অনিৰ্বাণ সেনগুপ্ত
১
কলকাতার গঙ্গার ধারে সন্ধ্যার পরই এক অদ্ভুত আবহ ছড়িয়ে পড়ে। দিনের ব্যস্ততা, মালবোঝাই বার্জের হর্ন, নৌকার ভিড় আর ঘাটের চেঁচামেচি—সব মিলিয়ে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত জায়গাটা থাকে কর্মচঞ্চল। কিন্তু সূর্য নামলেই চেনা ছবিটা ধীরে ধীরে বদলে যায়। ঘাটের ধারে বসে থাকা চায়ের দোকানদার আলো নিভিয়ে বাড়ি ফেরে, কাঁকড়া বা ছোট মাছ বিক্রির টাটকা হট্টগোল স্তব্ধ হয়ে যায়, আর গঙ্গার কালো জল যেন আরও ঘন হয়ে ওঠে। সেই অন্ধকারেই দাঁড়িয়ে থাকে পুরনো ব্রিটিশ কবরস্থান—ধূসর পাথরের ক্রস, শেওলা ধরা সমাধিফলক আর আধভাঙা গম্বুজওয়ালা সমাধি। কবরগুলোর চারপাশে রাত নামলেই এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি পাহারা দিচ্ছে। যারা প্রতিদিন নদীতে কাজ করে, তারা দূর থেকেই কবরস্থানের দিকে চোখ রাখে, কিন্তু খুব কম মানুষই সাহস করে ভেতরে যায়। অল্পস্বল্প বাতাসে গাছের ডাল ভাঙার শব্দ, কুকুরের হাহাকার আর দূর থেকে ভেসে আসা শাঁখ বাজনার ধ্বনি—সব মিলিয়ে জায়গাটা সাধারণ রাতের থেকেও ভৌতিক মনে হয়।
এই জায়গাটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক পুরনো গল্প। স্থানীয় মাঝি, জেলে কিংবা ঘাটের শ্রমিকরা অল্প হেসে, আবার অনেকটা ভয় মিশিয়ে, মাঝরাতের সাদা পোশাকের ভদ্রমহিলার কথা বলে। কারও মতে, তিনি গঙ্গার জলে ভেসে ওঠেন, লম্বা সাদা জামা ভিজে সেঁটে থাকে দেহে, আর চুলগুলো কাঁধ পেরিয়ে ভিজে যায় কপালের ওপর। কেউ বলে, তিনি হাত বাড়িয়ে দাঁড়ান, আর নৌকো যদি কাছে যায় তবে জলের ভেতর টেনে নেন। আবার কেউ বলে, তিনি ঘাটের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নীরবে তাকিয়ে থাকেন, যতক্ষণ না কেউ তার দৃষ্টি এড়িয়ে পালায়। শোনা যায়, একাধিক নৌকা মাঝরাতে গঙ্গার স্রোতে হঠাৎ উল্টে গেছে, আর উদ্ধার হওয়া মৃতদেহগুলোর মুখে ভয়ের ছাপ ছিল অবিশ্বাস্যরকম তীব্র। এসব গল্প লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছে, আর ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে গুজবে। অনেকেই বিশ্বাস করে, ব্রিটিশ আমলে এক ইংরেজ মহিলার মৃত্যু হয়েছিল এখানে—প্রেমে প্রতারিত হয়ে তিনি গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছিলেন, আর আজও তার আত্মা খুঁজে বেড়ায় সঙ্গী। সত্যি-মিথ্যা যাই হোক, এই কাহিনি নদীর ধারের প্রতিটি চায়ের দোকানে, প্রতিটি মাঝির গল্পে, প্রতিটি জেলের আড্ডায় শোনা যায়।
হরিপদ মাঝি সেইসব মানুষের একজন, যিনি নিজে নাকি চোখে দেখেছেন সাদা পোশাকের মহিলাকে। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে, গায়ের রঙ ধূসর বাদামি, চোখে চিরকাল আতঙ্কের ছাপ লেগে আছে। এক সন্ধ্যায় অরিন্দম মল্লিক, পেশায় সাংবাদিক, কবরস্থানের ঘাটে দাঁড়িয়ে হরিপদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। হরিপদ নিজের নৌকা বেঁধে রেখেছিলেন, আর মাটির চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিতে দিতে ধীরে ধীরে গল্পটা শোনালেন। “বাবু, আমি নিজ চোখে দেখছি। ও জলের ওপর ভাসছিল, সাদা কাপড় নড়ছিল বাতাসে, কিন্তু বাতাস তো ছিলই না! আমি আরেকজন যাত্রী নিয়ে যাচ্ছিলাম, সে চিৎকার করে উঠল। আমিও চমকে উঠলাম, তারপর দেখি, ওই ভদ্রমহিলা হাত বাড়িয়ে আছে, যেন ডাকছে। আমরা নৌকো ঘুরিয়ে দিয়েছিলাম, নইলে হয়তো আজ আমি আপনাদের সামনে বসে থাকতাম না।” অরিন্দম শুনে মৃদু হেসে সিগারেট ধরালেন, কিন্তু তার চোখে কৌতূহলের ঝিলিক স্পষ্ট। কলকাতার ভুতুড়ে লোককথা নিয়ে তিনি লিখে থাকেন, আর এই গোরস্থানের গুজব তার কাছে ছিল একেবারে আদর্শ উপাদান। হরিপদের কণ্ঠে আতঙ্ক, চারপাশের অন্ধকার ঘাটের নীরবতা আর গঙ্গার গভীর শব্দ মিলিয়ে সেই রাতে যেন এক অদ্ভুত অশুভ সূচনা ঘটল—যা অরিন্দমকে টেনে নিয়ে যাবে রহস্যের অন্ধকারে।
২
অরিন্দম মল্লিক, বয়স উনত্রিশ, কলকাতার এক বেসরকারি সংবাদপত্রে ফিচার সাংবাদিক। সাধারণ রাজনীতি বা খেলার খবরে তার তেমন আগ্রহ নেই; বরং শহরের অলিগলি জুড়ে ছড়িয়ে থাকা রহস্য, লোককথা আর অদ্ভুতুড়ে ঘটনার সূত্র খুঁজে বের করাই তার নেশা। তার ফ্ল্যাট কলেজ স্ট্রিটের কাছেই, বইয়ের গন্ধমাখা সেই পাড়াতেই তার বেড়ে ওঠা। ছোট থেকেই ইতিহাস আর গল্পের প্রতি ঝোঁক ছিল, আর তাই সাংবাদিকতায় নামার পর শহরের অচেনা অচিন্তনীয় দিকগুলোকে তুলে ধরতে চেয়েছেন পাঠকের সামনে। গঙ্গার ধারে গোরস্থানের গুজব তার কানে আসার পর থেকেই তার মনে কৌতূহলের ঢেউ উঠেছিল। হরিপদ মাঝির ভয়ার্ত বর্ণনা, নদীর ধারের নীরবতা আর পুরনো ব্রিটিশ সমাধিগুলোর আবহ মিলিয়ে অরিন্দম যেন এক অদৃশ্য ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারলেন না। তার মনে হলো—এখানে হয়তো কোনো অতিপ্রাকৃত রহস্য আছে, আবার হয়তো সবই মানুষের কল্পনা, ভয়ের জন্ম দেওয়া প্রতারণা। সাংবাদিক হিসেবে তার দায়িত্ব হলো সত্যিটা খুঁজে বের করা। রাত জেগে ল্যাপটপে পুরনো আর্কাইভ ঘেঁটে তিনি খুঁজতে শুরু করলেন ব্রিটিশ আমলের পত্রিকা, যেখানে হয়তো পাওয়া যাবে গঙ্গায় ডুবে যাওয়া কোনো মহিলার খবর। যতই পড়ছিলেন, ততই তার মনে হচ্ছিল, রহস্যের ভেতরে ডুব না দিলে এই কাহিনি কেবল লোককথাই থেকে যাবে, প্রমাণহীন এক ভয়ের গল্প।
এই তদন্তে একা নামতে চাননি অরিন্দম। তাই তিনি যোগাযোগ করলেন মৌসুমী সেনের সঙ্গে—একই অফিসে কাজ করেন, বয়স ছাব্বিশ, আধুনিক, দৃঢ়চেতা তরুণী। মৌসুমী বিশেষভাবে কাজ করেন শহরের সংস্কৃতি ও আর্টস সংক্রান্ত বিষয়ে, তবে অরিন্দমের মতোই তার মধ্যেও অজানাকে জানার অদম্য ইচ্ছা আছে। অফিস শেষে কফিহাউসের এক কোণে বসে অরিন্দম যখন তাকে গঙ্গার ধারের ভূতের গল্প শুনালেন, প্রথমে মৌসুমী হেসে উঠলেন। “ভূতপ্রেতের গল্প লিখবে তুমি? পাঠক হাসবে, ভয় পাবে না,” বলেই তিনি কফির কাপ নামালেন। কিন্তু অরিন্দম হাল ছাড়লেন না। তিনি শান্ত গলায় বললেন, “তুমি ভাবছ এটা শুধু ভূতের গল্প, কিন্তু যদি এর পেছনে কোনো বাস্তব ঘটনা থাকে? যদি কোনো নারী সত্যিই গঙ্গায় ডুবে মারা যায়, আর তার কাহিনি এভাবে লোকমুখে রয়ে যায়? সেটাই খুঁজে বের করা দরকার।” মৌসুমী এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে গেলেন। তার চোখে পড়ল অরিন্দমের অদ্ভুত আগ্রহ, যে আগ্রহ কেবল পেশাগত নয়, বরং একধরনের ব্যক্তিগত টান। কিছুক্ষণ পর তিনি হেসে বললেন, “ঠিক আছে, তবে প্রমাণ ছাড়া কিছু লিখবে না। আমি তোমার সঙ্গে যাব, কিন্তু শর্ত হলো—যা পাবো, তা যুক্তি দিয়ে খতিয়ে দেখতে হবে। ভূতের পেছনে চোখ বুজে বিশ্বাস নয়।” এই চুক্তির মধ্য দিয়েই শুরু হলো তাদের যৌথ যাত্রা—এক রহস্য অনুসন্ধানের পথে, যেখানে যুক্তি আর ভয়ের টানাপোড়েন চলবে পাশাপাশি।
অরিন্দম ও মৌসুমীর এই সিদ্ধান্ত যেন তাদের চারপাশের পরিবেশকেই নতুন করে বদলে দিল। অফিস শেষে রাতের বেলা তারা ল্যাপটপে পুরোনো সংবাদকাগজ ঘাঁটতে লাগলেন, নোট নিলেন কবরস্থানের অবস্থান, সেখানে কারা কবরস্থ হয়েছে, কোন সময় থেকে এর অস্তিত্ব। একদিন গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে তারা দু’জন নিজের চোখে জায়গাটা দেখলেন—ঝোপঝাড়ে ঢাকা, আধভাঙা সমাধি, আর নদীর জল কবরের গা ঘেঁষে বয়ে চলেছে। মৌসুমী ফিসফিস করে বললেন, “এই জায়গাটা সত্যিই অদ্ভুত। দিনের আলোয়ও এক অস্বস্তি কাজ করছে।” অরিন্দম সিগারেট ধরিয়ে বললেন, “এই অস্বস্তির ভেতরেই আছে গল্পের মূল। ভয় কেবল কল্পনা নয়, কোনো না কোনো বাস্তব ঘটনাই তার জন্ম দেয়।” মৌসুমী ক্যামেরা বের করে কয়েকটা ছবি তুললেন, আর ঠিক তখনই অরিন্দম লক্ষ্য করলেন—জলের ওপরে ঘন কুয়াশা জমছে, যদিও তখন গ্রীষ্মকাল, এমন কুয়াশা হওয়ার কথা নয়। মৌসুমীও থমকে গেলেন। হয়তো সেটা ছিল নিছক প্রাকৃতিক ঘটনা, কিন্তু তাদের দু’জনের ভেতরে একসঙ্গে কৌতূহল আর শঙ্কা জেগে উঠল। তারা বুঝে গেলেন, এ কেবল গল্প নয়, বরং এমন এক যাত্রার শুরু যেখানে তাদের সাহস, যুক্তিবাদিতা আর সাংবাদিকতা—সবকিছুকেই পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে।
৩
গঙ্গার ধারের সেই পুরনো কবরস্থানটিতে ঢোকার মুহূর্তেই অরিন্দম ও মৌসুমীর মনে হলো, তারা যেন এক অচেনা সময়ের ভেতরে প্রবেশ করছে। বিশাল লোহার গেট, যেটার রং বহু বছর আগে উড়ে গিয়ে এখন কেবল মরচে ধরা ধূসরতায় দাঁড়িয়ে আছে, আর ভেতরে ঢুকতেই ছড়িয়ে আছে শেওলায় ঢাকা সমাধি, ভাঙা গম্বুজ, পাথরের উপর খোদাই করা ইংরেজি নাম, যার অনেকটাই সময়ের সঙ্গে মুছে গেছে। বিকেলের আলো ক্রমশ ফিকে হয়ে এলে চারপাশটা আরও গম্ভীর হয়ে উঠল। অরিন্দম খেয়াল করছিলেন, জায়গাটা যেন নিস্তব্ধতার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, এমনকি কাছাকাছি গঙ্গার ঢেউয়ের শব্দও এখানে প্রবেশ করতে সাহস পাচ্ছে না। মৌসুমী ক্যামেরা হাতে ছবি তুলছিলেন, কিন্তু তার চোখে-মুখে ছিল ভয়ের চাপা ছাপ। ঠিক সেই সময় তারা দেখলেন একজন মানুষ ধীরে ধীরে কবরের পাশ দিয়ে এগিয়ে আসছেন। গায়ের গঠন পাতলা, চুল সাদা, কিন্তু চোখে অদ্ভুত এক গাম্ভীর্য। তার হাতে ছিল একটি লণ্ঠন, আর কাঁধে একটি পুরনো কম্বল। তিনি নিজেকে পরিচয় করালেন—“আমার নাম গণেশ পাল, আমি এই গোরস্থানের রক্ষক।” তার কণ্ঠস্বরে এক ধরনের শুষ্কতা, যেন বহু বছর ধরে নিরবতায় কথা না বলে এই মুহূর্তে হঠাৎ শব্দ করতে হচ্ছে।
অরিন্দম দ্রুত এগিয়ে গিয়ে তাকে সম্ভাষণ জানালেন এবং ব্যাখ্যা করলেন, তারা সাংবাদিক হিসেবে পুরনো লোককথা নিয়ে কাজ করছেন। গণেশ পাল তাদের শান্ত চোখে দেখলেন, যেন বোঝার চেষ্টা করছেন—এরা কি সত্যিই কৌতূহলী, নাকি নিছক ভূতের গল্প শুনে রোমাঞ্চ খুঁজতে এসেছে। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর তিনি ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন। “এই জায়গাটা ব্রিটিশ আমল থেকে আছে। যারা তখন কলকাতায় শাসন করত, তাদের অনেকেই এখানে কবরস্থ। কিন্তু এক বিশেষ কবরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অন্যরকম ইতিহাস। এক ইংরেজ ভদ্রমহিলা—এলিজাবেথ। শুনেছি, তিনি ছিলেন এক ব্রিটিশ অফিসারের স্ত্রী। খুব সুন্দরী, খুব প্রাণবন্ত মহিলা ছিলেন তিনি। কিন্তু জীবনে সুখ পাননি। স্বামীর নিষ্ঠুরতা আর এক নিষিদ্ধ প্রেমের কাহিনি তাকে ধ্বংস করেছিল। এক রাতে তিনি গঙ্গার ধারে এসে, এই কবরস্থানের সিঁড়ি থেকে নদীতে ঝাঁপ দেন। তার দেহ ভেসে উঠেছিল কয়েকদিন পর, কিন্তু মৃত্যুর পরে তার আত্মা এখানে শান্তি পায়নি। যারা মাঝরাতে নৌকা চালায়, তারা অনেকেই বলে তাকে দেখতে পেয়েছে—সাদা পোশাক পরে, হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।” গণেশের গলায় কোনো নাটকীয়তা ছিল না, ছিল কেবল এক নিস্তেজ ভরাট স্বর, যেন তিনি এমন কিছু বলছেন যা বহুবার শুনেছেন, বহুবার বর্ণনা করেছেন, তবু সত্যিটা পাল্টায়নি। মৌসুমী তার ক্যামেরা নামিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলেন, আর অরিন্দম সিগারেট ধরিয়ে চুপচাপ চোখ রেখেছিলেন গণেশের দিকে।
অবশেষে গণেশ একদম কাছে এসে থেমে গেলেন। তার চোখে তখন অদ্ভুত এক দৃঢ়তা, কণ্ঠস্বর আরও গভীর হয়ে উঠল। তিনি ধীরে ধীরে বললেন, “বাবু, তোমরা সাংবাদিক—সত্য খুঁজবে, আমি জানি। কিন্তু সব সত্য সবার জানার নয়। কিছু কিছু কাহিনি মানুষকে ভয় পাইয়ে দেয়, কিছু কাহিনি মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। এলিজাবেথের আত্মা এখনো শান্তি পায়নি। হয়তো প্রতারিত হওয়ার যন্ত্রণায়, হয়তো মৃত্যুর বেদনাতেই সে এখানে আটকে আছে। যারা অযথা কৌতূহল নিয়ে তার কাছে যায়, তারা আর ফিরে আসে না। আমি এত বছর এখানে পাহারা দিচ্ছি, কিন্তু মাঝরাত হলে আমিও এই কবরস্থানের ভেতর আসি না। আমি কেবল গেটের বাইরে থেকে পাহারা দিই। কারণ জানি, ওই সাদা পোশাকের ভদ্রমহিলা আজও গঙ্গার জলে ঘোরাফেরা করে।” কথাগুলো বলেই গণেশ যেন নিঃশ্বাস ফেলে থেমে গেলেন। অরিন্দম ও মৌসুমীর মধ্যে এক মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধতা নেমে এলো, যেন চারপাশের বাতাসও কথা শুনছিল। তারপর অরিন্দম নিজের নোটবুকে দ্রুত কয়েকটি লাইন লিখলেন, আর মৌসুমীর চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠল দ্বন্দ্ব—তিনি ভূতে বিশ্বাসী নন, কিন্তু গণেশ পালের গলায় যে দৃঢ়তা, তা নিছক কল্পকাহিনি বলে উড়িয়ে দেওয়াও কঠিন। সেই মুহূর্তেই তারা দু’জন বুঝে গেলেন, রহস্যের ভেতরে ঢুকতে গেলে শুধু তথ্য নয়, সাহসেরও প্রয়োজন হবে। গণেশ পালের সতর্কবার্তা যেন কানে বাজছিল—“ওই আত্মা এখনো শান্তি পায়নি।”
৪
সন্ধ্যা নামতেই কলকাতার গঙ্গার ঘাটে এক অদ্ভুত শীতলতা নেমে এলো। দিনের ভিড়, পূজারত মানুষের শব্দ, ঘণ্টা আর ভজনের আওয়াজ মিলিয়ে ধীরে ধীরে স্তব্ধ হয়ে গেল। কেবল নদীর কালো জল অন্ধকারে আরও গাঢ় হয়ে উঠল, আর হাওয়া যেন ভিজে ঠান্ডা হয়ে বইতে লাগল। অরিন্দম তার ব্যাগ থেকে ক্যামেরা আর নোটবুক বের করছিলেন, পাশে হরিপদ মাঝি নৌকা গুছিয়ে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। বয়স হয়েছে হরিপদের, কিন্তু হাত এখনো শক্ত, চোখে ভয় এবং অভিজ্ঞতার ছাপ। তিনি বহুবার রাতে গঙ্গায় নৌকা বেয়েছেন, কিন্তু আজকের রাত যেন অন্যরকম। বারবার অরিন্দমকে বলছিলেন—“বাবু, যাই বটে, কিন্তু আজকে মনে হচ্ছে ভালো হবে না। গোরস্থানের সামনে রাতে নৌকা চালানো পাপ।” অরিন্দম ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি টেনে উত্তর দিলেন, “পাপ নয় কাকা, এ কেবল কুসংস্কার। আমি চাই নিজের চোখে দেখতে, যা নিয়ে সবাই ভয়ে কাঁপে।” হরিপদ মাথা নাড়লেন, কিন্তু তবুও বাঁশ হাতে নৌকা ঠেলে নদীর বুকে নামিয়ে দিলেন। নৌকা আস্তে আস্তে মাঝনদীতে ভেসে উঠতেই চারপাশ যেন আরও নীরব হয়ে গেল। কোনো পাখি নেই, দূরের শহরের আলোও যেন কুয়াশায় ঢেকে নিভে গেছে। কেবল নদীর জলে হালকা ছলাৎছল শব্দ, আর দূরে ভেসে আসা ঘাটের ঘণ্টাধ্বনি।
মাঝরাত ঘনিয়ে এলে হঠাৎই নদীর ওপরে অদ্ভুত কুয়াশা জমতে শুরু করল। গ্রীষ্মকালেও এমন কুয়াশা হওয়া স্বাভাবিক নয়, তবু মনে হচ্ছিল যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি ধীরে ধীরে নদীটাকে ঢেকে দিচ্ছে। হরিপদ হঠাৎ নৌকার দাঁ বেয়ে থেমে গেলেন। তার চোখ স্থির হয়ে গেল নদীর ওপারের দিকে, ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু শব্দ বেরোচ্ছে না। অরিন্দম বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হলো কাকা?” তখনই তিনি লক্ষ্য করলেন—কুয়াশার ভেতর থেকে যেন এক সাদা অবয়ব ধীরে ধীরে ভেসে উঠছে। অবয়বটা প্রথমে অস্পষ্ট, কিন্তু ধীরে ধীরে তা স্পষ্ট হতে থাকল—একটি লম্বা সাদা পোশাক, ভিজে ভিজে কাপড় নদীর হাওয়ায় উড়ছে, আর লম্বা কালো চুল কাঁধ থেকে বয়ে নেমে এসেছে। মুখটা ঠিক দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু অদ্ভুত শূন্যতা যেন সেই জায়গায় ঘনীভূত হয়ে আছে। হরিপদ ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন—“ওই যে! ওই তো ভদ্রমহিলা! বলেছিলাম বাবু, আজকে সর্বনাশ হবে!” তিনি দাঁ টেনে নৌকা ঘুরিয়ে নিতে চাইছিলেন, কিন্তু হাত কাঁপছিল, দাঁ যেন নিয়ন্ত্রণে আসছিল না। কুয়াশার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা অবয়ব ধীরে ধীরে নদীর দিকেই এগোতে লাগল, আর নৌকাটা অজানা টানের মতো স্থির হয়ে রইল।
অরিন্দমের ভেতরে তখন ভয় আর কৌতূহল লড়াই করছিল। শরীরের প্রতিটি শিরায় শিরায় ঠান্ডা স্রোত বইছে, কিন্তু সাংবাদিকতার প্রবল তাগিদে তিনি ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করলেন। হরিপদ প্রায় কেঁদে ফেলছিলেন, হাতজোড় করে বলছিলেন, “না বাবু, ছবি তুলবেন না, ও রাগ করবে, আমাদের ডুবিয়ে মারবে।” কিন্তু অরিন্দম যেন শুনলেনই না। কুয়াশার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা সেই সাদা অবয়বকে লক্ষ্য করে তিনি লেন্স ফোকাস করলেন। হাত কাঁপছিল, তবু তিনি শাটার চাপলেন। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ হঠাৎ আলোকিত করে দিল চারপাশ, আর এক সেকেন্ডের জন্য তিনি স্পষ্ট দেখলেন—ভদ্রমহিলার মুখ। সেটা ছিল শূন্য, ফাঁকা, যেন চোখ-মুখ সবকিছু অন্ধকারে গিলে নিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই প্রবল এক ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়া নৌকাটাকে দুলিয়ে দিল। হরিপদ হাহাকার করে দাঁ ফেলে দিলেন পানিতে, প্রাণপণে নৌকা ঘুরিয়ে তীরের দিকে চালাতে লাগলেন। কুয়াশার ভেতর থেকে তখনও সাদা অবয়বটা স্থির দাঁড়িয়ে চেয়ে আছে, যেন জলের ওপরে অচল ভাসমান ছায়া। অরিন্দমের বুক ধড়ফড় করছিল, কিন্তু ক্যামেরার ভেতরে ছবিটা ধরা পড়েছে জেনে তার মনে হলো—তিনি এমন কিছু প্রত্যক্ষ করলেন যা কেবল গুজব নয়। নৌকা দ্রুত ঘাটের দিকে ফিরছিল, আর হরিপদের গলায় ক্রমাগত প্রার্থনার শব্দ ভেসে আসছিল। রাতের গঙ্গা যেন তখন নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে আছে—সেই সাদা পোশাকের ভদ্রমহিলার রহস্যময় উপস্থিতি আর দুই সাহসী মানুষের আতঙ্কে ভরা যাত্রার দিকে।
৫
পরদিন দুপুরে অরিন্দম ও মৌসুমী শহরের এক শান্ত ক্যাফের কোণে বসে আগের রাতের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলছিলেন। বাইরের পৃথিবী স্বাভাবিক—রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে, মানুষজন হাসছে, দোকানের সামনে ভিড় জমছে, কিন্তু তাদের দু’জনের ভেতরে এখনো গত রাতের অদ্ভুত ভয় এবং বিস্ময় বেঁচে আছে। অরিন্দম বারবার ক্যামেরার মেমোরি কার্ড ল্যাপটপে ঢুকিয়ে ছবিগুলো দেখছিলেন। প্রথম কয়েকটি ছবিতে কেবল কুয়াশা আর গঙ্গার কালো জল ধরা পড়েছে, কিন্তু একটা ছবিতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল নদীর ওপর দাঁড়িয়ে আছে সাদা একটা অবয়ব। মুখ ধরা যায়নি, তবে লম্বা পোশাক, শরীরের ভঙ্গি এতটাই আলাদা যে তা কোনো আলোছায়ার খেলা মনে হয়নি। মৌসুমী ছবির দিকে তাকিয়ে থম মেরে গেলেন। তার গলায় ভয় মেশানো বিস্ময়—“এটা কি প্রতিফলন হতে পারে? হয়তো আলো আর কুয়াশা মিলে তৈরি করেছে এই অবয়ব।” অরিন্দম শান্ত গলায় উত্তর দিলেন, “আমি-ও তাই ভাবছি। অনেক সময় ক্যামেরা চোখের চেয়ে বেশি কিছু ধরে ফেলে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে সেটা অলৌকিক।” তবুও তার মনের গভীরে কোথাও একটা প্রশ্ন কাঁটার মতো খচখচ করতে লাগল—যদি সত্যিই এ শুধু কুয়াশার খেলা হয়, তবে কেন সেই মুহূর্তে তিনি অনুভব করেছিলেন ঠান্ডা শিরশিরে হাওয়া, কেন মনে হয়েছিল যেন কেউ কাছে এসে দাঁড়িয়েছে?
মৌসুমী যুক্তি খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু ছবির দিকে যত তাকাচ্ছিলেন, ততই যেন ভয় তার ভেতরে চেপে বসছিল। “দেখো, প্রতিফলন হলে সেটাকে নড়াচড়া করতে দেখা যেত না। কিন্তু তুমি বলেছিলে ও যেন এগিয়ে আসছিল নৌকার দিকে। আর আমিও লক্ষ্য করেছি, কুয়াশার মধ্যে কখনো কখনো হঠাৎ আলো-ছায়া বদলাচ্ছিল, যেন কোনো উপস্থিতি আছে।” তার গলা কেঁপে উঠল, চোখে স্পষ্ট ভয়ের রেখা। অরিন্দম তাকে শান্ত করার ভান করে বললেন, “তুমি জানো, মানুষের মন খুব সহজে ভ্রম তৈরি করে। ভয় পেলে আমাদের চোখ অনেক কিছু কল্পনা করে নেয়। আমি সাংবাদিক, তাই প্রতিটি ঘটনাকে আগে যুক্তি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি।” তিনি কফির কাপ হাতে নিলেন, কিন্তু হাত সামান্য কাঁপছিল। মৌসুমী সেটা খেয়াল করলেন। তিনি ধীরে ধীরে বললেন, “তাহলে ছবিটাকে তুমি কিভাবে ব্যাখ্যা করবে? একে আলো বা প্রতিফলন বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় কি?” অরিন্দম উত্তর দিলেন, “হয়তো যায়। কিন্তু হয়তো কিছু আছে, যা আমরা এখনো বুঝিনি। আমি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাব না।” তাদের কথোপকথনে অদ্ভুত এক দ্বন্দ্ব তৈরি হলো—ভয়ের সঙ্গে যুক্তি, বিশ্বাসের সঙ্গে সংশয়।
দু’জনেই ছবিগুলো বারবার দেখছিলেন, যেন সত্যিটাকে ক্যামেরার লেন্সের ভেতর থেকে টেনে বের করতে চাইছেন। বাইরে তখন হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে, জানালার কাঁচে জলবিন্দু জমে নকশা তৈরি করছে, আর ক্যাফের ভেতরে বাজছে মৃদু সুর। কিন্তু সেই সুর, সেই ব্যস্ততা তাদের কাছে ফিকে হয়ে গিয়েছিল। তাদের মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরছিল—সত্যিই কি গঙ্গার ধারে এক অদৃশ্য আত্মা ভেসে বেড়াচ্ছে? নাকি তারা কেবল ভয়ের বশে কল্পনা করছে? মৌসুমী ধীরে ধীরে বললেন, “আমি জানি না ভূত আছে কি নেই, কিন্তু একটা কথা বুঝেছি—এই রহস্যকে হালকা ভাবে নেওয়া যাবে না। প্রতিদিন যদি নতুন কুয়াশার রাত আসে, তবে প্রতিদিন নতুন করে ভয় আর প্রশ্ন জেগে উঠবে।” অরিন্দম মাথা নেড়ে উত্তর দিলেন, “তুমি ঠিকই বলছো। আমি এখনো যুক্তির দিকেই দাঁড়াতে চাই, কিন্তু ভেতরে কোথাও মনে হচ্ছে এর পেছনে বড়ো কোনো ইতিহাস লুকিয়ে আছে। হয়তো এলিজাবেথের সেই করুণ কাহিনিই এর কারণ।” তাদের কথোপকথন ধীরে ধীরে স্তব্ধ হয়ে এলো। ছবির সাদা অবয়ব যেন নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে, আর তারা দু’জন জানতেন—এই গল্প এখানেই শেষ নয়, বরং এখনই শুরু হলো আসল যাত্রা।
৬
অরিন্দম যখন পরের দিন আবার কবরস্থানের ফটকের ভেতরে ঢুকলেন, চারপাশ যেন আরও নির্জন, আরও গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। পুরনো গাছগুলোর ডালপালা হেলে পড়েছে, ভাঙাচোরা সমাধি শ্বেতশুভ্র পাথরে সময়ের ক্ষতচিহ্ন বহন করছে। সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলেন গণেশ পাল, হাতে লণ্ঠন, চোখে ক্লান্ত অথচ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। তিনি অরিন্দমকে দেখে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন। “বাবু,” তার গলায় যেন ইতিহাসের ভার মিশে আছে, “তুমি যেটা দেখেছো, ও কেবল কুয়াশার খেলা নয়। এই জায়গার মাটি, এই নদী—সবকিছুতে একটা অদৃশ্য ছায়া বেঁচে আছে।” অরিন্দম গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। তখনই গণেশ পাল ধীরে ধীরে শুরু করলেন এলিজাবেথের করুণ কাহিনি। “ব্রিটিশ আমলের কথা। এক সাহেব অফিসার এখানে আসতেন নিয়মিত। তার স্ত্রী ছিলেন এক সুন্দরী, নাম এলিজাবেথ। কিন্তু তার মনে ছিল অন্যরকম আকাঙ্ক্ষা। শুনেছি তিনি এক বাঙালি যুবকের প্রেমে পড়েছিলেন। সমাজ সেটা মেনে নেয়নি। চারদিকে চাপ, গঞ্জনা, আর অপমানের ভারে তিনি ভেঙে পড়েন। এক রাতে—হ্যাঁ, এই গঙ্গার ধারে, এই ঘাটেই—তিনি নিজের জীবন শেষ করে দেন। পোশাক পরা অবস্থাতেই ঝাঁপ দিয়েছিলেন নদীতে।” কথা শেষ করতেই লণ্ঠনের আলো কেঁপে উঠল, আর কবরস্থানের শূন্যতা যেন আরও গভীর হয়ে গেল। অরিন্দমের গলা শুকিয়ে গেল, তবু তিনি প্রশ্ন করলেন, “তার দেহ কি পাওয়া গিয়েছিল?” গণেশ পাল নিঃশব্দে মাথা নেড়ে বললেন, “না বাবু, নদী তাকে গ্রাস করেছিল। তাই হয়তো আজও তার আত্মা শান্তি পায়নি।”
গল্প শুনে অরিন্দমের মনে একটা অদ্ভুত আলোড়ন শুরু হলো। এটা কেবল গুজব নয়, এর মধ্যে ইতিহাসের ছাপ আছে। সাংবাদিক হিসেবে তিনি সত্যিই জানতে চাইলেন এর প্রমাণ কী। তিনি কবরস্থানের ভেতরে ঢুকে পড়লেন, আর গণেশ পাল তাকে পুরোনো একটি ঘরের সামনে নিয়ে গেলেন। ঘরটা ভেঙে পড়া, ছাদের কোথাও কোথাও ফাটল, ধুলোয় ঢাকা কাঠের আলমারি। গণেশ ফিসফিস করে বললেন, “এই আলমারির ভেতরে অনেক পুরনো নথি আছে। সাহেবদের রেকর্ড, মৃত্যুর খতিয়ান—সব এখানে রাখা।” অরিন্দম হাত বাড়িয়ে ধুলো মুছে ফাইলগুলো খুললেন। কাগজগুলো প্রায় পচে গেছে, তবু অক্ষরগুলো এখনো স্পষ্ট। তিনি ধীরে ধীরে পাতা উল্টাতে লাগলেন। প্রথমে বিভিন্ন নাম, মৃত্যুর তারিখ, কারণ—সব সাধারণ নথির মতো। কিন্তু হঠাৎই তার চোখ আটকে গেল একটি পাতায়। সেখানে ইংরেজি অক্ষরে লেখা: Elizabeth Howard – Drowned in the River Ganges – 1832. অরিন্দমের বুক কেঁপে উঠল। এর নিচে ছোট্ট নোটে লেখা, Circumstances unknown. Suspected suicide. তিনি নথিটা হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। মৌসুমী, যিনি তার সঙ্গেই এসেছিলেন, ফাইলটা পড়ে আঁতকে উঠলেন। “তাহলে গল্পটা সত্যি!” তার চোখে ভয় আর দুঃখ একসঙ্গে ঝরে পড়ছিল। গণেশ পাল ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ বাবু, সত্যিই ঘটেছিল। কাগজ আছে, ইতিহাস আছে। কিন্তু তার আত্মার শান্তি নেই। তাই এখনো মাঝরাতে সে ভেসে ওঠে গঙ্গার বুক থেকে।”
অরিন্দম মল্লিক, বয়স উনত্রিশ, কলকাতার এক বেসরকারি সংবাদপত্রে ফিচার সাংবাদিক। সাধারণ রাজনীতি বা খেলার খবরে তার তেমন আগ্রহ নেই; বরং শহরের অলিগলি জুড়ে ছড়িয়ে থাকা রহস্য, লোককথা আর অদ্ভুতুড়ে ঘটনার সূত্র খুঁজে বের করাই তার নেশা। তার ফ্ল্যাট কলেজ স্ট্রিটের কাছেই, বইয়ের গন্ধমাখা সেই পাড়াতেই তার বেড়ে ওঠা। ছোট থেকেই ইতিহাস আর গল্পের প্রতি ঝোঁক ছিল, আর তাই সাংবাদিকতায় নামার পর শহরের অচেনা অচিন্তনীয় দিকগুলোকে তুলে ধরতে চেয়েছেন পাঠকের সামনে। গঙ্গার ধারে গোরস্থানের গুজব তার কানে আসার পর থেকেই তার মনে কৌতূহলের ঢেউ উঠেছিল। হরিপদ মাঝির ভয়ার্ত বর্ণনা, নদীর ধারের নীরবতা আর পুরনো ব্রিটিশ সমাধিগুলোর আবহ মিলিয়ে অরিন্দম যেন এক অদৃশ্য ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারলেন না। তার মনে হলো—এখানে হয়তো কোনো অতিপ্রাকৃত রহস্য আছে, আবার হয়তো সবই মানুষের কল্পনা, ভয়ের জন্ম দেওয়া প্রতারণা। সাংবাদিক হিসেবে তার দায়িত্ব হলো সত্যিটা খুঁজে বের করা। রাত জেগে ল্যাপটপে পুরনো আর্কাইভ ঘেঁটে তিনি খুঁজতে শুরু করলেন ব্রিটিশ আমলের পত্রিকা, যেখানে হয়তো পাওয়া যাবে গঙ্গায় ডুবে যাওয়া কোনো মহিলার খবর। যতই পড়ছিলেন, ততই তার মনে হচ্ছিল, রহস্যের ভেতরে ডুব না দিলে এই কাহিনি কেবল লোককথাই থেকে যাবে, প্রমাণহীন এক ভয়ের গল্প।
এই তদন্তে একা নামতে চাননি অরিন্দম। তাই তিনি যোগাযোগ করলেন মৌসুমী সেনের সঙ্গে—একই অফিসে কাজ করেন, বয়স ছাব্বিশ, আধুনিক, দৃঢ়চেতা তরুণী। মৌসুমী বিশেষভাবে কাজ করেন শহরের সংস্কৃতি ও আর্টস সংক্রান্ত বিষয়ে, তবে অরিন্দমের মতোই তার মধ্যেও অজানাকে জানার অদম্য ইচ্ছা আছে। অফিস শেষে কফিহাউসের এক কোণে বসে অরিন্দম যখন তাকে গঙ্গার ধারের ভূতের গল্প শুনালেন, প্রথমে মৌসুমী হেসে উঠলেন। “ভূতপ্রেতের গল্প লিখবে তুমি? পাঠক হাসবে, ভয় পাবে না,” বলেই তিনি কফির কাপ নামালেন। কিন্তু অরিন্দম হাল ছাড়লেন না। তিনি শান্ত গলায় বললেন, “তুমি ভাবছ এটা শুধু ভূতের গল্প, কিন্তু যদি এর পেছনে কোনো বাস্তব ঘটনা থাকে? যদি কোনো নারী সত্যিই গঙ্গায় ডুবে মারা যায়, আর তার কাহিনি এভাবে লোকমুখে রয়ে যায়? সেটাই খুঁজে বের করা দরকার।” মৌসুমী এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে গেলেন। তার চোখে পড়ল অরিন্দমের অদ্ভুত আগ্রহ, যে আগ্রহ কেবল পেশাগত নয়, বরং একধরনের ব্যক্তিগত টান। কিছুক্ষণ পর তিনি হেসে বললেন, “ঠিক আছে, তবে প্রমাণ ছাড়া কিছু লিখবে না। আমি তোমার সঙ্গে যাব, কিন্তু শর্ত হলো—যা পাবো, তা যুক্তি দিয়ে খতিয়ে দেখতে হবে। ভূতের পেছনে চোখ বুজে বিশ্বাস নয়।” এই চুক্তির মধ্য দিয়েই শুরু হলো তাদের যৌথ যাত্রা—এক রহস্য অনুসন্ধানের পথে, যেখানে যুক্তি আর ভয়ের টানাপোড়েন চলবে পাশাপাশি।
অরিন্দম ও মৌসুমীর এই সিদ্ধান্ত যেন তাদের চারপাশের পরিবেশকেই নতুন করে বদলে দিল। অফিস শেষে রাতের বেলা তারা ল্যাপটপে পুরোনো সংবাদকাগজ ঘাঁটতে লাগলেন, নোট নিলেন কবরস্থানের অবস্থান, সেখানে কারা কবরস্থ হয়েছে, কোন সময় থেকে এর অস্তিত্ব। একদিন গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে তারা দু’জন নিজের চোখে জায়গাটা দেখলেন—ঝোপঝাড়ে ঢাকা, আধভাঙা সমাধি, আর নদীর জল কবরের গা ঘেঁষে বয়ে চলেছে। মৌসুমী ফিসফিস করে বললেন, “এই জায়গাটা সত্যিই অদ্ভুত। দিনের আলোয়ও এক অস্বস্তি কাজ করছে।” অরিন্দম সিগারেট ধরিয়ে বললেন, “এই অস্বস্তির ভেতরেই আছে গল্পের মূল। ভয় কেবল কল্পনা নয়, কোনো না কোনো বাস্তব ঘটনাই তার জন্ম দেয়।” মৌসুমী ক্যামেরা বের করে কয়েকটা ছবি তুললেন, আর ঠিক তখনই অরিন্দম লক্ষ্য করলেন—জলের ওপরে ঘন কুয়াশা জমছে, যদিও তখন গ্রীষ্মকাল, এমন কুয়াশা হওয়ার কথা নয়। মৌসুমীও থমকে গেলেন। হয়তো সেটা ছিল নিছক প্রাকৃতিক ঘটনা, কিন্তু তাদের দু’জনের ভেতরে একসঙ্গে কৌতূহল আর শঙ্কা জেগে উঠল। তারা বুঝে গেলেন, এ কেবল গল্প নয়, বরং এমন এক যাত্রার শুরু যেখানে তাদের সাহস, যুক্তিবাদিতা আর সাংবাদিকতা—সবকিছুকেই পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে।
নথির পাতায় চোখ রেখে অরিন্দমের মনে যেন এক অদ্ভুত ছবির খেলা শুরু হলো। তিনি যেন দেখতে পেলেন—এক ইংরেজ মহিলার মুখ, চোখে জল, ঠোঁটে ব্যথার নীরবতা। চারপাশে গঙ্গার কালো ঢেউ, আর সেই অন্ধকারে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছেন তিনি। সাংবাদিক হিসেবে অরিন্দমের উত্তেজনা বেড়ে গেল। এটা শুধু ভূতের গল্প নয়, বরং এক অসমাপ্ত প্রেমের ইতিহাস, এক নারীর দুঃখভরা আত্মত্যাগ। তিনি মৌসুমীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “এটাই প্রমাণ। এখন আমরা জানি, কেবল ভ্রম নয়—এখানে সত্যিই এক কাহিনি আছে। আর সেই কাহিনি আজও অসমাপ্ত থেকে গেছে।” মৌসুমীর চোখ ভিজে উঠেছিল। তিনি ধীরে গলায় বললেন, “হয়তো সেই অসমাপ্ত কাহিনি থেকেই জন্ম নিয়েছে এই অশান্ত আত্মা। যতদিন না কেউ তাকে শান্তি দেবে, সে ততদিন গঙ্গার বুক থেকে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে।” গণেশ পাল নিঃশব্দে লণ্ঠন উঁচু করলেন, আর আলোয় প্রতিফলিত হলো ভাঙা সমাধি, ভিজে মাটি, আর ইতিহাসের নিঃশ্বাস। অরিন্দম জানলেন, তার সামনে এখন এক নতুন দায়িত্ব—শুধু প্রমাণ নয়, সত্যিকারের গল্পটাকে মানুষের সামনে আনা। কারণ প্রতিটি কাহিনি, যতই করুণ হোক না কেন, তার একটা শেষ থাকা উচিত। কিন্তু এলিজাবেথের গল্পের শেষ এখনো লেখা হয়নি।
৭
দ্বিতীয় রাতের প্রস্তুতি ছিল আগের চেয়ে অনেক বেশি গম্ভীর ও সযত্নে পরিকল্পিত। অরিন্দম এবার শুধুমাত্র সাংবাদিক নন, বরং এক অনুসন্ধানকারী হয়ে উঠেছিলেন। সঙ্গে আনলেন অতিরিক্ত ব্যাটারি, টর্চলাইট, ভিডিও ক্যামেরা, ভয়েস রেকর্ডার, এমনকি মোবাইলের লাইভ স্ট্রিমিং-এর সুবিধাও ঠিক করে রাখলেন, যাতে কিছু ঘটলে তা অস্বীকার করার উপায় না থাকে। মৌসুমীও এবার মানসিকভাবে কিছুটা প্রস্তুত হলেও চোখেমুখে ভয় লুকোতে পারছিলেন না। তিনি একটা ছোট্ট প্রার্থনার বই সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন, যা গোপনে ব্যাগের ভেতরে রাখলেন। হরিপদ মাঝি প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না, আগের রাতের অভিজ্ঞতায় তার মন ভরে উঠেছিল আতঙ্কে। কিন্তু অনেক বোঝানোর পর, আর কিছুটা টাকার প্রলোভনে, তিনি আবার রাজি হলেন। রাত নামতেই তারা তিনজন নৌকা নিয়ে গঙ্গার বুকের দিকে যাত্রা শুরু করলেন। চারপাশে কুয়াশার আস্তরণ নেমে এসেছে, যেন নদীটা নিজেই গোপন করতে চাইছে তার বুকের গভীর রহস্য। অরিন্দম হাতের ক্যামেরা চালু করলেন, আর মৌসুমী চোখে অদ্ভুত এক উদ্বেগ নিয়ে তাকিয়ে রইলেন। বাতাস ঠান্ডা হয়ে আসছিল, গায়ে হালকা কাঁপুনি ধরছিল। গঙ্গার ঢেউগুলো যেন তাদের নৌকাকে এক অচেনা দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।
ঠিক যখন তারা কবরস্থানের ঘাটের কাছাকাছি পৌঁছালেন, হঠাৎ নৌকাটা যেন নিজের ইচ্ছেতে থেমে গেল। হরিপদ মাঝি প্রাণপণ বৈঠা চালানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু বৈঠা যেন অদৃশ্য শক্তির কবলে পড়ে গিয়েছে। অরিন্দম ভ্রূ কুঁচকে দেখলেন—নৌকার নিচ থেকে যেন টান পড়ছে। জল ঘূর্ণি খেয়ে উঠছে, আর তলার কাঠগুলো কেঁপে উঠছে যেন কেউ নিচ থেকে চাপ দিচ্ছে। হরিপদ ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “বাবু, নৌকা নামাও, এই জায়গা ভাল না। এই নদী খেতে চাইছে।” তার কণ্ঠে আতঙ্কের ছাপ এতটাই গভীর ছিল যে মৌসুমী আঁতকে উঠলেন। তিনি নৌকার এক পাশে বসে টর্চ জ্বালালেন। আর সেই আলোতেই দৃশ্যমান হলো এক শিহরণ জাগানো মুহূর্ত—নৌকার ধারে ভিজে সাদা হাত, পাতলা, হাড় বের হওয়া আঙুলগুলো জলের উপর থেকে উঠে এসেছে, যেন নৌকাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে। মুহূর্তের মধ্যে মৌসুমী চিৎকার করে উঠলেন, হাত থেকে টর্চ ছিটকে পড়ল জলে। তার চোখে স্পষ্ট আতঙ্ক, ঠোঁট কাঁপছে, শরীর কেঁপে উঠছে। অরিন্দম তাড়াহুড়ো করে ক্যামেরা ধরলেন, কিন্তু হাত সামান্য কাঁপছিল। তার ভেতরে সাংবাদিকতার কৌতূহল আর মানবিক ভয়, দুইয়ের দ্বন্দ্ব চলছিল। একদিকে তিনি এই অদ্ভুত দৃশ্য ধারণ করতে চান, অন্যদিকে বুঝতে পারছিলেন এ এমন কিছু, যা মানুষের বোঝার ক্ষমতার বাইরে।
মৌসুমীর চোখে জল চলে এলো। তিনি প্রার্থনার বইটা আঁকড়ে ধরে ফিসফিস করে কিছু উচ্চারণ করতে লাগলেন। হরিপদ তখন প্রাণপণ চেষ্টা করছেন বৈঠা চালিয়ে নৌকাটাকে ঘুরিয়ে নিতে, কিন্তু বৈঠা যেন বারবার জলে আটকে যাচ্ছে। নদীর বুক থেকে আবারও ভেসে উঠল সাদা পোশাকের এক অবয়ব। চুল ভিজে কপালে লেপ্টে আছে, মুখ ফ্যাকাশে, চোখ দুটো গভীর অন্ধকারের মতো শূন্য। সেই অবয়বের হাত ধীরে ধীরে নৌকার ধারে বেয়ে উঠছিল, যেন এক মুহূর্তেই ভেতরে উঠে আসবে। মৌসুমীর গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল, তিনি কেঁদে ফেললেন, “অরিন্দম, আমি আর পারছি না। আমাদের এখান থেকে চলে যেতে হবে।” কিন্তু অরিন্দম, ভয়ের মাঝেও, এক অদ্ভুত টান অনুভব করছিলেন। ক্যামেরার লেন্সে তিনি তাকালেন, আর লাল রেকর্ডিং আলো জ্বলতে লাগল। তার মনে হলো—যদি সত্যিই এ আত্মা হয়, তবে এটাই ইতিহাসের প্রমাণ হয়ে থাকবে। কিন্তু একই সঙ্গে শরীরের প্রতিটি স্নায়ু যেন চিৎকার করে উঠছিল—এখান থেকে পালাও, নইলে বিপদ আসবে। হরিপদ অবশেষে অমানুষিক শক্তি দিয়ে বৈঠা চালাতে শুরু করলেন। নৌকা ধীরে ধীরে পিছোতে লাগল, আর নদীর বুকের সেই সাদা অবয়ব কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে গেল। চারপাশ আবার অন্ধকার আর নিরবতায় ঢেকে গেল, কেবল মৌসুমীর কান্না আর দম বন্ধ করা ভয় ভাসছিল গঙ্গার বাতাসে। অরিন্দম তখনো নিঃশব্দে ক্যামেরার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন, আর ভেতরে ভেতরে অনুভব করলেন—আজকের রাতের ভয় শুধু শুরু, এর পেছনে আরও গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে।
৮
সেই রাতের ভয় কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই অরিন্দমের ভেতরে এক অদ্ভুত শক্তি কাজ করতে শুরু করেছিল। তিনি জানতেন—যতক্ষণ না সত্যটা প্রকাশ পাচ্ছে, ততক্ষণ এই অভিজ্ঞতা শুধু অর্ধেক গল্প হয়েই থেকে যাবে। তাই আবারও তিনি মৌসুমীকে সঙ্গে নিয়ে নদীর ধারে এলেন, যদিও মৌসুমীর চোখেমুখে স্পষ্ট অনিচ্ছা ছিল। কুয়াশা সেদিন আরও ঘন হয়ে নেমেছিল, নদীর জলে চাঁদের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছিল না, বরং এক অদ্ভুত অন্ধকার যেন চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছিল। হরিপদ মাঝি এবার আর আসেননি; তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, “বাবু, ওই রাতে যা দেখেছি, আর কোনোদিনও সেখানে যাব না।” তাই অরিন্দম নিজেই বৈঠা হাতে তুলে নিলেন। মৌসুমী এক কোণে বসে নিঃশব্দে কেঁপে উঠছিলেন। নৌকা যতই কবরস্থানের ঘাটের দিকে এগোতে লাগল, চারপাশের বাতাস ভারী হতে লাগল, যেন নদী ও মৃতদের আত্মা মিলে একটা অদৃশ্য বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। তখনই হঠাৎ জলের ঢেউ অস্বাভাবিকভাবে কেঁপে উঠল, আর সাদা পোশাকের সেই অবয়ব স্পষ্ট হয়ে উঠল। এবার আর কেবল অস্পষ্ট ছায়া নয়—অরিন্দম স্পষ্ট দেখলেন এক ইংরেজ মহিলার মুখ, যার চোখ দুটি শূন্য অথচ ব্যথায় ভরা, ঠোঁটে হালকা নীরব চিৎকার যেন চেপে আছে।
অরিন্দমের বুকের ভেতর শীতল স্রোত বয়ে গেল, কিন্তু তিনি নিজেকে সামলে নিলেন। ভয়ের তাড়নায় নৌকা ঘুরিয়ে পালিয়ে যাওয়া নয়, তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন মুখোমুখি দাঁড়ানোর। ঠাণ্ডা মাথায় কাঁপতে কাঁপতে তিনি বললেন, “এলিজাবেথ… যদি সত্যিই তুমি থাকো, তাহলে আমাকে শোনো। আমি শত্রু নই, আমি কেবল জানতে চাই তোমার ব্যথার কাহিনি।” মুহূর্তের জন্য নদীর বুক নিস্তব্ধ হয়ে গেল, কেবল বৈঠার শব্দ থেমে গেল। সেই সাদা অবয়ব যেন সামনের দিকে এগিয়ে এল, তার চোখ দুটি অরিন্দমের চোখের গভীরে তাকিয়ে রইল। মৌসুমী আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল, কিন্তু অরিন্দম তাকে শান্ত করলেন, “ভয় পেও না, আমি আছি।” হঠাৎ সেই মুহূর্তে নদীর জল ঘোলা হয়ে গেল, যেন তলার কাদা ওপরে উঠে আসছে। জলের ভেতর থেকে উঠতে লাগল অদ্ভুত বুদ্বুদ, আর তার সঙ্গে মিলিয়ে ভেসে এলো এক শিহরণ জাগানো শব্দ—না কোলাহল, না সঙ্গীত, বরং এক মৃত আত্মার আর্তনাদ, যা একইসঙ্গে কান্না আর আহ্বান। নৌকার ধারে হাত রেখে সেই আত্মা যেন ডাক দিচ্ছিল অরিন্দমকে—“এসো… এসো…”। তার ভেতরে এক অদ্ভুত টান অনুভূত হচ্ছিল, যেন সত্যিই সে নদীর গভীরে নেমে যেতে চাইছে।
অরিন্দম প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন সেই টান প্রতিহত করতে। তার মনে হচ্ছিল, যদি একবার ভেসে যান, তবে আর কখনো ফেরা হবে না। তিনি শক্ত গলায় বললেন, “তুমি শান্তি পাওনি, কিন্তু তোমার কাহিনি আমরা জেনেছি। তোমার ব্যথা আমরা প্রকাশ করব, মানুষ জানবে তোমার কথা।” যেন কথাগুলো বাতাসে প্রতিধ্বনিত হলো। অবয়বটি সামান্য থেমে গেল, তার চোখের দৃষ্টি কোমল হলো এক মুহূর্তের জন্য। মৌসুমী, যিনি আতঙ্কে প্রার্থনার বই আঁকড়ে ধরেছিলেন, হঠাৎ সাহস জুগিয়ে উচ্চস্বরে প্রার্থনা পড়তে লাগলেন। সেই শব্দ গঙ্গার অন্ধকার ভেদ করে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল, আর ঘোলা জল ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলো। অদ্ভুত শব্দটি স্তিমিত হয়ে মিলিয়ে গেল রাতের নীরবতায়। অরিন্দম দেখলেন, সাদা অবয়বটি ধীরে ধীরে নদীর ঢেউয়ের মধ্যে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। যেন সে কোনো এক অদৃশ্য বাঁধন থেকে মুক্তি পেল। মৌসুমী কান্নাভেজা চোখে ফিসফিস করে বললেন, “তুমি কি দেখলে? ও কি সত্যিই শান্তি পেল?” অরিন্দম নিঃশ্বাস ফেলে উত্তর দিলেন, “হয়তো। অথবা হয়তো আমাদের বলা কথাগুলো ওর ভেতরের ব্যথাকে স্পর্শ করেছে।” নদী আবার তার স্বাভাবিক ঢেউয়ে ফিরে এল, কেবল রাতের কুয়াশার পর্দা এখনো ভাসছিল। অরিন্দম জানলেন, তারা আজ এক অসম্ভব অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়েছেন—যেখানে মানুষ আর অতৃপ্ত আত্মার মাঝখানে কথা বিনিময় হলো, আর সেখানে জন্ম নিল এক মুক্তির অনুভূতি।
৯
নদীর বুকের সেই অদ্ভুত রাত শেষ হওয়ার পরও অরিন্দমের শরীর যেন অদৃশ্য কারও শক্তিতে টেনে নামাতে চাইছিল। তিনি যদি মৌসুমীর হাত শক্ত করে না ধরতেন, তবে হয়তো নদীর অন্ধকার গহ্বরে চিরতরে হারিয়ে যেতেন। মৌসুমীর হাতদুটো তাকে আঁকড়ে ধরেছিল মৃত্যুভয়ে কাঁপতে থাকা মানুষের মতো, তার চোখে আতঙ্কের স্রোত বয়ে যাচ্ছিল, অথচ সেই ভয়ই অরিন্দমকে বাঁচিয়ে দিল। তিনি অনুভব করলেন, কেবল নিজের সাহস নয়, আরেকজনের বিশ্বাসই তাকে জীবিত ফিরিয়ে আনল। অবশেষে তারা কোনোভাবে নৌকা নিয়ে ঘাটে ফিরতে পারলেন, দুজনেই হাঁপাচ্ছিলেন, শরীর জলে ভিজে গেছে, ঠাণ্ডা কাঁপুনি দিচ্ছে। কিন্তু ভেতরে এক অদ্ভুত উপলব্ধি কাজ করছিল—তাদের সামনে কিছু অসাধারণ ঘটেছে, যা কেবল লোককথা নয়, বাস্তব। অরিন্দম নৌকার তলা থেকে ক্যামেরা আর ভয়েস রেকর্ডার বের করলেন। ব্যাটারি প্রায় শেষ হয়ে এলেও যন্ত্রগুলো এখনো চালু ছিল। ক্যামেরার স্ক্রিনে দেখা গেল বারবার সাদা আলোর ঝলক, যেন কেউ হঠাৎ ক্যামেরার সামনে দিয়ে গিয়েছিল। ভয়েস রেকর্ডারে শোনা গেল অস্পষ্ট কিছু শব্দ—কখনো ফিসফিসানি, কখনো দীর্ঘশ্বাস, আবার কখনো এক অদ্ভুত চিৎকারের মতো শব্দ। মৌসুমীর শরীর শিউরে উঠল, তিনি কাঁপা গলায় বললেন, “অরিন্দম, এগুলো সত্যিই আমাদের সঙ্গে ঘটেছিল… এটা কি প্রমাণ?” অরিন্দম নীরব রইলেন, কিন্তু তার চোখে সেই উত্তেজনা ফুটে উঠেছিল যা কেবল একজন অনুসন্ধানীর চোখেই দেখা যায়।
পরের দিন সকালে তারা আবার গোরস্থানে গেলেন। সূর্যের আলোয় জায়গাটা আগের রাতের ভৌতিক ছায়া হারিয়েছে, কিন্তু এখনো চারপাশে এক অদ্ভুত শূন্যতা যেন ভাসছিল। সেখানে বসে ছিলেন কবররক্ষক গণেশ পাল। তিনি তাদের দেখে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন, যেন আগেই সব জানেন। অরিন্দম তাকে ক্যামেরা আর রেকর্ডারের প্রমাণ দেখালেন। গণেশ পাল গভীর মনোযোগ দিয়ে স্ক্রিনের ঝলক আর কণ্ঠের অস্পষ্ট শব্দ শুনলেন। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ, আমি জানতাম একদিন তোমরা এর মুখোমুখি হবেই। ও শুধু ভয়ের ছায়া নয়, ওর ভেতরে একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা আছে—মুক্তি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। এলিজাবেথের আত্মা কবরের মাটি থেকে নয়, নদীর বুক থেকেই ডাক দেয়, কারণ সেখানেই সে শেষ নিশ্বাস নিয়েছিল।” মৌসুমী বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বললেন, “কিন্তু মুক্তি কেন পাচ্ছে না?” গণেশ পাল হালকা নিঃশ্বাস ফেলে উত্তর দিলেন, “অপূর্ণতা। যাদের মৃত্যু অসমাপ্ত, যাদের কাহিনি অস্বীকৃত থেকে যায়, তারা এভাবে আটকে থাকে। তোমাদের সাহসই হয়তো তার অসমাপ্তি পূর্ণ করবে।” কথাগুলো শুনে মৌসুমীর ভেতর শীতল স্রোত বইয়ে গেল। অরিন্দম শান্তভাবে বললেন, “তাহলে সত্যিই আমাদের দায়িত্ব এটা প্রকাশ করা।”
অরিন্দম আর মৌসুমী দুজনেই তখন উপলব্ধি করলেন, তাদের যাত্রা আর নিছক কৌতূহলের অনুসন্ধান নয়—এখন এটা একপ্রকার দায়বদ্ধতা। তারা যে শব্দ, যে ছবি ধারণ করেছেন, তা প্রমাণ করে দিয়েছে এলিজাবেথের আত্মা শুধু ভয়ের ছায়া নয়, বরং এক অসমাপ্ত কাহিনির প্রতীক। মৌসুমী চোখে জল নিয়ে বললেন, “গতকাল তুমি যদি আমার হাত ছাড়তে, তবে হয়তো আমিও তোমাকে হারাতাম। হয়তো এভাবে সে আরও একটি প্রাণকে তার অন্ধকারে নিয়ে যেত।” অরিন্দম ধীরে মাথা নাড়লেন, “কিন্তু তোমার বিশ্বাসই আমাকে বাঁচিয়েছে। হয়তো এটাই তার মুক্তির চাবিকাঠি—মানুষের ভয় নয়, মানুষের সহানুভূতি।” গণেশ পাল তখন মৃদুস্বরে যোগ করলেন, “যতদিন তার নাম, তার কাহিনি, তার ব্যথা পৃথিবীতে বলা হবে, ততদিন তার আত্মা ধীরে ধীরে মুক্তির আলো পাবে।” চারপাশের বাতাসে এক নিস্তব্ধতা নেমে এলো। যেন কবরস্থান নিজেই তাদের কথার সাক্ষী। অরিন্দম গভীরভাবে বুঝলেন—এটাই সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানো, যেখানে অতীতের এক আত্মা আর বর্তমানের দুই জীবিত মানুষের ভাগ্য মিলেমিশে যায়। তাদের সামনে অপেক্ষা করছে শেষ পদক্ষেপ—কিভাবে সেই কাহিনিকে সবার সামনে তুলে ধরা যায়।
১০
শেষ রাত। আকাশজুড়ে ঘন অন্ধকার, কেবল মাঝে মাঝে শিয়ালের ডাক ভেসে আসছে দূরের ঝোপঝাড় থেকে। অরিন্দম এক হাতে মোমবাতি আর অন্য হাতে ছোট্ট ফুলের তোড়া নিয়ে প্রবেশ করলেন কবরস্থানের ভেতর। ভেজা ঘাসের গন্ধ, পুরনো শ্যাওলা জমা সমাধিফলক, আর বাতাসে ভেসে বেড়ানো এক অদ্ভুত ঠাণ্ডা শিরশিরানি তাকে ঘিরে ধরেছিল। মৌসুমী ধীরে ধীরে তার পাশে এসে দাঁড়ালেন, হাতে একটি প্রার্থনার বই। তারা একসঙ্গে এগোতে লাগলেন সেই নির্দিষ্ট কবরের দিকে, যেখানে গণেশ পাল তাদের দেখিয়েছিলেন এলিজাবেথের নাম খোদাই করা। অরিন্দমের হৃদয় জোরে জোরে ধকধক করছিল—কেন যেন মনে হচ্ছিল, তিনি এক অদৃশ্য সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কবরের সামনে এসে তিনি হাঁটু গেড়ে বসলেন, আর সতর্ক হাতে মোমবাতি জ্বালালেন। হলদে আলোয় সমাধিফলকের পুরনো অক্ষরগুলো জীবন্ত হয়ে উঠল—“Elizabeth, 1832”। মুহূর্তে মনে হলো যেন তিনি আর মৌসুমী শুধু কবরের সামনে নন, বরং এক অসমাপ্ত কাহিনির মাঝখানে বসে আছেন। বাতাস হালকা দুলে উঠল, মোমবাতির শিখা দপদপ করে কেঁপে উঠল, যেন অদৃশ্য কেউ তাকিয়ে আছে। অরিন্দম নরম স্বরে ফিসফিস করে বললেন, “আমরা তোমার কথা বলব, তোমার গল্প সবাই জানবে।”
মৌসুমী তখন চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা শুরু করলেন। তার কণ্ঠে কোনো পেশাদার ভক্তির সুর ছিল না, বরং ছিল এক আন্তরিকতা—এক নারীর প্রতি আরেক নারীর সহানুভূতি। তিনি বললেন, “হে অদৃশ্য আত্মা, যদি তুমি কোথাও থাকো, তবে শান্তি পাও। তোমার অসমাপ্ত কাহিনি আজ থেকে আর অজানা রইল না।” তার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল সমাধির মাটিতে, মোমবাতির আলোর সঙ্গে মিশে তৈরি করল এক অলৌকিক দৃশ্য। অরিন্দম অনুভব করলেন, বাতাসের ভারীতা ধীরে ধীরে কমছে। কোনো কান্নার সুর শোনা যাচ্ছে না, কোনো অদ্ভুত টান অনুভূত হচ্ছে না। যেন চারপাশে এক নিস্তব্ধ প্রশান্তি নেমে এসেছে। দুজনেই কিছুক্ষণ নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। সময় থমকে গেছে, কেবল মোমবাতির আলো আর মৌসুমীর প্রার্থনার সুর ভেসে আসছে। দূরে কোথাও রাতচরা পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ শোনা গেল, কিন্তু সেটা আর ভয় জাগাল না। বরং মনে হলো প্রকৃতি নিজেই সাক্ষী হয়ে আছে এই মুক্তির প্রক্রিয়ার। অরিন্দম জানলেন, এলিজাবেথের আত্মা হয়তো অবশেষে মানুষের কণ্ঠ থেকে সহানুভূতি পেয়েছে, যা এত বছর সে খুঁজছিল।
যখন প্রথম ভোরের আলো ধীরে ধীরে আকাশ ছুঁল, গঙ্গার জলে এক অদ্ভুত শান্তি ছড়িয়ে পড়ল। আর কোনো ঢেউয়ের অস্থিরতা নেই, আর কোনো অস্বাভাবিক কুয়াশার পর্দা নেই। নদী যেন নিজেই নিঃশ্বাস ফেলছে এক গভীর প্রশান্তির। মৌসুমী মৃদু হেসে বললেন, “দেখো, আজ গঙ্গা কেমন শান্ত।” অরিন্দম আকাশের দিকে তাকালেন, যেখানে হালকা সোনালি আলো ভেসে উঠছে। তিনি অনুভব করলেন, হয়তো সত্যিই আত্মা শান্তি পেয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে তার ভেতরে এক প্রশ্ন রয়ে গেল—যদি আত্মারা কখনো পুরোপুরি মুক্ত না হয়? যদি তারা চিরকাল কুয়াশার ভেতর থেকে নদীর ডাক শোনায়? তিনি সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলেন না, কারণ কিছু রহস্য হয়তো চিরকাল রহস্যই থেকে যাওয়ার জন্য। তারা দুজন নীরব দাঁড়িয়ে রইলেন, গঙ্গার ধারে, যেখানে শতবর্ষের ইতিহাস, মৃত্যু, ব্যথা আর মুক্তির গল্প মিলেমিশে একাকার হয়েছে। মোমবাতি ধীরে ধীরে নিভে গেল, ভোরের হাওয়া তার আলোকে গ্রাস করল। কিন্তু সেই আলোই যেন থেকে গেল তাদের হৃদয়ে—একটি অসমাপ্ত কাহিনির পূর্ণতার প্রতীক হয়ে। আর পাঠকের মনে রয়ে গেল সেই প্রশ্ন—এলিজাবেথ কি সত্যিই শান্তি পেলেন, নাকি তিনি আজও কুয়াশার মধ্যে ভেসে থাকবেন? নদী উত্তর দিল না। শুধু রেখে গেল গঙ্গার ধারে এক গভীর নীরবতা।
সমাপ্ত




