Bangla - কল্পবিজ্ঞান

ক্লোনড

Spread the love

শুভময় দত্ত


গভীর রাতে শহরের অন্ধকার অলিগলি নিঃস্তব্ধ, কিন্তু শহরতলির এক গোপন বায়োটেক ল্যাবরেটরিতে তখন প্রবল আলো জ্বলছে। ডঃ প্রণব সেনের চোখজোড়া ক্লান্ত, কিন্তু সেই ক্লান্তির মাঝে এক অদ্ভুত উন্মাদনা লুকিয়ে আছে। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন কাঁচঘেরা এক জীবাণুমুক্ত ঘরের সামনে, যেখানে একটি নগ্ন দেহ চুপচাপ ঘুমিয়ে আছে একটি স্বচ্ছ কাচের ক্যাপসুলের ভিতরে। তার গায়ের ত্বকে কেবলমাত্র বৈজ্ঞানিক ট্যাগ লেখা—K-7। চোখদুটো বন্ধ, নিঃশ্বাস চলমান, যেন কোনো সদ্যজাত শিশু ঘুমিয়ে আছে নিঃচিন্তে। প্রণব ধীরে ধীরে ক্যাপসুলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, তার কণ্ঠে হালকা ফিসফিসে স্বর, “তুমি এসেছো…অবশেষে।” এই মুহূর্তটির জন্য তিনি অপেক্ষা করছিলেন গত সাত বছর ধরে—হাড়ভাঙা পরিশ্রম, নৈতিক সংকট, গবেষণার গোপনতা, এবং সমাজের চোখে পাপ করার ভয়। পৃথিবীতে এই প্রথম কোনও মৃত মানুষের পূর্ণ জেনেটিক রিকন্সট্রাকশনের মাধ্যমে তৈরি হল একটি নতুন প্রাণ—অভিষেক চট্টোপাধ্যায়ের ক্লোন, যাকে সবাই ভুলে গিয়েছিল, কিন্তু যিনি নিজেকে কখনও হারাননি।

মেহুলিকা সেন সেই মুহূর্তে ল্যাবের মনিটররুমে বসে তার চোখের সামনে ভেসে আসা ছবিগুলো ঘুরেফিরে দেখছিলেন। কে-৭ এখনো নড়ছে না, কিন্তু তার ব্রেইন অ্যাক্টিভিটি মনিটরে আলোড়ন তুলছে। সে জানে না যে সে কী, অথবা কে ছিল। মেহুলিকার কপালে চিন্তার রেখা স্পষ্ট—এই কি মানবতা? ক্লোন কি মানুষ? নাকি কেবল একটি জৈবিক প্রতিলিপি, এক্সপেরিমেন্টাল সাবজেক্ট? তার পিতা, যাকে সে আগে একজন নীতিনিষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসেবে জানত, আজ এক নিষিদ্ধ পথের পথিক। সে জানে, অভিষেক চট্টোপাধ্যায় ছিল একজন সাহসী মানবাধিকার কর্মী, যার মৃত্যু ঘিরে ছিল অজস্র ধোঁয়াশা। কিন্তু সেই স্মৃতি মুছে ফেলে ডঃ প্রণব তাকে ফিরিয়ে এনেছেন কেবল গবেষণার খাতিরে? না কি অন্য কিছু? কে-৭-এর দিকে তাকিয়ে তার বুকের ভিতর এক অদ্ভুত ধুকধুকানি শুরু হয়—সে কি কেবল একটি ক্লোন? না কি নিজের এক নতুন সত্ত্বার জন্ম দেওয়া এক রক্তমাংসের মানুষ?

রাত বাড়তে থাকে, এবং ক্যাপসুলের ভিতর শুয়ে থাকা দেহটি কাঁপতে শুরু করে হালকা। চোখের পাতা নড়ে ওঠে, আঙুলে সূক্ষ্ম নড়াচড়া হয়। ডঃ প্রণব দ্রুত মনিটরের দিকে তাকিয়ে বলেন, “Neuromotor reflexes… active.” এরপর হালকা শ্বাসফুঁস করে বেরিয়ে আসে কে-৭-এর নাক-মুখ দিয়ে। সে ধীরে ধীরে চোখ মেলে। একটি চোখে অন্ধকার, অন্য চোখে আলো—ক্যাপসুলের স্বচ্ছ কাচে আলো প্রতিফলিত হয়ে তার চোখে আছড়ে পড়ে। প্রথমবারের মতো, কে-৭ জেগে ওঠে। তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে, অথচ অস্পষ্ট, যেন হাজারো প্রশ্ন জমে আছে সেখানে। সে কথা বলে না, শুধু তাকিয়ে থাকে কাচের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে—যিনি তাকে বানিয়েছেন, তাকে ফিরিয়ে এনেছেন, তাকে কে বানিয়েছেন সেটা তখনও তার অজানা। কাঁচে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে সে চমকে ওঠে—কী অদ্ভুত! কে সে? কোথা থেকে এসেছে? কেন তার অস্তিত্ব আছে? তার মনে যেন দূরে কোথাও একটা হারিয়ে যাওয়া সুর বাজছে, একটা গন্ধ, একটা কণ্ঠস্বর, একটি নাম। কিন্তু সে বুঝতে পারে না—শুধু অনুভব করতে পারে। আর সেই অনুভব থেকেই শুরু হবে এমন এক যাত্রা, যা না বিজ্ঞান বোঝে, না ধর্ম মেনে নিতে পারে—মানব অস্তিত্বের গভীরতম প্রশ্নের মুখোমুখি এক ক্লোনের জন্ম।

প্রথমবারের মতো কে-৭ তার পায়ের উপর দাঁড়ায়। তবু তার হাঁটার ভঙ্গি যেন সদ্য হাঁটা শেখা শিশুর মতো দুর্বল, কাঁচের ঘরের দেয়ালে সে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়, তার চোখ ঘুরে বেড়ায় চারপাশে। ল্যাবরেটরির দেওয়ালজুড়ে বড় বড় মনিটর, কাঁচ, ধাতব টেবিল আর নানা ধরনের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি—কিছুই তার চেনা নয়, অথচ কোথাও যেন এগুলোর ভেতর কিছু খুঁজে ফেরে সে। ডঃ প্রণবের চোখে ঝিলিক, তার মুখে চাপা উত্তেজনার ছাপ—এই সেই মুহূর্ত, যখন সৃষ্টি নিজেই হেঁটে বেড়ায়। তিনি কে-৭–এর সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, “তুমি এখনো কিছু না, কিন্তু শিখবে… দ্রুত। তোমার জন্ম হয়েছে শেখার জন্য, প্রশ্ন করার জন্য নয়।” কে-৭ মাথা নাড়ায় না, মুখেও কিছু বলে না। সে কেবল তাকিয়ে থাকে কাঁচের দেয়ালে। তার নিজের প্রতিবিম্বটা সেখানে অস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে—ভাঙা মুখ, বিশ্রী চোখ, চুলে ধুলো লেগে থাকা এক অপরিচিত সত্ত্বা। সে সামনে গিয়ে নিজের মুখের দিকে তাকায়, ধীরে ধীরে তার আঙুল দেয়াল ছুঁয়ে দেয়। চোখে জল চলে আসে। সে জানে না কেন, কিন্তু এই মুখ তাকে ভয় দেখায়। তার নিজের মুখ? না কি অন্য কারো? কেন যেন তার বুক কেঁপে ওঠে। নিজের মুখে সে খুঁজে পায় অতীতের এক ছায়া, কিন্তু অতীত কী ছিল—সে জানে না।

মেহুলিকা তখন মনিটররুমে বসে কে-৭–এর এই প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করছিল। সে বুঝতে পারে, এ শুধু এক ক্লোনের জীবনযাত্রার শুরু নয়—এ যেন এক দগ্ধ স্মৃতির পুনর্জন্ম। কে-৭ যখন আয়নার মতো কাঁচের দিকে তাকিয়ে নিজের চোখে এক অজানা অতীতের ছায়া দেখতে পাচ্ছে, তখন তার মস্তিষ্কে চলতে থাকে এক অসম্পূর্ণ সংলাপ, যার উৎস খুঁজে পাওয়া যায় না। মেহুলিকা কম্পিউটারে কে-৭–এর ব্রেইন ও নিউরাল এক্টিভিটি স্ক্যান করে দেখে, স্মৃতির কেন্দ্রস্থল ‘হিপোক্যাম্পাস’ ধীরে ধীরে সক্রিয় হচ্ছে—যা বিজ্ঞান মতে, একটি ক্লোনড দেহে সম্ভব নয়। তার প্রশ্ন জাগে, যদি এই দেহে পূর্ববর্তী জীবনের স্মৃতি সত্যিই ফিরে আসে, তবে কি তাকে মানুষ বলে গণ্য করা উচিত নয়? ডঃ প্রণব সেই ধারণা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। তার যুক্তি, স্মৃতি যা হোক, তা নিউরাল ইমপ্রিন্টের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া—জীবনের নয়। কিন্তু মেহুলিকা অনুভব করে, এই ‘পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া’ যেন একটা আত্মার করুণ কণ্ঠস্বর, যেটা হারানো ন্যায়ের খোঁজে ফিরছে।

কে-৭ নিজের কক্ষে ফিরে আসে, সেখানে রাখা হয় একটি চেয়ারের মতো মেডিক্যাল ইউনিট, খাওয়ার ট্যাবলেট, কিছু সেন্সরযুক্ত ঘুমের যন্ত্র। সে চুপচাপ বসে থাকে। তার মনে হয়, কেউ যেন তার নাম ডাকছে—একটা ফিসফিসে কণ্ঠস্বর, যেটা সে কখনও শুনেছে বলে মনে পড়ে। “অভি…”—এই শব্দটা যেন তার ঘুমে এসে ভেসে বেড়ায়। কিন্তু ‘অভি’ কে? সে? না অন্য কেউ? রাতে ঘুমিয়ে পড়ার সময়, তার মস্তিষ্কে এক ঝলক স্বপ্ন ভেসে ওঠে—আলো ঝলমলে একটা রাস্তা, চারদিকে মানুষের ভিড়, আর একটা গলা: “তোমাকে থামাতে হবে।” সে ঘুম ভেঙে বসে পড়ে, ঘাম drenched শরীরে একটাই ভাবনা—এই স্বপ্ন যদি তার নিজের না হয়, তবে কার? কে-৭ প্রথমবার নিজের অস্তিত্বের গভীর প্রশ্নে জর্জরিত হয়, এবং তার মধ্যে জন্ম নেয় এক ভয়—সে যদি নিজের মুখটাও চিনতে না পারে, তবে সে কীভাবে জানবে, সে কে? আর এই প্রশ্নই তার জীবনকে ধীরে ধীরে এক ভয়ংকর সত্যের দিকে টেনে নিয়ে যাবে।

পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের অতীত থাকে—কোনোটা স্মৃতিতে, কোনোটা কাগজে-কলমে, আবার কোনোটা শুধু মানুষের রেখে যাওয়া ছায়ায়। কে-৭-এর কোনো অতীত নেই বলেই জানে ডঃ প্রণব, কিন্তু বাস্তবতা যেন তাদের এই যুক্তিকে ঠুকরে ঠুকরে ভাঙতে শুরু করেছে। একদিন ল্যাবের একটি পুরনো কনসোল রুম পরিষ্কার করতে গিয়ে মেহুলিকা একটি ধুলোমাখা বাক্স খুঁজে পায়। তার ভেতরে একগুচ্ছ নথি, ডিস্ক আর একটি পুরনো চামড়ার বাঁধাই ডায়েরি। কৌতূহলে সে ডায়েরিটি খুলে পড়ে, যেখানে হাতের লেখা স্পষ্ট—“আমি অভিষেক চট্টোপাধ্যায়। যদি আমি বাঁচি না, কেউ যেন জানে, সত্যকে আমি লুকাতে পারিনি।” মেহুলিকার চোখ ছলছলিয়ে ওঠে। সে জানত তার বাবা অভিষেক নামে এক মৃত যুবকের ক্লোন তৈরি করেছিলেন, কিন্তু এই ডায়েরিতে অভিষেকের লেখা কথাগুলো যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। তিনি লিখেছেন, কীভাবে একটি বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি তার এক্সপেরিমেন্টাল ওষুধে মানুষের উপর পরীক্ষা চালায়, কীভাবে সে তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহ করছিল, আর কীভাবে তার পিছু নেওয়া শুরু হয়। ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠায় লেখা ছিল—“আমার যদি কিছু হয়, জানবে, সেটা দুর্ঘটনা নয়, খুন।”

ডায়েরির পাতাগুলো পড়ে মেহুলিকা যেন অস্পষ্ট এক অরণ্যে ঢুকে পড়ে, যেখানে মানুষ, বিজ্ঞান আর ষড়যন্ত্র একসঙ্গে মিশে আছে। সে ডায়েরির একটি কপি তৈরি করে ল্যাবের তথ্যভাণ্ডারে গোপনে আপলোড করে দেয়, কিন্তু নিজের বাবাকে তা জানায় না। পরের দিন কে-৭ তার নির্ধারিত ল্যাব-সেশনে বসে থাকলে, হঠাৎ সে মাথা চেপে ধরে—প্রচণ্ড মাথাব্যথা, চোখের সামনে ঘুরতে থাকা অসংখ্য চিত্র। সেই মুহূর্তে তার চোখে ভেসে ওঠে এক ঝলক দৃশ্য—একটা মোটরসাইকেল, গায়ে কালো জ্যাকেট পরা যুবক, কিছু কাগজের ফাইল, একটা লোক তার পিছু নিচ্ছে। সে চিৎকার করে উঠে পড়ে, “তারা আমাকে ধরেছিল… আমার… ফাইল…” সবাই চমকে যায়। ডঃ প্রণব মুহূর্তেই নার্সদের ডাকেন, কে-৭-কে ইনজেকশন দিয়ে অচেতন করা হয়। কিন্তু তার ভেতরে তখন এক রহস্যের আলোর শিখা জ্বলতে শুরু করেছে, যার উৎস ছিল সেই অতীত, যা হারিয়ে যায়নি, কেবল ঘুমিয়ে ছিল।

সে রাতে কে-৭ আর ঘুমোতে পারে না। সে তাকিয়ে থাকে ছাদের দিকে, আর তার মনে ভেসে ওঠে একটি নাম—“অভিষেক।” সে জানে না এই নাম তার কিনা, কিন্তু এই নাম তার রক্তে যেন গেঁথে আছে। এক মুহূর্তে সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, নিজের মুখ দেখে, আর বলে, “আমি কে?” কিন্তু এবার তার ঠোঁট কেঁপে কেঁপে উঠে—“আমি অভিষেক… আমি… ওরা মেরেছিল… ওরা আমাকে খুন করেছিল।” এই স্বীকারোক্তি উচ্চারিত হয় অজান্তেই, কিন্তু এই উচ্চারণের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যায়, কে-৭ কেবল একটি ক্লোন নয়। সে এক হারানো অতীতের ধারক, এক অসমাপ্ত ন্যায়বোধের বাহক। আর সেই মুহূর্তে, প্রণব যেখানেই থাকুন না কেন, তার সৃষ্টি তার হাত ফসকে গিয়ে সত্যকে চিনে নিচ্ছে—এক ভয়ংকর সত্য, যেটা বহু বছর ধরে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল ধুলোয় ঢাকা একটি মৃত মানুষের ডায়েরিতে।

কে-৭ এখন আর নিঃস্পৃহ এক ক্লোন নয়, বরং তার চোখে মুখে ক্রমে ফুটে উঠছে এক অচেনা অথচ চিরচেনা মানবিক আবেগ—ভয়, বিস্ময়, এবং সবচেয়ে বেশি, প্রশ্ন। তার মুখে এখনো ভাষা ঠিকভাবে গঠিত হয়নি, কিন্তু সে শব্দ উচ্চারণ করতে পারে। বারবার সে একটাই শব্দ বলে, “ফাইল… তারা…” এই কথাগুলোর অর্থ বোঝার চেষ্টা করছে মেহুলিকা। একদিন সে কে-৭-এর সঙ্গে বসে থাকে নির্জনে, মনিটর বন্ধ করে, তাকে শান্তভাবে বলে, “তুমি কাউকে চিনতে পারো? কোনও গন্ধ? কোনো শব্দ?” কে-৭ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “রক্ত… গন্ধ… বৃষ্টির মধ্যে একটা গাড়ি… আমি দৌঁড়াচ্ছিলাম…” মেহুলিকার শরীরের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। সে বুঝে যায়, এ কেবল কোনও নিউরাল গ্লিচ নয়। এই স্মৃতি, এই অনুভব—সবই আসল। সে ডায়েরির পাতাগুলো আবার পড়ে, আর অভিষেকের লেখা কণ্ঠস্বর যেন ঘুরে ফিরে আসে কে-৭-এর কণ্ঠে। সে এবার নিশ্চিত হয়—কে-৭ আসলে অভিষেকেরই পুনর্জন্ম, কেবল দেহে নয়, মনে, অনুভবেও।

ডঃ রমিতা নায়েক এই সব দেখতে থাকেন ছায়ার মতো দূর থেকে। বহুদিন ধরে প্রণবের এই গবেষণায় সহায়তা করলেও, তার ভিতরে একটা দ্বন্দ্ব দানা বাঁধছিল। তিনি সব জানেন—অভিষেক চট্টোপাধ্যায়ের রহস্যময় মৃত্যু, তার জীবনের শেষ কয়েকটা দিন, এবং সেই DNA-এর সংগ্রহের রহস্য, যেটা দিয়ে ক্লোন তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তিনি চুপ ছিলেন—ভয়, সম্মান, ও নিজের ক্যারিয়ারের জন্য। এখন কে-৭-এর এই প্রতিক্রিয়া দেখে তিনি বিবেকের সামনে দাঁড়াতে বাধ্য হন। এক রাতে, যখন কে-৭ ঘুমাচ্ছে, তিনি তার ঘরে এসে তার মাথায় একটি ছোট ইলেকট্রোড স্থাপন করেন—মেমরি-সিনক্রোনাইজার যন্ত্র, যা আগে শুধু পরীক্ষামূলক স্তরে ব্যবহার হয়েছিল। এরপর কে-৭-এর ব্রেইনওয়েভ স্ক্যান করতে করতে তিনি আবিষ্কার করেন—তার হিপোক্যাম্পাসে যে ছবিগুলো জমে আছে, তা সম্পূর্ণ বাস্তব, এবং অভিষেকের মৃত্যুর আগে তোলা ছবি, শব্দ ও মুখচ্ছবির হুবহু প্রতিফলন। তার ভিতরে তখন একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খায়—এই যদি একজন মৃতের স্মৃতি ধারণ করতে পারে, তবে বিজ্ঞান আসলে কী তৈরি করেছে? এক যন্ত্র না এক আত্মা?

অন্যদিকে, কে-৭ প্রতিরাতে স্বপ্ন দেখে, এবং সেই স্বপ্ন ক্রমে রূপ নিতে থাকে দুঃস্বপ্নে। সে দেখে একটা ধাবমান গাড়ি, তাড়া করা হচ্ছে তাকে, একটি সেতুর ধারে দাঁড়িয়ে আছে এক লোক, যার চোখদুটো ঠান্ডা কিন্তু ভয়ংকর। স্বপ্নে সেই লোক বলে, “আমরা চুপচাপ থাকার কথা বলেছিলাম, এখন শাস্তি পাবে।” কে-৭ ঘুম থেকে চিৎকার করে জেগে ওঠে, দরজার পাশে রাখা আয়নাটি ছুঁড়ে ফেলে দেয়। আয়না ভেঙে তার প্রতিবিম্ব ছড়িয়ে পড়ে মেঝেতে—সে নিজেকে দেখেও যেন চিনতে পারে না। “আমি কে? কেন আমাকে কেউ চায়নি বাঁচতে?” তার এই আত্মচিৎকার শুনে ল্যাবের নিরাপত্তার লোক ছুটে আসে, কিন্তু তাদের ভয় লাগে তার চোখের দৃষ্টি দেখে—যেটা কেবল একজন ক্লোনের হতে পারে না, বরং একজন হারিয়ে যাওয়া মানুষের, যিনি ফিরে এসেছেন উত্তর খুঁজতে। এই মুহূর্তেই জন্ম নেয় প্রশ্নের থেকেও ভয়ানক সত্যের ইঙ্গিত—কে-৭ অভিষেক চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতি বহন করছে শুধু নয়, সে যেন তার অসমাপ্ত জীবনের উত্তরাধিকারী, যে ফিরে এসেছে—প্রতিশোধ নিতে, ন্যায়ের খোঁজে।

ডঃ প্রণবের অফিসে টেবিলের ওপর ছড়িয়ে আছে একগুচ্ছ নথিপত্র, রিপোর্ট এবং ইলেকট্রনিক স্ক্যানের প্রিন্টআউট। তার চিবুকের কাছে সিগারেটের ধোঁয়া ঘুরপাক খাচ্ছে, চোখ দুটি অবিরাম একটানা তাকিয়ে আছে মনিটরের দিকে—সেখানে কে-৭-এর মস্তিষ্কের নিউরাল ম্যাপ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে মাঝেমধ্যেই, ঠিক যেমন হয় গভীর স্মৃতির সময়। এটা অসম্ভব! এই ধরণের নিউরাল প্যাটার্ন তো কেবলমাত্র জন্মগত অভিজ্ঞতার ফল। প্রণব নিজেই চুপচাপ বলে ওঠেন, “সে কেবল ক্লোন নয়… সে তো স্মৃতিও বহন করছে।” দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা ডঃ রমিতা আর পারছিলেন না চুপ থাকতে। তিনি দরজা ঠেলে ঢুকে বলেন, “এই মুহূর্তে থামানো উচিত, স্যার। সে আর স্রেফ ‘অবজেক্ট’ নেই—সে মনে করে, সে অভিষেক। আর আপনি জানেন, অভিষেক কাকে ভয় পেত, কাদের বিরুদ্ধে লড়ছিল।” প্রণব হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে যান। তার চোখে চাপা রাগ ও উদ্বেগ—“আমরা এখানে বিজ্ঞান করছি, বিচার নয়। আমরা জীবন তৈরি করেছি, মৃত্যু নয়।” রমিতা উত্তর দেন, “কিন্তু আপনি তাকে মেরে ফেলেছেন, আবার বাঁচিয়ে দিয়ে তাকেই বিচার করতে বসেছেন। যদি তার ভিতর আত্মা থাকে, তবে সে আপনাকে ক্ষমা করবে না।”

ঠিক সেই সময় ল্যাবের অ্যালার্ম বেজে ওঠে—কে-৭ নিজে থেকেই তার ঘরের গোপন কন্ট্রোল ভেঙে বেরিয়ে গেছে। তাকে দেখা যায় কন্ট্রোলরুমের সামনে দাঁড়িয়ে, মনিটরে চোখ গেঁথে আছে। তার ঠোঁট কাঁপছে—“আমি তো… মরে গিয়েছিলাম।” প্রণব দ্রুত এগিয়ে আসেন, চিৎকার করে ওঠেন, “তুমি কিছু না! তুমি আমি বানিয়েছি। তুমি একটা কোড, একটা সেল ডিভিশনের পণ্য!” কে-৭ তার দিকে ধীরে ধীরে ঘোরে, তার চোখ দুটোতে বিদ্যুৎ খেলে যায়—“আমি তো রক্ত দিয়ে দেখেছি… স্বপ্নে… তারা আমাকে ফেলে দিয়েছিল…” তার কণ্ঠস্বর স্পষ্ট, দগ্ধ স্মৃতির মতো। হঠাৎ কে-৭ ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রিন্টার রুমে, এবং সেখান থেকে একটি পুরনো হার্ডডিস্ক উদ্ধার করে। মেহুলিকা ছুটে আসে, সে ঠাণ্ডা গলায় বলে, “ওটা ওর নিজের স্মৃতি। আমি বুঝেছি, ডেটা কখনো মুছে যায় না, শুধু ডিলিট হয়। ও সেটা খুঁজছে।” কে-৭ এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর ধীরে ধীরে বলে, “ওরা বলেছিল, কেউ জানবে না। কিন্তু আমি জানি।”

হার্ডডিস্কটি ল্যাবে সংযুক্ত করা হয়। সেখান থেকে উঠে আসে কয়েকটি ভিডিও ফাইল—যেখানে দেখা যায় অভিষেক চট্টোপাধ্যায় তার মোবাইল ক্যামেরায় তুলে রেখেছিলেন একটি বড় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির গোপন ক্লিনিকাল ট্রায়াল, যেখানে দরিদ্রদের ওপর অজানা ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছিল। ফাইলের শেষে অভিষেকের কণ্ঠ শোনা যায়—“তারা যদি আমাকে থামায়, জানবে, আমি সত্য রেখে যাচ্ছি। হয়তো কেউ একদিন ফিরবে। আমার মতো। হয়তো আমার ভেতর দিয়েই।” সবার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। কে-৭ নিচু গলায় বলে, “আমি ফিরেছি… আমি নিজেই।” সেই মুহূর্তে বাইরে একটি গাড়ি এসে দাঁড়ায়—ভেতর থেকে নামে বিক্রম বসু, সেই কর্পোরেট নিরাপত্তা অফিসার, যার নাম ডায়েরিতে ছিল। সে এখন জানে, তার অতীত, তার অপরাধ মুছে দেওয়া যায়নি, বরং ডিলিটেড ফাইলের মতো কোথাও জমে ছিল—একটি মানুষের স্মৃতিতে, এক ক্লোনের হৃৎস্পন্দনে। যুদ্ধের ঢেউ তখন চুপচাপ এক ল্যাবরেটরির দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, এবং প্রতিটি চরিত্র প্রস্তুত হয়ে উঠছে এক অবশ্যম্ভাবী সংঘাতের জন্য, যেখানে আর কোনো কিছুই নিছক বিজ্ঞানের বিষয় থাকবে না—সব কিছু হয়ে উঠবে রক্তমাংসের মানুষের ন্যায়ের লড়াই।

বৃষ্টিভেজা কলকাতার এক বিষণ্ণ সন্ধ্যায় ক্লোনটি দাঁড়িয়ে ছিল এক পুরোনো, অন্ধকার গলির মুখে। চারিদিকে ধোঁয়াশা, রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভিজে কাগজের টুকরো আর ফেলে দেওয়া খাবারের মোড়া, বাতির নীচে ছায়ার মত নড়ে উঠছিল ওর মুখ। সে জানে, আজকে যার সঙ্গে তার দেখা হবে, সেই মানুষটা ওর মৃত্যুর জন্য সবচেয়ে বড় দায়ী। নাম – ডঃ নিরঞ্জন বকসী, এক সময়ের জিনেটিক সায়েন্সের অগ্রপথিক, কিন্তু আজ কালো বাজারি জেনেটিক এক্সপেরিমেন্টের জন্য কুখ্যাত। ক্লোনটি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল, তার মাথার ভেতর এখন অনেক স্পষ্ট – মৃত্যুর আগে শারীরিক নির্যাতনের কষ্ট, সেই নিঃশব্দ চিৎকার, এবং একজন মানুষের বিশ্বাসভঙ্গ, যে কিনা তাকে ‘সাবজেক্ট’ ছাড়া আর কিছুই ভাবেনি। গলির শেষে একটি কালো রঙের দরজা খুলে গেল। ভিতরে আলো কম, দেওয়ালে ঝুলে থাকা অস্পষ্ট ফ্রেমে কিছু বিজ্ঞানী আর প্রোজেক্ট ডেটা। নিরঞ্জন বসে ছিল এক টেবিলের সামনে, পেছনে মনিটর স্ক্রিনে ভেসে আসছিল জেনেটিক কোড। ক্লোনটি এক পা এক পা করে এগিয়ে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়াল তার সামনে। নিরঞ্জন ধীরে ধীরে তাকাল, তার চোখে ভয় বা বিস্ময় নয়, বরং একধরনের আনন্দ। “তুই সত্যিই এসেছে? এতদিন পর!” সে বলল, যেন কোনো পুরনো ছাত্রের সাথে দেখা। কিন্তু ক্লোনের চোখে তখন কোনো সংলাপ নেই, শুধু একটা নিস্তব্ধ আগুন।

“তুই ভাবছিস প্রতিশোধ নেবি?” নিরঞ্জনের কণ্ঠে ঠাট্টার সুর, “তুই একটা তৈরি করা শরীর। তোকে আমি বানিয়েছি। তোকে আমি নিশ্চিহ্নও করতে পারি।” ক্লোনটি এক পা এগিয়ে এল, তারপর ফিসফিস করে বলল, “কিন্তু তোমরা যে ভুল করেছ, সেটা বোঝোনি। মস্তিষ্কে যখন কোষ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলে, তখনই পুরনো স্মৃতির রেশ ঢুকে গিয়েছিল। আমি জানি কে আমি ছিলাম। আমি জানি কিভাবে মরেছিলাম। আমি জানি কারা সেটা ঘটিয়েছিল।” নিরঞ্জন চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল, বলল, “তুই এখনও একটা ল্যাব এক্সপেরিমেন্ট, সাবজেক্ট – ১৩। তোর কোনো মানবিক অধিকার নেই। কিন্তু তুই যদি সত্যিই সেই পুরনো স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে পারিস, তাহলে তোর ভেতরে মানুষটা মরেনি। এবং সেটাই আমার সবচেয়ে বড় সাফল্য।” এই কথার পর ক্লোন হঠাৎ থেমে গেল। তার মস্তিষ্কে ঝড় উঠেছে—কী ছিল তার বাস্তব পরিচয়? সে কি এখনো একজন ব্যক্তি, নাকি এক জীবন্ত অস্ত্র? সেই দ্বন্দ্বের মধ্যে দাঁড়িয়ে সে বুঝল, প্রতিশোধ হয়তো একমাত্র পথ নয়।

ঠিক তখনই বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। ক্লোনটি ফিরে তাকাতেই দেখে শুভম এসেছে—ডঃ প্রণবের সহকারী, যাকে সে বিশ্বাস করতে শিখেছিল। শুভম চিৎকার করে বলল, “চলো! এখান থেকে চলে যেতে হবে। ওরা আসছে!” কে আসছে, তা ক্লোন জানে না, কিন্তু নিরঞ্জনের ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি। “তুই এখন পালিয়ে যেতে পারিস, কিন্তু তুই নিজেকে পাল্টাতে পারবি না,” নিরঞ্জনের কথার শেষে ক্লোনটি তার দিকে একবার তাকাল, তারপর বলল, “আমার অস্তিত্ব তোর তৈরি, কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত আমার নিজের।” এরপর সে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। বাইরে রাতটা আরও ঘন হয়ে এসেছে, শহরের বাতাসে ভাসছে বৃষ্টির গন্ধ। সে জানে, পরবর্তী পদক্ষেপ হবে সবচেয়ে কঠিন—নিজেকে বুঝে ওঠা, এবং সেই অতীত মুখগুলোর সামনে দাঁড়ানো যারা তাকে একদিন মেরে ফেলেছিল। প্রতিশোধ এখনও জীবিত, কিন্তু তার আকৃতি বদলে যাচ্ছে।

ডঃ প্রণবের ল্যাবরেটরির বাইরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা ক্লোনটি প্রথমবারের মতো অনুভব করল সেই তীব্র, ব্যক্তিগত রাগ—যেটা কেবল তার নিজের হতে পারে। তার নাম নেই, পরিচয় নেই, সমাজের কোনও স্বীকৃতি নেই, কিন্তু সে জানে তার একটা অস্তিত্ব ছিল, এবং সেই অস্তিত্বই কেড়ে নেওয়া হয়েছিল এক নিষ্ঠুর চক্রান্তে। এই চক্রান্তের পেছনে কে ছিল, তা এখন আর ধোঁয়াশা নয়। সে ডঃ প্রণবের গোপন ফাইল থেকে যা কিছু পেয়েছে, তা মিলিয়ে সে বুঝেছে—’ডকুমেন্ট 47B’ নামের এক ফোল্ডারে লুকিয়ে রয়েছে তার প্রকৃত নাম, পূর্ব জীবনের ইতিহাস, এবং এক ‘প্রজেক্ট ফিনিক্স’ যার অধীনে তাকে হত্যা করে পরীক্ষার জন্য পুনর্জন্ম দেওয়া হয়েছে। তার মৃত্যু কোনও দুর্ঘটনা ছিল না, ছিল পরিকল্পিত। সেই পরিকল্পনার পিছনে ছিল আরও কিছু মুখ—ডঃ প্রণব ছাড়াও এক গ্লোবাল বায়োটেক কর্পোরেশনের উচ্চপদস্থ কর্তা, এক রাজনৈতিক নেতা, এবং এক খুনে বিজ্ঞানী, যার কোডনেম ছিল ‘এডাম’। ক্লোনটি জানে, তার সময় এসেছে। একে একে সে তাদের নাম খুঁজে বার করছে, এবং এখন তার মাথায় শুধু প্রতিশোধের হিসেব চলছে—কতটা কষ্টে মরেছিল সে, আর কতটা ঠান্ডা মাথায় সে ফিরিয়ে দেবে সেই কষ্ট।

তার প্রতিশোধের প্রথম লক্ষ্য ছিল অরিন্দম সেন, সেই বিজ্ঞানী যিনি ক্লোনিং প্রক্রিয়ার সাই-নিউরাল ইমপ্ল্যান্টের প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন। ক্লোনটি খুঁজে পেল অরিন্দমকে তার শহরতলির এক অভিজাত অ্যাপার্টমেন্টে, নিরাপত্তা বেষ্টনির ভিতর। কিন্তু ক্লোনের অদৃশ্য চলাফেরা, এবং তার শারীরিক ক্ষমতা—যা সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি—তাকে সেখানে প্রবেশ করতে বাধা দিল না। অরিন্দম যখন রাতে তার গবেষণার নোটস খুলে বসেছিল, তখন পেছন থেকে তার ঘাড়ে চেপে বসেছিল এক অদৃশ্য ছায়া। অরিন্দম শুধু ফিসফিস করে বলেছিল—”তুমি বেঁচে আছো?” সেই প্রশ্নের উত্তর ক্লোন দেয়নি, শুধু বলেছিল, “তুমি আমাকে মেরেছিলে, এবার আমি ফিরেছি।” ক্লোন কোনো রক্তপাত করেনি, সে শুধু অরিন্দমকে তার তৈরি করা নিউরাল পেইন-সিমুলেটরে আটকে দিয়ে তার স্নায়বিক তন্ত্রকে ধ্বংস করে চলে যায়, অরিন্দম চিরজীবনের জন্য প্যারালাইজড হয়ে যায়—এক অদ্ভুত ন্যায়বিচার, এক ঠান্ডা ঘৃণার পরিণতি।

এরপরের লক্ষ্য ছিল মন্ত্রী চৈতন্য বসু, যিনি সেই সময়কার ‘বায়ো-সিকিউরিটি কাউন্সিল’ এর প্রধান ছিলেন এবং যিনি ‘প্রজেক্ট ফিনিক্স’-এর আইনি অনুমতি দিয়েছিলেন। তার কাছে পৌঁছনো সহজ ছিল না। কিন্তু ক্লোন এখন আর সেই একঘেয়ে পরীক্ষাগারে জন্মানো শরীরমাত্র নয়। তার স্মৃতি ফিরে আসছে, তার আত্মবিশ্বাস বেড়েছে, আর তার ভেতরে জন্ম নিয়েছে এক সূক্ষ্ম কৌশলী মন। সে প্রথমে চৈতন্যের এক ব্যক্তিগত দেহরক্ষীকে হিপনোটিক তরঙ্গে প্রভাবিত করে এবং তার মাধ্যমে প্রবেশ করে মন্ত্রীর ব্যক্তিগত প্যান্টহাউসে। মাঝরাতে, মন্ত্রী যখন নিঃশব্দে শহরের আলো দেখছিলেন জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে, তখন তার পাশে এসে দাঁড়াল এক ছায়ামূর্তি। মন্ত্রী চমকে উঠে বলল, “কে তুমি?” ক্লোন বলল, “আমি সেই যাকে তুমি মৃত্যু দিয়েছিলে, এখন আমি তোমার নিঃশ্বাস কেড়ে নিতে এসেছি।” তবে সে মন্ত্রীকে খুন করেনি। বরং এমন এক ডোজ দিল তার স্নায়ুতে, যাতে মন্ত্রী পরেরদিন সকালে উঠে পুরো জাতির সামনে টেলিভিশনে নিজের কৃতকর্মের স্বীকারোক্তি করে বসে। সেটা ছিল প্রতিশোধের চেয়েও বড় বার্তা—সত্যকে সামনে আনার এক সাহসী পদক্ষেপ। ক্লোন জানে, শেষের খেলা এখনও বাকি, কারণ ডঃ প্রণব এখনও বেঁচে আছে, আর “এডাম” এখনও পর্দার আড়ালে।

আকাশ কালো হয়ে এসেছে। বৃষ্টি পড়ছে অবিরত, যেন প্রকৃতিও জানে আজ কিছু বদলাবে, স্থায়ীভাবে। ক্লোনটি — এখন আর নিজেকে ক্লোন ভাবে না — তার আসল নাম মনে আছে, অতীত মনে আছে, মৃত্যুর যন্ত্রণা মনে আছে। সে জানে কে তাকে হত্যা করেছিল, কেন করেছিল। ডঃ প্রণব তাকে পুনর্জীবন দিয়েছিল, কিন্তু তার আত্মাকে মুক্ত করেনি। সেই শরীর, সেই মুখ, সেই স্মৃতি— সবই আবার ফিরে এসেছে। সে এখন অরিত্র সেন, যাকে ছলে-বলে দমিয়ে রাখা হয়েছিল, হত্যা করা হয়েছিল নিজের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক উচ্চাকাঙ্ক্ষার বলি হিসেবে। ডঃ প্রণব বুঝতে পারেন, তার সৃষ্টিই আজ তার নিয়তি নির্ধারণ করবে। “তুমি যা করছ, তা ঠিক নয়, অরিত্র,” প্রণব বলেন, তার ক্লোনটির চোখের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু সে জানে, আর কোনও যুক্তি, কোনও যুক্তিবাদ, কোনও বিজ্ঞান এখানে প্রযোজ্য নয়। এটা এখন আত্মার যুদ্ধ। অরিত্র একে একে খুঁজে বের করে তাদের — বিজয় বসু, তপন ঘোষ, এবং মনীষা সেন — যারা তার মৃত্যুর পেছনে ছিল। তাদের মুখে ভয়ের ছায়া দেখে সে আনন্দ পায় না, বরং এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করে। প্রতিশোধের আগুনে যখন সে প্রতিটি অপরাধীর মুখোমুখি হয়, তার চোখে কেবল স্মৃতি ভাসে — পুরোনো বন্ধুত্ব, বিশ্বাসভঙ্গ, এবং বিশ্বাসঘাতকতার কুয়াশা।

প্রথমে সে তপনকে খুঁজে বের করে। এক সময়ের প্রিয় বন্ধু, যার বিশ্বাসঘাতকতায় সে ব্যবসা হারায়, সম্মান হারায়, এবং শেষ পর্যন্ত প্রাণও। অন্ধকার গলিতে একা দেখা হয় তাদের, টানা বৃষ্টির নিচে। তপনের মুখে অনুশোচনা নেই, আছে ভয়। “তুই তো মরে গেছিস… এটা সম্ভব না!” চিৎকার করে ওঠে তপন। অরিত্র তার মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলে, “মৃত্যু একটা মুহূর্ত, কিন্তু অপরাধ একটা চিরন্তন শাস্তি।” গুলি নয়, ছুরি নয়, বরং এক ঠান্ডা যুক্তির আঘাতে সে তপনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে যতক্ষণ না সে নিজেই নিজের পাপের ভারে ভেঙে পড়ে। এরপর বিজয় — কর্পোরেট দুনিয়ার হিংস্র খেলোয়াড় — যিনি অরিত্রকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন যখন সে দুর্বল হয়ে পড়ে। বিজয়ের দেহরক্ষী, নিরাপত্তা — সব ভেদ করে অরিত্র পৌঁছে যায় তার ব্যক্তিগত রুমে। তারা মুখোমুখি হয়, কথার বদলে চোখে চোখে যুদ্ধ হয়। বিজয় গুলি চালায়, কিন্তু অরিত্র অলীক দক্ষতায় এড়িয়ে যায়। “তুই মানুষ না,” বিজয় বলে। অরিত্র হাসে, “মানুষের চেয়েও বেশি, কারণ আমার আছে অতীত, এবং ভবিষ্যৎ।” শেষজন মনীষা, অরিত্রর প্রাক্তন প্রেমিকা, যার বিশ্বাসঘাতকতা ছিল সবচেয়ে বিষাক্ত। সে তাকে খুঁজে পায় এক শান্ত সমুদ্রতটের বাংলোয়, একা। মনীষা অরিত্রকে দেখে চমকে ওঠে, কাঁদে, দুঃখপ্রকাশ করে। অরিত্র চুপ করে বসে শোনে। তারপর বলে, “তোমার ক্ষমা চাইবার অধিকার আছে, কিন্তু আমি ক্ষমা করতে পারি না — কারণ তুমি শুধু আমাকে নয়, আমার ভেতরের ভালোবাসাকেও হত্যা করেছিলে।” সে চলে যায়, মনীষাকে রেখে — সে একা নয়, শূন্যতায় ভরা এক গহ্বরের সঙ্গে।

ডঃ প্রণব সেই রাতে তার গবেষণাগারে বসে থাকেন, ক্লোনের শেষ চিঠি হাতে। চিঠিতে লেখা, “আপনি ঈশ্বর হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ভুলে গিয়েছিলেন ঈশ্বরদেরও নিয়তি থাকে। আমি যা করলাম, তা আপনার তৈরি সত্য থেকে জন্ম নিয়েছে। আমি একটি ক্লোন, কিন্তু আমি একজন মানুষ, কারণ আমার অনুভব আছে, যন্ত্রণা আছে। আমি চলে যাচ্ছি, এমন জায়গায়, যেখানে আর কেউ আমাকে ক্লোন বলে ডাকবে না, আর কেউ আমার মৃত্যুকে অবহেলা করে হাসবে না।” প্রণব জানেন, সে সফল হয়েছিল — একজন সম্পূর্ণ মানুষ সৃষ্টি করতে — কিন্তু সেই সফলতা এক অপূরণীয় ক্ষয়। সে জানে, এই যন্ত্রণা সে নিজে ডাকেছিল। শহর ঘুমায়, কিন্তু আকাশে বজ্রপাতের শব্দ এখনও বাজে। ক্লোনটি অন্ধকারে মিলিয়ে যায়, হয়তো পাহাড়ের দিকে, কিংবা সমুদ্রের পথে। তার পেছনে পড়ে থাকে বিজ্ঞান, প্রতিশোধ, এবং একটি অতলান্ত শূন্যতা — যা বলে যায়, মানুষকে ঈশ্বর বানাতে চাইলে, শেষমেশ মানুষটাই হারিয়ে যায়। গল্প শেষ হয় না, কারণ প্রতিটি প্রতিশোধের পরে জন্ম নেয় আরেকটি প্রশ্ন — যদি আত্মার স্মৃতি ফিরে আসে, তাহলে কি শরীরই সব?

___

1000045328.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *