তানভীর রানা
১
ঢাকার ব্যস্ত শহর থেকে কয়েকজন যুবক-যুবতী বেরিয়ে পড়েছে এক অজানা যাত্রায়। তারা কেউই পেশাদার অভিযাত্রী নয়, তবে প্রত্যেকেই নতুন জায়গা ঘোরার নেশায় পাগল। একসঙ্গে বন্ধুদের একটি ট্রাভেল গ্রুপ গড়ে তোলা হয়েছে কেবল রোমাঞ্চ খোঁজার জন্য, আর সেই রোমাঞ্চের খোঁজেই এবার তাদের গন্তব্য গোপালগঞ্জের বিখ্যাত কালো জঙ্গল। নাম শুনলেই মনে হয় ভয়ঙ্কর কোনো অরণ্যের কথা, যেখানে আলো পৌঁছায় না, মানুষের পা পড়েনি বছরের পর বছর। ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় রাত তিনটের দিকে যখন তারা মাইক্রোবাসে উঠলো, তখনও কারো চোখে ক্লান্তি নেই—হাসি, মজা আর নানা রকম ঠাট্টায় গাড়ির ভেতর জমে উঠেছে উৎসবের আবহ। দলের নেতৃত্বে আছে রাহুল, বয়স তেইশ-চব্বিশের মধ্যে, একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস পড়েছে, এখন নিজের ইউটিউব চ্যানেলের জন্য ট্রাভেল ভিডিও বানায়। তার সাথে আছে আরও কয়েকজন—রুবাইয়া, নীলা, সজল, অর্ণব আর প্রান্ত। প্রত্যেকের মধ্যেই দুঃসাহসিকতার ঝোঁক, আবার একইসঙ্গে বন্ধুত্বের বন্ধনে জড়িয়ে থাকা উচ্ছ্বাস। যাত্রার শুরুতে তারা কেউই বুঝতে পারেনি এই ভ্রমণ কেবল আনন্দের নয়, বরং অদ্ভুত এক আতঙ্কের দিকে এগিয়ে চলেছে।
গাড়ি শহর ছাড়িয়ে গ্রামবাংলার পথে ঢুকে পড়তেই দৃশ্যপট বদলে গেল। উঁচু উঁচু গাছ, অন্ধকারে জোনাকির আলো, ফাঁকা মাঠের ওপর কুয়াশার চাদর যেন অচেনা এক জগতের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। বন্ধুরা হঠাৎ করেই ফিসফিস করে কথা বলতে শুরু করলো—কে যেন বলল, “শোনো, কালো জঙ্গল নাকি ভূতের আস্তানা। সেখানে গেলে রাতে নাকি মানুষের কান্না শোনা যায়।” বাকিরা হেসে উড়িয়ে দিলেও কথাগুলো মনের ভেতর এক অজানা শীতলতা ছড়িয়ে দিল। স্থানীয় ড্রাইভার, যিনি বহুবার ওই পথ ধরে গাড়ি চালিয়েছেন, চুপ করে বসে ছিলেন এতক্ষণ। হঠাৎ তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, “ওখানে গেলে সাবধান থাকবেন। রাত নামার আগেই বের হয়ে আসবেন। অনেক কথা প্রচলিত আছে সেই জঙ্গল নিয়ে। কেউ কেউ নাকি আর ফেরেইনি।” ড্রাইভারের কথায় মুহূর্তের জন্য গাড়ির ভেতর নীরবতা নেমে এল। তারপর আবার কেউ একজন মজা করে বলল, “আচ্ছা ভাই, এসব গল্প আপনি চালকদের ভয় দেখানোর জন্য বানান নাকি?” হাসির রোল উঠলো আবার, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সবার মনেই যেন সামান্য কাঁপুনি তৈরি হলো।
মাইক্রোবাস এগোতে থাকল অন্ধকার গ্রামীণ সড়ক ধরে। জানালার বাইরে তাকালে শুধু দেখা যাচ্ছিল কৃষ্ণগহ্বরের মতো রাত, মাঝে মাঝে জোনাকি কিংবা কোনো দূরবর্তী কুঁড়েঘরের আলো ভেসে আসছে। যাত্রীরা ক্লান্ত হলেও উত্তেজিত, তাদের ব্যাকপ্যাকে ভরে রাখা খাবার, টর্চলাইট, ক্যামেরা আর প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম। রাহুল ক্যামেরা হাতে বের করতে চাইল জার্নি ভিডিও শুরু করার জন্য, কিন্তু ড্রাইভার একরকম কড়া গলায় বলল, “ভাই, এখনই শুরু কইরেন না। ওই জঙ্গলের আগে রাস্তার বাতি নাই, একদম অন্ধকার। চোখ অভ্যস্ত হোক আগে।” কথাগুলো শুনে সবাই একটু অবাক হলেও চুপ করে গেল। গাড়ির ইঞ্জিনের গর্জন আর দূরের শিয়ালের হাহাকার মিলে এক অদ্ভুত শূন্যতা তৈরি করছিল। প্রত্যেকের বুকের ভেতর তখনও মজা আর হাসির আবহ ছিল, কিন্তু তার আড়ালে তারা টের পাচ্ছিল, যাত্রা তাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে—সেই প্রশ্নের উত্তর যেন রাতের অন্ধকারই গোপন করে রেখেছে। কালো জঙ্গলের দিকে প্রথম পদক্ষেপ যেন তাদের অজান্তেই মৃত্যুর ফাঁদে ঢুকে পড়া।
২
মাইক্রোবাস থেকে নামতেই দলটি বুঝতে পারল, তারা এক অন্য জগতে প্রবেশ করেছে। সূর্যের আলো তখনও পুরোপুরি ম্লান হয়নি, কিন্তু জঙ্গলের ঘন ছায়ায় মনে হচ্ছিল বিকেলের আলো রাত হয়ে গেছে। চারপাশে উঁচু উঁচু গাছ মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে, তাদের ডালপালা এমনভাবে একে অপরের সঙ্গে মিশে গেছে যে ওপরে আকাশের রেখাটুকু দেখা মুশকিল। জঙ্গলের ভেতরে ঢুকেই শরীরে এক অদ্ভুত শীতল স্রোত নেমে এলো, যা গরম দিনের ক্লান্তিকে মুহূর্তেই দূর করলেও ভেতরে ভেতরে এক অকারণ অস্বস্তি তৈরি করছিল। চারপাশে নিস্তব্ধতা এত গভীর যে মনে হচ্ছিল, পৃথিবীর সমস্ত শব্দ এখানে এসে থেমে গেছে। পাখির ডাক নেই, ঝিঁঝিঁ পোকার সুর নেই, এমনকি পাতার মর্মরধ্বনিও না—শুধু নিস্তব্ধতা আর কাঁপুনি ধরানো ঠান্ডা হাওয়া। সবাই প্রথমে ভাবল, হয়তো তারা কল্পনা করছে, কিন্তু যতই গভীরে পা বাড়াচ্ছিল, ততই মনে হচ্ছিল কোনো অজানা চোখ তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ লক্ষ্য করছে।
গাইড সঞ্জয়, যিনি বহুবার নাকি এই জঙ্গলে এসেছেন, শান্ত গলায় বললেন, “এখানে এভাবেই থাকে। ভয় পাবেন না, এগিয়ে চলুন।” কিন্তু তার গলার স্বরেও যেন অদ্ভুত দ্বিধা লুকিয়ে ছিল। দলের সদস্যরা তাকে বিশ্বাস করতে চাইলেও অস্বস্তি কাটাতে পারছিল না। রুবাইয়া টর্চ জ্বালাতে চাইল, কিন্তু সঞ্জয় থামিয়ে দিলেন—“এখন দরকার নেই, অন্ধকারে চোখ অভ্যস্ত হতে দিন।” কথায় যুক্তি থাকলেও সবাই বুঝল, এখানে নিয়মগুলো ভিন্ন। একটু পরেই প্রান্ত হেসে বলল, “আরে, ভূত টুত কিছু হলে না হয় ক্যামেরায় ধরা পড়বে।” কথাটা বলেই সে ক্যামেরা অন করতে গেল, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ডিভাইসটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। ব্যাটারি তো পূর্ণই ছিল, তবুও যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তা অকেজো করে দিল। সবার মুখে তখনই থমথমে নীরবতা নেমে এল। কেউ হাসল না, কেউ কিছু বলল না—শুধু নীলা ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বলল, “এমন নীরবতা খুব অস্বাভাবিক… প্রকৃতি কখনো এত নিস্তব্ধ হয় না।” তার কণ্ঠে শিহরণ লেগে গেল।
যতই গভীরে তারা এগোতে থাকল, জঙ্গলের অন্ধকার যেন ক্রমশ গাঢ় হয়ে উঠছিল। বাতাসে অদ্ভুত এক স্যাঁতসেঁতে গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিল, যেন বহু বছরের পচন আর মৃত্যুর গন্ধ জমে আছে এখানে। অর্ণব পেছন ফিরে তাকাল কয়েকবার, কারণ মনে হচ্ছিল কেউ যেন তাদের অনুসরণ করছে। কিন্তু চোখে পড়ছিল কেবল গাছের গুঁড়ি আর ছায়া। একবার মনে হলো যেন গাছের ফাঁক থেকে একটি ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে দেখছে, কিন্তু যখন টর্চ ফেলা হলো, কিছুই নেই—শুধু ফাঁকা অরণ্য। গাইড সঞ্জয় যদিও স্থির মুখে হাঁটছিলেন, কিন্তু তার কপালের ঘাম অস্বস্তির কথাই বলছিল। অদ্ভুত এক চাপা ভয় ক্রমে গ্রুপটির উপর ভর করতে শুরু করল। প্রত্যেকের বুকের ভেতর যেন ধুকপুক ধ্বনি বেড়ে যাচ্ছিল, অথচ কাউকেই সেই ভয় প্রকাশ করতে দেখা গেল না। এক অজানা শক্তি যেন তাদের অগ্রসর হতে বাধ্য করছে, পেছন ফিরে যাওয়ার কথা কেউ উচ্চারণও করল না। ঠিক তখনই দূরে হঠাৎ বাতাসের ঝাপটায় মরা পাতার স্তূপ উড়ে গিয়ে যেন ফিসফিস করে বলল কোনো নাম—শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। কে সেই নাম শুনল, আর কে শুনল না, তা আর বোঝা গেল না, কিন্তু মুহূর্তেই সবার মনে স্পষ্ট হলো—কালো জঙ্গলের প্রথম ছায়া তাদের ঘিরে ধরেছে।
৩
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দীর্ঘক্ষণ হেঁটে যাওয়ার পর দলটি কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। সূর্যের আলো প্রায় অদৃশ্য হয়ে এসেছে ঘন ছায়ার নিচে, আর চারপাশে সেই একই নিস্তব্ধতা—যেন পাখিরাও এখানে গান গাইতে ভয় পায়। বিশ্রামের জন্য সবাই একটা ফাঁকা জায়গায় বসলো। মাটির ওপর শুকনো পাতা, কিছু উঁচু গাছের শেকড় বেরিয়ে আছে, আর মাঝখানে অদ্ভুতভাবে উঁচু হয়ে থাকা একটা অংশ মাটির নিচে লুকোনো কোনো কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছিল। প্রান্ত কৌতূহলবশত তার লাঠি দিয়ে ওই জায়গাটা খুঁটতে শুরু করলো। অন্যরা প্রথমে বাধা দিলেও কৌতূহল দমন করতে পারলো না। কয়েক মিনিট পরই মাটির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটি ভারী পাথরের ফলক, ধুলো-মাটি আর শ্যাওলায় ঢাকা। রাহুল আর অর্ণব মিলে সেটি পরিষ্কার করার চেষ্টা করলো। ধীরে ধীরে পরিষ্কার হতেই দেখা গেল সেখানে খোদাই করা আছে অদ্ভুত সব অক্ষর, যেগুলো অনেকটা সংস্কৃত বা পালি ভাষার মতো, কিন্তু একেবারে একরকম নয়। রাহুল, যে ইতিহাস পড়েছে, চোখ কুঁচকে পড়ার চেষ্টা করলো, তারপর ধীরে ধীরে অনুবাদ করল বাক্যগুলো—“এখানে যার নাম পড়বে, সে আর বাঁচবে না।”
প্রথমে সবাই হেসে উঠলো। সজল হেসে বলল, “আরে, এ তো সিনেমার কাহিনি! এরকম লাইন তো ভূতের গল্পে সবসময় থাকে।” রুবাইয়া ঠাট্টা করে যোগ করল, “তাহলে কি এখন থেকে নাম ডাকা যাবে না? কে জানে, ভূত এসে ধরে নিয়ে যাবে নাকি?” হালকা হাসি-ঠাট্টায় মুহূর্তটা ভরে গেলেও ভেতরে ভেতরে সবার বুকেই শীতল স্রোত বয়ে গেল। এই জঙ্গলের অদ্ভুত পরিবেশ আর নিস্তব্ধতা মিলিয়ে কথাগুলো একেবারেই মজা মনে হচ্ছিল না। নীলা চোখ কুঁচকে ফলকটা দেখে ফিসফিস করে বলল, “তোমরা খেয়াল করেছ? অক্ষরগুলোর চারপাশে যেন লালচে দাগ লেগে আছে। মনে হচ্ছে রক্তের দাগ।” বাকিরা বিষয়টাকে এড়িয়ে গেলেও, এক অদ্ভুত অস্বস্তি যেন চেপে ধরল চারপাশকে। সবাই চুপচাপ বসে ছিল, কেবল প্রান্ত আবার পড়ার চেষ্টা করছিল, আর রাহুল বলছিল এটা হয়তো প্রাচীন কোনো সতর্কবাণী, মানুষের ভয় বাড়ানোর জন্য রাখা। তখনই হঠাৎ গাইড সঞ্জয়, যিনি এতক্ষণ নীরব ছিলেন, একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, “এসব বাজে কথা বাদ দিন। চলো সামনে যাই।”
কিন্তু সেই মুহূর্তেই ঘটে গেল অদ্ভুত ঘটনা। প্রান্ত হেসে মজা করতে করতে অনিচ্ছাকৃতভাবে উচ্চারণ করে ফেলল—“এই তো, সঞ্জয় ভাইয়ের নাম যদি লেখা হতো, তাহলে তো শেষ।” কথাটা বলামাত্রই চারপাশের হাওয়া যেন হঠাৎ থমকে গেল। পাতার মর্মরধ্বনি থেমে গেল, পাখির ডাক নেই, কেবল ভয়ানক নীরবতা। সঞ্জয় থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন, চোখে অস্বস্তির ছাপ। বাকিরা প্রথমে হাসলেও পরের মুহূর্তেই গা ছমছমে অনুভূতি তাদের চেপে ধরল। যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাদের ওপর দিয়ে বয়ে গেল। সবাই কিছুক্ষণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল, কেউ কিছু বলল না। শিউরে ওঠা এক শূন্যতা ঘিরে ধরল দলটিকে। রুবাইয়া মুখে বলল, “এগুলো কাকতালীয় ছাড়া আর কিছুই নয়।” কিন্তু তার কণ্ঠে কোনো দৃঢ়তা ছিল না। তারা কেউই তখন বুঝতে পারেনি, আসল খেলার শুরু হয়ে গেছে। গোপালগঞ্জের কালো জঙ্গলে চাপা পড়ে থাকা সেই প্রাচীন লিপি তাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে, আর সেই মজা করে উচ্চারিত সঞ্জয়ের নাম হবে অভিশাপের প্রথম শিকার।
৪
জঙ্গলের গভীরে সেদিন সূর্য অস্ত গেল অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতায়। দলের সবাই তখন ক্লান্ত ও ভীত, যদিও তারা সরাসরি ভয় প্রকাশ করছিল না। সঞ্জয় গাইড বললেন, “এখন আর এগোনো ঠিক হবে না, এখানেই রাত কাটাতে হবে।” তাঁর কণ্ঠে ক্লান্তি ছিল, কিন্তু এক ধরনের জোরও, যেন তিনি দলের নিয়ন্ত্রণ রাখতে চাইছিলেন। সবাই মিলে এক ফাঁকা জায়গায় তাঁবু গেড়ে শিবির তৈরি করল। শুকনো কাঠ জোগাড় করে আগুন জ্বালানো হলো, যাতে অন্তত চারপাশটা কিছুটা আলোকিত থাকে। আগুনের শিখায় মুখগুলো অদ্ভুতভাবে লালচে হয়ে উঠছিল, আর চারপাশের অন্ধকার যেন আরও গাঢ় হয়ে আসছিল। প্রথমে সবাই মজা করে কথা বলতে লাগল—কে কী রান্না করবে, কার হাতে টর্চ থাকবে, এসব নিয়ে। কিন্তু একটু পরেই নীরবতা নেমে এলো। প্রত্যেকের মনে তখনও বাজছিল সেই অভিশপ্ত ফলকের লেখা: “এখানে যার নাম পড়বে, সে আর বাঁচবে না।” যতই তারা বিষয়টাকে উপেক্ষা করতে চাইছিল, ততই মনে হচ্ছিল ছায়ার আড়ালে কেউ যেন দাঁড়িয়ে শোনছে তাদের আলাপ।
মাঝরাতে চারপাশে নিস্তব্ধতা আরও ভারী হয়ে উঠল। জঙ্গলের গাছগুলো বাতাসে দুলছিল, কিন্তু অদ্ভুতভাবে কোনো শব্দ হচ্ছিল না, যেন শব্দগুলো কোথাও আটকে গেছে। দলের অধিকাংশই ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল, কেবল সঞ্জয় জেগে ছিলেন। তিনি শুয়ে থেকেও বারবার উঠে বসছিলেন, চোখে উৎকণ্ঠার ছাপ ছিল স্পষ্ট। প্রায় রাত বারোটার দিকে আচমকা দূরে থেকে ভেসে এলো এক কর্কশ, ভৌতিক চিৎকার। সেই চিৎকার এত অস্বাভাবিক ছিল যে দলের সবাই আঁতকে উঠল। তারা বুঝতে পারছিল না, সেটি মানুষ নাকি পশুর শব্দ, কিন্তু ভয়াবহতায় শরীর কাঁপিয়ে দিল সবাইকে। চিৎকার শোনার মুহূর্তেই তাঁবুর ভেতর আলো নিভে গেল কয়েক সেকেন্ডের জন্য, আবার জ্বলে উঠল, আর সেই মুহূর্তেই তারা দেখল—সঞ্জয় মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। নিথর, সম্পূর্ণ স্থির। তার চোখদুটো খোলা, কিন্তু তাতে কেবল ভয়ের ছাপ—যেন মৃত্যুর আগে তিনি এমন কিছু দেখেছেন, যা ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা তাঁর ছিল না।
ঘটনাটা দেখে কেউ প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিল না। রুবাইয়া কাঁপতে কাঁপতে সঞ্জয়ের শরীর নেড়ে দেখল, কোনো সাড়া নেই। অর্ণব হাত বাড়িয়ে তার নাড়ি পরীক্ষা করল, একেবারে থেমে গেছে। তখন সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল—কেউ কাঁদল না, কেউ চিৎকার করল না, যেন ভয় তাদের কণ্ঠই কেড়ে নিয়েছে। নীলা অবশেষে ভেঙে পড়ে বলল, “এটা কাকতালীয় নয়… আমরা সবাই জানতাম কী হতে যাচ্ছে।” সেই কথা শুনে বাকিরা হঠাৎ করেই শিউরে উঠল। আসলেই, কয়েক ঘণ্টা আগে প্রান্ত মজা করে উচ্চারণ করেছিল সঞ্জয়ের নাম, আর সেই লিপিতে লেখা ছিল, “এখানে যার নাম পড়বে, সে আর বাঁচবে না।” এখন যখন সঞ্জয় মৃত, তখন আর হাসি বা অবিশ্বাসের জায়গা নেই। দলের প্রত্যেকের মনে তখন একটাই প্রশ্ন প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল—পরবর্তী শিকার কে? কালো জঙ্গলের অভিশাপ যেন তাদের ঘিরে ধরেছে, আর এই অন্ধকারের মধ্যে থেকে বাঁচার কোনো পথ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
৫
নিশ্ছিদ্র অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে চারপাশে কেবল পাতার নড়াচড়া আর দুর্বল বাতাসের সুর বাজছিল। সঞ্জয়ের মৃত্যু যেন এক ধাক্কার মতো তাদের সকলকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে। তার নিথর দেহ, চোখে ভয় আর মুখে অর্ধ-বিস্ময়ের ছাপ, যেন বারবার তাদের সামনে ফিরে আসে। দলটি ভয়ের গাঢ় আচ্ছাদনে ভর করে, প্রত্যেকের পদক্ষেপ যেন নতুন হুমকির আশঙ্কায় থেমে যাচ্ছিল। চারপাশের পরিচিত পথগুলো অচেনা মনে হচ্ছিল, যেন জঙ্গল নিজেই তাদের বোধ ও দিশাকে ধোঁয়াশা করে দিচ্ছিল। তারা চেষ্টা করছিল সঠিক পথে এগোতে, কিন্তু যেকোনো পদক্ষেপের পর তারা ফিরে আসছিল সেই একই স্থানে। মনের ভেতরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল সঞ্জয়ের শেষ কথা—“এখান থেকে কেউ বেরোতে পারবে না”—যা যেন কেবল শব্দ নয়, বরং এক ধরণের আধ্যাত্মিক অভিশাপ হয়ে তাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। বাতাসে ভেসে আসা অদ্ভুত গন্ধ, অচেনা আওয়াজ, আর পাতার নড়াচড়া তাদের অজান্তেই ক্রমশ আতঙ্কের দোলাচল বাড়াচ্ছিল। প্রত্যেকের শরীরে কাঁপন আর মনকে দখল করা এক অদৃশ্য থরথরানি, যেন এই জঙ্গল শুধু একটি স্থান নয়, বরং এক সচেতন প্রাণ হয়ে তাদের উপর নজর রাখছে।
দলটি যেভাবে এগোচ্ছিল, সেই পথ যেন তাদেরকে নিজের পাঁয়তারা খেলাচ্ছিল। তারা এক মুহূর্তে মনে করছিল, তারা ঠিকমতো এগোচ্ছিল, আর পরের মুহূর্তে আবার একই গাছের তলায়, একই পাথরের পাশে ফিরে আসছিল। প্রত্যেকজনের চোখে ভয়, কপালে ঘাম, আর হৃদয়ের স্পন্দন যেন থেমে যাচ্ছিল। কেউ বলতে পারছিল না কবে ঠিক কেমন বিপদ অপেক্ষা করছে। সঞ্জয়ের মৃত্যু যেন এক অদৃশ্য চিহ্ন হয়ে দোলাচলে ঘুরছিল, প্রত্যেকের মনে একরকম ভয়ের অনুভূতি তৈরি করছিল—যেন এই জঙ্গল তাদের শিকার করার জন্য তৈরি হয়েছে। বাতাসে কেমন অদ্ভুত সুর, শীতলতা, আর আংশিক কণ্ঠস্বর মিলিত হয়ে একটি অদ্ভুত আতঙ্ক তৈরি করেছিল। কেউ কেউ জোরে চিৎকার করতে চাইছিল, কিন্তু তাদের মুখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। কেউ হঠাৎ থেমে দাঁড়াচ্ছিল, যেন ভিতরের ভয় তাকে স্থির করে দিচ্ছিল। তারা বুঝতে পারছিল, এই আতঙ্ক শুধু বাস্তব নয়, বরং তাদের মনে তৈরি এক জাল, যা আসল পথকে অচেনা করে দিচ্ছে।
বছরের এই নির্জন রাতে, চারপাশে চুপচাপ অন্ধকার আর ভৌতিক নীরবতার মাঝে তারা নিজেদের এক অদৃশ্য বন্দি মনে করছিল। তারা একে অপরের দিকে তাকাতেই পাচ্ছিল না, কারও চোখে যেন হতাশার ছায়া, আর কারও মন কেবল এই ভয়ের মাঝে আটকে গেছে। সঞ্জয়ের মৃত্যু কেবল একটি ঘটনা নয়, এটি যেন তাদের সবার উপর এক শক্তিশালী মানসিক চাপ হয়ে উঠেছে, যা প্রতিটি পদক্ষেপকে আরও জটিল করে তুলছিল। প্রতিটি গাছ, প্রতিটি ছায়া যেন একটি নতুন হুমকি হয়ে সামনে আসছিল। তারা বুঝতে পারছিল, যদি এক মুহূর্তের জন্যও সাহস হারায়, তারা এই অভিশপ্ত জঙ্গলের বাইরে বের হতে পারবে না। অথচ পথ খুঁজতে গিয়ে তারা ক্রমশ হারাচ্ছিল নিজেদের দিশা ও স্বাভাবিকতা। এমন একটি পরিস্থিতিতে আতঙ্ক যেন নিজেই একটি প্রানী হয়ে তাদের চারপাশে ঘুরছিল, তাদের মনকে ধীরেধীরে দখল করে নিচ্ছিল। অবশেষে তারা বুঝতে পারল, এ পরিস্থিতি কেবল দেহের জন্য নয়, বরং মন ও আত্মার জন্যও এক ভয়ঙ্কর পরীক্ষণ। প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি নিশ্বাস, প্রতিটি চিৎকার—সবকিছু যেন একটি ভয়ঙ্কর চক্রে তাদের আটকে রাখছিল।
৬
রাতের অন্ধকার বনে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এসেছে। প্রথম শিকার সঞ্জয়ের মৃত্যুর পর, দলটি স্বাভাবিকভাবেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল, তবুও তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের সাহস জড়ো করে সামনে এগোচ্ছিল। ঠিক এই সময়, নীলা—একটি সাহসী, কৌতূহলপূর্ণ মনোভাবের তরুণী—নিজের কৌতূহল প্রকাশ করতে গিয়ে লিপির সঙ্গে ঠাট্টা করতে শুরু করল। সে মনে করল, হালকা হেসে মজার ছলে এই অদ্ভুত পরিস্থিতিকে সামলানো যায়। কিন্তু হঠাৎই সে এক মুহূর্তে ঠাট্টার ছলে নিজের নাম বলে ফেলল। এই সাধারণ ঘটনা, যা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কারো জন্যও বিপদ সৃষ্টি করে না, এখন যেন এক ভয়ঙ্কর সংকেত হয়ে উঠল। চারপাশে থাকা সবাই হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো, মনের ভিতরে এক অজানা শীতলতার অনুভূতি ঘনিয়ে উঠল। হাওয়ার দম বন্ধ করা শান্তি এবং গাছের নড়াচড়া, সবকিছু যেন একবারে ভয়ে বদলে গেল। এক অদৃশ্য শক্তি যেন তাদের কণ্ঠের প্রতিধ্বনিকে ধরল এবং নীলাকে লক্ষ্য করল।
পরের মুহূর্তে, একটি অদ্ভুত কম্পন বনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। নীলার হাত-মুখের দৃষ্টান্ত, হাসি, এবং সাহসী ঠাট্টা—সবকিছু যেন অদ্ভুতভাবে স্তব্ধ হয়ে গেল। হঠাৎ তার শরীর ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠে যায়, আর মাটির সাথে স্পর্শ হারিয়ে ফেলে। দলটি মর্মাহত হয়ে যায়, কেউ কিছু বলার সাহস পাননি। প্রত্যেকের চোখে বিভ্রান্তি ও আতঙ্কের মিশ্রণ দেখা গেল। তারা চিৎকার করতে চাইলেও শব্দ যেন গলায় আটকে গেল। নীলার দিকে দৌড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু পদে পদে যেন এক অদৃশ্য শক্তি তাদের থামাচ্ছিল। ঝোপঝাড়, গাছ, আর মাটির প্রতিটি অংশ যেন তার উপস্থিতি লুকিয়ে রাখছে। হাওয়ার মধ্যে এক অদ্ভুত শীতলতা বয়ে চলছিল, যা শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও ভয় তৈরি করছিল। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, এবং মনে হচ্ছিল, বন নিজেই একটি প্রানী হয়ে তাদের চারপাশে বেঁধে ফেলেছে।
অবশেষে, নীলার দেহ কোথাও পাওয়া গেল না। দলটি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, প্রত্যেকের চোখে অসহায়তা এবং আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। কেউ জানত না, তার সাথে কী ঘটেছে, এবং কোন দিকে তাকালে পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। মনে হচ্ছিল, বন কেবল স্থান নয়, বরং এক চেতনাসম্পন্ন অভিশপ্ত জায়গা, যা নিজের শিকার খুঁজে বের করে তার জীবন চুরি করে নেয়। প্রথম শিকার সঞ্জয়ের মৃত্যু কেবল একটি শিখন ছিল, কিন্তু নীলার অদ্ভুত নিখোঁজ হওয়া সবাইকে বুঝিয়ে দিল, তারা একেবারেই এক অজানা শক্তির মাঝে আটকা পড়েছে। আতঙ্কের মাত্রা এত বেশি যে তারা একে অপরের দিকে তাকাতেই পারছিল না, প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি শব্দ যেন নতুন বিপদের সংকেত বহন করছিল। চারপাশের অন্ধকার আর অজানা নীরবতা যেন তাদের মনকে ধীরে ধীরে দখল করছিল, এবং প্রত্যেকের মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল—পরবর্তী শিকার কে হবে?
৭
রাতের অন্ধকার এবং বনের গাঢ় নীরবতার মধ্যে দলটি ক্রমশ এক অদ্ভুত আতঙ্কে আটকা পড়ে। নীলার নিখোঁজ হওয়া এবং সঞ্জয়ের মৃত্যু তাদের মনে গভীর ছাপ ফেলে। তারা বুঝতে পারে, শুধু সঞ্জয় বা নীলার নয়, বরং যেকোনো নাম উচ্চারিত হলেই সেই ব্যক্তি শিকার হতে পারে। এই ভয়ংকর আবিষ্কার তাদের মনকে এক নতুন স্তরে আতঙ্কিত করে। দলটি একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, লিপিটিকে যত্ন সহকারে পুঁতে দেওয়ার চেষ্টা করতে। কিন্তু যত তারা চেষ্টা করে, লিপির চারপাশে ক্রমশ অদ্ভুত ছায়ামূর্তি দেখা দিতে থাকে। কখনো তা হঠাৎ লাফ দিয়ে দৌড়ে চলে যায়, কখনো কোনো নির্দিষ্ট স্থানে স্থির হয়ে থাকে, যেন তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ছায়াগুলি শুধুই চোখে দেখা নয়; তাদের উপস্থিতি মানসিকভাবে দলটিকে দমিয়ে রাখে, হঠাৎ কাঁপন আর ঘামের সৃষ্টি করে। তাদের মধ্যে কেউ বলে, এই ছায়া যেন অতীতের কোনো প্রাচীন শক্তির আবির্ভাব। এই শক্তি তাদেরকে শুধু ভয় দেখাচ্ছে না, বরং এক অদৃশ্য চক্রে আটকে ফেলছে।
যতক্ষণ তারা লিপিকে পুঁতে রাখার চেষ্টা করে, ততক্ষণ ছায়ামূর্তিগুলি আরও ঘন হয়। গাছের ডাল, ঝোপঝাড়ের নড়াচড়া, বাতাসের অদ্ভুত সুর—সবকিছু যেন এক অশরীরী উপস্থিতিকে নির্দেশ করছে। দলটির মধ্যে একজন নীরব হয়ে মাটিতে বসে থাকে, আরেকজন চিৎকার করার চেষ্টা করে, কিন্তু শব্দ যেন বাতাসে হারিয়ে যায়। তাদের মন ও দেহ এক সঙ্গে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে, এবং প্রত্যেকের মধ্যে একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল—এই অভিশপ্ত জঙ্গল কি তাদের প্রাণ কেড়ে নেবে? কেউ বলেন, প্রাচীন যুগে এই অঞ্চল ছিল এক রাজার কবরস্থান, যেখানে বিশ্বাসঘাতকদের উপর অভিশাপ দেওয়া হয়েছিল। এই কথার ছাপ দলটির মধ্যে ভয়ের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। তারা বুঝতে পারে, শুধুই লিপি বা নামের উচ্চারণ নয়, বরং এই বন এক প্রাচীন, শাস্তিমূলক শক্তির অধিকারী, যা এখনও জীবন্ত এবং তাদের উপর নজর রাখছে।
দলটি ক্রমশ বুঝতে শুরু করে যে তাদের একমাত্র উপায় হলো লিপিকে কেন্দ্র করে ছায়ামূর্তিগুলির উপস্থিতি ও কার্যকারিতা বোঝা। তারা একে অপরকে সমর্থন করতে চেষ্টা করে, কিন্তু প্রত্যেকের মনে আতঙ্কের ছায়া এত গভীর যে একে অপরের কথা বোঝা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। লিপি পুঁতে দেওয়া হলেও, ছায়ামূর্তিগুলি যেন আরও সক্রিয় হয়ে উঠছে, তাদের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে এবং প্রতিটি নাম উচ্চারণের আগে এক অদৃশ্য প্রহরী হয়ে দমিয়ে দিচ্ছে। রাতের অন্ধকার, বন এবং অশরীরী উপস্থিতি একত্রে একটি মনস্তাত্ত্বিক দমনের প্রেক্ষাপট তৈরি করে, যেখানে দলের প্রত্যেক সদস্য শুধু নিজের জীবন বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা বুঝতে পারে, একমাত্র সাহস এবং একাত্ম চেষ্টার মাধ্যমে এ অভিশপ্ত জঙ্গল থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব। কিন্তু আতঙ্কের ঘোর, অশরীরী শক্তি এবং প্রাচীন অভিশাপের ছায়া ক্রমশ তাদের মন ও দেহকে দখল করে নিচ্ছে, এবং প্রত্যেক মুহূর্তে মনে হচ্ছে, পরবর্তী শিকার কোনো মুহূর্তেই তাদের মধ্যে হতে পারে।
৮
রাতের অন্ধকার জঙ্গলে দলটি ক্রমশ নিজেকে ভীতসন্ত্রস্ত অনুভব করতে লাগল। নীলার নিখোঁজ এবং সঞ্জয়ের মৃত্যুর পর আতঙ্ক যেন তাদের রক্তে মিশে গেছে। অশরীরী ছায়া, প্রতিটি গাছের ছায়া, বাতাসের অদ্ভুত সুর—সবকিছু তাদের মনে এক গভীর ভয় জন্মাচ্ছিল। তারা বুঝতে পারছিল, একমাত্র উপায় হলো এই অভিশপ্ত বন থেকে দ্রুত পালানো। তবুও, বনের পথ যেন তাদের প্রতি পদক্ষেপে অচেনা হয়ে উঠছিল। প্রত্যেকটি পদক্ষেপ তাদেরকে যেন একই জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে। তারা হতাশ হয়ে পড়ছিল, মনে হচ্ছিল যে বন নিজেই তাদেরকে আটকে রেখেছে। দলটি বুঝতে পারছিল, শারীরিক শক্তি যথেষ্ট নয়, মন এবং সাহসও প্রয়োজন। হঠাৎ একজন বলে, “যদি আমরা একত্র থাকি, হয়তো কিছুটা সুরক্ষা পাবো।” তবে আতঙ্কের মাত্রা এত বেশি ছিল যে একে অপরের পাশে থাকা, কথা বলা বা পরিকল্পনা করাও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। বাতাসের নীরবতায় অদ্ভুত আওয়াজ, পাতা নড়াচড়া, দূর থেকে আসা ছায়ামূর্তির ছায়া—সবকিছু যেন তাদের উপর ক্রমশ চাপ সৃষ্টি করছে।
পালানোর চেষ্টার মধ্যে তাদের দল বিভক্ত হয়ে যায়। কেউ কেউ দ্রুত ছুটে যায়, কেউ কেউ গাছের পেছনে লুকিয়ে যায়। বিভক্ত হওয়ায় তাদের ভীতি আরও বাড়ে। প্রত্যেকটি শব্দ, যেটি আগে কখনও তাদের ভয় দিত না, এখন মনে হচ্ছিল প্রাণহানি ঘটানোর মতো। হঠাৎ কোথাও কোনো শব্দ, বা কোনো অজানা ছায়া, প্রত্যেকের রক্তকে জমাট করে দিচ্ছিল। কেউ হেসে, কেউ চিৎকার করে নিজেকে সাহস দেয়ার চেষ্টা করলেও আশেপাশের অশরীরী উপস্থিতি সেই সাহসকে ভেঙে দিচ্ছিল। প্রত্যেকের মন ক্রমশ আতঙ্কের জালে আটকে যাচ্ছিল। আরেকজন দলের সদস্য ভুলে নিজের নাম উচ্চারণ করল। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সে শ্বাসরোধে কেঁপে ওঠে এবং মাটিতে ধাক্কা খেয়ে নিথর হয়ে পড়ে। এই ঘটনা পুরো দলের মধ্যে এক চরম আতঙ্ক তৈরি করে। তারা বুঝতে পারল যে, নাম উচ্চারণ করা একমাত্র মৃত্যুর পূর্বাভাস নয়, বরং এক অদৃশ্য শক্তির ডাকে আত্মসমর্পণ করা।
ভয়ের মধ্যেও দলটি এগোতে বাধ্য ছিল। তারা একে অপরকে ডাকছিল, চিৎকার করছিল এবং পথ খুঁজতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপ তাদের জন্য বিপদ তৈরি করছিল। জঙ্গলের ঘন অন্ধকারে প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি শব্দ যেন তাদের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। প্রত্যেকটি গাছ, ঝোপঝাড় আর পাথর যেন অশরীরী উপস্থিতির প্রহরী হয়ে গেছে। তাদের দৃষ্টি ক্রমশ বিভ্রান্ত হয়ে যায়, এবং তারা বুঝতে পারে, পালানো কেবল শারীরিক নয়, বরং মানসিক ও আধ্যাত্মিকও হতে হবে। বাতাসের হাওয়ার সাথে মিশে থাকা অদ্ভুত শব্দগুলো তাদের মনকে দমিয়ে রাখছিল। এই অবস্থায় তারা বুঝতে পারে, বন কেবল স্থান নয়, বরং এক চেতনা, এক অভিশপ্ত শক্তি, যা তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করছে। ক্রমশ প্রত্যেকের মনে আতঙ্কের ঘর জাগ্রত হয়, এবং প্রত্যেক মুহূর্তে মনে হয়, পরবর্তী শিকার তারা নিজেই হতে পারে। পালানোর এই কঠিন প্রচেষ্টা, বিভ্রান্তি, আতঙ্ক এবং মৃত্যুর হুমকি—সবকিছু একসাথে তাদের মনে এক গভীর মানসিক ভাঙন সৃষ্টি করে, যা তাদের চেতনাকে ধীরে ধীরে দখল করে নিচ্ছে।
৯
দূরদূরান্তর অন্ধকারের মধ্য দিয়ে দলটি ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল, তাদের মধ্যে বাকিরা বেঁচে থাকলেও আতঙ্কের ছায়া ক্রমশ ঘন হয়ে উঠছিল। নাম উচ্চারণের ভয়, অশরীরী উপস্থিতির আতঙ্ক, এবং নীলার নিখোঁজ হওয়া—সবকিছু তাদের মনে এক অদৃশ্য চাপ সৃষ্টি করেছিল। প্রত্যেকটি গাছ, ঝোপঝাড় এবং বাতাসের আওয়াজ যেন ক্রমশ তাদের দিকে নজর রাখছিল। হঠাৎ তারা জঙ্গল গভীরে একটি অদ্ভুত ধ্বংসাবশেষ দেখতে পায়। ধ্বংসস্তূপের মাঝে কিছু বালির স্তূপ, ভাঙা মৃৎপাত্র এবং পুরাতন মন্দিরের ভগ্নপ্রায় স্তম্ভ—সবকিছু একটি অজানা রহস্যের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। দলের সকলেই চুপচাপ হয়ে গেল। তারা বুঝতে পারল, এটি সাধারণ কোনো ধ্বংসাবশেষ নয়, বরং এক প্রাচীন, অভিশপ্ত স্থানের চিহ্ন। বাতাসে অদ্ভুত শীতলতা, চারপাশের অন্ধকার, এবং অজানা ছায়ামূর্তিগুলি যেন তাদের মানসিকভাবে প্রভাবিত করছিল। এখানে এসে তাদের মনে হয়, তারা যে অদৃশ্য শক্তির মধ্যে আটকা পড়েছে, তার মূল কেন্দ্র খুঁজে পেয়ে গেছে।
ধ্বংসাবশেষের মধ্যেই তারা একটি প্রাচীন স্তম্ভে খোদাই করা লিপি দেখতে পায়। ধীরে ধীরে তারা বুঝতে পারে, এই লিপিই তাদের সকল সমস্যার মূল। লেখা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করছে, “এই লিপি তৈরি হয়েছিল এক অভিশপ্ত যাজকের দ্বারা, যিনি জীবদ্দশায় বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি দেয়ার জন্য মৃত্যুর পরও প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন।” দলের মধ্যে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে আসে। তাদের মনে হয়, এই যাজকের আত্মা এখনও মুক্তি পায়নি, আর তার প্রতিশোধের শক্তি এই বন ও লিপির মাধ্যমে ক্রমশ প্রাণহানি ঘটাচ্ছে। প্রত্যেকটি নাম, প্রত্যেকটি শব্দ, প্রতিটি পদক্ষেপ—সবই যেন তার অভিশপ্ত শক্তিকে সক্রিয় করছে। দলের একজন সদস্য আরও পড়ে দেখল, লিপিতে লেখা আছে যে এই যাজক একমাত্র তার লিপির মাধ্যমে পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগ রাখে এবং আত্মার শান্তি পায়নি। এই আবিষ্কার তাদের মনকে মর্মাহত করে, কারণ তারা বুঝতে পারে, শুধু পালানোই সম্ভব নয়; তারা এক অদৃশ্য শক্তির কেন্দ্রে ঢুকে পড়েছে, যা প্রতিটি মুহূর্তে তাদের প্রাণের উপর নজর রাখছে।
জঙ্গল ও ধ্বংসাবশেষের সংযোগ তাদের মনে নতুন প্রশ্নের জন্ম দেয়। তারা ভাবতে থাকে, এই অভিশপ্ত যাজকের লিপি তৈরি হওয়ার পেছনের উদ্দেশ্য কি শুধুই শাস্তি, নাকি আরও কোনো গভীর রহস্য আছে? তাদের চোখে ধ্বংসাবশেষের প্রতিটি ভাঙা স্তম্ভ, মাটির ফাটল, এবং পুরাতন মৃৎপাত্র যেন কিছু বলতে চাচ্ছিল। বাতাসের মধ্যে হালকা কণ্ঠস্বর, অদ্ভুত ছায়া, এবং বনভূমির নীরবতা—সবই তাদের মনে আতঙ্ক এবং কৌতূহলের মিশ্রণ সৃষ্টি করছিল। তারা বুঝতে পারে, এখানে পৌঁছানো মানে শুধু একটি শারীরিক গন্তব্য নয়; এটি এক মানসিক ও আধ্যাত্মিক পরীক্ষা, যেখানে বেঁচে থাকা তাদের জন্য এক চূড়ান্ত চ্যালেঞ্জ। তারা যতদূর সম্ভব সতর্ক হতে চেষ্টা করে, লিপির পাঠ অনুযায়ী বুঝতে চেষ্টা করে যে কিভাবে এই অভিশপ্ত শক্তির কেন্দ্র থেকে বের হওয়া সম্ভব। কিন্তু অভিশপ্ত যাজকের ছায়া, লিপির শক্তি, এবং ধ্বংসাবশেষের অশরীরী উপস্থিতি ক্রমশ তাদের মনকে দখল করতে থাকে, এবং তারা বুঝতে পারে যে, পরবর্তী পদক্ষেপে একমাত্র ভুলই তাদের জন্য প্রাণঘাতী হতে পারে।
১০
রাতের অন্ধকার জঙ্গলে বাতাসের মধ্যে এক অদ্ভুত কম্পন ছড়িয়ে পড়েছে। প্রথম থেকেই যারা বেঁচে ছিল, তারা ক্রমশ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে এগোচ্ছিল। নীলার নিখোঁজ, সঞ্জয়ের মৃত্যু, এবং অশরীরী ছায়ামূর্তির আতঙ্ক—সবকিছু তাদের মনে গভীর ভয়ের ছাপ রেখেছে। অবশেষে, দল থেকে মাত্র দু’জনই বেঁচে থাকে, তারা ক্রমশ ক্লান্ত, ঘা, ভয়, এবং হতাশার মধ্যে ভেসে চলছিল। তাদের সামনে যে ধ্বংসাবশেষ এবং অভিশপ্ত লিপি খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল, সেটিই তাদের একমাত্র আশ্রয় এবং একই সঙ্গে মৃত্যুর সম্ভাবনার কেন্দ্র। তারা বুঝতে পারে, এই লিপিই সকল মৃত্যুর কারণ। তাই তারা লিপিটিকে ভেঙে ফেলে, গুঁড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। হাত জ্বলে, ঘাম গড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু তারা চূড়ান্ত চেষ্টা করতে বাধ্য। ঠিক সেই মুহূর্তে আকাশে প্রচণ্ড ঝড় ওঠে। বজ্রপাতের শব্দে জঙ্গল কেঁপে উঠছে, বাতাসে বৃষ্টি আর দমকা হাওয়া যেন তাদের শরীর ও মনকে এক সঙ্গে দমিয়ে রাখছে।
ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলের মধ্যে আগুন ধরে যায়। শুকনো গাছপালা এবং ঝোপঝাড় একে একে শিখায় ঢেকে যাচ্ছে। লিপি ভাঙার চেষ্টা চলতেই থাকে, কিন্তু আগুন এবং বজ্রপাত তাদের প্রচেষ্টা আরও বিপজ্জনক করে তোলে। তারা একে অপরকে ধরে রাখে, কিন্তু ঝড়ের তাণ্ডব এবং আগুনের বিস্তার তাদেরকে পৃথক করে দেয়। বাতাসে ধোঁয়ার গন্ধ, জ্বালাপোড়ার শব্দ, বজ্রপাতের আঘাত—সবকিছু যেন এক ভয়ঙ্কর, জীবন্ত প্রহরী হয়ে তাদের চারপাশে ঘুরছে। তারা চিৎকার করে, সাহায্য চাইতে চায়, কিন্তু শব্দ বাতাসে হারিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হয়, অশরীরী ছায়ামূর্তি, অভিশপ্ত যাজকের শক্তি, এবং প্রকৃতির তাণ্ডব একত্র হয়ে তাদের আত্মাকে নিপীড়ন করছে। প্রতিটি পদক্ষেপে তাদের মনে হয়, আগুনের শিখা তাদের নিঃশ্বাস চুরি করে নেবে, আর বজ্রপাতের শক্তি শেষ করে দেবে তাদের জীবন।
শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, তারা চিৎকার করে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে, তাদের মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। তাদের চিৎকার ক্রমশ কালো অন্ধকারের সঙ্গে মিলিয়ে যাচ্ছে, যেন কোন শব্দই বেঁচে থাকছে না। তারা শেষ পর্যন্ত লিপি ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয় কিনা, সেটি স্পষ্ট নয়। ধোঁয়া, আগুন, বজ্রপাত, এবং অশরীরী শক্তির ছায়া—সবই তাদের চারপাশে এক চরম আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করছে। কোনো পথের শেষ নেই, কোনো রেহাই নেই। কালো অন্ধকারে কেবল শোনা যায় সেই অভিশপ্ত শাপের প্রতিধ্বনি—“এখানে যার নাম পড়বে, সে আর বাঁচবে না…”। এটি যেন শেষ নয়, বরং এক চিরস্থায়ী, মর্মস্পর্শী হুমকির ঘোষণা। প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি শব্দ, এবং প্রতিটি নামের উচ্চারণের ভয়, সেই রাতের শেষ চিরস্থায়ী আতঙ্কের প্রতিফলন হয়ে জঙ্গল ও পাঠকের মনে নেমে আসে, যা কখনো ম্লান হয় না।
শেষ