ঈশিতা মল্লিক
পর্ব ১
ঘড়িতে তখন ঠিক বারোটা। রোদটা ছিল না ঠিক চড়া, আবার ম্লানও না। একটা পাহাড়ি দুপুরের মধ্যে ঠিক যেমনটা আলোর আভা থাকে—নির্দিষ্ট কিছু নয়, নরম ছায়ার মতো। ঈরা জানালার কাঁচে কপাল ঠেকিয়ে বসে ছিল, গাড়ির প্রতিটা ঝাঁকুনি যেন তার বুকের ভেতরও কিছু একটা আলগা করে দিচ্ছিল। শিলিগুড়ি ছাড়িয়ে এখন পাহাড়ি রাস্তায় ঢুকে পড়েছে গাড়ি। সহযাত্রী দুজন—বাবা আর মৌদি—পেছনের সিটে ঘুমোচ্ছে, আর ঈরার হাতে ধরা নোটবুকের পাতায় শুধু একটা বাক্য লেখা: “এইবার পাহাড়ে শুধু মনটা নিয়ে যাবো, শরীরটা থাক না কোথাও গড়িয়ে।”
ঈরার পাহাড়ে আসা নতুন নয়। স্কুলের সময় থেকে টানা আট বছরে সে পাহাড়ে এসেছে দশবার। কিন্তু এইবার আলাদা। এইবার শুধু ভ্রমণ নয়, এইবার সে লিখতে এসেছে। ট্র্যাভেল ব্লগের জন্য না, ইনস্টাগ্রামে ‘পাহাড়ি ভোর’-এর হ্যাশট্যাগ জুড়ে দেবার জন্যও না। এইবার সে এসেছে একটা রুঢ় অথচ বাস্তব সত্য বুঝতে—মানুষ পাহাড়ে শুধু সৌন্দর্যের জন্য আসে না, আসে নিজেকে ভুলে যেতে।
মেঘলা বেনারসির মতো চুপচাপ বসে থাকা পাহাড় যেন ঈরার মধ্যেও একটা হারানো স্বরের সন্ধান জাগায়। তার নিজের মধ্যেই সে খুঁজে পেতে চায় একটা নতুন কণ্ঠ—একটা যাত্রার কাহিনি।
গাড়ির চালক বলল, “দিদি, এবার এক ঘণ্টা জার্নি, তারপর লাঞ্চ ব্রেক। এক জায়গা আছে, খুব সুন্দর—লোকজন কম যায়। চাইলে থামব।”
ঈরা প্রথমে কিছু বলল না। তারপর হঠাৎ যেন একটা টান অনুভব করে বলল, “হ্যাঁ, একটু থামা যাক। অন্য কোথাও নয়, ওই বাঁকের আগে যেটা বললেন—সেখানে।”
পাহাড়ি রাস্তার বাঁক গুলো এমনই—সোজা কিছু নেই। বাঁকের ওপারে কি আছে, কেউ জানে না। ঠিক তেমনই, ঈরাও জানত না এই থামার মধ্যে আছে এক পুরো গল্প—“ঘুংঘুরের আগে পাহাড়”-এর গল্প।
জায়গাটার নাম ছিল ‘চিলি ঝোর’। নামটা স্থানীয়, কিন্তু কোনো পর্যটন ম্যাপে নেই। ঈরা গাড়ি থেকে নেমে চারদিক দেখতে লাগল। বুনো ফুল, বাঁশঝাড়, একটা শুকনো ঝরনার চওড়া খাঁদ, আর খানিকটা ওপরে টিনের চাল দেওয়া একটা ছোট কাঠের ঘর। সেই ঘরের পাশে একটা বয়স্ক মানুষ বসে আছেন, পায়ের কাছে একটা সাদা মাটির হাঁড়ি আর হাতে বাঁশের বানানো একরকম বাজনা।
ঈরা আগ্রহ নিয়ে কাছে যেতেই তিনি মাথা তুলে বললেন, “আপনিও কি গান লেখেন?”
ঈরা অবাক। “না তো…মানে হ্যাঁ, মাঝে মাঝে কবিতা লিখি। আপনি জানলেন কী করে?”
“আপনার চোখ দেখে। পাহাড়ে যারা শুধু ছবি তুলতে আসে, তাদের চোখে দেখার গভীরতা থাকে না। কিন্তু যারা শুনতে চায়—তাদের চোখ অন্যরকম।”
ঈরা একটু হেসে বসে পড়ল। লোকটার মুখে একরকম শান্তি। সে বলল, “এই জায়গাটা খুব সুন্দর। কেউ আসে না?”
“না আসে না। কারণ এখানে ‘কিছু’ নেই। কিন্তু যাদের জীবনে কিছু হারিয়ে গেছে, তারা কখনও কখনও এসে বসে। আপনি এসেছেন কারণ আপনি লিখতে চান, কিন্তু আসলে আপনি খুঁজতে এসেছেন।”
ঈরার গলা শুকিয়ে গেল। সত্যিই তো, এত পাহাড়ে ঘুরে সে কিচ্ছু খুঁজে পায়নি। তার ভেতরে সেই শূন্যতা এখন এই চিলি ঝোরের কুয়াশায় আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
লোকটা একটা ছোট কাঠি দিয়ে হাঁড়ির মুখে ঠুকঠাক শব্দ করল—একটা তাল বাজল, যেন সেতারের প্রিলিউড।
“একটা মেয়ে ছিল এখানে, নাম ছিল চুনি। ঘুংঘুর পরত পায়ে। এই ঝরনার ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান গাইত। তার স্বর শুনলে পাহাড় থমকে যেত। একদিন সে হারিয়ে গেল। কেউ জানে না কোথায়। কেউ বলে, সে পাহাড়ে মিশে গেছে। কেউ বলে, সে শহরে চলে গেছে। কিন্তু আমি জানি, সে রোজ সন্ধেয় এখানে ফিরে আসে—কেউ না কেউ তাকে খোঁজে বলেই।”
ঈরা বলল, “আপনি তার কি হন?”
লোকটা মৃদু হাসল। “সে আমার গল্পের চেয়ে বড় কিছু। সে পাহাড়ের আত্মা। আপনি শুনবেন?”
ঈরা মাথা নাড়ল। হাঁড়ি থেকে তিনি একটা ছোট ঘুংঘুর বের করলেন। তার গলায় বাঁধলেন। ঘুংঘুরের শব্দ মিলিয়ে গেল ঝিরঝিরে বাতাসে।
“এই ঘুংঘুর আপনার জন্য। এটা পড়ে রাখবেন যতক্ষণ পাহাড়ে থাকবেন। আপনি যেহেতু গল্প খুঁজছেন, তাই পাহাড় আপনাকে ডাকবে—এই ঘুংঘুরের মাধ্যমে।”
ঈরার মনে হলো, যেন কোনো অদৃশ্য দরজা খুলে গেল। তার কাঁধের ব্যাগের ভেতরে রাখা নোটবুক যেন একা একাই ভারি হয়ে উঠছে। সে চুপ করে ঘুংঘুরটা হাতে নিল। মনে মনে লিখল—
“এই পাহাড়ের আগে, একটা মেয়ে ছিল
যে শুধু ঘুংঘুর পরে গান গাইত।
আর আমি এসেছি, সেই গানটা শুনতে…”
চিলি ঝোরের বাতাসে তখন শুধু একটা শব্দ বাজছিল—টানটান নিস্তব্ধতা আর তার ভেতরে এক জোড়া ঘুংঘুরের হালকা ঝনঝন।
পর্ব ২
ঈরা ঘুংঘুরটা হাতে নিয়ে বসে রইল অনেকক্ষণ। সে জানত না—এই পাহাড়ে এসে মাত্র দশ মিনিটেই সে এমন এক গল্পের মুখোমুখি হবে, যা তার ট্র্যাভেল নোটবুকে কখনও কল্পনাও করেনি। চিলি ঝোরের সেই বাতাস, পাহাড়ি বৃদ্ধের চোখে গাঢ় নিঃসঙ্গতা আর এই ঘুংঘুর—সবকিছু যেন মিলেমিশে এক অদৃশ্য সুতোয় তাকে টেনে নিচ্ছিল। হঠাৎ মৌদি আর বাবা নেমে এল গাড়ি থেকে। ঈরা সঙ্গে সঙ্গে ঘুংঘুরটা ব্যাগে গুঁজে ফেলল।
“তোর মুখ এতো গম্ভীর কেন? ভালো লাগছে না?”—মৌদি জিজ্ঞেস করল।
“না না, জায়গাটা একটু অন্যরকম লাগছে। শান্ত।”
“চা খাবি একটা?”—বাবা বলল।
“হ্যাঁ, খাই,”—বলেই ঈরা পাশের ছোট দোকানে গেল, যেটা ঝুপড়ি মতো করে বানানো। সেখানে দুটো ছোট বাঁশের চেয়ারে বসে তারা লাল চা খেতে খেতে গল্প করতে লাগল। কিন্তু ঈরার মন পড়ে রইল সেই বৃদ্ধ আর তার ঘুংঘুরের দিকে। দোকানদার বলল, “আপনারা ভাগ্যবান, আজ ঝরনার ধারে সন্ধের আগে কেউ আসে না। কিন্তু আজ সকাল থেকেই হাওয়া কেমন অদ্ভুত।”
ঈরা হঠাৎ বলল, “চুনি নামে কাউকে চিনেন এখানে?”
দোকানদার চমকে তাকাল। “আপনি চুনির কথা জানলেন কীভাবে? এখানে তো তার কথা কেউ বলে না।”
ঈরার গলা শুকিয়ে গেল। সে কিছু না বলে মাথা নাড়ল। দোকানদার বলল, “অনেক বছর আগে একটা মেয়ে ছিল এখানে, খুব সুন্দর গলা ছিল। সে নাচত আর গান গাইত। কিন্তু তার সঙ্গে কিছু একটা হয়েছিল। কেউ জানে না ঠিক কী। তবে হ্যাঁ, অনেকেই বলে, ঝরনার ধারে সন্ধের দিকে ঘুংঘুরের আওয়াজ শোনা যায়।”
ঈরার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। সে বলল, “সন্ধেবেলা কি কেউ এখানে থাকে?”
দোকানদার একটু চুপ করে বলল, “আমি থাকি না, বোন। পাহাড়ে কিছু জায়গা আছে, যেখানে মানুষ যত কম যায়, তত ভালো। কিছু স্মৃতি মানুষ রেখে দেয়, কিন্তু পাহাড় সেই স্মৃতিকে নিজের মতো সাজিয়ে রাখে।”
ঈরা ফিরে এসে গাড়িতে বসল, কিন্তু মনটা আর সহজে গাড়ির গতি নিতে পারছিল না। তারা উঠল পাশের পাহাড়ি হোমস্টেতে। জায়গাটার নাম ‘নীল আকাশ হিলটপ’। তিন তলা কাঠের বাড়ি, ওপরে খোলা ব্যালকনি আর চারপাশে চা বাগান। ঈরার রুমের জানালা দিয়ে পুরো উপত্যকার ভিউ দেখা যাচ্ছিল।
হোমস্টের কেয়ারটেকার মীরা বৌদি এসে চা দিল। সে হাসতে হাসতে বলল, “দিদি কোথা থেকে আসছেন?”
“কলকাতা থেকে। একটু পাহাড় দেখতে।”
মীরা বৌদি বলল, “পাহাড় শুধু দেখবার জিনিস না, শোনারও জিনিস। জানেন তো, এখানে রাতে মাঝে মাঝে সুর ভেসে আসে। কারও বাঁশি, কারও গান।”
ঈরা আর স্থির থাকতে পারছিল না। সে জানত, কিছু একটা আছে এই জায়গায়—কিছু যা তাকে খুঁজে আনছে, কিছু যা সে খুঁজে পেতে চায়। সন্ধে নামতেই সে জানালা খুলে বসল, চারপাশে কুয়াশার মতন আলো, দূরে ঝিঁঝিঁর ডাক, আর হালকা বাতাস। সে ব্যাগ থেকে ঘুংঘুরটা বের করে তাকিয়ে রইল। তারপর, একটা অদ্ভুত তাড়নায়, সেটা নিজের ডান হাতে বাঁধল। যেন এক অদৃশ্য চুক্তি করল পাহাড়ের সঙ্গে।
রাত আটটা। মা ফোন করলেন। কথা বলার সময় ঈরা বুঝতে পারল, বাইরে কিছু একটা বাজছে—একটা দুলুনির মতন সুর, যেন কেউ দূর থেকে গুনগুন করছে। সে চুপ করে রইল, ফোনটা রেখে সোজা বারান্দায় চলে এল। চারদিক নিস্তব্ধ, শুধু সেই সুর—দূরের চিলি ঝোরের দিক থেকে আসছে।
ঈরা কিছু না ভেবেই চাদর জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল। অন্ধকার, কিন্তু তার পা জানে কোনদিকে যেতে হবে। সে কেয়ারটেকারকে কিছু না বলে নিচের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগল। মোবাইলের টর্চ না জ্বালিয়েও সে দেখতে পাচ্ছিল সবকিছু—চাঁদের আলো, পাতার ছায়া, ঝিরঝিরে হাওয়া। ২০ মিনিট হাঁটার পর সেই চেনা জায়গায় পৌঁছে গেল—চিলি ঝোর। কিন্তু এবার বৃদ্ধটি নেই। ঝরনার জল শুকনো, কিন্তু সেই সুরটা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।
ঈরা দাঁড়িয়ে রইল। তার ঘুংঘুর হালকা শব্দ করল। হঠাৎ সে দেখতে পেল—একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে ঝরনার অপর পাশে। সাদা জামা, খোলা চুল, আর পায়ে ঘুংঘুর।
মেয়ে ভেসে গাইছে—
“জল ঘুমোয়নি আজ,
চোখ ভিজে গেছে পাথরে।
কে যে আসে সুরে সুরে,
চেনা নয়, তবু ফিরে ফিরে।”
ঈরার গলা শুকিয়ে এল। কে এই মেয়ে? সে কি চুনি? না কি চুনির গল্পের রূপ? আর কেনই বা সে ফিরে ফিরে আসে?
মেয়েটি চোখ তুলল, ঈরার চোখে চোখ রাখল। তারপর একটু হাসল। তার সেই হাসি—না ছিল ভয়, না ছিল আহ্বান। শুধু একটা শূন্যতা, যেন কোনো কথা বলতেই হবে না।
মেয়েটি বলল না কিছুই। শুধু হাত তুলে ঈরার ঘুংঘুরটার দিকে ইশারা করল। ঈরা বুঝে গেল, তার কাছেও হয়তো আছে বলার মতো কিছু, কিন্তু সেই বলাটা সুরে, শব্দে নয়—চুপচাপ অনুভবে।
ঈরা মনে মনে বলল, “তুমি কি চুনি? আমি কি তোমার গল্প লিখতে পারব?”
কোনো উত্তর এল না। মেয়েটি ধীরে ধীরে ঝরনার পাশ ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল। শুধু থেকে গেল সেই সুর—আর ঈরার গলায় চেপে বসা এক অজানা উত্তেজনা।
সে ধীরে ধীরে ফিরে এল হোমস্টেতে। কেয়ারটেকার দরজা খুলে বলল, “আপনি গিয়েছিলেন? ওইদিকে?”
ঈরা কিছু বলল না। শুধু ঘরে ঢুকে জানালার পাশে বসে নোটবুক খুলল।
“আজ রাতে চুনি গান গাইছিল। আমি শুনেছি।
কেউ বিশ্বাস করুক বা না করুক—পাহাড়ে যা ঘটে, তা লেখা হয় না, অনুভব করা যায়।”
পর্ব ৩
পরদিন সকালটা যেন স্বপ্নের মতো লাগছিল। জানালার ওপারে পাহাড়ের গায়ে রোদ ছড়িয়ে পড়েছে, বাতাসে শুঁকে নেওয়ার মতো সতেজতা। ঈরা ঘুম ভাঙার পর কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে বসে রইল। মাথায় তখনও আগের রাতের ঝরনার ধারে দেখা মেয়েটির মুখ। সে কি সত্যি? না কি ঘুম-জড়ানো মনের কল্পনা? কিন্তু ঘুংঘুর তো তার হাতে বাঁধা ছিল। আর সুরটা? সেই গান?
সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কুয়াশার ভেতর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রইল। পাহাড়ের একেকটা ঢেউ যেন নীরবে কিছু বলতে চাইছে। ঈরার চোখ আটকে গেল একটা জায়গায়—ঝরনার দিক থেকে হালকা ধোঁয়ার মতো কুয়াশা উঠছে, তার গায়ে রোদের আলতো ছোঁয়া। আর ঠিক সেই মুহূর্তে সে বুঝল—এই পাহাড় শুধু জায়গা নয়, এটা একটা জীবন্ত স্মৃতি।
ব্রেকফাস্টে বাবা খবরের কাগজে ডুবে ছিলেন আর মৌদি সোশ্যাল মিডিয়ায় আগের দিনের ছবি পোস্ট করছিল। ঈরা চুপচাপ চা খাচ্ছিল, কিন্তু তার মন অন্যখানে। হঠাৎ মৌদি বলল, “আজ তো টয় ট্রেন ধরার প্ল্যান ছিল, মনে আছে?”
ঈরা চমকে উঠল। “না না, আমি আজ থাকছি। তোমরা যাও। আমি একা ঘুরে আসি এখানে।”
বাবা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। জানতেন ঈরার যখন নিজের মতো থাকতে ইচ্ছে করে, তখন জোর করে কিছু বলা বৃথা। মৌদিও বুঝে গেল, ঈরার মধ্যে কেমন একটা পরিবর্তন ঘটেছে।
সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর ঈরা আবার সেই পুরনো নোটবুকটা হাতে নিল। কভারটা ঘষামাজা হয়ে গেছে, কিন্তু ভিতরের পাতা যেন নতুন নতুন কথা খুঁজছে। সে লিখল—
“ঘুংঘুর পরে যে গান গায়,
সে কি শুধু পাহাড়ের?
নাকি আমরাও কেউ কেউ
তার মতো হারিয়ে যেতে চাই?”
ঈরা এবার বেরিয়ে পড়ল আবার চিলি ঝোরের দিকে। দুপুর গড়িয়েছে, কিন্তু রোদটা নরম। পথে সে একজন বৃদ্ধাকে দেখতে পেলেন, যিনি কাঁধে কাঠের বোঝা নিয়ে পাহাড়ের ঢালুতে উঠছিলেন। ঈরা এগিয়ে গিয়ে বলল, “আপনি কিছু সাহায্য চান?”
বৃদ্ধা হাসলেন। “তুই তো শহরের মেয়ে, এই বোঝা বইবি?”
ঈরা বলল, “একটু বইতে পারি। আপনি চুনিকে চিনতেন?”
বৃদ্ধার মুখ থমকে গেল। তারপর ফিসফিস করে বললেন, “চুনির কথা আজও কেউ বলে?”
ঈরা মাথা নাড়ল। “আমি তাকে দেখেছি—অন্তত বিশ্বাস করি দেখেছি। তিনি কি… ছিলেন?”
“ছিল। একদম নিজের মতন ছিল। কথা কম বলত, কিন্তু গান গাইত মন ভরিয়ে। কেউ বলত ও পাগল, কেউ বলত সাধিকা। আমি বলতাম, ও পাহাড়ের মেয়ে—কারও না, সবার।”
ঈরা বলল, “তিনি কোথায় গিয়েছিলেন?”
বৃদ্ধা বললেন, “সেই উত্তর কেউ জানে না। শুধু জানি, সে যে গান গাইত, তা চুপচাপ পাতার নিচে থেকেও শোনা যেত।”
ঈরা বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করল, “মানে?”
“মানে, পাহাড়ের পাতারা কথা বলে। কিছু পাতা বাতাসে নড়ে, কিছু পাতা চুপচাপ গানের কথা জমিয়ে রাখে। তুই যদি মন দিয়ে শুনিস, তোর কানে পৌঁছবে।”
ঈরার গলা শুকিয়ে গেল। সে জানে, সে এবার একদম ঠিক পথে হাঁটছে। সে বৃদ্ধাকে ধন্যবাদ দিয়ে আবার ঝরনার পথে হাঁটতে লাগল। জায়গাটা যেন আজ একটু অন্যরকম লাগছিল। বাতাস ভারী, রোদ একটু সোনালি, আর গাছের পাতায় যেন হালকা দুলুনি।
ঝরনার ধারে এসে সে দাঁড়িয়ে রইল। কোনো চিহ্ন নেই সেই মেয়েটির, না ঘুংঘুরের। কিন্তু একটা ছায়া যেন পাতার ফাঁকে দাঁড়িয়ে—নির্বাক, নিঃশব্দ। ঈরা বসে পড়ল মাটিতে। সে চোখ বন্ধ করে দিল।
তখনই…
কান পাততেই সে শুনতে পেল হালকা একটা সুর। খুব দূরের, খুব মৃদু।
কেউ যেন গাইছে, ঠিক আগের রাতের মতোই।
কিন্তু এবার শুধু গান না, মাঝে মাঝে এক-একটা শব্দ ভেসে আসছে—
“শুধু পাহাড় নয়, আমি ছিলাম তোমার মধ্যেও…”
“তুমি যে লিখছো, তা আমি শুনছি।”
ঈরা চোখ খুলে তাকাল। সামনে মাটির উপর পড়ে আছে একটা পুরনো চিঠি। সাদা কাগজ, হাতে লেখা, পাতার নিচে চাপা ছিল।
সে কাঁপা হাতে সেটা তুলল। কাগজের গায়ে লাল কালি, লেখা মাত্র তিন লাইন—
“আমি ফিরে আসব, যখন কেউ আবার গান শুনতে চাইবে।
শব্দের চেয়েও গানের গুরুত্ব বেশি।
খুঁজো না আমাকে, খুঁজে নাও নিজেকে।”
ঈরা স্তব্ধ। এই চিঠি কি চুনির? না কি পাহাড়ের ভাষা?
সে কাগজটা ভাঁজ করে ব্যাগে রাখল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আবার গায়ে ঘুংঘুর বাঁধল। এবার যেন কোনও ভয় নেই, শুধু টান।
ফিরে আসার পথে সে নিজেকে অন্যরকম অনুভব করল। এমন কী যেন খুঁজে পেয়েছে, যা ব্যাখ্যা করা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়।
রাতে খাওয়ার পর মৌদি বলল, “তোর চোখে আজ অন্যরকম আলো, কী হল?”
ঈরা শুধু বলল, “আমি আজ পাহাড়ের গান শুনেছি। মানুষ যদি মন দিয়ে শোনে, তবে পাহাড়ও কথা বলে।”
মৌদি একটু অবাক হলেও আর কিছু বলল না। কিন্তু ঈরা জানত, চুপচাপ পাতার নিচে লুকিয়ে থাকা গান সে শুনে ফেলেছে। এবং সেই গানের সুর তাকে আরও কিছু বলবে—অদূর ভবিষ্যতে।
সে তার ডায়েরিতে লিখল—
“আজ আমি পাহাড়ের প্রথম গান শুনলাম।
কাল আমি তার গল্প খুঁজতে যাবো।
আর তারপর হয়তো খুঁজে পাবো—নিজেকে।”
পর্ব ৪
সকালের আলো এখনও পুরোপুরি ছড়ায়নি, অথচ ঈরা তখনই তৈরি হয়ে ফেলেছে। ব্যাগে নোটবুক, ঘুংঘুর, একটা ফ্লাস্কে গরম জল, আর সেই চিঠিখানা—যেটা সে পেয়েছিল গতকাল ঝরনার ধারে পাতার নিচে। মৌদি আর বাবা তখনও ঘুমিয়ে, হোমস্টের কেয়ারটেকার দরজা খোলার শব্দে একটু অবাক হয়ে বললেন, “এতো সকালে বেরোচ্ছেন?”
ঈরা বলল, “একটু হেঁটে আসি পাহাড়ে। গল্প খুঁজতে।”
“গল্প?”
“হ্যাঁ, যেগুলো মাটিতে পড়ে থাকে, কেউ তুলে নেয় না। আজ আমি সেগুলো খুঁজব।”
কেয়ারটেকার মাথা নাড়লেন। পাহাড়ের মানুষেরা অনেক কিছু জানেন, অনেক কিছু বলেন না।
ঈরা এবার অন্যপথে হাঁটল। চিলি ঝোরের বিপরীত দিকে একটা পুরনো, প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া পাহাড়ি পথ আছে—খুব কম মানুষ যায় ওদিকে। স্থানীয়রা বলে, আগে এখানে একটা ছোট গ্রাম ছিল, এখন তা প্রায় জনমানবশূন্য। হাঁটতে হাঁটতে ঈরার পা যেন নিজে নিজেই পথ খুঁজে নিচ্ছিল। গাছের ছায়া লম্বা হয়ে পড়েছে, মাটি ভেজা, আর বাতাসে একটা কাঁচা গন্ধ। কিছুদূর যাওয়ার পর একটা ছোট মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়ল। সিঁড়ি ভেঙে পড়েছে, দেয়ালে শ্যাওলা জমেছে, কিন্তু একপাশে একটা ঘন্টা এখনও ঝুলে আছে—মৃদু বাতাসে হালকা দুলে।
ঈরা থেমে গেল। ঘন্টার নিচে মাটিতে ছড়িয়ে রয়েছে কিছু পুরনো পাতা, শুকনো ফুল আর কয়েকটা ছোট পাথর। তার নজর আটকে গেল একটায়—একটা পাথরের গায়ে খোদাই করা ছোট্ট চিহ্ন, যেন কারও নাম লেখা ছিল, এখন মুছে গেছে। সে পাথরটা তুলে নিয়ে দেখল, নিচে চাপা পড়ে আছে এক টুকরো কাপড়—বেগুনি রঙের, ঘুংঘুর সেলাই করা।
তার বুক কেঁপে উঠল।
এটা কি চুনির ঘুংঘুরের অংশ? সে কি এখানে এসেছিল? কিংবা… এখানেই থাকত?
হঠাৎ পেছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর, “আপনি যদি গল্প খুঁজে থাকেন, তবে উঁচুতে উঠুন। ওখানেই সে শেষ গান গেয়েছিল।”
ঈরা চমকে পেছনে তাকাল। একজন মাঝবয়সী মহিলা দাঁড়িয়ে, পরনে কালো শাল, হাতে ঝুড়ি। তিনি পাহাড়ি উচ্চারণে বললেন, “চুনির কথা আপনি কোথায় শুনেছেন?”
ঈরা বলল, “আমি… আমি তাকে দেখেছি। একরাতে, ঝরনার ধারে… সে গান গাচ্ছিল।”
মহিলার মুখে বিস্ময়ের রেখা। “তাকে দেখতে পাওয়া যায় না, শুধু অনুভব করা যায়। আপনি যদি দেখে থাকেন, তবে বুঝতে পারবেন—তিনিই আপনাকে ডেকেছেন।”
“কে আপনি?”
“আমি তার সহপাঠিনী ছিলাম। ছোটবেলায় আমরা একসঙ্গে গান শিখতাম। সে খুব অন্যরকম ছিল। সে যা গাইত, তা লিখত না—সে বিশ্বাস করত, গান যদি মাটিতে পড়ে যায়, তবে পাহাড় তা তুলে রাখে।”
ঈরার চোখ ছলছল করে উঠল। “সে কি সত্যি কোথাও আছে?”
“সে গল্পে আছে, সুরে আছে, বাতাসে আছে। আপনি যদি খুঁজতে থাকেন, একদিন হয়তো তাকে ছুঁয়ে ফেলবেন, ঠিক যেমন আজ আপনি তার ঘুংঘুরের কাপড় খুঁজে পেলেন।”
ঈরা কাপড়টা আলতো করে হাতে তুলল। যেন অনেক বছর পর কিছু হারানো জিনিস ফিরে এলো তার কাছে। সে জানে না কেন, কিন্তু মনে হচ্ছিল তার জন্ম থেকে এই কাপড়টা তার জন্যই ছিল।
“উঁচুতে কোথায় যাবো আমি?”
মহিলা বললেন, “যেখানে সিঁড়ি নেই, কিন্তু পায়ের ছাপ আছে। সেখানে মানুষ যায় না, গল্প যায়। পাহাড়ের শরীরের উপরে আপনি সেই গল্পগুলো দেখতে পাবেন—যেগুলো কেউ লেখে না, শুধু রেখে যায়। আজ থেকে আপনিও একজন সংগ্রাহক। গল্পের পায়ে পড়ে আপনি হাঁটছেন।”
ঈরা ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠতে লাগল। সোজা পথ নয়, কিন্তু ক্লান্তিকরও না। যেন প্রতিটি পাথরে, প্রতিটি পাতায় কেউ তার জন্য চিহ্ন রেখে গেছে। খানিকটা উঠে সে একটা জায়গায় এল, যেখানে গাছগুলো বেঁকে আছে একদিকে, যেন বাতাস বারবার সেদিকেই বয়। ঠিক সেখানে এক গাছের গায়ে ছোট ছোট খোদাই—চিত্রলিপির মতো, পাহাড়ি ভাষায় লেখা কিছু।
সে হাতে ছুঁয়ে দেখল, এক লাইন বোঝা গেল—
“তুমি যদি শোনো, আমি আসব।”
ঈরার মনে হলো, ঠিক এই মুহূর্তে তার ডান হাতে বাঁধা ঘুংঘুরটা যেন নড়ে উঠল।
সে চারদিক দেখল—নীরবতা। শুধু বাতাস আর তার শ্বাসপ্রশ্বাস।
কিন্তু গাছের নিচে মাটিতে ছড়িয়ে থাকা শুকনো পাতার নিচে হঠাৎ চোখে পড়ল আরেকটা চিঠি।
সে কাঁপা হাতে তুলল।
লিখা—
“তুমি যেদিন পাহাড়ে এলেও ভাবো তুমি একা,
আমি তোমার পায়ের নিচে ছিলাম পাতার মতো।
এবার শুধু শোনো,
কারণ এবার গল্প আমার না—তোমার।”
ঈরা বসে পড়ল গাছের নিচে। আর কোনও প্রশ্ন নেই, কোনও ভয় নেই।
সে জানে, এই পাহাড়ে প্রতিটি দিন, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি পদক্ষেপ—একেকটা গল্প।
আর সেই গল্পের ভেতর দিয়েই সে লিখবে নিজের কথাও।
কারণ এই পাহাড় তাকে শুধু স্মৃতি দেয়নি, দিয়েছে একটা জীবনদর্শন।
সে ডায়েরি খুলে লিখল—
“আমি আজ প্রথমবার সত্যিকারের কোনও গল্পকে ছুঁতে পারলাম।
যেখানে পায়ে পড়ে গল্প, সেখানে উঠে দাঁড়ায় মানুষ।
আর আজ আমি দাঁড়িয়ে আছি পাহাড়ের গায়ে—
এক অনামা ঘুংঘুরের সুরে বাঁধা হয়ে।”
পর্ব ৫
ঈরা গাছটার নিচে বসে কাঁপা হাতে দ্বিতীয় চিঠিটা আবার পড়ল।
“তুমি যেদিন পাহাড়ে এলেও ভাবো তুমি একা,
আমি তোমার পায়ের নিচে ছিলাম পাতার মতো।
এবার শুধু শোনো,
কারণ এবার গল্প আমার না—তোমার।”
এই চারটি লাইন শুধু কবিতা নয়, যেন চুনির আত্মা তার ভেতরে ঢুকে গেছে শব্দের শরীর হয়ে। ঈরার বুকের ভেতর থেকে একরকম নীরব স্পন্দন শুরু হল—সেই স্পন্দন গান হয়ে উঠছে কি না, বোঝা গেল না, তবে শব্দের বাইরে কিছু একটা তৈরি হচ্ছিল নিঃশব্দে।
সে গাছটার গা থেকে পেছন দিকে তাকাল। উঁচু থেকে নিচের উপত্যকা দেখা যায়। দূরের পাহাড়ে সূর্যের আলো পড়েছে সোনালি ঢেউয়ের মতো, আর মাঝে মাঝে মেঘের ছায়া খেলে যাচ্ছে। তার মনে হল, এই জায়গায় দাঁড়িয়ে কেউ যদি খুব জোরে গান গায়, তবে সেই গান পুরো উপত্যকায় প্রতিধ্বনিত হবে। হঠাৎই মনে পড়ল—বৃদ্ধ লোকটা প্রথম দিন বলেছিলেন, “চুনি গান গাইলে পাহাড় থেমে যেত।”
সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। চারদিক নিস্তব্ধ। মোবাইল অফ। শব্দ নেই। শুধু তার ডান হাতে বাঁধা ঘুংঘুর।
সে চোখ বন্ধ করল। মনে মনে একটা সুর গুনগুন করল—সেই সুর, যেটা আগের রাতে মেয়েটি গেয়েছিল ঝরনার ধারে।
গলায় গরম কুয়াশার মতো এক টান অনুভব করল ঈরা। গলা দিয়ে যেন বেরিয়ে এল একটা শব্দ—অপরিচিত, অথচ নিজের।
“তুই যে গাইস চুপ করে,
সে সুর কানের ভেতরে
গলে গিয়ে, ছুঁয়ে যায়—
পাথরেরও অভ্যন্তরে।”
সে জানত না কোথা থেকে এল এই চার লাইন। এমনকি মনে হল, এই লাইনগুলো সে কখনও লিখেওনি, শুনেওনি। কিন্তু শব্দেরা তার শরীর ব্যবহার করে বেরিয়ে আসছে।
এই অনুভব—এই সুরের ভেতর শরীরের খেলা—তাকে ভরিয়ে দিল। যেন সে গানের মাধ্যমে চুনির শরীর স্পর্শ করল, তার নিঃশ্বাসে ঢুকে পড়ল সেই পাহাড়ি মেয়ের জীবন, যার ঘুংঘুর হারিয়ে গিয়েছিল কিন্তু গল্প থেকে মুছে যায়নি।
হঠাৎ বাতাস বদলে গেল। গাছের পাতা একসঙ্গে দুলে উঠল। যেন পাহাড় খুশি হয়েছে, কোনও এক চিরকালের দুঃখ আজ মুছে গেল।
ঈরা জানত, কিছু ঘটছে। সে নিচে নেমে এলো। এবার চিলি ঝোর নয়, বরং সে হোমস্টের উল্টো দিকে আরেক পুরনো কাঠের রাস্তা ধরল। স্থানীয়রা বলে ওদিকটা ‘মহারানি পথ’। ব্রিটিশদের সময় নাকি এক পাহাড়ি রাজার কন্যা ওদিক দিয়ে বনে বেড়াতে যেতেন, তার সঙ্গী থাকত এক সংগীতজ্ঞ।
ঈরা ভাবল, গান, পাহাড়, পথ—সবই এক সূত্রে বাঁধা।
হাঁটতে হাঁটতে একটা ছোট পুকুরের ধারে এসে সে বসে পড়ল। পুকুরে আকাশের ছায়া, আর তার গলা থেকে আবার ভেসে উঠল সেই অজানা গান—
“আমি যদি গান হয়ে যাই,
তবে তুই শুনবি কি শুধুই শব্দ?
না কি ধরবি আমার ঘ্রাণ,
আমার শরীরের ভেতর ঢুকে থাকা শোক?”
সুরটা নিজের থেকেই তৈরি হচ্ছে। ঈরা কিছু লিখছে না, শুধু গাইছে। তার নিজের কণ্ঠে সে যেন শুনতে পাচ্ছে দুই কণ্ঠের মেলবন্ধন—একটা তার, আরেকটা… হয়তো চুনির।
পুকুরের পাশ দিয়ে একজন লোক হেঁটে যাচ্ছিল, থেমে গেল। সে বলল, “এই সুর আমি আগেও শুনেছি। কিন্তু আপনি কবে গাইলেন?”
ঈরা বলল, “এই প্রথম।”
লোকটা বলল, “না। এই গান আমি ছোটবেলায় শুনতাম। আমার মা বলতেন, এক পাহাড়ি মেয়ে এই সুর গাইত পুকুরপাড়ে বসে। নাম ছিল চুনি। আপনি কি তার আত্মীয়?”
ঈরার গলা বন্ধ হয়ে এলো। “আমি জানি না। কিন্তু আমি ওকে খুঁজছি। হয়তো ও আমায় খুঁজছে।”
লোকটা কিছু না বলে চলে গেল। কিন্তু ঈরা স্থির হয়ে রইল। তার হাতে বাঁধা ঘুংঘুর এবার যেন নিজে থেকেই বেজে উঠছে—চুপচাপ, একটানা।
সে আবার ডায়েরি খুলে লিখল—
“আজ আমি গাইলাম, কিন্তু গলার শব্দ আমার ছিল না।
হাত নড়ল, কিন্তু লেখা যেন কারও অভ্যন্তর থেকে উঠে এলো।
এই পাহাড় আমার শরীর হয়ে উঠছে,
আর আমি তার ভেতর দিয়ে গান হয়ে যাচ্ছি।”
ঠিক তখনই তার কাঁধে হালকা হাত। পিছন ফিরে দেখল—এক কিশোরী, খুব শান্ত মুখ, হাতে একটা পুরনো বাঁশি। বলল, “তুমি গান গাও, তাই তো? আমি শুনতে চাই। কারণ আমার মা গাইত, আর তুমি সেই সুরেই গাও। তুমি তার মতোই বাজো। তোমার ঘুংঘুরও তো তারই মতো।”
ঈরা কিছু বলার আগেই মেয়েটি হেসে চলে গেল। তার চলাফেরায় এমন ছায়াময় হালকা ছন্দ, যেন সে গান হয়েই বাঁচে।
ঈরা হোমস্টেতে ফিরে এল। ডিনারে মৌদি জিজ্ঞেস করল, “তোর গলা এমন কেমন হয়ে গেল? কি করছিলি?”
ঈরা শুধু বলল, “গান গাচ্ছিলাম।”
“তুই তো কখনও গাস না! এতদিন কই শুনিনি?”
ঈরা বলল, “আমি গাই না ঠিকই। কিন্তু আজ গাইলাম। মনে হল শরীর নিজেই গান হয়ে গেল।”
রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ঈরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল। চাঁদ ছিল না, কিন্তু তারা ছিল। একটা তারা যেন একটু বেশি উজ্জ্বল। সে মনে মনে বলল—
“তুই যদি থাকিস, তবে আমি লিখে যাবো।
আর যদি না থাকিস, তবে তোর সুরে নিজেকে হারিয়ে ফেলব।
কারণ আমি এখন বুঝতে পারি,
সুর শুধু কানে নয়, শরীরেও জন্মায়।”
পর্ব ৬
সকালটা কিছুটা অদ্ভুত ভাবে শুরু হয়েছিল। হোমস্টের বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে ঈরার চোখে পড়ল—পাহাড়ের গা বেয়ে নিচে একটা সরু নদী বয়ে চলেছে। আগের ক’দিন এই নদী চোখে পড়েনি। কিংবা ছিলই না? হয়তো কুয়াশায় ঢাকা ছিল। অথবা, হয়তো সে এতদিন খুঁজে দেখেনি। কিন্তু আজ, খুব পরিষ্কারভাবে নদীটা দেখা যাচ্ছে—চোখের সামনে দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে একটা রুপালি রেখা, যেন পাহাড়ের শরীর ছুঁয়ে কানের কাছে ফিসফিস করছে।
ঈরা সিদ্ধান্ত নিল—আজ সে নদীর কাছে যাবে।
সে ব্যাগে ঘুংঘুরটা রাখল, নোটবুক, একটা কলম, জল আর শুকনো খাবার। বাবাকে শুধু বলল, “আমি নিচে একটু হেঁটে যাচ্ছি। নদীটা দেখতে চাই।” বাবা মাথা নাড়লেন। মৌদি একটু অবাক হয়ে বলল, “এই পাহাড়ে নদী আছে?”
“আছে,”—ঈরা বলল—“শুধু সবাই খেয়াল করে না।”
রাস্তা মসৃণ নয়। গাছের শিকড় বেরিয়ে এসে পথ আটকে রেখেছে, আর মাটির গায়ে শিশিরের আর্দ্রতা। কিন্তু ঈরার চলায় কোনো কষ্ট নেই। যেন সে জানে এই পথ তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পাখির ডাক ভেসে আসে, কিন্তু নদীর শব্দ সবচেয়ে স্পষ্ট—একটানা, মৃদু, গভীর।
প্রায় আধঘণ্টা হাঁটার পর সে পৌঁছল নদীর ধারায়। নদীটা পাহাড়ি ঝরনার মতো চঞ্চল নয়, বরং যেন বয়সে পরিণত নারী—ধীর, ধ্বনিময়, অথচ আত্মস্থ। পাথরের গায়ে গায়ে জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে, কোথাও ফেনা নেই, কোথাও জোর নেই, কিন্তু তার নিজের ভিতরের একটা ছন্দ আছে।
ঈরা নদীর ধারে বসে পড়ল। তার চোখে জল নয়, কিন্তু ভেতরে একরকম স্নান শুরু হয়েছে। সে মনে মনে ভাবল, এই নদী কি পাহাড়ের বেদনার ফসল?
ঠিক তখনই একটা কণ্ঠস্বর পেছন থেকে ভেসে এল, “এই নদীর নাম কেউ রাখেনি। কিন্তু সবাই তাকে ডাকে—‘চুনির জল’।”
ঈরা পিছন ফিরে তাকাল। সেই মাঝবয়সী পাহাড়ি মহিলা, যাকে সে আগেও দেখেছে। তার হাতে বাঁশের ঝুড়ি, চোখে গাঢ় শান্তি।
“আপনি আবার!”—ঈরা অবাক।
“আমি তো এখানেই থাকি, চুনির কাছাকাছি। আপনি তো তার গান গেয়েছেন… এখন তার চোখে জল দেখবেন।”
ঈরা বলল, “এই নদী… তার চোখের জল?”
“হ্যাঁ। যারা কষ্টে গলায় সুর পায় না, তারা চোখে জল ফেলে। আর সেই জল যদি পাহাড় ছোঁয়, তবে তা নদী হয়ে যায়।”
ঈরার শরীর হিম হয়ে এল। সে বুঝতে পারছিল না, কথা হচ্ছে মেটাফোরে, না বাস্তবতায়। কিন্তু কিছু একটা যেন প্রবাহিত হচ্ছিল তার ভিতর দিয়ে।
মহিলা বসে পড়লেন ঈরার পাশে। “তুমি জানো? চুনি একদিন এই নদীর ধারে বসেই নিজের শেষ গান গেয়েছিল। তারপর আর কেউ তাকে দেখেনি। কিন্তু নদী বয়ে যাচ্ছে—প্রতিদিন, নিরবধি। তার সুরগুলো জমা পড়ে এখানে।”
ঈরা নিচু গলায় বলল, “আমি কি শুনতে পারি?”
মহিলা মাথা নাড়লেন। “শুধু কান দিয়ে না, মন দিয়ে শোনো। চোখ বন্ধ করো। আর ঘুংঘুরটা বাঁধো পায়ে। সুর শুধু গলায় নয়, শরীরেও বাজে।”
ঈরা ধীরে ধীরে ডান পায়ে ঘুংঘুর বাঁধল। চোখ বন্ধ করল। নদীর শব্দটা যেন এবার অন্যরকম লাগছিল—একটা দুলুনি আছে, একটানা ঢেউয়ের মতো, যার ভিতর সুর ভেসে আছে। খুব ক্ষীণ… খুব দূর থেকে কেউ যেন গাইছে—
“পাথরের নিচে শব্দ জমে,
পাতায় জমে চিঠি,
নদী শুধু বইতে জানে,
আর গায় না কোনও পঙ্ক্তি।”
ঈরার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। মেয়েটা আবার কথা বলছে। না, এবার গান নয়, যেন নিজের ভিতরের কথা।
সে চোখ খুলে দেখল—নদীর ওপারে একটা ছোট পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সেই সাদা পোশাক পরা মেয়ে। এবার তার মুখ আরও স্পষ্ট। বয়স? হয়তো ষোল বা আঠারো। চুল খোলা, চোখে তীব্র কষ্ট আর প্রশান্তি মিশ্রিত এক অদ্ভুত দৃষ্টি। সে কিছু বলল না, শুধু ঈরার দিকে তাকিয়ে ঘাড় নেড়ে ইশারা করল—লিখো।
ঈরা ব্যাগ থেকে নোটবুক বের করল। তার আঙুল চলতে লাগল—
“আজ নদীর জলে আমি সুর খুঁজলাম না।
খুঁজলাম একটা মুখ—যেটা কথা বলে না,
শুধু বলে—‘তুমি কি সত্যি শুনতে চাও?’
আর আমি লিখে ফেললাম,
সুর নয়, শরীরের শব্দ।”
চোখ তুলে দেখল—মেয়েটি নেই। নদী শুধু বইছে। সেই মহিলাও নেই। চারদিক শুনশান, শুধু পাথরে জল ছোঁয়ার শব্দ।
ঈরা উঠে দাঁড়াল। সে জানে না এই অভিজ্ঞতা কাকে বলবে, বা আদৌ বলবে কি না। কিন্তু তার ভিতরটা যেন আলোকিত হয়ে উঠেছে। সে নদীর দিকে ঝুঁকে এক মুঠো জল তুলে নিল। ঠোঁটে ছোঁয়াল। স্বাদ নেই, গন্ধ নেই। কিন্তু অনুভব আছে।
ফিরে আসার পথে তার মনে হল, আজকের দিনটা শুধু নদীর সঙ্গ না, নিজের সঙ্গও ছিল। চুনির সাথে তার যে যোগ, তা শুধু অতীতের নয়—তা বর্তমানেরও। এই পাহাড়ে সে একা নয়, এই নদী তার জন্য গান ধরে রাখছে।
রাতে ঘরে ফিরে সে জানালার পাশে বসে চুপচাপ আকাশ দেখছিল। মোবাইল এখন অফ। সে চাইছে না কিছু পোস্ট করতে, কারও সাথে শেয়ার করতে। এই অনুভব ব্যক্তিগত। খুবই নিজের।
সে লিখল—
“আমি চুনিকে দেখি না এখন,
আমি নিজেকেই দেখি।
যে নিজের মতো শুনতে পারে,
আর চুপ করে জানে—
পাহাড়ের নিচে যে নদী,
সে আর কাঁদে না,
সে শুধু বয়ে যায়…
আর আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।”
পর্ব ৭
ঈরা জানালার পাশে বসে আরও একবার নদীটার দিকে তাকাল। দূরে, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সেই রুপালি রেখা যেন ক্রমে মিলিয়ে যাচ্ছে সবুজে। চাঁদের আলোয় কুয়াশা জমেছে, তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে সেই শান্ত নদী, যার বুকে জমা পড়ে আছে কোনো এক মেয়ের অনুচ্চারিত সুর।
ঘরে ফেরার পর থেকে ঈরা কথা বলছে কম, হাসছে আরও কম, কিন্তু তার চোখে এমন একটা আলো এসেছে, যেটা মৌদি এর আগে কখনও দেখেনি। রাতের খাওয়ার পর মৌদি জিজ্ঞেস করল, “তুই ঠিক আছিস তো?”
ঈরা মাথা নাড়ল। “আমি আগের থেকে বেশি ঠিক আছি। আমি জানি না কেন, কিন্তু মনে হচ্ছে আমি এখন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে, যেটা কারও না—আমারও না—কিন্তু আমি এখানেই ঠিক।”
মৌদি আর কিছু বলল না। ঈরা আবার নিজের ঘরে ফিরে এল। ঘরের দেয়ালে ছায়া পড়েছে গাছের পাতার, হাওয়ায় দুলছে ঘুংঘুর বাঁধা তার ডান হাত। ঘুংঘুর—যেটা সেদিন বৃদ্ধ লোকটা দিয়েছিলেন—এখনও ঠিকভাবে বাঁধা, কিন্তু আজ হঠাৎ করেই তার মনে হল এটা যেন একটু আলগা হয়ে এসেছে।
সে ধীরে ধীরে সেটা খুলে তার বিছানার পাশে রাখল। ঘুংঘুরের গায়ে জমে থাকা ধুলো, তার নিজের হাতের গন্ধ, চুনির চিঠি, নদীর শব্দ—সব যেন মিলেমিশে একসঙ্গে বেঁধে ফেলেছে তাকে এই পাহাড়ের গল্পে।
ঘুম আসছিল না। সে নোটবুক খুলে লিখতে শুরু করল—
“আমি বুঝতে পারছি, প্রতিটি পাহাড় তার বুকে একেকটা চুপ থাকা চিৎকার লুকিয়ে রাখে।
কেউ গান হয়ে ওঠে, কেউ চিঠি হয়ে হারিয়ে যায়।
আর কেউ কেউ, শুধু ঘুংঘুর পরে গল্প হয়ে বেঁচে থাকে।”
লিখে রাখা শেষ হয়নি, এমন সময় জানালার বাইরে এক মৃদু শব্দ—ঘুংঘুরের।
সে চমকে উঠল। বাইরে কেউ হেঁটে যাচ্ছে? এই গভীর রাতে?
ঈরা ধীরে ধীরে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। অন্ধকার, ঠান্ডা হাওয়া, আর সেই শব্দ—চেনা, হালকা ঝনঝন। কে যেন পাহাড়ের গায়ে নেমে চলেছে ঘুংঘুর পরে।
সে আর দেরি করল না। সোয়েটার জড়িয়ে মোবাইল ছাড়া ব্যাগটা কাঁধে ফেলে বেরিয়ে পড়ল। এই রাতে কেউ নেই রাস্তায়। কুয়াশা এমনভাবে জমেছে যেন গায়ের ওপর একটা পাতলা সাদা চাদর। পায়ের নিচে পাতা ভেঙে যাচ্ছে মৃদু আওয়াজে, যেন সেই পাতাগুলোর ভেতর থেকেও কারও গান বাজছে।
সে চলল চিলি ঝোরের দিকে। ঝরনা শুকনো, কিন্তু মনে হলো সেখানেই যাবে সেই ঘুংঘুরের শব্দ। এবং হ্যাঁ, দূর থেকে দেখা গেল—ঝরনার একপাশে দাঁড়িয়ে এক ছায়ামূর্তি, পায়ের কাছে কিছু একটা পড়ে আছে।
ঈরা দৌড়ে গেল। কিন্তু কাছে পৌঁছে কেউ নেই।
শুধু পড়ে আছে—তার সেই ঘুংঘুর। যে ঘুংঘুরটা সে বিছানার পাশে রেখেছিল, এখন পড়ে আছে এখানে।
কিন্তু এটা কিভাবে এল?
সে কুড়িয়ে নিল ঘুংঘুরটা। এবার তার মনে হচ্ছিল এই ছোট জিনিসটা শুধু অলঙ্কার নয়, এটা এক ধরনের চাবি—যে চাবি দিয়ে চুনি তার জীবনের দরজা খুলে যেতে চায়।
ঈরা ধীরে ধীরে বসে পড়ল। বাতাস থেমে গেছে, ঝরনার পাশে এখনো জল নেই, কিন্তু মনে হচ্ছে গভীর নিচে কিছু একটা চলতে শুরু করেছে।
সে চোখ বন্ধ করল।
“ঘুংঘুর হারিয়ে যাওয়ার আগে,
আমি তাকে পায়ে পরেছিলাম।
সে আমাকে গান শিখিয়েছিল না,
শুধু শিখিয়েছিল—নীরবতায় কীভাবে শরীর নড়ে।”
একটা মুহূর্তে মনে হল, কেউ যেন তার কাঁধ ছুঁল। চোখ খুলে দেখল—না, কেউ নেই। কিন্তু বাতাস ভারি। একরকম ছায়া যেন জমে উঠছে চারপাশে।
মাটি ছুঁয়ে থাকা পাথরে লেখা একটা বাক্য—আঙুল দিয়ে কেউ যেন লিখে গেছে—
“আমি এবার সত্যি যাবো।
কিন্তু তুই তো শুনে ফেলেছিস।
তোর লেখা থেকে কেউ আমাকে হারাতে পারবে না।”
ঈরার চোখে জল এসে গেল। তার মনে হল চুনি তার দায়িত্ব দিয়ে গেল—এই পাহাড়, এই নদী, এই সুরগুলোকে সে সংরক্ষণ করবে। কণ্ঠ দিয়ে নয়, কলম দিয়ে। অথবা, শুধু অনুভব দিয়ে।
সে উঠে দাঁড়াল। এবার তার হাতে ঘুংঘুর নেই। সে নিজের চেয়ে হালকা বোধ করল। যেন শরীর থেকে কিছু একটা খসে গিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে, কিন্তু সেই খালি জায়গা ভরেছে এক গভীর আলোয়।
ফিরে আসার সময় সে শেষবারের মতো পিছন ফিরে তাকাল চিলি ঝোরের দিকে। ভোরের আলো পড়ছে আস্তে আস্তে, পাখির ডাক, হাওয়ার নরম শব্দ—সব একসঙ্গে বলছে, “তুই পারবি, তুই লিখবি।”
হোমস্টেতে ফিরে আসার সময় কেয়ারটেকার দরজা খুলে বলল, “আপনি এত ভোরে গেলেন কোথায়?”
ঈরা বলল, “একটা জায়গায়, যেখান থেকে গল্পেরা ফিরতে চায় না।”
সে ঘরে ঢুকে ডায়েরি খুলল।
প্রথম পাতায় বড় করে লিখল—
“ঘুংঘুর হারিয়ে যাওয়ার আগে,
কেউ একটা শেষবার গেয়েছিল।
আমি শুনেছি। আমি লিখছি।”
পর্ব ৮
তিন দিন কেটে গেছে। সময় চলে গেছে নদীর মতো, কারও অপেক্ষা না করে। পাহাড় একইরকম রয়ে গেছে, শুধু ঈরার ভেতরটা বদলে গেছে একেবারে। এখন সে কম কথা বলে, অনেক শোনে। কম লেখে, কিন্তু গভীর থেকে লেখে। মৌদি একবার জিজ্ঞেস করেছিল, “তুই কি ঠিক আছিস?” — ঈরা হেসে বলেছিল, “না, আমি এখন ঠিক নেই। কিন্তু ঠিক হয়ে যাবো। কারণ এখন আমি জানি, আমি কেন এসেছিলাম।”
সেদিন ভোরবেলা, ঈরা বারান্দায় বসে চুপ করে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার ব্যাগ গুছোনো। আজই তারা ফিরবে কলকাতায়। নিচে পাহাড়ি গাড়ি দাঁড়িয়ে, বাবা ট্যাক লাগাচ্ছেন, মৌদি ফোনে কাউকে জানাচ্ছেন ‘চলে যাচ্ছি’। কিন্তু ঈরা কিছু বলছে না। সে শুধু চুপ করে একটা কাজ করছে—ডায়েরির শেষ পাতায় লিখছে—
“পাহাড় আমাকে একটা ঘুংঘুর দিয়েছিল।
আমি তাকে গান দিয়ে ফিরিয়ে দিলাম।
এই বদলটা ঠিক সমান না,
কিন্তু অনুভবটা ভারী—একান্ত নিজস্ব।
আমি ফিরে যাচ্ছি, কিন্তু আমার ভেতর কেউ রয়ে যাচ্ছে—
এক পাহাড়ি মেয়ে, যার গলায় সুর ছিল
আর পায়ে ছিল গল্প।”
বেরোনোর আগে সে আর একবার চিলি ঝোরে যেতে চাইল। সবাই রাজি হল না, কিন্তু ঈরা বলল, “একবার যেতে হবে। শেষবার।”
চিলি ঝোরের সেই শুকনো ঝরনা, সেই বাঁশঝাড়, সেই পুরনো কাঠের ঘর—সব একই আছে। শুধু বদলে গেছে ঈরার চোখ। আজ সে সুর খুঁজছে না, গল্পও না—সে শুধু বিদায় জানাতে এসেছে।
সে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তার হাতে বাঁধা ছিল না ঘুংঘুর। সেটা সে রেখে এসেছিল ঝরনার ধারেই—সেই জায়গায়, যেখানে সে প্রথম বার চুনির গান শুনেছিল। যেন প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিল—এই ঘুংঘুর এখন আমার নয়।
হঠাৎ এক ঝলক হাওয়া এল। পাতার ফাঁকে দিয়ে রোদ এসে পড়ল তার কপালে। আর ঠিক তখনই কোথা থেকে যেন একটা মৃদু শব্দ—চেনা, একদম চেনা—ঘুংঘুরের।
ঈরা অবাক হয়ে চারদিক তাকাল। না, কেউ নেই। শুধু বাতাস, শুকনো পাতা, আর অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা। কিন্তু সেই নিস্তব্ধতার মধ্যেই আজ একটা অনুভব—চুনির উপস্থিতি।
সে ডায়েরি খুলে লিখল—
“তুই যদি এখনো থেকিস, আমি জানি তুই শুনছিস।
আমি সব লিখে ফেলব না,
কিছু রেখে দেবো বাতাসের জন্য,
কিছু রেখে দেবো পাতার ফাঁকে।
আর কিছু রেখে দেবো পাহাড়ের বুকের নিচে—
যেন কেউ একদিন এসে
সেই ঘুংঘুরের শব্দে নিজেকে খুঁজে পায়।”
নেমে আসার সময় ঈরা থেমে গেল সেই গাছটার নিচে, যেখানে সে প্রথম চিঠিটা পেয়েছিল। পাথরের ফাঁকে এবার আর কোনো চিঠি ছিল না, কোনো শব্দ ছিল না, শুধু তার নিজের প্রতিচ্ছবি।
সে জানে, তার ভেতর চুনি নেই—সে নিজেই চুনির সুর হয়ে গেছে। আর এই পাহাড়ের গায়ে তার একটা ছায়া রয়ে গেছে চিরদিন।
কলকাতায় ফেরার ট্রেনটা ছিল রাত আটটার। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ঈরা একবার পেছন ফিরে তাকাল—না পাহাড় নেই, না নদী। আছে শুধু শহরের কোলাহল, ব্যস্ততা, হাঁসফাঁস করা বাতাস। কিন্তু তার ব্যাগের ভিতরে একটা ছোট্ট ডায়েরি, আর হৃদয়ের গহীনে একটা দীর্ঘশ্বাস।
মৌদি বলল, “তুই এবার আবার সেই আগের রুটিনে ফিরবি?”
ঈরা হেসে বলল, “হয়তো ফিরব। কিন্তু আগের মতো আর কিছুই হবে না। কারণ এবার আমি একটা সুর সঙ্গে নিয়ে ফিরছি।”
ট্রেন চলতে শুরু করল। জানালার পাশে বসে ঈরা শেষবারের মতো ডায়েরিটা খুলল। নিজের লেখা পড়ে সে যেন নিজেকেই চিনতে পারল না। কবে লিখেছে, কীভাবে লিখেছে—সেটা মনে নেই। শুধু মনে আছে, এই লেখা তার গলার কণ্ঠস্বর নয়—তার অভ্যন্তরের সুর।
ট্রেন ছুটছে। জানালার কাচে রাতের আলো, স্টেশনের নামগুলো এক এক করে হারিয়ে যাচ্ছে।
ঈরা চোখ বন্ধ করল।
আর তার কানের পাশে ভেসে এল এক পরিচিত শব্দ—
ঘুং…ঘুং…
আর কিছু নয়।
শুধু একটা মৃদু সুর, যেন বলছে—
“তুই লিখে ফেলেছিস।
এবার আমি হারিয়ে যেতে পারি।”
ঈরা হাসল। শান্ত এক হাসি।
তার ঠোঁটে কোনও শব্দ নেই, কিন্তু মনের ভেতর একটা গান বেজে চলেছে।
শেষ




