Bangla - অনুপ্রেরণামূলক গল্প

গাংচিলের ডানা

Spread the love

অনন্যা দে


অধ্যায় ১: আকাশের দিকে তাকিয়ে

বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা এই ছোট্ট গ্রামটা এতটাই নির্জন যে মনে হয়, সময় এখানে দাঁড়িয়ে গেছে। লবণের গন্ধ মিশে আছে বাতাসে, আর ঝাউগাছের ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের আলো যেন সোনা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এখানে ঘুম ভাঙে ঢেউয়ের শব্দে, আর দিন শেষ হয় পাখির ডাকে। এই গ্রামেই জন্মেছিল রুই।

না, বড় কোনো নাম নয়। তার বাবার প্রিয় মাছের নাম থেকেই এই নাম রাখা হয়েছিল—রুই। নামটা নিয়ে সে হাসত না, কাঁদত না, শুধু মেনে নিয়েছিল যেন এটা তার একটা খোলস।

রুইর জীবন অন্য সবার মতো সহজ ছিল না, আবার খুব আলাদা বললেও কম বলা হয়। তার বয়স যখন পাঁচ, তখন সে প্রথমবার সমুদ্র দেখেছিল। বাবার কোলে বসে, একটা নৌকোয় চেপে সে ঢেউয়ের বুকের ওপর ভেসে বেড়াচ্ছিল, আর তখনই সে প্রথম গাংচিল দেখেছিল—সাদা-কালো ডানার এক পাখি, বিশাল আকাশে যেন খেলা করছে।

সে চমকে গিয়েছিল।
— “ওরা কোথায় যায়, বাবা?”
— “আকাশে… যতদূর মন চায়, ততদূর,” বলেছিলেন তার বাবা, গর্বের সঙ্গে।

সেই দিন থেকেই রুইর মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল একটা ছবি—নিজেকে একটা গাংচিল হিসেবে ভাবা, আকাশে ভেসে বেড়ানো, সাদা মেঘের ফাঁকে নিজের ছায়া দেখা।

রুইর অন্য ছেলেমেয়েদের মতো খেলাধুলায় মন ছিল না। কেউ যখন কাঁচি কাগজে ঘুড়ি কাটত, সে তখন বালির ওপর পাখির ডানা আঁকত। কেউ যখন ঝাঁপিয়ে পড়ত পানিতে মাছ ধরতে, সে দাঁড়িয়ে থাকত সমুদ্রের দিকে চেয়ে।

সে প্রায়ই তার মাকে জিজ্ঞেস করত—
— “মা, আমি কি উড়তে পারি?”
— “তুই তো মানুষ, বাবা। পাখিরা উড়ে, আমরা নয়।”
— “তাহলে পাখিরা কেমন মানুষ? ওদেরও তো মা-বাবা থাকে। আমি যদি গাংচিল হতাম?”
— “তুই এখনো পাখি না হলেও তোর মনটা পাখির মতো। ওটাই বড় কথা,” মা বলতেন, স্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে।

রুইর ঘরটা ছিল খুব সাধারণ—কাঠের দেয়াল, খড়ের ছাদ, আর একটি জানালা যেটা সমুদ্রের দিকে খোলে। প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙত গাংচিলের ডাক শুনে। আর প্রতিদিন রাতে সে শুয়ে শুয়ে আকাশে তাকিয়ে ভাবত, “আমি কীভাবে ওদের মতো উড়তে পারব?”

সময় এগিয়ে চলল। রুই যখন স্কুলে যেতে শুরু করল, তখনই বুঝতে পারল তার স্বপ্ন সবার কাছে এতটা সাধারণ নয়।

— “তুই কি পাগল? গাংচিল হতে চাস?” — বলত রমেন, তার ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্ট ছেলে।
— “দেখ না ওর মুখটা। এবার পিঠে ডানাও বানাবে নিশ্চয়?” — হাসত দীপ্তি, পাশের বেঞ্চে বসা মেয়ে।
— “উড়ে চলে যা, রুই গাংচিল!” — ব্যঙ্গ করত সবাই।

রুই প্রথম প্রথম কষ্ট পেত। সে চেষ্টা করত তাদের বোঝাতে—আকাশের প্রতি এই টানটা আসলে কতটা গভীর। সে পাখি নিয়ে বই পড়ত, স্কুলের লাইব্রেরি থেকে পাখির চিত্রপুস্তক ধার করত। পাখির হাড়ের গঠন, তাদের ডানার গতি, বাতাসের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষমতা—সব কিছু জানতে চেয়েছিল সে।

কিন্তু সবাই ভাবত সে উদ্ভট। ধীরে ধীরে সে একা হয়ে গেল। তার খেলাধুলা বন্ধ হলো, কারো জন্মদিনে ডাকা হতো না। কেউ আর তার পাশে বসতে চাইত না। তবে সে একটিবারও স্বপ্ন দেখা বন্ধ করল না।

রুইর একটা পুরনো ডায়েরি ছিল—বাবা একবার মাছ বিক্রি করে এনেছিল শহর থেকে। সেই ডায়েরির পাতা ভরিয়ে তুলেছিল সে নিজের আঁকা পাখি, গাংচিলের পেছনে সূর্য, ডানার মাপের হিসাব, এমনকি একটাও স্বপ্নের ছবি—সে নিজে গাংচিল হয়ে উড়ছে।

রুই লিখেছিল: “যদি আমি পাখি হতাম, আমি উড়ে যেতাম পাহাড় ছুঁতে। কিন্তু যদি আমি মানুষ হয়েও উড়তে পারি, তবে আমি স্বপ্ন ছুঁতে পারি।”

ডায়েরিটার নাম দিয়েছিল সে—“গাংচিলের ডানা।”

এক রাতে রুই এক আশ্চর্য স্বপ্ন দেখল। সে সমুদ্রতটে দাঁড়িয়ে। বাতাসে কুয়াশা, চারপাশ নিঃশব্দ। হঠাৎ তার পিঠে যেন কিছু ভিজে ডানা গজাচ্ছে। সে ডানাগুলো মেলে ধরল, এবং এক ঝটকায় বাতাসে উঠে গেল। নিচে সমুদ্র, ঢেউ, তার ঘর—সব পেছনে পড়ে গেল। সে উড়ে চলেছে, গাংচিলের পাশে পাশে। ঘুম ভাঙতেই রুইর বুক ধুকধুক করতে লাগল। সে জানত—স্বপ্নটা একদিন বাস্তব হবে। একদিন বিকেলে রুই বসে ছিল পাড়ে। তখনই সে দেখল, তার বাবার নৌকার পেছনে একটি গাংচিল লেজে লেজ মিলিয়ে উড়ে চলেছে। ঠিক যেন পথ দেখাচ্ছে। সে ভাবল—“গাংচিলরা কি জানে আমি তাদের মতো হতে চাই?”

সে প্রতিদিন তাদের চলন লক্ষ্য করত। তারা কিভাবে বাতাসে নিজেদের শরীর ঢিলে করে, কীভাবে ডানার কোণে বাঁক তৈরি করে, কখন থেমে যায়, আবার কবে জোরে উড়ে যায়—সব।

রুই নিজের শরীর দিয়েই চেষ্টা করত অনুকরণ করতে। মাঠে দৌড়ে, বাতাসে হাত ছুঁড়ে সে ভাবত নিজেকে পাখি।
বাচ্চারা হাসত, বড়রা বলত—“পাগলের মতো পাগলামি!”
কিন্তু তার চোখে ছিল নির্ভার আকাশ।

একদিন সমুদ্রের পাড়ে বসে সে হঠাৎ খুব একা অনুভব করল। ডায়েরিটা পাথরে রেখে সে হাঁটু জড়িয়ে বসল।আকাশে এক দল গাংচিল উড়ে যাচ্ছিল। তাদের ভেসে থাকা দেখে রুইর চোখে জল এল। সে আস্তে বলল—
“তোমরা আমায় নিয়ে যাবে? আমি কেবল একটু আকাশ চাই।”

তখনই এক পায়ের আওয়াজ শুনল সে। পেছনে দাঁড়িয়ে এক বুড়ো, মাথায় ছাতা, হাতে লাঠি। চোখে রহস্যময় আলো।

রুই তাকাল তার দিকে।

— “তুই উড়তে চাস?” প্রশ্ন করল বুড়ো।

— “হ্যাঁ,” নিঃশব্দে বলল রুই।

বুড়ো জেলেটি একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল—

— “যদি মন হয় সমুদ্রের মতো বিশাল, তবে শরীরও ডানা গজাবে।”

রুই থমকে গেল। বুকের ভিতর বাজ উঠল।
সেদিন বুঝেছিল—তার স্বপ্ন নিছক পাগলামি নয়, একটা ডাকে সাড়া দেওয়া।

অধ্যায় ২: হাসির পাত্র

রুইর মনে সেদিন থেকেই অদ্ভুত কিছু জন্ম নিল। বুড়ো জেলের কথা যেন ধ্বনিত হচ্ছিল বারবার:
“যদি মন হয় সমুদ্রের মতো বিশাল, তবে শরীরও ডানা গজাবে।”

সেই রাতে ঘরে ফিরে রুই ডায়েরির একটি খোলা পাতায় লিখল— “আজ একজন বলল—মন যদি সমুদ্রের মতো হয়, তবে শরীরও ডানা গজাবে। তাহলে আমি তো অর্ধেক রাস্তায় পৌঁছে গেছি। কারণ আমার মন তো সমুদ্রের চেয়েও গভীর।”

পরদিন স্কুলে রুই তার চেনা চেহারায় ফিরেছিল। কিন্তু তার চোখের ভেতর যেন নতুন দীপ্তি। ক্লাসে গিয়ে সোজা উঠে দাঁড়াল।

— “আমি একদিন উড়ব,” বলল সে, গলা শক্ত করে।

— “কি বললি?” রমেন চমকে তাকাল।

— “একদিন গাংচিলের মতো আমি উড়ব। আকাশে।”

ক্লাস ফেটে পড়ল হাসিতে।

— “তাহলে এখনই জানলা দিয়ে লাফ দে!” — রমেন চেঁচিয়ে বলল।
— “উড়ে যদি গিয়ে পড়িস বাজারে, তোর পেছনে দড়ি বেঁধে দেব, ঘুড়ি বানিয়ে রাখব!” — দীপ্তি বলল ব্যঙ্গ করে।

রুই মুখ নামিয়ে নিল না। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, হাসির ঝড় চলতে থাকল।

শিক্ষক এসে পড়লে হাসি থেমে গেল। তবে সেই হাসির রেশ রুইর কানে কাঁটা হয়ে রইল।

স্কুলের ঘটনাটা ছড়িয়ে পড়ল। পাড়ার বড়োরা চায়ের দোকানে বসে বলতে লাগল—

— “এই ছেলেটা পাগল হয়ে যাচ্ছে।”
— “জেলেপাড়ার ছেলে হয়ে আকাশে উড়তে চায়?”
— “একটা দিন মাছ ধরতে শেখেনি, শুধু আকাশ-আকাশ করে!”

রুইর বাবা, হরিদাস, একটু চিন্তিত হল। একদিন রাতে সে রুইকে ডেকে বলল—

— “দেখ রে, আকাশ তো দূরের জিনিস। আমাদের জীবন সমুদ্রেই বাঁধা। এসব ভাবা বন্ধ কর।”

রুই ধীরে বলল,
— “কিন্তু বাবা, আকাশও তো সমুদ্রেরই ওপর। গাংচিলরাও তো পাখি, কিন্তু তারা সাগরের সাথেই থাকে। আমি যদি সাগরের সন্তান হই, আমি কেন আকাশে যেতে পারি না?”

হরিদাস চুপ করে রইল। ছেলের যুক্তিতে কোনো জবাব ছিল না। রুই একদিন সমুদ্রপাড়ে বসে ডায়েরি খুলে নিজের লেখা পড়ছিল। হঠাৎ সে একটা পাতা ছিঁড়ে ছুঁড়ে দিল বাতাসে। সে রাগে-দুঃখে বলল—

— “সবাই ভাবে আমি পাগল। সবাই আমায় নিয়ে হাসে। কেন আমি আর পাঁচজনের মতো হতে পারি না?”

হঠাৎ পেছন থেকে আওয়াজ এলো—
— “তুই কি চাইছিস আর পাঁচজনের মতো হতে?”

রুই ঘুরে দেখল, আবার সেই বুড়ো জেলে দাঁড়িয়ে। গায়ে ময়লা জেলেদের জামা, কিন্তু চোখে সেই একই মায়াবী দীপ্তি।

— “তুই যে হাসির পাত্র, সেটাই তো তোকে আলাদা করে। সবাই যদি হেসে চলে যায়, তার মানে এই না তোর স্বপ্ন ভুল। মানে তুই অন্য কিছু দেখছিস, যেটা ওরা দেখতে পায় না।”

— “কিন্তু সবাই মিলে আমায় তুচ্ছ করে!”

— “সাগরের ঢেউকে কেউ থামায়? গাংচিলকে কেউ বন্দী করতে পারে? তাহলে তুই কেন কারো কথায় থামবি?”

রুই চুপ করে রইল। তার চোখ ধীরে ধীরে জলে ভরে উঠল।

সেদিন রাতেই রুই সিদ্ধান্ত নিল—সে আর কাউকে কিছু বোঝাতে যাবে না। সে হাসবে না, কাঁদবেও না, শুধু নিজের কাজ করবে। সে ঠিক করল, সে নিজেই বানাবে নিজের ডানা।

রাতে সে কাঠের টুকরো জড়ো করল। পাড়ার ফেলে দেওয়া সাইকেলের হ্যান্ডেল, পুরনো ঘুড়ির কাগজ, মাছ ধরার জাল—সব জিনিস ঘরে এনে রাখল।

মা অবাক হয়ে বলল—
— “কি করছিস এত রাত করে?”

— “ডানা বানাব মা।”

— “ডানা?”

— “হ্যাঁ, আমার ডানা। আমি উড়তে চাই।”

মা কিছু বলল না। তার চোখে শুধু ছিল বিস্ময় আর গর্বের মিশ্র ছায়া।

পরের দিন সকালেই পুরো গ্রামে খবর ছড়িয়ে পড়ল—রুই ডানা বানাচ্ছে!

চায়ের দোকানে, মাছের হাটে, স্কুলের আঙিনায়—সর্বত্র আলোচনা।

— “সত্যিই পাগল হয়েছে!”
— “ছেলেটা একদিন মরে যাবে!”
— “ওর মা-বাবা কিছু বলেন না?”

একদিন স্কুলে হেডমাস্টার রুইকে ডেকে বললেন—

— “তুই এইসব পাগলামি বন্ধ কর। ক্লাসের বাচ্চারা তোকে নিয়ে হাসে, এটা স্কুলের জন্য লজ্জার ব্যাপার!”

রুই বলল না কিছু। সে বুঝেছিল, যে কেউই তাকে বুঝবে না।

সে শুধু একটাই কথা মনে রাখল—

“আমি যদি নিজেকে না বিশ্বাস করি, তবে কেউ করবে না।”

সন্ধ্যে থেকে রাত পর্যন্ত রুই কাজ করত তার ঘরে। পুরনো কাঠ, বাঁশ, কাগজ দিয়ে তৈরি করছিল এক জোড়া ডানা। সে বাতাসের গতি মাপতে শিখেছিল, বাউন্স তৈরি করতে শিখেছিল, আর তার ডায়েরি—সেটা হয়ে উঠেছিল তার পরিকল্পনার নীলনকশা।

সে প্রায়ই গিয়ে গাংচিলদের ডানার গঠন লক্ষ্য করত। তারা যখন ওপরে উঠে হঠাৎ নামত, সেই গতিবিধি, বাতাসে ভারসাম্য—সব কিছু সে অঙ্ক কষে লিখে রাখত।

গ্রামের লোক হাসত, কিন্তু সে জানত—সে কেবল উড়ার স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা গড়ে তুলছে।

একদিন রুইর মা এসে চুপচাপ তার পাশে বসে ডানা বানানো দেখছিল।

— “তুই জানিস, তোর বাবা তোকে নিয়ে অনেক চিন্তায় থাকে। কিন্তু আমি জানি, তুই যা ভাবিস, সেটা হাওয়ায় নয়। তুই মাটির মানুষ। তুই আকাশেও ডানা মেলতে পারবি।”

— “তুমি আমায় বিশ্বাস করো, মা?”
— “বিশ্বাস করি। কারণ আমি জানি, তুই শুধু ডানা নয়, সাহসও তৈরি করছিস।”

রুইর চোখে জল এলো। মা’র এই বিশ্বাস তার হৃদয়ে আগুন হয়ে জ্বলল।

একদিন ভোরে, রুই তার ডানা নিয়ে দাঁড়াল সমুদ্রপাড়ে।  চারপাশে কুয়াশা, গাংচিলদের ডাক, আর উত্তরের হাওয়া।

সে জানে, এখনো উড়ার সময় আসেনি। কিন্তু আজ সে জানে—সে আর একা নয়।

সে এক হাসির পাত্র, যে নিজের হাসিটাই বদলে দিতে চলেছে একদিন পৃথিবীর আকাশ।

অধ্যায় ৩: সমুদ্রের গল্প

রুই যখন ছোট ছিল, তখনই সমুদ্র ছিল তার খেলার সাথী। বাকি ছেলেরা মাঠে খেলে, গাছে উঠে আম পাড়ত, আর রুই বসে থাকত জেটির মাথায়। তার ছোট্ট হাতে ছিল কাঠি আর পুরনো জাল – সে গাংচিলের দিকে তাকিয়ে ভাবত,
“ওদের কেউ শেখায়নি উড়তে, তাহলে আমাকেও কেউ শেখাতে পারবে না—আমি নিজেই শিখে নেব।”

মা বলত, “তোর জন্মদিনের দিনও সমুদ্র শান্ত ছিল না। ভোরে এমন ঢেউ উঠেছিল, মনে হচ্ছিল যেন তুই এলে বলেই সমুদ্র উত্তাল!”

সমুদ্রের সেই উত্তালতা যেন রুইর চরিত্রেও ঢুকে গিয়েছিল। সে ছিল শান্ত, কিন্তু গভীর জেদি।

বাবা হরিদাস ছিল গ্রামের সেরা জেলে। কিন্তু রুইর আকাশে উড়তে চাওয়ার বাতিক তাকে অস্বস্তিতে ফেলত।

— “আমার ছেলে মাছ ধরতে শেখেনি এখনো। ডানার পেছনে ছুটছে!”

বিকেল বেলা একদিন বাবা ছেলেকে ডেকে বলল,

— “তুই আমার ছেলেই তো? আমার রক্তই তো? তাহলে কেন এমন অদ্ভুত?”

রুই বলল,
— “তুমি তো সমুদ্র ভালোবাসো, তাই না?”

— “হ্যাঁ।”

— “আমি শুধু সমুদ্রটাকে এক অন্য দৃষ্টিতে দেখছি। তুমি তার বুক চিরে মাছ ধরো। আমি তার বুকে ভেসে যেতে চাই।”

হরিদাস একটু থমকে গেল। মনে মনে বুঝল, ছেলে জেদি হলেও অলীক নয়। তার স্বপ্নে সত্যিই গভীরতা আছে।

সে বলল না কিছু, শুধু ধীর কণ্ঠে বলল—
— “যদি পড়ে যাস, ফিরে আয়। আমি থাকব।”

সন্ধ্যায় সেই বুড়ো জেলে আবার দেখা দিল রুইর ঘরের পাশে। কাঁধে বস্তা, হাতে প্যাঁচানো দড়ি।

— “তুই ডানা বানাচ্ছিস, শুনলাম।”

— “হ্যাঁ কাকু।”

— “তোর জেদ মনে করিয়ে দেয় আমাকে আমার শৈশব।”

রুই তাকাল। বুড়ো হেসে বলল—
— “আমি ছোটবেলায় কাব্য লিখতাম। সবাই বলত, ‘জেলে হয়ে কবি?’ হাসত সবাই। আমি লেখাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। আজও পাঞ্জাবি পকেটে একটা পুরনো পাণ্ডুলিপি রেখেছি।”

সে ঝোলার ভেতর থেকে বের করল এক মলিন খাতা—সাদা পাতায় পুরনো কালি, কাঁপা হাতে লেখা ছড়া।

রুই বলল—
— “তাহলে তুমি এখনো কবি। যদি লেখাটা বুকে থাকে, কেউ কিছু বলুক, তুমি থামো না।”

বুড়ো একটু চমকে তাকাল। তার চোখে জল, ঠোঁটে হাসি।

— “তুই আমায় আমার পুরনো আমি ফিরিয়ে দিলি, বাছা।”

রুই বুঝল, তার স্বপ্ন শুধু তার নিজের নয়—এটা ছুঁতে পারে অন্যদেরও।

দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। রাতের পর রাত, সে কাটল কাঠ, বাঁধল জাল, গাঁথল বাঁশ আর কাগজে।

অবশেষে, এক জোড়া বিশাল ডানা প্রস্তুত হল। ৭ ফুট দৈর্ঘ্যের কাঠের ফ্রেম, কাগজ আর কাপড়ের আবরণ, মাছ ধরার জালের সাহায্যে ভারসাম্য রাখা হয়েছে।

সে ডায়েরিতে লিখল: “এগুলো নিছক কাগজ নয়। এগুলো আমার ইচ্ছার রূপ। আমার ভয়, লজ্জা, ব্যর্থতা – সব কিছু থেকে গড়ে উঠেছে এই ডানা।”

তবে, শুধু বানালেই তো হল না—পরীক্ষা তো বাকি। সেই দিনটির কথা রুই আজীবন মনে রাখবে। ভোরবেলা, কুয়াশা ছেয়ে আছে পাড়ার চারদিক। সব ঘুমিয়ে, শুধু সে আর সমুদ্র জেগে।

সে গিয়ে দাঁড়াল গ্রামের পুরনো লাল ক্লিফের চূড়ায়—সেখানে থেকে সরাসরি নীচে সমুদ্র।

ডানাগুলো কাঁধে বেঁধে নিয়েছে। বুক ধুকপুক করছে।

— “এই যদি শেষ হয়? যদি পড়ে যাই?”

এক মুহূর্তের জন্য বুড়ো জেলের কথা মনে পড়ল—“যদি মন হয় সমুদ্রের মতো বিশাল, তবে শরীরও ডানা গজাবে।”

সে দৌড় দিল, পাথরের কিনারা ছুঁয়ে, ঝাঁপ দিল নিচে!

হাওয়ার চাপ মুখে লাগল। ডানাগুলো ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে।
সেকেন্ড কয়েকের জন্য সে সত্যিই ভেসে ছিল। গাংচিলের মতো নয়, কিন্তু নিজের মতো। নিজের সাহস, নিজের প্রযুক্তি, নিজের বিশ্বাসে। তারপর ডানাগুলো ভারসাম্য হারাল—রুই হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল সাগরের জলে। জলের ভীরে সে চোখ খুলে দেখল—আলো পড়ছে তার চারপাশে। মনে হচ্ছিল, সমুদ্রও তাকে স্বাগত জানাচ্ছে। সে ভেসে উঠল। গা ভিজে, ডানা ভেঙে গেছে। কিন্তু মুখে একটুও পরাজয়ের ছাপ নেই।সে হাসল। প্রথমবার সে জানল—সে উড়েছে।

বাড়ি ফিরে তার শরীর কাঁপছিল। কিন্তু চোখ ছিল উজ্জ্বল।

মা ছুটে এল—
— “কি হয়েছে?”
— “আমি পড়ে গেছি। কিন্তু আমি ওড়ার স্বাদ পেয়েছি, মা।”

হরিদাস ছুটে এসে প্রথমে কিছু বলল না। তারপর পা টিপে বলল—

— “তুই পড়েছিস, কিন্তু হারাসনি।”

রুই বলল,
— “আমি আবার বানাবো। আরও ভালো ডানা। এবার ডানা নয়, গতি ও সমতলতা দুটোই বুঝে বানাব।”

বুড়ো জেলে এল রাতেই।
— “তুই প্রথম মানুষ, যাকে আমি পড়ে গিয়েও হাসতে দেখলাম।”

রুই বলল,
— “কারণ আমি জানি—আমি শুরু করেছি। এটা শেষ নয়।”

সমুদ্রের ঢেউ সেই রাতে একটু বেশিই সরব ছিল।

গাংচিলেরা ডাকছিল অনেক ওপরে।
রুই জানত, সে এখনো তাদের মতো নয়।
কিন্তু আজ, সে প্রথমবার একটু হলেও আকাশ ছুঁয়েছিল।

ডায়েরিতে সে লিখল:

“সমুদ্রের গল্প কেউ বোঝে না, কারণ সবাই কেবল তরঙ্গ দেখে।
কিন্তু আমি সাগরের গভীরতা জানি। আর জানি, সেই গভীরতা থেকেই জন্মায় আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন।”

অধ্যায় ৪: ডানা ও দিগন্ত

রুইর শরীর পুরোপুরি সেরে ওঠেনি। কাঁধে ব্যথা, পিঠে আঁচড়। কিন্তু চোখে আগুন। সে আবার ফিরল তার খুঁটিনাটি খাতা-কলমে। পুরনো ডানার নকশা খুলে বসে বিশ্লেষণ করতে লাগল—

কোথায় ভুল ছিল?

ওজন ভারসাম্য কি ঠিক ছিল না?

জাল কি বেশি টান দিচ্ছিল?

মা তাকে বলল,

— “দেহকে বিশ্রাম দে, আগে সুস্থ হ।”

রুই হাসল,

— “দেহ বিশ্রাম চায়, কিন্তু মন তো এখনই উড়ছে।”

সে এবার ঠিক করল, শুধু শক্ত কাঠ নয়—বাঁশ, ক্যানভাস, হাওয়ার গতির জ্ঞান, এসব নিয়েই পরের ডানা তৈরি করবে।বুড়ো জেলে এসে বলল,

— “এবার শুধু সাহস নয়, বুদ্ধিও লাগবে। সাহস আগুন, আর বুদ্ধি তার পাথর।”

রুই বলল,

— “আমি এবার পাথর গড়তে শিখছি, কাকু।”

গ্রামের পাঠশালায় একবার এক বিজ্ঞানী এসেছিলেন “কাইট ডায়নামিক্স” পড়াতে। রুই তখন পড়ত না, কিন্তু সে সেদিন কাঁচের জানালার বাইরে থেকে সব শুনেছিল।

এখন সে সেই বিজ্ঞানীর কথাগুলো মনে করতে লাগল—

“পাখির ডানা ওড়ে ত্রিভুজীয় ভরবন্টনে, না যে শক্তি বেশি, সে উড়তে পারে—যার ছন্দ বেশি, সে টেকে।”

রুই গেল পুরনো লাইব্রেরিতে। dusty science বই খুলে পড়তে লাগল aerodynamics, bird flight pattern, thermal current—যা পায় তা-ই পড়ছে।

পাঠশালার মাস্টারমশাই, অরুণ বাবু বললেন—

— “তুই তো বিজ্ঞানী হবি রে, জেলে নয়!”

রুই বলল—

— “আমি জেলেই হব। কিন্তু আমার জাল হবে ডানা, আর মাছ হবে দিগন্ত।”

একদিন, সে বুড়ো জেলেকে জিজ্ঞেস করল—

— “দিগন্ত আসলে কী, কাকু?”

বুড়ো একটু চুপ করে বলল—

— “যেখানে আকাশ আর জল মিশে যায়। কিন্তু সেই স্থান কখনো ধরা যায় না, যত এগোতে থাকো, সে তত পিছিয়ে যায়।”

রুই বলল—

— “তাহলে কি দিগন্ত শুধু ভ্রম?”

— “না রে, দিগন্তই তো আশ্বাস যে সামনে কিছু আছে।”

এই কথা রুইর মনে গেঁথে গেল। সে বুঝল—সে কেবল একটা গন্তব্য চায় না, সে চায় গতি।

এবারের ডানা আগের থেকে অনেক উন্নত। কাঠ নয়, বেছে নিয়েছে বাঁশ। হালকা কিন্তু শক্ত। জাল নয়, এবার কাপড় – পুরনো পাঞ্জাবি আর ক্যানভাস। ডানার প্রান্তে লাগানো হয়েছে ভাঁজযোগ্য হ্যান্ডেল – যাতে হাওয়ার সঙ্গে ছন্দ মিলানো যায়।এখন আর হুট করে ঝাঁপ দেবে না। সে প্রথমে বানাল একটা ঢালু বাঁশের র‍্যাম্প – গিয়ে দাঁড়াবে ক্লিফের পাশে, ছোট একটা দৌড়, তারপর ধীরে উড়ান।

রুই প্রতিবার লিখে রাখে সবকিছু—

“এটা এখন আর স্বপ্ন নয়—এটা প্রকৌশল। আমি গড়ছি একটা পাখি, যার পালকগুলো আমার হাতের তৈরি।”

এবার সে যেদিন উড়বে ঠিক করল, সেদিন খবর ছড়িয়ে পড়ল পাড়ায়। বাচ্চারা ছুটে এল, বুড়ো জেলেরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে।হরিদাস দূরে দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত গর্ব। রুইর কাঁধে আবার ডানা। এবার তার মুখে চিন্তা নেই—শুধু লক্ষ্য।

সে চিৎকার করে বলল—

— “আজ আমি সমুদ্রকে জানাব, আমি শুধু তার সন্তানই নই, আমি তার স্বপ্নও!”

সে দৌড় দিল র‍্যাম্পে। এইবার শরীর হালকা। বাতাস থমকে গেল যেন। ডানা ছড়িয়ে সে ভাসতে লাগল বাতাসে। সমুদ্র নিচে, আকাশ উপরে—সে মাঝখানে।

সেই মুহূর্তে, গাংচিলের দল একসাথে তার চারপাশে চক্কর দিল। লোকেরা নিচে তাকিয়ে দেখল—একটা ছেলে, তার হাতে তৈরি ডানায় ভেসে আছে, গাংচিলদের সঙ্গে!

এক বাচ্চা চিৎকার করে বলল—

— “ও উড়েছে! রুই দাদা উড়ছে!”

তবে চিরদিন উড়ান হয় না। ডানা এক সময় ভারসাম্য হারাল, আর রুই ধীরে ধীরে নিচে নামতে লাগল। কিন্তু এবার সে পড়ে যায়নি—সে পরিকল্পিতভাবে জল স্পর্শ করল। সে পানিতে নামল এক গাংচিলের মতোই—কোমল, নিখুঁত, নিজের ইচ্ছেমতো। জল থেকে উঠে সে ডানাগুলো খুলে ফেলল, বুকের ভেতরে এক দমকা হাসি—

“আমি পেরেছি। আমি শুধু উড়িনি, আমি নামতেও শিখেছি।”

বুড়ো জেলে তার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল—

— “আজ তুই শুধু উড়িসনি, আজ তুই এক নতুন পথ খুলেছিস। তুই আমাদের ভাবতে শিখিয়েছিস।”

সেই রাতে রুইর ঘরে মোমবাতি জ্বলছিল।

সে তার খাতায় লিখল— “আজ আমি দিগন্ত ছুঁইনি। কিন্তু আজ দিগন্ত আমার চোখে এসে বসেছে। আমি জানি, এ পথ লম্বা, কঠিন। কিন্তু আমি জানি, আমি থামব না।”

বাবা চুপচাপ এসে পাশে বসল।

— “তুই আমার চেয়েও বড় মৎস্যজীবী হবি, রুই।”

রুই হাসল।

— “আমি মাছ ধরব, তবে আকাশের নদী থেকে।”

মা এসে একটা গরম দুধ দিল।

— “তুই একদিন সব ছেলেমেয়েকে শেখাবি, কিভাবে উড়তে হয়।”

রাত গভীর হল। গাংচিলেরা ডাকল দূরে। রুই জানত—তার সামনে পথ অনেক, স্বপ্ন আরও অনেক। কিন্তু সে একা নয়।আজ সে জানে—তার ডানা আছে। আর দিগন্ত তার নিজের।

অধ্যায় ৫: ছেলেটি যে পাখি গড়ে

রুইয়ের উড়ে ওঠা যেন পাড়ার বাতাসেই গন্ধ ছড়ালো।
বাচ্চারা রাস্তায় রাস্তায় বলছে,
— “রুই দাদা গাংচিল!”
— “সে তো আকাশে হেঁটেছে!”

প্রথমে যাঁরা হেসেছিলেন, তাঁরাও এখন মাথা চুলকান,
— “সে কি সত্যি পারল?”
— “আমরাও তো এককালে স্বপ্ন দেখতাম…”

গ্রামের মোড়ে চায়ের দোকানে লোকজন বলছে,
— “ছেলেটা অন্যরকম। কত দূর যাবে কে জানে!”
— “সেই বুড়ো জেলের কথাই ঠিক, মন যদি সমুদ্রের মতো হয়…”

রুই কিন্তু এখন আর গর্বে ভাসে না। সে জানে—এই উড়ান ছিল শুধু সূচনা।

সেই বিকেলে, স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে একদল ছোট ছেলে তার বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়াল।

সবচেয়ে ছোট ছেলেটি, নাম গোপু, বলল—
— “দাদা, আমিও উড়তে চাই। তুমি শিখিয়ে দেবে?”

রুই একটু চমকে গেল। তারপর মৃদু হেসে বলল,
— “উড়তে হলে পড়াশোনা লাগবে। হাত শুধু ডানা বানাবে না, মাথাও বানাবে পথ।”

তারা বলল,
— “তুমি যেমন করেছো, তেমনই করব। আমরা ডানা গড়ব!”

সেদিন থেকেই রুই তার উঠোনকে বানাল ছোট্ট এক “উড়ানশালা”।
বাঁশ-কাঠ-কাগজ আর বিজ্ঞান বই মিলিয়ে শুরু হল এক নতুন পাঠ।

কিন্তু সবসময় গ্রাম একসাথে স্বপ্ন দেখে না।.একদিন পঞ্চায়েতের এক বুড়ো এসে বলল—
— “ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে নিয়ে খেলাচ্ছ? পড়াশোনা বন্ধ? এটা কোনো কাজের কথা নয়!”

রুই বলল,
— “আমি ওদের ওড়ান শেখাচ্ছি, পড়া ফেলে নয়, পড়ার ভিতর দিয়ে।”

— “আকাশে ওড়ে গাংচিল, মানুষের ছেলে নয়। শাসন দরকার।”

রুই চুপ করে রইল। সে জানে—উড়তে গেলে শুধু ডানা নয়, সহ্যশক্তিও লাগে।

তবে সেইদিন স্কুলের অরুণ বাবু পঞ্চায়েতে দাঁড়িয়ে বললেন,
— “আমি রুইয়ের পাশে। সে গ্রামকে নতুন আলো দেখাচ্ছে।”

গ্রামের বেশ কিছু বাবা-মা রুইয়ের কাছে এলেন,
— “আমাদের ছেলেমেয়েকে ঠিক পথে রেখো। বই-খাতা ফেলে যেন উড়ানই না হয় জীবনের একমাত্র পাঠ।”

রুই মাথা নাড়ল—
— “আমি শেখাব, কিভাবে পড়া থেকেই উড়ে যাওয়া যায়।”

দিন চলে যায় বাঁশ কাটতে, কাপড় কাঁটতে, ছোট ছোট ডানা বানাতে। রাত হলেই লণ্ঠনের আলোয় তারা পড়ে—“পাখির ডানার গঠন,” “হাওয়ার গতি,” “ওজনের ভারসাম্য।”
একটা পুরনো কালো বোর্ডে রুই লেখে—
“উড়ান মানেই পাখি হওয়া নয়, মনকে হাওয়া দেওয়া।”

গোপু এখন একটা ছোট্ট “ডানা” বানিয়েছে।
সে জানে, সেটা নিয়ে সে হঠাৎ উড়বে না, কিন্তু তার বিশ্বাস—একদিন সে পারবেই।

রুই প্রতিদিন তাদের শেখায়—

— “যদি গিয়ে পড়ো, উঠে দাঁড়াও। যদি ডানা ভেঙে যায়, নতুন বানাও। আর যদি হাওয়া থেমে যায়, নিজের ভেতর হাওয়া খুঁজো।”

একদিন ডাক এল পাশের শহর থেকে। এক সাংবাদিক চিঠি পাঠিয়েছে— “শুনেছি আপনি উড়েছেন। আমরা এক ভিডিও করতে চাই, ‘ছোট গ্রামে বড় স্বপ্ন’। আপনি সাক্ষাৎ দেবেন?”

রুই দ্বিধায় পড়ে। সে শহরে যায়নি কখনো। বুড়ো জেলে এসে বলল,
— “যা, শহর দেখ। কিন্তু মনে রাখিস, তোর দিগন্ত এখানেই। বাইরে যা দেখবি, সেই আলো এখানেই ছড়াবি।”

রুই গিয়ে শহরে সাক্ষাৎ দেয়। ভিডিও হয়—সে কিভাবে নিজের হাতে উড়েছে, কিভাবে শিখিয়েছে অন্যদের।

ভিডিও ভাইরাল হয়। লোকজন তাকে ডাকতে থাকে—“টক শো,” “মোটিভেশনাল স্পিকার,” “ইউথ আইকন”।

কিন্তু রুই বুঝে যায়—
উড়ে যাওয়া যতটা জরুরি, ততটাই জরুরি ফিরে আসা।

গ্রামে ফিরেই সে প্রথমে সবাইকে জড়ো করল। সে বলল—
— “আমাকে শহর জিজ্ঞেস করল—তুমি কি পাখি? আমি বললাম, আমি শুধু পাখি নই, আমি পাখিদের গড়ি।”

এবার সে বড় একটা লক্ষ্য ঘোষণা করল—
“একটা গাংচিল বিদ্যালয়”—যেখানে বিজ্ঞান, হাতের কাজ, প্রকৃতি আর স্বপ্ন—সব একসাথে শেখানো হবে।

লোকজন হেসে ফেলল প্রথমে। তবে এবার রুই একা নয়—তার শিষ্যরা পাশে। পুরনো মাছঘাটটাই তারা নতুন করে বানাতে লাগল। পুরনো নৌকাকে করল পাঠশালার ক্লাসরুম।
ডাঙায় বানাল ছোট রানওয়ে—ছোটদের ওড়ান অনুশীলনের জন্য।শুরু হল এক নতুন অধ্যায়—যেখানে ছেলে-মেয়েরা শুধু বই নয়, বাতাসকেও পড়ে। এক সন্ধ্যায়, গোপু তার ছোট্ট ডানা নিয়ে ছুটে এল।

সে বলল,
— “রুই দাদা, আমি একটু উঠতে পেরেছি! মাটির ওপর তিন ফুট!”

রুই তাকে জড়িয়ে ধরল।

— “তিন ফুট আজ, কাল তিরিশ। কিন্তু তারচেয়েও বড় তুমি শিখেছ—ডানা মানে সাহস।”

রুই আকাশের দিকে তাকাল। এক ঝাঁক গাংচিল তখন উড়ছে মাথার ওপর। সে জানে, আজ সে শুধু ওড়েনি। সে সেই ছেলেটি—যে নিজের হাতে পাখি গড়ে।

অধ্যায় ৬: গাংচিল বিদ্যালয়

ভোরবেলায় রুই দাঁড়িয়ে থাকে পুরনো মাছঘাটের সামনে। তার হাতে একটা খসড়া নকশা—
একটা নৌকা-ক্লাসরুম, একটা মাটির ঘর যেখানে দেয়ালই ব্ল্যাকবোর্ড, আর একটা বাঁশের তৈরি উড়ান-প্যাভিলিয়ন।

গোপু ও তার বন্ধুরা কাঁধে করে বয়ে আনছে বাঁশ, পুরনো টিন, শুকনো নারকেলগাছের গুঁড়ি।
কেউ রঙ করছে টিনের ছাউনি, কেউ ছেঁচে নিচ্ছে পুরনো কাঠ।

রুই বলে,
— “আমাদের গাংচিল বিদ্যালয় শুধু পড়াবে না—গড়বে। পাখিদের মতো, যাদের পাখনার ভিতরেই লেখা থাকে দিকচিহ্ন।”

এক বুড়ো জেলে এগিয়ে এসে এক গাদা ছেঁড়া জাল দিল—
— “এই নে রে, এগুলা দিয়ে তোরা মডেল বানাতে পারবি।”

রুই চমকে উঠল।
যারা একদিন বলত, “পাখি হওয়ার স্বপ্ন দেখিস না,” তারাই আজ হাতে হাত দিচ্ছে।

রুই বলল—“আমরা তিন রকম ক্লাস নেবো—হাতের কাজ, মননের কাজ আর হৃদয়ের কাজ।”

হাতের কাজ:
এই ক্লাসে শেখানো হয় কিভাবে পাখির ডানা বানাতে হয়।
বাঁশ, কাগজ, কাপড়, বেলুন, এমনকি প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে তারা বানায় ছোট ছোট উড়ন্ত জিনিস।

মননের কাজ:
এখানে পড়ানো হয়—পাখিবিদ্যা, বাতাসের নীতি, ওজন-বন্টন, নিউটনের সূত্র, পৃথিবীর গোলকীয়তা।

হৃদয়ের কাজ:
এটি ছিল সবচেয়ে আলাদা। এখানে কেউ গল্প বলত নিজের স্বপ্ন নিয়ে, কেউ আঁকত নিজের ভবিষ্যতের ছবি, কেউ গান গাইত আকাশ নিয়ে।
রুই বলত—“উড়ান মানে মন থেকে মন ছোঁয়ার সাধনা।”

এই বিদ্যালয়ে ছিল না কোনো ঘণ্টা, না কোনো কঠোর নিয়ম।
কিন্তু ছিল একটাই শর্ত—“তোমার স্বপ্ন তুমি নিজে আঁকো।”

একদিন রুই দেখল—পাহাড়ঘেরা পাশের গ্রাম থেকে ছেলেমেয়েরা এসে দাঁড়িয়েছে।
তারা বলল—
— “আমরা শুনেছি, এখানে আকাশ শেখানো হয়।”

রুই হেসে বলল—
— “তোমরা ভুল শুননি। এখানে মন শেখে কিভাবে পাখি হয়।”

শুধু ছোটরা নয়, কয়েকজন কিশোরও এল। তারা বলল—
— “আমরা শহরের স্কুলে থেমে গেছি। কিন্তু উড়ান থামেনি। আমাদের শেখাবে?”

রুই বুঝল—এই বিদ্যালয় শুধু তার গ্রামের নয়, চারপাশের দিগন্তেরও।

শীতকালের একটি দিন। গ্রামে একটা হাট বসেছে—চাল, মাছ, কাপড় সব বিক্রি হচ্ছে। রুই ঠিক করল—“আজ আমাদের বিদ্যালয়ের প্রদর্শনী হবে। গ্রামের সবাইকে দেখাতে হবে আমরা কী করি।”

গোপু, এখন দশ বছরের হলেও মনের দিক থেকে অনেক বড়।

সে বানিয়েছে একটা ডানা—নাম দিয়েছে “উৎসাহ”।

হাটের মাঝে ছোট্ট একটা স্টেজ বানানো হয়েছে।
গ্রামের সবাই ভিড় করেছে।

গোপু বলল,
— “আমি এখন ডানা ছুঁড়ে দিচ্ছি। এটা উড়বে না শুধু, মনও নিয়ে যাবে।”

সে হাওয়ায় ছুঁড়ে দিল তার ডানাটি। এটা বাতাসে দুলতে দুলতে ঘুরে ফিরে গেল প্রায় ১৫ সেকেন্ড। ছোটদের জন্য এটি এক বিস্ময়, বড়দের জন্য—এক নতুন আলো।

রুই বলল—
— “এই হল গাংচিল বিদ্যালয়। এখান থেকে শুধু মেধা নয়, সাহস জন্মায়।”

তবে প্রতিটি স্বপ্নের শত্রু থাকে। একদিন, জেলা শিক্ষা অফিসার এলেন।

তিনি বললেন—
— “আপনার এই বিদ্যালয় সরকারি অনুমোদন পায়নি। আপনার পদ্ধতিও তো বইয়ের বাইরে।”

রুই শান্ত স্বরে বলল—
— “আমরা পরীক্ষার জন্য না, জীবনের জন্য শেখাই। তবে হ্যাঁ, আপনার অনুমতি ছাড়া আমরা আগাতে চাই না। আপনি যদি আমাদের দেখে যান, দেখবেন—আমরা স্রেফ স্বপ্ন ছড়াই না, তার ভিত্তি গড়ি।”

অফিসার ঘুরলেন, দেখলেন।

তিনি শেষে বললেন—
— “আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে পারছি না এখনও, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি পাশে আছি।”

রুই জানে, পথ কঠিন, কিন্তু জোরদার।

মাঘ মাসের পূর্ণিমায় রুই ঘোষণা করল— “উড়ান উৎসব”।

সেই রাতে বিদ্যালয়ের মাঠ আলোয় ভরে উঠল। ডানা-প্রদর্শনী, স্বপ্ন-কথা, গানের অনুষ্ঠান, কবিতার আসর।
ছেলেমেয়েরা বলল—
— “আমি ডাক্তার হব, আমি নভোচারী, আমি পাখির গবেষক!”

এক ছোট্ট মেয়ে বলল,
— “আমি শুধু উড়তে চাই, রোজ। মন নিয়ে।”

রুই বুঝল—এই বিদ্যালয় শুধু শিক্ষার জায়গা নয়, বিশ্বাসের উত্স। সেই রাতে, শত ডানা হাওয়ায় ওড়ে। গ্রামের আকাশ যেন এক নতুন দিগন্ত ছুঁয়ে ফেলে।

রাত শেষে, বুড়ো জেলে এসে রুইয়ের পাশে দাঁড়াল।

সে বলল—
— “তোকে সেদিন বলেছিলাম—মন যদি হয় সমুদ্রের মতো, শরীরেও ডানা গজাবে।
তুই এখন ডানাও গড়িস, সমুদ্রও। তোর নাম এখন শুধু রুই নয়—আলো-গড়া পাখি।”

রুই আকাশের দিকে তাকাল। এক ঝাঁক গাংচিল তখন দিগন্ত ছুঁয়ে উড়ে চলেছে। সে জানে—তার “গাংচিল বিদ্যালয়” থেকে জন্ম নিচ্ছে শত রুই, শত গোপু—যারা একদিন সত্যি সত্যি আকাশ হবে।

অধ্যায় ৭: সেই গাংচিলের ছায়া

এক সকালে রুই গাংচিল বিদ্যালয়ের সামনের বেঞ্চে বসে ভবিষ্যতের কিছু নকশা আঁকছিল। গোপু দৌড়ে এসে বলল—
— “রুই দাদা! তোর নামে একটা চিঠি এসেছে। দেখ, কাগজটা কেমন পুরনো!”

রুই চমকে উঠল। কে চিঠি লেখে আজকাল? আর কেমন যেন হালকা হলুদাভ কাগজ, একপাশে সামান্য ছেঁড়া।

প্রাপক: “রুই (গাংচিলের স্বপ্নদ্রষ্টা), নামহীন গাঁয়ে, সমুদ্রপারের পাঠশালা”
এই ঠিকানায় চিঠি কিভাবে পৌঁছাল, কেউ জানে না।

সে চিঠি খুলল—
ছাপা অক্ষরে নয়, হাতে লেখা। অদ্ভুত ছন্দময় বাংলায়।

“তুই কি আমায় মনে রাখিস? আমি তো সেই প্রথম গাংচিল,
যেদিন তুই সাগরের ধারে বসে বলেছিলি—
‘আমি একদিন তোদের মতো উড়ব।’
আমি তোর চোখে স্বপ্ন দেখেছিলাম, রুই।
তখন তুই ছোট, তোর শরীর কাঁপছিল ঠাণ্ডায়,
আর তোর চোখ জ্বলছিল আগুনে। আমি তোর পাশে একবার ডানা ঝাঁপটিয়ে উড়েছিলাম।

তুই হেসে বলেছিলি, ‘দেখিস একদিন আমি ওড়ব তোদের সঙ্গে।’
আমি কথা দিয়েছিলাম—আমি ছায়া হয়ে থাকব তোর ডানায়।আমি এখনও উড়ি রে, রোজ। তোর গাংচিল বিদ্যালয়ের ওপরে দিয়ে। তোর জন্য রেখে গেলাম সমুদ্রপাড়ের সেই পাথরটার নিচে একটা কিছু। সেখানে তোর প্রথম ডানার নকশা আঁকা আছে। দেখা করিস। সময় এসেছে।

— এক অদৃশ্য ডানার বন্ধু”

রুই স্তব্ধ। সে অনেক ছোট ছিল, যখন প্রথম গাংচিল দেখেছিল কাছ থেকে। সেই পাখির চোখে ছিল এক অদ্ভুত কৌতূহল। সে একা বসে ছিল, মা-বাবার লড়াইয়ের শব্দে ক্লান্ত। আর সেই পাখি তার কাছে এসে একটু মাথা নেড়ে, যেন বলেছিল—”তুই পারবি।”

সেই কথা কি কেউ জানে?

রুই ছুটে গেল পুরনো সেই জায়গায়। এখন সেই পাথরের চারপাশে কচুরিপানা, ঝাউগাছ। একটা গর্তে হাত ঢুকিয়ে তুলে আনল ছোট্ট একটা টিনের বাক্স। ভেতরে একটিই কাগজ।তাতে ছিল একটা নকশা—পাখার মতো, কিন্তু তার গঠন ছিল নিখুঁত। তার নিচে লেখা—
“ডানা নয়, এ মন—উড়বে ছায়া ছুঁয়ে।”

রুই বুঝতে পারল, এই নকশা কেউ রেখে গেছে বহু বছর আগে। হয়তো তারই কোনো শিক্ষক, বা হয়তো সত্যিই সেই প্রথম দেখা গাংচিল।

কিন্তু কে লিখেছে এই চিঠি?

গোপু বলল—
— “দাদা, এটা কি পাখির লেখা?”

রুই বলল—
— “সম্ভব নয়, কিন্তু কে জানে! কিছু কিছু ছায়া শুধু দেখা যায় হৃদয়ে।”

রুই ফিরে গেল তার পুরনো খাতাগুলোর দিকে।
একটা পাতায় সে একদিন ছোটবেলায় আঁকেছিল গাংচিলের চোখ। তার নিচে লেখা ছিল—
“আমার ডানার বন্ধু”।

সে তখন একা থাকত। বাবা ছিল জেলে, মা মাছ শুকোতেন।
খেলতে যাওয়ার সময় এক পাখি প্রায়ই তাকে অনুসরণ করত।

সে এখন বুঝতে পারছে—সেই সময় থেকেই কেউ একজন তাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করছিল।

সে ছুটে গেল বুড়ো জেলের কাছে।

— “বুড়ো কাকা, তুই আমাকে একবার বলেছিলি—পাখিরাও কথা বলে।”

বুড়ো হেসে বলল—
— “তুই তখন ছোট। তোর চোখে একটা গাংচিল প্রায় রোজ বসত।
একদিন আমি দেখেছিলাম, সে তোর হাতের ওপর ঠোঁট ছুঁয়েছিল।
তুই হাসতে হাসতে বলেছিলি—‘আমার ভাই হবে এটা।’”

রুই কেঁপে উঠল।

সে কি সত্যিই একটা গাংচিলের সঙ্গে এমন বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিল যা সময় পেরিয়ে এখনও বেঁচে আছে?

রুই ঠিক করল—এই নকশা ব্যবহার করবে তার পরবর্তী শিক্ষা প্রকল্পে। তার ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সে গড়ে তুলল
“ছায়া-উড়ান” নামে একটি প্রকল্প।

এখানে শুধু বাহ্যিক উড়ান নয়, মনোজাগতিক ও কল্পনাপ্রসূত উড়ানের চর্চা হয়। শিক্ষার্থীরা লেখে—

“আমার স্বপ্ন উড়ছে এক বিশাল পাখির পিঠে।”

“আমার ভয় নিচে পড়ে আছে, আমি এখন হাওয়ায় হেসে চলেছি।”

“ছায়া নয়, আমি আলো।”

রুই তাদের শেখায়—
— “একটা ডানা মানে শুধু উপরে ওঠা নয়, ভিতরে গমনের পথ।
যদি ভেতরের ছায়া ছুঁতে পারো, তবে বাইরের আকাশ নিজে আসবে।”

এক সন্ধ্যায়, হঠাৎ এক ঝাঁক গাংচিল উড়ে এলো বিদ্যালয়ের উপর দিয়ে।

সবাই বলল—
— “দেখো! গাংচিলেরা বার্তা নিয়ে এসেছে!”

গোপু বলল—
— “ওদের একজন বারবার নিচে নিচে ঘুরছে, যেন আমাদের দেখে নিচ্ছে।”

রুই তাকাল।
একটা গাংচিল সত্যিই তার মাথার ওপর চক্কর কাটছে।
তার ডানার নিচে যেন একটা কালো দাগ—একটা আর ইংরেজি অক্ষরের মতো।

রুই ফিসফিস করে বলল—
— “রুই…?”

পাখিটি একবার ছুঁয়ে চলে গেল দিগন্তের দিকে। কেউ জানে না সে কে। কিন্তু রুই জানে—সে ফিরে এসেছে, তার ছায়ার বন্ধু। তাকে মনে করিয়ে দিতে, তার স্বপ্নগুলো একা ছিল না।

রাতে রুই লিখে রাখল—

“আমি জানি, কিছু বন্ধুত্ব কাগজে লেখা যায় না।
কিছু চিঠি আসে সমুদ্রের হাওয়ায়।
কিছু ছায়া থেকে যায় ডানার ভাঁজে।
আমি একা ছিলাম না কোনো দিন।
গাংচিলেরা জানত, আমি আসছি।
আজ আমার বিদ্যালয়ে শুধু ছাত্র নয়,
আমার অতীতও ছাত্র হয়ে ফিরে এসেছে।
আকাশ এখন আর দূরে নয়।
আকাশ এখন আমার ভেতরে।”

অধ্যায় ৮: উড়ে যাওয়া পাথর

সকালবেলা গাংচিল বিদ্যালয়ে গুঞ্জন ছড়ায়- শুভ নেই।
তৃতীয় শ্রেণির সেই নিরীহ, ভাবুক ছেলেটি, যাকে রুই প্রায়ই জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে দেখত।

গোপু বলল—
— “দাদা, শুভ ক্লাসে আসেনি। ওর মা বলছে, ও ভোরেই বেরিয়েছে। আর ফেরেনি।”

রুইর বুক ধড়ফড় করে উঠল। এই তো আগের দিন শুভ বলেছিল—
— “দাদা, তুমি বলেছিলে না ‘পাথরও একদিন উড়তে চায়’? আমি একবার সেটা দেখতে চাই!”

কী বলেছিল সে? উড়ে যাওয়া পাথর?

রুই দ্রুত ছুটল সেই সমুদ্রপাড়ের দিকে, যেখানে তারা সেই পুরনো পাথরটি পেয়েছিল, যার নিচে ছিল রহস্যময় নকশা।

পাথরটা নেই। তার বদলে জলে ভেসে আছে একটুকরো কাপড়—শুভর গায়ের জামার অংশ।

রুই মনে করতে চেষ্টা করল— শুভ কি সত্যিই কোথাও যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিল?

হ্যাঁ। আগের সপ্তাহে সে একটি নোট দিয়েছিল রুইকে।
সেখানে আঁকা ছিল একটি পাথর, যার ভেতর থেকে ডানা গজিয়েছে।
নিচে লেখা—
“যদি পাথরও স্বপ্ন দেখে, তবে আমি তার সঙ্গে যাব। দেখা হবে ডানার আড়ালে।”

রুই বুঝল—শুভ শুধু হারিয়ে যায়নি, সে খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই ছায়া, যেটা রুই একদিন পেয়েছিল।
সে হয়তো সেই প্রথম গাংচিল বা তার প্রতীক খুঁজতে বেরিয়েছে।

বুড়ো জেলের কাছে গেল রুই।

— “বুড়ো কাকা, তুমি বলেছিলে কোনো কোনো পাথর জলের নিচে থেকেও অপেক্ষা করে উড়বার জন্য। শুভ কি এমনই কোনো পাথরের পেছনে গেছে?”

বুড়ো জেলের চোখে জল।

— “ও ছেলে বুঝেছিল, স্বপ্ন শুধু বাতাসে নয়, জলের নিচেও থাকে। হয়তো সে সেই ছায়ার খোঁজেই গেছে, যেটা একদিন তোর হয়েছিল।”

রুই পুরো গ্রাম জুড়ে শুভকে খুঁজতে লাগল। সে গিয়েছে জোয়ারের দিকে, এমনটাই খবর। তখন রাত হয়ে গেছে।

হঠাৎই এক ছেলেমেয়ের চিৎকার—
— “ঐ তো শুভ! ঐ তো একদম পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে!”

সবার দৃষ্টি সমুদ্রের জলে ডুবে থাকা এক অদ্ভুত পাথরের দিকে। তার ওপরে দাঁড়িয়ে শুভ, দু’হাত মেলে রেখেছে।
চারপাশে জোয়ার, অথচ তার পাথরের নিচে একটুও জল নেই। শুভ যেন ডানা মেলে দাঁড়িয়েছে। রুই ছুটে গিয়ে টেনে আনে তাকে।

— “তুই এখানে কেন এলি?”

শুভ কাঁপতে কাঁপতে বলল—
— “দাদা… আমি তো শুধু দেখতাম সেই পাথরটা…
ওটা উড়ছিল, আমি দেখেছি… আর আমি ভেবেছিলাম, যদি আমি দাঁড়াই, আমি বুঝতে পারব… আমি কি গাংচিল?”

পরদিন রুই সেই পাথর খুঁড়ে দেখল—ভেতরে একটা খাঁজ।

সেই খাঁজে একটা ছোট পিতলের পাত। তাতে লেখা—

“আমি একদিন উড়তে চেয়েছিলাম, তাই নিজেকে পাথর বানিয়েছিলাম, যেন উড়তে পারি নিজের ওজন নিয়েও। যে আমার ওপরে দাঁড়ায়, সে নিজেই হয়ে ওঠে হালকা। আমি এক উড়ে যাওয়া পাথর।”

— নামহীন ডানার মালিক

রুই বুঝল—এটা কোনো পাখি নয়, কোনো শিশু, বা স্বপ্নদ্রষ্টা বহুদিন আগে তার ভবিষ্যতের জন্য রেখে গেছে এই বার্তা।গাংচিল বিদ্যালয়ের শিশুরা আজ সেই উত্তরসূরি। শুভ হাসতে হাসতে বলে—
— “দাদা, আমি জানি, আমি উড়িনি। কিন্তু যখন দাঁড়িয়ে ছিলাম, আমার মনে হচ্ছিল, আমি মাটিতে নেই।”

রুই বলল—
— “তুই উড়েছিস, শুভ। মনে মনে উড়লে, শরীর তো শুধু বাহক।”

রুই তৈরি করল একটি নতুন চত্বর—
“উড়ে যাওয়া পাথর প্রাঙ্গণ”

এখানে শিশুরা এসে দাঁড়ায়, ভাবে, চোখ বন্ধ করে স্বপ্ন দেখে।

একটি দেয়ালে খোদাই করা—

“এই পাথর তাদের, যারা ওজন নিয়ে হালকা হতে চায়।”

শিশুরা একে একে বলে—

“আমি ওড়াতে চাই আমার ভয়।”

“আমি ছুঁতে চাই আমার বাবার হারিয়ে যাওয়া হাসি।”

“আমি হতে চাই গল্প।”

রুই বোঝে—প্রকৃত ডানা হলো সেই ক্ষমতা, যা বিশ্বাস জোগায়,যে শক্তি বলে— তুই পারবি।

রাতে রুই ডায়েরিতে লেখে—

“একটা পাথরও যদি উড়তে চায়, তাহলে একটা মন কেন পারবে না?
শুভ আজ দেখিয়েছে—যে পাথরের ওজন তাকে তলিয়ে দেয়,
সেই পাথরই হয়ে উঠতে পারে উড়ানের পাটাতন।
আমি শুধু শিক্ষক নই।
আমি সেই গল্পের পাথর, যার ওপরে দাঁড়িয়ে একদিন রুই নামের ছেলেটি বলেছিল—
‘আমি একদিন উড়ব।’
আর আজ, অন্য এক শুভ দাঁড়িয়ে বলছে—
‘আমিও।’”

অধ্যায় ৯: সমুদ্রের শেষ পাঠশালা

এক বিকেলে, গাংচিল বিদ্যালয়ের বইয়ের তাক পরিষ্কার করার সময় রুই এক পুরনো চামড়ার খাতা পেলো।
খাতা পাতলা, কিন্তু পাতা-পাতা সোনালী আঁচড়ে লেখা। খাতার পৃষ্ঠায় ধোঁয়া-মাখা হাতের ছাপ।

রুই মনে করল—“এই কি আমার বুড়ো জেলের সময়ের কিছু?”

খাতা খুলতেই চোখে পড়ল তার প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা—

“যে পথ ধরে তুমি এলে, তার শেষে সমুদ্র অপেক্ষা করছে, কিন্তু এই সমুদ্র কখনও শেষ হয় না।
তোমার পাখিদের ডানা শিখতে হবে শুধু উড়তে নয়, পড়ারও।”

রুই একটু অবাক হয়ে পড়ল। তখনই একদম নিচে একটা নাম— শ্রীমতী কমলা দেবী।

বুঝতে পারল, এটি কেউ নারী শিক্ষক লিখেছেন, যিনি অনেক বছর আগে এই গ্রামের মেয়ে শিশুদের পড়াতেন।

রুই খাতা ধরে পড়তে লাগল। সেখানে শুধু শিক্ষা নয়, বরং জীবনের পাঠ ছিল গাঁথা—একেকটি গল্পের আড়ালে একেকটি নীতিমালা, যেগুলো সমুদ্রের মতো গভীর।

একখান গল্প চোখে পড়ল—

“একবার এক মেয়ে ছিল, নাম রাণী। সে ছিল ভীষণ সাহসী, কিন্তু গ্রামের সবাই বলত ‘মেয়ে তোমার স্বপ্ন কবে পূর্ণ হবে?’
সে হাসত, বলত— ‘স্বপ্ন পূর্ণ হয় যখন মন বিশাল হয়। ডানাও তখন গজায়।’
আজ সে গ্রামের সবচেয়ে বড় শিক্ষক।”

রুই অবাক হল। সে ভাবল, এমনই একটা নারী শিক্ষক হয়তো সেই বুড়ো জেলে যেমন তার স্বপ্ন দেখিয়েছে, তারই উত্তরসূরি।

খাতার এক পৃষ্ঠায় কমলা দেবী লিখেছেন— “শিক্ষা শুধু বই পড়ানো নয়, আকাশে উড়ার প্রশিক্ষণ। একদিন এই গাংচিলেরা শুধু সমুদ্র পাড়ি দিবে না, তারা স্বপ্নপূরণের ডানা গজাবে।”

রুই গভীর ভাবনায় পড়ল। বুঝতে পারল, এই স্কুল শুধু পড়ার জায়গা নয়, বরং জীবনের, স্বপ্নের, আস্থার পাঠশালা।

খাতা খুলতেই সামনে এল একটি ছোট্ট নকশা— একটি গাংচিল একটি শিশুকে ডানা ছোঁয়ানোর মতো। তার পাশে লেখা— “যে শিশুটি ডানার ছোঁয়া পায়, সে আর পাথর হয় না। সে হয় আকাশের অংশ।”

রুই হঠাৎ বুঝতে পারল—এটাই তার জীবনের মূল কথা।
যে ডানা সে ছোটবেলা থেকে চাইছিল, তা শুধু বাহ্যিক নয়, অন্তর্নিহিত। এ ডানা দিয়ে সে শুধু নিজেকে নয়, অন্যদেরও উড়তে শিখাবে।

রুই খাতা নিয়ে বিদ্যালয়ের সামনে গিয়ে সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলল—  “এই খাতা আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে, আমাদের সপ্নকে আমরা শুধু দেখতে পারি না, বাস্তবও করতে পারি।
আমাদের ডানাগুলো শুধু পাখির নয়, মন এবং মনুষ্যত্বেরও।”

শিশুরা হাততালি দিলো। একজন ছাত্র বলল— “দাদা, তাহলে কি আমরা শুধু পড়ব না, উড়বও?”

রুই হাসল— “হ্যাঁ। শুধু পড়াশোনা নয়, আমাদের স্বপ্নের ডানা গড়া।”

রুই রাতে খাতায় লিখল—

“একজন পুরনো শিক্ষক আমার জন্য রেখেছিল এই খাতা।
সে বলেছিল—‘যে ডানা গজাবে, সে শুধু উড়বে না, অন্যদেরও নিয়ে যাবে।’
আমি শুধু একটা শিক্ষক নই—আমি সেই ডানার কপালে এক আঁচড়। আমি জানি, এই সমুদ্রের শেষ নেই, কিন্তু আমি ডানা গজাবো। ডানার ছোঁয়া দিয়ে আমার স্কুলের সবাই একদিন আকাশ ছুঁবে।”

অধ্যায় ১০: ডানার ওড়ান

রুই স্কুলের উঠোনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলো, আজকের দিনের সূর্য যেন একটু আলাদা, একটু নতুন রঙের। আকাশটা যেন তার জন্য একটু বেশি প্রশস্ত। সমুদ্র থেকে আসা হালকা হাওয়া খেলছে গাছের পাখা থেকে ঝরে পড়া পাতা গুলোকে।

“আজ থেকেই শুরু,” সে মনে করল, “আমাদের ডানাগুলো সত্যিকারের ওড়ার প্রস্তুতি নেবে।”

স্কুলের সব ছাত্রছাত্রী জমে উঠলো নতুন উদ্যোগের জন্য —
একটা প্রকল্প, যেখানে তারা শুধু বইয়ের শিক্ষাই নয়, জীবনের শেখা নেয়া ও স্বপ্ন পূরণের গল্প তৈরি করবে।

স্কুলের শিক্ষকরা নিয়ে এলেন নানা রঙের কাগজ, কাঠের ছড়ি, কাপড়ের টুকরো। শিশুরা হাতেমুখে লাগালো, তৈরি করলো তাদের নিজস্ব পাখির ডানা।

রুই বললেন—
“ডানা মানে শুধু পাখির ডানা নয়, এটা তোমাদের স্বপ্ন, তোমাদের মনোবল, তোমাদের অদম্য ইচ্ছাশক্তি। এই ডানা দিয়ে উড়ো, ছোঁও সেই আকাশ যা তুমি চিন্তা করো।”

শিশুরা যত্ন করে বানালো, তাদের নিজের নাম লিখে দিলো ডানার পিঠে। শুভ ও আকাশ, রুইর দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু, বিশেষ করে উৎসাহী ছিলো। তারা বারবার বলছিল—
“আমাদের ডানাগুলো যেন সবচেয়ে বড় হয়!”

কিন্তু জীবনে সবসময় রোদেই তো চলেনা। গ্রামের একদল মানুষ বললো—
“এই ডানা নিয়ে কী করবি? মাছ ধরার কাজ এড়িয়ে যাবি? পড়াশোনা কিসের? মাটি মাড়ি না, আকাশে উড়বি?”

রুই ও শিশুরা অটল থাকল। তারা জানতো, এটা তাদের আত্মার উড়ান। একদিন ঝড় এলো, স্কুলের ছাদ থেকে ডানাগুলো উড়িয়ে গেল। অনেকেই মন খারাপ করল।
শুভ বলল—
“দেখো, ডানাগুলো আবার ছড়ালো আকাশে।”

রুই হেসে বলল—
“ঝড় তো আসে ডানা মজবুত করার জন্য।”

এক সুন্দর সকালে, স্কুলের মাঠে আয়োজন হলো “ডানার উড়ান”।
গ্রামের সবাই এসেছে। তাদের মাঝে কিছু আগ্রহী বয়স্ক মানুষ, যারা আগে ডানা নিয়ে হাসত।

রুই স্টেজে দাঁড়িয়ে বলল—
“আজ আমরা শুধু ডানা উড়াবো না, আমাদের স্বপ্নগুলোও উড়াবো। জীবনের প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলবো।”

শিশুরা একে একে তাদের ডানাগুলো হাতে নিয়ে ছুঁড়ে দিল আকাশে।
ডানাগুলো উড়ল, ঘুরপাক খেলল, বাতাসে ভেসে গেল।

গ্রামের মানুষদের মুখে হাসি ফোটলো, চোখে আশার দীপ্তি জাগলো।

উদ্বেগমিশ্রিত ভালোবাসায় রুই বুঝতে পারল, শুধু ডানা বানানো নয়, শিশুদেরকে জীবনের প্রতিটি বাঁকে লড়াই করতে শেখানোই আসল।

সে বলল—
“আমরা আজ থেকে শুধু গাংচিলের ডানা নিয়ে থাকব না। আমরা গাংচিলের মনোভাব গড়ে তুলবো—নিজের ওপর বিশ্বাস, স্বপ্নের পেছনে অক্লান্ত পরিশ্রম।”

সে সেই রাতে তার ডায়েরিতে লিখল—

“আমি শিখেছি, ডানা শুধু বাহ্যিক নয়। আমাদের মন, মনোবল, ভালোবাসা, লড়াই—এসবই আসল ডানা।
যে ডানা দিয়ে আমরা নিজের সীমা ছাড়িয়ে যাই, নিজের স্বপ্নগুলোকে সত্যি করি। আজ আমার স্কুলের সব শিশু গাংচিল, তারা ডানা মেলে উড়ে যাবে তাদের জীবনের সমুদ্র পাড়ি দিয়ে।”

সমুদ্রের ঢেউ যেমন অবিরাম সুর তুলে, তেমনি রুইয়ের স্কুলের শিশুরাও অবিরাম উড়ার শপথ নিলো।
গাংচিলের ডানার মতোই, তাদের আত্মাও মুক্ত, বিশাল।

রুই তখন জানত—সে স্বপ্ন দেখার ছেলেটা আজ হয়ে উঠেছে সেই মানুষ, যে অন্যদের ডানা গজানোর সাহস দেয়।

শুভের কথা মনে পড়ে, যে বলেছিল,
— “দাদা, আমরা উড়বো।”

হ্যাঁ, উড়বে তারা। তাদের ডানা নেবে আকাশের পাথরের স্পর্শ। আর সেই দিন দূরে নয়।

শেষ

 

1000023457.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *