Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

গন্ধহীন গোলাপ

Spread the love

শ্রেয়া মুখার্জী


রূপা সেন জানালার পাশে বসে ছিল, ঘরের অন্ধকারে আধা-দৃশ্যমান তার মুখে দিনের ক্লান্তির ছাপ। বৃষ্টি থেমে গেছে কিছুক্ষণ আগে, জানলার কাঁচে জলের রেখাগুলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল। বাইরের আলো আর ঘরের নিস্তব্ধতা মিলে একটা ঘুমন্ত দৃশ্যপট তৈরি করেছিল। রান্নাঘর থেকে ভাতের চাপা গন্ধ আসছিল, কিন্তু সেই গন্ধেও যেন কোথাও কোনও উষ্ণতা ছিল না। অভিরূপ একটু আগেই ঘরে ফিরেছে, অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে সোজা টিভির সামনে বসে গেছে—সাধারণ, প্রতিদিনের দৃশ্য। “আজ অফিসে অনেক চাপ ছিল,” বলেছিল সে, রূপাও মুখ ঘুরিয়ে বলেছিল, “আমারও।” কথাবিনিময় সেখানেই শেষ। এভাবেই শেষ হয় প্রতিদিনের আলোচনার পরিসর—যেন কোনও অদৃশ্য নিয়মের বাঁধনে তারা আটকে আছে, যার ভেতরে আবেগ নেই, নেই কোনও সহমর্মিতা। রূপা জানে, এটাই তার জীবন, এই আট বছরের দাম্পত্য জীবন তাকে আর স্পর্শ করে না। সংসারটা একটা বদ্ধঘর—জানালা আছে, আলো নেই; গোলাপ আছে, গন্ধ নেই।

রূপার বিয়ে হয়েছিল সামাজিক চাপেই। অভিরূপ ছিল পরিচিত পরিবারের ছেলে, ব্যাংকে চাকরি, রূপার বাবার পছন্দের পাত্র। রূপা তখন সদ্য চাকরিতে ঢুকেছে, ছোটবেলা থেকেই সংসারের দায়িত্বের নিচে তার স্বপ্নগুলো ধীরে ধীরে শুকিয়ে গিয়েছিল। লেখালিখির ঝোঁক ছিল একসময়, কবিতা লিখত, গল্প সাজাত—কিন্তু বিয়ের পর, সেই পাতাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। অভিরূপ ভালো ছেলে, তবু ভালোবাসা নেই তার মধ্যে। রূপার প্রতি তার আচরণ কখনও নির্দয় নয়, কিন্তু নিঃসঙ্গ করে দেওয়ার মতো যথেষ্ট ঠান্ডা। একটা সময় পর্যন্ত রূপা ভেবেছিল, সময়ের সঙ্গে সব ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু না—বরং সম্পর্কটা যেন আরও দূরে সরে গেছে। এক বিছানায় দুই মানুষ, অথচ দুটি ভিন্ন পৃথিবীতে বাস করে। অভিরূপের রুটিন নির্ধারিত—অফিস, বাড়ি, খাওয়া, ঘুম। রূপার জীবনে একমাত্র রঙ ছিল তার অফিসের কাজ, যেখানে অন্তত নিজের দক্ষতা প্রমাণ করতে পারে, কিন্তু কাজ শেষে যখন ফিরে আসে—এই দেয়ালঘেরা ঘরে, তখন মনে হয় সে এক সাঁতারু, যে প্রতিদিন ডুবে যায় আর ভেসে ওঠে না। মায়ের সঙ্গে মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয়, কিন্তু সেখানে সব কথা বলা যায় না। কী বলবে সে? যে সে ভালো নেই? যে সে প্রতিদিন একটু একটু করে মরে যাচ্ছে?

সেদিন সন্ধ্যায়, রূপা চুপচাপ বসে ছিল নিজের ল্যাপটপে, একটা ক্লায়েন্টের রিপোর্ট তৈরি করছিল। অভিরূপ তখনও টিভির সামনে, কোলের ওপর মোবাইল, মুখে অনাগ্রহ। আচমকাই রূপার মনে হল, গত এক সপ্তাহে তারা কতটা কথা বলেছে? দু’টি, তিনটি বাক্য? তারও হয়তো কম। সে আর ভাবতে পারে না, মাথার ভেতরে চাপা একটা শব্দ কেবল ঘুরপাক খাচ্ছিল—”আমি কোথায় আছি?”। সে কীভাবে এত বছর ধরে এই শূন্যতাকে স্বাভাবিক ভেবে কাটিয়ে দিল? বিয়ে মানে কি এই নিরব বোঝাপড়া? না কি, কোনও দায়ে নিজেদের পাঁজর চেপে ধরে বেঁচে থাকা? রূপা জানে না উত্তর কী, কিন্তু সে অনুভব করে, সে আর পারছে না। সে জানে, ভেঙে পড়া মানে দুর্বলতা নয়—ভেঙে বেরিয়ে আসা মানেই নতুন জন্ম। কিন্তু এই জন্ম নেওয়ার আগে কতটা সাহস লাগে, সেই সাহস কী তার আছে? হয়তো না, হয়তো আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে, শুধু এই মুহূর্তে, সে জানে—তার হৃদয়ে কোনও গোলাপ নেই, কারণ সেই গোলাপে গন্ধ নেই। এক নিঃশ্বাসে ল্যাপটপ বন্ধ করে সে জানালার দিকে তাকায়, দূরে কোথাও বিদ্যুতের আলো ঝলকে ওঠে—একটা নতুন সকাল কি তার অপেক্ষায়?

রূপা অফিসে ঢুকেই তার ডেস্কের সামনে বসে পড়ে, যেন আজ কিছুতেই দেরি চলবে না। চোখে ক্লান্তি, কিন্তু মনের ভেতরে এক অদ্ভুত ঝড়। ঘরের নিঃশব্দতা থেকে এসে সে যেন প্রাণ ফিরে পায় এই কিউবিকল শব্দে। কম্পিউটারের মনিটরে চোখ রাখলেও মাথার ভিতরটা একদম ফাঁকা। নীলচে পর্দার ওপার থেকে অনিন্দিতা বলে ওঠে, “আজ খুব চুপচাপ লাগছে তোর, সব ঠিক?”—রূপা মুখ তুলে একবার হাসে, সেই নিষ্প্রভ হাসি—যেটা শিখে নিয়েছে বছরের পর বছর ধরে। “হ্যাঁ, ঘুম হয়নি কাল,” বলে ফের মনিটরে মুখ গুঁজে দেয়। কিন্তু ও জানে, অনিন্দিতা বোঝে। ও একমাত্র মানুষ যে বোঝে, বুঝতে চায়, এবং উত্তর না পেলেও জিজ্ঞেস করতে ছাড়ে না। দুপুরে ক্যান্টিনে একসাথে খেতে বসলে অনিন্দিতা আবারও ধীরে বলে, “রূপা, তুই কতদিন ধরে এমন করে চলছিস? নিজের মতো করে বাঁচতে ইচ্ছে করে না?”—এই প্রশ্ন রূপার কাছে যেন কোনও বিদেশি ভাষা। নিজের মতো করে বাঁচা—এই ধারণাটা এতটাই অচেনা যে সে কেবল মাথা নেড়ে বলে, “সম্ভব নয়…” অনিন্দিতা চুপ করে যায়। আর কিছু বলে না। কিন্তু রূপা বুঝতে পারে, তার ভিতরে কোনও এক গোপন দেয়ালে আজ একটা ফাটল ধরেছে।

বাসায় ফিরতে ফিরতে বৃষ্টি নামে। রূপা ভিজে পড়ে রিকশা থেকে নামার আগে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে তার মনে হয়, এই বৃষ্টির মধ্যেও কেউ কি তার মতো নিঃসঙ্গভাবে ঘরে ফিরছে? ঘরের ভিতর আলো জ্বলছে না—অভিরূপ এখনও ফেরেনি। সোফায় বসে পায়ের চপ্পল খুলে দেয় সে, গায়ে ভেজা শাড়ির শীতলতা যেন শরীর ছুঁয়ে মনকেও বরফ বানিয়ে দেয়। জানালার কাঁচ ভিজে কুয়াশার মতো হয়ে আছে, বাইরের আলো আর ভিতরের অন্ধকারের মাঝে দাঁড়িয়ে রূপা যেন নিজেকে দেখতে পায় না—শুধু এক ঝাপসা অবয়ব। একটা সময় সে ডায়েরি লিখত—নিজের কথা, ছোট ছোট কবিতা, এমনকি গল্পের খসড়া। সেই নীল মলাটের ডায়েরিটা এখন অ্যালমারির নিচের খুঁটিনাটি জিনিসপত্রের নিচে চাপা। আজ বহুদিন পর সে সেটা খুঁজে বের করে, আর প্রথম পাতায় লেখা একটি লাইন পড়ে—“নিজেকে হারিয়ে ফেললে, ফেরার পথ থাকেনা।” চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। কে লিখেছিল এ কথা? সে-ই তো! এখন তার মনে হয়, নিজেকে খুঁজে পাওয়াটাই সবচেয়ে জরুরি। কিন্তু নিজেকে হারানোর কারণটা কী? অভিরূপ? না কি সে নিজেই? এতদিন ধরে সে যে দাম্পত্যে বন্দী, তা কি শুধুই সমাজের চাপ? না কি তার ভয়, একা হওয়ার, অনিশ্চয়তার, বদলে যাওয়ার?

রাত গভীর হলে অভিরূপ ফিরে আসে—তার মুখে অফিসের গল্প, ক্লায়েন্টের চাপ, সহকর্মীর নালিশ। রূপা একমনে শুনে যায়, যেন রোবট। মাঝে একবার অভিরূপ বলে, “তুই একদম কথা বলিস না এখন, আগের মতো না।” রূপা তাকায় না, শুধু বলে, “বলার কিছু থাকে না।” অভিরূপ আবার টিভি চালিয়ে দেয়, যেন কথোপকথনের প্রয়োজন নেই। ঘুম আসেনা রূপার, বিছানায় শুয়ে থাকে চুপচাপ। পাশের মানুষটা যেন আর পরিচিত নয়। রূপা ভাবে, তার চারপাশে যেন কাচের একটা দেয়াল—সব দেখতে পাচ্ছে, বুঝতেও পারছে, কিন্তু ছুঁতে পারছে না। সেই দেয়ালের ওপারে আছে এক জীবন, যেখানে নিঃশ্বাস নেওয়া যায়, যেখানে মানুষ নিজের মতো করে হাঁটতে পারে। সে কি কোনওদিন ওই দেয়ালের ওপারে যেতে পারবে? সেই প্রশ্নের কোনও উত্তর না নিয়েই সে চোখ বন্ধ করে—ভেতরে এক চুপচাপ কান্না ঝরে পড়ে বালিশের ভিতর।

বুধবার সকালটা অন্যরকম ছিল। অফিস থেকে একটি নতুন প্রজেক্ট হাতে এসেছে রূপার টিমে, যেখানে একটা ফ্রিল্যান্স ভিজ্যুয়াল ডিজাইনারের সঙ্গে মিলে কাজ করতে হবে। মেইলের অ্যাটাচমেন্টে ছিল সেই ডিজাইনারের প্রোফাইল—নাম: সোহম বসু। প্রথমে নামটা দেখে কিছু বোঝা যায়নি, কিন্তু তার কাজের নমুনা দেখে রূপার চোখে একটা আলাদা দীপ্তি খেলে যায়। ছবিগুলো যেন কথা বলে, প্রতিটা ডিজাইনে এমন এক জীবন আছে যা কোনও ফর্মুলায় ফেলা যায় না। ভিডিও কলে প্রথম পরিচয়, পর্দার ওপারে একটা বেহুলাভঙ্গ চেহারার ছেলেকে দেখে রূপা চমকে ওঠে। মুখে দাড়ি-গোঁফ, চোখে রোদচশমা, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, আর ঠোঁটে যেন সারাক্ষণ হালকা হাসি লেগে থাকে। রূপা একটু দ্বিধায় ছিল, অচেনা একজন ফ্রিল্যান্সারকে নিয়ে কাজ করতে হবে—কিন্তু তার প্রথম কথাতেই সব দ্বিধা ঝরে পড়ে। “আপনারা যতটা নিয়মমাফিক ভাবেন, আমি ততটাই ছন্দভাঙা। তবে কাজটা আমি ভালোবাসি। আপনারা নির্ভার থাকতে পারেন”—এই এক বাক্যেই রূপা অনুভব করে, মানুষটা আলাদা।

কাজের সূত্রে রূপা ও সোহমের কথোপকথন বাড়তে থাকে। প্রথমে শুধু প্রজেক্ট সংক্রান্ত কথা—কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে সেই কথার মাঝেই ঢুকে পড়ে গান, বই, সিনেমা আর জীবনের গল্প। একদিন সন্ধ্যায় অফিস শেষে, রূপা যখন বাড়ি ফিরছিল, হঠাৎ সোহম মেসেজ করে—“আজ বৃষ্টি হবে, জানালার ধারে বসে আকাশ দেখবেন তো?” রূপার হাত থমকে যায়। অভিরূপ কোনওদিনও এমন করে তাকে কিছু বলেনি। সে কোনও জানালার ধারে রূপাকে বসিয়ে কফি দেনি, বা জিজ্ঞেস করেনি—সে কেমন আছে। সোহম কিছু চায় না—তবে তার কথায় একটা অদ্ভুত উষ্ণতা থাকে। ফোনে গল্প হয়, হাসি হয়, আর সেই দীর্ঘদিনের মৌনতা ফাটিয়ে দেয় কিছু শব্দ, যেগুলো এতদিনে রূপার জীবনে ছিল না। সোহম কখনও জানতে চায় না—রূপা বিবাহিত কি না, সংসার কেমন চলছে, তার অতীত কী। সে কেবল জানতে চায়, রূপা কোন গান শুনে ঘুমায়, শেষ কী বই পড়েছে, অথবা সে পাহাড় ভালোবাসে নাকি সমুদ্র। এই না-চাওয়াই যেন একধরনের টান তৈরি করে।

রূপা বুঝতে পারে, তার ভিতরে কিছু বদলাচ্ছে। সে আগের মতো ক্লান্ত লাগে না, অফিসে একটু বেশি আগ্রহ নিয়ে কাজ করে, অনিন্দিতা দেখে বলে, “তোর মুখে আলো আসছে আজকাল, কী ব্যাপার?” রূপা হেসে বলে, “অন্যরকম মানুষদের সঙ্গে কাজ করলে এমন হয় বুঝি!” কিন্তু সে জানে, শুধু কাজ নয়, সোহমের কথা, সোহমের চোখে জীবন দেখার ভঙ্গিই তাকে নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছে। অভিরূপ তখনও সেই একই—প্রতিদিন অফিস, বাড়ি, ফোনে ব্যস্ত, রূপার দিকে তার নজর পড়ে না। আর রূপা একদিন রাতে বিছানায় শুয়ে চুপচাপ ভাবে—সোহম যদি তার স্বামী হতো, তাহলে কী হতো? কিন্তু সাথে সাথেই এই ভাবনার জন্য সে নিজেকে ধিক্কার দেয়। সে তো কারও সঙ্গে প্রতারণা করছে না, তবু কেন নিজেকে দোষী মনে হয়? হয়তো সমাজের চোখ এখনও তার কাঁধে বসে আছে। কিন্তু একটা সত্য সে আজ স্পষ্ট বুঝতে পারে—সোহমের সঙ্গে কথা বলার সময় তার মনে হয়, সে বাঁচছে। এবং সেই বাঁচাটা অনেকদিন পর আবার অনুভব করতে পারছে।

রূপা জানে, তার ভেতরে কিছু একটা বদলাচ্ছে। এটা প্রেম নয়—না, সে সোহমকে নিয়ে কোনও প্রেমের কল্পনা করে না, অন্তত এখনও না। কিন্তু এতদিনের চুপ করে থাকা, মুখ বুজে সহ্য করার একটা অভ্যেসে যে ক্ষরণ চলছিল, সেই ক্ষরণটা এখন যেন কণ্ঠনালী দিয়ে উঠে আসছে। সে নিজেই অবাক হয়ে দেখে—অফিসে ছোট ছোট বিষয়ে সে নিজের মত বলছে, বাসায় ফিরে অভিরূপের অদৃশ্যতা আর তার মনকে আগের মতো আর দমিয়ে রাখতে পারছে না। সেদিন রাতের খাবার খেতে খেতে অভিরূপ প্রশ্ন করল, “এই নতুন প্রজেক্টটা নিয়ে এত ব্যস্ততা কিসের? শুধু একজন ফ্রিল্যান্সার আসছে তো, তোর এত উৎসাহ কেন?” রূপা চুপ করে ছিল। অভিরূপ আবার বলে, “তুই একটু বেশি উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়িস না যেন, যেরকম একেকটা মানুষ একটু আদর করে কথা বললেই তুই ভাবতে থাকিস—জীবন বদলে যাবে।”
এই কথাটা এমনভাবে বলা হল, যেন অভিরূপ নিজের দায়িত্বটুকু ফলাও করে বুঝিয়ে দিচ্ছে—তুই একটা সাধারণ, সহজে বিভ্রান্ত হওয়া নারী, যে পুরুষসুলভ সতর্কতার প্রয়োজনীয়তা বুঝিস না। রূপার চোখে মুখে কোনও প্রতিক্রিয়া এল না, কিন্তু সে বুঝতে পারল—এই সম্পর্কের ভিতটা আসলে আর অবশিষ্ট নেই। আগুন নিভে গেলে যেমন শুধু ধোঁয়া উড়ে বেড়ায়, তেমনই তাদের মধ্যে এখন কেবল অস্পষ্ট শব্দ, কুয়াশার মতো তিক্ততা, আর একটুও উষ্ণতা ছাড়া সম্পর্ক।

রাত গভীর হলে রূপা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, এক কাপ চা হাতে, বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ। বাইরে হালকা হাওয়া বইছে, ছাদের টিনে টুপটাপ জলের শব্দ। হঠাৎ তার মনে হয়, এত বছর ধরে যে জীবন সে কাটিয়েছে, সেটাকে আসলে জীবন বলা যায় কি? বিয়ে মানে কি কেবল সামাজিক স্বীকৃতি? ভালবাসা না থাকলে, স্পর্শ না থাকলে, হাসি-ঠাট্টা, বন্ধুত্ব, কিংবা পারস্পরিক শ্রদ্ধা না থাকলে সেটা কিসের বন্ধন? তার শরীর আছে, মন আছে, স্বপ্ন ছিল, ইচ্ছে ছিল—কিন্তু সেগুলোকে বিয়ের পর এমনভাবে চাপা দেওয়া হয়েছে যেন সে একটা নির্দিষ্ট রুটিনের যন্ত্র হয়ে গেছে। সে কেন আর এইসব প্রশ্নকে চাপা দেবে? তারও তো অধিকার আছে এক কাপ কফির পাশে বসে নিজের কথা বলার, একটা হাত ধরার, একটি মানুষকে নিজের গভীরতম অনুভূতিগুলো জানানোর। কিন্তু অভিরূপ কখনও সেটা চায়নি। রূপা ঘরের এক কোণে বসে নিজের ফেলে রাখা পুরোনো বইগুলো খুলে দেখে—একটা পাতায় সে লিখেছিল, “ভালোবাসাহীন সম্পর্ক মানে হলো ধীরে ধীরে বিষ খেয়ে বেঁচে থাকা।” লিখেছিল বহু বছর আগে—তখনও বুঝতে পারেনি যে ভবিষ্যতে সে নিজেই এই বিষের স্বাদ পাবে, প্রতিদিন একটু একটু করে।

পরের দিন সকালে রূপা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে। চুল এলোমেলো, চোখের নিচে হালকা কালি, ঠোঁটে রঙ নেই—কিন্তু সে নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে। অনেকদিন পর সে বুঝতে পারে, সে নিজেকে দৃষ্টিতে রাখতে ভয় পাচ্ছে না। অনিন্দিতার সঙ্গে দুপুরে একান্তে কথা হয়—চায়ের কাপ হাতে, ছাদের কোণে বসে। রূপা অনেকটা সময় নীরব থাকার পর বলে, “আমি ডিভোর্স চাইব, অনিন্দিতা।” কণ্ঠস্বরে ভয় নেই, শুধু একরাশ শান্তি। অনিন্দিতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, “তুই নিশ্চিত?” রূপা মাথা নাড়ে, “এটা শুধু ভালোবাসা নেই বলে নয়, সম্মানও নেই। আমি আর নিজেকে ভুল প্রমাণ করতে চাই না।” সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে অভিরূপকে কিছু বলেনি, শুধু নিজের ঘুমন্ত স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে একটা সিদ্ধান্ত আরও গভীরে মুদ্রিত করে নেয়। সে জানে—এই ভাঙন কোনও ঝড়ের মতো আচমকা নয়, এটা ভিতরে ভিতরে গড়ে ওঠা এক ভূমিকম্প, যার পরিণতি অপ্রতিরোধ্য।

রূপার জীবনে অফিস ছিল একমাত্র স্থান যেখানে সে নিজের মতো করে নিঃশ্বাস নিতে পারত। প্রতিদিন সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে বাগবাজার থেকে বাস ধরে সল্টলেক সেক্টর ফাইভের অফিস পৌঁছানো ছিল তার রুটিন, কিন্তু অফিসের নিয়মিততা ছিল একধরনের পরিত্রাণও। সেই নিয়মিততার মাঝেই একদিন, ছাদে চা খাওয়ার ফাঁকে রূপার আলাপ হয় নীলয়ের সঙ্গে—একজন নতুন জোন লিড, সদ্য ব্যাঙ্গালোর থেকে ট্রান্সফার হয়ে আসা। নীলয় বয়সে রূপার সমানই, কিন্তু চোখে মুখে অন্যরকম এক শান্ত-আলো ছড়িয়ে ছিল। প্রথম কয়েকদিন খুব স্বাভাবিক, সৌজন্যমূলক কথাবার্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলেও, ধীরে ধীরে তাদের আলাপ গাঢ় হতে শুরু করে। অফিস শেষে মাঝেমাঝে একসাথে বাস ধরার সময়, কিংবা দুপুরে ক্যান্টিনের এক কোনায় বসে খাবার খাওয়ার সময়, নীলয়ের কথায় রূপা একরকম নতুন রঙ খুঁজে পায়। সে বুঝতে পারে, নীলয় শুধু একজন সহকর্মী নয়, বরং একজন শুনতে জানে, অনুভব করতে জানে। এমন কাউকে পাওয়া, যে রূপার নিঃশব্দ কষ্টগুলোর ভাষা বোঝে, তার কাছে যেন আশ্চর্য অনুভবের মতো।

নীলয়ের সঙ্গে সময় কাটাতে কাটাতে রূপার মনের ভিতর জমে থাকা অনেক অপ্রকাশিত অনুভূতি যেন মুখ খুঁজে পায়। একদিন সন্ধ্যায় অফিসের রুফটপ ক্যান্টিনে চা খেতে খেতে নীলয় হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসে— “তুমি কি সত্যিই খুশি?” প্রশ্নটা ছিল এতটাই সরল আর গভীর, যে রূপা থমকে যায়। সে কখনো এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়নি। একটা দীর্ঘ নীরবতার পর রূপা শুধু বলেছিল, “আমি ভালো থাকার অভিনয় জানি।” সেই দিনটার পর থেকে তারা দুজনেই জানত, সম্পর্কটা আর কেবল পরিচিতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। রূপার মনে জন্ম নেয় অপরাধবোধের বীজ। সংসার থাকাকালীন অন্য এক পুরুষের উপস্থিতি যে এত স্বস্তিদায়ক হতে পারে, তা ভাবতেই পারত না সে আগে। কিন্তু এটাও সত্যি, নীলয় তাকে কোনোদিন অপারগ করে কিছু চায়নি। বরং বারবার বলেছে, “তোমার স্বাধীনতা তোমার নিজের—তুমি যদি বন্ধন ভাঙো, সেটা তোমার জন্য হওয়া উচিত, আমার জন্য নয়।” সেই পরিণত কণ্ঠস্বর আর চোখের স্বচ্ছতা দেখে রূপা প্রতিদিন নিজেকে একটু একটু করে চিনতে শুরু করে।

এই অধ্যায়ে রূপার এক আত্মচেতন জার্নি শুরু হয়। সে নিজের জীবনের প্রতিটি মোড় আবারও মূল্যায়ন করতে থাকে। সে ভাবে—সংসারের দায়িত্ব নেওয়া কি শুধুই একরকম চুক্তিপত্র? যেখানে ভালোবাসার কোনও স্থান নেই? রূপার এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে ফোনে কথা বলে সে জানতে পারে, বন্ধু ইতিমধ্যেই বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে নিজের নতুন জীবন শুরু করেছে এবং অনেক ভালো আছে। এই ঘটনাগুলো রূপার মনে এক প্রবল আলোড়ন তোলে। রূপা এক সন্ধ্যায় যখন বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে, শূন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, তার মনে হয়, তার জীবনটা যেন একটা গন্ধহীন গোলাপের মতো—দেখতে ঠিকঠাক, কিন্তু কোনো গন্ধ নেই, কোনো অনুভব নেই। সেই মুহূর্তে সে সিদ্ধান্ত নেয়, আর নয়। ভালোবাসাহীন সেই নিঃস্ব জীবন থেকে বেরিয়ে আসা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। নিজের জন্য, নিজের ভবিষ্যতের জন্য, নতুন এক স্বাধীন সকালের জন্য তাকে এখন সাহস দেখাতে হবে।

রূপা ধীরে ধীরে বুঝতে শিখেছিল নিজের শূন্যতাকে কীভাবে পরিপূর্ণ করতে হয়। এক সন্ধ্যেয় অফিস থেকে ফেরার পর, বালিশে মুখ গুঁজে নয়, সে বসে ছিল ব্যালকনিতে, এক কাপ চায়ের ভাপ গায়ে মেখে। শ্যামল নামে এক নতুন সহকর্মী ইদানীং তার জীবনে একটু আলাদা জায়গা করে নিয়েছে। কোনো সম্পর্ক নয়, প্রেম নয়—তবে একধরনের বন্ধুত্ব, যা এতদিন রূপার জীবনে ছিল না। শ্যামল ছিল অনেকটা তার বিপরীত—আবেগপ্রবণ, সোজাসাপটা, আর মানুষকে সময় দিতে জানে। রূপা অবাক হয়ে দেখেছিল, কাজের মাঝে কী নিপুণ দক্ষতায় ছেলেটা তার দুঃখ বুঝে ফেলে। ওর চোখে কখনও দাম্পত্যের ক্লান্তি, কখনও ব্যক্তিগত বিষণ্ণতা—কোনোদিন রূপা বলেইনি কিছু, তবু শ্যামল যেন বুঝতে পারে। এই সহানুভূতি কখন যে তার ভিতরের খোলসটা আলগা করে দিয়েছিল, রূপা জানতেই পারেনি।

কিন্তু এই নির্ভরশীলতার জন্ম যেমন শান্তি দেয়, তেমনি ভয়ও জাগায়। রূপা জানত, সমাজ এই ধরনের বন্ধুত্বে সন্দেহ খোঁজে, আর তার নিজের মধ্যবিত্ত মানসিকতায় একধরনের অপরাধবোধ জন্ম নিতে থাকে। সে শ্যামলকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। কাজের বাইরে কথা বলা বন্ধ, মেসেজে দেরিতে উত্তর দেওয়া, এমনকি একদিন তো শ্যামলের চোখে চোখ রেখে বলেই ফেলেছিল, “আমার মনে হয় আমাদের সীমা টেনে দেওয়া দরকার।” শ্যামল কিছু বলেনি সেদিন, শুধু একরাশ হতাশা নিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বলেছিল, “বন্ধুত্ব কি সীমার মধ্যে থাকে, রূপা?” কথাটা রূপার বুকের ভেতর কাঁটা হয়ে বিঁধেছিল। সত্যিই তো—তার জীবনের প্রতিটা সম্পর্ক এক একটা সীমায় বাঁধা, এক একটা নিয়মে ঘেরা। শ্যামল সেই নিয়ম ভাঙতে চেয়েছিল না; সে শুধু চেয়েছিল একজন মানুষকে পাশে থাকতে, নিঃস্বার্থভাবে। কিন্তু রূপা ভীত—যেন নিজের পুরনো ধ্বংসস্তূপ থেকে বেরিয়ে আসার সাহসটাই তার নেই এখনও।

কয়েকদিন পরে এক সন্ধ্যায়, অফিস শেষে হঠাৎ করে শ্যামল এসে বলল, “চলো, এক কাপ কফি খাই। আজ কোনও কারণ ছাড়াই।” রূপা প্রথমে না বলতে গিয়েও হ্যাঁ বলে দেয়। কফি শপে বসে দুজনের মাঝে অনেক কথা হয় না—তবু এক ধরণের বোঝাপড়া জন্ম নেয়। শ্যামল একটা ছোট বাক্স এগিয়ে দেয়—ভেতরে একটা বই, কাভারে লেখা ‘The Courage to Be Disliked’. রূপা বইটা হাতে নিয়ে শুধু চেয়ে থাকে শ্যামলের দিকে—এই বইটিই যেন তার কাছে এক বার্তা হয়ে আসে, যে ভালোবাসা মানে শুধু দাম্পত্যে আটকে থাকা নয়, বরং নিজেকে ভালোবাসারও আরেক নাম। সে বইটা বুকে জড়িয়ে বলে, “আজকে প্রথমবার মনে হচ্ছে, আমি সত্যিই বাঁচতে চাই। আমার নিজের মতো করে।” সেই রাতে রূপা ঘুমায় নিজের ভেতরকার বোঝা ঝেড়ে, বুকভরা এক নতুন স্বপ্ন নিয়ে। জলের মতো স্বচ্ছ নয়, তবু সেই স্বপ্নের জলঘোলা হয়ে উঠেছিল তার জীবনের সবচেয়ে শান্ত মুহূর্তগুলোর একটা।

রূপার জীবনে ধীরে ধীরে যে নতুন আলোর রেখা ফুটে উঠছিল, তার সঙ্গে সঙ্গে একটা গোপন অন্ধকারও গাঢ় হতে লাগল। অফিসের কাজ, নতুন জীবনযাত্রা, একাকিত্বের রুটিন—সবকিছুর মাঝে সে বুঝতে পারছিল, যেটা ফেলে এসেছে, তা শুধু একটা ভাঙা দাম্পত্য নয়, বরং নিজের জীবনের অর্ধেকটা ছিল। একদিন বিকেলে বৃষ্টিভেজা জানালার ধারে বসে, তার পুরোনো ডায়েরির পাতা খুলে বসেছিল রূপা। সেখানে লেখা ছিল বিয়ের আগের স্বপ্নগুলো—নিজের মতো করে বাঁচার, পড়াশোনা শেষ করে বিদেশে যাওয়ার, কিংবা এক নিঃস্বার্থ প্রেমে জড়িয়ে পড়ার। কিন্তু বাস্তবে কিছুই ঘটেনি। তার মনের ভিতর জমে থাকা অভিমান, হতাশা, আর একরাশ অনিশ্চয়তা হঠাৎ করে অঝোর বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ল চোখ দিয়ে। সেই রাতে রূপা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “তুই ঠিক আছিস তো?” ছায়াটা নীরব ছিল, কিন্তু সেই নীরবতায় রূপা যেন শুনতে পেল নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট মেয়েটির কান্না, যে আরেকটু ভালোবাসা, আরেকটু সাহস চেয়েছিল।

এরপরের কয়েকদিন, রূপা অফিসে গেলেও মন পড়ে থাকত ভেতরের এক অস্থিরতায়। সে বুঝতে পারছিল, শুধু সংসার ভেঙে বেরিয়ে আসা নয়, নিজের সত্তাটাকে গড়ে তোলাটাও জরুরি। এই উপলব্ধি তাকে টেনে নিল এক সাইকোথেরাপিস্টের কাছে। প্রথম প্রথম কথা বলতে তার খুব অস্বস্তি লাগছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে সে খুলে বলল নিজের জীবনের সমস্ত স্তব্ধতা, অপমান, আর আত্মপরিচয়ের টানাপোড়েন। চিকিৎসকের স্নিগ্ধ অথচ তীক্ষ্ণ প্রশ্নে রূপা বুঝতে পারল—সে এতদিন যা ভাবছিল, যে সে দুর্বল, নিরুপায়, তা আসলে ঠিক নয়। বরং তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে একটা দৃঢ়, স্বাধীন সত্তা, যে শুধু ভয়ের কারণে নিজেকে আড়াল করে রেখেছিল। এই নতুন জার্নিটা ছিল আত্মপুনর্নির্মাণের, যেখানে প্রতিটি আবেগ, প্রতিটি ব্যথা হয়ে উঠছিল এক একটা শোধনের যন্ত্রণা। সে বুঝে গেল, যদি সে নিজেকে ক্ষমা না করে, নিজের চাওয়া-পাওয়ার সম্মান না করে, তাহলে কোনো নতুন জীবনের কথা কেবলই মরীচিকা।

এই আত্মচিন্তার ধারা তাকে ফিরিয়ে আনল সেই পুরোনো স্বপ্নগুলোর কাছে, যেগুলোকে সে একসময় ভুলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। বিদেশে যাওয়া নয়, তবে এবার সে ঠিক করল—নিজের ছোট্ট এক উদ্যোগ শুরু করবে, যেখানে মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা যাবে। সে নিজেকে গুছিয়ে তুলল আবার, অফিস শেষে সময় বার করে পড়তে লাগল কাউন্সেলিং নিয়ে, অনলাইন কোর্সে ভর্তি হল, আর ধীরে ধীরে তার মধ্যে গড়ে উঠতে লাগল এক অদম্য আত্মবিশ্বাস। তার বন্ধু দেবলীনা এই ব্যাপারে পাশে ছিল, উৎসাহ দিত, আর বলত—”তুই পারবি রে, শুধু নিজেকে বিশ্বাস রাখ।” রূপার মনে হচ্ছিল, এবার সে আর ছায়ার সঙ্গে কথা বলবে না—সে আলোতে দাঁড়িয়ে, মুখোমুখি হবে নিজের সত্য সত্তার। নিজেকে আর কোনো কাঁচের দেয়ালের মধ্যে বন্দি না রেখে, সে এবার সত্যিকারের মুক্তির পথে হাঁটতে শুরু করল।

রূপার নতুন জীবনের এই পর্যায়ে সময় যেন অন্যরকম হয়ে উঠেছে। আগের মতো তাড়া নেই, বাধ্যবাধকতার ভার নেই, প্রতিটি সকাল শুরু হচ্ছে নিজের পছন্দমতো। একটা নতুন বাসা, নিজের মতো সাজানো, নিজের মতো করে বাঁচা—এই অভিজ্ঞতাগুলো এতদিন তার জীবনে ছিল না। সে এখন সকালবেলা উঠেই নিজের বারান্দায় বসে কফির কাপ হাতে সূর্যোদয় দেখে। ল্যাপটপ খুলে তার ফ্রিল্যান্স আইটি প্রোজেক্টগুলোতে মন দেয়, কখনও কখনও লেখালেখিও করে। একটা ছোট বাটিক প্রজেক্ট শুরু করেছে—’রূপকথা’ নামে—যেখানে নারীদের স্বাধীনতা, আত্মপরিচয় ও পুনর্জন্মের গল্প তুলে ধরা হয়। সে জানে তার মতো আরও অনেক রূপা এই শহরে আছেন, যারা ভালোবাসাহীন অথচ প্রথাগত সম্পর্কে আটকে পড়ে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আছেন। তাদের জন্য একটা কণ্ঠস্বর তৈরি করা এখন তার কাছে দায়িত্ব মনে হয়।

একদিন বিকেলে রূপা গেল শহরের এক সাহিত্যচক্রের আসরে। সেখানে তার কবিতা পাঠ করার কথা ছিল। স্টেজে উঠে সে যখন বলল—”আমি এক সময় গন্ধহীন গোলাপ ছিলাম, শুধু শোভা ছিল, ঘ্রাণ ছিল না”—তখন গোটা ঘর যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। তার কবিতায় উঠে আসে তার ভাঙন, তার আত্মদহন, তার সাহস ও নতুন করে বাঁচার গল্প। সভার শেষে একজন নারী এগিয়ে এসে বললেন, “আপনার কবিতা শুনে মনে হলো যেন আমার নিজের জীবন শুনলাম।” রূপা হেসে বলল, “তাহলে আপনি বুঝতে পারছেন, ঘ্রাণ ফিরে পেতে হলে গোলাপকে তার মাটির কাছে ফিরতে হয়।” সেই নারী চোখে জল নিয়ে বললেন, “আমিও বেরোতে চাই।” রূপা তার হাত ধরল, ঠিক যেমন কোনো এক সময় সোহিনী তার হাত ধরেছিল। এইভাবে একে একে সে অন্য নারীদেরও সাহস জোগাতে লাগল—যাদের ভালোবাসার নামে শুধুই দায়িত্ব আর যন্ত্রণা কপালে জুটেছে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রূপার হৃদয়েও কিছু পরিবর্তন আসে। শঙ্খর সঙ্গে যোগাযোগ এখন সীমিত হলেও বন্ধ হয়নি। শঙ্খ তাকে কখনোই কোনো সম্পর্কের চাপ দেয়নি, শুধু পাশে থেকেছে। একদিন তারা দুজনে গিয়েছিল শান্তিনিকেতনে, বোলপুরে এক শান্ত পলাশবনের মাঝে। রূপা বলেছিল, “আমি কাউকে ভালোবাসার সাহস পাই না, ভয় হয় আবার কোনো গন্ধহীন গোলাপে পরিণত হব।” শঙ্খ শুধু বলেছিল, “তুমি যদি চাও, গোলাপ নিজেই তার ঘ্রাণ খুঁজে পাবে। কেউ তোমায় তা কেড়ে নিতে পারবে না।” সেই কথাগুলো রূপার মনে দাগ কেটেছিল। সময়ের পরিক্রমায় সে উপলব্ধি করল—ভালোবাসা মানে কারও ছায়ায় থাকা নয়, বরং পাশাপাশি হাঁটা, সম্মানের জায়গা থেকে সম্পর্ক গড়ে তোলা। এবং এই উপলব্ধিই তাকে আবার ভালোবাসায় বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিল। নিজের প্রতি ভালোবাসা, নিজের স্বাধীনতার প্রতি ভালোবাসা—এই দুটি ছিল তার নবজন্মের মূলভিত্তি। আজ সে জানে, তার ভেতরের গোলাপ এখন শুধু শোভা নয়, ঘ্রাণেও পূর্ণ। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সে এখন আর গন্ধহীন নয়—সে পরিপূর্ণ এক গোলাপ।

****

1000045307.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *