অনিৰ্বাণ ধর
১
দক্ষিণ কলকাতার গলির এক কোণায় পুরনো বাড়ির নিচতলায় ছোট্ট একটা দোকান— নাম ‘কফি উইথ কল্পনা’। দোকানের বাইরে ছোট কাঠের বোর্ডে লেখা “Real Coffee. Unreal Thoughts.” দিনের বেলা দোকান খোলেই থাকে, কিন্তু বিকেল নামার সঙ্গে সঙ্গে সেটির রূপ বদলায়। দুপুরের অফিসফেরত ক্লান্ত মুখগুলো ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে যায়, শুধু কিছু নির্দিষ্ট মুখ থেকে যায়— যারা হয় তো বাস্তবের চেয়েও বেশি কিছু খোঁজে প্রতিটি কাপে। আর তারপর আসে রাত। ঠিক ৮:১৩-তে। দোকানের ভেতরে চারটে ছোট গোল টেবিল, দেয়ালে বইয়ের তাক, আর এক কোণে পুরনো রেকর্ড প্লেয়ার, যেটা সোমনাথ ঘোষ যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছে। এই দোকান তার জীবন, তার স্বপ্ন, তার একাকীত্বের গোপন শিকড়। আজ প্রায় আট বছর, সোমনাথ এই দোকান চালাচ্ছেন, নিজের সব কিছু ছেড়ে। প্রতিদিনের মতোই আজও দোকান খোলা, স্রোতসিনী মিত্র তার কোণে বসে ল্যাপটপে ডিজাইন তৈরি করছে, আর দু-একজন ছাত্র ব্যাগে বই নিয়ে চুপচাপ কফি খাচ্ছে। কিন্তু সোমনাথের মন পড়ে আছে ঘড়ির দিকে। সময় তখন ৮:১১।
ঘড়ির কাঁটা ৮:১৩ ছুঁতেই জানালার পাশে রাখা কোণার চেয়ারে একজন এসে বসে। কোনো শব্দ নেই, কোনো গন্ধ নেই, শুধু একটা ভারী উপস্থিতি। গায়ের রং লম্বা কোটের মতো ঘোলাটে, মাথায় হুড তোলা, চোখ মুখ কিছুই দেখা যায় না। দোকানের আলো তেমন ঝলমলে না হলেও, অন্যদের মুখ দেখা যায়— শুধু ওনারটা কখনোই পরিষ্কার নয়। সোমনাথ যতবারই তাকায়, মনে হয় যেন আলোটা ওখানে গিয়ে নিভে যায়। মানুষটা কিছু অর্ডার করে না, শুধু বসে থাকে— চুপচাপ। কিছু না বলেও যেন সমস্ত কিছুর ওপরে তার এক অদৃশ্য প্রভাব রয়েছে। প্রথম প্রথম সোমনাথ ভাবতেন— হয়তো পথচলতি কেউ, হয়তো একাকী কেউ, কিংবা মানসিকভাবে কিছু সমস্যা আছে এমন মানুষ, কিন্তু মাস দেড়েক ধরে প্রতিরাতে একই সময়, একই চেয়ার, একই ভঙ্গিতে বসে থাকা— সেটা আর ‘অসুবিধা’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সিসিটিভি ফুটেজ দেখলে বোঝা যায়, সে ঢুকছে— কিন্তু মুখ ঝাপসা, প্রতিবারই। তাপমাত্রা কমে যায় দোকানের ওই কোণে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্যান্য কাস্টমাররা একে একে উঠে যায়। স্রোতসিনী একদিন বলেছিল, “এই লোকটা আসার পর যেন আমার হাত জমে যায়। ডিজাইনেও ভুল হয়। আলো-ছায়া সব উলটে যায় রে, সোমদা।” সোমনাথ হেসেছিল সেদিন, যদিও ভেতরে তার নিজের হাত কাঁপছিল। প্রতিদিনের এই রুটিন তার মধ্যে একটা অদ্ভুত দোদুল্যমানতা সৃষ্টি করছিল— ভয় ও কৌতূহল, দুটোই।
সেদিন রাতটা একটু বেশি নিঃশব্দ ছিল। বাইরে রাস্তা ফাঁকা, হালকা কুয়াশা জমে উঠছে বাতাসে। অজানা ব্যক্তি এসে বসার পাঁচ মিনিট পরে হঠাৎ করেই রেকর্ড প্লেয়ারটা আপনাআপনি ঘুরে ওঠে। আওয়াজ খুবই নরম, কিন্তু একধরনের পুরনো কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়া যায়— যেন কারো ফিসফাস: “আমি ফিরে এসেছি… ঠিক সময় মতো।” স্রোতসিনী চমকে ওঠে, তার কফির কাপ থেকে কফি ছলকে পড়ে যায়। সে চেয়ে থাকে জানালার পাশের লোকটার দিকে, কিন্তু আজ যেন আরও অস্বাভাবিকভাবে অন্ধকার সেই মুখ। সোমনাথ উঠে দাঁড়ায়, কিন্তু কিছু বলার আগেই লোকটা উঠে দাঁড়ায় এবং ধীরে ধীরে দরজার দিকে হাঁটতে থাকে। চেয়ারটা ঠেলেই যায়নি— যেন ভেসে ওঠে। দরজা খুলে লোকটা বাইরে যায়, আর সঙ্গে সঙ্গে দরজা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়। সোমনাথ দৌড়ে এসে বাইরে বেরোয়, কিন্তু গলির দুপাশে কেউ নেই। বাতাসে হালকা ধোঁয়ার গন্ধ, যেন পুরনো কাঠ পুড়েছে কোথাও। সে ফিরে এসে তাকায় সেই চেয়ারের দিকে— কাপটা গরম, অথচ কফি তো কেউ দেয়নি। ঘড়িতে তখন ৮:১৯। সেদিনই প্রথম সোমনাথ চুপ করে নিজেকে বলেছিল, “এই মানুষটা মানুষ নয়। হয়তো কোনো সময় আটকে পড়া কিছু… অথবা আমি নিজেই।” সে রাতেই ঠিক করল, কাল রাতে, সে পিছু নেবে। আর যদি কিছু ঘটে— তাহলেও সত্যিটা জানতে হবে। যেকোনো মূল্যেই হোক।
২
রাতটা ঠিকমতো ঘুমোতে পারেনি সোমনাথ। বারবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে সেই মুখহীন মানুষটি— যার মুখ দেখা যায় না, অথচ উপস্থিতি এমন যাকে অস্বীকার করা যায় না। পরদিন সকালে খুব ভোরে উঠে সে সিসিটিভি ফুটেজ খুলে বসে। আগের রাতের সময়টা বের করে সে মন দিয়ে দেখতে থাকে। ফুটেজে ধরা পড়েছে লোকটার ঢোকা, বসা, উঠেও যাওয়া— কিন্তু সবটাই যেন ধোঁয়ায় মোড়া। প্রতিবার যে কোণে সে দাঁড়ায়, ক্যামেরার রেঞ্জ সেখানে পরিষ্কার— অথচ ফুটেজে শুধু কাঁপতে থাকা ছায়া। সে ভিডিওটা জুম করে, ফ্রেম ধরে ধরে মুখটা দেখার চেষ্টা করে, কিন্তু প্রতিবারই সেই চেহারা ঘোলা হয়ে যায়, যেন কোনো পুরনো স্মৃতির উপর ঘষে দেওয়া ছাই। সকালে দোকান খোলার পর কেশু পাল এসে চা খেতে খেতে বলে— “এই দোকানটা কিন্তু আগে ভালো ছিল না সোমনাথবাবু। জানেন তো, এই কোণাটাতেই এক ছেলের লাশ পাওয়া গেছিল অনেক আগে… ঠিক রাত আটটার পরে। লোকটা হঠাৎ উধাও হয়ে গেছিলো, কেউ খুঁজে পায়নি। পরে জানতে পারি, ওর নাম ছিল অরিন্দম। খুব চুপচাপ, লেখালেখির ঝোঁক ছিল। কেমন জানি আপনার মতোই— কথা কম, মাথার ভেতরে কিছু বেশি।” সোমনাথ গা ছমছম করে ওঠে, যদিও বাইরে চুপচাপ ভাবে চুমুক দেয় কফিতে। কেশু বলে চলে, “তখন তো এখানে কফির দোকান ছিল না, ছিল পুরনো প্রেস— ছাপাখানা। ওখানেই কাজ করত ছেলেটা। পরে সেই প্রেসও বন্ধ হয়ে যায়। শুনেছি ওর সঙ্গে নাকি কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল… কেউ বলত ও নিজেই নিজের ছায়া হারিয়ে ফেলেছিল!”
সেদিন স্রোতসিনী একটু দেরি করে এল। মুখে চিন্তার ছাপ। বসে বসেই বলল, “সোমদা, গতকালের ওই শব্দটা কি আপনি শুনেছিলেন? ‘আমি ফিরে এসেছি’— এটা কি রেকর্ড প্লেয়ারে ছিল?” সোমনাথ মাথা নাড়ল, “আমি তো ওই ধরনের কোনো ডিস্ক চালাইনি।” স্রোতসিনী এবার ল্যাপটপটা খুলে দেখাল— সে কাল রাতে কিছু ভিডিও তুলেছিল নিজের কাজের জন্য। কিন্তু সেই ক্লিপে রেকর্ড প্লেয়ারের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোকটা স্পষ্ট দেখা গেলেও, মুখটা ঘোলাটে, ঠিক যেমন সিসিটিভিতে। আর আশ্চর্যজনকভাবে, পেছনের দেয়ালে তখন যে ছবি টাঙানো ছিল— সেটার জায়গায় ধরা পড়েছে এক কালো ছায়ামূর্তি, যেটা বাস্তবে ছিল না। সে বলল, “এই ছায়াটা আমার এক দুঃস্বপ্নে এসেছে একবার। ছোটবেলায়, বাবার মৃত্যুর পর।” সোমনাথ চুপ করে রইল, তার মাথায় তখনও ঘুরছে কেশুর বলা ‘অরিন্দম’ নামটা। দোকানের রেকর্ড ফাইলে গিয়ে সে খোঁজ করল— একসময় যারা এখানে কাজ করত বা বসত, তাদের নামের তালিকায় সত্যিই ‘অরিন্দম কর’ নামে একজনের নাম ছিল, মৃত্যুর বছর: ২০০৩। আর ঠিক তখনই বেজে উঠল সন্ধ্যার ঘণ্টা— দোকানের সামনে একটানা বৃষ্টি পড়ছে, আর ঘড়ির কাঁটা অজানা সময়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
রাত যত গভীর হল, দোকানে লোকজন তত ফাঁকা হয়ে গেল। স্রোতসিনী তার ডিজাইনের কাজ নিয়ে ব্যস্ত, কিন্তু চোখ বারবার চলে যাচ্ছে দরজার দিকে। ঠিক ৮:১৩ বাজতেই সেই পরিচিত ছায়ামূর্তি ঢুকল। আজ তার গায়ে অন্য রঙের কোট— বাদামি। চুপচাপ এসে জানালার পাশে চেয়ারে বসে পড়ে। আজ তার বসার সঙ্গে সঙ্গে রেকর্ড প্লেয়ার আপনাআপনি চালু হয়নি, তবে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। সোমনাথ এবার চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর সাহস করে এগিয়ে গেল সেই চেয়ারের দিকে। বলল, “আপনি কে?” কোনো উত্তর এল না। সে আবার বলল, “আপনি কিছু অর্ডার করবেন?” এবার লোকটা কেবল সামান্য মাথা ঘোরাল— কিন্তু তখনও মুখ অদৃশ্য। এই প্রথম সোমনাথ তার শরীরে হালকা গন্ধ টের পেল— যেন পুরনো বই, কালি আর কাঠের ধোঁয়া একসঙ্গে মিশে আছে। সেই মুহূর্তে, লোকটা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়, দরজার দিকে হাঁটে, আর হঠাৎ একটা কাগজ ঝরে পড়ে তার কোট থেকে। সে কিছু না বলেই চলে যায়, দরজার বাইরে মিলিয়ে যায় কুয়াশায়। কাগজটা কুড়িয়ে নিয়ে সোমনাথ দেখল— সেটাতে লেখা শুধু একটা নাম: অরিন্দম কর। নিচে লেখা তার নিজের কাঁপা হাতের লেখায়: “আমার গল্প এখনও শেষ হয়নি, তুমি জানবে।” সেদিন রাতে ঘুমোনোর আগে, সোমনাথ দরজার ছিটকিনি বন্ধ করেও জানত— কাল রাতেও সে ঠিক ৮:১৩-তে আসবে। কিন্তু এবার সে শুধু তাকিয়ে থাকবে না। এবার সে পিছু নেবে… আর যা-ই হোক না কেন, তাকে মুখোমুখি হতেই হবে অতীতের, সময়ের, এবং তার নিজের ভেতরে লুকিয়ে থাকা এক অব্যক্ত অন্ধকারের।
৩
সকালবেলা দোকান খোলার আগেই সোমনাথ কাগজটা নিয়ে বসে রইল কাঠের টেবিলের কোণে। “অরিন্দম কর”— নামটা যেন চেনা। সে বারবার ভাবতে লাগল, এই ছেলেটা কার? কেন এসে বসে প্রতিরাতে? আর কেন প্রতিবার একই সময়েই তার আগমন ঘটে? আগের রাতে ঝরে পড়া কাগজের সেই লাইন— “আমার গল্প এখনও শেষ হয়নি”— মনে হচ্ছিল ঠিক যেন সোমনাথের নিজেরই মনের কথা। সত্যিই কি কেউ মৃত্যুর পরও নিজের গল্প বাঁচিয়ে রাখে? নাকি সেই গল্পটা টিকে থাকে তার চারপাশের স্মৃতিতে, বাতাসে, কাঠের গন্ধে, ধুলোয় জমে থাকা অক্ষরে? দোকান পরিষ্কার করতে করতে সে হঠাৎ খেয়াল করে, জানালার ধারে রাখা সেই নির্দিষ্ট চেয়ারের সামনে রাখা কফির কাপটা এখনো উষ্ণ। অথচ গতকাল রাতে সে পরিষ্কার করেই রেখেছিল কাপগুলো, আর কেউ তো ব্যবহার করেনি। সে কাপটা হাতে নিয়ে দেখে, তার নিচে এক ফোঁটা কফি জমে আছে— গাঢ় রঙের, যেন তাজা। বিস্ময়ে তার শরীরটা কেঁপে ওঠে। কেশু পাল দরজার বাইরে এসে দাঁড়ায়, একটা চায়ের কাপ হাতে, আর বলে— “আপনার দোকানে জিনিসপত্র একা একা গরম থাকে বুঝলেন? এলুমিনিয়ামের জিনিস তো ঠান্ডা হবার কথা!” সোমনাথ কিছুই বলে না। তার দৃষ্টি আটকে যায় কাপটার গায়ে— যেখানে হাত রেখে সে যেন অনুভব করে এক নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস।
দুপুরের পর স্রোতসিনী এল। চোখে হালকা ক্লান্তি, হাতে ল্যাপটপ। বলল, “আজকে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম সোমদা। আমি দাঁড়িয়ে আছি এই দোকানের ভিতরে, কিন্তু বাইরে থেকে কেউ আমায় ডাকছে। জানলার বাইরে একটা মুখ— কিন্তু সেই মুখ একদম ধোঁয়ায় মোড়া। কেবল চোখ দুটো দেখা যাচ্ছিল। আর আশ্চর্যের ব্যাপার, ওই চোখগুলো আমি চিনতাম। খুব খুব পরিচিত। যেন বহু বছর আগে কোথাও দেখেছি।” সে থামে, তারপর কাপ হাতে নিয়ে বসে। কফি খাওয়ার পর হঠাৎ চমকে ওঠে, “এই কাপটা তো ওই লোকটার? আপনি এটা ধুয়ে দেননি?” সোমনাথ মাথা নাড়ে— “আমি তো গতকালই সাফ করেছিলাম, কিন্তু আজ সকালে দেখি কাপটা গরম।” স্রোতসিনী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “এই কাপ থেকে আমি একটা পুরনো গন্ধ পাচ্ছি… জানেন, আমার বাবার কাগজপত্রে এমন একটা কালি ব্যবহার হত। তখন আমি ছোট। আমি ওই গন্ধ খুব ভালো চিনতে পারি।” তার গলা কেঁপে উঠল। “বাবা বলতেন, গন্ধ শুধু স্মৃতি নয়, সময়ের ভিতর একটা ফাটল।” কথাটা শুনে সোমনাথ কেমন যেন হঠাৎ জড়িয়ে যায় সেই গন্ধে, সেই শব্দে। মনে হয় তারও কারও কথা মনে পড়ছে, যাকে সে বহু বছর ধরে ভুলে থাকার ভান করেছে।
রাত ৮টার কাছাকাছি দোকান আবার নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। আজ কফির অর্ডার কম। হয়তো বৃষ্টি আসছে, কিংবা হয়তো কিছু অদৃশ্য আতঙ্ক ছড়িয়ে আছে বাতাসে। ঠিক ৮:১৩ বাজে— আর দরজা খোলে। সেই অজানা ব্যক্তি আবার ঢোকে। আজ তার গায়ে কালচে সবুজ কোট। জানালার পাশে নির্ধারিত চেয়ারে এসে বসে পড়ে। এবার, সোমনাথ আর পেছনে থাকে না। হাতে সেই কাপটা নিয়ে এগিয়ে যায় তার দিকে। সে ধীরে ধীরে কাপটা নামিয়ে দেয় টেবিলে, ব্যক্তির সামনে। বলল, “আপনার জিনিস হয়তো… ফিরে এসেছে।” মানুষটা এবার সামান্য ভাবে মাথা নিচু করে— যেন সম্মতি জানায়। ঠিক তখনই দোকানের বাতি হঠাৎ ঝিমিয়ে ওঠে। আলো নিভে যায় কিছুক্ষণের জন্য। স্রোতসিনী ভয়ে উঠে দাঁড়ায়, কিন্তু নিজের জায়গা ছাড়ে না। চোখের সামনে সেই ছায়ামূর্তি, আর কফির কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে— একেবারে সরাসরি উপরের দিকে, কোন দিকচিহ্ন ছাড়া। আলো ফিরে এলে দেখা যায়, সেই ছায়ামূর্তি নেই। কেবল কাপটা পড়ে আছে, কিন্তু এবার সেই কাপ পুরোপুরি ঠান্ডা। সোমনাথ বুঝে যায়, এই কাপের উষ্ণতা শুধু কফির ছিল না— সেটা ছিল এক যোগাযোগের, এক ‘অসমাপ্ত কথা’র। সেদিন রাতে প্রথমবার সোমনাথ ভাবল— সত্যিই কি কিছু আত্মা ফিরে আসে তাদের অসমাপ্ত গল্প শেষ করতে? আর যদি আসে… তবে তার নিজের ভেতরেও তো একটা গল্প রয়ে গেছে, যা এখনও শেষ হয়নি। হয়তো সেই গল্পের ছায়াই প্রতিরাতে জানালার ধারে এসে বসে, অপেক্ষা করে… মুখহীন, কিন্তু স্মৃতিতে পরিচিত।
৪
একটা অদ্ভুত অসহায়তা নিয়ে দিনটা কাটে সোমনাথের। দোকান যথারীতি খোলে, নিয়মমাফিক কফি বানায় সে, টেবিল মোছে, সেলফে বই ঠিকঠাক রাখে, কিন্তু তার মন পড়ে থাকে সেই কাপ, সেই চোখ দুটো, আর সেই উষ্ণতা যা এক মুহূর্তে সময়কে গলিয়ে দিয়েছিল। সেই সময় থেকেই তার মধ্যে এক রকম তাড়না জন্মায়— ‘অরিন্দম কর’ কে? সে কেন ফিরে এসেছে? এই কফিশপের সাথে তার সম্পর্কটা কী? সেই পুরনো ছাপাখানার সঙ্গে এই কফির গন্ধ কীভাবে জড়িয়ে গেল? দুপুরের দিকে দোকানে আসে স্রোতসিনী। আজ তার চোখে ক্লান্তি আর অস্থিরতা। বসেই বলল, “সোমদা, আমার বাবার পুরোনো নোটবুকগুলো খুঁজে দেখছিলাম গতকাল। জানেন, ২০০৩ সালের ১৪ নভেম্বর একটা পাতায় তিনি লিখেছিলেন— ‘অরিন্দমের চোখ দুটো ঠিক ওর মায়ের মতো… আমি জানি, ওকে লেখালেখির মাঝে হারিয়ে যেতে হবে একদিন।’” সোমনাথ অবাক হয়ে বলে, “তোর বাবা ‘অরিন্দম’-কে চিনতেন?” স্রোতসিনী মাথা নাড়ে, “আমার মনে পড়ে না, কিন্তু ওই লাইনগুলো দেখে কেমন একটা পরিচিত অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। মনে হয় যেন এই গল্পটা আমারও কোনোভাবে অংশ। আমি জানি না কেন।” দু’জনের মধ্যে তখন এক রকমের নিঃশব্দ জোট বাঁধে, যার একমাত্র লক্ষ্য— সত্যকে খুঁজে বের করা।
সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়, দোকানও প্রায় ফাঁকা হয়ে আসে। ঠিক তখন, দোকানের দরজায় ঢোকে একজন— লম্বা, রোগা চেহারা, গায়ে বৃষ্টি ভেজা সোয়েটার গন্ধ। মুখে দাড়ি-গোঁফ, চোখে একধরনের কুয়াশা। সোমনাথ তাকে দেখে কিছুক্ষণ চিনতে পারে না, তারপর হঠাৎ মুখ খুলে বলে, “সঞ্জয় ধর?”
সঞ্জয় ম্লান হেসে উত্তর দেয়, “আপনার দোকান আগে বন্ধ করে দিয়েছিলেন, তাই আসিনি বহুদিন। কিন্তু খবর পেয়েছি, কেউ একজন আবার এসে বসছে ওই কোণার চেয়ারে।”
সোমনাথ ও স্রোতসিনী তাকে বসতে বলে। তিনজন মিলে পুরোনো কফি ভাগ করে নেয়। কফির গন্ধের ফাঁকে ফাঁকে সঞ্জয় বলতে শুরু করে—
“২০০৩ সালের শেষের দিকে আমি এই দোকানে প্রায় প্রতিরাতেই আসতাম। তখন আমি সদ্য চাকরি পেয়েছি, ভীষণ টেনশনে থাকতাম। অরিন্দম তখন এখানে কাজ করত না, কিন্তু আশেপাশে ঘোরাঘুরি করত। সবার থেকে আলাদা ছিল। কথা কম বলত, কিন্তু চোখে কিছু ছিল… যেন কিছুকে চিরকাল ধরে রাখার চেষ্টা করছে। এক রাতে আমরা একসঙ্গে কফি খাচ্ছিলাম, হঠাৎ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছায়া ওকে ডাকল। অরিন্দম চমকে গিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। আমি উঠে দাঁড়াতেই দোকানের লাইট নিভে গেল। মিনিট তিনেক পর আমি বাইরে বেরিয়ে দেখি— কেউ নেই। অরিন্দম আর কোনোদিন ফেরেনি।”
সঞ্জয় থামে, তারপর গলায় ধীরে ধীরে ভেসে ওঠে অন্য এক সুর, “সে ফিরে এসেছে, তাই না? আমি ঠিক শুনেছি?”
স্রোতসিনী তার দিকে তাকিয়ে বলে, “তাকে আমরা প্রতিরাতে দেখি। কিন্তু সে কিছু বলে না। একদিন কাগজ পড়ে গেছে তার কোট থেকে— নাম লেখা ছিল: ‘অরিন্দম কর’।”
সঞ্জয়ের চোখ ছলছল করে ওঠে। সে ধীরে ধীরে একটা ছোট খাম বের করে সোমনাথের হাতে দেয়। খামের গায়ে লেখা: “অরিন্দমের জন্য, যদি সে ফিরে আসে।” খামটা বহুদিন পুরোনো, ভেতরের কাগজ হলুদ হয়ে গেছে। সোমনাথ ধীরে ধীরে খুলে পড়ে—
“আমি জানি তুমি ফিরে আসবে। কারণ অসমাপ্ত গল্পেরা কখনো হারায় না। তারা সময়ের গলিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। এই কফিশপ, এই চেয়ার, এই কফির গন্ধ— সব কিছু তোমার অপেক্ষায় ছিল, আর থাকবে। তুমি ফিরে এসো… তবে সাবধানে। সময় প্রতিশোধ নিতে জানে।”
এই চিঠি কে লিখেছিল বোঝা যায় না। কোনো নাম নেই। কিন্তু কাগজটা থেকে একটা পরিচিত গন্ধ উঠে আসে— কালি, কাঠ আর ভেজা ধুলোর। সঞ্জয় নিচু গলায় বলে, “আমি আর পারি না সোমনাথ। আমি যত দিন গেছে, তত ভুলতে চেয়েছি। কিন্তু তুমি, তুমি পারবে… কারণ তুমি এই কফিশপের আত্মা এখন।”
সেদিন রাতে, দোকান বন্ধ করার পরে, সোমনাথ একা বসে থাকে জানালার কোণায়। রাত ৮:১৩ বাজে, দরজা খোলে, ছায়া এসে বসে। কিন্তু এবার সে কাপ হাতে নেয়। হালকা মাথা নাড়ায়। তারপর ধীরে ধীরে বলে ওঠে—
“তুমি জানতে চাও? তবে এসো আমার সঙ্গে…”
আর সেই মুহূর্তে সোমনাথ উঠে দাঁড়ায়— জানে, এবার আর শুধু কফির কাপে আটকে থাকলে হবে না। এবার তাকে নামতে হবে অতীতের সেই অন্ধকার গলির ভিতর, যেখানে অরিন্দম হারিয়েছিল, আর তার গল্প এখনও শেষ হয়নি।
৫
রাতটা এক অন্যরকম ভার নিয়ে এসেছিল। বৃষ্টির কোনো পূর্বাভাস ছিল না, অথচ সন্ধ্যার ঠিক পরপরই আকাশ ঘন হয়ে আসে। মেঘের নিচে ল্যাম্পপোস্টের আলো যেন সময়ের মতো ঝিমিয়ে পড়ে। সোমনাথ জানালার পাশের চেয়ারটা পরিপাটি করে রাখে— যেন কারও সম্মানীয় প্রত্যাবর্তনের জন্য। ঘড়ির দিকে বারবার তাকায়, অথচ সময় যেন আজ একটু ধীরে চলছে। স্রোতসিনী আজ আসেনি, হয়তো সে নিজেকে একটু দূরে রাখতে চেয়েছে। একা থাকাই ভালো আজ— কারণ সোমনাথ জানে, আজ যা ঘটবে তা হয়তো ‘ফেরার’ সুযোগ দেবে না। ঠিক ৮:১৩ বাজে, দরজার ঘণ্টি বাজে না, কিন্তু দরজা খোলে— আগের মতোই নিঃশব্দে। সেই চিরচেনা ছায়ামূর্তি এসে বসে চেয়ারে। আজকের বাতাসে অন্যরকম চাপ আছে, যেন কিছুর শেষ ঘনিয়ে আসছে। সোমনাথ এবার কাপ এগিয়ে দেয় না, প্রশ্নও করে না। সে শুধু দাঁড়িয়ে থাকে একদৃষ্টিতে, আর তারপর ছায়া যখন উঠতে শুরু করে— ঠিক তখনই সে পিছু নেয়।
দোকান ছেড়ে অজানা সেই ব্যক্তিটি ঢুকে পড়ে দক্ষিণ কলকাতার পিছনের অন্ধকার গলিতে। গলিটা যেন বদলে যাচ্ছে হাঁটার সঙ্গে সঙ্গে— যে গলি সোমনাথ চেনে, সেটা আর নেই। ঘরবাড়ির রঙ ফিকে, দেওয়ালে আগাছা, পুরনো পোস্টার— যেন সময় ২০০৩-এ ফিরে যাচ্ছে। কুকুরের ডাক, একটানা রেনার মতো জল পড়ার শব্দ, আর দূরে এক রেকর্ড প্লেয়ারের পুরনো গান— “একলা চলো রে…”। ছায়ামূর্তির হাঁটা একটানা, থামে না, পেছনে তাকায় না, কিন্তু সোমনাথ জানে— সে দেখছে। দেখে চলেছে তার সাহস, তার সংকল্প। ছায়া একসময় একটা বন্ধ গেটের সামনে দাঁড়ায়— একটা ভগ্নপ্রায় প্রেস, যার নাম মুছে গেছে, কেবল সাইনবোর্ডে রয়ে গেছে দুটি অক্ষর: “KA”। দরজাটা একটু খোলা, ছায়া ভেতরে ঢুকে যায়। সোমনাথ একটু থেমে নিঃশ্বাস নেয়, তারপর প্রবেশ করে সেই প্রাচীন অন্ধকারের ভিতরে। ভিতরটা যেন বাতাসহীন— শুধুই ধুলো, ভাঙা ছাপার মেশিন, মাটিতে ছড়ানো কালি, ছেঁড়া কাগজ। হঠাৎ একটা দেয়ালে চোখ পড়ে তার— সেখানে আঁকা এক মুখ, কালো কালি দিয়ে। মুখটা যেন অপরিচিত নয়— চোখের রেখা, ঠোঁটের বাঁক… ঠিক নিজেরই মতো! কাঁপতে কাঁপতে সে সামনে এগোয়, আর দেখে এক কোণে রাখা টেবিলের ওপর একটা কফির কাপ— আর পাশে বসে আছে ছায়ামূর্তি।
সোমনাথ তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। এবার ছায়া মুখ তোলে— আর হঠাৎই সমস্ত ঝাপসা কেটে গিয়ে দেখা যায় এক মুখ, যার অর্ধেক সোমনাথের নিজের মতো, আর অর্ধেক অপরিচিত— সময়ের ভিতর জর্জরিত এক রূপ। সে বলে, “তুই আমার উত্তর… আমি তো শুধু শুরু করেছিলাম। এই কফির গন্ধ, এই ছাপাখানা, এই গল্প— এগুলো সবই আমার না, তোরও। আমরা একে অপরের অসমাপ্ততা।” সোমনাথ কিছু বলতে পারে না। তার গলা শুকিয়ে আসে। ছায়া বা ‘অরিন্দম’ বলে, “আমি একটা গল্প শেষ করতে পারিনি… সময়ের ভুলে আমি তলিয়ে গিয়েছিলাম। তুই লিখবি সেটা। কিন্তু তুই যদি লেখ না, তাহলে আমি আবার ফিরে আসব, প্রতিরাতে। ঠিক ৮:১৩-তে। যতদিন না কেউ আমার গল্পটা বলে দেয়— আমি আটকে থাকব।” হঠাৎ দেয়ালের এক কোণ থেকে আলো ঝলসে ওঠে, আর সেই আলোয় সোমনাথ নিজেকে দেখতে পায় আয়নার মতো— সেই মুখ, সেই চোখ, কিন্তু ভিতরে অন্য কেউ। আর তারপর— সব আলো নিভে যায়।
সকালবেলা কেশু এসে দেখে, দোকান খোলা কিন্তু ভেতরে কেউ নেই। কফির কাপ ঠান্ডা, কাগজে শুধু লেখা একটা লাইন:
“সে ফিরে এসেছে। এখন তোমার গল্প বলার পালা।”
আর ঠিক তখন, বাইরে থেকে আসা এক ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে থাকে জানালার বাইরে… মুখ ঢাকা, চোখ ঝাপসা।
আর ঘড়িতে তখন বাজে— ৮:১৩।
৬
স্রোতসিনীর ঘুম ভেঙে যায় ঠিক ভোর পাঁচটার দিকে। মাথার মধ্যে এক অদ্ভুত অস্বস্তি— যেন কেউ তার নামে ফিসফিস করে কিছু ডেকেছে। চশমাটা চোখে দিয়ে ঘরের জানালা খুলতেই দেখে— বাইরে হালকা কুয়াশা, কিন্তু তার মধ্যেই এক অচেনা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণ আগেও, আর তখনই হঠাৎ মিলিয়ে যায়। সে চমকে ওঠে। ফোনে সময় দেখে— ৫:১৩। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে নিজেকে বোঝাতে চায়, এটা স্বপ্ন ছিল। কিন্তু সে জানে, কিছু একটা ঘটেছে। কিছু সত্যি অস্বাভাবিক। তারপরই হঠাৎ সে খেয়াল করে, তার মোবাইলে একটি অজানা নাম্বার থেকে মাঝরাতে একটা ভয়েস রেকর্ড এসেছে। প্লে করতেই একটা ফিসফিসে গলা— “তুই জানিস, আমি কোথায় গিয়েছি?” গলাটা যেন সোমনাথের মতো, কিন্তু শব্দে যেন রেকর্ডের মতো ভাঙা ভাঙা। স্রোতসিনীর শরীরের প্রতিটি কোষ এক মুহূর্তে ঠান্ডা হয়ে যায়। সে ব্যাগ গোছায়, আর সেই সকালেই বেরিয়ে পড়ে ‘কফি উইথ কল্পনা’-র দিকে।
দোকানে পৌঁছে দেখে— গেট খোলা, অথচ ভেতরে কেউ নেই। কাউন্টার ফাঁকা, চেয়ারগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে, এক কোণে জ্বলে থাকা একটি কফির কাপ, যেটার ধোঁয়া এখনো বাতাসে। দেয়ালের উপর লেখা কিছু শব্দ— টানা কালো কালি দিয়ে আঁকা: “যারা সত্য জানে না, তারা নীরবতা খোঁজে। যারা সত্য খোঁজে, তারা হারিয়ে যায়।”
স্রোতসিনী চেয়ার টেনে বসে পড়ে— মাথা তার হাতের উপর, কাঁপছে অজান্তেই। তার জীবনে সোমনাথ এমন একজন হয়ে উঠেছিল, যার সঙ্গে সে কোনও রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও একটা নীরব বন্ধনের জন্ম হয়েছিল। তার বাবার মৃত্যুর পর এই মানুষটি তার ভিতরের শূন্য জায়গাটাকে হালকা করে দিয়েছিল— নিঃশব্দে, প্রতিদিনের এক কাপ কফির মত। আর এখন, সেই মানুষটিই নেই। ফোন করে কোনো সাড়া মেলে না। থানায় গিয়ে নিখোঁজ ডায়েরি করতে গেলে, পুলিশ হালকা ভাবে বলে— “এই বয়সে চলে যাওয়ার লোকের সংখ্যা শহরে কম নয়, ম্যাডাম।”
কিন্তু স্রোতসিনী জানে, এটা সাধারণ কোনো ঘটনা নয়। সে দোকানের সিসিটিভি দেখে— শেষ রেকর্ড করা ফুটেজে দেখা যায়, সোমনাথ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, আর সামনে সেই ছায়ামূর্তি হাত বাড়িয়ে আছে তার দিকে। তারপর ক্যামেরা ঝাঁকুনি খেয়ে বন্ধ হয়ে যায়। ওই সময়টা ৮:১৩। সেই সংখ্যাটা যেন ধীরে ধীরে তার মস্তিষ্কে গেঁথে যায়।
সে বুঝতে পারে, সোমনাথ কোথাও আটকে গেছে— ঠিক যেমন অরিন্দম আটকে ছিল। আর তাকে বের করে আনার দায়িত্ব এখন তার নিজের। আর এই কাজে তাকে একা এগোতে হবে।
বিকেলের দিকে, কেশু পাল দোকানে এসে দাঁড়ায়। স্রোতসিনী তাকে দেখে বলে, “তুমি কি জানো, সোমদা কোথায় গেছেন?”
কেশু চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর ফিসফিস করে বলে, “এই দোকানটা একা থাকতে চায় না। এখানে যারা আসে, তারা কিছু রেখে যায়— তাদের গল্প, ভয়, কিংবা কোনো অসমাপ্ত স্মৃতি। সোমনাথবাবু সেইসব কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করছিলেন… তাই হয়তো…”
স্রোতসিনী প্রশ্ন করে, “তুমি জানো কিছু?”
কেশু ধীরে ধীরে বলে, “একবার আমিও গিয়েছিলাম সেই গলিটা দিয়ে… অনেক দিন আগে। মনে আছে, আমি তখন ছাত্র, কলেজ থেকে ফিরছিলাম। এক ছায়া আমাকে ডাকল। আমি এগিয়ে গিয়েছিলাম… তারপর কী হয়েছিল মনে নেই। কিন্তু ফিরেছিলাম বটে— মাথার ভিতরটা হালকা জ্বালা নিয়ে।”
তার গলায় ভয় আর অভিজ্ঞতার একটা মিলেমিশে থাকা সুর।
স্রোতসিনী চুপ করে দোকানের সামনে বসে থাকে। তখন সূর্য ডুবে যাচ্ছে, আর জানালার বাইরে ছায়া যেন লম্বা হয়ে আসছে। বাতাসে ধোঁয়ার গন্ধ, কিন্তু কোথাও আগুন নেই।
সে প্রথমবার ভাবে— যদি কেউ ফিরে আসতে না চায়? যদি কেউ হারিয়ে যেতে চায়?
তবুও… সোমনাথ ফিরবেই। কারণ কিছু সম্পর্ক রক্তে নয়, গল্পে বাঁধা থাকে।
৭
স্রোতসিনী সারারাত ঘুমোয়নি। দোকানের জানালার ধারে বসে, সিলিং থেকে ঝুলতে থাকা হালকা আলোয় নীচু গলায় নিজের মনের প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজছিল। সে বুঝতে পেরেছে, সোমনাথ শুধু নিখোঁজ নয়— সে অন্য কোনো পরত, সময়ের এক ফাটলে আটকে গেছে। কিন্তু কীভাবে? কেন? কফির দোকানের প্রতিটি কোণ আজ তার চোখে অন্যরকম লাগছে— দেয়ালের রঙ, পুরনো কাঠের তাক, ছাপার পুরনো বইয়ের গন্ধ, এমনকি সেই কোণার চেয়ারটা— সব যেন কিছু একটা ‘বলতে’ চাইছে। ভোরের দিকে হঠাৎ তার চোখ আটকে যায় কাউন্টারের নিচে রাখা পুরনো এক ড্রয়ারে। সেটা সাধারণত বন্ধই থাকে। সে ধীরে ধীরে খুলে দেখে, ভিতরে এক গাদা পুরোনো বিল, কাপড়ের রুমাল, কিছু পুরনো বই, আর একটা ধুলোমাখা খাম। খামটা তুলে নিয়ে যখন ধুলো মুছে পড়তে শুরু করে, তখন তার বুক কেঁপে ওঠে। খামের গায়ে লেখা: “স্রোতসিনীর জন্য — যদি কখনও আমি হারিয়ে যাই।”
তাড়াহুড়ো করে খাম খুলে ভিতরের কাগজটা বের করে সে পড়ে —
> “তুই যদি এটা পড়ছিস, তাহলে বুঝে নিস — আমি আর ফিরিনি। অথবা ফিরতে পারিনি।
কিন্তু কফির কাপে যে উষ্ণতা থাকে, সেটাই আমার অস্তিত্ব।
‘প্রেস’ — যেখানে অরিন্দম হারিয়ে গেছিল, সেখানে আমি যাচ্ছি… কারণ আমি জানি, ও একা নেই।
সময় একটা গোল কফির দাগের মতো, যার শুরু-শেষ মুছে গেলে শুধু গন্ধ থেকে যায়।
যদি পারিস, ওখানে এস… কিন্তু ভয় পাস না।
কিছু মুখ অন্ধকারে জন্মায় — তোর আলো তাদের কাছে পৌঁছাবে।
বিশ্বাস রাখিস।”
কাগজটা ধরে স্রোতসিনী বসে পড়ে ফ্লোরে। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে, কিন্তু কান্না আসছে না— শুধু ভেতরের চিৎকারটা যেন থমকে গেছে। সোমনাথ জানত, সে কোথায় যাচ্ছে। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, সে জানত — স্রোতসিনীই একমাত্র সেই আলো যা তাকে খুঁজে আনতে পারবে। সে কাপটা নিয়ে আবার ঘুরে তাকায় দোকানজুড়ে— এবার প্রতিটি জিনিস তার কাছে যেন জীবন্ত। দেয়ালের ছায়া, বাতাসে ভেসে থাকা কফির ধোঁয়া, ছাপার শব্দ— সব যেন ফিসফিস করে বলছে, “যাও… শেষ করো অসমাপ্ত গল্পটা।”
সে উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগে রাখে সেই চিঠি, মোবাইল, লাইটার, আর একটা ছোট নোটবুক। মাথায় একটা পাথরের মতো স্থির সিদ্ধান্ত— তাকে যেতে হবে সেই ‘প্রেস’-এ। যেখান থেকে কেউ ফিরে আসেনি, যেখান থেকে সোমনাথ ডাক পাঠিয়েছে।
বিকেল নাগাদ সে পৌঁছায় পুরনো সেই গলির মুখে, যেখান দিয়ে সোমনাথ গিয়েছিল। প্রথমে সব স্বাভাবিক লাগে— দোকান, অটো, বাচ্চারা খেলছে… কিন্তু গলির ভিতর ঢুকতেই যেন সময় থমকে যায়। বাতাস ঘন, স্যাঁতসেঁতে, কুকুরগুলো হঠাৎ থেমে যায়, এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ঘিরে ফেলে তাকে। সামনে পুরনো, ভগ্নপ্রায় প্রেস— কালচে সবুজ রঙের কাঁচ, ভাঙা দরজা, আর এক পাশে অর্ধেক পড়া বোর্ড: K_A Press. সে ধীরে ধীরে ভেতরে ঢোকে। ভিতরটা অন্ধকার, মেঝেতে ভাঙা কালি, পাণ্ডুলিপি, আর ছাপার মেশিনের অংশ ছড়ানো। হঠাৎ চোখ পড়ে দেয়ালে— আঁকা সেই অর্ধেক মুখটা, যেটা সে আগেও দেখেছিল। কিন্তু এবার মুখটা সম্পূর্ণ। আর সেই চোখ… এই চোখ সে চেনে। এটা সোমনাথের চোখ!
হঠাৎ বাতাসে ধোঁয়া জমে ওঠে, আর ছায়ামতো একজন ধীরে ধীরে সামনে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু এটা অরিন্দম নয়। মুখটা ঝাপসা নয়, কিন্তু আবছা। সেটা স্পষ্ট হওয়ার আগেই এক নারীকণ্ঠ বলে ওঠে—
“তুই পেরেছিস, স্রোতা। সাহস নিয়ে এসেছিস, তাই আমিও ফিরব।”
৮
প্রেসের অন্ধকার ঘরে দাঁড়িয়ে স্রোতসিনী বোঝে— সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়াটা নিছক কোনো আত্মা নয়। এটা সময়ের এক প্রতিফলন, একটা ছেঁড়া অংশ, যেখান থেকে কেউ ফিরতে চায়, কেউ ফেরাতে চায়। তার মাথায় তখন ভেসে আসছে সোমনাথের সেই চিঠির শব্দ— “ভয় পাস না… কিছু মুখ অন্ধকারে জন্মায়, তোর আলো তাদের কাছে পৌঁছাবে।” সেই আলো যদি থাকে, তাহলে সেটা এখন জ্বালানোর সময়। স্রোতসিনী ব্যাগ থেকে লাইটারটা বের করে— সেটা ওর বাবার পুরোনো, এখনও চলে। আলো জ্বলে উঠতেই দেয়ালের কোণে দেখা যায় একটা কাঠের দরজা— যেটা এতক্ষণ ছিল অদৃশ্য। দরজার গায়ে ছাপার অক্ষরে লেখা একটা বাক্য: “এইপারে যারা বুঝতে চায়, তারা ওপারে আটকে যায়।”
কাঁপতে কাঁপতে সে হাত রাখে দরজার ধাতব হাতলে— বরফ ঠান্ডা, অথচ বুকের ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে। দরজাটা খোলে ধীরে ধীরে, আর ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে একটা আলোকময় করিডোরের মতো কিছু দেখা যায়। দেয়ালের দুপাশে পাণ্ডুলিপি ঝুলছে, কিছু কাগজে লেখা: ‘শেষ অধ্যায়’, ‘অসমাপ্ত চিন্তা’, ‘মুছে ফেলা চিঠি’। হেঁটে চলতে চলতে একসময় সে পৌঁছায় একটা ঘরের সামনে— ঘরের ভিতরে বসে আছে সোমনাথ, সামনে একটা খাতা, চারপাশে ছেঁড়া পৃষ্ঠা আর কফির কাপ। সে কাঁপা গলায় ডাকে, “সোমদা…”
সোমনাথ ধীরে ধীরে মুখ তোলে— চোখ দুটো লাল, কিন্তু তাতে ভয় নেই। শুধু অভিমান আর ক্লান্তি। বলল, “তুই এলি… আমি জানতাম। আমি লিখে চলেছি অরিন্দমের শেষ গল্পটা। প্রতিরাতে ও ফিরে আসে, ওর নিজের জন্য নয়… ওর পাঠকদের জন্য। ও বলেছিল— যদি কেউ তার গল্পটা শেষ না করে, তাহলে কফির কাপটা কখনও ঠান্ডা হবে না। আমি শুরু করেছিলাম… কিন্তু কিছু লিখতে গিয়ে আমার নিজের ভেতরের গল্পগুলো বেরিয়ে এল। আমি যে নিজেই অরিন্দমের মতো হয়ে যাচ্ছিলাম বুঝতেই পারিনি।” স্রোতসিনী তার সামনে এসে বসে বলে, “তুমি ফিরে চলো। তোমার কাহিনি আমিও লিখব… আমরা একসঙ্গে শেষ করব এই গল্পটা। তুমি একা নও।”
এই প্রথম, ঘরের বাতাসে একটা শান্তি নামে। দেয়ালের কাগজগুলো হাওয়ায় উড়ে যায়, ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় করিডোর। কফির কাপ ঠান্ডা হতে শুরু করে। সময় যেন স্থির হয়, আবার বয়ে চলে। সোমনাথ উঠে দাঁড়ায়। সে জানে— তার গল্প এখনও শেষ হয়নি, কিন্তু এবার সে হারিয়ে যাবে না।
দুজন মিলে যখন সেই আলো দিয়ে ভরা পথ দিয়ে ফিরে আসে, তখন দরজার গায়ে লেখা বাক্যটা পাল্টে গেছে: “যারা আলো নিতে আসে, তারা আলো দিয়ে ফেরে।” প্রেসের ঘরে ফিরে এসে দেখে সূর্য উঠছে— কিন্তু জানে, রাত এখনও শেষ হয়নি। তাদের সামনে আরও অধ্যায় অপেক্ষা করছে।
সেদিন বিকেলে ‘কফি উইথ কল্পনা’ খুলে আবার বসে স্রোতসিনী আর সোমনাথ। দোকানের সেই জানালার পাশের চেয়ারটা খালি— কিন্তু কেউ যেন বসে আছে। কফির কাপ আজ ঠান্ডা, কিন্তু গল্পটা গরম। কারণ কেউ একজন অপেক্ষা করছে— “এই গল্পটা শেষ করো…”
৯
যতই দিন যায়, ‘কফি উইথ কল্পনা’ ধীরে ধীরে আবার চেনা ছন্দে ফিরতে থাকে— কিন্তু কিছুই আর আগের মতো থাকে না। জানালার পাশে রাখা সেই চেয়ার, যেটায় প্রতিরাতে কেউ এসে বসত, এখন আর কেউ বসে না, কিন্তু সোমনাথ প্রতিদিন সেখানে এক কাপ কফি রেখে দেয়। কারণ সে জানে, কোনো এক পরতে, কেউ আজও অপেক্ষা করে গল্প শোনার জন্য। এক সন্ধ্যায়, দোকান প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময়, স্রোতসিনী সোমনাথকে ডাকে— “সোমদা, এই চিঠিটা দেখো। এটা আমি কালই বাড়ির পুরনো বইয়ের ভেতর পেয়েছি।” চিঠির উপর লেখা: “ডঃ অমিতাভ কর, ১৯৭৯”। ভেতরে লেখা,
> “আমার ছেলেটা, অরিন্দম… ও আলাদা ছিল। ওর মধ্যে আমি এমন কিছু দেখতাম যা আমি নিজেও বুঝতাম না— যেন সময়ের অনেক পরের কথা ভাবত ও। ওর জন্ম হয় এক অদ্ভুত সময়চক্রে… ১৩ই আগস্ট, রাত ৮টা ১৩ মিনিটে। আজও ভাবি— এ শুধু কাকতাল নয়।”
স্রোতসিনীর ঠোঁট শুকিয়ে যায়। সোমনাথ মুখ তুলে তাকায়— “অরিন্দমের জন্ম… ঠিক সেই সময়?”
সে ধীরে ধীরে বলে, “তুমি কি জানো, আমার জন্মদিনও ১৩ই আগস্ট… রাত ৮টার পরে।”
এক মুহূর্তে দুজনেই বুঝতে পারে, সময়ের যে খেলা এতদিন তারা দেখছিল, সেটার শিকড় তাদের মাঝেও। হয়তো অরিন্দম ফিরে আসার জন্য শুধু একজন লেখক খুঁজছিল না— সে খুঁজছিল একটা ছায়া, একটা প্রতিবিম্ব, একটা উত্তরাধিকার। সোমনাথ চুপ করে বলে, “আমি কখনও ভাবিনি, ও আমারই এক প্রতিচ্ছবি হতে পারে। হয়তো আমরা দুই সময়ে জন্মেছি, দুইভাবে, কিন্তু একই গল্পে বাঁধা। ওর মুখটা যখন প্রথম দেখি… আমার নিজের মতোই লেগেছিল।”
স্রোতসিনী তখন উঠে গিয়ে পুরনো সেই কফির কাপটা নিয়ে আসে, যেটায় প্রথম ধোঁয়া উঠেছিল। কাপের নীচে হালকা করে খোদাই করা: A.K.
সেই মুহূর্তে, যেন সমস্ত কিছু মিলে যায়—
অরিন্দম কর
অমিতাভ কর
আলোক কর?
“কিন্তু যদি ওর অস্তিত্ব সত্যিই সময়ের ফাঁকে জন্মায়?”— স্রোতসিনীর গলায় নিঃশব্দ ভয়।
“তাহলে মুখ শুধু মুখ নয়… সেটা একটা সময়, একটা জীবন, একটা হারিয়ে যাওয়া গল্পের কাঠামো।”
সেদিন রাতে সোমনাথ একা বসে থাকে জানালার পাশে, সেই চেয়ারে। বাইরের বাতাসে কুয়াশা নেই, কিন্তু ভেতরের মেঘ আরও ঘন। তার সামনে রাখা ডায়েরির প্রথম পাতায় সে লিখে—
“আমার নাম সোমনাথ কর। কিন্তু আমি জানি, আমার গল্প এখানে শেষ নয়। আমি হয়তো অরিন্দম নই, কিন্তু আমি তার উত্তর।”
সেই সময়েই জানালার কাচে জমে ওঠে এক ছায়া— মুখহীন, চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। সোমনাথ চমকে উঠে দাঁড়ায়।
ছায়া ধীরে ধীরে বলে,
“শেষ করো, তবে সত্যিটা বলে। মুখের আড়ালে যে মুখ, সেই মুখটাই গল্প।”
আর তারপরেই হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জানালার কাচের ওপর লেখা হয় এক লাইন—
“১৩ই আগস্ট, ৮:১৩— সময়ের গর্ভে জন্ম, সময়েই ফিরে যাওয়া।”
১০
রাতটা ছিল কেমন যেন অস্বাভাবিকভাবে নিঃস্তব্ধ। শহরের ট্র্যাফিক কম, জানালার বাইরের আলোও কুয়াশায় গিলে নিচ্ছে নিজেকে। ‘কফি উইথ কল্পনা’-র ভিতরে আলো নিভিয়ে বসে আছে সোমনাথ, সামনে সেই পুরোনো কফির কাপ, তার ভেতরে কিছু নেই— কিন্তু ধোঁয়া উঠছে… প্রতিবারের মতোই। আজ আর ভয় করছে না। এখন তার মনে হচ্ছে, সে নিজেই একটা গল্প হয়ে উঠেছে— যা সে লেখেনি, যা তাকে লিখেছে। জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে সে দেখে— ছায়াটা আর দাঁড়িয়ে নেই। বদলে, একটা উজ্জ্বল রূপ দাঁড়িয়ে আছে— মুখ দেখা যাচ্ছে, চোখে এক অদ্ভুত শান্তি। অরিন্দম? না, তার থেকে অনেক বেশি স্বচ্ছ, অনেক বেশি সময়ছেঁড়া। সেই ছায়ার ঠোঁট নড়ে— কিন্তু শব্দ হয় না। সোমনাথ বোঝে, বলা হচ্ছে:
“তুই লিখে ফেলেছিস। এবার আমি ফিরতে পারি।”
আর ঠিক তখনই সে টেবিলে রাখা সেই খাতা থেকে একটা পৃষ্ঠা আলগা হয়ে হাওয়ায় ভেসে উঠে যায়। বাতাস থেমে যায়। ধোঁয়াও নিঃশেষ। শুধু কাপটা ঠান্ডা।
সকালে স্রোতসিনী এসে দেখে দোকান খোলা, কিন্তু ভেতরে কেউ নেই। সব কিছু নিখুঁতভাবে গোছানো, কাউন্টারে রাখা সেই কফির কাপ, পাশে একটা খোলা খাতা— খাতার প্রথম পাতায় লেখা:
> “শেষ কফির ধোঁয়া তখনই থামে, যখন গল্পটা নিজের মুখ পায়।”
তিন পৃষ্ঠা ধরে লেখা রয়েছে অরিন্দমের শেষ গল্প— যেখানে একজন লেখক সময়ের ভুলে হারিয়ে গিয়ে নিজের প্রতিচ্ছবির মধ্যে নিজেকে ফিরে পায়। সেই গল্পের শেষে লেখা:
“এই কাহিনি এখন কারও নয়, এখন এটা সবার।”
স্রোতসিনী চোখ বন্ধ করে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে— কল্পনায় শুনতে পায় সোমনাথের সেই গলা: “তোর চোখে যেটা আলো, সেটাই আমার ফেরার পথ।”
এরপর অনেক বছর কেটে যায়।
‘কফি উইথ কল্পনা’ এখন আর কেবল এক কফির দোকান নয়, এটা হয়ে উঠেছে এক রহস্যময় জায়গা— যেখানে প্রতিরাতে ৮:১৩-এ জানালার পাশে একটি চেয়ারে রাখা থাকে একটি কফির কাপ। সেখানে কেউ এসে বসে না— তবুও কিছু মানুষ দেখে সেখানে হালকা ধোঁয়া ওঠে। স্রোতসিনী এখন লেখক— সময়, আত্মা আর কল্পনার মিশেলে তার গল্প আজ শহরজুড়ে ছড়িয়ে। সে জানে, কাহিনি শেষ হয়নি। কারণ…
গল্প যেখানেই শেষ হয়, ধোঁয়া সেখানেই জন্ম নেয়।
—
শেষ




