Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

ঘুঙুর

Spread the love

মহুয়া নাগ


এক

রাধিকা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পায়ের ঘুঙুরজোড়ায় আলতো করে আঙুল বোলায়। সে জানে এই ঘুঙুরগুলো কেবল একটি বাদ্যযন্ত্র নয়, এগুলো তার অস্তিত্বের প্রতিধ্বনি। ঘরে বাতাস চলাচল করে না, মশারির ফাঁকে ভোরের আলো ঢুকে চিবুকে ছুঁয়ে যাচ্ছে; তবু তার মন যেন কোথাও চলে গেছে—এক বিস্তৃত মঞ্চে, যেখানে কেবল সে আছে, তার নাচ আছে, আর আছে নিঃশব্দ দর্শক। বাইরে থেকে শোনা যায় তবলার ঠেক-ঠুক শব্দ—তার বাবা সুবীর সেনের রেওয়াজ চলছে, ভোর পাঁচটার ধারা বজায় রেখে। রাধিকা সেই তাল চেনে, সেই লয় তার ভেতরে প্রবেশ করে প্রতিদিন, কিন্তু আজকাল সে তবলার তাল নয়, শরীরের সঞ্চালনের ভাষা বুঝতে চায়। তার মা মীনাক্ষী আজও ঘুম থেকে ওঠেননি, হয়ত চা দেবার আগেই বাবার রাগ শুনতে হবে বলে দেরি করছেন। তবলা, গানের ঘর, বাড়ির দেয়াল—সবকিছু যেন তাকে বলছে, “তুমি কি করতে চাইছো?” কিন্তু তার ঘরের এক কোণে রাখা পুরনো ঘুঙুর যেন ফিসফিস করে জবাব দেয়, “তুমি যা হতে চাও, তাই হও।” কিশোরীবেলা থেকে নাচের প্রতি এই আকর্ষণ তার গোপন প্রেম, নিজের কাছেও এক ধরণের অপরাধ। অনেকবার চেষ্টাও করেছে ভুলে যেতে, বাবার রেওয়াজে মন বসাতে, কিন্তু ঘুঙুরের মৃদু শব্দ বারবার তাকে ছুঁয়ে গেছে।

শ্রাবণের এক ঝিরঝিরে বৃষ্টির দিনে প্রথম সে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে ইউটিউবে ওডিশি নৃত্য দেখে দেখে শিখতে শুরু করে। শরীরের প্রতিটি ভঙ্গিমায় কী গভীর অভিব্যক্তি, মুখে কথা নেই অথচ চোখে কত ভাষা—সেইসব দেখে সে অভিভূত। গায়ের কাঁটা দিয়ে উঠত যখন কোনও গুরুপাঠ পেরিয়ে যাওয়া শিল্পী কোমরের গতি আর হাতের মুদ্রায় যুগের চিত্র এঁকে দিচ্ছে। তার মা একদিন জানালা দিয়ে দেখে ফেলে তার নাচ। কিছু না বললেও মীনাক্ষীর চোখে এক ধরণের গোপন গর্ব ছিল, যেটা শুধু একজন নিষ্ফল স্বপ্নবতী মা-ই বুঝতে পারে। মীনাক্ষী একসময় রবীন্দ্রনৃত্যে তালিম নিয়েছিলেন, কিন্তু বিয়ের পরে সব বন্ধ। সুবীর এক কথায় বলে দিয়েছিলেন—“নাচলে আর সংগীতের সম্মান থাকবে না।” সেই কথার ভার এত বছর ধরে বহন করছে মীনাক্ষী, অথচ মেয়ের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পান আজ। কিন্তু রাধিকাকে কিছু বলতে পারেন না, কারণ এই বাড়ির দেয়ালের মধ্যেও প্রাচীন নিপীড়ন বাস করে—যেখানে পুরুষশিল্পী মহান আর নারীশিল্পী ‘দেখানোর জিনিস’। তবু রাধিকা থামে না। রাতের বেলা, সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সে ঘরের আলো নিভিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছোট ছোট মুদ্রা চর্চা করে—কখনও ভরতনাট্যম, কখনও ছায়ালতা দাসের সমসাময়িক নাচের স্টাইল, কখনও লোকনৃত্যের ছন্দ। প্রতিদিন সে বুঝতে পারে, তার শরীর যেন তাকে পথ দেখায়, তার ইচ্ছেগুলো ঘুঙুরের শব্দে রূপ নেয়।

কিন্তু এই লুকিয়ে লুকিয়ে বাঁচা ক্লান্তিকর। এক সন্ধ্যায় সে সাহস করে পাড়ার ‘মাধবী নাট্যকেন্দ্র’-তে যায়, যেখানে সপ্তাহান্তে নতুনদের জন্য নৃত্য ও মঞ্চ-আভিনয়ের কর্মশালা হয়। সেখানে তার দেখা হয় অদ্বৈত মুখার্জীর সঙ্গে—একটা ভিন্ন পৃথিবী যেন খুলে যায় তার সামনে। অদ্বৈত নাচকে কেবল অঙ্গসঞ্চালন নয়, বরং আত্মার ভাষা হিসেবে বোঝান। তিনি বলেন, “তুমি নারী, তাই তুমি নাচো—এই ধারণাটাই ভুল। তুমি শিল্পী, তাই তুমি নাচো।” সেই বাক্যগুলো রাধিকার ভিতরে ঝড় তোলে। কর্মশালায় তার প্রথম পারফরম্যান্সে সে মাত্র তিন মিনিটে সকলকে স্তব্ধ করে দেয়। তার চোখে ছিল অদ্ভুত রাগ, যন্ত্রণা আর মুক্তির আর্তি। অদ্বৈতের চোখে জল আসে, সে বলে—“তুমি তো আগুন।” সেই মুহূর্তে রাধিকা নিজের মধ্যে যেন এক নবজন্ম অনুভব করে। কিন্তু সেই রাতেই বাড়িতে ফেরার পরে বাবার মুখ অন্ধকার হয়ে থাকে। সুবীর জানেন না ঠিক কী করছে রাধিকা, তবে তার মধ্যে কিছু একটা বদল ঘটছে তা টের পাচ্ছেন। একদিন তিনি দেখে ফেলেন ঘরে ঘুঙুর পড়ে আছে—তখনই তিনি কড়া গলায় বলেন, “এই বাড়িতে যদি নাচো, তবে আমার তবলা বাজবে না।” ঘরে নিস্তব্ধতা নেমে আসে, ঘুঙুর যেন থেমে যায়, তবলা যেন চুপ হয়ে যায়। কিন্তু রাধিকার মুখ থামে না। সে উত্তর দেয়, “তবলা আমার জীবন হতে পারে না, ঘুঙুর হয়েছে।” সেই প্রথম সে প্রতিবাদ করে—এক নারীর কণ্ঠ থেকে, এক শিল্পীর হৃদয় থেকে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, পায়ের নিচে ঘুঙুর জড়িয়ে সে জানে—এই পথ সহজ নয়, তবে সত্যি।

দুই

রবিবার সকালে ছিমছাম গলিটার শেষে লাল ইটের পুরোনো বাড়িটাকে দেখে প্রথমে রাধিকার মনে হয়েছিল জায়গাটা হয়তো ধ্বংসের মুখে। কিন্তু ‘মাধবী নাট্যকেন্দ্র’-এর রিহার্সাল রুমে পা রেখেই সে বুঝতে পারে, এখানেই লুকিয়ে আছে তার ভবিষ্যতের ভাষা। দরজার ভেতর পা দিতেই ঘ্রাণে মিশে আসে ঘামের গন্ধ, পুরোনো কাঠের গন্ধ, আর যেটা সবচেয়ে স্পষ্ট—সৃষ্টির উষ্ণতা। ছেলেমেয়েরা মেঝেতে বসে বিভিন্ন অ্যাক্টিং গেমসে মেতে আছে। কজন হাঁটু গেড়ে বসে ছায়া নাটকের প্র্যাকটিস করছে। রাধিকার চোখে পড়ে এক দীর্ঘদেহী যুবক, যার মুখে গোঁফ-দাড়ির রেখা, কিন্তু চোখে যেন স্থির দৃষ্টির আগুন। তিনিই অদ্বৈত মুখার্জী, এই নাট্যকেন্দ্রের নির্দেশক। অদ্বৈতের চেহারায় মাধুর্য নেই, তেজ আছে—আর তার হাঁটার ছন্দে যে আত্মবিশ্বাস, সেটাই যেন পুরো দলটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। রাধিকা লাজুকভাবে নিজেকে পরিচয় দেয়। অদ্বৈত তার দিকে তাকিয়ে শুধু বলে, “তুমি কী খুঁজতে এসেছো?” কিছুটা হতচকিত হয়ে রাধিকা উত্তর দেয়—“নিজেকে।” সেই উত্তরে অদ্বৈতের মুখে সামান্য হাসি খেলে যায়। তিনি বলেন, “তবে ভুল জায়গায় আসোনি।” শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়, যেখানে রাধিকা আর কেবল বাবার তবলার ছায়ায় বাস করে না, বরং নিজের শরীরের ভাষা খুঁজে পায় নাটকের ছন্দে, নাচের ভঙ্গিমায়। অদ্বৈতের চোখে নারী মানেই শরীর নয়, নারী মানেই এক শক্তি—যেটা শব্দহীন ভাষায় সমাজকে প্রশ্ন করে, উত্তর ছিনিয়ে আনে।

প্রথম দিনেই অদ্বৈত বলে দেয়, “তোমার শরীরকে তোমারই জানতে হবে। নাচ তার আগে কিছুই নয়।” সেই শিক্ষা রাধিকাকে দারুণভাবে আলোড়িত করে। সে নিজেকে আয়নায় দেখে, প্রতিদিন, নতুন চোখে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত নিজেকে না দেখে কখনোই সে বোঝেনি, তার শরীরেই তার প্রতিবাদের অস্ত্র লুকিয়ে আছে। নাট্যকেন্দ্রের প্র্যাকটিসগুলো নিছক কসরত নয়—সেগুলো যেন আত্মদর্শনের প্রক্রিয়া। শরীরের প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি ছন্দ, চোখের দৃষ্টি, হাঁটার গতি—সব মিলিয়ে তৈরি হয় এক পরিপূর্ণ ভাষা, যেখানে রাধিকার অস্বীকৃত আকাঙ্ক্ষাগুলো মুখ খোলে। সে যখন নাচে, তখন আর মেয়ে থাকে না, মানুষ হয়ে ওঠে—প্রশ্ন করে, জবাব দেয়, চিৎকার করে আর কখনো কখনো নিঃশব্দে ভেঙে পড়ে। নাট্যকেন্দ্রের বাকিরাও ধীরে ধীরে রাধিকাকে আপন করে নেয়। কেউ কেউ তার সাহস দেখে মুগ্ধ, কেউ কেউ ঈর্ষান্বিত। কিন্তু সবাই জানে, রাধিকার চোখে যে আগুন, তা নেভানো যাবে না। প্রতি সপ্তাহে রবিবার তার জীবনে এক নবজন্মের দিন হয়ে ওঠে।

তবে এই নতুন জগতের মাঝেও রাধিকাকে বাড়ির ভেতরের পুরোনো দেয়ালের সঙ্গে যুঝতে হয়। সে মিথ্যা বলে বাড়ি থেকে বেরোয়—“পড়া শেষ করে টিউশনে যাচ্ছি।” আসলে সেই সময়েই সে ‘মাধবী নাট্যকেন্দ্র’-এ প্র্যাকটিসে যায়। কিন্তু মিথ্যে বলে বাঁচার ক্লান্তি দিন দিন বেড়ে চলেছে। তবু একরকম আত্মরক্ষা ছাড়া উপায় থাকে না। একদিন প্র্যাকটিস শেষে অদ্বৈত তাকে আলাদা করে ডাকে। অদ্বৈতের চোখে বিস্ময়, গলায় গাম্ভীর্য—“তোমার চোখে একটা যুদ্ধ আছে, রাধিকা। তুমি জানো কী তুমি কার বিরুদ্ধে লড়ছো?” রাধিকা মাথা নাড়ে, বলে, “হয়তো নিজের জন্মের বিরুদ্ধে। যে ঘর আমাকে ভালোবেসে বেঁধেছে, সেই ঘরই আমাকে আটকে দিচ্ছে।” অদ্বৈত বলে, “তোমার ঘুঙুরের শব্দ যেন মেঘের নিচে বজ্রধ্বনি। তুমি যখন নাচো, আমি দেখতে পাই একজন মুক্ত মানুষ।” সেই রাতে বাড়ি ফিরে রাধিকা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে জানালার পাশে। বৃষ্টি পড়ে, যেন ঘুঙুরের মতো শব্দ তোলে টিনের চালে। সে জানে তার লড়াই শুরু হয়ে গেছে। ঘরের ভেতরের দেয়ালগুলো হয়ত জানে না, কিন্তু একদিন এই ঘুঙুরই সেই দেয়াল ভেঙে দেবে।

তিন

সেই সন্ধ্যেটা যেন বাকিদের চেয়ে আলাদা ছিল না—ঘরের কোণায় সুবীর সেন তবলা নিয়ে বসেছেন, মীনাক্ষী নিরবে চায়ের কাপ সাজাচ্ছেন, আর রাধিকা নিজের ঘরে দরজা লাগিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বাতাসে একটা অস্বস্তিকর ভার অনুভূত হচ্ছিল, যেন সবকিছু থমকে আছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে আজ আর চুপিচুপি চর্চা করছে না, বরং নিজের দৃষ্টিতে নিজেকে দেখে এক ধরনের প্রত্যয়ের অভিজ্ঞতা নিচ্ছে। তার মুখে তীব্র এক এক্সপ্রেশন, শরীরের প্রতিটি অংশে যেন কথা ফুটে উঠছে। এমন সময়েই দরজার বাইরে থেকে পায়ের শব্দ হয়—সুবীর উঠে এসেছেন ওপরে, হঠাৎ করে দরজার ফাঁক দিয়ে চোখ রেখে দেখেন মেয়ে তার পায়ে ঘুঙুর বেঁধে নাচ করছে, সেই ঘুঙুরের শব্দ তবলার তালের বিপরীতে চলে যাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য সুবীর স্তব্ধ হয়ে যান—তার চোখে যেন আগুনের রেখা। তিনি দরজায় ধাক্কা দেন, রাধিকা চমকে গিয়ে ঘুঙুর হাতে নিয়ে পিছিয়ে পড়ে। সুবীর গর্জে ওঠেন—“এই ঘরে এই বাজে জিনিস চলবে না, শুনলে?” রাধিকাও এবার পিছিয়ে থাকে না, সে বলেই ফেলে—“আপনি তবলা বাজান, আমি ঘুঙুর পরি। আপনি শিল্পী, আমিও তাই হতে চাই।” তার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, কিন্তু চোখে ভয়ের ছায়া ছিল না। মীনাক্ষী ছুটে আসে মাঝখানে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে, কিন্তু সুবীর ততক্ষণে সেই ঘুঙুরজোড়া ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন খাটের নিচে। ঘর জুড়ে শুধু একটাই শব্দ—তবলার কাঠের ঠেক, যেটা এই পরিবারের একমাত্র বৈধ সঙ্গীতের প্রতীক।

সেদিন রাতের খাবারের টেবিল ছিল নিঃশব্দ, অথচ ভেতরে ভেতরে যেন বিস্ফোরণ হচ্ছিল। মীনাক্ষী কয়েকবার বলার চেষ্টা করেও কিছু বলতে পারেন না। রাধিকা বসে থাকে চুপচাপ, কিন্তু তার চোখে ছিল স্পষ্ট সিদ্ধান্তের রেখা। পরের দিন স্কুলে যাওয়ার নাম করে সে আবার নাট্যকেন্দ্রে যায়—এবার আর লুকিয়ে নয়, চুপচাপ নিজের ব্যাগে ঘুঙুর বেঁধে। অদ্বৈত তাকে দেখে কিছু বলেন না, শুধু একবার মাথা ঝাঁকান, যেন বুঝে নিয়েছেন সে সীমানা পেরিয়ে এসেছে। সেইদিন তাদের ওয়ার্কশপে ছিল “নারী শরীর ও প্রতিবাদ” নিয়ে বিশেষ পর্ব। রাধিকা মঞ্চে উঠে দাঁড়ায়, সঙ্গীত ছাড়া শুধু শরীরের ভাষায় সে দেখায়, কীভাবে একজন নারী নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে জন্ম নেয়, কীভাবে সমাজ তার দেহটাকে বন্দী করে, আর কীভাবে শিল্প সেই দেহকেই মুক্তির অস্ত্র বানায়। তার প্রতিটি গতিতে ছিল বিদ্রোহ, প্রতিটি থমকে যাওয়ায় ছিল চোখের চিৎকার। পারফরম্যান্স শেষে পুরো হল স্তব্ধ। কেউ হাততালি দেয় না, কেউ চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে, কেউ কাঁদে। অদ্বৈত বলে, “আজ তুমি শিল্পী হয়ে উঠলে, রাধিকা। আর ফিরে যেয়ো না।” এই ‘আর ফিরে যেয়ো না’—এই কথাটাই তার জীবনের পরবর্তী দিক নির্ধারণ করে। সে জানে, এখন থেকে তার তবলার কাঠের ঠেক আর ঘুঙুরের ধ্বনি একসাথে বেজে উঠবে না—তবে সে ভয় পায় না।

সুবীর যদিও মুখে কিছু বলেন না, কিন্তু ঘরে তার উপস্থিতি এখন হয়ে উঠেছে একধরনের বোবা প্রতাপ। রাধিকার ঘরে তবলার রেওয়াজ আর শোনা যায় না, কিন্তু মাঝেমাঝেই রাতের বেলায় খাটের নিচ থেকে তুলে আনা ঘুঙুরের শব্দ যেন দেয়ালের ওপারে পৌঁছে যায়। একদিন দুপুরে সুবীর পিসিমা—ভরতী সেনকে নিয়ে আসেন বাড়িতে। তিনি একসময় খেয়ালগানের শিল্পী ছিলেন, পরে হঠাৎ করে গানে ইতি টেনে গৃহবন্দী হয়ে পড়েন। ভরতী এসে রাধিকাকে ডেকে বলেন, “শোন, আমি জানি তুই কী করতে চাইছিস। আমিও চেয়েছিলাম, পারিনি। আমি যখন গাইতাম, তখন বাড়ি থেকে বলত ওটা পুরুষের গান। তোকে কেউ থামাতে পারবে না, যদি তুই নিজে থামিস না।” পিসিমার এই কথাগুলো রাধিকাকে ভিতর থেকে কাঁপিয়ে দেয়। সে বুঝতে পারে, ঘরের ভেতরেও কেউ কেউ আছে যারা বোঝে, জানে, অনুভব করে। সে জানে সামনে আরও ঝড় আসবে, আরও তর্ক, আরও অপমান। কিন্তু সেই রাতে ঘরের জানালা খুলে দিয়ে সে যখন পায়ে ঘুঙুর বেঁধে আয়নার সামনে দাঁড়ায়, তখন তার দেহ আর কাঁপে না—তার দৃষ্টি দৃঢ়, আর প্রতিটি পদক্ষেপে শোনা যায় এক নতুন ধ্বনি। তার ঘুঙুর আর কেবল এক বাদ্যযন্ত্র নয়, সেটা এখন এক যুদ্ধঘোষণা।

চার

রাধিকার চেয়ে অনেক পুরোনো সেই ঘরটার কাঠের মেঝে এখনো কিঞ্চিৎ শব্দ তোলে, দরজার পাল্লায় ধুলো জমে আছে, আর জানালার গ্রিলের ফাঁকে ফাঁকে লতাগুল্ম ঢুকে পড়েছে। বাড়ির এককোণে অবস্থিত এই ছোট রেওয়াজঘরটা এখনো যেন বেঁচে আছে, যদিও বহু বছর এখানে গান হয়নি, কেউ রেওয়াজ করেনি। ভরতী পিসিমা এই ঘরেই একদিন গলা সাধতেন, খেয়ালের অলঙ্কারে বাড়ি কাঁপিয়ে দিতেন, অথচ এখন তিনি এ ঘরে ঢোকেন না, শুধু বাইরের উঠোনে বসে সময় কাটান। কিন্তু সেদিন সকালে তিনি নিজেই ডেকে নিয়ে গেলেন রাধিকাকে সেখানে। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকেই যেন একটা অতীতের গন্ধ এসে লাগে রাধিকাকে—মাধুর্য, পরিত্যাগ আর প্রতিবাদের মিশ্র ঘ্রাণ। ঘরের এক কোণে একটা পুরোনো হারমোনিয়াম, কাঠের একটা ছোট তানপুরা রাখা, আর খাটের নিচে দেখা যায় একটা ছোট্ট বাক্স। পিসিমা ধীরে ধীরে গিয়ে সেই বাক্সটা বের করে আনেন। খুলে দেখান—এক জোড়া ঘুঙুর, কালচে হয়ে গেছে, তার মাঝখানে ধূলোর স্তর জমে আছে, কিন্তু রাধিকাকে দেখে মনে হয় যেন তারা এখনও শব্দ করতে চায়। পিসিমা বলেন, “এই ঘুঙুরটা আমার ছিল না, আমার এক বান্ধবী নাচত—ওর থেকে ধার করে এনেছিলাম, ভেবেছিলাম একটা নতুন শিল্পমাধ্যম শিখব। কিন্তু পারলাম না। এই সমাজ আমাকে বলেছিল, গান চলবে, কিন্তু নাচ নয়। কারণ গানে চোখ নেই, শরীর নেই, কিন্তু নাচে সবটাই প্রকাশ পায়। সেটা তারা ভয় পায়।” তার কণ্ঠে অভিমান নেই, কেবল এক নিস্তরঙ্গ বেদনার ঢেউ।

রাধিকা ঘুঙুরদুটো হাতে নেয়। তার চোখে যেন সময় ঘুরে ফিরে আসে, এই ঘরেই একদিন এক তরুণী পিসিমা স্বপ্ন দেখতেন শিল্পী হবেন বলে, আর সেই স্বপ্নটাকেই ধীরে ধীরে গলা টিপে মেরে ফেলা হয়েছিল। ঘরের চারপাশের পুরনো দেয়ালগুলো সেই কান্না আজও ধরে রেখেছে—দেয়ালের ছোট ছোট ফাটলে জমে থাকা ছত্রাকের মতো। পিসিমা বলেন, “তুই যা করতে চাইছিস, সেটা আমি চেয়েও সাহস পাইনি। আমি গান করতাম, কারণ ওটা নিরাপদ। কিন্তু তুই নাচিস—তোর শরীরকেই তুই শিল্প বানাচ্ছিস। এটা সমাজকে ভয় দেখায়। তোর বাবাও ভয় পায়—কারণ ও জানে, তোর ঘুঙুর ওর তবলাকে পেরিয়ে যাবে একদিন।” রাধিকাকে সে দিন প্রথম বলা হয়, “তুই যা করছিস, সেটা শুধু তোর নিজের লড়াই নয়। আমাদের প্রজন্মের সব কণ্ঠরুদ্ধ মেয়েদের হয়ে তুই দাঁড়াচ্ছিস।” রাধিকার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, কিন্তু সে নিজের ভিতরে একরকম শিখা অনুভব করে। যেন ঘরের ভেতরের অন্ধকার এখনো উজ্জ্বল হতে চায়, কেবল একটি সাহসী পায়ের শব্দের অপেক্ষায়। সে সেই ঘুঙুর আবার নিজের ব্যাগে তুলে নেয়—এবার কেবল নিজের নয়, এক ভাঙা প্রজন্মের উত্তরাধিকার হিসেবে।

ঘর থেকে বেরিয়ে এসে পিসিমা তাকে বলেন, “যখনই তুই থেমে যেতে চাইবি, মনে করবি এই ঘরের কথা। মনে করবি, আমি কী হারিয়েছিলাম, তুই তা ফিরিয়ে আনবি।” সেই কথাগুলো যেন আরেকটা প্রতিজ্ঞায় পরিণত হয়। রাধিকা এখন জানে, সে আর একা লড়ছে না—তার সাথে আছে একটা ছায়াময় অতীত, যা এখনও পূর্ণতা পায়নি। সে ঘরে ফিরেই জানালার ধারে বসে থাকে অনেকক্ষণ। সন্ধ্যার আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে, পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসছে সন্ধ্যারতির ঘণ্টা। সে সেই পুরনো ঘুঙুরে হাত রাখে, আর প্রতিজ্ঞা করে—এবার সে থামবে না। সে নাচবে—পিসিমার হয়ে, নিজের হয়ে, আর সেইসব নারীদের হয়ে যারা শিল্পী হতে চেয়েছিল, কিন্তু হতে পারেনি। ঘুঙুর এবার নিছক এক বাদ্যযন্ত্র নয়, বরং উত্তরাধিকার, স্মৃতি, দায়, আর মুক্তির সেতুবন্ধ। সেই রাতেই সে প্রথমবারের মতো নিজের ঘরে দরজা খোলা রেখে নাচে, কেউ দেখে কি না—সে ভাবে না। ঘরের বাইরে যে অন্ধকার জমেছে, সে জানে তার প্রতিটি ধ্বনি সেই অন্ধকার ছিন্ন করে মিশে যাবে পিসিমার হারমোনিয়ামের এক ঘুমিয়ে থাকা রাগে।

পাঁচ

রাধিকার জীবনে তখন একধরনের টানাপোড়েন চলছিল—শরীর চাইত নাচ, কিন্তু সমাজ আর সংসার চেপে বসেছিল বুকের উপর। আউশগ্রামের সেই কাঁচা রাস্তায়, বাবা আশুতোষের তবলার তাল আর শিষ্যদের ঘনঘন আগমনে বাড়িতে যেন কেবল সুর-লয়ের ধর্মীয়তা বজায় থাকত, কিন্তু রাধিকার পায়ের তালে যেটুকু জীবনের উচ্ছ্বাস ছিল, তা কেবল শ্বাসরোধকারী নিঃশ্বাসে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে সে একদিন পায়ের ঘুঙুর খুলে রেখে দেখল একজোড়া জুতো—মায়ের পুরনো চপ্পল নয়, বাবার সাদামাটা চামড়ার জুতোও নয়—একজোড়া মঞ্চে পরার মতো কালো চরিত্রজুতো, যেটা সে এক আত্মীয়র বাড়ির শোকসভায় ভুল করে নিয়ে এসেছিল। ঘরে ফিরেই হঠাৎ তার মনে হলো, এই জুতোজোড়া যেন কোনো প্রতীক হয়ে উঠেছে—শিল্পের আরেক পথ, হয়তো পুরুষশাসিত মঞ্চ থেকে নিজের জায়গা কাড়ার লড়াই। ঘুঙুর বাঁধা পায়ের নিচে যদি একদিন এই জুতো পড়ে যায়, তবে কেমন হবে? প্রশ্নটা প্রথমে খেয়ালি ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে সে প্রশ্ন রাধিকার মনে ঢুকে গেল ঘুণ পোকার মতো—ঘুঙুরের তালে যদি হিন্দুস্তানি সঙ্গীত মেলানো যায়, তবে কেন পুরুষশাসিত যন্ত্রবাদ্য আর নৃত্যের মঞ্চে একজন নারী পায়ের ঘুঙুর নিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না?

একদিন সন্ধ্যেবেলা, বাবা ঘরে ছিলেন না, মা চুলা ধরাচ্ছিলেন। রাধিকা তার ঘরের দরজা বন্ধ করে আয়নার সামনে দাঁড়াল। পায়ের নিচে ছড়িয়ে রাখা ঘুঙুর আর চরিত্রজুতো—দুটো একসাথে পরল সে। প্রথমে অদ্ভুত লাগল, কিন্তু খানিক পরে নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে সে বুঝল—নিজেকে আলাদা লাগছে, ভয়ংকরভাবে স্বাধীন লাগছে। সে পায়ের আঙুলে তাল দিল, নিজের কণ্ঠে এক অচেনা বোল আওড়াল, এবং ধীরে ধীরে ঘরের খাটটা ঠেলে একটু জায়গা করে নিজেই নিজের দর্শক হয়ে উঠল। আয়নার সামনে সে মঞ্চ, সে দর্শক, সে আলো, সে নর্তকী। বাইরে তখন গ্রামের সন্ধ্যা নামছে, শালগাছের পাতা পড়ছে, দূরে কোথাও হয়তো সাঁওতাল কোনো গ্রামে ঢোল বাজছে। রাধিকা নিজেকে এক নিঃসঙ্গ যুদ্ধক্ষেত্রের সৈনিক ভাবল—যেখানে অস্ত্র তার পায়ের নাচ আর আত্মবিশ্বাস। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে দরজায় টোকা পড়ল। মা হয়তো কিছু বলতে এসেছেন। তড়িঘড়ি ঘুঙুর খুলে চরিত্রজুতোটা আলমারির নিচে ঢুকিয়ে দিল সে। দরজা খুলতেই মা একটু অবাক গলায় বললেন, “এই যে, তুই এত চুপ করে আছিস কেন? রান্না হয়ে গেছে, আয় খেয়ে নে।” রাধিকা মাথা নীচু করে বলল, “আসছি।” কিন্তু তার চোখে তখনও সেই আয়নার প্রতিচ্ছবি ঘুরছিল—যেখানে সে নিজেকে দেখেছে একজন নৃত্যযোদ্ধা হিসেবে, পায়ের জুতোজোড়ার লড়াইয়ে জিতে বেরিয়ে আসার ইচ্ছেপূর্ণ শিল্পী হিসেবে।

পরের দিন স্কুলে যাওয়ার সময় তার চোখ পড়ল হাইস্কুলের দেওয়ালে লাগানো একটি বিজ্ঞাপনে—“অন্তর্জল শিল্পমেলা, বীরভূম জেলার মধ্যে প্রতিযোগিতা। অংশগ্রহণ করুন নৃত্য, বাদ্য ও নাটকে।” বিজ্ঞাপনটি রাধিকার শরীরের ভেতরে বিদ্যুৎ ছড়াল। সে বুঝে গেল—এটাই সুযোগ, সমাজের চোখ এড়িয়ে, বাবার চোখ এড়িয়ে, নিজের পথ তৈরি করার। কিন্তু প্রশ্ন ছিল—কে তাকে সমর্থন করবে? সেই উত্তর এল এক অপ্রত্যাশিত জায়গা থেকে—স্কুলের বাংলার শিক্ষিকা স্নেহাশ্রী মিস, যিনি নিজের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে রাধিকার সৃজনশীলতা আগেই আঁচ করেছিলেন। একদিন রাধিকা তাঁর কাছে গিয়ে কাঁপা গলায় বলল, “আপা, আমি এই প্রতিযোগিতায় নাচতে চাই। কিন্তু আমার পরিবার জানে না।” স্নেহাশ্রী এক মুহূর্ত চুপ থেকে জবাব দিলেন, “তুমি নিজের স্বপ্নে বিশ্বাস রাখো, রাধিকা। বাকিটা আমায় ভাবতে দাও।” সেই প্রথম রাধিকা বুঝল, সমাজের মধ্যে কিছু মানুষ আছেন যারা দেয়াল না তুলে, সিঁড়ি তৈরি করেন। সেই সন্ধ্যায় সে ঘরে ফিরে আবার আয়নার সামনে দাঁড়াল, ঘুঙুর বাঁধল, কিন্তু এবার চরিত্রজুতো খুলল না—বরং দুটোকে একসাথে পরে, পায়ের তালে একটি নতুন নাচ শুরু করল—নতুন জীবনের সূচনা।

ছয়

রাধিকা এখন শহরের অন্যতম আলোচিত নাম। পত্রপত্রিকায় তাঁর ছবি, সাক্ষাৎকার—চারদিকে তাঁকে ঘিরে উত্তেজনা। কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে অনুভব করছিল, এই খ্যাতির বৃত্তটা যেন তাকে নতুন করে বন্দি করে ফেলছে। প্রতিদিনের অনুশীলন, অনুষ্ঠান, ক্লাস—সবকিছু যেন এক কঠোর ছকে বাঁধা। কোথাও যেন আর ঘুঙুরের সেই মুক্ত সুরটা বাজে না। তার ঘরে বসে বারবারই সে তবলার কাঁসা আওয়াজ কানে পায়, বাবার রাগ-দরবারের টান সে যেন ঘুঙুরের তালে মিলিয়ে দিতে চায়। কিন্তু প্রত্যেকবার কোথাও না কোথাও একটা ছন্দপতন ঘটে। এমনই একদিন সন্ধ্যাবেলা, অনুষ্ঠান শেষে ফিরে এসে সে আবিষ্কার করে, তার ঘুঙুরের এক জোড়া সুতো ছিঁড়ে গেছে। আশ্চর্যভাবে তার মনে হল যেন ঘুঙুরগুলো নিজেই আর বেঁধে থাকতে চায় না—সে চাইছে ছুটে যেতে অন্য কোথাও, অন্য এক সুরের সন্ধানে।

এরপরের কয়েকদিন, রাধিকা নিজেকে নিয়ে এক গভীর দ্বন্দ্বে পড়ে। সে কি শুধু একজন নৃত্যশিল্পী? নাকি সেই নাচের মধ্যে দিয়ে তার শিল্পচেতনা বড় কিছু বলতে চায়? একটি অনুষ্ঠানে, যেখানে তাকে একটি আধুনিক উপস্থাপনা করতে বলা হয়, সে সিদ্ধান্ত নেয়—নতুন কিছু করবে। তার নাচে সে যোগ করে শাস্ত্রীয় ভঙ্গিমার পাশাপাশি একরাশ মুক্ত আন্দোলন—নাটকের সংলাপ, মুখভঙ্গি, আর আধুনিক সংবেদনশীলতার এক রুক্ষ, সাহসী মঞ্চায়ন। দর্শকদ席ে একটা নিস্তব্ধতা নামে। কেউ বুঝে উঠতে পারে না, এটা কি নাচ, না অভিনয়, না প্রতিবাদ? অনুষ্ঠান শেষে অনেকেই প্রশংসা করলেও, কয়েকজন প্রবীণ শিল্পী কটাক্ষ করে বলেন, “ওটা কি নাচ, না নাটক? এতদিনের ধারাটাকে অপমান করল।” কিন্তু রাধিকা সেই রাতে প্রথমবার নিজের ঘুঙুর খুলে বিছানায় রেখে দেয়—সে জানে, আগামী দিনে এই ঘুঙুরই আবার নতুন শব্দে বাজবে।

একদিন, পুরোনো শহরের একটি ছোট গলিতে সে হঠাৎ দেখতে পায়—একজন বৃদ্ধ তবলা-বাদক, এককোণে বসে বাজাচ্ছেন অসাধারণ এক কাফি রাগ। রাধিকার মনে হয়, এ যেন তার বাবার সুর। বৃদ্ধের চোখে জল, তবলা যেন কাঁদছে। সে এগিয়ে গিয়ে বসে পড়ে, আর চোখে জল নিয়ে বলে, “আমি তোমার তালে নাচতে চাই, কিন্তু নিজের মতো করে।” বৃদ্ধ হেসে বলেন, “তুই তো নাচিস না, তুই তো কথা বলিস পায়ের ছন্দে।” সেই দিন থেকে রাধিকার নতুন অধ্যায় শুরু হয়—সে শহরের কেতাদুরস্ত মঞ্চ ছেড়ে ছোট ছোট প্রাঙ্গণে, মাটির ঘ্রাণ মেশানো অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতে শুরু করে। ঘুঙুরের ছন্দে সে বলতে থাকে তার গল্প, সমস্ত শোষণের, সমস্ত বাঁধনের, এবং মুক্তির। এবং শেষমেশ সে বুঝতে পারে, তার ঘুঙুর তাকে কোথাও টানেনি—সে নিজের ভিতরেই একটা নতুন পথের দিশা খুঁজে পেয়েছে।

সাত

কলকাতার বৃষ্টিভেজা দুপুর, রাধিকার মনেও তখন এক প্রবল ঝড় বইছে। গৃহবন্ধন, সামাজিক মুখোশ আর পারিবারিক দায়িত্বের ভারে ক্লান্ত সে ক্রমাগত খুঁজে চলেছে মুক্তির রাস্তাটা। তার পায়ে বাঁধা সেই পুরনো ঘুঙুর—যা একদিন আনন্দের প্রতীক ছিল—এখন যেন শিকল হয়ে গেছে। আজকের রিহার্সালটা ছিল অন্যরকম। ওস্তাদ নাসিরুদ্দিন খান, যিনি তার প্রথম গুরু, অনেকদিন পর এসেছিলেন তাকে দেখতে। কিন্তু তাঁর চোখে সে আগের সেই ছোট্ট মেয়েটি নেই—তিনি দেখলেন এক আত্মসম্মানে দীপ্ত, প্রতিবাদী নারী, যিনি শিল্পকে নিজের অস্তিত্ব করে তুলেছে। নাসিরুদ্দিন খান চুপ করে তাকিয়ে ছিলেন রাধিকার দিকে, তার প্রতিটি মুদ্রা, প্রতিটি ভঙ্গিমা যেন আরাধ্য মন্ত্র। “তুই এখন আমার শেখানোকে ছাড়িয়ে গেছিস রাধিকা,”—গুরু মৃদুস্বরে বললেন। এই কথাগুলো শোনার পর রাধিকার চোখে জল এসে গেল। সে বুঝল, তার দীর্ঘ লড়াইয়ের কিছুটা সার্থকতা এসেছে, যদি তার গুরু তাকে শিল্পীর চোখে দেখেন।

কিন্তু সবটাই তো এত সহজ নয়। বাড়িতে ফেরার সময় সে রাস্তার মোড়ে বাবার এক পুরনো শিষ্য রণজয়ের মুখোমুখি পড়ে। রণজয় একসময় রাধিকার প্রতি দুর্বল ছিল, কিন্তু সে দুর্বলতা পরিণত হয়েছিল ঈর্ষায়। সে আজও বিশ্বাস করে, একজন মেয়ের উচিত নয় তবলা বা নৃত্যশিল্পের মতো চর্চায় সময় দেওয়া—তাদের জায়গা রান্নাঘরে। রণজয়ের কথা, “তুই তো শুধু নাচতে জানিস, সংসার করতে পারিস না। এইসব নাচ-গান দিয়ে কেউ সংসার টানে না রে!” রাধিকার মুখে তখন শুধু একটাই উত্তর—একটা দীর্ঘ, দৃঢ়, সাহসী চাহনি। সে কিছু বলেনি, কিন্তু তার চোখ দুটো বলছিল, ‘সংসার যদি আমার স্বপ্নকে গিলে খায়, তবে আমি সে সংসার চাই না।’ ফিরে এসে সে মায়ের সামনে দাঁড়ায়। মা তখন একমনে কাপড় কাচছিলেন। রাধিকা বলল, “মা, আমি দিল্লি যাচ্ছি। ‘জস্না ফেস্টিভ্যাল’-এ আমার নাম উঠেছে। মা এক মুহূর্ত থেমে বললেন, ‘তুই যা, রাধি। কিন্তু তোর ঘরে ফিরতে দেরি করিস না।’ রাধিকা তখন বুঝল, মা তার স্বপ্নে বিশ্বাস না করলেও, তাকে আটকায় না—এটাই অনেক বড় আশীর্বাদ।

রাত্রি গভীর হলে রাধিকা তার ঘরের জানালাটা খুলে দেয়। বাইরে তখন বজ্রবিদ্যুৎ খেলা করছে, যেন প্রকৃতিও বিদ্রোহ করছে কারও বিরুদ্ধে। জানালার কাঁচে হাত রেখে সে ভাবে, এই শহর, এই বাড়ি, এই পরিচিত মুখগুলো—সব কিছুই যেন তার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ, তার মনে এক অদ্ভুত শান্তি। সে জানে, আর মাত্র কয়েকটা দিন, তারপরই তার পায়ের ঘুঙুরগুলো কাঁপিয়ে দেবে দিল্লির মঞ্চ। সে চুপচাপ ঘরের কোণে রাখা তার পিতলের বাক্স থেকে সেই পুরনো ঘুঙুরজোড়া বের করে। অনেক দিন পর, সে একে একে সেগুলো পরতে থাকে। ঘুঙুরের শব্দ যেন তার নিজের হৃদস্পন্দনের প্রতিধ্বনি। ঠিক তখনই তার ফোনে একটা মেসেজ আসে—জস্না ফেস্টিভ্যাল থেকে। বিষয়টি একেবারেই অপ্রত্যাশিত: “দুঃখিত, আপনার পারফর্ম্যান্স ক্যান্সেল করা হলো। নতুন নীতিমালার জন্য এবার শুধুমাত্র সরকার-অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানভুক্ত শিল্পীদেরই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।” রাধিকার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আসে, কিন্তু সে ঘুঙুর খোলেনি। কারণ সে জানে, যতবার তার স্বপ্ন ভেঙেছে, ততবার সে আরও দৃঢ় হয়েছে। এইবারও হবে। কারণ তার ঘুঙুরের শব্দ কখনো থামে না।

আট

সন্ধ্যাবেলায় নাট্যমঞ্চের আলো যখন ধীরে ধীরে ম্লান হচ্ছিল, তখন রাধিকা বসে ছিল মঞ্চের পাশে, ঘুঙুরখানা খুলে কোলে রেখে। তার মুখে ক্লান্তি ছিল না, বরং এক অদ্ভুত প্রশান্তির ছায়া। আজকের নৃত্যপ্রদর্শনী ছিল একটা বাঁক, একটা যাত্রাবিন্দু—যেখানে সে আর কারও অনুমোদনের অপেক্ষায় নেই। কিন্তু এই নতুন জগতটা সম্পূর্ণ অচেনা, যেখানে প্রতিটা হাসির পেছনে যেন একটা প্রহসনের ছায়া লুকানো। প্রখ্যাত নৃত্যগুরু মালবিকা সেন, যিনি আজ রাধিকার নৃত্য দেখে অভিভূত হয়েছিলেন, তিনিই পরে ভ্যানিটিতে দাঁড়িয়ে সহশিল্পী অনন্যাকে বলে উঠেছিলেন—”এই মেয়েটার পায়ে আগুন আছে, কিন্তু মুখে বেশি কথা!” রাধিকা দরজার আড়াল থেকে শুনেছিল কথা গুলো। তার ভিতরে তখন যেন একটা ঘুমন্ত পাখি ডানা ঝাপটে উঠেছিল। খ্যাতি হয়তো একটা অনন্য প্রকাশ, কিন্তু সেই প্রকাশের পিছনেও যদি নারীশরীর আর পেছনের গল্পগুলোকে টেনে আনা হয়, তবে শিল্প কোথায়? রাধিকা নিজেকে প্রশ্ন করেছিল—এই পথটা কি শুধু আলোয় মোড়া, নাকি প্রতিটা আলো নিজের ছায়া তৈরি করে?

সে রাতে বাড়ি ফিরেও ঘুম এল না। বারান্দায় বসে সে ঘুঙুর জোড়াটাকে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ। কী অদ্ভুত এই শব্দ—একদিকে যেন উচ্ছ্বাস, অন্যদিকে কষ্ট। তার বাবা এখনো রাধিকার এই পথকে মেনে নিতে পারেননি, যদিও তিনি প্রকাশ্যে আর কিছু বলেন না। মা এখনো নীরব দর্শক, ছোট বোন রিয়া মাঝে মাঝে মুগ্ধ হয়ে তার নাচ দেখে, আবার পরক্ষণেই বলে—”তুই এখন এসব করে কী করবি দিদি? চাকরি খুঁজ না!” এইসব শব্দ রাধিকাকে না কষ্ট দেয়, না উজ্জীবিত করে, বরং সে এখন অভ্যস্ত। কিন্তু শহরের উচ্চাভিলাষী শিল্পজগতে ঢুকেই সে বুঝেছিল—নৃত্য, গলা, ছন্দ—এসব শুধু সামগ্রিক দক্ষতার বিচার্য নয়। কখনো কখনো সে কার বাড়ির মেয়ে, কে তার পৃষ্ঠপোষক, কিংবা সে কতটা “সহজ” এসব নিয়েও অনেক কিছু নির্ধারিত হয়। এক সন্ধ্যায় একটি বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী তাকে ডেকে বলেছিলেন, “তুমি আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে কাজ শুরু করো, আমার ওয়ার্কশপে। পরে সুযোগ পাবে।” কিন্তু রাধিকার চোখ বুঝেই বুঝেছিল—সেই সুযোগ মানে একটা চুপচাপ চুক্তি, যেখানে সে নিজের ইচ্ছাকে বিসর্জন দিয়ে কেবল মুখোশ পরে থাকব। সে politely না বলেছিল। আর তখন থেকেই তার পেছনে কানাঘুষো শুরু হয়—”ঘাড় উঁচু মেয়েটা”, “বেশি চালাক”, “নিজেকে অনেক কিছু ভাবে”।

এমন এক সময়েই সে আবার ফিরে যায় তার পুরোনো গুরু অরুণ স্যারের কাছে। সেই মানুষটা যে একসময় তাকে প্রথম ছন্দ শিখিয়েছিলেন, তার মায়ের লুকিয়ে আসা অনুরোধে। অরুণ স্যার এখন অনেকটা বয়সী, চোখে ঝাপসা, কিন্তু কণ্ঠে এখনো দৃঢ়তা। তিনি রাধিকার চোখে সব পড়ে ফেলেন এক ঝলকে—”তোর চোখের ভিতর যে আগুন ছিল, সেটা কেউ হয়তো এখন নিভিয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু মনে রাখবি, শিল্প একটাই জিনিস, যেখানে তুই তোকে হারালে, আর খুঁজে পাবি না।” সেই সন্ধ্যায় রাধিকা আবার শুরু করে—পুরনো মাটির মেঝেতে, পায়ে ঘুঙুর বেঁধে, ছন্দে ছন্দে নিজের শরীরকে জাগিয়ে তোলে। মালবিকা সেনের সমালোচনা, শহরের ঠান্ডা মুখোশ, নিজের পরিবারের নির্বিকারতা—সব কিছু ছাপিয়ে সে অনুভব করে, এই নাচ তার অস্তিত্ব। ঘুঙুরের শব্দ আজ আর তার জন্য কোনো শিকল নয়, বরং মুক্তির ডাক। এই ডাক কারো মুখাপেক্ষী নয়, একেবারে নিজের ভেতর থেকে ওঠে আসা এক অনবদ্য প্রত্যয়। রাধিকা স্থির করে—এই যাত্রা সহজ হবে না, কিন্তু সে আর থামবে না। এখন শুধু নৃত্য নয়, নিজের অস্তিত্ব নিয়েই সে লড়বে—প্রতিটি প্রহসনের মুখোশ ছিঁড়ে ফেলবে ছন্দের ঘূর্ণিতে।

নয়

রাধিকা তখন মঞ্চে, চোখে আলো এসে পড়েছে—চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে আছে সামনের অন্ধকার দর্শকাসনের দিকে। কিন্তু তার মন পড়ে আছে পেছনে, মঞ্চের বাইরে, গানের ঘরটিতে যেখানে শিবলাল এখনো তবলার বোল তুলে চলেছেন নিঃশব্দে, একা। এই প্রথমবার, রাধিকা তাঁর সাহচর্য ছাড়া নাচছে, যেন নিজের ঘর থেকে ছিঁড়ে এনে কেউ একে আকাশে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু সেই আকাশ, সেই আলো—তাতে কোনো ভয় নেই আজ। মঞ্চে রাধিকা নিজের ঘুঙুরের শব্দে এক নতুন ভাষা খুঁজে পায়, যে ভাষায় কোনো পুরুষতন্ত্র নেই, কোনো হুকুম নেই, কেবল শিল্প আছে, নীরবতার মাঝখানে যে সুর ফোটে, তবলার বোল আর পদক্ষেপের ছায়া হয়ে মিশে যায় শরীরে, মাটিতে, বাতাসে। সে যেন হঠাৎ উপলব্ধি করে—এই মুহূর্তটাই তার চূড়ান্ত উত্তর, হাজার প্রশ্নের।

নৃত্যশেষে যখন করতালির গর্জন ছড়িয়ে পড়ে প্রেক্ষাগৃহে, রাধিকার চোখে জল আসে। সে জানে এই অশ্রু কেবল আনন্দের নয়—এ এক প্রলয়ের অশ্রু, যা সবকিছুকে ধুয়ে দিতে চায়। পর্দা পড়ে গেলে পেছনের ঘরে ফিরে আসে সে, ঘরে ঢুকেই দেখে শিবলাল এক কোণে বসে আছেন, নিঃশব্দে, মুখে কোনো ভাব নেই। কিন্তু রাধিকা জানে, সে দেখছে। একটিবার সে চেয়ে থাকে শিবলালের চোখে, আর সেই চোখে সে দেখে চুপচাপ একটি স্বীকৃতি, যেটা কখনো উচ্চারিত হয়নি। শিবলাল বলে ওঠেন না কিছু, কেবল ঘুঙুরের দিকে তাকিয়ে থাকেন—যেন সেটাই এখন কথা বলছে। রাধিকা এগিয়ে গিয়ে নিজেই খুলে রাখে ঘুঙুরজোড়া, যত্ন করে রাখে নিজের ছোটো বাক্সে। শিবলাল বলেন, “আজ তুমি নিজেকে ছাড়িয়ে গেছো।” এতদিনের তবলা-বোলের ভিতরে যে আদেশ ছিল, আজ তার জায়গা নিয়েছে এক নিঃশব্দ সম্মান।

রাত্রি গভীর হলে রাধিকা ছাদের দিকে ওঠে। রাতের হাওয়া এসে চুলের গোছা এলোমেলো করে দেয়। আকাশের দিকে তাকিয়ে সে ভাবে—নিজের ভেতরের যে পরতগুলো এতদিন জমে ছিল, আজ তা গলে পড়েছে। বাবার সুর, সমাজের চোখ, পাড়ার মানুষের কথাবার্তা, ভয়ের দেয়াল—সব পেরিয়ে আজ সে কেবল একজন শিল্পী, একজন স্বাধীন মানুষ। সে বুঝতে পারে, মুক্তি আসে বাইরের জগৎ পাল্টে দেওয়ার মাধ্যমে নয়, আসে নিজের ভিতরকার শিকল ভেঙে দেওয়ার সাহসে। এবং এই সাহস তাকে এনে দিয়েছে তার ঘুঙুর—যা একদিন তার শিকল ছিল, আজ তা-ই তার পাখার ডানা।

দশ

তিন বছর কেটে গেছে। রাধিকার পায়ে বাঁধা ঘুঙুর আজও সেই আগুনের মতোই ঝঙ্কার তোলে, কিন্তু তাতে আজ আর কেবল বিরহের সুর নেই, আছে এক গভীর আত্মবিশ্বাস। রাধিকা আজ মুম্বইয়ের এক খ্যাতনামা নৃত্যগুরু—নিজের ছোট্ট এক স্কুল খুলেছে ‘নৃত্যমুক্তি’। পুরুষতন্ত্র, কুপ্রস্তাব, প্রতিকূলতা—সব পেরিয়ে আজ সে দাঁড়িয়ে আছে দৃঢ় পায়ে, অথচ তার সেই পুরনো দিনের অন্ধকার ঘরের কথা সে ভোলে না। প্রতিটি ছাত্রীকে শেখায় শুধু নাচ নয়, শেখায় নিজের মর্যাদা রক্ষা করতে। চন্দ্রিমা, যে একদিন ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল সেই গ্রাম থেকে, সে আজ রাধিকার ডানহাত। তারা একসঙ্গে গড়ে তুলছে এমন এক পরিসর, যেখানে মেয়েরা কেবল নৃত্যশিল্পী নয়, নিজের পরিচয়ের দাবি করে একজন মানুষ হিসেবেও। প্রতিদিন সকালে রাধিকা নিজের ঘুঙুর পরেন, এক কাপ চায়ে চুমুক দিয়ে আকাশের দিকে তাকান, তারপর শুরু হয় তার ক্লাস—যেখানে প্রতিটি কন্যার চোখে জ্বলে ওঠে স্বাধীনতার স্বপ্ন।

এই আজকের রাধিকার পথটা সহজ ছিল না। কলকাতা থেকে মুম্বই এসে ঠাঁই পেতে তাকে রাতের পর রাত ফুটপাতে কাটাতে হয়েছে। নৃত্য শেখার জন্য টাকা না থাকায় সে বাসন মাজা থেকে শুরু করে ডান্স ক্লাসে পরিচ্ছন্নতার কাজ করেছে। কিন্তু কোথাও কখনও তার চোখের দীপ্তি ম্লান হয়নি। একবার এক কাস্টিং ডিরেক্টর তাকে অশ্লীল প্রস্তাব দিয়েছিল—তখনই সে প্রথমবার নিজের ঘুঙুর ছুড়ে মেরেছিল তার গায়ে। সেই সংবাদপত্রে হেডলাইন হয়েছিল “নৃত্যশিল্পীর ঘুঙুরে কাস্টিং কাউচের মুখ থুবড়ে পড়া”—তারপর থেকেই মুম্বইয়ের ছোট-বড় নাট্যমঞ্চ রাধিকার সাহসকে শ্রদ্ধা করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে তার পারফরম্যান্সে শুধু সৌন্দর্য নয়, উঠে আসে এক বিদ্রোহ, এক প্রশ্ন—“কেন নারীর শরীরকেই সবকিছু ধরে নেওয়া হবে?” তার ‘আন্তর্জলি যাত্রা’ পারফরম্যান্সে একটি মৃত বধূর ভূমিকায় সে যেভাবে নিজের শরীরকে ক্যানভাস করেছিল, তা দর্শকদের চোখে জল এনেছিল।

আজ ‘নৃত্যমুক্তি’র দশম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। মঞ্চে বসে রাধিকা চায়ের কাপ হাতে অপেক্ষা করছিল তার ছাত্রীরা পারফর্ম করবে। সবার শেষে এক নৃত্য শুরু হয়—বাঁধা ঘুঙুরের আওয়াজে ঢেকে যায় হলের নিঃশব্দতা। আলো পড়ে একজন ছোট্ট মেয়ের মুখে—সে মঞ্চে উঠে বলে, “আমি রঞ্জিতা। আমার মায়ের স্বপ্ন ছিল আমি নাচ শিখি। মা এখন আর নেই। কিন্তু আমি জানি, ও আকাশ থেকে আজও আমার পায়ে বাঁধা ঘুঙুরের আওয়াজ শুনতে পায়।” রাধিকার চোখ জলে ভরে যায়। সে নিজের হাতে তৈরি প্রতিটি শিল্পীর মধ্যে যেন নিজের অতীতকে খুঁজে পায়—যারা কেউ আর নিছক নারী নয়, কেবল মেয়ে নয়, তারা সব—শিল্পী।

___

 

____

ঘুঙুর, নারীমুক্তি, নৃত্যশিল্পী, নারীশক্তি, সাহসিনী, সংগ্রামীনারী, শিল্পীরপথ, স্বপ্নেরউড়ান, বাধাভেঙেপথচলা, বাংলারগল্প, নারীরস্বাধীনতা, নৃত্যেরজীবন, সাংস্কৃতিকসংগ্রাম, অন্তর্দ্বন্দ্ব, তবলা_ও_নৃত্য

 

1000042716.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *