স্বপ্ননীল ভৌমিক
অধ্যায় ১:
গোধূলির সময়, যখন সূর্য পশ্চিম দিকের আকাশে ধীরে ধীরে লালিমা ছড়াচ্ছে, নদীর পাড়ে সবকিছু যেন এক অদ্ভুত নীরবতায় ভরে যায়। বালুর ওপর হালকা পদচারণার শব্দ, বাতাসে ভেসে আসা সুগন্ধি ফুলের আভাস, আর দূর থেকে লতায় লুকোচুরি খেলতে থাকা পাখিদের কিচিরমিচির—সবকিছু মিলিয়ে একটি মনোরম ছায়াময় দৃশ্য তৈরি করেছিল। সেই পাড়ের বাঁকে, যেখানে জল এবং আকাশ একে অপরের সঙ্গে খেলতে থাকে, দুই কিশোর-কিশোরী হঠাৎ করেই দেখা করল। তারা দুজনেই প্রথমবার একে অপরের চোখের সঙ্গে মিলিত হল। কিশোরীর চোখে এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস, আর কিশোরের চোখে স্নিগ্ধ কৌতূহল। এই অচেনা মিলনের মধ্যে যেন লুকানো এক রহস্যময় অনুভূতি প্রবাহিত হতে থাকে। নদীর স্রোত ধীরে ধীরে বয়ে চলছিল, কিন্তু তার সঙ্গে যেন সেই দুই হৃদয়ও এক রঙের মতো ছন্দে নেচে উঠছে। কিশোরী একটি ছোট্ট হাসি ফেলে কিশোরের দিকে তাকাল, আর কিশোর হালকা মাথা নেড়ে সেই মৃদু সাড়া ফিরিয়ে দিল। এই প্রথম কথার বিনিময় ছিল খুবই সরল, ছোট্ট, কিন্তু মনের গভীরে এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস জাগিয়ে তুলেছিল।
কথোপকথনের শুরুটা ছিল নিছক স্বাভাবিক, “তুমি কি প্রতিদিন এই নদীর ধারে আসে?”—কিশোরী তার কণ্ঠে কৌতূহল মিশিয়ে জিজ্ঞাসা করল। কিশোর হালকা হেসে উত্তর দিল, “হ্যাঁ, প্রায়ই। কখনও কখনও শুধু নদীর স্রোত শুনতে। তুমি?” তাদের কথায় যেন নীরবতার মধ্যেও এক অদ্ভুত মিলন ঘটছিল। নদীর জল শীতল, কিন্তু গোধূলির আলো তাদের চারপাশে উষ্ণতা ছড়াচ্ছিল। বাতাসের সঙ্গে তাদের চুলের নরম স্পর্শ, নদীর জলের হালকা ছোঁয়া এবং দূরবর্তী হরিতাল ছায়ার মিলনে সেই মুহূর্ত আরও গভীর হয়ে উঠেছিল। কিশোরী হঠাৎ নদীর দিকে আঙুল দিয়ে দেখল, “দেখো, কত সুন্দর রঙ!”—সূর্যের শেষ রশ্মি জলে প্রতিফলিত হয়ে যেন সোনালী কণার মতো নাচছে। কিশোরের চোখে আনন্দের দীপ্তি ফুটল, এবং সে বলল, “হ্যাঁ, মনে হয় পুরো পৃথিবী আজ এখানে এসে জমায়েত করেছে।” তাদের কথায় যেন কোনও ধরনের বিরক্তি বা ব্যস্ততার ছাপ নেই; শুধু নদী, আকাশ এবং নিজেদের হৃদয়ের ধ্বনি। এই ক্ষুদ্র আলাপের মধ্য দিয়ে তারা ধীরে ধীরে একে অপরের প্রতি আস্থা এবং প্রিয়তার প্রথম ইঙ্গিত পেয়েছিল।
নদীর পাড়ের এই মুহূর্তটি তাদের জন্য এক ধরনের অবিস্মরণীয় স্মৃতি হয়ে দাঁড়ালো। সূর্য ধীরে ধীরে অস্ত যাচ্ছে, আকাশের রঙ লাল, কমলা আর গোলাপী ছায়ায় মিশে এক মনোমুগ্ধকর চিত্র তৈরি করছে। কিশোরী তার হালকা চুলের খেয়াল করতে করতে কিশোরের দিকে চেয়ে হেসে উঠল। কিশোরও তার বুকের ভেতরের অদ্ভুত উচ্ছ্বাসকে সামলে রাখতে না পেরে হালকা করে কাঁধ কঁপাল। নদীর স্রোত অবিরাম বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তাদের কথোপকথন এবং চোখের মিলন যেন সময়কে থমকে দিয়েছে। তারা জানে না, এই প্রথম সাক্ষাতের ছোট্ট মুহূর্তটি কেবল আজকের দিনের জন্য নয়, বরং একটি দীর্ঘ যাত্রার শুরু, যেখানে প্রতিটি নদীর ঢেউ, প্রতিটি হাওয়া, প্রতিটি সূর্যাস্ত তাদের অনুভূতির সঙ্গে মিলিত হবে। নদীর ধারে সেই প্রথম পরিচয় যেন তাদের হৃদয়ে চিরস্থায়ী দাগ কাটল, আর গোধূলির সেই নরম আলো, নদীর স্রোতের সঙ্গেই মিশে তাদের এক অদ্ভুত বন্ধনের সূচনা করল, যা শুধু তাদের দুজনেই জানে, এবং নদী—একমাত্র নদী তার সাক্ষী।
অধ্যায় ২:
নদীর ধারে সেই প্রথম দেখা থেকে কিছুক্ষণ পর, কিশোর ও কিশোরী ধীরে ধীরে নিজেদের কথা খুলতে শুরু করল। সূর্যপ্রভা এখনও আকাশে ঝরছে, কিন্তু গোধূলির আলো তার আভা আরও কোমল করে তুলেছে। কিশোরী প্রথমে একটু লাজুকভাবে নিজের নাম বলল, “আমি মায়া।” কিশোরও হালকা হাসি দিয়ে উত্তর দিল, “আমি আদিত্য।” এই ছোট্ট নামের বিনিময় যেন তাদের মধ্যে একটি অদ্ভুত বন্ধনের সূচনা করল। প্রথমে সাধারণ কথায় তারা নিজেদের পরিচয় দিল—স্কুলের নাম, কোন ক্লাসে পড়ে, কোন শিক্ষকের সঙ্গে বেশি ভালো লাগে। মায়া বলল, “আমি বিজ্ঞান বিষয়টা ভালোবাসি, কিন্তু কখনও কখনও শুধু ছবি আঁকতে মন চায়।” আদিত্য হেসে বলল, “আমিও রঙের সঙ্গে খেলা পছন্দ করি, কখনও কখনও নদীর ধারে বসে রঙের খেলা করি।” এই সাধারণ বিনিময়গুলো তাদের হৃদয়ের মধ্যে ধীরে ধীরে বিশ্বাসের প্রথম রেশ জাগিয়ে তুলল। নদীর শান্ত স্রোত যেন তাদের কথার গতি মেনে চলে, কখনও নরম ছোঁয়া দিয়ে, কখনও হালকা সুর তুলিয়ে। তারা বুঝতে পারছিল যে, নদী শুধু তাদের সঙ্গী নয়, একই সঙ্গে তাদের অনুভূতির প্রতিধ্বনি।
কথা বাড়তে থাকল, এবং তারা ধীরে ধীরে ছোট ছোট শখ ও অভিজ্ঞতা ভাগ করতে লাগল। মায়া বলল, “আমার একটি ছোট্ট নোটবুক আছে, যেখানে আমি সব রঙের মিশ্রণ ও ছবি আঁকার ধারনা লিখি। কখনও কখনও নিজেকে হারিয়ে ফেলি সেই নোটবুকের পাতায়।” আদিত্য আগ্রহী হয়ে বলল, “তাহলে আমাদের একদিন একসাথে বসে সেই রঙের গল্পগুলো তৈরি করতে হবে।” এই কথায় মায়ার চোখে এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতা ফুটল। তারা গল্প করল স্কুলের বন্ধুদের, গেমের সময়, বইয়ের পছন্দ—সকল কিছু যেন হঠাৎ করেই তাদের মধ্যকার দূরত্ব কমিয়ে দিল। প্রথম বারের মতো তারা বুঝতে পারল, অন্য কেউ তাদের মতোই ভাবছে, একইভাবে হাসছে, একইভাবে জিজ্ঞাসা করছে। নদীর ধারা হালকা ঢেউ তোলে, আর বাতাসে এক ধরণের স্নিগ্ধতা ভেসে আসে, যেন প্রকৃতিই তাদের আড্ডায় অংশগ্রহণ করছে। তাদের কথোপকথন ছিল বিনয়ী, সরল, কিন্তু হৃদয়ে এমন গভীর ছাপ ফেলছিল যা তারা জানত না কতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে।
যতক্ষণ তারা নদীর পাড়ে বসে ছিল, ততক্ষণই তাদের মধ্যে ‘বিশ্বাসের বন্ধন’ ধীরে ধীরে তৈরি হতে লাগল। তারা আর একে অপরকে শুধুই অচেনা মুখ হিসেবে দেখছিল না; বরং একটি অদ্ভুত অনুভূতি জন্ম নিল, যেখানে তারা একে অপরের কথায় মনোনিবেশ করছিল। মায়া বলল, “আমাদের মনে হচ্ছে, আমরা আগেও একে অপরকে চিনতাম।” আদিত্য হালকা করে মাথা নেড়ে সম্মত হল, “হয়তো নদী আমাদের সঙ্গে রেখে দিয়েছে সেই স্মৃতির একটি অংশ।” এই মুহূর্তে নদীর স্রোত আরও শান্ত মনে হচ্ছিল, যেন সে তাদের বিশ্বাসের এই সূক্ষ্ম বন্ধনকে আশীর্বাদ করছে। সূর্য নেমে যাচ্ছিল, আকাশে লালিমার পরিবর্তে ধীরে ধীরে নীলিমা ভরে উঠছিল। কিন্তু এই প্রাকৃতিক পরিবর্তনের মাঝেও তাদের মধ্যে তৈরি হওয়া প্রথম কথোপকথনের সেই বন্ধন যেন স্থায়ী হয়ে থাকল। নদী, বাতাস, সূর্যের আলো—সবকিছু মিলিয়ে তাদের হৃদয়ের মধ্যে এক অবিস্মরণীয় স্মৃতি তৈরি করল, যা শুধু তাদের দুজনেরই জানা, আর সেই বিশ্বাসের মৃদু স্পন্দন—যা এক দিনও মিলনকে ভাঙতে পারবে না।
অধ্যায় ৩:
প্রতিদিন গোধূলির সময়, যখন সূর্য তার শেষ রশ্মি দিয়ে আকাশের ধূসর আড়ালকে গোলাপী ও কমলার নরম রঙে রাঙাচ্ছে, মায়া ও আদিত্য আবার নদীর ধারে দেখা করতে আসত। তারা জানত, এই সময়টুকুই তাদের একমাত্র নিরাপদ জায়গা, যেখানে কেউ তাদের উপস্থিতি নজর রাখে না। নদীর ধারে বালুর ওপর বসে তারা প্রথমে চুপচাপ সময় কাটাত, নদীর ঢেউ এবং হাওয়ার সাথে মিলিয়ে। কখনও কখনও তারা নদীর জলে ছোট্ট পাথর ছুড়ে তার লাফানো ঢেউ পর্যবেক্ষণ করত, আবার কখনও ফুলের পাপড়ি ছুড়ে নদীর স্রোতের সঙ্গে তার ভেসে যাওয়া দেখত। এই ছোট ছোট খেলাগুলো তাদের জন্য এক ধরনের অবাধ স্বাধীনতা তৈরি করেছিল, যেখানে তারা শুধু নিজেদের হয়ে থাকতে পারত। ধূসর আকাশের আড়াল যেন তাদেরকে ঢাকা দিচ্ছিল, শহরের ব্যস্ততা ও মানুষের চোখের বাইরে রেখে। কখনও মায়া হেসে বলত, “দেখো, পাথরটা কত উঁচুতে লাফাল!” আর আদিত্য হালকা করে মাথা নেড়ে উত্তর দিত, “হ্যাঁ, এবং নদীও যেন খুশি হচ্ছে আমাদের সঙ্গে।” তাদের এই ছোট্ট বিনোদনগুলো শুধু মজা নয়, বরং এক অদ্ভুত বন্ধন ও আস্থা তৈরি করছিল।
গোধূলির সেই মুহূর্তগুলোতে তারা নিজেদের গল্প এবং অভিজ্ঞতা ভাগ করতে লাগল। মায়া বলল, “আজ স্কুলে এমন কিছু ঘটল, যা কেউ জানে না।” আদিত্য আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কি ঘটল?” এবং মায়া তার চোখে এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতা নিয়ে গল্প শুরু করল। আদিত্য মন দিয়ে শুনছিল, মাঝে মাঝে হেসে বা ভয় পাওয়া দেখিয়ে প্রতিক্রিয়া দিত। তাদের কথোপকথনে নদীর ধীরে চলা স্রোত যেন যোগ দিচ্ছিল, কখনও নরম ছোঁয়া দিয়ে, কখনও হালকা সুর তুলে। তারা হঠাৎ বুঝতে পারল, এই গোধূলির আড়াল শুধু একটি সময় নয়, বরং তাদের হৃদয়কে একে অপরের কাছে নিয়ে আসার সেতু। তারা জানত, বাইরে থেকে কেউ তাদের পর্যবেক্ষণ করছে না, তাই তারা নিজেদের ভেতরের অনুভূতি এবং স্বপ্নগুলো খোলাখুলিভাবে শেয়ার করতে পারত। কখনও তারা নদীর পাশে বসে নীরবতা উপভোগ করত, শুধুই নদীর ঢেউ এবং বাতাসের সঙ্গেই মিলিয়ে। ধূসর আকাশের আড়ালে তাদের এই নীরব খেলা, গল্প, এবং হাসি যেন এক অদৃশ্য জাল বোনা শুরু করেছিল—যা তাদের বন্ধনকে আরও শক্তিশালী করে তুলছিল।
প্রতিদিনের এই গোধূলির আড়ালে তাদের সম্পর্ক ধীরে ধীরে গভীর হয়ে উঠছিল। পাথর, ফুল, গল্প বা হাওয়ার সাথে মিলিত তাদের হাসি—সবকিছু যেন এক নির্দিষ্ট ছন্দে বাঁধা। এক সময় তারা অনুভব করল, এই নদীর পাড় যেন তাদের নিজস্ব জগৎ, যেখানে কেবল তারা দুজনই আছেন। কখনও কখনও তারা একে অপরের চোখে তাকিয়ে হাসি বিনিময় করত, এবং সেই ছোট্ট মুহূর্তগুলো তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত নিরাপত্তা এবং আস্থা তৈরি করত। ধূসর আকাশ, নদীর স্রোত, হালকা বাতাস এবং গোধূলির আলো—সবকিছু মিলিয়ে একটি দৃঢ় এবং মধুর স্মৃতি তৈরি করছিল। মায়া হেসে বলল, “আমি মনে করি নদী আমাদের কথা সব জানে।” আদিত্য হালকা করে মাথা নাড়ল এবং উত্তর দিল, “হ্যাঁ, এবং মনে হয় সে আমাদের খুশি দেখতে চায়।” এই কথায় নদীর স্রোত যেন আরও নরমভাবে ভেসে যায়, তাদের মাঝে তৈরি হওয়া বিশ্বাসের বন্ধনকে জোরদার করে। গোধূলির আড়াল শুধু তাদের দেখা এবং খেলাধুলার জায়গা নয়, বরং একটি শান্ত, গভীর ও অদৃশ্য বন্ধনের স্থান হয়ে উঠেছিল, যা তারা দুজনই চিরকাল মনে রাখবে।
অধ্যায় ৪:
নদীর ধারে প্রতিদিনের সেই পরিচিত দৃশ্যের মধ্যে, মায়া ও আদিত্য ধীরে ধীরে নিজেদের ভেতরের আবেগকে খুলে দিতে শুরু করল। গোধূলির আলো তাদের চারপাশে নরম কমলা ও গোলাপী ছায়া ছড়াচ্ছিল, কিন্তু এই আলো তাদের চোখের মধ্যে শুধু হাসি নয়, গভীর অনুভূতিরও প্রতিফলন ঘটাচ্ছিল। আজকের দিনটা ছিল অন্য রকম—শুধু সাধারণ গল্প বা খেলাধুলা নয়, বরং নিজেদের স্বপ্ন, আশা এবং ভয়ের কথা ভাগ করার দিন। মায়া প্রথমে কণ্ঠে কিছুটা লাজুকতা নিয়ে বলল, “আমি কখনও ভাবি, বড় হয়ে আমি কী করব। কখনও মনে হয় সব কিছু ঠিক মতো হবে না।” আদিত্য মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনল, আর তার চোখে এক অদ্ভুত সহমর্মিতা ফুটে উঠল। সে হালকা করে বলল, “আমি জানি কি মনে হচ্ছে। আমি নিজেও অনেক সময় ভয় পাই, কিন্তু জানো, এই নদীর ধারা সবসময় আমাদের শান্ত করে, তাই না?” এই কথায় মায়ার হৃদয় কিছুটা হালকা হয়ে গেল। নদীর স্রোত তাদের কথার সঙ্গে মিলিয়ে ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছিল, যেন একে অপরের আবেগকে তুলে ধরে শান্তি প্রদান করছে। তারা বুঝতে পারছিল যে, শুধুমাত্র কথায় নয়, নদীর নীরব স্রোতও তাদের আবেগের কণ্ঠ হয়ে উঠেছে।
ধীরে ধীরে তাদের কথোপকথনে আরও গভীরতা আসে। মায়া আদিত্যকে বলল তার ছোট ছোট স্বপ্নের কথা—কোনো দিন সে পৃথিবীর নানা জায়গায় ভ্রমণ করতে চায়, নতুন নতুন মানুষ ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে চায়। আদিত্য হেসে বলল, “আমি ওরকম স্বপ্ন দেখি—আমারও নিজের জগৎ তৈরি করা, যেখানে সব কিছু সুন্দর হবে।” তাদের কথায় কখনও হাসি, কখনও একটুখানি বিষাদ, কখনও উত্তেজনা—সব মিলিয়ে একটি জটিল আবেগের ভাণ্ডার তৈরি হচ্ছিল। তারা একে অপরকে জানত, বুঝত, আর বিশ্বাস করত যে, নদীর ধারে এই সময় শুধু তাদের জন্যই। মায়া হঠাৎ বলল, “আমার ভয়ও আছে—ভয় যে আমি কখনও হেরে যাব।” আদিত্য তার হাত হালকা করে নদীর পাশের বালুর ওপর রাখল এবং বলল, “ভয় থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু জানো, আমরা একসাথে থাকলে সেই ভয়ও হালকা হয়।” নদীর স্রোত তাদের কথার সঙ্গে মিলিয়ে হালকা নাচের মতো ভেসে যাচ্ছিল, এবং বাতাসে সেই অনুভূতি যেন আরও ঘন হয়ে ওঠে।
এই আবেগের ভোর তাদের মধ্যে এক অদৃশ্য বন্ধন তৈরি করল। তারা বুঝতে পারল, শুধু হাসি এবং খেলাধুলা নয়, বরং এই খোলামেলা কথোপকথনই তাদেরকে একে অপরের কাছে আরও কাছে নিয়ে এসেছে। মায়া তার চোখে আর্দ্রতা নিয়ে বলল, “আমাদের কথা কেউ জানবে না, কিন্তু আমার মনে হয় তুমি সব বুঝতে পারছ।” আদিত্য হালকা করে মাথা নাড়ল এবং উত্তর দিল, “হ্যাঁ, এবং আমি চাই এই নদী আমাদের সব গোপন আবেগ রাখুক।” সূর্য ক্রমশ অস্তাচলমুখী, আকাশে নীলিমা আর ধূসর ছায়ার মিশ্রণে গোধূলির রঙ আরও কোমল হয়ে আসছে। তাদের চোখে চোখ রেখে কথোপকথন, নদীর স্রোতের শান্তি, বাতাসের নরম স্পর্শ—সব মিলিয়ে এই মুহূর্ত যেন চিরস্থায়ী হয়ে গেল। আবেগের এই ভোরে তারা বুঝতে পারল, বিশ্বাস, স্বপ্ন, ভয়—সবকিছু ভাগ করলে তা হালকা হয়ে যায়, এবং নদীর ধারে এই শান্ত পরিবেশ তাদের সেই উপলব্ধি দিতে সবচেয়ে নিখুঁত স্থান।
অধ্যায় ৫:
নদীর ধারে প্রতিদিনের হাসি-মজার মুহূর্তগুলো হঠাৎ করেই এক অজানা অন্ধকারে ঢলে যায়। মায়া এবং আদিত্য, যারা এতদিন একে অপরের আবেগ ও অনুভূতি বুঝত, হঠাৎ একটি ছোট ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়। এটি কোন বড় বিষয় নয়, কেবল একটি কথার ভুল ব্যাখ্যা—কিশোরী হেসে বলেছে কিছু, কিশোর তা অন্যভাবে নিয়েছে। প্রথমে কেউই বুঝতে পারেনি, কিন্তু চোখের মুখের অভিব্যক্তি এবং একে অপরের নীরবতার মাঝে ধীরে ধীরে ক্রোধ ও হতাশার ছাপ পড়তে শুরু করল। মায়া মনে করল, “আদিত্য কি সত্যিই আমাকে বোঝে না?” আর আদিত্য ভাবল, “কী করে সে এমনটা বলতে পারে?” এই ক্ষুদ্র দ্বন্দ্বের মধ্যেই তাদের হৃদয়ে অজানা অস্থিরতা জন্ম নিল। নদীর শান্ত স্রোত তাদের চারপাশে অবিরাম বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার মাঝেই যেন প্রতিটি ঢেউ তাদের অশ্রু ধরে টেনে নিচ্ছে। মায়ার চোখে হঠাৎ জল জমল, আর আদিত্যও হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেল, চোখে এক অদ্ভুত অস্থিরতা। নদীর ধারে বসে তারা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিল, কিন্তু দুজনেই কোন শব্দ বলার সাহস পাচ্ছিল না।
সময়টা হঠাৎ থেমে গেছে বলে মনে হচ্ছিল। মায়া তার ছোট্ট হাত দিয়ে চোখ মুছতে লাগল, কিন্তু অশ্রুর প্রবাহ থামল না। নদীর ঢেউ এবং বাতাসের নরম স্পর্শও তাদের দুঃখকে হালকা করতে পারছিল না। আদিত্য মন দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছিল, কোথায় ভুল হলো, কিভাবে এই ছোট্ট ভুল বোঝাবুঝি তাদের বন্ধনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সে হঠাৎ নদীর দিকে তাকিয়ে বলল, “মায়া, আমি চাই না আমরা একে অপরের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করি। কিন্তু কিছু কথা…” মায়া হঠাৎ হালকা করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমি জানি, আমি ভুল বুঝেছি, কিন্তু হৃদয়টা… এটা ভেঙে গেছে।” তাদের চোখে জল, মনের মধ্যে বিশৃঙ্খলা, এবং নদীর স্রোতের সঙ্গে মিলিত সব অনুভূতি এক অদ্ভুত তীব্রতা তৈরি করেছিল। তারা দুজনই জানত, এই ক্ষুদ্র দ্বন্দ্ব কেবল একটি পরীক্ষা, তাদের সম্পর্কের জন্য। নদী যেন তাদের পাশে বসে শান্তভাবে সেই কষ্ট বুঝতে চাচ্ছিল, ঢেউয়ের নরম ছোঁয়া দিয়ে মৃদু সান্ত্বনা দিচ্ছিল।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর, ধীরে ধীরে তারা বোঝার চেষ্টা করল। মায়া তার চোখে এখনও আর্দ্রতা নিয়ে হালকা হাসি ফেলে বলল, “আদিত্য, আমরা দুজনেই মানুষ। ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। কিন্তু আমরা আবারও ঠিক করতে পারি।” আদিত্য হালকা করে মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, এবং এই নদীর মতো আমাদের সম্পর্কও আবার শান্তি পেতে পারে।” নদীর স্রোত তাদের দুজনের আবেগকে নিখুঁতভাবে প্রতিফলিত করছিল—একদিকে কষ্ট, অন্যদিকে শান্তির সূচনা। ধীরে ধীরে তাদের কথার মাধ্যমে, হালকা হাসি, হাতের স্পর্শ, আর চোখের অদৃশ্য ভাষা তাদের ভাঙা হৃদয়কে মেরামত করতে শুরু করল। এই প্রথম দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে তারা শিখল, বিশ্বাস এবং বন্ধন শুধু হাসি-মজা নয়, কখনও কখনও কষ্টের মধ্য দিয়ে আরও দৃঢ় হয়। সূর্য পশ্চিমে অস্তাচলমুখী, আকাশের রঙ ধীরে ধীরে গভীর নীলিমায় মিলিত, আর নদীর স্রোত তাদের জন্য শান্তি এবং নতুন সূচনা নিয়ে আসল—যা দেখালো, কখনও কখনও ছোট্ট দ্বন্দ্বই বন্ধনকে আরও গভীর করে তোলে।
অধ্যায় ৬:
মায়া এবং আদিত্য, সেই ছোট্ট ভুল বোঝাবুঝির পরে কয়েকদিনের বিচ্ছিন্নতার পর, আবার নদীর ধারে মিলিত হল। গোধূলির নরম আলো তাদের চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছিল, আকাশে লালিমা আর ধূসর মেঘের মিশ্রণে এক মৃদু শান্তি ভেসে আসছিল। প্রথম দেখা থেকে শুরু হওয়া বন্ধন, প্রথম দ্বন্দ্বের পরে আরও দৃঢ় হয়ে ফিরে এসেছে। মায়া একটি ছোট্ট গোলাপি ফুল হাতে নিয়ে নদীর ধারে দাঁড়াল, আর আদিত্য তার পাশে হালকা কাঁপা হাতে একটি ছোট স্নিগ্ধ পাথর ধরেছিল। তারা জানত, এই ছোট্ট উপহারগুলো কেবল বস্তু নয়; বরং এটি তাদের হৃদয়ের প্রকাশ, প্রেম ও বিশ্বাসের প্রতীক। মায়া তার চোখে আনন্দের ঝলক নিয়ে বলল, “ফুলটা তোমার জন্য।” আদিত্য হালকা হাসি দিয়ে উত্তর দিল, “আর এই পাথরটা তোমার।” নদীর স্রোত, যে আগে তাদের অশ্রুর সাক্ষী হয়েছিল, আজ শান্তি এবং আনন্দের সঙ্গে তাদের মুহূর্তে যোগ দিচ্ছিল। তাদের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে বলতে, তারা অনুভব করল, বিচ্ছিন্নতার দুঃখ কেবল সম্পর্ককে আরও মধুর করে তুলেছে।
নদীর ধারে বসে তারা ধীরে ধীরে তাদের প্রতিদিনের গল্প এবং অভিজ্ঞতা ভাগ করতে লাগল। মায়া বলল, “এই কয়েকদিন তোমাকে না পেয়ে মনে হচ্ছিল, যেন কিছু একটা অসম্পূর্ণ রইল।” আদিত্য হেসে বলল, “আমিও ঠিক তেমনই অনুভব করেছি। এই নদী আমাদের সাথে থাকলেও, আমরা যে একে অপরের কাছে ছিলাম না, তা অনুভব করা কঠিন ছিল।” তাদের কথায় এক ধরনের স্বাভাবিক স্বীকৃতি এবং আন্তরিকতা ফুটে উঠল। তারা একে অপরকে ছোট্ট হাসি, চোখের ইঙ্গিত, এবং হালকা স্পর্শের মাধ্যমে বোঝাতে লাগল যে, সমস্ত ভুল বোঝাবুঝি ভুলে গিয়েছে। ফুল, পাথর, এবং নদীর শান্ত স্রোত—সবকিছু মিলিয়ে একটি গোপন আনন্দের রূপ তৈরি করেছিল। তারা জানত, এই মুহূর্তটি কেবল তাদের জন্য, আর নদী—যা সবকিছু দেখেছে—আজও তাদের সুখের সাক্ষী। ধীরে ধীরে তারা বুঝতে পারল, উপহারগুলি শুধু বস্তু নয়, বরং তাদের বিশ্বাস এবং নতুন সূচনার প্রতীক।
পুনর্মিলনের এই দিনটি তাদের বন্ধনের জন্য এক নতুন অধ্যায় খুলল। সূর্য অস্তাচলমুখী, আকাশের রঙ ধীরে ধীরে নীলিমায় মিলিত, আর বাতাসে নদীর স্রোতের সঙ্গে মিশে এক শান্ত এবং মধুর সুর ভেসে আসছিল। তারা বসে গল্প করছিল, কখনও হাসছিল, কখনও একে অপরের চোখে গভীর দৃষ্টি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল। মায়া তার ছোট্ট হাত দিয়ে আদিত্যর হাতের পাশে ফুল রাখল, আর আদিত্য পাথরটি মৃদুভাবে তার দিকে এগিয়ে দিল। এই ছোট্ট প্রতীকগুলো তাদের হৃদয়ে বিশ্বাসের আলো জ্বালিয়ে দিল। নদী তাদের পাশে থেকে এই নীরব আনন্দ এবং প্রেমের সূক্ষ্ম মুহূর্তগুলোর সাক্ষী হয়ে থাকল। তারা বুঝল, বিচ্ছিন্নতা এবং দ্বন্দ্ব কেবল তাদের অনুভূতি আরও গভীর করেছে, আর পুনর্মিলনের এই শান্তি তাদের বন্ধনকে এক চিরস্থায়ী দৃঢ়তায় রূপান্তরিত করল। নদীর ধারে বসে এই মুহূর্তে, তারা জানল যে, প্রেম শুধু কথায় নয়, ছোট্ট উপহার, চোখের ভাষা এবং নীরব স্রোতের সঙ্গে মিশে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
অধ্যায় ৭:
নদীর ধারে প্রতিদিনের মিলনের রুটিন এবার এক নতুন রূপ নিল—মায়া এবং আদিত্য ধীরে ধীরে একটি গোপন খেলা শুরু করল, যা শুধু তাদের দুজনেরই ছিল। তারা ঠিক করল, একে অপরকে চিঠি লিখে লুকিয়ে রাখা হবে, আর সেই চিঠিগুলো নদীর পাড়ের নির্দিষ্ট স্থানে রেখে যাওয়া হবে। ছোট ছোট কাগজের টুকরোতে লেখা হতো হাসি, গল্প, স্বপ্ন, কখনও কখনও অজানা প্রশ্ন। মায়া প্রথম চিঠিটা রাখল একটি পুরনো বটগাছের তলায়, আর আদিত্য হালকা পা ফেলে নদীর ধারে এসে সেটা নিয়ে হেসে উঠল। এই ছোট্ট গেমে তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ জন্ম নিল। প্রতিটি চিঠি শুধু শব্দ নয়, বরং হৃদয়ের প্রতিফলন, যেখানে অনুভূতি, স্বপ্ন এবং ছোটখাট খুশি একত্রে মিশে যায়। নদীর স্রোত তাদের খেলার সঙ্গে মিল রেখে হালকা ছন্দে বয়ে যাচ্ছিল, যেন নিজেও এই রহস্যময় মজায় অংশগ্রহণ করছে। বাতাসে ভেসে আসা ফুলের গন্ধ এবং নদীর নরম ঢেউ—সব মিলিয়ে এই গেমকে এক ধরণের যাদুর মতো রূপ দিচ্ছিল, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে আনন্দ এবং রোমাঞ্চের ছোঁয়া স্পষ্ট।
ধীরে ধীরে তাদের গোপন গেম আরও জটিল এবং মজাদার হয়ে উঠল। কখনও তারা নদীর পাড়ে অজানা পথে দেখা করতে শুরু করল, যেখানে একে অপরকে হঠাৎ করে দেখার আনন্দ আর আনন্দের চেয়েও বেশি উত্তেজনা তৈরি করত। মায়া হঠাৎ আসল পথে না দিয়ে একটি বাঁকা পথ ধরে চলল, আর আদিত্য হেসে ছুটে এসে দেখল সে কোথায় লুকেছে। তাদের চোখে চোখের মিশ্রণ, হালকা হাসি, এবং একে অপরকে অনুসরণ করার রোমাঞ্চ—সব মিলিয়ে নদীর ধারে এমন এক আবহ তৈরি করল যা শুধুই তাদের নিজস্ব। কখনও কখনও তারা নদীর কাছে বসে চিঠি খোলার সময় নীরবভাবে একে অপরের চোখে তাকাত, আর সেই নীরব দৃষ্টি হতো তাদের গোপন খেলার সবচেয়ে আনন্দদায়ক অংশ। বাতাসে হালকা সুর, নদীর ঢেউয়ের ধাক্কা, এবং দূর থেকে পাখির কিচিরমিচির—সব মিলিয়ে যেন প্রকৃতিই তাদের খেলার অংশ হয়ে উঠেছে। তারা জানত, এই মুহূর্তগুলো শুধুই তাদের, এবং পৃথিবীর কোনো বাধা বা সময়ের সীমা তাদের আনন্দকে স্পর্শ করতে পারবে না।
প্রতিটি গোপন চিঠি, প্রতিটি অজানা দেখা, এবং প্রতিটি ছোট্ট মজা তাদের বন্ধনকে আরও গভীর করে তুলল। তারা বুঝতে পারল, শুধু কথা বলা বা গল্প শোনা নয়, এই ছোট্ট গেমের মধ্যেও প্রেম, আস্থা এবং আনন্দের একটি অদৃশ্য বন্ধন তৈরি হয়। মায়া হেসে বলল, “প্রতিটি চিঠি যেন আমাদের ছোট্ট রহস্য।” আদিত্য হালকা করে মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, আর নদী আমাদের সেই রহস্যের সাক্ষী।” সূর্য ক্রমশ অস্তাচলমুখী, আকাশে ধূসর ও কমলার মিশ্রণ, আর নদীর শান্ত স্রোত—সব মিলিয়ে তাদের গোপন আনন্দের মুহূর্তটিকে আরও জাদুময় করে তুলল। তারা জানত, এই খেলা শুধুই মজা নয়, বরং তাদের বন্ধনকে পরীক্ষা করার, শক্ত করার, এবং একে অপরকে আরও গভীরভাবে বোঝার এক অনন্য পথ। গোপন গেমের প্রতিটি মুহূর্তে আনন্দ এবং রোমাঞ্চের ছোঁয়া তাদের হৃদয়ে একটি চিরস্থায়ী স্মৃতি তৈরি করল, যা নদীর ধারে সেই গোধূলির আড়ালে এক অদ্ভুত এবং মধুর আবহ সৃষ্টি করল।
অধ্যায় ৮:
নদীর ধারে প্রতিদিনের দেখা আর গোপন খেলাগুলো হঠাৎ থেমে যেতে শুরু করল। মায়া এবং আদিত্য, যারা এতদিন একে অপরের সঙ্গে হাসি-মজা, গল্প এবং চিঠি বিনিময় করত, হঠাৎ করেই তাদের জীবনে পরিবর্তন এসে গেল। স্কুলের পরীক্ষা, পরিবারিক দায়িত্ব, এবং স্থানান্তরের মতো বড়ো বিষয় তাদের সময় ও মনোযোগ নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করল। মায়া হঠাৎ বুঝল, এখন নদীর ধারে সময় কাটানো আর সহজ নয়—তার পড়াশোনা, বাড়ির কাজ, এবং পরীক্ষা সব মিলিয়ে মনোযোগ ছিনিয়ে নিচ্ছে। আদিত্যও তার পরিবারের ব্যস্ততা এবং নতুন পাঠ্যসূচির চাপের কারণে প্রায় দেখা করতে পারছিল না। তাদের মধ্যে সেই নীরব দূরত্ব ক্রমশ বাড়তে লাগল। নদীর ধারে বসে তারা একে অপরের অভাব অনুভব করত, কিন্তু এখন আর দেখা হওয়া সহজ নয়। নদীর শান্ত স্রোত তাদের কাছে যেন একমাত্র বন্ধু হয়ে দাঁড়াল, যা তাদের দুঃখকে বোঝে এবং সেই অদৃশ্য বোঝাপড়ার সঙ্গে মিলিয়ে তাদের ভাঙা মনকে শান্ত করার চেষ্টা করে।
প্রতিদিনের ছোট খুশি আর গোপন খেলার অভাব তাদের মনকে ভারাক্রান্ত করে তুলল। মায়া স্কুল থেকে ফিরে এসে নদীর দিকে তাকালেও কেবল একাকিত্ব অনুভব করত, আর আদিত্যও তার বাড়ির কাজ শেষে নদীর তীরে বসে নীরবে বাতাসের স্পর্শ আর স্রোতের নরম ধাক্কা অনুভব করত। তারা জানত, একে অপরের সঙ্গে দেখা কম হওয়ায় তাদের মধ্যেকার সম্পর্কের সেই সরল আনন্দটি দূরে চলে গেছে। কখনও কখনও তারা চিঠি লিখে পাঠাত, কিন্তু সময় এবং ব্যস্ততার কারণে তা পড়ার সুযোগ কমে যাচ্ছিল। নদী তাদের পাশে থেকে সেই অনুভূতি বোঝে—প্রকৃতির নীরবতা এবং শান্তি যেন এই দূরত্বের ব্যথাকে হালকা করার চেষ্টা করছে। বাতাসে ভেসে আসা নদীর ধোঁয়াটে গন্ধ, ঢেউয়ের নরম স্পর্শ, এবং দূর থেকে পাখির কিচিরমিচির—সব মিলিয়ে একটি নীরব সান্ত্বনা তৈরি করছিল। তারা বুঝতে পারল, জীবনে পরিবর্তন আসতেই পারে, দেখা কম হতে পারে, কিন্তু নদী সবসময় তাদের পাশে থেকে দুঃখের সঙ্গী হয়ে থাকবে।
এই হঠাৎ পরিবর্তন তাদের বন্ধনকে এক নতুন পরীক্ষায় ফেলে। মায়া হঠাৎ অনুভব করল, “আমরা এখন একে অপরের সঙ্গে কম আছি, কিন্তু মনে হয় হৃদয়টা এখনও একই রকম অনুভব করছে।” আদিত্যও চুপচাপ নদীর ধারে বসে হালকা হেসে বলল, “হ্যাঁ, এবং নদী আমাদের সেই অনুভূতি মনে করিয়ে দেয়।” সূর্য ধীরে ধীরে অস্তাচলমুখী, আকাশে কমলা আর ধূসর রঙ মিশে এক ধরনের বিষণ্ণতায় ভরে যাচ্ছে, কিন্তু নদীর স্রোত তাদের মনকে হালকা করছে, ভাবাচ্ছিল যে, সময় এবং পরিস্থিতি পরিবর্তিত হলেও অনুভূতি হারায় না। এই হঠাৎ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তারা শিখল, জীবনের ব্যস্ততা, পরীক্ষা, এবং দায়িত্ব আসতেই পারে, কিন্তু প্রকৃতি এবং বিশ্বাসের স্রোত সবসময় তাদের পাশে থাকে। নদীর ধারে বসে তারা চুপচাপ সেই দূরত্ব এবং পরিবর্তনের ব্যথা মেনে নিল, বুঝল যে, এই কঠিন সময়ও তাদের বন্ধনকে শক্ত করবে, আর একদিন আবার সেই আনন্দময় দেখা ফিরে আসবে।
অধ্যায় ৯:
নদীর ধারে সেই শেষ গোধূলি তাদের জীবনে এক অদ্ভুত এবং মধুর মুহূর্ত নিয়ে এল। মায়া ও আদিত্য জানত, আজকের এই দেখা হয়তো শেষবারের মতো হবে—চোখের আড়ালে, নদীর নীরব স্রোতের সঙ্গী হয়ে। সূর্য ক্রমশ পশ্চিমে নামছে, আকাশে কমলা, গোলাপী ও নীলিমার মিশ্রণ এক স্নিগ্ধ আলোকছটা তৈরি করছে, যা তাদের হৃদয়ের অনুভূতিকে আরও গভীর করে তুলছে। তারা নদীর তীরে বসে প্রথমে চুপচাপ থাকল, চোখে চোখ রেখে নদীর স্রোতের নরম ধাক্কা অনুভব করল। কিছুক্ষণ নীরবতার পরে মায়া হালকা হাসি দিয়ে বলল, “আজকের এই মুহূর্তটা আমি মনে রাখব।” আদিত্যও হেসে বলল, “আমিও। নদী, তুমি আমাদের সব কথা শুনেছ। আজও শুনবে।” এই কথাগুলো যেন নদীর স্রোতের সঙ্গে মিলিয়ে এক শান্ত, অথচ মধুর অনুভূতি সৃষ্টি করল। ধূসর আকাশে মিশ্রিত শেষ রোদ, নদীর স্রোতের হালকা ঢেউ, এবং বাতাসের নরম স্পর্শ—সব মিলিয়ে তাদের বিদায়ের মুহূর্তকে এক জাদুময় রূপ দিচ্ছিল।
শেষ দেখা, শেষ কথোপকথন, এবং শেষ হাসি—সবই তাদের হৃদয়ে একটি চিরস্থায়ী ছাপ ফেলল। তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বসেছিল, হালকা হাসি বিনিময় করছিল, আর সেই হাসির আড়ালে একটি মৃদু দুঃখও লুকিয়ে ছিল। মায়া হঠাৎ একটি ছোট্ট ফুল বের করল, যা আজকের শেষ মুহূর্তের প্রতীক হয়ে দাঁড়াল, আর আদিত্য তার পাশে বসে নদীর তীরে একটি ছোট পাথর রাখল, যেন তাদের বন্ধনকে চিরস্থায়ী করার চেষ্টার প্রতীক। তাদের চোখে এক ধরনের প্রশান্তি এবং বিদায়ের মিষ্টি দুঃখ ফুটে উঠল। নদীর স্রোত তাদের সমস্ত কথার সাক্ষী হয়ে নীরবভাবে ভেসে যাচ্ছিল, কখনও হালকা ছোঁয়া দিয়ে, কখনও ছোট্ট ঢেউ তুলে। তারা জানত, আজকের এই বিদায় শুধু শারীরিক, কিন্তু অনুভূতি, বিশ্বাস, এবং সেই প্রথম দেখার স্মৃতি চিরকাল থাকবে। নদীর ধারে বসে তারা কিছুক্ষণ চুপচাপ সময় কাটাল, কেবল একে অপরের দিকে তাকিয়ে। এই নীরবতা তাদের বন্ধনকে আরও গভীরভাবে অনুভব করাল, যেন সমস্ত কথার প্রয়োজন নেই, সবকিছু চোখের ভাষা এবং নদীর নীরব স্পর্শে বোঝা যাচ্ছে।
সূর্য অস্তাচলমুখী, আকাশে নীলিমা ধীরে ধীরে গভীর নীল রঙে মিলিত, আর নদীর স্রোত তাদের সমস্ত স্মৃতি এবং অনুভূতিকে শান্তভাবে বহন করছে। তারা একে অপরের হাত হালকা চেপে ধরল, চোখে কণার জল এবং হৃদয়ে এক মধুর স্মৃতির অনুভূতি নিয়ে। মায়া হেসে বলল, “আমাদের প্রথম দেখা থেকে আজকের এই শেষ গোধূলি—সবই এক অদ্ভুত যাত্রা।” আদিত্যও হালকা করে মাথা নাড়ল এবং বলল, “হ্যাঁ, এই নদী আমাদের সব সাক্ষী, সব কথা, সব অনুভূতি জানে।” তারা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, নদীর ধারের সেই শেষ দৃশ্যের দিকে চেয়ে। বাতাসে হালকা নীরবতা, নদীর স্রোতের মৃদু ঢেউ, এবং সূর্যের শেষ রশ্মি—সব মিলিয়ে তাদের এই শেষ গোধূলির স্মৃতি চিরকাল হৃদয়ে বেঁচে থাকবে। সেই দিন, সেই মুহূর্ত, সেই নদীর ধারা—সব মিলিয়ে তাদের বন্ধনকে চিরস্থায়ী এবং মধুর করে রেখেছিল, যেখানে বিদায়ের দুঃখ ও শান্তি একসাথে মিলিত হয়ে এক অদ্ভুত সুর তৈরি করেছিল, যা শুধুই তাদের জানা।
অধ্যায় ১০:
বছর কেটে গেল। মায়া এবং আদিত্য ছোট কিশোর-কিশোরী থেকে তরুণ তরুণী হয়ে উঠল। জীবনের নানা ব্যস্ততা—পড়াশোনা, নতুন শহর, নতুন মানুষ—সবকিছু তাদের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু সেই গোধূলির নদী, যেখানে প্রথম দেখা, প্রথম হাসি, প্রথম দ্বন্দ্ব এবং প্রথম চিঠি বিনিময় হয়েছিল, তাদের হৃদয়ে চিরকাল জীবন্ত থেকে গেল। প্রতিদিনের মতো নয়, কিন্তু স্মৃতির আকারে, নদীর নীরব স্রোত এবং হাওয়ায় মিশে থাকা সেই মুহূর্তগুলো তাদের সাথে থেকেছে। মায়া কখনও অজান্তেই তার চোখ বন্ধ করে নদীর নরম ঢেউ, গোধূলির আলো এবং তাদের ছোট্ট খেলার দৃশ্য মনে করত। আদিত্যও কোনও বই পড়তে বসলেও, কোনও অচেনা পথ দিয়ে হেঁটে আসলেও তার মনে হঠাৎ সেই নদীর ধারে বসার নীরব শান্তি ভেসে আসত। নদী যেন তাদের অদৃশ্য বন্ধু হয়ে তাদের জীবনের প্রতিটি মোড়ে উপস্থিত, সব গোপন কথা, হাসি, অশ্রু—সবকিছুর সাক্ষী।
সময় বদলিয়েছে, মানুষ বদলিয়েছে, কিন্তু সেই স্মৃতি চিরন্তন। মায়া এবং আদিত্য যদিও দূরে, কখনও কখনও একে অপরের সঙ্গে দেখা হয়, কিন্তু নদীর ধারে তাদের ছোট্ট রোমাঞ্চ, গোপন চিঠি, হাসি, আবেগ—সবকিছু এখন শুধু স্মৃতির আকারে। তারা জানে, এই নদী তাদের গোপন বন্ধু, যা কোনো দিন তাদের অনুভূতি ভুলে যাবে না। নদীর স্রোত, যা একসময় তাদের অশ্রুর সঙ্গী হয়েছিল, এখন তাদের সুখী স্মৃতি বহন করে। মায়া হঠাৎ নিজের ডেস্কে বসে হেসে উঠল, কারণ তার চোখের সামনে সেই ছোট্ট পাথর, সেই ফুল, সেই গোধূলির আড়াল—সবকিছু যেন আবার জীবন্ত হয়ে উঠল। আদিত্যও ফোনের স্ক্রিনে মায়ার লেখা কিছু কথা পড়ে হেসে উঠল, এবং মনে করল, এই নদী তাদের গল্প জানে, যা কখনও লোপ পায় না। নদী এখন শুধুই জল নয়, বরং তাদের অতীত, তাদের ছোট্ট ভালোবাসা, তাদের প্রথম আবেগ—সবকিছুর এক জীবন্ত স্মৃতিস্তম্ভ।
স্মৃতির নদী তাদের বড় হয়ে যাওয়া জীবনে এক অদ্ভুত শান্তি নিয়ে আসে। তারা জানে, সময় বদলিয়েছে, মানুষ বদলিয়েছে, কিন্তু তাদের প্রেম, তাদের হাসি, তাদের গোপন কথা—সব নদীর স্রোতের সঙ্গে মিলিয়ে চিরকাল থাকবে। মায়া হঠাৎ ভাবল, “যদি আমরা কখনও আবার নদীর ধারে যাই, সব কিছু আবার সেই গোধূলির মতো মনে হবে।” আদিত্যও হালকা হাসি দিয়ে বলল, “হ্যাঁ, এবং নদী সব কিছু মনে রাখে—যেন সময়ও আমাদের প্রেমকে ভুলতে পারে না।” নদীর ঢেউ, বাতাস, ধূসর আকাশের শেষ রশ্মি—সব মিলিয়ে তাদের মনে করিয়ে দেয় যে, জীবনের ব্যস্ততা, দূরত্ব, এবং সময়ের পরিবর্তন কোনোভাবেই তাদের চিরস্থায়ী আবেগকে দূর করতে পারে না। তারা বড় হয়েছে, কিন্তু সেই গোধূলির নদী—চোখে না দেখা হলেও, মনে অদৃশ্য—চিরকাল তাদের অন্তরে জীবন্ত থেকে যাবে, তাদের প্রথম হাসি, প্রথম চিঠি, প্রথম দ্বন্দ্ব, প্রথম ভালোবাসার সব স্মৃতি যেন এক চিরন্তন স্রোতের মধ্যে মিলেমিশে বয়ে চলেছে।
শেষ