Bangla - কল্পবিজ্ঞান

ক্লোন নদীর রহস্য

Spread the love

সৌরভ মুখোপাধ্যায়


পর্ব ১: পদ্মার তীরে ল্যাবরেটরি

পদ্মার জল আজও যেমন তীব্র স্রোত নিয়ে বয়ে যায়, তেমনি তার বুকের উপর ভেসে আছে এক বিশাল ধাতব স্থাপনা। দূর থেকে দেখলে মনে হয় নদীর বুকে যেন ভেসে উঠেছে কোনও অচেনা দ্বীপ, কিন্তু কাছে গেলেই বোঝা যায় সেটি প্রকৃতির নয়, মানুষের তৈরি। নাম—“মেমরি রিসার্চ সেন্টার”, সংক্ষেপে এমআরসি। বিশাল বৃত্তাকার ল্যাবরেটরিটি নদীর স্রোতের সঙ্গে বাঁধা, তলায় শ’খানেক টারবাইন ঘুরছে ক্রমাগত, যা বিদ্যুৎ জোগাচ্ছে গোটা কেন্দ্রে। আর ভেতরে সাদা দেয়ালে ঝুলছে হাজার হাজার স্ক্রিন, টেবিলের উপর সারি সারি কাঁচের কনটেইনার, যেগুলোর ভেতরে ঝিলমিল করছে তরল আলো—কেউ বলে ওগুলো আসলে মানুষের ছেঁড়া স্বপ্ন।

এখানকার বিজ্ঞানীরা দাবি করেন, মানুষের স্মৃতিকে জলকণিকা থেকে আলাদা করে ফেলা সম্ভব। পদ্মার জলে ভাসমান ক্ষুদ্র কোষের ভেতর প্রতিদিন জমে থাকে হাজার মানুষের হাসি, কান্না, ভয় আর ভালোবাসার খণ্ডচিত্র। সেই স্মৃতিকে প্রযুক্তির সাহায্যে বের করে এনে সংরক্ষণ করা যায়। শুধু তাই নয়—চাইলে সেই স্মৃতি থেকে তৈরি করা যায় হুবহু এক নতুন মানুষ। যাকে তারা বলে—“ক্লোন।”

প্রথমে বিষয়টি গবেষণার পর্যায়ে ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর জাপানের কয়েকজন বায়োটেক বিশেষজ্ঞ মিলেই পরীক্ষাটি চালান। কিন্তু খুব দ্রুত সরকারও হাত বাড়ায়। কারণ সহজ—যদি স্মৃতি থেকে মানুষ বানানো যায়, তবে শ্রমিক, সৈনিক, এমনকি রাজনীতিবিদের বিকল্পও তৈরি হবে। এতে দেশের ভবিষ্যৎ নাকি সুরক্ষিত। কিন্তু পদ্মার ধারের সাধারণ মানুষদের কাছে ব্যাপারটা অন্যরকম।

গঙ্গাপাড়ের এক গ্রাম—জলঙ্গীপুর। নদীর ধার ঘেঁষে ছোট ছোট কুঁড়েঘর, অর্ধেক ভাঙা বাঁশের সেতু, মাছ ধরার নৌকা আর চায়ের দোকানের গন্ধে ভরা এই গ্রামে এমআরসি-র খবর ছড়িয়ে পড়েছিল খুব তাড়াতাড়ি। দারিদ্র্যে জর্জরিত মানুষদের কাছে বিজ্ঞানীরা এক লোভ দেখালেন—যে কেউ যদি নিজের স্মৃতির অংশ বিক্রি করে, তবে তাকে দেওয়া হবে মোটা টাকা। একটা শৈশব, একটা পুরনো প্রেম, কিংবা একটা হারানো স্বপ্ন—সবকিছুরই বাজারদর আছে। গ্রামবাসীরা প্রথমে ভেবেছিল মজা, পরে যখন দেখল মুদিখানার মালিক বা ধারের চাষি টাকা পেয়ে হঠাৎ বড়লোক হয়ে উঠছে, তখন তারাও ভিড় জমাতে শুরু করল।

এমনই এক তরুণ—অরুণ মণ্ডল। বয়স পঁচিশ, বাবার রেখে যাওয়া এক চিলতে জমিতে চাষ করে, তবে তা দিয়ে সংসার চলে না। মা অসুস্থ, ছোট বোনের পড়াশোনা মাঝপথে বন্ধ। চারদিকে শুধু অভাব। তাই যখন এমআরসি-র এক সাদা অ্যাপ্রন পরা লোক তার হাতে কাগজ দিল—“আপনার একটা পুরনো স্মৃতি বিক্রি করলে চলবে, তাতেই লাখ টাকা পাবেন”—তখন অরুণ প্রথমে ভয় পেলেও পরে রাজি হয়ে গেল।

সেদিন ভোরে সে ল্যাবরেটরির ভেতরে ঢুকল। ভেতরের ঠাণ্ডা বাতাস আর জীবাণুমুক্ত গন্ধ তাকে কাঁপিয়ে দিল। সাদা স্যুট পরা এক মহিলা তাকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন।
—“ভয় পাবেন না। শুধু একটা ছোট্ট স্মৃতি নেব। কোনটা দেবেন, সেটা আপনিই বেছে নেবেন।”
অরুণ দ্বিধায় পড়ল। কোন স্মৃতি দেবে সে? অবশেষে ঠিক করল—তার বাল্যবন্ধু সাগরের কথা, যে নদীতে ডুবে গিয়েছিল। সেই স্মৃতিটাই তার সবচেয়ে কষ্টের। হয়তো সেটা বাদ দিলে বুকের ভার হালকা হবে।

অপারেশন শুরু হল। মাথার উপর অদ্ভুত এক হেলমেট পরিয়ে দেওয়া হল তাকে। হেলমেটের তারগুলো কাচের এক কনটেইনারের সঙ্গে যুক্ত। কয়েক মিনিটের মধ্যে অরুণ অনুভব করল মাথার ভেতর থেকে যেন কেউ কিছু টেনে নিচ্ছে। প্রথমে একটা অস্বস্তি, তারপর হঠাৎ হালকা লাগতে শুরু করল। চোখের সামনে অন্ধকার নামল, আর একসময় সে দেখল কনটেইনারের ভেতর ঝিলমিল করছে নীল আলো। বিজ্ঞানীরা হাসিমুখে বলল—“হয়ে গেছে। আপনার স্মৃতি আলাদা হয়ে গেছে।”

অরুণের হাতে টাকা তুলে দেওয়া হল। সে ভাবল—এবার সংসারের হাল কিছুটা বদলাবে। কিন্তু বাড়ি ফিরে দেখল, মায়ের দিকে তাকালে বুকের ভেতর এক অদ্ভুত শূন্যতা তৈরি হচ্ছে। আর ছোট বোনের হাসিতে খুঁজে পাওয়া যায় না সেই পরিচিত টান। যেন কোথাও থেকে কিছু কেটে নেওয়া হয়েছে তার ভেতর থেকে।

এর কিছুদিন পরেই অদ্ভুত এক খবর ছড়িয়ে পড়ল গ্রামে। পদ্মার ধারের ল্যাব থেকে বেরিয়েছে অরুণেরই আরেকটা রূপ—হুবহু তার মতো দেখতে এক মানুষ। মানুষ বিশ্বাস করতে পারল না, কিন্তু চোখে দেখল—অরুণ বাড়িতে বসে আছে, অথচ হাটের মোড়ে দাঁড়িয়ে তারই মতো আরেক অরুণ মাছ কিনছে। কেউ বলল—এটা ভূত, কেউ বলল যমজ ভাই। কিন্তু অরুণ বুঝল—এটা তারই হারানো স্মৃতি থেকে তৈরি এক “ক্লোন।”

নদীর ধারে দাঁড়িয়ে সে দেখল দূরে এমআরসি-র লাইট জ্বলছে। সাদা কুয়াশার ভেতর ধাতব স্থাপনাটা যেন এক দৈত্যের মতো দপদপ করছে। আর তার বুকের ভেতর হুহু করে বাজছে এক প্রশ্ন—সে আসল অরুণ নাকি ওটা? যদি ও-ই তার হারানো স্মৃতির রূপ হয়, তবে এই শরীর আর আত্মার দাম কতটুকু?

পদ্মার ঢেউ ততক্ষণে জোরে আছড়ে পড়ছে বাঁধে। নদীর স্রোতের শব্দে অরুণের কানে ভেসে এল ফিসফিসানি—মনে হল নদী যেন বলছে, “এখনও শুরু হয়নি। যা আসছে, তার জন্য প্রস্তুত হও।”

পর্ব ২: অরুণের সিদ্ধান্ত

অরুণ রাতভর ঘুমোতে পারল না। খাটে শুয়ে চোখ বন্ধ করলেই মনে হচ্ছিল—হাটের মোড়ে দাঁড়িয়ে তার মতো দেখতে মানুষটা হঠাৎ ফিরে তাকাচ্ছে, ঠোঁট বাঁকিয়ে একরকম অচেনা হাসি দিচ্ছে। অথচ সেটা তারই মুখ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যতবার নিজের প্রতিবিম্ব দেখেছে, কখনও এরকম অনুভূতি হয়নি। সেই রাতে খোলা জানলা দিয়ে নদীর স্রোতের শব্দ এসে মিলল বুকের ভেতরের অস্বস্তির সঙ্গে।

ভোরের আলো ফুটতেই খবর ছড়িয়ে পড়ল—গ্রামে আরও দুজনের ক্লোন দেখা গেছে। কালীপদ মিস্ত্রির ক্লোন নাকি মদের দোকানে বসে দেদার খাচ্ছে, অথচ আসল কালীপদ তখন নিজের ঘরে। আর বকুলি, যে কয়েক সপ্তাহ আগে গোপনে এমআরসি-তে গিয়েছিল, সে দেখল তারই মতো আরেকজন মহিলা নদীর ধারে কাপড় শুকোচ্ছে। গ্রামজুড়ে চাঞ্চল্য।

চায়ের দোকানে বসা লোকজন নানা মত দিতে লাগল। কেউ বলল—“এগুলো আসলে ভূত, যাদের ডাকছে পদ্মা।” কেউ বলল—“সরকার নকল মানুষ বানাচ্ছে, যাতে ভোটে ব্যবহার করতে পারে।” আবার কেউ ফিসফিস করে বলল—“এগুলো আমাদের বিক্রি করা স্মৃতি থেকে তৈরি। আমাদেরই আরেক রূপ।”

অরুণ এসব শুনে কেমন যেন অবশ হয়ে গেল। সে জানত—ওরা ঠিক বলছে। নিজের ভেতর থেকে কিছু কেটে নেওয়ার যে শূন্যতা সে টের পেয়েছিল, সেটাই এখন হাঁটাচলা করছে বাইরে। হঠাৎ মনে পড়ল, সেই মহিলার কথা—যিনি স্মৃতি আলাদা করার সময় হাসিমুখে বলেছিলেন, “কোনটা দেবেন, আপনি বেছে নিন।” সত্যিই কি সে নিজের ইচ্ছায় দিয়েছিল? নাকি তাদের প্রযুক্তি গোপনে আরও কিছু নিয়ে নিয়েছিল?

বাড়ি ফিরে সে দেখল তার মা খাটে শুয়ে কাশছেন, বোন পড়ার খাতা নিয়ে বসে আছে। তাদের চোখে অরুণ নিজের আগের জায়গায়ই আছে, কিন্তু সে জানে—কোথাও একটা ফাঁক রয়ে গেছে। মা যখন বললেন, “তুই তোকে চিনতে পারিস না নাকি রে? মুখটা এমন গম্ভীর কেন?”, তখন অরুণের বুকের ভেতর খচখচ করে উঠল। সে উত্তর দিল না, শুধু বাইরে বেরিয়ে এল।

পদ্মার ধারে দাঁড়িয়ে সে দেখল দূরে এমআরসি-র আলো। বিশাল ধাতব স্থাপনা কুয়াশার ভেতর জ্বলজ্বল করছে। অরুণ অনুভব করল—সে যদি চুপচাপ থাকে, তবে একদিন তার জায়গায় সেই ক্লোন ঢুকে পড়বে। হয়তো পরিবারও বুঝতে পারবে না কে আসল। আসল-নকলের এই খেলায় তাকে নিজের জায়গা বাঁচাতে হবে।

কিন্তু প্রশ্ন হল—কীভাবে?

অরুণ ঠিক করল সে সরাসরি ল্যাবরেটরির কারও সঙ্গে কথা বলবে। রাতে গ্রামের পরিত্যক্ত বাঁশঝাড়ে সে গিয়ে দেখা করল রফিকের সঙ্গে, যে এমআরসি-তে ছোটখাটো কাজ করে। রফিক সাধারণত গোপনে তথ্য ফাঁস করে টাকাপয়সা কামায়। অরুণ তাকে জিজ্ঞেস করল—
—“শোন, আমার মতো দেখতে আরেকজনকে দেখেছে সবাই। এটা কেমন করে সম্ভব? তোরা কি সত্যিই ক্লোন তৈরি করিস?”
রফিক একটু ইতস্তত করে বলল—“শোন অরুণ, আমি বেশি কিছু জানি না। তবে হ্যাঁ, যেসব স্মৃতি তোরা বিক্রি করিস, সেগুলো থেকে নতুন মানুষ বানানো হয়। ওরা বলে এগুলো শুধু ‘ডাটা কপি’। কিন্তু আমি নিজের চোখে দেখেছি—তোর মতো, কালীপদর মতো অনেকেই আছে ভেতরে। ওরা খাঁচায় থাকে, পরীক্ষার জন্য।”
অরুণের গলা শুকিয়ে গেল।
—“মানে…ওরা বেঁচে আছে?”
—“হ্যাঁ। একেবারে আসল মানুষের মতো।”

এই কথাগুলো তার মাথায় আঘাতের মতো বাজল। তার মানে, যে স্মৃতিটুকু সে বিক্রি করেছে, সেটাই এখন আরেকজনের শরীরে পূর্ণ জীবন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু যদি সেই জীবন আসল হতে চায়? যদি সে নিজের জায়গা দাবি করে?

রাতে বাড়ি ফিরে অরুণ দেখল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই “অন্য অরুণ।” অন্ধকার গলির আলোয় স্পষ্ট তার মুখ, তারই মতো ঠোঁট, চোখ, ভঙ্গি। দুজন মুখোমুখি দাঁড়াল।
অরুণ থরথর করে জিজ্ঞেস করল—“তুই কে?”
অন্যজন মৃদু হেসে বলল—“তুই-ই তো। তবে তুই যা ভুলে গেছিস, আমি তা মনে রেখেছি।”
অরুণের বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। এই প্রথম সে নিজের ক্লোনের কণ্ঠ শুনল।

দুজন কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। শুধু নদীর স্রোতের শব্দ ভেসে আসছিল। তারপর ক্লোন ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেল, অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। অরুণ কেবল দাঁড়িয়ে রইল, বুকের ভেতর তীব্র ধুকপুকানি।

সেদিন রাতেই সে সিদ্ধান্ত নিল—সে চুপ করে বসে থাকবে না। যদি এই খেলা তার জীবনের নিয়ন্ত্রণ নেয়, তবে সে লড়বেই। হয়তো লড়াইটা হবে নিজেরই ছায়ার সঙ্গে, কিন্তু পিছু হটার উপায় নেই।

পর্ব ৩: স্মৃতি ব্যবসার অন্ধকার

পদ্মার বুকের উপর দাঁড়িয়ে থাকা এমআরসি-র আলো যেন ক্রমশ গাঢ় হতে লাগল। চারদিকে যে জলোচ্ছ্বাস আর কুয়াশা, তার ভেতর লুকিয়ে থাকল এক অদ্ভুত অস্থিরতা। গ্রাম থেকে শহরে, শহর থেকে রাজধানীতে—খবর ছড়িয়ে পড়ল, “মানুষের স্মৃতি বিক্রি করা যায়। তার দামও পাওয়া যায় সঙ্গে সঙ্গে।” এই খবর পৌঁছে গেল রাজনীতিবিদের কানে, ব্যবসায়ীর কানে, এমনকি আন্তর্জাতিক কর্পোরেট সংস্থার কানে।

প্রথমে বিষয়টি গোপন ছিল। কিন্তু একদিন টিভির পর্দায় দেখা গেল—ঢাকার এক মন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করছেন, “স্মৃতি ব্যবসা ভবিষ্যতের অর্থনীতি। যেসব দেশ প্রযুক্তির দৌড়ে এগোতে চায়, তাদের জন্য এটি আশীর্বাদ।” তার হাসিমুখের পেছনে গোপন থাকল সেই লোভ—মানুষকে নকল করে তৈরি করা শ্রমিক আর সৈন্যদের একদিন যে ব্যবহার করা যাবে যুদ্ধে, তা সবাই বোঝে।

অরুণ এসব শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল। সে একা নয়—গ্রামের অনেকেই নিজেদের স্মৃতি বিক্রি করেছে। চাষি জমি হারিয়ে, মজুর কাজ হারিয়ে, গৃহবধূ স্বামীর ঋণ শোধ করতে গিয়ে—সবাই একে একে গিয়েছে এমআরসি-তে। আর ফিরে এসেছে কিছুটা ফাঁপা মুখ নিয়ে, হাতে কড়া নোটের গন্ধ নিয়ে।

কিন্তু আশ্চর্য হল, যাদের স্মৃতি বিক্রি হয়েছে, তাদের চোখে এক অদ্ভুত শূন্যতা। যেন তারা হেসে কথা বললেও, ভেতরে কোথাও কিছু নেই। গ্রামের লোকেরা মাঝে মাঝে ফিসফিস করে বলে—“ওদের ভেতর থেকে প্রাণটাই তুলে নেওয়া হয়েছে।”

একদিন সন্ধ্যায় অরুণ বাজারে গিয়ে দেখল, কয়েকজন বিজ্ঞানী গ্রাম থেকে নতুন মানুষ আনছে। ট্রাকে ভরা কয়েকজন তরুণ-তরুণী, যাদের হাতে চুক্তিপত্র। তাদের চোখে লোভের ঝিলিক—শুধু কয়েকটা স্মৃতি বিক্রি করলে ঋণ শোধ হয়ে যাবে, সংসার চলবে। অরুণের বুকটা কেমন করে উঠল। সে জানত—ওদের সবার জায়গায় তৈরি হবে নতুন নতুন ক্লোন।

অল্পদিনের মধ্যেই গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল আরও অদ্ভুত খবর। কেউ কেউ নাকি হঠাৎ পাগল হয়ে যাচ্ছে। যেমন—কালীপদ মিস্ত্রি, যে নিজের শৈশব বিক্রি করেছিল, একদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার শুরু করল—“আমার শৈশব কোথায়? আমি কে?” লোকেরা তাকে ধরে রাখল, কিন্তু তার চোখে ফুটে উঠল ভীষণ আতঙ্ক। তার স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে বলল—“ও আর চিনতে পারছে না ঘরবাড়ি, না আমাদের। শুধু খুঁজছে নিজের হারানো স্মৃতি।”

এই দৃশ্য দেখে মানুষ ভয় পেতে শুরু করল। কিন্তু তবুও এমআরসি-র সামনে ভিড় কমল না। টাকা মানুষকে এমনভাবে টানে যে ভয়ও তার কাছে হার মেনে যায়।

অরুণ এক রাতে গোপনে আবার রফিকের সঙ্গে দেখা করল। রফিক ফিসফিস করে বলল—“তোরা জানিস না, ভেতরে কী হয়। প্রতিদিন হাজার হাজার স্মৃতি জমা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা ওগুলো থেকে নতুন নতুন মানুষ বানাচ্ছে। কিন্তু সব ক্লোন ঠিক থাকে না। কেউ কেউ স্মৃতি হারিয়ে উন্মাদ হয়ে যায়। ওদের গোপনে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।”
অরুণ আঁতকে উঠল।
—“মানে? জীবিত মানুষ নদীতে ফেলে দিস তোরা?”
রফিক নিচু গলায় উত্তর দিল—“ওদের কাছে ওরা জীবিত নয়। শুধু ‘ডাটা ত্রুটি’। ভুল ফাইল মুছে দেওয়ার মতো ব্যাপার।”

এই কথাগুলো শুনে অরুণের বুক ধকধক করতে লাগল। সে ভাবল—যদি তার নিজের ক্লোনও একদিন ত্রুটি হয়ে যায়? যদি সেই সত্তাকে একদিন নদীতে ফেলে দেওয়া হয়? কিন্তু তার ক্লোন তো এখন বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বাজারে যাচ্ছে, কথা বলছে। তবে কি তার জীবনও ঝুঁকির মুখে?

গ্রামে ধীরে ধীরে এক অদ্ভুত ভয় ছড়িয়ে পড়ল। মানুষ বুঝতে পারল—ওরা নিজেদের স্মৃতি বিক্রি করে শুধু টাকা পাচ্ছে না, নিজের অস্তিত্বও ভাগ করে দিচ্ছে। কারও ঘরে আসল মানুষ, কারও ঘরে নকল মানুষ। শিশু পর্যন্ত বোঝে না, মা আসল নাকি ক্লোন।

এক রাতে হাটে বিশাল অগ্নিকাণ্ড হল। সবাই দৌড়ে এল, দেখল—আগুনের ভেতর থেকে দৌড়ে বেরোচ্ছে দুটো একই রকম মানুষ। একজন অচিৎকরের মতো চিৎকার করছে—“আমি আসল!” আরেকজন একইভাবে গলা ফাটাচ্ছে—“আমি-ই আসল!” ভিড় জমে গেল, কেউ আলাদা করতে পারল না কে সত্যি। শেষে দুজনেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল। পরদিন সকালে যখন লোকজন তাদের ধরতে গেল, তখন দেখা গেল তারা দুজনেই উধাও।

এই ঘটনার পর গ্রামে গুজব আরও বেড়ে গেল। কেউ বলল—ক্লোনরা নিজেরাই বিদ্রোহ শুরু করছে। কেউ বলল—এটা সরকারের ষড়যন্ত্র। কিন্তু অরুণ জানল, আসল সত্যি আরও অন্ধকার। নদী তার বুকের ভেতর যে স্মৃতির খণ্ড লুকিয়ে রেখেছিল, সেটাই এখন অদ্ভুতভাবে নতুন জীবন নিচ্ছে।

সেই রাতে, নদীর ধারে দাঁড়িয়ে অরুণ শুনল এক ফিসফিসানি—যেন কেউ ডেকে বলছে, “অন্ধকার কেবল শুরু হয়েছে।”

পর্ব ৪: বিদ্রোহের বীজ

পদ্মার ধারে রাতগুলো এখন আর আগের মতো নিস্তব্ধ নয়। বাতাসে অচেনা ফিসফিসানি ভেসে বেড়ায়, গ্রামবাসীরা বলে—এগুলো আসলে ক্লোনদের নিশ্বাসের শব্দ, যারা অন্ধকারে গোপন সভা বসাচ্ছে। দিনদুপুরে মানুষ কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে, বাজারে মাছ কিনে, ফসল বেচে, কিন্তু রাত নামলেই চারপাশে অদৃশ্য টান জমে ওঠে। মনে হয় কোথাও না কোথাও একদল মানুষ জড়ো হচ্ছে, যাদের মুখ একই, অথচ ভেতরটা অন্যরকম।

অরুণ এখন প্রায়শই সেই টান অনুভব করে। নিজের ক্লোনকে প্রথম দেখার পর থেকে সে যেন এক অদৃশ্য দড়ির সঙ্গে বাঁধা হয়ে আছে। যেদিকে ও-টা যাবে, সেদিকেই তার ভেতর থেকে একটা শক্তি টেনে নিয়ে যায়। এক রাতে সে সেই টানের পথ অনুসরণ করল। কুয়াশায় ঢাকা বাঁশঝাড় পেরিয়ে সে পৌঁছল নদীর ধারের এক ফাঁকা জমিতে। সেখানে মৃদু আলো জ্বলছে—কেউ একটা লণ্ঠন রেখেছে।

ভেতরে তাকাতেই তার বুক কেঁপে উঠল। অন্তত কুড়িজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সবাই হুবহু একই চেহারার দুই দুইটা রূপে বিভক্ত। কেউ আসল, কেউ ক্লোন—কিন্তু চোখের চাহনিতে বোঝা যাচ্ছে, ওরা সবাই নিজেদের অস্তিত্বের দাবি করছে। লণ্ঠনের আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা একজন গলা তুলে বলল—
—“আমরা কেউ নকল নই। আমরা আলাদা মানুষ। আমাদের স্মৃতি আছে, শরীর আছে, আমরা অনুভব করতে পারি। তাহলে কেন আমাদের খাঁচায় বন্দি রাখা হবে?”

অরুণ বুঝতে পারল, এ এক বিদ্রোহের সূচনা।

ওদের নেতা ছিল অরুণেরই ক্লোন। সে অন্যদের উদ্দেশে বলল—
—“আমাদের তৈরি করা হয়েছে যেন আমরা কেবল পরীক্ষার যন্ত্র হই। কিন্তু আমরা জানি, নদীর জল শুধু স্মৃতি বহন করে না, জীবনও দেয়। সেই জীবন থেকে আমরা জন্মেছি। মানুষ আমাদের অস্বীকার করতে পারে না।”
একটা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল। এক বৃদ্ধ ক্লোন বলে উঠল—“কিন্তু আসল মানুষরা আমাদের মানবে কীভাবে? ওরা তো আমাদের ছায়া মনে করে।”
অরুণের ক্লোন উত্তর দিল—“ছায়া তো আলোর সঙ্গেই থাকে। আলোর অস্বীকার করলে ছায়া থাকবে না। আমরা যদি নিজেদের ছায়া মানতে না চাই, তবে নিজেদের অস্তিত্ব তৈরি করতে হবে। নিজেদের গ্রাম, নিজেদের সমাজ।”

শুনে ভিড় থেকে কয়েকজন আসল মানুষ ভয়ে সরে গেল। কিন্তু বাকিরা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। যেন নদীর স্রোতও থেমে গিয়ে শুনছে।

অরুণ কুয়াশার আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁপছিল। সে বুঝতে পারল—ক্লোনদের দাবিটা অস্বীকার করা যায় না। সত্যিই তো, তাদেরও শরীর আছে, তাদেরও অনুভূতি আছে। শুধু জন্মের উৎস আলাদা। কিন্তু এই বিদ্রোহ যদি বড় হয়, তবে আসল মানুষ আর ক্লোনদের মধ্যে সংঘর্ষ হবেই।

পরদিন সকালে গ্রামে কানাঘুষো শোনা গেল। রাতের সভায় যারা গিয়েছিল, তারা বলল—“ক্লোনরা এখন নিজেদের নেতা বানিয়েছে। ওরা আর ল্যাবরেটরির বন্দি হবে না।” খবরটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। কেউ কেউ চুপচাপ ভয় পেল, কেউ আবার গোপনে উল্লসিত হল। কারণ গ্রামে অনেকেই ক্লোন আত্মীয় হারিয়েছে—যাদের হয়তো খাঁচায় বন্দি রাখা হয়েছিল।

এদিকে এমআরসি-র ভেতর বিজ্ঞানীরাও অস্বস্তি টের পেল। কয়েকটি কন্টেইনার খালি পাওয়া গেল, কয়েকজন ক্লোন নিখোঁজ। গোপন প্রতিবেদনে লেখা হল—“ক্লোনদের মধ্যে বিদ্রোহের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। ওদের ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে।” কিন্তু সরকারের কাছে এই খবর চাপা দেওয়া হল। তারা চাইছিল, বাইরে যেন কিছু না ফাঁস হয়।

অরুণ সেদিন সন্ধ্যায় নিজের ক্লোনের সঙ্গে আবার দেখা করল। এবার ওরা মুখোমুখি বসল নদীর ধারের ভাঙা নৌকায়। ক্লোন প্রথমে চুপ করে থাকল, তারপর বলল—
—“তুই জানিস, আমি তোর ভেতরের সেই অংশ, যা তুই হারিয়ে ফেলেছিস। সাগর ডুবে যাওয়ার স্মৃতি তুই বিক্রি করেছিলি। আমি সেই ব্যথার মধ্যে জন্মেছি। তাই আমি জানি—হারানোর যন্ত্রণা কেমন।”
অরুণ চোখ নামিয়ে ফেলল। বুকের ভেতর পুরনো ক্ষত খুলে গেল।
ক্লোন আবার বলল—“আমরা যদি এক হই, তবে হয়তো অন্য ক্লোনদের পথ দেখাতে পারব। মানুষ আর ক্লোন মিলেও কি থাকতে পারে না?”
অরুণ উত্তর দিল না। নদীর ঢেউ ততক্ষণে গর্জে উঠছিল, যেন তার মনে প্রশ্ন তুলছে—“তুই কোন দিক বেছে নেবি?”

রাতের আকাশে চাঁদ উঠে আসছিল। পদ্মার জলে সেই প্রতিচ্ছবি কাঁপছিল। বিদ্রোহের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে—কিন্তু তার ফল কী হবে, তা এখনো কেউ জানে না।

পর্ব ৫: আসল বনাম নকল

গ্রামজীবনের সহজ ছন্দ ভেঙে গেছে। আগে যেমন সকালের বাজারে মাছের ডাক, কুয়াশায় ভেজা সবজি, কিংবা মসজিদের আজানের ধ্বনি একসঙ্গে মিলেমিশে দিনের শুরু করত, এখন তার ভেতরে ঢুকে পড়েছে এক অদ্ভুত বিভ্রান্তি। কারণ বাজারে দাঁড়ানো মানুষের ভিড়ের মধ্যে ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে—কেউ আসল, কেউ ক্লোন। অথচ কে আসল আর কে নকল তা বোঝার উপায় নেই।

চায়ের দোকানে বসে লোকজন খিস্তি করতে করতে হঠাৎ খেয়াল করে—একজন একইসঙ্গে দোকানের ভেতরে বসে চা খাচ্ছে, আর রাস্তার ওপার থেকে তাকাচ্ছে। দুজনের মুখ হুবহু এক। লোকজন চমকে ওঠে। ভেতরে বসা মানুষটা বলে ওঠে—“আমি-ই আসল।” ওপারের জন চেঁচিয়ে ওঠে—“আমি ছাড়া আসল কে আছে?” দোকানদার দিশেহারা হয়ে যায়। শেষমেষ ঝগড়াঝাটি শুরু হয়ে যায় দুজনের মধ্যে। ভিড় জমে যায়। কেউ বিশ্বাস করে একে, কেউ বিশ্বাস করে অন্যজনকে।

এই বিভ্রান্তি কেবল বাজারেই নয়, ঘরোয়া সম্পর্কেও ঢুকে পড়ল। স্বামী একদিন ঘরে ফিরে দেখল, তার স্ত্রী রান্নাঘরে ভাত বসিয়েছে। সে খুশি হয়ে ডাকল, কিন্তু অল্প পরেই আরেকজন একই চেহারার স্ত্রী শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। দুজনই দাবি করল—“আমি আসল।” স্বামী ভয়ে চিৎকার করে বাইরে দৌড়ে গেল। এমন ঘটনা প্রতিদিন ঘটতে শুরু করল।

অরুণও বাদ গেল না। এক রাতে সে ঘরে ফিরল, দেখল তার মা শুয়ে আছেন। কিন্তু পাশের ঘরে বসা ছোট বোন হঠাৎ বলে উঠল—“দাদা, মা তো বাইরে উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে।” অরুণ ছুটে গিয়ে দেখল, হ্যাঁ, উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে মায়ের আরেক রূপ, চোখে অবিরল জল। দুজন মা একসঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়ালেন, আর দুজনেই একই কণ্ঠে বললেন—“আমি-ই তোকে জন্ম দিয়েছি।” অরুণ হতভম্ব হয়ে গেল, বুঝল না কাকে আঁকড়ে ধরবে।

গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। মানুষরা নিজেদের ছায়াকেও সন্দেহ করছে। রাতের আঁধারে কেউ কেউ ক্লোন শিকার শুরু করল—যাদের সন্দেহ হয়, তাদের বেঁধে রাখা হয়, মারধর করা হয়। কিন্তু প্রমাণ পাওয়া যায় না কে আসল, কে নকল। ফলে আসল মানুষও মারা গেল, ক্লোনও। রক্তের গন্ধ নদীর হাওয়ায় মিশে যেতে লাগল।

এদিকে এমআরসি-র বিজ্ঞানীরা চুপচাপ সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিল। তারা জানত এই বিশৃঙ্খলাটা অনিবার্য। এক প্রতিবেদনে লেখা হল—“ক্লোনদের সঙ্গে মূল মানুষের সীমারেখা মুছে যাচ্ছে। সামাজিক বিভাজন তৈরি হচ্ছে। এই বিভাজনকে কাজে লাগানো সম্ভব।” আসলে ওরা চাইছিল, গ্রামবাসীরা নিজেরাই একে অপরকে ধ্বংস করুক, আর সেই সুযোগে সরকার পুরো নিয়ন্ত্রণ নিক।

কিন্তু ক্লোনদের মধ্যে বিদ্রোহী শক্তিও ক্রমশ বাড়ছিল। একদিন পদ্মার ধারের জঙ্গল থেকে খবর এলো—একদল ক্লোন রাতের অন্ধকারে গ্রামের মানুষদের ডাকছে, বলছে—“তোমরা আমাদের শত্রু নও, আমরা তোমাদেরই আরেক রূপ। আমাদের সাথে থেকো।” কিন্তু যারা গিয়ে শুনতে চেয়েছিল, তারা আর ফিরে আসেনি। কেউ বলে, ক্লোনরা তাদের নিজেদের দলে টেনে নিয়েছে।

অরুণের ভেতর দ্বন্দ্ব বাড়ছিল। তার ক্লোন প্রায়ই তার সামনে এসে দাঁড়াত। মুখে একই রূপ, চোখে একই কষ্ট, কিন্তু কণ্ঠে অন্য সুর। একদিন অরুণ চিৎকার করে উঠল—
—“তুই নকল! তুই আমার জায়গা নিতে চাইছিস।”
ক্লোন শান্ত স্বরে বলল—“আমি নকল নই। আমি তোরই এক অংশ। তুই হারাতে চাইছিস আমাকে, অথচ আমি তোর বুকের ভেতর থেকে জন্মেছি। যদি আমি মরে যাই, তোরও একটা অংশ মরে যাবে।”

এই কথায় অরুণ কেঁপে উঠল। সত্যিই তো, ক্লোন আসলে তার নিজেরই হারানো টুকরো। কিন্তু সেই টুকরো যদি নিজের অস্তিত্ব দাবি করে, তবে আসল-নকলের এই খেলায় শেষ পর্যন্ত কোনটা বেঁচে থাকবে?

গ্রামে এক ভয়ংকর রাত নেমে এল। হঠাৎ দেখা গেল মসজিদের মিনারে দাঁড়িয়ে আছে একই ইমামের দুটো রূপ। দুজনেই আজান দিতে শুরু করল। একই কণ্ঠ, একই ছন্দ, অথচ প্রতিধ্বনির মতো নয়—আলাদা আলাদা স্বর। লোকজন জড়ো হয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল। রাতটা কাটল বিশৃঙ্খলার মধ্যে।

অরুণ জানল—এখন সিদ্ধান্ত নেবার সময় এসেছে। সে চুপ করে থাকলে একদিন গ্রাম ডুবে যাবে বিশৃঙ্খলায়। কিন্তু সে যদি নিজের ক্লোনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সত্যিটা মেনে নেয়, তবে হয়তো একটা পথ বেরোতে পারে।

পদ্মার স্রোত তখন প্রচণ্ড বেগে বয়ে চলেছে। ঢেউয়ের গর্জনে যেন শোনা যাচ্ছে এক ভয়ংকর প্রশ্ন—“আসল কে? নকল কে? নাকি দুজনেই সমান সত্যি?”

পর্ব ৬: অরুণ ও তার ছায়া

অরুণ এখন আর নিজের ছায়াকেও বিশ্বাস করতে পারে না। সকালের রোদে হাঁটতে হাঁটতে সে যখন নিজের ছায়ার দিকে তাকায়, তখনও মনে হয়—ওটা হয়তো অন্য কেউ, যে হঠাৎ ছিঁড়ে বেরিয়ে এসে তার জায়গা নিয়ে নেবে। ক্লোনের আবির্ভাব তাকে কেবল আতঙ্কে ফেলেনি, তার আত্মপরিচয়কেও ভেঙে দিয়েছে।

গ্রামের চারদিকে বিশৃঙ্খলা বাড়ছে। কোথাও ভাই নিজের ভাইকে সন্দেহ করছে, কোথাও বউ স্বামীকে চিনতে পারছে না। এমআরসি-র বিজ্ঞানীরা এই বিশৃঙ্খলার খবর গোপন রাখতে ব্যস্ত, কিন্তু গুজব আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। পদ্মার স্রোতও যেন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে, প্রতিদিন রাতে জলধ্বনি আরও তীব্র শোনায়।

এই অবস্থায় এক সন্ধ্যায় অরুণ আবার মুখোমুখি হল তার ক্লোনের। নদীর ধারে বসেছিল সে, হঠাৎ অনুভব করল কেউ পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তাকাতেই দেখল—তারই মতো মুখ, কিন্তু চোখ দুটো আলাদা। সেই চোখে অদ্ভুত শান্তি আর অদৃশ্য কষ্ট।

অরুণ তীব্র গলায় বলল—
—“তুই কেন আমার পিছনে পিছনে ঘুরছিস? তুই নকল, তুই শুধু একটা স্মৃতি থেকে জন্মানো ছায়া। তুই আমার জায়গা নিতে পারবি না।”

ক্লোন শান্তভাবে বসে পড়ল। তার কণ্ঠে কোনো রাগ নেই।
—“আমি জায়গা নিতে চাই না, অরুণ। আমি তোকে মনে করাতে চাই, তুই কে ছিলি। সাগরের ডুবে যাওয়ার দিনটা কি তুই সত্যিই ভুলে গেছিস? আমি সেই দিনের ব্যথা থেকে জন্মেছি। তুই যদি আমাকে মেনে না নাস, তবে তুই নিজেরই ব্যথাকে অস্বীকার করছিস।”

অরুণের বুক ধক করে উঠল। সাগরের নাম তার ভেতরে শূন্যের মতো বাজল। সত্যিই তো—সে সেই স্মৃতি বিক্রি করে দিয়েছিল, ভেবেছিল মুক্তি পাবে। কিন্তু সেই স্মৃতিই এখন মানুষের রূপে তার সামনে বসে আছে।

—“তুই কি তবে কেবল কষ্ট?” অরুণ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল।
ক্লোন মৃদু হেসে বলল—“না, আমি তোরই বিস্মৃত টুকরো। তুই নিজের ভেতর থেকে আমাকে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিস, আর আমি শরীর নিয়ে ফিরে এসেছি। তাই আমি নকল নই, আমি তো তুই-ই।”

অরুণ মাথা নিচু করল। তার মনে হল যেন দুই অরুণ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে—একজন যাকে সমাজ আসল বলে মেনে নিয়েছে, আরেকজন যে ভুলে যাওয়া যন্ত্রণার ভেতর থেকে জন্ম নিয়ে প্রমাণ করতে চাইছে তারও অস্তিত্ব আছে।

এই সময় গ্রামের ভেতর আরও ঘটনা ঘটতে লাগল। কালীপদ মিস্ত্রির ক্লোন এসে আসল কালীপদের ঘরে ঢুকে বসে পড়ল। স্ত্রী তাকে চিনতে পারল না, কারণ দুজনই এক। শেষে বাচ্চা ছেলেটা মায়ের আঁচল ধরে বলল—“মা, আমি দুটো বাবাকেই চাই।” এই নির্দোষ কণ্ঠ মানুষকে আরও বিভ্রান্ত করে দিল।

অরুণ এক রাতে তার ক্লোনকে নিয়ে লম্বা কথোপকথনে বসল। নদীর ধারে নৌকার উপর বসে দুজনে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলল। ক্লোন বলল—“তুই ভয় পাচ্ছিস আমি তোর জায়গা নেব। কিন্তু ভেবে দেখ, যদি আমরা মিলে যাই, তবে আমরা আরও সম্পূর্ণ হব। আমি তোর হারানো দিক, তুই আমার বর্তমান দিক। আমরা এক হলে হয়তো অন্য ক্লোনদেরও পথ দেখাতে পারব।”

অরুণ স্তব্ধ হয়ে গেল। এই কথায় এক আশ্চর্য সত্য লুকিয়ে আছে। সে বুঝল—ক্লোনকে মুছে দিলে সে নিজেরই একটা অংশ হারাবে। কিন্তু মেনে নিলে? তবে তো আসল-নকলের সীমানা মুছে যাবে।

রাতে অরুণ ঘরে ফিরল, কিন্তু ঘুমোতে পারল না। তার মনে হচ্ছিল—যদি সত্যিই সে আর তার ক্লোন মিলে যায়, তবে কেমন হবে? মানুষ কি মেনে নেবে এমন এক অস্তিত্ব, যা একইসঙ্গে আসল আর নকল? নাকি সমাজ তাকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলবে?

পদ্মার ঢেউ সেদিন আরও তীব্র শব্দ তুলছিল। মনে হচ্ছিল নদী নিজেই বলছে—“তোর ছায়া থেকে তুই পালাতে পারবি না।”

পর্ব ৭: ল্যাবরেটরির ষড়যন্ত্র

পদ্মার বুকের উপর দাঁড়িয়ে থাকা ধাতব ল্যাবরেটরি যেন দিনকে দিন আরও অচেনা হয়ে উঠছিল। বাইরের থেকে দেখলে ওটা কেবল আলো জ্বলা এক বিশাল যন্ত্র, কিন্তু ভেতরে ঢুকলেই বোঝা যায়—মানুষের ভবিষ্যৎ এখানে বন্দি। এমআরসি-র ভেতরে কাচের খাঁচার সারি, প্রতিটিতে আলাদা আলাদা মুখ, কিন্তু সেই মুখগুলো আবার একরকম—কারও হারানো স্মৃতি থেকে জন্ম নেওয়া ক্লোন। তারা চুপচাপ বসে থাকে, কারও চোখে নিঃশব্দ প্রশ্ন, কারও ঠোঁটে থমকে থাকা চিৎকার।

বিজ্ঞানীদের ভেতরকার আলোচনা এখন আর শুধু গবেষণার সীমায় নেই। একদিন মিটিং-রুমে বসে প্রধান বিজ্ঞানী ড. কামরুল বলল—
—“এভাবে আলাদা আলাদা স্মৃতি থেকে ক্লোন বানিয়ে লাভ নেই। আমাদের দরকার সমষ্টিগত শক্তি। যদি একশো মানুষের স্মৃতি একত্র করে এক শরীরে ভরা যায়, তবে এমন এক সত্তা জন্ম নেবে, যে হবে সুপার-ক্লোন। তার মস্তিষ্কে থাকবে শত শত অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, বেদনা—যা একক মানুষ বহন করতে পারে না।”

কিছু বিজ্ঞানী শিউরে উঠল। ড. মেহরুন বলল—“এটা কি সম্ভব? এত স্মৃতি একসঙ্গে গেলে মস্তিষ্ক ভেঙে পড়বে।”
কামরুল ঠান্ডা গলায় বলল—“ভেঙে পড়লে পড়ুক। দশটা ত্রুটি হলে একটা সফলতা আসবে। সেই সফলতাই বদলে দেবে ইতিহাস।”

আলোচনার পেছনে ছিল সরকারের চাপ। মন্ত্রীদের গোপন নির্দেশ—“আমাদের দরকার এমন সত্তা, যে সৈন্যদের জায়গা নেবে, যে ভোটের মাঠে আমাদের হয়ে দাঁড়াবে, যে শ্রমিকদের চেয়ে দ্রুত কাজ করবে।” এই নির্দেশে এমআরসি-র বিজ্ঞানীরা বুঝে গেল—তাদের গবেষণা আর বিজ্ঞান নয়, এটা রাজনীতির অস্ত্র।

এদিকে অরুণের কাছে খবর পৌঁছাল রফিকের মাধ্যমে। সে গোপনে ল্যাব থেকে বেরিয়ে এসে বলল—
—“অরুণ ভাই, ভেতরে বড় খেলা হচ্ছে। শুধু আলাদা আলাদা ক্লোন নয়, ওরা তৈরি করছে ‘সুপার ক্লোন’। হাজার মানুষের স্মৃতি মিশিয়ে এক দানব বানানো হবে। যদি ওটা জন্ম নেয়, তবে আমরা কেউই নিরাপদ থাকব না।”

অরুণ স্তম্ভিত হয়ে গেল। তার নিজের ক্লোনের মুখ মনে পড়ল—যে শান্ত স্বরে বলেছিল, “আমি তোর হারানো অংশ।” কিন্তু সুপার ক্লোন হলে সেটা আর কেবল হারানো অংশ নয়, হবে বহু মানুষের ভাঙা খণ্ড থেকে তৈরি এক অদ্ভুত দেহ।

সেই রাতে অরুণ তার ক্লোনের সঙ্গে দেখা করল। নদীর ধারে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে দুজনের মুখ প্রায় এক হয়ে গেল।
—“তুই জানিস?” অরুণ জিজ্ঞেস করল।
ক্লোন মাথা নেড়ে বলল—“হ্যাঁ। আমি শুনেছি। ওরা আমাদের একসঙ্গে জুড়ে দিতে চায়, যেন আমরা আর আলাদা সত্তা না থাকি। কিন্তু সেটা হবে মৃত্যুর থেকেও ভয়ংকর।”
—“তাহলে কী করব আমরা?”
ক্লোনের চোখে এক ঝলক আগুন দেখা গেল।
—“আমাদের প্রতিরোধ করতে হবে।”

অরুণ স্তব্ধ হয়ে রইল। প্রতিরোধ মানে? গ্রামবাসী তো ভয়ে ভেঙে পড়ছে, কেউ বিশ্বাস করছে না কাকে আসল বলা যায়। অথচ ক্লোনরা ধীরে ধীরে সংগঠিত হচ্ছে। তাদের রাতের সভায় এখন স্লোগান ওঠে—“আমরা মানুষ, আমাদের অধিকার চাই।”

কিন্তু এমআরসি-র ভেতর অন্য ষড়যন্ত্রও চলছে। কয়েকজন বিজ্ঞানী গোপনে বাজারে ভিড়ের মধ্যে ক্লোন ছেড়ে দিচ্ছে। উদ্দেশ্য—দাঙ্গা বাধানো। মানুষ যেন নিজেরাই একে অপরকে আঘাত করে। তাতে এমআরসি দায়মুক্ত থেকে আরও শক্তি পাবে।

একদিন ভোরে গ্রামে হঠাৎ বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ল। হাটের মোড়ে দাঁড়িয়ে দুজন কৃষক একে অপরকে মারতে শুরু করল, কারণ দুজনেই দাবি করছে সে আসল। ভিড় জমল, লোকেরা লাঠি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অল্প সময়ের মধ্যেই হাট রক্তে ভেসে গেল। এমআরসি-র ড্রোন আকাশে ভেসে সব রেকর্ড করল। পরে রিপোর্টে লেখা হল—“সামাজিক অস্থিরতা বেড়েছে, আমাদের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।”

অরুণ এসব দেখে ভিতরে ভিতরে বুঝতে পারল—গ্রামবাসী, ক্লোন আর বিজ্ঞানীদের এই খেলা এক ভয়াবহ দিকে যাচ্ছে। যদি সুপার ক্লোন জন্ম নেয়, তবে সবকিছু ভেসে যাবে।

রাতে সে আবার নদীর ধারে দাঁড়িয়ে শুনল অচেনা ফিসফিসানি। মনে হল পদ্মা নিজেই কথা বলছে—“তাদের ষড়যন্ত্র থামাও, নয়তো আমি নিজেই সব গিলে নেব।”

অরুণ বুঝল, খেলা আর কেবল মানুষের হাতে নেই। নদীও জেগে উঠছে।

পর্ব ৮: নদীর ফিসফিসানি

পদ্মার ধারে রাতের অন্ধকারে যেন নতুন শব্দ জন্ম নিচ্ছিল। আগে নদীর ঢেউ শুধু আছড়ে পড়ত, বাতাসে শুধু কুয়াশার গন্ধ ভেসে বেড়াত। কিন্তু এখন ঢেউয়ের গর্জনের মধ্যে স্পষ্ট শোনা যায় এক অদ্ভুত ফিসফিসানি। গ্রামবাসীরা বলে—“নদী কথা বলছে।” কেউ কেউ ভয় পেয়ে ভাবে এটা হয়তো মৃত ক্লোনদের আত্মা, যাদের নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অরুণ যখন শোনে, তখন তার মনে হয়—এ শব্দ যেন তাকে ডাকছে, যেন নদী নিজেই সতর্ক করছে।

এক রাতে অরুণ ঘুম ভেঙে উঠল। বাইরে এসে দাঁড়াতেই স্পষ্ট শোনা গেল সেই ফিসফিসানি। যেন হাজার মানুষের একসঙ্গে নিঃশ্বাস। সে কেঁপে উঠল, তারপর ধীরে ধীরে নদীর দিকে হাঁটল। চাঁদের আলোয় জলের উপর ঝিলমিল করছে অদ্ভুত সব প্রতিচ্ছবি। মনে হচ্ছিল—অসংখ্য মুখ ভেসে আছে, কেউ হাত নেড়ে কিছু বলতে চাইছে।

ঠিক তখনই তার পাশে এসে দাঁড়াল তার ক্লোন। চোখে একই রকম ভয়, কিন্তু গলায় দৃঢ়তা।
—“শুনতে পাচ্ছিস?” ক্লোন জিজ্ঞেস করল।
অরুণ মাথা নেড়ে বলল—“হ্যাঁ। মনে হচ্ছে নদী রাগ করেছে।”
ক্লোন ধীরে ধীরে উত্তর দিল—“ও শুধু রাগ করেনি, ও সাবধান করছে। নদীর বুক থেকে আমাদের জন্ম, নদীর বুকেই আমাদের মৃত্যু। এখন নদী নিজেই বলছে—খেলাটা আর চলবে না।”

সেই রাতে অরুণ প্রথমবার দেখল নদীর জল ঘূর্ণি তুলে উঠছে। ছোট ছোট ঘূর্ণির মধ্যে নীল আলো ঝিলমিল করছে। এমআরসি-র বিজ্ঞানীরা বলত এগুলো কেবল রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া, কিন্তু অরুণের মনে হল নদী যেন শ্বাস নিচ্ছে, বাঁচতে চাইছে।

পরদিন গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ল—রাতে কয়েকজন নাকি নদীর ধারে গিয়ে ফিরে আসেনি। সকালের আলোয় দেখা গেল, বাঁধের ধারে বালি ভিজে আছে, তার উপর অদ্ভুত সব ছাপ, যেন অচেনা হাত টেনে নিয়ে গেছে। বয়স্করা বলতে লাগল—“নদী নিজের লোক বেছে নিচ্ছে।”

অরুণ এই সময় বুঝল—গ্রামের ভেতরে যে ভয় ছড়িয়ে পড়ছে, সেটা কেবল ক্লোনদের জন্য নয়, নদীর জন্যও। সে যেন নিজে প্রতিশোধ নিচ্ছে।

এদিকে এমআরসি-র ভেতরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। সুপার ক্লোন তৈরির জন্য যে বিশাল চেম্বার বানানো হয়েছিল, তার চারপাশে যন্ত্রগুলো অকারণে ব্যর্থ হতে শুরু করল। তারগুলো পুড়ে যাচ্ছে, কাচ ফেটে যাচ্ছে। ড. কামরুল রাগে গর্জে উঠল—“এই প্রকল্প থামানো যাবে না। আমরা যদি ব্যর্থ হই, তবে সরকার আমাদের গিলে খাবে।”
কিন্তু মেহরুন চুপচাপ বলল—“নদী বাধা দিচ্ছে। তুমি কি শুনতে পাচ্ছ না?”
কামরুল হাসল, কিন্তু সেই হাসিতে কাঁপুনি ছিল।

রাতে অরুণ ও তার ক্লোন আবার একসঙ্গে বসেছিল নদীর ধারে। দুজনেই নিঃশব্দে শুনছিল ফিসফিসানি। মনে হচ্ছিল নদী বলছে—“তোমাদের দুজনকে আমি আলাদা করিনি। তোমরা আলাদা হতে চাইছ, তাই এই বিভেদ। যদি তোমরা এক হতে শেখ, তবে হয়তো আমি শান্ত হব।”

অরুণ তাকাল তার ক্লোনের দিকে।
—“তুই শুনেছিস?”
—“হ্যাঁ,” ক্লোন বলল। “কিন্তু মানুষ কি আমাদের এক হতে দেবে? ওরা চায় আসল আর নকলের লড়াই, যাতে ওরা লাভ পায়।”
অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
—“তাহলে নদী আমাদের বাঁচাবে কীভাবে?”
ক্লোনের চোখে নীল প্রতিফলন ঝিলমিল করছিল। সে ফিসফিস করে বলল—“হয়তো নদী ঠিক করেছে, যাকে দরকার নেই তাকে গিলে নেবে। মানুষ হোক বা ক্লোন।”

সেই রাতে গ্রামে ভয়ংকর ঝড় উঠল। পদ্মার স্রোত এত প্রবল হল যে বাঁধ কেঁপে উঠল। আকাশে বজ্রপাতের আলোয় দেখা গেল নদীর বুকের উপর অদ্ভুত নীল আগুন জ্বলছে। লোকজন চিৎকার করে বলল—“নদী জেগে উঠেছে!” অনেকে ভয়ে পালাল, অনেকে হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা করতে লাগল।

অরুণ বুঝল—এখন আর মানুষের হাতে খেলা নেই। নদী নিজেই বিচার করবে।

পর্ব ৯: আগুনের রাত

সেই রাতটা গ্রামবাসীরা চিরদিন মনে রাখবে। পদ্মার উপর কালো মেঘ জমে এসেছিল সন্ধ্যা থেকেই, কিন্তু মাঝরাত নামতেই যেন আকাশ আর নদী একসঙ্গে ফেটে পড়ল। বজ্রপাতের শব্দে ঘরবাড়ি কেঁপে উঠছিল, বাতাসে উড়ে যাচ্ছিল খড়ের ছাউনি। এই ভয়ংকর আবহের ভেতরেই শুরু হল মানুষ আর ক্লোনদের সংঘর্ষ।

বাজারপাড়ায় প্রথম আগুন লাগল। কেউ বলল, ক্লোনরা এসে দোকানে লাঠি মেরেছে, কেউ আবার বলল আসল মানুষরাই সন্দেহ করে মশাল জ্বালিয়েছে। কিন্তু কে শুরু করল তা আর জানা গেল না। মুহূর্তের মধ্যে কয়েকটা দোকান দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। আগুনের লেলিহান শিখা আকাশের দিকে উঠতে উঠতে গ্রামজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিল।

চিৎকার ভেসে এল চারদিক থেকে—“আমাদের ঘর বাঁচাও!”, “ওরা নকল!”, “ওরা আসল!”—আসল আর নকলের সীমানা মুছে গিয়ে মানুষে মানুষে ছুরি, দা, লাঠি ঝাপসা হয়ে উঠল। কেউ আর বোঝাতে পারল না কাকে রক্ষা করতে হবে, কাকে শত্রু ভাবতে হবে।

অরুণ নিজের চোখে দেখল—দুজন একই চেহারার মানুষ একে অপরকে পিঠমোড়া করে বেঁধে রেখেছে, দুজনেই চেঁচাচ্ছে—“আমি-ই আসল!”। ভিড় থেকে লাঠি উঠে এল, তারপর রক্ত ঝরে পড়ল মাটিতে। সে বুঝতে পারল—এ রাত শুধু আগুনের নয়, এ রাত অন্ধকারের।

এই বিশৃঙ্খলার মাঝেই এমআরসি-র লোহার গেট খুলে গেল। সশস্ত্র প্রহরীরা বেরিয়ে এল বন্দুক হাতে। তাদের চোখে কোনও দয়া নেই। তারা নির্দেশ পেয়েছে—“যে প্রতিরোধ করবে তাকেই শেষ করো।” লাল আলো ঝলসে উঠল আকাশে, গুলির শব্দ মিশে গেল বজ্রপাতের গর্জনের সঙ্গে।

কিন্তু আশ্চর্য হল, ক্লোনরাও পালাল না। তারা জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে গেল নদীর ধারে। তাদের নেতা—অরুণের ক্লোন—চিৎকার করে উঠল—“আমরা পণ্য নই, আমরা মানুষ! আমাদের হত্যা করলে নদী তোমাদেরও গ্রাস করবে।”

তার কণ্ঠ বজ্রপাতের মতো গমগম করে উঠল। আগুনের আলোয় তার মুখে এক অদ্ভুত দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ল। মুহূর্তের জন্য আসল অরুণও বিভ্রান্ত হয়ে গেল—ও কি সত্যিই তার নকল, নাকি আরও বড় কিছু?

ঝড়ের ভেতর নদীও যেন বিদ্রোহে ফেটে পড়ল। জল হঠাৎ ফুলে উঠতে লাগল, ঢেউ বাঁধের উপর আছড়ে পড়ল। ভেসে উঠল মৃত মাছ, ভেসে উঠল অদ্ভুত সব কণ্ঠস্বর—যেন নদীর বুক থেকে আসছে হাজার মানুষের কান্না।

গ্রামবাসীরা ভয়ে দৌড়াতে লাগল, কেউ প্রার্থনা করল, কেউ লড়াই চালিয়ে গেল। এমআরসি-র প্রহরীরা গুলি চালালেও বাতাসে বারবার দিক বদলে যাচ্ছিল, যেন অদৃশ্য শক্তি তা ঠেকাচ্ছে।

অরুণ হঠাৎ নিজের ক্লোনের চোখে তাকাল। সেখানে ভয় নেই, বরং এক অচেনা দৃঢ়তা। ক্লোন তার হাত ধরল, আর ফিসফিস করে বলল—“আজ সিদ্ধান্ত হবে। নদী চাইছে আমরা বেছে নিই—একসঙ্গে বাঁচব, না একে অপরকে মেরে ফেলব।”

অরুণ কেঁপে উঠল। আগুনে জ্বলছে বাজার, গুলির শব্দ আকাশ কাঁপাচ্ছে, নদী গর্জে উঠছে—আর তার ভেতর দ্বন্দ্ব ছিঁড়ে ফেলছে বুক।

তখনই বজ্রপাতের আলোয় আকাশ ফেটে পড়ল। পদ্মার বুক থেকে উঠে এল এক বিশাল ঘূর্ণি। নীল আগুনের মতো আলো ফেটে বেরোল তার ভেতর থেকে। গ্রামবাসীরা চিৎকার করে বলল—“নদীর দেবী জেগে উঠেছে!”

অরুণ বুঝল—এ শুধু মানুষের বিদ্রোহ নয়, নদীরও। আগুনের রাত শেষ হবে না সহজে, শেষ হবে কেবল রক্ত আর জলে ভেসে।

পর্ব ১০: শেষ সত্য

পদ্মার সেই রাত যেন পৃথিবীর শেষ রাত। আগুনের লেলিহান শিখা আকাশকে গিলে নিচ্ছিল, বজ্রপাতের শব্দ কানে তালা লাগাচ্ছিল, আর নদীর বুক থেকে উঠে আসছিল এক অদ্ভুত আলোর ঝড়। মানুষ দৌড়াচ্ছিল, চিৎকার করছিল, কেউ কারও কথা শুনছিল না। কিন্তু এই বিশৃঙ্খলার মাঝেই দাঁড়িয়ে ছিল অরুণ আর তার ক্লোন—দুজন মুখোমুখি, যেন পৃথিবীর সব দ্বন্দ্ব তাদের বুকেই এসে জমেছে।

অরুণ গলা কাঁপিয়ে বলল—
—“তুই আমার জায়গা নিতে চাইছিস। তুই নেই হলে সব শান্ত হয়ে যাবে।”
ক্লোন শান্ত কণ্ঠে উত্তর দিল—
—“না, আমি জায়গা নিতে চাই না। আমি তোর ভেতরের হারানো অংশ, যাকে তুই মুছে ফেলেছিস। আমি বেঁচে থাকলে তুই সম্পূর্ণ থাকবি। আমি মরে গেলে তুইও অর্ধেক হয়ে যাবি।”

অরুণের বুকের ভেতর দ্বন্দ্ব জ্বলছিল। বাইরে আগুন, ভেতরে আগুন। তখনই নদী যেন নিজেই তাদের দিকে এগিয়ে এল। ঢেউ ফেটে পড়ল, জল উঠে এল হাঁটু অবধি। আর সেই জলের ভেতর থেকে ভেসে উঠল অসংখ্য মুখ—কেউ ক্লোন, কেউ আসল, কারও চোখে কান্না, কারও ঠোঁটে ব্যথা। মনে হল নদী নিজেই বলছে—“তোমরা আলাদা নও। তোমরা একই। আমার বুক থেকেই তোমাদের জন্ম।”

হঠাৎ এক বজ্রপাতের আলোয় এমআরসি-র বিশাল ল্যাব কেঁপে উঠল। ভেতরের চেম্বার ভেঙে গিয়ে বেরিয়ে এল অর্ধসমাপ্ত “সুপার ক্লোন।” তার শরীর জ্বলজ্বল করছে নীল আলোর ভিতর, চোখে অসংখ্য কণ্ঠের প্রতিধ্বনি। সে যেন একসঙ্গে শত শত মানুষের স্বর নিয়ে চিৎকার করে উঠল—
—“আমি তোমাদের ভবিষ্যৎ।”

গ্রামবাসীরা আতঙ্কে পিছিয়ে গেল। প্রহরীরা গুলি চালাল, কিন্তু গুলি গিয়ে অদৃশ্য শক্তিতে মিলিয়ে গেল। নদী গর্জন করল, ঢেউ উঠে গেল আরও উঁচু। মনে হল পদ্মা আর এই দানবকে সহ্য করবে না।

অরুণ আর তার ক্লোন একে অপরের দিকে তাকাল। অরুণ ফিসফিস করে বলল—
—“আমরা যদি এক না হই, তবে এই দানব সবকিছু গিলে ফেলবে।”
ক্লোন হাত বাড়িয়ে দিল।
অরুণ মুহূর্তের জন্য দ্বিধা করল, তারপর তার হাত ধরল।

সেই মুহূর্তে বজ্রপাতের আলো ঝলসে উঠল। মনে হল দুজন দেহ একাকার হয়ে গেল। অরুণ অনুভব করল বুকের ভেতর যে শূন্যতা এতদিন ছিল, তা পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। সাগরের মৃত্যু, শৈশবের ব্যথা, সব আবার ফিরে এল। আর তার ক্লোন অনুভব করল—সে আর আলাদা নয়, সে সম্পূর্ণ।

দুজন একসঙ্গে দাঁড়িয়ে সুপার ক্লোনের দিকে তাকাল। অদ্ভুত এক শক্তি তাদের শরীর থেকে বেরিয়ে এল, যেন নদীর ঢেউ তাদের হয়ে কথা বলছে। সুপার ক্লোন গর্জে উঠল, কিন্তু সেই শক্তির সামনে টিকল না। নীল আলো হঠাৎ ভেঙে পড়ল, নদী এক ঝলক ঘূর্ণি তুলে তাকে গ্রাস করে নিল।

আকাশে তখনও আগুন জ্বলছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে ঝড় থেমে এল। বজ্রপাত নিভে গেল, আগুনের শিখা নিস্তেজ হল। ভোরের আলো ফুটতেই পদ্মা শান্ত হয়ে গেল, যেন কিছুই ঘটেনি।

গ্রামবাসীরা আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে ছিল, কিন্তু তারা দেখল—অরুণ এখনও দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে আর বিভ্রান্তি নেই। সে বুঝল, সে আর আলাদা নয়, সে আর অসম্পূর্ণ নয়।

অরুণ ফিসফিস করে বলল—
—“আসল আর নকল নেই। আমরা সবাই একই নদীর সন্তান।”

কিন্তু এই সত্য কি মানুষ মেনে নেবে? কেউ কেউ বিশ্বাস করবে, কেউ কেউ অস্বীকার করবে। তবে অরুণ জানে, নদী ইতিমধ্যেই নিজের রায় দিয়ে দিয়েছে।

পদ্মার স্রোত শান্তভাবে বয়ে চলল, যেন ফিসফিস করে বলছে—“শেষ সত্য একটাই—জন্ম যেখানেই হোক, জীবন সবাইকে সমান করে দেয়।”

সমাপ্ত

WhatsApp-Image-2025-08-26-at-6.37.35-AM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *