Bangla - প্রেমের গল্প

গন্ধরাজের ছায়া

Spread the love

অর্কদীপ ঘোষ


 

আষাঢ়ের এক শেষ বিকেল। ধূলিধূসর রাস্তা পেরিয়ে রাধিকার গাড়ি এসে দাঁড়াল শান্তিনিকেতনের এক পুরনো বাড়ির সামনে—দোতলা, লালমাটির ধুলোয় লেপা উঠোন, চারপাশে পেঁচিয়ে ওঠা মাধবীলতা আর ঘন পাতা গন্ধরাজ গাছের ছায়া। জানালার গরাদে কাঁটা লতাভরা স্মৃতি আটকে আছে, যেন কেউ সময়কে ছেঁচে রেখে দিয়েছে ওই দেয়ালের ফাটলে। এক সময় এই বাড়ির প্রতিটি কোণা তার চেনা ছিল—দাদুর বইয়ের আলমারি, মামিমার হাতের লুচির গন্ধ, আর উঠোনের কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা সেই বিশাল গন্ধরাজ গাছ, যার তলায় একদিন ঋষভ দাঁড়িয়ে বলেছিল, “তুই চলে যাবি তো ঠিকই, কিন্তু এই গন্ধটা থেকে যাবে। জানবি আমি কাছে আছি।” আজ বছর তেরো পর রাধিকা সেই গন্ধে ফিরে এসেছে, কাঁধে ব্যাগ, চোখে ঘুমভাঙা স্মৃতি, আর বুকের মধ্যে এক অদৃশ্য অস্থিরতা নিয়ে। মামাবাড়ির দালানটা এখনো বদলায়নি, শুধু মানুষের চোখে যেন একটু বেশি শূন্যতা জমেছে। মামিমা বারান্দায় দাঁড়িয়ে, সাদা চুলে হাওয়ার দোল, হাসিতে একধরনের বোবা কান্না। রাধিকা ব্যাগ নামিয়ে প্রথমেই গন্ধরাজ গাছটার দিকে তাকাল—ফুল ফেটেছে। হঠাৎ মনে হল, কেউ যেন তাকিয়ে আছে জানালার ওপার থেকে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই চেনা সেই ছায়া, চেনা সেই চোখের রেখা—ঋষভ।

ঋষভ বদলায়নি, আবার হয়তো অনেকটাই বদলে গেছে। তার চুলে এখন হালকা সাদা, চোখে চশমা, গায়ে ছাপোষা পাঞ্জাবি আর ধুতি। সে কিছু বলে না, শুধু একবার চোখে চোখ রাখে রাধিকাদের দোতলার সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়। তাতে কোনো প্রশ্ন নেই, কোনো অভিমানও নয়, যেন একটা টান—অতীতের কড়িকাঠে বাঁধা পড়া কিছু একটা আজ আবার জেগে উঠেছে। সেদিন সন্ধ্যায় রাধিকা জানালার পাশে বসে ছিল, গন্ধরাজের গন্ধে ভরে থাকা বারান্দায়, আর নিচে উঠোনে ঋষভ গাছের নিচে জল দিচ্ছিল। আলো কমে এলে ছায়াগুলো লম্বা হতে থাকে, আর রাধিকার চোখে ভাসে সেই শেষ দিনটা, যেদিন কলেজে ভর্তি হতে কলকাতায় চলে গিয়েছিল সে। ঋষভ এসেছিল বিদায় জানাতে, কিন্তু মুখে কিছু বলেনি—শুধু একটা গন্ধরাজ ফুল তুলে দিয়েছিল হাতে, মাটির রঙে ছোপ ছোপ লাগা পাতাগুলোতে লেগে ছিল অগোছালো প্রেম। সেই ফুলটা সে ডায়েরির পাতায় রেখে দিয়েছিল, এখনও আছে, কিন্তু সেই পাতার মতই শুকিয়ে গেছে অনেক কিছু। মামিমা রাতের খাওয়ার পর রাধিকার মাথায় হাত রেখে বললেন, “ঋষভ এখনও ওই গন্ধরাজ গাছটার যত্ন নেয়, জানিস তো? তোরা ছোট থাকতে বলতিস, গাছটা নাকি তোদের প্রেম দেখে। কে জানে, হয়ত এখনো দেখে।”

রাধিকা সেদিন রাতে ঘুমোতে পারল না। জানালার কাঁচে বৃষ্টির টিপটিপ শব্দ আর গাছের পাতায় ঝরে পড়া রাতের গল্প তাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেল অতীতের চিলেকোঠায়। সেই জায়গাটা, যেখানে তারা দুইজনে বসে ‘ঘাসের উপর পা রাখলে প্রেম সত্যি হয় কিনা’ এসব দার্শনিক প্রশ্ন করত, ঈশ্বরের চেয়ে বেশি বিশ্বাস করত একে অপরকে, আর ভেবেছিল—এই গন্ধরাজ গাছটাই হবে তাদের সাক্ষী। কিন্তু সময় সাক্ষী রাখে না কাউকে, সে শুধু ধরে রাখে গন্ধ আর আক্ষেপ। রাধিকা উঠে জানালার দিকে গেল, দেখল ঋষভ উঠোনে দাঁড়িয়ে—ছাতা হাতে, মুখে কোনও ভাবান্তর নেই। সে তাকাল একবার, হালকা মাথা নোয়াল, তারপর চলে গেল নিজের বাড়ির দিকে। মনে হল, অনেক কথা তার ভেতরেই রয়ে গেছে, যেগুলো কখনও উচ্চারিত হয়নি। রাধিকার মনে হল, হয়ত এই ফেরাটাও সেই উচ্চারণহীন কথার একটা শুরু—একটা দীর্ঘ ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে, যেখানে এখনও গন্ধরাজ ফোটে।

পরদিন সকালটা কেমন ঘোলাটে আলোয় শুরু হয়। শান্তিনিকেতনের বাতাসে এখনও ভোরের শিশির, আর আকাশে কিছুটা সোনালি মেঘের ভেসে থাকা ধ্বংসপ্রায় নীল। রাধিকা ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়—হাতে কাঁসার কাপ, মামিমার দেওয়া দুধ-চা। নিচে গন্ধরাজ গাছের নিচে পাতা ঝরে জমে আছে, আর এককোণে দেখা যায় কালকের ছায়া—ঋষভ। আজ সে গাছের মাটি পাল্টাচ্ছে, পায়ের পাশে মাটির হাঁড়িতে গোবরসার মিশ্রণ। রাধিকার চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা দেখে সে একবার চোখ তুলে তাকায়, তারপর চোখ নামিয়ে নেয়। রাধিকার মনে হল—এই চুপচাপভাবটুকুই তো তাদের প্রেমের আসল ভাষা ছিল। কোনোদিন তারা বলেনি কিছু, কিন্তু জানত সবকিছু। হঠাৎ রাধিকার চোখে পড়ে, গাছের এক ডালে লেপ্টে থাকা একটি পুরোনো রঙিন সুতো—ওটা তাদের ছোটবেলার খেলা ছিল, ইচ্ছা বাঁধা সুতো। ঈশান—না, ঋষভ বলেছিল, “যদি সুতোটা একবছর ঝড়ে না পড়ে, তাহলে আমাদের বন্ধন থাকবে।” রাধিকার মনে পড়ে যায়—সেই বছরই সে চলে গিয়েছিল কলকাতা, আর ফিরে আসেনি বহুদিন।

বিকেলে মামিমা রান্নাঘরে ব্যস্ত, গন্ধে ভেসে আসে খিচুড়ি আর বেগুন ভাজার পরিচিত স্বাদ। রাধিকা বইয়ের তাক ঘেঁটে একটা পুরোনো ডায়েরি বের করে—যেটা সে একসময় এখানে রেখে গিয়েছিল। তার ভেতরে গন্ধরাজ ফুলটা এখনও আছে, শুকনো পাতায় গন্ধ নেই, কিন্তু চিহ্ন আছে—হলুদ হয়ে যাওয়া একখানা সময়ের। সেই সময়টাতে একরকম সাহস ছিল, যেখানে অপেক্ষা মানে ছিল একরকম প্রেম, আর চিঠি লেখা ছিল নিজের বুক খুলে দেওয়া। হঠাৎ সে অনুভব করল, একটা চিঠি লেখা দরকার। কিন্তু কাকে? ঋষভকে? সে কি পড়বে সেই চিঠি? বারান্দায় ফিরে এসে সে দেখল, ঋষভ এখন উঠোনে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে—সেই পুরোনো সুর, রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়, একটা ভাটিয়ালি সুর, যার মাঝে মাঝেই থেমে যাওয়া ব্যথা লুকিয়ে আছে। রাধিকা জানালার কাঁচের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকে—না ডাকছে, না ফিরে যাচ্ছে। এই দূরত্বই কি তাদের প্রেমের আশ্রয়?

রাত বাড়তে থাকে। আকাশে পূর্ণিমার আলো গন্ধরাজ গাছের ছায়া ফেলে দেয় বারান্দার মেঝেতে। রাধিকা তার ফোনে কোনো নোটিফিকেশন না পেয়ে একটা কাগজে লিখে ফেলে: “আমরা কি এখনও সেই সুতোয় বাঁধা আছি?” তারপর কাগজটা ভাঁজ করে বারান্দা থেকে ছুড়ে দেয় নিচে, গাছের পাতার দিকে। সে জানে, ঋষভ হয়ত সকালে ওটা দেখবে, কিংবা দেখবে না। হয়ত উড়িয়ে দেবে হাওয়ার হাতে, কিংবা রেখে দেবে বুকপকেটে। কিন্তু তবুও, এই চিঠি—এই অল্প লেখাই তার সাহস, যেটুকু শব্দে সে নিজেকে ফিরে পায়। গন্ধরাজের গন্ধে সে চোখ বন্ধ করে, আর বুঝতে পারে—পুরোনো জানালার ওপার থেকেও প্রেম ফিরতে পারে, যদি কেউ অপেক্ষা করে থাকে নির্জন কোনো সুরে।

ভোরবেলার শান্তিনিকেতন যেন শব্দহীন এক পাণ্ডুলিপি—পাতা ওড়ানো হাওয়া, দূরে কোকিলের ডাক, আর উঠোনে জমে থাকা হালকা কুয়াশা। ঋষভ চিরকাল ভোরে উঠে, গাছের তলায় বসে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকে—না প্রার্থনা, না ধ্যান, বরং এক রকম শূন্যতায় ডুবে থাকা। আজ সে যেমনটা প্রতিদিন করে, তেমনি গন্ধরাজ গাছের নিচে গিয়েই তার চোখে পড়ে একটা কাগজ। প্রথমে মনে হয় কোনো শুকনো পাতা, কিন্তু তুলে দেখে, ভাঁজ করা কাগজ, তার ওপর হালকা হাতের লেখা—”আমরা কি এখনও সেই সুতোয় বাঁধা আছি?” সে মুহূর্তে তার মুখে কোনো ভাব ফুটে ওঠে না, শুধু একটা দীর্ঘ দৃষ্টিপাত, যেন ছেলেবেলার দিনগুলো ছায়া হয়ে নেমে আসে তার কাঁধে। সে দাঁড়িয়ে পড়ে, মাথা তুলে তাকায় দোতলার বারান্দার দিকে—খালি, শুধু জানালার কাঁচে হালকা কুয়াশার রেখা। দীর্ঘ সময় পরে সে কাগজটা বুকপকেটে রেখে দেয়—একটা শব্দ না বলেও সে যেন শুনতে পাচ্ছে বহু পুরোনো এক আওয়াজ, যা একদিন থেমে গিয়েছিল।

ঋষভ দুপুরে ছায়া ঘেরা উঠোনে এসে বসে কাঠের পিঁড়িতে, তার পাশে মামিমা বসে ছুলে দিচ্ছেন কাঁচা আম। রাধিকা বারান্দা থেকে নামছে—আজ তার পরনে সাদামাটা তুলসী সবুজ শাড়ি, মুখে কোনো সাজ নেই, কিন্তু চোখে যেন অনন্ত কথার কালি লেগে আছে। তারা কেউ কিছু বলে না, কিন্তু আকাশের ভঙ্গুর নীলের মতো একটা অস্বচ্ছ আলাপ চলতে থাকে। হঠাৎ ঋষভ বলল, “সেই গন্ধরাজ গাছটা কেমন করে এত বছর টিকে গেল, ভাবিস?” রাধিকা মৃদু হেসে বলল, “হয়তো ভালোবাসা পেলে গাছও বাঁচে।” তারপর থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুই কি এখনো সুতো বাঁধিস ডালে?” ঋষভ সোজা হয়ে বসে, বলল, “না, কিন্তু খুলেও ফেলিনি। কিছু কিছু বন্ধন কেটে ফেলা যায় না—তারা গন্ধ হয়ে থাকে।” এই কথাগুলো উচ্চারণের সময় যেন দুজনের মধ্যেকার অদৃশ্য দূরত্ব একটু নড়ে ওঠে, সময়ের জমাট বরফে এক চিলতে ফাটল ধরে। তাদের চারপাশে রোদ গড়িয়ে পড়ে উঠোনে, পাতায় বাজে বাতাসের ক্ষীণ গুঞ্জন, আর সেই মাঝখানে দুই জোড়া চোখ, যাদের মধ্যে বহু প্রশ্নের ঘোর লেগে আছে।

সন্ধ্যায়, যখন গোধূলির আলো মাটিতে পড়ে সোনালি ছায়া আঁকে, ঋষভ হঠাৎ গলায় হারমোনিয়াম নিয়ে বসে। সে জানে, রাধিকা শুনবে—অন্তত জানালার ও পাশ থেকে। সে গায়, “সুতোটা ছেঁড়েনি আজো, সময় শুধু লুকিয়ে রেখেছে…”—নিজের বানানো এক গীত। রাধিকা জানালার পাশে বসে, তার হাতে সেই শুকিয়ে যাওয়া গন্ধরাজ ফুল, আর মনে মনে ভাবে—যদি আজ ঋষভ উঠে এসে বলে, “চলো, আবার গন্ধরাজ গাছটার নিচে বসি”—তাহলে সে যাবে কি? কিন্তু ঋষভ কিছুই বলে না, সুর থেমে যায়, শুধু বাতাসের মধ্যে থেকে যায় সেই কথাহীন প্রেমের ধ্বনি, যেটা কেউ শুনতে পারে না, কিন্তু কেউ ভুলতেও পারে না। রাধিকা জানে, এভাবে বলা হয় না প্রেমের কথা—তবু এভাবেই তারা বলেছিল, আর এখনো বলে।

রবিবারের দুপুরে গাঢ় নিস্তব্ধতা নামে শান্তিনিকেতনের আকাশে। কুয়াশার রেখা গলিয়ে সূর্য কেমন যেন কুয়াশা-ছাওয়া আলো ছড়িয়ে দেয়—নরম, গাঢ়, মনের গভীরে ছায়া ফেলে এমন এক আলো যা গোপন কথা শোনার উপযুক্ত। রাধিকা ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনের কোণায় গিয়ে দাঁড়ায়। গন্ধরাজ গাছটার তলায় বসে আছে ঋষভ—চুপ করে, হাতে একটা নোটবুক, সম্ভবত আঁকছে কিছু। রাধিকা কোনো শব্দ না করে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে তারা। তারপর ঋষভ চোখ তুলে তাকায়, তার চোখে বিস্ময় নেই, বরং প্রস্তুতির ছায়া। রাধিকা মৃদু হেসে বলে, “তুই কি এখনও ছবি আঁকিস?” ঋষভ মাথা নাড়ে, “আঁকি, শুধু আর তোর মতো কেউ দেখে না।” একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস আসে রাধিকার গলা দিয়ে। সে বলে, “তুই কখনো আমায় থামিয়ে রাখতে চাসনি কেন, ঋষভ?” এই প্রশ্নটা অনেক বছর ধরে জমে ছিল তার ভিতর—একটা না বলা ব্যথার মতো। ঋষভ নিচু গলায় বলে, “আমি থামিয়ে দিলে তুই আমায় দোষ দিতি। আমি ছাড়িয়ে দিয়ে ভেবেছিলাম, যদি একদিন নিজের ইচ্ছেতেই ফিরিস। দেখিস তো, ফিরেছিস।”

এই বাক্যটার মধ্যে অদ্ভুত কিছু ছিল—না অভিমান, না অহংকার, বরং এক ধরনের শান্ত স্বীকারোক্তি। রাধিকার চোখে জল জমে ওঠে, সে বলে, “আমরা কি প্রেমে ছিলাম, ঋষভ?” ঋষভ হালকা হাসে, “আমরা এখনও আছি।” সেই মুহূর্তে সবকিছু থেমে যায়—পাতা নড়ে না, পাখি ডাকে না, এমনকি বাতাসও নিঃশব্দ হয়ে যায় যেন। রাধিকা ধীরে ধীরে বসে পড়ে তার পাশে। গন্ধরাজ গাছের ছায়া দুজনকে ঢেকে রাখে, তাদের অনেক বছরের অপেক্ষা, ভুল বোঝাবুঝি, চিঠি না লেখা দিন—সব মিলিয়ে এই নীরবতাই যেন তাদের ভাষা। তারা মুখোমুখি হয়, না চোখে চোখ রেখে, বরং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বসে। দুজনের মাঝখানে পড়ে থাকা শুকনো গন্ধরাজ ফুলটা হঠাৎ বাতাসে উড়ে যায়। হয়তো তাদের বুক থেকে উঠে যাওয়া কোনো অচেনা বোঝা।

ঋষভ বলে, “আমি তোকে চিঠি লিখতাম এখনো—লিখতাম, কিন্তু কখনো পাঠাতাম না। তুই কি পড়তিস, জানতাম না।” রাধিকা বলে, “আমি তো তোকে কখনো চিঠিই দিইনি, শুধু মনে মনে বলতাম কিছু কথা। আজ বলছি।” তারা দুজনে হাঁটতে থাকে—সেই পুরোনো কুয়াশার পথ ধরে, যেখানে তারা প্রথম হাত ধরেছিল, প্রথম হাসতে হাসতে বলেছিল, “একদিন আবার দেখা হবে।” সেই দেখা আজ হয়েছে, এবং সেই দেখা—শুধু চোখের নয়, আত্মার দেখা। গন্ধরাজ গাছটা নীরবে দুলছে বাতাসে, যেন আশীর্বাদ জানাচ্ছে, পুরোনো প্রেম ঠিক পথ খুঁজে নিতে পারে—যদি তাতে গন্ধ থাকে, ছায়া থাকে, আর একটা চুপ করে অপেক্ষা করে থাকা মন থাকে।

সন্ধে হবার খানিক আগে রাধিকা হঠাৎ বলল, “তুই কি একবার সেই মাঠটায় নিয়ে যেতে পারবি, যেখানে আমরা ছোটবেলায় ঘুড়ি ওড়াতাম?” ঋষভ একটু থেমে তাকাল তার দিকে। সেই মাঠ এখনো আছে, কিছুটা আগাছায় ঢাকা, কিছুটা ভাঙা বেঞ্চে ঠাসা, আর এক কোণায় পড়ে থাকা পুরোনো বটগাছটা যেন নীরবে স্মৃতির সিন্দুক রক্ষা করে আসছে এতকাল। তারা দু’জনে রিকশা করে বেরোয়, ছায়াপথ ধরে, যেখানে গাছের পাতায় সন্ধ্যার আলো নরমভাবে খেলে যাচ্ছে। রাধিকা জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে, গাল ছুঁয়ে থাকা হাওয়ায় পুরোনো কথা জেগে ওঠে—সেই দিনটা, যেদিন তাদের ঘুড়িটা সবচেয়ে উঁচুতে উঠেছিল, আর ঋষভ বলেছিল, “দেখ, যদি ডোর না ছেঁড়ে, আমাদের মনও ছেঁড়াবে না।” কিন্তু পরদিনই রাধিকা চলে গিয়েছিল কলকাতায়, আর ডোর… ছিঁড়েই গিয়েছিল কি?

মাঠে পৌঁছে তারা কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। দূরে দু-তিনটা ছেলে ফুটবল খেলছে, মাঝেমাঝে হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে। ঋষভ একটা জায়গায় হাত দেখিয়ে বলল, “ওখানেই তুই পড়েছিলি একবার, পা কেটে গেছিল। আমি তো তোকে বাড়ি পর্যন্ত কোলে করে এনেছিলাম। মনে আছে?” রাধিকা হেসে বলে, “মনে থাকবে না? আমি তোর বুকে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।” তারপর তারা হাঁটতে শুরু করে, মাঠের কোণায় গিয়ে বসে পড়ে একটা ভাঙা বেঞ্চে। রাধিকা বলল, “তুই জানিস, শহরে থাকাকালীন আমি অনেক সম্পর্কে জড়িয়েছিলাম। কিন্তু সবই কেমন যেন… গন্ধহীন। কেউ আমার চোখে প্রেম খুঁজত না, শুধু আমার পেছনে গল্প খুঁজত। কিন্তু তুই… তুই শুধু আমার পাশে বসে থাকতিস, কিছু না বলে।” ঋষভ শান্ত গলায় বলল, “কারণ আমি গল্পটা জানতাম না, আমি শুধু তোর নীরবতা পড়তে পারতাম। তাই হয়তো ভালোবাসতে পারতাম।”

রাধিকা তখন ঋষভের হাত ছুঁয়ে বলে, “তুই কি এখনও পারিস, ঋষভ?” এই প্রশ্নের উত্তর সে চায় না কথায়, সে চায় চোখে, হাওয়ায়, গন্ধরাজের ছায়ায়। ঋষভ উত্তর দেয় না, শুধু রাধিকার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখে। তারা দু’জনে আবার সেই বিকেলের মতো মাঠে বসে থাকে—পেছনে সূর্য ডুবে যাচ্ছে, আকাশে নরম গন্ধরাজের রঙের মেঘ, আর চারপাশে নিঃশব্দ হয়ে আসা গোধূলি। সেই মুহূর্তে রাধিকা বুঝতে পারে—প্রেম আসলে কিছুই চায় না। সে শুধু ফিরে আসতে চায় একবার, নিঃশব্দে, ঠিক যেমন আজ এসেছে। সময় ছেঁড়া, ডোর ছেঁড়া, কিন্তু মন? সে তো এখনো বাঁধা—একটা পুরোনো গন্ধরাজ ফুলের মতো, শুকনো হলেও ফেলে দেওয়ার মতো নয়।

কলকাতা থেকে ফোনটা এল একেবারে সকালে—কলেজের প্রিন্সিপাল, কড়া অথচ মায়াময় গলায় বললেন, “রাধিকা, তোমার ছুটিটা আর বাড়ানো যাচ্ছে না। আগামী সোমবার থেকেই ক্লাস।” ফোনটা কানে নিয়েই বারান্দায় এসে দাঁড়াল রাধিকা। গন্ধরাজ গাছটা হাওয়ায় দুলছে—তেমনি নিঃশব্দে, প্রতিদিনের মতো। কিন্তু আজ সেই দুলনোতেও একটা অস্থিরতা আছে, যেন গাছটাও জানে, এবার আবার যাওয়ার সময় এসেছে। সে ফোন নামিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। একমুহূর্তে চোখে জল চলে আসে—সে জল ব্যস্ততা থেকে নয়, ভালোবাসার অভ্যেসে ভাঙা স্থিরতাকে হঠাৎ চেপে ধরার থেকে জন্ম নেয়। এতদিনে যা গড়ে উঠেছিল মনের গভীরে, আজ আবার তার গায়ে শহরের সময়সীমা লেগে গেছে। এ তো নতুন কিছু নয়—তবুও, এই ‘যাওয়া’র মধ্যেও তো কিছু থেকে যায়। রাধিকার নিজেরই মনে হয়, এবার যাওয়ার আগে কিছু বলতেই হবে। যে কথাগুলো এতদিন বলা হয়নি, যেগুলো রোজ ঋষভের চোখে তাকিয়ে জমে উঠেছে।

সেদিন দুপুরবেলা রাধিকা হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় ঋষভের বাড়ির দিকে। খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে, ঋষভ একটা কাঁচা কাঠের ফ্রেমে গন্ধরাজ গাছের পাতার ছাপ বসাচ্ছে জলরঙে। রাধিকা বলে, “সুন্দর হচ্ছে… কিন্তু এবার আমাকে যেতে হবে।” ঋষভ থেমে যায়, ব্রাশটা রেখে বলে, “জানি। ফিরতে তো হবেই, সময়ের কাছে তো কেউ চিরকাল থাকতে পারে না।” রাধিকা ধীরে ধীরে বলে, “কিন্তু আমি এবার আর আগের মতো ফিরব না, ঋষভ। আমি জানি না কবে আবার আসব। হয়তো কখনো আসবই না।” একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস জমে থাকে কথাগুলোর ফাঁকে। ঋষভ একটু হেসে বলে, “তাহলে এইবার বলে যা। যেটা এতদিন বলিসনি।” রাধিকা প্রথমে থেমে যায়, তারপর মৃদু কণ্ঠে বলে, “আমি তোকে ভালোবাসতাম… এখনও বাসি। কিন্তু ভয় পেয়েছিলাম—আমার শহুরে ব্যস্ততার প্রেম তোর এই গন্ধরাজ গাছটার প্রেমকে বোঝার মতো নয়। তুই তো চুপচাপ ভালোবাসিস, আর আমি তো সবকিছুর জবাব খুঁজে ফিরি।” ঋষভ বলে, “তাই তো তোকে ভালোবাসি। কারণ তুই না বললেই বুঝি, তোর চোখের ফাঁকে কী লুকিয়ে আছে।”

দুজনের মাঝখানে কয়েক মুহূর্তের নিরবতা নামে, আর তার ভেতর দিয়ে হাওয়ায় ভেসে আসে গন্ধরাজের সুবাস। রাধিকা হঠাৎ ব্যাগ থেকে একটা ছোট কাঁচের শিশি বের করে দেয়—তার ভেতর শুকনো গন্ধরাজের পাপড়ি। “এটা রাখ,” সে বলে, “যদি কখনো ভুলে যাস, আমি এসেছিলাম।” ঋষভ কাঁচের শিশিটা হাতে নিয়ে চেয়ে থাকে, তারপর বলে, “তুই যদি সত্যিই চলে যাস, আমি গন্ধরাজ গাছটার নিচে একটা খালি চেয়ার রাখব। যদি কখনো আবার ফিরিস… শুধু বসে যাস। আমি কিছু জিজ্ঞেস করব না।” রাধিকার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। সে হেসে বলে, “তুই বরাবরই এমন—কিছু না বলেই সব বলে ফেলিস।”

স্টেশনটা যেন সেই আগের মতোই আছে—রোদে পোড়া পাটাতন, ছেঁড়া বিজ্ঞাপনপত্র, আর ধুলোর মাঝে কুন্ডলি পাকানো ধোঁয়া। রাধিকার হাতে ছোট্ট একটা ট্রলি ব্যাগ, কাঁধে ঝোলা আর চোখে অনিশ্চিত ক্লান্তি। ট্রেন ধরার তাড়া নেই, অথচ সময়টা যেন তার পেছনে ঘুরে ঘুরে জিজ্ঞেস করছে—“তুই যাচ্ছিস?” প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে বসে সে চারপাশে তাকায়—এই প্ল্যাটফর্মেই একসময় তারা দাঁড়িয়ে ছিল, সেই কিশোরী বয়সে, এক অপ্রকাশিত দৃষ্টির মধ্যে কত কিছু বলে দিয়েছিল। রাধিকা জানে, ঋষভ আসবে না। সে কথা দিয়েছিল আসবে না—কারণ কিছু বিদায়, উপস্থিত না থেকেই সবচেয়ে সত্য হয়। তবুও, মন চায় তাকিয়ে থাকতে, দেখতে এক ঝলক ছায়া দৌড়ে আসছে কিনা। পাশের এক বৃদ্ধ বলছিলেন, “এই ট্রেন তো লেট হয় আজকাল, তোমার অপেক্ষা একটু লম্বা হবে মা।” রাধিকা মনে মনে হেসে উঠল—এ অপেক্ষা তো অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে।

ঋষভ তখন বাড়ির উঠোনে বসে, গন্ধরাজ গাছটার তলায় একটা খালি চেয়ার রেখে দিয়েছে। চেয়ারটা সাধারণ, বাঁশ দিয়ে বাঁধানো, তবে তার দিকে তাকালেই মনে হয় কেউ বসবে বলে প্রস্তুত হয়ে আছে। পাশেই একটা পুরোনো ক্যাসেট প্লেয়ারে চলছে এক পুরোনো গান—“তুমি রবে নীরবে…”। গন্ধরাজের ফুলেরা বাতাসে দুলছে, আর ছায়া পড়ে পড়ছে উঠোনে। ঋষভ জানে রাধিকা এখন ট্রেনে উঠবে, জানালার পাশে বসবে, বাইরে তাকিয়ে থাকবে—কিন্তু কোনো কিছুতে চিৎকার করবে না, কোনো অশ্রু প্রকাশ করবে না। শুধু মনে মনে হয়তো সেই খালি চেয়ারের ছবি আঁকবে—যা তার জন্য ছেড়ে রাখা হয়েছে, একদিন হয়তো ফেরার আশায়। তার মুখে কোন বিষাদ নেই, বরং এক রকম নিশ্চিন্তি—কারণ প্রেম যদি গভীর হয়, তবে সে ফিরে আসেই—সময় নিয়ে, অথবা চুপচাপ।

রাধিকার ট্রেন ছেড়ে দেয় বিকেল চারটের সময়। সে জানালার পাশে বসে, গাছের সারি পেছনে যেতে যেতে মিলিয়ে যায়। তার চোখে জল নেই, ঠোঁটে হালকা হাসি। সে ব্যাগের ভেতর থেকে সেই কাঁচের শিশিটা বের করে, দেখে—ভেতরে গন্ধরাজের শুকনো পাপড়িগুলো ঝিম ধরে আছে, কিন্তু ভেঙে যায়নি। সেদিন ঋষভ বলেছিল, “তুই যদি ফিরে আসিস, আমি কিছু জিজ্ঞেস করব না।” রাধিকা মনে মনে বলে, “আমিও বলব না কিছু। শুধু বসে পড়ব সেই চেয়ারে। তখন সব কথা হয়ে যাবে।”

বছর তিন কেটে গেছে। শান্তিনিকেতনের বাতাসে এখন নতুন বসন্ত। কুড়মুড়ে পাতা ঝরে নতুন কুঁড়ির জন্ম হয়েছে গন্ধরাজ গাছে, আর পাখিরা এসে সেই ছায়ার নিচে গান গায়—যেমন তারা গেয়েছিল বহু বছর আগে। ঋষভ এখনও থাকেন সেই বাড়িতেই। তার দিন কাটে গাছের সঙ্গে, রঙের সঙ্গে, আর কিছুটা নিঃশব্দ অপেক্ষার সঙ্গে। খালি চেয়ারটা এখনও ঠিক গন্ধরাজ গাছের নিচে, নড়েনি একচুলও। অনেকেই জিজ্ঞেস করে, “এই চেয়ারে কি কেউ বসে?” ঋষভ হেসে বলে, “হ্যাঁ, একদিন বসবে।” কেউ বিশ্বাস করে, কেউ করে না। কিন্তু সে অপেক্ষা থেমে থাকে না। অপেক্ষার তো সময় লাগে না—সে শুধু বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে থাকে, গন্ধের মতো।

সেদিন ছিল চৈত্রের শেষ রবিবার। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে। হালকা হাওয়া বইছে গন্ধরাজের গায়ে, আর রোদ পাতার ছায়া ফেলে রেখেছে উঠোনজুড়ে। ঋষভ বারান্দায় বসে বাঁশের পিঁড়িতে ছবি আঁকছিল, তখনই বাড়ির ফটকে কড়া নাড়ল কারও। সে চমকে ওঠেনি, শুধু একটু বিরতি নিয়ে উঠল। দরজা খুলতেই এক মুহূর্তের নীরবতা—একটা সময় থমকে দাঁড়াল। রাধিকা দাঁড়িয়ে আছে, সাদা কুর্তি, কাঁধে ঝোলা, চোখে সেই চিরচেনা নিঃশব্দতা। সে কিছু বলে না, শুধু একবার চোখে চোখ রাখে। ঋষভ বুঝে যায়—সে ফিরেছে, ঠিক সময়মতো, ঠিক সেইভাবে, যেমন তারা কথা দিয়েছিল। সে একবার গন্ধরাজ গাছটার দিকে তাকায়, তারপর বলল, “চলো, বসো।” রাধিকা এগিয়ে গিয়ে সেই খালি চেয়ারে বসে পড়ে। পাতা নড়ে ওঠে হাওয়ায়, দূরে একটা কোকিল ডাকে, আর ছায়া এসে পড়ে দুজনের পায়ের ওপর। কোনো কথা হয় না। কিছু বলার প্রয়োজনও পড়ে না। দুজনই জানে—যতদিন খালি চেয়ারে কেউ বসে না, ততদিন অপেক্ষা শেষ হয় না। আজ সেই চেয়ার পূর্ণ, সেই গন্ধ ফিরে এসেছে, সেই প্রেম আবার জমেছে ছায়ার নিচে।

বিকেল গড়ায়, রাত নামে ধীরে ধীরে। গন্ধরাজ ফুল ফোটে নিরবে, আর দুই মানুষ বসে থাকে পাশাপাশি—শব্দহীন, অথচ পূর্ণ। এখন আর কিছু বলার নেই, শুধু থাকার আছে। অনেক বছর পরে গন্ধরাজ গাছের ছায়া সত্যিই কোনো প্রেমকে সাক্ষী রাখল—একটা চিরস্থায়ী, শব্দবিহীন পুনর্মিলনের।

1000039584.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *