Bangla - তন্ত্র

ঘড়ির কাঁটা ও কালতন্ত্র

Spread the love

রৌনক রায়


রাত তখন দেড়টা। সল্টলেকের গলির মুখে জ্বলছে কেবল একটি পথবাতি। সেই হালকা আলোয় ঢাকা পড়ে আছে বিশাল এক ভবনের শেড—যেটিকে বাইরে থেকে সাধারণ কোনো গবেষণাগার মনে হলেও, তার ভেতরে সময় নিয়ে চলছিল এক অকল্পনীয় গবেষণা। ড. অনির্বাণ চৌধুরী বসে আছেন ডেস্কে, সামনে ছড়ানো রয়েছে ঘড়ির যন্ত্রাংশ, একটি প্রাচীন ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা চর্মপুঁথি এবং তাঁর সর্বশেষ নির্মিত কোয়ান্টাম পেনডুলাম। সিগারেটের ধোঁয়া ধীরে ধীরে উঠে মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে, আর তাঁর চোখ জ্বলজ্বল করছে—দীর্ঘদিনের অভ্যাসে তিনি বুঝে গেছেন, আজ কিছু হতে চলেছে। হঠাৎই ঘড়ির কাঁটা, যেটি তিনি নিজেই ডিজাইন করেছিলেন সময়চক্র পরিমাপের জন্য, ধীরে ধীরে থেমে গিয়ে ঘুরে গেল উল্টো দিকে। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন যান্ত্রিক ত্রুটি, কিন্তু পরমুহূর্তেই তাঁর শরীরের লোম খাড়া হয়ে গেল। তিনি জানতেন, এটি সেই প্রতীক্ষিত সংকেত—সময়ের রেখা তার প্রাকৃতিক প্রবাহ হারিয়েছে।

প্রায় দুই বছর আগে, তিনি খুঁজে পান কলেজ স্ট্রিটের এক পুরনো দোকানে ধুলোমাখা এক পুঁথি, যার প্রথম পাতায় লেখা— “কালতন্ত্র: সময় নিয়ন্ত্রণের গুপ্তপথ।” পুঁথিটি প্রাথমিকভাবে লাগছিল আধ্যাত্মিক কোনো কবজ, কিন্তু পৃষ্ঠাগুলি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি লক্ষ্য করেন—এর গঠন অদ্ভুতভাবে মিলে যাচ্ছে কোয়ান্টাম টাইম থিওরির কিছু সূত্রের সঙ্গে। সেই থেকেই তিনি শুরু করেন এক অভিনব গবেষণা—বিজ্ঞানের সঙ্গে তন্ত্রের সমন্বয়। আজকের পরীক্ষাটি ছিল তাঁর বৃহৎ পরীক্ষাগুলির একটি, যেখানে তিনি ‘মাইক্রো-টাইম স্কিপ’ প্রমাণ করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু যেটা হলো, তা পরীক্ষার চেয়েও বেশি কিছু—সময়ের গায়ে হালকা একটা আঁচড় লেগেছে। তিনি কল্পনাও করতে পারেননি, এর প্রভাব এত গভীরে পৌঁছাবে। তাঁর চোখ গিয়ে পড়ে চর্মপুঁথির একটা পৃষ্ঠায়, যেখানে লেখা: “সময় একটি তন্তু, একে বাঁকাতে গেলে আত্মাকে বেরিয়ে আসতে হয় শরীর থেকে।” তাঁর বুকের ভেতর এক অজানা ভয় জন্ম নেয়—যদি সে-ই ছিল সময়ের সঙ্গে এই প্রথম প্রত্যক্ষ সংযোগ?

ভোর হতে না হতেই, তিনি পৌঁছালেন বিমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের কাছে—এক বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ এবং পুরাতন জ্যোতিষগ্রন্থের ব্যাখ্যাকার। অনির্বাণের হাতে থাকা পুঁথিটি দেখে বিমলেশ্বরের চোখ স্থির হয়ে আসে। “এই চিহ্নটা দেখেছো?” বলে তিনি দেখান এক ত্রিভুজাকৃতি চিহ্ন যার ভেতরে সময়ের ঘড়ি এবং নিচে লেখা ‘কাল-যন্ত্র’। “এই চিহ্ন প্রাচীন নাথযোগীদের। তারা বিশ্বাস করত, সময় শুধুমাত্র একটি ধারাবাহিকতা নয়, এটি একাধিক সমান্তরাল রেখার সমষ্টি—যেখানে বিশেষ মন্ত্রে চেতনা একটি রেখা থেকে অন্য রেখায় স্থানান্তরিত হতে পারে। তবে তারা এটাও বলেছে—এই প্রক্রিয়া আত্মার ভার বহন করতে পারে না বারবার। একবার সরে গেলে, ফিরে আসার পথ ঝুঁকিপূর্ণ।” অনির্বাণ বিমলেশ্বরকে কিছু না জানিয়ে বুঝলেন, তিনি ইতিমধ্যেই এই চক্রে প্রবেশ করে ফেলেছেন। বিজ্ঞান তাকে বহু কিছু দিয়েছে, কিন্তু এখন সেই বিজ্ঞানের ভাষা যেন অচেনা ঠেকছে। সময়ের কাঁটা এখন তার নির্দেশ মেনে চলছে না—সে যেন নিজেই নিজের পথ খুঁজে নিচ্ছে।

সেই রাতে, ল্যাবে ফিরে এসে তিনি আবার বসেন পেনডুলামের সামনে। এইবার তার লক্ষ্য শুধু সময় নয়—সে চায়, চেতনা দিয়ে সময়কে ছুঁয়ে দেখতে। সুরেলা মন্ত্র উচ্চারণের ধ্বনি বেজে ওঠে তার রেকর্ডারে, যেগুলো সে পুঁথি থেকে কণ্ঠস্থ করেছে। কক্ষটি ধীরে ধীরে অদ্ভুত আলোয় ভরে যায়। চোখের সামনে সবকিছু ঘোলাটে হয়ে উঠতে থাকে, যেন সময় নিজেই কেঁপে উঠছে তার উপস্থিতিতে। হঠাৎই পিছনে একটা কণ্ঠস্বর—নরম, কিন্তু প্রখর, “তুমি কি জানো, তুমি কোথায় প্রবেশ করেছো?” তিনি ঘুরে তাকিয়ে দেখেন এক অপরিচিত নারী দাঁড়িয়ে আছেন—সাদা ধুতি, কপালে ত্রিপুণ্ড, চোখে গভীর আত্মজ্ঞান। তিনি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু নারীর কথা থামায় তাঁকে—“আমি ভ্রামরী। কালতন্ত্রের দ্বাররক্ষক। তুমি সময়কে জাগিয়ে তুলেছো। এখন সময় তোমাকে খুঁজবে।” অনির্বাণ বোঝেন, রাতটা আর কখনও আগের মতো হবে না। কালতন্ত্র তাকে এখন পিছনের দিকে টানছে—যেখানে শুধুই সময় নয়, রয়েছে এক গভীর আত্মিক রহস্য।

ভোরের আলো তখনো ঠিকমতো ভাঙেনি, কিন্তু সল্টলেক সেক্টর ফাইভের ফ্ল্যাটে অনির্বাণের মন স্থির নেই। সে সমস্ত রাত ঘুমোয়নি—ভ্রামরীর উপস্থিতি, তার কণ্ঠস্বরে উচ্চারিত অদ্ভুত বাক্য, আর সেই চোখের গভীরতা—সবকিছু যেন এক অদৃশ্য চুম্বকের মতো তার চিন্তায় গেঁথে গেছে। শুধু একবার মাত্র দেখা, তবু যেন বহু জন্মের পূর্ব পরিচয়। কিন্তু সমস্যাটা তার চেয়েও বড়। ঘড়ির কাঁটা উল্টো দিকে ঘোরা আর চেতনার বিচ্যুতি—এই অভিজ্ঞতা তাকে একেবারে স্থবির করে দিয়েছে। সে জানে, এ আর শুধু বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নয়—এ এক দেহের বাইরের অস্তিত্বে প্রবেশের প্রবণতা, যেখানে তন্ত্র বিদ্যার বাস্তবতা আঘাত হানে আধুনিক যুক্তিবাদকে। এমন অবস্থায়, একমাত্র যার উপর ভরসা রাখা যায়, সে হলো বিমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়।

বিকেলবেলা উত্তর কলকাতার হাতিবাগান অঞ্চলের পুরনো এক দোতলা বাড়িতে পৌঁছায় অনির্বাণ। এই বাড়িতেই বাস করেন বিমলেশ্বর, যিনি ইতিহাসের অধ্যাপক হলেও তার গবেষণার মূল ক্ষেত্র প্রাচীন ভারতীয় তন্ত্র, জ্যোতিষ ও উপনিষদ। বাড়ির ভেতরে ধূপকাঠির হালকা গন্ধ আর পুরোনো বইয়ের কাগজের গন্ধ মিশে এক অদ্ভুত আবহ তৈরি করেছে। অনির্বাণ পুঁথিটি নিয়ে হাজির হয়। বিমলেশ্বর চোখে চশমা লাগিয়ে পুঁথির পাতাগুলি একে একে দেখেন, আঙুলের ছোঁয়ায় প্রতিটি চিহ্ন যেন খুলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। “দ্যাখো এই প্রতীকটা,” তিনি বলেন, “ত্রিকোণাকার চিহ্নের ভেতরে ঘড়ির কাঁটা—এটা কালচক্রযন্ত্রের প্রতীক। নাথযোগীদের গোপন গোষ্ঠী ‘ত্রিকালনাথ’ এই চিহ্ন ব্যবহার করত। তারা সময়কে দেখত তিন রূপে—ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ—আর এই ত্রিকোণের মধ্য দিয়ে আত্মা নাকি চলাচল করতে পারত।” অনির্বাণ বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। “তোমার অভিজ্ঞতাটা ব্যাখ্যা করা কঠিন নয়,” বিমলেশ্বর ধীরে ধীরে বলেন, “তুমি সময়কে স্পর্শ করেছো, কিন্তু সেটা একমাত্র সম্ভব যদি চেতনা শরীরের বাইরে বিচরণ করে। এটাই কালতন্ত্রের মূলসূত্র।”

কথা শেষ হতেই অনির্বাণের মনের মধ্যে যেন একটি ক্লিক করে। সে মনে করতে পারে ভ্রামরীর সেই শেষ কথা—“তুমি সময়কে জাগিয়ে তুলেছো। এখন সময় তোমাকে খুঁজবে।” এই কথার তাৎপর্য কি শুধু আধ্যাত্মিকতা? না কি সত্যিই সময়, এক জীবন্ত সত্তা হিসেবে, প্রতিশোধ নিতে পারে? বিমলেশ্বর হেসে বলেন, “তুমি যে অবস্থায় পৌঁছেছো, সেখানে বিজ্ঞান আর তন্ত্র একে অপরকে অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু সাবধান—এই পথে চলতে গেলে আত্মিক ভারসাম্য না থাকলে চেতনা ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে পারে।” অনির্বাণ বোঝে, সে একটি বিপজ্জনক পথে পা বাড়িয়েছে। সে বলে, “আমাকে জানতে হবে, পুঁথিটির বাকি অংশ কোথায়, কারণ এখান থেকে তো শুরু মাত্র।” বিমলেশ্বর একটু থেমে বলেন, “বাকি অংশ? ওটা আছে এক ঘড়ির দোকানে, কলেজ স্ট্রিটের মোড়ের মাথায়—সেখানেই ছিল শেষ নাথযোগীর ছদ্মবেশী উত্তরসূরি।” তার কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে নিচু, “তাকে সবাই চেনে ‘ঘড়ির সাধু’ নামে।”

ফিরে আসার পথে অনির্বাণের ভেতর চলতে থাকে এক দ্বন্দ্ব। যুক্তিবাদ আর অনুশীলনের এতদিনের পথ পেরিয়ে সে আজ দাঁড়িয়েছে এমন এক সত্যের সামনে, যেটা কোনো মাইক্রোস্কোপে দেখা যায় না, কোনো থিসিসে ব্যাখ্যা করা যায় না। এ সত্য আত্মার, সময়ের এবং অদৃশ্য সংযোগের। সে জানে, এই পথে যাওয়ার মানে হলো—নিজের অস্তিত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলা। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ার পথও আর নেই। যে প্রশ্ন সে খুলে ফেলেছে, তার জবাব চাই—আর সে জবাব লুকিয়ে আছে ‘কালতন্ত্র’-এর বাকি পাতায়, সময়দণ্ডের রহস্যে, এবং সেই ঘড়ির দোকানে—যেখানে সে জানতে পারবে, সময়কে বাঁকানোর আগে কতটা আত্মাকে প্রস্তুত রাখতে হয়।

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত যখন নেমে আসে, তখন সল্টলেকের আকাশে ঝুলে থাকে এক নীলচে নির্জনতা। অনির্বাণ চৌধুরীর মাথা যেন ভেঙে পড়ছে চিন্তার ভারে। ‘ঘড়ির সাধু’, ‘ত্রিকালনাথ’, ‘কালচক্রযন্ত্র’—এসব কিছু যেন এক-একটা শব্দ নয়, বরং দরজা, যার পেছনে লুকিয়ে আছে এমন এক জগৎ, যেখানে সময় তার নিজের নিয়মে চলে না। বিমলেশ্বরের কথা বারবার তার মনে ভাসে: “তুমি চেতনার বাইরে গিয়েছো, এখন আর পুরোনো অবস্থায় ফেরা সম্ভব নয়।” অনির্বাণ জানে, সে এখন একটা রৈখিক জীবনের সীমা পেরিয়ে এসেছে। ঘুম তার কাছে এখন শুধুই শরীরের প্রয়োজন—মন, চেতনা, অনুভূতি সব কিছু সময়ের কাঁটার বাইরে ঘুরপাক খাচ্ছে। সে জানে, কিছু একটা আসছে। কিছু অজানা, অপ্রকাশ্য।

ঠিক রাত বারোটার সময়, যখন সে নিজের ডায়রি লিখছিল, টেবিলের পাশে রাখা ক্যাসেট প্লেয়ারটা নিজে থেকেই চালু হয়ে যায়। কীভাবে, তা বোঝার সময়ই নেই। অদ্ভুত এক মন্ত্র ধ্বনিত হতে থাকে—“কালং সর্বং ভ consuming: মহাকালং নমঃ।” শব্দ যেন ঘরের দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠে আসছে তার হাড়ের ভেতর। হঠাৎ সে অনুভব করে, কেউ দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। সে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে আছেন সেই নারী—যাকে সে দেখেছিল প্রথম রাতে, যার চোখে সে এক অদ্ভুত নিঃসঙ্গ গভীরতা অনুভব করেছিল। তার পোশাক একেবারে সহজ—সাদা ধুতি, মাথায় অল্প খোঁপা, কপালে চন্দনের ত্রিপুণ্ড। কিন্তু তার দৃষ্টিতে যে তীব্রতা, তা কোনো সাধারণ নারীর নয়। তিনি বলেন, “তুমি আমায় চিনতে পারছো, অনির্বাণ?” অনির্বাণ চমকে ওঠে—এই নারী তার নাম জানে কীভাবে? সে বলে, “তুমি কে?” — “আমি ভ্রামরী,” উত্তর আসে স্থির স্বরে, “কালতন্ত্রের রক্ষক, সময়ের ধারক। আমি সেই পথের পথিক, যেখানে সময় আর আত্মা একে অপরের প্রতিবিম্ব।”

ভ্রামরী ধীরে ধীরে ঘরের ভেতর হাঁটতে থাকেন। তার চোখ যেন ঘড়ির কাঁটার মতো—ধীরে, নির্ভুল, অতল গম্ভীর। তিনি বলেন, “তুমি সময়কে জাগিয়ে তুলেছো। তুমি তার প্রবাহে এক ফাটল এনেছো, অনির্বাণ। এটা শুধু বিজ্ঞানের ব্যাপার নয়। তুমি যেখানে পৌঁছেছো, সেখানে চেতনা আর সময় মিলেমিশে এক নতুন সত্ত্বা তৈরি করে—তাকে বলে ‘কালানুভব’। আর সেই অনুভব যদি অপরিণত আত্মার হাতে পড়ে, তা হলে সৃষ্টি হয় ‘আত্মাভ্রম’। তুমি সেই সীমানায় দাঁড়িয়ে, যেখানে আর পেছনে ফেরা যায় না।” অনির্বাণ বিস্ময়ে আচ্ছন্ন হয়ে প্রশ্ন করে, “তুমি জানলে কীভাবে?” ভ্রামরীর ঠোঁটে হালকা হাসি, “তুমি যখন প্রথমবার কালচক্রে প্রবেশ করেছিলে, আমি তা অনুভব করেছিলাম। আমারই ছায়া ছিল তোমার চেতনার সাথে বাঁধা। তুমি আমায় ডেকেছিলে নিজের অজান্তে।”

ঘরের বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠেছে। ভ্রামরী বসে পড়েন অনির্বাণের ঘড়ির যন্ত্রের পাশে। “এই যন্ত্র তুমি বানিয়েছো, কিন্তু এর প্রাণ নেই,” তিনি বলেন। “প্রাণ দিতে হলে প্রয়োজন আত্মজ্ঞান। তুমি শুধু ঘড়ির কাঁটা বাঁকাতে চাও, কিন্তু সময় হলো এক জীবন্ত সত্ত্বা। তাকে শুধু পরিমাপ করলে হবে না, জানতে হবে, অনুভব করতে হবে তার শ্বাস।” অনির্বাণ আর স্থির থাকতে পারে না। সে বলে, “তুমি কি আমাকে শেখাবে? আমি প্রস্তুত।” ভ্রামরী চোখ বন্ধ করেন। কণ্ঠে অদ্ভুত এক মন্ত্র উচ্চারিত হয়, ঘরের বাতাস ঘুরতে শুরু করে, সময় যেন থেমে গেছে কিছুক্ষণের জন্য। তিনি বলেন, “তোমার শরীর এখানেই থাকবে, কিন্তু চেতনা নিয়ে তুমি প্রবেশ করবে ‘ত্রিকালপথ’-এ। আমি তোমাকে প্রথম দিকচক্র দেখাবো।” অনির্বাণ জানে না কী হতে চলেছে, শুধু জানে—তার সামনে এক এমন দরজা খুলে গেছে, যেটি একবার পার হলে আর ফিরে আসার রাস্তা থাকবে না। কিন্তু সে ইতিমধ্যেই সময়ের ফাঁদে পড়েছে। এবার তার লক্ষ্য—ফাঁদ নয়, নিয়ন্ত্রণ।

পরের দিন সকালে অনির্বাণ তাঁর ল্যাবে পৌঁছতেই দেখতে পান, কেউ একজন আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত। চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠছে, আর ঘুরে ঘুরে নানা যন্ত্র দেখছে এক সুদর্শন যুবক—চওড়া কাঁধ, গাঢ় নীল শার্ট, চোখে অ্যাভিয়েটর চশমা, আর ঠোঁটে এমন এক আত্মবিশ্বাসী হাসি যা সহজেই যেকোনো দ্বিধা ছিঁড়ে ফেলতে পারে। সে ঘুরে তাকিয়ে বলে, “আহা, অবশেষে আপনার দেখা মিলল, ডক্টর চৌধুরী। আমি আদিত্য রায়—Aditya TechnoGenesis-এর কর্ণধার। আপনাকে বেশ কিছুদিন ধরে খুঁজছি।” অনির্বাণ একটু বিরক্তই হন অনধিকার প্রবেশে। তবু ভদ্রভাবে বলেন, “আপনার কী প্রয়োজন?” আদিত্য হেসে বলে, “আপনার গবেষণা নিয়ে আমার গভীর আগ্রহ। আপনি সময় নিয়ে যা করছেন, সেটাই আমাদের ভবিষ্যতের দিক নির্ধারণ করতে পারে। আপনি যদি এই প্রযুক্তির মূল কাঠামো আমাদের হাতে দেন, আমরা বিশ্ববাজারে বিপ্লব ঘটাতে পারি।” অনির্বাণ কিছুটা হতবাক। কেউ কি সত্যিই তার গবেষণার এতটা গভীরে ঢুকে পড়েছে?

অনির্বাণ বোঝেন, এটি কেবল উৎসাহের চেহারায় আসা এক কর্পোরেট অনুপ্রবেশ। আদিত্য খুবই কৌশলী—সে অনির্বাণের পেনডুলাম পরীক্ষা, চেতনা বিচ্ছুরণ, এমনকি কালপুঁথি নিয়েও খানিকটা জেনে এসেছে। অনির্বাণের প্রশ্নে সে হেসে বলে, “বিজ্ঞানের কোনো রহস্য চিরকাল গোপন থাকে না, ডক্টর। শুধু সময়ের ব্যাপার।” অনির্বাণ চুপ করে যান। তিনি জানেন, সময়ের এই অভ্যন্তরীণ রহস্য বিজ্ঞানের নয়—তন্ত্রের, আত্মার, চেতনার। কিন্তু কর্পোরেট মস্তিষ্ক সময়কে দেখে শুধুই এক পণ্যের চোখে—যাকে বিক্রি করা যায়, নিয়ন্ত্রণ করা যায়, প্রয়োজনে মানুষকে হাতের ক্রীড়নক বানানো যায়। আদিত্য এই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে ভবিষ্যৎ জানার চেষ্টা করতে চায়, শেয়ার বাজার থেকে যুদ্ধনীতিতে। সে অনির্বাণকে প্রস্তাব দেয় কোটি টাকার বিনিময়ে অংশীদারিত্ব—তবে সে জানে না, অনির্বাণ যা ধারণ করেছে, তা অর্থের মাপে মাপা যায় না।

সেই রাতে ভ্রামরী আবার আসে। তার মুখ কঠিন, চোখে অস্থিরতা। “ওর ছায়া আমি দেখেছি,” সে বলে। “আদিত্য শুধু একজন ব্যবসায়ী নয়, ও সময়চক্রের ফাঁক খুঁজে বেড়ায় অনেকদিন ধরে। ওর পূর্বসূরিরা ছিল ব্রিটিশ আমলে যেসব সময় সাধনার কাগজ চুরি করে লন্ডনে পাঠাত, তাদের বংশধর। ও জানে সময় ভাঙা যায়, কিন্তু জানে না—সময় প্রতিশোধ নেয়।” অনির্বাণ ভ্রামরীর দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি কি তাহলে কালতন্ত্র লুকিয়ে রাখব? বিজ্ঞান কি গোপন থাকা উচিত?” ভ্রামরী স্থির চোখে তাকিয়ে বলে, “বিজ্ঞান যদি আত্মাকে ছুঁয়ে ফেলে, তবে সেটা আর বিজ্ঞান থাকে না—তা হয়ে যায় নিয়তির চাবিকাঠি। সেই চাবি কাকে দেবে, সেটাই পরীক্ষার আসল স্থান।” অনির্বাণের ভেতরে শুরু হয় দ্বন্দ্ব—একদিকে সত্য আবিষ্কারের তৃষ্ণা, অন্যদিকে সত্যকে নিয়ন্ত্রণ করার ভয়। সে বুঝতে পারে, আদিত্য যদি কালতন্ত্রের এক বিন্দুও পায়, তবে সময় আর মানুষের জন্য মুক্তির পথ হবে না—তা হয়ে উঠবে সীমাহীন দাসত্বের অস্ত্র।

পরদিন সকালে অনির্বাণ তার গবেষণাগারে ফিরে গিয়ে প্রথম কাজ করলেন নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্ত করা। তার মন্ত্র-কাঠামো, চেতনার তরঙ্গ রেকর্ড, এমনকি ঘড়ির গহ্বরে লুকিয়ে রাখা সেই সময়দণ্ড—সবকিছুর উপরে রক্ষাকবচ বসালেন। আদিত্য বুঝতে পারে, অনির্বাণ তার পিছু হটেনি—বরং আরও দৃঢ় হয়ে উঠেছে। সেই মুহূর্তে, শহরের আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আদিত্য বলে উঠল এক নিজস্ব অঙ্গীকার—“যদি সময় হাতের মুঠোয় আসতে পারে, তবে সেটি আমার মুঠোতেই আসবে। অনির্বাণ চৌধুরী বাধা হতে পারে, কিন্তু সময় কখনোই অপেক্ষা করে না। আমি তাকে পিছু ডেকে আনবো।” আর অনির্বাণ, সেই রাতে, ঘুমোবার আগে নিজের নোটবুকে লিখে রাখেন একটি বাক্য—“সময় এখন শব্দ নয়, অস্ত্র।”

কলেজ স্ট্রিট, দুপুর তিনটে। বইয়ের দোকান আর কাগজের গন্ধে ভরা এক জাদুকরি অলিগলি। এই রাস্তার প্রতিটি ইট যেন ইতিহাস ধারণ করে আছে। অনির্বাণ ধীরে ধীরে হাঁটছিল। তার চোখের দিকে কেউ তাকালে বুঝে যেত—সে কোনো সাধারণ পাঠকের খোঁজে আসেনি। সে খুঁজছে এমন একজনকে, যাকে সকলে জানে ঘড়ির মিস্ত্রি হিসেবে, কিন্তু তার আসল পরিচয় ঢাকা পড়ে আছে প্রাচীন তন্ত্র ও সময়-চর্চার পর্দার আড়ালে। ঠিক পলস ক্যাফের উল্টোদিকে একটা স্যাঁতসেঁতে গলি—সেখানে টিনের ছাউনির নিচে ছোট্ট দোকান: “সময়ের ঠিকানা।” দোকানটার সামনে কয়েকটা পুরোনো ওয়াল ঘড়ি ঝুলছে, যেগুলোর কাঁটা যেন নিজের ইচ্ছেতে চলে। অনির্বাণ একটা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে ভেতরে পা রাখল।

দোকানের ভেতরে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা। লম্বা কাঠের তাকজুড়ে ঘড়ির সারি, কিছু ঘড়ি চলমান, কিছু একদম স্তব্ধ। দেয়ালে ঝুলছে সাদা-কালো কিছু ছবি—যার একটিতে দেখা যাচ্ছে একজন সন্ন্যাসীর পাশে এক প্রাচীন পুঁথি খুলে রাখা। ঠিক তখনই একটা কাশির শব্দ। দোকানের কোণ থেকে উঠে এলেন এক বৃদ্ধ—রক্তিম কপালে তিন দাগের ত্রিপুণ্ড, পরনে মলিন ধুতি, হাতে লাল রঙের পুঁতির মালা। অনির্বাণ বুঝে গেল, এ-ই সেই ব্যক্তি—ঘড়ির সাধু। বৃদ্ধ তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ, তারপর বললেন, “তুই এসে গেছিস অবশেষে।” অনির্বাণ চমকে উঠে বলল, “আপনি জানেন আমি কে?” — “তুই নিজেই জানিস না এখনও তুই কে, তবে সময় জানে। আর আমি শুধু সময়ের দোকানদার। যা চায়, তাকে দরজা খুলে দিই।”

বৃদ্ধ তাকে ভেতরের একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসতে বলেন। “আমি জানি তুই কী খুঁজছিস—কালতন্ত্রের শেষ পৃষ্ঠা। কিন্তু তার আগে শোন, সময় কেবল ঘণ্টা আর কাঁটার মধ্যে থাকে না। সময় একটা নদী নয়, একটা চক্র—আর চক্রে ঢুকলে ঠিক জায়গায় থামতে না পারলে, সব কিছু আবার শুরু হয়।” তিনি একটা ছোট কাঠের বাক্স আনেন, যার মধ্যে লুকানো ছিল একটি রত্নখচিত যন্ত্র—সময়দণ্ড। দেখতে ছোট্ট একটা সেপটারের মতো, যার শীর্ষে ঘড়ির কাঁটার মতো সূচ বসানো। “এটা একবারই ব্যবহার করা যায়। ব্যবহার করার আগে জানতে হবে কোথায় থামতে হবে, নয়তো আত্মা আটকে যাবে চক্রের ঘূর্ণিতে।” অনির্বাণ বিস্মিতভাবে জিজ্ঞাসা করল, “এই যন্ত্র দিয়ে কি চেতনা প্রেরণ করা সম্ভব নির্দিষ্ট সময়ে?” ঘড়ির সাধু মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ, তবে শুধু চেতনা নয়, সময়ও তোর দিকে ছুটে আসবে। যদি তুই প্রস্তুত না থাকিস, তবে তুই আর ফিরতে পারবি না।”

তিনি জানালেন, বহু শতাব্দী আগে ত্রিকালনাথ সম্প্রদায়ের একজন তান্ত্রিক এই সময়দণ্ড নির্মাণ করেন। তার কাজ ছিল কেবল তন্ত্রের শক্তিকে সময়চক্রে স্থাপন করা, যাতে আত্মা নির্দিষ্ট মুহূর্তে নিজেকে উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু এরপর থেকেই সেই তান্ত্রিক নিখোঁজ। অনেকে বলে, সে আটকে গেছে সেই সময়চক্রে, প্রতিবার জন্ম নিয়ে চেষ্টা করছে ফিরে আসার। অনির্বাণ শুনে শিউরে ওঠে—তাঁর নিজের জীবনের অদ্ভুত পুনরাবৃত্তির স্মৃতি ভেসে ওঠে, যেন সব কিছু পূর্ব নির্ধারিত ছিল। ঘড়ির সাধু বলেন, “তুই এই দণ্ডের যোগ্য কিনা, তা তোর চেতনা জানে। আমি শুধু রক্ষক। তবে স্মরণ রাখিস, সময় একবার ছুঁলে আর পেছনে ফিরিস না।”

অনির্বাণ ধীরে ধীরে সময়দণ্ড হাতে নেয়। তার মনে হয়, এই মুহূর্তটাই তার জীবনের সবচেয়ে ভারী সিদ্ধান্ত। সে জানে, কালতন্ত্রের পথে তাকে একা হাঁটতে হবে, কিন্তু সে আরও জানে—পেছনে থেকে যাবে এই ঘড়ির সাধু, যিনি সময়ের রক্ষক, অভিভাবক, কখনো কখনো পরীক্ষক। দোকান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ঘড়ির সাধু কেবল একটা কথা বলেন—“সময় যেমন গড়ায়, তেমন গড়ায় না। ওকে ডাকতে জানলে আসে, না জানলে চুরমার করে দেয় সব। সাবধানে হাঁটিস।” আর অনির্বাণ, সন্ধ্যার রোদে দাঁড়িয়ে, সময়দণ্ড বুকের ভেতর রেখে হাঁটতে শুরু করে—সে জানে, তার পথ আর ফিরে যাওয়া নয়, বরং সময়ের সঙ্গে সামনে এগোনোর এক নির্লজ্জ, ঝুঁকিপূর্ণ যুদ্ধ।

রাত তখন গভীর। শহরের শব্দ থেমে এসেছে, কেবল অনির্বাণের গবেষণাগারে ঘড়ির কাঁটার একটানা টিকটিক শব্দ। তার সামনে রাখা সময়দণ্ড যেন আলোয় ঝলমল করে উঠছে—কিন্তু আলোটা কোনো বৈদ্যুতিক প্রতিফলন নয়, বরং যেন চেতনার ভেতর থেকে উৎসারিত। অনির্বাণ সেই দিন বিকেল থেকে কিছুই খাননি। ঘড়ির সাধুর দেওয়া কথাগুলো, ভ্রামরীর উপস্থিতির ধাক্কা, আর নিজের অন্তঃস্থ কৌতূহল—সব মিলিয়ে সে নিজেকে অনেকটাই নিঃসার বোধ করছে, তবুও ভিতরে এক ভয়ঙ্কর আলো জেগে উঠেছে। কালতন্ত্রের তৃতীয় স্তর পর্যন্ত সে পৌঁছে গেছে, পুঁথির পাণ্ডুলিপিতে লেখা আছে—তৃতীয় স্তরে আত্মা নিজেকে প্রকৃত সময়ে স্থাপন করতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—‘সেই সময়’ বেছে নেওয়া কি নিজের ইচ্ছার উপর নাকি সময়ই নিজের মত বেছে নেয় আগতকে? অনির্বাণ জানে না। তবে সে প্রস্তুত।

সে একটি চক্র এঁকে নেয় ল্যাবের ফ্লোরে—পুঁথিতে নির্দেশিত “চক্রবিন্দু সঞ্চার মন্ডল”। সেই চক্রের মাঝে বসে, সময়দণ্ড হাতের মধ্যে রাখে। চোখ বন্ধ করে, ভ্রামরীর উচ্চারিত মন্ত্রের প্রতিধ্বনি মনে করে মনে মনে আওড়ে যেতে থাকে—“কালং নমঃ। সময়ং প্রবিশ। চেতনা বিসর্জয়।” তার শ্বাস ধীরে ধীরে ভারী হয়ে আসে। সময়ের কাঁটা যেন থেমে গিয়েছে, ঘরের সব শব্দ স্তব্ধ। হঠাৎ একটা বিদ্যুৎঝলকের মতো অনুভূতি—তার শরীর যেন সরে গেল একপাশে, আর চেতনা ভেসে উঠল উপরের দিকে, তারপর সামনে, তারপর… সময়ের বাইরে। আলো আর অন্ধকারের মাঝে সে দেখতে পায় প্রবাহিত এক মহাপথ—যেন অসংখ্য কালের রেখা, নদীর মত এগিয়ে যাচ্ছে অসীম গন্তব্যের দিকে। প্রতিটি রেখায় চলেছে জীবনের অসংখ্য দৃশ্য—কেউ হাঁটছে, কেউ কাঁদছে, কেউ মারছে, কেউ জন্ম নিচ্ছে। এবং তারপর, হঠাৎ করে সে থেমে গেল—তার আত্মা নিজেকে অনুভব করল একটি ভিন্ন সময়ে।

সে এখন দাঁড়িয়ে আছে ১৮৬৫ সালের কাশী শহরের একটি সরু গলিতে। ঘড়ির শব্দ নেই, ট্রামের ধ্বনি নেই, গাড়ির চেঁচামেচি নেই। বদলে আছে ষাঁড়ের ঘণ্টার শব্দ, মাটির গন্ধ, আর সেই পুরনো বাংলার সুরভিত ভয়। তার পরনে এখন আধা-ধ্বংসপ্রাপ্ত ধুতি, মাথায় ঘাম, এবং চোখে বিস্ময়। সে নিজেকে চিমটি কেটে বোঝে—সে শারীরিকভাবে নয়, তবে চেতনাগতভাবে উপস্থিত এক অন্য সময়ে। সেখানে সময় চলছে নিজের নিয়মে, কিন্তু সে যেন সেই সময়ের বাইরের কেউ। হঠাৎ করেই সামনে এসে দাঁড়ায় এক বৃদ্ধ—কাঁধে জটা, কপালে আগুনের রঙে আঁকা ত্রিপুণ্ড। তিনি অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে বলেন, “তুই অনেক দেরি করে ফেলেছিস, আত্মা। সময় তোকে ডাকছিল বহুদিন ধরে।” অনির্বাণ থমকে যায়, “আপনি কে?” বৃদ্ধ হেসে বলেন, “আমি তোরই পূর্বজ। এই পথ আমি খুলেছিলাম। তবে ফিরতে পারিনি।” অনির্বাণ বুঝে যায়, সে সেই রহস্যময় তান্ত্রিকের মুখোমুখি, যার পুঁথি থেকে শুরু হয়েছিল কালতন্ত্রের যাত্রা।

তাঁরা দুজনে বসেন গঙ্গার ঘাটে। গঙ্গার জলের শব্দ যেন আর কিছু নয়, সময়ের ছন্দ মাত্র। বৃদ্ধ বলেন, “তুই যা করেছিস, তাতে ভবিষ্যৎ বদলাতে পারে। তবে সময় বদলানো মানেই যে ভবিষ্যৎ পাল্টাবে, তা নয়। সময় জীবন্ত, সে প্রতিরোধ করে, কখনো কখনো প্রতিশোধ নেয়। সময়ের উপর আধিপত্য চাইলে আগে আত্মাকে শুদ্ধ করতে হয়।” অনির্বাণের গলা শুকিয়ে আসে। সে প্রশ্ন করে, “তাহলে কি আমি ভুল করছি?” বৃদ্ধ মাথা নাড়েন, “না। তবে তুই যা করছিস, সেটা শুধু নিজের জন্য করলে ক্ষতি হবে। মনে রাখিস, তুই এখন এক সেতু, অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে, চেতনা ও বাস্তবের মধ্যে।” অনির্বাণ জানে, তার হাতে সময় আছে—কিন্তু সে বুঝতে পারছে, সময়কে বুঝতে হলে আগে বুঝতে হবে নিজেকে, নিজের সীমা, নিজের ছায়া।

আনুমানিক সেই একই সময়ে, যখন অনির্বাণ অতীতে আত্মা বিসর্জন দিয়ে ফিরে আসার পথ খুঁজছে, কলকাতার নিউটাউন অঞ্চলের এক গ্লাস টাওয়ারে আলো জ্বলছিল ভোররাতেও। আদিত্য রায়, প্রযুক্তি উদ্যোক্তা, তার ব্যক্তিগত গবেষণা ঘরে বসে ছিল এক অদ্ভুত উৎকণ্ঠায়। তার সামনে টেবিলজুড়ে ছড়ানো ছিল অনির্বাণের গবেষণার কিছু কপি—চুরি করে আনা সফট ফাইল, পেনডুলামের কাঠামোর নোট, এমনকি চর্মপুঁথির পাতা স্ক্যান করে রঙিন প্রিন্ট। আদিত্য জানে, সে পুরোটা বুঝে উঠতে পারেনি, কিন্তু এই “কালতন্ত্র” জিনিসটা কী, তার ধারণা স্পষ্ট হয়ে গেছে—এ কোনো থিওরি নয়, এ এক বাস্তব শক্তি। এবং এই শক্তির দখল মানেই সময়ের উপর নিয়ন্ত্রণ, ভবিষ্যৎ নিজ হাতে গঠন করা। অনির্বাণ যেটিকে তন্ত্র ও আত্মজ্ঞানের প্রশ্ন বলে দেখে, আদিত্য সেখানে দেখে এক বিপ্লবের সম্ভাবনা। সে বলে, “যদি সময় নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, তাহলে অর্থনীতি, রাজনীতি, মানুষ—সবই আমার ইচ্ছায় চলবে।”

গভীর রাত। সে নিজের তৈরি করা ‘টাইম-চেম্বার’-এ প্রবেশ করে। এটি ছিল এক বিশেষভাবে প্রস্তুত কোয়ান্টাম চেম্বার, যেখানে কৃত্রিমভাবে সময়চক্রের তরঙ্গ তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছিল—অবশ্যই অনির্বাণের নোট ঘেঁটে। সে সময়দণ্ডের অনুরূপ এক জিনিস বানিয়েছে, যদিও তাতে ছিল না তন্ত্রের প্রাণ-শক্তি। তবু, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর আদিত্য নিজের শরীরে বিশেষ সেন্সর লাগিয়ে চেম্বারের মধ্যে প্রবেশ করল। কক্ষের চারদিকে ঘুরছে গাণিতিক তরঙ্গ, সাদা আলো ঝলমল করছে, একঘেয়ে শব্দে ঘুরছে প্রোগ্রাম। সে চোখ বন্ধ করে উচ্চারণ করে কিছু বিভ্রান্ত মন্ত্র, যা সে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছে অনির্বাণের খাতার ছেঁড়া পৃষ্ঠার উপর ভিত্তি করে। প্রথমে কিছুই হয় না। তারপর আচমকা বিদ্যুৎ চমকের মত আলোর বিস্ফোরণ। পুরো কক্ষ থেমে যায় এক মুহূর্তের জন্য, তারপর এক চিৎকার—আদিত্যর নিজের, যেন কেউ তাকে ছিঁড়ে নিচ্ছে সময়ের মধ্যেই।

দুই ঘণ্টা পর আদিত্যকে পাওয়া যায় তার অফিসের মেঝেতে, নিঃসাড়, চোখ খোলা, ঠোঁট কাঁপছে। ডাক্তার এসে দেখে—তার হার্টবিট স্বাভাবিক, শরীরে চোট নেই, কিন্তু সে যেন ১৮৬০ সালের কোনো ভাষায় অস্পষ্ট উচ্চারণ করে যাচ্ছে, যার অর্থ উদ্ধার করা যাচ্ছে না। কখনো সে বলছে, “বহে না গঙ্গা… রক্ত… কাশীর মাটি…” আবার কখনো ফিসফিস করে, “আমি ফিরে আসতে পারিনি… ফিরে আসিনি…” তার মুখ বিকৃত, চোখ যেন দেখছে কিছু যা এ জগতে নেই। সে নিজেকে চিনছে না, আশপাশকে ভুল করে কারাগার ভাবছে, এবং সবসময় ঘরের এক কোণে তাকিয়ে থাকছে, যেখানে কিছুই নেই। মানসিক চিকিৎসকরা বলেন, এটি এক ধরনের ট্রমা-ইউসড সাইকোসিস। কিন্তু অনির্বাণ, ফিরে এসে সংবাদ পেয়ে, বুঝে যান—আদিত্য শুধু পাগল হয়নি, সে সময়চক্রে ঢুকে গিয়েছিল ভুলভাবে, আর ফিরে এসে ফেঁসে গেছে দু’টি সময়ে—অতীতের এক ছিন্নপ্রায় স্মৃতি আর বর্তমানের অপার বাস্তবতার মাঝে।

অনির্বাণ দেখে আদিত্য এখন আর কর্পোরেট মুখ নয়—সে এখন সময়ের ভুল ব্যাখ্যার এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। সে বলে, “তুই আমাকে বিশ্বাস করোনি, কিন্তু সময় আমায় ঢুকতে দিল। এখন আমি কোথায়, তুই বলতে পারবি?” তার কণ্ঠে ঠান্ডা ভয়, তার শরীরের ভেতরে যেন বাস করছে আরও কেউ, আরও কিছু। ভ্রামরী অনির্বাণকে বলে, “এটাই সময়ের প্রতিশোধ। যাকে জোর করে ছোঁয়া হয়, সে সময় নয়, সে হয় ভয়াবহ বিকৃতি। আদিত্য এখন সময়ের ফাঁদে। তাকে বাঁচাতে গেলে তোর আরও গভীরে যেতে হবে।” অনির্বাণ চুপ করে যান। তিনি জানেন, সময় খেলনা নয়। তবু, একজন মানুষ—যে ভুল করেছিল, লোভে ঢুকেছিল অন্ধকারে—তাকে কি ফেলে রাখা যায়? সময় যদি প্রতিশোধ নেয়, তবে কেউ কি সময়ের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার পথ খুঁজে পায় না?

রাত তিনটে। অনির্বাণ তার ল্যাবরেটরির মেঝেতে বসে আছে, সামনে রাখা সময়দণ্ড, ঘূর্ণায়মান পেনডুলাম, আর মাঝখানে খোলা পুঁথির শেষ খণ্ডটি। ঘড়ির সাধুর কাছ থেকে ফিরে এসে সে বুঝে গিয়েছে—যে চেতনা প্রথমবার সময় ভেদ করে গিয়েছিল, এবার তাকে আরও গভীরে নামতে হবে। কারণ আদিত্য একা নয়, তার অভিজ্ঞতা অনির্বাণের দিকেই আঙুল তুলছে—এই গবেষণা, এই তন্ত্র, এই চেতনার প্রয়োগ সব কিছুই ছুঁয়ে গেছে এমন এক রেখা, যার পর থাকে শুধু বিভ্রম আর বাস্তবের লুপ্ত সীমানা। ভ্রামরী এসে বসে তার পাশে, নীরব। দীর্ঘক্ষণ কিছু না বলে শেষে সে বলে, “তুমি এখন সময়ের ফাঁদে পা দিচ্ছো, অনির্বাণ। তুমি যদি ফিরে না আসতে পারো, তাহলে শুধু তুমি নয়—সময় নিজেই হারিয়ে যাবে নিয়ন্ত্রণ।”

অনির্বাণ জানে, এবার আর আত্মার ভ্রমণ নয়—এবার তার চেতনার এক টুকরোকে পাঠাতে হবে ঠিক সেই সময়সন্ধিক্ষণে, যেখানে আদিত্য আটকে গেছে। সে পেনডুলামের গতিপথ পরিবর্তন করে, সময়চক্রে নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সি বসায়—১৮৬০ সালের কাশী, এক ঘোরলাগা সন্ধ্যার মুহূর্ত, যেখানে সময় থেমেছিল আদিত্যর চেতনাকে ধরে রেখে। সে বুঝতে পারে, সেখানে এখনও একটি ছায়া আটকে আছে, যা নিজেকে সময় বলে ভাবছে—এক বিভ্রম সত্ত্বা, যার রূপ নেই, নাম নেই, কেবল অস্থিরতা আর ফিসফাস। পুঁথিতে লেখা আছে—“এই ফাঁদ এমন এক কালচক্র, যেখানে প্রবেশ করলে মানুষ ভুলে যায় সে কে, সে কোথা থেকে এসেছে, সে কেন এসেছে। তার চেতনা ভেঙে যায়—কিছুটা থাকে ভবিষ্যতে, কিছুটা আটকে পড়ে অতীতে।” অনির্বাণ নিজেকে তৈরি করে। সময়দণ্ড তার কপালে স্পর্শ করিয়ে, চোখ বন্ধ করে মন্ত্র উচ্চারণ শুরু করে—“চেতনা দিক্সন্ধানং, সময়পথে বিসর্জনং, বিভ্রমে মুক্তি।”

হঠাৎ করেই ঘর থেমে যায়। আলো নিভে যায়, শব্দ স্তব্ধ হয়। অনির্বাণ অনুভব করে, সে এখন আর এই ঘরে নেই। তার সামনে শুধু অন্ধকার, আর সেই অন্ধকারে কানে ভেসে আসে হাজার হাজার মানুষের কণ্ঠ—কেউ কাঁদছে, কেউ ডাকছে, কেউ হাসছে অদ্ভুতভাবে। সামনে কুয়াশার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে একজন—চেনা, কিন্তু বিকৃত। আদিত্য। তবে তার চোখে এখন আর আদিত্য নেই—তাতে আছে দুঃস্বপ্ন, সময়ে ফেঁসে যাওয়ার ছাপ। সে বলে, “অনির্বাণ, তুমি কেন এলে? তুমি তো জানো, এখানে কোনো কিছু স্পষ্ট নয়। এখানে আলো নেই, এখানে সময় নেই।” অনির্বাণ ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়, বলে, “তুই বাস্তব নয়, তুই বিভ্রম। আমি জানি, তুই আটকে পড়েছিস সময়ের ফাঁদে, কিন্তু আমি তোকে টেনে আনব।” তখনই পিছন থেকে একটা চেহারা—মানুষের মতো নয়, কাঁটা দিয়ে মোড়া এক সময়-ছায়া, চোখের জায়গায় কাঁটা ঘুরছে। সে হেসে বলে, “তাকে নিলে তুই হারাবি নিজেকে। একটি আত্মা, একটি চেতনা—আর বেশি নয়।”

এই সময়েই ভ্রামরীর কণ্ঠ অনির্বাণের মনে প্রতিধ্বনিত হয়—“ভয়কে পেছনে রেখে এগোতে হয়। সময়কে ছুঁতে গেলে আত্মাকে পুড়তে হয়।” অনির্বাণ বুঝে যায়, সে নিজের চেতনার একাংশ দিতে প্রস্তুত—আদিত্যকে টেনে আনার জন্য। সে পেনডুলামের কাঁটা নিজের বুকে গেঁথে দেয়, আর মুহূর্তেই আলো বিস্ফোরিত হয়, চারপাশ ঘুরে যায় অসংখ্য ঘড়ির কাঁটার মতো। সেই ছায়া চিৎকার করে মিলিয়ে যায়, আর আদিত্য মাটিতে পড়ে যায়—মৃত নয়, কিন্তু মুক্ত। এবং অনির্বাণ বুঝে যায়, সে ফিরে আসছে… তবে সম্পূর্ণরূপে নয়।

ল্যাবে ফিরে আসার সময় তার শরীর নিঃসাড় নয়, চোখ খুলছে ধীরে ধীরে, কিন্তু তার ভেতরে কিছু একটায় চিরতরে বদলে গেছে। সে সময়কে ছুঁয়েছে, তাকে ভেঙেছে, আবার গড়েছে। কিন্তু তার চেতনার এক অংশ রয়ে গেছে সেই ফাঁদে, হয়ত আর কোনোদিন ফিরবে না। ভ্রামরী কাঁপা গলায় বলে, “তুমি তাকে ফিরিয়ে এনেছো, কিন্তু নিজের একটা দিক হারিয়ে বসেছো।” অনির্বাণ চুপ করে থাকে। কারণ সে জানে—যে জায়গায় সময় থামে, সেখানে মানুষ আর পূর্ণ থাকে না।

অনির্বাণ জানে—তার চেতনার একাংশ ফাঁদে রয়ে গেছে, আর সেই ফাঁদ থেকে পূর্ণভাবে ফিরে আসার একমাত্র উপায় লুকিয়ে আছে ত্রিকালনাথ সম্প্রদায়ের মূল গুহা–এক স্থানে, যেখান থেকে শুরু হয়েছিল এই কালতন্ত্রের যাত্রা, যেখানে সময় ও আত্মা প্রথমবার পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিল। বিমলেশ্বর তাকে বলেন, “এই গুহা সময়ের শরীরের ভেতরে ছিদ্র—তুই যা বলিস wormhole, কিন্তু তা শুধু জ্যোতির্বিদ্যার নয়, আত্মারও। বহু শতাব্দী আগে এখানে সেই প্রথম তান্ত্রিক, যার নাম কালে হারিয়ে গেছে, গড়েছিলেন ত্রিকালবিন্দু সঞ্চার। তিনটি সময়ের যোগপথ। সেই পথেই তোকে যেতে হবে—নইলে চক্র ভাঙবে না।”

পাহাড়ি অঞ্চল—উত্তরবঙ্গের এক জনমানবহীন জায়গা, নাম আলকাপুর। লোককথায় শোনা যায়, এই অঞ্চলে রাতের বেলা সময় থেমে যায়, ঘড়ি চলে না, পশুপাখি চুপ করে থাকে, আর কেউ কেউ বলে—তাদের পূর্বপুরুষেরা নাকি এই সময়ভেদী গুহার রক্ষক ছিলেন। অনির্বাণ পৌঁছে সেখানে, সঙ্গে ভ্রামরী। পাহাড় বেয়ে বহুটা উপরে উঠে তারা পৌঁছায় সেই গুহার মুখে—প্রাকৃতিক নয়, বরং মনুষ্যনির্মিত, কিন্তু এমন কারিগরিতে খোদাই করা যেন প্রকৃতিরই অংশ। প্রবেশপথের উপরে খচিত আছে এক প্রতীক—ত্রিকোণ, যার তিন কোণে সূর্য, চাঁদ আর এক ঘড়ির কাঁটা। ঘড়ির কাঁটা উল্টো দিকে বাঁকানো। ভ্রামরী বলে, “এটাই ত্রিকালবিন্দু। তিন সময়ের সীমানা যেখানে এক বিন্দুতে মিশেছে।”

গুহার ভেতরে নেমে গেলে আলো থাকে না, শব্দ থাকে না—শুধু নিজস্ব চেতনার প্রতিধ্বনি। অনির্বাণ টর্চ ফেলে, সময়দণ্ড হাতে নিয়ে এগোয় ভিতরে। হঠাৎ চারপাশে শুরু হয় অদ্ভুত এক ঝড়—না, প্রকৃতির নয়, বরং চেতনার। সে দেখতে পায় তিনটি দরজা—প্রতিটি একটি সময় নির্দেশ করছে: অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। এবং প্রতিটি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এক একটি ছায়া, যেন সময় নিজেই তার তিন রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। অতীত—এক বয়স্ক সন্ন্যাসী, যিনি শুধু স্মৃতি ধারণ করেন; বর্তমান—এক যুবক, যার চোখে দ্বন্দ্ব; ভবিষ্যৎ—এক নারী, যার চোখ অন্ধ, কিন্তু ঠোঁটে একটি অশরীরী হাসি। তারা একসাথে বলে, “তুমি চক্র ভাঙতে চাও? তবে দিতে হবে নিজেকে। যাকে গ্রহণ করবে এক সময়, তাকে ত্যাগ করতে হবে অন্য সময়।”

অনির্বাণ বুঝে যায়—এখান থেকে ফিরে গেলে সে পূর্ণ থাকবে না। এক সময় তার চেতনা কেড়ে নেবে একাংশ—তা হয়তো স্মৃতি, হয়তো ভবিষ্যৎ-দৃষ্টি, অথবা বর্তমানের অনুভব। তবু সে এগিয়ে যায়। তিনটি দরজায় একত্রিত হয়ে দাঁড়ায় সময়দণ্ড হাতে, উচ্চারণ করে সেই শেষ মন্ত্র, যা শুধু একজন চেতনা-সন্ধানী উচ্চারণ করতে পারে—
“ত্রিকালং নমঃ। চেতনা বিংদু সঞ্চারং। সময় বিভক্তি, আমি এক।”

চারপাশে আলো বিস্ফোরিত হয়, গুহা কাঁপতে শুরু করে, শব্দের অতল গভীর থেকে উঠে আসে এক সুর—তাঁর নিজের গলার সুর, কিন্তু অনেক দূরের, যেন পূর্বজন্ম থেকে উচ্চারিত। তৎক্ষণাৎ গুহা স্থির হয়ে যায়। সামনে দাঁড়িয়ে থাকে এক দরজা, যা ছিল না কিছুক্ষণ আগেও—এক রত্নখচিত তামার দরজা, যার গায়ে লেখা—
“যে নিজেকে জানে, সে সময়কে বদলায় না, সময় নিজেই তাকে বদলে দেয়।”

অনির্বাণ সে দরজা পেরিয়ে যায়। এখন তার সামনে আর কোনো দিক নেই, কেবল এক বিন্দু—ত্রিকালবিন্দু, যেখান থেকে সব শুরু, যেখানে সব শেষ।

১০

ত্রিকালবিন্দুর সেই দরজার ওপারে এক রহস্যময় শূন্যতা। কোন মাটি নেই, কোন আকাশ নেই—কেবল এক অনন্ত সাদা পর্দার মত জায়গা, যেখানে অনির্বাণ দাঁড়িয়ে আছেন নিজের অস্তিত্ব নিয়ে। কানে ভেসে আসছে নিজের শ্বাস, নিজের হৃদস্পন্দনের মতো একঘেয়ে শব্দ, অথচ যেন তা তার নিজের নয়। হঠাৎ করেই সে অনুভব করে—তার শরীর ছায়ায় রূপ নিচ্ছে, এবং ছায়াটি রূপ নিচ্ছে এক গোলাকার আলোয়। সেই আলো থেকেই বেরিয়ে আসে একটি পুরুষ কণ্ঠস্বর—নয় শীতল, নয় উষ্ণ।
“আমি কালতন্ত্রের আত্মা। আমি তোরই মতো একজন ছিলাম, যে জানতে চেয়েছিল সময়কে। এখন আমি সময় নিজেই। তুই যদি জানতে চাস শেষ সত্য, তবে জানতে হবে প্রথম প্রশ্ন—তুই কে?”

অনির্বাণ থমকে যায়। সে নিজেকে বলে, “আমি অনির্বাণ, একজন গবেষক, একজন অনুসন্ধানকারী…” কিন্তু আলো তীব্রতর হয়। কণ্ঠস্বর আবার বলে,
“তুই একজন গবেষক, কিন্তু সময় তো শুধু বিজ্ঞানের বস্তু নয়। তুই যদি সত্যিই সময়কে স্পর্শ করতে চাস, তবে তোর অস্তিত্ব ত্যাগ করতে হবে। সময়ের ভাষা শুধু আত্মা বোঝে, মন নয়। তোকে জানতে হবে—সময় কি কিছু বহন করে, না শুধুই গ্রাস করে।”

এই মুহূর্তে অনির্বাণের সামনে দেখা যায় তার অতীত—ছোটবেলায় বাবার ঘড়ি খুলে দেখছে, মায়ের মুখে শোনা প্রথম “সময় মানে নিয়ম”, তার প্রথম প্রেম, প্রথম ব্যর্থতা, প্রথম মৃত্যু দেখার অভিজ্ঞতা। সমস্ত স্মৃতি একসাথে এসে হু হু করে বাজতে থাকে তার মাথায়। সে চিৎকার করে বলে ওঠে,
“আমি তো শুধু জানতে চেয়েছিলাম—কেন কিছুই থামে না? কেন সময় শুধু নিয়ে যায়?”
আলো যেন ধীরে ধীরে অনির্বাণকে ঢেকে নিচ্ছে। কণ্ঠস্বর এবার নরম হয়ে বলে,
“তুই বুঝে গেছিস। সময় কিছুই নিয়ে যায় না, মানুষই নিজেকে সময়ে বিলিয়ে দেয়। আর সেই বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যেই লুকিয়ে আছে চিরকাল বেঁচে থাকার রহস্য। যে নিজেকে বিসর্জন দেয়, সে-ই সময়ের মালিক।”

এবং ঠিক তখনই অনির্বাণ দেখতে পায় এক দরজা, যার ওপারে রয়েছে একটি বই—তার নিজের লেখা, অথচ সে কোনোদিন লেখেনি। বইয়ের নাম:
“ঘড়ির কাঁটা ও কালতন্ত্র”
প্রথম পাতায় লেখা:
“লিখেছেন: অনির্বাণ চৌধুরী — এক চেতনা, যা ফিরে এসেছিল সময়ের বাইরে থেকে।”

সে বইটি হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করতেই চারপাশে ঝড় উঠে যায়, আলো মিলিয়ে যায়, দরজা গলে যায় শূন্যতায়।

অনির্বাণ জেগে ওঠে নিজের ল্যাবে—ঘড়ির কাঁটা তখন সকাল ৬:০০। সামনে রাখা তার গবেষণার নোট, পেনডুলাম ঘুরছে স্বাভাবিক ছন্দে, আর আদিত্য—চুপচাপ ঘুমোচ্ছে পাশের সোফায়, স্বাভাবিক নিঃশ্বাসে। ভ্রামরী পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলেন,
“তুমি ফিরে এসেছো। তুমি সময়কে বোঝোনি—তুমি সময় হয়ে উঠেছো।”

অনির্বাণ জানে—সে আর আগের মানুষ নেই। এখন তার ভেতরে রয়েছে একটি শক্তি, যা কেবল সময় নিয়ন্ত্রণ করে না, তা সময়কে অনুভব করে। এখন সে জানে—সবচেয়ে বড় তন্ত্র হল নিজেকে ভুলে, নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া। কাঁটার দিক ঘুরে যাওয়া মানেই সময় থেমে যায় না—বরং শুরু হয় এক নতুন সময়চক্র।

শেষে, সে আবার ডায়রি খুলে লেখে তার শেষ লাইন:
“আমার নাম অনির্বাণ। আমি এক চেতনা—যার গন্তব্য ছিল কালতন্ত্র, আর এখন আমি নিজেই এক কাঁটা—যা সময়ের দিক বদলে দিতে পারে।”

শেষ

1000042708.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *