মৌসুমী ধর
বর্ষার ঠিক পরের সকাল, মাটি তখনো ভিজে, বাতাসে কাদা আর শালপাতার গন্ধ মিশে এক অদ্ভুত নরম ছোঁয়া এনে দিয়েছে গ্রামের বুকে। সেই বটগাছটা, যা গ্রামের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে, শিকড় ছড়িয়ে মাটিকে আঁকড়ে রেখেছে, আর শাখা-প্রশাখা মেলে এমন এক বিশাল ছায়া তৈরি করেছে যেখানে গোটা গ্রামের মানুষ একসাথে দাঁড়াতে পারে—সেই গাছতলায় আজ সকালে অল্পবয়সী রতন বসে আছে এক কোণে, কৌতূহলী চোখে চারপাশের মানুষদের দেখে। ওর চোখে যেন এক অদ্ভুত জ্বালা—সবকিছু বুঝে নেওয়ার, শোনার, শিখে নেওয়ার তাগিদ। একটু দূরেই নববধূ ফুলমতি, মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে, লাজুক চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, গ্রামের মেয়েদের ফিসফিসানি শুনছে; আর গাছের ডালে বসে থাকা দু-একটা শালিক ও কাকও যেন এই অদ্ভুত ভিড় দেখে কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। আজকের আসরের কারণ—মধু মিস্ত্রির হাঁস নাকি মঙ্গল পালের ধানখেত নষ্ট করেছে; মধু চিৎকার করে বলছে, ‘‘আমি দেখিনি, আমার হাঁস কখনো যায় না ঐদিকে!’’ আর মঙ্গল পাল কপাল ভাঁজ করে, কণ্ঠের রাগ চেপে রাখার চেষ্টা করে বলছে, ‘‘তোমার হাঁসই করেছে, গাঁয়ের সবাই জানে!’’ গ্রামের মানুষ এই ঝগড়া থামাতে এসে জট পাকিয়েছে আরও, আর ঠিক তখনই গাছের গুঁড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো বৃদ্ধ হরিধন দত্ত ধীরে ধীরে গলা খোলে—‘‘তোমরা চেঁচামেচি না করে আমার কথা শোনো। এই গাছতলায় বসেই হবে মীমাংসা।’’ তার গলা স্পষ্ট, স্থির, অথচ এক ধরনের কোমলতা আছে তাতে, যা গ্রামের মানুষের মধ্যে একরকম বিশ্বাস জাগায়। সরস্বতী মাসি, যিনি শাড়ির আঁচল কাঁধে গুঁজে মাথা নেড়ে বলেন, ‘‘হরিধন দা ঠিকই বলেছেন। এত বড় গাছের নিচে মিথ্যা বলতে গেলে কিন্তু গাছেরও লজ্জা পায়।’’ মানুষের মধ্যে ফিসফাস শুরু হয়, আর একটু একটু করে সবাই বটগাছের ছায়ায় জড়ো হতে থাকে, যেন এই গাছই তাদের ন্যায়বোধের ছাতা।
পৃথিবীর অন্য কোথাও হয়তো এত সরলভাবে একটা ‘কোর্ট’ তৈরি হয় না, কিন্তু এই গ্রামের মানুষ জানে—যেখানে মন আছে, সেখানে মীমাংসা সম্ভব। গ্রামের প্রায় সব মানুষ একে একে বসে যায় গাছের নিচে; কেউ গামছা পেতে বসে, কেউ মাটিতে হাত রেখে বসে, আর ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা গাছের শিকড়ে দোল খেতে খেতে কান খাড়া করে। হরিধন দত্ত প্রথমে মধু আর মঙ্গলকে ডাকে, ‘‘তোমরা দু’জনে দাঁড়াও।’’ কাঁপা গলায় মধু বলতে শুরু করে, ‘‘আমার হাঁস সত্যিই যায় না ঐদিকে, আমি সকাল-বিকেল দেখে রাখি।’’ আর মঙ্গল কড়া চোখে তাকিয়ে বলে, ‘‘আমি নিজে দেখিনি, কিন্তু হারা ক্ষেতে হাঁসের পায়ের ছাপ আছে, আর এমন তো আর কারো হাঁস নেই গ্রামে!’’ সরস্বতী মাসি হালকা কাশি দিয়ে বলে ওঠে, ‘‘কে দেখেছে সেই সময়, কেউ দেখেছে?’’ তখন কয়েকজন গৃহবধূ, যাঁরা নদী থেকে জল আনতে গিয়েছিলেন, বলেন তাঁরা নাকি দূর থেকে হাঁসকে মাঠে দেখেছেন। নিমাই, যিনি শহরে কাজ করে গ্রামে ফিরেছেন, বলে ওঠে, ‘‘শুধু শোনা কথায় হবে না, পায়ের ছাপ দেখাও, মাঠে নিয়ে গিয়ে দেখাও আমাদের।’’ এইভাবে পুরো বিষয়টা গ্রামের মানুষের চোখের সামনে খুলে যায়; কারও চোখে সন্দেহ, কারও চোখে দয়া। রতন বিস্ময়ে দেখে, একেকজন কথা বলছে একেকভাবে, কিন্তু হরিধন দত্ত আর সরস্বতী মাসি তাদের থামাচ্ছেন না—বরং সবাইকে বলতে দিচ্ছেন, শুনছেন মন দিয়ে। ধীরে ধীরে বোঝা যায়, মধু হয়তো ঠিকমতো হাঁস পাহারা দেয়নি, আর মঙ্গলও রাগে কিছুটা অতিরঞ্জন করেছে। শেষে হরিধন দত্ত বলে, ‘‘মধু, তুমি ভুল করেছ পাহারা না দিয়ে, আর মঙ্গল, তুমিও রাগে বেশি কথা বলেছ। এখন থেকে তোমরা নিজেরা খেয়াল রাখবে, আর গ্রামের কাছে মাফ চাইবে।’’ দুইজনই মাথা নিচু করে মাফ চায়, আর গাছতলায় উপস্থিত মানুষদের মুখে স্বস্তির ছায়া পড়ে; যেন ভারি মেঘ কেটে রোদ উঠেছে। রতন ভাবে, শহরে হলে পুলিশ ডাকতে হতো, কোর্টে যেতে হতো, আর এখানে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় শেষ হয়ে গেল! ফুলমতি লাজুক মুখে একপাশে দাঁড়িয়ে সব দেখে, মনের মধ্যে এক নতুন আশ্চর্য বিশ্বাস জন্মায়—এভাবে ওর শ্বশুরবাড়ির গ্রামে ন্যায় মেলে, শক্তি নয়, বোঝাপড়া দিয়েই।
এভাবে সেই দিনের পরে বটগাছের ছায়ায় তৈরি হয় এক নতুন জায়গা—যেখানে মানুষ নিজেরাই নিজের বিচার করে, অন্যায় করলে মাফ চায়, আর সত্যি কথা বলতে সাহস পায়। গ্রামের বুড়োরা বলেন, ‘‘আগেও তো এমন করে ঝগড়া মিটত, তবে এত আনুষ্ঠানিক করে হয়নি।’’ সরস্বতী মাসি একদিন আঙুল তুলে বলে, ‘‘এটা শুধু বিচার নয়, এটা আমাদের ভরসার জায়গা।’’ ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষের মধ্যে খবর ছড়িয়ে যায়, মধু আর মঙ্গলের বিবাদ যেভাবে মিটল, সেটা যেন এক নতুন কাহিনি হয়ে গেল। কিশোর রতন আরও বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে, প্রতিদিন বটগাছের নিচে বসে, কথা শোনে, শিখে নেয় কিভাবে যুক্তি দিয়ে, ধৈর্য ধরে মানুষকে বোঝাতে হয়। ফুলমতিও আর লুকিয়ে থাকে না, মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে, নতুন নতুন কথা বলে—যা গ্রামের মেয়েদের মধ্যে সাহস জাগায়। আর হরিধন দত্ত, মাথায় সাদা চুল আর চোখের কোণায় জলের রেখা নিয়ে, দূর থেকে হাসেন—কারণ তিনিই জানেন, এই বটগাছের ছায়ায় জন্ম নিচ্ছে কেবল একখানা ‘কোর্ট’ নয়, জন্ম নিচ্ছে গ্রামের নতুন হৃদয়, নতুন ন্যায়বোধ আর সহমর্মিতার স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের প্রথম আলো ঠিক এই দিনেই জ্বলে ওঠে, আর গল্পের শুরু হয় এখান থেকেই—বটগাছের ছায়ায়।
–
বর্ষা থেমে এখন গ্রামে শরতের রোদ; আকাশে তুলোর মতো সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে, আর শিউলি ফুলের গন্ধ ভাসছে বাতাসে। সেই দিনের ঘটনার পর থেকে গ্রামের মানুষ বটগাছের ছায়ায় জড়ো হতে যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছে; সকাল হোক বা বিকেল, কেউ না কেউ বসে থাকে, কথা বলে, ঝগড়া মিটিয়ে নেয় বা শুধু গল্প করে। এই গাছতলায় সবচেয়ে বেশি যিনি বসে থাকেন, তিনি সরস্বতী মাসি। তাঁর চোখে ভারী চশমা, কপালে কয়েকটি স্পষ্ট ভাঁজ, অথচ কণ্ঠে এমন এক দৃঢ়তা আর কোমলতা মিশে থাকে যে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে ‘মাসি’ বলেই ডাকে, শিক্ষিকা হিসেবেই নয়। মাসির জীবনের অভিজ্ঞতা অনেক; একসময় গ্রামের ছোট স্কুলে পড়াতেন, স্বামীর অকালমৃত্যুর পর একাই লড়েছেন, নিজের সন্তানকে মানুষ করেছেন, আর আজ এই বটগাছের ছায়ায় মানুষের মনের কথাও শুনছেন, ন্যায়ের কথাও শুনছেন। এক বিকেলে, ঠিক যখন রোদ গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চুইয়ে পড়ছে, তখনো গাছতলায় জটলা—এবার বিবাদ গ্রামের দুই গৃহবধূর মধ্যে। লক্ষ্মীর অভিযোগ, তার প্রতিবেশী কুসুম বারবার তার কুয়ো থেকে জল নিতে আসে, অথচ কুয়োর চাঙ থেকে মাটি ফেলে রাখে, পা দিয়ে ঠেলে দেয়। কুসুম বলছে, ‘‘আমি ইচ্ছে করে করিনি, কাজের তাড়াহুড়োতে হয়তো মাটি ফেলেছি!’’ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা দুই বউয়ের কণ্ঠে কাঁপন; কেউ কাউকে ছাড়তে রাজি নয়। গ্রামের মেয়েরা ফিসফিস করে, ছেলেরা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে, আর তখনই সরস্বতী মাসি গলা খাকে নিয়ে বলে ওঠেন, ‘‘তোমরা দু’জনেই বসো।’’ তাঁর গলায় রাগ নেই, তর্জনি নেই—আছে এক ধরনের নরম দৃঢ়তা। মাসি ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘লক্ষ্মী, তোমার মনে হয়েছে ইচ্ছে করে মাটি ফেলেছে—কেন এমন মনে হলে?’’ লক্ষ্মী বলে, ‘‘কুসুম আগে বলেছিল আমার স্বামীর চেয়ে তার স্বামী ভালো কাজ জানে… সেই থেকে মনে হয় ও ইচ্ছে করে।’’. মাসি এবার কুসুমের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘‘তুই ইচ্ছে করে করিসনি—এখনো সেই কথাতেই থাকিস?’’ কুসুম কেঁদে ফেলে, ‘‘না মাসি, সত্যিই করিনি!’’ এই সরল স্বীকারোক্তি শুনে চারপাশে হালকা ফিসফাস শুরু হয়, আর মাসি আস্তে বলেন, ‘‘দেখ লক্ষ্মী, একটুখানি সন্দেহ থেকে বড় বিবাদ হয়, আর সন্দেহকে যদি আমরা না থামাই, তাতে কেবল মন ভাঙে, সম্পর্ক ভাঙে।’’ তাঁর কণ্ঠে এমন বিশ্বাস থাকে যে চারপাশের মানুষ চুপচাপ শোনে; রতন অবাক হয়ে দেখে, এভাবে শুধু কথা বলে, যুক্তি আর সহানুভূতিতে, কত বড় ঝগড়া মিটিয়ে দেওয়া যায়!
এই ঘটনার পরে গ্রামের মেয়েদের মধ্যে সরস্বতী মাসির প্রতি এক অদ্ভুত আস্থা জন্মায়। শুধু বিবাদ নয়—মেয়েরা আস্তে আস্তে নিজেদের মনের কথাও বলতে শুরু করে। কেউ স্বামীকে নিয়ে দুঃখ শোনায়, কেউ শ্বশুরবাড়ির অন্যায় আচরণ নিয়ে আড়ালে বলে, আবার কেউ নিজের স্বপ্নের কথাও ভাগ করে—যেমন ফাল্গুনী বলে, ‘‘মাসি, আমি ভাবি গ্রামে একটা ছোট সেলাইয়ের কাজ শুরু করব…’’ সরস্বতী মাসি মন দিয়ে শোনেন, মাথা নাড়েন, পরামর্শ দেন, আর কখনো কঠোর সত্য কথাও বলেন। মাসির কাছে ন্যায় মানে শুধু কোর্টের রায় নয়; ন্যায় মানে মনটাকেও বোঝা, দোষ কোথায় লুকিয়ে আছে তা খুঁজে বের করা, আর সেই দোষ থেকে নিজেকে শোধরানোর শক্তি জোগানো। মাসির এই সরল অথচ গভীর দৃষ্টিভঙ্গি গ্রামের কোর্টকেও আলাদা করে তোলে; এখানে কেবল শাস্তি নয়, বোঝাপড়া আর পরিবর্তনও জরুরি। একদিন, যখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে, রতন বসে বসে মাসির কথাগুলো শুনছিল; হঠাৎ রতন জিজ্ঞাসা করে, ‘‘মাসি, তুমি কখনো ভেবেছো কোর্ট হবে শুধু বুড়োদের কথা শোনার জায়গা?’’ মাসি একটু হাসেন, ‘‘তুই জানিস, এই গাছতলা বুড়ো-যুবক, নারী-পুরুষ, গরিব-ধনীর পার্থক্য রাখে না।’’ সেই হাসির মধ্যে এমন এক আস্থা থাকে, যা রতনের মনে গেঁথে যায়—এই কোর্ট হবে সবার জন্য, কোনো একপক্ষের নয়।
এভাবেই সরস্বতী মাসির ধীর অথচ দৃঢ় কথাবার্তা, তাঁর সহজ অথচ গভীর যুক্তি গ্রামের মানুষের কাছে ন্যায়বোধকে এক নতুন অর্থে পৌঁছে দেয়। মানুষ বুঝতে শেখে, কোর্ট মানে শুধু শক্ত গলা নয়—কখনো সেটা নরম কথায়ও হয়, কখনো সেটা চোখের জল দিয়েও হয়, আর কখনো নিজের ভুল স্বীকার করাটাই হয় সবচেয়ে বড় ন্যায়। মাসি বুঝিয়ে দেন, একপক্ষের কথা শুনলে বিচার অসম্পূর্ণ থেকে যায়; দুইপক্ষের কথা শুনেই কেবল সত্যের নাগাল পাওয়া যায়। এর মধ্যেই ফুলমতিও আর শুধু দর্শক থাকে না; সাহস করে একদিন জিজ্ঞাসা করে, ‘‘মাসি, আমরা মেয়েরাও কি বলতে পারি গাছতলায়?’’ মাসি তাকিয়ে বলেন, ‘‘কেন নয়? তোর গলাতেও তো সত্যি কথা আছে!’’ সেই কথায় ফুলমতির মুখ উজ্জ্বল হয়, আর গ্রামের আরও মেয়েরাও নিজেদের মত প্রকাশের সাহস পায়। গ্রামের মানুষ ধীরে ধীরে বোঝে, এই গাছতলায় কোর্ট শুধু কাদা ঝাড়ার জন্য নয়; এ এক নরম আলো, যা সত্যটাকে দেখিয়ে দেয়, সম্পর্কের ফাটল জোড়া লাগায় আর মানুষের মনে মানুষের জন্য জায়গা করে দেয়। সেই আলোই এখন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে—একটি বটগাছের ছায়া থেকে সারা গ্রামে।
–
গ্রামের বাতাসে তখনও শরতের রোদ আর কাশফুলের নরম গন্ধ ভাসছে, কিন্তু সেই নরম বাতাসে হঠাৎ একদিন ঢুকে পড়ে এক অন্যরকম গন্ধ—শহরের ব্যস্ততা, হিসাবি ভাব আর একটু গর্জন করা যুক্তির স্বাদ। গ্রামের প্রান্তের ছোট দোকানের সামনে বসে থাকা নিমাইই সেই শহরের বাতাস বয়ে আনে; বছর কয়েক আগে শহরে ছোটখাটো চাকরি করতেন, তারপর বাবার অসুস্থতায় গ্রামে ফিরেছেন, আর এখন চালাচ্ছেন মুদি দোকান। বিকেলে দোকানের সামনে মাদুর পেতে বসে গ্রামের ছেলেরা, যুবকেরা আর কখনো কখনো রতনও বসে, আর নিমাই গল্প করে শহরের আদালত, বড় উকিল আর পুলিশের কথা—‘‘শহরে তো ভাই, শুধু মুখের কথায় হয় না; প্রমাণ লাগে, কাগজ লাগে, আইনের বইয়ের পাতা উল্টাতে হয়!’’ শুনে প্রথমে রতন আর অন্যদের চোখ বড় বড় হয়; তাদের মনে হয়, এই গাছতলায় কোর্টে তো কিছুই লেখা থাকে না, কারোর কথাই লিখে রাখা হয় না, শুধু মনে রেখে চলে। নিমাই একদিন বলে, ‘‘তোমরা জানো, শহরের কোর্টে কেরানি থাকে, রেকর্ড রাখে, কাগজে লিখে রাখে—যাতে পরে ভুল না হয়। আমাদেরও এমন কিছু করতে হবে না?’’ এই কথার রেশ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে; সরস্বতী মাসি ধীরে বলেন, ‘‘ভালো কথা, নিয়ম থাকলে তো মন্দ হয় না। কিন্তু নিয়ম যেন মানুষের উপরে না চাপে, বরং মানুষকে সঠিক পথে চালায়।’’. হরিধন দত্ত চুপচাপ শোনেন, কখনো মাথা নাড়েন, কখনো চোখ বন্ধ করে থাকেন, যেন ভেতরে ভেতরে ভাবেন এই নতুন বাতাস কি গাছতলার সরলতাকে নষ্ট করবে, নাকি আরও শক্ত করবে।
এরপর একদিন বিকেলে রোদ যখন বটগাছের পাতায় লাল আভা ছড়ায়, তখনই রতন আর নিমাই একসাথে বসে একটা খাতা নিয়ে আসে—সাদা পাতায় বড় বড় হরফে লেখে ‘‘গাছতলায় কোর্টের নিয়ম।’’ প্রথমেই লেখে: ‘‘প্রত্যেক বিবাদে দুই পক্ষের কথা শোনা হবে, সাক্ষী থাকলে শোনা হবে, তারপর গ্রামের প্রবীণরা একমত হয়ে রায় দেবেন।’’ তারপর লেখে, ‘‘মিথ্যা বললে শাস্তি হবে, অন্যায় করলে ক্ষমা চাইতে হবে, আর বড় অন্যায় হলে গ্রামের সবাই মিলে শাস্তি ঠিক করবে।’’ এই নিয়মের খাতা নিয়ে তারা যায় হরিধন দত্তের কাছে; দত্তবাবু চোখের চশমা ঠিক করে ধীরে ধীরে পড়েন, আর বলেন, ‘‘ভালো, তবে মনে রেখো, কাগজ শুধু মনে করানোর জন্য—বিচার হবে মন দিয়ে, বিবেক দিয়ে।’’ সরস্বতী মাসি খুশি হয়ে বলেন, ‘‘তোমরা তো আমার থেকে অনেক বেশি এগিয়ে গেছো, এটাই আসল শিখন!’’ গ্রামের ছেলেরা এই খাতা দেখে গর্বে বুক ফোলায়, আর মেয়েরাও উৎসাহ পায়—ফুলমতি তো এক পৃষ্ঠায় নিজের হাতের লেখা রাখে, যেন কোর্টের এক অংশ হয়ে ওঠে। সেই সন্ধ্যায় গাছতলার নিচে আনুষ্ঠানিকভাবে খাতা পড়ে শোনানো হয়; মানুষ হাততালি দেয়, কারো চোখে জল জমে, আর গ্রামের বৃদ্ধা-বৃদ্ধরা বলেন, ‘‘এখন তো আমাদের কোর্ট শহরের মতো নয়, আবার একেবারে নির্দোষ খেলাও নয়—এ যেন গ্রামের মতোই, কিন্তু আরও কিছুটা পাকা।’’. সেই রাতের নীলে বটগাছের পাতায় ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের ফাঁকে ফাঁকে শোনা যায় মানুষের ফিসফাস—এই কোর্ট শুধু কথার মধ্যে থাকবে না, এখন কাগজের পাতাতেও লেখা থাকবে, যাতে ইতিহাস হয়ে থাকে।
শহরের বাতাস আসায় শুধু নিয়মের খাতাই আসেনি; মানুষের মনে একটু আধুনিক ভাবনাও ঢুকে গেছে। নিমাই বলে, ‘‘শহরে তো কোর্টে উকিল থাকে, সাক্ষী থাকে, যদি আমরাও রাখি?’’ রতন ভাবে, ‘‘আমাদের গাছতলায় কোর্টে উকিল না থাকলেও যুক্তি থাকতে হবে—যেমন সরস্বতী মাসি শেখান।’’. ফুলমতি ভাবে, ‘‘আমরাও যদি সাক্ষী দিই, মেয়েরা যদি বলি, সত্যিটা তাহলে ভালোভাবে বোঝা যায়!’’ এভাবে শহরের কাঠামো আর গ্রামের হৃদয় মিলে তৈরি হয় এক নতুন ধারা—যেখানে নিয়ম আছে, কিন্তু নিয়মের ওপরে আছে মানুষের মন, যেখানে কাগজ আছে, কিন্তু কাগজের বাইরে আছে চোখের জল আর হাসি। সেই সন্ধ্যায় বটগাছের ছায়ায় বসে থাকা হরিধন দত্ত দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘‘গ্রাম যেমন বদলায়, তেমনি বিচারও বদলায়, কিন্তু ন্যায়বোধ যেন কখনো না বদলায়।’’ আর সরস্বতী মাসি আস্তে বলেন, ‘‘এ কোর্ট শুধু নিয়ম দিয়ে নয়, মানুষকে ভালোবাসা দিয়ে গড়তে হবে।’’ সেই কথায় নীরব থেকে রতন, নিমাই, ফুলমতিসহ সবাই মাথা নাড়ে; তারা জানে শহরের বাতাস শুধু কাগজ আর নিয়ম এনে দেয়নি, এনেছে এক নতুন স্বপ্ন—যাতে গ্রামের ন্যায়বোধ আর শহরের শৃঙ্খলা একসাথে বেঁচে থাকতে পারে, আর এই বটগাছের ছায়াতেই জন্ম নেয় নতুন দিনের কোর্ট, নতুন দিনের গ্রাম।
–
শরতের আকাশ ধীরে ধীরে স্নিগ্ধ হতে হতে এখন হেমন্তের কুয়াশায় মুড়ে যাচ্ছে গ্রামটাকে; সকালের হালকা কুয়াশার ভেতর দিয়ে দেখা যায় বটগাছের ছায়া আর তার শিকড়ের জট। সেই গাছতলায় এখন আর শুধু বুড়ো-বুড়িরা বসে থাকে না—নতুন নতুন মুখও যোগ হয়েছে, আর তাদের মধ্যে সবচেয়ে অদ্ভুত চোখের চাহনি নিয়ে বসে থাকে ফুলমতি। সেদিন সকালে চুলের খোঁপা শক্ত করে বেঁধে, লাজুক হাসি লুকিয়ে, সে গাছতলায় আসে, কারণ আজ একটা অন্যরকম বিচার হবে। গ্রামের এক বউকে, নাম তার সুমিত্রা, শ্বশুরবাড়ির কিছু লোক দোষারোপ করছে—নাকি সে প্রতিবেশী ছেলেটির সঙ্গে লুকিয়ে কথা বলেছে, আর নাকি তাতে গ্রামের মান নষ্ট হচ্ছে। সুমিত্রা চোখ মুছতে মুছতে বসে, আর তার চোখের লাল ভাব, কপালের ভাঁজ, সবই বোঝায় সে কতটা ভয় পেয়েছে। চারপাশে ফিসফাস, মেয়েরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে—কেউ বিশ্বাস করে, কেউ সন্দেহ করে। হরিধন দত্ত গলা খাকে নিয়ে বলেন, ‘‘সুমিত্রা, তুই সত্যি করে বল, কী হয়েছে?’’ কণ্ঠ কাঁপতে কাঁপতে সুমিত্রা বলে, ‘‘আমি কোনো অন্যায় করিনি দাদু, ও শুধু পথের পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল বাজার থেকে কী এনেছি—আমি উত্তর দিয়েছি, এইটুকু ছাড়া কিছু না।’’ সরস্বতী মাসি ধীরে বলেন, ‘‘তুই আর কিছু লুকাচ্ছিস না তো?’’ সুমিত্রা মাথা নাড়ে, চোখের জল গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তখন শ্বশুরবাড়ির লোকেরাও চিৎকার শুরু করে—‘‘আমাদের মেয়ের মান নষ্ট হয়েছে, গ্রাম কী বলবে?’’ এমন উত্তপ্ত মুহূর্তে গ্রামের সবাই কথা বলতে শুরু করে; রতন চুপচাপ শোনে, আর ফুলমতি নিজের বুকের ভেতর এক অদ্ভুত কাঁপুনি অনুভব করে—সে ভাবতে থাকে, সত্যিই কি শুধু একটুখানি কথায় এমন বড় অন্যায় হয়?
ফুলমতির ভেতরে সেই কাঁপুনি থেকে জন্ম নেয় অন্যরকম এক সাহস। সে দাঁত চেপে ভাবে, ‘‘না, আজ আমি চুপ থাকব না।’’ ধীরে ধীরে সে দাঁড়িয়ে পড়ে; চারপাশে মানুষ অবাক হয়ে তাকায়—কারণ বউরা সাধারণত এভাবে প্রকাশ্যে কথা বলে না। ফুলমতি কাঁপা গলায় বলে, ‘‘মাফ করবেন, আমি কিছু বলব?’’ সরস্বতী মাসির চোখে একরকম স্নেহময় চাহনি দেখা যায়, আর মাসি আস্তে মাথা নাড়েন। ফুলমতি বলে, ‘‘আমরা মেয়েরা তো প্রতিদিন হাটে যাই, রাস্তায় যাই—পথে যদি কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করে, তা কি অন্যায়? যদি কথা বলাই না যায়, তাহলে তো মেয়েদের মুখই বন্ধ করে দেওয়া হয়!’’ তার কথা শুনে চারপাশে গুঞ্জন শুরু হয়; কিছু মুখ অবাক হয়, কিছু মুখ বিরক্ত হয়, কিন্তু কিছু মুখে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। ফুলমতি আরো বলে, ‘‘যদি অন্যায় না করে থাকি, তাহলে ভয়ে কেন লুকাব? যদি অন্যায় না হয়, তাহলে দোষারোপ কেন?’’ এই সরল অথচ দৃঢ় কথাগুলো যেন বটগাছের পাতায় বাতাসের মতো ছড়িয়ে যায়। হরিধন দত্ত চশমা ঠিক করে বলেন, ‘‘তুই ঠিকই বলেছিস, বউমা—সত্যিই যদি অন্যায় না হয়, তাহলে দোষারোপ করা অন্যায়।’’. সুমিত্রা লজ্জায় চোখ নিচু করে, কিন্তু মুখে হালকা স্বস্তির ছাপ দেখা যায়; ফুলমতির চোখও চকচক করে ওঠে—সে বুঝতে পারে, আজ প্রথমবার শুধু দর্শক না থেকে সে নিজের কণ্ঠ তুলেছে, আর সেই কণ্ঠে লুকিয়ে ছিল মনের সত্যি কথা।
এই ঘটনার পর গ্রামের মেয়েদের মধ্যে অদ্ভুত পরিবর্তন আসে। ফুলমতি হয়ে ওঠে সাহসের এক ছোট্ট প্রতীক; অনেকে লুকিয়ে বলে, ‘‘ও পারলে, আমরা কেন পারব না?’’ সরস্বতী মাসি একদিন বিকেলে ফুলমতিকে কাছে ডেকে বলে, ‘‘আজ তুই যা বললি, তা শুধু সুমিত্রাকে নয়, আমাদের সবাইকেই শক্তি দিল।’’. মাসির চোখের কোণায় হাসি, আর গলায় নরম অথচ দৃঢ় সুর, যা ফুলমতিকে বোঝায় যে তার কথা বৃথা যায়নি। রতন সেই দিন গাছতলায় বসে ভাবে, ‘‘এই কোর্ট শুধু বুড়োদের বা শিক্ষিতদের নয়—যে কারো কথা বলার জায়গা, সত্যি বলার জায়গা।’’ হরিধন দত্ত দূর থেকে দেখে, ফুলমতির চোখের ভেতর যে আলো জ্বলছে, সেটা নতুন প্রজন্মের আলো—যেখানে ভয় নেই, লজ্জা নেই, শুধু সত্যি কথা বলার সাহস আছে। সেই দিন বটগাছের ছায়ায় বসে থাকা মানুষরা বুঝে যায়, এই কোর্ট কেবল নিয়মের খাতা আর বুড়োদের কথায় নয়, বরং মেয়েদের কণ্ঠেও বড় হয়, নতুন প্রজন্মের চোখেও টেকে, আর গ্রামের প্রতিটি মানুষের বিশ্বাসেই বেঁচে থাকে। সন্ধ্যায় যখন ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যায়, তখন সেই ডাকের ফাঁকে ফাঁকে ভেসে আসে ফুলমতির নরম কিন্তু সাহসী কণ্ঠের প্রতিধ্বনি—যা গ্রামের ন্যায়বোধকে আরও গভীরে গেঁথে দেয়।
–
হেমন্তের শেষের দিকে গ্রামের মাঠে নতুন ধানের গন্ধ ভেসে আসে; সকালে কুয়াশায় আড়াল হয়ে যায় গাছতলা, আর দুপুরের রোদে আবার গাছের ছায়ায় মানুষ জড়ো হয়। সেই বটগাছের নিচে আজ ভিড় যেন একটু বেশি, কারণ আজকের ঝগড়া শুধু দুই পরিবারের নয়—প্রশ্নটা গ্রামের নিয়ম আর ন্যায় নিয়ে। হরিপদ ওরফে হরিপো, এক গরিব চাষা, বলছে তার জমির আইল সরিয়ে দিয়ে পাশের বড়লোক গোপাল সাহা কিছুটা জমি নিজের করে নিচ্ছে; গোপাল সাহা বলছে, ‘‘আমি তো আইল ঠিকই রেখেছি, ও বুঝতে পারছে না!’’ এমন সময় রামু, যে নিজের মতো গরিব কৃষক, মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। সেদিন তার চোখে যেন আগুন; সে সরাসরি গোপাল সাহার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘‘আপনি বলছেন জমি আপনার, ও বলছে ওর—কিন্তু আপনার মতো ধনীর কথা শুনে যদি আমরা চোখ বন্ধ করি, তবে এই কোর্টই বা থাকবে কেন?’’ চারপাশে ফিসফাস শুরু হয়; কেউ ভাবে, রামু সাহা সাহস পেয়েছে কেমন করে? গোপাল সাহা একটু হেসে বলে, ‘‘তুই কে রে রামু, আমাকে প্রশ্ন করিস?’’ রামু ঠান্ডা গলায় বলে, ‘‘আমি কারো উকিল নই, কিন্তু ন্যায়ের পক্ষে কথা বলছি।’’ হরিধন দত্ত চুপচাপ শোনেন, সরস্বতী মাসির চোখে প্রশংসার ছাপ; রতন এক কোণ থেকে অবাক হয়ে দেখে, কিভাবে রামুর কণ্ঠে ভয় নেই, আছে যুক্তি আর রাগ মেশানো একরকম সাহস, যা বড়লোকের চোখে চোখ রেখে দাঁড় করায়।
রামু বলে যায়, ‘‘যদি জমি আপনার হয়, প্রমাণ দিন। শুধু মুখের কথায় হবে না; যেই নিয়মের খাতা আমরা লিখেছি, সেখানে তো সাক্ষী আর প্রমাণের কথাই আছে!’’ তখন গ্রামের কয়েকজন বয়স্ক মানুষ বলেন, ‘‘হ্যাঁ, গোপাল, তুমি যদি ঠিক বলো, তোমার জমির দলিল দেখাও, আইলের দাগ দেখাও।’’ গোপাল সাহা একটু অপ্রস্তুত হয়, কারণ আসলে জমির কাগজ তার হাতে নেই, শহরে আছে। তখন রামু আবার বলে, ‘‘আপনি যদি ধনী বলেই আপনার কথা সত্যি হয়, তবে গরিবের কথা কে শুনবে? এই গাছতলায় কোর্টে আমরা শিখেছি সবার কথা সমানভাবে শুনতে হবে!’’ তার কণ্ঠের জোরে গাছের পাতাও যেন থমকে যায়; গ্রামের মানুষ অবাক হয়ে চেয়ে থাকে—রামু, যে নিজের জমি নিয়ে লড়ে, সে আজ অন্যের জন্য, হরিপো-র জন্য, দাঁড়িয়েছে। সেই মুহূর্তে গাছতলা আর শুধু জমি নিয়ে বিবাদের জায়গা থাকে না; এটা হয়ে ওঠে গরিবের কণ্ঠ তোলার জায়গা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জায়গা। শেষ পর্যন্ত হরিধন দত্ত বলেন, ‘‘যতক্ষণ পর্যন্ত দলিল না আসছে, আইল বদলাবে না; আর গোপাল, তুমিও শহর থেকে কাগজ এনে দেখাও।’’ গোপাল সাহা মুখ ভার করে চুপ করে যায়; আর হরিপো’র চোখে জল চলে আসে—সে মাথা নিচু করে রামুকে বলে, ‘‘তুই না থাকলে আমার কথা কেউ শুনত না রে!’’
সন্ধ্যায় বটগাছের ছায়া আরও গাঢ় হতে হতে হারিয়ে যায়, কিন্তু সেই ছায়ার ভেতর দিয়ে ভেসে থাকে রামুর কণ্ঠের প্রতিধ্বনি—যেখানে গরিবের পক্ষে দাঁড়াবার সাহস আছে, যুক্তির শক্তি আছে, আর আছে অন্যায়ের সামনে মাথা না নোয়ানোর অদম্য ইচ্ছে। রতন দূর থেকে বসে ভাবে, ‘‘এই কোর্ট শুধু শাস্তি দেয় না, শক্তিও দেয়; গরিবকেও কথা বলার জায়গা দেয়।’’ সরস্বতী মাসি আস্তে বলেন, ‘‘রামুর মতো মানুষের জন্যই এই কোর্ট বাঁচে।’’ ফুলমতি চুপচাপ শোনে, আর ভাবে, ‘‘যদি সত্যি বলতে ভয় না হয়, তবে অন্যায়ও দূরে সরে যায়।’’ সেই দিন গ্রামের মানুষ বোঝে, গাছতলার কোর্ট শুধু নিয়মের খাতা নয়, শুধু বটগাছের শিকড় নয়—এটা মানুষের ভিতরের সত্যিকারের শক্তিকে খুঁজে বের করে, আর সেই শক্তিই গ্রামের ন্যায়ের সবচেয়ে বড় ভরসা হয়ে ওঠে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের ফাঁকে ফাঁকে রাতের আঁধারে ভেসে আসে সেই তর্কের আওয়াজ, যেটা কেবল একজন গরিব কৃষকের পক্ষে নয়—পুরো গ্রামের ন্যায়বোধের পক্ষে ছিল।
–
শীতের সকাল, বাতাসে কুয়াশা আর আলগা ঠান্ডা; বটগাছের শিকড়ে শিশির জমে আছে, আর গাছতলার কোর্টের খাতাটা এখনো শুকনো কাপড়ে মোড়ানো আছে সরস্বতী মাসির কাছে। এই নিয়মের খাতা, যেখানে গ্রামের প্রতিটি বড় বিবাদের কথা লিখে রাখা হচ্ছে, যেন গ্রামের ইতিহাসের প্রথম লিখিত দলিল হয়ে উঠছে। সকালবেলায় রতন সেই খাতাটা নিয়ে গাছতলার মাটিতে বসে থাকে, পাতা উল্টায়; তার কচি চোখে অদ্ভুত আনন্দ আর দায়িত্বের মিশেল। আজকের বিবাদ আরেকটু জটিল—সুদীপ্ত নামের এক যুবক, যার বাড়ি গ্রামের একধারে, অভিযোগ করেছে যে সে টাকা ধার দিয়েছিল চন্দন নামে এক বন্ধুকে; চন্দন বলছে সে টাকা ফেরত দিয়েছে, কিন্তু কোনো প্রমাণ নেই। গাছতলায় লোক জড়ো হয়েছে; কেউ বলে, ‘‘বন্ধুর মধ্যে এমন সন্দেহ!’’, কেউ বলে, ‘‘সত্যি যদি ফেরত দিয়ে থাকে, প্রমাণ কেন নেই?’’ রতন খাতার নতুন পাতায় শিরোনাম লেখে: ‘সুদীপ্ত-চন্দনের বিবাদ’। হরিধন দত্ত ধীরে ধীরে বলেন, ‘‘তোমরা দু’জনেই কথা বলো, মন খুলে, মিথ্যা বললে গাছটাও লজ্জা পাবে!’’ তার গলায় বার্ধক্যের কম্পন থাকলেও চোখে ঝলক আছে—যা দেখে মানুষ চুপ হয়ে শোনে। চন্দন লাজুক কণ্ঠে বলে, ‘‘আমি ফেরত দিয়েছিলাম, মুখে মুখে…’’ আর সুদীপ্ত বলে, ‘‘তাহলে আমার কাছে খবর নেই কেন?’’ সরস্বতী মাসি হাত তোলেন, ‘‘বন্ধুত্ব থাকুক, কিন্তু সত্যিটা বের করাও তো দায়িত্ব।’’
এই মুহূর্তে নিয়মের খাতাটা প্রথমবার আসল চেহারায় ওঠে; সরস্বতী মাসি বলেন, ‘‘আজ থেকে আমরা যে কেউ বড় টাকা ধার দিলে বা ফেরত পেলে, এখানে লিখে রাখব—যাতে পরে ভুল বোঝাবুঝি না হয়।’’ রতন সেই কথা শুনে খাতায় নতুন নিয়ম লেখে: ‘যে কোনো অর্থনৈতিক লেনদেন এই খাতায় লিখিত থাকবে, দুই পক্ষের সাক্ষরসহ’। গ্রামের মানুষ অবাক হয়ে চায়; এমন কিছু তারা কখনো ভাবেনি, যে গ্রামের কোর্টের কথাও এভাবে লিখে রাখা যায়। চন্দন প্রথমে মাথা নিচু করে থাকে, তারপর বলে, ‘‘ঠিক আছে মাসি, এখন থেকে লিখে রাখব…’’ আর সুদীপ্তও মাথা নাড়ে। রামু, যে তখনো গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছে, বলে, ‘‘এই খাতা শুধু লিখে রাখবে না, আমাদের বিশ্বাসও রাখবে।’’. সেই সময় রতনের চোখ জ্বলজ্বল করে; সে বুঝতে পারে, এই খাতা শুধু কাগজ নয়—এ গ্রামকে একসাথে বাঁচিয়ে রাখার এক ধরনের প্রতিশ্রুতি। ফুলমতি একপাশ থেকে বলে ওঠে, ‘‘এতে তো মেয়েরাও লিখতে পারবে?’’ সরস্বতী মাসি হেসে বলেন, ‘‘সবাই লিখতে পারবে, সত্যিটা লিখতে পারলেই চলবে।’’ সেই কথায় গ্রামের মেয়েদের চোখে আনন্দের ছাপ পড়ে; তারা ভাবতে শুরু করে, এই খাতায় তাদের কথাও থাকবে, তাদের স্বপ্ন, তাদের ন্যায়ের দাবি।
সন্ধ্যায় বটগাছের নিচে যখন কুয়াশা আরও গাঢ় হয়, সেই নিয়মের খাতার পাতায় লেখা অক্ষরগুলো কুয়াশার মধ্যেও স্পষ্ট থেকে যায়। রতন সেই খাতা বুকের কাছে চেপে ধরে, যেন নিজের জীবনের অংশ হয়ে গেছে; হরিধন দত্ত ধীরে বলেন, ‘‘আজ আমরা লিখতে শিখলাম, কাল আমাদের ছেলেমেয়েরা হয়তো আরও ভালো নিয়ম বানাবে।’’. সরস্বতী মাসি চোখের কোণায় তাকিয়ে বলেন, ‘‘খাতায় দাগ পড়বে, কালি মুছবে, কিন্তু ন্যায়ের দাগ যেন মন থেকে না মুছে যায়।’’ রামু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ভাবতে থাকে, ‘‘আমাদের কণ্ঠ, আমাদের যুক্তি আর এই খাতা—সব মিলিয়েই গাছতলার কোর্ট দাঁড়িয়ে থাকবে।’’. ফুলমতি দূর থেকে গাছের শিকড়ে বসে থাকে; তার চোখে ভয় নেই, আছে এক ধরনের বিশ্বাস—যা গ্রামের প্রতিটি মেয়ের, প্রতিটি মানুষের মনে ছড়িয়ে যায়। সেই রাতে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের ফাঁকে ফাঁকে বাতাসে ভেসে থাকে খাতায় লেখা প্রথম নিয়মের গল্প—যা শুধু কালির দাগ নয়, বরং পুরো গ্রামের ন্যায়বোধের দাগ হয়ে থাকে।
–
শীত ধীরে ধীরে জেঁকে বসেছে গ্রামে; ভোরের কুয়াশায় বটগাছের শিকড় সাদা বাষ্পে ঢাকা, আর বিকেলে মৃদু রোদে সেই শিকড়ের ফাঁকে বসে থাকে মানুষ—কারও চোখে কৌতূহল, কারও চোখে চিন্তা। সেই বিকেলে গাছতলার কোর্টে আসে এক নতুন মুখ—জবা, গ্রামের এক বিধবা, যার স্বামী বছরখানেক আগে চলে গেছে, আর যার জীবনের গল্প গ্রামের অনেকেই জানে, কেউ পুরোটা বোঝে না। চোখেমুখে দুঃখের ছাপ আর ভয়ে কাঁপতে থাকা কণ্ঠ নিয়ে জবা দাঁড়ায়, আর চারপাশে ফিসফাস শুরু হয়; কেউ ভাবে ও কি সত্যিই সাহস পাবে কথা বলার? হরিধন দত্ত আস্তে বলেন, ‘‘জবা, তুই যা বলতে চাস, ভয় না পেয়ে বল।’’. জবা কাঁপা গলায় বলে, ‘‘আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা বলছে, স্বামী মারা যাওয়ার পর নাকি আমি অন্য পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করছি…’’ তার চোখ থেকে অশ্রু গড়ায়, মুখ লজ্জায় ঢেকে যায়। বাতাস থমকে যায়; গ্রামের কয়েকজন পুরুষ কপাল কুঁচকায়, কেউ সন্দেহের চোখে তাকায়, আর কেউ মুখ ফিরিয়ে নেয়। সরস্বতী মাসি এগিয়ে এসে বলে, ‘‘কেউ কি দেখেছে? প্রমাণ আছে?’’ এক নারীর চোখে চোখ রেখে এমন প্রশ্ন করার শক্তি মাসির গলাতেই থাকে। কেউ কিছু বলতে পারে না; জবার কথা শুনে ফুলমতি একপাশ থেকে এগিয়ে এসে বলে, ‘‘আমি চিনি জবাকে—সে প্রতিদিন ভোরে জল আনতে যায়, নিজের কাজেই ব্যস্ত থাকে।’’ সেই ছোট্ট কথাটাই জবার কাঁপা মনে একটু ভরসা আনে।
রামু দাঁড়িয়ে বলে, ‘‘যদি কেউ দেখে থাকে, তাহলে সে আসুক, কথা বলুক।’’ কিন্তু কারও মুখে কথা নেই; কেবল ফিসফাস, কেবল সন্দেহের ছায়া। হরিধন দত্ত গলা স্পষ্ট করেন, ‘‘যতক্ষণ পর্যন্ত প্রমাণ নেই, ততক্ষণ এভাবে একজন নারীকে অপমান করা অন্যায়।’’ তার গলায় বছরের পর বছর গ্রাম চালানোর অভিজ্ঞতা আর ন্যায়বোধের জোর ঝরে পড়ে। সরস্বতী মাসি বলেন, ‘‘জবা একা থাকে, তাই ওকে সহজ টার্গেট মনে করা হয়; কিন্তু সত্যি কথা না জেনে দোষারোপ করা মহাপাপ।’’. গ্রামের অনেকের মুখে তখন লজ্জার ছাপ; কিছু মুখে অবিশ্বাস, কিন্তু কিছু মুখে সহানুভূতি দেখা যায়। ফুলমতি ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে জবার হাত ধরে; সেই স্পর্শে জবার চোখে আরও বড় জলকণা নামে, কিন্তু সেই কান্না এবার শুধু ভয়ের নয়—কোনো এক নতুন ভরসার, নতুন সাহসের কান্না। রতন দূর থেকে বসে দেখে, কোর্টে দাঁড়ানো এক নারীর চোখের জল কিভাবে সত্যিটা চুপ করে বলে দেয়, কিভাবে কান্না আর নীরবতাও যুক্তির চেয়ে শক্তিশালী হতে পারে।
সন্ধ্যায় বটগাছের ছায়া গাঢ় হতে হতে মিশে যায় কুয়াশায়; সেই ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে হরিধন দত্ত বলেন, ‘‘আজ থেকে নিয়ম লিখে রাখো—কোনো নারী বা পুরুষের নামে এমন অপবাদ দিতে গেলে প্রমাণ থাকতে হবে, না হলে দোষারোপকারীই শাস্তি পাবে।’’ রতন খাতার নতুন পাতায় লেখে: ‘মিথ্যা অপবাদ অন্যায়, প্রমাণ ছাড়া বলা যাবে না’। সেই অক্ষরগুলো কুয়াশার মধ্যেও স্পষ্ট থাকে; যেন গাছতলার ন্যায়বোধ শীতের কুয়াশা ভেদ করে দাঁড়িয়ে থাকে। জবা চোখ মুছে একপাশে বসে যায়; ফুলমতি ওর কাঁধে হাত রাখে। সরস্বতী মাসি আস্তে বলেন, ‘‘আজ জবার কান্না শুধু এক নারীর নয়, পুরো গ্রামের বিবেকের কান্না।’’ সেই রাতে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের ভেতর ভেসে আসে সেই কান্নার প্রতিধ্বনি—যা কেবল দুঃখ নয়, বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অদম্য সাহসের প্রতিধ্বনি। আর গ্রামের মানুষ মনে মনে স্বীকার করে, এই গাছতলার কোর্ট শুধু যুক্তির নয়, মানুষের চোখের জলকেও ন্যায়ের প্রমাণ হিসেবে মানতে শিখেছে।
–
শীতের শেষের দিকে গ্রামে বসন্তের হাওয়া বইতে শুরু করেছে; মাঠে সরষের ফুল ফোটে, গাছের ডালে কুঁড়ি আসে, আর সেই সঙ্গে বটগাছের ছায়ায়ও এক নতুন আশার আলো ছড়িয়ে পড়ে। গাছতলার কোর্টের খাতা তখন আর নতুন থাকে না—পাতায় পাতায় লেখা নানান বিবাদের কথা, রায়, মানুষের দুঃখ আর স্বপ্নের টুকরো। সেই খাতার অক্ষর যেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও গভীর অর্থ পায়। এক বিকেলে রতন খাতাটি নিয়ে বসে থাকে, পাতা উল্টায় আর ভাবে, ‘‘কত মানুষের চোখের জল, কত মানুষের রাগ, কত মানুষের সত্যি আর মিথ্যে এই পাতায় রয়েছে…’’ সেই সময় হরিধন দত্ত এসে বসেন, কাঁপা হাতে শিকড় ছুঁয়ে বলেন, ‘‘এই গাছ যেমন বড় হয়েছে শিকড় পুঁতে, আমাদের ন্যায়ও তেমনি বড় হয়েছে এই কোর্টের শিকড়ে ভর করে।’’ রতন কিছু না বলেই মাথা নিচু করে; সে বুঝতে পারে, এই কোর্ট শুধু নিয়ম দিয়ে চলে না—এ চলে মানুষের বিশ্বাস, মমতা আর একে অপরের কথা শোনার ক্ষমতায়। তখনই ফুলমতি ও রামু একসাথে আসে; তারা বলে, ‘‘আজ নতুন নিয়ম লিখতে হবে—যাতে মেয়েরাও, গরিবেরাও সমানভাবে বলতে পারে, লিখতে পারে।’’ সরস্বতী মাসি চোখে আনন্দের ছাপ নিয়ে বলেন, ‘‘লিখ রতন, এই কোর্ট শুধু বুড়োদের নয়, সবার।’’
সেদিন গাছতলায় অনেক মানুষ জড়ো হয়; মেয়েরা, ছেলেরা, বৃদ্ধা-বৃদ্ধ, এমনকি যারা আগে কোনোদিন গাছতলায় আসেনি, তারাও আসে। রতন নিয়মের খাতায় নতুন শিরোনাম লেখে: ‘কোর্ট সবার জন্য—নারী-পুরুষ, গরিব-ধনী, বুড়ো-তরুণ’। সরস্বতী মাসি বলেন, ‘‘আজ থেকে এই কোর্ট শুধু বিবাদ মেটাবে না, গ্রামের স্বপ্নও লিখবে।’’ সেই কথায় সবাই অবাক হয়; মাসি ব্যাখ্যা দেন, ‘‘যদি কারো স্বপ্ন থাকে—কোনো কাজ শুরু করার, কারো পড়াশোনার, কারো সেলাই শেখানোর—সব এখানে লেখা থাকবে।’’ ফুলমতির চোখ চকচক করে ওঠে; সে বলে, ‘‘তাহলে আমাদের স্বপ্নও এই কোর্টে থাকবে!’’ গ্রামের মেয়েরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে, তারপর একে একে বলে, ‘‘আমি চাই, মেয়েরা রাতেও নির্ভয়ে চলতে পারুক…’’, ‘‘আমি চাই, মেয়েরা পড়তে শিখুক…’’ সেই স্বপ্নগুলো কোর্টের খাতায় লেখা হয়; কালি দিয়ে লেখা সেই স্বপ্ন যেন কেবল অক্ষর নয়, বরং একেকটা জীবন্ত বাসনা, যা গ্রামের আকাশে উড়ে বেড়ায়। হরিধন দত্ত দূর থেকে চেয়ে থাকেন, চোখে জলের মতো আলোর ঝলক; তিনি বলেন, ‘‘এই গাছতলার কোর্ট শুধু ঝগড়া মেটানোর নয়, নতুন গ্রাম গড়ার প্রতিজ্ঞা।’’
সন্ধ্যা নামলে বটগাছের ছায়া আরও গাঢ় হয়; ঝিঝিঁ পোকার ডাকের মধ্যে গ্রামের মানুষ বাড়ি ফেরে। কিন্তু সেই রাতে গ্রামের বাতাসে ভাসে এক অদ্ভুত নরম, অথচ দৃঢ় অনুভূতি—যেখানে একটুখানি ভয়ও নেই, আছে মিলনের সুর, ভরসার গন্ধ। রতন খাতাটি বুকে চেপে ধরে ভাবে, ‘‘এই কোর্ট শুধু কথা নয়, এটা এক ধরনের স্বপ্নের শিকড়।’’. সরস্বতী মাসি শিকড়ে হাত রেখে চোখ বন্ধ করেন; তাঁর মনে পড়ে যায় প্রথম দিনের সেই বিচার, প্রথম দিনের ভয় আর অজানা কাঁপুনি—যা আজ গ্রামের ন্যায়ের প্রতীক হয়ে গেছে। রামু চুপচাপ আকাশের তারা দেখে; ফুলমতি মৃদু হেসে ভাবে, ‘‘আজ আমরা মেয়েরা কেবল দর্শক নই, আমাদের কথাও শোনা হচ্ছে।’’ সেই রাতে বটগাছের শিকড়ের নিচে লেখা প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি স্বপ্ন, আর প্রতিটি চোখের জল মিলে এক নীরব অথচ শক্তিশালী প্রতিজ্ঞা হয়ে দাঁড়ায়—এই কোর্ট থাকবে, যতদিন থাকবে মানুষের বিশ্বাস, যতদিন থাকবে মানুষের বুকের ভেতর ন্যায়ের শিকড়।
***