েছেন, গ্রামের এক কোণে শুরু হওয়া তার দ্বিতীয় পাঠশালা আজ সরকারি স্কুলের নিয়মিত পাঠ্যক্রমে জায়গা করে নিয়েছে। শিক্ষামহল পর্যন্ত খবর গেছে, এক স্কুল ড্রপআউট কিশোর কীভাবে পাঠ্যবই ছাড়াই বিজ্ঞান আর সৃজনশীলতা শিখতে পারে, আর অন্যদের শেখাতে পারে।

একদিন জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শকের গাড়ি এসে থামে স্কুলের উঠোনে। সঞ্জয় স্যার তাকে ঘুরিয়ে দেখান—ঘুড়ির প্রদর্শনী, খোলা পাঠের দিনপঞ্জি, রঞ্জনের নকশার খাতা আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, গ্রামের ছেলেমেয়েদের চোখে বদলে যাওয়া শেখার আনন্দ। সেই অফিসার চুপচাপ দেখে যান, তারপর বলেন, “এই ছেলেটার জন্যই পুরো গ্রামের শিক্ষায় একটা আলো এসেছে। ওর নাম নথিভুক্ত করে ফেলুন, বিশেষ উদ্ভাবনী শিক্ষার্থী হিসেবে।” রঞ্জন কিছু না বলেই মুচকি হাসে, তার হাতে তখন একটা নতুন ঘুড়ি—যার পেটে লেখা ‘ঘুড়ির লেজ হাওয়ায় ভাসে, স্বপ্ন খুঁজে নেয় দিশা।’ স্কুলে রিনার হাত ধরে সে ছুটে বেড়ায়, নতুন ছেলেমেয়েদের শেখায় ঘুড়ি ওড়ানো, বাতাস বোঝা, কাগজ কাটা, আর তার ফাঁকে ফাঁকে বলে—“ভয় পাবি না, কেউ বই মুখস্থ করতে না পারলে মানে এই নয় যে সে কিছু শিখতে পারবে না।”

গাঁয়ের মাঠে যখন রোদ পড়ে আসে, তখন প্রায়শ দেখা যায়, অভয় বাবু দাওয়ায় বসে আছেন, সামনে কুড়িয়ে পাওয়া পুরোনো খাতায় নতুন কিছু লিখছেন, আর ওপরে আকাশে ভাসছে রঞ্জনের ঘুড়ি—তাতে লেজ বাঁধা, রঙিন কাগজের, সেই পুরোনো সুতোয় নতুন আশা গাঁথা। হেমন্ত এখন আর চুপচাপ নয়, হাটে গিয়ে গর্বের সঙ্গে বলেন, “হ্যাঁ, ওই ঘুড়ি-ওড়ানো ছেলেটাই আমার ছেলে। বইয়ের ক্লাসে সে পিছিয়ে ছিল ঠিকই, কিন্তু আজ… আজ অনেকের সামনে ও এগিয়ে।” গ্রামের চায়ের দোকানে গল্প হয়—“ঘুড়ির লেজের মতো ছেলেটা ঘুরেই ঠিক নিজের আকাশ খুঁজে পেয়েছে।” আর সত্যিই, সেদিনের “অপদার্থ” রঞ্জন এখন আর শুধু একজন ঘুড়িওয়ালা ছেলে নয়—সে একজন পথ দেখানো স্বপ্নবাজ, যার হাতে বাঁধা লেজ বেয়ে বহু শিশুর চোখে ওড়ার সাহস গেঁথে গেছে।

ঘুড়ির লেজটা এখন আর শুধু ভারসাম্য রাখার উপায় নয়, তা হয়ে উঠেছে একটা প্রতীক—যেখানে শিক্ষা মানে কেবল পাঠ্যবই নয়, মানে একটা ভাবনার ডানা দেওয়া। অভয় বাবু একদিন বলেছিলেন, “শিক্ষা শুরু হয় প্রশ্ন দিয়ে, আর পূর্ণতা পায় কল্পনায়।” রঞ্জন সেই কল্পনাকে বাস্তবে টেনে এনেছে। শেষ দৃশ্যে, আমরা দেখি সন্ধ্যের আকাশে বহু ঘুড়ি উড়ছে—তাদের লেজ বাতাসে দুলছে, আর তার মধ্যে একটা ঘুড়ির পেটে বড় করে লেখা—”যারা নিচে নামতে ভয় পায়, তারা কখনও উঁচুতে উঠতে পারে না”। সেই ঘুড়ির নিচে দাঁড়িয়ে থাকে এক কিশোর, যার নাম রঞ্জন, আর যাকে দেখে এখন গোটা গ্রাম বলে—“ওই ঘুড়ির লেজই আমাদের ভবিষ্যতের দিশা।”

1000036406.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *