Bangla - ভূতের গল্প

ঘড়ির ভিতর মুখ

Spread the love

ঋজু বসু


সাঁইবাবা মন্দিরের পেছনের সরু গলি দিয়ে ঢুকলেই একখানা বাড়ি চোখে পড়ে, তার তিন তলা মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন নিজের অস্তিত্বের প্রতিবাদে, অথচ প্রতিটি জানালায় জীর্ণ কাচ, প্রতিটি দেয়ালে কুয়াশার দাগ। রামেশ্বর লেন ৩। লোকেরা বলে, ওটা ঘড়িওয়ালা বাড়ি। কারণ বাড়িটার ভেতর যত ঘড়ি আছে, সব থেমে আছে—ঠিক রাত বারোটায়। কেউ বলে সেগুলো আর চলে না, কেউ বলে এগুলো নতুন কারও জন্য অপেক্ষায়। ইতিহাসের গবেষক সায়ন্তিকা সাহা এসব কুসংস্কার মানে না, কিন্তু অলৌকিক স্থাপত্য নিয়ে তার থিসিসের জন্য এই বাড়িটাই সবচেয়ে আকর্ষণীয়। সে সিদ্ধান্ত নেয়, একরাত কাটিয়ে যাবে। সঙ্গে ক্যামেরা, সাউন্ড রেকর্ডার আর তার বন্ধু চন্দন, যার একটাই কাজ—সব কিছু ধারণ করা। বিকেলে তারা পৌঁছে যায় বাড়ির সামনে। রোদ তখন ঢলে পড়ছে, ছায়া গাঢ় হচ্ছে বাড়িটার গায়ে। দরজাটা প্রায় খুলে পড়ে আছে, এমনভাবেই, যেন কেউ বেশ কিছুদিন আগে খুলে রেখে গেছে এবং তারপর আর কেউ হাত দেয়নি। ভেতরে ঢুকতেই ঠান্ডা হাওয়া লাগে, গা ঘেঁষে বয়ে যায় যেন কারও নিঃশ্বাস। সায়ন্তিকা তা পাত্তা দেয় না। সে চারপাশে দেখে দেয়ালে ঝোলানো কিছু ছবি—সব কেমন বিবর্ণ। কিন্তু অদ্ভুতভাবে প্রতিটি ছবিতেই একজন নারীর মুখ, যার চোখ নেই। ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি, কিন্তু সেই হাসি যেন বিদ্রূপে ভরা। এক ঘরের দেয়ালে লেখা, “তুমি ফিরেছ?” সায়ন্তিকা ফিসফিস করে বলল, “আমরা এখানে।” চন্দন একটা ঘরে ঢুকল, তার মাঝখানে সাদা চকের বৃত্ত আঁকা, আর তার ভিতর রাখা একটি দেওয়াল ঘড়ি। কাঁচটা ফাটা, কিন্তু কাঁটা থেমে আছে বারোটায়। হঠাৎ বাতাস যেন ভারী হয়ে এল, ঘরের প্রতিটি কোণ থেকে শব্দ আসতে লাগল—টিক টিক টিক। একটার পর একটা ঘড়ির শব্দ একসঙ্গে শুরু হলো। চন্দন বলল, “তুই শুনছিস?” সায়ন্তিকা তখনো চেয়ে আছে ঘড়িটার দিকে। কাঁচের ভেতর ভেসে উঠল একটি মুখ, চোখ নেই, মুখে সেই একই মৃত হাসি। আর কাঁচে হাত রাখতেই শব্দ এল, “তুমি সময় এনেছো?” মুহূর্তে সায়ন্তিকা লুটিয়ে পড়ল। চন্দন ছুটে গিয়ে ওকে ধরল, কিন্তু তার শরীর ঠান্ডা। ক্যামেরা তখন রেকর্ড করছিল। স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছিল, ঘরের দেয়ালে ছায়া নড়ে উঠছে। এক সময় সেখান থেকে বেরিয়ে এল একজন—হয়তো সেই নারী, যার মুখ ছিল ছবিতে। তার মুখও চোখহীন। চন্দনের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল গোঙানির মতো শব্দ, কিন্তু সে চলতে পারল না। ঘরের বাতাস থমকে গিয়েছিল। শুধু সেই টিক টিক টিক চলছিল। তারপর হঠাৎ করে সব শব্দ থেমে গেল। ক্যামেরার আলো নিভে গেল, ঘর ভরে গেল নিকষ অন্ধকারে। পরদিন সকালে এলাকার লোকজন বাড়ির সামনে দেখতে পায় পুলিশ ভ্যান, সায়ন্তিকা আর চন্দনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সায়ন্তিকা নিঃসাড়, চোখ মেলে তাকায় না। আর চন্দন শুধু বলে, “ঘড়ি চলতে শুরু করল। আমি দেখেছি, আমি…” কিন্তু সে আর কিছু বলতে পারে না। তার মুখে ভয় জমে থাকে, তার চোখ ফাঁকা। ডাক্তাররা কিছু বোঝে না, মনোরোগ বিশেষজ্ঞরাও নীরব। তবে ক্যামেরায় শেষ যে ফুটেজ ধরা পড়েছে তা দেখে সবাই স্তব্ধ। সেখানে ঘড়ির কাঁচে প্রতিফলিত মুখ—সায়ন্তিকার—কিন্তু চোখ নেই। আর কাঁচের কোণে হালকা আঁচড়ে লেখা—“তোমার সময় শেষ।” তারপর সেই ফুটেজও নষ্ট হয়ে যায়, ক্যামেরার মেমোরি কার্ড গলে যায় যেন আগুনে। হাসপাতালের ঘরে চন্দনের বিছানার পাশে রাখা ঘড়ি নিজে নিজে চালু হয়ে যায়, আর তার কাঁটা আবার থেমে যায়—বারোটায়। এরপর শহরের বুকে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, কেউ কেউ বলে তারা মাঝরাতে ওই বাড়ির জানালায় ছায়া দেখেছে। কেউ বলে, এক নারী দাঁড়িয়ে থাকে, চোখ নেই, কিন্তু তার মুখ হাসে। কেউ বলে, সে ঘড়ির ভিতর থাকে। আর যখন সে কারও সময় পায়, তখন সে সেই মুখ নিয়ে নেয়। আর তখন ঘড়ি আবার চলতে শুরু করে।

সেই ঘটনার পর তিনমাস কেটে গেছে। সায়ন্তিকা এখনও হাসপাতালে, তার শরীরে প্রাণ আছে কিন্তু চেতনা নেই। চোখ খোলা, কিন্তু কোথাও তাকিয়ে নেই। চন্দন মাঝেমধ্যে আসে, বসে থাকে, কথা বলে, কিন্তু কোনো সাড়া পায় না। আর যখন একা থাকে, দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে—“ঘড়িটা ওর মুখ খেয়ে ফেলেছে… আমি কিছু করতে পারিনি…” ডাক্তারেরা বলেন, প্যারানরমাল ট্রমা বলে কিছু নেই, সব মনস্তাত্ত্বিক। কিন্তু চন্দন জানে, সেই রাতে কিছু হয়েছিল—সেই মুখটা, সেই চোখহীন হাসি, সেই ঘড়ির শব্দ—এসব বানানো নয়। এই সময়েই এক নতুন ঘটনা ঘটল। শহরে নতুন এক সংস্থা চালু হয়েছে—“Ghost Walk Kolkata”—যারা কলকাতার ভৌতিক বাড়ি, পুরোনো অলৌকিক কাহিনিকে ঘিরে ট্যুর করায়। উদ্যোক্তারা গল্প শুনে রামেশ্বর লেন ৩-কে নিজেদের ট্যুরে রাখে। অনেকেই বলে, “ওখানে কেউ যায় না।” কিন্তু সাহস দেখাতে গিয়েই তো এমন ট্যুর জমে ওঠে। তিনজন অংশগ্রহণকারী—ইউটিউবার রিয়া, ভ্লগার অয়ন, এবং এক বিদেশি পর্যটক মাইকেল। তিনজনেই সাহস দেখাতে চায়, ভিডিও তুলবে, কনটেন্ট বানাবে। গাইড তাদের বলে, “বাড়িটা যেমন ভাঙা, ভেতরের গল্প ততটাই কাঁপানো।” তারা হাসে। রাত দশটায় বাড়ির সামনে পৌঁছে তারা। দরজা ঠিক আগের মতোই হালকা খোলা। ঢোকার সময় কেউ অনুভব করল না যে কোনো দরজা ঠেলেছে, কিন্তু দরজা নিজে থেকেই সরে গেল। ভিতরে ঢুকে তারা মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। প্রথমে নিচের ঘর, তারপর সিঁড়ি দিয়ে ওঠা। একতলার ঘরে এখন ধুলোর স্তর আরও গভীর, ঘরের মধ্যে বাতাস ঠান্ডা আর ভারী। হঠাৎ করেই ঘরের এক কোণে একটানা শব্দ—টিক টিক টিক। রিয়া বলে উঠল, “সাউন্ড ইফেক্ট? কেউ কি এখানে আগে এসে কিছু সাজিয়েছে?” মাইকেল বলে, “The air is different here. It feels… like a vacuum.” ঘরটা হঠাৎ কাঁপল। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল এমন শব্দে, যেন বাইরের জগৎ কেটে গেছে। ঘরের মধ্যে এখন শুধু টিক টিক শব্দ। দেয়ালে ঝুলে থাকা এক ছবিতে আলো পড়ল—ছবিটা সেই নারীর, চোখ নেই, মুখে সেই বিকৃত হাসি। ঠিক তখনই জানালার কাঁচে প্রতিফলিত হল রিয়ার মুখ, কিন্তু কাঁচে তার চোখ নেই। সে ঘুরে তাকাল না, শুধু হঠাৎ চিৎকার করে উঠল। অয়ন দৌড়ে গিয়ে রিয়ার হাত ধরল, কিন্তু তার হাত বরফের মতো ঠান্ডা। মাইকেল কাঁপতে কাঁপতে বলল, “We need to get out!” কিন্তু দরজা বন্ধ। তখনই ঘরের কোণ থেকে বেরোল কুয়াশার মতো কিছু একটা, ধীরে ধীরে তা রূপ নিল এক নারীর। সেই মুখ, সেই চেনা চোখহীনতা, সেই মৃত হাসি। সে এগিয়ে এলো। তিনজন একসঙ্গে পেছাতে লাগল। দেয়াল পেছনে, জানালা পেছনে, আর সামনে সেই মুখ। কেউ কিছু বলছে না, কেবল ঘড়ির শব্দ আর নিঃশ্বাস। হঠাৎ ঘরের সব ঘড়ি একসঙ্গে বেজে উঠল—টিক টিক টিক… তারপর সব নিস্তব্ধ। বাইরের লোকজনের দাবি, তারা জানালায় তিনটি ছায়া দেখেছে, তাদের কারও মুখ নেই। সেই রাতে তিনজন আর বেরোয়নি। সকালবেলা পুলিশ আসে, ভিতরে কোনো দাগ নেই, কোনো চিহ্ন নেই, শুধু একখানা মোবাইল পাওয়া যায়, যেখানে শেষ ভিডিও ফুটেজে ক্যামেরা ঘুরছে ঘড়ির কাঁচের উপর, আর কাঁচে প্রতিফলিত তিনটি মুখ, চোখহীন। ক্যামেরার শেষ ফ্রেমে দেখা যায় সেই পুরোনো বৃত্তটা, আর তার মাঝে লেখা—“তোমার মুখ আমি নিয়ে নিলাম।” সংস্থাটি চুপ করে যায়, ট্যুর বন্ধ হয়, লোকজন ভুলে যেতে চায়। কিন্তু রাত্রি বারোটার পর যারা ও বাড়ির রাস্তা ধরে, তারা বলে, জানালায় এক নারী দাঁড়িয়ে থাকে, আর একটা ঘড়ি নিয়ে কারও দিকে তাকিয়ে হাসে। আর দূর থেকে শোনা যায়—টিক… টিক… টিক…

মাইকেলের মোবাইলে পাওয়া ভিডিও ফুটেজ নিয়ে অনেক চর্চা হয়। শহরের প্যারানর্মাল ফোরাম, কিছু অল্টারনেট গবেষক, এমনকি কিছু বিদেশি ইউটিউব চ্যানেল পর্যন্ত এই ঘটনাকে ঘিরে ভিডিও বানায়। কিন্তু আশ্চর্যভাবে, কেউই ফুটেজের শেষে সেই মুখটা থামাতে পারে না। প্রতি ফ্রেমে দেখা যায় ঘড়ির কাঁচে প্রতিফলিত মুখ—যার চোখ নেই, ঠোঁটে হাসি। ক্যামেরা ঘোরে, ঘড়ির কাঁটা চলতে থাকে, আর শেষে স্ক্রিন কেঁপে ওঠে। কেউ কেউ দাবি করে, তারা এই ভিডিও দেখার পর রাতে ঘুমোতে পারছে না, কেউ কেউ বলে তাদের ঘরের ঘড়ি নিজে নিজে থেমে গেছে বারোটায়। আসলে সময় যে এখানে শুধু একটি কাঁটা নয়, সে যেন একটা অস্তিত্ব। এই সময়েই এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে। হাসপাতালে সায়ন্তিকা হঠাৎ চোখ মেলে তাকায়। তিন মাসের ঘুম ভেঙে সে বলে, “চোখ নেই… কোথাও দেখি না… কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি!” নার্স ছুটে আসে, ডাক্তার আসে, চন্দন খবর পেয়ে দৌড়ে আসে। সায়ন্তিকার চোখদুটো খোলা, কিন্তু দৃষ্টি অসাড়। সে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমার ঘড়ি থেমে গেছে। ও আমার মুখ নিয়ে নিয়েছে। এবার ওর সময় শেষ করতে হবে।” সবাই মনে করে সে এলোমেলো বলছে। কিন্তু চন্দনের মনে পড়ে যায় সেই রাতের দৃশ্য। সে এবার চুপ করে থাকে না। সিদ্ধান্ত নেয়, আবার বাড়িটায় যাবে। এবার একা। রাত্রি সাড়ে ন’টা, চন্দন পুরোনো সেই রামেশ্বর লেনের বাড়ির সামনে দাঁড়ায়। বাতাস ভারী, আকাশ মেঘলা। দরজাটা আগের মতোই হালকা খোলা। চন্দন এবার ক্যামেরা চালু না করে, শুধু একটা রেকর্ডার নিয়ে ঢোকে। ঘরের মধ্যে ঢুকেই গন্ধটা পায়—এক ধরনের পঁচা লোহার গন্ধ। দেয়াল জুড়ে সেই ছবিগুলো এখনও আছে—চোখহীন মুখ, মুখে ঠান্ডা হাসি। ঘরের মধ্যে এবার একটানা শব্দ নেই, বরং নিস্তব্ধতা। প্রথম ঘর পার হয়ে দ্বিতীয় ঘরে গিয়ে দেখে, সেই সাদা বৃত্তটা মুছে গেছে। সেখানে এখন শুধু একটা ছোট ঘড়ি রাখা। তার কাঁচ অক্ষত, কিন্তু কাঁটা এখনও বারোটায়। চন্দন সামনে এগোয়, হঠাৎ ঘড়িটা নিজে থেকে টিক করে ওঠে। কাঁটা এগোয় এক ধাপ। সেই সঙ্গে ঘরের বাতাস কাঁপে। দেয়ালের মধ্যে ছায়া নড়ে ওঠে, একটা অদৃশ্য শরীরের প্রতিফলন যেন ছায়া হয়ে হেঁটে বেড়ায়। চন্দন কাঁপতে কাঁপতে বলে, “আমি ফিরেছি। এবার তোমার সময় শেষ।” সেই মুহূর্তে কাঁচের ভেতর সেই মুখ দেখা যায়। এবার চোখের জায়গায় শুধু অন্ধকার, যেন কোনো গহ্বর। সে বলে, “তুমি আবার এসেছো… মুখ ফেরত চাও?” চন্দন জবাব দেয় না। ঘড়িটা এবার পুরোপুরি চলা শুরু করে, ঘরের চারপাশে ঘড়ির শব্দ ফিরে আসে। দেয়ালে লেখা হয়ে যায় এক লাইন—“মুখ ফেরত নয়। সময় ফেরত চাইলে মুখ দিতে হয়।” ঘরের মাঝখানে আলোর বলয় তৈরি হয়। সেখানে দাঁড়িয়ে একজন নারী—সেই মুখ, সেই চোখহীনতা, কিন্তু এবার সে কাঁদছে। মুখে হাসি নেই, চোখ নেই, কিন্তু কান্নার শব্দ স্পষ্ট। চন্দন এগিয়ে গিয়ে বলে, “তুমি কে? তুমি কী চাও?” সে জবাব দেয় না, শুধু তার পায়ের কাছে একটি ঘড়ি রেখে দেয়। তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। ঘড়িটা যখন চন্দন হাতে তোলে, তখন সে দেখতে পায়, সেখানে সায়ন্তিকার ছবি খোদাই করা। ছবিতে সায়ন্তিকার মুখে চোখ আছে, কিন্তু ঠোঁটে হাসি নেই। চন্দন সে ঘড়ি নিয়ে ফিরে আসে হাসপাতালের দিকে। পথে সে বারবার দেখে, তার আশেপাশে আলো কমছে, রাস্তায় ঘড়ি নেই, মোবাইলের সময় বন্ধ, চারদিকে একরকম নিঃশব্দতা নেমে এসেছে। হাসপাতালের ঘরে ঢুকেই সে ঘড়িটা সায়ন্তিকার কোলের ওপর রাখে। মুহূর্তে সায়ন্তিকা চোখ বন্ধ করে ফেলে। তারপর ধীরে ধীরে আবার খুলে। এবার তার চোখে দৃষ্টি আছে। সে বলে, “ও এখনও আছে। তুমি কেবল তার সময়কে ছুঁয়ে এসেছো। মুখ ফেরত দিতে গেলে সময় থামাতে হয়।” চন্দন বুঝতে পারে, কিছু একটার শুরু হয়েছে। কিন্তু শেষ? সে এখনও অনেক দূর।

সায়ন্তিকার ফিরে আসা শুধু তার পরিবার নয়, চিকিৎসকরাও বুঝে উঠতে পারে না। এমন নিঃসাড় অবস্থার পর হঠাৎ এমন দৃষ্টিস্পষ্ট জাগরণ—তাও কোনো চিকিৎসায় নয়, একটি ভাঙা ঘড়ির স্পর্শে। সবাই যখন ভাবছে অলৌকিক কিংবা কাকতালীয়, তখন সায়ন্তিকা চুপ করে বসে থাকে। তার চোখ দুটি জেগে থাকলেও চাহনিতে যেন কুয়াশা। সে কারও দিকে তাকায় না, কারও প্রশ্নের উত্তর দেয় না, শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে। তার চোখের নিচে ক্লান্তি, কিন্তু ঠোঁটে এক ধরনের স্থিরতা। চন্দন ওকে জিজ্ঞেস করে, “তুই কেমন আছিস?” সে উত্তর দেয়, “আমি ওকে দেখেছি। আমার মুখ এখনও ওর ঘড়ির ভেতর। কিন্তু একটা পথ আছে।” চন্দন চমকে যায়। “কী পথ?” সায়ন্তিকা বলে, “ও সময় খায়, মুখ নেয়, কিন্তু কিছু ফেরতও দেয় যদি তাকে ভুল পথে চালানো যায়।” চন্দন বোঝে না, কিন্তু সায়ন্তিকা জোর দিয়ে বলে, “আমাকে আবার সেখানে নিয়ে চল। এবার একা নয়, আমি তৈরি।” কিছুদিন পর তারা দুজনে আবার রওনা দেয় সেই বাড়ির দিকে। সময় রাত দশটা। আকাশ মেঘলা, বাতাসে জলের গন্ধ। তারা ঢোকে। diesmal সায়ন্তিকার চোখে ভয় নেই, তার হাতে সেই ঘড়িটা, যা ফিরে এসেছিল। ভেতরে ঢুকেই ঘরের গন্ধ আরেকটু ঘন। যেন ধুলো আর রক্তের গন্ধ মিশে আছে। দেয়ালে সেই চেনা ছবিগুলো নেই, বরং একটায় দেখা যাচ্ছে সায়ন্তিকার মুখ—চোখ নেই। সায়ন্তিকা এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলে, “আমি এসেছি। এবার আমাকে ফেরাও।” ঘড়ির শব্দ শুরু হয়। টিক… টিক… টিক… হঠাৎ ঘরটা হালকা কেঁপে ওঠে। বাতাস ভারী হয়ে যায়। জানালা নিজে থেকে বন্ধ হয়। ঘরের মাঝে এক অদ্ভুত আলো তৈরি হয়—মেঝেতে ছায়া, আর ছায়ার ঠিক মাঝে সেই নারী—চোখহীন, মুখে ঠান্ডা কান্না, এবার আর হাসি নেই। সায়ন্তিকা এগিয়ে গিয়ে বলে, “তুমি কে?” সেই নারী বলে না কিছু, শুধু তার দিক থেকে আলো সরে গিয়ে দেয়ালে একটা দৃশ্য ফুটে ওঠে—একজন মেয়েকে বাড়ির মধ্যে আটকে রাখা হয়েছে। তার চোখ ঢেকে দেওয়া, কণ্ঠ স্তব্ধ। কণ্ঠে কেউ যেন বলছে, “ও ছিল ঘড়িওয়ালার মেয়ে, যার চোখে সময় দেখা যেত। ওকে আটকে রেখেছিল কেউ, যাতে সে সময় না দেখাতে পারে আর। ওর অভিশাপ ছিল—যে ওর দিকে তাকাবে, তার সময় আটকে যাবে।” চন্দন বলে, “তাহলে এই বাড়ি… এই মুখ… সবটাই সেই মেয়ের রাগ?” সায়ন্তিকা ফিসফাস করে বলে, “ও সময়কে ফেরাতে চায়। কিন্তু কেউ যদি ওকে নিজের সময় দেয়?” ঘর তখন গাঢ় অন্ধকারে ডুবে যায়। শুধু সায়ন্তিকার ঘড়ির কাঁটা নড়ে। সে সেটা মেঝেতে রাখে। সেই নারী এগিয়ে আসে, এবার চোখ নেই, কিন্তু কান্না থেমে গেছে। তার হাত বাড়ানো, সায়ন্তিকা তা ধরে। মুহূর্তে ঘরের আলো কেঁপে ওঠে। দেয়ালে প্রতিটি মুখ গলে যায়। একটানা শব্দ হয়—টিক… টিক… তারপর স্তব্ধতা। যখন আলো ফেরে, ঘরের মেঝেতে শুধু একটি ছবি পড়ে থাকে—সায়ন্তিকার, যার চোখ দুটি ফিরে এসেছে। দেয়ালে লেখা—“যে সময় দেয়, সে মুখ ফেরত পায়। কিন্তু তার সময় থামে।” চন্দন চারপাশে দেখে, সায়ন্তিকা নেই। সেই ঘর, সেই নারী, সব অদৃশ্য। কেবল সে আর ঘড়ির কাঁটা, যেটা আবার থেমে গেছে—বারোটায়। সে বাইরে বেরিয়ে এসে বুঝতে পারে, সে একা নয়। তার পকেটের ঘড়ি থেমে গেছে। মোবাইল বন্ধ। সময় থেমে আছে, কিন্তু তার শরীর চলছে। সে বুঝতে পারে, এখন সে নিজেই একটা ঘড়ি, যার কাঁটার ভিতর রয়েছে একটি মুখ।

চন্দন বুঝে উঠতে পারছিল না—সে কি সত্যিই জীবিত, নাকি কেবল এক সময়ের অস্তিত্ব? হাসপাতালের ঘরে ফিরেও কিছুই বদলায় না, সায়ন্তিকার জায়গা খালি। ডাক্তাররা বলে, সে তো পালিয়ে গেছে, আবার কেউ বলে, এমনিই ঘরটা খালি পাওয়া গেছে। কিন্তু চন্দন জানে, সে চলে যায়নি, বরং কারও জায়গা নিচ্ছে। তার স্মৃতিতে ফিরতে থাকে সেই মুহূর্ত, যখন আলোর বলয়ের মাঝখানে সে হাত ধরেছিল, আর মেঝেতে পড়ে ছিল সেই ঘড়ি, যার কাঁটা থেমে আছে। এখন সে যে সময় দেখে, তা অন্যদের চেয়ে ধীরে চলে। আশেপাশে লোকজন হাঁটে, ঘড়ির কাঁটা এগোয়, কিন্তু তার নিজের কাঁটা এক জায়গায় আটকে। সে বুঝতে পারে, সায়ন্তিকা হয়তো কিছু সময় তাকে দিয়ে গেছে, কিন্তু নিজের সময় আটকে রেখেছে। একরাতে তার স্বপ্নে আসে সেই মুখ। চোখহীন সেই নারী বলে, “তুমি এখনও মুক্তি পাওনি। ঘড়ি থেমেছে, কিন্তু মুখ ছুটেনি।” চন্দন চমকে ওঠে। এবার সে ভাবে, এই সময়ের অভিশাপের শেষ কোথায়? সে আবার বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। এবার কেউ তাকে বাধা দেয় না। বাড়ি এখন অনেক বদলে গেছে—দেয়াল জুড়ে আর ছবি নেই, শুধু কাঁচে লেখা কিছু শব্দ—“ফেরাও”, “চাও”, “থেমে যাও”, “ঘড়ি ঘোরাও”। সে সিঁড়ি বেয়ে ওঠে সেই ঘরে, যেখানে প্রথম দিন তারা দেখেছিল সেই সাদা বৃত্ত। এবার ঘরে কোনও বৃত্ত নেই, কেবল এক বড় আয়না। আয়নার কাঁচে তার নিজের প্রতিবিম্ব দেখে সে চমকে ওঠে—চোখ নেই। সে পেছনে ঘুরে তাকায়, দেয়ালে লেখা—“তুমি এখন সময়ের ভিতর। তুমি একটা ঘড়ি।” হঠাৎ তার কানে ভেসে আসে সেই পুরোনো শব্দ—টিক টিক টিক… কিন্তু এবার তা আসছে তার বুকের ভিতর থেকে। মনে হয় যেন হৃদপিণ্ডের বদলে এখন একটা কাঁটা ঘুরছে। সে বোঝে, এই বাড়ি শুধু মুখ নেয় না, সময় খায় না, মানুষকে সময় করে তোলে। তখনই সে দেখল আয়নায় তার পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে—সায়ন্তিকা। কিন্তু সে কিছু বলে না, শুধু বলে, “আমরা সবাই এখানে আটকে। সময়ের ভিতরে আমরা সবাই একটা ঘড়ি।” চন্দন কাছে গিয়ে তার মুখ ছুঁতে চায়, কিন্তু ছোঁয়ার আগেই সে মিলিয়ে যায়। তারপর সে শুধু দেয়ালের দিকে তাকায়। দেয়ালে আবার নতুন লেখা—“যে নিজেকে ভাঙে, সে মুক্ত হয়।” সে ভাবে, তবে কি তাকে নিজেকে শেষ করতে হবে? সে পকেট থেকে সেই ঘড়িটা বের করে, কাঁচে ফাটল এখনও আছে। এবার সে সেই কাঁচের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমার সময় শেষ। আমাকে বেরোতে দাও।” কাঁচে তার প্রতিবিম্ব হাসে—চোখ নেই। সে ঘড়িটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় মেঝেতে। মুহূর্তে পুরো ঘর জেগে ওঠে, আলো ঝলসে ওঠে, দেয়ালে আগুন ধরে যায়, ঘড়ির কাঁটা সব একসঙ্গে চলতে শুরু করে, জানালা খুলে যায়। বাতাসে ভেসে আসে শত শত মুখ—যাদের কারও চোখ নেই, কিন্তু তারা হাসছে। চন্দন কুঁকড়ে পড়ে যায় মেঝেতে, আর দেখে দেয়ালের মধ্য থেকে একে একে বেরিয়ে আসছে ছায়া, একেকটা মুখ হয়ে উঠছে ঘড়ির কাঁটা। তারা ঘুরছে, বাজছে, সময় তৈরি করছে, আবার খাচ্ছে। তারপর হঠাৎ সব থেমে যায়। সে জ্ঞান হারায়। যখন জ্ঞান ফেরে, সে নিজেকে খুঁজে পায় একটা ঘরের মাঝখানে—সেই পুরোনো ঘর, ঘড়ি নেই, দেয়াল ফাঁকা। কেবল এক জানালা দিয়ে রোদ ঢুকছে। সে বাইরে আসে। বাড়ি আগের মতো, তবে গেট বন্ধ, তালা ঝুলছে। সে ভাবে, তবে কি সব শেষ? কিন্তু ঠিক তখনই তার মোবাইল বেজে ওঠে—ঘড়ির স্ক্রিনে সময় দেখায় ১২:০০। সে জানে, এই বারোটা কোনও নতুন দিন নয়, কোনও রোদেলা সকাল নয়, বরং তার ভিতর চলা সেই অভিশপ্ত ঘড়ির নতুন সূচনা।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর চন্দনের মনে হচ্ছিল যেন সে হাওয়ার ভেতর দিয়ে হাঁটছে। চারপাশে শব্দ নেই, পাখির ডাক নেই, এমনকি তার নিজের পায়ের আওয়াজও শুনতে পাচ্ছে না। রাস্তার আলো জ্বলছে, কিন্তু সব আলো যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। মোবাইলের স্ক্রিনে এখনও ১২:০০—সময় এগোয় না, পেছায় না, শুধু দাগ কেটে থাকে। সে যখন বাড়ির পাঁচিল পেরিয়ে মূল রাস্তায় আসে, দেখে শহর ঠিক আগের মতো, কিন্তু তার চোখে যেন বদলে গেছে সব। লোকজন হাঁটছে, গাড়ি চলছে, কিন্তু সবার মুখ অচেনা, এবং প্রতিটি মুখে একই অভিব্যক্তি—একরকম অন্যমনস্কতা, যেন তারা কেউ কোথাও নেই, অথচ চলেছে। চন্দন বুঝতে পারে, সে সত্যিই ফিরে আসেনি, বরং এক অন্য সময়ের ফাঁদে আটকে আছে। সে একটা দোকানে ঢোকে, ঘড়ি কিনতে চায়, কিন্তু দোকানদার বলে, “আজ আর ঘড়ি বিক্রি হয় না। সবাই সময় ভুলে গেছে।” সে থমকে দাঁড়ায়। বাইরে বেরিয়ে দেখে, রাস্তার প্রতিটি ঘড়ির কাঁটা থেমে আছে, যেন এই শহরের কোনো অংশ আর এগোয় না। সে ফিরে যায় নিজের বাড়িতে, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দেখে, তার নামফলকটা অদৃশ্য। দরজাটা খুলে সে ঘরে ঢোকে। ভিতরে আলো জ্বলছে, কিন্তু কেউ নেই। তার ডেস্কে রাখা ঘড়িটা নিজে থেকেই ঘুরছে। সে দেখে, ঘড়ির কাঁচে সায়ন্তিকার মুখ প্রতিফলিত, চোখ আছে, কিন্তু ঠোঁটে সেই পুরোনো ঠান্ডা হাসি। সে জোরে ঘড়িটা ছুঁড়ে দেয়, কিন্তু সেটি মেঝেতে পড়ে থেমে যায়, ভাঙে না। ঠিক তখনই জানালার বাইরে ঝড় শুরু হয়। বাতাসের মাঝে সেই পুরোনো টিক… টিক… টিক… শব্দ ভেসে আসে। হঠাৎ সে অনুভব করে, সে আর একা নেই। ঘরের কোণ থেকে একে একে বেরিয়ে আসে মুখহীন ছায়া—যারা তার দিকে এগিয়ে আসছে, ধীর পায়ে, কিন্তু থেমে নেই। তাদের শরীর নেই, কেবল মুখ, আর মুখের জায়গায় কাঁটা—যা সময় মেপে চলে। চন্দন দেয়ালের দিকে সেঁধিয়ে যায়, চিৎকার করে বলে, “তোমরা কী চাও? আমি কিছু করিনি!” তখন এক ছায়া সামনে এগিয়ে আসে, বলে, “তুমি দেখেছো, আর যারা দেখে, তারা মুখ রাখে ঘড়ির ভিতর। এবার তুমিও রাখো।” সে ছায়া এক কাঁটা দিয়ে চন্দনের চোখে ছুঁয়ে দেয়। মুহূর্তে সব অন্ধকার হয়ে যায়। যখন সে আবার চোখ মেলে, দেখতে পায়, সে একটি ঘরের মধ্যে—তিনটে দেয়াল ঘিরে রেখেছে তাকে, চতুর্থ দেয়াল কাঁচ। সে দেয়ালের ওপারে দেখতে পায় মানুষজন, চলাফেরা করছে, কথা বলছে, হাসছে, কেউ কেউ মোবাইল ঘাঁটছে। কিন্তু তারা কেউ তার দিকে তাকায় না। সে চিৎকার করে, কিন্তু কেউ শোনে না। তখন সে বোঝে, সে নিজেই এখন এক ঘড়ির মধ্যে, একটা দেওয়াল ঘড়ি, যার কাঁচের পেছনে সে আটকে। তার মুখে চোখ আছে, কিন্তু কেউ দেখে না। সে শুধু শুনতে পায়—ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে। তারপর হঠাৎ সব থেমে যায়। এবং তখনই তার সামনে একটি নতুন মুখ ভেসে ওঠে—একটি কিশোর, হয়তো নতুন কেউ, যে এই ঘড়ির দোকানে এসেছিল। সে তাকায়, কাঁচে নিজের মুখ দেখে। মুহূর্তে চন্দনের মুখে হাসি ফুটে ওঠে—ঠান্ডা, চোখহীন, শান্ত হাসি। কিশোর চমকে ওঠে, পিছিয়ে যায়। দোকানদার তখন বলে, “এই ঘড়িটা নেওয়ার নয়। এটা সময় খায়।” কিশোর হাসে, ভাবে এটা মজা। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা তখন আবার নড়ে ওঠে—টিক… টিক… টিক… আর ঘড়ির ভিতর চন্দনের মুখ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গিয়ে নতুন রূপ নেয়। বাইরে সূর্য ওঠে, আবার সময় শুরু হয়, কিন্তু একটা নতুন মুখ, এক নতুন ঘড়ি, এক নতুন অভিশাপ শুরু করে তার পথ। কারণ, সময় কখনো থেমে যায় না, শুধু তার ভিতর যারা থাকে, তাদের আমরা দেখতে পাই না।
শেষ

Lipighor_1749923711467.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *