ঋত্বিক মুখোপাধ্যায়
পর্ব ১: কাঁচের গম্বুজের নীচে
গঙ্গার স্রোত নেমে আসছিল কংক্রিটের ধ্বংসস্তূপ বেয়ে। একসময়ের মহার্ঘ্য ভবনগুলো এখন কেবল ডুবে থাকা প্রেতনগরের ভগ্নাবশেষ—কলকাতা আর নেই, কেবল ভেসে থাকা নাম-অস্তিত্ব। সমুদ্রপৃষ্ঠ এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে মহানগরীর রাস্তাঘাট, চৌরঙ্গি, কলেজস্ট্রিট, এমনকি হাওড়া ব্রিজের অর্ধেক অংশও জলের নিচে অদৃশ্য হয়ে গেছে। কিন্তু মানুষ হাল ছাড়েনি। তারা গড়ে তুলেছে নতুন এক পৃথিবী—গঙ্গার তলদেশে কাঁচের স্বচ্ছ গম্বুজ ঘেরা এক নগরী।
সেই নগরীর নাম—অমরাবতী।
কাঁচের গম্বুজটিকে বলা হত AquaDome, বিশাল বায়োটেক কাঠামো। এর ভেতর অক্সিজেন উৎপাদনের জন্য লাগানো হয়েছিল নীল শৈবাল আর কৃত্রিম বনভূমি। শহরের ভেতর আবার তৈরি হয়েছিল রাস্তা, আলো, বাজার, আবাসন, ল্যাবরেটরি। মানুষের পরবর্তী প্রজন্মরা জন্ম নিয়েছিল এই কাঁচঘেরা জলতলের শহরে, যেখানে আকাশ নেই, আছে কেবল গম্বুজের গায়ে প্রতিফলিত গঙ্গার ঢেউ।
ঋদ্ধি, এক কিশোর, জন্ম থেকেই এই গম্বুজে মানুষ। তার কাছে বাইরের জগত মানে গল্পের বইয়ের মতো কিছু—উপরে একসময় ছিল নীল আকাশ, পাখির উড়ান, বৃষ্টির গন্ধ। কিন্তু বাস্তবে সে জানে কেবল গম্বুজের কৃত্রিম আলো আর গঙ্গার চাপা শব্দ।
একদিন সে তার বাবার সঙ্গে গিয়েছিল Hydro-Lab এ। ওখানেই বিজ্ঞানীরা গঙ্গার জলের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে, যেন এই কাঁচের শহর চিরস্থায়ীভাবে টিকে থাকে। বাবার নাম অরিন্দম চক্রবর্তী—প্রকৌশলী। তিনি কাঁচের গম্বুজের রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের প্রধান।
ঋদ্ধি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল—
“বাবা, এই কাঁচটা যদি ফেটে যায়? তখন কি হবে?”
অরিন্দম কড়া গলায় উত্তর দিলেন—
“ওরকম কথা মুখে আনিস না। ফেটে গেলে সেকেন্ডের মধ্যে শহরটা ডুবে যাবে। আমরা সবাই জলের সঙ্গে মিশে যাবো। তাই এই কাঁচই আমাদের প্রাণ।”
ঋদ্ধির বুকের মধ্যে হঠাৎ শীতল ভয় নেমে এলো। কিন্তু ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতরে জন্ম নিলো অদ্ভুত এক কৌতূহলও। বাইরের জগৎ কেমন? গঙ্গার নিচে যারা এখনো অন্ধকারে ঘোরাফেরা করছে, তাদের কি কেউ আছে?
রাতে, নিজের ঘরে শুয়ে, সে গম্বুজের স্বচ্ছ ছাদের দিকে তাকিয়ে রইল। ঢেউয়ের ছায়া ঝিকমিক করছিল কাঁচের ওপরে। হঠাৎ সে লক্ষ্য করল কিছু অস্বাভাবিক। যেন গম্বুজের বাইরে কোনো ছায়া ভেসে গেল। মানুষের মতো, আবার মানুষের মতো নয়।
সে চোখ কচলাল, ভেবেছিল হয়তো বিভ্রম। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরে আবারো সেই ছায়া। যেন কেউ গম্বুজের বাইরে, জলের গভীরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ঋদ্ধি ফিসফিস করে বলল—
“ওরা কারা?”
পরদিন স্কুলে গিয়ে সে বন্ধু সায়নীকে বলল ব্যাপারটা। সায়নী অবাক হয়ে হাসল—
“তুই খুব গল্প বানাতে শিখেছিস। জলের নিচে মানুষ থাকে নাকি? আমাদের ছাড়া তো আর কেউ নেই।”
ঋদ্ধি গম্ভীর হয়ে বলল—
“না, আমি দেখেছি। ওরা ছিল। চোখের সামনে দিয়ে সাঁতরে গেল।”
সায়নী একটু চুপ করে রইল। তারপর ফিসফিস করে বলল—
“আমাদের দাদু-ঠাকুমারা একটা কাহিনি বলত। তারা বলত, গঙ্গার গভীরে অন্য প্রাণীরা থাকে। যারা একসময় মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বিজ্ঞানীরা ওদের নিয়ে কোনোদিন কথা বলেনি। হয়তো সরকার লুকিয়ে রেখেছে।”
ঋদ্ধির মনে আগুন জ্বলে উঠল। সরকার, বিজ্ঞানী—সবাই যদি সত্যি কিছু লুকিয়ে রাখে, তবে সে-ই খুঁজে বের করবে।
সেদিন রাতে সে একা একা গম্বুজের উত্তর প্রান্তে গিয়ে দাঁড়াল। যেখানে গম্বুজের কাঁচের ওপারে কেবল অন্ধকার, নীচে গঙ্গার স্রোত। হঠাৎ, তার চোখ বিস্ময়ে স্থির হয়ে গেল।
কাঁচের ওপারে স্পষ্ট দেখা গেল একটা অবয়ব—মানুষের মতোই, কিন্তু চোখ দুটো অস্বাভাবিকভাবে দীপ্তিময়, জলের মতো স্বচ্ছ। সেই চোখের দৃষ্টি যেন সরাসরি ঋদ্ধির ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে।
ঋদ্ধি এক মুহূর্তের জন্যও নড়তে পারল না। ঠাণ্ডা ভয়ে তার হাত কাঁপছিল। কিন্তু পরক্ষণেই সেই অবয়ব হাত বাড়িয়ে কাঁচে আঙুল রাখল—ঠিক যেখানে ঋদ্ধি দাঁড়িয়ে। কাঁচের দুই প্রান্তে মানুষের হাত আর অজানা প্রাণীর হাত এক বিন্দুতে মিলল।
আর সেই মুহূর্তেই, ঋদ্ধির মনে ভেসে উঠল একটি স্পষ্ট শব্দ—কোনো ঠোঁট নাড়াচ্ছে না, কিন্তু মনে মনে সে শুনতে পেল—
“আমরা এখানে আছি।”
ঋদ্ধির বুকের ভেতর যেন বাজ পড়ল।
গঙ্গার তলদেশে নগরী আসলে একা নয়।
পর্ব ২: অদৃশ্য কণ্ঠস্বর
ঋদ্ধি পরের দিন সকাল পর্যন্ত ঘুমোতেই পারেনি। সেই দীপ্তিময় চোখ, কাঁচের ওপাশে ভেসে ওঠা অবয়ব, আর মনের ভেতর ধ্বনিত হওয়া অচেনা কণ্ঠ—সবকিছু যেন তার বুকের মধ্যে পাথরের মতো চেপে ছিল। সে জানে, ওটা স্বপ্ন ছিল না। স্বপ্ন হলে কাঁচের গায়ে আঙুলের ছাপ দেখা যেত না।
কিন্তু সে কাউকে বলার সাহস পেল না। সায়নীকে বললেও সে কেবল হাসবে। বাবা অরিন্দমকে বললে তো বিপদ। বাবা তার সব কল্পনাকে উড়িয়ে দেন, বলেন, “অতিরিক্ত বই পড়িস, তাই এসব বিভ্রম হয়।” আর এবার যদি বলে, তবে হয়তো বাবা তাকে Neuro-Check করাতে পাঠিয়ে দেবেন।
তবু সারাদিন ক্লাসে বসে তার মন গম্বুজের বাইরে ঘুরে বেড়াল। শিক্ষক বোঝাচ্ছিলেন নতুন প্রজন্মের জন্য হাইড্রোজেন সেল কীভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, কিন্তু ঋদ্ধি শুধু ভাবছিল—ওরা কারা? কেন ওরা কাঁচের বাইরে ঘুরছে? আর কেনই বা তার সঙ্গেই যোগাযোগ করল?
সন্ধেবেলা সে আবার সেই জায়গায় ফিরে গেল, গম্বুজের উত্তর প্রান্তে। এবার সে প্রস্তুত ছিল—একটা ছোট্ট ওয়াটারপ্রুফ প্যাড সঙ্গে এনেছিল। যদি আবার দেখা দেয়, তবে আঁকতে পারবে।
সে দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। গঙ্গার অন্ধকার জলে ছোট ছোট ফসফরাসের দাগ ভেসে উঠছিল, যেন জোনাকির মতো। হঠাৎ, তার বুক কেঁপে উঠল। আবার সেই ছায়া। এবার একাধিক। তিনটে অবয়ব, কাঁচের বাইরের স্রোতে দুলছে।
তাদের চোখগুলো ঝলমল করছিল—মানুষের চোখ নয়, যেন নীলাভ তরল ভরা কাচের পাত্র। আর তাদের শরীর অর্ধেক মানুষের মতো, অর্ধেক জলের স্রোতের মতো স্বচ্ছ। যেন শরীরটা স্থির নয়, ক্রমাগত তরঙ্গিত হয়ে বদলে যাচ্ছে।
ঋদ্ধি আঁকতে শুরু করল। কিন্তু আঁকতে আঁকতেই আবার সেই কণ্ঠস্বর তার ভেতরে বাজল—
“ভয় পেও না।”
সে আঁচল কাটতে কাটতে প্রায় বসে পড়ল। ঠোঁট নড়ছিল না, চারপাশে কোনো শব্দও নেই, অথচ মাথার ভেতর স্পষ্ট ধ্বনি। সে কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞেস করল—
“তোমরা কারা?”
উত্তর এলো—
“আমরা অর্যা। আমরা এখানে আছি হাজার বছর ধরে। গঙ্গা আমাদের বাড়ি। তোমরা এসেছো দখল করতে।”
ঋদ্ধি হতভম্ব হয়ে গেল। “দখল করতে? আমরা তো বাঁচতে এসেছি। ওপরে জল বেড়ে সব শেষ হয়ে গেছে।”
তখন দ্বিতীয় অবয়ব এগিয়ে এল। তার চোখে বিদ্যুতের মতো নীল আলো ঝলসে উঠল।
“তোমাদের শহর আমাদের শ্বাসরোধ করছে। কাঁচের গম্বুজ যত বড় হচ্ছে, গঙ্গার প্রবাহ বদলাচ্ছে। আমাদের আশ্রয় ভেঙে পড়ছে। তোমরা হয়ত জানো না, কিন্তু তোমাদের বিজ্ঞানীরা জানে। তবু লুকিয়েছে।”
ঋদ্ধির মাথা ঘুরে গেল। সত্যি কি? বাবা, সরকার—সবাই কি জানে যে বাইরেও প্রাণ আছে? আর তারা সেটা গোপন করছে?
সে গলা শুকিয়ে গিয়ে বলল—
“তোমরা আমাকে কেন দেখালে?”
প্রথম অবয়ব হাসির মতো কিছু করল। জলের ফেনার মতো ঝলক।
“কারণ তুমি প্রশ্ন করো। অন্যরা ভয়ে মুখ বন্ধ রাখে। তুমি খুঁজে বের করবে সত্য।”
হঠাৎ তারা মিলিয়ে গেল। আবার শুধু গঙ্গার অন্ধকার।
ঋদ্ধি ছুটে বাড়ি ফিরল। কিন্তু ঘরে ঢুকেই বুঝল, বাবা বসে আছেন, গম্ভীর মুখে।
“কোথায় ছিলি?”
ঋদ্ধি গলা শুকনো গলায় বলল—
“স্রেফ হাঁটছিলাম।”
অরিন্দম চোখ সরু করে তাকালেন।
“তুই উত্তর প্রান্তে গেছিলি, তাই না? ওখানে যাওয়া নিষেধ। গেজ-সেন্সর সব দেখেছে।”
ঋদ্ধি থতমত খেয়ে বলল—
“কিন্তু—”
অরিন্দম গর্জে উঠলেন—
“আর একবার ধরতে পারলে শাস্তি পাবে। ওই প্রান্তে যাওয়া বিপজ্জনক। মনে রাখিস।”
ঋদ্ধি আর কিছু বলল না। কিন্তু তার বুকের ভেতর রাগ জমে উঠল। বাবা জানেন। সরকার জানে। অথচ সবাইকে অন্ধকারে রাখা হয়েছে।
রাতে ঘুমোতে না পেরে সে আঁকা প্যাডটা বার করল। অবয়বগুলোর নীলচোখ আঁকতে গিয়ে মনে হলো তারা যেন কাগজের ভেতর থেকেও তাকাচ্ছে।
সে চুপচাপ লিখল—
“অর্যা—আমরা এখানে আছি।”
তারপর বুকের ভেতর অদ্ভুত শপথ জাগল। সে সত্যি জানবে।
সে জানত না, ঠিক তখনই দূরে, Hydro-Lab এর কাচঘেরা ঘরে, কিছু বিজ্ঞানী গোপনে স্ক্রিনে একই ছবি দেখছিল। গঙ্গার তলদেশের মনিটরে ভেসে উঠেছিল দীপ্তিময় অবয়ব। আর তাদের পাশে লাল লেখা ফুটে উঠছিল—
“AQUA BREACH: CLASSIFIED THREAT.”
পর্ব ৩: গোপন ফাইল
পরদিন সকাল থেকেই অমরাবতী নগরীর ভেতর অস্বাভাবিক উত্তেজনা। কাঁচের গম্বুজের ভেতর লাউডস্পিকার বেজে উঠল—“আজ সন্ধ্যায় নাগরিক সভা অনুষ্ঠিত হবে। উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক।”
ঋদ্ধির বুক ধকধক করতে লাগল। হয়তো সেই অদ্ভুত অবয়বগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু ঘটেছে। সে স্কুলে গেল বটে, কিন্তু সারাক্ষণ মনে হচ্ছিল শিক্ষক-শিক্ষিকাদের চোখ অস্বাভাবিক কঠোর, যেন সবাই কিছু জানে অথচ মুখে কিছু বলে না।
দুপুরে সায়নী তার পাশে বসে ফিসফিস করে বলল—
“তুই শুনেছিস? উত্তর প্রান্তে আবারও সিগন্যাল ধরা পড়েছে। বাবার অফিসে আলোচনা হচ্ছিল।”
ঋদ্ধির চোখ বড় হয়ে গেল। “কোন সিগন্যাল?”
সায়নী কাঁধ ঝাঁকাল। “ঠিক জানি না। তবে ‘অ্যাকুয়া ব্রিচ’ নামটা বলছিল।”
ঋদ্ধির মাথার ভেতর আগুন জ্বলে উঠল। গত রাতে সে কাগজে যে শব্দ লিখেছিল, সেটাই যেন সরকার ব্যবহার করছে। Aqua Breach—Classified Threat. তাহলে কি অর্যা-রা সত্যিই ‘হুমকি’? নাকি সরকার শুধু ভয় দেখাচ্ছে?
সন্ধ্যায় সভায় মানুষ ভিড় জমাল। গম্বুজের বিশাল চত্বরের মধ্যে সবাই বসে পড়ল। স্টেজে উঠে এলেন অমরাবতীর প্রশাসক ডঃ শোভনলাল দত্ত। তাঁর কণ্ঠ ঠাণ্ডা অথচ দৃঢ়—
“আমাদের শহর নিরাপদ। তবে গঙ্গার তলদেশে কিছু অস্বাভাবিক ক্রিয়া-কলাপ শনাক্ত করা গেছে। আমরা জানি না সেগুলো প্রাকৃতিক নাকি অন্য কিছু। তাই সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।”
জনতার মধ্যে গুঞ্জন উঠল। কেউ বলল—“অন্য কিছু মানে কী?” কেউ আবার ফিসফিস করে বলল—“ভূত-প্রেত নাকি?”
ঋদ্ধির মনে হল, সত্যিটা আবার লুকোনো হচ্ছে। প্রশাসক কেবল অর্ধেক বলছে।
সেদিন রাতেই সে এক অদ্ভুত পরিকল্পনা করল। বাবার অফিস—Hydro-Lab—এ মাঝে মাঝে সে যেত। বাবার অথরাইজড কার্ড দিয়ে ল্যাবের ভিতরে প্রবেশ করা যেত। কিন্তু বাবার ড্রয়ারে সে একবার দেখেছিল আরও একটা ছোট্ট কী-চিপ, যেটা বিশেষ দরজার জন্য।
ঋদ্ধি সারা রাত অপেক্ষা করল। বাবা ঘুমিয়ে পড়ার পর চুপচাপ ড্রয়ার খুলে সেই চিপ বের করল। বুকের ভেতর কাঁপুনি সত্ত্বেও সে পা টিপে ল্যাবের দিকে চলে গেল।
ল্যাব ফাঁকা। চারদিক অন্ধকার, কেবল মেশিনের নীল আলো জ্বলছে। বিশাল স্ক্রিনের সামনে দাঁড়াতেই তার নিঃশ্বাস আটকে গেল। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছিল ভিডিও ফিড—গঙ্গার তলদেশের লাইভ ফুটেজ। আর সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল—অর্যা-দের ভেসে বেড়ানো অবয়ব।
তাদের চোখ নীল আলোয় ঝলমল করছে, আর শরীর স্রোতের সঙ্গে তরঙ্গিত। ঋদ্ধির বুকের মধ্যে ভয় আর বিস্ময় একসাথে জমল। এটাই সে দেখেছিল।
সে আরও খেয়াল করল—একটা ফোল্ডার খোলা আছে। নাম PROJECT VARUNA. সে দ্রুত সেটায় ঢুকে পড়ল। ভেতরে কিছু গোপন ফাইল—রিপোর্ট, ইমেজ, অডিও।
প্রথম রিপোর্টের শিরোনাম—“Non-Human Aquatic Entities (Codename: ARYA).”
ঋদ্ধি স্তব্ধ হয়ে পড়ল। সরকার জানে! অনেক আগে থেকেই জানে। রিপোর্টে লেখা আছে—
- অর্যা-রা অন্তত পাঁচশো বছর ধরে গঙ্গার গভীরে টিকে আছে।
- তাদের শরীর জল-অণু দ্বারা গঠিত, তাই আংশিক স্বচ্ছ।
- তারা মানুষের সঙ্গে টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ করতে সক্ষম।
- অমরাবতী নগরীর নির্মাণে তাদের আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে।
শেষ লাইনে লেখা—
“Recommendation: Suppression of Knowledge. Classified Threat to Human Expansion.”
ঋদ্ধির হাত কাঁপতে লাগল। Suppression of Knowledge—মানে ইচ্ছে করেই সবাইকে অন্ধকারে রাখা হচ্ছে।
হঠাৎ পেছনে শব্দ হলো। কেউ এগিয়ে আসছে। ঋদ্ধি তড়িঘড়ি করে চিপ বের করে ফাইল বন্ধ করল, কিন্তু তখনই বাবা অরিন্দম ঘরে ঢুকলেন।
“ঋদ্ধি!”
বাবার চোখ রাগে লাল হয়ে উঠল। “তুই এখানে কী করছিস?”
ঋদ্ধি তোতলাতে লাগল—
“আমি… আমি শুধু… দেখতে চেয়েছিলাম।”
অরিন্দম এক ঝটকায় স্ক্রিন বন্ধ করে দিলেন। তারপর কড়া গলায় বললেন—
“শোন, যা দেখেছিস সব ভুলে যা। এগুলো তোর জানার বিষয় নয়। এটা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ব্যাপার। আর যদি কখনো কাউকে কিছু বলিস, আমি নিজে তোকে শাস্তি দেব।”
ঋদ্ধির চোখে জল চলে এলো। কিন্তু মনে মনে সে শপথ করল—যা-ই হোক, সত্যিটা সে লুকোবে না।
সেই রাতেই বিছানায় শুয়ে তার কানে আবার সেই অচেনা কণ্ঠ বাজল—
“তুমি সত্য দেখেছ। এখন আমাদের সাহায্য করো।”
ঋদ্ধি কাঁপতে কাঁপতে ফিসফিস করে বলল—
“কীভাবে?”
কণ্ঠস্বর যেন জলের ভেতর থেকে উঠে এল—
“আমাদের মুক্ত করো। আমাদের গল্প মানুষের কাছে পৌঁছে দাও।”
তারপর নিস্তব্ধতা।
ঋদ্ধি বুঝল, সে এখন একা নয়। কিন্তু পথটা ভীষণ বিপজ্জনক।
পর্ব ৪: বিদ্রোহের বীজ
ঋদ্ধির মাথার ভেতর যেন তুফান বইছিল। সে জানে, তার চোখের সামনে যা খুলে গেছে, তা আর চাপা দেওয়া যাবে না। সরকার ইচ্ছে করেই সত্যিটাকে গোপন করছে, আর তার নিজের বাবা সেই যন্ত্রের অংশ হয়ে উঠেছেন। অথচ অর্যা-দের কণ্ঠস্বর তার কানে অনুরণিত হচ্ছিল—“আমাদের মুক্ত করো। আমাদের গল্প মানুষের কাছে পৌঁছে দাও।”
পরদিন স্কুলে গিয়ে সে সায়নীকে ডেকে নিল। প্রথমে দ্বিধা করছিল, কিন্তু আর চেপে রাখতে পারল না।
“সায়নী, তুই শোন। আমি দেখেছি। ওরা সত্যি আছে। অর্যা নামের প্রাণীরা। গঙ্গার নিচে, আমাদের কাঁচের বাইরে।”
সায়নী অবাক হয়ে তাকাল। “তুই আবার শুরু করলি? এগুলো গুজব।”
ঋদ্ধি গম্ভীর হয়ে বলল, “না। আমি বাবার ল্যাবে ঢুকে প্রোজেক্ট ভারুণার ফাইল দেখেছি। সরকার জানে সব। তারা চেপে যাচ্ছে।”
সায়নী স্তব্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর বলল, “মানে… সত্যি হলে ব্যাপারটা ভয়ানক। কিন্তু তুই আমায় কেন বলছিস?”
“কারণ আমি একা পারব না,” ঋদ্ধি বলল। “তুই আমার বন্ধু। তোকে ছাড়া আমি কাউকে বিশ্বাস করতে পারব না।”
সায়নী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “এটা খুব বিপজ্জনক। ধরা পড়লে তোকে জেলে পাঠাবে।”
ঋদ্ধির গলা কেঁপে উঠল। “তাও আমাকে করতে হবে। ওরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। টেলিপ্যাথি দিয়ে কথা বলেছে। আমাদের সতর্ক করছে। যদি আমরা না শুনি, শহরটাই ধ্বংস হয়ে যাবে।”
সায়নী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক আছে। আমি তোকে সাহায্য করব।”
ঋদ্ধির বুক হালকা হয়ে গেল।
সেই সন্ধ্যায় তারা দুজন গোপনে গম্বুজের উত্তর প্রান্তে গেল। বাইরে গঙ্গার অন্ধকার ঢেউ খেলছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হঠাৎ আবার দেখা দিল সেই অবয়ব। তিনটি অর্যা ভেসে এল কাঁচের কাছে। তাদের চোখের নীল আলো তীব্র হয়ে উঠল।
সায়নী প্রথমে পিছিয়ে যেতে চাইছিল, কিন্তু ঋদ্ধি তার হাত শক্ত করে ধরল। আর তখনই তাদের দুজনের মাথার ভেতরে একসঙ্গে কণ্ঠস্বর বেজে উঠল—
“আমরা তোমাদের অপেক্ষায় ছিলাম।”
সায়নী হাঁপিয়ে উঠল। “ঋদ্ধি, আমি শুনতে পাচ্ছি!”
অর্যা-রা বলল, “তোমাদের নগরী যত বাড়ছে, আমাদের ঘর তত ভেঙে যাচ্ছে। আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন। কিন্তু তোমাদের সরকার চায় না মানুষ সত্য জানুক। তারা আমাদের ধ্বংস করতে চাইছে।”
ঋদ্ধি কাঁপা গলায় বলল, “তাহলে আমরা কী করতে পারি?”
অর্যা-রা বলল, “তোমরা মানুষদের জাগাও। প্রমাণ দাও। দেখাও যে আমরা আছি। তবেই আমাদের বাঁচানো যাবে।”
সায়নী সাহস সঞ্চয় করে বলল, “কিন্তু আমরা তো সাধারণ ছাত্র। প্রমাণ কীভাবে দেব?”
তখন একটি অর্যা কাঁচের ওপর হাত রাখল। কাঁচ কেঁপে উঠল হালকা। হঠাৎ সায়নীর কব্জির ঘড়ি নিজে থেকেই ঝলমল করে উঠল। তাতে ভেসে উঠল এক অচেনা প্রতীক—একটা বৃত্তের ভেতর তিনটি ঢেউয়ের রেখা।
কণ্ঠস্বর বলল, “এটাই আমাদের চিহ্ন। যখন সময় আসবে, এটা ব্যবহার করো।”
তারপর তারা অদৃশ্য হয়ে গেল।
ঋদ্ধি আর সায়নী হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
পরদিন অমরাবতী নগরীতে আরেকটা বড়ো ঘটনা ঘটল। লাউডস্পিকারে ঘোষণা হলো—“Hydro-Lab এর বাইরে অননুমোদিত সিগন্যাল ধরা পড়েছে। নাগরিকদের জানানো হচ্ছে, কোনো অস্বাভাবিক কিছু দেখলে অবিলম্বে প্রশাসনকে জানাতে হবে।”
মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। কেউ কেউ ফিসফিস করে বলল, “এটা নিশ্চয়ই বাইরের অদ্ভুত ছায়াদের ব্যাপার।” আবার কেউ বলল, “সরকার শুধু ভয় দেখাচ্ছে।”
ঋদ্ধির বাবা অরিন্দম এ নিয়ে বাড়ি ফিরেই রাগে ফুঁসতে লাগলেন। “কেউ না কেউ নিয়ম ভাঙছে। আমি জানি, কিছু বাচ্চারা গোপনে ওই প্রান্তে যায়। আবার যদি কাউকে ধরি, সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
ঋদ্ধি চুপ করে থাকল, কিন্তু মনে মনে জানত বাবার সন্দেহ ওর ওপর পড়ছে।
সেই রাতেই সায়নী ঋদ্ধিকে ডাকল। “আমার মনে হয় আমাদের কিছু করতে হবে। কেবল অপেক্ষা করলে হবে না।”
“কী করবে?” ঋদ্ধি জিজ্ঞেস করল।
“প্রমাণ জোগাড় করব। তোর বাবার ল্যাবের ফাইল থেকে কপি করতে হবে। সেটাই সবার সামনে আনতে হবে।”
ঋদ্ধির বুক কেঁপে উঠল। “এটা অসম্ভব। ল্যাবের সিকিউরিটি খুব কড়া।”
সায়নী দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “অসম্ভব কিছু নেই। আমাদের হাতে অর্যা-দের দেওয়া চিহ্ন আছে।”
সে তার কব্জির ঘড়ি দেখাল। ঘড়ির মধ্যে প্রতীকটা আবার হালকা আলোয় ঝলমল করছে।
ঋদ্ধি স্তব্ধ হয়ে তাকাল। বুঝল, আর ফেরার পথ নেই। তারা এখন বিদ্রোহের পথে পা বাড়িয়েছে।
ঠিক তখনই শহরের অন্য প্রান্তে, প্রশাসক ডঃ শোভনলাল দত্ত গোপন বৈঠকে বসেছেন। টেবিলের ওপর প্রোজেক্ট ভারুণার ফাইল খোলা।
“অর্যা-রা আবার যোগাযোগ শুরু করেছে। এবার আমাদের কঠিন ব্যবস্থা নিতে হবে। যদি এই খবর ছড়িয়ে পড়ে, অমরাবতীতে বিশৃঙ্খলা হবে।”
একজন বিজ্ঞানী গম্ভীর গলায় বলল, “তাহলে পরিকল্পনা অনুযায়ী Phase Two শুরু করতে হবে।”
ডঃ দত্ত মাথা নেড়ে বললেন—
“হ্যাঁ। Phase Two: Neutralization.”
পর্ব ৫: প্রমাণের খোঁজে
ঋদ্ধির চোখে ঘুম নেই। মাথার ভেতর ঘুরছিল সেই প্রতীক—বৃত্তের ভেতর তিনটি ঢেউ। কব্জির ঘড়িতে সেটি যখনই জ্বলে ওঠে, মনে হয় অর্যা-রা ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন কোনো অদৃশ্য বন্ধন জেগে উঠেছে।
সায়নী একেবারে স্থির। পরদিন স্কুল শেষে সে সরাসরি বলল,
“আজ রাতেই ল্যাবে ঢুকব।”
ঋদ্ধি আঁতকে উঠল। “এত তাড়াহুড়ো কেন? ধরা পড়লে সর্বনাশ।”
সায়নী চোখ সরু করে তাকাল। “তুই বুঝছিস না? সরকার Phase Two শুরু করতে চলেছে। মানে তারা অর্যা-দের ধ্বংসের প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদি আমরা এখনই প্রমাণ না দিই, সব শেষ হয়ে যাবে।”
ঋদ্ধি চুপ করে গেল। তার বাবার মুখ মনে পড়ল—গম্ভীর, ভীতিকর, কিন্তু একইসাথে অসহায়। হয়তো তিনিও জানেন, যা ঘটছে তা অন্যায়, তবু সরকারের চাপে তিনি চুপ।
রাত নেমে এলে তারা দুজন চুপচাপ বেরোল। অমরাবতীর গলিগুলো নিরব, শুধু আলো জ্বলছে কৃত্রিম গাছের পাতায়। Hydro-Lab এর দিকে যাওয়া মানে বিপদ ডেকে আনা, কিন্তু তারা জানত, আর কোনো উপায় নেই।
ল্যাবের মূল দরজায় সিকিউরিটি স্ক্যানার। অরিন্দমের কী-চিপ ছাড়াই ঢোকা অসম্ভব। কিন্তু সায়নী কব্জির ঘড়ির প্রতীক স্পর্শ করতেই আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। স্ক্যানারের লাল আলো সবুজ হয়ে গেল, আর দরজা নিজে থেকেই খুলে গেল।
ঋদ্ধি হাঁফ ছেড়ে ফিসফিস করে বলল, “এটা কীভাবে হলো?”
সায়নী গম্ভীরভাবে উত্তর দিল, “অর্যা-রা আমাদের সাহায্য করছে।”
ভেতরে ঢুকে তারা সোজা গেল সেই কন্ট্রোল রুমে, যেখানে ঋদ্ধি আগেও ফাইল দেখেছিল। বিশাল স্ক্রিনে আবার ভেসে উঠল গঙ্গার তলদেশ। কাঁচের বাইরের অন্ধকার জলে অর্যা-দের অবয়ব ভেসে বেড়াচ্ছে।
ঋদ্ধি তাড়াহুড়ো করে কনসোলে ঢুকল। PROJECT VARUNA ফোল্ডার খুলে সে ফাইলগুলো ডাউনলোড করতে শুরু করল। কিন্তু তখনই হঠাৎ অ্যালার্ম বাজতে লাগল। লাল আলো ঝলমল করে উঠল।
সায়নী ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “ধরা পড়ে গেছি!”
ঋদ্ধি গলা শুকিয়ে বলল, “না, অপেক্ষা কর। ফাইল প্রায় কপি হয়ে গেছে।”
কিন্তু দরজা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকলেন অরিন্দম। তার চোখ রাগে জ্বলছে।
“আমি জানতাম! তুই আবার এখানে আসবি।”
ঋদ্ধি কাঁপতে কাঁপতে বলল, “বাবা, ওরা সত্যি আছে। আমরা সবাইকে জানাতে চাই।”
অরিন্দম গর্জে উঠলেন, “এটা রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য। তুই বুঝিস না, এতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে? মানুষের শহর ভেঙে পড়বে।”
সায়নী এগিয়ে এসে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “কিন্তু মিথ্যে বলে কোনো সভ্যতা টিকে থাকতে পারে না। সত্যি চাপা দিলে বিপর্যয় হবেই।”
অরিন্দম কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ স্ক্রিন কেঁপে উঠল। অর্যা-রা সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের চোখের নীল আলো তীব্র হয়ে জ্বলছে।
আর তখনই কণ্ঠস্বর বাজল—
“মানুষ, তোমরা সিদ্ধান্ত নাও। আমাদের ধ্বংস করবে, না সত্যিকে স্বীকার করবে?”
অরিন্দম হতবাক হয়ে গেলেন। “তাহলে তোমরাই সিগন্যাল পাঠাচ্ছিলে!”
অর্যা-রা উত্তর দিল, “হ্যাঁ। আমরা বহুদিন চেষ্টা করেছি, কিন্তু তোমাদের সরকার আমাদের শত্রু মনে করেছে। অথচ আমরা কেবল বাঁচতে চাই।”
ঋদ্ধি বাবার দিকে তাকাল। তার চোখে জল টলমল করছে।
“বাবা, দয়া করে। এদের মেরে ফেলো না। এরা শত্রু নয়।”
অরিন্দম স্তব্ধ হয়ে গেলেন। বহু বছর ধরে রাষ্ট্রের নিয়ম মেনে চলা মানুষ হঠাৎ দ্বন্দ্বে পড়ে গেল। তিনি ফিসফিস করে বললেন, “কিন্তু… যদি সরকারের বিরুদ্ধে যাই, তবে আমাকেও শেষ করে দেবে।”
সায়নী দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “কখনো কখনো এক মুহূর্তের সাহস ইতিহাস বদলে দেয়।”
অরিন্দম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “তোমরা পালাও। আমি অ্যালার্ম থামিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু সাবধান, প্রশাসন এত সহজে ছাড়বে না।”
ঋদ্ধি অবাক হয়ে তাকাল। “বাবা, তুমি…?”
“যাও,” অরিন্দম বললেন। “সত্যি লুকোনো আর সম্ভব নয়।”
তারা তড়িঘড়ি করে ফাইলের কপি হাতে নিয়ে ল্যাব থেকে বেরিয়ে গেল।
কিন্তু বাইরে বেরোনোর আগেই চারপাশে সাইরেন বাজতে শুরু করল। কাঁচের শহরের আকাশে লাল আলো জ্বলে উঠল। ঘোষণার কণ্ঠ বেজে উঠল—
“দ্রোহীদের আটক করো! রাষ্ট্রীয় তথ্য চুরি হয়েছে।”
ঋদ্ধি আর সায়নী দৌড়ে পালাতে লাগল। চারপাশে সশস্ত্র প্রহরী ছুটে আসছে। তাদের মাথার ভেতরে আবার অর্যা-দের কণ্ঠ বাজল—
“ভয় পেয়ো না। আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি।”
অন্ধকার গলিপথ ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে ঋদ্ধি জানল, এখন আর পিছু হটার পথ নেই।
ঠিক তখনই শহরের কন্ট্রোল রুমে ডঃ শোভনলাল দত্ত দাঁড়িয়ে স্ক্রিনে সবকিছু দেখছিলেন। তাঁর ঠোঁটের কোণে শীতল হাসি খেলে গেল।
“তাহলে শুরু হলো বিদ্রোহ। এবার Phase Two দ্রুত শুরু করতে হবে।”
পাশের বিজ্ঞানী কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “Neutralization-এর মানে কি পুরো শহরকে ঝুঁকির মুখে ফেলা?”
দত্ত ধীরে ধীরে বললেন—
“প্রয়োজনে তাই। অমরাবতী বাঁচুক বা না বাঁচুক, কিন্তু মানুষকে জানতে দেওয়া যাবে না যে তারা একা নয়।”
পর্ব ৬: পালানোর ছক
অমরাবতীর ভেতর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। লাল সাইরেনের আলোয় গম্বুজের ভেতরটা যেন রণক্ষেত্র। নাগরিকরা ভয়ে ঘর থেকে উঁকি দিচ্ছে, আর প্রহরীরা অস্ত্র হাতে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। ঘোষণার কণ্ঠ বারবার বাজছে—
“দ্রোহীদের খুঁজে বের করো। রাষ্ট্রদ্রোহ সহ্য করা হবে না।”
ঋদ্ধি আর সায়নী শ্বাস নিতে হিমশিম খাচ্ছিল। অন্ধকার গলির ভেতর দৌড়ে চলতে চলতে তারা বুঝতে পারছিল—শহরের প্রতিটি নজরদারি ক্যামেরা তাদের খুঁজছে।
সায়নী ফিসফিস করে বলল, “আমরা বেশিক্ষণ লুকোতে পারব না।”
ঋদ্ধি হাঁপাতে হাঁপাতে উত্তর দিল, “আমাদের অর্যা-দের কাছে পৌঁছতে হবে। শুধু ওরাই বাঁচাতে পারবে।”
তখনই কব্জির ঘড়ি ঝলমল করে উঠল। প্রতীকের ভেতর থেকে এক টান অনুভব করল দু’জনেই। কানে ভেসে এল অর্যা-দের কণ্ঠ—
“পূর্ব প্রান্তে এসো। আমরা পথ খুলে দেব।”
তারা দুজন দৌড়াতে লাগল পূর্ব প্রান্তের দিকে। ওদিকে শহরের ভেতর ভিড় বাড়ছে, মানুষ আতঙ্কে ঘুরছে, কেউ কেউ চিৎকার করছে, “কি হচ্ছে? কেন এত সৈন্য?”—কিন্তু কেউ উত্তর পাচ্ছে না।
এদিকে প্রশাসক ডঃ শোভনলাল দত্ত কন্ট্রোল রুমে দাঁড়িয়ে স্ক্রিনে সব নজর রাখছেন। তাঁর চোখে ভয় নয়, বরং শীতল দৃঢ়তা।
“এই দুই বাচ্চা শহরের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। এদের হাতে প্রমাণ আছে। কোনো মূল্যে ধরা পড়তে হবে।”
একজন অফিসার বলল, “স্যার, যদি এরা অর্যা-দের সঙ্গে যোগ দেয়?”
দত্ত ঠাণ্ডা গলায় বললেন, “তাহলেই Phase Two চালু করতে হবে। গম্বুজে চাপ বাড়িয়ে বাইরের সব স্রোত ধ্বংস করতে হবে। অর্যা-দের নিঃশেষ করতে হবে।”
বিজ্ঞানীরা কেঁপে উঠল। একজন ফিসফিস করে বলল, “কিন্তু এতে তো গম্বুজেরই ক্ষতি হবে…”
দত্ত কড়া দৃষ্টিতে তাকালেন। “প্রয়োজনে শহর উৎসর্গ করতে হবে। রাষ্ট্রের গোপনীয়তা বড়।”
ঋদ্ধি আর সায়নী পূর্ব প্রান্তে পৌঁছতেই দেখল, প্রহরীরা রাস্তা ঘিরে ফেলেছে। আর পালাবার পথ নেই। তখনই আশ্চর্য ঘটনা ঘটল—গম্বুজের একদম নীচের কাচে হঠাৎ ভেসে উঠল নীল আলো। কাচ যেন তরল হয়ে সরে গেল, খুলে গেল এক অদৃশ্য ফটক।
অর্যা-দের অবয়ব ভেসে এল, চোখে তীব্র দীপ্তি। কণ্ঠস্বর বাজল—
“দ্রুত ভেতরে আসো।”
ঋদ্ধি আর সায়নী একে অপরের হাত ধরে ঝাঁপ দিল কাঁচের ওপাশে। মুহূর্তেই তারা গম্বুজের ভেতর থেকে বাইরে, গঙ্গার জলে। অথচ তারা ডুবে গেল না—অর্যা-রা তাদের চারপাশে স্বচ্ছ বুদবুদের মতো সুরক্ষা তৈরি করেছিল।
ঋদ্ধি বিস্ময়ে চারদিক দেখল। গঙ্গার গভীরে অসংখ্য আলোকিত গুহা, অদ্ভুত স্থাপত্য, যেন জলের ভেতর গড়া এক প্রাচীন সভ্যতা।
অর্যা-দের কণ্ঠ বাজল—
“এটাই আমাদের আবাস। শতাব্দীর পর শতাব্দী আমরা এখানে টিকে আছি। মানুষ কখনো জানেনি। কিন্তু এখন তোমাদের শহর আমাদের ধ্বংস করছে।”
সায়নী হতবাক হয়ে বলল, “এটা… এত সুন্দর! অথচ আমাদের সবাইকে শেখানো হয়েছে যে বাইরে শুধু শূন্য অন্ধকার।”
অর্যা উত্তর দিল, “সত্যিই তাই। শূন্য অন্ধকারও আছে। কিন্তু জীবনও আছে। তোমাদের সরকার ভয় পেয়েছে। তাই তারা আমাদের মিথ্যে বানিয়েছে।”
এদিকে অমরাবতীর ভেতর খবর ছড়িয়ে পড়েছে—দুই কিশোর গায়েব হয়ে গেছে। প্রশাসন ঘোষণা করেছে—“এরা রাষ্ট্রদ্রোহী। যদি কেউ সাহায্য করে, তাকে শাস্তি দেওয়া হবে।”
মানুষ আতঙ্কে চুপ করে গেল। কেউ কেউ ফিসফিস করে বলল, “হয়তো সত্যিই বাইরের প্রাণীরা আছে।” কিন্তু উচ্চস্বরে বলার সাহস কারও নেই।
অরিন্দম একা বসে ছটফট করছিলেন। তাঁর ছেলে এখন সরকারের শত্রু। কিন্তু মনের গভীরে তিনি জানেন—ঋদ্ধিই সত্যি বলছে। দ্বন্দ্বে ভেঙে পড়া মানুষটার চোখে জল ভেসে উঠল।
অর্যা-দের শহরে ঋদ্ধি আর সায়নী প্রথমবার মুক্তির শ্বাস নিল। এখানে কোনো কাচের সীমা নেই, শুধু জলের নীলাভ আলো। অর্যা-রা তাদের ঘিরে দাঁড়াল।
“তোমরা আমাদের বন্ধু। কিন্তু সময় কম। সরকার আমাদের ধ্বংস করতে চাইছে। Phase Two শুরু হলেই গঙ্গার প্রবাহ বদলে যাবে, আমাদের শহর ভেসে যাবে।”
ঋদ্ধি দৃঢ় গলায় বলল, “আমরা তোমাদের বাঁচাব। প্রমাণ আছে আমাদের কাছে। আমরা সবাইকে দেখাব।”
অর্যা মাথা নেড়ে বলল, “তোমাদের ফিরতে হবে। মানুষকে জাগাতে হবে। আমরা সাহায্য করব, কিন্তু সিদ্ধান্ত তোমাদের।”
সায়নী গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “আমরা ফিরব। কিন্তু এবার ভয় পাব না।”
ঋদ্ধির মনে হলো, বিদ্রোহের বীজ সত্যিই রোপিত হয়েছে। আর তা আর থামানো যাবে না।
ঠিক তখনই অমরাবতীর কন্ট্রোল রুমে লাল বোতামের ওপর হাত রাখলেন প্রশাসক দত্ত। তাঁর কণ্ঠ ভেসে উঠল—
“Phase Two: শুরু করো।”
পর্ব ৭: ফেজ টু
অমরাবতীর কাঁচের গম্বুজে হঠাৎ করেই এক অদ্ভুত চাপ তৈরি হলো। শহরের নাগরিকরা আতঙ্কে বুঝতে পারছিল না কী ঘটছে। আলো নিভে গিয়ে আবার জ্বলছিল, যেন কৃত্রিম সূর্যের হৃদস্পন্দন কেঁপে উঠছে।
লাউডস্পিকারে গম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা এলো—
“নিরাপত্তার কারণে Phase Two চালু করা হয়েছে। সবাই ঘরে থাকুন।”
মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে একে অপরের দিকে তাকাল। “Phase Two?”—এই শব্দ তারা আগে শোনেনি। কিন্তু প্রশাসনের কণ্ঠে এমন হিমশীতল ভরসা ছিল যে তারা প্রশ্ন করতেও ভয় পেল।
গোপন কন্ট্রোল রুমে ডঃ শোভনলাল দত্ত মনিটরে চোখ রেখে বললেন,
“চাপ বাড়ানো শুরু করো। বাইরের স্রোত ভেঙে দাও। যত দ্রুত সম্ভব অর্যা-দের শহর ধ্বংস হোক।”
বিজ্ঞানীরা কনসোলের সামনে দাঁড়িয়ে দ্বিধায় পড়েছিল। একজন ফিসফিস করে বলল, “স্যার, এতে আমাদের গম্বুজও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।”
দত্ত কঠোর কণ্ঠে উত্তর দিলেন, “আমি বলেছি শুরু করো। রাষ্ট্রের জন্য কয়েকশো প্রাণ উৎসর্গ হলে ক্ষতি নেই।”
বাধ্য হয়ে তারা কন্ট্রোল সক্রিয় করল। বিশাল যন্ত্রের গর্জন শুনে গম্বুজ কেঁপে উঠল। বাইরের গঙ্গার স্রোত হঠাৎ উত্তাল হয়ে উঠল, জলকণা বজ্রের মতো আঘাত হানতে লাগল কাঁচে।
ঋদ্ধি আর সায়নী তখন অর্যা-দের শহরে। হঠাৎ চারদিক কেঁপে উঠল। স্বচ্ছ আলোকিত গুহাগুলোতে ঢেউ আছড়ে পড়ল। অর্যা-রা আতঙ্কে সরে গেল।
তাদের কণ্ঠ বাজল—
“মানুষরা Phase Two চালু করেছে। স্রোত ভেঙে দিচ্ছে। আমাদের ঘর ধ্বংস হয়ে যাবে।”
ঋদ্ধির বুক কেঁপে উঠল। “না, এটা হতে পারে না। আমাদের কিছু করতে হবে।”
সায়নী ফিসফিস করে বলল, “প্রমাণ তো আছে আমাদের হাতে। কিন্তু শহরের ভেতরে পৌঁছে সেটা দেখানো ছাড়া উপায় নেই।”
অর্যা-দের এক নেতা এগিয়ে এল। তার চোখে তীব্র আলো, কণ্ঠ আরও গভীর।
“আমরা তোমাদের নিরাপদে ফিরিয়ে দিতে পারি। কিন্তু তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নাও। সময় কম।”
ঋদ্ধি দৃঢ় গলায় বলল, “আমাদের ফিরিয়ে দাও। আমরা শহরের ভেতরে সত্য প্রকাশ করব।”
অর্যা হাত তুলতেই জলের ভেতর এক টান অনুভূত হলো। মুহূর্তে তারা আবার গম্বুজের ভেতরে ঢুকে পড়ল, পূর্ব প্রান্তের এক অন্ধকার করিডরে।
কিন্তু তখন শহরের ভেতর ভয়াবহ অবস্থা। কৃত্রিম বাতাসে চাপ বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। দেয়ালের কাচে ফাটল ধরছে। মানুষ আতঙ্কে চিৎকার করছে—
“গম্বুজ ভেঙে যাচ্ছে!”
প্রহরীরা চারদিকে টহল দিচ্ছে। প্রশাসনের নির্দেশ—দ্রোহীদের ধরো।
ঋদ্ধি সায়নীর হাত শক্ত করে ধরল। “এবার আমাদের সত্যিই কিছু করতে হবে। না হলে শহরও ধ্বংস হবে, অর্যা-দের ঘরও।”
সায়নী কণ্ঠ কঠিন করল। “তাহলে চল। মূল চত্বরেই প্রমাণ দেখাতে হবে। সবাইকে একসাথে জানাতে হবে।”
অন্যদিকে, অরিন্দম নিজের কক্ষে বসে সব খবর শুনছিলেন। শহর কাঁপছে, মানুষ আতঙ্কে, অথচ প্রশাসন শুধু ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। তাঁর বুকের ভেতর দ্বন্দ্ব তীব্র হচ্ছিল।
“আমি কি চুপ করে থাকব?”—নিজেকে প্রশ্ন করলেন। আর তখনই মনে পড়ল ছেলের কথা—“মিথ্যে বলে কোনো সভ্যতা টিকে থাকতে পারে না।”
হঠাৎ তিনি দাঁড়িয়ে উঠলেন। নিজের অথরাইজড কার্ড হাতে তুলে নিয়ে সোজা বেরিয়ে গেলেন।
ঋদ্ধি আর সায়নী চত্বরের দিকে দৌড়াচ্ছিল। চারপাশে বিশৃঙ্খলা, মানুষ ভয়ে চিৎকার করছে। তখনই স্ক্রিন ঝলমল করে উঠল। প্রহরীরা তাদের দেখে ছুটে আসছে।
ঋদ্ধি ব্যাগ থেকে সেই ফাইল-চিপ বের করল। তড়িঘড়ি করে মূল পাবলিক স্ক্রিনের কনসোলে সেটি লাগিয়ে দিল। মুহূর্তেই স্ক্রিনে ভেসে উঠল গোপন রিপোর্ট—
“Non-Human Aquatic Entities (Codename: ARYA).”
মানুষ বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। স্ক্রিনে অর্যা-দের ছবি, তাদের ইতিহাস, আর Phase Two-র পরিকল্পনা সব স্পষ্ট হয়ে উঠল।
চত্বর জুড়ে হৈচৈ শুরু হলো। কেউ চিৎকার করল, “তাহলে সত্যিই বাইরেও প্রাণ আছে!”
আরেকজন বলল, “আমাদের ঠকানো হয়েছে!”
প্রশাসনের প্রহরীরা চিপ খুলে ফেলতে ছুটল, কিন্তু তখনই অরিন্দম এসে দাঁড়ালেন।
“কেউ চিপ ছুঁবে না। মানুষকে সত্য জানতেই হবে।”
সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। নিজের সন্তানদের বাঁচাতে অরিন্দম এবার প্রশাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেলেন।
কন্ট্রোল রুমে দাঁড়িয়ে দত্ত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। “এটা বন্ধ করো! এখনই!”
কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। মানুষের ভেতর বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছে। তারা চিৎকার করছে—
“Phase Two বন্ধ করো!”
“অর্যা-দের হত্যা করা যাবে না!”
শহর যেন ফেটে পড়ছে।
ঠিক তখনই বাইরের গঙ্গার স্রোত আরও উত্তাল হলো। ফাটল ধরল গম্বুজের এক প্রান্তে। জল ঝাপসা হয়ে ঢুকতে চাইছিল। মানুষ আতঙ্কে ছুটতে লাগল।
অর্যা-দের কণ্ঠ ভেসে এলো—
“তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নাও। আমাদের সঙ্গে থাকবে, না ধ্বংসের পথে যাবে?”
ঋদ্ধির বুক কেঁপে উঠল। এবার সত্যিই জীবন-মৃত্যুর সীমানায় দাঁড়িয়ে গেছে তারা।
পর্ব ৮: ফাটলের ভেতর আলো
অমরাবতীর কাঁচের গম্বুজে যখন প্রথম ফাটল দেখা গেল, তখনও মানুষ ভেবেছিল হয়তো এটা সামান্য। কিন্তু সেকেন্ডের মধ্যেই বুঝতে পারল—ফাটলটা ছড়িয়ে পড়ছে। কাঁচে ফাটার শব্দ গোটা শহরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, যেন কোনো বিশাল বরফগিরি ভেঙে যাচ্ছে।
জনতার চিৎকার আকাশবিদারী। কেউ দৌড়ে পালাচ্ছে, কেউ সন্তানকে আঁকড়ে ধরে কাঁদছে। আবার কেউ বোকার মতো স্থির দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে ওপরে, যেখানে গঙ্গার কালো ঢেউ আলো-আঁধারিতে ঘূর্ণি তুলছে।
ঋদ্ধি সায়নীর হাত শক্ত করে ধরে ছিল। তাদের সামনে স্ক্রিনে এখনো ভেসে আছে Project Varuna-র ফাইল—অর্যা-দের ছবি, তাদের ইতিহাস, আর সরকারের মিথ্যে। মানুষের মধ্যে শোরগোল—
“তাহলে এতদিন আমাদের বোকা বানানো হয়েছে!”
“ওরা আমাদের শত্রু নয়, আমাদের মতোই প্রাণ!”
অরিন্দম এগিয়ে এসে গর্জে উঠলেন, “সবাই শান্ত হও! আতঙ্কে কিছু হবে না। সত্যিটা তোমাদের চোখের সামনে—অর্যা-রা আছে, তারা আমাদের শত্রু নয়। আমাদের শহরকে ধ্বংস করছে সরকারী গোপন প্রকল্প।”
ঠিক তখনই লাউডস্পিকারে শোভনলাল দত্তর গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো—
“নাগরিকগণ, শান্ত থাকুন। কেউ ভুয়ো তথ্য ছড়াচ্ছে। Phase Two চালু হয়েছে তোমাদের নিরাপত্তার জন্য। অর্যা-রা এক মারাত্মক হুমকি।”
কিন্তু এবার মানুষ বিশ্বাস করল না। তারা চিৎকার করে উঠল—
“মিথ্যে!”
“আমরা নিজের চোখে দেখেছি!”
কন্ট্রোল রুমে দাঁড়িয়ে দত্ত দাঁত চেপে বললেন, “ঠিক আছে। তাহলে জোর করে থামাতে হবে।”
তিনি ইঞ্জিনিয়ারদের নির্দেশ দিলেন, “চাপ আরও বাড়াও। গম্বুজ শক্ত করো। বাইরের সবকিছু ভেঙে ফেলতে হবে।”
বিজ্ঞানীরা কাঁপছিল। একজন ফিসফিস করে বলল, “স্যার, এতে ভেতরের চাপও বেড়ে যাবে। শহরটাই ফেটে যেতে পারে।”
দত্ত চোখ রাঙালেন। “প্রয়োজনে তাই হবে। রাষ্ট্রের সত্য লুকিয়ে রাখা জরুরি।”
এদিকে গম্বুজের ফাটল দ্রুত বাড়ছিল। জল ফোঁটা ফোঁটা করে ঢুকতে শুরু করেছে। মানুষ উন্মাদ হয়ে ছুটছে। সাইরেন বাজছে ক্রমাগত।
সেই বিশৃঙ্খলার মধ্যেই ঋদ্ধি সায়নীকে বলল, “আমাদের এখনই অর্যা-দের ডাকার চেষ্টা করতে হবে। নইলে সব শেষ।”
তারা দুজনে কব্জির ঘড়ি উঁচু করে ধরল। প্রতীকের আলো তীব্র হয়ে উঠল। মুহূর্তেই চারদিক কেঁপে উঠল, আর কাঁচের ওপাশে দেখা দিল অর্যা-দের দীপ্তিময় অবয়ব।
তাদের কণ্ঠ ভেসে এলো—
“আমরা এখানে আছি। কিন্তু তোমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে—আমরা কি কাঁচ ভেঙে সবাইকে মুক্ত করব, না তোমরা নিজেরাই আমাদের পাশে দাঁড়াবে?”
মানুষ হাহাকার করছে। অরিন্দম চিৎকার করে উঠলেন, “অর্যা-রা আমাদের সাহায্য করতে চায়! আমরা যদি ওদের মেনে নিই, তাহলে হয়তো বাঁচব।”
কিছু নাগরিক দ্বিধায় পড়ল। একজন বলল, “ওরা যদি শত্রু হয়?”
আরেকজন উত্তর দিল, “সরকারই শত্রু! ওরা আমাদের বোকা বানিয়েছে।”
ঋদ্ধি এগিয়ে এসে কণ্ঠ উঁচু করল—
“আমি নিজের চোখে দেখেছি। ওরা আমাদের মতোই প্রাণ। ওরা ধ্বংস চায় না, টিকে থাকতে চায়। আমরা যদি ওদের সঙ্গে না দাঁড়াই, গম্বুজ ভেঙে সব শেষ হয়ে যাবে।”
মানুষের মধ্যে তখন প্রথমবার ঐক্যের গর্জন উঠল—
“আমরা ওদের পাশে দাঁড়াব!”
কন্ট্রোল রুমে দত্ত মুখ বিকৃত করে ফেললেন।
“বোকা মানুষ! এরা জানে না, বাইরে কী বিপদ।”
তিনি হাত তুললেন। “শেষ অস্ত্র চালু করো। Neutralizer সক্রিয় করো।”
শহরের ভেতরে হঠাৎ সব আলো নিভে গেল। ভয়ঙ্কর অন্ধকার নেমে এল। কেবল ফাটল দিয়ে আসা নীলাভ আলো দেখা যাচ্ছিল। আর তখনই অর্যা-রা কাঁচে হাত রাখল।
কাঁচ কেঁপে উঠল, ফাটল আরও ছড়িয়ে গেল। জল ঢুকে পড়ল স্রোতের মতো। মানুষ চিৎকার করল। কিন্তু অর্যা-দের কণ্ঠ বেজে উঠল—
“ভয় পেয়ো না। মুক্তির পথ খোলাই একমাত্র উপায়।”
ঋদ্ধি আর সায়নী একে অপরের হাত শক্ত করে ধরল। অরিন্দমও এবার ছেলের পাশে এসে দাঁড়ালেন।
জল ঢুকতে শুরু করল, কিন্তু আশ্চর্য—মানুষ ডুবল না। অর্যা-রা চারপাশে সুরক্ষা ছড়িয়ে দিল। তাদের শহরের আলো মানুষের শরীর ঘিরে নীল আভা তৈরি করল।
জনতার মুখে তখন বিস্ময় আর স্বস্তি মিলেমিশে যাচ্ছে। তারা অনুভব করল, হয়তো সত্যিই মুক্তির সময় এসে গেছে।
ঠিক তখনই দত্তর কণ্ঠ আবার ভেসে এলো—
“এটা বিশ্বাসঘাতকতা! তোমরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যাচ্ছ!”
কিন্তু এবার কেউ তার কথা শুনল না। মানুষ চিৎকার করে উঠল—
“আমরা সত্যের পাশে! আমরা অর্যা-দের পাশে!”
বাইরের স্রোত যেন শহরটিকে আলিঙ্গন করে নিল। ফাটল প্রশস্ত হলো, জল গর্জন করে ঢুকে পড়ল। কাঁচ ভেঙে পড়তে লাগল।
অর্যা-রা হাত বাড়িয়ে মানুষকে টেনে নিল তাদের জলের শহরের দিকে। এক মুহূর্তে অমরাবতী ভেঙে পড়ল, আর শুরু হলো এক নতুন যাত্রা।
পর্ব ৯: নতুন শ্বাস
অমরাবতীর কাঁচের গম্বুজ ভেঙে পড়ার মুহূর্তটা ছিল ভয়াবহ, অথচ অলৌকিকও বটে। মানুষ ভেবেছিল তারা জলে ডুবে মরবে, কিন্তু বাস্তবে ঘটল ঠিক উল্টো। অর্যা-দের সৃষ্ট স্বচ্ছ নীল সুরক্ষার বুদবুদ প্রত্যেক নাগরিককে ঘিরে ফেলল। জল বুকের ভেতর ঢুকল না, বরং অদ্ভুত এক হালকা শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো কাজ করল। যেন গঙ্গা নিজেই শ্বাস দেওয়ার ক্ষমতা উপহার দিল।
মানুষ বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল চারপাশে। গঙ্গার অন্ধকার গভীরতা হঠাৎই আলোকিত হয়ে উঠেছে অসংখ্য দীপ্তি-ঝলমলে রেখায়। ওগুলো অর্যা-দের শহরের আলো, শৈবালের আলো, জলের ভেতর জন্ম নেওয়া অদ্ভুত জ্যোতির্ময় পাথরের আভা।
ঋদ্ধি অবাক হয়ে দেখল—অমরাবতীর ভেঙে যাওয়া ধ্বংসাবশেষ ধীরে ধীরে ভেসে যাচ্ছে, আর তার ভেতর থেকে মানুষদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে অর্যা-রা।
অরিন্দম হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, “অবিশ্বাস্য… এতদিন আমাদের বলা হয়েছিল বাইরের জগৎ মৃত্যুর মতো অন্ধকার। অথচ এ যে অন্য এক সভ্যতা!”
সায়নী নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “এটা যেন অন্য এক জন্ম।”
অর্যা-দের এক প্রবীণ নেতা তাদের দিকে এগিয়ে এল। তার চোখের দীপ্তি ছিল শান্ত অথচ প্রখর। কণ্ঠস্বর ভেসে উঠল—
“তোমরা ভয় পেয়ো না। আমরা জানতাম এই দিন আসবে। গম্বুজ ভাঙতেই হবে, কারণ মিথ্যে দিয়ে কোনো শহর বাঁচে না।”
মানুষরা একে অপরের দিকে তাকাল। কেউ এখনও ভয় পাচ্ছে, কেউ কাঁদছে, কিন্তু ধীরে ধীরে সবার মনে জমতে লাগল স্বস্তি—অন্তত তারা বেঁচে আছে।
ঋদ্ধি এগিয়ে এসে বলল, “কিন্তু এখন কী হবে? আমাদের ঘর তো শেষ হয়ে গেল।”
অর্যা নেতা শান্ত কণ্ঠে উত্তর দিল,
“এখন থেকে তোমাদের ঘর হবে আমাদের শহরও। জল আর মানুষকে আলাদা করে রাখা আর সম্ভব নয়। তোমরা শিখবে আমাদের মতো বাঁচতে, আর আমরা শিখব তোমাদের মতো বাঁচতে।”
কিন্তু সবাই এত সহজে মেনে নিতে পারল না। কয়েকজন নাগরিক চিৎকার করে উঠল,
“আমরা কি মাছ হয়ে যাব? আমরা তো মানুষ! এই জলে আমরা কতদিন টিকে থাকব?”
অরিন্দম গম্ভীর গলায় উত্তর দিলেন,
“তোমরা এখনও মানুষই থাকবে। শুধু পরিবেশ বদলেছে। আর বেঁচে থাকার জন্য এই নতুন পথ মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।”
ঋদ্ধি তখন সামনে এগিয়ে চিৎকার করে বলল,
“যতদিন আমাদের সরকার মিথ্যে বলে এসেছে, ততদিন আমরা অন্ধ ছিলাম। আজ আমরা চোখ খুলেছি। এখন আমাদের হাতে সুযোগ আছে—একসাথে নতুন সভ্যতা গড়ার।”
অর্যা-দের শহরে সবাইকে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে গুহার মধ্যে শৈবাল জ্বলছে, ফসফরাসের মতো আলো ছড়াচ্ছে। প্রাচীন প্রাচীরগুলোয় অদ্ভুত চিহ্ন খোদাই করা, যেন হাজার বছরের ইতিহাস লিখে রাখা।
সায়নী সেই চিহ্নের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“ঋদ্ধি, দেখ, এটা তো আমাদের কব্জির প্রতীকটার মতো!”
অর্যা নেতা মাথা নেড়ে বলল,
“হ্যাঁ। বহু যুগ আগে আমরা বিশ্বাস করতাম, একদিন জল আর ভূমির মানুষ আবার মিলিত হবে। এই প্রতীক সেই ভবিষ্যদ্বাণীর চিহ্ন।”
ঋদ্ধির বুকের ভেতর গর্বে ভরে উঠল।
কিন্তু বিপদ তখনও শেষ হয়নি। গঙ্গার ভেতর হঠাৎই বিস্ফোরণের মতো শব্দ হলো। শহরের ধ্বংসাবশেষ থেকে কিছু যন্ত্র সক্রিয় হয়ে উঠল।
অরিন্দম চমকে উঠলেন। “এগুলো Neutralizer! দত্তরা এগুলো আগে থেকেই বসিয়ে রেখেছিল। ওগুলো চালু হলে এই জলেই বিষ ছড়িয়ে পড়বে।”
অর্যা-রা আতঙ্কে সরে গেল। বিষাক্ত তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়লে তাদের পুরো সভ্যতাই ধ্বংস হবে।
ঋদ্ধি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আমাদের থামাতেই হবে। এখনই।”
সায়নী তার দিকে তাকাল। “কিন্তু কিভাবে?”
অরিন্দম দৃঢ় গলায় বললেন,
“আমার কাছে কোড আছে। আমি প্রশাসনের অংশ ছিলাম বলে এই যন্ত্রগুলোর মাস্টার-কী জানি। কিন্তু আমাকে সাহায্য করতে হবে।”
অর্যা নেতা হাত তুলল। “আমরা তোমাদের পথ দেখাব। একসাথে গেলে যন্ত্র ধ্বংস করা যাবে।”
মানুষের মধ্যে তখন নতুন সাহস জন্ম নিচ্ছে। তারা জানল, বাঁচতে হলে একসাথে দাঁড়াতে হবে—মানুষ আর অর্যা, দু’জনেরই।
ঋদ্ধি মনে মনে শপথ করল,
“আমরা যদি পারি এই যন্ত্র থামাতে, তবে শুরু হবে এক নতুন সভ্যতার কাহিনি।”
ঠিক তখনই দূরে জ্বলজ্বলে আলো ফেটে উঠল। সেখানেই সক্রিয় হয়েছে Neutralizer। স্রোতের ভেতর ধীরে ধীরে বিষ ছড়িয়ে পড়ছে।
পর্ব ১০: এক নতুন সভ্যতার ভোর
গঙ্গার তলদেশে তখন মৃত্যুর মতো নীরবতা, কেবল দূরে Neutralizer যন্ত্রের গর্জন। অদৃশ্য তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে, জল ধীরে ধীরে রঙ বদলাচ্ছে। নীলাভ আলোয় কালো রেখা বেয়ে যাচ্ছে, যেন বিষ ছড়িয়ে পড়ছে সমুদ্রশিরায়।
অরিন্দম শ্বাস টেনে বললেন,
“সময় কম। ওগুলো পুরোপুরি সক্রিয় হয়ে গেলে শুধু অর্যা নয়, আমরা মানুষও বাঁচব না।”
ঋদ্ধি মুঠি শক্ত করল। “আমরা থামাবো। একসাথে।”
অর্যা-দের নেতা এগিয়ে এল। তার চোখ দীপ্তিময়।
“আমরা স্রোতের শক্তি ব্যবহার করব। তোমরা মানুষের কোড দাও। তখন যন্ত্র ভেঙে পড়বে।”
সবাই মিলে এগোতে লাগল ধ্বংসস্তূপের দিকে। জলের ভেতর ভাসছে অমরাবতীর ভাঙা টুকরো—বাড়ি, স্কুল, বাজার, সবই অতীতের স্মৃতি। সেই ধ্বংসাবশেষের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে Neutralizer-এর কালো যন্ত্রগুলো, ভয়ঙ্কর আলো ছড়াচ্ছে।
সায়নী ফিসফিস করে বলল,
“ঋদ্ধি, এটা যেন শেষ যুদ্ধ।”
ঋদ্ধি মাথা নেড়ে উত্তর দিল,
“হ্যাঁ। জিতলে আমরা নতুন পৃথিবী পাব, হারলে সব শেষ।”
অরিন্দম যন্ত্রের কনসোলে হাত রাখলেন। স্ক্রিন জ্বলে উঠল, তাতে লাল অক্ষরে লেখা—
“Phase Two: Active.”
তিনি দ্রুত কোড টাইপ করতে শুরু করলেন। কিন্তু হঠাৎ স্ক্রিন কেঁপে উঠল। শোভনলাল দত্তর কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হলো—
“তোমরা মনে করছো এত সহজে আমাকে হারাতে পারবে? আমি এখনো কন্ট্রোল রুমে আছি। যন্ত্রের চাবি কেবল আমার হাতে।”
ঋদ্ধি দাঁত চেপে বলল,
“তুমি শহর ধ্বংস করেছো, দত্ত! এবার তোমাকে থামানোই হবে।”
অর্যা-রা হাত তুলে আলো ছড়িয়ে দিল। স্রোতের প্রবাহ যন্ত্রগুলোর দিকে ধেয়ে গেল, কিন্তু তখনই Neutralizer থেকে বজ্রের মতো বিদ্যুৎ ছুটল। কয়েকজন অর্যা কেঁপে উঠল, আলো নিভে গেল তাদের শরীরে।
সায়নী চিৎকার করে উঠল, “না!”
অরিন্দম হিমশীতল কণ্ঠে বললেন,
“ঋদ্ধি, শোন। শেষ এক কোড আছে—Override। এটা সক্রিয় করলে যন্ত্র থেমে যাবে, কিন্তু আমার আইডি মুছে যাবে। তার মানে আমি রাষ্ট্রদ্রোহী হয়ে যাব। আমায় হয়তো মেনে নেবে না কেউ।”
ঋদ্ধি বাবার হাত শক্ত করে ধরল।
“বাবা, ইতিহাস তোকে মনে রাখবে। রাষ্ট্র নয়।”
অরিন্দমের চোখে জল ভেসে উঠল। তিনি দ্রুত Override টাইপ করলেন। স্ক্রিনে ঝলমল করে উঠল—
“SYSTEM SHUTDOWN INITIATED.”
এক মুহূর্তে গর্জন থেমে গেল। Neutralizer নিভে পড়ল, তার ভেতরের লাল আলো নিস্তেজ হয়ে গেল। বিষ ছড়ানো বন্ধ হলো।
অর্যা-দের শহরে আলো ফেটে উঠল। তারা সবাই উল্লাসে ভেসে গেল।
“বাঁচলাম!”—তাদের কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হলো মানুষের মনের ভেতরেও।
মানুষেরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরল। ভয়ের জায়গায় এলো মুক্তির আনন্দ।
সায়নী নিঃশ্বাস ফেলল।
“ঋদ্ধি, আমরা পেরেছি।”
ঋদ্ধি চারপাশে তাকাল—অর্যা আর মানুষ, একই স্রোতের ভেতর দাঁড়িয়ে। সে অনুভব করল, এটাই নতুন পৃথিবীর শুরু।
দূরে শোভনলাল দত্ত কন্ট্রোল রুমে দাঁড়িয়ে হতভম্ব। স্ক্রিনে লেখা—
“Access Revoked. Control Terminated.”
তার চোখ লাল হয়ে উঠল। তিনি ফিসফিস করে বললেন,
“একদিন… তোমরা আমার কথা মনে করবে। মানুষ আর অন্য প্রাণ একসাথে থাকতে পারে না।”
কিন্তু তার কণ্ঠ তলিয়ে গেল স্রোতের ভেতরে।
অরিন্দম এবার নাগরিকদের সামনে দাঁড়ালেন।
“আজ থেকে আমরা অমরাবতীর মানুষ আর অর্যা একসাথে। গম্বুজ ভেঙেছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের শ্বাস ফুরোয়নি। আমরা বেঁচে আছি কারণ আমরা সত্য মেনেছি।”
মানুষের মুখে তখন একটাই স্লোগান উঠল—
“সত্যিই মুক্তি!”
অর্যা-রা হাত তুলে জল আলোকিত করল। গঙ্গার তলদেশে তখন যেন নতুন সূর্যোদয় ঘটল।
ঋদ্ধি গভীর নিঃশ্বাস নিল। সে জানত, ইতিহাসে আজকের দিনটা লেখা থাকবে—
এক শহরের পতন আর এক নতুন সভ্যতার জন্ম।
সায়নী তার পাশে এসে দাঁড়াল।
“এবার আমাদের গল্প শুরু হলো, ঋদ্ধি। কাঁচের ভেতর নয়, মুক্ত জলের ভেতর।”
ঋদ্ধি মাথা নেড়ে ফিসফিস করে বলল—
“হ্যাঁ। গঙ্গার তলদেশে, যেখানে অন্ধকার ভেঙে আলো জন্ম নেয়।”
সমাপ্ত