Bangla - স্মৃতিকথা

ক্যারম বোর্ড আর শীতের কম্বল

Spread the love

মেঘালি দাস


ঋত্বিক মৈত্র ডান হাতে একটা মাঝারি সাইজের ব্যাগ আর বাঁ হাতে পুরনো স্কচটেপের খোপ ধরা অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিল স্টোর রুমের দরজার সামনে। জানলা দিয়ে ঢুকে পড়া বিকেলের হালকা রোদ যেন স্টোর রুমটার চারপাশে ধুলোর আস্তরণে সোনালি পরত ছড়িয়ে দিয়েছে। দোতলার দক্ষিণ ঘরের এক কোণে আটকে থাকা এই ছোট্ট ঘরটা বহুদিন পর খোলা হচ্ছে আজ। কলকাতার মধ্যবিত্ত এক বাড়ির ক্লান্ত দেয়ালের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা স্টোর রুমটা যেন নিজের ভেতরে আর্কাইভ করে রেখেছে মৈত্র পরিবারের ছোট ছোট মুহূর্তগুলো। হোস্টেলে যাওয়ার আগে নিজের প্রিয় ক্যারম বোর্ডটা নিয়ে যেতে চায় ঋত্বিক—এটাই তো ছিল তার আর বাবার একমাত্র ‘বন্ধুত্বের খেলা’, সন্ধ্যায় আলো-আঁধারিতে দুটো কাঠের গুটি ঘুরিয়ে দুজনেই হয়ে যেত নিঃশব্দে কাছের। দরজাটা খুলতেই যেন বুকের মধ্যে একধরনের কাঁপুনি শুরু হলো, বহুদিন ধরা না পড়া ঘ্রাণ, দাদুর পুড়োনো বোরোলিন মাখা চাদরের গন্ধ, কোথাও পড়ে থাকা আলমারির নিচে মা-র গুটিয়ে রাখা শীতের কম্বলের কোণ, একটা হঠাৎ চেনা হয়ে যাওয়া ঘরের নীরব আহ্বান—“এসো, তুমি আবার এইখানে ছিলে।” ধুলোর স্তরে ঢাকা ক্যারম বোর্ডটা দেখা গেল একটা মোড়ানো ট্রাংকের পাশে হেলান দিয়ে রাখা। তার পাশেই একটা সাদা কাপড়ে জড়ানো গুটি-স্ট্যান্ড, আর ছোট্ট টিনের ডিব্বায় চকচকে পুরনো স্ট্রাইকার, যেটা একবার বাবার হাত থেকে পড়ে ভেঙে গিয়েছিল, আবার বাবাই সারিয়ে নিয়েছিলেন।

ঋত্বিক বোর্ডটা হাতে তুলে নিল ধীরে ধীরে, যেন কোনও মৃত আত্মীয়কে জড়িয়ে ধরা হচ্ছে—ততোটা সাবধান, ততোটা যত্ন করে। আঙুল বুলিয়ে নিল পাউডারের দাগ বসে থাকা পৃষ্ঠে, যেন ছুঁয়ে দেখছে তার হারিয়ে যাওয়া বিকেলগুলো। তার মনে পড়ে গেল, তখন সে ক্লাস সিক্সে পড়ে—দাদু তখনও ছিলেন, মা তখন বিকেলে আলু পোস্ত রেঁধে ঘরে নিয়ে এসে দিতেন, আর বাবা অফিস থেকে ফিরেই গেঞ্জি পরে বসে পড়তেন ক্যারমের সামনে। একদিকে টেবিল ফ্যান চলত, অন্যদিকে চলত পয়েন্ট কাটা গুটি নিয়ে বাবার একটা বিশেষ ট্রিক, যেটা সে কোনওদিনই পারত না ঠেকাতে। হেরে গেলেও বাবা বলতেন, “হাসতে শিখলেই জেতা যায়।” সেই হাসিটাই আজ আর কোথাও নেই—বাবা এখন অফিস থেকে ফিরলে টিভির সামনে চুপ করে বসে থাকেন, ক্যারম বোর্ডটা আর খোলা হয় না। মা এখনও আলু পোস্ত রাঁধেন, কিন্তু সেটা এখন গ্যাস-আলোতে গন্ধ কমায়। আর দাদু তো চলে গেলেন বছর চারেক আগে, শেষদিকে কথা বলাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন, কেবল চোখের কোণে স্মৃতির মতো ভেসে থাকতেন। এই বোর্ডটার কাঠে, এই শীতের কম্বলের ভাঁজে, এখনও যেন দাদুর হাতের গন্ধ রয়ে গেছে—জীবনটা ঠিক কোথায় পাল্টে যায় মানুষ টের পায় না, কেবল যখন কোনো পুরনো জিনিস সামনে আসে, তখনই বোঝা যায় সেই জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেছে।

হঠাৎ করে কম্বলের নিচে একটা ছোট্ট খাতা পড়ে যায়—ছেঁড়া পৃষ্ঠ, দাগ লাগা বাঁধাই, কিন্তু প্রথম পাতায় দাদুর হাতের লেখা স্পষ্ট: “ঋত্বিকের ক্যারম ডায়েরি, বয়স ৮”। হাওয়ার মতন শ্বাস বন্ধ হয়ে এল ঋত্বিকের, সে খাতা খুলে দেখতে লাগল—প্রথম পাতায় লেখা, “আজ বাবা হারল, আমি চারটা গুটি মারলাম, দাদু বলল আমি খেলোয়াড় হয়েছি।” পাতাগুলোতে আর যাই লেখা থাক না কেন, একটা শব্দ বারবার ফিরে আসছিল—‘ঘর’। একটা সময় ছিল যখন এই ঘরটা ছোট ছিল, কিন্তু ভালোবাসায় ভরা ছিল। এখন বাড়ি বড় হয়েছে, ছেলেটা হোস্টেলে যাচ্ছে, কম্বলের গন্ধ ফিকে হয়ে গেছে, বাবার চোখে ক্লান্তি, মায়ের মুখে নীরবতা। কিন্তু স্টোর রুমটা এখনও সেই পুরনো ক্যারম বোর্ডের মতো—ধুলো মুছে নিলেই আবার সব উজ্জ্বল হয়ে উঠতে চায়। বোর্ডটা এক কোণে রাখার আগে ঋত্বিক একবার তাকাল মেঝের দিকে—যেখানে একসময় দাদুর পায়ের চপ্পলের দাগ পড়ে থাকত, সেইখানে এখন শুধু হালকা ছায়া পড়ে আছে। বোর্ডটা তুলে নিল কাঁধে, খাতাটা ব্যাগে রাখল সাবধানে, আর একবার দরজার দিকে তাকিয়ে বলল ধীরে, “আমি আবার আসব।”

***

স্টোর রুম থেকে ফিরে এসে ঋত্বিক নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করল আস্তে করে, যেন পুরনো স্মৃতি যেন ভেঙে না যায় শব্দে। কাঁধ থেকে ক্যারম বোর্ডটা নামিয়ে বিছানার পাশে রাখল, আর খাতাটাকে খোলা রেখে চোখ বুজে শুয়ে পড়ল। জানলার কাচ দিয়ে শীতের রোদ ঢুকে পড়েছে ঘরের মধ্যে, আর সেই আলোতে ক্যারম বোর্ডের পাটিগুলো যেন আবার সজীব হয়ে উঠেছে। হঠাৎ করেই তার মনে পড়ে গেল মায়ের সেই শীতের কম্বলটার কথা—যেটা সন্ধ্যেবেলায় পড়ে গেলে মা নিজে এসে শরীর ঢেকে দিতেন। সেসময় হয়তো রান্নাঘরে উড়ছিল পাঁপড় ভাজার গন্ধ, আর টিভির আওয়াজ ভেসে আসত ঘরজুড়ে। মায়ের হাতের সেই পুরনো কম্বলের গন্ধ—এক অনির্বচনীয় উষ্ণতা, যে গন্ধে মিশে থাকত নারকেলের তেল, ডাল-ভাতের ভাপ, আর একটা নিরাপদ ঘরের নির্ভরতা। সেই গন্ধটা আজকাল নেই, সেই হাতটাও এখন দূরে দাঁড়িয়ে থাকে, ঋত্বিক নিজেই তো অনেক বড় হয়ে গেছে এখন। হোস্টেলের লিস্টে শীতের চাদর লেখা থাকলেও সে জানে, ওই কম্বলের গন্ধের কোনও বিকল্প নেই। বিছানার পাশে বসে থাকা মা-কে আজকাল সে শুধু “আচ্ছা, দে তো” বা “আমি নিয়ে নেব”—এই ধরনের বাক্যে আটকে দেয়। অথচ একদিন এই মা-ই রাতের বেলায় উঠে দেখে যেতেন ছেলেটার পা ঢাকা আছে কি না।

ঋত্বিক নিচে নামল, ডাইনিং টেবিলে মা দাঁড়িয়ে চুপচাপ টিফিনে শুকনো লুচি আর আলুর চচ্চড়ি ভরছিলেন। তার পেছনে কাঁধে পড়ে থাকা সেই পুরনো শালটা ঋত্বিক এক নজরে চিনতে পারল—যেটা মা পাঁচ বছর আগে শীতের ছুটিতে বর্ধমানে মামার বাড়ি যাওয়ার সময় জড়িয়েছিলেন। সেই গন্ধটাও কেমন ধোঁয়াটে হয়ে গেছে এখন, যেমন ধোঁয়ার মধ্যে মানুষ চিনতে কষ্ট হয়। “মা, ওই কম্বলটা দেবে? পুরনো লাল-নীল ফুল ছাপওয়ালা যেটা দাদু ব্যবহার করত, পরে তুমি দিতেই না আমাকে ঢেকে রাখার জন্য,”—বলতে বলতেই থেমে গেল ঋত্বিক। সন্দীপা একটু চমকে তাকাল ছেলের দিকে। সেই চোখে কেমন অবিশ্বাস—এই ছেলে আজ এত বছর পর কম্বলের কথা বলছে? তারপর মুখে আস্তে একটা হাসি ফুটল, “ওইটা তো তোর দাদুর কম্বল ছিল… তোর খুব প্রিয় ছিল জানি… ভেবেছিলাম পুরনো হয়ে গেছে, রাখার দরকার নেই আর…”—কথা শেষ করতে পারলেন না, চোখের কোণে জল থমকে থাকল। তারপর হালকা গলায় বললেন, “রেখে দিয়েছিলাম একটা বাক্সে… স্টোর রুমেই।” ঋত্বিক কিছু বলল না, শুধু মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। মা এবার চুপ করে কম্বলের বাক্সটা এনে ছেলের হাতে দিলেন, পলিথিন খুলতেই সেই পুরনো গন্ধ আবার মাথার মধ্যে ঢুকে পড়ল। কী অদ্ভুত—একটা গন্ধ যেন অতীতকে ফিরিয়ে আনে, একটা ছেঁড়া কম্বল যেন শৈশবের প্রতিটি সন্ধ্যা মনে করিয়ে দেয়। সে জানত, এই কম্বল সে হোস্টেলে নিয়ে গেলেও কেউ বুঝবে না এর মানে, কিন্তু তার নিজের কাছে এটাই সবচেয়ে নিরাপত্তার প্রতীক।

রাতে খাওয়া শেষে সঞ্জীব মৈত্র এসে বসেছিলেন টিভির সামনে, নিউজ চ্যানেলে রাজনীতি চলছে। ঋত্বিক ধীরে ধীরে গিয়ে ক্যারম বোর্ডটা নামিয়ে রাখল তার সামনে, আর বলল, “খেলবে একটু?” বাবা প্রথমে কিছু বললেন না, তারপর চশমা খুলে পাশে রাখলেন, বললেন, “অনেকদিন তো খেলা হয় না… তুই তো এখন বড় হয়ে গেছিস, আমায় হারিয়ে দেবে নিশ্চয়।” এই কথায় একটা হালকা ঠাট্টা থাকলেও তাতে ছিল একটা অব্যক্ত কষ্ট। ঋত্বিক হাসল, “দেখিস না, কে হারে।” টেবিল ফ্যান চালু হল, খেলার পাউডার ছড়িয়ে দেওয়া হল বোর্ডে, আর সাদা-কালো গুটি গড়িয়ে গেল শব্দ করে, যেন পুরনো সন্ধ্যারা আবার ফিরে এল এক নিমিষে। সন্দীপা দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন, রান্নাঘর থেকে চা বানানোর শব্দ আসছিল, আর টেবিলের নীচে পড়ে থাকা কম্বলটা যেন আবার ধীরে ধীরে বাড়ির ভিতরটাকে আগলে রাখছিল। সেই পুরনো বোর্ড, সেই স্ট্রাইকার, সেই শীতের গন্ধ, আর একসাথে বসে থাকা তিনজন মানুষ—হয়তো তারা কিছুই বলেন না, কিন্তু বোর্ডের গুটির মতোই ঘুরে ফিরে তারা বারবার একে অপরের কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরে আসে।

***

হোস্টেলে যাওয়ার ঠিক আগের সন্ধ্যেটা এমন, যেন সময় নিজেই একটু থেমে পড়েছে। ঋত্বিক জানত, এটাই সেই শেষ সন্ধ্যা—যে সন্ধ্যায় ঘরের জানলা দিয়ে ঢুকবে মা-র ডেকে রাখা চা-র গন্ধ, বাবার চুপচাপ বসে থাকা, আর স্টোর রুম থেকে খুঁজে আনা সেই পুরনো ক্যারম বোর্ডটা আবার একবার বেঁধে দেবে একটা অদৃশ্য বন্ধনে। সারাদিন ব্যাগ গোছানো, লিস্ট চেক করা, জামাকাপড় ধোওয়া—সব কিছুই যেন মেকানিক্যাল মনে হচ্ছিল। কিন্তু বিকেল হতেই একটা চাপা অস্থিরতা ঋত্বিকের মনকে আচ্ছন্ন করল—হঠাৎ যেন সবকিছুই বড় আপন মনে হচ্ছিল, যেগুলো এতদিন ছিল ঠিক সামনেই, এখন সেগুলোর অস্তিত্বও কেমন পাল্টে যাচ্ছে। ঘরের কোণে রাখা কম্বলটা সে আবার তুলে নিল, গন্ধটা এখনও সেই আগের মতো আছে—তপ্ত ভাত, বালিশের পাশে রাখা পাজামা আর মায়ের গায়ের হালকা নারকেল তেলের গন্ধ। চোখে জল আসেনি, কিন্তু বুকের ভেতর কিছু একটা ভারী হয়ে বসে আছে। মা চুপ করে তার পিঠে হাত রেখে বললেন, “কাল সকালে গাড়ি ধরতে হবে তো, একটু তাড়াতাড়ি খেয়ে নিস আজ।” সেই গলায় যতটা কথার প্রয়োজন, তার অনেক বেশি ছিল শব্দহীনতা।

ডাইনিং টেবিলের পাশে বসে সঞ্জীব মৈত্র পত্রিকা খুলে বসেছিলেন, চোখ কিন্তু বারবার চলে যাচ্ছিল ছেলের দিকে। ঋত্বিক প্লেট থেকে একটানা ভাত খাচ্ছিল, কিন্তু গলা দিয়ে খাবার নামছিল না। এমন নয় যে সে প্রথমবার বাড়ি ছাড়ছে, কিন্তু এবার ছাড়াটা যেন চিরস্থায়ী কোনও অনুভূতির মতো মনে হচ্ছিল। খাওয়া শেষে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “খেলবে একটু?” চুপ করে থাকা মানুষটা পত্রিকা ভাঁজ করলেন ধীরে, তার মুখে সেই চেনা ছায়া হাসি, “তুই তো ভালো খেলিস রে এখন… আমি হারেই যাব।” ঋত্বিক জানত, বাবার এই কথায় রাগ, খুনসুটি, অভিমান—সব মিশে থাকে। সে বোর্ডটা নামিয়ে রাখল, পাউডার ছড়িয়ে দিল, স্ট্রাইকার গুছিয়ে দিল। খেলা শুরু হল। প্রথম স্ট্রাইকে বাবা একটা সাদা গুটি মারলেন নিখুঁতভাবে, মুখে কিছু না বললেও চোখের কোণে একটা হাসি ফুটল। ঋত্বিকও মারল, কিন্তু ইচ্ছা করে স্ট্রাইকারটা এক পাশ ঘষে ফেলল। গুটির পাশ দিয়ে হালকা শব্দে স্ট্রাইকার ছুটে গেল—যেন সম্পর্কের মতো, একেবারে ছুঁয়ে গিয়েও ধরে রাখতে পারল না। মা একপাশে দাঁড়িয়ে চা নিয়ে এলেন, গ্লাসে ধোঁয়া উঠছে, যেন পুরনো সময় গলছে ধীরে ধীরে। কেউ কিছু বলছে না, কিন্তু প্রত্যেকে জানে—এই মুহূর্তগুলো আর ফিরবে না, আজই শেষ।

রাতটা ঘুম এলো না ঋত্বিকের চোখে। জানলার পাশে বসে সে সেই ক্যারম বোর্ডটা দেখছিল—ধুলো ঝেড়ে ওঠা হলেও বোর্ডটার গায়ে দাদুর সময়ের দাগ রয়ে গেছে। সে টিনের খোল খুলে স্ট্রাইকারটা বের করল—বাবা যেটা সারিয়েছিলেন নিজের হাতে, সেই দাগটা আজও রয়ে গেছে। পেছনের কাঠের ফ্রেমে ছোট্ট একটা দাগ, যেটা একবার সে রেগে গিয়ে লাথি মেরেছিল, তখন দাদু বলেছিলেন, “ক্যারম বোর্ডে পা দিলে খেলোয়াড় ছোট হয়, মানুষ না।” সেই কথা আজও মনে পড়ে। সেই মানুষটা তো সে হতেই চেয়েছিল—আর আজ, স্টোর রুমের সেই কম্বলের গন্ধ, ক্যারম বোর্ডের গুটি, বাবার নিঃশব্দ স্নেহ, আর মায়ের গরম চা নিয়ে দাঁড়ানো চেহারা—সবকিছু নিয়েই তো গড়ে উঠেছে তার মানুষ হয়ে ওঠার ছাঁদ। ভোর হতেই ঋত্বিক গাড়িতে উঠবে, তার পিঠে ঝোলানো ব্যাগে থাকবে সেই ছোট খাতাটা আর কম্বল। ক্যারম বোর্ডটা রয়ে যাবে বাড়িতে, কিন্তু সেই খেলাটা, সেই শেষ সন্ধ্যা—যেখানে তিনটি মানুষ কোনো কথা না বলে ভালোবাসার সবচেয়ে নিঃশব্দ ভাষায় কথা বলেছিল—সেটা সে সারাজীবন ভুলতে পারবে না।

***

হোস্টেলের ঘরটা ছোট, চারদিকে অপরিচিত মুখ, আর একেবারে নতুন জীবন। ঋত্বিক জানালার পাশে বিছানায় বসে ছিল—একটু পরই ক্লাস শুরু হবে, কিন্তু মনটা কোথাও বসছে না। ছোট বেলায় শোনা দাদুর গল্পে একটা কথা ছিল—“বাড়ি যখন দূরে থাকে, তখন চিঠিই সবচেয়ে কাছের হয়।” আজ সকালে হঠাৎ করেই যেন মনে হল, বাবাকে বা মাকে ফোন করে বলা যাবে না এসব, কিন্তু কাগজে লিখলে হয়তো নিজের ভিতরের কথাগুলো একটু বেশি খোলসা হয়। ডেস্ক থেকে একটা সাদা কাগজ টেনে নিল, আর এক কোণে লিখল, “প্রিয় বাবা-মা”—। কিছুক্ষণ কলমটা থেমে থাকল, তারপর শব্দগুলো নিজে থেকেই বেরিয়ে এলো।

“হোস্টেলের ঘরটা খুব ছোট, কিন্তু জানলা দিয়ে অনেক দূর দেখা যায়। জানলার পাশে বসলে মনে হয় যেন এখনও আমাদের সেই বাড়ির স্টোর রুমের আলো পড়ছে আমার গায়ে। গতকাল রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে তোমার দেওয়া কম্বলটা গায়ে দিয়েছিলাম মা, একটা গন্ধ এল—ভাতের ভাপ, ডাল আর একটু নারকেল তেলের গন্ধ। চোখের কোনে জল এসে পড়েছিল, লুকিয়ে নিয়েছিলাম। বাবা, তোমার সাথে সেই শেষদিন ক্যারম খেলার সময় তুমি চুপচাপ হেসে বলেছিলে ‘তুই এখন বড় হয়ে গেছিস’—জানো, বড় হতে ইচ্ছে করছে না আর। আমি এখনও ওই খাতার পাতাগুলোয় আঁকিবুকি করি, স্ট্রাইকারটা যতবার দেখি, তোমার চোখের সেই প্রশ্রয় দেখি বাবার মতো। মা, তোমার রান্নার গন্ধ, তোমার শাল, আর সেই শেষ সন্ধ্যার চা—সব এখন অন্যরকম হয়ে গেছে। এখানে কেউ বোঝে না, কবে গুটিগুলো পড়ে গিয়ে জীবনও থেমে যায়। আমি শুধু চাই, তোমরা চিঠিটা পড়ে জানো—আমি তোমাদের খুব মিস করছি, আর ওই ক্যারম বোর্ডের ভাঁজে আমার ছোটবেলাটাকে প্রতিদিন একটু করে ছুঁয়ে দেখছি।”

চিঠি লিখে সে ভাঁজ করল ধীরে, খামের ভেতর রাখার আগে একবার চোখ বুলিয়ে নিল প্রতিটি লাইনের উপর। মনে হল, এই চিঠিটার ভেতর সে তার ঘরটাকে পুরোটাই পুরে ফেলেছে—দাদুর গল্প, মায়ের শীতের সন্ধ্যা, আর বাবার বোর্ডঘেরা স্নেহ। চিঠির পাশে খামের মধ্যে সে একটু কাপড় কেটে ভরে দিল কম্বলের এক কোণা—হালকা, মোলায়েম এক টুকরো। কেউ যদি খুলে দেখে, বুঝবে না তার মানে, কিন্তু মা জানবেন। সেই গন্ধে তিনি চিনে নেবেন ছেলের অশ্রুবিন্দু। ডাকঘরের ঠিকানাটা লিখে পোস্টবক্সে ফেলার আগে ঋত্বিক মনে মনে বলল, “তোমরা চিঠিটা পড়লে বোঝো—আমি হারিয়ে যাইনি, শুধু একটু দূরে আছি।” ক্যাম্পাসে হেঁটে যেতে যেতে তার মনে হল—মানুষ যত দূরে যায়, তত নিজের ঘরের গল্পকে পিঠে নিয়ে বেড়ায়। আর সেই গল্পগুলোই হয়তো একদিন তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় আবার সেই স্টোর রুমে, সেই কম্বলের নীচে, সেই বোর্ডের চারদিকে ছড়িয়ে থাকা সন্ধ্যায়।

সন্ধ্যায় যখন কলেজ ক্যাম্পাসে হালকা ঠাণ্ডা পড়ছে, ঋত্বিক জানালার পাশে বসে দূরে তাকিয়ে থাকে। ফোনটা চুপ করে পড়ে থাকে, মেসেঞ্জারে কেউ কেউ লিখেছে “রাতের পড়া শেয়ার করবি?”, “ক্লাস কেমন ছিল?”—কিন্তু সে কারো উত্তর দেয় না। স্ট্রাইকারটা টেবিলের উপরে রেখে দেয়, সেই খাতাটা খুলে নতুন একটি পাতায় লেখে, “আজ কম্বলের গন্ধটা একটু কম ছিল, হয়তো মায়ের শাড়ির গন্ধ মিশছিল না বলে। কিন্তু তবুও, ঘুম এল।” সেই ঘুমটা ঘরের নয়, স্মৃতির ভিতর থেকে আসা—যেখানে বোর্ডে ঘুরতে থাকা গুটি, চায়ের ধোঁয়া, আর ঠান্ডা রাতে মায়ের হাতে ঢাকা পড়া শরীর বলে দেয়, সে একা নয়। সে কারও ছেলে, কারও খেলোয়াড়, কারও গল্পের চরিত্র।

***

রবিবারের সকালটা শান্ত, কলেজের হোস্টেলে চারপাশে নীরবতা ঘনিয়ে আছে, অনেকটা সেই সকালবেলার মতো, যখন ঘুম ভাঙে না, শুধু জানলা দিয়ে আলো এসে পড়ে চোখের পাতায়। ঋত্বিক নিজের ঘরে চুপচাপ বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল, নিচে ক্যান্টিনের দিকে কেউ হাঁটছে ধীরপায়ে, কিছু ছেলেমেয়ের হাসির শব্দ দূর থেকে ভেসে আসছে, কিন্তু তার মন নেই তাতে। বিছানার পাশে রাখা সেই পুরনো কম্বলটায় মুখ গুঁজে একটু গন্ধ শুঁকল সে—আজও সেই ঘরের গন্ধ আছে কি না জানে না, কিন্তু তার নিজের ভিতর থেকে যে গন্ধটা উঠে আসছে তা সেই পুরনো রাত্রিগুলোর, যেখানে মায়ের হাত ছুঁয়ে ঘুম আসত, দাদুর গল্প শুনতে শুনতে চোখ জড়িয়ে যেত, আর বাবার চুপচাপ বসে থাকা ছায়া বিছানার পাশে পড়ত নিঃশব্দে। ও পাশের রুমের সৌরভ ডেকে বলল, “চল ক্যাম্পাসের কফিশপে যাই?” ঋত্বিক জানাল, যাবে না আজ, একটু ক্লান্ত লাগছে। সৌরভ কিছু বলল না, শুধু দরজা বন্ধ করে চলে গেল। হোস্টেলের এই নির্লিপ্ত বন্ধুতা ওর অভ্যস্ত হয়ে গেছে এখন, যাকে ওর পুরনো বন্ধুদের মতন গল্প শোনানোর দরকার নেই, কেবল মাথা নেড়ে সময় পেরিয়ে দিতে হয়। কিন্তু আজ ঋত্বিক জানে—মনের ভেতরে যেটা ঘুরে চলেছে, সেটা কোনও বর্তমান নয়, বরং এক অবিরত অতীত, যে অতীত তার মনে ঘর বেঁধে বসে আছে ঠিক যেন সেই বারান্দার মোড়ে রাখা কাঠের চেয়ারটায়, যেখানে একদিন বাবা বসে বলেছিলেন, “তুই একদিন বাড়ির বাইরে থাকবি, তখন বুঝবি এই ঘরের মানে।” সে কথাটা তখনকার দিনে কেমন ছেলেমানুষি মনে হয়েছিল, কিন্তু আজ হোস্টেলের এই নির্জন রুমে বসে সেই কথার ভার টের পাওয়া যায়।

ঋত্বিক নিচে নামল বিকেলে, ব্যাগে একটা খাতা, পেনসিল আর সেই স্ট্রাইকারটা নিয়ে। হোস্টেলের পাশে যে পুরনো লাইব্রেরি বিল্ডিং আছে, তার পেছনে একটা খোলা বারান্দা রয়েছে—সেখানে গিয়ে বসে সে মাঝে মাঝে লেখে বা পড়ে, কেউ আসে না সেখানে, কেবল বাতাস আসে আর পাতার ঝরা শব্দে কথা বলে। আজ সেখানে বসে খাতাটা খুলে লেখে, “কম্বলের গন্ধ আজ একটু দূরে ঠেকছে। হয়তো আমি দূরে নই, গন্ধটাই ক্লান্ত।” তারপর লিখে, “মা, বাবার চোখের কোনা দেখে বুঝতে পারি, আমার চলে আসার পরেও তোমরা চুপচাপ বসে থাকো। জানি, তুই হয়তো রান্না করে প্লেটে ভাত সাজিয়ে রেখে দিস, আমি খাবো না জেনেও। বাবা হয়তো আজও খবরের কাগজে মুখ গুঁজে বসে থাকেন, বোর্ডটা ধুলে ঢেকে রাখেন, খেলেন না, যেন তার প্রিয় খেলোয়াড়টাই চলে গেছে মাঠ ছেড়ে। কিন্তু জানো, আমি এখনও প্রতিদিন কিছু না কিছু হারাই—ক্লাসে গিয়ে হারাই বাবার চশমার শব্দ, ক্যাম্পাসে হাঁটতে গিয়ে হারাই মায়ের শাড়ির কোণের গন্ধ, আর রাত্তিরে শুতে গিয়ে হারাই দাদুর গল্প। এইসব হারানোর মাঝে মাঝে একটা নতুন জিনিসও পাই—নিজের ভিতরের বাড়িটাকে খুঁজে পাওয়া। এখন আর চারদিকে খুঁজে দেখি না, নিজেকে জিজ্ঞেস করি, ‘তুই ঠিক কোথায় আছিস?’ তখনই উত্তর আসে—আমি আছি ক্যারম বোর্ডের এক কোণে, আমি আছি একটা চিঠির ভাঁজে, আমি আছি সেই কম্বলের গন্ধে, আমি আছি মায়ের চোখে।” খাতাটা বন্ধ করে ঋত্বিক একটু ঝুঁকে বসে বাতাসে হাত রাখে, যেন অতীতের স্মৃতিরা তার হাত ছুঁয়ে চলে যায়, কিংবা সে তাদের ছুঁয়ে আবার একবার অনুভব করে, ঠিক যেমন ভাবে ছোটবেলায় এক কাপ গরম দুধ খেতে খেতে জানালা দিয়ে বাইরের কুয়াশা দেখত—জানি না কবে ফিরে আসবে।

রাতে হোস্টেলের ঘরে ফিরে এসে ঋত্বিক ফোনটা হাতে নিল, মায়ের নাম্বারটা দেখে কিছুক্ষণ আঙুল থেমে রইল। তারপর টাইপ করল, “কম্বলটা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়েছি মা, জানলা দিয়ে শীত ঢুকছে একটু, তবু গন্ধটা আরাম দেয়। দাদুর খাতায় আজও লিখলাম—আজ স্ট্রাইকার ছুটে গেল ঠিক যেমন ভাবে সময়ও যায়।” মেসেজটা পাঠানোর আগে থেমে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর পাঠিয়ে দিল। মিনিট দুয়েকের মধ্যে উত্তর এলো, “তুই তো গন্ধটা নিয়ে গেছিস, ঘরে এখন কিছুই নেই… তবু চেয়ারটা আর ক্যারম বোর্ডটা রেখে দিয়েছি যেমন ছিল। মনে হয়, তুই বুঝে ফেলার আগেই আমি তোকে আগলে রাখি প্রতিদিন।” চোখে জল এলো না, তবু বুকের ভিতর একটু হালকা লাগল, যেন সব অভিমান, সব দূরত্ব ধুয়ে গেল একটা বার্তায়। ঋত্বিক জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল, বাইরে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ছে ছাদের উপর, কুয়াশার মধ্য দিয়ে দূরে ক্যাম্পাসের আলো ঝলমল করছে। তার মনে হল—এই শহর, এই হোস্টেল, এই দূরত্ব—সব কিছুর মধ্যেও একটা সূক্ষ্ম সুতো রয়ে গেছে, যা তাকে আটকে রেখেছে সেই ক্যারম বোর্ডের কোণে, সেই চুপচাপ বসে থাকা বারান্দায়, আর সেই শীতের কম্বলের গন্ধে। মানুষ বড় হলে চলে যায় ঠিকই, কিন্তু তার ভেতরের শিশুটাকে যে ধরে রাখে, সে আসলে ওই পুরনো কম্বলটিই।

***

শনিবার দুপুর। হোস্টেলের করিডোরে সবাই ব্যস্ত যার যার ফোনে কথা বলায়, কেউ কেউ হেডফোনে গান শুনছে, কেউ মেসের খাবার নিয়ে হাসছে—এই নিত্যনতুন ভিড়ে ঋত্বিক একটু আলাদা, নিজের ঘরে জানালার পাশে বসে পেনসিলে টুকটাক কিছু লিখছিল। হঠাৎ ফোনটা কেঁপে উঠল—”বাবা Calling…” স্ক্রিনে এই দুই শব্দ দেখে তার বুক কেমন হালকা ধাক্কা খেল। সাধারণত মা-ই ফোন করে, বাবার থেকে বছরে এক-দুই বার, তাও দরকারে। একটু দ্বিধা নিয়েই সে কলটা রিসিভ করল, “হ্যাঁ বাবা?” ওপাশ থেকে অদ্ভুত রকম শান্ত গলা, যেন আলতো করে কানে পড়ল, “তুই কেমন আছিস রে?” ঋত্বিক কিছুটা হতবাক, “ভালো… মানে ঠিকঠাক। আপনি?” বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “আমি ঠিকই আছি। কিন্তু তোকে একটা জিনিস দেখাতে চাই। আজ দুপুরে বোর্ডটা খুঁজে বের করলাম… স্ট্রাইকারগুলো সাজিয়ে বসে পড়েছিলাম, তোর খেলাটা খুব মনে পড়ছিল।” এমন কিছু কথা, এমন এক মুহূর্ত, যার জন্য কোনও প্রস্তুতি থাকে না—ঋত্বিক যেন বিশ্বাসই করতে পারল না, এতদিন পর বাবা নিজেই ক্যারম বোর্ড খুলে বসেছেন! সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শুধু বলল, “আপনি খেললেন?” বাবা একটু হাসলেন, “একাই খেললাম, তোকে মনে করে। তারপর ভাবলাম, যদি ভিডিও কল করি… তুই যদি একটু সময় দিস, আমরা আবার একসাথে খেলতে পারি। আলাদা জায়গা থেকে, এক বোর্ড, দুই মন।”

ফোনের স্ক্রিনে বাবার মুখটা ফুটে উঠল—চশমাটা নেমে এসেছে একটু, পাশে রাখা বোর্ডটা দেখা যাচ্ছে, টেবিল ফ্যান ঘুরছে ধীরে ধীরে, জানলার পাশের পর্দাটা নড়ছে হালকা হাওয়ায়। ঋত্বিক জানালার আলোতে নিজেও বোর্ডের স্কেচ নিল টেবিলে, গুটি সাজিয়ে ফেলল, একপাশে মায়ের পাঠানো স্ট্রাইকারটা। বাবার মুখে সেই পুরনো হাসিটা নেই, কিন্তু চোখে একটা উজ্জ্বলতা—যেন এই খেলার ভিতর দিয়েই বহুদিন বাদে ছেলেটার সঙ্গে চোখ মেলানো। প্রথম স্ট্রাইক বাবার, ভিডিওর ও-পাশে শব্দ শোনা গেল, গুটি সরে গেল একদিকে—তারপর হাসতে হাসতে বললেন, “সোজা ঢুকল, দেখলি?” ঋত্বিক হেসে বলল, “স্ট্রাইকার পাল্টে ফেলেছেন বুঝি?” খেলা চলতে লাগল, দুটি ঘরের দূরত্বের ভিতর দিয়ে গুটি চলল ঠিক আগের মত, স্ট্রাইকার টুকটাক শব্দে ঘুরে বেড়াল সেই পুরনো কায়দায়। মা একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন ফোনের পিছনে, মাঝে মাঝে হেসে উঠছিলেন, হয়তো তাদের চোখে একসাথে বসা সেই ছবি আবার চোখে পড়ছিল—যেখানে একপাশে আলু চচ্চড়ি আর অন্যপাশে গুঁড়ো পাউডারে ঢাকা ক্যারম বোর্ড। হোস্টেলের ঘরটা যেন মুহূর্তের মধ্যে বাড়ি হয়ে গেল, বাবা যেন অনেকটা কাছে এসে পড়লেন, আর গুটি মারার মাঝখানে যে নিঃশব্দ ভালবাসা থাকে, সেটা আবার অনুভব করা গেল যেন জীবনের খুব গভীরে।

খেলা শেষের দিকে, বাবার গুটি বাকি একটিই, ঋত্বিকের তিনটি। বাবা একটু থেমে বললেন, “আজ তুই হারলেও আমি তোর কাছেই হেরে যাব—কারণ তুই তো দূরে থেকেও পাশে আছিস।” এভাবে কখনও কথা বলেননি বাবা, এই ভঙ্গিমা ঋত্বিক কখনও কল্পনাও করেনি। তার গলাটা ভারী হয়ে এল, ঠোঁট নড়ল না, শুধু চোখের কোনায় জমে থাকা অদৃশ্য কৃতজ্ঞতা যেন ভিডিওর পর্দা ভিজিয়ে দিল। ক্যারম খেলার গুটি তখনও ঘুরছে বোর্ডে, কিন্তু মনে হচ্ছিল অন্য একটা খেলাও চলছে—যেটা চলছে একটা বাবা ও ছেলের মধ্যে, বহুদিনের দূরত্ব, নিঃশব্দতা আর ভুল বোঝাবুঝির ভিতর দিয়ে একটা নতুন খেলার বোর্ডে, যেখানে কোনও পক্ষ হারছে না, বরং প্রতিটা মুহূর্তে কাছাকাছি চলে আসছে। খেলা শেষে ভিডিও বন্ধ করার আগে বাবা হেসে বললেন, “পরের বার স্ট্রাইকার বদলাব না, কিন্তু গুটিটা সোজা ঢুকবে—দেখিস।” ঋত্বিক জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল, বাইরে নীলচে আলো পড়ছে ছাদের গায়ে, আর সে ভাবল—এই মুহূর্তটা তার জীবনের সেই স্মৃতিগুলোর সঙ্গে মিশে থাকবে, যেগুলো রাত্রে শুয়ে পড়ার আগে মনে পড়ে যায়, ঠিক সেই কম্বলের গন্ধের মত—অদৃশ্য, অথচ একান্ত আপন।

***

ডিসেম্বরের শুরুটা হোস্টেলে বেশ হিমেল হয়ে আসে। ঘুম ভাঙার আগে নাকের ডগায় ঠান্ডা টুক করে পড়ে, হাত ধোয়ার সময় জলের কামড়ে হাতের চামড়া জ্বলে যায়, আর ক্যান্টিনের কড়াই থেকে উড়ে আসা ভাজার গন্ধ একটুখানি বাড়ির বেলার স্মৃতি টেনে আনে। ঠিক এই শীতের মধ্যেই একদিন ঋত্বিক ডাকঘরের একটা ছোট্ট খাম হাতে পেল—মায়ের পাঠানো চিঠি। হোস্টেলে ই-মেইল আর মেসেজের যুগে কেউ কাগজে চিঠি লেখে না বলেই অন্য রুমমেটরা চমকে তাকিয়েছিল। চিঠিটার খামটা একটু হলদে, কোণায় নীল কালি দিয়ে ‘স্নেহের ঋত্বিক’ লেখা। ঋত্বিক সেই লেখা দেখেই চোখ বন্ধ করে এক মুহূর্তের জন্য গন্ধ নিতে চাইল—যেন সেই চিঠিতে শুধুই শব্দ নেই, আছে রান্নাঘরের আগুনে বসা মা, দেয়ালে ঝোলানো কালো ঘড়ির কাঁটা, আর ভোরবেলার ঘুমভাঙা রোদ্দুর। সে চিঠিটা বিছানায় বসে এক নিঃশব্দতায় খুলল, ভিতরে ছিল দুটো পাতার কাগজ আর একটা ছোট কাপড়ের খণ্ড—সেই পুরনো চাদরের কোণা, যেটা সে একদিন পা দিয়ে জড়িয়ে শুতো। মায়ের হাতের অক্ষর এখনও আগের মত, বাঁকা আর বড় বড়, কিন্তু প্রতিটা লাইনে যেন শীতের কুয়াশার মধ্য দিয়ে হেঁটে আসা এক মায়াবী পাড়ার গল্প লেখা।

চিঠির শুরুতে লেখা, “আমার ঋত্বিক, তুই হয়তো এখন মোটা সোয়েটার পরেই ঘুমাস, কিন্তু তোর পুরনো কম্বলটা আজও তোর বিছানার পাশে পড়ে থাকে। শীত পড়েছে, জানালা বন্ধ রাখি এখন, তোর ঘরটা অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে। তোর বাবা মাঝে মাঝে রাতবেলা উঠে ঘরটায় এসে তাকিয়ে থাকে, বোঝা যায় না সে তোকে খুঁজছে, নাকি নিজেকেই। ওই স্টোর রুমটা মাঝে মাঝে খুলি, ধুলো মুছি—বোর্ডটার উপর হাত বোলালেই এখনও মনে হয় তুই পাশেই বসে আছিস। দাদুর গল্পের সেই নীলখাম চিঠিগুলো বের করেছিলাম, যেগুলো একসময় আমাকে লিখেছিল বর্ধমানে থাকতে। তুই বলেছিলি না, ঘরের গন্ধ হারিয়ে যায় না? ঠিক তাই। আমি তোকে কিছু গন্ধ পাঠালাম—এই চাদরের কোণায়, আমার হাতের ছোঁয়ায়, আর কাগজে লাগা একটু তেজপাতার গুঁড়োয়, যেটা তোর পছন্দের মাছের ঝোলে পড়ত। মনে আছে, ছোটবেলায় ওই গন্ধেই তুই বলতি, ‘আজ মা মেজাজ ভালো’? এখনো সেই গন্ধই রয়ে গেছে, কেবল তুই একটু দূরে।” চিঠির প্রতিটা শব্দ যেন কোনো বালিশে মাথা রাখার মতো—নরম, উষ্ণ, আর নিজের।

ঋত্বিক চোখ বন্ধ করে একটু শুয়ে পড়ল চিঠির উপরেই, বুকের কাছে রাখা কাপড়ের টুকরোটা আলতো করে ধরল। বাইরে সূর্য পড়ছে, হোস্টেলের করিডোরে ছেলেরা ব্যস্ত ফুটবল নিয়ে, হুইসেল বেজে উঠছে মাঠে, কিন্তু তার মনে হচ্ছে সে ফিরে গেছে শীতের সেই বিকেলে—যখন মায়ের হাতের চা, বাবার হাসিমুখ, আর জানালার পাশে শুয়ে থাকা ক্যারম বোর্ড তাকে একটা ছোট পাড়ার, ছোট বাড়ির খুব বড় নিরাপত্তা দিত। সে জানে, এই চিঠিগুলো সে যতই পড়ে, ততই তার ভিতর থেকে ছেলেবেলার একটা পাড়ার গন্ধ উঠবে—যেখানে মানুষজন ঠিক ৫টার সময় চুলায় পাঁপড় ভাজে, টিভিতে সিরিয়ালের শব্দ বাড়ির বাইরে পর্যন্ত শোনা যায়, আর জানলার বাইরে শুকোতে দেওয়া তোয়ালের ছায়ায় এক ছেলে গুটি হাতে ক্যারম খেলতে বসে। সেই পাড়া, সেই শীত, সেই গন্ধ আজ তার বিছানার উপর ছড়িয়ে পড়েছে—একটা মায়ের চিঠির ভাঁজে করে।

***

হোস্টেলের গেট পেরিয়ে সন্ধ্যাবেলা কুয়াশা ঢুকে পড়ে করিডোরের ভেতর, আর লাইটের আলোয় সেই কুয়াশা কেমন এক অলীক আবরণ তৈরি করে। ঋত্বিক সেই আলো-ছায়ার ফাঁকে দাঁড়িয়ে একটা ব্যাগ খুলে বের করল পুরনো ক্যারম বোর্ডটা—যেটা মা গত সপ্তাহে কুরিয়ারে পাঠিয়েছিলেন, পাশে স্ট্রাইকার, গুটি, পাউডারের প্যাকেট সব সাজানো। ওর রুমমেট সৌরভ অবাক হয়ে বলল, “দেখি? এটা তোর বাড়ির বোর্ড?” ঋত্বিক মাথা নাড়ল, চোখে একরকম গর্ব আর প্রশ্রয়, যেটা হয়তো দাদুর কাছ থেকে পাওয়া, বাবার দিকে চেয়ে শিখে নেওয়া। “এটার সাথে আমার অনেকটা সময় আটকে আছে,” সে শুধু এটুকুই বলল। নিচতলার কমনরুমটা একটু ফাঁকা ছিল সেদিন, সবাই সিনেমা দেখতে ব্যস্ত। ওরা দু’জনে বোর্ড সেট করল, একটা টেবিল টেনে এনে। পাউডার ছড়ানোর সময় স্ট্রাইকারটা ওর আঙুলে ঘুরছিল, ঠিক যেভাবে ছোটবেলায় ঘোরাত, চোখ বন্ধ করলেই মনে হচ্ছিল, পাশের ঘর থেকে মায়ের চা-এর কেটলি সিটি দিচ্ছে, বাবার খবরের কাগজ উল্টানোর শব্দ শুনতে পাচ্ছে। সৌরভ যখন প্রথম স্ট্রাইকে গুটি মারল, সে হেসে বলল, “তোকে দেখে মনে হচ্ছে তুই অনেকদিন খেলিস না, আমি কিন্তু হারাতে চাই!” ঋত্বিক হাসল, “জানিস, আমি এই বোর্ডে জিতেও কেঁদেছি, হারলেও কখনও মন খারাপ হয়নি। কারণ খেলাটা যে শুধু ক্যারম না, এটা একটা সময়… একটা গন্ধ… একটা বাড়ির ছায়া।”

খেলা চলতে লাগল—গুটি ঘুরছে, স্ট্রাইকার সরে যাচ্ছে হালকা শব্দে, পাশের টেবিলে কিছু ছেলে এসে দাঁড়াল দেখার জন্য। কেউ বলল, “ওহ, ক্লাসিক বোর্ড! আমার মামাবাড়িতে ছিল একটা!” কেউ গুটি সাজানোর ধরন দেখে মুগ্ধ। তখনই ঋত্বিক বুঝল, সে একা নয়। এই ক্যারম বোর্ড শুধু ওর নয়, ওর মতো অনেকেই নিজেদের ঘর খুঁজে বেড়ায় পুরনো জিনিসের ভেতর, কেউ স্ট্রাইকারে, কেউ গানকেসেটে, কেউ শালখানা কিংবা কাঁসার থালায়। সৌরভ এবার মারল একদম নিখুঁত স্ট্রাইক—একসঙ্গে দুটো গুটি ঢুকল। সে চিৎকার করে বলল, “Yes! দুইটা একসাথে!” সবাই হাততালি দিল। ঋত্বিক মাথা নাড়ল, কিন্তু ভেতরে তার মনটা একটুও হালকা হলো না—বরং খুব গভীর শান্তি এল, কারণ এই খেলাটা যেন এক ধরনের প্রত্যাবর্তন, তার নিজের হারিয়ে যাওয়া সময়ের সঙ্গে পুনরায় আলাপ। এই বোর্ড সে বহুদিন আগেই আলমারিতে তুলে রেখেছিল, কিন্তু বোঝেনি—এই বোর্ডই ওকে ফিরিয়ে আনবে তার সবচেয়ে আপন জায়গায়, সবচেয়ে গভীর সম্পর্কগুলোয়।

রাতটা একটু লম্বা হলো সেদিন। খেলার পর সবাই চা খেতে গেল হোস্টেলের উল্টোদিকের স্টলটায়। ঋত্বিক ব্যাগে গুটিগুলো ভরছিল, স্ট্রাইকারটা আলাদা পকেটে রেখে দিল, খুব যত্নে, যেন কোনও প্রাচীন সম্পদ। এক পাশে সৌরভ হঠাৎ বলল, “তোর মা কী সুন্দর পাঠিয়েছেন রে এত কিছু। আমি তো শুধু বলি বাড়ি থেকে চিপস দিও!” তারা হেসে উঠল। কিন্তু সেই হাসির মাঝেই ঋত্বিকের মনে হচ্ছিল, আজকের খেলাটা শুধু হোস্টেলের, বন্ধুদের বা নিজের না—এই খেলাটা সে খেলেছে তার বাবা, মা, দাদু আর ছোটবেলার সঙ্গে। প্রতিবার স্ট্রাইকার চালানোর সময়, সে যেন বাবার চোখে চোখ রাখছে, মায়ের মুখের গন্ধ পাচ্ছে, আর দাদুর গল্পে ফের ভেসে যাচ্ছে। সেই বোর্ডটা যখন হোস্টেলের ধূসর দেওয়ালে টাঙানো থাকবে, তখন তার গায়ে লেগে থাকবে একটা পরিবারের গন্ধ, একটা গল্পের ঘাম, আর একটা ছেলের ফিরে আসার কল্পনা। এবং তখনই ঋত্বিক বুঝে গেল—কিছু কিছু জিনিস হারায় না, তারা শুধুই অপেক্ষা করে—ঠিক যেমন ক্যারম বোর্ডটা কর্নারে পড়ে ছিল, যেমন মায়ের চিঠি একদিন হঠাৎ এসে পড়ে, যেমন শীতের কম্বলের গন্ধ আবার একদিন ফিরেই আসে।

***

শীতের ভোরে হোস্টেলের জানালা ধোঁয়ায় আবছা হয়ে যায়। ঘুম ভাঙে না ঠিকমতো, বরং অর্ধনিদ্রার মতো এক অবস্থায় শরীর বিছানায় এলিয়ে পড়ে থাকে, অথচ মাথার ভেতর কিছু একটা ঘোরে—কখনো বাবার গলা, কখনো মায়ের শাড়ির ঘ্রাণ, কখনো আবার দাদুর গল্পে বলা অলীক শহরের ছবি। ঋত্বিক এমন এক ভোরেই ধীরে ধীরে চোখ খুলল—ঘরের আলো নিভে আছে, কেবল জানালার ফাঁক দিয়ে হালকা নীল আলো ঢুকছে ভিতরে, আর তার মধ্যে ক্যারম বোর্ডটা পড়ে আছে এক কোণায়, যেন ঘুমিয়ে পড়েছে রাতের শেষে। হঠাৎ মনে হলো, সে যেন স্বপ্নে দেখেছে—বাড়ির বারান্দায় সে বসে ক্যারম খেলছে, আর চারপাশে ছড়ানো আছে শীতের শিশিরে ভেজা তুলোর মতো মায়া। স্ট্রাইকারটা একা ঘুরছে বোর্ডে, অথচ কেউ ঠেলেনি। দাদু একপাশে দাঁড়িয়ে হাসছেন, বলছেন, “তুই যত দূরে যা, এই গুটিগুলো তোর পথ ঠিক করে রাখবে।” ঘুম থেকে উঠে সে খাতাটা খুলল, একটা লাইন লিখল—“আজ ভোরে বোর্ডটা আমাকে ডাকল। হয়তো ফিরে যেতে বলল।” এই ‘ফিরে যাওয়া’ মানে শুধু বাড়ি ফেরা নয়, বরং সেই অনুভবটুকুতে ফেরা—যেখানে ঘর মানেই ছিল গন্ধ, স্পর্শ আর একান্ত নীরবতা।

সেই দিন সকালে ক্লাসে গেল না ঋত্বিক। একা ছাদের ধারে বসে রইল, কুয়াশা ধীরে ধীরে ঝরে পড়ছে মাথার উপর, ঘন হয়ে। পকেট থেকে স্ট্রাইকারটা বের করল—ওর প্রিয় নীল রঙের, মাঝখানে হালকা ঘষার দাগ, যেটা দাদু বলতেন “অভিজ্ঞতার দাগ”। স্ট্রাইকারটা ওর হাতের আঙুলে ঘুরতে লাগল ধীরে ধীরে, যেন একটা তাল লেগে গেছে, এক ছন্দ। ওর মনে হলো এই ঘূর্ণনের মধ্যেই তো আছে তার ছেলেবেলা, এই ছন্দেই সে একদিন বোঝে গিয়েছিল—সব কিছু ঠিকঠাক থাকলেও, যদি স্পর্শ না থাকে, তবে কিছুই জোড়া পড়ে না। স্ট্রাইকারটা এবার মাটিতে ছুঁই ছুঁই করে একটা গোল আঁকল ধুলোয়—একটা নিখুঁত আলপনা, একটা জ্যামিতিক ফুল। ঋত্বিক থমকে গেল—এটা তো ঠিক সেই দাগ, যেটা ছোটবেলায় মেঝেতে পাউডারে পড়ে যেত ক্যারম খেলার সময়, আর মা এসে হেসে বলতেন, “বোর্ডে খেলে মাটি আঁকিস কেন?” এখন আবার সেই ফুল আঁকা হলো মাটির উপর—তফাত শুধু এতদিনে সে বড় হয়ে গেছে, আর বোর্ডটা হোস্টেলের। কিন্তু বোর্ডের ছায়া তার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটে, তাকে ভোরে জাগিয়ে দেয়, আর নিঃশব্দে বলে—“তুই এখনও হারাসনি।”

বিকেলবেলা সে কমনরুমে ফিরে গিয়ে ক্যারম বোর্ডের ধারে বসে আবার গুটিগুলো সাজাতে শুরু করল। আজ আর খেলার সঙ্গী নেই, কিন্তু স্ট্রাইকার, গুটি, আর সেই পাউডারের গন্ধ—সব যেন একত্র হয়ে একটা অদৃশ্য নাড়ির মতো তাকে আবার সেই ছেলেবেলায় ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি গুটি সাজাতে সাজাতে সে মনে মনে ভাবল, বাবা এখন কি তখনকার মত চুপচাপ বসে আছেন? মা কী এখন পিঠে ঘি দিচ্ছেন? দাদু কি এখনও তার খাতায় অলিখিত গল্পের পাতায় বসে আছেন, যেখান থেকে কোনও দিনই তিনি উঠে যাননি? হঠাৎ করে এক টুকরো আলো এসে পড়ল বোর্ডের উপর, জানলার ফাঁক দিয়ে ছাদের ধুলোয় প্রতিফলিত হয়ে। সেই আলোয় সে দেখল—স্ট্রাইকারের চারপাশে সত্যিই একটা গোল বৃত্ত তৈরি হয়েছে, যেন শূন্য থেকে জন্ম নিল নতুন এক ছন্দ। সে বুঝে গেল—এই বোর্ড, এই স্ট্রাইকার, এই শীতের ভোর… সবই আসলে আলপনার মতো। একেকটা বৃত্তের মতো, যা শুরু হয় অতীতে, এবং ফিরে আসে ভবিষ্যতের ডানায় চেপে। মানুষ কখনও তা আঁকে, কখনও বোঝে, কখনও শুধু চুপচাপ তাকিয়ে থাকে। আর তার মধ্যেই সে আবিষ্কার করে—সে কতখানি ফিরে এসেছে নিজের দিকে।

***

ট্রেনটা রাত্তির তিনটে নাগাদ এসে ঢুকল স্টেশনে। জানলার কাচে জমাটবাঁধা কুয়াশা গলছিল ধীরে ধীরে, ঠিক যেন ঋত্বিকের বুকের ভার কিছুটা ফুরিয়ে আসছে। শহরটা ঘুমিয়ে, আলো-আঁধারির খেলায় পুরোনো পরিচিত মুখ গলিয়ে দিয়েছে রেললাইনের পাথরের ফাঁকে। প্ল্যাটফর্মে নেমেই একটা গন্ধ পেল সে—গরম চায়ের কাপে এলাচের মতো মায়া মেশানো, যা তাকে জানিয়ে দিল: সে ফিরে এসেছে। স্টেশন থেকে বাড়ি গিয়ে পৌঁছতে ভোর হয়ে গেল। মায়ের মুখ দরজা খুলতেই আলোয় জ্বলজ্বল করে উঠল, আর বাবা সামান্য পিছনে দাঁড়িয়ে, চোখে চশমা সঁজানো, একটাও শব্দ না করে শুধু মাথা নাড়লেন। ঘরটা সেই আগের মতোই—দেয়ালে টাঙানো পুরনো ক্যালেন্ডার, স্টোর রুমের দরজা আধখোলা, আর বারান্দার ধুলো জমে থাকা চেয়ারটায় একটা কম্বল রাখা, ভাঁজ করে। ঋত্বিক হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখল বোর্ডটা—কঠিন কাঠের গায়ে তার আঙুল ঘুরল, যেন এক বারের ছোঁয়াতেই আবার সক্রিয় হয়ে উঠল সে পুরনো বোর্ড, পুরনো প্রতিযোগিতা, পুরনো সন্ধ্যাগুলো। “খেলবি?”—বাবার এই ছোট্ট প্রশ্নটার ভিতর ছিল এক অদ্ভুত আবেগের ঢেউ, আর কোনো না বলা ক্ষমার ছায়া, যা কোনোদিন শব্দে বলা যায় না, কেবল বোর্ডে বসে বোঝা যায়।

বসার সময় বোর্ডের চারপাশে রাখা হলো গুটি, পাউডার, স্ট্রাইকার—মায়ের হাতের চা এগিয়ে দেওয়া হলো টেবিলে। বাইরের বাতাসে ধুলো উড়ছিল, কিন্তু ঘরের ভেতরে যেন এক নীরব আশ্রয়। প্রথম স্ট্রাইক করল ঋত্বিক—নিশ্ছিদ্র নিখুঁত, গুটি গড়িয়ে গেল এক কোণে। বাবা একটু চমকে বললেন, “অনেক প্র্যাকটিস করেছিস দেখি।” ও হেসে বলল, “বোর্ডটাই তো শিখিয়েছে, আপনি তো শিখতে দেননি!” মায়ের মুখে ছোট্ট হেসে পড়া, আর দাদুর খাতাটা পাশে টেবিলে রাখা, যেন তিনজনের মধ্যে চতুর্থ খেলোয়াড় তিনিও। শীতের বাতাস আস্তে আস্তে জানলা গলিয়ে ভিতরে ঢুকছে, কিন্তু কম্বলের নিচে সবাই গুটিসুটি মেরে বসে, একসাথে। প্রত্যেকটা গুটি ছুঁয়ে যাওয়ার মুহূর্তে, একেকটা পুরনো মুহূর্ত এসে পড়ছে চোখের সামনে—ঋত্বিকের প্রথম স্ট্রাইক, ছোটবেলায় হারার পর মুখ ফুলিয়ে বসে থাকা, বাবার চুপচাপ হাঁটতে হাঁটতে এক গুটি মেরে দেওয়া, আর মায়ের গম্ভীর মুখেও গোপনে গর্বের ছায়া। ঘরের বাতাসে আজ একটা শান্তি, একটা নিঃশব্দ সমাধান।

খেলা শেষ হল। বাবা জিতলেন, কিন্তু ঋত্বিক জানে—এখানে কেউ হারেনি। এই সন্ধ্যেটা ছিল সেইসব স্মৃতির প্রতীক, যেগুলো হয়তো হারিয়ে গিয়েছিল স্রোতের টানে, কিন্তু আবার খুঁজে পাওয়া গেল এক চায়ের কাপ, এক বোর্ড, আর এক টুকরো উষ্ণ কম্বলের ভিতর দিয়ে। রাত্তিরে শুয়ে পড়ার আগে মা আলনাটা ঠিক করে দিলেন, বাবার পায়ের ধাক্কায় বোর্ড একটু সরল, আর জানলার বাইরের কুয়াশা ঢুকল নিঃশব্দে। চোখ বন্ধ করার ঠিক আগ মুহূর্তে ঋত্বিক শুনতে পেল—গুটিগুলো যেন মৃদু শব্দ করছে, কল্পনায় নয়, বাস্তবে—ঠিক কম্বলের নিচে থেকে। সে জানে, এই শব্দগুলোই ওর ঘরের গান, ওর জীবনের ছন্দ, আর ওর শীতের নরম আশ্রয়। আর এই গল্প, এই সন্ধ্যা, এই ছোঁয়া—সবকিছু মিশে থাকল সেই এক অদৃশ্য বোর্ডে, যেখানে জীবন নামের খেলায় জয় মানেই ছিল একসাথে খেলা, একসাথে থাকা।

___

 

1000032877.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *