Bangla - রহস্য গল্প

গঙ্গার ধারে খুন

Spread the love

দেবমাল্য গুপ্ত


ভোরবেলা গঙ্গার ঘাট সবসময়ই যেন অদ্ভুতভাবে রহস্যময় হয়ে ওঠে। শীতল হাওয়া জলের গায়ে তরঙ্গ তুলে দিচ্ছিল, দূরে পুরোনো মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসছিল কুয়াশার আড়ালে, আর ঘাটে কিছু ভোরের সাধক গঙ্গাস্নানে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু সেই নিরিবিলি সকালে হঠাৎই এক চিৎকার ভেদ করে গেল চারপাশের নীরবতা। একজন মাঝি প্রথমে জলে ভাসতে থাকা অচেনা দেহটি দেখতে পায় এবং দৌড়ে লোক ডাকতে শুরু করে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই গঙ্গার ঘাটে ভিড় জমে যায়। সবাই শিউরে উঠল, কারণ দেহটি একেবারে অচেনা কারো নয়—চেনা শহরেরই একজন, ব্যবসায়ী বিশ্বজিৎ লাহিড়ী। মানুষটি গতকাল রাত পর্যন্ত শহরে দোকানে বসেছিলেন, এমনকি অনেকেই তাকে দেখেছে স্থানীয় ক্লাবে। অথচ আজ সকালে সেই মানুষটি নিথর দেহ হয়ে গঙ্গার জলে ভাসছে। লোকজনের ফিসফাস চলতে লাগল—কে জানে, হয়তো তিনি নিজেই প্রাণ দিয়েছেন, হয়তো কোনো দুর্ঘটনা। কিন্তু দেহ তোলার পরেই সবাই দেখল, মৃতের হাতে লালচে কালি দিয়ে আঁকা আছে অদ্ভুত এক প্রতীক—অর্ধচন্দ্রের মতো বাঁকা, তার মাঝখানে ত্রিভুজ, আর চারপাশে কিছু অচেনা দাগ। স্থানীয়রা কেউই এর মানে বুঝতে পারল না, তবে সেই প্রতীক যেন হাড় পর্যন্ত শীতল করে দিল ভিড়ের প্রতিটি মানুষকে।

খবর পৌঁছাতেই থানার গাড়ি এসে দাঁড়াল, সঙ্গে ইন্সপেক্টর অরিজিৎ সেন। চশমার কাঁচে ভোরের আলো ঝলসে উঠছিল, মুখে এক ধরনের গম্ভীরতা যা তার স্বভাবের সঙ্গে মানানসই। অরিজিৎ প্রথমে দেহটি পরীক্ষা করলেন, চারপাশের লোকদের থেকে তথ্য নিলেন। অনেকের মতামত—এটি আত্মহত্যা, কারণ ব্যবসায়ীর আর্থিক অবস্থা নাকি ভালো যাচ্ছিল না। কিন্তু অরিজিৎ বিষয়টিকে সেভাবে নিতে পারলেন না। তার বহু বছরের অভিজ্ঞতা বলে দিয়েছে—দেহের নিস্তব্ধতা সবসময় নিজের গল্প বলে। আর বিশ্বজিৎ লাহিড়ীর দেহও ঠিক তেমনই কিছু ফিসফিস করে যাচ্ছিল। তার মুখে অদ্ভুত শূন্যতা, ঠোঁটের কোণে জমে থাকা রক্তের দাগ, আর সবচেয়ে বড় কথা, হাতে আঁকা প্রতীক। কোনো মানুষ নিজের হাতে ওইভাবে প্রতীক এঁকে আত্মহত্যা করবে, এমনটা তার মনে হল অস্বাভাবিক। ঘাটের পাশে ভিড় জমে উঠছিল, কেউ আবার আঙুল তুলে বলছিল—এটা নাকি কালো জাদুর চিহ্ন, আবার কেউ বলছিল—কোনো পুরনো শত্রুর অভিশাপ। অরিজিৎ এসব কুসংস্কার সরিয়ে রেখে যুক্তির দিকেই মন দিতে চাইলেন। দেহটি ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন এবং চারপাশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন কোনো সূত্র পড়ে আছে কিনা। কিন্তু ঘাট ছিল একেবারেই পরিষ্কার—শুধু জলের গায়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাওয়া রক্তের হালকা ছোপ, আর বাতাসে ছড়িয়ে থাকা গঙ্গার কাঁপা গন্ধ।

পুলিশের গাড়ি চলে যাওয়ার পরও ভিড় ছত্রভঙ্গ হতে চাইছিল না। লোকজনের মনে ভয়ের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল কৌতূহল। অনেকেই আবার নিজেদের মতো করে গল্প বানাতে শুরু করল—কেউ বলল ব্যবসায়ীর প্রেমঘটিত সমস্যা ছিল, কেউ বলল কাল রাতে ঝগড়ার আওয়াজ শোনা গিয়েছিল। কিন্তু অরিজিৎ এসব কথার প্রতি মনোযোগ না দিয়ে নিজের ডায়েরিতে কয়েকটি প্রশ্ন লিখে নিলেন—এক, মৃতের হাতে আঁকা প্রতীকের অর্থ কী? দুই, সত্যিই যদি আত্মহত্যা হয় তবে কেন এরকম প্রতীক আঁকতে হবে? তিন, ঘাটের চারপাশে কোনো প্রত্যক্ষদর্শী কিছু অস্বাভাবিক লক্ষ্য করেনি কেন? তার মনে হচ্ছিল, এই কেস এতটা সহজ নয়, এর পেছনে কোনো অজানা অন্ধকার লুকিয়ে আছে। ভোরের কুয়াশা তখনো ঘাটের সিঁড়িতে বসে থাকা মানুষের চেহারা ঢেকে রেখেছিল, যেন প্রকৃতি নিজেও সত্যকে গোপন রাখতে চাইছে। গঙ্গার ঢেউ ভেসে যাচ্ছিল নির্দ্বিধায়, যেন মানবজীবনের মৃত্যু, রহস্য আর ভয়কে উপহাস করছে। অরিজিৎ গাড়ির ভেতরে বসে ঘাটের দিকে শেষবার তাকালেন—তার মনে হল, আজ থেকে শুরু হচ্ছে এমন এক যাত্রা যা তাকে নিয়ে যাবে অচেনা, অদ্ভুত আর ভয়ঙ্কর এক পথে, যেখানে যুক্তি ও অন্ধকার হাত ধরাধরি করে চলে।

পুলিশি তল্লাশির পর অবশেষে জানা গেল, গঙ্গার ঘাটে ভেসে ওঠা মৃতদেহটি বিশ্বজিৎ লাহিড়ীর নয়, যেমনটা ভোরে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। ময়নাতদন্তের আগে আঙুলের ছাপ মিলিয়ে ও ব্যক্তিগত জিনিসপত্র দেখে নিশ্চিত হওয়া গেল—তার নাম সৌরভ সেন, বয়স মাত্র আটাশ। সে একটি প্রাইভেট ফার্মে জুনিয়র এক্সিকিউটিভ পদে কর্মরত ছিল, অফিস ছিল শহরের মাঝেই। খবর পৌঁছাতেই থানায় কান্নাকাটি করতে করতে ছুটে এল তার বাবা-মা আর ছোট বোন। বাবা দেবাশিস সেন—অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী, মা গৃহিণী, আর একমাত্র বোন স্নেহা কলেজে পড়ে। তাঁরা বললেন, সৌরভ খুব চুপচাপ প্রকৃতির ছেলে হলেও দায়িত্ববান এবং পরিবারের প্রতি ভীষণ যত্নবান। কয়েকদিন ধরেই সে কিছুটা গম্ভীর হয়ে পড়েছিল, কিন্তু এমন আচমকা আত্মহত্যা করার মতো কিছু তাদের নজরে পড়েনি। মা ভাঙা গলায় বললেন, “ও তো আমাদের বলতেও পারেনি কষ্টটা… যদি কষ্ট থাকত।” বাবার চোখে হতাশা আর ক্রোধ, তিনি বারবার বলছিলেন, “আমার ছেলে আত্মহত্যা করতে পারে না, নিশ্চয়ই ওকে মেরে ফেলা হয়েছে।” বোন স্নেহা কাঁদতে কাঁদতে বলল, তার দাদা কয়েকদিন ধরে রাতে একা বসে মোবাইল নিয়ে কিছু লিখত বা কারো সঙ্গে কথা বলত, কিন্তু সে কিছুই বুঝতে পারেনি। এইসব কথাগুলো শুনতে শুনতে ইন্সপেক্টর অরিজিৎ বুঝলেন, বিষয়টা আরও গভীর ও জটিল। কারো মৃত্যুর কারণ খুঁজতে গেলে পরিবারই প্রথম সূত্র দেয়, কিন্তু পরিবার এখানে স্পষ্ট জানিয়েছে—আত্মহত্যা নয়। তবুও কিছু অদ্ভুততা স্পষ্ট—সৌরভ কি সত্যিই কোনো অজানা সমস্যায় ভুগছিল, না কি বাইরের কেউ তার জীবনে প্রবেশ করেছিল?

তদন্ত এগোতেই সৌরভের মোবাইল উদ্ধার করা হয়, এবং সেটি একেবারেই খালি নয়। কল লিস্টে দেখা গেল, মৃত্যুর আগের রাতে তার ফোনে কয়েকবার অজানা নম্বর থেকে কল এসেছে, কিন্তু সে কলগুলো রিসিভ করা হয়নি। মোট পাঁচটি মিসড কল, সব একই নম্বর থেকে, রাত এগারোটা থেকে সাড়ে বারোটার মধ্যে। ঠিক এই সময়েই তার মৃত্যুর সম্ভাব্য সময়সীমা নির্ধারণ করেছে চিকিৎসকরা। কাকতালীয়ভাবে না হলেও, পুলিশের কাছে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হয়ে উঠল। অরিজিৎ নম্বরটি ট্র্যাক করার নির্দেশ দিলেন, যদিও প্রথমেই জানা গেল এটি একটি প্রিপেইড সিম, যেটি কোনো ভুয়ো ঠিকানায় রেজিস্টার করা। আরেকটি প্রশ্ন মাথায় ঘুরছিল—সৌরভ কেন একবারও সেই কলগুলো রিসিভ করল না? নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে গেল? তার ফোনে কিছু মেসেজও পাওয়া গেল, তবে সেগুলো ডিলিট করা, কেবল মেসেজ রিকভারি টুল ব্যবহার করেই উদ্ধার সম্ভব। কিন্তু একটি ভিন্ন জিনিস নজরে এল—তার ডায়েরির মতো ফোল্ডারে বেশ কয়েকটি নোটস, যেখানে হঠাৎ হঠাৎ লেখা কিছু শব্দ—“অন্ধকার”, “অচেনা ছায়া”, “চিহ্ন”, “ঘাট”—যেন কোনো সংকেত। এই নোটগুলো পুলিশকে আরও বিভ্রান্ত করল, কারণ এগুলো অনেকটাই অসংলগ্ন, অথচ গঙ্গার ঘাটে পাওয়া প্রতীকের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে মিলে যাচ্ছে। সৌরভ কি তবে আগেই কিছু আন্দাজ করেছিল? নাকি সে কোনো রহস্যের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিল যেখান থেকে বেরোনোর চেষ্টা করছিল?

অরিজিৎ সেন পরিবারের সঙ্গে আবার কথা বললেন, বিশেষত স্নেহার সঙ্গে। সে জানাল, দাদা কয়েকদিন ধরে কারো ফোন আসলে বারান্দায় চলে যেত কথা বলতে, আর ফিরে এলে বেশ অস্থির দেখাত। কোনোদিন তার মুখ থেকে স্পষ্ট কিছু বের করা যায়নি। অফিস থেকেও তেমন কিছু জানা গেল না, সহকর্মীরা বলল সৌরভ সবার মতোই কাজ করত, বিশেষ কোনো ঝামেলা কারো সঙ্গে হয়নি। বরং, সে কাজের প্রতি আন্তরিক ছিল, কিন্তু হঠাৎ গত সপ্তাহ থেকে মনোযোগ হারিয়ে ফেলেছিল। এসব টুকরো টুকরো তথ্য জোড়া দিতে গিয়েও অরিজিৎ এক অদ্ভুত শূন্যতায় আটকে গেলেন। কেসের শুরুটা যতটা সরল মনে হয়েছিল, ধীরে ধীরে তা ততটাই রহস্যময় হয়ে উঠছিল। একদিকে হাতে আঁকা প্রতীক, অন্যদিকে মৃতের মোবাইলে রহস্যময় মিসড কল, আর সেই ডায়েরি সদৃশ নোটস—সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল কেউ যেন ইচ্ছে করে সৌরভকে এক ভয়ঙ্কর খেলায় টেনে এনেছিল। পরিবারের অসহায় কান্না আর ঘাটের সকালের কুয়াশা তার মনে গা ছমছমে শীতলতা তৈরি করছিল। তিনি জানতেন, এ মৃত্যু আত্মহত্যা নয়, এর পেছনে আছে এক অদৃশ্য হাত, আর সেই হাতের ছায়া হয়তো এখনো শহরের ভেতরে লুকিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

সৌরভ সেনের মৃত্যুর তদন্ত যত এগোতে লাগল, ততই তার জীবনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অচেনা অধ্যায়গুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে শুরু করল। সহকর্মী, বন্ধু, এমনকি কলেজজীবনের কয়েকজন পরিচিতের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ইন্সপেক্টর অরিজিৎ সেন জানতে পারলেন—সৌরভ একসময় ভীষণ প্রেমে পড়েছিল মীরা নামের এক মেয়ের। কলেজজীবন থেকে শুরু হয়ে সেই সম্পর্ক বহু বছর ধরে টিকে ছিল। দু’জনের একসঙ্গে কাটানো সময়ের গল্প ছড়িয়ে ছিল বন্ধুদের মুখে, তাদের আড্ডার স্থান, সিনেমা দেখা, আর ভবিষ্যতের স্বপ্নের পরিকল্পনা। সবাই জানত, তারা একদিন বিয়ে করবে। কিন্তু ভাগ্য সবসময় এত সহজ হয় না। মীরার পরিবার ছিল ধনী ও প্রভাবশালী, আর তারা চাইত না মেয়ের বিয়ে এক সাধারণ মধ্যবিত্ত কর্মচারীর সঙ্গে হোক। চাপ, অপমান, আর পারিবারিক দ্বন্দ্ব মীরাকে বাধ্য করেছিল প্রেম ভাঙতে। শেষমেশ সে বিয়ে করে ধনী ব্যবসায়ী অভিজিত মালিককে, যিনি শহরে বেশ প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক যোগসাজশে পরিচিত। এই তথ্য জানার পর থেকেই অরিজিৎয়ের মনে নতুন সন্দেহ জাগল—কয়েক বছর আগের ব্যর্থ প্রেম কি আবার ফিরে এসেছে সৌরভের জীবনে? হয়তো সেই অতীতই তার বর্তমানের মৃত্যুর সূত্র।

অরিজিৎ মীরার ঠিকানা জোগাড় করলেন এবং তার বাড়িতে গেলেন। বাড়িটি ছিল অভিজাত, বড় গেট, পাহারাদার, গাড়ির লাইন, আর চারপাশে শহরের অন্যতম ধনকুবেরদের মতো আভিজাত্যের ছাপ। অভিজিত তখন বাইরে ছিলেন, তাই মীরার সঙ্গেই তার প্রথম দেখা। মীরা দেখতে শান্ত, গম্ভীর, তবে চোখের গভীরে অদ্ভুত এক দৃষ্টি, যা লুকোতে চাইলেও ধরা পড়ছিল। অরিজিৎ সৌজন্য বিনিময়ের পর সরাসরি সৌরভের প্রসঙ্গ তোলেন। মীরার ঠোঁট কেঁপে উঠল, কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিল। কিছুটা চুপ থাকার পর বলল, “হ্যাঁ, আমি আর সৌরভ একসময় খুব কাছের ছিলাম। আমরা বিয়ে করার স্বপ্ন দেখতাম, কিন্তু পরিবার… পরিবার চাইছিল না। আমি পারিনি বাবার বিরুদ্ধে যেতে। তারপর সব শেষ হয়ে গিয়েছিল।” তার কথার ভেতরে ছিল অপরাধবোধ আর দুঃখ, কিন্তু অরিজিৎ লক্ষ্য করলেন, এই দুঃখের সঙ্গে যেন লুকিয়ে আছে এক চাপা ভয়ও। তিনি সরাসরি প্রশ্ন করলেন, “সৌরভের সঙ্গে কি সাম্প্রতিককালে কোনো যোগাযোগ হয়েছিল?” মীরা চোখ নামিয়ে উত্তর দিল, “হ্যাঁ… কয়েকবার ফোন করেছিল। আমি সাড়া দিইনি। একদিন হঠাৎ দেখাও হয়েছিল বাজারে। ও খুব অদ্ভুতভাবে তাকাচ্ছিল, যেন অনেক কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু আমি এড়িয়ে গিয়েছিলাম।” এতটুকুতেই স্পষ্ট হয়ে গেল—পুরনো প্রেম এখনও পুরোপুরি মুছে যায়নি, বরং হয়তো পুনর্জীবিত হওয়ার চেষ্টা করছিল।

অভিজিত মালিকের নাম এই কাহিনিতে আসতেই অরিজিৎয়ের সন্দেহ আরও গাঢ় হয়ে উঠল। সৌরভের মৃত্যুর আগে রাতে যে মিসড কলগুলো এসেছিল, তা কি মীরার নম্বর হতে পারে? নাকি কারো মাধ্যমে সৌরভের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা হয়েছিল? আর যদি তাই হয়, তাহলে অভিজিত কি এই সম্পর্ক টের পেয়েছিলেন? প্রভাবশালী, ধনী মানুষরা অনেক সময় নিজেদের সম্মান বাঁচাতে যেকোনো পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করে না। হয়তো পুরনো প্রেমের ছায়া অভিজিতের জন্য ছিল অসহনীয়। পুলিশি তদন্তের নিয়ম মেনে অরিজিৎ মীরার স্বামীর সম্পর্কেও খোঁজ নিলেন—তিনি শহরের রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় অন্যতম প্রভাবশালী, তার সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের ওঠা-বসা, আর এ ধরনের মানুষের পক্ষে চাইলে যে কোনো কেলেঙ্কারি গোপন রাখা সম্ভব। তবে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছোনোর আগে অরিজিৎ নোট করে নিলেন—সৌরভ, মীরা আর অভিজিত—এই ত্রিভুজ সম্পর্কের ভেতরেই হয়তো লুকিয়ে আছে মৃত্যুর আসল রহস্য। অফিসে ফেরার পথে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে তার মনে হচ্ছিল, এই কেসটা আর শুধুই এক সাধারণ খুনের তদন্ত নয়, বরং মানুষের অতীত, প্রেম, বিশ্বাসঘাতকতা আর প্রতিশোধের জটিল জালে বোনা এক অন্ধকার গল্প, যার প্রতিটি ধাপই তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে গভীরতর ছায়ার ভেতরে।

ইন্সপেক্টর অরিজিৎ সেন মীরার স্বামী অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের জন্য যখন তার দোতলা অভিজাত বাংলোয় পৌঁছালেন, তখন সূর্য অস্তমিত হওয়ার আলো চারপাশে এক অদ্ভুত ছায়ার আবহ তৈরি করেছিল। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করার মুহূর্তেই তিনি বুঝতে পারলেন, এই মানুষটির জীবনযাপন সাধারণ নয়। চারদিকে দামী শোপিস, কার্পেট, আর দেয়ালে ঝোলানো শিল্পকর্ম অভিজিৎয়ের আর্থিক প্রভাব ও সামাজিক অবস্থানকে স্পষ্ট করে দিচ্ছিল। অভিজিৎ প্রথমে ভদ্রলোকের মতোই ব্যবহার করলেন—গায়ে সাদা পাঞ্জাবি, হাতে দামি ঘড়ি, ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি। কিন্তু যখন অরিজিৎ সৌরভ সেনের নাম উচ্চারণ করলেন, সেই হাসি মুহূর্তে ম্লান হয়ে গেল। তার চোখে অস্বস্তি ভেসে উঠল, আর এক সেকেন্ডের জন্য সে যেন দম আটকে গেল। তারপরই স্বর মেপে বলল, “আহা! ওর মৃত্যুটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা, তবে আমার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। আমার স্ত্রী অতীতের একটা অধ্যায় ভুলে গেছে, আমি চাই না সেই পুরোনো বিষয় আবার আলোচনায় আসুক।” এই কথাগুলো যথেষ্ট ভদ্র ও সংযত শোনালেও অরিজিৎ লক্ষ্য করলেন, প্রতিটি শব্দের আড়ালে যেন লুকানো ছিল তীক্ষ্ণ সতর্কতা, যেন সে এক অদৃশ্য সীমানা টেনে দিচ্ছে—এর বাইরে পুলিশ যেন না যায়। অভিজিৎ তার প্রভাব ও ক্ষমতার কথা না বললেও, কথার ভঙ্গিতে পরিষ্কার বোঝা গেল, সে জানে তার অবস্থান পুলিশকে ভীত করতে পারে। কিন্তু অভিজ্ঞ অফিসার হিসেবে অরিজিৎ বুঝলেন—যে মানুষ এত সাবধান হয়ে কথা বলে, সে কিছু না কিছু গোপন করছেই।

সাক্ষাৎকার চলতে থাকল, আর অরিজিৎ খুব সূক্ষ্মভাবে কথার মোড় ঘোরাতে লাগলেন। তিনি প্রশ্ন করলেন, সৌরভের সঙ্গে কি সাম্প্রতিক সময়ে কোনো যোগাযোগ হয়েছিল? অভিজিৎ তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল, “কখনোই নয়।” আবার যখন জানতে চাইলেন, মীরার সঙ্গে সৌরভের কি কোনো যোগাযোগ ছিল বলে তিনি জানেন কি না, অভিজিৎয়ের মুখ শক্ত হয়ে গেল। “আমার স্ত্রী খুব সৎ মেয়ে। তার অতীত নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। আর যদি ও আমাকে ফোনও করে থাকে, তাতে আমার কিছু যায় আসে না।” কথার মধ্যে আক্রমণাত্মক এক ঝাঁজ টের পাওয়া গেল। অরিজিৎ বুঝলেন, সৌরভের নামই অভিজিৎকে অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে। আর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এক চাপা টানাপোড়েন স্পষ্ট। মীরার চোখে আগেরদিন যে অপরাধবোধ দেখেছিলেন, তা হয়তো শুধু নিজের ব্যর্থতার জন্য নয়, স্বামীর দিক থেকেও এক ধরনের অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ তার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। আর এই জায়গাতেই তদন্তের সূক্ষ্মতম বিন্দুটি লুকিয়ে আছে বলে মনে হল অরিজিৎয়ের। তিনি লক্ষ্য করলেন, মীরার উপস্থিতি ছাড়াই অভিজিৎ তার প্রতিটি উত্তর দেওয়ার সময় বারবার চোখ এড়িয়ে যাচ্ছিলেন, কখনো টেবিলে রাখা গ্লাসের দিকে তাকাচ্ছিলেন, কখনো হঠাৎ ফোনে কল এসেছে ভান করছিলেন। একজন নির্দোষ মানুষ এতটা অস্থির হতেন না, আর এখানেই সন্দেহের জায়গাটা আরও পোক্ত হয়ে উঠল।

সাক্ষাৎকার শেষ করে বেরিয়ে আসার পর অরিজিৎ গাড়িতে বসে সবকিছু নোট করলেন। সৌরভের মৃত্যু কি কেবলই একটি অঘটন, না কি মীরার অতীত প্রেমকে মুছে ফেলার জন্য অভিজিৎয়ের পরিকল্পিত পদক্ষেপ? ধনী ব্যবসায়ী সমাজে মান-সম্মান রক্ষার জন্য এমন ঘটনা ঘটানো অস্বাভাবিক নয়। পুলিশ হিসেবে তিনি জানেন, টাকার প্রভাব, রাজনৈতিক যোগসাজশ, আর সামাজিক মুখোশ অনেক অপরাধকে চাপা দিয়ে রাখতে সক্ষম। কিন্তু তার অভিজ্ঞতা বলছে, সৌরভের হাতে আঁকা প্রতীক, রহস্যময় মিসড কল, আর মীরার চোখে লুকানো আতঙ্ক—সবকিছু মিলিয়ে এটা নিছক আত্মহত্যা হতে পারে না। এখন প্রশ্ন হল, অভিজিৎ সরাসরি জড়িত কি না, নাকি অন্য কেউ এই দম্পতির সম্পর্কের ফাঁটলকে ব্যবহার করছে? ভেতরে এক ভয়ানক দ্বন্দ্ব চলছিল—স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অদৃশ্য টানাপোড়েন, পুরনো প্রেমের ছায়া, আর এক যুবকের মৃত্যু। অরিজিৎ জানতেন, এই সূত্র আরও গভীরে খুঁজে বের করতে হবে, কারণ সত্য এখনো ঘাটের কুয়াশার মতো ঝাপসা, আর যত নাড়াচাড়া করা হবে, ততই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসবে নতুন নতুন ছায়া।

সৌরভ সেনের মৃত্যুর রহস্য ইতিমধ্যেই অরিজিৎ সেনকে নানা দিক থেকে ভাবিয়ে তুলেছিল। পরিবার বলেছে, ছেলেটি আত্মহত্যা করতে পারে না। প্রাক্তন প্রেমিকা মীরা মুখ লুকোতে চাইছে, আর তার প্রভাবশালী স্বামী অভিজিৎ নাম শুনলেই অস্বস্তিতে পড়ে যায়। এবার তদন্তে যুক্ত হল সৌরভের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু অনিন্দ্য ঘোষাল। শৈশব থেকে কলেজ, তারপর কর্মজীবন পর্যন্ত দু’জনের বন্ধুত্বের গভীরতা ছিল সবার জানা। অনিন্দ্য থানায় এসে বলল, “আমি আমার বন্ধুর জন্য সব করতে রাজি আছি, স্যার। ওকে যে এইভাবে মরতে হলো, সেটা আমি মানতেই পারছি না।” কথাগুলো শুনে প্রথমে অরিজিৎ ভেবেছিলেন, এই তরুণ হয়তো সত্যিই সব খুলে বলবে, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি টের পেলেন—অনিন্দ্যের বয়ানে অদ্ভুত অসঙ্গতি আছে। উদাহরণস্বরূপ, সে প্রথমে বলল, সৌরভ খুব চুপচাপ মানুষ ছিল, ঝগড়া-বিবাদে যেত না, কিন্তু কয়েক মিনিট পরই যখন অফিসের সহকর্মী নিয়ে প্রশ্ন করা হলো, তখন বলল, “ওর তো অফিসে কিছু শত্রু ছিল, মাঝে মাঝেই ঝামেলায় জড়াত।” একই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন কথা বলায় সন্দেহ আরও গভীর হলো। অরিজিৎ চুপচাপ বসে তার প্রতিটি বাক্য খুঁটিয়ে শুনছিলেন, বুঝছিলেন অনিন্দ্য ইচ্ছে করেই কিছু তথ্য গোপন করছে।

আলোচনা যত এগোতে থাকল, ততই স্পষ্ট হয়ে উঠল, অনিন্দ্যের কাছে সৌরভের জীবনের এমন কিছু তথ্য আছে, যা পরিবার বা অন্য বন্ধুরা জানে না। অরিজিৎ জিজ্ঞেস করলেন, মৃত্যুর আগের রাতে অনিন্দ্যের সঙ্গে সৌরভের কথা হয়েছিল কি না। অনিন্দ্য কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “না, হয়নি।” কিন্তু সৌরভের মোবাইলের কল লিস্ট পরীক্ষা করেই পুলিশ জেনে গিয়েছে, রাত দশটার দিকে অনিন্দ্যের নম্বরে সৌরভ কল করেছিলেন। জেরা করতে গিয়ে যখন এ প্রসঙ্গ তোলা হলো, অনিন্দ্য একেবারে চমকে উঠল। কপালে ঘাম জমে গেল, এবং সে তোতলাতে তোতলাতে বলল, “আসলে… হ্যাঁ, ও ফোন করেছিল। কিন্তু কোনো বিশেষ কথা হয়নি, শুধু একটু মন খারাপ ছিল।” এই উত্তরেই অরিজিৎ বুঝলেন, অনিন্দ্য সত্য লুকাচ্ছে। যদি কোনো সাধারণ কথাবার্তা হতো, তাহলে প্রথমে তা অস্বীকার করার কারণ ছিল না। মনে হচ্ছিল, রাতের সেই ফোনালাপে এমন কিছু ছিল, যা প্রকাশ করলে গোটা কাহিনির মোড় ঘুরে যেতে পারে। অরিজিৎ সরাসরি চাপ দিলেন না, বরং চুপচাপ নোট করলেন—এই বন্ধুই হয়তো সৌরভের অন্তরালের রহস্য জানে, আর সেটাই আড়াল করার চেষ্টা করছে।

অনিন্দ্যের কথার ভেতর আরও কিছু অসঙ্গতি চোখে পড়ল। সে বলছিল, সৌরভের প্রাক্তন প্রেমিকা মীরার সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ ছিল না, অথচ অন্য বন্ধুদের কাছ থেকে জানা গেল—কয়েক মাস আগে অনিন্দ্য নিজেই মীরার বাড়ির কাছে সৌরভকে পৌঁছে দিয়েছিল। আবার, অফিসের সহকর্মীরা বলল, মৃত্যুর আগে এক সপ্তাহ ধরে সৌরভ অদ্ভুতভাবে চঞ্চল হয়ে উঠেছিল, বারবার ফোনে ফিসফিস করে কথা বলত, অনেক সময় অনিন্দ্যের সঙ্গে। অথচ অনিন্দ্য সবকিছু অস্বীকার করছে। এসব অসঙ্গতি স্পষ্ট করে দিচ্ছিল, এই বন্ধু কেবলমাত্র তদন্তে সাহায্য করার ভান করছে, আসলে কিছু আড়াল করছে। হয়তো সৌরভ তাকে এমন একটি গোপন কথা জানিয়েছিল, যা প্রকাশ পেলে মীরা কিংবা অভিজিৎয়ের নাম উঠে আসবে। হয়তো সেই কথাই লুকোনোর চেষ্টা করছে অনিন্দ্য। পুলিশের জেরা যতই বাড়তে লাগল, অনিন্দ্যের মুখের অভিব্যক্তি ততই বদলাতে লাগল—প্রথমের আত্মবিশ্বাসী সুর ভেঙে গিয়ে তার জায়গায় এল অস্থিরতা আর আতঙ্ক। অরিজিৎ তখন চুপচাপ ভেবে নিলেন—এই মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে পরবর্তী বড় সূত্র লুকিয়ে আছে এই বন্ধুর বুকের ভেতরেই, আর তাকে ভাঙানোই হবে তদন্তের পরবর্তী ধাপ।

গঙ্গার ঘাটে পাওয়া সৌরভ সেনের লাশ ঘিরে যে অদ্ভুত প্রতীকটির রহস্য দিন দিন গাঢ় হয়ে উঠছিল, সেটি তদন্তে নতুন মোড় আনল। প্রতীকটি এতদিন অরিজিৎ সেন আর তার টিমকে বিভ্রান্ত করছিল—এটি কি শুধুই কাকতালীয় আঁকিবুকি, নাকি এর মধ্যে লুকিয়ে আছে গভীর কোনো বার্তা? উত্তর খুঁজতে গিয়ে এক স্থানীয় বাসিন্দার পরামর্শে অরিজিৎ পৌঁছে গেলেন ঘাটের পুরোনো পুরোহিত, পন্ডিত হরিদাসের কাছে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া এই মানুষটির চোখে এক ধরনের অদ্ভুত দীপ্তি ছিল, যা দেখে মনে হতো, তিনি শুধু ধর্মীয় আচারই জানেন না, ইতিহাস, পুরাণ আর মানুষের অচেনা মানসিক দিক সম্পর্কেও তার তীক্ষ্ণ ধারণা আছে। প্রতীকটির ছবি হাতে দিয়েই অরিজিৎ জিজ্ঞাসা করলেন, “পন্ডিতজি, আপনি কি জানেন এটা কী?” হরিদাস প্রথমে ছবির দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “এটা কোনো সাধারণ চিহ্ন নয়, বাবু। এটা প্রতিশোধের প্রতীক। প্রাচীন সংস্কৃত মন্ত্রের এক অদ্ভুত ব্যাখ্যা থেকে এসেছে, যেখানে বলা হয়—‘যে অন্যায় ভোগ করেছে, তার আত্মা প্রতিশোধ ছাড়া শান্তি পায় না।’ এই প্রতীক মূলত শত্রুকে সতর্ক করার জন্য আঁকা হতো, যেন সে জানে—তার বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার আসছে।” কথা শুনে অরিজিৎয়ের শরীরে যেন শিহরণ বয়ে গেল। এতদিন যে প্রতীকটিকে তিনি হয়তো কাকতালীয় মনে করছিলেন, সেটিই এখন ইঙ্গিত দিচ্ছে কোনো প্রাচীন দর্শনের দিকে।

অরিজিৎ কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলেন, “তাহলে কি সৌরভ নিজেই এই প্রতীক এঁকেছিল? নাকি কেউ তাকে এভাবে চিহ্নিত করেছে?” পন্ডিত হরিদাস চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “দুটোই হতে পারে। হয়তো মৃত্যুর আগে সে কারো মুখোমুখি হয়েছিল, যে এই প্রতীককে তার হাতে এঁকে দিয়ে তাকে বোঝাতে চেয়েছে—তুমি শাস্তি পাবে। আবার এটাও হতে পারে, সৌরভ বুঝেছিল তার জীবনে এমন কারো আগমন ঘটেছে, যে তাকে ধ্বংস করতে চায়। তখন সে নিজেই এই চিহ্ন আঁকতে পারে সতর্কবার্তা হিসেবে।” অরিজিৎ আরও বিস্মিত হলেন। কারণ তদন্তের প্রাথমিক ধাপেই তিনি বুঝেছিলেন, সৌরভের মৃত্যু নিছক আত্মহত্যা নয়। এখন সেই সন্দেহ আরও জোরালো হলো। প্রতীক মানে পরিকল্পনা, প্রতীক মানে উদ্দেশ্য। আর এর পেছনে লুকিয়ে আছে হয়তো সৌরভের শেষ মুহূর্তের এক গোপন যোগাযোগ। হরিদাস আরও বললেন, “এই প্রতীক সাধারণ মানুষ জানে না। এর সূত্র প্রাচীন তন্ত্রশাস্ত্রে। কেউ যদি এটা ব্যবহার করে, বুঝতে হবে সে কেবল সাধারণ খুন করতে চায় না, সে চায় তার প্রতিশোধের কথা প্রকাশ্যে জানাতে।” কথাগুলো শুনে মনে হলো, এ যেন এক গোপন খেলার সূচনা, যেখানে হত্যাকারী চাইছে পুলিশ ইশারাটা খুঁজে পাক, কিন্তু সমাধান যেন না করতে পারে।

থেকে থেকে অরিজিৎয়ের মনে ভেসে উঠছিল সৌরভের বন্ধু অনিন্দ্যের অসঙ্গত কথাবার্তা, মীরার আতঙ্কিত চোখ, আর অভিজিৎয়ের ভদ্রলোকসুলভ আচরণের আড়ালে লুকানো অস্বস্তি। যদি প্রতীকের সূত্র সত্যিই প্রতিশোধ হয়, তবে কার প্রতিশোধ নিচ্ছিল সৌরভের মৃত্যু? সৌরভ কি নিজেই শিকার, না সে অন্য কারো দোষের ফল ভোগ করছে? এই প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরপাক খেতে খেতে অরিজিৎ প্রতীকের গুরুত্ব নোট করে নিলেন। এখন তদন্তের নতুন ধাপ শুরু হবে—এই প্রতীক কোথায় কোথায় ব্যবহার হয়েছে, কারা এ বিষয়ে জানে, আর সৌরভের জীবনে এর যোগসূত্র কোথায়। পুলিশি তদন্ত যত এগোবে, ততই স্পষ্ট হবে, এই প্রতীকের রহস্য কেবল একজন মানুষের মৃত্যুর গল্প নয়, বরং এক অন্ধকার শক্তির ছায়া, যা হয়তো আরও বড় কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। গাড়িতে ফেরার পথে অরিজিৎ মনে মনে ভাবলেন, এই খুন এখন নিছক অপরাধ নয়, এটা এক নাটকীয় ঘোষণা—যেখানে খুনি প্রতিটি ধাপে প্রতীকের মাধ্যমে তার অস্তিত্বের জানান দিতে চাইছে। আর সত্য খুঁজে বের করা এখন কেবল দায়িত্ব নয়, এক যুদ্ধ—অন্ধকার আর আলোর মধ্যে, ন্যায় আর প্রতিশোধের মধ্যে।

তদন্ত যত এগোতে থাকে, ততই সৌরভ সেনের মৃত্যুর কাহিনি অদ্ভুতভাবে জটিল হয়ে উঠতে লাগল। প্রথমে মনে হয়েছিল এটি হয়তো আত্মহত্যা, তারপর সন্দেহ ঘনীভূত হলো পুরোনো প্রেমিকা মীরা এবং তার স্বামী অভিজিৎয়ের দিকে। কিন্তু পুলিশের খুঁটিনাটি অনুসন্ধানে যেই সত্য ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে লাগল, তাতে বোঝা গেল—এটি নিছক সম্পর্কের দ্বন্দ্ব নয়, বরং প্রতারণা আর ভাঙনের এক জাল, যেখানে সৌরভ যেন অজান্তে পা ফেলে দিয়েছিল। সৌরভের অফিস থেকে পাওয়া কিছু তথ্য, তার মোবাইল রেকর্ড এবং অনিন্দ্যের দেওয়া আংশিক সত্য মিলিয়ে উঠে এল যে, মৃত্যুর আগের দিনগুলিতে সৌরভ এক ভয়ঙ্কর গোপন সত্য জেনে ফেলেছিল। মীরার সঙ্গে তার সম্পর্ক অতীতের বিষয় হলেও, সৌরভ টের পেয়েছিল মীরা ও অভিজিৎয়ের দাম্পত্য আসলে ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছে। বাইরে থেকে ধনী ব্যবসায়ী আর তার মার্জিত স্ত্রী—এমন রূপ দেখালেও, ভিতরে লুকিয়ে ছিল অবিশ্বাস, দূরত্ব এবং ক্রমাগত অশান্তি। সৌরভ টের পেয়েছিল সেই অশান্তির ফাঁক দিয়ে অন্য এক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে—মীরা আর অনিন্দ্যের। এই সত্য জানা মাত্রই তার জীবনে নামল বিপর্যয়, কারণ সে বুঝতে পারল, সে এমন এক ষড়যন্ত্রের কাছে পৌঁছে গেছে, যেখানে তার উপস্থিতি অপ্রয়োজনীয় তো বটেই, বরং বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।

অরিজিৎ সেন তদন্তের প্রতিটি সূত্র জোড়া লাগাতে লাগলেন। সৌরভের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর অসঙ্গত কথাবার্তা, মীরার আতঙ্ক আর অভিজিৎয়ের অস্বস্তি এখন নতুন আলোয় ধরা পড়ছিল। পুলিশি সূত্রে জানা গেল, কয়েক সপ্তাহ ধরে অনিন্দ্য প্রায় নিয়মিত মীরার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিল, আর তাদের মধ্যে গোপনে সাক্ষাৎও হচ্ছিল। মীরার ফোন রেকর্ডে ধরা পড়ল, গভীর রাতে বারবার অনিন্দ্যের সঙ্গে কথা হয়েছে। অথচ জেরা করার সময় অনিন্দ্য সবকিছু অস্বীকার করেছিল। তখন অরিজিৎয়ের সন্দেহ আরও ঘনীভূত হলো। হয়তো সৌরভ এই সম্পর্কের খবর পেয়ে গিয়েছিল, আর মীরাকে প্রশ্নও করেছিল। সৌরভ যদি অনিন্দ্যকে শৈশব থেকে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে জানত, তাহলে তার কাছে এই বিশ্বাসঘাতকতা ছিল অসহনীয়। ঠিক এখানেই শুরু হলো ষড়যন্ত্রের পর্দা টানা। অনিন্দ্য জানত, যদি সৌরভ সব প্রকাশ করে দেয়, তবে তার নিজের জীবন ভেঙে পড়বে, মীরার সংসার ধ্বংস হবে, আর অভিজিৎয়ের ব্যবসায়িক ও সামাজিক সম্মান মাটিতে মিশে যাবে। তাই প্রশ্ন উঠল—এই তিনজনের মধ্যে কে সৌরভকে চুপ করিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল? নাকি এ এক সম্মিলিত প্রয়াস, যেখানে সবারই প্রাপ্তি ছিল, আর সৌরভের একমাত্র পরিণতি হলো মৃত্যু? প্রতারণার এই জাল যতই উন্মোচিত হচ্ছিল, ততই পরিষ্কার হচ্ছিল, সৌরভ কেবল প্রেমের ত্রিভুজে আটকে পড়া মানুষ নয়—সে হয়ে উঠেছিল অন্যদের লুকোনো পাপের সাক্ষী, আর সেই কারণেই তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

অরিজিৎ সেনের মাথায় তখন ক্রমাগত প্রতীকের কথা ঘুরছিল। পন্ডিত হরিদাসের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এটি ছিল প্রতিশোধের চিহ্ন। কিন্তু প্রতিশোধটা কার ছিল? সৌরভ কি প্রতিশোধ নিতে যাচ্ছিল, নাকি তার বিরুদ্ধেই প্রতিশোধ নেওয়া হলো? অনিন্দ্যের সঙ্গে মীরার সম্পর্ক হয়তো সৌরভ আবিষ্কার করেছিল, আর সেই জ্ঞানই তার মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছিল। হয়তো অভিজিৎ, যিনি সমাজে সম্মানিত ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত, সেই সম্মান বাঁচাতে এক নির্মম পরিকল্পনায় যুক্ত হলেন। আবার হতে পারে, অনিন্দ্যই বন্ধু সেজে বন্ধুর জীবন কাড়ল, কারণ তার লজ্জা ফাঁস হয়ে যাওয়া মানে নিজের সর্বনাশ। আর মীরা? তার চরিত্র ঘিরে তখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন দাঁড়াল—সে কি নিরুপায় ভুক্তভোগী, নাকি এই ভয়ঙ্কর খেলায় সক্রিয় অংশগ্রহণকারী? সব মিলিয়ে তদন্ত তখন এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়াল, যেখানে প্রতিটি চরিত্র সন্দেহজনক, প্রতিটি সম্পর্ক দ্বিমুখী, আর প্রতিটি সত্য মিথ্যার আড়ালে ঢাকা। প্রতারণার জাল যে কেবল সৌরভকে গ্রাস করেছে তা নয়, বরং পুলিশকেও টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক জটিল ধাঁধায়, যেখানে প্রতিটি সুতোর টান অন্যদিকে ছুটে যাচ্ছে। আর এই অন্ধকার গহ্বরেই অরিজিৎ এখন খুঁজছেন আলো—সেই আলো, যা হয়তো প্রমাণ করবে কে আসল খুনি, আর কার জন্য সৌরভ সেনের জীবন এমন মর্মান্তিক পরিণতি পেল।

অবশেষে সেই সময় এল, যখন ইন্সপেক্টর অরিজিৎ সেন সিদ্ধান্ত নিলেন সমস্ত সন্দেহভাজনকে একসাথে বসিয়ে সত্য উদঘাটন করবেন। এতদিন ধরে আলাদা আলাদা করে জেরা করা হয়েছে, প্রত্যেকেই নিজেদের মতো করে উত্তর দিয়েছে, কেউ অস্বীকার করেছে, কেউ আবার অস্পষ্ট উত্তর দিয়ে গড়িমসি করেছে। কিন্তু অরিজিৎ জানতেন, সত্যিকারের মুখোশ খোলানো সম্ভব তখনই, যখন তাদেরকে একে অপরের সামনে দাঁড় করানো হবে। থানার নির্জন ইন্টারোগেশন রুমে বসানো হলো মীরা, অভিজিৎ এবং অনিন্দ্যকে। তিনজনের চোখেই ছিল অস্বস্তি, তবে প্রত্যেকের ভঙ্গি আলাদা। মীরা কিছুটা কাঁপছিল, বারবার চোখ নামিয়ে নিচ্ছিল। অভিজিৎ যতটা সম্ভব ধীরস্থির থাকার চেষ্টা করছিল, কিন্তু তার কপালে ঘাম জমেছিল। আর অনিন্দ্য—সে-ই সবচেয়ে আত্মবিশ্বাসী দেখাতে চাইছিল, যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু অরিজিৎ তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বুঝতে পারছিলেন, আত্মবিশ্বাসের মুখোশ আসলে ভেতরের ভয়ের পর্দা মাত্র। নীরব ঘরটিতে যখন তিনি বললেন, “আজ তোমাদের কারো মুখোশ লুকিয়ে থাকবে না। সত্যিই বেরিয়ে আসবে,” তখন বাতাস ভারি হয়ে উঠল, যেন প্রত্যেকেই জানত, এদিনই সব পর্দা সরে যাবে।

অরিজিৎ প্রথমেই প্রতীকের প্রসঙ্গ তোলেন। ছবিটি সবার সামনে রেখে তিনি বললেন, “এটা কোনো প্রাচীন প্রতিশোধের প্রতীক নয়। আসল উদ্দেশ্য ছিল আমাদের বিভ্রান্ত করা। প্রশ্ন হলো—এটা কে আঁকল?” মীরা ভয়ে চোখ বড়ো করে তাকাল, অভিজিৎ চোখ নামিয়ে নিল, কিন্তু অনিন্দ্য নির্বিকার গলায় বলল, “আমি জানি না।” অরিজিৎ তীক্ষ্ণ হাসি দিয়ে বললেন, “তুমি জানো না? অথচ আমাদের হাতে প্রমাণ আছে—তুমি কয়েকবার তান্ত্রিক গ্রন্থের ওয়েবসাইট খুঁজেছ, প্রতীকের মতো ছবি ডাউনলোড করেছ। এগুলো সৌরভের হাতে এঁকেছিলে তুমি-ই।” মুহূর্তেই অনিন্দ্যের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অরিজিৎ এবার একে একে বাকি প্রমাণ সামনে আনলেন—সৌরভের মোবাইল থেকে উদ্ধার হওয়া ভয়েস নোট, যেখানে সে স্পষ্ট বলেছিল, ‘অনিন্দ্য আমার পেছনে লুকিয়ে মীরার সঙ্গে সম্পর্ক করছে, আমি জানি।’ এই প্রমাণ শুনেই মীরার চোখে জল চলে এল। অভিজিৎ গম্ভীর হয়ে বসলেন, কিন্তু কিছু বললেন না। অরিজিৎ এবার অনিন্দ্যের দিকে ঝুঁকে কঠোর স্বরে বললেন, “তুমি ভয় পেয়েছিলে, তাই না? সৌরভ তোমাদের সম্পর্ক প্রকাশ করে দেবে, সমাজ, পরিবার সব জায়গায় তোমরা অপমানিত হবে। তাই তাকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে। আর প্রতীকের নাটক সাজিয়ে আমাদের ভুল পথে চালাতে চেয়েছিলে।” অনিন্দ্য কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর হঠাৎ গলা কাঁপা স্বরে বলল, “হ্যাঁ… আমি-ই ওকে খুন করেছি।”

সেই স্বীকারোক্তি যেন ঘরে বজ্রপাতের মতো নেমে এল। মীরা মুখ চেপে কেঁদে ফেলল, অভিজিৎ চেয়ারে বসে গম্ভীরভাবে মাথা নিচু করলেন। অনিন্দ্য কাঁপতে কাঁপতে বলল, “আমি চাইনি ব্যাপারটা এতদূর যাক। কিন্তু সৌরভ যেদিন আমাকে হুমকি দিল যে সে সব প্রকাশ করে দেবে, আমি জানতাম আমার জীবন শেষ। আমি মীরাকে ভালোবাসতাম, আর ওর সঙ্গ ছাড়া আমি কিছু ভাবতে পারতাম না। সেইজন্যই পরিকল্পনা করলাম। গঙ্গার ঘাটে তাকে ডেকে নিয়ে গেলাম, তর্ক হলো, তারপর আমি ওকে পানিতে ঠেলে দিলাম। মৃতদেহ ভেসে ওঠার পর যাতে পুলিশ এটাকে আত্মহত্যা বা রহস্যময় প্রতিশোধ মনে করে, তাই প্রতীকের গল্প সাজালাম।” তার স্বীকারোক্তি শুনে অরিজিৎ নিশ্চুপ হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তিনি জানতেন, সত্যিই এটাই পুরো ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু। মীরা কেঁদে বলতে লাগল, “আমি কিছু জানতাম না, আমি শুধু একা হয়ে পড়েছিলাম, অনিন্দ্যের ওপর ভরসা করেছিলাম। কিন্তু খুন? এটা আমি চাইনি।” অভিজিৎ নীরবে স্ত্রীর দিকে তাকালেন, চোখে অদ্ভুত হতাশা। তিনি নিজেও দোষী, কারণ সবকিছু জেনে তিনি চুপ করে ছিলেন, নিজের সম্মান রক্ষা করতে চান বলে। অরিজিৎ কঠোর গলায় ঘোষণা করলেন, “সত্য প্রমাণিত হলো। সৌরভ সেন আত্মহত্যা করেনি। তাকে খুন করা হয়েছে, ঠাণ্ডা মাথায়, পরিকল্পনা করে। আর সেই খুনি তুমি, অনিন্দ্য।” ঘরের ভেতর তখন নিস্তব্ধতা, শুধু মীরার কান্না আর অনিন্দ্যের কণ্ঠে অনুতাপ ভরা স্বীকারোক্তি ভেসে আসছিল। তদন্তের দীর্ঘ পথ শেষে, অরিজিৎ অবশেষে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করালেন সবাইকে—যেখানে প্রতারণা, বিশ্বাসঘাতকতা আর স্বার্থের জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে এল খুনের নগ্ন বাস্তবতা।

—-

1000059730.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *