আকাশ সরকার
অধ্যায় ১: পরিকল্পনার শুরু
শহরের ভিড়, যানজট আর ব্যস্ততার মধ্যে দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল একঘেয়ে ছন্দে। প্রত্যেকেই যেন যান্ত্রিক হয়ে গিয়েছিল—সকালে ঘুম ভেঙে কাজে বের হওয়া, সারাদিন অফিস বা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাপ সামলে রাতে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ি ফেরা। সপ্তাহান্তে হয়তো কেউ সিনেমা দেখে বা ক্যাফেতে সময় কাটায়, তবু মনের ভেতরে এক ধরনের শূন্যতা জমে যাচ্ছিল। বন্ধুদের মধ্যে সেই শূন্যতার কথাই সবচেয়ে বেশি অনুভব করছিল অনিক। এক সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো আড্ডাখানায়, ধূসর আলোয় মোড়া চায়ের দোকানে বসে থাকতে থাকতে সে হঠাৎ বলে উঠল, “আমাদের কিছু আলাদা করা দরকার। এইভাবে শহরে বসে থেকে আমরা কেবল আরও ক্লান্ত হচ্ছি। যদি কোথাও যাওয়া যেত—কিন্তু এবার যেন হোটেল বা রিসোর্টে নয়, অন্যরকম কিছু।” তার কথায় সবার চোখ চকচক করে উঠল। রূপা বলল, “তুমি কি বলছো ক্যাম্পিংয়ের মতো কিছু?” অনিক মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিল, “হ্যাঁ, কিন্তু সাধারণ ক্যাম্পিং নয়। শুনেছো গ্ল্যাম্পিং সম্পর্কে? আধুনিক বিলাসিতার মধ্যে থেকেও জঙ্গলের গভীরে প্রকৃতির ছোঁয়া পাওয়া যায়।”
চায়ের কাপে ধোঁয়া ভেসে উঠছিল, আর বন্ধুরা উচ্ছ্বাসে গলা মিলিয়ে পরিকল্পনা শুরু করল। তন্বী মোবাইল বের করে গুগলে সার্চ দিয়ে দেখাতে লাগল ছবি—সুন্দরভাবে সাজানো তাঁবু, ভেতরে নরম বিছানা, কাঠের ডেক, বাইরে জ্বলন্ত ক্যাম্পফায়ার, চারদিকে ঘন জঙ্গল। শোভন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে বলল, “এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে তো দারুণ হবে। আমরা সবাই একসাথে থাকব, প্রকৃতির মাঝখানে, অথচ কোনো অস্বস্তি থাকবে না।” তারা একে একে নিজেদের ব্যস্ততার হিসাব মিলিয়ে দেখতে লাগল—কোন দিন ছুটি পাওয়া যাবে, কে কোথায় থেকে যোগ দেবে। প্রত্যেকের চোখে তখন ছিল সেই অদ্ভুত ঝলক, যেন দীর্ঘদিনের ক্লান্তি ধুয়ে যাওয়ার মতো এক প্রতিশ্রুতি। রূপা বলল, “আমরা যদি এক সপ্তাহ পর বের হই, তাহলে অফিস থেকে ছুটি নেওয়া সম্ভব হবে।” অনিক উত্তেজিত স্বরে যোগ করল, “ঠিক আছে, তাহলে পরিকল্পনা পাকাপাকি। আমরা পাঁচজনই যাচ্ছি—আমি, রূপা, শোভন, তন্বী আর আবির।”
বন্ধুত্বের টানে ভরা এই সিদ্ধান্ত যেন মুহূর্তেই তাদের সম্পর্ককে নতুনভাবে প্রাণবন্ত করে তুলল। সবাই নিজেদের দায়িত্ব ভাগ করে নিল। আবির বলল, সে গাড়ির ব্যবস্থা করবে; রূপা নেবে খাবারের দায়িত্ব; তন্বী আনবে বারবিকিউ সেট; শোভন ক্যামেরা আর ড্রোন নিয়ে আসবে, আর অনিক সামলাবে রুট আর ক্যাম্পসাইট বুকিং। কথোপকথনের মধ্যে হাসি-ঠাট্টা চলতেই থাকল। যেন অনেকদিন পর তারা সত্যিই বেঁচে থাকার মতো একটা পরিকল্পনা করছে। দোকানের মালিকও মজা করে বলল, “তোমাদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে বড় কোনো মিশনে যাচ্ছো!” সবাই হেসে উঠল, আর সেই হাসির ভেতরেই যেন লুকিয়ে রইল এক নতুন সূচনার প্রতিশ্রুতি। শহরের একঘেয়ে রুটিন ভেঙে তারা খুঁজে পেল অজানার ডাক, আর সেই ডাকের সাড়া দিয়েই শুরু হলো গ্ল্যাম্পিং যাত্রার প্রথম অধ্যায়।
অধ্যায় ২: যাত্রার প্রস্তুতি
দিনক্ষণ ঠিক হয়ে যাওয়ার পর থেকেই বন্ধুদের উত্তেজনা যেন আরও বেড়ে গেল। প্রতিদিনের মতো অনিকের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এখন আর শুধু মজার মিম বা সাধারণ খবরের আদান-প্রদান হচ্ছিল না, বরং একের পর এক তালিকা তৈরি হচ্ছিল—কী কী নিতে হবে, কে কোন জিনিস আনবে। রূপা প্রথমেই দায়িত্ব নিল খাবারের; সে নিজেই রান্নায় দক্ষ, তাই বলল, “আমি কিছু রেডি-টু-কুক জিনিস নেব, যাতে জঙ্গলে গিয়ে ঝামেলা না হয়।” তন্বী তখন বলল, “আমি বারবিকিউ গ্রিল সেট আনব, আর কিছু কাঠি ও সস। ভাবছি চিকেন কাবাব করলে কেমন হয়?” কথার মাঝেই শোভন যোগ দিল, “তাহলে আমার দায়িত্ব হলো সব মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করা। আমি ড্রোনও নিয়ে যাব, আকাশ থেকে আমাদের তাঁবু আর জঙ্গল—সবকিছু সিনেমার মতো ফুটে উঠবে।” আবির তখন গাড়ি বুকিংয়ের খবর দিল। “আমি একটা এসইউভি ঠিক করে ফেলেছি, আমাদের পাঁচজনের সাথে ব্যাগপত্র আর সরঞ্জামও সহজেই যাবে।” কথাগুলো বলার সময় সবার চোখে-মুখে যে উচ্ছ্বাস ফুটে উঠেছিল, তা যেন প্রতিদিনের ব্যস্ততা ভেদ করে এক নতুন শক্তি এনে দিল।
এই প্রস্তুতির মধ্যে এক ধরনের শিশুসুলভ আনন্দ কাজ করছিল। অনিক একদিন সবাইকে ফোন করে বলল, “ব্যাগ গোছানোর সময় কোনো ভুল করা যাবে না। আমরা তো হোটেলে যাচ্ছি না, তাই যা লাগবে সব সঙ্গে নিতে হবে।” রূপা মজার ছলে জবাব দিল, “চিন্তা কোরো না, আমি তো প্রায় অর্ধেক রান্নাঘর সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি।” তন্বী তখন বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু ব্যাগ যেন এত ভারী না হয় যে গাড়িতে জায়গা না থাকে।” সবাই হেসে উঠল, তবে ভেতরে ভেতরে প্রত্যেকেই নিশ্চিত হচ্ছিল যে যাত্রা নিখুঁত করার জন্য কোনো ত্রুটি রাখা যাবে না। শোভন ক্যামেরার ব্যাটারি চার্জ দিচ্ছিল, মেমোরি কার্ড খালি করছিল; আবির গাড়ির সার্ভিসিং করিয়ে নিল; আর অনিক জিপিএস ম্যাপ দেখে রুট চিহ্নিত করল, কোথায় থামা যাবে, কোথায় জ্বালানি পাওয়া যাবে সব হিসাব কষে ফেলল। প্রস্তুতির এই ধাপগুলো তাদের কাছে শুধু দায়িত্বই ছিল না, বরং প্রত্যাশার এক মিষ্টি অংশ, যা ভ্রমণটিকে আরও আনন্দময় করে তুলছিল।
শেষ কয়েক দিন যেন কোনোভাবেই কাটছিল না। প্রতিদিন রাতেই গ্রুপ কলে নতুন আলোচনা চলত—কে কী গান বাজাবে, ক্যাম্পফায়ারের চারপাশে কী খেলা হবে, আর তারা কত রাত জেগে তারা দেখবে। শহরের অচেনা ব্যস্ততার ভিড়ে এই পরিকল্পনাগুলো যেন এক টুকরো স্বপ্ন হয়ে তাদের বাঁচিয়ে রাখছিল। এমনকি অফিসে বা ক্লাসে বসেও তারা সুযোগ পেলেই ভ্রমণের প্রসঙ্গ তুলত, আর হেসে উঠত নিজেদের দুষ্টুমিতে। অবশেষে যাত্রার আগের রাতে প্রত্যেকেই ব্যাগ গুছিয়ে রাখল দরজার পাশে, যেন সকালে বের হওয়ার সময় কোনো দেরি না হয়। রূপা মেসেজ দিল, “সবাই ঠিক সময় বের হবে, দেরি করলে কিন্তু রওনা দিতে দেব না।” উত্তরে অনিক লিখল, “আমরা তো ট্রেকিংয়ে যাচ্ছি না, গ্ল্যাম্পিং করতে যাচ্ছি—তবু দেরি করা যাবে না।” হাসির ইমোজি ভেসে উঠল চ্যাটবক্সে, আর তাদের প্রাণভরা উত্তেজনা যেন তখনই এক অদৃশ্য সুরে বাঁধা পড়ল। শহর ছাড়ার আগের সেই প্রস্তুতির মুহূর্তগুলোই তাদের মনে রয়ে গেল এক অনন্য আনন্দের প্রতিশ্রুতি হয়ে।
অধ্যায় ৩: জঙ্গলের পথে
সকালের সূর্য তখনো পুরোপুরি উঠেনি, শহরের রাস্তায় হালকা কুয়াশা জমে ছিল। আবিরের বুক করা কালো এসইউভি সামনে এসে দাঁড়াতেই একে একে সবাই ব্যাগপত্র নিয়ে হাজির হলো। তন্বী হাতে গিটার নিয়ে এসেছিল, যেন প্রথম রাতের ক্যাম্পফায়ারেই সেটি বাজানো যায়। রূপার বড় ব্যাগে নানা ধরনের খাবারের প্যাকেট, কনটেইনার আর মসলা ভর্তি ছিল, যা দেখে শোভন মজা করে বলল, “তুমি মনে হয় একটা রেস্টুরেন্ট খুলতে যাচ্ছো।” অনিক সবার ব্যাগ সঠিকভাবে গাড়ির পেছনে গুছিয়ে রাখল, তারপর জিপিএস সেট করে দিল গন্তব্যের দিকে—শহরের বাইরে প্রায় কয়েক ঘণ্টার পথ, পাহাড়ি জঙ্গল আর নদীর পাশ দিয়ে যেতে হবে। গাড়ি চলতেই ভেতরে শুরু হলো হাসি-ঠাট্টা আর গানের আসর। শোভন জানালার কাচ নামিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, “শহর ছেড়ে বের হওয়ার মুহূর্তটাই সবচেয়ে ভালো লাগে। মনে হয় সব ক্লান্তি পেছনে ফেলে যাচ্ছি।”
যাত্রাপথের দৃশ্যগুলো যেন একে একে ছবির মতো ভেসে উঠছিল। শহরের ভিড় ফেলে তারা পৌঁছাল খোলা মহাসড়কে, যেখানে দুই পাশে বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ। দূরে কিছুটা কুয়াশা ঢাকা গাছপালা, মাঝে মাঝে ছোট গ্রাম, আর রাস্তার ধারে সকালের বাজারের দৃশ্য তাদের ভ্রমণকে আরও জীবন্ত করে তুলছিল। আবির গাড়ি চালাচ্ছিল ছন্দময় ভঙ্গিতে, আর গাড়ির ভেতর বাজছিল পুরোনো বাংলা গান। তন্বী মাঝেমধ্যে গিটারের তারে হাত বোলাত, রূপা সবার হাতে তুলে দিচ্ছিল স্ন্যাকস, আর শোভন ক্যামেরায় ধরে রাখছিল প্রতিটি মুহূর্ত। গাড়ির ছাদ দিয়ে যখন প্রথম পাহাড়ি বাতাস এসে ভেসে এল, অনিক বলল, “এটাই আমাদের আসল শুরু। শহর এখন অনেক দূরে।” মুহূর্তেই সবার মধ্যে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ ছড়িয়ে পড়ল।
কিছুক্ষণ পর গাড়ি ঢুকল আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তায়। একদিকে উঁচু সবুজ পাহাড়, অন্যদিকে গভীর উপত্যকা, মাঝে দিয়ে কুণ্ডলী পাকানো রাস্তা। সবাই জানালার বাইরে তাকিয়ে একেকবার নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছিল সেই সৌন্দর্যে। দূরে দেখা যাচ্ছিল জলপ্রপাতের ঝরনা, আর সূর্যের আলো কুয়াশা ভেদ করে পড়ছিল গাছের পাতায়—যেন পুরো প্রকৃতি তাদের জন্যই সাজানো হয়েছে। রূপা মোবাইল বের করে বলল, “এই মুহূর্তটা যদি চিরদিন ধরে রাখা যেত।” শোভন হেসে উত্তর দিল, “চিন্তা নেই, আমার ক্যামেরায় সব ধরা পড়ছে।” গাড়ির ভেতরের হাসি, বাইরের সৌন্দর্য আর ভেতরের উত্তেজনা মিলে যাত্রাপথটা যেন হয়ে উঠল তাদের জীবনের সেরা অভিজ্ঞতার শুরু। শহরের দূষণ আর ক্লান্তির গণ্ডি পেরিয়ে তারা এখন সত্যিই প্রবেশ করছে সেই অজানা জগতে, যেখানে অপেক্ষা করছে জঙ্গলের গভীর নীরবতা আর গ্ল্যাম্পিংয়ের নতুন রোমাঞ্চ।
অধ্যায় ৪: প্রথম দেখা গ্ল্যাম্পসাইট
দীর্ঘ যাত্রার পর গাড়ি যখন কাঁচা পথ পেরিয়ে জঙ্গলের গভীরে প্রবেশ করল, তখন আকাশে সূর্যের আলো একটু নরম হয়ে এসেছে। চারদিকে ঘন গাছ, পাখির ডাক, আর মাঝে মাঝে অচেনা ঝোপঝাড়ের ফিসফিস আওয়াজ—সব মিলিয়ে একেবারে নতুন এক আবহ তৈরি হয়েছিল। গাড়ি থেমে গেল একটি খোলা জায়গায়, আর সেখানেই চোখের সামনে ধরা দিল সেই স্বপ্নের দৃশ্য—গ্ল্যাম্পসাইট। দূর থেকে দেখতে ঠিক যেন রূপকথার কোনো গ্রাম, যেখানে প্রতিটি তাঁবু আলাদা করে দাঁড়িয়ে আছে। এগুলো সাধারণ কাপড়ের তাঁবু নয়, বরং মজবুত কাঠের ফ্রেমে টানানো সাদা-ক্রিম রঙের মোটা ক্যানভাস। প্রতিটি তাঁবুর সামনে ছোট ছোট কাঠের ডেক, যেখানে চেয়ার-টেবিল সাজানো, আর পাশেই ঝোলানো লণ্ঠন সূর্যের আলোয় হালকা ঝিকমিক করছে। চারপাশের সবুজ গাছপালা আর ঝরনার স্রোতের শব্দ মিলে জায়গাটাকে একেবারে অন্য জগতের মতো করে তুলেছিল।
বন্ধুরা গাড়ি থেকে নেমে চারদিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল। তন্বী প্রথমেই চিৎকার করে উঠল, “বিশ্বাসই হচ্ছে না, আমরা সত্যিই এখানে এসেছি!” অনিক মৃদু হেসে বলল, “এবার বুঝছো কেন এতদিন ধরে প্ল্যান করছিলাম?” রূপা চারপাশে হাঁটতে হাঁটতে একেকটা তাঁবুর ভেতর উঁকি দিয়ে দেখছিল। ভিতরে ছিল নরম বিছানা, পরিষ্কার সাদা চাদর, ছোট ল্যাম্প আর কাঠের আলমারি। জানালাগুলো কাঁচ দিয়ে ঢাকা, তাই ভিতরে বসেই বাইরে জঙ্গলের দৃশ্য দেখা যায়। শোভন ক্যামেরা হাতে নিয়ে নিরন্তর ছবি তুলছিল, যেন প্রতিটি মুহূর্ত সে আটকে রাখতে চায়। আবির গাড়ি থেকে ব্যাগ নামিয়ে সবাইকে সাহায্য করছিল, তবে তার চোখেও লুকোনো উত্তেজনা স্পষ্ট ছিল। এতদিন শহরের কোলাহলে আটকে থাকা তারা যেন হঠাৎ প্রকৃতির কোলে এসে একেবারে অন্যরকম এক স্বাধীনতা অনুভব করছিল।
তাঁবুর পাশের খোলা জায়গায় ছিল একটি বড় ফাঁকা মাঠ, যেখানে সন্ধ্যায় ক্যাম্পফায়ার হবে বলে সাজানো ছিল আগুন জ্বালানোর কাঠ। দূরে ঝরনার মৃদু শব্দ, পাখির উড়ে যাওয়া আর হাওয়ার দোলা মিলিয়ে বাতাসে এক অদ্ভুত সুর বাজছিল। সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে রইল, আর কারও মুখে তেমন কোনো কথা রইল না। শব্দহীনতায় তারা বুঝতে পারল, শহর থেকে বহু দূরে এই নির্জন জায়গাটা শুধু ভ্রমণ নয়, বরং তাদের ভেতরের সব চাপ, ক্লান্তি আর অবসাদের থেকে মুক্তি এনে দিয়েছে। তন্বী গিটার বের করে বাজাতে শুরু করল হালকা সুর, আর সেই সুর যেন মিলেমিশে গেল জঙ্গলের নীরবতার সাথে। রূপা হাসতে হাসতে বলল, “এখানে রাতটা কেমন হবে ভাবতেই আমার গা শিরশির করছে।” অনিক চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নিল, তারপর মৃদু স্বরে বলল, “এটাই তো আমরা খুঁজছিলাম—প্রকৃতির কোলে আধুনিকতার আরাম।” আর ঠিক সেই মুহূর্তে তারা বুঝল, তাদের যাত্রার আসল গল্প শুরু হলো এখান থেকেই।
অধ্যায় ৫: প্রকৃতির সাথে প্রথম রাত
সূর্য যখন ধীরে ধীরে গাছের মাথার আড়ালে ঢলে পড়ল, তখন জঙ্গলের রং যেন পাল্টে গেল। দিনের আলোয় যে সবুজ এত প্রাণবন্ত লাগছিল, তা রাতের ছায়ায় হয়ে উঠল রহস্যময় আর নীরব। গ্ল্যাম্পসাইটের চারপাশে ছোট ছোট লণ্ঠন জ্বলে উঠল, তাদের হলদেটে আলো জঙ্গলের অন্ধকারে কোমল আবরণ তৈরি করল। আবির কাঠের স্তূপ সাজিয়ে দিল, আর অনিক দিয়াশলাই ধরতেই আগুন ফোঁপাতে ফোঁপাতে উঁচু হয়ে উঠল। শিখার আলোয় সবাই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল—তাদের চোখে পড়ছিল আগুনের ঝিলিক আর পেছনে গভীর জঙ্গলের কালো অন্ধকার। রূপা খাবারের প্যাকেট খুলে আনল, তন্বী গিটার হাতে নিয়ে আগুনের পাশে বসল, আর শোভন ক্যামেরায় সেই মুহূর্তগুলো বন্দি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। চারদিকে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর দূরের কোনো অজানা প্রাণীর ডাকে এই নীরবতা আরও গভীর হয়ে উঠেছিল।
গানের সুরে সবার ভেতর এক অদ্ভুত প্রশান্তি নেমে এলো। তন্বী নরম স্বরে একের পর এক পুরোনো বাংলা গান গাইছিল, আর বাকিরা গলা মেলাচ্ছিল। আগুনের তাপে মাঝে মাঝে কাঠ ফেটে যাওয়ার শব্দ উঠছিল, তাতে যেন আরও ছন্দ তৈরি হচ্ছিল। রূপা মজার ছলে বলল, “এই ক্যাম্পফায়ার ছাড়া আমাদের ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যেত।” সে খাবারের বাক্স থেকে বের করে দিল সেদ্ধ ভুট্টা আর মাখা আলুর প্যাকেট। গরম গরম ভুট্টার দানা খেতে খেতে শোভন বলল, “জীবনে অনেক পার্টি করেছি, কিন্তু এই মুহূর্তটার মতো আনন্দ আর কখনো পাইনি।” অনিকের চোখে যেন আলাদা এক শান্তি ফুটে উঠেছিল। সে ধীরে ধীরে বলল, “প্রকৃতির মাঝে আসলেই মানুষ বুঝতে পারে, কতটা ছোট সে, আর কতটা সহজ জিনিসেই সুখ খুঁজে পাওয়া যায়।” আগুন, গান, খাবার আর বন্ধুত্বের হাসিতে সেই রাত যেন জাদুময় হয়ে উঠল।
রাত যত গভীর হচ্ছিল, ততই আকাশে তারার সংখ্যা বাড়ছিল। শহরে থেকে যে তারাগুলো তারা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল, এখানে তা হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে ফেলার মতো কাছে মনে হচ্ছিল। সবাই একসাথে মাঠের ঘাসে শুয়ে পড়ল, উপরে তাকিয়ে তারা গুনতে লাগল। রূপা মুগ্ধ হয়ে বলল, “এমন আকাশ আমি আগে কোনোদিন দেখিনি।” আবির মজা করে বলল, “তাহলে এবার একটা উইশ করো, হয়তো পূরণ হয়ে যাবে।” তারা গুনতে গুনতে হাসতে লাগল, তবু ভেতরে ভেতরে প্রত্যেকেই অনুভব করছিল এক অদ্ভুত শান্তি। আগুনের তাপ, রাতের শীতল হাওয়া, গানের সুর আর তারাভরা আকাশ—সব মিলিয়ে সেই রাতটা শুধু তাদের প্রথম গ্ল্যাম্পিং অভিজ্ঞতা নয়, বরং জীবনের এক অনন্য স্মৃতি হয়ে গেল। বন্ধুরা বুঝল, এ এক ভ্রমণ নয়; এটা ছিল জীবনের চাপের বাইরে গিয়ে সত্যিকারের বেঁচে থাকার অনুভূতি।
অধ্যায় ৬: রহস্যময় শব্দ
রাতের গভীরতা যেন জঙ্গলের প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে পড়ছিল। আগুন তখনো নিভে যায়নি, তবে তার শিখা আর আগের মতো উঁচু ছিল না—শুধু লালচে অঙ্গারের আলো ধিকিধিকি করে জ্বলছিল। বন্ধুরা কিছুক্ষণ আগেই তারাভরা আকাশ দেখে তাঁবুর ভেতরে ঢুকেছে। তাঁবুর ভিতরে নরম বিছানার আরামে শুয়ে তারা গল্প করছিল, কখনো হেসে উঠছিল, আবার কখনো চুপ করে থেকে চারপাশের অদ্ভুত নীরবতা শুনছিল। কিন্তু সেই নীরবতা বেশিক্ষণ টিকল না। হঠাৎ করে কোথাও থেকে একটা শুকনো ডাল ভাঙার শব্দ এলো—খটাস করে। সবাই থমকে গেল। অনিক ফিসফিস করে বলল, “শুনলে তো?” তন্বী বিছানার চাদর শক্ত করে জড়িয়ে বলল, “হয়তো কোনো হাওয়া।” কিন্তু রূপার গলা কাঁপছিল, “না, আমি স্পষ্ট শুনেছি, কারও পায়ের আওয়াজের মতো।” তাঁবুর কাঁচ জানালা দিয়ে তারা অন্ধকার জঙ্গলের দিকে তাকাল, কিন্তু ঘন ছায়ার ভেতরে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না।
এক মুহূর্তের জন্য সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল, তারপর শোভন ক্যামেরা হাতে নিয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। “আমি দেখি,” সে বলল। কিন্তু জানালার বাইরে শুধু নড়াচড়া করা পাতার শব্দ আর দূরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া আর কিছু ছিল না। হঠাৎ আবার ঝোপের ভেতর থেকে অদ্ভুত শব্দ শোনা গেল—যেন কিছু একটা ঘাসের ওপর দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আবির দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগোতেই রূপা হাত টেনে ধরল, “বাইরে যেও না!” অনিক ঠান্ডা মাথায় সবাইকে শান্ত করার চেষ্টা করল। “হয়তো কোনো বন্যপ্রাণী। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।” কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারও বুক ধকধক করছিল। কারণ এতদিন শহরে থেকে তারা কখনো এমন অচেনা শব্দ শোনেনি, আর জঙ্গলের গভীরে এসে এই রহস্যময় পরিবেশ যেন ভয়ের ছায়া ফেলে দিল।
শব্দগুলো ধীরে ধীরে দূরে সরে গেল, কিন্তু তাদের ভেতরে অস্বস্তি থেকে গেল। তাঁবুর ভেতর নিস্তব্ধতা এমন ঘন হয়ে উঠল যে, কারও শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। অবশেষে অনিক লণ্ঠনটা নিভিয়ে বলল, “চেষ্টা করো ঘুমিয়ে পড়তে। যত ভাবব, তত ভয় বাড়বে।” সবাই ধীরে ধীরে চুপ করে গেল, তবে চোখ কারও বন্ধ হচ্ছিল না। দূরের ঝোপে মাঝে মাঝে আবার মৃদু শব্দ শোনা যাচ্ছিল—কখনো পাতা নড়ার, কখনো অচেনা ডাক। সময় যত গড়াচ্ছিল, সেই শব্দগুলো আর ভয়ের মতো লাগছিল না, বরং রহস্যময় এক ছন্দের মতো মনে হচ্ছিল। শহরে থেকে তারা যা কখনো শোনেনি, প্রকৃতির সেই অচেনা সুরের সাথেই তারা প্রথমবার পরিচিত হলো। ভয় আর কৌতূহলের মিশ্র অনুভূতি নিয়ে সেই রাতটাও ধীরে ধীরে তাদের জীবনের অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতায় পরিণত হলো।
অধ্যায় ৭: ভোরের সৌন্দর্য
রাতের সেই ভয়ের আবহ কেটে গিয়ে অবশেষে যখন ভোর হল, তখন তাঁবুর ভেতর নরম আলো ঢুকে পড়ল। প্রথমে সবাই অলস ঘুমের মধ্যে ছিল, কিন্তু পাখির একসাথে ডাক যেন তাদের জাগিয়ে তুলল। রূপা প্রথমে দরজার চেইন খুলে বাইরে বেরোল, আর দৃশ্য দেখে তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। চারদিকে শিশির ভেজা ঘাস, পাতার গায়ে ছোট ছোট পানিকণা সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করছে। হালকা কুয়াশার চাদর এখনো ঝুলে আছে গাছের মাথায়, আর দূরে পাহাড়ি ঢাল বেয়ে পড়া সূর্যের সোনালি আলো পুরো জঙ্গলের রঙ বদলে দিয়েছে। বাতাসে ছিল এক ধরনের কাঁচা, সতেজ গন্ধ, যা শহরে থেকে তারা কোনোদিন পায়নি। রূপা চুপ করে দাঁড়িয়ে সবকিছু শুষে নিচ্ছিল নিজের ভেতরে, তারপর হাসিমুখে ডাকল, “সবাই বাইরে এসো, এটা মিস করলে আফসোস করবে।”
এক এক করে সবাই তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলো। অনিক গভীর শ্বাস নিয়ে বলল, “এই বাতাসটা যেন পুরো শরীর ধুয়ে দিচ্ছে।” আবির ঘাসের ওপর খালি পায়ে হাঁটতে লাগল, শিশিরে ভিজে পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল, আর সেই ঠান্ডা স্পর্শে তার মনে হচ্ছিল, সে যেন কোনো অচেনা পৃথিবীতে পা দিয়েছে। তন্বী গিটার হাতে নিয়ে ডেকের ওপর বসে হালকা সুর তুলল, আর পাখিদের ডাকের সাথে সেই সুর একেবারে মিশে গেল। শোভন তখন ড্রোন ক্যামেরা উড়িয়ে আকাশ থেকে দৃশ্য ধারণ করছিল। উপরে থেকে দেখা যাচ্ছিল তাঁবুগুলো ছোট ছোট বিন্দুর মতো, আর চারপাশে সবুজের বিস্তৃতি। ছবির মতো সেই দৃশ্য দেখে শোভন বলল, “এমন সৌন্দর্য ক্যামেরায় ধরে রাখা সম্ভব না। শুধু চোখ দিয়েই এটা আসলভাবে দেখা যায়।” সবাই মুগ্ধ হয়ে নীরবতায় ডুবে গেল, যেন প্রকৃতি তাদের জন্যই এই সকালের আয়োজন করেছে।
রূপা আগুন জ্বালিয়ে সকালের নাস্তা বানাতে শুরু করল—ডিম ভাজি আর টোস্ট। গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে ভরতে ভরতে সে বলল, “এখানে থেকে গেলে কেমন হতো, বলো তো?” অনিক হেসে উত্তর দিল, “তাহলে হয়তো শহরের ব্যস্ততায় কখনো আর ফিরতে চাইতাম না।” সকালের সেই সহজ অথচ অনন্য আয়োজনের মাঝেই তারা অনুভব করছিল, প্রকৃতির কাছে মানুষের আসল জায়গা কতটা ভিন্ন। দূরে সূর্যের আলো ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল, কুয়াশা সরে গিয়ে জঙ্গলের সবুজ আরও স্পষ্ট হচ্ছিল, আর তাদের হৃদয়ের ভেতর জমে থাকা সমস্ত ভয়, ক্লান্তি আর উদ্বেগ যেন সেই আলোয় মিলিয়ে যাচ্ছিল। ভোরের সেই সৌন্দর্য তাদের মনে এমন শান্তি এনে দিল, যা কোনো বিলাসবহুল হোটেল বা শহুরে জীবনে কখনো পাওয়া সম্ভব নয়। তারা বুঝল, প্রকৃতির সাথে একাত্ম হওয়ার এই মুহূর্তটাই তাদের যাত্রার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার।
অধ্যায় ৮: ছোট্ট অ্যাডভেঞ্চার
সকালের নাস্তা শেষ করে বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিল জঙ্গলের ভেতরে একটু ট্রেকিং করবে। গ্ল্যাম্পসাইটের ম্যানেজার তাদের হাতে একটা রুট ম্যাপ দিল, যেখানে কাছেই একটা ছোট ঝরনার অবস্থান দেখানো ছিল। অনিক মানচিত্র দেখে বলল, “এই রুটটা খুব বেশি দূর নয়, দুই ঘণ্টার মধ্যেই ঘুরে আসতে পারব।” সবাই জুতো শক্ত করে বাঁধল, ব্যাকপ্যাকে পানি আর কিছু স্ন্যাকস নিল, আর শোভন গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে এগিয়ে গেল প্রথমে। চারপাশে তখন সূর্যের আলো গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে এসে পড়ছিল, বাতাসে ভিজে মাটির গন্ধ আর পাখিদের ডাক মিলেমিশে একেবারে রহস্যময় পরিবেশ তৈরি করেছিল। এক সময় তারা এক সরু কাঠের সেতুর সামনে এসে দাঁড়াল, যেটা ছোট্ট নদীর ওপর দিয়ে গেছে। সেতুটা দুলছিল, কিন্তু সবাই মজা করে একে একে পার হলো। রূপা ভয় পেয়েও হাসতে হাসতে বলল, “এটা তো একেবারে সিনেমার মতো লাগছে।”
জঙ্গলের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে তারা নানা রকম দৃশ্য দেখতে পেল। কোথাও লতাগুল্মে ভরা গাছ, কোথাও রোদ এসে পড়েছে এমন খোলা জায়গা, আবার কোথাও পাথরে ঢাকা সরু পথ। মাঝে মাঝে তাদের চোখে পড়ছিল বুনো ফুল, রঙিন প্রজাপতি আর পাখির ঝাঁক। তন্বী বারবার থেমে ছবি তুলছিল, আর শোভন প্রতিটি মুহূর্ত ক্যামেরায় ধরে রাখছিল। হঠাৎ করে একটা ঝোপের ভেতর থেকে অচেনা শব্দ এলো, সবাই থেমে গেল। অনিক নিচু স্বরে বলল, “চিন্তা নেই, হয়তো কোনো হরিণ বা খরগোশ।” সত্যিই কিছুক্ষণ পরেই ঝোপ থেকে একটা ছোট বুনো হরিণ লাফিয়ে বেরিয়ে গিয়ে দূরে অদৃশ্য হয়ে গেল। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, আর আবির মজা করে বলল, “আমরা সত্যিই জঙ্গলে আছি, শহরের চিড়িয়াখানায় নয়।” হাসির রোল পড়ে গেল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রত্যেকেই বুঝছিল, এই অভিজ্ঞতা তাদের মনে চিরকাল বেঁচে থাকবে।
শেষমেশ তারা পৌঁছাল সেই ঝরনার কাছে। ছোট হলেও ঝরনাটা যেন একেবারে জাদুর মতো সুন্দর। পাথরের ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা পানি গড়িয়ে পড়ছে, চারপাশে সবুজে ঢাকা দেয়াল, আর পানির ফোঁটা সূর্যের আলোয় রঙিন হয়ে উঠছে। সবাই জুতো খুলে পানিতে পা ডুবিয়ে দিল, ঠান্ডা পানির স্পর্শে যেন ক্লান্তি মুহূর্তেই উড়ে গেল। রূপা হাসিমুখে বলল, “এটাই তো আমাদের আসল পুরস্কার।” আবির তখন পানির ছিটা মেরে সবাইকে ভিজিয়ে দিল, তাতে হাসি আর চিৎকারে পুরো জায়গাটা মুখর হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ পরে তারা পাথরের ওপর বসে স্ন্যাকস খেল, আর প্রকৃতির সেই শান্ত সৌন্দর্যের মধ্যে সময় যেন থেমে গেল। ফেরার পথে সবার চোখে-মুখে এক ধরনের আনন্দ আর তৃপ্তি ছিল, যেন ছোট্ট এই অ্যাডভেঞ্চারই তাদের যাত্রাকে আরও পূর্ণতা দিয়েছে।
অধ্যায় ৯: বন্ধুত্বের বন্ধন
ঝরনার সেই ছোট্ট অ্যাডভেঞ্চার শেষে যখন তারা গ্ল্যাম্পসাইটে ফিরে এলো, তখন সূর্য ইতিমধ্যেই পশ্চিমে হেলে পড়েছে। সকালের ক্লান্তি সবার শরীরে থাকলেও মুখে ঝলমল করছিল এক অদ্ভুত আনন্দ। তাঁবুর সামনে বসেই তারা ব্যাগ থেকে কিছু বের করল—চিপস, বিস্কুট আর পানীয়। প্রথমে ভেবেছিল কেবল একটু বিশ্রাম নেবে, কিন্তু গল্প শুরু হতেই সময় যেন উড়ে গেল। রূপা বলল, “আমরা শহরে থাকলে এভাবে বসার সুযোগ পাই না। সবসময় কাজ, ফোন আর ব্যস্ততা।” অনিক মাথা নেড়ে উত্তর দিল, “হ্যাঁ, অথচ আসল আনন্দ তো এইখানেই—কোনো ভান নেই, শুধু আমরা আর প্রকৃতি।” তাদের কথোপকথনের মাঝে বারবার গাছ থেকে পাখি উড়ে যাচ্ছিল, হাওয়ার দোলায় তাঁবুর কাপড় নড়ছিল, আর দূরে সূর্যের রঙিন আলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছিল। বন্ধুত্বের নীরব বন্ধন যেন আরও শক্ত করে বাঁধছিল তাদের একে অপরের সঙ্গে।
রাত নামতেই তারা আবার আগুন জ্বালাল। এবারে আবির নেতৃত্ব নিল রান্নার কাজে। তন্বী গিটার হাতে গান গাইছিল, শোভন হাসতে হাসতে ক্যামেরা একদিকে রেখে বলল, “আজ ছবি নয়, শুধু মুহূর্তটা উপভোগ করি।” রূপা আগুনের পাশে বসে রান্নার মশলা মেশাচ্ছিল, আর অনিক পুরো দৃশ্যটা দেখে চুপ করে ছিল। এত বছর ধরে বন্ধুত্ব হলেও শহরের কোলাহলে তারা যেন একে অপরকে ভুলে গিয়েছিল, অথচ এখানে এসে আবার নতুন করে খুঁজে পাচ্ছে সেই পুরোনো সম্পর্ক। গানের সুর, খাবারের গন্ধ আর আগুনের ঝিলিক মিলে একধরনের পারিবারিক উষ্ণতা তৈরি করছিল। রূপা হেসে বলল, “আমাদের তো মনে হচ্ছে না আমরা কোনো ভ্রমণে এসেছি, বরং নিজেদের একটা নতুন বাড়ি বানিয়েছি।” কথার সাথেই যেন সবাই মনের ভেতরে সম্মতি জানাল।
খাবার শেষে তারা আগুনের চারপাশে বসে নিজেদের পুরোনো স্মৃতিগুলো মনে করছিল। কলেজের দিন, প্রথম ভ্রমণ, প্রথম প্রেম—সব একে একে আলোচনায় আসছিল। মাঝে মাঝে হাসি, আবার কখনো নীরবতা, কিন্তু সেই নীরবতাতেও ছিল এক অদ্ভুত স্বস্তি। অনিক ধীরে বলল, “বন্ধুত্ব আসলে কোনো ছবির মতো নয়, যেটা শুধু ফ্রেমে বাঁধা থাকে। এটা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে পরিবর্তিত হয়, আর এ ধরনের ভ্রমণ আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমরা কতটা ভাগ্যবান।” বাকিরা চুপ করে তার কথা শুনল, তারপর তন্বী গিটার বাজিয়ে সুর তুলল। আগুনের আলোয় তাদের হাসিমাখা মুখ, জঙ্গলের নীরব পটভূমি আর হৃদয়ের সেই গভীর সংযোগ—সব মিলিয়ে রাতটা হয়ে উঠল এক অমূল্য সম্পদ, যা সময়ের সাথে মুছে যাবে না। বন্ধুত্বের এই নতুন বাঁধনেই তারা উপলব্ধি করল, আসল ভ্রমণ মানে শুধু জায়গা দেখা নয়, বরং একে অপরের ভেতরে নতুন করে ফিরে পাওয়া।
অধ্যায় ১০: বিদায় কিন্তু স্মৃতিময়
শেষ রাতের আগুনের উষ্ণতা আর গান এখনো তাদের মনে রয়ে গেছে। সকালে সূর্য ওঠার আগেই তাঁবুর ভেতর সবার ব্যাগ গোছানো শুরু হয়ে গেল। ভেতরে ভেতরে সবাই জানত যে আজই তাদের ফিরতে হবে, তবু চোখে-মুখে ছিল একধরনের নীরব অনিচ্ছা। রূপা কাপড় ভাঁজ করতে করতে বলল, “আমার তো মনে হচ্ছে এখানেই থেকে যাই।” আবির হাসতে হাসতে উত্তর দিল, “তা হলে তোমার অফিসের বসকে কে সামলাবে?” সবাই হেসে উঠল, কিন্তু সেই হাসির আড়ালে চাপা ছিল একধরনের বিষণ্ণতা। তাঁবুর বাইরে গাছের পাতা ঝরে পড়ছিল, হাওয়ার সাথে সাথে এক অদ্ভুত বিদায়ের আবহ তৈরি হচ্ছিল। প্রত্যেকে মনে মনে বুঝতে পারছিল, এই কয়েকদিনের অভিজ্ঞতা শুধু ভ্রমণ নয়—এটা ছিল তাদের জীবনের এক বিশেষ অধ্যায়, যেটা চিরকাল মনে থাকবে।
গ্ল্যাম্পসাইটের ম্যানেজার যখন এসে তাঁদের বিদায় জানাল, তখনও তারা বারবার চারপাশের দৃশ্য চোখে ভরছিল। শিশিরভেজা ঘাস, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ভেসে আসা পাখির ডাক, আর সেই সকালের কুয়াশা—সবকিছু যেন এক অদৃশ্য সুতোয় তাদের বেঁধে ফেলেছিল। অনিক বলল, “শহরে ফিরে গেলে আবার কাজ, ব্যস্ততা আর শব্দের ভিড়… কিন্তু এখানে আমরা সত্যিই নিজের মতো করে বেঁচেছিলাম।” শোভন ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে চারপাশে শেষবারের মতো ছবি তুলল, তারপর আস্তে করে বলল, “ক্যামেরায় হয়তো ধরা পড়বে, কিন্তু হৃদয়ের ভেতর যা আছে সেটা কোনো ছবিতে ধরা যাবে না।” তন্বী গিটারটা কেসে ভরতে ভরতে বলল, “এই কয়েকটা গান, এই আগুনের চারপাশে বসে যে মুহূর্তগুলো কাটালাম, এগুলো একদিন আমাদের আবার ডাকবে।” সবাই একমত হল, একদিন তারা অবশ্যই আবার এখানে ফিরবে।
ফেরার গাড়িতে বসে সবাই জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইল। জঙ্গলের ভেতরকার আঁকাবাঁকা পথ, দূরের পাহাড়, আর সূর্যের আলোয় ঝলমলে সবুজ যেন তাদের বিদায় জানাচ্ছিল। গাড়ির ভেতরে তেমন কথা হচ্ছিল না, কিন্তু নীরবতার মধ্যেও বন্ধুত্বের উষ্ণতা স্পষ্ট ছিল। রূপা আস্তে বলল, “আমরা সবাই হয়তো আবার শহরে ফিরে যাব, কিন্তু এই ভ্রমণ আমাদের বদলে দিয়েছে।” আবির হাসিমুখে যোগ করল, “হ্যাঁ, মনে হয় আমরা আবার নিজেদের খুঁজে পেয়েছি।” গাড়ি যত দূরে যেতে লাগল, ততই জঙ্গলের ছবি ফিকে হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু স্মৃতিগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। তাদের প্রত্যেকেই জানত, এ কেবল একটি ভ্রমণের সমাপ্তি নয়, বরং বন্ধুত্বের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। আর সেই অনুভূতিই এই গ্ল্যাম্পিং ভ্রমণকে তাদের জীবনের সবচেয়ে স্মৃতিময় অভিজ্ঞতায় পরিণত করল।
-শেষ-