অঙ্কিতা ভট্টাচাৰ্য
এক
প্রথম দেখা, প্রথম স্পর্শ, প্রথম নিঃশ্বাসে ভেসে আসা এক অচেনা গন্ধ—এসবই এক গবেষণার কাজে গ্রামের অচেনা জমিদারবাড়ির দিকে এগিয়ে আসা তরুণী ইরা সেনের কাছে যেন এক অজানা অভিজ্ঞতা। কলকাতার ব্যস্ত ভিড়, শহুরে ছন্দ, লাইব্রেরির ধুলো-মাখা বইয়ের স্তূপ ছেড়ে সে এসেছে এই প্রত্যন্ত গ্রামে, যেখানে আজও সময় যেন ঘুমিয়ে আছে শেকড়ের মধ্যে। তার গবেষণার বিষয় ছিল বাংলার পুরনো জমিদারবাড়ি ও তাদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা স্থাপত্য এবং সংস্কৃতি, কিন্তু কাগজে-কলমে যেটা শুষ্ক মনে হয়, বাস্তবে এসে দাঁড়ালে তার মধ্যে লুকিয়ে থাকে অদ্ভুত রহস্য আর আবেগ। সেই অনুভূতিই ইরার বুক কাঁপিয়ে দিল যখন রিকশা থেকে নামতেই তার চোখে ভেসে উঠল সেই অট্টালিকা—ধসে পড়া বারান্দা, ফিকে হয়ে যাওয়া রঙের দেয়াল, শেওলা জমা পাথরের কারুকাজ আর গা ছমছমে সিঁড়ি। বাড়িটা যেন নিঃশ্বাস নিচ্ছে—যেন তার প্রতিটি ভাঙা ইট এখনও অতীতের গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে। ইরা প্রথমেই খেয়াল করল বাগানের দিকে, যেখানে অসংখ্য লাল গোলাপ ফুটে আছে। অগোছালো হলেও ফুলগুলো যেন এক অদ্ভুত শৃঙ্খলায় সাজানো, আর তার গন্ধ ভেসে আসছিল বাতাসে। ইরার চোখে তখন একরকম আলো খেলে গেল—গবেষক হিসেবে সে জানত এ বাগান ইতিহাসের সাক্ষী, কিন্তু মেয়েটি হিসেবে সে অনুভব করল এ বাগানে কিছু আছে যা হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
ইরা বাড়ির ভেতরে পা রাখতেই তার পদচারণায় ধুলো উড়ল, আর সিলিংয়ের ঝাড়লণ্ঠন থেকে মাকড়সার জাল ঝুলে নড়তে লাগল। ফাঁকা ঘরগুলোতে তার কানে প্রতিধ্বনি বাজতে থাকল, যেন কেউ লুকিয়ে তার উপস্থিতি দেখছে। বুকের ভেতর হালকা ভয়ের স্রোত বয়ে গেলেও ইরার মনের ভেতর গবেষণার তৃষ্ণা আরও বেড়ে উঠল। পুরনো কড়িকাঠের গন্ধ, দেওয়ালে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া রাজপরিবারের ছবির ফ্রেম, আর ফাটল ধরা মেঝের ইট—সবকিছুই যেন সময়ের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে আছে। এ বাড়ির প্রতিটি ইঞ্চি জমি ইতিহাস বহন করছে—সেটা ইরা অনুভব করতে পারল। কিন্তু যতই সে ভেতরে এগোতে লাগল, ততই তার মন টানছিল বাইরে, সেই গোলাপবাগানের দিকে। সেখানেই যেন এই জমিদারবাড়ির আসল প্রাণ লুকিয়ে আছে। একসময় আবার বাইরে বেরিয়েই সে হাঁটতে লাগল বাগানের মধ্যে, আর ঠিক তখনই তার চোখ পড়ল এক ছেলের ওপর—গাঢ় সবুজ শার্ট আর ধূসর প্যান্ট পরা, মাথা নিচু করে গোলাপ গাছের কাঁটা ছেঁটে দিচ্ছে। তার হাতের আঙুলে কাঁটার আঁচড়ের দাগ, কিন্তু মুখে কোনও অভিযোগ নেই; বরং যত্নে আর ভালোবাসায় সে ফুলের দিকে তাকিয়ে আছে। ইরা এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল, কারণ তার মনে হল ছেলেটি গাছের সঙ্গে যেন কথা বলছে, যেন ফুলগুলোকে বোঝাচ্ছে কেমন করে বাঁচতে হয়।
ছেলেটি মাথা তুলে তাকাতেই চোখাচোখি হল ইরার সঙ্গে। এক অদ্ভুত নীরবতা ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। ইরা একেবারে স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করল, “তুমি এখানে কাজ করো?” ছেলেটি হালকা হেসে উত্তর দিল, “হ্যাঁ, এই বাগানটাই আমার দায়িত্ব।” তার গলায় বিন্দুমাত্র অহংকার নেই, শুধু সরল এক সুর, যা ইরার কানে অদ্ভুতভাবে মিষ্টি লাগল। ইরা মনে মনে ভাবল, এ তো নিছকই এক মালী—কিন্তু তার চোখে যেন অন্য কিছু ছিল, যা ইরাকে কিছুটা বিভ্রান্ত করল। সে বইটা শক্ত করে বুকে চেপে ধরল, যেন নিজের ভেতরের অস্বস্তি লুকোতে চাইছে। ছেলেটি আবার কাজে ফিরে গেল, কিন্তু তার মুখের শান্ত হাসিটা ইরার চোখে আটকে রইল। গোলাপবাগানের লাল ফুলগুলো যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার কাছে। তখনও সে জানত না, এ প্রথম সাক্ষাৎ তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে, আর এই সাধারণ মনে হওয়া ছেলেটিই একদিন তার গবেষণার পাতার বাইরে গিয়ে হয়ে উঠবে হৃদয়ের অনিবার্য অধ্যায়।
দুই
বিকেলের আলো তখন ধীরে ধীরে নরম হয়ে আসছে, পুরনো জমিদারবাড়ির ফিকে দেওয়াল আর শেওলা ধরা কার্নিশের উপর ছায়া খেলা করছে। ইরা বারান্দার ধুলো ঝাড়া চেয়ারটায় বসে নোটবই খুলে কিছু লিখছিল, কিন্তু বারবার তার চোখ চলে যাচ্ছিল বাগানের দিকে। অর্ণব নিচু হয়ে একে একে গোলাপ গাছের শুকনো পাতা কেটে দিচ্ছে, মাঝে মাঝে আঙুলে কাঁটা ফুটলেও তাতে তার মুখে কোনো বিরক্তি নেই, বরং যেন আরও যত্নে কাজ করছে। ইরা বিস্মিত হয়ে ভাবছিল—একজন মানুষ কীভাবে এত ভালোবাসা নিয়ে প্রতিটি ফুলের দিকে মন দেয়? শহরের ব্যস্ত জীবনে সে কখনও এমন দৃশ্য দেখেনি। গোলাপের পাপড়িগুলো বাতাসে নড়ে উঠছিল, আর তার মনে হচ্ছিল যেন ওগুলোও অর্ণবকে চেনে, তার যত্নে খুশি হয়ে আরও ফুটে উঠছে। সে নীরবে কিছুক্ষণ দেখল, তারপর নিজেকে সামলাতে না পেরে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল বাগানের দিকে। কাছে গিয়ে অবাক হয়ে বলল, “তুমি খুব যত্ন নিয়ে কাজ করছো, যেন প্রতিটি ফুলের সঙ্গে তোমার আলাদা সম্পর্ক আছে।” অর্ণব মুখ তুলে হেসে বলল, “সম্পর্ক তো আছেই, এরা আমার আপনজন। প্রতিটি গোলাপের একটা নাম আছে, একটা গল্প আছে। তুমি চাইলে আমি তোমাকে শুনিয়ে দিতে পারি।” ইরা চমকে গেল, কারণ সে ভেবেছিল অর্ণব স্রেফ একজন সাধারণ মালী, কিন্তু তার কথার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এক গভীর আবেগ, এক অদ্ভুত দার্শনিক সুর, যা তার কৌতূহল আরও বাড়িয়ে দিল।
অর্ণব তাকে নিয়ে যেতে লাগল বাগানের এক কোণ থেকে আরেক কোণে। একটি সাদা গোলাপ দেখিয়ে বলল, “এটার নাম আমি রেখেছি শান্তি। যখন বাড়ির ভেতরে ঝগড়া বা অশান্তি চলত, আমি এখানে এসে দাঁড়াতাম। এই ফুলটা দেখলেই মনে হতো সবকিছু একদিন শান্ত হয়ে যাবে।” আবার একটি লাল গোলাপের দিকে আঙুল তুলে বলল, “ওটার নাম আশা। কয়েক বছর আগে যখন আমি অনেক কষ্টে ছিলাম, এই ফুলটাই প্রতিদিন সকালে আমাকে শক্তি দিতো।” ইরা অবাক হয়ে দেখল, প্রতিটি ফুল অর্ণবের কাছে যেন জীবন্ত স্মৃতি হয়ে আছে। সে প্রশ্ন করল, “তুমি এগুলোকে নাম দিয়েছো? সবাইকে?” অর্ণব গম্ভীর হয়ে বলল, “হ্যাঁ, কারণ এই গোলাপগুলো আমাকে কখনও একা থাকতে দেয়নি। যখন মানুষ দূরে সরে গেছে, ওরা আমার সঙ্গে থেকেছে।” ইরার মনে কেমন যেন হল। শহরে তার চারপাশে অসংখ্য মানুষ থাকলেও সে বহুবার একাকীত্ব অনুভব করেছে, অথচ এই গ্রাম্য ছেলেটি ফুলকে বন্ধু করে জীবনের শূন্যতা পূর্ণ করেছে। সে মনে মনে স্বীকার করল, অর্ণবের সরলতা আর সত্যিকারের অনুভূতি তাকে স্পর্শ করছে। সেই মুহূর্তে হাওয়ায় ভেসে এল গোলাপের গন্ধ, আর ইরার মনে হল যেন বাগানও দুজনের কথোপকথন শুনছে, তারাও এই নীরব সম্পর্কের জন্মলগ্নে সাক্ষী হয়ে রইল।
ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে কথাবার্তা বাড়তে লাগল। ইরা প্রথমে গবেষণার জন্যই প্রশ্ন করছিল—বাগান কবে থেকে আছে, জমিদার পরিবার কেমন ছিল, ফুলের যত্ন নেওয়ার নিয়ম কী—কিন্তু অর্ণবের উত্তরগুলো এত আন্তরিক আর গল্পে ভরা ছিল যে কথোপকথন ধীরে ধীরে ব্যক্তিগত হয়ে উঠল। অর্ণব জানতে চাইলো, “তুমি এত দূর থেকে এখানে এলে কেন?” ইরা একটু ভেবে বলল, “ইতিহাস খুঁজতে। আমি চাই অতীতের সত্যিটা তুলে ধরতে, যা হয়তো হারিয়ে যাচ্ছে সময়ের সঙ্গে।” অর্ণব শান্ত গলায় উত্তর দিল, “সত্যিটা শুধু বইতে পাওয়া যায় না, অনেক সময় ফুলও সেটা মনে রাখে।” কথাটা শুনে ইরা স্তব্ধ হয়ে গেল। এতো সরলভাবে এত গভীর কথা কেউ বলবে, সে ভাবতেই পারেনি। মনে হল অর্ণবের চোখের গভীরে এমন কিছু আছে যা সে এখনও পড়তে পারেনি, যেন কোনও রহস্য চাপা পড়ে আছে। অথচ তার হাসিতে সেই রহস্য গলে গিয়ে ভেসে আসছিল এক অদ্ভুত প্রশান্তি। সন্ধ্যার আলো নেমে আসছিল, পাখিরা কিচিরমিচির করে ঘরে ফিরছিল, আর ইরা বুঝতে পারছিল—তার গবেষণা কেবল স্থাপত্য বা ইতিহাস নিয়ে নয়, বরং এই বাগান, এই গোলাপ, আর অর্ণবের সরল হৃদয়ের ভেতর লুকোনো এক নতুন ভাষা শিখে নেওয়া। সে নিজেকে প্রশ্ন করল, “আমি কি সত্যিই শুধু গবেষণা করছি, নাকি ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছি এমন এক জগতে, যেখান থেকে ফিরে যাওয়া আর সহজ হবে না?” গোলাপবাগানের নীরবতা তার কানে যেন ফিসফিস করে বলল—এটাই তো নতুন যাত্রার শুরু।
তিন
পরদিন সকালটা ছিল অদ্ভুতভাবে নীরব। আকাশে রোদ ছিল ম্লান, চারপাশে যেন এক ধরনের অচেনা ভার জমে ছিল। ইরা সেই পুরনো জমিদারবাড়ির করিডোর দিয়ে হাঁটছিল হাতে নোটবুক আর কলম নিয়ে। তার চোখ পড়ছিল দেয়ালে ঝোলানো বিবর্ণ প্রতিকৃতিগুলোর দিকে—কখনও এক গম্ভীর দাড়িওয়ালা জমিদার, কখনও গয়নায় মোড়া জমিদারানি, আবার কখনও তরুণ যুবকের কঠিন মুখাবয়ব। প্রতিটি ছবির চোখ যেন তাকে অনুসরণ করছে, যেন বলতে চাইছে—আমাদের কাহিনি এখনও অজানা রয়ে গেছে। ইরার বুকের ভেতর শিহরণ উঠল। সে লিখে রাখছিল প্রতিটি খুঁটিনাটি, কিন্তু মনে হচ্ছিল এ বাড়ি শুধু স্থাপত্য নয়, বরং এক জীবন্ত সত্তা। চারপাশের নীরবতা আর পুরনো কাঠের কড়িকাঠের গন্ধ মিলিয়ে তাকে নিয়ে যাচ্ছিল বহু পুরনো দিনে। সে বুঝতে পারছিল, এ বাড়ি একসময় প্রভাবশালী জমিদার পরিবারের কেন্দ্র ছিল। আশপাশের গ্রামজুড়ে তাদের শাসন চলত, রাজনীতি থেকে শিল্পকলা—সবকিছুতেই তাদের প্রভাব ছিল। অথচ হঠাৎ করেই সব শেষ হয়ে যায়। কেন এমন হল, সেই প্রশ্ন ইরার মনে ক্রমশ তীব্র হতে লাগল। ইতিহাসের বইতে সে কিছু সূত্র পেয়েছিল, কিন্তু সেগুলো অসম্পূর্ণ। মনে হচ্ছিল সত্যিটা ইচ্ছে করে চাপা দেওয়া হয়েছে। আর সেই সত্য খুঁজে বের করতেই আজ সে দাঁড়িয়ে আছে এই নির্জন অট্টালিকায়।
এমন সময় করিডোরের অন্ধকার দিক থেকে ভেসে এল খকখক কাশি। ইরা ঘুরে তাকিয়ে দেখল বৃদ্ধ তত্ত্বাবধায়ক ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে। সাদা ধুতি আর মলিন শার্ট পরে, পাকা দাড়ি, চোখে গভীরতা—তার চেহারায় যেন একসঙ্গে অবিশ্বাস আর ক্লান্তি আঁকা। ইরা বিনীতভাবে সালাম করে বলল, “আপনি কি আমাকে বাড়িটা সম্পর্কে কিছু বলবেন? আমি গবেষণার জন্য জানতে চাই।” বৃদ্ধ এক মুহূর্ত চুপ করে তাকিয়ে রইল, তারপর আস্তে আস্তে বলল, “কিছু কথা আছে যা বইতে লেখা নেই। তবে সবকিছু জানাও যায় না।” ইরা আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে এল, “তাহলে অন্তত কিছুটা বলুন।” বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তারপর বলতে শুরু করল—“এই বাড়ি একসময় আলোয় ভরা ছিল। জমিদার মহেন্দ্রনারায়ণ ছিলেন এই অঞ্চলের সবথেকে ক্ষমতাবান মানুষ। তার দাপটে কেউ টুঁ শব্দ করত না। বাড়িতে আসত কবি, গায়ক, নাট্যকার, এমনকি রাজনীতিবিদও। সোনার চামচে খাবার উঠত, নাচগান চলত রাতভর। কিন্তু মানুষের লোভ যখন সীমা ছাড়ায়, তখন পতন আসবেই। মহেন্দ্রনারায়ণের ছেলেরা একে অপরের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। জমি আর সম্পত্তি নিয়ে অশান্তি শুরু হয়, আর ঠিক তখনই বাইরের শত্রুরা সুযোগ নেয়। এক রাতে হঠাৎ করে সবকিছু শেষ হয়ে যায়। কে বিশ্বাসঘাতকতা করল, কে বাঁচল, কে মরল—সবকিছু রহস্যে ঢাকা রয়ে গেল।” ইরা গভীর মনোযোগে শুনছিল, তার কলম দ্রুত কাগজে নাচছিল। কিন্তু লক্ষ্য করল, বৃদ্ধ অনেক প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাচ্ছে। সে জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু কীভাবে শেষ হল? রক্তপাত হয়েছিল? নাকি বাইরে থেকে আক্রমণ এসেছিল?” বৃদ্ধ কেবল গম্ভীর চোখে তার দিকে তাকাল, আর বলল, “কিছু কথা জানার নয়, কিছু ইতিহাস চাপা থাকাই ভালো।”
ইরার মনে তখন আরও তীব্র কৌতূহল জেগে উঠল। এ বাড়ির প্রতিটি ইট যেন অতীতের রক্ত আর অশ্রুর দাগ বয়ে বেড়াচ্ছে, অথচ কেউ সেসব স্পষ্ট করে বলতে চাইছে না। সে বুঝতে পারছিল বৃদ্ধ তত্ত্বাবধায়ক অনেক কিছু জানে, কিন্তু বলতে ভয় পাচ্ছে, হয়তো কোনো প্রতিজ্ঞার কারণে, হয়তো কোনো অদৃশ্য অভিশাপের কারণে। বৃদ্ধের চোখে ভেসে উঠছিল গভীর যন্ত্রণা, যেন তিনি নিজেও সেই ইতিহাসের ভার বইছেন। ইরা তাকে আর জোর করল না, তবে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল সত্যিটা একদিন উন্মোচন করবেই। সে আবার বাগানের দিকে ফিরে গেল, সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল অর্ণব, হাতে গোলাপের ডাল। তার চোখে ছিল এক ধরনের নীরবতা, যেন সেও সব জানে কিন্তু কিছু বলতে চাইছে না। ইরার বুক কেঁপে উঠল। হয়তো এই ছায়াঘেরা জমিদারবাড়ি আর গোলাপবাগান শুধু ইতিহাসের স্মৃতি নয়—বরং এমন এক গোপন সত্য লুকিয়ে আছে, যা তার নিজের জীবনকেও বদলে দেবে। বাড়ির প্রতিটি কোণ, প্রতিটি নিঃশ্বাসে যেন সেই চাপা পড়ে থাকা অতীত তাকে ডেকে বলছিল—“আমাদের ছায়ার ভেতরে ঢুকে পড়ো, সত্যিটা খুঁজে বের করো, যদি সাহস থাকে।”
চার
অর্ণবের রহস্য যেন ইরার মনে কাঁটার মতো বিঁধে গিয়েছিল। প্রথম দিন থেকেই ইরা লক্ষ্য করছিল, অর্ণব অন্যদের মতো নয়। সে কাজকর্মে যতই সাধারণ একজন মালি বলে মনে হোক না কেন, তার চলাফেরা, তার দৃষ্টির ভঙ্গি, আর কখনো হঠাৎ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে পুরোনো জমিদারবাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকার ভঙ্গি ইরার কৌতূহল বাড়িয়ে দিচ্ছিল। অনেক সময় ইরা লক্ষ্য করেছে, বাড়ির নির্দিষ্ট কিছু অংশের কাছে অর্ণব অনায়াসে চলে যায়, যেন সে জানে কোন পথ কোন ঘর বা বাগানের সঙ্গে যুক্ত। অথচ, স্থানীয় গ্রামবাসীরা পর্যন্ত এই পথচিহ্ন ভুলে গেছে। একদিন গবেষণার ফাঁকে ইরা চুপিসারে অর্ণবকে পর্যবেক্ষণ করছিল। সে দেখল, বাড়ির পেছনের পুরোনো কুয়ার পাশে অর্ণব দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখে যেন এক ধরনের বিষণ্ণতা খেলা করছিল, আর ঠোঁটের কোণে অচেনা কিছু কথা বিড়বিড় করে বলছিল। ইরা এগোতেই সে চমকে ওঠে, তবে মুহূর্তের মধ্যেই মুখে এক অদ্ভুত স্থিরতা এনে বলে, “গবেষণার কাজ চলছে ভালো তো, মেমসাহেব?” ইরার মনে হলো—এই প্রশ্নের আড়ালে সে যেন ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের কিছু লুকোচ্ছে। তখন থেকেই ইরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলো, অর্ণব আসলে কে, আর তার অতীতে জমিদার পরিবারের সঙ্গে কী সম্পর্ক লুকিয়ে আছে, তা খুঁজে বের করবেই।
এরপর থেকে ইরা বারবার চেষ্টা করতে লাগল কথার ফাঁকে অর্ণবকে নিয়ে কিছু জানার। একদিন দুপুরে, যখন চারপাশের কাজ থেমে গিয়েছে, সে অর্ণবকে বসতে বলল। শুরুতে অর্ণব এড়িয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু ইরার অনবরত প্রশ্নে ক্লান্ত হয়ে সে কিছুটা হাসল, যেন কৌতুক করছে। “আমার জীবনে এমন কিছু নেই, যেটা জানার মতো,”—এই ছিল তার সহজ উত্তর। কিন্তু ইরার চোখে পড়ল, তার কণ্ঠে সামান্য কাঁপন লুকোচ্ছে। “তাহলে আপনি জমিদার বাড়ির গোপন পথগুলো এত ভালোভাবে জানেন কীভাবে?”—ইরা সোজাসুজি প্রশ্ন করল। অর্ণব কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল, “শৈশবে আমি এই প্রাসাদের আশেপাশেই বড় হয়েছি। তখন অনেক কিছুই দেখেছি, শিখেছি।” কিন্তু তার চোখ যেন অন্য কিছু বলছিল। ইরা খেয়াল করল, প্রতিবার জমিদার পরিবারের নাম উঠলেই অর্ণব অস্বস্তিতে পড়ে যায়, আর বিষয় পরিবর্তন করে। এই অস্বস্তিই ইরাকে নিশ্চিত করল, অর্ণবের জীবনের সঙ্গে জমিদার পরিবারের কোনো না কোনো জটিল যোগসূত্র রয়েছে। কয়েকবার ইরা তাকে পুরোনো দলিল বা ছবির বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, আর তখন অর্ণবের চোখে হঠাৎ এক ঝলক আতঙ্কের ছায়া নেমে আসত। ইরা তখন বুঝল, এই রহস্য সহজে উন্মোচিত হবে না। তবু সে সিদ্ধান্ত নিল, একদিন অর্ণব নিজেই বলবে—কারণ এই লুকোচুরি দীর্ঘদিন ধরে রাখা যায় না।
রাতগুলোতে যখন বাড়ি নিস্তব্ধ হয়ে যায়, ইরা তার গবেষণার নোটগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে ভাবত—অর্ণব আসলে কে? শুধু কি একজন মালি, নাকি জমিদার পরিবারের কোনো হারিয়ে যাওয়া সদস্যের উত্তরসূরি? গ্রামের বৃদ্ধরা পর্যন্ত এ বিষয়ে সরাসরি কিছু বলতে চাইত না। একদিন, অল্পবয়সী এক গ্রামবাসীর কাছে জানতে পারল, অর্ণবের মা একসময় জমিদার পরিবারের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। হঠাৎ করেই তার মৃত্যু হয়, আর অর্ণবকে এই এলাকায় আশ্রয় নিতে হয়। তবে এটুকু গল্পের আড়ালেই থেকে গেল আরও কিছু অজানা অধ্যায়, যা কেউ বলতে সাহস পায়নি। অর্ণব নিজেও এই প্রসঙ্গে সবসময় নীরব। কিন্তু ইরা যতই রহস্য ঘনীভূত হতে দেখল, ততই তার গবেষণা জমিদারবাড়ির অতীত থেকে সরে এসে অর্ণব নামের এই মানুষের দিকে ঘুরে গেল। ইরা মনে মনে বুঝে ফেলল, জমিদারবাড়ির ইতিহাস যেমন অনেক রহস্যের ভেতর লুকিয়ে আছে, তেমনি অর্ণবও সেই ইতিহাসের অংশ, হয়তো অদৃশ্য অথচ অপরিহার্য। সে প্রতিজ্ঞা করল—যে কোনো মূল্যে অর্ণবের রহস্য উদঘাটন করবে। আর এই অদম্য কৌতূহলই তাকে আরও গভীর অন্ধকারের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল, যেখানে ইতিহাস, সম্পর্ক আর গোপন অতীতের জটিল জাল একে অপরকে ছুঁয়ে আছে।
পাঁচ
ইরা সেদিন সকালে একা বাগানের ভেতর ঘুরছিল, অর্ণব কোথাও দেখা যাচ্ছিল না। হঠাৎ তার চোখে পড়ে গোলাপগাছের আড়ালে মাটির নিচে অর্ধেক ঢাকা একটি পুরনো কাঠের বাক্স, সময়ের ছাপ স্পষ্ট, কাঠের কোণে শ্যাওলা জমে আছে। কৌতূহলী হয়ে ইরা বাক্সটি তুলে নেয়, ধুলো মুছে দেখে ভেতরে রাখা আছে একটি চামড়ার বাঁধানো পুরনো ডায়েরি। পাতাগুলো হলদেটে হয়ে গেছে, কিন্তু লেখাগুলো এখনো স্পষ্ট। প্রথম পাতায় লেখা—“এই বাগানের গোলাপ কেবল ফুল নয়, এরা সাক্ষী এক নিষিদ্ধ প্রেমের।” ইরা এক মুহূর্ত নিঃশ্বাস আটকে পড়ল, যেন অতীতের এক অদৃশ্য দরজা খুলে গেল তার সামনে। ডায়েরির পাতায় পাতায় ভেসে উঠল জমিদার পরিবারের এক অজানা কাহিনি—এক যুবক জমিদারপুত্র, যার প্রেমে পড়েছিলেন বাড়িরই এক পরিচারিকার কন্যা। সে প্রেম ছিল গোপন, অন্ধকার রাতের ছায়ায় লুকোনো, গোলাপবাগানের নিভৃত কোণে যেখানে আজও বাতাসের হালকা সুবাস যেন সেই গোপনতার সাক্ষ্য দেয়। ইরা পড়তে পড়তে বুঝল এই বাগানের প্রতিটি ফুল, প্রতিটি শ্বাস যেন বহন করছে সেই অসম্পূর্ণ প্রেমের দীর্ঘশ্বাস। কিন্তু কেন এই ডায়েরি লুকোনো হয়েছিল? কে লিখেছিল? ইরা থেমে গিয়ে এক অদ্ভুত শিহরণ অনুভব করল—মনে হল ডায়েরির পাতার প্রতিটি শব্দ শুধু অতীতের কথা নয়, যেন তাকে উদ্দেশ্য করেই লেখা হয়েছে।
ইরা ডায়েরির পাতায় গভীরভাবে ডুবে যেতে লাগল। সেখানে লেখা আছে, এক রাতে গোলাপবাগানের লাল ফুলের আড়ালে তারা প্রথম একে অপরের কাছে আসে। জমিদারপুত্র জানত সমাজ এই সম্পর্ক মেনে নেবে না, আবার মেয়েটি জানত এ সম্পর্ক প্রকাশ হলে শুধু লাঞ্ছনা নয়, তার বাবার চাকরিও যাবে। তাই তারা প্রতিদিন এই বাগানে এসে মিলিত হতো, আর গোলাপের সুগন্ধ তাদের গোপন প্রেমকে ঢেকে রাখত। কিন্তু একদিন সব প্রকাশ হয়ে যায়, পরিবারের বিরুদ্ধতায় সেই প্রেম ভেঙে পড়ে, এবং শোনা যায় মেয়েটিকে দূরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। জমিদারপুত্র ভেতরে ভেঙে পড়েছিল, আর গোলাপবাগান হয়ে ওঠে তার একমাত্র আশ্রয়। ডায়েরির পাতায় লেখা আছে—“যদি কখনও আবার এই বাগানে কারও প্রেমের ফুল ফোটে, তবে জেনে নিও আমাদের আত্মা সেখানে আশীর্বাদ দিয়ে থাকবে।” ইরার হাত কাঁপতে লাগল, সে বুঝতে পারছিল না এ যেন শুধু অতীতের কাহিনি নয়, বরং আজকের দিনে সে এবং অর্ণবের সম্পর্কের এক অদ্ভুত প্রতিচ্ছবি। অর্ণবকে সে যেভাবে অনুভব করছে, তাতে সেই পুরনো প্রেমকাহিনির সঙ্গে তার বর্তমানের আশ্চর্য মিল খুঁজে পাচ্ছে। অর্ণবের রহস্যময় চোখের দৃষ্টি, তার নিঃশব্দ উপস্থিতি, আর তার এড়িয়ে যাওয়া সব কথার মধ্যে যেন এই ডায়েরির ছায়া মিশে আছে। ইরার মনে হল, হয়তো অর্ণবের পরিবারই সেই নিষিদ্ধ প্রেমের উত্তরাধিকার বহন করছে, হয়তো এই গোলাপবাগান শুধু ফুল নয়—এটি এক অভিশাপ ও আশীর্বাদের মিশ্র প্রতীক।
ডায়েরি বন্ধ করে ইরা দীর্ঘক্ষণ চুপ করে বসল। বাগানের চারপাশে নিস্তব্ধতা, শুধু বাতাসে দোল খাচ্ছে গোলাপের ডাল। ইরার মনে হচ্ছিল যেন অতীত ও বর্তমান এক হয়ে গেছে। সে অনুভব করল, এই ডায়েরি হয়তো তার হাতেই আসার ছিল, কারণ অর্ণবের প্রতি তার টান আর ডায়েরির কাহিনি একই সুতোয় বাঁধা। কিন্তু অর্ণব কি জানে এই ডায়েরির অস্তিত্ব সম্পর্কে? নাকি ইরাকেই সত্যটা উন্মোচন করতে হবে? তার মনে প্রশ্ন জাগল—যদি অর্ণব সত্যিই সেই নিষিদ্ধ প্রেমের বংশধর হয়, তবে কি তাদের সম্পর্কও একই পরিণতি পাবে? নাকি এবার গোলাপবাগানের ইতিহাস ভিন্ন পরিণতির সাক্ষী হবে? ইরার চোখে জল চলে এল, সে ডায়েরিটি বুকে চেপে ধরল, যেন অতীতের প্রেমিক-প্রেমিকার অসম্পূর্ণতা তাকে নিজের জীবনে পূর্ণতা খুঁজে নিতে ডাকছে। কিন্তু সেই সঙ্গে তার হৃদয়ের ভেতরে এক ভয়ও জন্ম নিল—হয়তো এই বাগানের ফুল আজও শুধু সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, বরং রক্ত, বেদনা আর লুকোনো অশ্রুরও গোপন সাক্ষ্য। ঠিক তখনই দূরে অর্ণবকে আসতে দেখে ইরা চমকে উঠল। সে ডায়েরি লুকিয়ে রাখল, কিন্তু চোখের ভেতরের আলো আর অস্থিরতা অর্ণবের দৃষ্টি এড়িয়ে গেল না। হয়তো খুব শিগগিরই ফুলের আড়ালে লুকোনো অতীত বর্তমানের সামনে উন্মোচিত হবে।
ছয়
বাগানের নিস্তব্ধতার ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে ইরা আর অর্ণবের সম্পর্ক যেন এক নতুন রূপ নিতে শুরু করল। দিনের আলোয় যখন তারা ধূলিধূসর পাতা উল্টে পুরনো ইতিহাসের দলিল খুঁজত, রাতের আঁধারে সেই আলো-আঁধারের মাঝে জমে উঠত এক অদৃশ্য টান। ইরা কখনও নিজেকে অজান্তেই অর্ণবের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখত—তার শান্ত স্বভাব, মনোযোগ দিয়ে শোনার অভ্যাস, কিংবা সামান্য হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা গভীরতা তাকে অদ্ভুতভাবে টানত। অর্ণবও টের পেত ইরার উপস্থিতি তার দিনগুলোতে নতুন আলো এনে দিয়েছে। বাগানের নির্জন কোনায় যখন তারা একসঙ্গে বসত, তখন শব্দের প্রয়োজন পড়ত না। তাদের চোখ, তাদের চুপচাপ সঙ্গই যেন অজান্তে সব কিছু বলে দিত। বাগানে হাওয়া বইলে গোলাপের পাপড়ি উড়ে এসে ইরার চুলে লেগে যেত, আর অর্ণব নিঃশব্দে হাত বাড়িয়ে সেই পাপড়ি সরিয়ে দিত। একবার ইরা ডায়েরির একটি অংশ পড়তে গিয়ে কণ্ঠ কেঁপে উঠলে অর্ণব তার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘক্ষণ নীরবে বসে রইল—সেই নীরবতা ছিল ভাষাহীন অথচ গভীর বন্ধনের মতো, যা তাদের অচেনা আবেগের পথ খুলে দিচ্ছিল।
দিনের পর দিন গবেষণার অজুহাতে তারা আরও বেশি সময় কাটাতে লাগল। দুপুরের ভেতর রোদ যখন ম্লান হয়ে আসত, ইরা আর অর্ণব বই-খাতা গুটিয়ে বাগানের ছায়ায় হাঁটত। গাছের নিচে বসে ইরা নিজের অজান্তে শৈশবের কথা বলত, মায়ের কাছে শেখা গান গাইত, আবার কখনও গোলাপের গন্ধে চোখ বন্ধ করে স্বপ্নে ডুবত। অর্ণব সব শুনত, কোনো মন্তব্য না করেও তার চোখের দৃষ্টিতে ইরা বুঝতে পারত—সে যেন ইরার প্রতিটি কথা মনের ভেতর গেঁথে রাখছে। কখনও কখনও তারা একই পাতার ওপরে ঝুঁকে নোট নিত, আর তাদের আঙুল একে অপরকে ছুঁয়ে যেত। সেই ছোঁয়া মুহূর্তের জন্য হলেও মনে হতো যেন সময় থেমে গেছে। অনেক রাত অবধি তারা লাইব্রেরিতে আলো জ্বেলে কাজ করত, বাইরের নিস্তব্ধতায় দূরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যেত, আর ভেতরে নীরবতার ভেতর তাদের অচেনা আবেগ আরও গাঢ় হয়ে উঠত। দুজনেই অনুভব করত, কিন্তু কেউ তা মুখে আনত না। মনে হতো, তাদের সম্পর্ক ঠিক গোলাপের মতো—ফুলে ওঠার জন্য সময় নেয়, আর সময় এলেই সে নিজে থেকেই রঙ ছড়ায়।
তাদের মধ্যে এই নীরবতার বন্ধন ধীরে ধীরে এক অদৃশ্য প্রতিশ্রুতিতে রূপ নিল। একদিন সন্ধ্যায় তারা গোলাপবাগানের পুরনো ফোয়ারার পাশে বসেছিল। চারপাশে কুয়াশার মতো হালকা ঠান্ডা হাওয়া, উপরে চাঁদ উঠেছে। ইরা চুপ করে বসে ছিল, তার চোখে যেন এক অচেনা আলো। অর্ণব বুঝতে পারছিল কিছু একটা ইরা বলতে চাইছে, কিন্তু শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না। সে কিছু না বলেই ইরার হাতের কাছে হাত রাখল—না ছুঁয়ে, শুধু কাছাকাছি। সেই দূরত্বের ভেতর এক অদ্ভুত উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ল। ইরা তাকাল তার চোখে, আর হঠাৎ যেন সময় থেমে গেল। তারা কেউ কথা বলল না, কিন্তু নীরবতাই যেন তাদের মধ্যে এক অব্যক্ত অঙ্গীকারের মতো বেঁধে দিল। ইরার মনে হলো, এই নীরবতা শব্দের চেয়েও অনেক গভীর, অনেক সৎ। অর্ণবও অনুভব করল, জীবনের এতদিনের একাকিত্ব হয়তো আজ ভাঙতে শুরু করেছে। এভাবে রাত নামল, কিন্তু তাদের হৃদয়ে আলো জ্বলে উঠল—নীরবতার বাঁধনে জড়িয়ে দুজন যেন এক নতুন অধ্যায়ের দিকে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল।
সাত
প্রফেসর দিবাকর মুখার্জি সবসময়ই ছিলেন একরকম ঠান্ডা মাথার মানুষ, যিনি গবেষণার প্রতি প্রবল আবেগী অথচ ব্যক্তিগত আবেগকে তিনি দুর্বলতা মনে করতেন। কলকাতা থেকে এই জমিদারবাড়ির অন্দরমহল ঘুরে দেখার জন্য এসেছিলেন তিনি, ইরার অগ্রগতি যাচাই করার ছুতোয়। সকালবেলা ইরা তাঁকে বাড়ির বারান্দায় অভ্যর্থনা জানাতে এলে তাঁর চোখে পড়ল যে ইরা যেন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটা আলোকিত হয়ে আছে। তার মুখের চাহনিতে নতুন দীপ্তি, কণ্ঠস্বরে অদ্ভুত কোমলতা—যা প্রফেসরের বহু বছরের অভিজ্ঞতা তাঁকে ইঙ্গিত দিলো যে, এখানে শুধুই গবেষণার খাতিরে আবেগ নেই, আছে অন্য কিছু। বারান্দার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অর্ণবের চোখে তাকিয়ে তিনি মুহূর্তের জন্য স্পষ্টই বুঝলেন, দুজনের মধ্যে এক অদৃশ্য সেতুবন্ধ তৈরি হয়েছে। দুপুরে জমিদারবাড়ির আঙিনায় ঘোরাঘুরি করতে করতে ইরা যখন বিভিন্ন স্থানের ঐতিহাসিক প্রমাণ তাঁকে দেখাচ্ছিল, প্রফেসর লক্ষ্য করলেন অর্ণব প্রায় নিঃশব্দে পাশে দাঁড়িয়ে থাকছে, কখনো ইরার ফাইল হাতে তুলে দিচ্ছে, কখনো ধুলো ঝেড়ে দিচ্ছে। অর্ণবের ছোট ছোট যত্নশীল আচরণ প্রফেসরের চোখ এড়াল না, আর ইরার সেই হাসিমাখা চোখও তাঁকে স্পষ্ট করে দিলো যে এই সম্পর্ক শুধুই কর্মসংক্রান্ত নয়।
দুপুরের শেষে, বড় সিঁড়ির ধাপের কাছে দাঁড়িয়ে তিনি ইরাকে ডেকে নিলেন আলাদা করে। তাঁর গলায় ছিল এক ধরনের গুরুগম্ভীর সুর, যেন আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস। তিনি বললেন, “ইরা, আমি তোমাকে প্রথম দিন থেকেই চিনেছি—তুমি গবেষণায় নিবেদিতপ্রাণ, তোমার ভেতর যে একাগ্রতা আছে, তা সচরাচর কারও ভেতর পাওয়া যায় না। কিন্তু আজ আমি যা দেখছি, তা নিয়ে আমি চিন্তিত। গবেষণার সময় হৃদয়ের বাঁধন যদি তোমাকে ঘিরে ধরে, তবে তুমি হয়তো কাজের মূল লক্ষ্য থেকে সরে যাবে।” ইরা প্রথমে থমকে গেল, যেন প্রফেসরের তীক্ষ্ণ চোখ তার ভেতরকার সমস্ত গোপন কথাই পড়ে ফেলেছে। ইরার মনে চলতে লাগল এক দ্বন্দ্ব—অর্ণব কি সত্যিই তার গবেষণার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে? অথচ সে-ই তো তাকে প্রতিদিন সাহায্য করছে, নানাভাবে সহযোগিতা করছে, পাশে দাঁড়িয়ে সব ভার কমিয়ে দিচ্ছে। প্রফেসরের কথায় সে দ্বিধায় পড়ে যায়—কাজ কি হৃদয়ের থেকে আলাদা? একজন গবেষকের জীবন কি কেবল তথ্য, দলিল, প্রমাণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত? নাকি মানুষের ভেতরের আবেগও তার কাজের অংশ হয়ে উঠতে পারে? অর্ণবের কথা ভেবে তার চোখে ভেসে উঠল সেই বিকেলের বাগান, সেই নীরবতার সেতুবন্ধ, যেখানে কথা না বলেও কত কিছু বলা হয়ে যায়। কিন্তু প্রফেসরের অভিজ্ঞতা ও সতর্কবাণী তাকে অস্থির করে তুলল।
রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে ইরা নিজের ঘরে বসে ডায়েরি লিখছিল। মোমবাতির আলোয় সে বারবার প্রফেসরের কথাগুলো ভেবেছিল। বাইরে জমিদারবাড়ির বিশাল অন্ধকার করিডরগুলো থেকে হালকা হাওয়ার শব্দ আসছিল, আর সেই নীরবতার মধ্যে তার মন দ্বিধায় ভরে উঠছিল। গবেষণার স্বপ্ন, পিএইচডির লক্ষ্য, ক্যারিয়ারের ভবিষ্যৎ—সবকিছুই যেন একদিকে টানছিল তাকে। অন্যদিকে অর্ণবের উপস্থিতি, তার মমতা, তার চোখের গভীরতা তাকে টানছিল অন্যপথে। প্রফেসরের কণ্ঠস্বর যেন কানে বাজতে লাগল—“এমন সম্পর্ক তোমার গবেষণা নষ্ট করতে পারে।” এই বাক্য যেন শাপের মতো তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিন্তু একইসাথে তার হৃদয়ের ভেতর এক মৃদু প্রতিবাদ জেগে উঠছিল—কাজ কি সত্যিই হৃদয়কে অস্বীকার করতে শেখায়? যদি ভালোবাসা তাকে আরও শক্তি দেয়, আরও অনুপ্রেরণা দেয় তবে সেটাই বা ভুল কোথায়? ইরা বুঝতে পারল, এই অধ্যায় থেকে তার যাত্রা সহজ আর হবে না। কারণ সামনে তাকে বেছে নিতে হবে—একদিকে গুরুজনের শাসন, গবেষণার কঠোর নিয়ম, আর অন্যদিকে হৃদয়ের টান, অর্ণবের অদৃশ্য হাত ধরা। এই দ্বন্দ্বের সূচনা ইরার ভেতরে এক নতুন অধ্যায়ের জন্ম দিল, যেখানে কাজ আর ভালোবাসা একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়াবে, আর তাকে সেই সেতু পার হতে হবে একা।
আট
জমিদারবাড়ির অন্ধকার করিডোরে সেই বৃদ্ধ তত্ত্বাবধায়ক হালকা ঝাপসা চোখে ইরাকে ডেকে নিলেন। গোধূলির ম্লান আলোয় তাঁর কণ্ঠস্বর যেন ভেসে এল অতীতের শোকে ভেজা বাতাসের মতো—“মাসিমা, তুমি যেটা নিয়ে খোঁজখবর করছ, তার ইতিহাস সোজা নয়, ওখানে শুধু স্থাপত্য নেই, আছে রক্ত, কান্না আর অভিশাপ।” ইরা বিস্মিত চোখে তাকালেন বৃদ্ধের দিকে, তাঁর কণ্ঠে এক অদ্ভুত কম্পন। তিনি বলতে শুরু করলেন সেই করুণ কাহিনি—প্রায় একশো বছর আগে এই বাড়ির জমিদার পুত্র নীলমণি এক গ্রামের মেয়ে হেমাঙ্গিনীর প্রেমে পড়েছিলেন। জমিদার পরিবারে সাধারণ মেয়ের সাথে সম্পর্ক কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। কিন্তু নীলমণি সব বিরোধিতা উপেক্ষা করে এক রাতে গোপনে হেমাঙ্গিনীকে বাগানের গোলাপতলায় দেখা করতে ডাকেন। সে রাতেই ঘটেছিল সেই ভয়ানক বিশ্বাসঘাতকতা। পরিবারের লোকেরা হঠাৎই আক্রমণ করে, রক্তের দাগ মিশে যায় লাল গোলাপের পাপড়িতে। হেমাঙ্গিনী সেদিন রাতেই অদৃশ্য হয়ে যায়, কেউ জানে না তাকে কোথায় নেওয়া হয়েছিল, আর নীলমণি পরিবারের চাপে নিজের প্রাণ বিসর্জন দেন। বৃদ্ধের কথার ফাঁকে ফাঁকেই শোনা যাচ্ছিল বাগানের দিক থেকে হাওয়ার সাথে মিশে আসা গোলাপের ঝোপের পাতার খসখসানি, যেন সেই পুরনো রাতের আর্তনাদ আজও শোনা যায়। ইরার বুক হিম হয়ে আসতে লাগল, অথচ তার ভেতরে ইতিহাস খুঁজে পাওয়ার ক্ষুধা আরো তীব্র হচ্ছিল, কারণ সে জানত তার গবেষণার মূলে এই গল্পই হয়তো সত্যি হয়ে দাঁড়াবে।
ইরা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল, “কিন্তু অভিশাপটা কোথায়?” বৃদ্ধ তত্ত্বাবধায়ক মাথা নিচু করে বললেন, “যতবার কোনো নারী বা পুরুষ ওই বাগানে ভালোবাসার কথা বলেছে, কিছু না কিছু অঘটন ঘটেছে। সেই গোলাপের ঝোপ আজও লাল হয়ে ওঠে অকারণেই, মাঝরাতে ফুলগুলো থেকে রক্তের গন্ধ আসে।” এই কথাগুলো যেন ইরার মনকে দ্বিখণ্ডিত করে দিল—একদিকে গবেষণার রোমাঞ্চকর সুযোগ, অন্যদিকে অজানা ভয়ের হিমশীতল হাত। তার মনে পড়ল প্রফেসরের সতর্কবাণী, কিন্তু তবুও এই অদ্ভুত টান থেকে বেরিয়ে আসতে পারল না। সেই মুহূর্তেই অর্ণব এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রাখল। “ভয় পেয়ো না, ইরা। অভিশাপ থাকলেও আমরা একসাথে সেটা ভাঙব। তোমার কাজ থামবে না।” অর্ণবের গলায় যে দৃঢ়তা ছিল, তা যেন ইরার কাঁপতে থাকা সত্ত্বাকে আশ্রয় দিল। তবু সে অনুভব করল, এই সম্পর্কের ভিতরে লুকিয়ে আছে অজানা বিপদ, এবং হয়তো এই জমিদারবাড়ির দেয়ালগুলো সব শুনছে তাদের প্রতিটি শব্দ। গোলাপের বাগান তখন দূরে অন্ধকারে ডুবে ছিল, কেবল বাতাসে ভেসে আসছিল মৃদু গন্ধ, যা ইরার কাছে রক্তের মতো ভারী ও তীব্র লাগছিল। বৃদ্ধ তত্ত্বাবধায়ক তাঁদের থামিয়ে বললেন, “যদি বেশি গভীরে খোঁজ করো, তবে যে ছায়াগুলো ঘুমিয়ে আছে, তারা জেগে উঠবে। সেই ছায়াদের শান্তি নেই, তারা চাইবে না আরেকটি প্রেম এখানে ফোটে।”
তবু ইরা ও অর্ণব সেই সতর্কতা সত্ত্বেও জমিদারবাড়ির গোলাপের বাগানের দিকে এগিয়ে গেলেন। চারপাশে নিস্তব্ধতা, কেবল জোনাকিরা ছুটে বেড়াচ্ছে অন্ধকারে। ইরার বুকের ধুকপুকানি যেন শোনা যাচ্ছিল নিজের কানে। তারা দাঁড়িয়ে গেল সেই গোলাপগাছের সামনে, যার কাহিনি শুনে ইরার গায়ে কাঁটা দিয়েছিল। ফুলগুলো অস্বাভাবিকভাবে লাল, যেন তাদের ভেতরে জমে থাকা শোক রঙ হয়ে ফুটে উঠেছে। অর্ণব নিচু হয়ে একটি গোলাপ ছিঁড়ে ইরাকে দিল। ইরা মুহূর্তে থমকে গেল—মনে পড়ল তত্ত্বাবধায়কের সতর্কতা। তবু অর্ণবের চোখে দৃঢ় ভালোবাসা দেখে সে সেই ফুল হাতে নিল, এবং ঠিক তখনই হাওয়ার ঝাপটা এল, যেন অতীতের করুণ আর্তনাদ আবার শোনা গেল। ইরা অদ্ভুত শিহরণে ভরে উঠল, মনে হল কোনো অদৃশ্য শক্তি বাগানের কোণ থেকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তার ভয়কে ঢেকে দিল অর্ণবের হাতের উষ্ণতা। সে বুঝল, অভিশাপ হোক বা না হোক, তাদের সম্পর্ক এই জমিদারবাড়ির দেয়ালের সাথে বাঁধা পড়ে গেছে। ইতিহাস, রক্ত, বিশ্বাসঘাতকতা আর প্রেম—সব মিলিয়ে তারা যেন এক অদ্ভুত খেলায় নেমেছে, যার শেষ কোথায় কেউ জানে না।
নয়
ঝড়ো রাতে আকাশে মেঘ গর্জন করছে, মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি জমিদারবাড়ির পুরনো বাগানকে ভুতুড়ে আলোয় ভাসিয়ে দিচ্ছে। বাতাসে কাঁপতে থাকা গোলাপগাছগুলো যেন অদৃশ্য কোনো গোপন কথা ফিসফিস করে বলছে। সেই রাতেই অর্ণব ইরাকে বাগানে নিয়ে আসে, ঝড়ের শব্দে যেন ভেতরের ভয় আর লুকোনো আবেগ ঢেকে যায়। ইরার মনে তখনও অস্বস্তি—গোলাপের অভিশাপের গল্প তাকে অস্থির করে তুলেছে। কিন্তু অর্ণবের দৃঢ় উপস্থিতি তাকে অদ্ভুত এক সাহস জোগায়। সে বুঝতে পারে, এতদিন অর্ণব তার পাশে ছিল কেবল একজন সহযাত্রী হিসেবে নয়, বরং তার প্রতিটি ভয়, প্রতিটি দ্বিধা ভাগ করে নেওয়ার জন্য। বাগানের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা অর্ণব হঠাৎ থেমে যায়, তার চোখে অদ্ভুত এক আলো, যেন বহুদিন ধরে চেপে রাখা কিছু প্রকাশ পেতে চাইছে। ইরা প্রথমে কিছুই বুঝতে পারে না, কিন্তু হঠাৎ অর্ণব তার হাত ধরে ফেলে। সেই স্পর্শে ইরার বুকের ভেতর তীব্র আলোড়ন ওঠে, বিদ্যুতের ঝলকানির মতোই তার মনে এক ঝলকে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়।
অর্ণব গভীর কণ্ঠে বলে ওঠে, “ইরা, এতদিন ধরে আমি চুপ করে থেকেছি, হয়তো ভেবেছিলাম তুমি বুঝবে, কিন্তু আজ আর পারছি না। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার ভেতরের ভয়, সাহস, কৌতূহল—সবকিছুর প্রতি আমার মুগ্ধতা। আমি জানি আমরা দুজনেই এই জমিদারবাড়ির রহস্যের মধ্যে ডুবে আছি, কিন্তু তার বাইরেও একটা সত্য আছে, আমি তোমাকে ছাড়া আমার পৃথিবী কল্পনা করতে পারি না।” কথাগুলো শুনে ইরা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, চারপাশের ঝড়-বৃষ্টির শব্দ যেন হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়। তার চোখ ভিজে আসে অজানা আবেগে। এতদিন যে অনুভূতিটা সে ভেতরে ভেতরে লুকিয়ে রেখেছিল, আজ আর ধরে রাখতে পারে না। অর্ণবের হাতের মুঠো শক্ত করে ধরে সে ফিসফিসিয়ে বলে, “আমিও তোমাকে ভালোবাসি, অর্ণব। হয়তো ভয় পেয়েছিলাম, হয়তো অভিশাপের ছায়া আমাদের ঘিরে আছে ভেবে পিছিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু সত্যি বলতে, তোমাকে ছাড়া আমারও পৃথিবী অসম্পূর্ণ।” অর্ণবের চোখে তৃপ্তির ঝিলিক দেখা দেয়, তার মুখে একটুখানি হাসি ফুটে ওঠে। বিদ্যুতের আলোয় দুজনের চোখ একে অপরের মধ্যে ডুবে যায়, যেন চারপাশের ভয়ঙ্কর ইতিহাসকেও মুছে দেয় এই মুহূর্তের সত্য।
এরপর ঝড়ো হাওয়ার শব্দের মাঝেই তারা দুজন দাঁড়িয়ে থাকে একে অপরের খুব কাছে। বাগানের গোলাপগাছগুলো কাঁপছে, পাপড়িগুলো ঝরে পড়ছে, কিন্তু সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছে ফুলেরাও যেন তাদের প্রেমের স্বাক্ষর দিচ্ছে। ইরা হঠাৎ অনুভব করে, এতদিন যে জমিদারবাড়ির রহস্য তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল, তার মধ্যে এক অনন্য শক্তি আছে, আর সেই শক্তি তাদের সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করছে। সে উপলব্ধি করে, হয়তো অতীতের অভিশাপ ভাঙার একমাত্র উপায় হলো নতুন ভালোবাসার জন্ম দেওয়া—যা ভয়কে অতিক্রম করবে। অর্ণবের কণ্ঠ আবার শোনা যায়, “ইরা, যত অভিশাপই থাকুক না কেন, আমি চাই তুমি আমার পাশে থাকো, প্রতিটি অন্ধকারে, প্রতিটি আলোতে।” ইরা বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। তারা যখন একে অপরকে আলিঙ্গন করে, তখন আকাশ থেকে এক তীব্র বজ্রপাত জমিদারবাড়ির পুরনো প্রাচীর আলোকিত করে তোলে, যেন প্রকৃতিও তাদের প্রেমের জন্মের সাক্ষী হয়। ঝড়ের সেই রাতে, বাগানের প্রতিটি ফুলে, প্রতিটি বাতাসে, প্রতিটি গর্জনে তাদের ভালোবাসার প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে, আর ইরা অনুভব করে, এই স্বীকারোক্তি শুধু একটি ব্যক্তিগত মুহূর্ত নয়, বরং তাদের যাত্রার এক নতুন সূচনা।
দশ
সন্ধ্যার আলো ধীরে ধীরে গাঢ় অন্ধকারে মিশে যাচ্ছিল, আর গোলাপবাগানের প্রতিটি কোণে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এসেছিল। সেই নীরবতার মধ্যে অর্ণব ইরাকে নিয়ে হাঁটছিল, যেন কোনো চিরচেনা অথচ অদেখা পথে তাকে নিয়ে যাচ্ছে। ইরা তখনও জানত না, অর্ণবের চোখের গভীরে কত অজানা কথা লুকিয়ে আছে। হঠাৎই তিনি থেমে দাঁড়ালেন বাগানের এক পুরোনো দিকের কাছে, যেখানে গোলাপগুলো অন্যদের মতো রঙিন নয়, বরং কিছুটা ম্লান। অর্ণব ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল তার জীবনের গল্প—কীভাবে সে আসলে এই জমিদার পরিবারের রক্তের উত্তরসূরি, কিন্তু বছরের পর বছর আগে একটি বিরাট পারিবারিক কলহ ও লোভের আগুনে তার বাবা-মা গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। ছোট্ট অর্ণব তখন প্রতিজ্ঞা করেছিল যে সে এই অমর্যাদার উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে যাবে না, বরং একজন সাধারণ মানুষ হয়ে উঠবে, জমিদার পরিচয়ের অহংকার নয় বরং পরিশ্রম আর আত্মসম্মানকে বেছে নেবে। কিন্তু ভাগ্যের এক রহস্যময় বাঁকে, সেই গোলাপবাগানই তাকে টেনে এনেছে, আর ইরার উপস্থিতি যেন তার জীবনের সব চাপা স্মৃতিকে নতুন করে আলোয় ভরে দিয়েছে। ইরা নিঃশব্দে শুনছিল, তার চোখে জল ভেসে উঠছিল, কারণ সে বুঝতে পারছিল—এই নীরব ও সাদামাটা অর্ণব আসলে কতটা গভীর মানুষ, যিনি নিজের অতীতের অন্ধকারকে এড়িয়ে এসে ভালোবাসার আলোকে বেছে নিয়েছেন।
অর্ণবের মুখে শোনা প্রতিটি শব্দ যেন গোলাপবাগানের বাতাসে ভেসে উঠছিল। ইরা অনুভব করছিল, এই বাগানের গোপন কথা আসলে কোনো পুরোনো রাজবংশের ইতিহাস নয়, বরং অর্ণবের আত্মপরিচয়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক অনন্ত যন্ত্রণা ও সাহসের কাহিনি। তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল ছোট্ট অর্ণবের ছবি, যে হয়তো পরিবারের নাম আর বিত্তকে প্রত্যাখ্যান করে একদিন একা পথে বেরিয়ে পড়েছিল। ইরা নিজেকে প্রশ্ন করছিল—সে কি কেবল গবেষক, যে এই কাহিনি লিপিবদ্ধ করবে, নাকি সে একজন প্রেমিকা, যে এই মানুষটির বেদনা ও সংগ্রামকে নিজের হৃদয়ে আগলে রাখবে? ঠিক তখনই গোলাপের গন্ধ ভেসে এলো, আর ইরা অনুভব করল যেন বাগানের প্রতিটি পাপড়ি ফিসফিস করে বলছে—“ভালোবাসাই সত্য, বাকিটা মায়া।” ইরা জানত, গবেষণার খাতায় এই ইতিহাস স্থান পাবে, কিন্তু তার ব্যক্তিগত জীবনে এই কাহিনি শুধু ইতিহাস হয়ে থাকবে না, বরং এক অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে, কারণ এর মধ্যে সে খুঁজে পেয়েছে নিজের জীবনের সবচেয়ে বড়ো সত্য—অর্ণবের ভালোবাসা। সে অর্ণবের হাত ধরে বলল, “তুমি হয়তো অতীতকে মুছে দিতে চেয়েছিলে, কিন্তু এই গোলাপবাগান তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে তোমার সত্য পরিচয় আর আমাকে দিয়েছে এমন এক ভালোবাসা, যা কোনো ইতিহাসের পৃষ্ঠায় ধরা যায় না।”
রাতের আকাশে তখন তারা ফুটে উঠেছে, আর গোলাপবাগান যেন নিঃশব্দে তাদের স্বীকারোক্তির সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইরা জানত, ইতিহাসের পাতায় এই জমিদার পরিবারের রহস্য সে সযত্নে লিখে রাখবে, কিন্তু তার হৃদয়ের পাতায় এই গোলাপবাগান চিরকাল রঙিন থাকবে অর্ণবের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলোর জন্য। অর্ণবও বুঝতে পারল, জীবনের এতদিনের লুকোনো সত্য প্রকাশ করেও সে কিছু হারায়নি, বরং অনেক কিছু ফিরে পেয়েছে। তার কাছে পরিবারিক পরিচয় নয়, ইরার ভালোবাসাই হয়ে উঠল সবচেয়ে বড়ো আশ্রয়। দুজন একসঙ্গে দাঁড়িয়ে অনুভব করল, সময় হয়তো অনেক কিছু কেড়ে নেয়, কিন্তু কিছু জায়গা থাকে যা অমলিন, যা ভালোবাসার মতোই অটুট। গোলাপবাগানও যেন সেই সত্যকে মুঠোয় ধরে রেখেছে—যেখানে পুরোনো ইতিহাস মিলিয়ে গেছে নতুন প্রেমের প্রতিধ্বনিতে। ইরা অনুভব করছিল, জীবনে সে হয়তো অনেক কিছু খুঁজবে, লিখবে, আবিষ্কার করবে, কিন্তু এই গোলাপবাগানের রাতের মতো মুহূর্ত আর কোনোদিন পাবে না। আর অর্ণবের কাছে সেই মুহূর্ত ছিল এক নতুন জন্ম, যেখানে সে শুধু এক পরিত্যক্ত উত্তরাধিকারী নয়, বরং ভালোবাসার দ্বারা পূর্ণ এক মানুষ হয়ে উঠেছে। এভাবেই গোলাপবাগানের গোপন কথা তাদের দুজনের জীবনকে বাঁধল এমন এক বন্ধনে, যা কোনো প্রজন্ম, কোনো সময় ভাঙতে পারবে না।
শেষ