সুদীপ্তা পাল
এক
কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তে টালিগঞ্জের এক পুরনো গলিতে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট এক ফটোগ্রাফি ওয়ার্কশপ—”লেন্সস্কেপ”। একতলা, লাল ইটের পুরনো বাড়ি, যার বাইরের দেওয়ালে সাদা রঙে আঁকা ক্যামেরার স্কেচ। গলির শেষে একটি বড় অশ্বত্থ গাছের ছায়ায় ঢাকা জায়গাটা যেন আলাদা এক পৃথিবী। বাইরের কোলাহল, বাস-অটো-রিকশার শব্দ পেরিয়ে এখানে পা রাখলে যেন শহরের এক ব্যস্ত দুপুরও স্তব্ধ হয়ে যায়।
ওয়ার্কশপের ভেতরে ঢুকলেই প্রথম চোখে পড়ে দেয়ালজুড়ে সাজানো শত শত ছবি—কখনো উত্তর কলকাতার ছাদে বৃষ্টিভেজা কাপড় শুকোনোর দৃশ্য, কখনো কলেজস্ট্রিটের মোড় ঘেঁষে পুরনো বইয়ের দোকানের ছবি, আবার কখনো দক্ষিণেশ্বর ঘাটে চায়ের কাপে ধোঁয়ার রোম্যান্টিকতা। টেবিলজুড়ে ছড়ানো লেন্স, ত্রিপড, ফিল্ম ক্যামেরা আর আধুনিক DSLR-এর সমাহার। স্যাঁতসেঁতে কাঠের ঘ্রাণ আর ক্যামিকেল-ফোটো পেপারের মিশ্রিত গন্ধ যেন পুরনো কলকাতাকে নতুন চোখে দেখার ডাক দেয়।
এখানেই একদিন প্রথম পা রাখল শ্রাবণ। সে অন্তর্মুখী, কিছুটা চুপচাপ, আত্মস্থ। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, গায়ে মাটি রঙা শার্ট, আর কাঁধে ঝোলানো বাবার পুরনো Nikon D90 ক্যামেরা। ও খুব একটা মানুষজনের সঙ্গে মিশে না। একা চলতে ভালবাসে।
শ্রাবণের ফটোগ্রাফির প্রতি ভালবাসা তার ছোটবেলা থেকেই। সে বলত না, দেখত। পাড়ার রঙচঙে ঠাকুরদালান, দুপুরবেলার খালি রাস্তা, বৃষ্টির জলে ভেসে যাওয়া কাগজের নৌকা—সবকিছুর মধ্যেই সে খুঁজে নিত এক নিজস্ব ভাষা। এই ভাষা প্রকাশ করত তার ক্যামেরা। ওর মতে, ক্যামেরা শুধু ছবি তোলে না, অনেকটা নিজের মনের আয়না—যেখানে সে দেখতে পায় নিজের অনুভব, ভয়, ভালোবাসা।
ওয়ার্কশপের প্রথম দিন শ্রাবণ গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। ভিতরে ঢুকবে কি না, সেটা নিয়ে একটু দ্বিধায় ছিল। ভেতরে তখন চলছে পরিচিতি পর্ব, হাসাহাসি, কফি আর পরিচয়ের আনুষ্ঠানিক গন্ধ। অবশেষে প্রশিক্ষক অনীকদা ওকে দেখে বলল, “এই যে নতুন ছেলে, এসো, বসো। তোমার নাম কী?”
শ্রাবণ একটু হকচকিয়ে গেলেও আস্তে করে বলল, “শ্রাবণ। শ্রাবণ দত্ত।”
ছোট্ট হেসে বসে পড়ল পেছনের সারিতে, জানালার ধারে। আলো তার মুখে পড়ল না, সেটাই যেন ও চায়। বাইরের রাস্তায় একটা ট্যাক্সি হর্ণ দিয়ে চলে গেল, কিন্তু শ্রাবণ তাকিয়ে রইল জানালার বাইরে।
ঠিক তখনই প্রথম বার ঢুকল তিতির। ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই যেন এক ঝলক রোদ ঢুকল সেই ঘরে। ওর চোখে ছিল অদ্ভুত উজ্জ্বলতা, চুলগুলো খোলা, একটা সাদা-হলুদ প্রিন্টেড কুর্তি পরা, আর গলায় ঝোলানো একটা Canon EOS 200D। ওর হাঁটার মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাস ছিল, যা শ্রাবণ মুগ্ধ হয়ে দেখল।
তিতির ঢুকেই বলল, “Sorry দেরি হয়ে গেল। কলেজ থেকে বেরোতে অনেক সময় লাগল।”
সবাই হেসে উঠল। প্রশিক্ষক বললেন, “ঠিক আছে, বসো। আমরা এখন ফটোগ্রাফির মুড নিয়ে কথা বলছি।”
তিতির গিয়ে বসল শ্রাবণের সামনের সারিতে। ওর পিঠজোড়া চুল মাঝে মাঝে শ্রাবণের চোখে পড়ে, মাঝে মাঝে উড়েও যায় তার চশমার কাচে। শ্রাবণ বুঝতে পারে, এই মেয়েটা অন্যরকম। খুব অন্যরকম।
ওয়ার্কশপের ক্লাস শুরু হয়—প্রথমদিন লেন্সের ধরণ, আলো ব্যবস্থাপনা, ফোকাল লেন্থ নিয়ে আলোচনা। সবাই প্রশ্ন করে, মত দেয়। শ্রাবণ চুপচাপ শোনে। কিন্তু তার চোখ সবসময় ঘুরে ফিরে যায় তিতিরের দিকে।
তিতির কথা বলে, হাসে, মাঝেমাঝে প্রশিক্ষকের কথা শুনে ছবি আঁকার মতো কল্পনা করে। সে বলে, “আমি ছবি তুলি কারণ মানুষের মুখে গল্প থাকে। চোখে থাকে ব্যথা। আমি সেটা ধরতে চাই।”
শ্রাবণ প্রথমবার অনুভব করল, কেউ তার মতোই ছবি দেখে, কিন্তু প্রকাশ করে একেবারে উল্টোভাবে। সে বোঝে, তিতির আলো ভালবাসে, শ্রাবণ ছায়া। তিতির ফ্রেমের সামনে যেতে ভালবাসে, শ্রাবণ পিছনে থাকতে চায়।
ক্লাস শেষ হওয়ার পর সবাই নিচে গিয়ে চা খাচ্ছে, আড্ডা দিচ্ছে। শ্রাবণ ছাদের দিকে পা বাড়ায়। সে জানে, ওইখানেই পাওয়া যাবে নিঃসঙ্গ আলো। হঠাৎ কাঁধে একটা শব্দ। “তুমি না শ্রাবণ?”
সে ঘুরে দাঁড়ায়। তিতির। হাসছে। হাতে ধরা ক্যামেরা।
“তুমি কিছু ছবি তুলছো?” – প্রশ্ন তিতিরের।
“না, শুধু আলো দেখছিলাম।”
“আলো? মানে?”
“এই সময়টায় ছাদের কোনায় একটা নির্দিষ্ট ছায়া পড়ে। সেটা দেখি। অন্যরকম লাগে।”
তিতির কৌতূহলী চোখে তাকায়। “তুমি ছায়া ধরতে চাও?”
শ্রাবণ একটু হেসে বলে, “আলো যেখানে ছায়া সৃষ্টি করে, ওটাই সবচেয়ে সত্যি।”
তিতির একটু থেমে, এবার নিজের ক্যামেরাটা ওপরে তোলে। বলল, “একটা ছবি তুলব তোমার?”
শ্রাবণ একটু কুণ্ঠিত হয়। “আমি ছবি তুলতে ভালোবাসি, তোলা হতে নয়।”
তিতির ক্যামেরা নামিয়ে বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু জানো, আমার ক্যামেরার মেমোরিতে অনেক মুখ থাকে, কিন্তু একটাও আমার নিজের না।”
সেদিন ছাদের কোণায় দাঁড়িয়ে শ্রাবণ তিতিরের দিকে তাকিয়ে ছিল। আলো তার চুলে পড়ছিল, চোখে কৌতূহল, ঠোঁটে একটি প্রশ্নচিহ্ন। ঠিক তখনই সে প্রথমবার ক্যামেরা তোলে। নিজের অজান্তেই ক্লিক করে বসে।
ডিজিটাল স্ক্রিনে ফুটে ওঠে সেই মুহূর্ত। সাদামাটা, অনাড়ম্বর, অথচ তীব্র। শ্রাবণ জানে না কেন, কিন্তু মনে হলো সে যেন এই ছবিটা অনেক আগে থেকেই তুলতে চাইছিল। হয়তো জন্ম থেকে।
ওয়ার্কশপের সেই প্রথম দিন ছিল এক নির্জন কবিতা—যেখানে শব্দ ছিল না, ছিল শুধু আলোছায়ার খেলা, অজান্তে জন্ম নেওয়া এক নিরব অনুভব।
এভাবেই শুরু, শ্রাবণ আর তিতিরের গল্প। এক ক্যামেরার লেন্স দিয়ে দেখা প্রথম প্রেমের সূচনা।
দুই
কলকাতার শরৎকাল যেন কোনও আলোকচিত্রীর স্বপ্ন। নীল আকাশ, পেঁজা তুলোর মতো মেঘ, আর রোদের ঝলকানি যেন প্রতিটি দৃশ্যকে একটি চিত্রপটে পরিণত করে। এই শহরে হাঁটলেই ক্যামেরা তুলে ধরার মতো মুহূর্ত তৈরি হয়ে যায়—রাস্তার ধারে ফুল বিক্রি করা কাকিমা, কোনো ফুচকার দোকানে ভিড় জমিয়ে থাকা বাচ্চারা, বা হঠাৎ একটা খোলা জানালা দিয়ে আসা রোদ্দুরে ধরা একটি বিড়ালের খেলা।
ফটোগ্রাফি ওয়ার্কশপ ‘লেন্সস্কেপ’-এর দ্বিতীয় সপ্তাহ ছিল ‘স্ট্রিট ফটোগ্রাফি’-র জন্য নির্ধারিত। ক্লাসে ঘোষণা হতেই উচ্ছ্বাসে ভরে উঠল সবাই। পনেরোজনের দল ভাগ হয়ে গেল তিনটি গ্রুপে। গন্তব্য—কালীঘাট, প্রিন্সেপ ঘাট আর গড়িয়াহাট। শ্রাবণ আর তিতির এল একই দলে, যারা যাবে গড়িয়াহাটে। শ্রাবণের মনে হলো অদ্ভুত এক প্রশান্তি। যেন চোখ বুজে বলা যায়, ভাগ্য এঁকে দিয়েছে এই মুহূর্ত।
সকাল ন’টা। গড়িয়াহাট মোড়ে ক্যামেরা কাঁধে ঘোরাঘুরি শুরু। তিতির একটার পর একটা ফ্রেম ধরে ফেলছে—সবজির দোকানে হাত ছুঁইয়ে দাম জিজ্ঞেস করা এক বৃদ্ধা, রাস্তার ধারে অ্যালুমিনিয়ামের গ্লাসে গরম চা ঢালছেন এক দোকানি, আর ফুটপাথের ধারে বসে থাকা এক বইওয়ালা যার চারপাশে হাজারো গল্প।
শ্রাবণ সবসময় তিতিরের এক দু-পা দূরত্বে থেকেছে। সে ছবি তুলছে ঠিকই, কিন্তু তার লেন্স বারবার ঘুরে পড়ছে তিতিরের মুখে, চোখে, হাতের ভঙ্গিতে, ক্যামেরা ধরার ভঙ্গিমায়। মাঝে মাঝে সে ক্লিক করে ফেলছে, চুপিচুপি, নিজের অজান্তেই। যেন ছবি তুলছে না, নিজের মনকেই চুরি করছে।
তিতির হঠাৎ ঘুরে তাকায়, “তুমি কি আমার ছবি তুলছো?”
শ্রাবণ কিছুটা চমকে যায়। একটু থেমে বলে, “না, মানে… হ্যাঁ… মানে তুই… মানে তুমি ক্যামেরা ধরার সময় খুব সুন্দর লাগে দেখতে।”
তিতির হেসে ফেলে। “তুমি বেশ চুপচাপ। কিন্তু ক্যামেরা দিয়ে ঠিকই কথা বলো।”
শ্রাবণ নিচু চোখে হাসে। “ক্যামেরা হলে আমি কথা বলতে পারি।”
তারা একসঙ্গে হাঁটে, চায়ের দোকানে দাঁড়ায়, আলো-ছায়া দেখে।
এক দোকানে দাঁড়িয়ে তিতির একটা ছেঁড়া কাগজের উপরে চোখ রাখে। সেখানে লেখা—“চোখে চোখ পড়লেই ছবি উঠে যায়।”
তিতির বলল, “এই কথাটা সত্যি, জানো?”
শ্রাবণ প্রশ্ন করল, “মানে?”
“যখন তুমি কারো চোখে তাকাও আর মনে হয়, এ তো একটা গল্প—তখনই তো সেটাই সবচেয়ে ভালো ফ্রেম।”
শ্রাবণ বুঝতে পারে, তিতিরের চোখেও হয়তো গল্প লেখা থাকে। সে চুপচাপ ক্যামেরা তোলে আর একবার ক্লিক করে।
এইভাবে তারা কাটিয়ে দেয় তিন ঘণ্টা। দুপুর গড়িয়ে বেলা পড়ে আসে। ওয়ার্কশপের নিয়ম অনুযায়ী সবার ছবি জমা দিতে হবে সেই সন্ধ্যেতে।
ওয়ার্কশপে ফিরে সবাই ছবি সাজাতে ব্যস্ত। কেউ Lightroom-এ কালার কারেকশন করছে, কেউ Photoshop-এ ফ্রেম টানছে। তিতির নিজের তোলা পনেরোটি ছবি সাজিয়ে বলল, “এই একটাই মিসিং… আজ একটা ছোট্ট মেয়ের চোখে কিছু ছিল, কিন্তু ক্লিক করার আগেই হঠাৎই ক্যামেরা বন্ধ হয়ে গেল।”
শ্রাবণ ধীরে এসে বলল, “তোমার চোখে ঠিক ছিল… আমি সেই মুহূর্তটা পেয়েছিলাম।”
সে নিজের ক্যামেরা থেকে সেই ছবিটা দেখায়। এক ছোট্ট মেয়ে—হলুদ জামা, চোখে বিস্ময়, যেন কিছু হারিয়েছে আবার খুঁজে পেয়েছে।
তিতির ধীরে ছবিটার দিকে তাকায়। দীর্ঘক্ষণ। “তুমি তো শুধু ফ্রেম খুঁজো না, অনুভব ধরো।”
শ্রাবণ কিছু বলে না। তার মনের ভিতরে যেন এক অজানা ঢেউ খেলছে।
চলে আসে সন্ধ্যা। অনীকদা সবাইকে ছবি দেখাতে বলে। একে একে সবাই নিজেদের কাজ দেখায়। প্রশংসা পায়। আলো, রঙ, সময়—সবকিছুর মধ্যে দিয়ে যাচাই হয় ছবি।
তিতিরর ছবিগুলোতে জীবন থমকে আছে—হাসি, কথা, ব্যস্ততা, ক্লান্তি। শ্রাবণের ছবিগুলোতে নীরবতা—এক বৃদ্ধের একাকিত্ব, একটা খোলা জানালায় উড়তে থাকা পর্দা, আর একটি ফ্রেম…
সবাই থেমে যায়, এক মুহূর্তে।
তিতিরের ক্যামেরায় তোলা শ্রাবণের ছবি—তিতিরের একটা মুহূর্ত—হালকা আলোতে চুল উড়ছে, চোখে সুর, ঠোঁটে অভিমান।
অনীকদা বলে উঠলেন, “এই ফ্রেমটা কার?”
শ্রাবণ ধীরে হাত তোলে। সবাই চুপ। প্রশিক্ষক বলেন, “এই হলো ব্যক্তিগত দৃষ্টি। যেখানে ক্যামেরা আর চোখ একসঙ্গে হৃদয়ের ভাষা বলে।”
তিতির কিছু বলে না। কিন্তু তার চোখ দুটো যেন শ্রাবণকে বলে, ‘আমি বুঝেছি।’
সেই রাতে শ্রাবণ বাড়ি ফিরে অনেকক্ষণ ছাদে বসে থাকে। শহর ঝিমিয়ে পড়েছে। তিতিরের হাসি যেন তার মাথার মধ্যে ঘুরে ঘুরে বাজছে।
সে ভাবে, ‘আমি কথা বলি না। কিন্তু তোর প্রতিটি মুহূর্ত আমি সংরক্ষণ করি।’
আর অন্যদিকে, তিতির নিজের ক্যামেরার ছবিগুলোর ফোল্ডার খুলে একটা সাবফোল্ডার করে—“ছেলেটা, যে ছায়া ভালোবাসে।”
সেই মুহূর্তে জন্ম নেয় আরও গভীর কিছু—কোনো ঘোষণা ছাড়াই, শব্দহীন, কিন্তু তীব্র।
তিন
ওয়ার্কশপের তৃতীয় সপ্তাহের থিম—’Portrait & Emotion’। এই পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের শেখানো হচ্ছে কীভাবে মানুষের মুখের রেখায়, চোখের ভাষায়, কিংবা হাতের নড়াচড়ায় অনুভবের গভীরতা ধরা যায় ক্যামেরার ফ্রেমে। ক্লাসে অনীকদা বলেছিলেন, “মানুষের মুখ যত না ছবি, তার চেয়ে অনেক বেশি গল্প।”
সেই সপ্তাহের ক্লাস ঘরোয়া আঙ্গিকে শুরু হয়। দক্ষিণ কলকাতার একটি পুরনো বাড়ির ছাদের ঘর ভাড়া নিয়ে সেখানে অস্থায়ী স্টুডিও তৈরি করা হয়েছে। হলুদ রঙের কড়ি-বরগার দেওয়াল, এক কোণে পেতলের জলপাত্র, আর জানালা দিয়ে ছড়িয়ে থাকা নরম আলো—এ যেন একটি ক্যানভাস নিজেই।
সকাল থেকে শ্রাবণ আর তিতির সেখানে কাজ করছে, সঙ্গে আরও কয়েকজন। তারা আলোর দিক বুঝে কেমন করে ফ্রেম সাজাতে হয়, কীভাবে সাবজেক্টকে আরামদায়ক পরিবেশে আনতে হয়, এসব চর্চা করছে।
তিতির, বরাবরের মতো প্রাণবন্ত। তার ক্যামেরা যেন মানুষের মুখ পড়ে নিতে পারে। সে কয়েকজন সহপাঠীর পোট্রেট তোলে, প্রতিটির মধ্যে ভিন্ন মুড—একটা কৌতূহল, একটা লজ্জা, একটা দুঃখ।
অন্যদিকে শ্রাবণ আজও চুপচাপ। সে খুব বেশি ছবি তোলে না। তিতিরের আশেপাশে ঘোরে, তার ক্যামেরা ব্যবহার দেখে। সে যেন তার চোখ দিয়েই পৃথিবী দেখতে চায়।
হঠাৎই অনীকদা বলে ওঠেন, “শ্রাবণ, আজ তুই একটু ক্যামেরার সামনে আয়। তিতির তোর পোট্রেট তুলুক।”
শ্রাবণ চমকে ওঠে, “আমি?… মানে আমি তো তুলতে পারি, সামনে দাঁড়াতে অস্বস্তি লাগে।”
তিতির হেসে বলে, “আমি তোদের পোট্রেট তুলতে চাই, মুখ নয়—ভিতরটা।”
শেষমেশ শ্রাবণ বসে পড়ল জানালার ধারে। পেছনে আলো পড়ছে কাঁধের ওপর, চোখের কোণে হালকা ছায়া। তিতির ফোকাস সেট করে বলে, “চোখে তাকাও। নিজেকে ভেবো না, ভাবো সেই মানুষটাকে—যাকে তুমি দেখতে চাও, কিন্তু বলতে পারো না।”
শ্রাবণ তাকায়। সোজাসুজি তিতিরের দিকে। মুহূর্তটা থেমে যায়। তিতির ক্লিক করে। পরপর কয়েকবার।
পরে কম্পিউটারে ছবিগুলো দেখা হয়। সবাই ছবি দেখে। কিন্তু একটি ছবি নিয়ে পুরো ক্লাস স্তব্ধ।
ছবিটিতে শ্রাবণের চোখে কিছু ছিল—অভিমান, আকর্ষণ, বলা না-বলা কথা, আর গভীর এক আকাঙ্ক্ষা।
অনীকদা বললেন, “এই একটা ফ্রেম বলছে—কোনো শব্দের দরকার নেই প্রেম বোঝাতে।”
তিতির কিছু বলে না, শুধু মন দিয়ে ছবিটা দেখে। মনে মনে ভাবে, “এই ছেলেটা কি তবে আমাকেই খুঁজে ফিরছে?”
সন্ধ্যাবেলায় শ্রাবণ একা ছাদে বসে। তিতির কাছে আসে, হাতে সেই ছবির প্রিন্ট।
“তুমি জানো, আমি যখন ছবি তুলি, নিজেকে ভুলে যাই। কিন্তু আজকে এই একটা ফ্রেমে তুমি নিজেকে পুরোটা দিয়ে দিয়েছিলে। আমার ক্যামেরায় তুমি ছিলে একেবারে খাঁটি।”
শ্রাবণ নিচু গলায় বলে, “তুমি বলেছিলে, ভাবো সেই মানুষটাকে… আমি তো ভাবিনি, আমি দেখছিলাম—তোমাকে।”
তিতির থমকে যায়। চুপ করে। তারপর ধীরে হেসে বলে, “তুমি শুধু ক্যামেরায় নয়, কথা বলতেও শিখে গেছো।”
শ্রাবণ একটু লাজুকভাবে চোখ নামায়।
“আমার একটা প্রোজেক্ট আছে,” তিতির বলে, “পরের সপ্তাহে ফাইনাল জমা দিতে হবে। থিম: ‘Unspoken’—অর্থাৎ, যা বলা হয়নি, কেবল অনুভব করা গেছে। আমি চাই তুমি আমার মডেল হও। এই ফ্রেমটা অসম্পূর্ণ, তাকে শেষ করতে হবে।”
শ্রাবণ অবাক হয়। “আমি? কিন্তু কেন?”
“কারণ, তুমিই সেই অনভিপ্রেত ভাষা, যা ক্যামেরা বোঝে। যাকে বলা যায় না, কেবল ধরা যায়।”
পরের দিন বিকেলে তারা যায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পাশে এক পুরনো পরিত্যক্ত বাগানবাড়িতে। রোদ আর ছায়ার খেলা চলছে। বাতাসে ভেসে আসছে শুকনো পাতার গন্ধ।
তিতির ক্যামেরা সেট করছে। শ্রাবণ দেয়ালের ধারে দাঁড়িয়ে, মুখে এক অদ্ভুত শূন্যতা। সেই শূন্যতার মধ্যেই যেন সঙ্গ, অভিমান আর অনুরাগ গলে আছে।
তিতির বলল, “চোখ বুজো। ভাবো, তুমি কাউকে বলতে চাইছো—থেমো না, থেকো আমার সঙ্গে।”
শ্রাবণ চোখ বন্ধ করে। তিতির ক্লিক করে ফেলে কয়েকটা ফ্রেম। একবার, দু’বার… তারপর হঠাৎ বলে ওঠে, “চোখ খোলো।”
শ্রাবণ চোখ খোলে। সামনে তিতির দাঁড়িয়ে, ক্যামেরা নামিয়ে রেখেছে। মুখোমুখি।
“তুমি জানো?” সে ধীরে বলে, “তুমি আমার জীবনের প্রথম ‘অন্যরকম’ ফ্রেম। তুমি আলো আর ছায়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা একটা অস্পষ্ট স্বপ্ন, যাকে আমি প্রতিদিন ধরে ফেলতে চাই।”
তিতির ধীরে এগিয়ে আসে, “আর তুমি আমার সেই চরিত্র, যাকে আমি প্রথম দেখাতেই ঠিক করে ফেলেছি—এই গল্পটা ওকে নিয়ে হবেই।”
শ্রাবণ একটু থেমে বলে, “তবে কি আমাদের গল্পের নাম হবে—‘Unspoken’?”
তিতির হাসে, “না। আমাদের গল্পের নাম হবে—‘প্রথম প্রেম’, কারণ আমি তো ক্যামেরায় প্রথম প্রেমটাই খুঁজছিলাম সবসময়।”
ঝিরঝিরে হাওয়া বয়ে যায়। ক্যামেরা বন্ধ। আলো পড়ে তাদের মুখে। চোখে। দুজনের মাঝে কোনো কথাই আর দরকার পড়ে না।
শুধু রয়ে যায় সেই অনুভব, যা আলোছায়ার রঙে ধরা থাকে চিরকাল।
চার
পরীক্ষার দিন শেষ হয়েছে। কলেজ ক্যাম্পাসে সেই পুরোনো ভিড় নেই। গাছপালার ফাঁকে রোদের ছায়া যেন লুকোচুরি খেলছে, ঠিক যেমন তিতির আর শ্রাবণের ভেতরকার অনুভবগুলো এক অদ্ভুত লুকিয়ে রাখা আবেগে বাঁধা পড়ে আছে।
তিতির ধীরে হাঁটছে। তার হাতে ক্যামেরা নেই আজ। বরং সে নিজেকে খুঁজছে, নিজের ভেতরের ক্যামেরায়। শ্রাবণ তার পাশে পাশে হাঁটে, কিন্তু কথা বলছে না। দু’জনের মধ্যেকার নীরবতা যেন আরও ঘন হয়ে উঠেছে।
“তুই আজ চুপ কেন রে?” তিতির প্রথমে বলল।
শ্রাবণ তাকাল। একটু সময় নিয়ে বলল, “চুপ না… শুধু ভাবছিলাম, তোর ভিউফাইন্ডারে আমি কোথায় দাঁড়িয়ে আছি।”
তিতির হেসে ফেলল। “ভিউফাইন্ডারে সব কিছু স্পষ্ট দেখা যায় না শ্রাবণ। কিছু কিছু জিনিস বোঝা যায়, ফোকাসের বাইরেও।”
তারা পৌঁছল কলেজের পেছনের ঘাসের মাঠে। ক্লাসরুমের বাইরের এই নিরিবিলি জায়গায় তারা অনেকদিন ছবি তুলেছে, অনেক গল্প হয়েছে। আজ এখানে এসে শ্রাবণ থেমে দাঁড়াল।
সে বলল, “তোর সাথে ছবি তুলতে গিয়ে আমি অনেক কিছু শিখেছি, তিতির। ক্যামেরা তো একটা বাহানা ছিল। আসলে তোর চোখের আলো, তোর একাগ্রতা, এসবের মধ্যে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।”
তিতির কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর ব্যাগ থেকে একটা ছোট প্রিন্ট করা ছবি বের করে শ্রাবণের দিকে বাড়িয়ে দেয়।
ছবিটা সেইদিনের—যেদিন শ্রাবণ ঘাড় ঘুরিয়ে দাঁড়িয়েছিল গঙ্গার ধারে, হালকা বিকেলের আলোতে তার মুখটা আধা ছায়া-আলোয় ঢাকা।
“এই ছবিটা আমি কখনই পোস্ট করিনি কোথাও,” তিতির বলল। “শুধু নিজের জন্য রেখেছিলাম। কারণ এটা আমার চোখ দিয়ে তোকে দেখার ছবি।”
শ্রাবণের গলা শুকিয়ে আসে। তার দৃষ্টিতে একধরনের বিস্ময় আর প্রশংসা একসাথে খেলা করে।
তিতির বলল, “আমি জানি না তুই কী ভাবিস আমার সম্পর্কে। কিন্তু তোর সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত আমার কাছে বিশেষ। তুই যদি একদিন হারিয়ে যাও, আমি এই ছবিগুলো দেখেই তোকে খুঁজে নেবো।”
শ্রাবণ ধীরে বলে, “আমি হারাবো না। অন্তত তোর লেন্সের বাইরে কখনও না।”
সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে। গাছের পাতা দিয়ে আলোর ছায়া ফুরিয়ে যাচ্ছে। তবু তারা দাঁড়িয়ে থাকে পাশাপাশি, যেন অপেক্ষা করছে সেই মুহূর্তটার জন্য—যখন শব্দের দরকার হবে না, শুধু চোখের ভাষা বলবে সব কথা।
এভাবেই, এক নীরব অথচ উজ্জ্বল বন্ধনের ভিত গড়ে ওঠে।
পঞ্চম
দক্ষিণ কলকাতার সেই শীতের সকালটা যেন খানিক বেশি রোদেলা। ফটোগ্রাফি ওয়ার্কশপ শেষ হলেও শ্রাবণ আর তিতিরের সম্পর্ক যেন ঠিক সেখানেই থেমে থাকেনি। শেষ দিনের “City Solitude” প্রজেক্টের পর থেকে তাদের দেখা না হলেও, প্রতিদিন হোয়াটসঅ্যাপে দু-একটা মেসেজ, ক্যামেরা নিয়ে আলোচনা, আর মাঝে মাঝে কোনো পুরোনো ছবি নিয়ে নতুন কথা—এইভাবেই এগোচ্ছে তাদের যোগাযোগ।
তিতির আজ প্রথমবারের মতো নিজে থেকেই শ্রাবণকে মেসেজ করে—“আজ একটু দেখা যাবে? এক জায়গায় নিয়ে যেতে চাই।”
শ্রাবণ অবাক হয়। তিতির নিজে দেখা করতে বলেছে, এটা আগে কখনও হয়নি। তার বুকের মধ্যে যেন ক্যামেরার শাটারের মতো এক ঝটকা লাগে। সে মেসেজ করে, “ঠিক আছে। কোথায় দেখা করব?”
তিতির: “হাজারদুয়ারি স্টুডিওর পেছনের ছোট ছাদটা মনে আছে? ওখানে।”
শ্রাবণ ভাবতেই পারে না তিতির তাকে সেই গোপন ছাদের কথা বলছে, যেখানে তাদের একবারই যেতে হয়েছিল প্রাকটিকাল শ্যুট করতে, আর তারপর দুজনে একসঙ্গে চুপ করে বসেছিল। সেখানে একটা ছোট লোহার চেয়ার ছিল, আর একপাশে ভাঙা পানির ট্যাঙ্ক। কিন্তু ওই ছাদেই তাদের নিঃশব্দ বন্ধুত্বের আসল শুরু।
সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটা। শহরের আলো ধীরে ধীরে জ্বলে উঠছে। ছাদে বাতাস বইছে হালকা ঠান্ডা। তিতির আগে থেকেই এসে বসে আছে। তার পরনে হালকা সাদা শাল, এক হাতে ক্যামেরা, আর চোখে একরাশ অপেক্ষা।
শ্রাবণ ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে ওঠে। তিতির তাকায়, মৃদু হাসে, “তুমি ঠিক সময়ে এসেছো। আজকের আলোটা দারুণ।”
শ্রাবণ বলে, “তুমি আমায় এখানে ডেকে এনেছো আলো দেখতে?”
তিতির হাসে, “না। তোমার সঙ্গে আলোটা ভাগ করে নিতে।”
তারা পাশাপাশি বসে। নিচে শহরের শব্দ আসে—হর্ন, ট্রামের ঘণ্টা, অটোওয়ালার গলা। কিন্তু ছাদে যেন এক নিঃশব্দ আশ্রয়।
তিতির ধীরে বলে, “তুমি জানো শ্রাবণ, আমি যাদের ছবি তুলি, তারা কেউ জানে না আমি আসলে কী খুঁজছি তাদের মুখে। একটা প্রকাশ, একটা নিজস্বতা, যা বলে—‘আমি আছি, কিন্তু বোঝাও যায় না।’”
শ্রাবণ চুপ করে শোনে।
তিতির আবার বলে, “তুমি সবসময় আমার ছবি তুলতে, অথচ কখনো কিছু বলতে না। আমি ভাবতাম তুমি শুধু আমায় সাবজেক্ট ভাবো। এখন বুঝি, তুমি আমায় গল্প ভাবতে শিখিয়েছিলে।”
শ্রাবণ ধীরে বলে, “তুমি তো নিজেই একটা গল্প, তিতির। প্রতিটি লেন্স তোমার মধ্যে নতুন কিছু খুঁজে পায়।”
তিতির এবার একটু কাছে সরে আসে। “তুমি জানো, আমি একটা নতুন সিরিজ শুরু করেছি, নাম দিয়েছি ‘আলোর নিচে’।”
“তাতে কী থাকবে?”
“তুমি। শুধু তুমি।”
শ্রাবণ চমকে তাকায়। তিতির তার চোখে চোখ রাখে। “এই আলোটা, এই শহরটা, এই প্রতিটি ক্লিকের মুহূর্ত—সবকিছুর মধ্যে এখন তুমি আছো। আমি আর ছবি তুলতে গিয়ে অন্য কাউকে খুঁজে পাই না। শুধু তোমাকেই খুঁজে ফিরি।”
—
সেই মুহূর্তে শ্রাবণ যেন বুঝে যায়, তার নিঃশব্দ ভালোবাসা আজ শব্দে রূপ পেল। সে ধীরে হাত বাড়িয়ে তিতিরের আঙুল ছুঁয়ে বলে, “আমার ক্যামেরার মেমোরি কার্ডে আজ পর্যন্ত ৭৪৩টা ছবি তোলা হয়েছে। তার মধ্যে ৭৩৮টা ছবিই তোমার। বাকি ৫টায় আমি পরীক্ষা করছিল ফোকাস।”
তিতির হেসে ফেলে। “তাহলে আমিই তোমার ফোকাস।”
শ্রাবণ বলে, “তুমি আমার লেন্স। যেটার ভেতর দিয়ে আমি পৃথিবী দেখি।”
তারা একসঙ্গে তাকিয়ে থাকে আলোর দিকে—যেখানে শহর আর ছাদ মিশে গেছে একটা উষ্ণতায়।
ষষ্ঠ
কলকাতার সন্ধ্যার আকাশ এখন গাঢ় নীল আর ধূসর মিশ্রিত, শহরের ধোঁয়াটে আলো গাছপালার পাতা আর পুরোনো ইটের দেয়ালের ওপর হালকা ফাঁটল দিয়ে পড়ছে। দক্ষিণ কলকাতার সেই ছোট্ট কফি শপের বাইরে, যেখানে বহুবার শ্রাবণ আর তিতির বসেছিল, আজও ঠান্ডা বাতাস বইছে।
তিতির এক কোণে বসে আছে, হাতের পাতায় ক্যামেরার স্ট্র্যাপের ঠাণ্ডা স্পর্শ অনুভব করছে। সে দেখছে শ্রাবণকে, যে চুপচাপ বসে তার পুরনো লেন্সের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। মাঝে মাঝে সে ক্যামেরার কাঁচা লেন্স ঘেঁটে পরীক্ষা করছে যেন কোনো ভুল বা ময়লা ধরা পড়ে না। তবে চোখে সেই মনোযোগের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক অদ্ভুত উন্মাদনা।
তিতির মুখে অল্প হাসি নিয়ে বলে, “শ্রাবণ, কখনো ভেবেছো, আমরা শুধু ছবি তোই না, গল্পও বলি?”
শ্রাবণ একটু থেমে হালকা একটা হাঁসি দিয়ে উত্তর দেয়, “গল্প? তিতির, আমার ক্যামেরার কাজটা তো সেই গল্পকে ধরে রাখা — কথা নয়, চোখের ভাষায়।”
তিতির চোখ মেলে শ্রাবণের দিকে দেখে, “তুমি জানো, আমি সারাদিন ছবি তুলি—আমার ক্যামেরা প্রায়শই অন্যদের মুখে হাসি ধরে রাখে। কিন্তু তুমি? তুমি শুধু আমার দিকে তাকাও, শুধু আমার ছবি তোলো। কেন?”
শ্রাবণ একটু লাজুক হয়ে চোখ নামিয়ে ফেলে, “কারো ছবি তোলা মানে তার মনের কথা পড়া। তোমার মনের কথা পড়তে চাই আমি।”
বাতাসের আছাড়ে কফি শপের বাইরে ঝাড়গাছের পাতা কাঁপতে থাকে, আর সেই কাঁপুনি যেন দুজনের মধ্যকার দূরত্ব কমিয়ে দেয়।
“তুমি জানো, আমি অন্তর্মুখী,” তিতির হালকা গলায় বলে, “আর তুমি প্রাণবন্ত, কিন্তু তুমি আমাকে বুঝতে পারো, এমন কেউ খুব কমই আছে।”
“তাহলে ভাবো,” শ্রাবণ বলে, “আমি যদি তোমার ছবির মধ্যে না থেকে, বরং তোমার জীবনের গল্পের একটা অংশ হই?”
তিতিরের চোখে কিছু প্রশ্ন উঠে, কিন্তু কোনো শব্দ বের হয় না। তার মনের ভিতর একটা ঝড় উঠতে থাকে—সঙ্গে একটি আশা।
সেই সন্ধ্যার আলোয়, যখন মেট্রোর ট্রেনের শব্দ দূরে থেকে আসছিল, তারা চুপচাপ বসে থেকে একে অপরের দিকে তাকাতে থাকে।
শ্রাবণ বলে, “ক্যামেরার ফ্রেমে আমরা গল্প বলি, কিন্তু ফ্রেমের বাইরে? ফ্রেমের বাইরে তো সত্যিকারের গল্পটা শুরু হয়।”
তিতির ধীরে বলল, “আমরা কি সত্যিই ফ্রেমের বাইরে যেতে পারব?”
শ্রাবণ চোখ তুলে তাকিয়ে বলে, “যে গল্প ফ্রেমের ভিতরে থাকে, সেটাই ফ্রেমের বাইরে সবচেয়ে শক্তিশালী।”
তাদের মধ্যে একটা নীরবতা নেমে আসে, যেখানে শব্দের অভাব নেই—আছে শুধুই অনুভূতি আর চাওয়া।
“আমি জানি, আমাদের গল্পটা অন্যদের থেকে আলাদা,” তিতির হেসে বলে, “ক্যামেরার লেন্সে যে প্রথম প্রেম, সেটা নিঃশব্দ, সুধু চোখে চোখ রেখে বলার মতো।”
শ্রাবণ ক্যামেরাটি তুলে ধরে, “চলো, তোমার চোখ দিয়ে আমার গল্প বলি।”
তিতির একটা ছবি তুলে ধরে—শ্রাবণের চোখের মধ্যে এক অদ্ভুত দীপ্তি।
তারা জানে, এই ছবি কেবল একটি ফ্রেম নয়, এটা তাদের জীবনের এক মুহূর্তের গল্প, যেখানে মিলেছে মনের গভীর ভালবাসা, নিঃশব্দ ভাষা, আর প্রথম ভালোবাসার অমলিন সুর।
সপ্তম
দক্ষিণ কলকাতার সন্ধ্যার গাঢ় আকাশ ধীরে ধীরে নীলাভ থেকে কালোতে মিশে যাচ্ছিল। শহরের রাস্তা একধরনের অজানা নির্জনতায় মোড় নিয়েছিল, যদিও দূরে দূরে ফুটপাতে মানুষের ভিড়, হকারদের ধোঁয়াশা আর গাড়ির হর্নের শব্দ একটা আলাদা জটলা তৈরি করছিল।
ফটোগ্রাফি ওয়ার্কশপের ভেতরে সেই ছোট্ট ঘরটা আজ যেন একটু আলাদা লাগছিল। জানালার স্লেটে ধুয়োঘেরা আলো এসে পড়ছিল মাটির মেঝেতে, আর বাতাসের হালকা স্পর্শে ফ্লোরে রাখা ক্যামেরাগুলোর শরীরের মেঠো অংশ একটু দোল খাচ্ছিল।
তিতির তার প্রিয় লেন্সের পেছনে চোখ মেলেছিল, যেন পুরোনো কোনো স্মৃতির খোঁজে হারিয়ে যাচ্ছে। আর শ্রাবণ, তার পাশে বসে, ক্যামেরার চশমা খুলে নিয়ে নিরিবিলি এক কোণে চোখ জুড়িয়ে বসেছিল।
“তিতির,” শ্রাবণ হালকা গলায় শুরু করল, “তুমি কখনো ভেবেছো—আমাদের ছবি কি সত্যিই সবার সামনে থাকে? না তো, অনেক সময় সত্যিকার গল্প ফ্রেমের বাইরে থেকে যায়।”
তিতির চোখে চঞ্চলতা এসে গেল। “আমার মনে হয়,” সে বলল, “আমাদের গল্পের সবচেয়ে সুন্দর ছবি আসলে ক্যামেরার লেন্সের বাইরেই।”
শ্রাবণ ধীরে ধীরে হাসল, “সেই ছবিটা যদি কেউ ধরতে পারে না, তাহলে সেটা সত্যি ছবি নয়?”
“না,” তিতির বলল, “একটা ছবি শুধু চোখ দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়ে দেখা হয়। আর তোমার সঙ্গে আমার সেই হৃদয় এক হয়ে গেছে।”
শ্রাবণের চোখে একটা আলোর ঝলক ফুটে উঠল। “তিতির, তোমার সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত আমার জীবনের সবচেয়ে মধুর ছবি হয়ে থাকবে। ক্যামেরা যেটা ধরে রাখতে পারে না, সেটাই তো আসল প্রেমের ছবি।”
তিতির একটু লজ্জিত হয়ে তাকাল, “শ্রাবণ, তুমি তো জানো, আমি সবসময় ছবি তুলতে ভালবাসি। কিন্তু আজ আমি চাই তোমার চোখে আমি কীভাবে দেখি, সেটা ক্যামেরার মাধ্যমে সবাইকে দেখাতে।”
তাদের চোখের মাঝে সেই গভীর বন্ধন যেন বাতাসে মিশে গিয়েছিল। কোনো শব্দের প্রয়োজন ছিল না, তারা শুধু একে অপরের চোখে নিজেদের ভাবনার প্রতিফলন খুঁজে পেয়েছিল।
“তুমি জানো,” শ্রাবণ বলল, “আমাদের প্রথম দেখা, প্রথম কথোপকথন, প্রথম হাসি — সবগুলো যেন একটা ছবি যেখানে আমরা দুজনেই ফোকাস।”
“আর সেই ছবিটাই আমাকে বুঝতে সাহায্য করে,” তিতির বলল, “যে প্রেম অনেক সময় নীরব থাকে, কিন্তু গভীর। ক্যামেরার লেন্সে ধরা না পড়লেও, হৃদয়ের গহীনে থাকে।”
বাইরে হঠাৎ মেট্রোর আওয়াজ এসে তাদের মনের নীরবতাকে ভেঙে দিলো। কিন্তু তাদের দুজনের জন্য সময় যেন স্থির হয়ে গিয়েছিল—সেই মুহূর্তে তারা জানত, জীবনের যেকোনো ঝড়ের মধ্যেও তাদের এই নীরব ভালোবাসা চিরস্থায়ী।
“চলো, এই ফ্রেমের বাইরে গিয়ে নতুন গল্প শুরু করি,” শ্রাবণ বলল, তার হাত ধীরে ধীরে তিতিরের হাতে দিলো।
তিতির হালকা লাজুক হাসি নিয়ে সেই হাতটা আঁকড়ে ধরল।
তারা দুজনেই জানত, ক্যামেরার লেন্সে না ধরা যাওয়া প্রেমটাই আসল, যা সময়ের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখে স্মৃতির আলোকসজ্জা।
অষ্টম
দক্ষিণ কলকাতার সন্ধ্যা হুড়মুড়িয়ে নামছে, যেন বৃষ্টি আসার আগে আকাশ নিজেই শিহরিত। মেঘেরা জমে জমে গাঢ় ধূসর রঙে রূপান্তরিত হয়ে বসেছে। শহরের রাস্তাঘাটে ক্রমশ হালকা বাতাসের সঙ্গে মিষ্টি মাটির গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। ফটোগ্রাফি ওয়ার্কশপের ছোট্ট ঘরটার জানালা দিয়ে ভেসে আসছে দূরের রাস্তার বাতির নরম আলো আর অদ্ভুত কাঁপন।
তিতির ক্যামেরার লেন্সের পেছনে চোখ রেখে শহরের ছায়া-আলোয়ের খেলা দেখতে লাগল। লেন্সের মধ্য দিয়ে তার চোখ অনেক বেশি কিছুই বুঝতে চাইছিল—শহরের ব্যস্ততা আর নিস্তব্ধতার মাঝে লুকিয়ে থাকা ক্ষণস্থায়ী মুহূর্তগুলোকে ধরার চেষ্টা। আর শ্রাবণ, তার পাশে বসে, হাতে একটি পুরোনো ক্যামেরা ধরে গভীর চিন্তায় মগ্ন।
“তিতির,” শ্রাবণ হঠাৎ বলল, “ছবি তো শুধু বাহ্যিক দৃশ্য নয়, তা একটা অনুভূতির গল্পও। তুমি কি মনে করো, আমরা কতটুকু অনুভূতিকে ক্যামেরায় বন্দী করতে পারি?”
তিতির ধীরে হাসল, “শ্রাবণ, ছবি তো সেই ‘কিছু’ ধরে রাখে যা চোখের সামনে থাকলেও অনেক সময় আমরা হারিয়ে যাই। তোমার ছবি তুলতে আমি ভালোবাসি, কারণ তোমার চোখে যে নিঃশব্দতা, সেই ভাষাটা অন্য কোথাও খুঁজে পাই না।”
শ্রাবণের চোখে হঠাৎ গাঢ় এক আলোর ঝলক ফুটে উঠল, “তুমি জানো, তিতির, আমাদের প্রথম দেখা থেকে এখন পর্যন্ত আমি সবসময় তোমার চোখের সেই নিভৃতে বয়ে যাওয়া আলোকে খুঁজেছি।”
তিতির চোখে কিছুটা লজ্জা আর আগ্রহের মিশ্রণ, “আমার চোখে তোমার ছবি তোলা মানে আমার হৃদয়ের ক্যানভাসে সেরা ছবি আঁকা। তুমি হয়তো জানো না, কিন্তু তোমার প্রতিটি অভিব্যক্তিই আমার জন্য একটা আলাদা ছবি।”
বাইরে হঠাৎ ঝুমঝুম বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করল জানালার কাঁচে। বাতাসে মাটির স্নিগ্ধ গন্ধ ভেসে এল, আর তারা দুজনেই যেন ওই নরম বাতাস আর বৃষ্টির শব্দের মাঝে হারিয়ে গেল।
“চলো,” তিতির বলে উঠে দাঁড়াল, “বৃষ্টির ছায়ার মাঝে একটু হাঁটতে যাই। শহরটা এই মুহূর্তে আমাদের ছবি তুলে দেবে। ক্যামেরার লেন্স ছাড়াও আমরা যেন ছবি তুলি আমাদের চোখে, মনের মধ্যে।”
শ্রাবণ তার হাত ধীরে ধীরে তিতিরের হাতে দিল। তারা হাত ধরাধরি করে নেমে পড়ল ফটোগ্রাফি ওয়ার্কশপের সরু গলিতে। রাস্তায় ফোটে উঠছে পুকুরের মতো জল, আর লাইটপোস্টের আলো ও বৃষ্টির প্রতিফলন যেন এক অন্য জগতে নিয়ে যাচ্ছে।
তিতির ক্যামেরা থেকে লেন্স খুলে রাখল, “আজকে আমি তোমার চোখে এই শহরের গল্প দেখতে চাই।”
শ্রাবণ এক মুহূর্তে থেমে গিয়ে বলল, “আমাদের সম্পর্কও তো একরকম ছবি — নিভৃতে লুকানো, কিন্তু গভীরে অনেক গহীন।”
তাদের কথা, হাসি আর বৃষ্টির ফোঁটার মিশ্রণে শহর যেন নতুন রঙ পেয়ে উঠল। পথ চলার মাঝখানে শ্রাবণ হঠাৎ বলল, “তুমি কি জানো, অনেক সময় আমি ভাবি, আমাদের ভালোবাসা ছবির মতো — পুরো ছবি নয়, বরং ফ্রেমের সেই ছোট ছোট অংশগুলো যা দেখে বুঝতে হয় পুরো গল্প।”
তিতির হালকা করে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, “শ্রাবণ, সেই ছোট ছোট অংশগুলোই তো আমাদের জীবনের আসল রঙ।”
তারা চলতে চলতে পৌঁছল এক ছোট পার্কে, যেখানে বৃষ্টির ধারা একটু কমছিল। গাছেদের পাতা থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছিল, আর মাটির নরম গন্ধ বাতাসে ভাসছিল।
শ্রাবণ বৃষ্টি ভেজা মাটিতে হাত বুলিয়ে বলল, “তিতির, আমি চাই এই শহরের প্রতিটি কোণে আমাদের গল্পটা জমে থাকুক — শুধু ক্যামেরার ফ্রেমেই নয়, জীবনের ফ্রেমেও।”
তিতির কিছু না বলে শুধু তার হাত শক্ত করে ধরল, যেন বলছে, ‘আমি তোমার সঙ্গে আছি, যেখানে যেখানে যাবো।’
সন্ধ্যার আঁধারে তারা পার্কের বেঞ্চে বসে থেকে শহরের আলো আর বৃষ্টির মেলবন্ধন দেখছিল। চোখে চোখ রেখে, তারা বুঝতে পারল যে, ছবি থেকে ছায়া, এবং ছায়া থেকে আলো — সব মিলিয়ে যেন তাদের ভালোবাসার ভাষা।
নবম
সন্ধ্যা নামছে দক্ষিণ কলকাতার এক ছোট্ট ফটোগ্রাফি ওয়ার্কশপের আঙিনায়। ঘরের বাতাসে মিশে আছে সামনের রাস্তার বৃষ্টি জমে থাকা মাটির স্নিগ্ধ গন্ধ। এমন সময়, যেখানে শহরের চঞ্চলতা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসে, শ্রাবণের মনও সেই সন্ধ্যার মতো নিস্তব্ধ, ভাবনার স্রোতমান।
সে বসে আছে জানালার পাশে, ক্যামেরার লেন্স খুলে রেখে, তাকিয়ে আছে বাইরে ঝরঝরে বৃষ্টির ফোঁটা গুলোতে। তার চোখে আজ অদ্ভুত এক ফাঁকফোকর, যেন কোনো অনিশ্চয়তার ছায়া নেমে এসেছে তার হৃদয়ে।
তিতির আজ এসে পৌঁছায়নি ওয়ার্কশপে, যা তাদের প্রতি সপ্তাহের নিয়মিত সাক্ষাৎ। সে জানে, এই ছোট্ট অনুপস্থিতি নয়, বরং এই অনিশ্চয়তার গভীরতা তাকে ব্যথিত করছে। কারণ, এক বছর ধরে তিতির তার ক্যামেরার লেন্সের বাইরে যেই পৃথিবী, সেখানে সে প্রবেশ করতে চেয়েছিল, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে কিছু একটা ঢাকনা টেনে রাখা হয়েছে।
হঠাৎ তার ফোনের স্ক্রিন জ্বলজ্বল করল। তিতিরের নাম। একটি ছোট্ট মেসেজ—
“শ্রাবণ, আজ একটু সময় লাগবে আমার। অনেক কিছু বুঝতে হবে। আমাদের কথা বলা জরুরি।”
শ্রাবণের বুকটা ভেঙে গেল। সে বুঝল, আজকের রাত তার জীবনের একটি মোড়। সন্ধ্যার পরে তারা নির্জন একটি কফিশপে মিলিত হল। বাইরে ঢেউ খেলানো বৃষ্টির শব্দ, মাটির গন্ধ আর কাঁচের জানালায় ঠেকা ঝরঝরে ফোঁটার আওয়াজ—সব মিলিয়ে যেন একটা নরম, অদৃশ্য আবরণ গড়ে তুলছিল।
তিতির চায়ের কাপ হাতে নিয়ে কিছুটা অস্থির হয়ে বলল,
“শ্রাবণ, আমি জানি তুমি আমার ছবি তোলো, প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—আমি কি তোমার জীবনের ছবি?”
শ্রাবণ একটু অবাক হয়ে চেয়ারে পিছনে সরে গেল, ক্যামেরার লেন্সের মতো ফোকাস হারিয়ে।
“আমি তো তোমাকে দেখছি, তিতির। শুধু ক্যামেরার লেন্স দিয়ে নয়, চোখে চোখ রেখে।”
তিতির মুখে একটা মৃদু ব্যথা। সে বলল,
“কিন্তু আমি তো দেখি তুমি আমার সঙ্গে কতটা দূরে থাকো। তোমার ক্যামেরার লেন্স হয়তো শুধু বাহ্যিক ছবি ধরছে, কিন্তু আমার অন্তরটা কোথায়?”
শ্রাবণ ধীরে ধীরে বলল,
“তিতির, কখনো ভাবিনি তোমার এত গভীর অনুভূতি আমার কাছে কতটা স্পষ্ট। আমি শুধু ছবি তুলি, কিন্তু তোমাকে দেখতে চাই। তোমার সেই অদৃশ্য অংশগুলো যা ক্যামেরায় ধরা পড়ে না।”
তিতির চোখের কোনায় জল জমে এলো।
“আমাদের সম্পর্কটা যেন একটা ছবি — যেখানে সব অংশ পরিষ্কার নয়। অনেক জায়গায় ছায়া, অনেক জায়গায় আলো। কিন্তু আমরা কি সেই ছায়ার ভেতর দিয়ে যেতে পারি?”
শ্রাবণের মনের গভীর থেকে একটি শব্দ বের হল,
“আমি চাই সেই অন্ধকারের মধ্য দিয়েও আমরা হেঁটে যেতে পারি, একসঙ্গে। কারণ তোমার ছায়াও আমার জন্য জীবনের অংশ।”
তিতির হালকা করে হাসল, “তাহলে আমার হাতে হাত দিয়ে বলো, তুমি আমার অন্তরটা দেখতে চাও।”
শ্রাবণ নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “আমি শুধু তোমার ছবি তোলার জন্য এখানে নেই, তিতির। আমি তোমার জীবনের অংশ হতে চাই।”
তারপর তারা হাঁটতে লাগল শহরের ফাঁকা রাস্তায়। বৃষ্টির শেষ ফোঁটা মাটির সঙ্গে মিশে গেল, আর তাদের কথা চলল থেমে থেমে, মন খুলে।
তিতির বলল,
“শ্রাবণ, আমি অনেকসময় ভেবেছি, আমরা কি আসলেই একে অপরের জন্য? আমার জীবনে তুমি কি শুধু একটা ‘ছবি’, নাকি পুরো আলোর উৎস?”
শ্রাবণ থামল, তার চোখে গভীর এক নিভৃত আলো জ্বলল,
“তিতির, তুমি আমার জীবনের সেই আলোর উৎস, যার ছায়ায় আমি নিজেকে বুঝতে শিখেছি।”
তিতির কিছু না বলে শ্রাবণের হাতে হাত রেখে বলল,
“আমাদের ভালোবাসা যেমন ছবি — কখনো কখনো অস্পষ্ট, কখনো কখনো ঝলমলে। কিন্তু শেষমেশ সেটা আমাদের সত্যিকার জীবনের অংশ।”
শ্রাবণ ধীরে বলল,
“আমি জানি, আমাদের পথ সবসময় মসৃণ হবে না, তবুও আমি চাই আমরা একসঙ্গে থাকি, এই অদৃশ্য সীমানাগুলো পেরিয়ে।” রাতের শেষ প্রান্তে, শহরের ম্লান আলো আর চাঁদের মৃদু আলোয় তারা দুজনেই একে অপরের চোখে হারিয়ে গেল। শহরের বুকে দুইটি নিভৃতে আলো জ্বলল — শ্রাবণ ও তিতিরের ভালোবাসার নিদর্শন।
দশম
ফেব্রুয়ারির শেষ দিক। শীতের রেশ এখনও বাতাসে টের পাওয়া যায়। শ্রাবণ ক্যাফেতে ঢুকে চারদিক দেখে। কোণের জানালার পাশে বসে আছে তিতির—তার চেনা ক্যামেরাটা টেবিলের উপর রাখা, এক হাতে কফির মগ, আর চোখের সামনে একটা ছোট খাতা। মুখটা শান্ত, তবু চোখে কিছুটা অস্থিরতা। শ্রাবণ জানে—এই মেয়ে ছবি তোলার সময় যেমন গভীর মনোযোগ দেয়, তেমনি যখন কিছু বলতে চায়, তখনও নিজের মনে অনেকটা প্রস্তুতি নেয়।
সে ধীরে কাছে গিয়ে বসে। তিতির তাকিয়ে বলে,
“তুই এলি।”
শ্রাবণ হেসে বলে, “তুই ডাকলি বলে।”
কিছুক্ষণ নীরবতা। বাইরে টুপটাপ বৃষ্টির শব্দ। জানালার কাঁচে জমে থাকা বিন্দুগুলো যেন ফোকাসের বাইরে পড়ে থাকা আবেগের মতো—স্পষ্ট নয়, তবু অনুভবযোগ্য।
তিতির ধীরে বলে, “তুই জানিস, আমি গত এক মাসে একটা এক্সিবিশনের জন্য কাজ করছি। বিষয়টা খুব ব্যক্তিগত। শুধু তোর জন্য বলছি।”
“বিষয়টা কী?” শ্রাবণ প্রশ্ন করে।
“প্রেম।” তিতির বলে এক নিঃশ্বাসে। “একটা নিরব প্রেম, যেটা অনেকদিন লুকিয়ে ছিল, শুধু ছবিতে প্রকাশ পেয়েছে। আমি ছবিগুলো দেখে বুঝলাম, আমি ভালোবেসেছি। সেই ভালোবাসা শুধু ক্যামেরার লেন্স দিয়ে নয়, চোখ দিয়ে, মনের গহীন থেকে।”
শ্রাবণ একটু চমকে যায়। “কাকে ভালোবেসেছিস?”
তিতির হালকা হাসে। “ভেবেছিলাম তুই নিজেই বুঝবি। কিন্তু আজ বলতে এসেছি—আমি তোকে ভালোবেসে ফেলেছি, শ্রাবণ।”
বৃষ্টির শব্দ যেন একটু বেড়ে যায়।
শ্রাবণ চুপ করে তাকিয়ে থাকে তিতিরের দিকে। তারপর তার ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট এনালগ ক্যামেরা বের করে।
“তুই জানিস, এই ক্যামেরাটা দিয়ে আমি প্রথম তোর ছবি তুলেছিলাম। সেইদিন একটা লাল ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলি, চোখে আলো পড়ছিল। আমি বুঝেছিলাম—তুই আলোর মধ্যে একটা ছায়া, যেটা ধরা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়। আজ তুই নিজেই বললি ভালোবাসার কথা—আমার সত্তার শেষ অংশটাও যেন জেগে উঠল।”
তিতির হালকা গলায় বলে, “তুই কিছু বলছিস না?”
শ্রাবণ ধীরে তিতিরের হাত ধরে বলে,
“তোর ছবির ফ্রেমে আমি অনেকদিন আগে হারিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সাহস ছিল না বলতে। আজ তুই বললি, তাই আমিও বলি—আমি তোকে ভালোবাসি, তিতির। আজ, আগামীকাল, প্রতিটি ক্লিকের মুহূর্তে, প্রতিটি ছায়ার ভিতরেও আমি তোকেই দেখি।”
তিতিরের চোখে জল আসে। কিন্তু সে হেসে ফেলে,
“তাহলে আমরা একসঙ্গে একটা নতুন প্রজেক্ট শুরু করতে পারি—’First Frame of Forever’।”
শ্রাবণ বলে,
“এই হবে আমাদের গল্পের নাম।”
দুই বছর পর…
কলকাতা বইমেলায় তিতির আর শ্রাবণের যৌথ ফটোগ্রাফি বই প্রকাশিত হয়েছে। নাম—”Lens-e Prem”। বুকস্টলে ভিড়। লোকজন বই উল্টে দেখছে, ছবির নিচে ছোট ছোট ক্যাপশন—“আলোতে যাকে খুঁজেছিলাম, ছায়ায় তাকে পেয়েছি।”
এক কোণে দাঁড়িয়ে তিতির আর শ্রাবণ—হাতে হাত, চোখে চোখ।
তাদের প্রেমের শুরু হয়েছিল ক্যামেরার লেন্সে। আজ তারা সেই লেন্সের ওপার থেকে দেখে নিজেদের অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ।
শেষ ক্লিকে ধরা পড়ে যায় প্রথম প্রেম—চিরকালীন এক ফ্রেমে।
সমাপ্ত