ঋত্বিক বসু
কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের গলির ভেতরে অচেনা এক দোকান হঠাৎ চোখে পড়ল অরুণবাবুর। কাঠের পুরনো বোর্ডে লেখা—‘কালান্তর এন্টিকস’। চারপাশে আধুনিক দোকানের ঝলমলে সাইনবোর্ডের ভিড়ে এই অক্ষরগুলো যেন একেবারে উনিশ শতকের চিহ্ন। তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। দোকানের ভেতরটা অদ্ভুত অন্ধকার, জানালার কাচে ধুলো জমে আছে, কিন্তু ভেতর থেকে ক্ষীণ হলুদ আলো বেরিয়ে আসছে। এক অদ্ভুত টান অনুভব করলেন, যেন কেউ ডাকছে। অরুণবাবু পেশায় শিক্ষক, ইতিহাসের মানুষ। পুরোনো জিনিসপত্র তাঁর দুর্বলতা। তাই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন। ভেতরে প্রবেশ করতেই কপালে ঠান্ডা বাতাস লাগল, যেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোনো ঘরে ঢুকেছেন, অথচ জানেন এই দোকানে সেরকম কিছু নেই। চারদিকে ভাঙাচোরা কাঠের আলমারি, পুরোনো থালা-বাসন, লণ্ঠন, তামার কলস, রাজকীয় আসবাবের অংশবিশেষ, আর দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ি। ঘড়ির সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। বড়ো-বড়ো গ্র্যান্ডফাদার ক্লক, পেন্ডুলাম ঘড়ি, টেবিল ঘড়ি, হাতঘড়ি—অজস্র সময় যেন এখানে আটকে আছে। দোকানের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছেন এক ভদ্রলোক। সাদা ধুতি, গায়ে হালকা কালো চাদর, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা। তাঁর চোখে এমন দৃষ্টি, যা অরুণবাবুকে অস্বস্তিতে ফেলে দিল। ভদ্রলোক হাসলেন অদ্ভুতভাবে—“সময় খুঁজছেন?” প্রশ্নটা যেন অকারণে ভেতরটা কেঁপে তুলল। অরুণবাবু কাঁপা গলায় বললেন, “না…মানে…দেখছিলাম শুধু।” দোকানদার মৃদু হেসে এগিয়ে এলেন, তাঁর পায়ের শব্দ শোনা গেল না। কাছে এসে একটি দেওয়াল ঘড়ির দিকে ইঙ্গিত করলেন। ঘড়িটি কাঠের, অদ্ভুত অলঙ্করণে ভরা। ডায়ালটা হালকা হলদেটে, রোমান সংখ্যায় সময় লেখা। পেন্ডুলামটা নড়ছে, কিন্তু এক অদ্ভুত ছন্দে। মনে হল কাঁটাগুলো টিকটিক শব্দ ছাড়াই ঘুরছে। অরুণবাবুর চোখে পড়ল ঘড়ির দাম লেখা নেই। দোকানদার ফিসফিস করে বললেন, “এই ঘড়ি সময় ফেরায়।” কথা বলার ভঙ্গি এমন, যেন এটা কোনো অফার নয়, শাপ-শাপান্ত। অরুণবাবু মৃদু হেসে বললেন, “ফেরায় মানে?” দোকানদার সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তাঁর চোখে লালচে আভা যেন ভেসে উঠল। বললেন, “রাত বারোটার পর এটার কাঁটা উল্টো দিকে ঘুরতে শুরু করে। তখন যা দেখবেন, তা আজকের নয়। অতীত আপনার সামনে খুলে যাবে।” অরুণবাবু চমকে উঠলেন। কানে যেন বাজল ‘অতীত’। তিনি তো ইতিহাস পড়ান, জীবনের সব আগ্রহ অতীতের ওপরেই। কিন্তু এ আবার কেমন খেলা? দোকানদার নরম স্বরে বললেন, “এটা আপনারই জন্য। ঘড়ির মালিক বেছে নেয় সময়কে।” অরুণবাবু অকারণে শিহরিত হলেন। তবুও হাত বাড়িয়ে ঘড়িটি ছুঁলেন। ঠান্ডা কাঠ, অথচ বুকের ভেতর আগুনের মতো উত্তাপ ছড়িয়ে গেল। “দাম?”—তিনি গলা শুকিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। ভদ্রলোক রহস্যময় হাসি দিয়ে বললেন, “দাম আপনার স্মৃতির মধ্যে আছে। কাগজে লেখা লাগবে না।” অরুণবাবু কিছুই বুঝলেন না। তবে এত অদ্ভুত আকর্ষণ তিনি জীবনে কখনো পাননি। যেন ঘড়িটি তাঁকে টেনে নিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত নগদ টাকা বের করে দিলেন। ভদ্রলোক ঘড়িটি প্যাক করার নামও করলেন না। বললেন, “যেমন আছে, তেমন নিয়েই যান। মনে রাখবেন, আজ রাত বারোটার পর প্রথম ঘণ্টা শুরু হবে।” অরুণবাবু আর কিছু বললেন না। দোকান থেকে বেরোবার সময় একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন—দোকান ফাঁকা, যেন কেউ কোনোদিন বসেইনি। কেবল ঝুলে থাকা অগণিত ঘড়ি, আর তাদের নীরবতা। বাড়ি ফিরে ঘড়িটি টাঙালেন ড্রয়িংরুমে। স্ত্রী এবং ছেলে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “হঠাৎ এ আবার কোথা থেকে?” অরুণবাবু হেসে উড়িয়ে দিলেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মনে হল, কাঁটা যেন সামান্য থমকে আছে। সময় তখন রাত দশটা। বাইরে কলকাতার রাস্তা ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে আসছে। দূরে ট্রামের ঘন্টাধ্বনি মিলিয়ে যাচ্ছে। অরুণবাবু বইয়ের পাতায় চোখ রাখলেন, কিন্তু মন বারবার চলে যাচ্ছে ঘড়ির দিকে। বুকের ভেতর অদ্ভুত উৎকণ্ঠা জমে উঠছে। তিনি জানেন, আজ রাত বারোটার পরেই শুরু হবে কিছু…যা ব্যাখ্যা করা যায় না।
সেই রাতে অরুণবাবু শুয়ে আছেন শোবার ঘরে, অথচ ঘুম আসছে না কিছুতেই। বাইরের ঘড়িটা যেন বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে—সময় এসে গেছে। শয্যার পাশে স্ত্রী মৃদু নিঃশ্বাস ফেলছেন, ছেলে পাশের ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু অরুণবাবুর চোখ বন্ধ হলেই মনে হচ্ছে ঘড়ির টিকটিক শব্দ ভেসে আসছে, অথচ ঘড়ির কোনো শব্দ হওয়ার কথা নয়। অবশেষে তিনি উঠে পড়লেন, নিঃশব্দে পায়ের শব্দ চাপা দিয়ে ড্রয়িংরুমে এলেন। দেওয়ালে টাঙানো ঘড়িটা এক অদ্ভুত আলোয় ভেসে আছে। হলদেটে ডায়াল যেন ভেতর থেকে জ্বলজ্বল করছে, আর কাঁটাগুলো মিনিটে নয়, মুহূর্তে মুহূর্তে এগিয়ে চলেছে। তিনি তাকিয়ে রইলেন। সময় ঠিক বারোটা বাজল, আর তখনই ঘড়ির কাঁটা ধীরে ধীরে থেমে গিয়ে উল্টো দিকে ঘুরতে শুরু করল। প্রথমে মিনিট, তারপর ঘণ্টা। পেন্ডুলাম যেন শীতল বাতাসের মতো দুলতে লাগল, আর ঘরের দেয়ালে ছায়া নড়ল। হঠাৎ আলো নিভে এল, চারপাশ ঘোলাটে হয়ে গেল। অরুণবাবু নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না—তিনি যেন অন্য এক সময়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ড্রয়িংরুম নেই, বরং সেই জায়গায় দেখা যাচ্ছে পুরোনো কাঠের মেঝে, তেলের প্রদীপের আলো, আর এক মহিলার ছায়া। মহিলা লাল শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে, মাথায় সিঁদুরের টান স্পষ্ট। তিনি যেন কারও জন্য অপেক্ষা করছেন। অরুণবাবু বুঝতে পারলেন না, এ কল্পনা, না বাস্তব। কিন্তু গন্ধ আসছে স্পষ্ট—জ্বালানো সরষের তেল, ভিজে কাঠের গন্ধ, এমনকি মহিলার দেহের গন্ধও যেন ভেসে আসছে। মহিলার চোখ হঠাৎ তাঁর দিকে পড়ল। ঠান্ডা, কষ্টভরা দৃষ্টি। ঠোঁট নড়ল—“ফিরে এসো…”। অরুণবাবু কেঁপে উঠলেন। কাকে ডাকা হচ্ছে? কে ফিরবে? তিনি কিছু বলার আগেই দৃশ্য মিলিয়ে গেল, আলো নিভে গিয়ে আবার ড্রয়িংরুম ফিরে এল। ঘড়ির কাঁটা তখনও উল্টো দিকে চলছে। এবার ভেতরে হালকা হাসির শব্দ ভেসে এল। অরুণবাবু টেবিলের ধারে এগোলেন, মনে হল কেউ বসে আছে। কিন্তু আসনে কেউ নেই। কেবল হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো ফিসফিসানি—“তুমি এখনো আছো, কিন্তু আমরা হারিয়েছি।” হঠাৎ তিনি পেছন থেকে শব্দ পেলেন। তাঁর ছেলে অয়ন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে, ঘুমভাঙা চোখে বলল, “বাবা, তুমি কার সঙ্গে কথা বলছ?” অরুণবাবু কিছুই বলতে পারলেন না। শুধু হাসলেন কষ্টের হাসি দিয়ে, বললেন, “কিছু না রে…ঘুমোতে যা।” কিন্তু অয়ন স্থির দাঁড়িয়ে রইল, তারপর ড্রয়িংরুমে এসে ঘড়ির দিকে তাকাল। কাঁটাগুলো উল্টো ঘুরছে দেখে ছেলেও চমকে উঠল। “এটা…এটা তো স্বাভাবিক না!”—অয়ন বলল কাঁপা গলায়। ঠিক সেই মুহূর্তে ঘড়ি একটা ভারী ঘণ্টাধ্বনি তুলল। তাদের কানে বাজল, যেন শ্মশানের শঙ্খধ্বনি। আলো নিভে গিয়ে চারপাশ কালো হয়ে গেল। শুধু ঘড়ির কাঁটার উল্টোদিকে চলার আভা। অরুণবাবু ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন, মনে হল চারপাশের দেয়াল গলে যাচ্ছে। কোথায় যেন তারা নামছে, সময়ের গহ্বরে। সেকেন্ডের ভেতর সব আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। ঘড়ির কাঁটা আবার সোজা চলতে শুরু করেছে। অয়ন কাঁপতে কাঁপতে বাবাকে বলল, “এটা ঘরে রাখা ঠিক নয়। এখানে কিছু একটা আছে।” অরুণবাবুর বুক ভারী হয়ে উঠল, তবু বললেন, “ঘড়িটা আমাকে বেছে নিয়েছে। বুঝলি না? এটা কাকতালীয় নয়।” ছেলের চোখে ভয় জমে উঠল, সে ধীরে ধীরে ঘরে চলে গেল। অরুণবাবু একা দাঁড়িয়ে রইলেন ঘড়ির সামনে, তাঁর ভেতরে ইতিহাসের শিক্ষক নয়, অচেনা এক অনুসন্ধানী জেগে উঠেছে। অতীতের দরজা আজ প্রথমবার খুলেছে, আর তিনি জানেন, এর ভেতর দিয়ে তাঁকে ঢুকতেই হবে।
পরদিন সকালটা যেন অস্বাভাবিকভাবে নীরব। অরুণবাবু ঘুম থেকে উঠে দেখলেন জানলার বাইরে রোদ ঝলমল করছে, পাখির ডাক ভেসে আসছে, কিন্তু তাঁর ভেতরটা ভারী হয়ে আছে। রাতের ঘটনাটা কি সত্যিই ঘটেছিল? তিনি কল্পনা করেননি তো? চায়ের কাপ হাতে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হল ঘড়ির টিকটিক শব্দ আবারও তাঁর মাথার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। স্ত্রী গায়ত্রী রান্নাঘর থেকে ডাক দিলেন, “শুনছো, তোমার ওই পুরোনো ঘড়িটা ঘরে রেখো না, রাতে টিকটিক শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়।” অরুণবাবু হেসে বললেন, “টিকটিক? ও তো কোনো শব্দ করে না।” গায়ত্রী আর কিছু না বলে ফিরে গেলেন, কিন্তু অরুণবাবুর বুক ধকধক করতে লাগল। রাতে তিনি সত্যিই তো টিকটিক শুনেছিলেন, অথচ সেটা কি তাঁরই ভ্রম? দুপুরবেলা কলেজে ক্লাস নেওয়ার সময় ছাত্রদের চোখে মুখে যেন সবকিছু স্বাভাবিক, কিন্তু অরুণবাবুর মনে হচ্ছিল প্রত্যেকটা চোখের পেছনে লুকিয়ে আছে কোনো না কোনো অতীতের ছায়া। পড়াতে পড়াতে হঠাৎ তিনি থেমে গেলেন। টেবিলের ওপর রাখা তাঁর ঘড়িটি—একেবারে সাধারণ হাতঘড়ি—মুহূর্তখানেকের জন্য উল্টো দিকে ঘুরে গেল। তিনি ঘেমে উঠলেন, চশমা মুছে আবার তাকালেন। ঘড়ি তখন স্বাভাবিক। ছাত্ররা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “স্যার, কী হয়েছে?” অরুণবাবু সামলে নিয়ে পড়াতে লাগলেন, কিন্তু মনের মধ্যে ভয় জমে উঠল। বিকেলে বাড়ি ফিরে তিনি দেখলেন ঘড়িটার সামনে ছেলে অয়ন দাঁড়িয়ে আছে। অয়ন ডায়েরি লিখছে, মাথা তুলেই বলল, “বাবা, গতরাতে যেটা দেখলাম, সেটা কি আমার কল্পনা?” অরুণবাবু ছেলের চোখের দিকে তাকালেন, সত্যিটা এড়াতে পারলেন না। ধীরে ধীরে বললেন, “না রে, কল্পনা নয়। আমিও দেখেছি।” অয়ন চুপ করে গেল, ডায়েরির পাতা বন্ধ করে দিল। তার চোখে এক অদ্ভুত ভয়। “বাবা, আমরা এটা পুলিশে জানাতে পারি না?” অরুণবাবু হেসে ফেললেন—“পুলিশকে কি বলবি? একটা ঘড়ি উল্টো দিকে ঘোরে আর অতীত দেখায়? হাসবে সবাই।” কিন্তু তিনি জানতেন, ব্যাপারটা সাধারণ নয়। রাত এলেই ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে চলেছে। সেই রাতেই আবার বারোটা বাজতেই ঘড়ির কাঁটা উল্টো দিকে ঘুরতে শুরু করল। অরুণবাবু এবার একা দাঁড়িয়ে রইলেন না। অয়ন তাঁর পাশেই দাঁড়িয়ে। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে সঙ্গে ঘর বদলে যেতে লাগল। হঠাৎ তারা যেন অন্য একটা সময়ের ভেতর চলে এল। চারপাশে ভাঙা ভাঙা ইটের বাড়ি, কাঁচা রাস্তা, কেরোসিন ল্যাম্পের আলো। মানুষের পোশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে, অন্তত একশো বছর আগেকার কলকাতা। হঠাৎ সামনে দিয়ে একটা হাতি চলে গেল, তার পিঠে মহারাজাসুলভ আসন। অরুণবাবু বিস্মিত, ছেলেকে বললেন, “দেখলি? এটা সেই উনিশ শতকের কলকাতা।” অয়ন হাঁ করে তাকিয়ে রইল। কিন্তু এর মাঝেই তারা এক দৃশ্য দেখল, যা তাদের রক্ত হিম করে দিল। রাস্তার ধারে এক অল্পবয়সি ছেলে, হয়তো বারো-তেরো বছরের, চোখের সামনে ট্রামের ধাক্কায় লুটিয়ে পড়ল। লোকজন চেঁচিয়ে উঠল, কোলাহল ছড়িয়ে গেল। অরুণবাবু অচেতন হয়ে পড়বেন মনে হল। ছেলেটির চোখ তাদের দিকে তাকিয়ে রইল, নিথর, কিন্তু ঠোঁট কাঁপছে—“বাঁচাও।” ঠিক তখনই সবকিছু মিলিয়ে গেল, তারা আবার ড্রয়িংরুমে ফিরে এল। ঘড়ির কাঁটা তখনও উল্টো ঘুরছে। অরুণবাবু শ্বাস নিতে পারছেন না। অয়ন আতঙ্কে বলল, “আমরা কি মৃতদের আত্মা দেখছি?” অরুণবাবু উত্তর দিতে পারলেন না। শুধু মনে হল ঘড়ি ক্রমশ তাদের টেনে নিচ্ছে সময়ের অন্ধকার ভেতরে, যেখানে বাঁচা-মরার সীমারেখা নেই।
সকালের আলোয় সবকিছুই নিখুঁত স্বাভাবিক দেখালেও অরুণবাবুর মাথার ভেতর একটা ভারী কুয়াশা বসে ছিল, যেন রাতে দেখা ছেলেটার চোখ এখনও তাঁর দৃষ্টিপথে ভাসছে। নাশতা শেষ হতে না হতেই অয়ন বলল, “বাবা, কাল রাতের ঘটনাটা যদি সত্যি হয়, আমাদের প্রমাণ খুঁজতে হবে। যে রাস্তা দেখলাম, হাতি গেল, ট্রাম এল—এটা তো উনিশ শতকের কলকাতা। হ্যারিসন রোডের মতো লাগছিল।” ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে অরুণবাবুও একই সন্দেহ করেছিলেন। তিনি বইয়ের তাক থেকে পুরোনো মানচিত্র বার করলেন—কলকাতা মিউনিসিপ্যালিটির ১৯০৩ সালের এক প্রতিলিপি, যে মানচিত্র তিনি ক্লাসে দেখান। আঙুল দিয়ে লাল কালি শুকিয়ে যাওয়া রেখার উপর টান দিলেন, “দেখ, হ্যারিসন রোড এখানেই ছিল, এখনকার মহাত্মা গান্ধী রোড। গত রাতে আমরা যে মোড়টা দেখলাম, সেটা যদি এই হয়, তবে ট্রামের লাইনটা এখান দিয়ে গেছে।” অয়নের চোখে আগুন জ্বলল, সে বলল, “চলো আজই বেরিয়ে পড়ি। আর ‘কালান্তর এন্টিকস’-এও যাই, দোকানদারকে জিজ্ঞেস করা দরকার।” গায়ত্রী বারণ করলেন—“দু’জনেই মাথা খারাপ করেছ! একটা ঘড়ি নিয়ে এত বাড়াবাড়ি?” কিন্তু তাদের হাঁটা থামল না। দুপুরের গরমে কলেজ স্ট্রিটের গলির ভিতর দিয়ে যখন তারা ওই জায়গায় পৌঁছোল, অরুণবাবুর বুকের ধুকপুকানি আচমকা থেমে গেল—‘কালান্তর এন্টিকস’ কোথায়? সেই কাঠের বোর্ড, ধুলো কাচ, হলুদ আলো—কিছুই নেই। সেখানে এখন টিনের শাটার নামানো এক পুরোনো বৈদ্যনাথ ভোগ অ্যান্ড ভান্ডার, দরজায় তালা। পাশের পানের দোকানের লোকটা চটি ঝাড়া পা দুলিয়ে বলল, “কাকে খুঁজছেন বাবু?” অরুণবাবু তাড়িত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “এখানে একটা এন্টিক দোকান ছিল, নাম ‘কালান্তর’—কাল বিকেলেই তো খোলা ছিল।” লোকটি এমনভাবে তাকাল যেন ভূত দেখছে, তারপর হাসল, “কালান্তর? এই নামটা শেষ শুনেছি আট-দশ বছর হবে। মালিক গিরীশদা মারা গেলেন, তারপর আর খোলা হয়নি। আপনারা ভুল দেখেছেন।” অয়ন তর্ক করতে গিয়ে শব্দ হারিয়ে ফেলল। বাবা-ছেলে দু’জনেই শাটারের তালায় ধুলোয় জমা আঙুল ছুঁয়ে দেখল, ধুলো অনেক বছরের। অরুণবাবুর গলায় একফোঁটা শব্দ আটকে গেল—তিনি কি তবে এমন এক দোকান থেকে ঘড়ি কিনেছেন, যে দোকান বহু বছর ধরে নেই? ফিরে আসার পথে তারা শহরের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে ঢুকে পড়ল। পুরোনো সংবাদপত্রের রিলের ঘ্রাণে ইতিহাসের ধুলো উড়ে এল। রক্ষীকে পরিচয় দিয়ে অরুণবাবু ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’, ‘দ্য স্টেটসম্যান’ আর ‘বঙ্গবাসী’-র ১৯০২ থেকে ১৯০৫ সালের পাতাগুলো চাইলে ক্লার্ক প্রথমে চোখ কুঁচকালেও শেষে এনে দিল। অয়ন মেশিনে ফ্রেম ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, “দেখছি…দেখছি…আরে থামুন!” হলদেটে স্ক্রিনে দাঁতের মতন অক্ষরে ভেসে উঠল—“হ্যারিসন রোডে ট্রাম দুর্ঘটনায় বালকের মৃত্যু”—তারিখ ১৭ আশ্বিন ১৩১০। খবরে লেখা, “শিবশঙ্কর নামক দ্বাদশবর্ষীয় এক বালক আজ সন্ধ্যায় ট্রামের চাকার তলায় পিষ্ট হয়। মাতার করুণ ক্রন্দনে জনতা স্তব্ধ।” অরুণবাবুর শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল; পেটে শীতল পাথরের মতো যন্ত্রণা। ‘মাতার করুণ ক্রন্দন’—গত রাতে লাল শাড়ির সেই মহিলার ঠোঁট কাঁপা ‘ফিরে এসো’ কি তবে এই মাতারই ডাকা? অয়ন নিঃশ্বাস বন্ধ রেখেই পড়ছিল, “মা শৈলজা দেবী, বাড়ি—৮৩, হ্যারিসন রোড।” বাড়ির নম্বরটা পড়তেই ওদের দু’জনের চোখ একসঙ্গে বিস্ফারিত হয়ে উঠল। তাদের এখনকার ভাড়া ফ্ল্যাটের ঠিকানা—এমজি রোড ৮৩—পুরোনো নম্বরেরই ধারাবাহিকতা। অরুণবাবু ফিসফিস করলেন, “মানে এই জায়গাটাই…এখানেই…” কণ্ঠস্বর ভেঙে গেল। অয়ন কাঁপা গলায় বলল, “বাবা, ঘড়িটা আমাদের বাড়ির সঙ্গে যুক্ত। সেই মা—শৈলজা দেবী—তিনি হয়তো অপেক্ষা করছিলেন।” অরুণবাবু আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলেন না। তাঁরা বাড়ি ফিরে এসে ঘড়ির দিকে বহুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। কাঠের কেসিংয়ের নিচের দিকে ছোট্ট একটা খাঁজ আছে—রাতের ঘোরে চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। আলতো চাপ্ দিতেই একটা সরু কাঠের ঢাকনা খসে পড়ল। ভিতরে রেখার আঁচড়, অদ্ভুত নীলচে দাগ আর এক কোণে পাতলা কাপড়ে মোড়া কাগজের গোট্টা। অরুণবাবু আঙুল কাঁপতে কাঁপতে তুলে নিলেন, কাপড় খুলতেই ধুলো হয়ে উড়ে গেল, আর একটা ক্ষীণ চিরকুট দেখা দিল: “শৈলজা—অশ্বিনী—তোমার ফিরতে বারোটা বাজে।” কালি সেঁধিয়ে গেছে কাঠের দানায়, তারিখ নেই, শুধু শব্দের ভিতর থেকে এক শীতল পাথর উঠে এসে হৃদয়ে ধপাস করে পড়ল। অয়ন বলল, “অশ্বিনী মানে আশ্বিন মাস—সংবাদে যে তারিখ দেখলাম—১৭ আশ্বিন। ‘বারোটা’—আমাদের ঘড়ির কাঁটা।” দুইয়ে দুইয়ে চার মিলতে থাকে, কিন্তু চারটা যেন এক অন্ধকার দরজা। গায়ত্রী তাদের এইসব হাবা-বাবা দেখে বিরক্ত হয়ে বললেন, “ঘড়ি খুলে ফেলো, দেয়ালের রং নষ্ট করবে।” অরুণবাবু তক্ষুনি ক্ষেপে উঠলেন না, বরং অদ্ভুত প্রশান্ত স্বরে বললেন, “আজ রাত বারোটায় দরজাটা খুলবে। আমরা ওদের কথা শুনব।” গায়ত্রী কিছু একটা বলবেন, তখনই থমকে গেলেন। তাঁর চোখ অস্বাভাবিক ঠান্ডা, তিনি অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঘোরের মধ্যে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে উঠলেন, “শিবু, খেয়ে নাও, ঠান্ডা হয়ে যাবে।” অয়ন চমকে মায়ের দিকে এগোল, “মা?” গায়ত্রী মুহূর্তে নিজেকে ফিরে পেয়ে মাথা ধরলেন, “অ্যাঁ? আমি কি বললাম?” কেউ উত্তর দিল না। বিকেলের শেষে আকাশে কালো মেঘ জমল, বজ্রপাতের চিকচিক—বৃষ্টি নেমে এলে শহরটা যে ভাবে অতীতের গন্ধে ভিজে ওঠে, সেরকমই বাড়ির ভিতরেও নোনাজল, সরষের তেল আর পুরোনো কাপড়ের গন্ধ মিশে গেল। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে দেয়ালঘড়ির ডায়াল যেন নিজের আলোয় জ্বলে উঠতে লাগল। অয়ন মোবাইলের ক্যামেরা স্ট্যান্ডে রেখে রেকর্ডিং চালু করল—“এইবার প্রমাণ থাকবে।” অরুণবাবু ঘড়ির কেসিংয়ের কাঠে আঙুল রেখে খুব ধীরে বললেন, “শৈলজা দেবী, যদি আপনি থাকেন, আমরা শুনছি।” ঠিক বারোটার মূহূর্তে টক করে বিদ্যুৎ চলে গেল, ঘর গাঢ় অন্ধকারে ডুবে গেল, আর সবার চোখের সামনে স্পষ্ট দেখা গেল কাঁটাগুলো থেমে এক শ্বাস নিয়ে উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়াল। প্রথমে মিনিট, তারপর ঘণ্টা। পেন্ডুলামের নড়াচড়া যেন জলভর্তি পাতিলে পড়া হিমের ধাক্কা। ঘরের ভেতর হাওয়ার শব্দ, গাঢ়া শীত। মেঝেতে পায়ের আওয়াজ নেই, তবু যেন লালপাড় শাড়ির আঁচল টেনে টেনে কেউ চলেছে; চৌকাঠে কারও দাঁড়িয়ে থাকা ছায়া ঘন হয়ে উঠল। গায়ত্রী অদ্ভুত শান্ত কণ্ঠে বললেন, “শিবু, দরজাটা খুলে দে।” তাঁর চোখে তখন আর গায়ত্রী নেই—নরম কিন্তু অসীম ক্লান্ত এক মায়ের ছায়া, স্বরে পুরোনো কলকাতার টান। অয়ন বাবার হাত শক্ত করে ধরে ফিসফিস করল, “মা তো…মা তো শৈলজা!” শব্দখানি ঘরের ভিতর ঢেউ তুলে ফিরে এল—শৈলজা—শৈলজা—শৈলজা—আর সেই প্রতিধ্বনি ভেদ করে দরজার ওপার থেকে শীতল শিশু-কণ্ঠ, একটিই শব্দ, শিরদাঁড়া বেয়ে হিম নামিয়ে দিল—“মা…”
শব্দটা এত স্পষ্ট, এত কাঁচা ব্যথায় ভরা যে ঘরের দেয়াল যেন ফেটে গেল। অয়ন আর অরুণবাবু একই সঙ্গে দরজার দিকে তাকালেন। ঘড়ির উল্টো দিকে ঘোরা কাঁটার আলোয় দেখা গেল দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে এক ছেলেটি—কালো চুল, গায়ের গঠন দুর্বল, চোখে মৃত্যুর ফাঁকা শূন্যতা। তার গলায় শুকনো ধুলো, মাথার একপাশে ফেটে যাওয়া ক্ষত থেকে রক্তের ছাপ। অথচ ঠোঁট নড়ছে—“মা…” গায়ত্রী যেন আচ্ছন্ন হয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁর মুখে এখন আর গায়ত্রী নেই, আছে শৈলজা দেবীর অপরিসীম শোক, গলায় ডাক—“শিবু, আয়…আমি তোকে এতদিন ধরে খুঁজছি।” অয়ন মায়ের হাত ধরতে গিয়েও পিছিয়ে গেল। হাতটা বরফের মতো ঠান্ডা, যেন মানুষের শরীরের তাপ নেই। অরুণবাবুর মাথার ভেতর ভয় আর কৌতূহল একসঙ্গে ঘুরপাক খেতে লাগল। ঘড়ির কাঁটা ক্রমশ দ্রুত উল্টোদিকে ঘুরছে, মিনিটের পর ঘণ্টা, ঘণ্টার পর দিন, দিন মিলিয়ে যাচ্ছে রাতের মধ্যে। হঠাৎই তারা আর নিজেদের ড্রয়িংরুমে নেই। চারপাশে অচেনা বাড়ির কাঠের খুঁটি, কেরোসিন ল্যাম্পের আলো, আর সিঁড়ির কোণে বসে আছে সেই ছেলেটি। মায়ের কোলে মাথা রেখে কাঁপছে, ঠোঁট শুকিয়ে যাচ্ছে। শৈলজা দেবী—অর্থাৎ এই মুহূর্তে গায়ত্রী—ছেলেকে আঁকড়ে ধরে আছেন। তাঁর চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছে। অরুণবাবু আর অয়ন বুঝে গেলেন, তারা চলে এসেছে একশো বছর আগের সেই রাতে, যে রাতে ট্রাম দুর্ঘটনায় শিবু মারা গিয়েছিল। চারপাশে শোকের গন্ধ, মানুষের কান্নার আওয়াজ, আর তবুও এক অবাস্তব স্থিরতা। হঠাৎ শিবুর চোখ ঘুরে গেল তাদের দিকে। সে যেন এই শতাব্দীর অতিথিদের চিনতে পারল। ঠোঁট নড়ে উঠল—“আমাদের আটকে রেখেছে। ঘড়ি ছাড়া বেরোনো যাবে না।” অরুণবাবুর বুকের ভেতর যেন বজ্রপাত হলো। “কে রেখেছে? কেন?”—তিনি প্রশ্ন করলেন। কিন্তু ছেলেটি আর কিছু বলল না, শরীরটা কেঁপে উঠল আর হাওয়া হয়ে মিলিয়ে গেল। শৈলজার দৃষ্টি হঠাৎ শক্ত হলো, গলায় কর্কশ স্বর—“ঘড়িটাই পথ। কিন্তু ঘড়ি চাইবে মূল্য। যাকে সময় ফিরিয়ে আনা হয়, তাকে সময় আবার কেড়ে নেয়।” অয়ন বাবার দিকে তাকিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “আমরা তাহলে ফাঁদে পড়েছি। ঘড়ি আমাদের বেছে নিয়েছে।” কথাটা শেষ হতেই চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে গেল। অরুণবাবু টের পেলেন, কেউ যেন তাঁর কানে নিঃশ্বাস ফেলছে। ফিসফিসানি—“আগামী রাতেই চূড়ান্ত পরীক্ষা। বারোটা বাজলেই সিদ্ধান্ত হবে, কে থাকবে আর কে হারিয়ে যাবে।” হঠাৎই সবকিছু মিলিয়ে গিয়ে তারা আবার নিজেদের ফ্ল্যাটের ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে। আলো জ্বলে উঠেছে, গায়ত্রী ঘামে ভিজে অচেতন হয়ে পড়ে আছেন সোফায়। ঘড়ির কাঁটা আবার স্বাভাবিক পথে চলতে শুরু করেছে, যেন কিছুই ঘটেনি। কিন্তু অরুণবাবু আর অয়ন দু’জনেই জানে, এটা কেবল শুরু। ঘড়ি শুধু অতীত দেখায় না, সেটা কাউকে ফিরিয়ে আনতে চাইছে, আর তার বিনিময়ে চাইবে কিছু। হয়তো জীবন। হয়তো সময়।
সকালের আলোয় গায়ত্রী যেন কিছুই মনে করতে পারছিলেন না। তাঁর চোখ ফোলা, শরীর ক্লান্ত, অথচ মুখে নির্লিপ্ত শান্তি। রান্নাঘরে চা বানাতে বানাতে বললেন, “কাল রাতে একটু মাথা ঘুরছিল, মনে হয় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম।” অরুণবাবু আর অয়ন দু’জনেই মুখ চেয়ে রইল, কিন্তু কিছু বলল না। তারা জানত, গায়ত্রীর শরীরটা দখল করে নিয়েছিল শৈলজা দেবীর আত্মা। কথাটা মুখে আনতে গেলেই এক অজানা আতঙ্ক ঘিরে ধরছিল। অরুণবাবু কলেজে গেলেন ঠিকই, কিন্তু বোর্ডে লিখতে গিয়ে চক ভেঙে গেল। ছাত্ররা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তিনি কিছু বোঝাতে পারলেন না। ভেতরে ভেতরে ঘড়ির ফিসফিসানি তাঁর কানে বাজছিল—“আগামী রাতেই সিদ্ধান্ত…”। বিকেলে লাইব্রেরিতে গিয়ে পুরোনো দলিল খুঁজলেন। ১৯০৩ সালের এক নথিতে চোখ আটকে গেল—“হ্যারিসন রোডে একাধিক আত্মহত্যা ও অদ্ভুত অসুস্থতার ঘটনার পর জনসাধারণ ভয়াবহ আতঙ্কে।” আরেকটি প্রতিবেদনে লেখা—“শৈলজা দেবী নামক বিধবা নারী রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ, অনেকে বলেন তিনি শিবশঙ্করের আত্মার খোঁজে অন্য জগতে পাড়ি দিয়েছেন।” অরুণবাবুর শরীর শিউরে উঠল। মানে শৈলজার আত্মা কখনও শান্তি পায়নি, তাই ঘড়ির ভেতরে বন্দি থেকে গেছে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখলেন অয়ন ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলের চোখে ভয় আর অদম্য কৌতূহল। “বাবা, এটা ভাঙা যায় না?”—অয়ন বলল হঠাৎ। অরুণবাবু চুপ করলেন, কিন্তু উত্তরটা যেন জানেন। ঘড়ি ভাঙা যাবে না। সেটা ভাঙার চেষ্টা করলে কে জানে কী ঘটবে। রাত নামতেই ঘরের ভেতর আবার ঠান্ডা হয়ে এল। বাতাসে সরষের তেলের গন্ধ ভাসতে লাগল। বারোটা বাজতেই কাঁটা উল্টো ঘুরতে শুরু করল। এবার তারা দাঁড়িয়ে রইল প্রস্তুত হয়ে। হঠাৎ ঘড়ির ভেতর থেকে শব্দ এলো, যেন লোহার দরজা খুলছে। দেয়ালে একটা ফাটল তৈরি হলো, সেই ফাটল দিয়ে তারা দেখতে পেল অসংখ্য মানুষের ছায়া—কেউ কান্না করছে, কেউ হাত বাড়িয়ে ডাকছে, কেউ নিথর চোখে তাকিয়ে। অয়ন শ্বাস আটকে বলল, “এরা কারা?” অরুণবাবুর কানে বাজল ফিসফিসানি—“সময়ের শিকার।” তিনি বুঝতে পারলেন, ঘড়ি শুধু শৈলজা আর শিবুকে নয়, আরও অগণিত আত্মাকে বন্দি করে রেখেছে। ফাটল থেকে হিমশীতল হাওয়া এসে তাদের শরীর ভিজিয়ে দিল। ঠিক তখনই গায়ত্রী ঘুম থেকে উঠে এসে সেই ফাটলের সামনে দাঁড়ালেন। তাঁর চোখে আবারও সেই অচেনা শূন্যতা, ঠোঁট নড়ে উঠল—“শিবু, এসো।” অয়ন ছুটে গিয়ে মায়ের হাত ধরল, “না মা, তুমি যেও না।” কিন্তু গায়ত্রী ঠেলে সরে দাঁড়ালেন। ফাটলের ভেতর থেকে শিশুকণ্ঠ আবার শোনা গেল—“মা…” শব্দটা এত করুণ, এত হৃদয়বিদারক যে অরুণবাবুর বুক কেঁপে উঠল। তিনি হাত বাড়ালেন গায়ত্রীর দিকে, কিন্তু তখনই ঘড়ির কাঁটা হঠাৎ থেমে গেল। এক মুহূর্তে সব নিস্তব্ধ। তারপর ভয়ানক ভারী ঘণ্টাধ্বনি বাজল একবার, যেন মৃত্যুর ঘোষণা। আলো নিভে গেল, আর ঘরজুড়ে প্রতিধ্বনি হলো—“আজ একজনকে যেতে হবে।”
“আজ একজনকে যেতে হবে”—ঘণ্টাধ্বনির প্রতিধ্বনি যেন দেয়ালের ভেতর ঢুকে কানের পর্দা ছিঁড়ে দিচ্ছিল। অয়ন ভয়ে বাবার হাত আঁকড়ে ধরল, অথচ গায়ত্রী তখনও ফাটলের সামনে দাঁড়িয়ে যেন অন্য এক শক্তির অধীনে। ঘড়ির কাঁটা উল্টোদিকে ঘুরছে, আর তার প্রতিটি টিক যেন মৃত্যুর হিসেব কষে দিচ্ছে। হঠাৎ ঘড়ির ডায়ালে আলো ফুটে উঠল। সেখানে তিনটি ছায়া দেখা গেল—একজন পুরুষ, একজন যুবক আর একজন নারী। স্পষ্ট বোঝা গেল, ওরা অরুণবাবু, অয়ন আর গায়ত্রী। ছায়াগুলো নিথর দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু নিচে লাল অক্ষরে লেখা উঠল—“একজনকে দাও, দুইজন বাঁচবে।” অরুণবাবু শিরদাঁড়া ঠান্ডা হয়ে গেল। এ তো রক্তাক্ত বলিদান, সময়ের ফাঁদ! অয়ন কাঁপতে কাঁপতে বলল, “না বাবা, আমরা কেউ যাব না। ঘড়িকে ভাঙতে হবে।” সে হাত বাড়িয়ে কাঠের কেসিংয়ে আঘাত করল। কিন্তু কাঠ ভাঙল না, বরং তার হাত ছিটকে পিছনে পড়ে গেল। আঙুলে ফোসকা পড়ে জ্বালা শুরু হলো। ঘড়ি যেন বিদ্রুপ করে টিকটিক শব্দে হাসছে। গায়ত্রী হঠাৎ শান্ত স্বরে বললেন, “আমাকেই যেতে হবে।” তাঁর চোখে তখন শৈলজা দেবীর ছায়া গাঢ় হয়ে উঠেছে। “আমি তো অনেককাল আগেই হারিয়ে গেছি। শিবু আমাকে ডাকছে। তোমরা থাকো।” তিনি ফাটলের দিকে এগিয়ে গেলেন। অরুণবাবু ঝাঁপিয়ে তাঁর হাত ধরলেন, কিন্তু ততক্ষণে ঘরের বাতাস ঝড়ের মতো ঘুরতে লাগল। অয়ন বাবাকে আঁকড়ে ধরে চিৎকার করল, “মাকে ছাড়বেন না!” ফাটলের ভেতর থেকে শিবুর কণ্ঠ শোনা গেল—“মা, এসো।” শব্দটা এত করুণ যে গায়ত্রী কেঁদে ফেললেন। “আমায় ছাড়ো, ওর কাছে যেতে দাও।” অরুণবাবুর ভেতরে তখন এক ভয়ানক দ্বন্দ্ব—স্ত্রীকে হারাবেন, নাকি ছেলেকে বাঁচাবেন? ঘড়ির লাল অক্ষর জ্বলজ্বল করছে—“সময় চাই।” হঠাৎ অরুণবাবু বুক ফুলিয়ে দাঁড়ালেন। চোখে আগুন জ্বেলে বললেন, “না! আমি দেব। আমি যাব।” অয়ন আর গায়ত্রী দু’জনেই চমকে উঠলেন। অরুণবাবু ছেলেকে বুকে জড়িয়ে বললেন, “তুই বাঁচবি। তোর ভবিষ্যৎ আছে। আমি শিক্ষক, আমি ইতিহাস পড়াই, আমিই ইতিহাসের ভেতরে মিলিয়ে যাব।” তিনি হাত ছাড়িয়ে ফাটলের দিকে এগোলেন। মুহূর্তে চারপাশের অন্ধকার ঘনীভূত হয়ে তাঁকে টেনে নিতে লাগল। অয়ন আর গায়ত্রী দু’জনেই চিৎকার করে উঠল, কিন্তু অরুণবাবু ঠান্ডা হাওয়ার স্রোতে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। ঘড়ির কাঁটা হঠাৎ থেমে গেল। আলো নিভে গেল। ফাটল মিলিয়ে গিয়ে ঘর আবার স্বাভাবিক। কেবল ঘড়ির ডায়ালে একফোঁটা রক্তের দাগ, আর টিকটিক শব্দে প্রতিধ্বনি—“একজন গেছে, সময় বেঁচেছে।”
অরুণবাবুর অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর ঘরটা যেন মৃত্যুর নীরবতায় ডুবে গেল। গায়ত্রী মেঝেতে বসে পড়লেন, চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে আসছে। অয়ন বাবার নাম ধরে চিৎকার করতে করতে দেয়াল চাপড়াতে লাগল, কিন্তু কোনো সাড়া নেই। ঘড়ির কাঁটা তখন স্থির, যেন কিছু ঘটেনি। অথচ ডায়ালের ভেতরে হালকা ছায়া ভেসে উঠছে—অরুণবাবুর মুখ, নিথর অথচ শান্ত, চোখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি। অয়ন ফুঁপিয়ে বলল, “না, আমি বাবাকে ফিরিয়ে আনব।” গায়ত্রী কাঁপা গলায় বললেন, “না রে, ও নিজের ইচ্ছায় গেছে। সময় তাকে নিয়েছে।” কিন্তু অয়ন দমল না। সেই রাতেই লুকিয়ে ঘড়ির নিচের ফাঁক খুলে ভেতরে আবার হাত ঢুকাল। ধুলোয় ভরা কাঠের তলায় সে পেল আরেকটা কাগজ—অর্ধেক পোড়া, তাতে লেখা, “যাকে সময় নেয়, তাকে ফেরানোর জন্য আরও রক্ত লাগে।” অয়ন থমকে গেল। মানে বাবাকে ফেরাতে হলে আরেকটা প্রাণ চাই! সকালে কলেজ থেকে বাবার সহকর্মীরা ফোন করছিলেন, তিনি ক্লাসে আসেননি জেনে উদ্বিগ্ন। গায়ত্রী তাদের সামলে বললেন, “শরীর খারাপ, বিশ্রামে আছেন।” কিন্তু সত্যি গোপন রাখা যায় না। পাড়া প্রতিবেশীরাও টের পাচ্ছিল বাড়ির ভেতরে অদ্ভুত কিছু ঘটছে। রাত নামতেই আবার ঘড়ির কাঁটা উল্টো দিকে ঘুরতে শুরু করল। এবার অয়ন ক্যামেরা চালু করে রেকর্ড করতে লাগল। আলো নিভে গেল, ফাটল আবার ফুটে উঠল। আর ফাটলের ভেতর অরুণবাবুর ছায়া দাঁড়িয়ে। তিনি হাত বাড়িয়ে বলছেন, “আমায় টেনে নাও না। আমি ফিরে আসতে চাই।” অয়ন কাঁদতে কাঁদতে বলল, “বাবা, আমি তোমায় ছাড়ব না।” কিন্তু গায়ত্রীর চোখে তখন অন্য চাহনি। তাঁর ঠোঁট দিয়ে বেরিয়ে এলো শৈলজা দেবীর স্বর, “না বাছা, তাকে আনতে গেলে তোর প্রাণ দিতে হবে।” অয়ন স্তব্ধ হয়ে গেল। ফাটলের ভেতর বাবার মুখে আতঙ্ক ফুটে উঠল। তিনি মাথা নাড়লেন—“না অয়ন, তুই কিছু করবি না। তুই বাঁচ।” কিন্তু অয়ন শুনছে না। ঘড়ির কাঁটার শব্দে তার মাথা ঘুরে যাচ্ছে। হাতে চিরকুটের ছেঁড়া কাগজ শক্ত করে ধরে সে ফিসফিস করল, “যদি রক্ত লাগে, আমি দেব।” কথাটা শেষ হতেই ঘড়ির কাঁটা দ্রুত ঘুরে গেল। ফাটলের ভেতর থেকে অসংখ্য হাত বেরিয়ে এল, কালো ধোঁয়ার মতো ছায়া মিশে গিয়ে অয়নের শরীর জড়িয়ে ধরল। গায়ত্রী ছেলের দিকে ছুটে গেলেন, কিন্তু তাঁকে ঠেলে পিছনে ফেলে দিল অদৃশ্য শক্তি। ঘড়ির ডায়াল হঠাৎ রক্তিম হয়ে উঠল। অয়ন চিৎকার করে উঠল, “বাবা…” আর তার কণ্ঠ মিলিয়ে গেল ঘড়ির টিকটিক শব্দের ভেতর। ফাটল ধপ করে বন্ধ হয়ে গেল। আলো ফিরে এল। মেঝেতে পড়ে আছে কেবল সেই ছেঁড়া চিরকুট, যার অক্ষর এখন ঝাপসা। ঘড়ির ডায়ালে আর কোনো ছায়া নেই। শুধু নিঃশব্দ নীরবতা। গায়ত্রী বুক চাপড়ে কাঁদতে লাগলেন—এক রাতেই স্বামী আর ছেলেকে হারালেন। অথচ ঘড়ি দেয়ালে ঝুলছে শান্তভাবে, যেন কিছুই ঘটেনি।
অয়ন নেই। গায়ত্রী ভোর পর্যন্ত নিথর বসে রইলেন মেঝেতে, চোখ শুকিয়ে কাঠ। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল ঘড়ির কাঁটার শব্দ তাঁর বুক ফুঁড়ে ঢুকে যাচ্ছে, প্রতিটি টিক যেন ছেলের হৃদস্পন্দনের প্রতিধ্বনি। সকাল হতেই প্রতিবেশীরা কড়া নাড়ল, কিন্তু তিনি দরজা খুললেন না। জানালার ফাঁক দিয়ে শুধু একবার চোখ মেলে তাকালেন—শহর আগের মতোই চলছে, অথচ তাঁর ঘরজুড়ে কেবল মৃত্যু। দুপুরে জল খেতে খেতে আচমকা টের পেলেন, ঘড়ির ডায়ালে কুয়াশার মতো কিছু ভেসে উঠছে। চোখ কুঁচকে তাকাতেই দেখলেন, সেখানে অরুণবাবু আর অয়ন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, দূরের মতো, কুয়াশার আড়াল থেকে। দু’জনেই হাত নাড়ছে। গলায় কোনো শব্দ নেই, শুধু ঠোঁট নড়ছে—“মা…”। গায়ত্রী এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালেন, ফিসফিস করে বললেন, “আমি আসছি।” সেই মুহূর্তে ঘরের ভেতর আবার ঠান্ডা হাওয়া বইতে লাগল, কেরোসিন তেলের গন্ধ ভেসে এল। বারোটা বাজেনি এখনও, তবু কাঁটা থেমে গিয়ে উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়াল। গায়ত্রী বুঝলেন, এবার তাঁকে ডাকা হচ্ছে। তিনি দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে ছুরিটা হাতে নিলেন। রক্তই যদি দরকার হয়, তবে তিনি নিজেরটা দেবেন। চোখে জল ভরে উঠল—“আমার দু’জনকেই ফেরাও, আমি একা থাকব না।” তিনি ছুরি নিজের হাতে বসিয়ে দিলেন। রক্ত ঝরতেই ঘড়ির কাঁটা পাগলের মতো দ্রুত ঘুরতে শুরু করল। দেয়াল ফেটে ফাটল তৈরি হলো, আর ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এক প্রবল ঝড়ের মতো আওয়াজ। সেখানে দেখা গেল অরুণবাবু আর অয়ন ছুটে আসছে, তাঁদের মুখে আতঙ্ক—“না, মা! তুমি এসো না!” গায়ত্রী হাত বাড়ালেন, তাঁদের ছুঁতে গিয়েই তিনি টের পেলেন শরীর শূন্য হয়ে যাচ্ছে। ফাটলের ভেতর থেকে শৈলজা দেবীর ছায়া বেরিয়ে এসে তাঁর কানে ফিসফিস করে বলল, “সময়ের ঋণ শোধ হলো।” গায়ত্রীর চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে গেল, চোখে ভেসে উঠল কেবল ছেলের মুখ। পরের মুহূর্তে সব নিস্তব্ধ। ঘরে কেউ নেই। শুধু ঘড়ি দেয়ালে টাঙানো, রক্তের দাগ শুকিয়ে বাদামি হয়ে গেছে কাঠে। বাইরের লোকেরা দরজা ভেঙে ঢুকলে ফাঁকা ঘর পেল। কোথাও অরুণবাবু, অয়ন বা গায়ত্রীর চিহ্ন নেই। কেবল সেই পুরোনো ঘড়ি, শান্তভাবে টিকটিক করছে—যেন কিছুই ঘটেনি।
বাড়িটা ফাঁকা হয়ে গেল, অথচ দেয়ালে ঘড়ি ঝুলে আছে একই ভঙ্গিতে। পাড়ার লোকজন প্রথমে ভেবেছিল পরিবারটা কোথাও চলে গেছে, কিন্তু ঘরে থাকা আসবাব, বই, কাপড় সবই ঠিকঠাক পড়ে আছে। শুধু মানুষ নেই। পুলিশ এলো, রিপোর্ট লিখল—“অস্বাভাবিক নিখোঁজ।” কিন্তু ঘড়িটার দিকে কেউ তাকাতে সাহস পেল না। অফিসারদের একজন চেষ্টা করেছিল সেটাকে খোলার, তখনই ঘড়ি থেকে হালকা টিকটিক শব্দ বেড়ে গিয়ে কানে গুঁজন তুলল। সে ভয় পেয়ে হাত সরিয়ে নিল। পরে পুরো বিষয়টা “অমীমাংসিত রহস্য” ফাইলে চাপা পড়ে গেল।
কয়েক মাস কেটে গেল। ফ্ল্যাট নতুন ভাড়াটিয়াকে দেওয়া হলো। তরুণ দম্পতি এসে উঠল, সঙ্গে ছোট্ট মেয়ে। তারা ঘড়িকে অদ্ভুত সুন্দর প্রাচীন অলঙ্কার ভেবে রেখে দিল দেয়ালে। মেয়ে প্রথম দিনই ঘড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মিষ্টি হাসিতে বলল, “মা, এই ঘড়িটা কথা বলে।” বাবা-মা হেসে উড়িয়ে দিল। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে ঘড়ির কাঁটা নিঃশব্দে একটু থেমে গেল। তারপর ধীরে ধীরে উল্টোদিকে ঘুরতে শুরু করল।
ডায়ালের কুয়াশার মধ্যে ভেসে উঠল তিনটি ছায়া—অরুণবাবু, গায়ত্রী আর অয়ন। তারা নিথর দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত সতর্কতার ঝিলিক। ঠোঁট নড়ল ধীরে ধীরে—“সময় ফেরে, মানুষ ফেরে না।” তারপর মিলিয়ে গেল সবকিছু।
শিশুটি ঘুমের ঘোরে কান্না শুরু করল। পরদিন সকালে তার শরীরে অদ্ভুত শীতল জ্বর ধরা পড়ল। ডাক্তার কিছুই বুঝতে পারল না। আর দেয়ালে টাঙানো ঘড়ি? সেটা নিস্তব্ধ টিকটিক শব্দে জানিয়ে দিল—সময়ের ঋণ কখনো মেটে না, কেবল নতুন নাম যোগ হয়।
অরুণবাবুর পরিবার হারিয়ে গেছে, কিন্তু ঘড়ি এখনও বেঁচে আছে, নতুন মালিক, নতুন শিকার খুঁজছে। যে বাড়ির মানুষই ভেবে নেবে ওটা কেবল প্রাচীন আসবাব, সেদিন থেকেই শুরু হবে আরেকটা অন্ধকার অধ্যায়।
শেষে কেবল ঘড়ির ঘণ্টাধ্বনি বেজে ওঠে—বারোটা। উল্টো দিকে ঘুরে যায় কাঁটা। অদৃশ্য অশরীরীদের ফিসফিসানি ভেসে আসে—
“আজ আবার নতুন এক আত্মা চাই।”
সমাপ্ত