Bangla - রহস্য গল্প

গঙ্গার তলদেশে

Spread the love

অর্ক গাঙ্গুলী


এক

গঙ্গার জলে ভোরের আলো তখনও পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়েনি। ঘাটে দাঁড়িয়ে নদীর বুকের দিকে তাকিয়ে যেন মনে হচ্ছিল এক বিশাল, অগাধ রহস্য ছড়িয়ে আছে সামনে। অরিন্দম ঘোষ নীরবে দাঁড়িয়ে ছিলেন, হাতে ডাইভিং স্যুট আর সরঞ্জাম। তাঁর চোখে ছিল অভিজ্ঞতার গভীরতা, কিন্তু সেই চোখের ভেতরে লুকিয়ে ছিল অন্যরকম এক অস্বস্তি। জীবনে বহুবার ডুব দিয়েছেন, সমুদ্রের অন্ধকার গহ্বর থেকে শুরু করে পাহাড়ি নদীর স্রোত—সবই তাঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে আছে। তবুও আজ গঙ্গার তলদেশে নামার আগে অদ্ভুত এক অশনি বার্তা যেন তাঁকে গ্রাস করেছিল। সেই মুহূর্তেই মাঝি জগন্নাথ এগিয়ে এসে গম্ভীর স্বরে বলল, “বাবু, গঙ্গা সব দেখে, সব রাখে। তবে যা সে নিজের বুকের তলায় লুকিয়ে রাখে, মানুষকে তা হাতে নিতে নেই। অনেকেই চেষ্টা করেছে, কিন্তু কেউ ফেরেনি।” জগন্নাথের কণ্ঠস্বর ভাঙা, তবু তার প্রতিটি শব্দে এক অদৃশ্য ভয়ের ছায়া ফুটে উঠছিল। দলের তরুণ সদস্য রাহুল তখন হেসে উঠেছিল, “এ আবার কেমন কুসংস্কার! আমরা এসেছি বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতে, ভূত ধরতে নয়।” তৃষা মিত্র, দলের পদার্থবিদ, যদিও কিছু বলেনি, তবে জগন্নাথের চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল সে যেন কিছুটা শিহরিত।

দলটা ছিল ছয়জনের—অরিন্দম ঘোষ, তৃষা মিত্র, রাহুল দত্ত, সমীরণ বসু, ইতিহাসবিদ ড. ইশিতা সেন আর স্থানীয় সহকারী দুই মাঝি। এদের মধ্যে অরিন্দমই ছিলেন প্রধান, এবং বাকিরা তাঁর নির্দেশ মেনে চলত। সমীরণ ব্যস্ত ছিল ক্যামেরা চেক করতে, আলো আর লেন্স সঠিকভাবে কাজ করছে কিনা। সে চাইছিল প্রতিটি মুহূর্ত ধরে রাখতে, কারণ এই অভিযানের ফুটেজই হতে পারে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ। ইশিতা তখন নিজের নোটবইতে শেষ মুহূর্তের কিছু তথ্য লিখছিল—প্রাচীন শিলালিপি ও মন্দিরের ইতিহাসের সঙ্গে গঙ্গার এই অংশের যোগসূত্র খুঁজে বের করা তার কাজ। কিন্তু পুরো পরিবেশে এক অদ্ভুত চাপা নীরবতা বিরাজ করছিল। দূরে শঙ্খ বাজিয়ে সকালের পূজা হচ্ছিল, ঘাটে অল্প কিছু মানুষ স্নান সেরে উঠছিল, কিন্তু সেই সব শব্দও যেন অরিন্দমদের চারপাশে পৌঁছাচ্ছিল না। গঙ্গার জল স্থির, অথচ অদৃশ্য স্রোতের মতো যেন টেনে নিচ্ছিল তাদের।

অভিযান শুরু হলো। সবাই ডাইভিং স্যুট পরে ধীরে ধীরে নদীর বুকে নামতে লাগল। প্রথমে জলের স্বচ্ছতা তেমন খারাপ ছিল না, তবে নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে আলো হারিয়ে যাচ্ছিল। কেবল হেডলাইটের নরম ঝিলিক আর অক্সিজেন সিলিন্ডারের গুমগুম শব্দ শোনা যাচ্ছিল। রাহুল এগিয়ে গিয়ে হাত নেড়ে সবার উদ্দেশ্যে সংকেত দিল—সে ভেতরে প্রবেশ করতে প্রস্তুত। অরিন্দম মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন, তবে তাঁর চোখে উদ্বেগ স্পষ্ট। নিচে নামতে নামতে দেখা গেল, নদীর তলদেশে অদ্ভুত আকারের কিছু পাথরের স্তূপ জমে আছে, যেন কোনো ভগ্ন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। তৃষা নীরবে ইঙ্গিত দিল, এগুলো হয়তো নদীর স্রোতে ভেসে আসা প্রাকৃতিক শিলা নয়, বরং মানুষের তৈরি কিছু। সেই মুহূর্তেই সমীরণের ক্যামেরায় ধরা পড়ল—পাথরের ফাঁক দিয়ে যেন নীলচে আলো বের হচ্ছে। দল থেমে গেল, সবাই চোখ বড় বড় করে তাকাল। অরিন্দম হাত তুলে সংকেত দিলেন, “সাবধানে এগোও।”

 

জলের ভেতর নেমে আসা নীরবতার মাঝেই দল যখন এগোতে লাগল, হঠাৎ মনে হচ্ছিল চারপাশে কারা যেন অদৃশ্য হয়ে তাদের পথ দেখাচ্ছে। রাহুল উৎসাহে ভরে সামনের দিকে ছুটে গেল, তার হাতের আলো পড়তেই দেখা গেল অর্ধেক কাদায় ঢেকে থাকা এক মূর্তি। পাথরের তৈরি, কিন্তু পাথরটা যেন অন্যরকম—ধাতব শিরা ফুটে উঠেছে, গায়ে অদ্ভুত সব নকশা। মূর্তির মুখ ছিল শান্ত, অথচ চোখদুটো যেন জীবন্ত। তৃষা থমকে দাঁড়াল, তার বুক ধড়ফড় করছে। ইশিতা চোখ মেলে তাকিয়ে দেখছিল, ঠোঁট কাঁপছিল ফিসফিস করে—“এটা কোনো সাধারণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নয়… এটা অন্য কিছু।” জগন্নাথের সতর্কবাণী তখনই মনে পড়ছিল অরিন্দমের, কিন্তু ফিরবার আর সময় ছিল না। মূর্তিটি যেন নিজে থেকেই তাদের ডেকে আনছিল, যেন নদীর বুক ফুঁড়ে উঠে বলছিল—“এসো, আমার গোপন ভেদ উন্মোচন করো।” আর ঠিক সেই মুহূর্তেই দলের মধ্যে এক অদৃশ্য শীতল স্রোত বয়ে গেল, কারও চোখে ভেসে উঠল ভীতি, কারও মনে অদ্ভুত কৌতূহল। অভিযান শুরু হয়েছিল মাত্র, অথচ অরিন্দম জানতেন, তাদের জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অধ্যায় এখন শুরু হলো।

দুই

তৃষা মিত্রর চোখ যেন বিশ্বাস করতে চাইছিল না, যা সে দেখছে। পানির অন্ধকার স্তরের ভেতর দিয়ে হেডলাইটের আলো ছুঁয়ে গেল একটি মূর্তিকে, আর তখনই মনে হলো যেন এক ভিন্ন জগতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে তারা। মূর্তিটি মাটির নিচে আধা ডুবে আছে, চারপাশে শ্যাওলা আর কাদা জমে গেছে, তবুও এর ভেতর থেকে যেন অদ্ভুত নীলচে আভা বের হচ্ছে। তৃষা চোখ বড় বড় করে দেখছিল, কারণ পাথরের গায়ে যে শিরাগুলো ফুটে আছে, সেগুলো প্রাকৃতিক নয়—বরং যেন কোনো অদৃশ্য ধাতব শিরা মূর্তির ভেতর দিয়ে বইছে। সে জীবনে বহু খনিজ ও ধাতব যৌগের গবেষণা করেছে, নদীর খনিজ স্রোতের গঠন বিশ্লেষণ করেছে, কিন্তু এমন শিরাযুক্ত পাথর সে আগে কখনো দেখেনি। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, মূর্তির চারপাশে সাধারণত যেমন মাছেরা সাঁতার কাটে, সেরকম কিছুই নেই। চারপাশ একেবারে ফাঁকা, যেন জীবজন্তুরাও ভয়ে দূরে সরে গেছে। পানির ভেতরের স্রোত মৃদু হলেও মূর্তির চারপাশে এক অদৃশ্য স্থিরতা বিরাজ করছে। তৃষার বুক কেঁপে উঠল, আর ঠোঁট ফিসফিস করে বলল—“এটা কোনো সাধারণ বস্তু নয়।” তার কণ্ঠস্বর যদিও পানির নিচে কারও কানে পৌঁছায়নি, কিন্তু নিজের মনে সেই কথাটা প্রতিধ্বনির মতো বেজে উঠছিল।

অরিন্দম কাছে এসে মূর্তির চারপাশ ঘুরে দেখল। সে জীবনে অসংখ্য পুরনো ধ্বংসাবশেষ আর ভাঙা মূর্তি দেখেছে, কিন্তু এরকম মূর্তি নয়। সাধারণত নদীর নিচে পাওয়া ভগ্ন প্রতিমা শ্যাওলা আর কাদায় ক্ষয়ে যায়, কিন্তু এই মূর্তি অদ্ভুতভাবে অক্ষত, সময় যেন তার উপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। মূর্তির মুখ ছিল প্রশান্ত, অথচ চোখদুটোতে অদ্ভুত জীবন্ত ভাব। যেন পাথর নয়, কোনো মানুষ দীর্ঘদিন ধরে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। সমীরণ তার ক্যামেরা চালু করল, আর হেডলাইটের আলো ফেলে মূর্তির দিক থেকে ফুটেজ তুলতে লাগল। প্রথমে সব স্বাভাবিক লাগছিল, কিন্তু হঠাৎ সে দেখল ক্যামেরার লেন্স নিজে থেকেই ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। ফুটেজে দেখা যাচ্ছে শুধু ঝাপসা আভা, যেন কোনো নীল কুয়াশা ক্যামেরার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সমীরণ তাড়াহুড়ো করে লেন্স মুছতে লাগল, কিন্তু কিছুতেই কাজ হলো না। তার বুক কেঁপে উঠল, সে বুঝতে পারছিল মূর্তির আশেপাশে স্বাভাবিক কোনো পরিবেশ নেই।

রাহুল, যে দলের সবচেয়ে তরুণ এবং সবচেয়ে উৎসাহী, হঠাৎ মূর্তির সামনে গিয়ে হাত বাড়াল। তার চোখে তখন কেবল রোমাঞ্চের ঝিলিক—সে ভেবেছিল, এই আবিষ্কার যদি তার নামে হয়, তবে সে এক ঝটকায় বিখ্যাত হয়ে যাবে। তৃষা ইশারা দিয়ে তাকে থামাতে চাইছিল, চোখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট, কিন্তু পানির নিচে কথা বলার কোনো উপায় নেই। রাহুলের হাত মূর্তির গায়ে ছোঁয়ার আগেই সবাই লক্ষ্য করল, চারপাশের পানির রং যেন অদ্ভুতভাবে গাঢ় হয়ে আসছে। সাধারণত আলো পড়লে পানি স্বচ্ছ হয়ে যায়, কিন্তু এখানে উল্টো হলো—অরিন্দমের আলো যেন গিলে নিল অদৃশ্য কোনো শক্তি। মূর্তির চারপাশে নীলচে আভা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল, আর সেই আলো রাহুলের মুখে পড়তেই মনে হলো সে হঠাৎ জমে গেছে। তার চোখ স্থির হয়ে গিয়েছিল, শরীর নিস্তব্ধ, যেন কারও অদৃশ্য শক্তি তাকে আঁকড়ে ধরেছে। অরিন্দম তড়িঘড়ি করে রাহুলকে টেনে সরাল, আর তখনই নীল আভা ম্লান হয়ে গেল। সবাই স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল, বুক ধড়ফড় করছে, কিন্তু কারও সাহস হলো না শব্দ করার।

ড. ইশিতা সেন মূর্তির দিকে নিবিড়ভাবে তাকালেন। তিনি প্রাচীন ভারতের বহু মূর্তি নিয়ে গবেষণা করেছেন, কিন্তু এ মূর্তি আলাদা। এর গঠন, এর খোদাই করা নকশা, এমনকি এর ভঙ্গিমা কোনো পরিচিত দেবদেবীর সঙ্গে মেলে না। বরং মনে হচ্ছিল এটি এক অচেনা রক্ষক, কোনো শক্তিকে পাহারা দিচ্ছে। ইশিতা মনে মনে পুঁথির কিছু কথা মনে করার চেষ্টা করলেন—কোনো কোনো প্রাচীন কাহিনিতে বলা আছে, নদীর তলায় এমন কিছু প্রতিমা ডুবিয়ে রাখা হতো যা অভিশপ্ত, যাতে মানুষ তার সংস্পর্শে না আসে। তার মনের ভেতর এক অদ্ভুত শীতল স্রোত বইতে লাগল। তৃষা তখন তার নোটপ্যাডের ওয়াটারপ্রুফ বোর্ডে লিখে দেখাল—“এটা খনিজ নয়। এর ভেতর কিছু আছে।” ইশিতা মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। অরিন্দমও বুঝতে পারছিল, এখানে যা আবিষ্কার হয়েছে, তা কেবল প্রত্নতাত্ত্বিক বা বৈজ্ঞানিক নিদর্শন নয়, বরং এমন কিছু যা মানুষের বোঝার বাইরে। দল স্তব্ধ হয়ে মূর্তির দিকে তাকিয়ে রইল, আর গঙ্গার বুকের নিচে অদৃশ্যভাবে বয়ে যাওয়া স্রোত যেন ফিসফিস করে বলছিল—“তোমরা ভুল জায়গায় পা দিয়েছ।”

তিন

রাহুল দত্তের বুকের ভেতরে তখন এক অদ্ভুত উন্মাদনা কাজ করছিল। সে সবার চোখের সামনে প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে, সে-ই দলের সবচেয়ে সাহসী ডুবুরি, আর কোনো অদ্ভুত পাথরের মূর্তি তাকে ভয় দেখাতে পারবে না। অরিন্দম বারবার হাত তুলে সাবধান করছিল, তৃষা আতঙ্কে মাথা নাড়ছিল, কিন্তু রাহুলের ভেতরের আগুন তখনো জ্বলছিল। গঙ্গার বুকের ভেতর নিস্তব্ধ জলে সে ধীরে ধীরে মূর্তির দিকে হাত বাড়াল। তার গ্লাভস পরা হাত ছুঁতেই হঠাৎ মনে হলো ঠান্ডা কোনো স্রোত সারা শরীর বেয়ে উঠছে, যেন হিমশীতল ধাতব সাপ একসাথে তার শিরার ভেতর ঢুকে গেছে। মূর্তিটি অবিশ্বাস্যভাবে হালকা মনে হলো, অথচ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কাদায় চাপা থাকা পাথর কখনো এত সহজে নড়ানো সম্ভব নয়। রাহুল তা সত্ত্বেও টেনে তুলল, আর তখনই পানির চারপাশে হঠাৎ অদ্ভুত নীল আভা ছড়িয়ে পড়ল। পুরো তলদেশ যেন আলোকিত হয়ে উঠল, অথচ সেই আলোতে কোনো উষ্ণতা নেই—শুধুই এক শীতল ভয়ের তরঙ্গ। দলের বাকিরা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, আর তাদের চোখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠল।

মূর্তিকে নিয়ে যখন রাহুল ওপরের দিকে ভেসে উঠতে লাগল, বাকিরাও বাধ্য হয়ে তার পিছু নিল। সবাই উপরে উঠল, ঘাটের পাশে নিরাপদ জায়গায় দাঁড়িয়ে সরঞ্জাম খুলতে না খুলতেই দেখা গেল রাহুলের শরীর অদ্ভুতভাবে কাঁপছে। তার শ্বাসপ্রশ্বাস অস্বাভাবিক দ্রুত হয়ে উঠেছিল, যেন কেউ তাকে ভেতর থেকে চেপে ধরছে। তার চোখে তখন অস্বাভাবিক নীল আভা, যেন চোখের মণি ভেতর থেকে জ্বলছে। তৃষা ভয়ে কেঁপে উঠল, তার মনে হচ্ছিল এই চোখ কোনো মানুষের নয়—বরং সেই মূর্তিরই প্রতিফলন। সমীরণ ক্যামেরা চালু রেখেছিল, কিন্তু তার হাত কাঁপছিল এতটাই যে ফ্রেম বারবার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল। সে বারবার চেষ্টা করছিল ফুটেজ ধরা, কিন্তু তার মনের গভীরে ভয় ঢুকে গিয়েছিল—এই ফুটেজ পরে কেউ দেখলে হয়তো বলবে এগুলো মানুষের চোখ নয়, কোনো প্রেতাত্মার দৃষ্টি।

অরিন্দম তাড়াতাড়ি রাহুলকে বসিয়ে দিল। সে নিজের অভিজ্ঞতায় বুঝছিল, পানির নিচে অনেক সময় অক্সিজেন লেভেলের পরিবর্তন বা স্রোতের চাপ মানুষের শরীরে অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ঘটাতে পারে। কিন্তু এ ঘটনা একেবারেই ভিন্ন। রাহুলের শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছিল, অথচ তার চোখ জ্বলছিল আগুনের মতো। ইশিতা কাছে এসে কপালে হাত রাখল, কিন্তু হাত দিয়েই সে পিছিয়ে গেল। তীব্র শীতলতা তার আঙুলে ছড়িয়ে পড়ল, যেন বরফের উপর হাত রেখেছে। “এটা সাধারণ অসুস্থতা নয়,” ইশিতা ফিসফিস করে বলল, “এই মূর্তিতে কিছু আছে… কিছু অভিশপ্ত।” তৃষা যুক্তি খুঁজতে চাইছিল, কিন্তু তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা মাথার ভেতর গুলিয়ে যাচ্ছিল। সে ভেতরে ভেতরে বুঝছিল—এটা কোনো খনিজ প্রতিক্রিয়া নয়, এটা ভিন্ন কিছু, যা তাদের বোঝার বাইরে। রাহুল তখনো হঠাৎ হঠাৎ গলগল করে অচেনা ভাষায় কিছু আওড়াচ্ছিল, যা শুনে জগন্নাথ সরে দাঁড়াল ভয়ে। মাঝি হাত জোড় করে উচ্চারণ করল, “বাবুগণ, আমি আগেই বলেছিলাম—গঙ্গার বুকে যা বন্দি, তা ছুঁতে নেই। এখন আর কিছু করার নেই।”

হাওয়া হঠাৎ ভারী হয়ে উঠল, চারপাশে এক অদৃশ্য অশুভ উপস্থিতি যেন ছড়িয়ে পড়ল। মূর্তিটি পড়ে ছিল পাশে, ভিজে কাদামাখা শরীর নিয়ে যেন অদ্ভুত নীরবতায় তাকিয়ে আছে সকলের দিকে। কেউ ছুঁতে সাহস করল না। অরিন্দম মূর্তির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল, এই যাত্রা আর শুধুই গবেষণা বা অভিযান নয়—এটা শুরু হয়েছে এক অভিশপ্ত পরীক্ষার, যার ফল ভয়ঙ্কর হতে চলেছে। রাহুল কাঁপতে কাঁপতে হঠাৎ থেমে গেল, তার চোখের আভা নিভে এল, শরীর ধপ করে পড়ে গেল মাটিতে। দলের সবাই ছুটে গেল, কেউ নাড়ি পরীক্ষা করল, কেউ মুখে শ্বাস দিতে চাইলো, কিন্তু সেই মুহূর্তে নদীর হাওয়ায় এক শীতল হাহাকার ভেসে উঠল। মনে হলো, গঙ্গার বুক থেকে কেউ যেন ফিসফিস করে হাসছে—“স্পর্শের প্রথম মূল্য দেওয়া হয়ে গেল।” দলের বুকের ভেতর শিহরণ বয়ে গেল, আর তাদের চোখে আতঙ্ক জমে রইল। তারা তখনও জানত না, এটা ছিল কেবল শুরু।

চার

রাত নেমে এসেছে। গঙ্গার তীরে ছাউনি খাটিয়ে ডুবুরি দলটি বসে আছে আতঙ্ক আর ক্লান্তি নিয়ে। নদীর বুক জুড়ে হালকা কুয়াশা ভেসে বেড়াচ্ছে, বাতাসে ভিজে গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে, আর দূরে কোথাও শেয়ালের ডাক ভেসে আসছে। অরিন্দম ঘোষ টিমের সবাইকে শান্ত রাখতে চেষ্টা করছেন, কিন্তু তার চোখের কোণে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট। রাহুল দত্ত, যে বিকেলেই মূর্তিকে ছুঁয়ে দেখেছিল, এখন শয্যায় অস্থিরভাবে এপাশ-ওপাশ করছে। তার শরীর কাঁপছে, ঠোঁট ফেটে বেরিয়ে আসছে অচেনা অস্পষ্ট শব্দ, যা দেখে দলের অন্যরা একে অপরের দিকে আতঙ্কভরা চোখে তাকাচ্ছে। তৃষা মিত্র কয়েকবার রাহুলের কাছে গিয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু তার ঠান্ডা ঘামে ভিজে যাওয়া দেহ আর অচেনা নীল আভায় চকচক করা চোখ দেখে সে পিছিয়ে এসেছে। সমীরণ, দলের ডকুমেন্টারি ক্যামেরাম্যান, ক্যামেরাটা ট্রাইপডে বসিয়ে সবকিছু ধারণ করছিল। সে বলেছিল, “যদি কাল কোনো রিপোর্ট দিতে হয়, প্রমাণ আমাদের হাতেই রাখতে হবে।” কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারও গলা শুকিয়ে আসছিল। জগন্নাথ মাঝি দূর থেকে তাকিয়ে ছিল। সে আগেই সাবধান করেছিল—“গঙ্গার বুকে কিছু আছে যা মানুষকে ছাড়ে না।” কিন্তু তার কথার সত্যতা এভাবে যে প্রকাশ পাবে, তা দলের কারও কল্পনায় ছিল না।

মধ্যরাতের কিছু পরেই অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটে। চারদিক অস্বাভাবিকভাবে নিস্তব্ধ হয়ে যায়, যেন বাতাসও শ্বাস নিতে ভয় পাচ্ছে। হঠাৎ করে রাহুল উঠে দাঁড়ায়, যেন ঘুমের ঘোরে হাঁটছে। তার চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে নীল আভায়, মুখে যেন হাসি আর কষ্ট মিশে এক ভয়ঙ্কর ছায়া। অরিন্দম এগিয়ে এসে তাকে থামাতে যায়, কিন্তু রাহুল কোনো কথা না বলে নদীর দিকে হাঁটতে শুরু করে। দল থমকে যায়, তাদের বুক ধড়ফড় করতে থাকে। “রাহুল! দাঁড়াও!” তৃষার চিৎকার ভেসে ওঠে, কিন্তু রাহুল যেন কোনো অদৃশ্য ডাক শুনতে পেয়ে চলতেই থাকে। কয়েক পা পরেই সে সরাসরি নদীতে ঢুকে যায়। চারদিক থেকে চিৎকার ওঠে, সবাই দৌড়ে নদীর ঘাটের দিকে যায়। অন্ধকার পানিতে রাহুলের ছায়া এক মুহূর্ত দেখা যায়, তারপর হঠাৎই জল তাকে ভেতরে টেনে নেয়। ঠিক তখনই সমীরণের ক্যামেরা লেন্সে ধরা পড়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য—পানির ভেতরে ধোঁয়ার মতো গাঢ় অন্ধকারে এক ছায়ামূর্তি, যার হাত রাহুলের গোড়ালি আঁকড়ে ধরে তাকে গভীরের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। রাহুল লড়াই করার চেষ্টা করছে, হাত-পা ছুঁড়ছে, কিন্তু ধীরে ধীরে তার শরীর অদৃশ্য হয়ে যায় নদীর বুকের ভেতরে। চারপাশে শুধু গঙ্গার ঢেউয়ের শব্দ আর দলের চিৎকার প্রতিধ্বনি হয়ে বাজতে থাকে।

দল স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের চোখের সামনে প্রথম মৃত্যু ঘটে গেল, অথচ কেউ কিছু করতে পারল না। তৃষা হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে কান্নায় ভেঙে যায়। অরিন্দম দাঁত চেপে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন নিজের অসহায়তাকে লুকোতে চাইছে। সমীরণ ক্যামেরাটা বন্ধ করেও চুপ করে বসে যায়, কারণ তার হাতে যে ফুটেজ আছে, তা সাধারণ মানুষকে দেখানো সম্ভব নয়। কণ্ঠ শুকিয়ে যাওয়া অরিন্দম অবশেষে বলে উঠল, “এটা দুর্ঘটনা নয়। নদীর ভেতরে কেউ আছে, কিছু আছে। আমরা যেটা তুলেছি, সেই অভিশপ্ত মূর্তিই এর কারণ।” বাকিরা কাঁপতে থাকে। সুজয় হালকা কণ্ঠে বলে ওঠে, “আমাদের এখনই অভিযান বন্ধ করতে হবে। এই মূর্তি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আবার জলে ফেরত দিতে হবে।” কিন্তু প্রশ্ন হলো—আসলেই কি এত সহজে মুক্তি পাওয়া যাবে? মূর্তির অভিশাপ কি এভাবে শেষ হবে?

রাতের শেষে কেউ ঘুমাতে পারেনি। সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়ে বসে থাকে, যেন একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরে গেলে নদীর অন্ধকার তাদেরও টেনে নেবে। জগন্নাথ মাঝি দূর থেকে বিড়বিড় করে মন্ত্র জপছিল, যেন কোনো প্রাচীন বিশ্বাস দিয়ে এই অশুভ শক্তিকে দূরে সরাতে চাইছে। কিন্তু ভোর হওয়ার আগে দল বুঝে গেল—রাহুলের মৃত্যু শুধু শুরু। তাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল, ভেতরে ভেতরে তারা উপলব্ধি করতে শুরু করল যে গঙ্গার বুক থেকে যে রহস্যময় মূর্তি তারা তুলে এনেছে, সেটার মধ্যে লুকিয়ে আছে বহু পুরোনো কোনো অভিশাপ, যার প্রতিটি ধাপে তারা হয়তো হারাবে একজন করে মানুষ। অরিন্দম নিজের মনে প্রতিজ্ঞা করল—সে সত্যটা খুঁজে বের করবে, যত বড় বিপদই সামনে আসুক না কেন। কিন্তু তার বুকের ভেতরেও ভয় গেঁড়ে বসল—পরবর্তী মৃত্যুটা কার?

পাঁচ

ভোরের আলো গঙ্গার বুক ছুঁয়ে উঠতেই চারপাশের পরিবেশটা একেবারে অস্বাভাবিকভাবে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। ডুবুরি দলের মধ্যে আতঙ্ক, অবিশ্বাস আর অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে রাহুলের মৃত্যুর পর থেকে। অরিন্দম ঘোষ চুপচাপ বসে আছেন, কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি যেন দূরে কোথাও হারিয়ে গেছে। ঠিক তখনই ড. ইশিতা সেন এসে হাজির হন। তিনি ইতিহাসের অধ্যাপক, পাশাপাশি স্থানীয় লোকবিশ্বাস ও প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন নিয়ে গবেষণা করেন। জগন্নাথ মাঝি তাকে অনেকদিন ধরেই চিনত এবং অরিন্দমকে পরামর্শ দিয়েছিল, যদি কোনো অদ্ভুত জিনিস মেলে তবে ইশিতা সেনই সঠিক মানুষ। অরিন্দমের ডাকেই তিনি এসেছেন। ইশিতা হাতে একটি পুরোনো চামড়ায় মোড়ানো পুঁথি নিয়ে আসেন, যা তিনি কলকাতার এক অচেনা সংগ্রাহকের কাছ থেকে ধার করেছিলেন। টেবিলের ওপর মূর্তির একটি স্কেচ রাখা হলো, আর তার পাশে ইশিতা ধীরে ধীরে পুঁথির পাতা ওল্টাতে লাগলেন। ঘরে থাকা সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার কণ্ঠস্বর নীচু কিন্তু দৃঢ়—“এটা কোনো দেবতার মূর্তি নয়। এটা হলো অভিশপ্ত রক্ষক।” কথাটা শোনামাত্র দলের কারও মুখে কোনো কথা আর বেরোল না।

ইশিতা পড়তে শুরু করলেন, “শত শত বছর আগে, গঙ্গার এই অঞ্চলে এক ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা লেখা আছে। এক অভিশপ্ত সত্ত্বা, যাকে ‘রক্ষক’ বলা হতো, তাকে এখানে বন্দি করা হয়েছিল। এই রক্ষক ছিল না কোনো দেবতা বা পূজনীয় প্রতিমা। বরং তাকে গঙ্গার তলদেশে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল শিকল আর মন্ত্রে বাঁধা অবস্থায়, যাতে সে আর কখনও মানবলোকে ক্ষতি করতে না পারে। বলা হয়, এই রক্ষক অমানুষিক শক্তির অধিকারী ছিল—সে শুধু মানুষকে হত্যা করত না, বরং তাদের আত্মাকে টেনে নিত অন্ধকারে। তাকে থামাতে পেরেছিলেন কয়েকজন সাধক, যারা নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। তারপর মন্ত্রপূত পাথরের মূর্তি বানিয়ে তার মধ্যে তাকে বন্দি করা হয়, আর সেই মূর্তিটিকে গঙ্গার গভীরে ফেলে দেওয়া হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষ এ কথা ভুলে গেছে, কিন্তু নদী ভুলেনি।” কথাগুলো শুনে সবার শরীরে কাঁপন ধরে গেল। তৃষা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল, “মানে… আমরা ওই অভিশপ্ত সত্ত্বাকেই ছুঁয়ে এনেছি?” ইশিতা গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন।

ঘরে যেন হিমেল বাতাস বইতে লাগল। সুজয় ঠোঁট শুকনো করে বলল, “তাহলে রাহুলের মৃত্যু দুর্ঘটনা নয়। ওকে সে টেনে নিয়েছে।” সমীরণ ক্যামেরার দিকে ইশারা করে বলল, “আমার ফুটেজে যা ধরা পড়েছে, তা এই কথাই প্রমাণ করছে।” অরিন্দম গম্ভীর গলায় বলল, “আমাদের ভুল হয়েছে। আমরা যে কৌতূহল নিয়ে গঙ্গার বুক খুঁড়েছি, তা আমাদের জন্য মৃত্যু ডেকে আনবে।” ইশিতা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “এই মূর্তিকে ফেরত দিতে হবে। কিন্তু শুধু নদীতে ফেলে দিলেই হবে না। এখানে যে মন্ত্রে তাকে বাঁধা হয়েছিল, সেই মন্ত্র আবার জপ করতে হবে। আর সেই মন্ত্রের অনেকটা অংশ এখনো খুঁজে বের করতে হবে।” তিনি পুঁথির পাতায় হাত রেখে বললেন, “এখানে আংশিক লেখা আছে, কিন্তু পুরো মন্ত্র নেই। হয়তো স্থানীয় লোককথা বা কোনো মন্দিরে সেই অংশ লুকিয়ে আছে।” তৃষা আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “মানে আমাদের এখনো সময় আছে তো?” ইশিতা উত্তর দিলেন না, কিন্তু তার নীরবতা যেন অনেক কিছু বলে দিল।

বিকেলের দিকে অরিন্দম সিদ্ধান্ত নিলেন, দল ভেঙে না গিয়ে সবাই একসঙ্গে কাজ চালিয়ে যাবে। যদিও ভেতরে ভেতরে সবাই আতঙ্কে জর্জরিত, তবুও তারা জানে সত্যটা না খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত মুক্তি নেই। রাত নামার আগে ইশিতা আবার পুঁথির কয়েকটি অংশ পড়ে শোনালেন। সেখানে লেখা ছিল, “রক্ষক আলোকে ভয় পায়, কিন্তু স্পর্শ করলে আলোও তার রূপান্তরে অচেনা হয়ে যায়।” সবাই একে অপরের দিকে তাকাল, কারণ রাহুলের চোখেও তারা অদ্ভুত নীল আলো দেখেছিল। আরেক অংশে লেখা, “যে তাকে ছোঁবে, সে তার প্রথম পথ হয়ে উঠবে।” ইশিতা ধীরে গম্ভীর স্বরে বললেন, “রাহুল সেই পথ হয়েছিল। তাই প্রথম মৃত্যু তার। এখন আমাদের হাতে খুব কম সময় আছে।” চারপাশে নেমে আসা অন্ধকারে যেন গঙ্গার জলে হালকা ঢেউ খেলে যাচ্ছিল, আর দূরে শোনা যাচ্ছিল ভাঙা মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি। সেই মুহূর্তে দলের সবার মনে একই ভয় ভর করল—এটা কি কেবল ইতিহাসের ছায়া, নাকি ছায়া থেকে বেরিয়ে আসা এক জীবন্ত অভিশাপ, যা আবার সক্রিয় হয়ে উঠছে?

ছয়

সন্ধ্যা নেমে এসেছে গঙ্গার পাড়ে। ভাঙাচোরা মন্দিরের ধ্বংসস্তূপের পাশে ডুবুরি দল মূর্তিটিকে নিয়ে বসেছে। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, মূর্তিকে আপাতত এখানে সুরক্ষিত জায়গায় রাখা হবে, তারপর সকালে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করা হবে। কিন্তু দলের ভেতরেই অস্বস্তি আর ভয় যেন ক্রমশ বেড়ে উঠছে। অরিন্দম ঘোষ চুপচাপ মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে আছেন। কালো পাথরে খোদাই করা অদ্ভুত নকশাগুলো আলো পড়লেই যেন নীল আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে। ড. ইশিতা সেন মূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে বারবার তার পুরোনো পুঁথির পাতাগুলো উল্টাচ্ছিলেন। হঠাৎ করেই চারপাশে যেন এক অদৃশ্য শব্দ ভেসে উঠল—প্রথমে যেন বাতাসের সঙ্গে মিশে আসা ক্ষীণ ধ্বনি, তারপর ধীরে ধীরে তা স্পষ্ট হতে লাগল। শব্দটা ছিল এক অজানা জপমন্ত্রের মতো, গম্ভীর অথচ কর্কশ। কানে আসতেই মনে হচ্ছিল যেন কারওা গলার স্বর মাথার ভেতরে আছড়ে পড়ছে। দলের সবাই অবাক হয়ে চারপাশে তাকাতে লাগল, কিন্তু কোথাও কোনো মানুষ নেই। অরিন্দম গম্ভীর গলায় বলল, “সবাই চুপ করো, শব্দটা মন দিয়ে শোনো।”

মন্ত্রের ধ্বনি যত জোরালো হতে লাগল, তৃষা হঠাৎই মাথা চেপে বসে পড়ল। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, চোখ বড় বড় হয়ে উঠেছে যন্ত্রণায়। সে চিৎকার করে উঠল, “থামাও! প্লিজ থামাও! মাথা ফেটে যাচ্ছে!” অন্যরা ছুটে এসে তাকে ধরে রাখল, কিন্তু তার শরীর convulsion-এর মতো কাঁপতে শুরু করল। তৃষার ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে নিজে থেকেই সেই অদৃশ্য মন্ত্রের শব্দ আওড়াতে লাগল, যেন কেউ তার গলা দিয়ে কথা বলাচ্ছে। ইশিতা আতঙ্কে বলে উঠল, “ও আক্রান্ত হয়েছে! এই মন্ত্রটা কোনো সাধারণ শব্দ নয়, এটা রক্ষকের ডাক।” মূর্তির চারপাশে অদ্ভুত নীল কুয়াশা তৈরি হতে লাগল, যা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে দলকে ঘিরে ধরল। সমীরণ ক্যামেরা চালু করলেও ভয় তাকে গ্রাস করেছিল। লেন্সের ভেতরেও নীল আলোর ধাক্কা যেন ঝলসে উঠছিল। সুজয় কাঁপা গলায় বলল, “আমাদের এখনই মূর্তিটা ছেড়ে দিতে হবে!” কিন্তু মূর্তির ওপর হাত রাখতেই তার হাত ঝলসে গেল, যেন আগুনে পুড়ছে। সে ব্যথায় চিৎকার করে হাত সরিয়ে নিল। তৃষা তখনো যন্ত্রণায় ছটফট করছে, আর তার ঠোঁট দিয়ে নিরন্তর বেরিয়ে আসছে অচেনা সেই জপমন্ত্র।

অরিন্দম সাহস করে মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে উঠল। সে ইশিতার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি বলেছিলে এই মন্ত্রপূত মূর্তিকে বিশেষ জপে বন্দি করা হয়েছিল। তার মানে এই শব্দটাই হয়তো মুক্তির চেষ্টা।” ইশিতা কপালে ঘাম মুছতে মুছতে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু এই মন্ত্র অসম্পূর্ণ। পুরো মন্ত্র জানা না থাকলে এটাকে থামানো সম্ভব নয়।” অরিন্দম গর্জে উঠল, “তাহলে তৃষাকে কীভাবে বাঁচানো যাবে?” ইশিতা চুপ করে গেল। তৃষার শরীরের ওপর তখন অদ্ভুত ছায়ার নড়াচড়া দেখা যাচ্ছিল, যেন তার শরীর দিয়ে অন্য কেউ ভেতরে ঢুকে পড়তে চাইছে। সমীরণ আতঙ্কে ফিসফিস করে বলল, “এটা যদি পুরোপুরি ঢুকে পড়ে, তবে ও বাঁচবে না।” জগন্নাথ মাঝি তখন দূরে দাঁড়িয়ে ভাঙা মন্দিরের ঘণ্টা বাজাতে লাগল। ঘণ্টার ধ্বনি উঠতেই এক মুহূর্তের জন্য মন্ত্রের শব্দটা দুর্বল হয়ে এলো, আর তৃষা জোরে শ্বাস নিতে নিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তার শরীর কাঁপছিল, কিন্তু চোখ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক রঙ ফিরে পেল। সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, যদিও ভয়টা একটুও কমেনি।

কিন্তু স্বস্তি অল্প সময়ের জন্যই ছিল। ইশিতা দৃঢ় গলায় বলল, “এখন আর সময় নষ্ট করা যাবে না। রক্ষক আমাদের টেনে আনছে, সে আবার মুক্তি পেতে চাইছে। যত দেরি হবে, তত বিপদ বাড়বে। আমাদের আজ রাতেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে—কোথা থেকে মন্ত্রের বাকি অংশ খুঁজে আনা যায়।” দল নিস্তব্ধ হয়ে গেল। গঙ্গার ওপরে তখন পূর্ণিমার আলো ভেসে পড়েছে, আর ভাঙা মন্দিরের ঘণ্টার ধ্বনি কেমন যেন প্রতিধ্বনি হয়ে চারপাশে বাজছে। তৃষা মাটিতে শুয়ে ফিসফিস করে বলল, “ওর আওয়াজ আমি এখনো শুনতে পাচ্ছি…” সবার বুকের ভেতর হিম হয়ে গেল। মূর্তিটা তখনো নীল আভায় ঝলমল করছিল, যেন গঙ্গার অন্ধকার বুক থেকে অদৃশ্য কোনো সত্তা চেয়ে আছে—অপেক্ষা করছে, কে হবে তার পরবর্তী শিকার।

সাত

ভোরবেলায় কুয়াশা নামতে শুরু করেছিল গঙ্গার পাড়ে, মূর্তিটি ভাঙা মন্দিরের ধ্বংসস্তূপের পাশে কাপড়ে ঢাকা অবস্থায় রাখা। আগের রাতের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা থেকে কেউ এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি। তৃষা, যিনি মূর্তির অদৃশ্য মন্ত্রোচ্চারণে প্রথম আক্রান্ত হয়েছিলেন, ভেতরে ভেতরে দুঃস্বপ্নের মতো আতঙ্ক বহন করলেও নিজের পেশাদার সত্ত্বাকে দমিয়ে রাখতে পারলেন না। তিনি আবার ডুবুরি দলের যন্ত্রপাতি বের করে মূর্তির গঠন পরীক্ষা করতে শুরু করলেন। মাইক্রোস্কোপে খনিজের গঠন, ধাতব শিরার বিশ্লেষণ, এমনকি ছোট্ট নমুনা কেটে তার রাসায়নিক গঠন বের করার চেষ্টা করলেন। কিছু সময় পর তিনি ঘোষণা করলেন, “এটা মূলত খনিজগঠিত পাথর, যার ভেতরে ধাতব শিরা আছে। কোনো প্রাচীন সভ্যতা হয়তো অদ্ভুত কোনো কারিগরি ব্যবহার করেছে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এর সব ব্যাখ্যা বিজ্ঞানের মধ্যে আছে।” তাঁর কণ্ঠস্বর দৃঢ় ছিল, কিন্তু চোখেমুখে লুকোনো ক্লান্তি আর ভয়ের ছায়া তখনো ছিল স্পষ্ট। দলের কয়েকজন তার কথায় একটু আশ্বস্ত হলো, যেন ভয়ের গ্রাস থেকে সাময়িক মুক্তি পেল।

কিন্তু ঠিক তখনই ড. ইশিতা সেন পুঁথি হাতে এগিয়ে এলেন। তাঁর গলা নিচু, কিন্তু প্রতিটি শব্দে দৃঢ়তা ছিল, “তৃষা, তুমি যা দেখেছ, তা কেবল খনিজের ব্যাখ্যায় মেলে না। আমি বারবার বলেছি, এটা হলো প্রাণবন্দি প্রতীক। শতাব্দী আগে সাধকরা এর ভেতরে এক অভিশপ্ত সত্ত্বাকে বন্দি করেছিলেন। তুমি কি অস্বীকার করতে পারো রাহুলের মৃত্যু, কিংবা তোমার নিজের অভিজ্ঞতাকে? বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা আছে, ঠিক, কিন্তু সবকিছুর ব্যাখ্যা বিজ্ঞানে নেই।” ইশিতা মূর্তির দিকে তাকিয়ে বললেন, “এটা শুধু পাথর নয়। এটা হলো অন্ধকারের কারাগার।” দলের মধ্যে চাপা গুঞ্জন উঠল। সুজয় মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “আমাদের যা হচ্ছে, তাতে আমি মনে করি ইশিতার কথাই ঠিক।” অন্যদিকে সমীরণ বলল, “আমি ক্যামেরায় যা ধরেছি, তা বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়।” কিন্তু তৃষা নাছোড়বান্দা ভঙ্গিতে বলল, “আমরা যদি সবকিছুকে অলৌকিক বলে মেনে নিই, তবে গবেষণা, অনুসন্ধান—সব বৃথা। রাহুলের মৃত্যু কোনো প্রাকৃতিক গ্যাসের নির্গমনেও হতে পারে।” তার গলাতে যুক্তির জেদ ছিল, কিন্তু দলের বাকিরা তার প্রতি আস্থা হারাচ্ছিল।

অরিন্দম এই দ্বন্দ্বে দলের ভেতরে বিভাজন তৈরি হতে দেখলেন। তিনি বুঝলেন, ভয় যখন মানুষের মনকে আচ্ছন্ন করে, তখন বিশ্বাস আর বিজ্ঞানের লড়াই আরও তীব্র হয়। তিনি সবার সামনে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বললেন, “আমরা কেউই এখন নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না সত্যিটা কী। তৃষা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজছে, আর ইশিতা ইতিহাস ও বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু আমাদের সামনে কঠিন বাস্তবতা হলো—রাহুল মারা গেছে, আর আমাদের সবার জীবন ঝুঁকির মুখে। তাই বিজ্ঞান আর বিশ্বাস—দুটোকেই সমান গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা যদি কেবল বিজ্ঞানের পথ ধরি, তবে হয়তো মূর্তির প্রকৃতি বুঝতে পারব, কিন্তু অভিশাপের প্রভাব ঠেকাতে পারব না। আবার যদি কেবল বিশ্বাসে ভর করি, তবে যুক্তির আলো হারাব। আমাদের বাঁচতে হলে দুটো পথকেই মেলাতে হবে।” তার কণ্ঠে দৃঢ়তা থাকলেও সবাই দেখছিল—তার নিজের ভেতরেও দোটানা চলছে।

তবুও দলের মধ্যে ভাঙন শুরু হয়ে গেছে। সুজয় আর সমীরণ ইশিতার পাশে গিয়ে দাঁড়াল, তারা বিশ্বাস করছিল অলৌকিক কিছু ঘটছে। তৃষা এক কোণে বসে যন্ত্রপাতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল, কিন্তু তার চোখেমুখে স্পষ্ট হতাশা—সে বুঝতে পারছিল তার যুক্তি কাউকে প্রভাবিত করতে পারছে না। অরিন্দম এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধে হাত রাখল, “তুমি আমাদের কাছে খুবই জরুরি, তৃষা। বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা দরকার, কারণ সেটা ছাড়া আমরা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারব না।” তৃষা কোনো উত্তর দিল না, কেবল চুপচাপ কাজ চালিয়ে যেতে লাগল। সেই মুহূর্তে ভাঙা মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি আবার ভেসে এল বাতাসে, আর গঙ্গার জলে অদ্ভুত এক ঢেউ খেলে গেল। সবাই থমকে গিয়ে মূর্তির দিকে তাকাল। কাপড়ের আড়ালে থেকেও মনে হচ্ছিল, মূর্তির ভেতর থেকে কেউ শ্বাস নিচ্ছে। অন্ধকারে বিশ্বাস আর বিজ্ঞানের লড়াই যেন আরও প্রকট হয়ে উঠল, আর অরিন্দম বুঝতে পারলেন—এই দ্বন্দ্বই হয়তো দলকে ভেঙে ফেলবে, তার আগেই যদি অভিশাপ সবাইকে গ্রাস না করে।

আট

গঙ্গার ধারে রাতের অন্ধকার নামতেই হাওয়া বদলে গেল। নদীর ওপর কুয়াশার চাদর নেমে এসেছে, ভিজে বাতাসে যেন অজানা ভয়ের গন্ধ লুকিয়ে আছে। তৃষা, ইশিতা, অরিন্দম আর সমীরণ মিলে আগুন জ্বালিয়ে বসেছিল, অথচ কারও মুখে স্বাভাবিক কথা নেই। আগের রাতের মৃত্যুর আতঙ্ক এখনও সবাইকে চেপে ধরেছে। তখনই মাঝি জগন্নাথ ধীরে ধীরে সামনে এসে দাঁড়াল। তার মুখে সময়ের ছাপ, চোখে ঝড়ের ছায়া। সে কাঁপা গলায় বলল, “বাবু, তোরা যাহা ধরিছিস, তা মানুষে বানানো কিছু নয়। আমি ছোটোবেলায় দাদার মুখে শুনেছিলাম—গঙ্গার তলায় এক অভিশপ্ত রক্ষক বন্দি আছে। ওকে কেউ ছুঁলেই বিপদ ডেকে আনে।” কথা শেষ করে সে গভীরভাবে নদীর দিকে তাকাল, যেন অন্ধকার জলের ভেতরেই কারও চেহারা দেখতে পাচ্ছে। অরিন্দম প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিতে চাইলেও তৃষার শরীর কেঁপে উঠল। তার মনে হচ্ছিল, মাঝির এই অদ্ভুত সতর্কবাণী স্রেফ কোনো গ্রাম্য গপ্পো নয়, বরং ভয়ঙ্কর বাস্তবের ছায়া।

জগন্নাথের কাহিনি শুনে ইশিতার চোখে ভয়ের ছায়া ঘন হল। সে বলল, “আমি যে পুঁথি পড়েছি, তার সঙ্গে এর মিল আছে। ও কোনো দেবতা নয়, ও হলো অভিশপ্ত রক্ষক। প্রাচীন মন্ত্রে বাঁধা ছিল গঙ্গার তলায়। আমরা হয়তো সেই শিকল ভেঙে দিয়েছি।” তার গলায় কাঁপন, অথচ কথাগুলো পাথরের মতো ভারী হয়ে ঝুলে থাকল। তৃষা তখন হঠাৎ মনে করল রাহুলের শেষ রাতের কথা। ছায়ার মতো হাত যখন তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, সে ঠিক এমন এক চাপা জলের শব্দ শুনেছিল—যেন কারও ফিসফিসানি। মাঝি এবার ফিসফিস করে বলল, “ওকে তোরা নদী থেকে যত দূরে নেবি, মৃত্যু তত কাছে আসবে। গঙ্গা ওকেই সামলায়, বাইরে আনা মানেই বিপর্যয়।” সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। দূরে অন্ধকারে শেয়ালের ডাক, আগুনের আলো কেঁপে উঠল, আর তৃষার মনে হলো চারপাশে অদৃশ্য চোখ তাকিয়ে আছে।

অরিন্দম দৃঢ় গলায় বলতে চাইল, “আমরা বৈজ্ঞানিক গবেষণা করছি, অন্ধ বিশ্বাসে চলতে পারি না।” কিন্তু কথার ভেতরেই দ্বিধা লুকোনো ছিল। তার ক্যামেরায় ধরা পড়া সেই ভুতুড়ে হাত এখনও তার চোখের সামনে ভাসছে। সমীরণ ধীরে বলল, “দাদা, যদি সত্যিই এত পুরোনো কোনো অভিশাপ থাকে? মাঝির কথার সঙ্গে ইশিতার বইয়ের ইতিহাস মিলে যাচ্ছে। এখন কি করব?” চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠল, আগুনের শিখা অকারণে নিভে যেতে চাইছিল। তৃষা মূর্তির দিকেই তাকাল—অন্ধকারেও ওর থেকে এক অদ্ভুত নীল আভা ছড়াচ্ছিল, মাছের চোখের মতো চকচক করে উঠছিল। মনে হচ্ছিল, মূর্তিটা যেন শ্বাস নিচ্ছে, আর প্রতি মুহূর্তে আরও কাছে আসছে মৃত্যুর ছায়া। সেই মুহূর্তে হরিদাস পণ্ডিত গ্রাম থেকে এসে হাজির হলেন। তার হাতে তামার ঘণ্টা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, আর চোখে অদ্ভুত দৃঢ়তা।

হরিদাস পণ্ডিত সবাইকে শান্ত গলায় বললেন, “তোমরা যা হাতে পেয়েছ, সেটা কোনো গবেষণার বস্তু নয়। এটা এক পুরোনো শপথের প্রতীক। বহু শতাব্দী আগে মহাপুরোহিতেরা এক দানবকে গঙ্গার তলায় বন্দি করেছিলেন। সেই দানবই এই মূর্তির মধ্যে জীবন্ত। নদীই ওর কারাগার, নদী ছাড়া কোথাও ওকে রাখা যাবে না।” তৃষার শরীর শিউরে উঠল, কারণ ঠিক এটাই মাঝি কিছুক্ষণ আগে বলেছিল। পণ্ডিত থেমে গম্ভীর গলায় যোগ করলেন, “মূর্তি নদী থেকে দূরে গেলেই মৃত্যুর ছায়া তোমাদের ঘিরে ফেলবে। রাহুল সেই শিকল ভাঙার প্রথম মূল্য দিয়েছে। বাকিরা যদি সতর্ক না হও, এই মৃত্যু চলতেই থাকবে।” বাতাসে মন্ত্রোচ্চারণের মতো এক অদ্ভুত কম্পন ভেসে উঠল। দলটা এবার সত্যিই ভেঙে পড়ল। বিজ্ঞান, ইতিহাস আর লোককথা মিলেমিশে যেন এক অচেনা বিভীষিকায় রূপ নিল। গঙ্গার ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ছিল, আর সবাই মনে মনে বুঝতে পারছিল—এই লড়াই শুধু গবেষণার নয়, জীবনের লড়াই।

নয়

রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের নিস্তব্ধতা যেন আরও ভারী হয়ে উঠল। দূরে গঙ্গার কালো জলের ওপরে কুয়াশা ঝুলে আছে, মাঝে মাঝে বাতাস বইলেই শীতল স্রোত এসে গায়ে কাঁপন ধরাচ্ছে। তৃষা, অরিন্দম, ইশিতা আর সমীরণ একসঙ্গে বসে পরিকল্পনা করছিল—মূর্তিকে ফের গঙ্গার তলায় ডুবিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। মাঝি জগন্নাথ আর হরিদাস পণ্ডিত দু’জনেই সেই পরামর্শ দিয়েছে, এবং প্রত্যেকের মনে এখন একই আতঙ্ক—যতক্ষণ এই মূর্তি মাটির ওপরে আছে, মৃত্যু আর অশান্তি থামবে না। অরিন্দম বলল, “আজ রাতেই কাজটা শেষ করতে হবে। দেরি করলে আমরা কেউ বাঁচব না।” তার গলায় দৃঢ়তা থাকলেও চোখে লুকোনো ভয়ের ছাপ ফুটে উঠছিল। তৃষা নিঃশব্দে মূর্তির দিকে তাকাল, অন্ধকারেও তার শরীর থেকে নীল আভা নির্গত হচ্ছিল, যেন কুয়াশার ভেতর দিয়ে কোনো জীবন্ত প্রাণী শ্বাস নিচ্ছে। মুহূর্তে সে অনুভব করল, মূর্তির ভেতর থেকে যেন কারও দৃষ্টি তাকে বিদ্ধ করছে।

সবাই যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিল, সমীরণ তার ক্যামেরা চালু করে রাখল। সে চেয়েছিল প্রতিটি মুহূর্ত ধরে রাখতে—হয়তো এই ভিডিও একদিন প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু ক্যামেরার পর্দায় চোখ পড়তেই তার বুক ঠাণ্ডা হয়ে গেল। অন্ধকারের মধ্যে লেন্সে এক অদ্ভুত ছায়া ধরা পড়েছে। প্রথমে সে ভেবেছিল আলো-আঁধারির খেলা, কিন্তু পরক্ষণেই দেখল, ছায়াটা দলের ভেতরের কারও সঙ্গে মিশে আছে। যেন দলের মধ্যেই কেউ ধীরে ধীরে সেই মূর্তির টানে অভিশপ্ত হয়ে পড়ছে। সমীরণ কাঁপা গলায় বলল, “তোমরা… এদিকে একবার দেখো।” সবাই ক্যামেরার পর্দায় তাকাতেই আতঙ্কে জমে গেল। তৃষার শরীর কেঁপে উঠল, কারণ ছায়াটা ঠিক তার পেছনেই দাঁড়িয়ে। কিন্তু ঘুরে তাকালে কিছুই নেই—শুধু ঘন অন্ধকার আর নীলচে আভা। ইশিতা ফিসফিস করে বলল, “এটা মানে… আমরা দেরি করে ফেলেছি।”

অরিন্দম হঠাৎ বুঝতে পারল, মূর্তির প্রভাব শুধু বাইরে ছড়াচ্ছে না, দলের ভেতরেও ঢুকে পড়েছে। কারও না কারও শরীর বা মন এখন সেই অভিশাপের কব্জায়। কিন্তু কে? সেই প্রশ্নই সবাইকে আরও আতঙ্কিত করে তুলল। সমীরণ পর্দায় জুম করে দেখল, ছায়াটা ধীরে ধীরে দলের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু ঠিকমতো কোনো চেহারার সঙ্গে মিশছে না। মনে হচ্ছিল, যেন অদৃশ্য এক সত্তা ধীরে ধীরে তাদের ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করছে। তৃষা তখন বুক চেপে ধরল—তার মনে হচ্ছিল ভেতর থেকে কেউ ফিসফিস করছে, “আমাকে মুক্ত করো…”। ইশিতা দৌড়ে তার পাশে গিয়ে হাত রাখতেই তৃষার শরীর হঠাৎ ঠাণ্ডা হয়ে গেল, আর চোখে নীল আলো জ্বলে উঠল। দল মুহূর্তে বুঝে গেল, মূর্তির টানে প্রথম যে বন্দি হয়েছে, সে আর কেউ নয়—তৃষা।

ভয় আর আতঙ্কে চারপাশে অরাজকতা শুরু হয়ে গেল। অরিন্দম তৃষাকে আঁকড়ে ধরল, কিন্তু তার শরীর যেন লোহার মতো শক্ত হয়ে গেছে, ঠেলে সরানো যায় না। ইশিতা আতঙ্কিত গলায় মন্ত্রোচ্চারণ করতে লাগল, যেন কোনোভাবে তৃষাকে সেই অদৃশ্য প্রভাব থেকে মুক্ত করা যায়। মাঝি জগন্নাথ হাহাকার করে বলল, “আমি তো বলেছিলাম! ও যেই নদীর কারাগার থেকে বেরিয়েছে, এখন তোদের ভেতর দিয়েই মুক্তি খুঁজছে।” সমীরণ ক্যামেরা ফেলেই তৃষার সামনে ছুটে গেল, কিন্তু মুহূর্তেই সে অনুভব করল অন্ধকারের ফাঁদ যেন চারপাশ থেকে তাদের জড়িয়ে ধরছে। আগুন হঠাৎ নিজে থেকেই নিভে গেল, বাতাস থেমে গেল, আর গঙ্গার জল থেকে ভেসে এলো অদ্ভুত গুঞ্জন—যেন হাজার মানুষের একসঙ্গে করা মন্ত্রোচ্চারণ। সেই অন্ধকারের ফাঁদে বন্দি হয়ে সবাই বুঝতে পারল—মূর্তিকে ফের নদীর তলায় নামানো এত সহজ হবে না, কারণ অভিশপ্ত রক্ষক ইতিমধ্যেই তাদের ভেতরে জায়গা করে নিয়েছে।

দশ

গঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে সবাই নিস্তব্ধ, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভয় তাদের গিলে খাচ্ছে। রাতের অন্ধকারে নদীর বুক এক অদ্ভুত রহস্যে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। মূর্তির চারপাশে তৈরি হওয়া সেই নীল আভা যেন নদীর কুয়াশার সঙ্গে মিশে আকাশ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। অরিন্দম বুঝে গিয়েছিল, আর কোনো দেরি করলে মৃত্যু অনিবার্য। দলের চোখে এখন কেবল ভয়ের ছাপ—তৃষা আধা জ্ঞানহীন অবস্থায় বসে আছে, সমীরণ ক্যামেরা আঁকড়ে ধরে কাঁপছে, আর ইশিতা পাণ্ডুলিপির কথাগুলো মনে করে আতঙ্কে বিহ্বল। জগন্নাথ কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ওকে ফের নদীর তলায় নামাও, নইলে কারও মুক্তি নেই।” তখনই অরিন্দম দৃঢ় গলায় বলল, “আমি নিজে যাব। মূর্তিকে ফিরিয়ে দেব গঙ্গার তলায়। যদি ফিরতে না পারি, তাহলে অন্তত জানবে—আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি।” কথাগুলো শোনামাত্র দলের বুক কেঁপে উঠল, কিন্তু তার চোখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি ফুটে উঠেছিল—যেন সে নিজের পরিণতি মেনে নিয়েই শেষ অভিযানে নামতে চলেছে।

মূর্তিকে কাঁধে তুলে নিয়ে অরিন্দম ধীরে ধীরে নদীর জলে নামল। ঠাণ্ডা স্রোত তাকে মুহূর্তেই ঘিরে ধরল, আর সেই সঙ্গেই ভেসে উঠল অদ্ভুত এক গুঞ্জন—যেন শত শত গলা একসঙ্গে মন্ত্রোচ্চারণ করছে। জলের তলায় নামতেই চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে গেল, কিন্তু মূর্তির শরীর থেকে ছড়িয়ে পড়া নীল আভা তাকে পথ দেখাতে লাগল। প্রতিটি পদক্ষেপে অরিন্দম অনুভব করছিল, মূর্তির ভেতর থেকে অদ্ভুত শক্তি বেরিয়ে এসে তার শরীর চেপে ধরছে, মাথার ভেতর কেউ ফিসফিস করছে—“আমাকে মুক্ত করো, আমার সঙ্গে থেকো…”। তার শ্বাস ধীরে ধীরে ভারী হয়ে উঠছিল, কিন্তু সে হাত ছেড়ে দেয়নি। জলের আরও গভীরে নামার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য ছায়ামূর্তি চারপাশে ভেসে উঠতে লাগল। কিছুটা মানুষের মতো, কিছুটা নদীর প্রবাহের মতো—তাদের চোখে একই নীল আভা, আর ঠোঁট নড়ে উঠছে মন্ত্রোচ্চারণে। মনে হচ্ছিল, অরিন্দম এক অদৃশ্য সভায় দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে সবাই মিলে অভিশপ্ত রক্ষককে পূজা করছে।

দল ওপরে দাঁড়িয়ে আতঙ্কে সব দেখছিল। সমীরণের ক্যামেরা অদ্ভুত শব্দ আর কাঁপুনি রেকর্ড করছিল, কিন্তু দৃশ্যগুলো ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল—যেন ক্যামেরার লেন্সও সহ্য করতে পারছে না। তৃষা হঠাৎ উঠে দাঁড়াল, তার চোখে আবার নীল আলো জ্বলে উঠল, আর সে কাঁপা গলায় বলল, “ও একা ফিরবে না… ও এখন নদীর সন্তান হয়ে গেছে।” ইশিতা চিৎকার করে উঠল, “না! অরিন্দম ফিরবেই। ওর আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না।” কিন্তু জগন্নাথের মুখে কেবল আতঙ্ক—সে জানত, নদীর রক্ষককে ফেরানোর মানে কারও না কারও আত্মাহুতি। হঠাৎ নদীর বুক চিরে এক বিশাল আলো বেরোল, আর গঙ্গার জল কেঁপে উঠল। মুহূর্তে সবাই দেখল, অরিন্দম মূর্তিকে নিয়ে গভীর স্রোতে তলিয়ে যাচ্ছে। তার চারপাশে অগণিত ছায়ামূর্তি নাচছে, মন্ত্রোচ্চারণ তীব্র হয়ে উঠছে, আর শেষ মুহূর্তে তার চোখেও সেই নীল আলো জ্বলে উঠল।

তারপর হঠাৎ সব নিস্তব্ধ হয়ে গেল। নদীর বুক শান্ত হয়ে গেল, মূর্তির আভা অদৃশ্য হলো, আর চারপাশে শুধু কুয়াশা আর হাহাকার বাকি রইল। দল একে অপরকে আঁকড়ে ধরে উপরের দিকে উঠল, যেন শ্বাস নেওয়ার জন্য মরিয়া। ওপরে উঠে তারা চারপাশে তাকাল, কিন্তু অরিন্দম আর নেই। সমীরণের ক্যামেরায় শেষ দৃশ্য ছিল অরিন্দমের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া—তার শরীর যেন গঙ্গার গভীরেই মিশে গেল। সবাই নিস্তব্ধ হয়ে বসে পড়ল, চোখে অশ্রু, মনে অদ্ভুত শূন্যতা। তৃষা বিড়বিড় করে বলল, “ও গেল রক্ষক হতে… ও এখন গঙ্গার তলদেশের অংশ।” ইশিতা ভেঙে পড়ল, কিন্তু একই সঙ্গে অনুভব করল—হয়তো এটাই ছিল একমাত্র উপায়। গঙ্গা শান্ত হলেও প্রশ্ন থেকে গেল—অরিন্দম কি সত্যিই মারা গেল, নাকি অভিশপ্ত রক্ষকের মতো চিরদিনের জন্য নদীর গভীরেই বেঁচে রইল? সেই উত্তর আর কেউ জানল না, শুধু গঙ্গার বুকের গভীরে ঢেকে রাখা রহস্যই জানল সত্যিটা।

***

1000061811.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *