সন্দীপ সেনগুপ্ত
হুগলির বিস্তীর্ণ গ্রামীণ প্রান্তরে, নদীর ধারে শ্যাওলায় ঢাকা ইটের প্রাচীর আর ধ্বংসস্তূপের মতো দাঁড়িয়ে আছে সেই পুরনো গড়। সময়ের ক্ষয়ে ক্ষয়ে এর অনেকটা ভেঙে পড়েছে, অনেকটা মাটির নিচে চাপা পড়েছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় নিস্তব্ধ প্রকৃতির কোলে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো অদ্ভুত নিদর্শন, অথচ স্থানীয়রা একে ভয়ে এড়িয়ে চলে। দীর্ঘদিন ধরে শোনা যায়, গড়ের ভেতরে রাত নামলে অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়—কখনো তলোয়ারের ঝনঝনানি, কখনো পদশব্দ, আবার কখনো গভীর নিশ্বাসের আওয়াজ। ফলে গ্রামবাসীর চোখে এ জায়গা “অভিশপ্ত” বলেই পরিচিত হয়ে উঠেছে। এই ভয়ের মধ্যেও সরকার ঠিক করে, প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে জায়গাটি খনন করা দরকার। হয়তো গড়ের ভেতর থেকে মিলবে বাংলার ইতিহাসের কোনো বিস্মৃত অধ্যায়, কোনো রাজবংশের হারানো দলিল, কিংবা প্রাচীন শিল্পকর্ম। আর সেই কাজের দায়িত্ব এসে পড়ে বিশিষ্ট প্রত্নতত্ত্ববিদ ডঃ অরিত্র মুখার্জীর ওপর। অরিত্র পেশায় একজন গম্ভীর মানুষ, বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, তবে চোখেমুখে অদম্য কৌতূহল ও তীব্র সাহসের ছাপ। তিনি জানেন, ইতিহাসের মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকা প্রতিটি ইট, প্রতিটি মুদ্রা, প্রতিটি ভাঙা প্রতিমা—নিজস্ব গল্প বলে। তাই গ্রামের কুসংস্কার বা ভয় তাঁকে বিচলিত করতে পারে না।
অরিত্রর সঙ্গে আসে একদল স্থানীয় শ্রমিক। গোপাল মণ্ডল তাদের নেতা—পঞ্চাশোর্ধ্ব এক চওড়া কাঁধের মানুষ, যিনি গায়ের জোরে যেমন খাটতে পারেন, তেমনি গ্রামবাসীর কুসংস্কারও নিজের ভেতরে বয়ে বেড়ান। তিনি প্রথমে কাজ নিতে রাজি হলেও, গড়ের ভেতরে ঢোকার সময় বারবার মন্ত্র জপতে থাকেন, আর শ্রমিকদের সাবধান করে দেন, “রাতে এখানে কেউ থাকবি না। যেটুকু কাজ দিবালোকে করা যায়, তাই করবি।” অন্য শ্রমিকেরা হাসাহাসি করলেও, তাদের চোখে ভয়ের ছায়া স্পষ্ট। কারণ ছোটবেলা থেকেই তারা শুনে এসেছে, গড়ে এক যোদ্ধার আত্মা এখনো পাহারা দেয়। প্রথম দিন সকালেই অরিত্র পুরো জায়গাটি ঘুরে দেখেন। শ্যাওলা ধরা প্রাচীরগুলোতে হাত রেখে তিনি অনুভব করতে থাকেন ইতিহাসের চাপা স্রোত। তাঁর কানে যেন ভেসে আসে যুদ্ধের আওয়াজ, পতাকার শব্দ, কিংবা সেনাদের হুংকার। মনে হয় যেন গড়ের প্রতিটি ইট অতীতের গল্প বলতে চাইছে। শ্রমিকেরা খননের কাজ শুরু করে—কেউ কোদাল চালায়, কেউ ঝুড়ি ভর্তি করে মাটি বাইরে নিয়ে যায়। আর গ্রামবাসীর অনেকে দূরে দাঁড়িয়ে তা দেখতে থাকে, তাদের চোখে ভয় ও কৌতূহলের মিশ্র ঝলক। তারা মনে মনে ভাবে, সত্যিই যদি অভিশপ্ত কিছু বেরিয়ে আসে, তবে তার দায় কার ওপর পড়বে?
দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজের চাপও বাড়তে থাকে। গরমে ঘাম ঝরতে থাকে শ্রমিকদের শরীর থেকে, মাটির ধুলোয় ধূসর হয়ে যায় তাদের মুখমণ্ডল। কিন্তু অরিত্রর চোখে মুখে ক্লান্তি নেই; বরং আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তাঁর কৌতূহল। তিনি মাঝে মাঝে থেমে নোটবইয়ে কিছু আঁকিবুঁকি করে রাখেন—কোনো ভাঙা অলঙ্কারের খোঁজ পেলেই টুকে রাখেন, আবার দেয়ালের গায়ে পাওয়া অদ্ভুত খোদাই মনোযোগ দিয়ে কপি করেন। তবু গড়ের ভিতর যেন এক অদ্ভুত ভারী আবহাওয়া তৈরি হতে থাকে। শ্রমিকরা মাঝেমধ্যে বলে ওঠে, “সাহেব, একটু হাওয়া বয়ে গেল মনে হচ্ছে। এরকম ঠান্ডা তো এই গরমে হয় না।” অরিত্র মুচকি হেসে বলেন, “এটা তোমাদের কুসংস্কারের খেলা। কাজ চালিয়ে যাও।” কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনিও অনুভব করেন—এই গড়ের চারপাশে যেন সত্যিই কিছু একটার ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাজের ফাঁকে তিনি তাকান দূরে দাঁড়ানো গ্রামবাসীদের দিকে। তাদের ভয়ের চোখ, কানে ভেসে আসা ফিসফিসানি—“অভিশপ্ত গড়”, “পাহারাদার আত্মা”—এসব কথা তাঁকে অস্বস্তি দেয় না, বরং আরও দৃঢ় করে। ইতিহাসের আসল সত্য যদি লুকিয়েই থাকে, তবে সেই সত্য বের করে আনার দায়িত্ব তাঁরই। তাই প্রথম দিনের খনন শেষে যখন সূর্য ডুবে গিয়েছে, আর শ্রমিকরা ভয়ে ভয়ে দ্রুত ঘরে ফিরে যেতে চাইছে, অরিত্র দাঁড়িয়ে থাকেন গড়ের ধ্বংসাবশেষের সামনে। নরম আলোয় ভেসে যাওয়া শ্যাওলাধরা ইটগুলোর দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হয়—আজ যে অভিযাত্রা শুরু হলো, তা হয়তো গ্রামবাসীর ভয় মিথ্যে প্রমাণ করবে, আবার হয়তো উন্মোচন করবে এমন এক রহস্য, যা কেবল ইতিহাস নয়, অরিত্রর জীবনকেও নতুন বাঁক এনে দেবে।
–
সূর্যের আলো তখন সবে মাথার ওপরে উঠেছে। গড়ের ভাঙা প্রাচীর ঘিরে শ্রমিকদের কাজ শুরু হয়েছে সকাল থেকেই। ধুলো-মাটি, ঘাম আর গরমে তাদের শরীর জ্বলছে, অথচ কারও মুখে আলস্য নেই। গোপাল মণ্ডল, দলনেতা, এক হাতে কোদাল চালাচ্ছেন, অন্য হাতে ঘাম মুছছেন। ডঃ অরিত্র মুখার্জী একটু দূরে দাঁড়িয়ে নোটবইয়ে কিছু লিখছেন। গতদিনের কাজ শেষে তিনি একটি বিশেষ জায়গায় দাগ কেটেছিলেন—এক কোণার মাটির স্তর অস্বাভাবিকভাবে উঁচু হয়ে আছে। তাঁর অভিজ্ঞ চোখ বলেছিল, এর নিচে কিছু লুকিয়ে থাকতে পারে। আজ শ্রমিকদের সে জায়গাতেই কাজ শুরু করতে বললেন। কোদালের ঘায়ে ঘায়ে মাটি আলগা হয়ে উঠতে লাগল, ঝুড়িতে বোঝাই হয়ে বাইরে যেতে লাগল। হঠাৎই এক শ্রমিকের কোদাল শক্ত কিছুতে ঠেকে গেল। প্রথমে সবাই ভাবল, হয়তো কোনো বড়ো ইট বা পাথর। কিন্তু কয়েকটা ঘা মারতেই মাটি ভেঙে ভেতর থেকে বেরিয়ে এল ফ্যাকাসে হাড়ের মতো কিছু। শ্রমিক থমকে গেল, আর মুহূর্তে চারপাশে হইচই পড়ে গেল। কেউ বলল, “হাড় পেয়েছি!” আবার কেউ ভয়ে পিছিয়ে গেল। অরিত্র ছুটে এসে কাজ থামালেন। ধীরে ধীরে মাটি সরিয়ে দেখা গেল—একটি মানবকঙ্কালের ওপরিভাগ ফুটে উঠেছে। শ্রমিকদের কণ্ঠে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল, চোখেমুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠল। গ্রামের মানুষ, যারা দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল, তারাও হৈচৈ করতে করতে কাছে এগিয়ে এল।
অরিত্র তখন শান্তভাবে পরিস্থিতি সামলাতে চেষ্টা করলেন। তাঁর প্রশিক্ষিত চোখ বলছিল, এটি বহু শতাব্দী পুরনো কঙ্কাল। তবে বিস্ময় এখানেই শেষ নয়। শ্রমিকরা যখন আরও মাটি সরাল, তখন কঙ্কালের বুকের কাছে একটি ধারালো তলোয়ার দেখা গেল। তলোয়ারটির ফলার বেশিরভাগই মরচে ধরা, কিন্তু তার গঠন থেকে বোঝা যাচ্ছিল এটি যুদ্ধের জন্য তৈরি—ভারী, লম্বা এবং মারাত্মক। ঠিক তার পাশেই দেখা গেল এক অদ্ভুত উজ্জ্বল রঙের রত্ন। প্রথমে শ্রমিকরা ভেবেছিল কাচের টুকরো, কিন্তু আলো পড়তেই স্পষ্ট হলো—এটি নীলকান্তমণি। নীলাভ ঝলক এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ছিল, যেন শতাব্দী ধরে মাটির নিচে চাপা থেকেও তার দীপ্তি একটুও হারায়নি। এই দৃশ্য দেখে শ্রমিকরা চমকে উঠল, কারও কারও শরীর শিউরে উঠল। তারা ফিসফিস করে বলতে লাগল, “এটা যে কোনো সাধারণ হাড় নয়। অভিশপ্ত গড়ের প্রহরীরই দেহ এটা।” গোপাল মণ্ডল এক ধাপ পিছিয়ে এসে কোদাল মাটিতে ফেলে দিলেন। তাঁর গলা কাঁপছিল, “সাহেব, আমি আগেই বলেছিলাম, এখানে অশুভ কিছু আছে। এখন আর খনন করা উচিত নয়।” গ্রামবাসীরা চিৎকার করে উঠল, কারও মুখে শোনা গেল মন্ত্রপাঠ, কারও মুখে ভয়ের গল্প।
এই সময়েই গড়ের চারপাশে হঠাৎ যেন আবহাওয়ার বদল হলো। দুপুরের রোদ্দুর মাথার ওপরে ঝলমল করলেও খননের জায়গাটিতে হাওয়া থমকে গেল, বাতাস ভারী হয়ে উঠল। শ্রমিকরা শীতল শিহরণ অনুভব করল—মনে হলো যেন শরীরের ভেতর দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে। কেউ ঘামে ভিজে গিয়েও কাঁপতে লাগল, কারও শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। সেই ঠান্ডা অনুভূতি যেন কঙ্কাল থেকে ছড়িয়ে আসছিল। অরিত্র নিজেও ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি টের পাচ্ছিলেন, কিন্তু তাঁর বিজ্ঞানমনস্কতা তাঁকে সামলে রাখল। তিনি শ্রমিকদের শান্ত করতে বললেন, “ভয়ের কিছু নেই। এটা ইতিহাসের এক অমূল্য প্রমাণ। তোমরা ভয় না পেয়ে কাজ চালিয়ে যাও।” কিন্তু শ্রমিকরা আর রাজি হলো না। কেউ কেউ সোজা কোদাল রেখে বাড়ির পথে ছুটল, কেউ দূরে দাঁড়িয়ে গা ঘেঁষে ফিসফিস করতে লাগল। গ্রামবাসীরা আরও ভয় পেয়ে বলতে লাগল, “দেখেছ? শীতল হাওয়া বইছে। আত্মা রাগ করেছে।” পরেশ ঘোষ, গ্রামের প্রভাবশালী জমিদারবাড়ির উত্তরসূরি, সেই সময় ঘটনাস্থলে এসে দাঁড়ালেন। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, “আমি আগেই বলেছিলাম, এই গড় খোঁড়াখুঁড়ি করো না। মাটির নিচে যা ছিল, তাকে শান্তিতেই থাকতে দাও।” তাঁর কণ্ঠে রাগ আর হুঁশিয়ারির মিশ্র সুরে গ্রামের মানুষের ভয় আরও বেড়ে গেল। অরিত্র নীরবে দাঁড়িয়ে কঙ্কাল, তলোয়ার ও নীলকান্তমণির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর মনে হলো, এই আবিষ্কার শুধু প্রত্নতত্ত্বের নয়—এটি এক ভয়ঙ্কর রহস্যের দ্বারপ্রান্ত। মাটির নিচ থেকে উঠে আসা কঙ্কাল যেন তাঁকে চোখ রাঙিয়ে জানিয়ে দিল, এই পথে হেঁটে গেলে শান্তি আর স্বাভাবিক জীবন আর থাকবে না। ইতিহাসের সঙ্গে মিশে থাকা কোনো অভিশাপ হয়তো আজ জেগে উঠল।
–
গড়ের ভেতর থেকে কঙ্কাল, তলোয়ার আর নীলকান্তমণি বেরোনোর পর থেকেই শ্রমিকদের মনে ভয়ের ছায়া আরও ঘন হয়ে উঠল। পরদিন সকালবেলা খননের কাজ শুরু হতেই গোপাল মণ্ডল শ্রমিকদের এক কোণে জড়ো করে দাঁড়ালেন। তাঁর কণ্ঠ গম্ভীর, চোখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। তিনি বললেন, “শোনো সবাই, আমি তোমাদের সবার বড়ো। জীবনে অনেক জায়গায় খেটেছি, অনেক ভাঙা কেল্লা দেখেছি। কিন্তু এমন অদ্ভুত ঠান্ডা হাওয়া আর ভয়ঙ্কর আবহাওয়া আমি কোথাও পাইনি। এটা নিছক কঙ্কাল নয়—এ এক অশুভ সংকেত। গড়ের ভেতরে যে সব বছর ধরে অভিশাপ ঘুমোচ্ছে, সেটা আমাদের হাতেই জেগে উঠেছে। এখন যদি বেশি খনন করি, তবে সর্বনাশ হবেই।” তাঁর এই কথায় শ্রমিকদের গুঞ্জন আরও জোরালো হয়ে উঠল। কেউ বলল, “আমার শরীর এখনও ঠান্ডা কাঁপুনি দিচ্ছে।” আরেকজন বলল, “গতরাতে স্বপ্নে দেখেছি, এক লোক তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে আমাকে ডেকেছে।” এইসব গল্পে ভয়ের পরিবেশ তীব্র হয়ে উঠল। ডঃ অরিত্র মুখার্জী শ্রমিকদের বোঝাতে চেষ্টা করলেন, “এসবই তোমাদের কল্পনা। কঙ্কাল আর তলোয়ার আমাদের ইতিহাসের সম্পদ, এগুলো থেকে আমরা জানতে পারব বাংলার অতীত।” কিন্তু তাঁর কথায় শ্রমিকদের আস্থা ফিরল না। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে সংকেত করল—মনে হলো যেন কাজ চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আর নেই।
ঠিক তখনই সামনে এসে দাঁড়ালেন গ্রামের প্রবীণ মানুষ কমলেশ দত্ত, যাকে সবাই ‘কমলেশদা’ নামে ডাকে। তাঁর বয়স পঁয়ষট্টি, চেহারা শুকনো, মুখে সাদা দাড়ি, চোখে গভীর রহস্যময়তা। তিনি ধীরে ধীরে বললেন, “গোপাল মিথ্যে কিছু বলছে না। আমি ছোটবেলায় দাদুর মুখে শুনেছি, এই গড় এক যোদ্ধার কবর। বহু বছর আগে প্রতাপাদিত্যের আমলে এক বিশ্বস্ত সেনাপতি রাজকোষ পাহারা দিত। শত্রুরা আক্রমণ করলে সে শেষ পর্যন্ত লড়েছিল। কিন্তু মৃত্যুর পরও সে কসম খেয়েছিল, যতদিন না তার আত্মা শান্তি পাচ্ছে, ততদিন সে গড়ের সম্পদ পাহারা দেবে। তাই আজও সে আত্মা এ গড় ছেড়ে যায়নি। রাতে তার পদশব্দ শোনা যায়, তলোয়ারের ঝনঝনানি ভেসে আসে।” শ্রমিকরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে গল্প শুনছিল। কেউ ফিসফিস করে বলল, “তাহলে কঙ্কালটা সেই সেনাপতির?” কমলেশদা হালকা হাসলেন, “হ্যাঁ, হয়তো তাই। তলোয়ার আর নীলকান্তমণি তো তারই নিদর্শন।” এই গল্প শুনে শ্রমিকদের চোখে আতঙ্ক দ্বিগুণ হয়ে উঠল। গোপাল মণ্ডল উচ্চকণ্ঠে বলল, “দেখলে তো? আমি যেটা বলছিলাম, কমলেশদাও একই কথা বলছে। এখন আর কাজ করার দরকার নেই। আমাদের প্রাণ বাঁচাই আগে।”
অরিত্র প্রথমে গল্প শুনে হেসে উড়িয়ে দিতে চাইছিলেন, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাঁর মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করল। প্রত্নতত্ত্ববিদ হিসেবে তিনি জানেন, লোককাহিনি অনেক সময় অতীতের সত্যকে আংশিক আকারে বহন করে নিয়ে আসে। তলোয়ার, কঙ্কাল, নীলকান্তমণি—এসব নিছক কাকতাল নয়, এর পেছনে কোনো ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা আছেই। তিনি ভাবলেন, “যদি কমলেশদার গল্প সত্যি হয়, তবে সেই সেনাপতির মৃত্যু ও রাজকোষ রক্ষার ইতিহাস হয়তো এই গড়েই চাপা আছে। এই কঙ্কাল সেই রহস্যেরই প্রমাণ।” অরিত্র কৌতূহল ও দায়িত্ববোধে দৃঢ় হয়ে উঠলেন। তিনি শ্রমিকদের শান্ত করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাদের মুখে আর আস্থা নেই। গোপাল মণ্ডল সোজাসুজি ঘোষণা করল, “আমি আজ আর কাজ করব না। যার সাহস আছে, সে থাকুক।” এই অবস্থায় গ্রামবাসীর মধ্যে কুসংস্কারের ছায়া এতটাই ছড়িয়ে পড়ল যে, কেউই খননের জায়গার কাছে যেতে চাইলো না। কেবল অরিত্র দাঁড়িয়ে রইলেন গড়ের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে, তাঁর চোখ গভীর হয়ে উঠল। তিনি ভাবলেন, “যদি সত্যিই অতীতের সঙ্গে এই আবিষ্কারের যোগ থাকে, তবে আমাকে যেকোনো মূল্যে তা খুঁজে বের করতেই হবে। ভয় বা কুসংস্কার দিয়ে ইতিহাসকে ঢেকে রাখা যায় না।” তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল সেনাপতির এক যোদ্ধামূর্তি—তলোয়ার হাতে, বুকের কাছে ঝলমলে নীলকান্তমণি, আর চোখে অদম্য প্রতিজ্ঞা। এই দৃশ্য যেন তাঁর কল্পনায় প্রাণ পেল, আর সেই মুহূর্তেই অরিত্র বুঝলেন, তিনি এক অচেনা অথচ ভয়ঙ্কর যাত্রার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন।
–
স্থানীয় পত্রিকার তরুণ সাংবাদিক কনিকা বসু সেই সকালে ঘটনাস্থলে পৌঁছলেন যখন গ্রামের মানুষজন কৌতূহলী ভিড় করে কঙ্কাল এবং তার পাশে ঝলমল করা নীলকান্তমণির দিকে তাকিয়ে আছে। মাথায় হালকা সাদা স্কার্ফ, হাতে ছোট্ট একটি নোটবুক আর ঝোলানো ক্যামেরা—এই সাজসজ্জাতেই যেন বোঝা যাচ্ছিল তিনি নিত্য নতুন খবরে ছুটে বেড়ানো মানুষ। গ্রামের লোকেরা ইতিমধ্যেই ভয়ে ও বিস্ময়ে অস্থির, কেউ কেউ মন্ত্র জপ করছে, আবার কেউ দূর থেকে শুধু তাকিয়ে আছে। কনিকা তাদের মধ্যে প্রবেশ করতেই অনেকের চোখে প্রশ্ন জ্বলজ্বল করতে শুরু করল, সাংবাদিক এসেছে মানেই হয়তো সবকিছু এখন বাইরের জগতে ছড়িয়ে পড়বে। কনিকা ঠাণ্ডা গলায় কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করলেন, কে প্রথম এই কঙ্কাল আর রত্নটি দেখতে পেয়েছিল, কিন্তু গ্রামবাসীর উত্তর এল কেবল মাথা নেড়ে, ফিসফিস করে বা ভয়ে চাপা স্বরে। তিনি বুঝলেন, ভয় এই গ্রামে গভীরভাবে ঢুকে পড়েছে। ক্যামেরা হাতে তুলে নিলেন, সূক্ষ্মভাবে কঙ্কালটির ছবিগুলো তুললেন—হাড়গুলো যে ভাবে শুয়ে আছে, তার পাশেই অদ্ভুত ঝলকানি ছড়াচ্ছে নীলকান্তমণি, তার সবকিছু তিনি যত্ন নিয়ে ধারণ করলেন। কিন্তু ক্যামেরার লেন্সের ভেতর দিয়ে তাকাতে তাকাতে তাঁর মনে হলো, এখানে কেবল ইতিহাস নয়, লুকিয়ে আছে আরও কোনো দুঃসহ অঘটনের ছাপ, এমন কিছু যা হয়তো বহুদিন আগে ঘটেছিল, কিন্তু তার শিকড় এখনও মাটির গভীরে জীবন্ত রয়ে গেছে।
এমন সময়েই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হলো অরিত্রর। অরিত্র সেই ভিড়ের ভেতরে কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, একদিকে গ্রামবাসীর আতঙ্ক অনুভব করছে, অন্যদিকে কৌতূহলও বোধ করছে। কনিকা যখন তাঁর ক্যামেরা গুছিয়ে নিলেন, তখন অরিত্র তাঁর দিকে এগিয়ে এসে বলল, “আপনি কি শহর থেকে এসেছেন? আপনিও কি মনে করেন, এই কঙ্কাল আর রত্নটা কোনো পুরোনো ঘটনার ইঙ্গিত?” কনিকাও বিস্মিত হলেন, কারণ এত ভিড়ের মধ্যে অরিত্রর প্রশ্নই তাঁর মনে জমে থাকা চিন্তার প্রতিধ্বনি করে উঠেছিল। দু’জনের চোখে কৌতূহলের দীপ্তি এক মুহূর্তের জন্য জ্বলে উঠল। কনিকা হালকা হেসে বললেন, “হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হচ্ছে। এ কেবল কঙ্কাল আর রত্ন নয়, এর ভেতরে হয়তো লুকিয়ে আছে কোনো না বলা কাহিনি। সাংবাদিক হিসেবে আমি সত্যি জানতে চাই, আর আপনিও যদি আগ্রহী হন, তবে আমরা একসাথে কিছু খোঁজখবর করতে পারি।” অরিত্র মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। তাঁদের কথোপকথন গ্রামের ভিড়ের কানে পৌঁছালো না, কারণ সবাই তখনও নিজেদের ভয়ে এবং গুজবে ডুবে আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে দু’জন অপরিচিত মানুষের মধ্যে কৌতূহলের সেতুবন্ধন তৈরি হলো, যা হয়তো ভবিষ্যতে আরও অনেক রহস্য উন্মোচনের পথ খুলে দেবে।
তারপর কনিকা চারপাশে একটু হাঁটাহাঁটি করলেন, মাটির গন্ধ, পুরনো আমগাছের নিচে ছায়ায় পড়া আলো, আর গ্রামের নিস্তব্ধতা যেন তাঁকে আরও গভীর এক অচেনা কাহিনির দিকে ঠেলে দিল। তিনি লক্ষ্য করলেন, গ্রামবাসী শুধু ভয়ে কুঁকড়ে নেই, বরং তাদের চোখে লুকিয়ে আছে অনেক না-বলা কথা। কেউ একজন তাঁকে ফিসফিস করে জানাল, “এ গাছটার নিচে আগেও অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল, অনেকেই রাতের বেলা কান্নার শব্দ শুনেছে।” কনিকা সেটা সঙ্গে সঙ্গে নোট করে রাখলেন। অরিত্র কাছে এসে বলল, “আমার ঠাকুরদা একসময় এই গ্রামে থাকতেন, ছোটবেলায় অনেক গল্প শুনেছি এই আমগাছ নিয়ে।” দু’জনের মধ্যে আলাপ জমতে শুরু করল, যেন তারা হঠাৎ করেই বুঝে গেল, একে অপরকে ছাড়া হয়তো এই রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব নয়। কনিকাও মনের ভেতর এক অদ্ভুত দৃঢ়তা অনুভব করলেন—এই ঘটনাটি তিনি শুধু রিপোর্ট করবেন না, তিনি সত্যিটা বের করে আনবেন, যত গভীরেই তা লুকিয়ে থাকুক না কেন। ক্যামেরার ফ্ল্যাশের আলোতে হাড় আর নীলকান্তমণি একসঙ্গে ঝলসে উঠল, আর কনিকাদের চোখে প্রতিফলিত হলো এক নতুন যাত্রার সূচনা, যেখানে সাংবাদিকতার কৌতূহল আর অরিত্রর ব্যক্তিগত টানাপোড়েন মিলেমিশে তৈরি করবে এক অনিবার্য অনুসন্ধানের গল্প।
–
রাতটা ছিল অদ্ভুত নিস্তব্ধ। মন্দির পুনর্নির্মাণের কাজ সেদিন সন্ধ্যার পরেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, কারণ শ্রমিকরা কঙ্কাল আবিষ্কারের পর থেকে এক অস্বস্তির আবহে দিন কাটাচ্ছিল। গোপাল মণ্ডল, যিনি দিনশেষে সব তালা-চাবির দায়িত্ব নেন, সেই রাতে একা ছিলেন পুরোনো গড়ের আঙিনায়। চারপাশে শুধু জোনাকির আলো আর শুকনো পাতার শব্দ। হঠাৎই তাঁর চোখে পড়ে, খোলা জায়গার ঠিক মাঝখানে সেই কঙ্কালটার পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারের মধ্যেও দেখা যাচ্ছিল, হাতে একখানা ঝকঝকে তলোয়ার, যার ফলা চাঁদের আলোয় অদ্ভুত রকমের রূপালি ঝিলিক ছড়াচ্ছে। অচেনা লোকটির চেহারা অস্পষ্ট হলেও ভঙ্গি ছিল ভয়ঙ্কর, যেন পাহারা দিচ্ছে মৃতদেহটাকে। গোপাল প্রথমে ভাবলেন হয়তো কোনো চোর বা উচ্ছৃঙ্খল যুবক, কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁর বুক কেঁপে উঠল—কারণ লোকটির চোখ জ্বলজ্বল করছিল, যেন আগুনের শিখার মতো। সাহস করে এক পা এগোতে গিয়েও তিনি স্থবির হয়ে গেলেন, শুধু ফিসফিস করে বললেন, “কে রে?” কোনো উত্তর মেলেনি, শুধু হালকা বাতাস বইতে শুরু করল আর কঙ্কালের হাড়গুলো যেন ঠকঠক করে বাজতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যে ভয়ে গোপাল পেছন ফিরে দৌড়ে পালালেন, আর পুরো রাত নিদ্রাহীন অবস্থায় কাটালেন।
পরের সকালে গড়ের ভেতরে গিয়ে শ্রমিকরা হইচই শুরু করল। গোপাল কাঁপা কাঁপা গলায় আগের রাতের কথা বলতেই সবাই কাজে হাত দিতে অস্বীকার করে বসলো। কারো মতে, এ নিশ্চয়ই কোনো ‘রাতের প্রহরী’—প্রাচীনকালে গড়ের গুপ্তধন পাহারা দেওয়ার জন্য নাকি এমন আত্মা নিযুক্ত হতো। আবার কেউ কেউ বলল, হয়তো কোনো স্থানীয় দুষ্কৃতী ভয় দেখিয়ে কাজ বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। গড়ের পরিবেশ ধীরে ধীরে ভয়ের ছায়ায় ঢেকে গেল। শ্রমিকরা বসে বসে বিড়ি টানছিল, কেউ কেউ বলছিল—“এখন থেকে কাজ করা মানে মরার দাওয়াত।” খোদাই করা প্রাচীরের কাজ অসম্পূর্ণ রেখে সবাই দূরে দাঁড়িয়ে পড়ল। খবর পৌঁছে গেল অরিত্র ও কনিকারের কাছে। দু’জনই ঘটনাটা শোনার পর গড়ের ভেতরে ঢুকলেন, আর শুরু করলেন খুঁটিনাটি খোঁজ। অরিত্র লক্ষ্য করলেন—কঙ্কালের পাশে আসলে একটা পুরোনো দাগ আছে, যেন কেউ মাটিতে ভারী অস্ত্র টেনে নিয়ে গেছে। আশেপাশে কিছু পদচিহ্নও মিলল, যা দেখলে বোঝা যায় না যে এগুলো সাধারণ মানুষের পায়ের ছাপ, কারণ গভীরতা অস্বাভাবিকভাবে বেশি। কনিকা বলল, “এটা কেউ ইচ্ছে করে তৈরি করেছে, হয়তো ভয় দেখানোর জন্য। কিন্তু রাতের অন্ধকারে আলো-ছায়ার খেলা অনেককিছুকে ভৌতিক করে তুলতে পারে।” তবুও দু’জনের মনে একটা সংশয় রয়ে গেল—শ্রমিকদের আতঙ্ক কি শুধু গুজব, নাকি এর পিছনে সত্যিই কোনো অজানা শক্তির উপস্থিতি আছে?
দিন গড়াতেই গড়ের চারপাশে লোকজন ভিড় করতে শুরু করল। ভয়ে কাজ বন্ধ থাকায় গড়ের পুনর্নির্মাণও থমকে গেল। সন্ধের পর আবার গোপালকে পাহারায় থাকতে হলো, তবে এবার অরিত্র ও কনিকা গোপনে নজর রাখলেন। অরিত্র একটা পুরোনো লণ্ঠন হাতে নিয়ে দূরে বসেছিলেন, আর কনিকা নজর রাখছিলেন কঙ্কালের দিকটায়। রাত বাড়তেই দেখা গেল, সত্যিই যেন ছায়ার মতো একটি অবয়ব কঙ্কালের পাশে ঘোরাঘুরি করছে। তলোয়ারের ঝিলিক এবারও দেখা গেল, তবে কাছে যেতেই অবয়বটি মিলিয়ে গেল অদ্ভুতভাবে। মাটিতে পড়ে রইল কেবল একটা মরচেধরা ধাতব তলোয়ার, যেটা বহু পুরোনো হলেও এখনো ধারালো। কনিকা বিস্মিত হয়ে বলল, “এটা তাহলে কার?” অরিত্র ভাবনায় পড়ে গেলেন—এ কি তবে প্রাচীন কোনো গোপন সংঘের অস্ত্র, নাকি কারও সাজানো খেলা? শ্রমিকরা ভয়ে কেঁপে উঠল, কেউ বলল—“প্রহরী আবার বেরিয়েছে, সাবধান!” কিন্তু অরিত্র শান্ত গলায় জানালেন—“ভয় নেই, এর মধ্যে একটা রহস্য আছে, যেটা আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে।” সেই মুহূর্তে তাঁরা দু’জন বুঝলেন—এই গড়ের কঙ্কাল আর তলোয়ার কেবল ইতিহাস নয়, বরং এক জটিল ষড়যন্ত্রের চাবিকাঠি, যার আসল সত্য রাতের অন্ধকারে ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে।
–
পরেশ ঘোষের সেই দিনের উপস্থিতি ছিল ঝড়ের মতো। মন্দিরসংলগ্ন উঠোনে গ্রামের মানুষ জড়ো হয়েছিল, খননকার্য নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র। খননকারী শ্রমিকরা যখন মাটির স্তর কাটছিল, তখন পরেশ ঘোষ হঠাৎ সশব্দে এসে দাঁড়ালেন, তাঁর পরনে ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি, হাতে রূপার মাথাওয়ালা ছড়ি। চোখেমুখে রক্তিম ক্ষোভ, গলায় বজ্রস্বর—“খননকার্য বন্ধ করো! এখনই বন্ধ করো।” এক নিমিষে স্তব্ধ হয়ে গেল চারপাশ। শ্রমিকরা কুঠার হাতে মাঝপথে থেমে গেল, কনিকা ও গবেষক দলের সদস্যরা একে অপরের দিকে তাকাল, যেন হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে বজ্রপাত নেমে এসেছে। পরেশ ঘোষের অবস্থান গ্রামের জমিদার পরিবার হিসেবে যথেষ্ট প্রভাবশালী। বয়স ষাটের কাছাকাছি হলেও তাঁর কণ্ঠের দৃঢ়তা এখনও গ্রামময় ভয় ছড়ানোর মতো প্রবল। তিনি গর্জন করে বললেন, “তোমরা জানো না, এই খনন একদিন আমাদের গ্রামের সর্বনাশ ডেকে আনবে। অকারণ মাটি খুঁড়ো না। ওখানে যা চাপা আছে, তা চিরকাল চাপা থাকলেই ভালো।” তাঁর চোখে তখন যেন এক অদ্ভুত আতঙ্ক, কিন্তু সেই আতঙ্ককে ঢেকে দিচ্ছিল রাগের আবরণ। গ্রামের সাধারণ মানুষদের কানে এ কথা যেন অগ্নিশিখার মতো দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। কেউ কেউ ফিসফিস করে বলতে লাগল—“জমিদারবাবুর কথা মানা উচিত, নইলে সত্যিই বিপদ ডেকে আনব।”
কনিকা তবে এত সহজে ভীত হওয়ার মানুষ নয়। সে শান্ত গলায় পরেশ ঘোষকে বলল, “আপনার ভয় আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা কখনো সর্বনাশ আনে না। আমরা ইতিহাস খুঁজি, অভিশাপ নয়।” কিন্তু পরেশ ঘোষ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঠান্ডা স্বরে বললেন, “তুমি হয়তো শহুরে মেয়ে, বই পড়ে ইতিহাস জানো। কিন্তু এই মাটির ইতিহাস রক্তে লেখা। তুমি জানো না আমাদের জমিদার বাড়ির গোপন কাহিনি। জানো না, কী ভয়ংকর শক্তি এই মাটির নিচে শুয়ে আছে। যখন আমার ঠাকুরদা জমিদার ছিলেন, তখনই এই স্থানে খনন করার চেষ্টা হয়েছিল। কয়েকজন শ্রমিক মারা গিয়েছিল, গ্রামের মানুষ অজানা রোগে ভুগেছিল। সেই অভিশাপ থামাতে বাধ্য হয়ে মাটি আবার ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। তারপর থেকে এই স্থান নিষিদ্ধ।” তাঁর কথা শুনে জনতার ভেতরে গুঞ্জন আরও বেড়ে উঠল। অনেকেই ভয়ে কাঁপতে শুরু করল, কেউ কেউ মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, আমাদের ঠাকুরমা সেই কাহিনি শুনিয়েছে।” কিন্তু কনিকার ভেতরে তখন প্রশ্নের ঝড়। সে লক্ষ্য করল, পরেশ ঘোষের কথায় যতটা না কুসংস্কারের রঙ, তার চেয়ে বেশি গোপন কিছু লুকোনোর ইঙ্গিত। তাঁর চাহনি এড়িয়ে গেলে মনে হচ্ছিল, যেন তিনি চাইছেন না সত্য প্রকাশ পাক। কনিকার সন্দেহ দৃঢ় হল—এই বিরোধিতার আড়ালে নিশ্চয়ই জমিদার পরিবারের এক গোপন ইতিহাস রয়েছে।
পরেশ ঘোষ তখন শ্রমিকদের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “যদি আজই কাজ বন্ধ না করো, তবে আমি আইন আনব। জমিদার পরিবারের অনুমতি ছাড়া এই মাটিতে খনন করার অধিকার তোমাদের নেই।” তাঁর কণ্ঠে ছিল ভয় দেখানোর মতো দৃঢ়তা। গবেষক দলের সদস্যদের চোখেমুখে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ল। কয়েকজন মনে মনে ভাবল—এমন বিরোধিতা চলতে থাকলে প্রকল্প থেমে যেতে পারে। কিন্তু কনিকা দৃঢ় সংকল্পে দাঁড়িয়ে রইল। সে জানে, ইতিহাস খুঁজতে গেলে প্রতিরোধ আসবেই। গ্রামের মানুষের ভয়, জমিদারের হুঁশিয়ারি—সবই হয়তো এক জালের অংশ, যার ভেতরে লুকিয়ে আছে রহস্য। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, যত বাধাই আসুক, খনন সে থামাবে না। বরং পরেশ ঘোষের অতীত, জমিদার পরিবারের অজানা অধ্যায়, আর সেই গোপন ইতিহাস খুঁজে বের করবে। তখনো ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন বৃদ্ধ ফিসফিস করে বলছিলেন, “পরেশবাবুর বিরোধিতা অকারণ নয়। জমিদারদের পুরনো গুপ্তভাণ্ডারের কাহিনি আমরা শুনেছি। হয়তো সেখানে এমন কিছু চাপা আছে, যা প্রকাশ পেলে গ্রামের ক্ষতি হবে।” কিন্তু কনিকার মনে হল, ক্ষতির ভয় নয়—বরং জমিদার পরিবারের গোপন লজ্জা বা অপরাধই চাপা দেওয়া হয়েছে এই মাটির নিচে। আর সেই সত্য ফাঁস হয়ে গেলে পরেশ ঘোষের মতো মানুষদের আসল মুখোশ খুলে যাবে।
–
রাত তখন নিস্তব্ধ, গড়ের ভগ্নদেয়ালের বাইরে কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর দূরের অরণ্যে হুটহাট বাদুড়ের ডানা ঝাপটানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে। কনিকা ও অরিত্র প্রায় ঘুমিয়ে পড়তে যাচ্ছিল, হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ে। দরজা খুলতেই তারা দেখে, ম্লান লণ্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে আছেন কমলেশদা। তাঁর চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে, যেন বহুদিনের গোপন কথা আজ তিনি আর গোপন রাখতে পারছেন না। ভিতরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে তিনি ফিসফিস করে বললেন, “তোমরা যা খুঁজছো, তার সূত্র আমি অনেক আগেই পেয়েছিলাম। কিন্তু কাউকে বলিনি। আজ মনে হচ্ছে, না বললেই নয়।” কনিকা ও অরিত্র হকচকিয়ে তাকিয়ে রইল। তাদের বুকের ভেতর কৌতূহল ও ভয়ের মিশ্র ঝড় বয়ে যেতে লাগল। কমলেশদা ধীরে ধীরে বসে চুরুট ধরালেন, ধোঁয়ার মেঘে তাঁর মুখ যেন আরও রহস্যময় হয়ে উঠল। তিনি বললেন, “যে কঙ্কালটা গড়ের নিচে তোমরা দেখেছ, সে সাধারণ মানুষ ছিল না। সে ছিল প্রতাপাদিত্যের সেনাপতি—সিংহনাথ রায়। গড়ের ইট-পাথরের সঙ্গে মিশে আছে তারই রক্ত, আর তার বুকের ভেতরে লুকিয়ে আছে বহু পুরনো অভিশাপ।”
কাহিনির গভীরে যেতে যেতে কমলেশদার কণ্ঠস্বর আরও গাঢ় হয়ে উঠল। তিনি বললেন, “সিংহনাথ রায় কেবল প্রতাপাদিত্যের এক বিশ্বস্ত যোদ্ধাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন রাজ্যের রক্ষক। যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর বীরত্ব কিংবদন্তির মতো ছড়িয়ে ছিল। কিন্তু আসল রহস্য লুকিয়ে আছে তাঁর গলায় ঝোলানো নীলকান্তমণিতে। সেই রত্নটা নাকি দেবতাদের আশীর্বাদে পবিত্র, যাকে পেলে অমিত শক্তি পাওয়া যায়। প্রতাপাদিত্যের রাজবংশে বিশ্বাস ছিল—যতদিন সেই নীলকান্তমণি সেনাপতির গলায় থাকবে, ততদিন গড় কোনোদিন পরাজিত হবে না। তাই এক রাতে যখন ষড়যন্ত্রকারীরা গড় দখলের ছক কষছিল, সিংহনাথ নিজের প্রাণ বাজি রেখে সেই রত্ন বাঁচাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর বিশ্বাসঘাতক সঙ্গীরাই তাঁকে বন্দি করে হত্যা করে, আর মৃতদেহ লুকিয়ে দেয় গড়ের গোপন গুহায়। সেই কঙ্কাল, যা তোমরা দেখেছ, সেই সিংহনাথেরই।” কনিকার গা শিউরে উঠল। সে কাঁপা গলায় বলল, “তাহলে… আজও কি সেই নীলকান্তমণি এখানে কোথাও আছে?” কমলেশদা মাথা নেড়ে বললেন, “আছে, তবে ওটা সহজে কারো হাতে আসবে না। সিংহনাথের আত্মা আজও পাহারা দেয়।”
অরিত্র ধীরে ধীরে উঠে জানলার দিকে তাকাল। বাইরে অন্ধকার গড়ের ভেতর থেকে যেন ফিসফিস করে আসছে অদ্ভুত শব্দ। সে হঠাৎ বুঝল, কমলেশদার গল্প কেবল ইতিহাস নয়, এর ভেতরে লুকিয়ে আছে বাস্তব এক শীতল সত্য। কমলেশদা আবারও ধোঁয়ার রিং ছড়িয়ে বললেন, “আমি বহু বছর ধরে গড়ের প্রতিটি কোণ ঘুরেছি, আর আমি জানি কোথায় কোথায় সেই সেনাপতির উপস্থিতি অনুভব করা যায়। তোমরা আজ রাতে ওসব জায়গায় গেলে হয়তো নিজেরাই বুঝতে পারবে—কোনো অদৃশ্য শক্তি এখনো সেই রত্নকে রক্ষা করছে।” কনিকা ও অরিত্র নিঃশব্দে একে অপরের দিকে তাকাল। রহস্য যেন আরও গভীর অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। হয়তো গড় কেবল ভাঙা ইট-পাথরের স্তূপ নয়, তার ভেতরে লুকিয়ে আছে রক্তাক্ত ইতিহাস, অপূর্ণ প্রতিশোধ আর অমর রহস্য। আর তারা দুজন এখন সেই ইতিহাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে—যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ হয়তো তাদের নিয়ে যাবে সিংহনাথের অদৃশ্য ছায়ার সামনে, অথবা সেই নীলকান্তমণির কাছে, যা আজও গড়ের ধ্বংসাবশেষে আলো ছড়াতে অপেক্ষা করছে।
–
অরিত্র এক অদ্ভুত অস্থিরতা নিয়ে রাতভর বসেছিল গড়ের অন্ধকারাচ্ছন্ন কোঠায়। বাতাসে শীতল স্রোত বইছিল, যেন অতীতের কোনো অদৃশ্য হাত তার কানে ফিসফিস করে ইতিহাস শোনাচ্ছে। হাতে সে তুলে নিয়েছিল পুরনো চামড়ার মলাটে বাঁধা দলিল, যেটা পাওয়া গিয়েছিল গড়ের গোপন সিন্দুকে। দলিলের পাতায় সময়ের দাগ—ছিঁড়ে যাওয়া কোণ, কালি মলিন হয়ে যাওয়া অক্ষর, আর হলুদ হয়ে আসা কাগজে পোকায় খাওয়া দাগ। কিন্তু তার ভেতরে লেখা ছিল এক অজানা কাহিনি। অরিত্র যখন শব্দগুলোর ভেতর প্রবেশ করতে শুরু করল, তখনই স্পষ্ট হলো, এই গড় শুধু রাজপ্রাসাদ ছিল না, বরং রাজ্যের সবচেয়ে বড় কোষাগারও এর অন্তরে লুকিয়ে ছিল। দলিলে বলা হয়েছিল, বহিরাগত আক্রমণকারীরা হঠাৎ গড়ের প্রাচীর ভেঙে প্রবেশ করতে চাইলে সেনাপতি দুর্দান্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, শেষ মুহূর্তে সেই সেনাপতি গায়েব হয়ে যান। শত্রুপক্ষ প্রবল প্রতিরোধের মুখে সফল হতে পারেনি, কিন্তু রাজকোষও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রজাদের মধ্যে তখন থেকেই গুজব ছড়িয়ে পড়ে—সেনাপতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, কোষাগার নিয়ে পালিয়েছেন কিংবা হয়তো কোনো অভিশপ্ত দায়িত্বে চিরকাল প্রাসাদের ভেতরে বন্দী হয়ে আছেন। অরিত্র চশমার কাঁচের ভেতর দিয়ে অক্ষরগুলো একে একে পড়ছিল, আর প্রতিটি শব্দ যেন তাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল গড়ের অদৃশ্য ইতিহাসের গভীরে।
কিন্তু বিষয়টা শুধু কিংবদন্তি ছিল না—অরিত্র হঠাৎ লক্ষ্য করল, দলিলের প্রান্তে হাতে আঁকা একটি চিহ্ন রয়েছে, যেটা সে আগে গড়ের দেয়ালে দেখেছিল। একটা ত্রিভুজের মধ্যে সূর্য আর চাঁদের প্রতীক, আর চারপাশে লেখা অদ্ভুত বৃত্তাকার অক্ষর। দলিলে বর্ণনা ছিল, রাজকোষ রক্ষার জন্য সেনাপতি এক গোপন চুক্তি করেছিলেন—”যতদিন এই প্রতীক টিকে থাকবে, ততদিন গড়ের সম্পদ অক্ষত থাকবে, আর পাহারাদারের আত্মা কখনো নিঃশেষ হবে না।” অরিত্রর মনে পড়ল, কয়েকদিন আগে রাতে যখন সে গড়ের দক্ষিণ প্রাচীর ঘুরে দেখছিল, তখন হঠাৎ এক অদ্ভুত শব্দ শুনেছিল, যেন ভারি বর্মের পায়ের শব্দ অন্ধকারে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সেদিন সে ভেবেছিল, হয়তো কল্পনা বা বাতাসের খেলা। কিন্তু আজ দলিলের এই বর্ণনা তার কল্পনার সব পর্দা সরিয়ে দিল। পাহারাদারের আত্মার গল্প কোনো নিছক লোককথা নয়, বরং শতাব্দী প্রাচীন শপথ আর অভিশাপের প্রতিফলন। অরিত্রর মনে হলো, সত্যটা ধরা দিতে শুরু করেছে, তবে এখনো ধাঁধার শেষ খণ্ড বাকি। দলিলের শেষ পাতায় ছিল এক অদ্ভুত বার্তা—“যদি প্রমাণ খুঁজতে চাও, আলো নিভে গেলে উত্তর মেলে।” এই বাক্যটা তাকে দ্বিধায় ফেলল। এটা কি প্রতীকী ইঙ্গিত, নাকি সত্যিই গড়ের অন্ধকারের ভেতরে লুকানো আছে চূড়ান্ত প্রমাণ? সে বুঝল, এখন তাকে দিন নয়, রাতের অন্ধকারে খুঁজতে হবে সেই নিখোঁজ সূত্র।
পরদিন গভীর রাতে, দলিল বুকে চেপে, অরিত্র আবার ফিরে এল গড়ের অন্তঃপুরে। চারদিক তখন নিস্তব্ধ, কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর দূরে শেয়ালের হাহাকার শোনা যাচ্ছিল। সে হাতে রাখা টর্চ হঠাৎ বন্ধ করে দিল, দলিলে লেখা নির্দেশ মনে রেখে। চারপাশ তখন একেবারে অন্ধকার, তবুও তার চোখ ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হলো সেই কালো দেয়ালে। কিছুক্ষণ পর সে খেয়াল করল, দক্ষিণ দিকের পাথরের দেওয়ালে মৃদু আলোর আভা ফুটে উঠছে, যেন চাঁদের আলো নিজে থেকে তার ভেতর থেকে বেরোচ্ছে। কাছে গিয়ে দেখল, একই ত্রিভুজ প্রতীক হালকা জ্যোতিতে জ্বলজ্বল করছে। অরিত্রর বুক ধকধক করতে লাগল—এটা নিছক কল্পনা নয়, এ সত্যিই কোনো অজানা শক্তির উপস্থিতি। হাত দিয়ে যখন প্রতীকটা ছুঁল, তখনই হঠাৎ দেয়ালের ভেতর থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া বেরিয়ে এলো, আর সঙ্গে ভেসে এল ভারি বর্মে মোড়া কারো শ্বাসের শব্দ। অরিত্র কেঁপে উঠল, তবু পিছু হটল না। ঠিক তখনই যেন অন্ধকার থেকে ভেসে উঠল এক ছায়া, চোখে অগ্নিশিখার মতো দীপ্তি, হাতে তলোয়ার, বুকে বর্মে ঝলসে ওঠা সেই একই প্রতীক। পাহারাদার আত্মা সত্যিই উপস্থিত। অরিত্র বুঝল, দলিলের লেখা শুধু ইতিহাস নয়, প্রমাণও বটে—এই আত্মাই গড়ের অদৃশ্য রক্ষক, হয়তো বিশ্বাসঘাতক নয় বরং এক চিরন্তন প্রহরী। তার অস্তিত্ব প্রমাণ করছে, গড়ের রহস্য এখনো জীবন্ত, আর সেই প্রমাণের খোঁজ এখানেই শেষ নয়, বরং আসন্ন ঘটনার শুরু। সেই রাতে অরিত্র ফিরে এলো ভয়ার্ত অথচ দৃঢ় মনে, কারণ এখন সে জানে—যদি এই রহস্য উন্মোচন করতে হয়, তবে তাকে এক ভয়াবহ মুখোমুখি অবস্থার জন্য তৈরি হতে হবে।
–
গভীর রাতের নীরবতা যেন অদ্ভুত এক ভয়ের আবরণে মোড়া। দূরে গ্রামের শ্মশানের দিক থেকে শিয়ালের ডাকে কেঁপে উঠছিল আকাশ, চারদিকে জোনাকিরা ছুটে বেড়াচ্ছিল, আর সেই পরিবেশেই কনিকা আর অরিত্র নিঃশব্দে জমিদার বাড়ির গড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। দু’জনের হাতে ছোট টর্চ, কিন্তু সেটি জ্বালানোর সাহস ছিল না—কারণ আলো মানেই ধরা পড়ার ভয়। স্যাঁতসেঁতে বাতাসে গড়ের ভাঙা দেওয়ালগুলো যেন ফিসফিস করে অতীতের রহস্য শোনাচ্ছিল। অরিত্রর মনে হচ্ছিল, যেন প্রতিটি ইটের গায়ে লেগে আছে শত বছরের অভিশাপ, আর কনিকাও বারবার কেঁপে উঠছিল বাতাসের শব্দে। তারা জানত, আজই সেই রাত, যখন সত্য প্রকাশ পাবে। বহুদিন ধরে প্রচলিত কাহিনি—গড়ের ভেতরে লুকোনো নীলকান্তমণির রহস্য আর সেই রত্নকে রক্ষা করে বেড়ানো ভূতের গল্প—সবই যেন আজ মিথ্যে প্রমাণ হবে বা নতুন করে সত্যে রূপ নেবে। ভাঙা দরজা ঠেলে তারা যখন ভেতরে ঢুকল, তখন মনে হচ্ছিল, যেন অন্ধকারটা তাদের গিলে খাচ্ছে। দেয়ালের ছায়া কখনো মানুষের মতো, কখনো দানবের মতো রূপ নিচ্ছিল, আর সেই ভয়াল পরিবেশে কনিকার হাত অনিচ্ছায় অরিত্রর হাতে আঁকড়ে ধরল। দুজনের বুকের ভেতর ঢাকের মতো ধুকপুকানি চলতে থাকল, কিন্তু পিছিয়ে আসার কোনো রাস্তা আর ছিল না।
গড়ের ভেতরে প্রবেশ করার কিছুক্ষণ পরেই অরিত্র লক্ষ্য করল, মেঝেতে মাটির উপর চাপা ধুলো হলেও কিছু জায়গায় যেন সাম্প্রতিক পদচিহ্ন রয়েছে। বিষয়টা প্রথমে স্বাভাবিক মনে হলেও ধীরে ধীরে ওরা বুঝতে পারল, এখানে কেউ নিয়মিত আসছে। সেই মুহূর্তেই আচমকা একটা শব্দ শুনে দুজন থমকে গেল। অরিত্র দ্রুত কনিকার হাত ধরে তাকে ভাঙা স্তম্ভের আড়ালে টেনে নিল। শব্দটা যেন ধাতব কিছুর—তলোয়ারের খাপে ঠোকাঠুকির মতো। নিস্তব্ধতার বুক চিরে কাঁপা আলোয় দেখা গেল এক ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আসছে। তার হাতে উজ্জ্বল এক বাঁকা তলোয়ার, আর লম্বা কালো চাদরে ঢাকা দেহটা চাঁদের আলোয় যেন ভূতের মতোই দেখাচ্ছিল। কনিকার বুক ধুকপুক করে উঠল, সে অরিত্রর কানে ফিসফিস করে বলল—“এটাই কি সেই ভূত?” অরিত্রর গলা শুকিয়ে গেলেও সে চোখ নামাল না। ছায়ামূর্তির পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে কাছে আসছিল, আর হঠাৎ থেমে গিয়ে আকাশ ফালাফালা করে এক অদ্ভুত হাসি শোনা গেল। ভয়ের শীতলতা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল, কিন্তু অরিত্র হঠাৎ সাহস সঞ্চয় করে চেঁচিয়ে উঠল—“কে ওখানে?” তার কণ্ঠস্বর গড়ের দেয়ালে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরল। ছায়ামূর্তি আর দেরি না করে সামনে এগিয়ে এল, চাঁদের আলো মুখে পড়তেই বোঝা গেল এটি কোনো প্রেত নয়, বরং রক্ত-মাংসের জীবিত মানুষ। মুখোশ ঢাকা ছিল তার চেহারা, তবে চোখের ভেতরে ভীতিকর আভা স্পষ্ট। অরিত্র আর কনিকা বুঝতে পারল, এতদিন গ্রামবাসীকে ভয় দেখাতে ভূতের নাটক সাজানো হয়েছিল।
অরিত্র হঠাৎ দ্রুত লাফ দিয়ে ছায়ামূর্তির হাত থেকে তলোয়ারটা সরিয়ে দিল। ধস্তাধস্তি শুরু হল, আর তাতে মুখোশ খুলে পড়ল মানুষের আসল চেহারা। দেখা গেল সে আসলে জমিদার পরেশ ঘোষের বিশ্বস্ত দোসর—হরিদাস। লোকটা ভয়ে কাঁপছিল, তবে চোখেমুখে ভয়ের চেয়ে বেশি ছিল লোভ। অরিত্রর গর্জন ভরা কণ্ঠে প্রশ্ন এল—“কেন এতদিন ভূতের মুখোশ পরে গ্রামকে ভয় দেখাচ্ছিস?” হরিদাস কাঁপা গলায় উত্তর দিল—“আমি… আমি শুধু আদেশ পালন করছিলাম। জমিদারবাবু চাননি কেউ এই গড়ে আসুক। নীলকান্তমণি এখানেই লুকোনো আছে, আর যদি কেউ ঢোকে তবে এই ভুতুড়ে নাটক দেখে পালাবে।” কনিকার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে উঠল। সে স্পষ্ট বুঝতে পারল, গ্রাম জুড়ে যত ভূতের গুজব ছড়ানো হয়েছিল, সবই ছিল একটি নির্দিষ্ট ষড়যন্ত্র—রত্ন লুকিয়ে রাখার জন্য। সেই নীলকান্তমণি, যা শুধু অর্থমূল্যে অমূল্য নয়, বরং গ্রামের ইতিহাস, অভিশাপ আর রক্তাক্ত ঘটনার সাক্ষী। রাতের অন্ধকারে জমিদারের এই গোপন খেলা ফাঁস হয়ে গেল। কিন্তু কাহিনি এখানেই শেষ নয়। হরিদাসের কণ্ঠে ভয়ের সাথে সাথে হিংস্রতাও ফুটে উঠল—সে জানত, এই সত্য প্রকাশ পেলে শুধু তার নয়, জমিদার পরেশ ঘোষেরও সর্বনাশ নিশ্চিত। তাই শেষ মুহূর্তে সে মরিয়া হয়ে অরিত্রকে আঘাত করার চেষ্টা করল। অরিত্র সজাগ ছিল, তলোয়ারের ঝলক কেটে গেল কেবল বাতাস, আর কনিকা হঠাৎই মাটিতে পড়ে থাকা কাঠের খুঁটি তুলে হরিদাসের দিকে ছুঁড়ে মারল। মুহূর্তের মধ্যে লোকটা হোঁচট খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। নীল আলোয় ভরা সেই অশুভ রাত সাক্ষী হয়ে রইল—অভিশপ্ত ভূতের কিংবদন্তির আসল মুখোশ খোলার। গড়ের গোপন রহস্য ধীরে ধীরে নগ্ন হয়ে গেল, আর কনিকা-অরিত্রর চোখে ফুটে উঠল নতুন এক সত্যের আলো।
–
পরেশের ষড়যন্ত্রের জাল ভেঙে যাওয়ার মুহূর্তটা যেন হঠাৎ করেই এক প্রবল ঝড়ের মতো নেমে এল গড়ের ভেতরে। এতদিন যিনি নির্লিপ্ত ভদ্রলোকের মতো গ্রামের হাটে-বাজারে যাতায়াত করেছেন, আসরে বসে ভক্তিভরে গপ্পো বলেছেন, তিনিই আসলে বহুযোজন আগের রাজবংশীয় উত্তরসূরি—এই খবর গ্রামবাসীর রক্তে বজ্রপাতের মতো আঘাত করল। কিন্তু অরিত্রর তীক্ষ্ণ তদন্ত আর কনিকের সাহসী প্রত্যুৎপন্নমতিতে পরেশের আসল চেহারা আর লুকোনো গেল না। বহু পুরোনো দলিল আর গোপন নথি উন্মোচন করে দেখা গেল, এই গড় এককালে যে মহারাজার দুর্গ ছিল, সেই রাজবংশের শেষ উত্তরাধিকারী পরেশই। বছরের পর বছর ধরে তিনি ধূর্তভাবে গড়ের রহস্যময় ইতিহাসকে কুসংস্কার আর অলৌকিক ভয়ের আবরণে ঢেকে রেখেছিলেন, যাতে কেউ ভেতরে ঢোকার সাহস না করে। আর তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল গড়ের অন্তঃস্থলে লুকিয়ে থাকা অমূল্য নীলকান্তমণিকে একদিন নিজের করে নেওয়া। গ্রামের মানুষকে ভয় দেখাতে তিনি রাতের অন্ধকারে কঙ্কালের মতো সাজতেন, অদ্ভুত শব্দ তুলতেন, আর পুরোনো সুরঙ্গপথ দিয়ে ঘোরাফেরা করে আতঙ্ক সৃষ্টি করতেন। কিন্তু বিজ্ঞান আর যুক্তির কাছে তার সব আয়োজন ভেঙে পড়ল। কঙ্কালটির ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্ট এল—প্রমাণিত হলো সেটি কোনো অশুভ শক্তির নিদর্শন নয়, বরং সেই সেনাপতির দেহাবশেষ, যিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রাজাকে রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন। শতাব্দীর আবরণ ভেদ করে সত্য প্রকাশ পেল, আর গড়ের অন্ধকার ভুতুড়ে ইতিহাস মুছে গিয়ে উন্মোচিত হলো রাজভক্তির এক বেদনাময় স্মারক।
অরিত্র ও কনিকা দুজনেই এক অদ্ভুত তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলল যখন সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগের হাতে নীলকান্তমণিটি তুলে দিল। তারা জানত, এই মণি ব্যক্তিগত লোভে ব্যবহৃত হওয়ার নয়; এটি দেশের সম্পদ, জাতির গর্ব। সংবাদপত্রের ক্যামেরার ফ্ল্যাশের সামনে দাঁড়িয়ে যখন দু’জনকে ধরা হলো, গ্রামের মানুষ প্রথমবার গর্বে বুক ফুলিয়ে উঠল। যে গড়কে এতদিন ভয়ে তারা এড়িয়ে চলত, সেই গড়ের রহস্য ভেদ করেছে তাদেরই সন্তানরা। গ্রামে আলোচনার ঝড় উঠল—কেউ বলল, “পরেশের মতো শিক্ষিত মানুষও কুসংস্কারের আড়ালে কীভাবে নিজের স্বার্থ লুকিয়েছে!” আবার কেউ বলল, “অরিত্র না থাকলে আমরা কোনোদিন জানতেই পারতাম না, সত্যি আসলে কেমন!” গ্রামের বয়স্করা স্বস্তির হাসি হেসে বলল, “ভূতের ভয়কে আমরা নিজেরাই এতদিন আঁকড়ে ধরেছিলাম, অথচ ভয়ের আড়ালে ছিল শুধু মানুষের স্বার্থ।” এই নতুন উপলব্ধি গ্রামে এক ধরণের মানসিক মুক্তি এনে দিল। বহু বছর পর শিশুরা গড়ের প্রাচীন দেওয়ালে খেলা করতে শুরু করল, মহিলারা সিঁদুর খেলায় অংশ নিতে সাহস পেল, আর বৃদ্ধরা বসে পুরোনো দিনের গল্প বলতে লাগল। পরেশের হাতকড়া পরা ছবি গ্রামে এক প্রকার প্রতীক হয়ে দাঁড়াল—অসত্য ও লোভের পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তার বাস্তব প্রমাণ।
গড়ের অন্ধকার অতীত ভেদ করে যখন সত্য উদ্ঘাটিত হলো, তখন শুধু একটি রহস্য সমাধানই হয়নি—একটি সমাজ নতুন করে নিজেকে খুঁজে পেল। অরিত্র ও কনিকা বুঝতে পারল, এ কেবল একটি মণির কাহিনি নয়, এ মানুষের চেতনার মুক্তির কাহিনি। এতদিন তারা ভেবেছিল কুসংস্কার মানে অজানার প্রতি অন্ধ ভয়, কিন্তু আজ বুঝল কুসংস্কারের পেছনে অনেক সময় থাকে মানুষের তৈরি ষড়যন্ত্র। গ্রামের মানুষও এবার যুক্তির শক্তিকে মেনে নিতে শিখল। তারা উপলব্ধি করল, অন্ধকারকে দূর করতে আলো জ্বালানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আর সেই আলো এখন তাদের চোখে নতুন করে গড়কে দেখাচ্ছে—অভিশপ্ত ভুতুড়ে জায়গা নয়, বরং এক ঐতিহাসিক নিদর্শন, যেখানে সাহস, ভক্তি আর সত্য একসাথে খোদাই হয়ে আছে। অরিত্র ও কনিকাকে দেখে গ্রামের ছেলেমেয়েরা স্বপ্ন দেখতে শিখল—তারা বুঝল, সত্যিকারের বীরত্ব মানে তলোয়ার হাতে যুদ্ধ নয়, বরং মিথ্যার মুখোশ খুলে দেওয়া। শেষ বিকেলের রোদ যখন গড়ের ভাঙা প্রাচীরে পড়ল, তখন মনে হলো সেই আলোই ঘোষণা করছে—ভয়কে পেছনে ফেলে এখন সময় এগিয়ে যাওয়ার। আর অরিত্রর চোখে তখন শুধু একটাই ঝিলিক—সত্যের জয় সবসময় হবে, যতই গভীর হোক অন্ধকার।
***




