Bangla - ভূতের গল্প - রহস্য গল্প

গোপন বেহালা

Spread the love

শান্তিনিকেতনের আকাশে সেই রাতে চাঁদের আলো ম্লান, যেন সেও কোনো অজানা শোকের আভাস বহন করছে। গ্রীষ্মের শেষ প্রান্তে শরতের হালকা শীতল হাওয়া এসে পৌঁছেছে, চারপাশে অদ্ভুত এক নীরবতা, মাঝে মাঝে শুধু দূরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। মজুমদার বাড়িটি লাল ইটের পুরনো দোতলা, চারদিকে শিউলি আর শিরীষ গাছ, যেগুলোর ছায়া পড়ে গেছে বাড়ির বারান্দায়। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা নাগাদ হঠাৎই ভেসে আসতে শুরু করল বেহালার সুর—এমন সুর, যা একদিকে কোমল অথচ তীব্র বেদনা বহন করছে। প্রতিবেশীরা প্রথমে ভেবেছিল অনিন্দ্যবাবু হয়তো নতুন কোনো রাগ নিয়ে পরীক্ষা করছেন, কারণ তিনি প্রায়ই গভীর রাতে সঙ্গীত চর্চা করতেন। কিন্তু এই সুরে ছিল অন্যরকম কিছু—মধ্যখানে সুর হঠাৎ থেমে গিয়ে আবার উঠছে, যেন কারও কান্না বেহালার তারে মিশে গেছে। পাশের বাড়ির সুমিত্রাদি, যিনি বহুদিন ধরে অনিন্দ্যবাবুর সুর শোনার অভ্যস্ত, সেই রাতে নিজের শোবার ঘরের জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন বাড়ির ভেতরকার আলো অদ্ভুতভাবে কাঁপছে, যেন মোমবাতির শিখা বাতাসে কেঁপে উঠছে।

সেই রাতের সুর প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলল। একসময় হঠাৎ থেমে গেল, আর তার পরের নীরবতায় শোনা গেল কেবল শিউলি গাছের পাতায় বাতাসের সরসরানি। কেউ সাহস করে তখন দরজা ঠেলে ঢোকার কথা ভাবল না; অনিন্দ্য মজুমদার শান্তিনিকেতনের এক সম্মানিত সংগীতশিক্ষক, এবং তাঁর নিভৃতচারি স্বভাবের জন্য লোকেরা তাঁকে সবসময় ব্যক্তিগত পরিসরে অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছে। তবে পাশের বাড়ির অনিরুদ্ধ, যিনি তরুণ ও কিছুটা কৌতূহলী, অদ্ভুত সুরের সমাপ্তি ও অস্বাভাবিক নীরবতা দেখে খেয়াল করলেন, অনিন্দ্যবাবুর ঘরের জানালার ভেতরকার ছায়াগুলো একেবারে থেমে গেছে। ভোর হতে না হতেই প্রথম খবরে আসা ব্যক্তি ছিলেন গৃহপরিচারিকা কল্পনা। তিনি যখন মূল দরজায় কড়া নাড়লেন, কোনো সাড়া এল না। দরজা ভেজানো থাকলেও খোলা ছিল; ভেতরে ঢুকে যে দৃশ্য তাঁর সামনে এল, তা জীবনে ভোলার নয়—বসার ঘরে একটি লোহার চেয়ারে বসে আছেন অনিন্দ্য মজুমদার, চোখ বন্ধ, ঠোঁটে অদ্ভুত এক শান্ত-তবু জমাট বাঁধা অভিব্যক্তি, হাতে যেন এখনও বেহালা বাজানোর ভঙ্গি ধরা আছে, যদিও বেহালাটি তখন কাচের আলমারির ভেতরে, তারগুলো অদৃশ্য কোনো হাওয়ায় সামান্য কাঁপছে।

খবরটি মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ল। কয়েকজন প্রতিবেশী ও আত্মীয় দ্রুত জড়ো হলেন। কেউ বলল, হয়তো হার্ট অ্যাটাক হয়েছে; আবার কেউ ফিসফিস করে বলল, এত শান্ত মুখমণ্ডল, কোনো যন্ত্রণার চিহ্ন নেই—এটা কি স্বাভাবিক মৃত্যু? কিন্তু যা সকলকে সবচেয়ে বেশি অস্বস্তিতে ফেলল, তা হল সেই কাচের আলমারির ভেতরের দৃশ্য। বেহালাটি যেন অদৃশ্য হাতে ধরা, তারগুলো খুব সূক্ষ্মভাবে দুলছে, কিন্তু ঘরে একটুও বাতাস নেই। আলমারির কাচে ম্লান প্রতিফলনে দেখা যাচ্ছিল জানালার ফ্রেম, বারান্দার গাছের ছায়া, আর তার মাঝখানে অস্পষ্ট এক নারীমূর্তি—যা কেউ স্পষ্টভাবে দেখল না, তবু উপস্থিত সকলেই অনুভব করল। ইনস্পেক্টর তপন চক্রবর্তী ঘটনাস্থলে এসে চারপাশ পরীক্ষা করলেন, জানালার কপাট বন্ধ, দরজার বাইরে বা ভেতরে জোরপূর্বক প্রবেশের কোনো চিহ্ন নেই। ঘরের তাপমাত্রা আশেপাশের তুলনায় অস্বাভাবিকভাবে কম, যেন কেউ ভেতরে অদৃশ্য বরফের টুকরো রেখে গেছে। আর সবার মনে সেই রাতের করুণ সুর বাজতে লাগল, যা এখন মনে হচ্ছে কেবল সুর নয়—বরং কোনো পুরনো, হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠের হাহাকার। অনিন্দ্য মজুমদারের শেষ সুর সেই রাতেই যেন অদৃশ্য ইতিহাসের দরজা খুলে দিয়েছিল।

শান্তিনিকেতনের আকাশে সেদিন সন্ধ্যার আলো যেন অস্বাভাবিকভাবে ম্লান হয়ে এসেছিল। বাতাসে মিশে ছিল একধরনের গুমোট শূন্যতা, যেন পুরো আশ্রমিক শহরটাই শোকে আচ্ছন্ন। অনিন্দ্যের মৃত্যুসংবাদ ইতিমধ্যেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, আর সেই খবরে যেন প্রতিটি ইট-পাথরও কাঁপছে। অনিন্দ্যের বাড়ির বারান্দায় বসে কবিতা মজুমদার স্তব্ধ হয়ে আছেন, তাঁর চোখদুটি লাল আর ক্লান্ত, কিন্তু চোখের জল যেন আর বেরোতে চায় না—অত্যধিক কান্নার পর যখন মানুষের অশ্রু শুকিয়ে যায়, তখন যে শূন্যতা তৈরি হয়, তাঁর মুখে সেই অভিব্যক্তি। হাতে একটা ভাঁজ হয়ে যাওয়া শাড়ির আঁচল, সেটাই তিনি বারবার মুখের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন, হয়তো অজান্তেই, যেন অনিন্দ্যের শেষ গন্ধটুকু খুঁজে নিতে চাইছেন। দরজায় উপস্থিত কয়েকজন প্রতিবেশী নিচু স্বরে সান্ত্বনার কথা বললেও তাঁর কানে সেগুলো ঠিকমতো পৌঁছাচ্ছে না। এই সময়েই তিনি ধীরে ধীরে ফোন তুলে নেন, আর কাঁপা গলায় ঋতব্রত সেনকে কল করেন। ঋতব্রত ফোন ধরতেই তিনি ফিসফিস করে বলেন, “আপনাকে একটা কথা বলব, মৃত্যুর আগের কয়েক রাত ধরে… বেহালার শব্দ আসত, আর সঙ্গে একজন নারীর গলা… ঠিক ঘুমের আগে শুনতাম।” তারপর তিনি যেন আর কথাটা শেষ করতে পারলেন না, গলাটা আটকে গেল, আর ফোনের ওপারে শুধু ঋতব্রতের নীরব শ্বাসপ্রশ্বাস শোনা গেল।

ঋতব্রত কলকাতায় ছিলেন, এক অসমাপ্ত কেসের নথিপত্র গুছিয়ে রাখছিলেন। গুরু অনিন্দ্যের মৃত্যুসংবাদ তিনি আগেই পেয়েছিলেন, কিন্তু কবিতার কণ্ঠে সেই অদ্ভুত বর্ণনা শুনে তাঁর শরীরের মধ্যে হালকা শীতল স্রোত বইতে লাগল। বেহালার শব্দ—তা হলে কি এটা নিছক কাকতালীয়, নাকি কোনো গভীর রহস্যের ইঙ্গিত? তিনি জানতেন, অনিন্দ্য শুধু তাঁর গুরুই নন, বরং জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষদের একজন। আর তাই, এই মৃত্যুকে তিনি শুধু একটি প্রাকৃতিক ঘটনা বলে মেনে নিতে পারলেন না। বুকের ভেতরে যেন হঠাৎ করে একরাশ দায়িত্বের চাপ এসে জমল—সত্যটা জানতেই হবে। তিনি পরদিনের প্রথম ট্রেনের টিকিট বুক করলেন, কাগজপত্র, নোটবুক, আর ছোট্ট একটি রেকর্ডিং ডিভাইস ব্যাগে ভরে নিলেন। রাতটা তাঁর জন্য খুব দীর্ঘ ছিল; জানালার বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল, আর ভেতরে তিনি বারবার সেই বেহালার সুর কল্পনা করছিলেন, যা তিনি নিজে শোনেননি, কিন্তু কবিতার ভাঙা কথাগুলোই যথেষ্ট ছিল এক অজানা ভয় জাগানোর জন্য।

পরদিন সকালে শান্তিনিকেতনের মাটিতে পা রাখতেই তাঁর মনে হলো, এই শহর যেন তাঁকে চেনে, আবার চিনতেও চায় না। আশ্রমের পথঘাট, লাল মাটির ধুলো, তালগাছের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি মারা শালবন—সবই একই রকম, অথচ এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা যেন চেপে বসে আছে। অনিন্দ্যের বাড়ি তখন শোকের ভারে স্তব্ধ। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা কবিতা তাঁকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন, কিন্তু চোখে কোনো আলো নেই। ঘরের ভেতর ঢুকতেই ঋতব্রত অনুভব করলেন, বাতাসে যেন কোনো এক অদৃশ্য গন্ধ আছে—যেন পুরোনো কাঠ, ধূপের ধোঁয়া আর শুকনো ফুলের মিশ্রণ। তিনি চুপচাপ বসে কবিতার কাছ থেকে মৃত্যুর আগের দিনগুলোর বিস্তারিত শুনতে লাগলেন। কবিতা বললেন, “বেহালাটা শুধু সুর তুলত না, সেই সুরে যেন কান্না মিশে থাকত… আর নারীকণ্ঠ… যেন আমাকে ডাকত।” ঋতব্রতের মনের মধ্যে প্রশ্নের ঝড় বয়ে গেল—কে সেই নারী? কেন এই সুর অনিন্দ্যের শেষ দিনগুলোতে প্রতিরাতে শোনা যেত? তিনি জানতেন, এই তদন্ত তাঁকে শুধু রহস্যের মুখোমুখি নয়, বরং গুরুজির অতীতের এক অজানা অধ্যায়ের সামনে দাঁড় করাবে। আর সেই অদেখা সত্যের ছায়া ইতিমধ্যেই তাঁর চারপাশে ঘনিয়ে এসেছে।

শর্মিষ্ঠা পাল যেন আজও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, তাঁর প্রিয় শিক্ষক অনিন্দ্য স্যার আর নেই। ছোটোখাটো গড়ন, সাদা চুলের মাঝে লালচে আভা, আর চোখে সদা জ্বলজ্বলে কৌতূহল—এমন একজন মানুষকে মৃত অবস্থায় পাওয়া তাঁর পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব ছিল। ঘটনাটার কথা বলতে বলতে তাঁর গলা কেঁপে যাচ্ছিল, আর সেই কণ্ঠস্বরের ভেতরে এক অদ্ভুত চাপা আতঙ্ক লুকিয়ে ছিল। তিনি জানালেন, মৃত্যুর মাত্র দুইদিন আগে, অনিন্দ্য স্যার তাঁকে ডাকেন তাঁর সঙ্গীতঘরে, যা একসময় ছিল পুরনো পড়ার ঘর, পরে নানা দেশের বাদ্যযন্ত্রে ভরে ওঠে। ঘরে ঢুকেই শর্মিষ্ঠার চোখ চলে গিয়েছিল কোণের কাঠের কেবিনেটের দিকে—সেখানে রাখা ছিল একটি অদ্ভুত, পুরনো কাঠের বেহালা, যার গায়ে যেন সময়ের দাগ স্পষ্ট। স্যার সেটি ধীরে ধীরে বের করে হাতে তুলে নিলেন, যেন বহুদিনের প্রিয় বন্ধুকে স্পর্শ করছেন। তিনি মৃদু হাসি দিয়ে বললেন, “এই বেহালায় শুধু সুর বাজে না, বাজে ইতিহাস—যা সবাই শুনতে পায় না। কিন্তু যে শুনতে পাবে, সে হয়তো বদলে যাবে।” কথাটা শুনে শর্মিষ্ঠা কৌতূহলী হলেও ভয়ও পেয়েছিলেন; স্যারের গলায় এমন এক ধরণের গম্ভীরতা ছিল, যা তাঁর আগে কখনও শোনা হয়নি। স্যার ধীরে ধীরে বেহালার তারে আঙুল বুলিয়ে দিলেন, আর ঘরটা যেন মুহূর্তে ঠান্ডা হয়ে এল। সুর ওঠেনি, কিন্তু সেই নীরবতার ভেতরে শর্মিষ্ঠা যেন অদ্ভুত এক চাপা স্পন্দন টের পেলেন।

পরের দিন স্কুল শেষে শর্মিষ্ঠা চুপিচুপি স্যারের সঙ্গীতঘরে ঢুকে পড়েন। জানালার বাইরে ছিল মেঘলা আকাশ, কাচের গায়ে বৃষ্টির ছোটো ফোঁটাগুলো টুপটুপ করে পড়ছিল, আর ভেতরে ছায়ার মতো আলো-অন্ধকার খেলা করছিল। কেবিনেটের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি দরজা খুললেন, আর ঠান্ডা কাঠের গন্ধ তাঁর নাকে এসে লাগল। হাত কাঁপতে কাঁপতে তিনি সেই বেহালাটি বের করলেন; যেন কোনও নিষিদ্ধ জিনিস স্পর্শ করছেন। কাঠের গায়ে আঙুল বোলাতেই তাঁর শরীরে এক অদ্ভুত শিরশিরানি বয়ে গেল, আর মনে হল, এই বেহালাটি তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল বহুদিন ধরে। শর্মিষ্ঠা ধীরে ধীরে সেটি কাঁধে তুলে নিলেন, ধনুকটি তারে রাখলেন, আর প্রথম সুরটি তুলতেই ঘরটা যেন এক অদ্ভুত শীতল হাওয়ায় ভরে গেল। সেই হাওয়া সাধারণ হাওয়া ছিল না—তার ভেতরে ছিল এক গভীর শ্বাসের শব্দ, যেন কেউ তাঁর খুব কাছে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। কয়েক মুহূর্ত পরে শোনা গেল ক্ষীণ কিন্তু হৃদয়বিদারক কান্না, যা ধীরে ধীরে চারদিক থেকে ঘনিয়ে আসতে লাগল। শর্মিষ্ঠার আঙুল থমকে গেল, কিন্তু সুর থামল না—যেন বেহালা নিজেই বাজছে, তাঁর ইচ্ছার বাইরে। সেই কান্নার শব্দ কখনও কিশোরীর মতো, কখনও বৃদ্ধার মতো শোনাচ্ছিল, আর তার সঙ্গে মিশে ছিল কোনও এক দূরের যুদ্ধক্ষেত্রের মতো শব্দ—লাঠির আঘাত, চিৎকার, আর ভাঙচুর। তিনি আতঙ্কে বেহালাটি নামাতে চাইলেন, কিন্তু হাত যেন তার সঙ্গে আটকে গিয়েছিল। কপালে ঠান্ডা ঘাম জমে গেল, চোখে জল চলে এল, আর হঠাৎ করেই সব শব্দ থেমে গেল—মৃত নীরবতা নেমে এল ঘরে।

বেহালাটি নামিয়ে রাখার পরও শর্মিষ্ঠা অনুভব করছিলেন, সেই ঠান্ডা বাতাস যেন তাঁর চামড়ায় লেগে রয়েছে। দরজা দিয়ে বেরোবার সময় তাঁর মনে হল, কেউ তাঁর পিছু নিচ্ছে—পায়ের শব্দ নেই, কিন্তু উপস্থিতি স্পষ্ট। তিনি দ্রুত পা চালালেন, কিন্তু বুকের ভেতর ভয় যেন জমাট বেঁধে রইল। বাড়ি ফিরে তিনি চেষ্টা করলেন ঘটনাটা ভুলে যেতে, কিন্তু সেই কান্নার শব্দ যেন কানে বাজতেই থাকল। পরদিন স্কুলে স্যারকে কিছু বলতে চাইলেও, তিনি আর সাহস পাননি। আর সেই রাতেই ঘটে গেল অনিন্দ্য স্যারের মৃত্যু—যেন সময় তাঁর জন্য থেমে গেল। শর্মিষ্ঠা বুঝতে পারলেন না, বেহালাটির সঙ্গে স্যারের মৃত্যুর কোনও যোগ আছে কিনা, কিন্তু তাঁর অন্তরের গভীরে একটা তীব্র অস্বস্তি গেঁথে রইল। এখন তিনি জানেন, সেই বেহালাটি শুধু কাঠ আর তারের সমষ্টি নয়, বরং এমন এক অদৃশ্য ইতিহাসের বাহক, যা জীবিতদের কাছে আসতে চায়—আর সেই ইতিহাসের মূল্য দিতে হয় কারও না কারও প্রাণ দিয়ে। শর্মিষ্ঠার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল কথা বলার সময়, আর চোখে ভয় মিশে ছিল—কারণ তিনি জানেন, এই গল্পটা শোনার পর হয়তো শ্রোতারাও বেহালাটির সুর শুনতে পাবে, যদি কখনও তার সামনে পড়ে যায়।

ঋতব্রত সেই বিকেলের রোদ্দুর ফিকে হতে হতে সোনালি আভা ছড়িয়ে পড়ার সময় দেবব্রত ঘোষের পুরনো দোতলা বাড়িতে পৌঁছালেন। লোহার গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই কানে এলো ভেজা পাতার গন্ধ আর দূরে বাগানের মধ্যে বাতাসে দুলে ওঠা জুঁইফুলের গন্ধ। দেবব্রত ঘোষ—একসময় শহরের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ, এখন সত্তরের কাছাকাছি বয়স, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, মুখে সময়ের খোদাই করা রেখা, তবু কণ্ঠে এমন মাধুর্য যে মুহূর্তেই মানুষকে আপন করে নিতে পারে। বসার ঘরে ঢুকতেই দেয়াল জুড়ে পুরনো বাদ্যযন্ত্রের সংগ্রহ—বেহালা, ম্যান্ডোলিন, হারমোনিয়াম, আর এক কোণে কাচের আলমারিতে সযত্নে রাখা এক অদ্ভুত বেহালা, যার কাঠের গায়ে হালকা লালচে আভা, যেন ভেতরে কোনো অদৃশ্য রক্ত সঞ্চালিত হচ্ছে। চা আর বিস্কুটের সঙ্গে গল্প শুরু হতেই ঋতব্রত বেহালাটির দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “এটাই কি সেই বেহালা?” দেবব্রত চশমার কাচ মুছতে মুছতে মৃদু হাসলেন—“হ্যাঁ, এরই কথা শুনতে চেয়েছিলেন না?” তাঁর চোখে তখন দূরের এক অতীতের আলো-আঁধারি স্মৃতি ভেসে উঠেছে।

“১৭৮৯ সাল,” দেবব্রত ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন, যেন প্রতিটি শব্দের ভেতর দিয়ে এক ইতিহাস জেগে উঠছে, “এক ফরাসি সুরকার ছিলেন—লুই ডেভে। প্যারিসের রাজসভায় তিনি ছিলেন অন্যতম সেরা বেহালাবাদক। কিন্তু তাঁর জীবনের সব আলো ছিল তাঁর প্রেয়সী ক্লারা। ক্লারা ছিলেন গায়িকা, তাঁর গলায় ছিল এমন জাদু যে রাজসভা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ—সবাই মুগ্ধ হয়ে যেত। কিন্তু ভাগ্য যেন হঠাৎ একদিন নিষ্ঠুর হয়ে উঠল। শীতের এক ভোরে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে ক্লারা মারা গেলেন। লুই পাগলের মতো হয়ে গেলেন, বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে তাঁর প্রিয় মানুষটি চিরদিনের জন্য চলে গেছে। সেই শোকে তিনি এমন এক কাজ করলেন, যা আজও মানুষ ফিসফিস করে বলে—তিনি এক বিশেষ কাঠ, ‘ব্লাডউড’, যা মৃত্যুর পরও সুর ধরে রাখতে পারে বলে কথিত, সেই কাঠে নিজের হাতে বেহালা বানালেন। কিন্তু শুধু কাঠ নয়—তিনি দাবি করেছিলেন, ক্লারার আত্মাকে তিনি সেই কাঠের মধ্যে বন্দি করেছেন, যাতে বেহালাটি বাজলেই ক্লারার গান শোনা যায়।” দেবব্রতের কণ্ঠে তখন ঠান্ডা শীতলতা, আর বাইরে হঠাৎ হাওয়ায় জানলার কাঁচ কেঁপে উঠল, যেন সেই কাহিনি শোনার জন্যই। ঋতব্রত অনুভব করলেন, তাঁর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।

দেবব্রত বললেন, “আমি প্রথম এই বেহালার কথা শুনি ১৯৭৮ সালে, ভিয়েনার এক পুরনো বাদ্যযন্ত্রের নিলামে। তখন এর ইতিহাস নিয়ে নানা গল্প শোনা যাচ্ছিল—কারও মতে, এটা নিছকই এক কুসংস্কার, আবার কারও মতে, যে একবার এই বেহালাকে বাজায়, সে ধীরে ধীরে তার নিজের সত্তা হারিয়ে ফেলে। আমি তখন স্রেফ কৌতূহল আর সংগীতপ্রেমের জন্য কিনে ফেলি। কিন্তু বাড়িতে আনার পর বুঝলাম, এটা শুধুই কাঠ আর তার নয়—এর ভেতরে কিছু আছে… এক ধরনের উপস্থিতি। মাঝরাতে একা বসে থাকলে মাঝে মাঝে শুনতাম, খুব দূর থেকে যেন এক নারীকণ্ঠ গান গাইছে—শব্দগুলো অস্পষ্ট, কিন্তু সুরে এমন এক বিষাদ, যা বুকের ভেতর কাঁপন ধরিয়ে দেয়। কয়েকবার সাহস করে রাত্তিরে বেহালাটি বাজানোর চেষ্টা করেছি—প্রথমে স্বাভাবিক সুর, কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যে আমার নিজের হাত কেঁপে ওঠে, আর এমন কিছু সুর বেরোয় যা আমি জীবনে বাজাইনি, বাজাতেও পারব না। তখন মনে হয়, আমি নই, অন্য কেউ বাজাচ্ছে—কেউ, যার শ্বাস আমার সঙ্গেই মিশে আছে।” দেবব্রতের গলা থেমে গেল, তিনি জানালার দিকে তাকালেন। ঋতব্রত দেখলেন, তাঁর চোখে অদ্ভুত এক মিশ্র অনুভূতি—ভয়, মুগ্ধতা আর এক ধরনের অদৃশ্য বন্ধনের কথা, যা হয়তো তাঁকে আজও সেই বেহালার সঙ্গে বেঁধে রেখেছে। আর তখনই ঋতব্রত বুঝলেন, এই কাহিনি কেবল ইতিহাস নয়—এটা এমন এক রহস্য, যা হয়তো এখনও শেষ হয়নি।

ইনস্পেক্টর তপন চক্রবর্তী প্রথম থেকেই ঘটনাটিকে সহজভাবে নেননি। বয়সে পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি, গমগমে কণ্ঠস্বর আর ক্ষুরধার চোখ—তিনি থানার সবচেয়ে অভিজ্ঞ অফিসারদের মধ্যে একজন। অনিন্দ্যের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর তিনি প্রথমে ধরে নেন, হয়তো হার্ট অ্যাটাক বা কোনো শারীরিক জটিলতার কারণে ঘটনাটি ঘটেছে। কিন্তু যখন ময়নাতদন্তের রিপোর্ট হাতে আসে, তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ে। রিপোর্টে স্পষ্ট লেখা—মৃতদেহের গলায় এবং বুকে হিমশীতল নীলচে দাগ, যা সাধারণ শারীরবৃত্তীয় মৃত্যুর ক্ষেত্রে হয় না। তাপমাত্রার অস্বাভাবিকতা এতটাই প্রবল ছিল যে, চিকিৎসকরা বললেন, মৃত্যু যেন কোনো অদৃশ্য বরফের স্পর্শে হয়েছে। তপনবাবু দীর্ঘক্ষণ রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর নীরবে ফাইল বন্ধ করে ঋতব্রতের দিকে তাকালেন। “তুমি যেমন বলছ ভূতের ব্যাপারটা, আমি তা মানি না,” তিনি দৃঢ় গলায় বললেন, “কিন্তু এই দাগগুলো আমাকে ভাবাচ্ছে। এর মানে কারও হাত আছে—মানুষের হাত, কিন্তু অদ্ভুত কোনো উপায়ে।” ঋতব্রত কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তার চোখে এক ধরনের তীব্র কৌতূহল, যেন সে নিশ্চিত যে মৃত্যুর পেছনে অদৃশ্য শক্তির প্রভাব আছে। কিন্তু তপন চক্রবর্তী স্থির করলেন, তিনি যুক্তি আর প্রমাণের পথে হাঁটবেন।

তদন্ত শুরু হলো ঘটনাস্থল থেকে। অনিন্দ্যের শোবার ঘরে গিয়ে তপনবাবু খুঁটিয়ে দেখলেন প্রতিটি কোণ। জানালার কাঠের ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছিল, কিন্তু বাইরে ছিল গরমের দিন—এত ঠান্ডা আসার কোনো যুক্তি নেই। বিছানার পাশে পড়ে থাকা একটি ছোট রুপোর লকেট তাঁর নজরে এলো। লকেটের মধ্যে ছিল একটি পুরনো সাদা-কালো ছবি—এক তরুণীর, যার চোখে অদ্ভুত এক শূন্যতা। ঋতব্রত লকেট দেখে বলল, “এটা অনিন্দ্যের পরিবারের কেউ নয়।” তপনবাবু ছবিটি পকেটে রেখে দিলেন, এবং ঘরের বাইরে গিয়ে বাড়ির অন্য সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। পরিবারের সবাই এককথায় জানাল, অনিন্দ্যের ঘরে কেউ ঢোকে না, আর সে মৃত্যুর আগের রাতটিতে কারও সঙ্গে কথাও বলেনি। কিন্তু আশেপাশের প্রতিবেশীদের জেরা করতে গিয়ে জানা গেল, রাত বারোটার দিকে বাড়ির ভেতর থেকে এক ধরনের শীতল হাওয়া বেরিয়ে আসছিল, সঙ্গে হালকা শাঁখ বাজানোর শব্দ। এই কথায় তপনবাবু স্পষ্ট বিরক্ত হলেন—তিনি অতিপ্রাকৃত তত্ত্ব শুনতে চান না, কিন্তু সাক্ষীদের বক্তব্য তিনি ফেলে দিতেও পারলেন না। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই “ঠান্ডার উৎস” খুঁজে বের করতেই হবে।

এরপরের কয়েকদিনে তদন্ত তীব্র রূপ নিল। তপন চক্রবর্তী ফরেনসিক টিম ডেকে আনলেন, যারা ঘরের দেয়াল, মেঝে, এমনকি বাতাসেরও তাপমাত্রা পরীক্ষা করল। বিস্ময়করভাবে, অনিন্দ্যের ঘরের এক কোণে তাপমাত্রা বাইরের চেয়ে ১২ ডিগ্রি কম পাওয়া গেল—যেন সেখানে অদৃশ্যভাবে বরফ জমে আছে। ঋতব্রত এই ফলাফল পেয়ে কিছুটা হাসল, কিন্তু তপনবাবু মুখ গম্ভীর রেখেই বললেন, “এখনও প্রমাণ হলো না যে এটা ভূতের কাজ। বরং এর পেছনে কোনো রাসায়নিক বা যান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকতে পারে।” তিনি শহরের এক রসায়নবিদের সঙ্গে কথা বলে জানলেন, কিছু বিশেষ গ্যাস ও রাসায়নিক আছে যা মুহূর্তের মধ্যে তাপমাত্রা কমিয়ে দিতে পারে এবং ত্বকে নীলচে দাগ ফেলতে পারে। এই সূত্র ধরে তিনি খোঁজ শুরু করলেন, কে বা কারা এমন জিনিসের নাগাল পেতে পারে। একই সঙ্গে তিনি লকেটের ছবিটির উৎস খুঁজতে লাগলেন। পুরনো নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেল, ছবির তরুণীটি প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে এই বাড়িতেই মারা গিয়েছিলেন, এবং তাঁর মৃত্যুর পরিস্থিতি ছিল প্রায় একই রকম—গলায় ও বুকে হিমশীতল দাগ। এই মিল দেখে তপন চক্রবর্তীর যুক্তিবাদী মনও খানিকটা কেঁপে উঠল। তিনি বুঝলেন, এই মামলার সমাধান হয়তো শুধু বিজ্ঞান দিয়ে সম্ভব নয়—এখানে ইতিহাস, রহস্য, আর হয়তো এমন কিছু শক্তি কাজ করছে যা তিনি এখনো মানতে চান না, কিন্তু অস্বীকার করতেও পারছেন না। তদন্ত আরও গভীরে ঢুকতে শুরু করল, আর প্রতিটি পদক্ষেপেই তাঁর সামনে উন্মোচিত হতে লাগল এক শীতল অন্ধকারের গোলকধাঁধা।

রাত তখন প্রায় আড়াইটা। বাইরে জানালার কাঁচে শীতের কুয়াশা ঘন হয়ে জমেছে, আর ঘরের ভেতর আলো জ্বলছে কেবল একটিমাত্র টেবিল ল্যাম্পে, যার হলুদ আভা ছড়িয়ে পড়েছে ঋতব্রতের পুরোনো কাঠের ডেস্ক আর তার ওপরে রাখা সেই অদ্ভুত বেহালাটার উপর। তিনি ধীরে ধীরে বেহালার বো অঁকড়ে ধরলেন, যেন প্রতিটি মুহূর্তের স্পর্শে কোন প্রাচীন প্রতিশ্রুতি পূরণ হচ্ছে। প্রথমে ধীরে, তারপর একটু একটু করে তীব্রতায়, সুর ভেসে উঠতে লাগল। কিন্তু এ সুর সাধারণ নয়—প্রতিটি নোট যেন ঘরের দেয়াল ভেদ করে দূরের অন্ধকার গলিপথ, কুয়াশায় ঢাকা প্রাচীন প্রাসাদ আর অদেখা কারও স্মৃতির ভিতর গিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। ঠিক তখনই, সেই সুরের সাথে মিশে ভেসে আসতে লাগল এক মৃদু নারীকণ্ঠ—স্বচ্ছ, মায়াবী, আর simultaneously দূরের মতো, আবার কানে ফিসফিসের মতো কাছে। ঋতব্রত প্রথমে অবাক হয়ে ভাবলেন, হয়তো কোথাও থেকে কোনও রেডিও চালু আছে বা পাশের ফ্ল্যাটে কেউ গান শুনছে। কিন্তু শব্দটা যতই পরিষ্কার হতে লাগল, ততই তাঁর বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত শিহরণ ছড়িয়ে পড়ল—কারণ এই গান তিনি আগে কখনও শোনেননি, আর ভাষাটাও চেনা নয়। তবুও সেই সুরে এমন এক ব্যথা, এমন এক আকুলতা ছিল, যা ভাষার সীমানা ছাড়িয়ে গিয়ে সরাসরি তাঁর মনকে গ্রাস করল।

ঋতব্রত কৌতূহল আর ভয়ের মাঝামাঝি অবস্থায় বেহালা বাজাতে থাকলেন, যেন সুর থামিয়ে দিলে কিছু হারিয়ে যাবে, অথবা কোনও অদৃশ্য বন্ধন ছিঁড়ে যাবে। নারীকণ্ঠটি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে লাগল—সেটি ছিল কোনও পুরনো ইউরোপীয় ভাষা, হয়তো ফরাসি বা জার্মান, কিন্তু উচ্চারণে যেন শতাব্দীর ধুলোমাখা ঘ্রাণ লেগে আছে। প্রতিটি শব্দ যেন একেকটি দীর্ঘশ্বাস, যা হারানো ভালোবাসা, অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি আর মৃত্যুর পরেও থেকে যাওয়া ব্যথার গল্প বলে। ঋতব্রতের মাথায় এক মুহূর্তে ঝড় বয়ে গেল—কেন এই গান কেবল তাঁর কানে শোনা যাচ্ছে? তিনি তাড়াতাড়ি ডেস্ক থেকে তাঁর পোর্টেবল রেকর্ডারটা এনে চালু করলেন। লাল লাইট জ্বলে উঠল, আর তিনি বেহালার বো চালাতে চালাতে রেকর্ডারটি সামনে রাখলেন। কিন্তু গানের অংশটা রেকর্ডারে ধরা পড়ল না—শুধু বেহালার স্বাভাবিক তারের শব্দ আর এক ধরনের শোঁ শোঁ শব্দ ভেসে এলো প্লেব্যাকে, যেন দূরের কোনও সমুদ্রতটে ঝড় উঠেছে। এই বৈপরীত্যে তাঁর বুকের ভেতর ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে এক প্রবল রহস্যজিজ্ঞাসা জন্ম নিল। রেকর্ডার ব্যর্থ হয়েছে মানে, এই শব্দটি হয়তো বাস্তব নয়, অন্তত মানুষের কান ছাড়া অন্য কোনও যন্ত্রে ধরা পড়ে না।

সেই রাতে ঋতব্রতের মনে হচ্ছিল, তাঁর চারপাশের দেয়াল আর ছাদ যেন আরও কাছে চলে আসছে, আলো যেন নিভে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। সুর আর সেই কণ্ঠের মিশ্রণ তাঁর মনে এক অদ্ভুত ছবি আঁকতে লাগল—একটি অচেনা প্রাসাদের লম্বা হলওয়ে, মোমবাতির ক্ষীণ আলো, কালো পোশাকের এক নারী দাঁড়িয়ে আছেন জানালার পাশে, বাইরে তুষারপাত। তিনি বেহালার সুরে গান করছেন, আর জানালার ওপার থেকে কেউ তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। ঋতব্রত হঠাৎ অনুভব করলেন, তাঁর আঙুল কাঁপছে, তবুও বো থামাতে পারছেন না। মনে হচ্ছিল, যদি থেমে যান, তবে সেই নারী হয়তো চিরতরে মিলিয়ে যাবেন, আর কোনওদিনই তাঁর গান শোনা যাবে না। কিন্তু বাজাতে বাজাতে তাঁর শরীরের মধ্যে শীতের ঠাণ্ডা ঢুকে পড়ল, যেন ঘরের তাপমাত্রা হঠাৎ কয়েক ডিগ্রি নেমে গেছে। শিরদাঁড়া বেয়ে সেই ঠাণ্ডা ধীরে ধীরে উঠতে লাগল মাথার দিকে। তিনি অনুভব করলেন, তাঁর পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে—নিঃশব্দে, কিন্তু উপস্থিতি এতটাই তীব্র যে তাঁর ঘাড়ের পশম খাড়া হয়ে গেল। ঋতব্রত সাহস করে পিছনে তাকাতে চাননি; শুধু সুর চালিয়ে যেতে লাগলেন, আর গান চলতে থাকল—এমন এক ভাষায়, যা তিনি বুঝতে পারেন না, কিন্তু যার প্রতিটি শব্দ যেন তাঁর আত্মার গভীরে গিয়ে আঘাত করছিল। সেই রাতের পর বেহালাটি আর তাঁর কাছে নিছক এক বাদ্যযন্ত্র রইল না, হয়ে উঠল এক দরজা—যা খোলে অদেখা এক জগতে, যেখানে সময়, ভাষা, আর জীবন-মৃত্যুর সীমারেখা মিশে যায়।

দেবব্রতের টেবিলের ওপর ছড়ানো পুরনো চামড়ার বাঁধাই ডায়েরি, চিঠির বান্ডিল আর কয়েকটি হলুদ হয়ে যাওয়া সংবাদপত্রের কাটিং যেন অতীতের এক অদৃশ্য দরজা খুলে দিল। ম্লান আলোয় সেই পাতাগুলো থেকে ধুলো উড়ে উঠছিল, আর হালকা পুরনো কাঠের গন্ধ মিলেমিশে যাচ্ছিল বাতাসে। শুভায়ন আর দীপ টেবিলের দুই পাশে বসে ছিল, দেবব্রতের গলা যেন ধীরে ধীরে কাঁপছিল, অথচ তাঁর চোখে এক ধরনের উন্মাদ উত্তেজনা। তিনি প্রথম পাতাটা উল্টে দিলেন—তাতে সূক্ষ্ম হস্তাক্ষরে লেখা: “Louis et Clara — 1789”। দেবব্রত ব্যাখ্যা করলেন, লুই ছিলেন ফ্রান্সের এক অভিজাত পরিবারের তরুণ, আর ক্লারা ছিলেন একজন গায়িকা—যার কণ্ঠস্বর নাকি প্যারিসের রাজপ্রাসাদ থেকে শুরু করে সাধারণ লোকের হৃদয় পর্যন্ত জয় করে নিয়েছিল। ফরাসি বিপ্লব তখন জ্বলন্ত আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ছে, রাস্তায় রাস্তায় লোহার গিলোটিন বসছে, আর অভিজাত আর বিপ্লবীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী দ্বন্দ্ব চলছিল। সেই সময়ে লুই আর ক্লারার প্রেম গোপনে ফুলের মতো ফুটে উঠেছিল, কিন্তু চারদিকের রাজনীতি ও বিদ্বেষের ঝড়ে সেই ফুল কেটে ফেলার আয়োজন শুরু হয়েছিল।

দেবব্রতের কণ্ঠ গভীর হয়ে এলো যখন তিনি বললেন, “১৭৯৩ সালের এক শরতের বিকেল—প্যারিস তখন রক্তে ভিজে আছে। ক্লারা ছিলেন বিপ্লব বিরোধী হিসেবে অভিযুক্ত, যদিও তাঁর একমাত্র অপরাধ ছিল রাজপক্ষের সমর্থনে কয়েকটি গান গাওয়া। সেই সময়ের একটি চিঠি এখানে আছে…” বলে তিনি একটি পুরনো, ভাঁজ করা কাগজ খুললেন। তাতে লুই-এর হাতের লেখা—অস্পষ্ট কালিতে লেখা কিছু লাইন, যেখানে তিনি ক্লারাকে পালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। কিন্তু চিঠি গন্তব্যে পৌঁছায়নি; বিপ্লবীদের হাতে ধরা পড়ে ক্লারা। প্রকাশ্যে জনসমক্ষে তাঁর বিচার হয়, এবং পরদিন সকালেই তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। দেবব্রত থামলেন, যেন তাঁর গলায় কিছু আটকে গেছে, তারপর ফিসফিস করে বললেন, “শেষ মুহূর্তে, যখন ক্লারাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তিনি গান গাইছিলেন—একটি পুরনো লালাবাই, যা লুই প্রথম তাঁর কাছ থেকে শুনেছিলেন।” সেই গান লুই-এর মনে এত গভীরভাবে গেঁথে গিয়েছিল যে, তিনি বিশ্বাস করতেন, কোনও না কোনও ভাবে সেই কণ্ঠ চিরকাল বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। মৃত্যুর পরে লুই উন্মাদ প্রায় হয়ে যান; বলা হয়, তিনি কাঠ খোদাই করে এক বিশেষ যন্ত্র বানানোর চেষ্টা করেন, যা শব্দকে শোষণ করে রাখতে পারবে। সেই যন্ত্রের কাঠ, দেবব্রত জানালেন, আজও সংরক্ষিত আছে—এবং অনেকের মতে, তা-ই হচ্ছে সেই অদ্ভুত রেডিওর আসল উৎস।

দেবব্রত পুরনো নথি গুছিয়ে একপাশে রাখলেন, কিন্তু দীপ ও শুভায়নের চোখে তখনও যেন অতীতের ছায়া ঘুরপাক খাচ্ছে। তারা দু’জনই যেন ১৮শ শতকের সেই রক্তাক্ত প্যারিসে পৌঁছে গেছে—গিলোটিনের পাশে দাঁড়ানো জনতা, পেছনে শোনা যাচ্ছে ক্লারার কণ্ঠ, আর লুই ভিড়ের মধ্যে থেকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। দেবব্রত বললেন, “লুই-এর শেষ দিনগুলির সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্য নেই, তবে গুজব আছে, তিনি ফ্রান্স ছেড়ে ভারতে চলে আসেন এবং তাঁর সেই কাঠের যন্ত্র কোনও এক গোপন সংগ্রাহকের হাতে তুলে দেন। ওই কাঠে এখনও ক্লারার কণ্ঠ ধরা আছে—যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ম্লান হলেও, মুছে যায়নি।” দীপ সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন, আর শুভায়ন এক গ্লাস জল হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে চুমুক দিলেন। দু’জনের মনেই তখন এক অদ্ভুত শিহরণ—যদি সত্যিই সেই কাঠে ক্লারার শেষ গান বন্দি থাকে, তবে রেডিওর কণ্ঠ রহস্য নয়, বরং এক অবিনশ্বর প্রেমের প্রতিধ্বনি। কিন্তু এর মানে দাঁড়ায়, তারা যা খুঁজছে, তা শুধু একটি পুরনো যন্ত্র নয়—এটি সময়, মৃত্যু আর প্রেমের সীমানা অতিক্রম করা এক অদ্ভুত ইতিহাস।

শর্মিষ্ঠা সেদিন সন্ধ্যায় একা বসে ছিলেন পুরোনো ঘরের কোণে, জানালার ফাঁক দিয়ে গোধূলির ম্লান আলো ঢুকছিল। বেহালাটি তাঁর কোলে রাখা, কিন্তু মন দ্বিধায় ভরা—গত রাতের অদ্ভুত অভিজ্ঞতা তাঁকে ভয় এবং কৌতূহল দুই-ই দিয়েছে। অবশেষে নিজের ভেতরের অজানা টানকে অবহেলা করতে না পেরে তিনি ধীরে ধীরে ধনুকে তারের উপর রাখলেন। প্রথম সুরটি বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হালকা ঠান্ডা বাতাস বইতে লাগল ঘরের ভেতর, যদিও বাইরের গাছের পাতাগুলো স্থির ছিল। সুর যেন নিজের মতো করে বইতে লাগল, তাঁর আঙুলের নিয়ন্ত্রণ ছাড়িয়ে, আর হঠাৎই কানের ভেতর স্পষ্ট শোনা গেল এক কণ্ঠ—স্বরে এক অদ্ভুত গভীরতা, যেন বহু শতাব্দীর ক্লান্তি আর আবেদন মিশে আছে—”আমাকে মুক্তি দাও।” শর্মিষ্ঠার বুক কেঁপে উঠল, আঙুল কেঁপে গেল, আর ধনুক থমকে গেল মাঝপথে। তিনি ভেবেছিলেন, হয়তো মনের ভুল, কিন্তু শব্দটি যেন তাঁর মনের ভেতর নয়, ঘরের দেয়াল ছুঁয়ে এসে কানে প্রবেশ করেছে। কণ্ঠটি আবার বলল, এইবার আরও তীব্রভাবে, “মুক্তি দাও… আমি এখানে বন্দি।” ঠান্ডা ঘামে তাঁর হাত ভিজে গেল, আর তিনি অনুভব করলেন যেন কারও চোখ তাঁর পিঠের ওপর গেঁথে আছে, যদিও ঘরে কেউ নেই।

হঠাৎ সুর থেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের সবকিছু যেন ভারী হয়ে উঠল। শর্মিষ্ঠা বুঝতে পারছিলেন, এই অভিজ্ঞতা বাস্তব না বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু ভয় যেন তাঁর শিরদাঁড়া বেয়ে উঠছে—তিনি অনুভব করলেন, বেহালাটি আর তাঁর হাতে নেই, যেন কারও অদৃশ্য হাত তা ধরে রেখেছে। আতঙ্কে তিনি ধনুক ছেড়ে দিলেন, আর এক ঝটকায় বেহালাটি হাত থেকে পড়ে গিয়ে মেঝেতে ধপ করে পড়ল। শব্দটি সারা ঘরে প্রতিধ্বনিত হল, কিন্তু সেই সঙ্গে যেন আরও গভীর এক নীরবতা এসে ভর করল চারপাশে। শর্মিষ্ঠা উঠে দাঁড়িয়ে পিছিয়ে গেলেন, চোখ ঘরের প্রতিটি কোণে ছুটে বেড়াচ্ছে—কিন্তু সেখানে কেবল ছায়া আর ফাঁকা জায়গা। তাঁর কানে তখনও বাজছে সেই শেষ শব্দ—”মুক্তি দাও”—যেন বেহালার কাঠে, তারের ভেতর কোথাও গেঁথে আছে। বুক ধড়ফড় করতে করতে তিনি বেহালাটিকে কোণায় রেখে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন, কিন্তু পিছনে তাকানোর এক অদ্ভুত তাগিদ থামাতে পারলেন না। তাকাতেই দেখলেন, বেহালার ধনুকটি মেঝেতে পড়ে থাকলেও তার একপ্রান্ত যেন হালকা নড়ছে, যেন কেউ অদৃশ্যভাবে তা ধরেছে।

পরের দিন সকালে শর্মিষ্ঠা তাঁর এই ঘটনার কথা প্রতিবেশী ও পরিবারের লোকদের বললেন, কিন্তু কেউই গুরুত্ব দিল না। সবাই হেসে উড়িয়ে বলল, “তুমি নিশ্চয়ই একা ঘরে বসে হ্যালুসিনেশন করেছো,” বা “হয়তো বাতাসে বেহালা নিজেই কেঁপে উঠেছে।” কিন্তু শর্মিষ্ঠা জানতেন, তিনি যা শুনেছেন, তা কোনো কল্পনা নয়। রাতে ঘুমের মধ্যে তিনি বারবার সেই কণ্ঠের শব্দ শুনতে পেলেন—একই অনুরোধ, একই অসহায় আবেদন। এ যেন কোনো অদৃশ্য সাক্ষাৎ, যেখানে এক মৃত বা হারিয়ে যাওয়া সত্তা তাঁর কাছে সাহায্য চাইছে, কিন্তু কেউ বিশ্বাস করছে না। ভেতরে ভেতরে শর্মিষ্ঠার মনে এক অদ্ভুত দায়বদ্ধতা জন্ম নিল—যদি সত্যিই কোনো আত্মা এই বেহালায় বন্দি থাকে, তবে তিনি কি সেটিকে মুক্ত করতে পারবেন? ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে কৌতূহলও বাড়তে লাগল, আর সেই কৌতূহলই হয়তো তাঁকে আবার বেহালা হাতে তুলতে বাধ্য করবে, যতই প্রতিজ্ঞা করুন আর না বাজানোর। শর্মিষ্ঠা জানতেন, এই গল্প এখানেই শেষ নয়—বরং এই অদৃশ্য সাক্ষাৎই হয়তো আরও গভীর রহস্যের দরজা খুলে দিচ্ছে।

ঋতব্রত সেই রাতে তার ডেস্কের উপর ছড়িয়ে রাখা পুরনো ইউরোপীয় লোককথার বইগুলো একে একে উল্টে যাচ্ছিলেন। বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল, আর জানলার ধারে বসে শর্মিষ্ঠা চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে ছিল। কাগজের পাতা উল্টাতে উল্টাতে তিনি হঠাৎ একটি প্রাচীন ফরাসি লোকবিশ্বাসের উল্লেখ পান—“যে সুর অসমাপ্ত থেকে যায়, তার সঙ্গে বেঁধে থাকা আত্মা কখনো মুক্তি পায় না; সেই সুর সম্পূর্ণ হলে তবেই সে চিরশান্তিতে বিশ্রাম নেবে।” এই লাইন পড়ে তাঁর মেরুদণ্ড বেয়ে শিহরণ নেমে গেল। লুই-এর গল্প মনে পড়ল—তার শেষ রচিত সুর, যা মৃত্যুর আগেই থেমে গিয়েছিল, এবং মৃত্যুর পরে সেই অসমাপ্ত সুরই যেন বাঁশির ভেতরে তার আত্মাকে বন্দি করে রেখেছে। ঋতব্রত বুঝতে পারলেন, এতদিন ধরে যে সমস্ত ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্যে তাঁরা ছিলেন, তার সমাধান লুকিয়ে আছে সঙ্গীতের ভেতরেই। তিনি শর্মিষ্ঠার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমাদের সেই সুরটা শেষ করতে হবে। যতক্ষণ না আমরা তা করি, লুই মুক্তি পাবে না।” শর্মিষ্ঠা প্রথমে দ্বিধা করলেও, তার চোখের মধ্যে ছিল এক ধরনের দৃঢ়তা—যেন এতদিনের আতঙ্কের শেষ দেখার তীব্র ইচ্ছে। তাঁরা টেবিলে বসে পুরনো নোটেশনগুলো ছড়িয়ে দিলেন, আর শুরু হল লুই-এর অসমাপ্ত সুরকে পুনরায় জীবন্ত করে তোলার কাজ।

রাত গভীর হতে লাগল, কিন্তু তাঁদের দুজনের মনোযোগ অটল রইল। বাঁশির পুরনো, জং ধরা নোটেশন কাগজে যতটুকু ছিল, তা থেকে বোঝা যাচ্ছিল—লুই-এর সুরটিতে ছিল এক অদ্ভুত মিশ্রণ, যেন আনন্দ ও বেদনার সূক্ষ্ম দ্বন্দ্ব। কিছু নোট এমন ছিল, যা শুনলে মনে হত শীতল হাওয়ার মতো এক শান্তি এসে ঢেকে দিচ্ছে, আবার কিছু নোট হঠাৎই কেটে দিচ্ছিল সেই শান্তিকে, যেন শূন্যে নেমে আসছে বিষণ্ণতার ছায়া। ঋতব্রত আর শর্মিষ্ঠা বারবার চেষ্টা করছিলেন, নোটগুলো মিলিয়ে সেই অদ্ভুত ভারসাম্য ধরে রাখতে, যাতে সুরটির মূল আত্মা নষ্ট না হয়। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, ঘরের বাতাস ভারী হয়ে আসছে—জানলার কাচে কেউ যেন আঙুল বুলিয়ে দিচ্ছে, বা মেঝের তক্তা হালকা কেঁপে উঠছে। কিন্তু তাঁরা থামলেন না। বরং এই অদ্ভুত উপস্থিতি তাঁদের সঠিক পথে এগোনোর প্রমাণ হয়ে দাঁড়াল। শর্মিষ্ঠা পিয়ানোর চাবিতে আঙুল চালাচ্ছিলেন, ঋতব্রত বাঁশির স্কোরে নতুন নোট লিখে যাচ্ছিলেন, আর মাঝে মাঝে দুজনেই থেমে লুই-এর সুরের আত্মাকে অনুভব করার চেষ্টা করছিলেন।

শেষ নোটটি লেখা মাত্রই যেন পুরো ঘর নিঃশ্বাস ফেলে চুপ করে গেল। জানলার বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে, দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসছে অদ্ভুত এক উষ্ণ হাওয়া। ঋতব্রত বাঁশি হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে সুরটি বাজাতে শুরু করলেন—প্রথমে লুই-এর লেখা অংশ, তারপর তাঁদের তৈরি শেষ অংশটি। সুরটির শেষ নোট বাজানোর মুহূর্তে হঠাৎ ঘরের মাঝখানে উজ্জ্বল সোনালি আলো জ্বলে উঠল, আর এক ক্ষীণ, ধোঁয়াটে অবয়ব ধীরে ধীরে আকার নিল। লম্বা কোট পরা, মুখে প্রশান্তির হাসি—লুই। তাঁর চোখে কৃতজ্ঞতা, ঠোঁটে যেন নীরব ধন্যবাদ। তিনি বাঁশির দিকে তাকিয়ে হালকা মাথা নাড়লেন, আর মুহূর্তের মধ্যেই সেই অবয়ব মিলিয়ে গেল, যেন বাতাসে ভেসে অদৃশ্য হয়ে গেল চিরতরে। ঘরে আবার শান্তি ফিরে এল, কিন্তু শর্মিষ্ঠা ও ঋতব্রতার চোখে জল—এটি ছিল মুক্তির সুর, আর তাঁরা জানতেন, এই রাতের পর আর কোনও বাঁশির শব্দ তাঁদের তাড়া করবে না। তবে এই অভিজ্ঞতা তাঁদের জীবনে এক অমোচনীয় ছাপ রেখে গেল—যেন তাঁরা সঙ্গীতের মাধ্যমে মৃত্যুকেও শান্তি দিতে পেরেছেন।

১০

রাতটা যেন এক অদৃশ্য আয়নার ভেতর আটকে ছিল, যেখানে সময় ধীরে ধীরে গলে পড়ছে—অরণ্য আর রিদ্ধি জানত, আজকের রাতই শেষ সুযোগ। ঘরটার দরজা-জানালা বন্ধ, শুধু বেহালার কেস খোলা, ভেতরে শুয়ে আছে সেই পুরনো, সোনালি রঙের বেহালা, যার গায়ে সময়ের ধুলো জমে এক অদ্ভুত ধূসর আবরণ তৈরি করেছে। বাইরে হালকা কুয়াশা, আর ভেতরে তেলের বাতির কাঁপা আলো দেয়ালে নাচছে। রিদ্ধি বেহালাটা হাতে তুলতেই কেমন একটা শিরশিরে অনুভূতি ওর শরীর জুড়ে বয়ে গেল—মনে হচ্ছিল কাঠের ভেতরে যেন কোনো অচেনা শ্বাস আটকে আছে। অরণ্য চুপচাপ বসে ছিল, হাতের আঙুলে সিগারেটের ধোঁয়া পাক খাচ্ছে, কিন্তু চোখ বেহালার তারের ওপর নিবদ্ধ। হঠাৎ যেন বাতাস আরও ঠান্ডা হয়ে এল, অদৃশ্য কোনো উপস্থিতি ঘরটাকে ঘিরে ধরল। রিদ্ধি ধীরে ধীরে ধনুকটা তুলল, আর প্রথম সুরটা বাজতেই এক অচেনা, তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর ঘরের কোণে ভেসে উঠল—না চিৎকার, না গান, বরং এমন এক বেদনাময় দীর্ঘশ্বাস, যা শিরদাঁড়া ঠান্ডা করে দেয়।

সুরটা এগোতে থাকল, আর প্রতিটি নোট যেন অতীতের গোপন দরজা খুলে দিচ্ছিল। রিদ্ধির হাত কাঁপছিল, কিন্তু সে থামেনি। অরণ্যের মনে হচ্ছিল, দেয়ালের ফ্রেমে টাঙানো অনিন্দ্যের ছবিটা যেন একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে—চোখে ভাসছে এক চাপা অনুশোচনা, এক অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষার ছায়া। সুরের মাঝপথে ঘরের তাপমাত্রা আরও নেমে গেল, তেলের বাতির শিখা একবার নিভে যেতে গিয়েও টিকে রইল, যেন কারও জোরাজুরিতে। হঠাৎ কণ্ঠস্বরটা স্পষ্ট হয়ে উঠল—মধুর অথচ বিষাদমাখা—”শেষ করো… মুক্তি দাও…”। রিদ্ধি আর অরণ্য একে অপরের দিকে তাকাল, দু’জনের চোখে একই প্রশ্ন—এ কি সত্যিই অনিন্দ্যের আত্মা কথা বলছে? কিন্তু প্রশ্ন করার সময় ছিল না। সুরের গতি বেড়ে গেল, তারের কম্পনে বাতাস ভারী হয়ে উঠল, যেন প্রতিটি নোটে জমে থাকা শোক, ভয় আর ভালোবাসা মিশে এক অদ্ভুত তীব্রতা তৈরি করছে। বাইরে কোথাও দূরে কুকুরের ডাক ভেসে এল, আর তার সঙ্গে মিশে গেল বেহালার আর্তনাদ।

শেষ নোটের সাথে সাথে যেন পুরো ঘরে এক বিস্ফোরণ ঘটল—না, শব্দের নয়, বরং অনুভূতির। বেহালার কাঠে হঠাৎ এক চিড় ধরা শব্দ শোনা গেল, আর সোনালি রঙের আবরণ মুহূর্তের মধ্যে ফিকে হয়ে ধূসর হয়ে গেল, যেন বহু বছরের ক্লান্তি একসঙ্গে ঝরে পড়েছে। বাতাস আবার স্বাভাবিক হয়ে এল, ঠান্ডা কেটে গেল, আর সেই কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, যেন দূরের কোনো নদীর ধারে হারিয়ে গেছে। রিদ্ধির বুক ধড়ফড় করছিল, অরণ্যের চোখে ছিল অবিশ্বাস আর বিস্ময়—তারা জানত, অনিন্দ্যের মৃত্যুর রহস্যের এক বড় অংশ আজ উন্মোচিত হয়েছে। তিনি হয়তো চেয়েছিলেন এই অসম্পূর্ণ সুরের মাধ্যমে কাউকে মুক্তি দিতে, হয়তো নিজেকেই, কিন্তু কোনো এক কারণে সেটা শেষ করতে পারেননি। আজ, বহু বছর পর, সেই সুর পূর্ণ হলো—আর তার সঙ্গে মিলিয়ে গেল এক অদৃশ্য বেদনা, রেখে গেল শুধু নীরবতা আর বেহালার নিঃশ্বাস। বাইরে তখন ভোরের আলো আসছে, কিন্তু ঘরের ভেতরে যেন একটা দীর্ঘ স্বপ্নের পর শান্তির ঘুম নেমে এসেছে।

সমাপ্ত

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *