Bangla - সামাজিক গল্প

ঘরহারা মানুষের ঘরকথা

Spread the love

সৌম্যজিৎ বসু


অধ্যায় ১:

কলকাতার শহরটা যখন প্রথম সূর্যকিরণে লালচে আভা পেতে শুরু করে, তখনও ময়লা পলিথিন, ইটের টুকরো আর টিনের ছাউনি ঘেরা বস্তি ঘুম থেকে পুরোপুরি জাগেনি। তবে বস্তির মধ্যে কুমুদ আগেই জেগে উঠেছে। চারদিকে নিস্তব্ধতা, কেবল দূর থেকে হালকা করে শোনা যায় ট্রামের ঘণ্টার টুং টুং শব্দ, আর মাঝে মাঝে কোনো বাসের গর্জন। কুমুদ একহাত দিয়ে চোখের ঘুমের ছাপ মুছে নিয়ে অন্য হাতে চোঙা প্যান্টটা ঠিক করে পরে নেয়। গায়ে পরনের ছেঁড়া গেঞ্জিটা রাতের ঘাম আর বস্তির ধুলোবালিতে আরও বিবর্ণ হয়ে গেছে।

সে জল আনার পিতলের কলসি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে, সরু গলিটা পেরিয়ে পাশের পাম্পের দিকে। পাম্পের চারপাশে ইতিমধ্যেই কয়েকজন মেয়ে ভিড় করেছে, লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লতিকা তখনও ঘরের ভিতরেই, শিবুর জন্য টিফিন তৈরি করছে। হাঁড়িকুঁড়ির মধ্যে ভাত আর ডালের গন্ধ মিশে বস্তির বাতাস ভারি করে তুলেছে।

কুমুদ পাম্পের কাছে পৌঁছে দেখে, বস্তির পুরনো বুড়ি জামিলা মাসি বসে কুলুখাচ্ছে আর ফিসফিস করে কিছু বলছে পাশের রমজানকে। কুমুদ কৌতূহলী হয়—“মাসি, কীর কথা বলছ?”

জামিলা মুখ তুলে তাকিয়ে বলে, “আর বলিস না কুমুদ, আজ ভোরবেলায় দেখলি না? কতগুলো অজানা লোক এসেছিল পাড়ার মধ্যে! নাপিতপাড়ার কোণায় গিয়ে মাপজোক করছে। একদম ঠুকে ঠুকে মাটিতে লাঠি বসিয়ে পরিমাপ করছে। তোর মাথা খারাপ নাকি? কিছু টের পাচ্ছিস না?”

কুমুদের মনে হঠাৎ কাঁপুনি ধরে। এই শহরে গরীবের বাসস্থানের মাপজোকের মানে একটাই—কোনো নতুন প্রকল্প হবে, আর তাদের ঘর হারানোর দিন ঘনিয়ে এসেছে।

কলসি ভর্তি করে জল নিয়ে সে দ্রুত ঘরে ফিরে আসে। লতিকা তখন শিবুর স্কুলের পোশাকটা হাত দিয়ে ধুলোর দাগ ঝাড়ছে। শিবু ঘুমকাতুরে চোখে বসে আছে, ভাতের থালাটা সামনে রাখা।

“লতিকা, কই শোন, আজ অজানা কিছু লোক পাড়ায় ঘুরছিল। মাপজোক করছে। মনে হচ্ছে আবার…” কথা শেষ করতে পারে না কুমুদ। লতিকা থমকে যায়, হাতের থালা নেমে যায় মাটিতে।

“নতুন প্রকল্পের নাম করে আবার ঘর ভাঙবে নাকি? এতো কষ্টে ঘরটা করেছি আমরা… এবার কোথায় যাব কুমুদ?”

কুমুদ মুখ নিচু করে বসে পড়ে। ওর মাথায় তখনই ভেসে ওঠে সেই বস্তি ভাঙার ছবি—যখন প্রথম এখানে ঘর বানিয়েছিল তারা, তখনও এমন একবার বুলডোজার এসেছিল।

ঘরের ভেতর ছাউনির ফাঁক দিয়ে সকালে রোদের চিকচিক করে ঢুকে পড়ছে। সেই আলোর রেখা ধরে শিবু অন্যমনস্ক হয়ে বাইরে তাকায়। তার বয়স মাত্র ১০, কিন্তু সে ইতিমধ্যেই এই বস্তির দারিদ্র্য, অস্থিরতা চিনে গেছে।

এরই মধ্যে বস্তির অন্য ঘরগুলো থেকেও শব্দ আসতে থাকে। কেউ কেউ কল থেকে জল বয়ে আনছে, কেউ বাজারে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে, কেউ বা লালমাটির মাটিতে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেলছে।

একটু পরে, কুমুদ বাইরে বেরোতেই দেখে কিছু লোক আবার ফিরে এসেছে। তাদের পরনে আধা-প্যান্ট, টিশার্ট, কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো। হাতে নোটবুক, টেপ মাপার ফিতে। তারা প্রতিটি ঘর, প্রতিটি রাস্তা মেপে যাচ্ছে। তাদের মুখ গম্ভীর। কারো চোখে করুণা নেই, কেবল কাজের তাগিদ।

“দাদা, আমাদের ঘর মাপছেন কেন?” সাহস করে জিজ্ঞেস করে কুমুদ।

লোকগুলো একরকম বিরক্ত মুখে উত্তর দেয়, “উন্নয়ন প্রকল্প হবে। সরকারি নির্দেশে কাজ চলছে। আপনারা ভয় পাবেন না, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হবে।”

কুমুদ বোঝে, এতো সহজে ভয় না পাওয়ার কথা বলা যায়, কিন্তু যে মাথার উপর ছাদের কথা ভাবছে প্রতিদিন, তার কাছে এই কথা সান্ত্বনা নয়, বরং অশনি সংকেত।

লতিকা বেরিয়ে এসে কুমুদের পাশে দাঁড়ায়। তারা দুজনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। বস্তির মানুষজনও জড়ো হয়ে যায়, সবাই মাপজোক দেখতে থাকে, আর বুকের ভেতর শঙ্কা জমতে থাকে।

অধ্যায় ২: 

সকালটা কেটে গেল দুশ্চিন্তায়। কুমুদ আর লতিকা কিছুতেই মন বসাতে পারছে না। শিবু স্কুলে গেল, তবে যাওয়ার সময় বারবার পিছনে তাকিয়ে দেখল বাবা-মায়ের মুখের উদ্বেগের রেখা। বস্তির বাতাসেই যেন আজ অজানা অস্থিরতা, যেন এই পলিথিন আর টিনের ছাউনি ঘেরা ঘরগুলো আজ কোনও এক অদৃশ্য ঝড়ে উড়ে যাবে। কুমুদ কাজের খোঁজে বেরিয়েছিল, কিন্তু বাজারের পাশের হোটেলের মালিক জানিয়ে দিল, “আজ দরকার নেই কুমুদ, কাজ কম।” এর মানে আজ মজুরি নেই, আর রাতের খাবারে আরও টান পড়বে। তবু কুমুদ সারাদিন ঘুরল, একবার বাজার, একবার ট্রেনের ধারে, একবার কারখানার গেটের সামনে। কোথাও কোনও কাজের হদিস পেল না। বিকেলে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে এল সে। লতিকা ততক্ষণে একবাটি জল দিয়ে গরম চা বানিয়ে রেখেছে। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে কুমুদ চুপচাপ বসে থাকে, আর ভাবে, “যদি ঘরটাই না থাকে, তবে এই চা, এই বসা, এই সংসার—সব কিসের জন্য?” লতিকা একদিকে রান্নার হাঁড়ি নাড়ছে, একদিকে কুমুদের দিকে নজর রাখছে। ততক্ষণে চারপাশের ঘরগুলোতেও ফিসফাস শুরু হয়েছে। অনেকে এসে কুমুদের ঘরের সামনের উঠোনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।

“কাল নাকি নোটিশ পড়ানো হবে,” বলল ফতেয়া, বস্তির এক যুবক, যার চোখে সর্বক্ষণ বিদ্রোহের ঝিলিক। “সকালেই মিউনিসিপ্যালিটির লোক আসবে। শুনলাম সাত দিনের সময় দেওয়া হবে বস্তি ছাড়ার জন্য। এরা নাকি বলছে, এখানে নতুন কমপ্লেক্স হবে, শপিং মল হবে। আর আমরা? ফুটপাতে পড়ে থাকব?” ফতেয়ার গলায় রাগের সুর। কুমুদ চুপচাপ শোনে। তার মনের ভেতর কেমন যেন একটা ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হচ্ছে। সে জানে, এই বস্তি ছাড়া আর কোনও জায়গা নেই তাদের থাকার। শহরের অন্য বস্তিগুলোতেও জায়গা নেই, আর ওই ফুটপাতের জীবন যে কতখানি অমানবিক, তা ও নিজেই জানে। হঠাৎ করেই মনে পড়ে যায়, এই ঘরের দেয়ালে শিবুর প্রথম আঁকা ছবি, এই উঠোনেই শিবু হাঁটতে শিখেছিল। লতিকা পাশ থেকে বলে ওঠে, “এতো বড় বড় বিল্ডিং হবে, আমাদের জন্য একটা ঘরও থাকবে না? এতদিন ধরে এই মাটিতে আমরা কত খেটে ঘর করেছি। সরকারের কি কোনও দয়া নেই?” মানুষজন জড়ো হতে থাকে আরও। চারপাশে ভিড় জমে। কারও মুখে ভয়, কারও মুখে হতাশা, কারও মুখে ক্রোধ। বাচ্চারা চুপচাপ মা-বাবার হাত ধরে থাকে। বস্তির বাতাস ভারি হয়ে ওঠে মানুষের উদ্বেগে।

সন্ধ্যায় মিউনিসিপ্যালিটির গাড়ি আসে। বড় বড় কাঁচের গাড়ি, গায়ে লাল রঙে লোগো আঁকা। কিছু আধিকারিক নেমে আসে, হাতে ফাইলের বান্ডিল। তারা বস্তির মানুষদের একত্র করে। এক অফিসার চশমা চোখে কাগজ খুলে পড়তে থাকে, যেন কোনও আবেগ নেই তার কণ্ঠে—শুধু কর্তব্য পালন করছে। “এই বস্তি এলাকার ওপর উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে বস্তি খালি করতে হবে। সরকার পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে। প্রকল্পের কাজে সহযোগিতা করুন।” অফিসারের মুখে কোনও করুণার ছাপ নেই, কেবল গড়গড়িয়ে পড়ে যাওয়া বাক্য। কথা শেষ করে তারা গাড়িতে উঠে চলে যায়। কাগজের নোটিশ গেঁথে দেওয়া হয় বাঁশের খুঁটির গায়ে, পলিথিনের ঘরের পাশে। মানুষ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, শুধু বাতাসে নোটিশের কাগজটা ফড়ফড় করে উড়তে থাকে। কুমুদ আর লতিকা দু’জনেই সামনে এগিয়ে নোটিশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কাগজের অক্ষরগুলো যেন শূল হয়ে বুকে বিঁধে যায়। সাত দিনের মধ্যে তাদের স্বপ্নের, শ্রমের, আশ্রয়ের, ভালোবাসার ঘর ছেড়ে দিতে হবে। বাচ্চারা চুপচাপ, বড়রা হতবাক, আর বুড়োরা মাটিতে বসে কপালে হাত দিয়ে শুধুই শূন্যে তাকিয়ে থাকে।

রাতে বস্তির মধ্যে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। চাঁদের আলো পলিথিনের ছাউনিতে চিকচিক করে, আর টিনের ছাদের ফাঁক দিয়ে তারার আলো ঢোকে। কিন্তু আজ সেই আলো যেন আরও নিঃসঙ্গ, আরও শীতল। লতিকা কুমুদের পাশে বসে চুপ করে থাকে। শিবু ঘুমিয়ে পড়েছে মায়ের কোলে মাথা রেখে। কুমুদ বাইরে বেরিয়ে দাঁড়ায়। পা দিয়ে আলগা মাটি ঘষে, যেন এই মাটি আঁকড়ে ধরতে চায় সে। হাওয়া বইছে আস্তে আস্তে, সেই হাওয়ায় নোটিশের কাগজটা বারবার সরে যায়, আবার থেমে যায়। দূরে বড় বড় আলোয় ঢাকা বিল্ডিংয়ের দিকে তাকায় কুমুদ। ভাবে, “ওদের আলো যত উজ্জ্বল হয়, ততই যেন আমাদের অন্ধকার ঘনায়। এই শহর কি শুধু বড়লোকের? আমাদের মতো গরীবের জন্য কোনও জায়গা নেই?” বুকের ভেতর চেপে রাখা কান্না একসময় আর ধরে রাখতে পারে না। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে ওঠে, “হে ভগবান, তুমি কি আছ? আমাদের জন্য কোনও আশ্রয় রেখেছ?” লতিকা আস্তে পেছন থেকে এসে ওর কাঁধে হাত রাখে। দু’জনে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে, আকাশের তারা ভরা রাতের নিচে। বস্তি তখন ঘুমায় না, বস্তি তখন স্বপ্ন দেখে না, বস্তি কেবল শঙ্কায় রাত জাগে।

অধ্যায় ৩: 

কলকাতার আকাশ আজ যেন আরও বেশি ঝলমল করছে, গরমের রোদে পিচের রাস্তা থেকে ধোঁয়া উঠছে, আর বস্তির মানুষগুলো সেই উত্তাপে হাঁসফাঁস করছে। দুপুর গড়িয়ে শেষ বিকেলের দিকে যাচ্ছে, তবু কুমুদের চোখে ঘুম নেই, শান্তি নেই। সকাল থেকে ও ঘরের চারপাশে পায়চারি করছে। লতিকা বারবার বলছে—“বসো, দুটো ভাত খেয়ে নাও।” কিন্তু কুমুদের গলায় কেমন যেন গলাধঃকরণ করতে কষ্ট হচ্ছে। মনের মধ্যে শুধু একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে—আজ বা কাল হয়তো সরকারি লোকজন আবার আসবে, আবার নোটিশ পড়ে যাবে, হয়তো বুলডোজার আসবে! চারপাশের মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, সবাই একই দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলতে গিয়েও আজ অচেনা হয়ে গেছে। তাদের চোখে আর খেলার ছল নেই, বরং রয়েছে এক ধরনের ভয় আর অস্থিরতা। বস্তির বড়োদের মুখেও কোনও হাসি নেই, কেউ আর চায়ের দোকানে বসে খোশগল্প করছে না, কেউ তাস খেলছে না, কেউ মদের ঠেকে গিয়ে গলা ভিজিয়ে আসছে না। সেই চেনা বিকেলটা যেন কোথায় হারিয়ে গেছে।

হঠাৎ দেখা গেল বস্তির মুখে আবার ঢুকল মিউনিসিপ্যালিটির সেই বড় গাড়িটা। এবার সঙ্গে পুলিশও আছে। কুমুদ আর লতিকা তড়িঘড়ি ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল। পুরো বস্তি যেন মুহূর্তের মধ্যে ছুটে এল গলির মুখে। গাড়ির দরজা খুলে নামল তিনজন অফিসার, সঙ্গে দুইজন কনস্টেবল। হাতে সেই চেনা নোটিশের ফাইল। অফিসারের গলায় কোনও রাগ, না কোনও সহানুভূতি, বরং শুষ্ক, যান্ত্রিক স্বর। সে বলল—“এই বস্তি এলাকায় সরকারি প্রকল্প শুরু হবে আগামী সপ্তাহে। তাই আজ চূড়ান্ত নোটিশ দেওয়া হচ্ছে। তিন দিনের মধ্যে ঘর খালি করতে হবে। পুনর্বাসনের জন্য নাম নথিভুক্ত করুন, তালিকা তৈরি হচ্ছে। দেরি করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” কথাগুলো বলেই নোটিশগুলো একে একে প্রতিটি ঘরের পাশে পেরেক দিয়ে গেড়ে দেওয়া হল। বস্তির মানুষগুলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, কেউ কিছু বলছে না। যেন কথার শক্তিটুকু আর নেই কারও গলায়। একজন বৃদ্ধা, যার চুল পাকা, চোখে জল, বলল—“বাবা, এই বয়সে আমরা কোথায় যাব? বউমার ঘর থেকেও তাড়িয়ে দিয়েছে। এখানেই মরে পড়ে থাকব।” অফিসার মুখ ঘুরিয়ে নিল, যেন কিছু শোনেনি। কনস্টেবলরা নোটিশ টাঙিয়ে শেষ করল কাজ।

নোটিশের কাগজগুলো ফড়ফড় করে হাওয়ায় কেঁপে উঠছে। কুমুদ সেই নোটিশের অক্ষরগুলো পড়ে যায় বারবার। লাল কালিতে লেখা শব্দগুলো চোখে গিয়ে কাঁটার মতো বিঁধছে—“তিন দিনের মধ্যে উচ্ছেদ”, “সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প”, “পুনর্বাসন”। কিন্তু এই পুনর্বাসন কথাটা কুমুদের কাছে ফাঁকা শব্দ ছাড়া আর কিছু নয়। কতবার শুনেছে এই কথা, আর তারপর? কই, কেউ তো আর কোনও ঘর দেয়নি! বরং শহরের অন্য প্রান্তে ফুটপাতে রাত কাটাতে হয়েছে, বৃষ্টি হলে গলিত মাটিতে কাদায় লুটিয়ে পড়তে হয়েছে, কনকনে শীতে কাপড়ে মুড়ে রাত কাটাতে হয়েছে। লতিকা পাশে দাঁড়িয়ে অজান্তেই শাড়ির আঁচল ভিজিয়ে ফেলেছে চোখের জলে। শিবু কাছে এসে বাবার হাত ধরে ফিসফিস করে বলল—“বাবা, আমাদের ঘর কি ভেঙে দেবে? আমার স্কুলের বইগুলো?” কুমুদের গলায় শব্দ বের হয় না। সে কেবল শিবুর মাথায় হাত বুলিয়ে যায়। সেই স্পর্শে যেন নিজের বুকের ভেতরটা চেপে ধরে, কান্না লুকিয়ে রাখে। বস্তির চারপাশে তখন সূর্য ডুবছে। লাল আভা ছড়িয়ে পড়ছে পলিথিনের ছাউনিতে, টিনের চালে, কাদার মেঝেতে। সেই আলোয় যেন বস্তির প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি ঘর, প্রতিটি স্বপ্ন নিঃশব্দে বিদায় নিচ্ছে।

রাত নেমেছে। দূরের বড় বড় দালানগুলো আলোয় ঝলমল করছে। সেই আলো যেন বস্তির অন্ধকারকে আরও ঘন করে তুলছে। কুমুদ উঠোনে চুপচাপ বসে আছে, চোখে ঘুম নেই। লতিকা পাশে বসে আছে, শিবু মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। চারপাশে বস্তির ঘরগুলোতে নিস্তব্ধতা। কোথাও একটা কুকুর ডেকে উঠল হঠাৎ, কোথাও কোনও ঘরের মধ্যে থেকে বাচ্চার কান্না শোনা গেল। বাতাসে নোটিশের কাগজগুলো ফড়ফড় করে বারবার দোল খাচ্ছে। কুমুদের মনে হচ্ছে, সেই শব্দগুলো যেন বলছে—“তুমি ঘরছাড়া, তুমি ঘরছাড়া।” লতিকা আস্তে বলে উঠল—“কুমুদ, আমরা কী করব বলো তো? কোথায় যাব?” কুমুদ উত্তর দিতে পারে না। শুধু নক্ষত্রভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে মনে মনে ভাবে, “ভগবান, তুমি যদি কোথাও থাক, তাহলে অন্তত শিবুর জন্য এক টুকরো আশ্রয় দাও। এই ছোট্ট ছেলেটার যেন স্কুলটা ছেড়ে দিতে না হয়, যেন ওর ঘুমভরা চোখে এই ভাঙনের ছবি না থাকে।” হাওয়া বয়ে যায় আস্তে আস্তে, আর বস্তি সেই হাওয়ার সঙ্গে অজানা ভবিষ্যতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে।

অধ্যায় ৪: 

বস্তিতে সকাল হতে না হতেই যেন এক অদৃশ্য আগুন ছড়িয়ে পড়ল। গত রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে সকালটা বিক্ষোভ আর ফিসফাসের মধ্যে শুরু হল। প্রতিটি ঘরের সামনে মানুষ বেরিয়ে এসেছে, চোখে ঘুম নেই, মুখে উদ্বেগ, মনে একটাই প্রশ্ন—এখন কী হবে? লতিকা খুব ভোরেই উঠেছে, শিবুকে পাশে শুইয়ে রেখে উঠোনে এসে বসেছে। তার চোখের নিচে কালো দাগ, সারারাত ঘুম আসেনি। কুমুদ ঘরের পাশের বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে আছে, দু’চোখে লাল রক্তের রেখা, চোখমুখে ক্লান্তি আর অভিমানের ছাপ। হঠাৎ ফতেয়া আর আরও কয়েকজন যুবক এসে হাজির হল তাদের উঠোনে। ফতেয়ার চোখে অদ্ভুত জেদ, মুখে কঠিন দৃঢ়তা। “এভাবে আর কত? ঘর হারিয়ে, আশ্রয় হারিয়ে আর কতদিন পড়ে থাকব রাস্তায়?”—বলতে বলতে সে চারপাশের মানুষদের দিকে তাকায়। “আমরা বস্তির মানুষ মিলে একজোট হব, প্রমাণ করব আমরা কেউ ভিখারি নই। আমাদের ঘর ভাঙা যাবে না এভাবে। আজ বিকেলেই আমরা মিছিল করব, থানার সামনে যাব, মিউনিসিপ্যালিটির অফিস ঘেরাও করব। খবরের কাগজ, টিভি চ্যানেল, সব জায়গায় খবর পৌঁছে দেব—শহরের উন্নয়নের নামে আমাদের উচ্ছেদ বন্ধ হোক।” ফতেয়ার কথায় চারপাশের মানুষজনের মুখে একরাশ আশার আলো ফুটে উঠল। মনে হল, এই জ্বালা শুধু কাঁদিয়ে নয়, লড়িয়ে দেবে।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই পুরো বস্তি যেন একজোট হয়ে গেল। মহিলারা শাড়ি আঁটসাঁট করে পরে নিল, ছেলেরা লাঠি কাঁধে নিল, বুড়োদের চোখেও দেখা গেল অদম্য সাহস। বাচ্চাদের কেউ ঘরে বসিয়ে রাখল না; তারাও বাবার হাত ধরে এগিয়ে এল। ফতেয়ার নেতৃত্বে বস্তির মানুষ এক লম্বা লাইন করে বস্তির গলি পেরিয়ে মেইন রোডে এসে পড়ল। কুমুদ লতিকার হাত ধরে হাঁটছে, আর শিবু বাবার আর মায়ের মাঝখানে নিরাপদে চলেছে। রোদ আর ধুলোয় রাস্তা জ্বলছে, তবু সেই উত্তাপে যেন মানুষের মনের আগুন আরও তেতে উঠছে। পথচারীরা অবাক হয়ে থেমে থেমে দেখছে—গরীবের মিছিল কীভাবে শহরের বুকে সাহসী চিহ্ন রেখে যাচ্ছে। কারও হাতে প্ল্যাকার্ড, লেখা—“ঘর আমাদের অধিকার”, “উন্নয়নের নামে উচ্ছেদ চলবে না”, “আমরা ঘর চাই, ভিখারি নই”। ধীরে ধীরে মিছিল পৌঁছল মিউনিসিপ্যালিটি অফিসের সামনে। বস্তির মানুষজন সেখানে বসে পড়ল মাটিতে। স্লোগানের আওয়াজে চারদিক মুখরিত হয়ে উঠল—“আমাদের ঘর চাই, ঘর চাই, ঘর চাই!” কেউ অফিসারদের সঙ্গে কথা বলতে চাইল, কিন্তু লোহার গেটের ওপার থেকে শুধু পুলিশের কড়া মুখ দেখা গেল, আর অফিসের জানলায় কাচের আড়াল।

মিছিলের খবর পৌঁছে গেল সংবাদমাধ্যমে। কিছু রিপোর্টার, ক্যামেরাম্যান চলে এলেন। ক্যামেরার লেন্সের সামনে মুখ দেখিয়ে ফতেয়া বলল—“দেখুন, এই শহরের উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু আমাদের ঘর ভেঙে দিয়ে। পুনর্বাসনের নামে ফাঁকা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিচ্ছে। এই বস্তি আমাদের ঘাম, রক্ত, শ্রমে তৈরি হয়েছে। আমরা এখানে জন্মেছি, এখানে বেঁচেছি, আমাদের সন্তান এখানে মানুষ হচ্ছে। সরকার যদি উন্নয়ন করতে চায়, আগে আমাদের নতুন ঘর দিক। না হলে আমরা আমাদের ঘর ছাড়ব না, জীবন দিয়ে রক্ষা করব।” চারপাশ থেকে হাততালি উঠল। কুমুদও সেই ভিড়ে গলা মেলাল, লতিকা শিবুকে বুকে চেপে ধরে আরও শক্তভাবে স্লোগান তুলল। বস্তির মহিলারা শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে মাটিতে বসে রইল, তারা হটতে রাজি নয়। রিপোর্টারদের প্রশ্নে তারা বলল—“আমরা কাজের লোক, চুরি-ডাকাতি করি না, আমাদের ঘর ভাঙা হলে আমরা ফুটপাতে যাব না। ঘর ভাঙা হলে সরকারকে আমাদের লাশ সরাতে হবে।” সেই দৃশ্য টিভির পর্দায়, ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ল। শহরের মানুষ জানল, বস্তির মানুষ হার মানতে জানে না।

রাত নেমে এল, তবু মিছিলের ভিড় ছত্রভঙ্গ হয়নি। গরমে, ধুলোয়, ক্লান্তিতে কেউ হাল ছাড়ল না। বস্তির মানুষ একে অপরের জন্য জল এনে দিল, বাচ্চাদের জন্য বিস্কুট জোগাড় করল। কেউ রাতের জন্য মশারি টাঙিয়ে বসার চেষ্টা করল। পুলিশ অফিসাররা দূর থেকে নজর রাখছে, তারা ভিড়ের মধ্যে ঢুকছে না, কিন্তু সতর্ক রয়েছে। শহরের আলোতে মিছিলের মুখগুলো জ্বলজ্বল করছে। কুমুদ শিবুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, বলল—“ভয় পাস না বাবা, আমরা একসঙ্গে আছি। কিছু হবে না।” লতিকা পাশে বসে বলল—“আজ মনে হচ্ছে, আমরা কেবল গরীব নই, আমরা সাহসীও।” ফতেয়া এসে বলল—“কাল সকাল পর্যন্ত এভাবেই বসে থাকব। সরকারকে কথা দিতেই হবে, ঘর না দেওয়া পর্যন্ত এখান থেকে আমরা নড়ব না।” আকাশে চাঁদ উঠে এসেছে। সেই চাঁদের আলোয় মিছিলের ভিড় যেন আরও দৃঢ়, আরও অটল মনে হল। সেই রাত ছিল শুধু এক রাত নয়, সেই রাত ছিল বস্তির মানুষের ঘর হারানোর শঙ্কা আর ঘর রক্ষার প্রতিজ্ঞার রাত। বস্তি জানিয়ে দিল, তারা আর নীরব নয়, তারা লড়াই করবে, ঘর তাদের অধিকার, আর সে অধিকার তারা ছিনিয়ে নেবে।

অধ্যায় ৫: 

রাত কেটে ভোর হল। শহরের আকাশে লালচে আলো ছড়িয়ে পড়ছে, পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে দূরে। বস্তির মানুষরা, যারা সারা রাত মিউনিসিপ্যালিটি অফিসের সামনে মাটিতে বসে ছিল, তারা চোখে ঘুম নিয়ে জেগে আছে। সেই ঘুম যেন ঘুম নয়, বরং ক্লান্তির ছায়া। মশার কামড়, গরমে ঘাম, তবু কেউ উঠে যায়নি, কেউ ভেঙে পড়েনি। কুমুদ শিবুকে কোল থেকে নামিয়ে এক চুমু খায় কপালে, লতিকা আঁচল দিয়ে ছেলের মুখ মুছে দেয়। ফতেয়া তখনো লাঠি হাতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, চোখের পাতা একবারের জন্যও পড়েনি মনে হয়। হঠাৎ সকাল সাতটার দিকে অফিসের ভেতর গেট খুলল, আর বাইরে বেরিয়ে এল কয়েকজন সরকারি কর্মচারী, সঙ্গে এক অফিসার, যার মুখে ক্লান্তি আর উদ্বেগের রেখা স্পষ্ট। অফিসার হাত তুলল, “আপনারা শান্ত থাকুন, কথা বলতে এসেছি।” ভিড় থেকে ফতেয়া, কুমুদ, আর কয়েকজন এগিয়ে গেল। অফিসার বলল—“আপনারা মিছিল করে যা বার্তা দিতে চেয়েছেন, সেটা আমরা পেয়েছি। সরকার পুনর্বাসনের কথা দিচ্ছে, প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার আগেই আপনাদের নতুন ঘরের ব্যবস্থা করা হবে। আপনারা নথিভুক্তির জন্য অফিসে নাম লিখিয়ে নিন।” অফিসারের কথায় হঠাৎ যেন এক মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধতা নেমে এল, তারপর ভিড়ের মধ্যে এক আশার আলো ছড়িয়ে পড়ল।

লতিকা ফিসফিস করে কুমুদকে বলল—“সত্যিই ঘর দেবে তো?” কুমুদও চুপ করে রইল, কারণ অতীতের প্রতিশ্রুতিগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে। তবু এই মুহূর্তে এই কথাগুলো একরকম স্বস্তি এনে দিল সবার মনে। ফতেয়া জোর গলায় বলল—“আমরা লিখিত প্রতিশ্রুতি চাই, কেবল কথায় বিশ্বাস নেই। সরকার আমাদের ঘর দেবে, সেটা লিখে দিন।” অফিসার কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল—“আপনাদের দাবি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেব। লিখিত প্রতিশ্রুতি পেতে হয়তো দু-এক দিন সময় লাগবে। তবে পুনর্বাসন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে, জমি চিহ্নিত হয়েছে, আপনারা যাতে কষ্ট না পান, সে ব্যবস্থা হবে।” ভিড় থেকে কেউ বলল—“বছরের পর বছর এ কথাই শুনছি, এবার যেন কথা রাখেন।” অফিসার হাত জোড় করে বলল—“আপনাদের কষ্ট বুঝতে পারছি। দয়া করে আজ মিছিল উঠিয়ে নিন। আপনারা শান্তিতে ঘরে ফিরুন, আমরা কাজ শুরু করছি।” এদিকে সংবাদমাধ্যম সেই কথোপকথন ক্যামেরায় বন্দি করল, শহরের মানুষ টিভি আর ফোনের পর্দায় সেই দৃশ্য দেখল। কেউ কেউ বলল—“দেখো, গরীব মানুষও লড়ে জিততে পারে।”

মিছিল আস্তে আস্তে ছত্রভঙ্গ হতে শুরু করল। বস্তির মানুষ গলা শুকিয়ে গেলেও মুখে হাসি ফুটিয়ে ফিরতে লাগল নিজেদের ঘরে। কুমুদ লতিকার হাত ধরে হাঁটছিল, আর শিবু বাবার কাঁধে চড়ে বাড়ি ফিরল। পথের ধারে দোকানদাররা মুচকি হেসে বলল—“ভাল করেছ, সাহস দেখিয়েছ।” লতিকা আস্তে বলল—“কুমুদ, জানো, আজ মনে হচ্ছে আমরা গরীব হলেও আমাদের কণ্ঠস্বর আছে। আমরা একজোট হলে আমাদের কথাও শোনা যায়।” কুমুদ হেসে বলল—“হ্যাঁ লতিকা, বস্তির মানুষ যদি এভাবে একসাথে থাকে, কেউ আমাদের সহজে ঠকাতে পারবে না।” ফিরে এসে তারা বস্তির মানুষজনকে নিয়ে আলোচনায় বসল—কীভাবে নথিভুক্তি হবে, কীভাবে নজরদারি রাখতে হবে যাতে প্রতিশ্রুতি ভুলে না যায় সরকার। বৃদ্ধা মায়েরা, যুবকরা, মহিলারা সবাই যেন হঠাৎ নতুন করে জেগে উঠল। বস্তির বাতাসে একটা দৃঢ় প্রত্যয়ের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। শিশুদের চোখে খেলাধুলার আনন্দ ফিরে এল, তারা আবার গলির কোণে দৌড়ঝাঁপ শুরু করল। কিন্তু কুমুদের চোখে তখনও একটা দ্বিধা—প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তব হবে?

দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল। বস্তির মানুষজন রুটি, ভাত রান্না করল, দিনের পরিশ্রমের শেষে একবেলা শান্তি খুঁজল। কুমুদ উঠোনে বসে লতিকার সঙ্গে কথা বলছে, শিবু পাশেই মাটিতে পেন্সিল দিয়ে কিছু আঁকছে—নতুন ঘরের ছবি। সেই ছবিতে টিনের ছাউনি নেই, পলিথিন নেই, আছে একখানা ইটের ঘর, জানালায় পর্দা। কুমুদ শিবুর ছবি দেখে মনে মনে প্রার্থনা করল—“ভগবান, অন্তত এই ছেলেটার স্বপ্ন ভাঙিস না।” হাওয়ায় তখন পলিথিনের বদলে উড়ছে প্রতিশ্রুতির গন্ধ। দূরের দালানগুলোর আলো বস্তির দিকে তাকিয়ে যেন বলছে—এই শহর শুধু বড়লোকের নয়, এই শহর কুমুদ-লতিকা-শিবুদেরও। চাঁদ উঠছে আকাশে, বাতাসে ভেসে আসছে মৃদু গান—কারও বউ ঘরের ভেতর গান গাইছে, কারও ছেলে বাঁশির সুর তুলছে। সেই রাতে বস্তির মানুষ জানল, লড়াই শুধু পথের নয়, লড়াই নিজের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখার। প্রতিশ্রুতির সকাল হয়তো আরও অনেক দূর, তবু তারা সেই সকাল দেখার আশায় বুক বাঁধল।

অধ্যায় ৬: 

বস্তিতে কয়েকটা সপ্তাহ কেটে গেল আশার আলো নিয়ে। মিছিলের সেই দিনটার কথা বস্তির মানুষজন প্রতিদিনই মনে করে। কুমুদ, লতিকা, ফতেয়া আর আরও অনেকে নথিভুক্তির জন্য অফিসে অফিসে ঘুরল, নাম লিখিয়ে এল, আঙুলের ছাপ দিল। সরকার নাকি এবার সত্যিই ঘর দেবে, নাকি এই শহরের উন্নয়নের মানচিত্রে তারাও জায়গা পাবে। প্রথম প্রথম সরকারি অফিসাররা দু-তিনবার এল বস্তিতে। বড় বড় ফাইলে নকশা দেখাল, মাপজোক করল, জায়গা চিহ্নিত করল। কুমুদের মনে হল এবার বোধহয় সত্যিই নতুন ঘর আসছে। লতিকা সন্ধ্যায় পেঁয়াজ কেটে ভাজা দিতে দিতে বলত—“কুমুদ, এবার নতুন ঘর পেলে শিবুর পড়ার জন্য এক কোণা করে দেব। সে তো এখনো কেরোসিনের আলোয় পড়ে।” কুমুদ হেসে বলত—“হ্যাঁ, আর তোর জন্য জানালার ধারে এক গাছ ফুল বসাব, তুই সকালবেলা পানি দেবে।” স্বপ্নগুলো যেন সত্যি হতে চলেছে ভেবে বস্তির প্রতিটি মানুষ নতুন করে বেঁচে উঠছিল। শিবুর চোখে নতুন ঘরের ছবি স্পষ্ট হচ্ছিল, মাটিতে কাঠির আঁচড়ে সে নিজের ঘরের মানচিত্র আঁকত—একটা ছোট উঠোন, একখানা পাকা ঘর, আর দুটো জানালা।

কিন্তু সময় গড়াল। অফিসাররা আর আসতে শুরু করল না। প্রথমে সপ্তাহ গেল, তারপর মাস। বস্তির লোকেরা নতুন করে ঘুরতে লাগল অফিসে। কেউ সান্ত্বনা দিল—“প্রকল্পে দেরি হচ্ছে”, কেউ বলল—“ফাইল আটকে আছে”, কেউ বলল—“নতুন টেন্ডার হবে, তারপর কাজ শুরু হবে।” বস্তির ভেতর ফের ফিসফাস শুরু হল। ফতেয়া মুখ গম্ভীর করে বলল—“দেখছ তো কুমুদ, আবারও আমাদের বোকা বানাচ্ছে। ঘর দেওয়ার কথা বলে ভোট চায়, ঘর দেওয়ার কথা বলে মিছিল উঠিয়ে দেয়, আর তারপর আমাদের ভুলে যায়।” কুমুদ কিছু বলল না, শুধু শূন্য চোখে দূরের বড় দালানগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। শহর যে প্রতিদিন বড় হচ্ছে, সে কথা বোঝা যায় সেই উঁচু দালানগুলোর সারি দেখে, কিন্তু সেই বড় হওয়া যেন ওদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে আরও। লতিকা ভেতরে ভেতরে চিন্তায় পড়ে গেল, রাতে শিবু ঘুমিয়ে গেলে কুমুদের কাছে ফিসফিস করে বলল—“আমরা কি ভুল করলাম মিছিল থামিয়ে? আমরা যদি বসেই থাকতাম…” কুমুদ আস্তে বলল—“ভুল তো করিনি লতিকা, কিন্তু গরীবের আশার দামই তো শহরের কাছে কিছু নয়।”

তারপর একদিন খবর এল—সরকার নতুন করে সেই বস্তির জায়গায় বড় রাস্তা তৈরি করবে, আর বস্তি পুরোপুরি ভেঙে ফেলা হবে। সেই খবর শুনে পুরো বস্তি যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। মানুষের মুখ থেকে হাসি মুছে গেল, চোখেমুখে শুধুই আতঙ্ক। সেই আশ্বাস, সেই প্রতিশ্রুতি যে আসলে ফাঁদ ছিল, তা বুঝতে বাকি রইল না। ফতেয়া জোর গলায় চিৎকার করে উঠল—“দেখলে? বলেছিলাম না, এরা আমাদের ঠকাচ্ছে? ঘর তো দূরের কথা, এবার আমাদের ছুঁড়ে ফেলে দেবে রাস্তায়।” বস্তির মায়েরা বাচ্চাদের বুকে চেপে ধরে কাঁদতে লাগল, ছেলেরা হতাশায় মাটিতে বসে পড়ল। কুমুদ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল, শিবু ভয় পেয়ে বাবার গা ঘেঁষে বসে রইল। লতিকা ফাঁকা চোখে মাটির দিকে তাকিয়ে বলল—“শহরটা কি আমাদের একটুও জায়গা দিতে পারল না?” সেই রাতে বস্তিতে আর রান্না হল না, কেউ পেট ভরিয়ে খেতে পারল না, শুধু কেরোসিন বাতির ম্লান আলোয় ঘরের কোণে বসে সবাই নিজের নিজের কষ্টের সাথে যুদ্ধ করল।

পরদিন সকালে আবার বস্তিতে জোরে জোরে হুইসেল বাজল, সরকারের দলবল, পুলিশ, বড় বড় মেশিন এসে হাজির। বস্তির মানুষ আবার একবার লড়ার চেষ্টা করল, লাঠি হাতে এগিয়ে গেল, কিন্তু পুলিশের ঢল আর মেশিনের সামনে মানুষের লাঠি নিতান্তই অক্ষম। বস্তির ঘরগুলো একে একে ভাঙা শুরু হল, মানুষের চোখের জলে মিশল ধুলো আর ইটের গুঁড়ো। শিবু মায়ের আঁচল ধরে চিৎকার করল—“মা, আমাদের ঘর ভাঙছে কেন?” লতিকা চোখের জল লুকিয়ে শিবুকে বুকের মধ্যে চেপে ধরল। কুমুদ কাঁপতে কাঁপতে ভাঙা ঘরের দিকেই তাকিয়ে রইল, আর বারবার মনে মনে বলল—“আমরা কোথায় যাব?” সেই দিন বস্তি আর বস্তি রইল না, হয়ে গেল শুধু স্মৃতি। প্রতিশ্রুতির ফাঁদে পা দিয়ে বস্তির মানুষ শিখল, কাগজের আশ্বাস আর বাস্তবের আঘাত এক নয়। কিন্তু বুকের ভেতর ছোট্ট এক আগুন জ্বলতে থাকল—যা শেষ পর্যন্ত জ্বলেই থাকবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য।

অধ্যায় ৭: 

ঘর ভেঙে যাওয়ার পর বস্তির মানুষগুলো ছিন্নমূল হয়ে পড়ল, যেন শিকড় কেটে নেওয়া গাছের মতন। শহরের ফুটপাত, রেললাইন ধারের জায়গা, শূন্য মাঠ—যেখানে একটু খালি জায়গা পেয়েছে সেখানেই তারা আশ্রয় নিয়েছে। কুমুদ, লতিকা আর শিবু এসে দাঁড়াল এক পরিত্যক্ত মিলের পাশের খোলা জায়গায়। চারদিকে ইট আর ভাঙা দেওয়াল, দূরে মিলের জং ধরা চিমনি। লতিকা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল, শিবু মায়ের আঁচল ধরে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকল। কুমুদ চারদিকে তাকিয়ে বলল—“লতিকা, আপাতত এখানেই থাকতে হবে। ছাউনিটা পলিথিন দিয়ে ঢাকতে হবে। রাতে বৃষ্টি নামলে ভিজতে হবে না যেন।” লতিকা কিছু বলল না, কেবল মাথা নাড়ল। দিনের আলো ফুটে থাকলেও সেই জায়গাটায় যেন ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে, যেখানে স্বপ্নগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আছে। দুপুরের রোদে মাথা ঝলসে যেতে যেতে কুমুদ, ফতেয়া আর কয়েকজন মিলে ইট পাটকেল জোগাড় করে অস্থায়ী দেওয়াল তুলতে শুরু করল। কারও মুখে ভাষা নেই, শুধু চোখের কোণ বেয়ে নেমে আসা ঘাম আর লোনা জলেই বোঝা যাচ্ছে কষ্টের গল্প।

সন্ধ্যা নামল। মিলের পাশের সেই খোলা জায়গা জেগে উঠল মানুষের করুণ সুরে। কেউ শিশুদের ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে, কেউ ফিসফিস করে বলছে—“কাল সকালেই নতুন জায়গা খুঁজতে হবে।” কুমুদ মাটিতে পলিথিন বিছিয়ে শিবুকে শুইয়ে দিল, লতিকা পাশে বসল ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে। দূরে হুইসেল বাজল, রাতের ট্রেন ছুটে গেল, আর সেই আওয়াজে শিবু ভয়ে বাবার দিকে তাকাল। কুমুদ ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলল—“ভয় পাস না, বাবা। আমরা আছি তো।” শিবু ফিসফিস করে বলল—“বাবা, আমাদের নতুন ঘর কবে হবে?” কুমুদের বুক কেঁপে উঠল, সে উত্তর দিতে পারল না। লতিকা চোখের জল লুকিয়ে বলল—“ঘুমিয়ে পড় শিবু, স্বপ্নে দেখবি আমাদের নতুন ঘর।” আকাশে তখন তারাগুলো যেন ম্লান, মিলের চিমনির পাশে অন্ধকার জমাট বেঁধেছে। শহরের গাড়ির আওয়াজ দূর থেকে শোনা যাচ্ছে, সেই আওয়াজে মিশে যাচ্ছে ছিন্নমূল মানুষের দীর্ঘশ্বাস।

পরদিন ভোরে কুমুদ আর ফতেয়া শহরের অন্য প্রান্তে গিয়ে খোঁজ শুরু করল—কোথায় একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই পাওয়া যায়। রেল স্টেশনের পাশে, ডাম্পিং গ্রাউন্ডের ধারে, পুরনো গ্যারেজের ফাঁকা জায়গা—সব জায়গায় ঘুরল, কিন্তু কোথাও পুলিশ-প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। কেউ বলল—“এখানে থাকলে পুলিশ তাড়িয়ে দেবে”, কেউ বলল—“এই জায়গা কোম্পানির জমি, দখল করতে দেবে না।” দিনভর গরমে ঘুরতে ঘুরতে কুমুদের পায়ে যেন আর জোর রইল না। ফতেয়া ধুলো ঝেড়ে বসে পড়ে বলল—“এই শহর আমাদের মতো গরীবের নয় রে কুমুদ। শুধু বড়লোকের দালান, বড়লোকের রাস্তা, আর আমাদের জন্য রইল শুধু পুলিশ লাঠি আর মেশিনের হুঁশিয়ারি।” কুমুদ চুপ করে দূরে বড় দালানের দিকে তাকিয়ে রইল। সেই দালানগুলো যেন তাদের ব্যঙ্গ করছে, যেন বলছে—“তোমাদের জন্য এখানে কোনো জায়গা নেই।” তবু কুমুদের মনে হল—এই শহরে কোনও না কোনও কোণায় নিশ্চয়ই জায়গা আছে, যেখানে সে তার ছেলেকে নিয়ে আবার একখানা ঘর বুনতে পারবে।

সন্ধ্যায় ফিরে এসে কুমুদ লতিকার পাশে বসে সব কথা বলল। লতিকা চোখ মুছে বলল—“যে শহরে জন্ম নিলাম, বড় হলাম, সেই শহরেই মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই? আমাদের ছেলে কি গাছতলায় বড় হবে?” কুমুদ মুঠো শক্ত করে বলল—“না লতিকা, একদিন না একদিন আমরা আমাদের ঘর পাবই। যত বড় দালান উঠুক, গরীবের লড়াইকে মুছে দিতে পারবে না।” রাতে মিলের ধারের সেই ফাঁকা জায়গায় বসে ছিন্নমূল মানুষেরা আবার জোট বাঁধল—যে শহর তাদের ঠেলে দিতে চায় অন্ধকারে, সেই শহরের বুকে তারা আবার আশ্রয় খুঁজবে, আবার লড়াই করবে। দূরে আকাশে বিজলির রেখা ঝলকাচ্ছে, হালকা বাতাস বইছে, আর সেই হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে প্রতিজ্ঞার মৃদু আওয়াজ—“আমরা হারব না।” শিবু ঘুমিয়ে পড়েছে লতিকার কোলে, কুমুদ ছেলের কপালে হাত বুলিয়ে বলল—“ঘুমা, শিবু। একদিন এই শহরেই তোর জন্য ঘর হবে, জানালা থাকবে, তাতে হাওয়া ঢুকবে, তুই আকাশ দেখতে পাবি।” রাত গভীর হচ্ছে, তবু সেই রাতে ছিন্নমূল মানুষের চোখে ঘুম নেই, কেবল আশ্রয়ের খোঁজে জেগে থাকা।

অধ্যায় ৮: 

শহরের সকাল যেমন ব্যস্ত, কোলাহলমুখর, তেমনই কুমুদদের দিনের শুরু হয় আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে বেড়ানো দিয়ে। মিলের পাশের খোলা জায়গায় ঘুম ভাঙতেই শিবুর ক্ষুধার্ত মুখ দেখে কুমুদের বুক হু হু করে ওঠে। লতিকা তাকে সামান্য শুকনো রুটি আর চিনি দিয়ে বোঝাতে চায়, কিন্তু শিবুর মুখে আর সেই হাসি নেই। কুমুদ নিজের বুকের মধ্যে একরাশ জেদ আর কষ্ট চেপে বলল—“লতিকা, আজ আমি ফিরব না যতক্ষণ না একখানা মাথা গোঁজার জায়গা খুঁজে পাই।” লতিকা কিছু বলতে গেল, কিন্তু কুমুদের চোখের ভাষা দেখে চুপ করে গেল। কুমুদ বেরিয়ে পড়ল ফতেয়াকে সঙ্গে নিয়ে। তারা ঘুরতে লাগল টালিগঞ্জের ফ্লাইওভার তলায়, বাদামতলা রোডের খালি জায়গায়, পার্ক সার্কাসের পুরনো বাজারের পেছনের ফাঁকা জমিতে। কিন্তু প্রতিটি জায়গায় একটাই গল্প—পুলিশের লাঠি, দালালদের চোখরাঙানি, বড়লোকদের বিল্ডিং প্রোমোটারের হুমকি। শহর যেন প্রতিটি কোণা থেকে তাদের ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইছে।

ফতেয়া হঠাৎ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বলল—“কুমুদ, কালীঘাটের রেললাইনের পাশের ঝোপঝাড়ও তো আছে। ওখানেও অনেকে থাকে শুনেছি।” কুমুদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল—“চল, দেখি। অন্তত রেলগাড়ির শব্দে হলেও রাতে ঘুম আসবে।” তারা গিয়ে দেখল, সেখানেও ছোট ছোট পলিথিনের ঘর, মাটিতে ইট বিছানো বিছানা, পাতা ছেঁড়া কাগজের আস্তরণ। সেখানে বসে থাকা বৃদ্ধ এক চাচা বলল—“তোমরা থাকতে চাও? জায়গা নেই ভাই, পুলিশ মাঝেমাঝে এসে লাঠি চালায়, তবু থাকি কারণ আর কোথায় যাব?” কুমুদ হতাশ চোখে চাচার দিকে তাকাল। শিবুর মুখটা মনে পড়ল, আর মনে হল—ছেলেটাকে আর কতোদিন এভাবে ভাসিয়ে রাখবে? ফিরে এসে লতিকার মুখের দিকে তাকিয়ে কুমুদের বুকটা ভেঙে যেতে চাইল। লতিকা চুপচাপ শিবুকে বুকে চেপে বলল—“যেখানে থাকি না কেন কুমুদ, তুমি সঙ্গে থাকলেই আমার ঘর। তবে ছেলেটার জন্য একটা ঠাঁই দরকার।” শিবু বাবার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল—“বাবা, আমাদের জানালার ঘর কবে হবে?”

কয়েকদিনের এই ঘুরে বেড়ানো, প্রত্যাখ্যাত হওয়া, লাঠির ভয়, পুলিশি তাড়ার পর কুমুদ আর ফতেয়া ঠিক করল—এবার তারা সরাসরি প্রশাসনের কাছে যাবে। তারা গেল স্থানীয় ওয়ার্ড অফিসে, কাউন্সিলরের কাছে। সেখানে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে এক অফিসারের সামনে পৌঁছে বলল—“বাবু, আমরা ঘর চাই। সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল, আমাদের ঘর দেওয়া হবে। এখন আমরা রাস্তায়।” অফিসার হেলদোল না করে কাগজপত্র দেখতে চাইল। কুমুদ ছিঁড়ে যাওয়া নথি, ছাপ মারা কাগজ বের করে দিল। অফিসার হালকা হাসল—“এগুলোতে কিছু হবে না। নতুন করে আবেদন করতে হবে। আর হ্যাঁ, ঘর পেতে হলে টোকেন লাগবে। সেটা তো জানেন?” ফতেয়া অবাক হয়ে বলল—“টোকেন? কোন টোকেন?” অফিসার কনুই দিয়ে পাশে বসা লোকটার দিকে ইঙ্গিত করল। সেই লোক হালকা গলা নামিয়ে বলল—“দশ হাজার টাকা দিতে হবে। তখন টোকেন পাবেন। নাহলে তো নাম লিস্টেই আসবে না।” কুমুদ ফতেয়া একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে বোবা হয়ে গেল। যে মানুষের পকেটে খাবার জোটে না, সে কেমন করে দশ হাজার টাকা দেবে ঘরের টোকেনের জন্য?

ফিরে এসে কুমুদ মিলের পাশের সেই জায়গায় বসে রইল, মাথা নিচু করে। লতিকা আস্তে এসে বলল—“কি হল?” কুমুদ ফিসফিস করে সব বলল। লতিকার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল, চোখ ভিজে উঠল। শিবু দূরে বসে কাগজে ঘর আঁকছিল কাঠি দিয়ে। দূর থেকে আলো এসে পড়ছিল তার ছবিতে—একটা ছোট্ট ঘর, জানালায় খোলা আকাশ, আর একপাশে ছোট্ট বাগান। কুমুদ ছেলের সেই ছবি দেখতে দেখতে চোখের জল মুছে ফেলল। রাতের আকাশে চাঁদ উঠেছে, বাতাসে মিলের পুরনো লোহার গন্ধ মিশে আছে। কিন্তু সেই রাতের অন্ধকারেও কুমুদের মনে হল—লড়াইটা শেষ নয়। যে শহর প্রতিদিন তাদের ঠকাচ্ছে, তার বুকেই একদিন নতুন ঘর গড়বে সে। লতিকা কাঁপা গলায় বলল—“আমরা একা নই কুমুদ। সব্বাইকে নিয়ে আবার লড়াই শুরু করতে হবে।” কুমুদ মৃদু মাথা নাড়ল। শহরের কোণায় কোণায় আশ্রয় না পেয়ে তারা বুঝল, আশ্রয় পেতে হলে নিজেদেরই আবার রাস্তায় নামতে হবে, নিজেদের ঘর নিজেদেরকেই গড়তে হবে।

অধ্যায় ৯: 

মিলের পাশের সেই খোলা জায়গায় বসে কুমুদের মন আর স্থির থাকতে পারল না। দিনরাতের চিন্তায়, হতাশায় বুকটা ভেঙে যেতে যেতে একদিন ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে সে উঠে দাঁড়াল। দূরে রাস্তা দিয়ে গাড়ি যেতে যেতে হর্ণ বাজাচ্ছে, পাখিরা ডাকছে, আর মিলের চিমনি থেকে বেরোচ্ছে হালকা ধোঁয়া। কুমুদ লতিকার দিকে তাকিয়ে বলল—“এভাবে আর হবে না লতিকা। আমরা সবাইকে এক করব। শুধু আমরা কেন, আমাদের মতো যারা ঘরহীন, যারা ঠকেছে, যারা পুলিশের লাঠি খেয়েছে, সবাই মিলে রাস্তায় নামব।” লতিকা অবাক চোখে স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে রইল। কুমুদের চোখে সেই আগুনের শিখা লতিকা স্পষ্ট দেখতে পেল। “তুই যা ঠিক করেছিস, আমি তোর পাশে আছি কুমুদ,” লতিকা বলল দৃঢ় কণ্ঠে। শিবু ঘুম ভেঙে বাবার মুখের দিকে তাকাল আর বলল—“বাবা, তুমি কাঁদছ?” কুমুদ ছেলেকে কোলে তুলে নিল আর হাসল—“না রে বাবা, আমি হাসছি। এবার আমরা নতুন ঘর গড়ব।”

সেই সকালেই কুমুদ আর ফতেয়া ছুটল আশেপাশের ছিন্নমূল মানুষগুলোর কাছে। কে নেই সেই ভাঙা শহরে? চায়ের দোকানদার ঘরহারা, ভ্যানচালক ঘরহারা, বাসনের মেরামত করা লোক ঘরহারা, ঘরভাঙা কারিগর, সেলাইয়ের মেশিনওয়ালা, চটের দোকানের হরিবাবু—সবাই ঘর ছাড়া। কুমুদ তাদের কাছে গিয়ে বলল—“আর চুপ করে থাকলে চলবে না। রাস্তায় নামতে হবে, মিছিল করতে হবে। সরকারকে বুঝিয়ে দিতে হবে, আমরা ভিখারি নই। আমাদের ঘর আমাদের অধিকার।” প্রথমে অনেকেই সন্দেহ নিয়ে শুনল। কেউ বলল—“কাজ হবে? পুলিশ পেটাবে না?” কেউ বলল—“মিছিল করে কী হবে, শালা কেউ কথা শোনে?” কিন্তু কুমুদের কথায় সেই আগুন ছিল, যা আস্তে আস্তে বাকিদের বুকেও জ্বেলে দিল আশার প্রদীপ। ফতেয়া পাশে দাঁড়িয়ে বলল—“পুলিশের লাঠি যদি আমাদের গায়ে পড়ে, একসঙ্গে পড়ুক। আমরা একসঙ্গে লড়ব।” আর এইভাবেই গড়ে উঠল এক দল—যারা মাথা গোঁজার আশায়, ন্যায়ের আশায় লড়তে তৈরি।

পরের ক’দিন ধরে তারা শহরের নানা বস্তিতে গিয়ে ডাক দিতে লাগল। কুমুদ, ফতেয়া, লতিকা আর আরও কয়েকজন রাতের পর রাত ঘুরল—দরজায় দরজায়, অস্থায়ী ছাউনির তলায়, রেললাইনের পাশের পলিথিন ঘরের ভিতর ঢুকে মানুষকে জাগাতে লাগল। “এসো ভাই, এসো বোনেরা, এবার লড়াই হবে। সরকার যেদিন বস্তি ভেঙেছে, ঘর ভেঙেছে, সেইদিন কথা দিয়েছিল ঘর দেবে। কথা রাখুক সরকার।” আস্তে আস্তে সেই ডাক সাড়া পেতে লাগল। পুরনো চেয়ারম্যান পাড়ার এক বৃদ্ধা বলল—“বাবা, এই কথাই তো আমরা কতদিন ধরে বলতে চাইছি। তুমি শুরু করেছ, আমরা থাকব পাশে।” আর সেই রাতেই মিলের পাশের ফাঁকা মাঠে জড় হল শতাধিক মানুষ। আগুন জ্বালিয়ে কুমুদ বলল—“কাল সকালেই আমরা ওয়ার্ড অফিস ঘেরাও করব। টোকেন নয়, ঘর চাই। ঘর না দেওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে।” হাওয়ায় তখন এক অদৃশ্য উত্তেজনা, ভোরের দিকে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে কুমুদের মনে হল—যেন নদীর ঢেউও এই লড়াইয়ে সঙ্গ দিচ্ছে।

পরদিন সকাল। শহরের রাস্তা দিয়ে মিছিল বেরোল। কুমুদ, লতিকা, ফতেয়া আর অজস্র ঘরহারা মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত হতে লাগল—“ঘর চাই, অধিকার চাই”, “বস্তি ভাঙলে ঘর দাও”, “আমরা ভিখারি নই, নাগরিক।” লাঠি হাতে পুলিশ এল, কিন্তু সেই লাঠির সামনে দাঁড়িয়ে গেল মানুষ। কেউ পিছিয়ে গেল না। বাচ্চা, বুড়ো, নারী-পুরুষ মিলিয়ে সেই মিছিল যেন এক বন্যার ঢল। ওয়ার্ড অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে কুমুদ বলল—“আজ না ঘর না প্রতিশ্রুতি লিখে নিয়ে ছাড়ব না।” পুলিশ ব্যারিকেড দিল, তবু কুমুদের গলায় সেই জেদ, ফতেয়ার চোখে সেই আগুন, লতিকার মুখে সেই দৃঢ়তা। শিবু লতিকার হাত ধরে বলল—“মা, আমাদের ঘর হবে তো?” লতিকা হেসে বলল—“দেখিস শিবু, হবে। আমরা লড়ছি না?” সেদিন শহরের খবরের কাগজের শিরোনাম হল—“ঘরহীনদের ন্যায়ের লড়াই, শহর দেখল এক নতুন মিছিল।” সন্ধ্যায় ক্লান্ত মুখে সবাই ফিরে এল মিলের পাশের সেই জায়গায়। কিন্তু তাদের চোখে ক্লান্তি নয়, ছিল এক নতুন আশা, নতুন লড়াইয়ের অঙ্গীকার।

অধ্যায় ১০: 

সেই রাতের মিছিলের পর শহরের বাতাসে যেন অন্যরকম ঘ্রাণ ভেসে বেড়াতে লাগল। খবরের কাগজ, টেলিভিশন চ্যানেল, রেডিও—সব জায়গায় ঘরহীন মানুষদের লড়াইয়ের ছবি, কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। কুমুদ আর তার সঙ্গীরা বুঝল, এই চাপের মুখে প্রশাসন আর চুপ করে বসে থাকতে পারবে না। সকাল হতেই কুমুদের কাছে খবর এল—ওয়ার্ড অফিস থেকে ডাক এসেছে, নেতাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য। কুমুদ, ফতেয়া, লতিকা আর আরও কয়েকজন ঘরহীন মানুষের প্রতিনিধি হয়ে রওনা দিল। অফিসের ঘরে ঢুকতেই গম্ভীর মুখের অফিসাররা, বড় বড় চেয়ারে বসা প্রোমোটারদের প্রতিনিধি, আর এলাকার কাউন্সিলর বসে আছে। এক অফিসার বলল—“আপনারা যেভাবে শহর অচল করেছেন, তাতে আমরা খুব সমস্যায় পড়েছি। তবে সরকার মানুষের পাশে আছে, আপনাদের জন্য নতুন প্রকল্প ঘোষণা হবে।” কুমুদ চুপচাপ শুনল, তারপর বলল—“আমরা আশ্বাস চাই না। লিখিত প্রতিশ্রুতি চাই, কবে ঘর হবে, কোথায় হবে, কীভাবে হবে। আর ঘর পেতে ঘুষ দিতে হবে না, সেটাও লিখে দিন।” অফিসাররা একে অপরের দিকে তাকাল, তারপর হালকা হাসল—“ঠিক আছে, আলোচনা হবে। আপনারা শান্ত থাকুন, আমরা শীঘ্রই আপনাদের প্রকল্পের নথি হাতে দেব।”

কুমুদরা যখন অফিস থেকে বেরিয়ে এল, বাইরে অপেক্ষা করছে শত শত মানুষ। কুমুদের মুখের দিকে চেয়ে সবাই বোঝার চেষ্টা করছে—কী হল? কুমুদ হাত তুলে বলল—“প্রশাসন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে আমাদের লড়াই এখানেই শেষ নয়। যতক্ষণ না ঘর হাতে পাই, ততক্ষণ লড়াই চলবে।” মানুষের মুখে তখন ধ্বনিত হতে লাগল—“জয় আমাদের হবে!”, “ঘর আমাদের অধিকার!” ফতেয়া এসে বলল—“দেখ কুমুদ, শহর এবার আমাদের কথা শুনছে। কিন্তু সাবধান থাকতে হবে, আবার যেন কেউ আমাদের ঠকাতে না পারে।” লতিকা ছেলেকে বুকে চেপে বলল—“শিবু, দেখবি, এবার আমাদের জানালার ঘর হবে।” শিবু হেসে বাবার হাত ধরে বলল—“বাবা, সেই ঘরে আমি ফুলগাছ লাগাব। জানালায় বসে পড়ব।” কুমুদ শিবুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল—“হ্যাঁ রে বাবা, এবার হবে।” সেই রাতটা যেন অন্যরকম ছিল। মিলের পাশের খোলা জায়গার মানুষগুলো ছোট ছোট দল করে বসে ঘরের স্বপ্নের কথা বলতে লাগল—“কোন রঙের দেয়াল হবে”, “ছাদের খাঁজে লতা গাছ উঠবে কিনা”, “জানালার পাল্লা থাকবে কাঠের না লোহার”—এইসব গল্পে রাত পার হতে লাগল।

পরের কয়েকদিন ধরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রকল্পের নথি তৈরি হতে লাগল। খবরের কাগজে ছাপা হল—“ঘরহীনদের জন্য বিশেষ প্রকল্প”, “নতুন পাকা বাড়ির প্রতিশ্রুতি।” কুমুদ আর ফতেয়া প্রতিদিন গিয়ে অফিসে খোঁজ নিত। একদিন অফিসারদের একজন এসে বলল—“দেখুন, জায়গা চূড়ান্ত হয়েছে। বেহালার ধারে খালি জমি, সেখানে হবে পাকা ঘর, বৈধ কাগজপত্র তৈরি হবে। তবে আপনাদেরও সহযোগিতা করতে হবে—আন্দোলন বন্ধ রাখতে হবে, যাতে কাজ দ্রুত হয়।” কুমুদ বলল—“লিখিত দিন, আমরা আন্দোলন থামাব। কথার উপরে ভরসা করতে গিয়ে আমরা কতবার ঠকেছি।” সেদিন সন্ধ্যায় কুমুদের হাতে লেখা চিঠি এল—সরকারের তরফ থেকে স্বাক্ষরিত, প্রকল্পের নাম, জায়গার বিবরণ, কাজ শুরুর দিন। মানুষ সেই চিঠি হাতে নিয়ে যেন বিজয়ের আনন্দে ভেসে গেল। শিশুরা নেচে উঠল, বৃদ্ধারা চোখের জল মুছল। লতিকা কুমুদের হাতে হাত রেখে বলল—“তুই পেরেছিস কুমুদ। তোর লড়াইতে আমরা জিতেছি।”

কিন্তু সেই জয়ের মধ্যেও কুমুদের বুকের ভেতর একটা চিন্তা লুকিয়ে রইল—যদি আবার প্রতারণা হয়? যদি এই প্রতিশ্রুতি ফাঁকা বুলি হয়ে থাকে? তাই কুমুদ ঠিক করল, তারা নিয়মিত কাজের অগ্রগতি দেখবে, দল বেঁধে জায়গায় জায়গায় ঘুরে কাজের হাল জানবে, আর কোনও অনিয়ম হলে সরাসরি রিপোর্ট করবে সংবাদমাধ্যমে। মানুষ এবার কুমুদের নেতৃত্বে গড়ে তুলল এক আশ্রয় আন্দোলন সমিতি। সেই সমিতির ছাতার তলায় থেকে সবাই ঠিক করল—“ঘর পেলে সবাই একসঙ্গে থাকব, এক পাড়া গড়ব, যেখানে থাকবে বন্ধুত্ব, সহযোগিতা, আর লড়াইয়ের ইতিহাস।” শহরের বাতাসে সেই রাত থেকে ভেসে বেড়াতে লাগল নতুন আশার গান—নতুন ঘরের গান। দূরে মিলের চিমনি থেকে বেরোচ্ছে ধোঁয়া, কিন্তু সেই ধোঁয়ার ফাঁক দিয়ে কুমুদের চোখে ভেসে উঠল জানালার ঘর, শিবুর বাগান, লতিকার হাসিমুখ, আর এক টুকরো আকাশ, যা কেবল তাদের জন্য।

 

-সমাপ্ত-

1000029755.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *