অর্ণা মুখার্জী
১
সায়নী বসু দক্ষিণ কলকাতার মফস্বলি এলাকায় দাঁড়িয়ে বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে ছিল একটি পরিত্যক্ত বাসস্ট্যান্ডের দিকে। নতুন প্রজেক্টের কাজে তাকে পাঠানো হয়েছিল এই অঞ্চলের একটি পুরনো জমি পরিদর্শনের জন্য, যেখানে একটা কমিউনিটি সেন্টার তৈরির পরিকল্পনা আছে। কিন্তু সেই জমির পাশেই পড়ে থাকা পুরনো বাসস্ট্যান্ডটি তার দৃষ্টি আটকে দেয়। নীল রং উঠে যাওয়া টিনের ছাউনি, ভাঙাচোরা কংক্রিটের বেঞ্চ, আর বৃষ্টির জল জমে থাকা ময়লা গর্ত — দেখলে মনে হতো এই জায়গায় কোনো স্বপ্নের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা এক ঝাঁক বাচ্চা ছেলেমেয়ে, কেউ বোতল কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে, কেউ চায়ের কাপে জল খাচ্ছে, কেউবা টায়ারের টুকরো নিয়ে খেলছে — ওদের মধ্যে এক আশ্চর্য প্রাণশক্তি যেন ওই পরিত্যক্ত জায়গাকে জীবন্ত করে তুলছিল। সায়নী একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল, পাশে এক কাপ চা, চোখে চিন্তা আর কল্পনার আলোর ঝলকানি। তার মনে হতে থাকে, যদি এই স্থানটিকে একটু বদলে দেওয়া যায়? যদি এই জায়গাতেই একটা ছোট্ট শিশুদের জন্য জায়গা বানানো যায়, যেখানে ওরা নিরাপদে খেলতে পারবে, হাসতে পারবে, নিজের মতো করে বাঁচতে পারবে?
চায়ের দোকানটি চালান মনজুর ভাই — বয়স পঞ্চাশের বেশি, সাদা দাড়িতে চায়ের কাপে ভাপ ওঠে, আর চোখে-মুখে সারল্য। সায়নী চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করে, “এই জায়গাটা তো আর ব্যবহার হয় না, তাই না?” মনজুর ভাই বলেন, “না দিদি, একসময় অনেক গাড়ি যেত, এখন তো আর কেউ দাঁড়ায় না, বাসও আসে না। কেবল এই বাচ্চাগুলো আসে… দিনের বেলা বসে থাকে, খেলে, কখনও ঝগড়া করে, কখনও হাসে।” কথা বলতে বলতে সায়নীর চোখ চলে যায় সেই ছোট্ট ছেলেটার দিকে — বয়স বড়জোর দশ, নোংরা হাফপ্যান্ট পরে, গায়ে জামা নেই, কিন্তু চোখে এমন একরকম জেদ আর কৌতূহল, যা তাকে আলাদা করে দেয়। সে এক হাতে প্লাস্টিকের ব্যাগ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, অন্য হাতে পুরনো একটা পেনসিল — যেন কিছু লিখতে চাইছে দেয়ালে। সায়নী বলে ওঠে, “এই ছেলেটার নাম কী?” মনজুর ভাই বলেন, “চিনু। কে জানে আসল নাম কী, সবাই চিনু বলেই ডাকে। ট্রেন থেকে নেমে একদিন এলো, তারপর থেকে এখানেই আছে।” সেই মুহূর্তেই সায়নীর মধ্যে জন্ম নেয় এক ভাবনা — যদি এই চিনুদের জন্য একটা ‘ঘর’ বানানো যায়, না হয় খুব ছোট, না হয় খুব অস্থায়ী — তবুও একটা ঘর, যেটার দেওয়ালে তারা রঙ মাখতে পারবে, মাটিতে দৌড়াতে পারবে, না খেয়ে থাকতে না হয় এমন একটা জায়গা।
সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে সায়নী তার স্কেচবুক নিয়ে বসে যায়। পাতার পর পাতা জুড়ে আঁকে সে — একটি অস্থায়ী কাঠামো, যেখানে পুরনো টায়ার ঝুলে থাকবে দোলনা হয়ে, কাঁচি দিয়ে কেটে বানানো কাপড়ের পতাকা, দেয়ালে রঙিন ফুল, চাঁদ, সূর্য, আর শিশুদের হাসিমুখ। সে ভাবে, এই কাজের জন্য খুব বেশি কিছু লাগে না — প্রয়োজন ইচ্ছা, কিছু সময়, কিছু বন্ধু আর একটা বিশ্বাস যে শিশুরাও সমাজের সমান অধিকারী। নিজের পুরনো কলেজ বন্ধুদের সঙ্গে সে কথা বলে, যারা কেউ স্থপতি, কেউ শিক্ষক, কেউ ফ্রিল্যান্স ডিজাইনার। সবাই আগ্রহ দেখায়, “তুই যা ভাবছিস, সেটা সাহসের কাজ… আমরা আছি তো!” সায়নী ঠিক করে, প্রতি রবিবার সে সেই জায়গায় যাবে, ধীরে ধীরে পরিষ্কার করবে, নিজের হাতে রং করবে, আর বাচ্চাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলবে। তার দৃষ্টিতে বাসস্ট্যান্ডটি আর কোনো পরিত্যক্ত জায়গা নয় — এটা হয়ে উঠেছে এক অপূর্ণ স্বপ্নের বীজ।
পরের রবিবার সকালে একটুকরো সাদা পোশাক, হাতে তুলির বাক্স, রঙের কৌটো আর চোখে স্বপ্ন নিয়ে সায়নী হাজির হয় বাসস্ট্যান্ডে। প্রথমেই সে জমে থাকা জঞ্জাল পরিষ্কার করতে শুরু করে — প্লাস্টিক, খালি বোতল, পঁচা খাবারের প্যাকেট সরাতে সরাতে শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে, কিন্তু মন চনমনে। কিছু শিশুরা দূরে দাঁড়িয়ে দেখে, ফিসফিস করে — “ও কে?” চিনু প্রথমে দূরে থেকে তাকিয়ে ছিল, কিন্তু পরে সাহস করে এগিয়ে আসে। সায়নী তাকে বলে, “তুই চাইলে রং করতে পারিস… আমি শেখাবো।” সে প্রথমে দ্বিধায় পড়ে, তারপর একটা ব্রাশ হাতে নেয়। সায়নী দেয়ালের এক কোণে সূর্য আঁকতে শুরু করে, আর চিনু সূর্যের চারপাশে ছোট ছোট রশ্মির মতো রেখা টেনে দেয়। সেই ছোট্ট রেখা থেকেই শুরু হয় এক নতুন ইতিহাস — একটি পরিত্যক্ত বাসস্ট্যান্ড আর একটি পথশিশুর মধ্যে তৈরি হয় সম্পর্ক, যার নাম “খেলাঘর” হবে তা তখনও কেউ জানতো না। কিন্তু সেই মুহূর্তেই, ধুলোয় ঢাকা শহরের মাঝে, মানবতার একটি নতুন ঠিকানা জন্ম নেয়।
২
পরের রবিবার সকালটা অন্যরকমভাবে শুরু হয়। সায়নী আগের রাতেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল — রঙের কৌটো, ছোট ছোট তুলি, পুরনো পাটের দড়ি, কিছু টায়ার আর কয়েকটা কাঠের পাটাতন। একটা পিঠে ঝোলানো ব্যাগে রাখা আছে চকপেন, কাগজ, কিছু গল্পের বই এবং কিছু বিস্কুটের প্যাকেট। মনজুর ভাই তাকে দেখে মুচকি হাসেন, “আজ তো আপনার সঙ্গে পুরো স্টুডিও এসেছে দেখছি!” সায়নী হেসে বলে, “আজ বাচ্চাদের সঙ্গে আসল আঁকিবুকি শুরু হবে।” ধীরে ধীরে বাচ্চারা একে একে এসে দাঁড়াতে থাকে দূরে দূরে — চিনু, রুবেল, নন্দিনী, বাবলু — প্রত্যেকে মুখে কৌতূহল আর চোখে এক ধরনের দ্বিধা। সায়নী তাদের ডাকে না, কিন্তু দেয়ালে নিজের তুলির প্রথম আঁচড় দিয়ে সূর্যের চারপাশে রঙ ছড়িয়ে দিতে থাকে। চিনু প্রথম এগিয়ে আসে, তার পেন্সিলটা দিয়ে একটা মাছ আঁকে নিচের কোণে। সায়নী প্রশংসা করে বলে, “দারুণ হয়েছে! এবার এটা রাঙিয়ে দে।” বাকিরা তখন লজ্জা ভুলে এগিয়ে আসে — রুবেল একটি ঘোড়া আঁকে, নন্দিনী তার মায়ের ছবি আঁকে, বাবলু কেবল নীল রং দিয়ে দেয়ালে গোল গোল বৃত্ত আঁকে — যেন কোনো চাঁদের খেলা চলছে।
সেই দুপুরটা যেন এক রঙিন উৎসব হয়ে উঠেছিল। বাসস্ট্যান্ডের পুরনো কংক্রিটের গায়ে এখন শিশুর কল্পনার ছবি ফুটে উঠছে। কেউ টায়ারে রং করে ফুল আঁকে, কেউ কাঠের টুকরো কেটে ‘KHELAGHOR’ লেখার চেষ্টা করে। মনজুর ভাই এবার নিজে থেকে এসে বলে, “আমি দোকানের পাশে যে বালতিটা পড়ে ছিল, সেটায় পানি দিয়ে এনেছি, রঙ মিশাতে কাজে লাগবে।” সায়নী অবাক হয়ে দেখে, চারপাশের পরিবেশ যেন নিজেই বদলাতে শুরু করেছে। এক সময় যারা এই জায়গাটাকে এড়িয়ে চলত, তারাই এখন আশপাশ থেকে উঁকি দিচ্ছে। পাশের বস্তির এক মা এসে দাঁড়িয়ে বলে, “আপনি এদের সঙ্গে এত মিশে গেছেন… কেউ তো কখনও এভাবে ওদের সঙ্গে কথা বলেনি!” সায়নী হাসে, “ওরা আমার ছোট ভাইবোন। শুধু একটু জায়গা দরকার, আর দু’মুঠো স্বপ্ন।” বাচ্চারা তখন ‘খেলাঘর’ শব্দটা মুখে মুখে আওড়াতে থাকে — “এই তো আমাদের খেলাঘর… এখানেই রোজ আঁকবো!”
সেদিন বিকেলে প্রথমবারের মতো চিনু একটি গল্প শোনায়। সে বলে, “একদিন আমি প্লেন বানাবো, যাতে সবাই উড়তে পারবে।” সবাই হাসে, কিন্তু সায়নী চুপ করে শোনে — কারণ সে জানে এই স্বপ্নই সবচেয়ে শক্তিশালী। সে সিদ্ধান্ত নেয়, পরের সপ্তাহে সে কয়েকটা বই আনবে, আর ছোট্ট একটা কোণে বসে একটা গল্পের জায়গা বানাবে — যেখানে সবাই বই পড়তে পারবে, কেউ গল্প বলবে, কেউ শুনবে। মনজুর ভাই নিজেই বলে, “দিদি, আপনি চাইলে আমার দোকানের পাশের ছোট ঘরটা ব্যবহার করতে পারেন… পুরনো কাগজপত্র পড়ে থাকে, সাফ করে দেব।” সায়নী কৃতজ্ঞ হয়ে মাথা নাড়ে। সেই মুহূর্তে সে বুঝতে পারে, এই খেলাঘর এখন শুধু তার একার প্রয়াস নয় — এটা হয়ে উঠছে এক ছোট্ট আন্দোলন, যেখানে পথশিশুদের জন্য সবাই একটু একটু করে নিজেদের জড়াচ্ছে, ভালোবাসছে।
সন্ধ্যার আলো গাঢ় হতে হতে সায়নী ধীরে ধীরে দেয়ালে তার শেষ তুলির আঁচড়টি টানে — একটি উড়ন্ত ঘুড়ি, যার লেজে লেখা — “আমার স্বপ্ন আমার অধিকার।” বাচ্চারা ঘিরে ধরে তাকে, কিছু খেতে চায়, কেউ গল্প শোনায়, কেউ তার আঁকা ঘুড়িকে ছুঁতে চায়। সায়নী সবার হাতে বিস্কুটের প্যাকেট দেয়, আর বলে, “আজ তোমরা যে কাজ করেছো, তা কারও জীবনে প্রথম নয় — কিন্তু তোমাদের রঙে এই জায়গাটা জীবন্ত হয়েছে।” চিনু কাঁধে হাত রেখে বলে, “আপু, কাল থেকে কেউ এলে বলবো — এটা আমার ঘর, খেলাঘর।” তার সেই সরল অথচ দৃঢ় কণ্ঠস্বরে যেন সায়নীর চোখে জল চলে আসে। সে তখন জানে, শুরুটা ঠিক জায়গা থেকেই করেছে। ঘরের দেয়াল এখনও অসম্পূর্ণ, দোলনা ঝোলে না, টেবিল-চেয়ার নেই, ছাদ ফুঁটে যায় — তবু এই ঘরটা দাঁড়িয়ে আছে স্বপ্ন আর সাহসের ভিতের ওপর। পরিত্যক্ত বাসস্ট্যান্ডে প্রথম তুলির আঁচড় পড়েছে — এবার পালা স্বপ্নটাকে বাস্তব করার।
৩
পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে সেই পরিত্যক্ত বাসস্ট্যান্ডটি এক নতুন চেহারা নেয় — ধীরে ধীরে, কিন্তু অবিচলভাবে। সায়নী নিয়ম করে প্রতি শনিবার-রবিবার হাজির হয় রঙ, দড়ি, পুরনো কাঠ, কাপড় আর ছোটখাটো সরঞ্জাম নিয়ে। স্থানীয় বস্তির কিছু মানুষ প্রথমে কৌতূহলী দৃষ্টিতে দেখলেও, এখন অনেকেই স্বেচ্ছায় সাহায্য করতে আসে। মনজুর ভাইয়ের দোকানের পাশের ছোট্ট পরিত্যক্ত ঘরটিকে চিনু ও তার দল সাফ করে দিয়েছে — জানলায় ঝোলানো হয়েছে রঙিন কাপড়ের পর্দা, ভেতরে রাখা হয়েছে পুরনো কাগজের বই আর রঙপেন্সিল। চিনু সেই ঘরটার নাম দিয়েছে “গল্পের গুহা”। সায়নী একদিন টায়ারের টুকরো কেটে বানায় একটা দোলনা, যা পাশের গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেয়। শিশুরা তখন রীতিমতো উল্লাসে ফেটে পড়ে — যেন কোনো বিলাসবহুল পার্ক নয়, তবে এটাই তাদের ‘নিজের জায়গা’, তাদের খেলার, শেখার, হাসার, কল্পনার ঘর।
সায়নী লক্ষ্য করে, শিশুরা ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। যেসব ছেলেমেয়ে আগে গালাগালি করত, মারামারি করত, এখন তারা পরস্পরের সঙ্গে ভাগ করে খায়, একসঙ্গে দেয়ালে ছবি আঁকে, কাঠ দিয়ে ঘর বানানোর খেলা খেলে। রুবেল, যে রাস্তায় গান গেয়ে টাকা উপার্জন করত, এখন প্রতিদিন বিকেলে ‘গল্পের গুহা’তে বসে কবিতা লেখার চেষ্টা করে। সে একদিন চুপিচুপি সায়নীকে বলে, “আপু, আমি বড় হয়ে কবি হতে চাই… খেলাঘর যদি না থাকতো, আমি কেবল গান গেয়েই জীবন কাটিয়ে দিতাম।” সায়নী সেই কথাগুলো শোনে আর গভীরভাবে উপলব্ধি করে, এই খেলাঘর কেবল একটি স্থাপত্য প্রকল্প নয় — এটা হলো স্বপ্ন তৈরির জমি, যেখানে শিশুরা নিজেদের অস্তিত্বকে খুঁজে পায় নতুন রূপে। সে তখন নিজের ভেতরে আরও দৃঢ় সংকল্প করে — যত বাধাই আসুক, এই খেলাঘরকে থামতে দেবে না।
একদিন সায়নী শহরের আর্কিটেকচার কলেজের কয়েকজন ছাত্রকে নিয়ে আসে খেলাঘরে — তারা আসে তাকে সাহায্য করতে, দেয়ালে বড় একটি মুরাল আঁকতে। মুরালের নাম হয় “স্বপ্নের সিঁড়ি” — যেখানে একটি রাস্তার শিশু ধীরে ধীরে ওপরে উঠে যাচ্ছে, প্রতিটি ধাপে লেখা — “আত্মবিশ্বাস, শিক্ষা, ভালোবাসা, পরিচয়, স্বপ্ন”। সেই মুরাল আঁকার দিনটা যেন উৎসবে পরিণত হয় — আশেপাশের মানুষ এসে দেখে, কেউ মোবাইলে ছবি তোলে, কেউ শিশুদের সঙ্গে আঁকায় যোগ দেয়। এক বৃদ্ধ বলেন, “এই জায়গা তো আগে গাঁজাখোরদের আস্তানা ছিল… এখন তো মনে হচ্ছে মেলা চলছে!” সায়নী হেসে উত্তর দেয়, “ভালোবাসা ছড়িয়ে দিলে সবচেয়ে অন্ধকার জায়গাও আলোকিত হয়ে ওঠে।” শিশুরা তখন মঞ্চ বানিয়ে গান গায়, নন্দিনী আবৃত্তি করে — “আমি ছোট্ট শিশু, আমিও বড় হবো একদিন… খেলার ঘরে বই হাতে নেবো, ছুঁবো আকাশ দিনদিন।”
সন্ধ্যার আলো পড়তে পড়তেই সায়নী একটি ছোট কাঠের ফলক টাঙিয়ে দেয় বাসস্ট্যান্ডের মূল গায়ে — “খেলাঘর: বাচ্চাদের নিজের জায়গা, নিজস্ব স্বপ্ন।” ফলকটি আঁকা হয়েছে রঙিন ফুল ও রামধনুর ছায়ায়, নিচে লেখা — “প্রতিষ্ঠা: সায়নী বসু ও পাড়ার শিশুরা।” ফলক টাঙানোর পর সব শিশুরা হাততালি দেয়, চিনু তো লাফিয়ে ওঠে বলে, “আজ আমাদের বাড়ির নাম হয়ে গেল!” সেই মুহূর্তে সায়নী চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, চোখে জল আর গর্বের এক অদ্ভুত মিশেল। সে ভাবে, এটাই তো চেয়েছিল — এক জায়গা, যেখানে শিশুরা কেবল বেঁচে নেই, বরং নিজেদের নির্মাণ করছে; যেখানে স্থাপত্য কেবল ইট-পাথর নয়, বরং মানবিক সম্পর্ক, আত্মবিশ্বাস ও ভালোবাসার রঙে আঁকা এক নতুন পৃথিবী। সেদিনের শেষে, খেলাঘর সত্যিকারের জন্ম নেয় — শুধু দেয়াল দিয়ে নয়, হৃদয়ের স্পন্দনে, প্রত্যেকটা হাসির রেখায়।
৪
সব স্বপ্নের পথেই যেমন কাঁটা থাকে, তেমনই খেলাঘরের পথেও একদিন নেমে আসে দুঃসময়। সেই উচ্ছ্বাসে ভরা দিনগুলোর মাঝে এক সকালে সায়নী যখন খেলাঘরে পৌঁছায়, দেখে তার প্রিয় দেওয়ালের একটা অংশে কালো রঙে আঁচড় কাটা — মুরালের স্বপ্নের সিঁড়িটা অর্ধেক মুছে ফেলা হয়েছে, দোলনার দড়ি কেটে দেওয়া হয়েছে, আর গল্পের গুহার দরজা ভেঙে ভেতরের বইগুলো ছড়ানো ছিটানো। শিশুরা এক কোনে দাঁড়িয়ে, চোখে ভয়। চিনু এসে বলে, “রাতে কয়েকজন দাদারা এসেছিল… বলে, খেলাঘর বন্ধ না করলে পেটাবে।” সায়নী স্তব্ধ হয়ে যায় — এতদিন ধরে যত্নে গড়ে তোলা ছোট্ট স্বপ্নের ঘর যেন রাতারাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। আশপাশের লোকজন কেউ কেউ মুখ ঘুরিয়ে নেয়, কেউ বলে, “ওরা স্থানীয় নেতার লোক… জায়গাটা চায়।” কেউ আবার বলে, “তোমার ভালো, তুমি এসব ছেড়ে চলে যাও। ওরা ভালো নয়।” কিন্তু সায়নী জানে, পালিয়ে যাওয়ার সময় নয়, এটাই লড়াইয়ের সময়।
সেই বিকেলেই সায়নী উপস্থিত হয় স্থানীয় কাউন্সিলরের অফিসে। পরনে রঙে ছোপ ছোপ করা সালোয়ার, হাতে ছবি তোলা ফোন আর গলায় দৃঢ় কণ্ঠ — “আপনার এলাকায় একটা শিশুপ্রকল্প গড়ে উঠেছে, যার জন্য শহরের মানুষের সাহায্য আসছে। অথচ আপনি জানেন না কিছু অসাধু লোক সেটাকে ভেঙে দিচ্ছে?” প্রথমে পাত্তা না দিলেও, তার স্পষ্ট ভাষা, মিডিয়া রেফারেন্স আর একাধিক স্থানীয় সমর্থনের কথা শুনে কাউন্সিলর বলেন, “আপনি চাইলে আবেদন করে প্রজেক্টটা রেজিস্টার করতে পারেন।” সেই রাতেই সায়নী অন্বেষা ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগ করে — যিনি একটি শিশু ও নারী কল্যাণমূলক NGO-র সঙ্গে যুক্ত। অন্বেষা বলেন, “তুমি যা করছ, তা শহরে নজিরবিহীন… আমরা তোমার পাশে আছি।” দুই দিনের মধ্যে খেলাঘর ঘিরে তৈরি হয় শহরের ছোট এক আন্দোলন — অন্বেষার এনজিও একটা মিটিং করে, সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানায়, সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয় খেলাঘরের ছবি আর শিশুদের বক্তব্য।
পরের সপ্তাহে সায়নী আবার বাসস্ট্যান্ডে আসে — কিন্তু এবার একা নয়, সঙ্গে অন্বেষা, কিছু সাংবাদিক, কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক এবং স্থানীয় শিক্ষাবিদ। সবাই মিলে আবার দেয়াল রং করতে শুরু করে। শিশুরা আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকে — তারা ভয় পেয়েছিল, ভেবেছিল খেলাঘর শেষ হয়ে গেল, কিন্তু এবার দেখে তাদের পাশে বড়রা দাঁড়িয়ে আছে, সাহসের সঙ্গে। চিনু ফিসফিস করে বলে, “আপু ফিরে এসেছে… মানে আমরা আবার শুরু করতে পারি?” সায়নী হাঁসতে হাঁসতে বলে, “তোমরা যদি পাশে থাকো, কেউ এই খেলাঘর ভাঙতে পারবে না।” সেইদিন গল্পের গুহার নতুন দরজা লাগানো হয়, দোলনার দড়ি আবার বাঁধা হয়, আর দেয়ালের মুছে যাওয়া সিঁড়ি আবার রঙিন হয় — তবে এবার সিঁড়ির ওপর এক নতুন শব্দ যোগ হয় — “লড়াই।”
সন্ধ্যার দিকে সবাই মিলে একটি মোমবাতি মিছিল করে ‘খেলাঘর’-এর চারপাশে। সবার হাতে লেখা প্ল্যাকার্ড — “আমরা স্বপ্ন দেখি”, “খেলাঘর ভাঙা যাবে না”, “প্রতিটি শিশুর হাসি রক্ষা করো।” সেই দৃশ্য দেখে পাশের বস্তির মা-বোনেরা প্রথমবার সাহস করে এসে দাঁড়ায় — কেউ গালে আঁকা খেলাঘরের প্রতীক, কেউ হাতে জল আর বিস্কুট নিয়ে সাহায্য করতে আসে। অন্বেষা বলে, “তোমার খেলাঘর এখন শুধু শিশুদের ঘর নয়, এটা এক প্রতিরোধের প্রতীক।” সায়নী চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে — সে জানে স্বপ্ন ভাঙে, আবার গড়েও ওঠে। সেই সন্ধ্যায় চিনুদের চোখে যে আলো জ্বলেছিল, সেটাই ছিল প্রকৃত সাফল্য — কারণ এবার তারা কেবল খেলছে না, নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য দাঁড়িয়ে লড়ছে। খেলাঘর যেন সত্যিই বেঁচে ওঠে — ইট-পাথরের নয়, হৃদয়ের শক্তিতে।
৫
সন্ধ্যা নামার আগেই পুরনো বাসস্ট্যান্ডের খালি জায়গাটা যেন নতুন এক রূপ পেয়েছিল। একপাশে বাঁধানো হচ্ছে কাগজের গুদামঘর, আরেক পাশে পুরনো টায়ার দিয়ে তৈরি হচ্ছে এক ঝুলন্ত দোলনা। রঙিন কাপড় দিয়ে ঘেরা হয়েছে একটা ছোট চত্বর — যার সামনে রাখা হয়েছে একটা কাঠের সাইনবোর্ড, তাতে বড় হরফে লেখা — “খেলাঘর: সবার জন্য খোলা”। সায়নী আজ প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে পথশিশুদের জন্য এই নতুন জায়গার দরজা খুলে দিল। তার চারপাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চাদের চোখে ছিল কৌতূহল, উল্লাস আর একরাশ অবিশ্বাস। রঙিন ওয়ালপেইন্টে আঁকা স্নেহের চিহ্ন, কল্পনার গাছপালা আর ভাসমান ঘুড়িগুলো যেন একটা স্বপ্নের দুনিয়ায় নিয়ে যাচ্ছিল সবাইকে। সায়নী মাটিতে বসে পড়ল বাচ্চাদের সঙ্গে, গল্প বলতে লাগল, জানাল এই ঘরটা তাদের — পড়া, খেলা, গল্প, ছবি আঁকা — সব কিছুই এখানে করা যাবে। প্রথমবারের মতো বাচ্চারা শব্দ করে হেসে উঠল, কেউ এসে আঁচলে মুখ লুকাল, কেউ ধরল তার হাত। যেন তারা বিশ্বাস করতে শুরু করল — হ্যাঁ, এমনও কেউ হতে পারে, যিনি কিছুই চান না, শুধু ভালোবাসেন।
দিনের পর দিন খেলাঘর হয়ে উঠল একটা ঠিকানা। সকালবেলা চা দোকানের পেছন থেকে উঠে আসা অনুপ, দুপুরে ফুল বেচা থেমে গিয়ে আসা ছন্দা, কিংবা মালপত্র টানতে টানতে আসা সজল — সবাইকে যেন খেলাঘর একটা নতুন চেতনার জগতে নিয়ে গেল। সায়নী খেয়াল করল, শুধু খেলাধুলা নয়, এই শিশুদের জীবনে শিক্ষার আলো পৌঁছানোও জরুরি। তাই সে যোগাযোগ করল কিছু স্বেচ্ছাসেবীর সঙ্গে — কলেজপড়ুয়া কিছু ছাত্রছাত্রী এল বিকেলবেলা পড়াতে। ধীরে ধীরে সায়নী শুরু করল ‘ছায়াশিক্ষা’ নামক এক প্রকল্প, যাতে মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরেও শিশুদের হাতে কলম তুলে দেওয়ার সুযোগ থাকে। পুরনো ট্রানজিট বাসের একটা অংশকে পাঠাগারে রূপান্তর করা হল, যেখানে পুরনো বই, পেনসিল, খাতা এনে জমা করলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। স্থানীয় স্কুলের এক প্রাক্তন শিক্ষক, মৃণাল বাবু, অবসর কাটানোর নতুন মানে পেলেন এখানে শিক্ষকতা করে। যেন একটা হারিয়ে যাওয়া মানবিক সম্পর্কের চক্র আবার বেঁধে উঠল।
এই পরিবর্তন সহজ ছিল না। বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা এসেছিল — বিশেষ করে কিছু স্থানীয় মানুষ বিরক্ত ছিলেন এই ভিড়, এই চেঁচামেচি আর ‘ফালতু ব্যাপার’-এর কারণে। একদিন রাতে কেউ পুড়িয়ে দিল খেলাঘরের একটি দোলনা। সায়নী ভেঙে পড়েছিল সেদিন — কিন্তু পরদিন সকালেই তার দেখা গেল, বাচ্চারা নিজেরা ভাঙা কাঠ জুড়ে নতুন করে বানাচ্ছে দোলনা। তারা জানিয়ে দিল — খেলাঘর এখন শুধু সায়নীর নয়, তাদেরও। এই একটা ছোট্ট ঘটনায় সায়নী বুঝল, তার বপন করা বীজ গাছে পরিণত হচ্ছে। এরপর সে সিদ্ধান্ত নিল, এদের জন্য একটা স্থায়ী আশ্রয় গড়তেই হবে। পুরনো ট্রানজিট বাসটার মালিককে খুঁজে বের করে সে একটা চুক্তি করল — মাসে নামমাত্র ভাড়ায় পুরো জায়গাটা ব্যবহারের অনুমতি পাওয়া গেল। আশ্চর্যভাবে, বাসমালিক নিজেও একসময় পথশিশু ছিল, তার চোখে জল এল সায়নীর কথা শুনে। আর্থিক সহায়তার জন্য সে যোগাযোগ করল কয়েকটা ছোট এনজিও-র সঙ্গে, যারা আগ্রহ দেখাল। খেলাঘর ধীরে ধীরে শুধু একটা জায়গা নয়, এক আন্দোলনের নাম হয়ে উঠছিল।
এনজিওদের পাশাপাশি কিছু সংবাদমাধ্যমও খোঁজ নিতে শুরু করল — ‘বাসস্ট্যান্ডে গড়ে উঠছে স্বপ্নের পাঠশালা’ এমন শিরোনামে প্রথমবার সংবাদপত্রে খবর বেরোল। সায়নীর ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা ছবি ভাইরাল হল — বাচ্চাদের রঙিন হাতে আঁকা দেয়াল, পুরনো টায়ারে চড়া ছোট্ট অনুপ, বা গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়া ছন্দার মুখ। এরপর এক আন্তর্জাতিক শিশু সংগঠন ‘Hope for All’ খেলাঘরের কথা জানতে পেরে তাদের এক প্রতিনিধি পাঠাল। সেই প্রতিনিধি এল, ঘুরে দেখল, বসে গল্প করল বাচ্চাদের সঙ্গে, তারপর সায়নীর হাতে ধরিয়ে দিল তাদের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাবনা — যদি সায়নী রাজি থাকেন, তাহলে তারা এই প্রকল্পকে বৃহৎ আকারে বাস্তবায়ন করতে চায়। সায়নী প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি — একটা অস্থায়ী কাঠামো থেকে শুরু করে এমন কিছু হবে, তা স্বপ্নেও ভাবেনি। কিন্তু খেলাঘরের দেয়ালে আঁকা সূর্যটা যেন যেন আজ সত্যিই উঁকি দিচ্ছিল তার জীবনের দিগন্তে — নতুন আলো নিয়ে, নতুন ঠিকানার প্রতিশ্রুতি নিয়ে।
৬
মৌমিতা এখন “খেলাঘর” প্রজেক্টের কেন্দ্রীয় মুখ। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন NGO, শিক্ষাবিদ, সমাজকর্মী তাকে খুঁজে নিচ্ছেন পরামর্শ নেওয়ার জন্য। কিন্তু তার বাইরের জগতে আলো যতটা ছড়াচ্ছে, ভেতরের জগতে যেন ততটাই আঁধার জমছে। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু বস্তিবাসী বাবা-মা অভিযোগ এনেছে, ওরা নাকি “খেলাঘর”–এ গিয়ে স্কুলে যেতে চায় না, সারাদিন খেলা আর আঁকার নেশায় পড়ে আছে। সমাজে পরিবর্তন আনতে গিয়ে মৌমিতা অনুভব করছে, সেই সমাজই কখনও কখনও নিজের রূপ বদলে দাঁড়িয়ে যায় প্রতিবন্ধকতা হয়ে। একদিন সন্ধ্যায়, যখন সে খেলাঘরের দেয়ালে নতুন একটি আঁকাজোকা করছে, সেখানে এক মহিলা এসে কাঁদতে কাঁদতে বলে — “আপনার জন্য আমার ছেলে বই ছুঁয়েও দেখে না, এখন বলে, ওকে আর স্কুল লাগবে না।” মৌমিতা কিছু বলতে পারে না, মাথা নিচু করে দেয়ালে তুলি চালাতে থাকে।
এই চাপের মধ্যে ‘খেলাঘর’—এর মধ্যে শুরু হয় আর্থিক সংকট। NGO গুলোর কিছু প্রমিসড ফান্ড আটকে যায় কাগজপত্রের জটিলতায়। কর্মীদের বেতন দিতে সমস্যা হয়, পেইন্ট, খেলার সামগ্রী কেনাও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। শিশুরা বুঝতে না পারলেও, ভলান্টিয়াররা বুঝতে শুরু করে মৌমিতার চোখের ক্লান্তি। রাতের পর রাত সে অফিসে বসে প্ল্যান করছে, নতুন ফান্ডিং পেতে কোথায় অ্যাপ্লাই করা যায়, কোন প্রেজেন্টেশন আপডেট করতে হবে, কার সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার। একদিন মধ্যরাতে সে একা বসে থাকা অবস্থায়, ছোট্ট শুভ এসে তার পাশে বসে বলে — “দিদি, তুমি কাঁদছো? তুমি যদি কাঁদো, আমরা খেলবো কীভাবে?” মৌমিতা তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “আমার ছোট্ট সৈনিকরা কখনো হারবে না।”
এরমধ্যে ‘খেলাঘর’ নিয়ে একটি বিতর্কিত সংবাদ প্রকাশিত হয় স্থানীয় একটি দৈনিকে—তাতে লেখা হয়, এই সংস্থার মাধ্যমে নাকি বাইরের অর্থ পাচার হচ্ছে, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ। কিছু লোক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই অপপ্রচার চালাচ্ছে, যাতে তারা ওই জমি দখল করতে পারে। পুরনো বাসস্ট্যান্ডের জায়গাটা শহরের কেন্দ্রস্থলে হওয়ায়, ব্যবসায়ীদের নজরে পড়েছে। মৌমিতা জানে, সত্যের পক্ষে দাঁড়ালে অনেক সময় একা লড়তে হয়, তবু সে ভয় পায় না। সে ডেটা, রিপোর্ট, ভিডিও, বাচ্চাদের প্রোগ্রামের সব কিছু সামনে এনে একটা জবাবি প্রেস কনফারেন্স করে। কিন্তু এই পর্বে সে বুঝে যায়, শিশুদের স্বপ্নের সঙ্গে রাজনীতি, ব্যবসা আর শহরের উন্নয়ন– এই শব্দগুলো অনেক সময় একই বাক্যে বসতে পারে না।
এই অধ্যায়ে মৌমিতার একাকীত্ব, সমাজের দোদুল্যমান মনোভাব, এবং অর্থনৈতিক সংকটের মাঝে সে যেভাবে শিশুগুলোর ভালোবাসায় আবার আশার আলো খুঁজে পায়—সেই পথচলাটাই ধরা পড়ে। খেলাঘরের ছেলেমেয়েরা যখন একসঙ্গে দেয়ালে লিখে দেয়—”আমরা তোমার সঙ্গে আছি, দিদি”, তখন সে জানে, এই লড়াইয়ের মাটিতে তার একলা পা পড়ছে না, তার সঙ্গে রয়েছে শত শত ছোট ছোট পা, যারা এখনো খালি, কিন্তু চোখ ভরা ভবিষ্যতের স্বপ্নে সজল।
৭
দুই বছর কেটে গেছে ‘খেলাঘর’ প্রতিষ্ঠার পর। সময়ের স্রোতে খেলাঘর শুধু একটা পুরনো বাসস্ট্যান্ডের গায়ে আঁকা রঙিন দোলনা আর দেয়ালের চিত্রকলার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং তা ছড়িয়ে পড়েছে কলকাতার নানা প্রান্তে। মীণার স্বপ্ন এখন বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে। মীণার নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী স্বেচ্ছাসেবী দল গড়ে উঠেছে—প্রত্যেকে আলাদা আলাদা পেশা থেকে আসা, কিন্তু একটাই উদ্দেশ্য: পথশিশুদের জীবনে আলো ফেরানো। মীণা এখন কেবল স্থপতি নয়, একজন পথপ্রদর্শক। প্রত্যেক সপ্তাহান্তে তার কর্মশালায় এসে নতুন স্বেচ্ছাসেবকেরা শেখে—কীভাবে খেলাঘরের মত ছোট পরিসরের উদ্যোগও এক বিশাল সামাজিক পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। মীণার সঙ্গে এ-যাত্রায় যুক্ত হয়েছে ছবির শিক্ষক, থিয়েটার কর্মী, মনোরোগ চিকিৎসক, এমনকি আইনের ছাত্র-ছাত্রীরাও। তারা সবাই চায় একটিমাত্র জিনিস—এই শিশুগুলো যেন স্বপ্ন দেখতে শেখে।
মীণার এই জার্নি নিছক মানবিকতায় প্রজ্জ্বলিত হলেও প্রশাসনের চোখে পড়ে যায় খুব তাড়াতাড়িই। রাজ্য শিশু অধিকার রক্ষা কমিশন এক জরুরি পরিদর্শনে এসে দেখে, যেখানে রাজ্যের হোমগুলোর অধিকাংশই অনুন্নত ও নির্মম বাস্তবতায় ডুবে, সেখানে খেলাঘর যেন এক টুকরো স্বর্গ। বাচ্চারা সেখানে খায়, লেখে, আঁকে, নাটক করে, হাসে—এবং কেউ তাদের ভয় দেখায় না। এটা প্রশাসনের একাংশকে আলোড়িত করে। কিছু সংবাদমাধ্যম এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে—‘এক পুরনো বাসস্ট্যান্ডে শিশুরা খুঁজে পেল ভালোবাসা’, ‘বাসস্টপ থেকে শিশুর রাজপথ’। এসবের প্রভাবে অনেক কর্পোরেট হাউস এগিয়ে আসে—কেউ বই দান করে, কেউ দোলনা বানায়, কেউ দেয়ালের রং দেয়। মীণা বুঝতে পারে, মিডিয়া কভারেজ আর বাস্তব কাজের মধ্যে সংযোগ ঘটালে দারুণ কিছু সম্ভব। সে প্রতিটি সাংবাদিককে ধন্যবাদ জানায়, এবং তাদের পাশে টেনে নেয়—তাদের কাছ থেকেও শেখে নতুন কিছু।
একদিন ইউনিসেফের কলকাতা চ্যাপ্টার থেকে আসে এক প্রতিনিধি, জার্মান নারী অ্যানা ফ্রেই। অ্যানা প্রথমেই মুগ্ধ হন—এই ঘিঞ্জি, অন্ধকার বস্তির মাঝখানে এত আলো, এত রং! সে বলে, “আমার দেশে এত খরচ করেও শিশুর মুখে যে আনন্দ দেখি না, তা আমি আজ এখানে দেখছি।” সে মীণাকে আমন্ত্রণ জানায় থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া আন্তর্জাতিক শিশু-সহযোগী প্রকল্পের সম্মেলনে। মীণার প্রথম বিদেশ যাত্রা—কিন্তু তার মধ্যে নেই কোনো আত্মপ্রদর্শনের গর্ব, বরং একরাশ অনিশ্চয়তা। সে ভাবে, “আমার কাজ তো এত সামান্য, ওখানে গিয়ে আমি কী বলব?” কিন্তু থিয়েটার ক্লাবের দীপ্তি, মনোরোগ চিকিৎসক অভিরূপ, এবং সাহসী সোহান তাকে সাহস দেয়—“তুমি বলবে কীভাবে তুমি একটা দোলনা বেঁধে একটা জীবন বাঁচালে।” মীণা সম্মেলনে যায়, এবং তার পেশ করা প্রেজেন্টেশন শুনে কানাডা, সুইডেন, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিনিধিরা অবাক হয়ে ওঠে। ছোট উদ্যোগ যে কতটা গভীর পরিবর্তন আনতে পারে, তা বুঝিয়ে দেয় এক তরুণী স্থপতির কথায়।
সম্মেলনের পরপরই ইউনিসেফ এবং Save the Children মীণার প্রকল্পে প্রাথমিক অনুদান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মীণা আর তার টিম একটা একাধিক লোকেশনে ‘খেলাঘর’ শাখা খোলার পরিকল্পনা নেয়। তারা পুরনো রেল স্টেশন, বন্ধ হয়ে যাওয়া ট্রাম ডিপো, এমনকি কিছু খালি গ্যারেজ ঘরকেও নতুন খেলাঘর হিসেবে ভাবতে থাকে। প্রতিটি জায়গার জন্য আলাদা থিম, আলাদা রঙচিত্র। কিছু জায়গায় রবীন্দ্রনাথ, কিছু জায়গায় গ্রামীণ শিল্প, আবার কোথাও হোক কাল্পনিক রূপকথার জগৎ। এই সময় মীণার সঙ্গে যোগাযোগ করেন বিদেশে থাকা কিছু প্রবাসী বাঙালি, যারা নিয়মিত অর্থ ও বই পাঠাতে আগ্রহী। খেলাঘর প্রকল্প এখন আর একটি শহরের গল্প নয়—এটা এক আন্দোলন। একদিন সন্ধ্যায়, দোলনায় বসে মীণা দেখে সোহান তার বোনকে পড়াতে পড়াতে গান গাইছে, আর পাশেই ছোট্ট মুসকান রং তুলিতে আকাশ আঁকছে—তখন মীণা মনে মনে বলে ওঠে, “এই তো স্বপ্ন, ঠিক এভাবেই রঙিন হোক প্রত্যেকটা শিশুর জীবন।”
৮
রোদেলা দুপুরের আলোয় ঝলমল করছে খেলাঘরের রঙিন দেয়ালগুলো। ছেলেমেয়েরা দুলনায়, লাফানোর রশিতে, আর খোলা মাঠে খেলছে, হাসছে, গান গাইছে। আকাশে বাতাসে মিশে আছে বাচ্চাদের সারল্যের এক অপার আনন্দ। অনন্যা দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে—এই সেই বাসস্ট্যান্ড, যেখানে একদিন ছিল শুধুই ধুলো, ভাঙা বেঞ্চ, আর বিষণ্ণ নীরবতা। আজ এখানে প্রাণ, ভালোবাসা, আর আশার স্বপ্নেরা বাসা বেঁধেছে। তার চোখে জল, মুখে হাসি। এক পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে অদ্বৈত, যার ক্যামেরা সেই সব মুহূর্ত ধরে রাখছে। আজকের দিনটা বিশেষ—খেলাঘর এবার সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছে শিশু উন্নয়ন মডেল হিসেবে, এবং আরও দশটি শহরে এর সম্প্রসারণ শুরু হচ্ছে। বিদেশি প্রতিনিধি দল এসেছে, অনন্যার কথা শুনেছে, বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছে। তারা মুগ্ধ, আর অনন্যা বারবার বলেছে—”এই কৃতিত্ব আমার একার নয়, এটা আমাদের সকলের, এই বাচ্চাদের, স্বেচ্ছাসেবকদের, পাড়ার মায়েদের, আর সেই প্রথম পেইন্ট করা দেয়ালের।”
একটা ছোট্ট মেয়ে—পাঁচ বছরের চুমকি—হাত ধরে টান দেয় অনন্যার, “দিদি, নতুন দেয়ালটা আমরা আজ আঁকবো, না?” অনন্যা হেসে মাথা নেড়ে বলে, “অবশ্যই, তুমিই তো আমাদের প্রধান শিল্পী!” পেছনে থাকা ছেলেরা হাঁক দেয়, “আমরাও আছি, দিদি!” সবাই মিলে রঙ, তুলি নিয়ে বসে পড়ে—এ যেন এক বর্ণময় উৎসব। দেয়ালের ছবিতে উঠে আসে এক বাসস্ট্যান্ড, যেটা ধীরে ধীরে রূপ নেয় খেলাঘরে—টায়ারের দোলনা, বইয়ের তাক, কমলা রঙের প্যাঁচার ছবি। প্রতিটি তুলির আঁচড়ে ওদের জীবনের গল্প, স্বপ্ন, সংগ্রাম আর ভালোবাসা লুকিয়ে। অনন্যা বোঝে—এই শিশুরা আজ শুধু উপভোক্তা নয়, তারাও সৃষ্টির শরিক। তার মনে পড়ে রাত্রির সেই শুরু, একা হাতে রঙ তুলে শুরু করা সেই প্রথম দেয়াল, যে দেয়াল এখন শত শিশুর খুশির ক্যানভাস।
গভীর রাতে, খেলাঘরের কাঠের বেঞ্চে বসে অনন্যা মোবাইলে দেখতে থাকে বিশ্ব শিশুকল্যাণ সংস্থার ইমেল—তারা তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে জেনেভায়, আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে অংশ নিতে, খেলাঘর মডেলের কথা বলার জন্য। অদ্বৈত পাশে বসে বলে, “তুই তো বলতিস, খেলাঘর একটা স্বপ্ন—এখন দেখ, সেই স্বপ্ন দিগন্ত ছুঁয়ে ফেলছে।” অনন্যা মৃদু হাসে, তারপর বলে, “এখনো অনেক কিছু বাকি, প্রতিটা শহরে, প্রতিটা বস্তিতে এমন খেলাঘর গড়তে হবে, যাতে একটা শিশুও স্বপ্ন দেখা না ভুলে।” হঠাৎ সে বলে ওঠে, “এই জায়গাটায় একটা লাইব্রেরি করা যায়, কী বলিস?” অদ্বৈত মাথা নাড়ে, “আর আমরা একটা রাতের স্কুলও করতে পারি ওদের জন্য, যারা দিনে কাজ করে।” দুজনে আবার নতুন পরিকল্পনায় মেতে ওঠে।
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। পেছনে বাচ্চাদের ঘুমন্ত মুখ, সামনের মাঠে শান্তি। খেলাঘর এখন আর শুধু একটা জায়গা নয়, এটা একটা আন্দোলন, একটা সমাজ-রূপান্তরের প্রতীক। অনন্যা জানে তার যাত্রা সবে শুরু। সামনে অনেক লড়াই, অনেক স্বপ্ন। কিন্তু এখন তার পাশে আছে অগণিত হাত, হাজারো পা, আর লক্ষ স্বপ্ন। সে চোখ তুলে আকাশের দিকে চায়—জীবনের এই খেলাঘর যেন একদিন সবার হৃদয়ে গড়ে ওঠে। আর সেদিন, সব শিশুই বলতে পারে—”আমাদেরও একটা ঠিকানা আছে, যেখানে আমরা কাঁদি না, শুধু হাসি।”
শেষ
				
	

	


