Bangla - ভূতের গল্প

গহন বন আর বাঁশির ডাক

Spread the love

তনয়া সেন


বিকেলের শেষ আলোয় যখন সূর্য পাহাড়ের গায়ে ধূসর হয়ে গলে আসছিল, তখনই অরণ্যের বাস এসে পৌঁছল ছোট্ট গ্রামটায়। বাস বলতে আসলে একটা পুরোনো মিনিবাস, জানালার কাচ ঝাপসা, সিটের চামড়ায় ফাটল। গাঁয়ের নাম রাধাপুর—এমন নাম মানচিত্রে খুঁজলেও পাওয়া মুশকিল। তবু অরণ্যের মতো ফটোগ্রাফারের কাছে এই জায়গার টান ছিল অন্যরকম। শহরের কোলাহল, নামজাদা প্রকল্প, নামী রিসর্ট নয়—বরং অচেনা, অনাবিষ্কৃত জায়গার মধ্যে লুকোনো প্রকৃতির ছবি তুলতে তার সবচেয়ে ভালো লাগে।

অরণ্যের কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা ভারী, ভিতরে ক্যামেরা, লেন্স, ত্রিপড আর কিছু নোটবুক। বাসস্ট্যান্ডে নেমে চারপাশে তাকাতেই সে বুঝল, এই গ্রাম যেন সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁচা রাস্তা, খড়ের চালের ঘর, বাচ্চাদের ছেঁড়া জামা, আর বাতাসে মিশে থাকা গাছের সোঁদা গন্ধ। দূরে নীলচে পাহাড়ের গা থেকে উঠে আসছে একটা সবুজ সমুদ্র—ওই হচ্ছে ঘন বন, যেখানে ঢুকতে সে এসেছে।

বাসস্ট্যান্ডে তখন মাত্র কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে। একজন চা-ওয়ালা ধোঁয়া ওঠা কেটলি নামাচ্ছে, আরেকজন বৃদ্ধ বিড়ি ধরাচ্ছে। তাদের চোখে অরণ্যকে দেখে অচেনা দৃষ্টি। বাইরের লোক এ গাঁয়ে কম আসে, যারা আসে তারাও সাধারণত বাজার-সদাই বা কাজের প্রয়োজনে। কিন্তু হাতে ঝোলানো ক্যামেরা আর চোখে কৌতূহল নিয়ে কেউ এলে সে যে আলাদা চোখে ধরা পড়বে, তা অরণ্য জানতই।

“আপনি শহর থেকে আসছেন?”—চা-ওয়ালা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল।

অরণ্য হেসে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, কলকাতা থেকে। কয়েকদিন থাকব এখানে। বন আর পাহাড়ের ছবি তুলতে চাই।”

চা-ওয়ালা ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই আরেকজন বৃদ্ধ এগিয়ে এসে থামাল, “রাত হলে বনে যাবেন না বাবু। সাবধান।”

অরণ্য অবাক হয়ে তাকাল। “কেন? বাঘ আছে নাকি?”

বৃদ্ধ মাথা নাড়ল। “বাঘ থাকলে বুঝতাম। বাঘকে বন্দুক দিয়ে মারা যায়, খাঁচায় পুরে রাখা যায়। কিন্তু ওই জিনিসটা… ওই বাঁশির ডাক—ওটা থেকে কে বাঁচাবে?”

অরণ্য কপালে ভাঁজ ফেলল। “বাঁশির ডাক?”

বৃদ্ধ আর কিছু না বলে চুপ করে গেল। চারপাশে হাওয়ায় এক অদ্ভুত চাপা নীরবতা নেমে এল। চা-ওয়ালা দ্রুত হাত নেড়ে চায়ের গ্লাস এগিয়ে দিল, যেন প্রসঙ্গটা চাপা দিতে চায়।

চা খেতে খেতে অরণ্য মনে মনে ভাবল, এ নিশ্চয়ই কোনো লোককথা বা গ্রামের গুজব। এ ধরনের গল্প সব জায়গাতেই থাকে। হয়তো বাচ্চাদের ভয় দেখানোর জন্য বানানো। কিন্তু তার ফটোগ্রাফারের চোখে এটা একটা সুযোগ—গল্পের সঙ্গে জুড়ে ছবি তোলার বাড়তি আকর্ষণ।

চা শেষ করে সে হেঁটে চলল বুক করা লজের দিকে। লজ বলতে আসলে একটা দোতলা ভাঙাচোরা বাড়ি, এক বুড়ি মহিলা চালান। ঘরে কেরোসিনের গন্ধ, খাটে পুরোনো খাটপোকা-খাওয়া গদি। তবু অরণ্যের তাতে অসুবিধে নেই। রাতে স্রেফ একটা জায়গা চাই ঘুমোনোর জন্য। মূল লক্ষ্য তো বন।

সন্ধ্যা নেমে আসছে। জানলার ফাঁক দিয়ে অরণ্য দেখল, দূরে পাহাড়-ঘেরা অরণ্য অন্ধকারে গাঢ় হয়ে উঠছে। কোথাও যেন এক চাপা শিসের মতো শব্দ ভেসে এল, হাওয়ার সঙ্গে মিশে। অরণ্য চমকে উঠল, তারপর হাসল। “হাওয়া। আর কিছু নয়।”

রাত বাড়ল। লজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অরণ্য তার নোটবুকে লিখল দিনের প্রথম অভিজ্ঞতা। গ্রাম, মানুষের চোখ, বৃদ্ধের সতর্কবার্তা—সব লিখল। শেষ লাইনে লিখল—
“বাঁশির ডাক—কাল থেকে খোঁজা শুরু।”

তারপর সে ঘরে ঢুকে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু জানালার বাইরে থেকে হাওয়ার স্রোতের সঙ্গে ভেসে আসা সেই মৃদু সুর যেন তার কানে বাজতেই থাকল—এক অদ্ভুত টান, অজানা ডাকের মতো।

ভোরের আলো পাহাড়ের মাথায় ধুয়োমাখা সোনালি রং ছড়িয়ে দিয়েছিল। অরণ্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই আলোয় ক্যামেরার লেন্সে ফ্রেম খুঁজছিল। ভোরের ঠান্ডা বাতাসে শরীর শিরশির করছিল, কিন্তু চোখে ছিল এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস। এতদিন কেবল শহরের কংক্রিট আর ভিড়ের ছবি তুলেছে, কিন্তু আজ সামনে যে দৃশ্য, তাতে ক্যামেরা চালানোই যেন একধরনের প্রার্থনা।

লজের বুড়ি মালকিন বারান্দায় উঠে এসে বলল,
“বাবু, কাল রাত্তিরে কি শুনলেন কিছু?”

অরণ্য লেন্স নামিয়ে হাসল।
“হাওয়া বইছিল। শিস দেওয়ার মতো আওয়াজ হচ্ছিল, তাই না?”

বুড়ি মহিলার চোখ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠল।
“হাওয়া হলে মন্দ ছিল না। ওইটেই তো ভয়।”

অরণ্য কিছু বলবার আগেই নিচ থেকে ডাক ভেসে এল। কয়েকজন গ্রামবাসী জড়ো হয়েছিল কাঁচা রাস্তার ধারে, তাদের মধ্যে একজন সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, বয়স সত্তরের ওপর, গালে সাদা দাড়ি। অন্যরা তাকে গুরুজনের মতো সম্মান দিয়ে ঘিরে রেখেছে। লোকটির হাতে পুরনো এক বাঁশের লাঠি।

লজের বুড়ি নিচে তাকিয়ে বলল,
“ওই যে হরিহর কাকু এসেছেন। গ্রামে যাঁকে সবাই মানে।”

অরণ্য ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে নিচে নেমে এল। হরিহর কাকু তাকে একবার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখলেন, তারপর ধীরে ধীরে বললেন—
“আপনি শহর থেকে এসেছেন শুনলাম। ছবি তুলতে বনের ভেতরে যাবেন?”

অরণ্য হাসিমুখে উত্তর দিল, “হ্যাঁ, স্যার। বন্যপ্রাণী, প্রকৃতি—সবই আমার কাজের বিষয়।”

লোকটির চোখে কেমন যেন ছায়া নেমে এল।
“বাবু, এখানে বনের ভেতরে শুধু গাছগাছালি নেই। একটা জিনিস আছে যেটা আপনার ক্যামেরায় ধরা পড়বে না, তবু ধরা পড়লে মুক্তি নেই। রাতে ওই বনের দিকে যাবেন না।”

অরণ্য কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“সবাই বারবার রাতের কথাই বলছে। রাতে কী হয় বলুন তো? বাঁশির ডাকই কি?”

চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষরা যেন গুঞ্জন করে উঠল। কারও মুখে চাপা ভয়ের ছায়া, কারও চোখে বিশ্বাসহীনতা। কিন্তু হরিহর কাকু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন—
“হ্যাঁ, বাঁশির ডাকই। বহু বছর আগে এক শিকারি ছিল এখানে। নাম কেউ উচ্চারণ করে না আর। খুব সাহসী, কিন্তু অহংকারী। এক রাতে বনের ভেতর শিকার করতে গিয়ে সে নিজের ছায়াকে গুলি করে বসে। সেই থেকে… তার আত্মা বাঁশি বাজায়। বাঁশি শোনা মানেই কেউ না কেউ তার টানে বনের ভেতরে ঢোকে। আর কেউ আর ফেরে না।”

অরণ্য প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিতে চাইছিল। ছায়াকে গুলি করা! এ তো কেবল লোককথা। কিন্তু হরিহরের চোখে যে তীব্র গাম্ভীর্য, তা হেসে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।

সে বলল,
“আমি তো গবেষণা করি লোকজ কাহিনি আর প্রকৃতির ওপর। যদি এ গল্পটা সত্যি না-ও হয়, ছবির সঙ্গে গল্প লিখলে পাঠকেরা আগ্রহ পাবে। আর যদি সত্যিই কোনো রহস্য থাকে, তাহলে তো আরও বড় আবিষ্কার।”

হরিহর কাকু গম্ভীর গলায় বললেন,
“আবিষ্কার নয় বাবু, ওটা ধ্বংস। আমরা এতগুলো বছর ধরে ও ডাকে কান দিই না বলেই বেঁচে আছি। আপনিও শুনবেন না। বাঁশির শব্দ যদি ভেসে আসে, চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকবেন। বাইরে যাবেন না।”

একটু নীরবতা নেমে এল। বাতাসে হঠাৎ যেন চাপা শীতলতা।

অরণ্য ভেতরে ভেতরে কাঁপলেও মুখে কিছু বলল না। বরং ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ফোকাস করতে শুরু করল, যেন গল্পটা তার কাছে আর পাঁচটা পুরনো কিংবদন্তির মতোই।

কিন্তু তার মনের গভীরে একটা প্রশ্ন কিলবিল করে উঠল—
“আসলেই যদি বাঁশি বাজে, তবে সেটা কে? আর কেন?”

দিনটা কেটে গেল বনে চারপাশ ঘুরে। অরণ্য দিনের বেলায় ভোরের কুয়াশা, পাখির ঝাঁক, বাঁশঝাড়ের ভিতর ছুটে চলা হরিণ—সব ছবি তুলল। কিন্তু সন্ধ্যা নামতেই গ্রামের মানুষদের মধ্যে অস্বস্তি বাড়তে লাগল। কেউ তাকে ডেকে বলল,
“শহুরে বাবু, সূর্য ডোবার আগেই ঘরে চলে আসবেন।”

লজের বুড়ি আলো জ্বালিয়ে দরজা-জানলা বন্ধ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

আর অরণ্য? সে নিজের খাতায় লিখল—
“আজ গুরুজনের সতর্কবার্তা শুনলাম। গ্রামের ভয় বাস্তব হোক বা কুসংস্কার—আমার কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। বাঁশির ডাকটা আমি শুনতেই চাই।”

সন্ধ্যা নামতেই গ্রামটা অদ্ভুত নীরবতায় ডুবে গেল। লজের ভাঙাচোরা জানলার ফাঁক দিয়ে অরণ্য দেখছিল—পাহাড়ের পেছনে সূর্য লাল আভা ফেলে মিলিয়ে যাচ্ছে। আকাশে একচিলতে চাঁদ উঠেছে, আর তার সঙ্গে জ্বলজ্বল করছে কয়েকটা তারা। অথচ গ্রামে যেন সবাই অদৃশ্য হয়ে গেছে। কাঁচা রাস্তা খালি, চায়ের দোকান বন্ধ, শিশুদের খেলা থেমে গেছে। কেবল দূরে কুকুরের একবারের ঘেউ ঘেউ, তারপর আবার স্তব্ধতা।

লজের বুড়ি মালকিন দরজার কপাট বন্ধ করতে করতে গম্ভীর গলায় বলল—
“বাবু, আপনি ঘরে থাকুন। আজ রাতের হাওয়া ভালো না।”

অরণ্য হেসে বলল, “চিন্তা করবেন না, আমি শুধু বারান্দায় বসে থাকব।”

কিন্তু মন তার অন্য কিছু চাইছিল। সারাদিনের সতর্কবার্তা, বাঁশির গল্প, গ্রামের আতঙ্ক—সব মিলিয়ে তার মধ্যে এক প্রবল কৌতূহল জমে উঠেছে।

রাত আটটার পর ক্যামেরা আর ছোট নোটবুক হাতে বারান্দায় গিয়ে বসল সে। হাওয়ার দমকা হালকা শিস তুলছে, দূরের পাহাড় অন্ধকারে গাঢ় হয়ে উঠছে। অরণ্য খাতায় লিখল—
“আজ রাতেই বুঝব, গল্পটা গুজব না সত্যি।”

প্রথম একঘণ্টা কিছু শোনা গেল না। কেবল ঝিঁঝিঁর ডাক আর হাওয়ার শব্দ। অরণ্য ধীরে ধীরে বিরক্ত হতে লাগল। হয়তো সবটাই বানানো কাহিনি। শহরের লোককে ভয় দেখানোর জন্যই এসব গল্প ছড়ানো হয়।

কিন্তু রাত প্রায় সাড়ে ন’টার দিকে হঠাৎ বাতাস থেমে গেল। ঝিঁঝিঁর ডাক স্তব্ধ। নীরবতা এমন যে নিজের শ্বাসের শব্দও অরণ্যের কানে অস্বস্তিকর লাগছে। ঠিক তখনই—

ভেসে এল মৃদু বাঁশির সুর।

অরণ্য প্রথমে ভেবেছিল হয়তো কোনো গ্রামবাসী বাঁশি বাজাচ্ছে। কিন্তু সুরটা এত অদ্ভুত, এত মায়াবী যে মনে হচ্ছিল দূরের জঙ্গলের গভীর থেকে এক অতৃপ্ত সুর উঠে আসছে। সুরে দুঃখ আছে, ডাক আছে, এক অদ্ভুত টান আছে।

অরণ্যের বুক কেঁপে উঠল।

সে ক্যামেরা অন করে বারান্দার দিকে তাকাল। লেন্স ফোকাস করল অন্ধকার বনের দিকে। কিন্তু ছবিতে কেবল ঘন ছায়া।

বাঁশির সুর ধীরে ধীরে জোরালো হয়ে উঠল। যেন কারও অদৃশ্য ঠোঁট বাঁশির ফুটোয় ছোঁয়া দিচ্ছে, নিশ্বাস ভরে বাজাচ্ছে। মাঝে মাঝে সুর ভেঙে যাচ্ছিল, যেন হাঁপ ধরা এক মানুষের শেষ চেষ্টা।

অরণ্যের হাত ঘেমে উঠল। কিন্তু তার পা যেন নিজে থেকেই নড়তে চাইছে। সুরটা তাকে টানছে। মনে হচ্ছে—যদি বনের ভেতরে গিয়ে না দাঁড়ায়, তবে কিছু মিস করবে, জীবনের সবচেয়ে বড় ছবি।

হঠাৎ লজের ভেতর থেকে বুড়ি মালকিনের কণ্ঠ ভেসে এল—
“বাবু! দরজা বন্ধ করুন, বাইরে থাকবেন না!”

অরণ্য চমকে উঠল। কানে বাঁশির সুর এখনও বাজছে, কিন্তু তার চেয়ে প্রবল হয়ে উঠল কৌতূহল। ক্যামেরাটা কাঁধে ঝুলিয়ে ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল সে।

রাস্তাটা ফাঁকা, আকাশে কুয়াশা নামছে। অরণ্য কয়েক কদম এগোতেই বাঁশির সুর যেন আরও কাছে এল। মনে হচ্ছিল, বন তাকে হাতছানি দিচ্ছে।

সে থামল, গভীর শ্বাস নিল। ভয় আর আকর্ষণ মিলে বুকের ভেতর ঝড় তুলছে। খাতায় কাল সকালে কী লিখবে ভাবতে ভাবতেই সে ফিসফিস করে বলল—
“আজ রাতেই রহস্য ধরা পড়বে।”

ক্যামেরার লেন্স তুলে ধরল সে।

এবং ঠিক তখনই, দূরের গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে দেখা গেল এক মুহূর্তের ছায়া—অদ্ভুত লম্বা, মানুষের মতো হলেও মুখ ফ্যাকাশে, হাতে কিছু একটা। আর পরমুহূর্তেই তা মিলিয়ে গেল।

অরণ্যের শ্বাস আটকে গেল।

বাঁশির সুর থেমে গিয়ে আবার শুরু হলো—আরও জোরে, আরও স্পষ্ট, যেন ঠিক তার নাম ধরে ডাকছে।

পরদিন সকাল। অরণ্যের চোখ ভোরেই খুলে গেল। সারারাত তার ঘুম আসেনি—কখনও বাঁশির সুর মনে পড়ছিল, কখনও ক্যামেরায় দেখা সেই এক ঝলকের ছায়া। মনে হচ্ছিল, সে যদি আরও কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকতে পারত, তবে হয়তো রহস্যটা ধরে ফেলত। তবু ভোরের কুয়াশায় সে উঠে পড়ল, বেরিয়ে পড়ল ক্যামেরা হাতে।

কিন্তু গ্রামটা যেন অদ্ভুত নীরবতায় ঢাকা। গাঁয়ের চা-দোকান খোলা নেই, উঠোনে কেউ বসে গল্প করছে না। গাছের ডাল থেকে ঝরে পড়া শিশিরের ফোঁটা আর দূরে মোরগের ডাক ছাড়া চারপাশে সব কিছু নিস্তব্ধ।

ঠিক তখনই দু’জন লোক দৌড়ে এল পশ্চিম দিক থেকে। তাদের মুখে আতঙ্কের ছাপ। একজন হাঁপাতে হাঁপাতে চেঁচিয়ে উঠল—
“মাখন ফিরল না রে! সারারাতেও ফিরল না!”

অরণ্য প্রথমে কিছুই বুঝতে পারল না। চারপাশে লোকজন বেরিয়ে এল, হরিহর কাকু লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এগোলেন। তিনি গম্ভীর মুখে বললেন,
“কখন গেছিল?”

একজন উত্তর দিল,
“কাল সন্ধেবেলা কাঠ কেটে আনতে গেল বনে। বলছিল ভোরের আগে ফিরবে। কিন্তু আর ফেরেনি।”

ভিড়ের মধ্যে থেকে আরেকজন চাপা গলায় বলল,
“গতকাল রাতেই তো বাঁশির ডাক শোনা গেছে।”

অরণ্যের বুকের ভেতর শিরশিরে কাঁপুনি নেমে এল। সে স্পষ্ট শুনেছিল সেই সুর, আর দেখেছিল ছায়া। মানে কি সত্যিই কারও টান লেগেছে?

হরিহর কাকু লোকজনকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু গ্রামের চোখেমুখে যে ভয় জমেছে, তা থামানোর উপায় নেই। এক মহিলা কান্নায় ভেঙে পড়ল—
“আমার ভাই কি আর ফিরবে না?”

অরণ্য এগিয়ে গিয়ে কৌতূহল লুকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“আপনারা খুঁজতে যাচ্ছেন না কেন? হয়তো কোথাও আটকে গেছে।”

একজন যুবক ফিসফিস করে উত্তর দিল,
“যে গেছে, সে আর ফেরে না। খুঁজতে গেলে আরও দু’জন হারাবে। এই বনের নিয়ম।”

অরণ্য হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শহুরে যুক্তিবাদী মাথায় এই ভয়াবহ অন্ধবিশ্বাস মানতে পারছিল না। তার মনে হলো—এই গ্রামবাসীরা আসলে অজানাকে ভয় পেয়ে নিজেরাই কুসংস্কার বানিয়েছে। হয়তো মাখনকে বন্য জন্তু আক্রমণ করেছে, অথবা সে অন্য কোথাও গিয়েছে। কিন্তু বাঁশির সুরের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া—এটা কি সত্যিই নিছক কাকতাল?

সে ক্যামেরাটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিরবিচ্ছিন্নভাবে লোকজনকে পর্যবেক্ষণ করছিল। সবাইকে আতঙ্কে কাঁপতে দেখে তার মধ্যে এক প্রবল জেদ জন্মাল।

নিজের খাতায় লিখল—
“আজ রাতেই আবার শোনার চেষ্টা করব। যদি সত্যিই ওই বাঁশি কাউকে টেনে নেয়, তবে তার প্রমাণ চাই।”

বিকেলের দিকে সে লজে ফিরে এল। বুড়ি মালকিন তাকে দেখে কপালে হাত ঠেকাল, বলল—
“আপনি কাল রাতে বাইরে গেছিলেন তো? আমি দরজা থেকে দেখেছি। বাবু, এভাবে যদি কৌতূহল নিয়ে বেরোন, আপনিও হারিয়ে যাবেন।”

অরণ্য হেসে বলল,
“আমি হারাব না, মাসিমা। আমার ক্যামেরা আছে।”

বুড়ি হা করে তাকাল।
“ক্যামেরা দিয়ে ভূত ধরা যায় নাকি? ভূত ছবি হয়ে থাকে না বাবু, মানুষ হয়ে টেনে নেয়।”

অরণ্য উত্তর দিল না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে অনুভব করল—তার আর গ্রামবাসীদের মধ্যে ফারাকটা যতটা ভেবে এসেছিল তার থেকেও অনেক গভীর। তারা ভয়ে পালায়, আর সে ভয়কে ক্যামেরায় বন্দি করতে চায়।

রাত নামতে থাকল। দূরে পাহাড় অন্ধকারে ঢেকে গেল। গ্রাম আবার নেমে গেল নিস্তব্ধতায়। সবাই দরজা-জানলা বন্ধ করে বসে রইল। আর অরণ্য, খাতায় নতুন লাইন লিখল—
“আজ রাতে বাঁশির সুর যদি আসে, আমি বনের ভেতর কয়েক কদম যেতেই পারি। মাখনের খোঁজ হয়তো সেখানেই লুকিয়ে।”

তারপর সে আলো নিভিয়ে জানলার পাশে বসল, চোখ ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে স্থির।

ঠিক তখনই… দূর থেকে আবার সেই মায়াবী বাঁশির সুর ভেসে এল।

পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে অরণ্য লক্ষ্য করল, গ্রামের বাতাস আরও গম্ভীর হয়ে উঠেছে। মাখনের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা যেন সবার মুখে এক চাপা ফিসফাসে ভাসছে। চায়ের দোকান খোলা হলেও লোকজন একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে সন্ত্রস্ত চোখে, যেন কথা বললেই কোনো অশুভ শক্তি টের পাবে।

অরণ্য ভেবেছিল সকালের আলোয় গ্রাম একটু প্রাণ ফিরে পাবে। কিন্তু তার বদলে নেমে এসেছে আরও ঘন ছায়া। হরিহর কাকুকে সে আর কোথাও দেখতে পেল না। লাঠি ঠুকতে ঠুকতে চিরচেনা ভঙ্গিতে ঘোরাঘুরি করা মানুষটা যেন আচমকা উধাও হয়ে গেছে।

চা-ওয়ালার কাছে দাঁড়িয়ে সে বলল,
“হরিহর কাকু আজ বেরোলেন না?”

চা-ওয়ালা দৃষ্টি ঘুরিয়ে নরম গলায় বলল,
“ও কাকু এসব নিয়ে কথা বেশি বলেন। কাল রাতের পর থেকে ওঁর শরীর খারাপ। আজ শয্যাশায়ী।”

অরণ্য বিস্মিত হয়ে বলল, “এটা তো কাকুতেও প্রভাব ফেলল?”

চা-ওয়ালা কিছু না বলে গরম চা এগিয়ে দিল। তারপর আস্তে বলল,
“আপনি যদি সত্যিই শুনতে চান আসল গল্প, তবে পুরোহিতমশাইয়ের কাছে যান। তিনি যা জানেন, আর কেউ জানে না।”

অরণ্য কৌতূহলে ভরে উঠল। দুপুর নাগাদ সে পুরোহিতের খোঁজ করল। গ্রামপথের একেবারে শেষ প্রান্তে ছোট্ট মন্দির। মাটির দেওয়াল, খড়ের ছাউনি। ভিতরে দাঁড়িয়ে আছেন এক বৃদ্ধ পুরোহিত—মুখে ভাঁজের পর ভাঁজ, চোখে অদ্ভুত দীপ্তি।

অরণ্য প্রণাম করতেই তিনি বললেন,
“আপনি শহর থেকে এসেছেন, তাই না? আপনিই গত রাতে বাঁশির ডাক শুনেছেন।”

অরণ্য বিস্ময়ে বলল,
“আপনি জানলেন কীভাবে?”

পুরোহিত হেসে ফেললেন।
“ও ডাক শোনার পর মানুষের চোখ অন্যরকম হয়ে যায়। আপনার চোখে সেই ছায়া আমি দেখতে পাচ্ছি।”

অরণ্যের শরীরে কাঁপুনি বয়ে গেল। সে ফিসফিস করে বলল,
“এটা কী? কেন বাজে বাঁশি? কে বাজায়?”

পুরোহিত গম্ভীর হয়ে বসে পড়লেন। তারপর আস্তে আস্তে বলতে শুরু করলেন—
“বহু বছর আগে, যখন এই গ্রামে শিকার ছিল জীবিকার প্রধান উপায়, তখন এক লোক ছিল। নাম উচ্চারণ করলে এখনও বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, তাই বলব না। সে ছিল তীরন্দাজি ও বন্দুক চালনায় অতুলনীয়। গর্ব ছিল আকাশছোঁয়া। বনজঙ্গলে পশু মারা তার কাছে খেলার মতো ছিল। কিন্তু গর্বই একদিন তার পতনের কারণ হলো।”

অরণ্য শ্বাসরুদ্ধ হয়ে শুনছিল। পুরোহিত থেমে এক ঢোঁক জল খেলেন, তারপর আবার বললেন—
“এক অমাবস্যার রাতে সে একা বেরিয়েছিল বনের গভীরে। বলেছিল, ওই রাতেই সে প্রমাণ করবে যে কেউ তাকে হারাতে পারবে না। রাত গড়ালে হঠাৎ তার চোখে পড়ে—এক অদ্ভুত ছায়া। নিজের মতোই দেখতে। এক মুহূর্তের জন্য সে ভেবেছিল কোনো শিকারি তার পথে দাঁড়িয়েছে। রাগে-অহংকারে বন্দুক তুলল আর গুলি চালাল। কিন্তু গুলির শব্দ থামতেই বুঝল—ওটা তার নিজেরই ছায়া।”

অরণ্যের বুক ধক করে উঠল।
“তাহলে…?”

পুরোহিত মাথা নেড়ে বললেন,
“তারপর থেকে সে আর ফেরেনি। সকালে লোকজন তার দেহ খুঁজতে বেরোলে কেবল পাওয়া গেল ভাঙা বাঁশি আর ছেঁড়া পোশাক। কিন্তু যেদিকটায় সে গুলি চালিয়েছিল, সেখানে মাটিতে এখনো শুকনো রক্তের দাগ পড়ে আছে। সেই থেকে বলা হয়—তার আত্মা বাঁশি বাজিয়ে ফেরে, টেনে নিয়ে যায় যার কানে সেই সুর ঢোকে।”

অরণ্য অবাক হয়ে শুনছিল। চারপাশে যেন বাতাস থেমে গেছে, শুধু পুরোহিতের কণ্ঠ ধ্বনিত হচ্ছে।

“তাহলে মাখনও…” অরণ্য চুপ করে গেল।

পুরোহিত দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
“হ্যাঁ। ও বাঁশির ডাকে টেনে গিয়েছে। ও ফিরবে না।”

অরণ্য আর থাকতে পারল না। ক্যামেরাটা আঁকড়ে ধরে সে উঠে দাঁড়াল।
“কিন্তু আমি সত্যিটা প্রমাণ করব। ভূতের গল্প বলে চাপা দিলে হবে না। আমার ক্যামেরায় ধরা পড়বে সব।”

পুরোহিত হালকা হাসলেন, কিন্তু সেই হাসিতে ছিল হাড় শীতল করা করুণ ব্যঙ্গ।
“ছবিতে যদি ছায়া আসে, তবে ভেবে নেবেন—আপনার সময়ও এসে গেছে।”

অরণ্য কথাটা এড়িয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল। কিন্তু তার কানে যেন এখনও বাজছে পুরোহিতের কণ্ঠ—
“নিজের ছায়াকে গুলি করা মানুষ… আজও সেই ছায়ার ভেতর বন্দি।”

দুপুরের রোদ মাথার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেও অরণ্যের শরীরে হাড় শীতল করা শিহরণ বয়ে গেল।

সারাদিন আকাশে ছিল একধরনের অস্বাভাবিক গুমোট। রোদ উঠলেও বাতাসে ছিল ভারী শ্বাসরোধী ভাব। অরণ্য লজের ছোট্ট ঘরে বসে বারবার ক্যামেরার ব্যাটারি পরীক্ষা করছিল, লেন্স পরিষ্কার করছিল, ট্রাইপড গুছিয়ে রাখছিল। পুরোহিতের কাহিনি তার মনে ঘুরছিল, কিন্তু ভয় নয়—বরং অদম্য কৌতূহল তাকে তাড়াচ্ছিল।

বিকেলে লজের বুড়ি মালকিন কেরোসিনের বাতি জ্বালাতে এসে চুপিচুপি বলল,
“বাবু, আজকে বাইরে যেও না। কালই গ্রামের পূজা, আজকের রাত অশুভ।”

অরণ্য শুধু হেসে মাথা নেড়ে বলল,
“আমার ছবিগুলোও তো একধরনের পূজা, মাসিমা। অজানাকে বন্দি করার পূজা।”

বুড়ি অসহায়ের মতো তাকাল।
“অজানাকে কেউ বন্দি করতে পারে না। অজানা বরং মানুষকে বন্দি করে।”

কথাগুলো শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেলেও অরণ্য জেদ চেপে রইল।

সন্ধ্যা নামতেই সে ব্যাগে ক্যামেরা, নোটবুক, টর্চ, আর ছোট্ট ছুরি ভরে নিল। গ্রাম নিস্তব্ধ হয়ে আসছে, সবাই নিজেদের ঘরে ঢুকে পড়ছে। কিন্তু অরণ্য সোজা বেরিয়ে গেল কাঁচা পথ ধরে।

চাঁদের আলো আজ হালকা। জঙ্গলের গাঢ় ছায়ার ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হচ্ছিল, প্রতিটি গাছ যেন নিঃশ্বাস নিচ্ছে, প্রতিটি ডাল যেন গোপনে তাকিয়ে আছে। ঝিঁঝিঁর ডাক হঠাৎ থেমে আবার শুরু হচ্ছিল, যেন অদৃশ্য কারও সংকেত।

প্রথমে সে ভেবেছিল, কিছুই পাওয়া যাবে না। কিন্তু জঙ্গলের ভেতর যত গভীরে যাচ্ছিল, ততই অদ্ভুত অস্বস্তি তাকে ঘিরে ধরছিল। বাতাস ঠান্ডা হয়ে আসছিল, অথচ শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছিল।

ঠিক তখনই—
ভেসে এল বাঁশির সুর।

আগের চেয়ে অনেক স্পষ্ট, অনেক কাছে। সুরে এক অদ্ভুত মায়া, যেন গভীর যন্ত্রণা থেকে জন্ম নেওয়া।

অরণ্য হাঁপাতে হাঁপাতে ট্রাইপড মাটিতে বসিয়ে ক্যামেরা অন করল। লেন্স ফোকাস করল অন্ধকার গাছের ফাঁক দিয়ে।

প্রথমে কিছু ধরা পড়ল না—শুধু কালো ছায়া। হঠাৎ ভিউফাইন্ডারে এক অদ্ভুত অবয়ব ভেসে উঠল। মানুষের মতো, লম্বাটে, মাথা নিচু, হাতে কিছু একটা—মনে হচ্ছে বাঁশি।

অরণ্যের শরীর কেঁপে উঠল। চোখের সামনে দৃশ্যটাকে সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। কিন্তু ক্যামেরা চলছেই, প্রতিটি সেকেন্ড রেকর্ড হচ্ছে।

বাঁশির সুর এবার এত কাছে এলো যে মনে হচ্ছিল ঠিক কানের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। অরণ্যের মনে হলো, কেউ যেন তাকে মৃদু হাত ধরে টেনে নিচ্ছে—আরও ভেতরে, আরও গভীরে।

সে একবার ভেবেছিল ফিরবে। কিন্তু ক্যামেরার স্ক্রিনে ঝলসে ওঠা সেই ধূসর অবয়ব তার ভয়কে কৌতূহলে পরিণত করল।

সে পা বাড়াল আরও গভীরে।

প্রতিটি পদক্ষেপে গাছের ছায়া ঘনিয়ে আসছিল। বাতাসে গন্ধ—আর্দ্র মাটির সঙ্গে মিশে আছে হালকা বারুদ পোড়ার গন্ধ। যেন অনেক বছর আগে ছোঁড়া গুলির স্মৃতি বাতাসে লেগে আছে।

অরণ্য হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে গেল। তার ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে এবার স্পষ্ট ধরা পড়ল—এক মানুষ, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, হাতে বাঁশি। মুখে কোনো রক্ত নেই, চোখ দুটো ফাঁপা গর্তের মতো।

অরণ্যের গলা শুকিয়ে গেল।

তবু ক্যামেরার রেকর্ড বাটন বন্ধ করল না। সে ফিসফিস করে বলল,
“এটাই… এটাই সেই শিকারি।”

বাঁশির সুর হঠাৎ থেমে গেল। চারপাশে মৃত্যু-নীরবতা।

অরণ্যের বুক ধকধক করছে। তার মনে হলো, অবয়বটা এবার মুখ তুলে তাকাল—সোজা তার দিকে।

তারপর আবার বাঁশি ঠোঁটে তুলল।

অরণ্যের মনে হলো, এইবার সুরটা তাকে ভেতর থেকে চিরে দিচ্ছে।

অরণ্য স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ভিউফাইন্ডারের ভেতর যা দেখছে, তা যেন চোখের ওপর বিশ্বাসঘাতকতা করছে। এক মানুষ—অথচ মানুষ নয়—ধূসর কুয়াশার মতো দেহ, হাতে বাঁশি, চোখদুটি যেন ফাঁপা গহ্বর। অবয়বটি স্থির, কিন্তু তার চারপাশে বাতাস অদ্ভুতভাবে ঘূর্ণি কাটছে। গাছের পাতারা একসাথে ঝাঁকুনি খেয়ে উঠছে, অথচ বাতাস নেই।

বাঁশির ঠোঁট ঠেকাতেই সুর ভেসে উঠল। সেই সুর—না আনন্দের, না বেদনার, না সম্পূর্ণ ভয়াবহ—কিন্তু তাতে এক মায়াবী ডাক ছিল, এমন এক টান যা প্রতিরোধ করা যায় না। অরণ্যর মনে হচ্ছিল তার শরীর নিজের ইচ্ছেতে আর নেই। ক্যামেরা এক হাতে ঝুলে আছে, পা নিজে থেকেই এগিয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ অবয়বটি মাথা তুলল। চোখের ফাঁকা গহ্বরগুলো সরাসরি অরণ্যের দিকে স্থির হয়ে গেল। অরণ্যের বুকের ভেতর হিম হয়ে গেল রক্ত। যেন এক অদৃশ্য তীর তার ভেতর দিয়ে সোজা বেঁধে গেল।

বাঁশিওয়ালা ধীরে ধীরে সামনে এগোতে লাগল। প্রতিটি পদক্ষেপে শুকনো পাতার শব্দ শোনা যাচ্ছিল না, বরং মনে হচ্ছিল মাটি চাপা কণ্ঠে গুনগুন করছে।

অরণ্য কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বলল,
“তুমি… কে?”

কোনো উত্তর নেই। শুধু বাঁশির সুর থেমে গিয়ে তার বদলে শূন্য বাতাসে প্রতিধ্বনির মতো বাজল শুকনো বন্দুকের ‘ট্রিগার’ টিপে ওঠার শব্দ—“ঠক্!”

অরণ্য ভয়ে থমকে গেল। তার ক্যামেরার লেন্স ঝাপসা হয়ে উঠছে, যেন ভেতরে কুয়াশা জমে যাচ্ছে। স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে, অবয়বটির পাশে হঠাৎ আরও একটি ছায়া ফুটে উঠছে—একই রকম মুখ, একই রকম ভঙ্গি।

শিকারি আর তার ছায়া।

অরণ্যের শরীর অবশ হয়ে আসছিল। তবু তার ভেতরের ফটোগ্রাফার জেদী স্বভাবে ক্যামেরার রেকর্ড বাটন শক্ত করে চেপে রাখল। সে বুঝতে পারছিল—যা-ই ঘটুক, এ মুহূর্তকে ক্যামেরায় বন্দি করতেই হবে।

হঠাৎ অবয়বটি বাঁশি ঠোঁট থেকে সরাল। তার মুখের গহ্বর থেকে বেরোল ভাঙা গলায় এক অদ্ভুত শব্দ—
“তুইও… আমার মতো…”

অরণ্যের বুক ধক করে উঠল। তার চোখ ছায়ার দিকে চলে গেল। ছায়াটা ধীরে ধীরে অরণ্যেরই অবয়ব নিতে শুরু করেছে। একই শরীর, একই মুখ, শুধু চোখ দুটি ফাঁকা।

সে পিছিয়ে আসতে চাইল, কিন্তু পা যেন জমাট বাঁধা মাটিতে আটকেছে। বাতাসে আবার বন্দুকের গর্জন শোনা গেল—এইবার যেন সোজা কানে।

অরণ্য ক্যামেরার লেন্স থেকে চোখ সরাতে চাইল, কিন্তু পারল না। ভিউফাইন্ডারে যা দেখা যাচ্ছে, তার বাইরেও সেই অবয়ব তাকে ঘিরে ফেলছে।

শিকারি ধীরে ধীরে বন্দুক তুলল—হাওয়ার ভেতর থেকে গঠিত, পুরনো কাঠ আর লোহার মিশ্রণে তৈরি এক ছায়া-বন্দুক। সেটা লক্ষ্য করা হলো অরণ্যের দিকে।

আর বাঁশি থেকে ঝরে পড়ল এক দীর্ঘ, মৃত্যুমুখী সুর।

অরণ্যের গলা শুকিয়ে গেল। চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল, অথচ ক্যামেরা এখনও চালু।

সে শেষ চেষ্টা করে ফিসফিস করে বলল—
“আমার ছবি তোলো… যদি পারো।”

তারপর হঠাৎ চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল।

বাতাস থমকে গেছে। অরণ্যর চারপাশে এমন নীরবতা নেমে এসেছে যেন পৃথিবীর সমস্ত শব্দ মুছে ফেলা হয়েছে। কেবল সে আর ধূসর অবয়ব—শিকারি। হাতে ছায়ার বন্দুক, ঠোঁটে অর্ধেক ভাঙা বাঁশি। আর মাটিতে ঝুঁকে থাকা অরণ্যর নিজেরই ছায়া, ধীরে ধীরে জীবন্ত হয়ে উঠছে।

অরণ্য চোখের ভেতর দিয়ে দেখতে পাচ্ছিল—তার ছায়াটা আর নিছক অন্ধকার নয়। ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে তারই মতো অবয়ব নিয়ে। যেন সে নিজেকে আলাদা করে ফেলে দিয়েছে, আর ছায়াটা এক বিকৃত প্রতিচ্ছবি হয়ে বাঁচতে চাইছে।

শিকারির গলা থেকে ভেসে এল গর্জনের মতো এক শব্দ, ভাঙাচোরা অথচ স্পষ্ট—
“ছায়াকে মেরে তবেই মুক্তি।”

বাঁশির সুর হঠাৎ থেমে গিয়ে মিলল বন্দুকের টানাটানিতে। ট্রিগারের শব্দ বাতাসে প্রতিধ্বনি তুলল—“ঠক্!”

পরের মুহূর্তেই বজ্রপাতের মতো গুলির শব্দ কাঁপিয়ে দিল বন।

অরণ্য দেখল, শিকারির বন্দুক থেকে বেরোনো ধোঁয়া ছুটে গেল সরাসরি তার ছায়ার বুকে। ছায়াটা হুড়মুড় করে কেঁপে উঠল, তারপর মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কিন্তু রক্ত নয়—অদ্ভুত কালচে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।

অরণ্যের মনে হলো—এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি সে আগে শুনেছে, পুরোহিতের মুখে। শিকারি একদিন ভুল করে নিজের ছায়ায় গুলি চালিয়েছিল। আর আজ—সে আবার করছে একই কাজ, চিরকাল ধরে, এক অভিশপ্ত চক্রে।

কিন্তু এবার ভিন্ন কিছু ঘটল।

ছায়ার ধোঁয়া সরাসরি ছুটে এলো অরণ্যের দিকে। তার বুকের ভেতর ঢুকে গেল সেই কালো ঝড়। অরণ্য হাঁপাতে লাগল, শরীর হঠাৎ জমে গেল। চোখ অন্ধকার হয়ে এলো, মনে হলো যেন ভিতর থেকে কেউ তাকে টেনে নিচ্ছে—এক অচেনা গহ্বরের মধ্যে।

সে ক্যামেরা আঁকড়ে ধরল মরিয়া হয়ে। ভিউফাইন্ডারে দেখতে পেল—শিকারির অবয়ব আর তার নিজের ছায়া একসাথে মিলিয়ে যাচ্ছে, আর তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সে নিজে, আধভাঙা আলোতে।

শিকারি হঠাৎ হাত তুলে ইঙ্গিত করল, আর বাঁশির সুর আবার শুরু হলো। এবার সুরটা আগের চেয়ে ভয়ঙ্কর, গভীর, মৃত্যুর মতো ধীর।

অরণ্যর মনে হলো, সে নিজেই বন্দুক তুলে নিয়েছে। হাত কাঁপছে, আঙুল ট্রিগারের ওপর। সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার নিজের ছায়া—অথচ এবার ছায়াটা নয়, বরং রক্তমাংসের অরণ্য, চোখ ফাঁকা, ঠোঁটে বিকৃত হাসি।

সে ফিসফিস করে বলল,
“এবার তোর পালা।”

চারপাশে হঠাৎ কাকের ডাক ভেসে এল, শীতল হাওয়া ছুটে গেল গাছের মাথায়। বন্দুকের গর্জন আরেকবার কাঁপিয়ে দিল বন।

অরণ্যের চোখে ভেসে উঠল শেষ ছবি—ক্যামেরার স্ক্রিনে ধরা পড়ছে দুই অবয়ব: এক শিকারি, এক ফটোগ্রাফার। দু’জনেই ছায়ার মধ্যে বন্দি, আর দু’জনের হাতে বন্দুক।

তারপর সব আলো নিভে গেল।

ভোর হতেই গ্রামটা কেমন যেন অচেনা হয়ে উঠল। আকাশে কুয়াশার পরত ঘন, সূর্য উঠেও আলো দিতে পারছে না। চারদিক নিস্তব্ধ, যেন রাতের অশুভ ভার এখনও চাপা হয়ে আছে।

লজের বুড়ি মালকিন উদ্বিগ্ন চোখে খোঁজ করতে লাগলেন, “বাবুটা ফিরল না তো? রাত থেকে দরজাটা খোলা রেখেছিলাম, কিন্তু আসার শব্দ শুনলাম না।”

লোকজন জড়ো হলো চায়ের দোকানের সামনে। খবর ছড়িয়ে পড়ল—শহরের ফটোগ্রাফার অরণ্য রাত থেকে নিখোঁজ। কারও চোখে বিস্ময় নেই, যেন আগেই জানা ছিল। কেউ কাঁধ ঝাঁকাল, কেউ বিড়বিড় করে বলল, “যার কানে বাঁশির সুর ঢোকে, সে আর ফেরে না।”

হরিহর কাকু অসুস্থ শরীরেও লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এগিয়ে এলেন। গলায় ফাঁপা গম্ভীরতা—
“আমি আগেই বলেছিলাম। সে সাবধান শুনল না।”

গ্রামবাসীরা মিলে বনের ধারে খোঁজ করতে গেল। দূরে মাটির ওপর পড়ে আছে অরণ্যের ক্যামেরা। কাদায় ভিজে গেছে, তবু অক্ষত। আর কিছু নেই—না ব্যাগ, না শরীরের চিহ্ন। শুধু শুকনো পাতার ওপর কালো ছাইয়ের মতো দাগ, যেন কেউ সেখানেই মুহূর্তে গলে গেছে।

ক্যামেরা হাতে নিয়ে এক যুবক বলল, “দেখি ভেতরে কী আছে।”

বাড়ি ফিরে ক্যামেরার মেমোরি কার্ড খুলে টিভির স্ক্রিনে চালানো হলো। প্রথম কয়েকটা ফ্রেম ছিল বনের ছবি—অন্ধকার গাছ, কুয়াশা, পায়ের ছাপ। তারপর হঠাৎ দেখা গেল অস্পষ্ট ছায়া, হাতে বাঁশি। ছবির কোণ ধূসর হয়ে আছে, লেন্সে কুয়াশার মতো দাগ।

গ্রামবাসীরা শিউরে উঠল।

তারপর শেষ কয়েকটি ফ্রেম দেখে সবাই নিঃশ্বাস আটকে গেল। স্ক্রিনে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে—শিকারির অবয়ব আর তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে অরণ্য। কিন্তু সেটা জীবন্ত অরণ্য নয়—চোখ ফাঁপা, মুখ ফ্যাকাশে, হাতে বন্দুক। যেন সে-ও হয়ে গেছে অভিশপ্ত ছায়ার অংশ।

লজের বুড়ি হাত জোড় করে কেঁদে উঠল, “ও বাবুও এখন বাঁশির ডাকে বন্দি হয়ে গেল।”

হরিহর কাকুর চোখ ভিজে উঠল। তিনি ফিসফিস করে বললেন,
“শিকারি একা ছিল না আর। এখন থেকে দু’জন বাঁশি বাজাবে।”

গ্রাম জুড়ে সেদিন ভয় আরও গভীর হলো। কেউ আর বনের ধারে গেল না। সন্ধ্যা নামতেই দরজা-জানলা বন্ধ, বাতি নিভিয়ে বসে রইল সবাই।

কিন্তু অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গেই দূরে, পাহাড়ের গা থেকে ভেসে এল বাঁশির সুর—এইবার দ্বিগুণ শক্তিতে, যেন দুই ঠোঁট মিলেমিশে বাজাচ্ছে।

আর গ্রামবাসীরা বুঝল, অভিশাপের কাহিনি এবার নতুন রূপ নিয়েছে।

রাধাপুর গ্রাম যেন আর আগের মতো নেই। মাখনের নিখোঁজ হওয়ার পরও মানুষ আশার আলো ধরে রেখেছিল—হয়তো একদিন ফেরত আসবে। কিন্তু অরণ্যের অন্তর্ধান ঘটতেই সেই আলো নিভে গেল। শহর থেকে আসা লোক, শিক্ষিত, যুক্তিবাদী, ক্যামেরা হাতে সাহসী—যে ভেবেছিল রহস্যকে ফাঁস করবে, সেও হারিয়ে গেল একই অন্ধকারে।

সন্ধ্যা নামলেই গ্রামজুড়ে আতঙ্ক নেমে আসে। চায়ের দোকান আর খোলে না, উঠোনে বাচ্চারা খেলা করে না। অকালেই গ্রামকে গ্রাস করেছে ভয়ের ছায়া। গ্রামবাসীরা দরজা-জানলা বন্ধ করে বসে থাকে, বাতিও নিভিয়ে দেয়। তবু ভয় কাটে না। কারণ অন্ধকার যত গাঢ় হয়, ততই দূরের পাহাড় থেকে ভেসে আসে বাঁশির সুর।

কিন্তু এখন সেই সুর আলাদা।

আগে একক বাঁশির শব্দ শোনা যেত, যেন এক আত্মা তার যন্ত্রণা বাজিয়ে চলেছে। আর এখন সুরটা দ্বিমুখী—দুটি বাঁশির মেলবন্ধন। প্রথমটা টেনে নিয়ে যায়, দ্বিতীয়টা তাকে আরও গভীরে ঠেলে দেয়। গ্রামের লোকজন বলে—“একটা পুরনো, একটা নতুন। এখন থেকে অভিশাপ দ্বিগুণ।”

এক রাতে, পূর্ণিমার আলোয় ভেসে থাকা আকাশের নিচে কয়েকজন গ্রামবাসী সাহস করে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। দূরে জঙ্গলের দিক থেকে শোনা গেল সুর। প্রথম বাঁশির টানে বুকে হাহাকার, দ্বিতীয় বাঁশির টানে মাথা ঝিমঝিম। হঠাৎ এক কিশোরী ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল, যেন অদৃশ্য কেউ হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। লোকজন প্রাণপণে তাকে থামাল। কিন্তু মেয়েটির চোখ তখন ফাঁকা, ঠোঁটে আধো হাসি—ঠিক যেমন ছবিতে দেখা গিয়েছিল অরণ্যের মুখে।

সেদিনের পর থেকে আর কেউ চেষ্টা করেনি বাইরে বেরোতে। তারা বুঝে গিয়েছে, বাঁশির সুরের বিরুদ্ধে মানুষের শক্তি নেই।

হরিহর কাকু, যে গ্রামটাকে এতদিন ধরে আগলে রেখেছিল, তার লাঠি ফেলে দিয়ে একদিন একেবারে নিস্তেজ হয়ে গেল। মৃত্যুর আগে শুধু বলল,
“অভিশাপ এখন চিরন্তন। যে বাঁশির ডাক শুনবে, তার আর ফেরা নেই।”

বছর গড়িয়ে যায়। রাধাপুর গ্রাম মানচিত্র থেকে মুছে যেতে বসে। বাইরের লোক আর আসে না। যারা আসে, তারা আর ফেরে না। মাঝে মাঝে পথভোলা পাখি জঙ্গলের উপর দিয়ে উড়ে গেলে হঠাৎ নিচে পড়ে যায়, যেন সুরে মন্ত্রবিদ্ধ হয়ে গেছে।

আর বাঁশির ডাক?

সে ডাক এখন বনের অঙ্গ হয়ে গেছে। দিনে শোনা যায় না, কিন্তু সূর্য ডুবলেই বাতাসে ভেসে ওঠে। প্রথমে ধীরে, তারপর স্পষ্ট, যেন দুইজন মিলে একসাথে বাজাচ্ছে।

একজন সেই পুরনো শিকারি, যে ভুল করে নিজের ছায়াকে গুলি করেছিল। আরেকজন শহরের তরুণ ফটোগ্রাফার, যে কৌতূহলে সত্যি ধরতে গিয়ে নিজেই সত্যির অংশ হয়ে গেল।

আজও গ্রামের লোকেরা বলে—
“যখন রাত গভীর হয়, আর বাতাস থেমে যায়, তখন শোনা যায় বাঁশির দ্বিস্বর ডাক। এক ডাক ডাকে, অন্য ডাক শৃঙ্খলিত করে। বন তখন জীবিত হয়ে ওঠে।”

এভাবেই রাধাপুর গ্রাম চিরকালের জন্য বাঁশির অভিশাপে বন্দি হয়ে রইল। আর সেই অভিশাপের কাহিনি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে যেতে লাগল—
গহন বনে রাতের বাঁশির সুর শোনো না। কারণ ওটা সঙ্গীত নয়, ওটা মৃত্যু।”

***

WhatsApp-Image-2025-08-19-at-6.17.17-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *