Bangla - ভূতের গল্প

গ্লিচড সেলফি

Spread the love

তন্ময় সরকার


এক

শহরের আকাশে সেইদিন গোধূলির রঙ মিশে ছিল অদ্ভুত ভাবে—আধেক নীল, আধেক কমলা, আর মাঝে কোথাও কোথাও ছায়ার মতো ভাসছিল মেঘ। রাহুল সেন নিজের পুরনো কিন্তু প্রিয় ক্যামেরাটা টেবিলে রেখে জানলার ধারে এসে দাঁড়াল। সামনের রাস্তায় হালকা ভিড়, দোকানের আলো জ্বলে উঠছে একে একে, আর দূরে শিঙা বাজিয়ে একজন আইসক্রিমওয়ালা এগিয়ে যাচ্ছে। কাজের ফাঁকে এইসব দৃশ্য ওর খুব ভালো লাগে—শহরের ছন্দ, আলো-ছায়ার খেলা। ঠিক তখনই ফোনে মেসেজ এল—মেহরের। “দেখ, একদম পাগল করা অ্যাপ পেয়েছি! তোকে দেখাতেই হবে।” কয়েক মিনিট পরেই ও দরজায় কড়া নাড়ল। মেহর নাসরিন, চশমা-পরা মুখে চিরচেনা হাসি, হাতে ধরে আছে মোবাইল। “তুই তো নতুন টেক নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে ভালবাসিস, এটা না ট্রাই করলে আফসোস করবি।” রাহুল হেসে ওকে ভেতরে নিয়ে এল, দুইজন সোফায় বসল। মেহর অ্যাপ চালু করল—স্ক্রিনে নানারকম ফিল্টার দেখাল, যেন কারও পেছনে ভাসছে উড়ন্ত লণ্ঠন, কারও মাথায় বসানো কাগজের মুকুট, আবার কারও মুখের ত্বক স্বপ্নের মতো মসৃণ হয়ে যাচ্ছে। “দেখ, ফেস ট্র্যাকিং একদম নিখুঁত, ব্যাকগ্রাউন্ডও বদলে যায়,” মেহর বলল, আর নিজের সেলফি তুলে দেখাল—পেছনে নীল সমুদ্র, চুলে রোদ্দুরের ঝিলিক। সবকিছুই খুব স্বাভাবিক, বাস্তবের সঙ্গে গেঁথে আছে যেন।

রাহুল মুগ্ধ হয়ে দেখছিল, তারপর স্বভাবসিদ্ধ কৌতূহলে বলল, “আমারও একটা তুলি দেখি।” মেহর ফোন এগিয়ে দিল, আর রাহুল নিজেকে ক্যামেরার ফ্রেমে ঠিক করল—হালকা ঝুঁকে, জানলার আলো মুখে পড়ছে এমন কোণ বেছে নিয়ে। স্ক্রিনে কিছু সেকেন্ডে লোড হল এক মায়াময় ব্যাকগ্রাউন্ড—মনে হচ্ছে কোথাও বিদেশি শহরের রাস্তা, পেছনে নিয়ন আলো ঝলকাচ্ছে। কিন্তু রাহুলের চোখ কেমন যেন আটকে গেল নিজের মুখে—অথবা বলা ভালো, মুখটা মোটেই নিজের নয়। চোয়ালটা একটু লম্বা, চোখের ভেতর যেন কোনো আলো নেই, আর ঠোঁটে এক অদ্ভুত টান, যেন অর্ধেক হাসি, অর্ধেক বিদ্রূপ। “এটা কী হল?” রাহুল ধাক্কা খাওয়া গলায় বলল। মেহর প্রথমে হেসে উঠল, “ওফফ, দ্যাখ! হয়তো অ্যাপের বাগ। তোর ফেস ট্র্যাকিং একটু গন্ডগোল করেছে।” কিন্তু রাহুল মোবাইলটা কাছে টেনে নিয়ে স্ক্রিনে ভাল করে তাকাল—এটা কোনো সাধারণ গ্লিচ নয়। গালের রেখাগুলো তীক্ষ্ণ, ত্বকটা অদ্ভুতভাবে ফ্যাকাশে, আর সেই চোখের গভীরে অস্বস্তিকর শূন্যতা, যা ওর নিজের চোখের সঙ্গে মেলে না। তাড়াতাড়ি আবার একবার ছবি তুলল, ভেবেছিল ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু না—আবারও সেই একই চেহারা, একই অদ্ভুত দৃষ্টি। শুধু মনে হল ঠোঁটের বাঁক আগের চেয়ে একটু বেশি স্পষ্ট হয়েছে, যেন সে চেনে রাহুলকে।

মেহর এবার কপাল কুঁচকাল। “তুই ফোনটা একবার রিস্টার্ট কর, বা অ্যাপটা আনইনস্টল কর। এইসব ফ্রি অ্যাপে অনেক সময় ডেটা মিক্সআপ হয়।” রাহুল মাথা নাড়ল, কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল শরীর জুড়ে। ও বহুবার ফেস-রেকগনিশন প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে, এভাবে কোনো অচেনা মুখ ফ্রেমে ঢুকে পড়া তার অভিজ্ঞতায় নেই। আরও অদ্ভুত লাগল যে, ব্যাকগ্রাউন্ড ও আলো সব ঠিকঠাক থাকলেও শুধু মুখটাই পুরোপুরি বদলে যাচ্ছে। ফোনের স্ক্রিনে ছবিটা ধীরে ধীরে ফেইড হয়ে গেলেও সেই মুখের শূন্য চোখ যেন তার দিকে তাকিয়েই রইল, মনে হচ্ছিল স্ক্রিনের ভেতর থেকে কেউ দেখছে। মেহর চা খেতে বললেও রাহুল চুপ করে বসে থাকল, হাতে মোবাইল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল, মনে হচ্ছিল কিছু একটা ঠিক নেই। বাইরে সন্ধ্যা নেমে আসছিল, রাস্তায় বাতি জ্বলে উঠছিল, কিন্তু ঘরের ভেতর যেন আলোর অভাব অনুভূত হচ্ছিল—হয়তো সেটা শুধু রাহুলের মনেই। সেই রাতে, শোবার আগে রাহুল শেষবারের মতো অ্যাপ খুলে সেলফি তোলার কথা ভাবল, কিন্তু আঙুল ক্যামেরা বাটনে গিয়ে থেমে গেল—মনে হল, হয়তো আরেকবার তুললেই মুখটা আরও কাছে চলে আসবে।

দুই

পরদিন দুপুরে রাহুল নিজের ডেস্কে বসে ছবিগুলো একে একে দেখছিল। জানলার পাশে রাখা গাছের পাতায় রোদ খেলছিল, কিন্তু ঘরের ভেতর যেন আলো ঢুকছিল না। রাতের অস্বস্তিটা এখনও কাটেনি। সে ভাবছিল—হয়তো গতকালের সবটাই একটা বাগ, হয়তো ক্যামেরা ফেস ডিটেকশনে গন্ডগোল করেছে। তাই মনের সন্দেহ কাটানোর জন্য অ্যাপটা আবার খুলল। স্ক্রিনে দেখা গেল সেই একই চমকপ্রদ ব্যাকগ্রাউন্ড অপশনগুলো—বিদেশি রাস্তাঘাট, কুয়াশা ভেজা জঙ্গল, নিয়ন আলোতে ভরা কোনো অচেনা শহর। রাহুল এবার সোজা দাঁড়িয়ে নিজের মুখ ফ্রেমে আনল, আর আঙুল দিয়ে শাটার চাপল। ছবিটা লোড হতেই তার বুকের ভেতরটা কেমন যেন চেপে এল—আবারও সেই মুখ। ফ্যাকাশে ত্বক, যেন রোদ-হাওয়ার ছোঁয়া বহুদিন পায়নি; চোখদুটো গভীর, ফাঁকা, ভিতরে যেন কোনো আলো নেই; আর ঠোঁটে অদ্ভুত বাঁকা হাসি—একই সঙ্গে ঠান্ডা ও বিদ্রূপাত্মক। আশ্চর্যের বিষয়, চারপাশের আলো, ব্যাকগ্রাউন্ড, এমনকি তার গলায় ঝোলানো ক্যামেরাটা পর্যন্ত ঠিকঠাক এসেছে, শুধু মুখটাই পুরোপুরি বদলে গেছে। রাহুল ফোনটা ধীরে ধীরে নামাল, যেন স্ক্রিনে সেই দৃষ্টি যতক্ষণ দেখবে, ততক্ষণ সেটা তার ভেতরে ঢুকে যাবে।

বিকেলে রাহুল মেহরের সঙ্গে দেখা করল। তারা এক ক্যাফের কোণের টেবিলে বসে কফি খাচ্ছিল। মেহর ফ্রেমে ঠিকঠাক এসেছে, তার ছবিতে কোনো অদ্ভুততা নেই—গ্লো, ব্যাকগ্রাউন্ড, সব কিছু সুন্দরভাবে কাজ করেছে। রাহুল ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল, “দ্যাখ, আজকে আবার তুললাম। একই মুখ।” মেহর স্ক্রিনে ঝুঁকে ভালো করে দেখল, তার ভুরু কুঁচকে গেল। “এটা খুবই অদ্ভুত। শুধু তোর ছবিতেই হচ্ছে। মানে, বাকি সবাই ঠিকঠাক, কিন্তু তোর ফ্রেমে এই লোকটা ঢুকে পড়ছে কেন?” রাহুল হালকা হেসে বলল, “হয়তো অ্যাপটা আমার সাথে শত্রুতা করছে।” কিন্তু হাসির নিচে তার গলায় কাঁপুনি লুকিয়ে ছিল। মেহর বলল, “তুই সিরিয়াসলি চিন্তা কর। অ্যাপের ফেস ম্যাপিং তো তোর মুখ স্ক্যান করে কাজ করে—তাহলে এই লোকটা কোথা থেকে আসছে?” রাহুল জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল, গাড়ির হর্ন, মানুষের কথাবার্তা, কফির গন্ধ—সবই স্বাভাবিক, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল এই আলোচনার মধ্যেই একটা ঠান্ডা স্রোত বইছে। সে চেষ্টা করছিল যেন ব্যাপারটাকে হালকাভাবে নেয়, কিন্তু ছবির সেই দৃষ্টি মাথা থেকে সরছিল না।

ক্যাফে থেকে বেরিয়ে তারা কয়েকজন পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করল—একটা ছোট গেট-টুগেদার ছিল। সবাই মিলে গ্রুপ সেলফি তুলল মেহরের ফোনে—সবাই স্বাভাবিক, হাসিমুখে। তারপর রাহুলের ফোন দিয়ে তোলা হল আরেকটা ছবি। মেহর ছবিটা দেখে হালকা শ্বাস আটকে ফেলল—গ্রুপের সবাই ঠিকঠাক, কিন্তু রাহুলের মুখের জায়গায় আবারও সেই ফ্যাকাশে চেহারা। এইবার মনে হল চোখদুটো সামান্য বড় হয়েছে, আর ঠোঁটের বাঁকা হাসি যেন একটু বেশি স্পষ্ট। চারপাশে হাসি-ঠাট্টা চলছিল, কেউ খেয়ালও করল না। রাহুল দ্রুত ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে দিল, যেন কেউ আর না দেখে। বন্ধুরা বিদায় নিল, রাত নামতে শুরু করল। বাসায় ফেরার পথে রাহুল অনুভব করছিল যেন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কেউ পেছনে পিছু নিচ্ছে—একটা অদৃশ্য উপস্থিতি, যা দেখা যায় না কিন্তু অনুভূত হয়। সে মাথা ঝাঁকিয়ে ভাবটা সরাতে চাইল, কিন্তু গলির কোণে লাগানো স্ট্রিটলাইটের আলোয় নিজের ছায়া দেখেই আঁতকে উঠল—ছায়াটা ঠিকঠাক তার মতো নয়, মুখের রেখায় কোথাও যেন অচেনা সেই বাঁকা হাসির আভাস লেগে আছে।

তিন

দুই দিন কেটে গেছে, কিন্তু রাহুলের মনে অদ্ভুত এক অস্থিরতা জমে আছে। এই সময়ে সে ইচ্ছে করেই নতুন সেলফি তোলার চেষ্টা করেনি, যেন সমস্যাটাকে এড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু আজ দুপুরে, কাজের ফাঁকে হঠাৎ একটা ইচ্ছে দমন করতে না পেরে আবার অ্যাপ খুলল। জানলার ধারে দাঁড়িয়ে শাটার চাপল—এবং স্ক্রিন ভরিয়ে উঠল সেই পরিচিত মুখ। কিন্তু এবার কিছুটা ভিন্ন। চোয়ালের রেখা আগের তুলনায় মসৃণ, আকৃতি অনেকটাই তার নিজের মতো; ঠোঁটের বাঁকা হাসি এখন অদ্ভুতভাবে মিলে যাচ্ছে তার নিজের স্বাভাবিক হাসির সাথে, শুধু চোখের ভেতরের ফাঁকা শূন্যতা এখনও রয়ে গেছে। ছবিটা দেখে তার শরীরের ভেতর দিয়ে এক শীতল স্রোত বয়ে গেল। এটা আর নিছক কোনো “গ্লিচ” বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না—এখানে যেন কিছু ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে, এক অচেনা চেহারা ক্রমশ তার নিজের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠছে।

রাহুলের কৌতূহল এবার ভয়ের চেয়ে বেশি সক্রিয় হয়ে উঠল। সে নিজের পুরনো ফটো অ্যালবাম খুলল—শারীরিক অ্যালবাম আর কম্পিউটারের ফোল্ডার মিলিয়ে প্রায় দশ বছরের ছবি রয়েছে তাতে। এক এক করে পাতাগুলো উল্টাতে লাগল। স্কুলের বন্ধুদের সাথে তোলা ছবি, কলেজের ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতার মুহূর্ত, ভ্রমণের দৃশ্য—কোথাও কি এই মুখটা দেখেছে আগে? প্রতিটি ছবির দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকছিল, যেন ব্যাকগ্রাউন্ডের মধ্যে কোনো লুকোনো অবয়ব খুঁজছে। কোথাও পেল না। কিন্তু তবুও এক ধরনের অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল—যেন মুখটা তার জীবনের কোনো এক সময়ে, কোনো ছায়াময় মুহূর্তে, এক ঝলকের জন্য চোখে পড়েছিল, কিন্তু মনে রাখার আগেই হারিয়ে গিয়েছিল। সে ভেবে দেখল, হয়তো কোনো রাস্তায়, ট্রেনে বা ভিড়ের মধ্যে একবার চোখাচোখি হয়েছিল কারও সাথে, আর সেই মুখটাই এখন তার ছবিতে ফিরে আসছে।

সন্ধ্যার দিকে, আলো কমে আসার সাথে সাথে ঘরের ভেতর একটা ধূসর আবহ তৈরি হল। রাহুল তখনও ছবির উপর ঝুঁকে বসে ছিল, মনোযোগ এতটাই তীব্র যে বাইরে বৃষ্টির শব্দও টের পাচ্ছিল না। কিছু পুরনো ছবিতে সে নিজের ছায়া বা রিফ্লেকশনে সামান্য অস্বাভাবিকতা খুঁজে পেল—মুখের কোণে অদ্ভুত টান, চোখে এক সেকেন্ডের জন্য কেমন যেন অন্য দৃষ্টি। আগের মতো হয়তো এসবকে কাকতালীয় ভাবত, কিন্তু এখন প্রতিটা ছোটো ইঙ্গিতকেই সংযোগ মনে হচ্ছে। হঠাৎ ফোনে নোটিফিকেশন এল—মেহরের মেসেজ, “তুই ঠিক আছিস তো? ক’দিন তোর কথা শুনছি না।” রাহুল উত্তর দিল না, শুধু ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে রইল। মনে হচ্ছিল, যদি আবার ছবি তোলে, তাহলে বদলটা আরও স্পষ্ট দেখা যাবে। কিন্তু একই সাথে তার মনে হচ্ছিল, এই বদল থামানোর উপায় হয়তো নেই। স্ক্রিনের কালো কাচে নিজের প্রতিবিম্ব দেখল—এক সেকেন্ডের জন্য নিশ্চিত হল যে প্রতিচ্ছবির ঠোঁটে হালকা বাঁকা হাসি লেগে আছে, অথচ সে নিজে হাসেনি।

চার

সন্ধ্যার দিকে রাহুল ঠিক করল, আর একা এই ব্যাপারটা সামলানো সম্ভব নয়। মাথায় প্রথমেই এলো তার পুরনো বন্ধু সমীর চট্টোপাধ্যায়ের কথা—এক অনলাইন নিউজ পোর্টালের সাংবাদিক, যার কৌতূহল ও জেদ প্রায়শই তাকে অদ্ভুত অদ্ভুত কেসে জড়িয়ে ফেলে। ফোনে প্রথমে রাহুল ঘটনাটা বলতে গিয়ে হেসে উড়িয়ে দিল, “শোন, আমার ছবি তোলার শখে নাকি ভূত ঢুকে পড়েছে।” সমীর হেসে উঠল, “তুই আবার নতুন নাটক শুরু করেছিস নাকি?” কিন্তু রাহুলের গলায় অদ্ভুত গাম্ভীর্য টের পেয়ে সমীরকে ডেকে নিল কাছের এক চায়ের দোকানে। গরম চায়ের কাপে ধোঁয়া উড়তে উড়তে রাহুল ফোন খুলে একে একে ছবিগুলো দেখাল। প্রথমে সমীর হালকা হেসে বলল, “দ্যাখ, এগুলো স্রেফ ফিল্টারের গোলমাল।” কিন্তু কয়েকটা ছবি পরপর দেখার পর তার মুখের ভাব পাল্টে গেল—চোখ সরু হয়ে এল, ঠোঁট শক্ত হয়ে গেল। সে ছবিগুলো বড় করে জুম করে দেখছিল, যেন খুঁটিনাটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।

“এটা কেবল বাগ না, রাহুল,” সমীর ধীরে ধীরে বলল, চোখ এখনও স্ক্রিনে। “দেখ, প্রতিটা ছবিতে মুখটা ক্রমশ বদলাচ্ছে। ব্যাকগ্রাউন্ড বা আলো ঠিক আছে, কিন্তু মুখটা… যেন কোনো বাস্তব মানুষের ছবি কেটে বসানো হয়েছে।” রাহুল কপাল কুঁচকে বলল, “তুই বলতে চাইছিস কেউ ইচ্ছে করে আমার ছবিতে এই মুখ ঢুকিয়ে দিচ্ছে?” সমীর কাঁধ ঝাঁকাল, “হতে পারে। আবার এটাও হতে পারে, এই মুখ কারও—যে একসময় বাস্তব ছিল।” কথাটা হাওয়ায় ঝুলে রইল, চায়ের দোকানের গরম গন্ধে মিশে গেল হালকা শীতের কাঁপুনি। পাশের টেবিলে কয়েকজন হেসে গল্প করছিল, কিন্তু রাহুলের মনে হচ্ছিল আশপাশের শব্দ যেন দূরে সরে গেছে, শুধু ছবির ফ্যাকাশে মুখটা চোখে ভাসছে। সমীর হঠাৎ উঠে দাঁড়াল, “আমাকে এগুলোর কপি পাঠিয়ে দে। আমি রিসার্চ করব—পুরনো ছবি, নিখোঁজ লোকজন, ক্রিমিনাল ডেটাবেস… কোথাও হয়তো মিল পাব।”

চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে তারা রাস্তায় হাঁটতে লাগল। স্ট্রিটলাইটের আলোয় সমীরের মুখে এক ধরনের তীব্র মনোযোগ দেখা যাচ্ছিল। “দেখ, এই ধরণের চেহারা আমি আগে দেখেছি—সাধারণ না, মনে রাখার মতো। হয়তো কোনো পুরনো খবরের কাগজে, হয়তো ক্রাইম রিপোর্টে।” রাহুল হাঁটতে হাঁটতে অনুভব করছিল তার পেছনে সেই অদৃশ্য নজরদারি আবার ফিরে এসেছে—যেন কোথাও থেকে কেউ দু’জনকে লক্ষ্য করছে। সমীর ফোন বের করে নোট নিচ্ছিল, মুখে নরম গলায় বলল, “তুই চিন্তা করিস না, আমি খুঁজে বের করব। কিন্তু তুই যতক্ষণ না আমরা কিছু জানি, ততক্ষণ ওই অ্যাপটা ব্যবহার করবি না।” রাহুল মাথা নাড়ল, যদিও জানত, ভেতরের কৌতূহল তাকে আবার টেনে নেবে সেই ক্যামেরার দিকে। সমীর বিদায় নিয়ে রিকশায় উঠে পড়ল, কিন্তু চলে যাওয়ার আগে শেষবার বলে গেল, “রাহুল, এই মুখটা কেবল কোনো ছবির অংশ নয়—আমার মনে হচ্ছে এর পেছনে বড়ো কিছু আছে।” সমীরের গলার স্বরে এমন একটা নিশ্চিত ভাব ছিল, যা রাহুলের শরীরের ভেতর দিয়ে আবারও ঠান্ডা স্রোতের মতো বয়ে গেল।

পাঁচ

প্রথমে সমীর ভেবেছিল বিষয়টা হয়তো নিছক কাকতালীয়, বা সর্বোচ্চ রাহুলের মানসিক বিভ্রম। কিন্তু সাংবাদিকতার অভ্যাস তাকে থামতে দিল না। রাতের পর রাত সে তার পরিচিত নিউজ আর্কাইভ, পুরনো কাগজপত্র আর অনলাইন ক্রাইম ফোরামে খুঁজতে লাগল কোনো সূত্র, যা এই অদ্ভুত মুখের উৎস প্রকাশ করতে পারে। তৃতীয় রাতে, এক অন্ধকারাচ্ছন্ন অফিস কক্ষে একা বসে যখন সে পুরনো পত্রিকার স্ক্যান কপি উল্টে দেখছিল, তখন তার চোখ থমকে গেল। পাতার এক কোণে, কালো-সাদা একটি ছোট্ট ছবির সাথে খবরের শিরোনাম— “শহরের প্রান্তে রহস্যজনক নিখোঁজ”। পাঁচ বছর আগের এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অমিতাভ চক্রবর্তী নামে এক যুবক হঠাৎ উধাও হয়ে যায় এক বর্ষার রাতে। সাক্ষীরা দাবি করেছিল, শেষবার তাকে দেখা গিয়েছিল শিয়ালদহ থেকে বসিরহাটগামী লোকাল ট্রেনে চড়তে, কিন্তু এরপর তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। পুলিশের প্রকাশ করা স্কেচটি ছিল কিছুটা অস্পষ্ট, তবুও সেই ঠোঁটের বাঁক, সেই ফাঁকা দৃষ্টি, সেই অদ্ভুত শীতলতা—সবকিছু রাহুলের ছবির অচেনা মুখের সাথে এক আশ্চর্য মিল রেখে যাচ্ছিল।

সমীর এক মুহূর্তের জন্যও চোখ সরাতে পারল না সেই ছবির থেকে। তার ভেতরে যেন ঠান্ডা একটা স্রোত নেমে এল—এ কি নিছক কাকতালীয়, নাকি এর পেছনে আছে গভীর কোনো রহস্য? খবরের নিচে লেখা ছিল, পরিবারের অনুরোধে পুলিশ মাসের পর মাস অনুসন্ধান চালিয়েছিল, কিন্তু মৃতদেহ বা কোনো প্রমাণ মেলেনি। সাক্ষীদের বিবরণ থেকে আঁকা স্কেচই ছিল একমাত্র চিহ্ন, যা মামলাটিকে টিকিয়ে রেখেছিল, যদিও শেষমেশ ‘অমীমাংসিত’ ট্যাগে ফাইলটি বন্ধ হয়ে যায়। সমীর সেই স্কেচটিকে বড় করে দেখল, একাধিকবার তুলনা করল রাহুলের অ্যাপে তোলা ছবির সাথে, আর প্রতিবারই তার মনে হচ্ছিল—এ দুটো মুখ যেন একই সত্তার ভিন্ন সময়ের প্রতিচ্ছবি। তার সাংবাদিক মন জানত, এই মিলকে উপেক্ষা করা বোকামি হবে, কিন্তু একই সঙ্গে তার মনের গভীরে অস্বস্তির শীতল একটা পর্দা নেমে এল—কারণ যদি এই মুখ সত্যিই মৃত কোনো মানুষের হয়, তবে কেন, কিভাবে, আর কোন উদ্দেশ্যে তা রাহুলের ছবিতে ভেসে উঠছে?

পরের দিন ভোরে সমীর রাহুলের বাড়িতে গিয়ে সব খুলে বলল। রাহুল প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিতে চাইছিল, কিন্তু সমীর যখন পুরনো পত্রিকার প্রিন্টআউট আর স্কেচটা তার হাতে দিল, তখন তার হাসি এক মুহূর্তে মিলিয়ে গেল। সে ছবিটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল—তার চোখে স্পষ্ট আতঙ্কের রেখা। “কিন্তু… আমি তো এই মানুষটাকে চিনি না, সমীর,” রাহুল ধীরে বলল, “আর পাঁচ বছর আগে আমার কোনো সম্পর্কই ছিল না এই ঘটনার সাথে।” সমীর চুপ করে রইল, কারণ সেও জানত, রহস্যের সূত্র এখনও পুরোপুরি ধরা দেয়নি। তবুও সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, এবার তাকে সেই নিখোঁজ ঘটনার সমস্ত কিছুর গভীরে নামতে হবে—অমিতাভ চক্রবর্তীর অতীত, তার পরিচিত মানুষ, শেষ দেখা পাওয়ার সময়কার পরিস্থিতি—সবই খুঁজে বার করতে হবে। কিন্তু তখনও কেউ জানত না, এই অনুসন্ধান তাদের দুজনকেই টেনে নিয়ে যাবে এমন এক অন্ধকারের দিকে, যেখান থেকে ফেরার পথ নেই।

ছয়

মেহরের চোখে তখনও ভয় লেগে আছে। গত ক’দিনে রাহুলের ফোনে দেখা ছবিগুলো তাকে যেন গভীর অস্বস্তির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। সে দৃঢ় কণ্ঠে রাহুলকে বলে, “এই ফিল্টারটা আর ব্যবহার করো না, প্লিজ। কিছু একটা ঠিক নেই।” কিন্তু রাহুল, যেভাবে সবকিছু কৌতূহলের চোখে দেখছে, তাতে মেহরের কথা তার কানে তেমন গিয়ে পৌঁছায় না। বাইরে থেকে শান্ত মনে হলেও ভেতরে ভেতরে রাহুল এক অদ্ভুত টান অনুভব করছে—যেন ছবির সেই অচেনা মুখের সাথে তার কোনো গভীর সংযোগ রয়েছে। মেহর চায় সবকিছু থেমে যাক, কিন্তু রাহুলের চোখে যেন একধরনের আসক্তি, যা কেবল সেই ফিল্টার দিয়ে নতুন ছবি তুলে মেটানো যায়। সন্ধ্যার পর, মেহর বাড়ি ফেরার পথে যখন পিছনে তাকায়, তখন অদ্ভুতভাবে মনে হয় কেউ যেন ছায়ার মতো তাকে অনুসরণ করছে। কিন্তু ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে কাউকে দেখতে পায় না।

রাতের দিকে রাহুল একা ঘরে বসে ফোন হাতে নেয়। মেহরের সতর্কবাণী তার মনে এক মুহূর্তের জন্যও আসে না—বরং তার কৌতূহল আরও বাড়ে। “শুধু একটা ছবি তুলব,” নিজের মনেই বলে সে, “দেখি আজ মুখটা কেমন দেখায়।” ক্যামেরা অ্যাপ খুলে ফিল্টার লাগিয়ে সে সেলফি তোলে। ছবিতে যা দেখে তাতে তার বুক ধক করে ওঠে—মুখটা আগের চেয়ে আরও স্পষ্টভাবে তার নিজের মতো হয়ে গেছে, চোয়ালের রেখা, ঠোঁটের বাঁক—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত প্রতিফলন। মনে হয় যেন সেই মুখটা ধীরে ধীরে তার নিজের প্রতিচ্ছবি দখল করে নিচ্ছে। কপালের মাঝ বরাবর হালকা ছায়া, চোখের কোণে অদ্ভুত তীক্ষ্ণতা—এসব দেখে রাহুল কিছুটা শিউরে ওঠে, কিন্তু সাথে সাথে এক ধরনের মুগ্ধতাও তাকে আচ্ছন্ন করে। যেন এই পরিবর্তনের পেছনে কোনো রহস্য আছে, আর সে তার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে।

কিন্তু আসল আতঙ্ক আসে সেই রাতেই। প্রায় দেড়টার সময়, হালকা অন্ধকার ঘরে রাহুল আবার ফোন তুলে সেলফি তোলে। ছবিটা তোলার মুহূর্তেই তার চোখে পড়ে—পেছনে, ঠিক তার কাঁধের কাছে, দাঁড়িয়ে আছে এক মানুষ। চেনা পোশাক নয়, মুখটা যেন ছবির সেই অপরিচিত জনেরই, তবে এবার আর ফ্যাকাশে নয়—বাস্তবের মতো, জীবন্ত। ঠোঁটে আগের মতোই সেই বাঁকা হাসি, কিন্তু চোখে এখন এক শীতল দৃষ্টি, যা সোজা রাহুলের দিকে তাকিয়ে আছে। বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়ে যায়, ফোনের স্ক্রিন কাঁপতে থাকে তার হাতের কম্পনে। সে ঘুরে দাঁড়ায়, কিন্তু ঘরে কেউ নেই। তবুও বাতাসে যেন কারো উপস্থিতি লেগে থাকে, আর রাহুল অনুভব করে—এই খেলা আর শুধু ছবির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। যে-ই হোক, সে এখন বাস্তব জগতে চলে এসেছে।

সাত

সকালটা শুরু হয় এক অস্বস্তিকর নীরবতার মধ্য দিয়ে। রাহুল ঘুম ভাঙতেই বুঝতে পারে কিছু একটা অস্বাভাবিক। তার মাথা ভারী, যেন সারারাত সে ঘুমায়নি, অথচ তার মনে পড়ে না আগের রাতের কোনো ঘটনাই। বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে প্রথমেই তার নাকে লাগে এক তীব্র অথচ পরিচিত গন্ধ—ভেজা মাটির মতো, যেন কোথাও সদ্য খোঁড়া হয়েছে মাটি বা বৃষ্টির পরের গন্ধ, কিন্তু এর মধ্যে একটা পচনের আভাসও মিশে আছে। রাহুল এক ধাক্কায় সোজা হয়ে বসে পড়ে, আর গন্ধটা তাকে ফ্ল্যাটের প্রধান দরজার দিকে টেনে নিয়ে যায়। দরজার ফাঁক দিয়ে যেন গন্ধটা ঢুকে আসছে। কৌতূহল আর ভয়ের মিশ্রণে সে ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগোয়, কিন্তু দরজা পুরোপুরি বন্ধ। তালা ভাঙা নয়, কোনো চিহ্ন নেই যে বাইরে কেউ ছিল। রাহুল কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে গন্ধটা বোঝার চেষ্টা করে, কিন্তু মাথার ভেতর তখনও অদ্ভুত এক ঘোর কাজ করছে। যেন স্মৃতির কোনো ফাঁকা জায়গা জুড়ে আছে কালো কুয়াশা।

সে রান্নাঘরের দিকে যায়, কিন্তু পা থমকে যায় ড্রয়িংরুমে পা দিতেই। দেয়ালে ঝুলছে তার প্রিয় ফ্রেমে বাঁধানো একটি ছবি, যা সে প্রায় তিন মাস আগে তুলেছিল—নিজের তোলা সবচেয়ে ভালো সেলফিগুলোর মধ্যে একটি। কিন্তু ছবিটা এখন ঠিক আগের মতো নয়। শরীর, ভঙ্গি, আলো সব একই, কিন্তু মুখটা আর রাহুলের নয়। চোখ বড় বড়, কপাল নিচু, চোয়ালের রেখা শক্ত হয়ে আছে, আর ঠোঁটের কোণে সেই অদ্ভুত হালকা বাঁক—ঠিক সেই অপরিচিত, বিকৃত মানুষের মুখ। রাহুলের বুকের ভেতর ধক করে ওঠে, হাতের তালু ঘামে ভিজে যায়। সে ছবির কাছে গিয়ে চোখ কুঁচকে দেখে, ভাবছে হয়তো এটা তার দৃষ্টিভ্রম বা আলো-ছায়ার খেলা। কিন্তু যতই কাছ থেকে দেখে, ততই বোঝে—এটা কোনো ভ্রম নয়, ছবিটা বদলে গেছে। তার মেরুদণ্ড বেয়ে ঠান্ডা একটা শিহরণ নেমে যায়।

রাহুল হঠাৎই চেষ্টা করে মনে করার—গতরাতে ঠিক কী ঘটেছিল। শেষ যে দৃশ্য তার মনে আছে, তা হল মোবাইল হাতে নিয়ে সেলফি তোলা, আর ক্যামেরার পর্দায় পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মানুষটিকে দেখা। তার পরের অংশ যেন কেটে গেছে, যেন কারও ইচ্ছে করে তার স্মৃতি মুছে দিয়েছে। তার কানে তখনও বাজছে সেই নীরবতার চাপা গর্জন, যা হয়তো শুধুই তার কল্পনা, অথবা সত্যি কোনো উপস্থিতির আভাস। গন্ধটা যেন আরও তীব্র হয়ে ঘর ভরিয়ে ফেলছে, আর রাহুল অনুভব করছে তার ফ্ল্যাটে এক অদৃশ্য সত্তার উপস্থিতি—যে তাকে দেখছে, তার প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ্য করছে। তার চোখ ছবির দিকে আটকে আছে, আর মনে হচ্ছে ছবির মানুষটা যে কোনো মুহূর্তে ফ্রেম থেকে বেরিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়াবে। তার বুকের মধ্যে ভয় জমাট বাঁধছে, কিন্তু ভেতরে কোথাও যেন এক অদ্ভুত আকর্ষণও কাজ করছে—যেন এই সব কিছুর রহস্য উদঘাটন করতেই হবে, এমনকি যদি তার জন্য ভয়ানক কোনো মূল্য দিতে হয়।

আট

সমীর সেই সন্ধ্যায় শহরের পুরনো সংবাদপত্রের আর্কাইভে বসে ফাইল ঘাঁটছিল। কাগজের পাতায় ধুলো জমে আছে, পুরনো ফাইলের প্রান্তে সময়ের দাগ লেগে গেছে। বেশ কয়েক ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পর, তার চোখ আটকে যায় এক পাতায়—তারিখ পাঁচ বছর আগের, শিরোনামে লেখা, “শহরের প্রান্ত থেকে যুবকের রহস্যজনক নিখোঁজ”। খবরের মধ্যে বলা হয়েছে, এক তরুণ, নাম অভিক সেন, হঠাৎ করে এক সন্ধ্যায় নিখোঁজ হয়ে যায়। পুলিশ পরে এলাকায় তল্লাশি চালালেও কোনো মৃতদেহ মেলেনি, এমনকি তার শেষ অবস্থানও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আরও নিচে পড়ে সমীর হঠাৎ থমকে যায়—খবরে উল্লেখ আছে, অভিক সেনের শেষ ফোন কল হয়েছিল একটি নম্বরে, যা সেই সময় পুলিশের নথিভুক্ত ছিল কিন্তু মালিকের সন্ধান মেলেনি। নম্বরটি দেখে সমীরের বুক ধড়ফড় করে ওঠে—এটা রাহুলের পুরনো মোবাইল নম্বর, যেটা রাহুল তাকে একদিন বলেছিল “চুরি হয়ে গিয়েছিল”। সে ফোন নম্বরের পাশে নোট নেয়, আর নিজের মনে প্রশ্ন জাগে—এটা কি কাকতালীয়, নাকি এর পেছনে কোনো গভীর সত্য লুকিয়ে আছে?

সমীরের মাথায় এখন কেবল একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে—রাহুল পাঁচ বছর আগে কোথায় ছিল, কী করছিল, আর কীভাবে তার নম্বর অভিক সেনের মৃত্যুর আগে শেষ কলের রেকর্ডে এল। সে রাহুলের ফটোগ্রাফি শুরু করার সময়কাল আর এই নিখোঁজ ঘটনার সময় মিলিয়ে দেখতে শুরু করে। কাকতালীয় হলেও, টাইমলাইনে অদ্ভুত সাদৃশ্য আছে। রাহুল সেই সময়ে শহরের প্রান্তবর্তী এলাকায় প্রায়ই ছবি তুলতে যেত, বিশেষ করে পুরনো বাড়ি আর নির্জন জায়গায়। পুলিশ রিপোর্টে অভিক সেনকে শেষবার দেখা গিয়েছিল এমন এক রাস্তার কাছেই, যা রাহুল প্রায়ই ফটোগ্রাফির জন্য বেছে নিত। সমীরের মনে পড়ে, রাহুল একবার মদ্যপ অবস্থায় বলেছিল—“পুরনো বাড়িগুলো জীবিত থাকে, শুধু ক্যামেরা তা ধরতে পারে।” তখন সেটাকে সে কবিতা ভেবেছিল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এর মধ্যে অন্য কোনো ইঙ্গিত ছিল। সমীরের কপালে ঘাম জমে যায়, বুকের ভেতর একটা শীতল শঙ্কা বাড়তে থাকে।

রাত গভীর হয়ে এসেছে, আর্কাইভ রুমে কেবল ফ্লুরোসেন্ট আলো ঝিকমিক করছে। সমীর ল্যাপটপে পুলিশের পুরনো কেস ফাইল ডাউনলোড করে, অভিক সেনের স্কেচ আর রাহুলের বিকৃত মুখওয়ালা ছবিগুলো পাশাপাশি রেখে দেখে। একটায় আছে নিখোঁজ যুবকের মুখ, অন্যটায় বিকৃত হলেও চেনা যায় তার বৈশিষ্ট্য। মিল প্রায় অভিন্ন। সমীর বুঝতে পারে, এই মিল কোনো প্রযুক্তিগত গ্লিচের কারণে নয়—এটা কিছু বাস্তব, কিছু অশুভ, যা রাহুলের সাথে কোনোভাবে জড়িয়ে আছে। পাঁচ বছরের পুরনো সেই ঘটনার শিকড় হয়তো রাহুলের জীবনেই প্রোথিত, আর সেই শিকড় এখন ক্যামেরা, ফিল্টার আর ছবির মাধ্যমে আবার মাথা তুলছে। সমীর জানে, এই সত্য যদি রাহুলকে না বলে, তবে হয়তো দেরি হয়ে যাবে। কিন্তু একইসাথে, সে ভয় পায়—রাহুল যদি কিছু লুকিয়ে থাকে, তবে এই সত্য ফাঁস করাটা তাদের দুজনের জন্যই বিপজ্জনক হতে পারে। বাইরে রাতের হাওয়া কাঁচের জানালায় ধাক্কা দিচ্ছে, যেন সেই অতীতের ছায়া আর্কাইভ রুমের ভেতর ঢুকতে চাইছে।

নয়

রাতের গভীরে রাহুল নিজের ফ্ল্যাটের ছোট্ট বাথরুমে দাঁড়িয়ে ছিল। সব আলো নিভিয়ে সে একমাত্র মিররের সামনে দাঁড়িয়ে তারই প্রতিচ্ছবি দেখছিল—কিছুতেই তাকে স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল না। ঝলমলে কাচের আড়ালে তার মুখ দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু চোখের ভেতর এক ধরনের শূন্যতা, যেন কোনো কালো গহ্বর তৈরি হয়ে গিয়েছে। ঠোঁটের সেই বাঁকা হাসি, যা সে এতদিন শুধু ছবির মধ্যে দেখেছে, এখন নিজেই তার মুখে ফুটে উঠছিল। প্রথমে মনে হয়েছিল চোখের ঠিক পাশে আলো ও ছায়ার খেলা, কিন্তু যতক্ষণ সে তাকিয়ে রইল, ততক্ষণ সেই ভয়ংকর হাসিটা তার নিজের রূপান্তরের সাক্ষী হতে লাগল। সে হাত সামনে বাড়িয়ে আয়নায় স্পর্শ করতে চাইল, যেন নিজেকে নিশ্চিত করতে চায় যে এটা তারই মুখ, তারই শরীর। কিন্তু হাত আড়ালে ঢুকিয়ে সে বুঝল, এই হাসি আর চোখের গহ্বর কোনো সাধারণ প্রতিফলন নয়—এটা তার জীবনের একটা অদ্ভুত সঙ্কেত, যা তাকে বলছে, সে আর আগের রাহুল থাকবে না।

মনের ভেতর এক ধরনের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। সে ভেবেছিল ছবির মধ্যে থাকা মুখটাই তার অজান্তে তার জীবনে প্রবেশ করেছে, কিন্তু এখন বুঝতে পারছিল, এই বিকৃত মুখ তার সাথে একাকার হয়ে গিয়েছে। প্রতিবার যখন সে আয়নায় তাকাত, মনে হত সে কোনো অদ্ভুত সত্তার সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলছে। চারপাশের অন্ধকার যেন আরও ঘনীভূত হচ্ছিল, আর বাতাসে নরম নরম ফিসফিস শব্দ গুঞ্জরিত হচ্ছিল—মুখের সেই বাঁকা হাসি যেন রাহুলকে ডেকে ডেকে বলছে, “আমি তোরই অংশ, তুমি আমাকে আর ফিরিয়ে দিতে পারবি না।” সে চেষ্টা করল নিজেকে বুঝানোর, যে সবটাই কেবল মানসিক অবসাদের প্রতিফলন, কিন্তু প্রতিটি রাতে তার ভয় আরও বাড়তে থাকল। ঘুম হারাম, স্বপ্নেও সে নিজেকে অচেনা এক মুখের মধ্যে খুঁজে পেত।

পরদিন সকাল হলে রাহুল নিজেকে খুবই দুর্বল ও বিষণ্ণ মনে করল। তার পরিচিত বন্ধুরা, মেহর ও সমীর, সবাই লক্ষ্য করল তার বদলে যাওয়া মনোভাব। কিন্তু রাহুল জানত, তার সমস্যার গভীরতা তারা বুঝতেই পারবে না। কারণ তার চোখের ভেতর আজ আর রাহুল নেই, বরং সেই বিকৃত মুখের কালো শূন্যতা ঢুকেছে। সে জানত, ছবি আর বাস্তবের মধ্যকার সীমা মুছে গেছে। যা একসময় শুধুমাত্র এআর ফিল্টারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, তা এখন তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। আর এই মুখ, এই হাসি, তার জীবনের সবচেয়ে বড়ো শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে। সেই বিকৃত মুখের সঙ্গে তার শেষ যুদ্ধ এখন শুরু হতে চলেছে—মুখোমুখি, সরাসরি, অবাধ্য ও নির্মম।

দশ

সমীর এবং মেহর একসঙ্গে রাহুলের ফ্ল্যাটে প্রবেশ করল, কিন্তু রাহুল কোথাও দেখা গেল না। ঘরের কোণে রাখা মোবাইল ফোনটি তাদের চোখে পড়ল—টেবিলের ওপর নিঃসঙ্গ অবস্থায়, ক্যামেরা অ্যাপ খুলে রাখা, এবং স্ক্রিনে বসে থাকা সেই বিকৃত মুখটি, যা এখন সম্পূর্ণরূপে রাহুলের মতো হয়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে স্ক্রিনের রঙ ফিকে হতে শুরু করল, যেন জীবনের আলো নিভে যাচ্ছে তার ভেতর থেকে। ঘরের চারপাশে ভেজা মাটির অদ্ভুত গন্ধ জুড়ে গেল, যা আগের মতোই তাদের মনে করিয়ে দিচ্ছিল কোনো পুরনো রহস্যের উপস্থিতি।

তারা মোবাইলের সামনে দাঁড়িয়ে রহস্যময় পরিবেশ অনুভব করছিল। ভেতরের অন্ধকার যেন গভীর হচ্ছিল, আর এই নীরবতার মাঝেই মোবাইলের ফিকে হওয়া ছবিটি যেন তাদের ভয় আর কৌতূহল বাড়াচ্ছিল। মেহর চোখ মুছল, আর সমীর সিদ্ধান্ত নিল—তারা রাহুলকে খুঁজে বের করতে হবে, যতই এই রহস্য তাদের নিয়ে গভীরে টেনে নিক। কিন্তু সেই বিকৃত মুখ আর ভেজা মাটির গন্ধ যেন এক ধরনের শেষ ইঙ্গিত হয়ে রইল, যা বলছিল, রাহুল আর কখনো আগের মত হবে না।

ঘরের ভিতর এক অদ্ভুত স্থবিরতা নেমে এলো, যেন কোনো জীবনের অস্তিত্ব নিঃশব্দ হয়ে গেছে। মোবাইলের স্ক্রিন ফিকে হয়ে গেল, আর তারা দুজন দাঁড়িয়ে রইল—অদৃশ্য কোনো সত্তার উপস্থিতি অনুভব করে, যার হাত ধরে এই গল্পের শেষ অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে।

অবশেষে, “গ্লিচড সেলফি” গল্পের মধ্যে লুকিয়ে থাকা রহস্য ও অদ্ভুততা রাহুলের জীবনে একটা অপরিবর্তনীয় ছাপ ফেলেছে। প্রযুক্তির মাধ্যমে শুরু হওয়া এই অদ্ভুত যাত্রা, যেখানে একটি বিকৃত মুখ ধীরে ধীরে তার নিজের অংশ হয়ে ওঠে, সেটা শুধুই একটা অ্যালগরিদমের ভুল নয়—বরং অতীতের এক গভীর ও বেদনাদায়ক সত্যের সঙ্গে তার আবদ্ধতা। রাহুলের হারানো স্মৃতি, নিখোঁজ যুবকের রহস্য, আর সেই বিকৃত মুখের ধীরে ধীরে বাস্তব জগতে প্রবেশ—সব মিলে একটি দুঃস্বপ্নময় আবর্ত তৈরি করেছে। সমীর ও মেহর যেমন এই অন্ধকারের গভীরে প্রবেশ করেছে, তেমনি পাঠকরাও বুঝতে পারেন যে কখনো কখনো প্রযুক্তির আড়ালে লুকিয়ে থাকে এমন ঘটনা যা বোঝা যায় না, ছুঁতে পারা যায় না, কিন্তু তা আমাদের জীবনের অংশ হয়ে ওঠে।

গল্পের শেষে যে ফিকে হওয়া সেলফি এবং ভেজা মাটির গন্ধের ছবি রয়ে যায়, তা এক দিক থেকে জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্ব আর অপর দিক থেকে অতীতের স্মৃতির অনিবার্যতা প্রকাশ করে। রাহুলের গল্প আমাদের সতর্ক করে যে, আমরা যতই আধুনিক প্রযুক্তির জগতে এগিয়ে যাই না কেন, অতীতের ছায়া থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ নয়। কখনো কখনো সেই ছায়া আমাদের মতো মানুষকেও বদলে দিতে পারে, এমনকি আমাদের পরিচয়কেও মুছে দিতে পারে। “গ্লিচড সেলফি” তাই একটি রহস্যের গল্প না শুধু, বরং আধুনিক জীবনের এক গভীর দার্শনিক প্রতিফলন।

শেষ কথা হলো, এই গল্প আমাদের সামনে এক বার্তা রেখে যায়—নিজেকে চেনা এবং অতীতের সঙ্গে সম্মুখীন হওয়া কতটা জরুরি, আর প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে আমাদের মানবিক সম্পর্কগুলোকে কিভাবে রক্ষা করতে হয়। রাহুলের যাত্রা যেমন ভয়ানক ছিল, তেমনি আমাদের প্রত্যেকের জীবনেও এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যেখানে আমরা নিজেদের সঠিক পরিচয় খুঁজে বের করতে হই। আর সেই যাত্রায় ধৈর্য, সাহস এবং ভালোবাসার গুরুত্ব অপরিসীম। “গ্লিচড সেলফি” আমাদের সেই যাত্রার এক অন্তর্দৃষ্টি, যা অনেক সময় আমাদের সবচেয়ে অন্ধকার মুহূর্তেও আলোর খোঁজ দেয়।

শেষ

1000052335.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *