Bangla - প্রেমের গল্প

ক্যানভাসে কাব্য

Spread the love

দুপুরটা কুমোরটুলির গলির মতোই কেমন যেন কাঁদামাখা হয়ে ছিল। গলি পেরোনোর সময় ঈশিতা প্রথমেই বুঝে ফেলেছিল, এখানে পা রাখলেই শহরের চেনা শব্দেরা বদলে যায়—হর্ন আর ট্র্যাফিকের শব্দের জায়গায় কাঠের খাঁচায় বন্দি রেডিওর মতো পুরনো রবীন্দ্রসঙ্গীত, বাঁশের কাঠামোয় চড়া রোদ, আর কাদার গন্ধে মিশে থাকা সৃষ্টির ঘর্মাক্ত গর্জন। ঈশিতা আজ এসেছে তার ম্যাগাজিন ‘অক্ষর’-এর শরৎ সংখ্যার কভার স্টোরি করতে—বিষয়: “কুমোরটুলি: দুর্গার আগমন-পূর্ব শিল্পশ্রমিকদের চোখে শরৎ”। সে খুব ভালো করেই জানে, সম্পাদক দেবাশিসদা তাকে এই দায়িত্ব দিয়েছেন কারণ এই বিষয়ের প্রতি ঈশিতার একধরনের অন্তরঙ্গ টান আছে। কিন্তু সে নিজেও জানে না, এই শহরের এক কোনায়, রোদে পোড়া কিছু কাদামাখা শিল্পীর মুখের পেছনে সে ঠিক কী খুঁজছে। হাতে খাতা আর মোবাইল, কাঁধে ছোট ব্যাগটা নিয়ে যখন সে ঢুকল পুরনো এক প্রতিমাশালায়, সেখানে এক মৃৎশিল্পী অর্ধসমাপ্ত প্রতিমার মুখে এক টান দিয়ে তুলির শেষ রেখা দিচ্ছিল। রোদের আলো ছুঁয়ে পড়েছিল সেই অগোছালো ঘরের ভেতরে—প্রতিমার চোখের চারপাশে আঁকা কালির নিচে দাঁড়িয়ে ছিল এক নিঃশব্দ যুবক, যার চুলে কাদা, হাতে তুলির দাগ, কিন্তু চোখে ছিল এমন এক গাঢ় স্থিরতা, যা ঈশিতাকে থমকে দিল।

“আমি কি একটু কথা বলতে পারি?”—এই প্রশ্নটুকু ঈশিতা উচ্চারণ করতেই শিল্পী তাকাল, কিন্তু তার মুখে কোনো শব্দ নেই। যেন সে শব্দ দিয়ে নয়, চোখ দিয়ে মাপছে ঈশিতার আগমনের কারণ। “আমি অক্ষর ম্যাগাজিন থেকে এসেছি। আপনার প্রতিমার কাজ দেখছি কিছুক্ষণ। খুব সুন্দর লাগল। আপনিই কি অয়ন বসু?” ছেলেটি এবার মাথা নাড়ে। চোখে খুব মৃদু এক স্বীকৃতি—একইসঙ্গে ক্লান্তি আর আত্মবিশ্বাসের মিলেমিশে থাকা অভিব্যক্তি। ঈশিতা আরও কিছু কথা বলে, কাজের প্রসঙ্গ তোলে, পুজোর আগে প্রস্তুতির চাপ নিয়ে জানতে চায়। অয়ন সংক্ষেপে উত্তর দেয়—শব্দ কাঁটাছেঁড়া করে, গলার সুর না বাড়িয়ে। কিন্তু প্রতিমার চোখে যখন তার তুলির টান নামে, তখন যেন সে অনেক বেশি বলছে, অনেক স্পষ্টভাবে। ঈশিতা ঘুরে ঘুরে দেখছে প্রতিমার মুখ, কালি আর মাটি মেশানো সেই লাবণ্য, যে লাবণ্য শহরের বিলবোর্ডে কখনো দেখা যায় না। সে হঠাৎ বলে ওঠে, “আপনার প্রতিমার চোখ যেন কিছু একটা বলছে। একটু শোনার মতো।” অয়ন এবার চুপ করে দাঁড়ায়, তারপর ফিসফিস করে বলে, “শিল্পীর চোখে যা পড়ে, তা প্রতিমার চোখে ওঠে।” আর এই একটিমাত্র বাক্যেই যেন শিল্প ও কবিতার মধ্যবর্তী একটি সেতু তৈরি হয়ে গেল। ঈশিতা নড়ে উঠল, খেয়াল করল—এই ছেলেটি বাইরে থেকে যতটা স্থির, তার ভেতরে যেন এক কবিতার মতোন উথালপাথাল।

প্রথম দিনটা এভাবেই কাটে। ঈশিতা ওখানে বেশ কিছুক্ষণ থাকে। তার কবিতার খাতা খুলে একটা নোট নেয়—”চোখের রেখায় জমে থাকে সৃষ্টির হাহাকার।” অয়ন বুঝতে পারে না সে কবিতা লিখছে না রিপোর্ট—তবে তাতে তার কিছু আসে যায় না। কাজের ফাঁকে মাঝে মাঝে সে ঈশিতার দিকেও তাকায়—মেয়েটির গলার স্বর কেমন স্নিগ্ধ, চোখে যেন পুরনো বইয়ের পাতার গন্ধ আছে। দিনশেষে ঈশিতা যখন বিদায় নেয়, অয়ন কেবল বলে, “আগামীকাল চক্ষুদান আছে, সকাল সাতটায় আসবেন?” ঈশিতা একটু অবাক হয়, কারণ এই প্রথম অয়ন নিজে তাকে ডাকছে। সে হাসে—মৃদু এক হাসি, যার মধ্যে রয়ে যায় কবিতা, কৌতূহল আর এক অজানা টান। গলি থেকে বেরিয়ে আসার সময় ঈশিতা ভাবে—কী আছে এই ঘর্মাক্ত গলিতে, এই রোদ-কাদায় মাখা শিল্পে, যা তার ভিতরের কল্পনার চিত্রপটটাকে এতটা স্পর্শ করে যাচ্ছে? হয়তো এই গল্পটা, যা সে লিখবে পত্রিকার জন্য, তাতে উঠে আসবে কেবল প্রতিমা তৈরির ছবি নয়—বরং এক শিল্পী, যার হাতে তুলির সঙ্গে আছে আত্মার ভাষা। আর হয়তো… সেই শিল্পীর সঙ্গে তার অদৃশ্য সংলাপ, যেটা আজ শুধু শুরু হলো—এক মাটির ঘ্রাণে, এক চোখের রেখায়।

সকালটা ছিল কুয়াশামাখা, যদিও তা জুলাইয়ের শহুরে আকাশে বিরল। ঈশিতা খুব ভোরেই বেরিয়ে পড়েছিল, হাতে তার চেনা সেই খাতা, এক পাতা লিখিত কবিতা আর মোবাইলে আগের দিনের কিছু ছবি। কুমোরটুলির গলির দিকে এগোতে এগোতে সে লক্ষ করল, গলির দোকানগুলো এখনও পুরোপুরি খোলেনি, কিন্তু অয়ন বসুর প্রতিমার ঘরে আগুন রকম আলো। সকাল সাতটা বেজে দশ, ঈশিতা একটু ধীরে পা ফেলে সেই ওয়ার্কশপের ভেতরে ঢুকল। ঘরের মাঝে একটা টুলে বসে অয়ন প্রতিমার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে। চারপাশে ছড়িয়ে আছে ব্রাশ, রঙের কৌটো আর কিছু কাপড়ের টুকরো। আজ প্রতিমার চোখ আঁকা হবে—চক্ষুদান। সেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, যখন মূর্তির মধ্যে ঢুকে পড়ে আত্মার সঞ্চার। ঈশিতা চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল, হঠাৎই অয়ন বলে ওঠে, “আপনি সময়মতো এসেছেন, আজ একটু জোরালো আলো দরকার ছিল।” তার গলায় যেন আলতো এক সুর ছিল আজ, গতকালের চেয়ে একটু বেশি খোলামেলা। ঈশিতা এগিয়ে গিয়ে প্রতিমার দিকে তাকায়—মাটি দিয়ে গড়া সেই মুখ, এখনো চোখহীন, কিন্তু তাতে এক অদ্ভুত প্রতীক্ষার রেখা। “চোখ আঁকেন কীভাবে?” ঈশিতা জিজ্ঞেস করে। অয়ন কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে, “যেভাবে কেউ প্রথম প্রেমে পড়ে—ভয়ে, যত্নে, আর বিশ্বাসে।”

ঈশিতা বসে পড়ে মাটির মেঝেতে, তার খাতা খুলে কবিতার কিছু পঙ্‌ক্তি পড়তে থাকে, যার প্রতিটা শব্দ যেন মিলেমিশে যায় সেই মুহূর্তের নীরবতায়। অয়ন তার তুলির ডগায় কালো রঙ তুলে প্রথমে প্রতিমার ডান চোখের পাতায় টান টেনে দেয়। এক নিঃশব্দ কাঁপুনি যেন ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। ঈশিতা দেখছিল, একজন শিল্পী কীভাবে নিঃশব্দে জীবনের ভাষা রচনা করে। “এই চোখগুলো কি আপনার কল্পনার?”—ঈশিতা আবার জিজ্ঞেস করে। অয়ন বলে, “না, এগুলো আমি দেখি রোজ—মাকে, মেয়েদের, যারা ঘর সামলায়, কাজ করে, আবার ফিরে এসে নিজের স্বপ্ন ভুলে যায়। প্রতিমার চোখ সেইসব নারীকে তুলে আনে, যাদের শক্তিকে আমরা ভুলে যাই।” ঈশিতা অবাক হয়ে দেখে—এই চুপচাপ ছেলেটার ভিতর কত গভীরতা, কত সামাজিক উপলব্ধি লুকিয়ে আছে। তখন সে একটা কবিতার লাইন লেখে, “চোখের ভাষা যাদের বোঝে না, তারা মুখের শব্দে ব্যর্থ হয়ে পড়ে।” অয়ন চেয়ে দেখে খাতার দিকে, মুখে বলে না কিছু, কিন্তু চোখে হাসি খেলে যায়।

তারা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। তারপর ঈশিতা বলে, “আপনার চোখও বোঝে অনেক কথা। হয়তো আপনি বলতেও চান না।” অয়ন এবার একটু থেমে বলে, “আমি যখন ছোট, বাবা বলত, বেশি বলা শিল্পী ভালো কাজ করতে পারে না। নীরবতাই নাকি সবচেয়ে ভালো রঙ।” এই কথার পর তারা আবার চুপ করে যায়, কেবল বাইরে একটা পাখি ডেকে ওঠে আর প্রতিমার চোখের রং শুকোতে থাকে। ঈশিতা বুঝতে পারে, তার লেখার মধ্যে যে কল্পনার দুনিয়া সে তৈরি করে, সেই দুনিয়ার বাইরে সত্যিকারের শিল্পীদের ভিতর এক ধরণের একাকিত্ব থাকে—যা সে আগে কখনো দেখেনি। চক্ষুদান শেষ হলে, অয়ন বলে, “আজ প্রতিমা আমাকে ছেড়ে চলে গেল।” ঈশিতা বিস্মিত হয়, “মানে?” অয়ন ধীরে বলে, “চোখ আঁকা মানে এক প্রকার বিদায়। এরপর এই মুখ আর আমার থাকে না। এখন সে মানুষের, পুজোর, বিসর্জনের।” ঈশিতার গলা ভার হয়ে আসে, কারণ সে বুঝতে পারে—এই শিল্পীর প্রতিটি সৃষ্টি, ঠিক তার কবিতার মতোই—প্রেম দিয়ে শুরু হয়, এবং একদিন পাঠকের হয়ে গিয়ে নির্মাতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। সে অয়নকে দেখে—একটু কাদা লেগে থাকা গাল, চোখের নিচে অনিদ্রার ছায়া, কিন্তু মুখে এক অদ্ভুত শান্তি। ঈশিতা ভাবে, লেখার জন্য তো এসেছিল, কিন্তু এই শহরের গলির এক কোণায় সে যেন নিজের কবিতার মানে নতুন করে শিখে ফেলছে।

বিকেলের আলোর রং বদলে গিয়েছিল আজ। আকাশ ছিল ঝাপসা, অথচ ভেতরে কোথাও যেন নরম আলো ছড়িয়ে পড়ছিল কুমোরটুলির গলিতে। ঈশিতা সেদিন কোনো পূর্বনির্ধারিত কাজ ছাড়াই চলে এসেছিল অয়নের প্রতিমাশালায়—শুধু এক অদ্ভুত আকর্ষণে। সে নিজেই বুঝতে পারছিল না, কেন এই জায়গাটা তাকে এতটা টানে, কিংবা কেন অয়ন বসুর নীরব উপস্থিতি তাকে এমনভাবে ভাবায়। ওয়ার্কশপের দরজা তখনও খোলা হয়নি, কিন্তু ভেতর থেকে শোন যায় মৃদু এক গান—বাঁশির মতো ভেসে আসা সুর। ঈশিতা একটু দ্বিধায় দাঁড়িয়ে, তারপর আলতো ঠেলে দরজা খুলে ভেতরে ঢোকে। অয়ন সেখানে বসে, প্রতিমার গায়ে আলতো রঙের তুলির ছোঁয়া দিচ্ছিল আর তার মা, মধুমিতা বসু, এক কোণে রেডিও চালিয়ে হালকা গুনগুন করছিলেন। ঈশিতাকে দেখে তিনি হেসে বলেন, “আজ তো আমাদের নতুন অতিথি সকালেই চলে এল!” ঈশিতা একটু হেসে সামনে এগোয়, “অয়নদা কি এখন কাজ করছেন? আমি একটু বসি?” মধুমিতা ঘরের এক কোণে জায়গা করে দেন, আর বলেন, “তুমি বসো, আর ইচ্ছা হলে গেয়ো একখানা গান। শুনেছি তোমার গলায় নাকি অনেক জাদু।”

একটা মুহূর্তের জন্য ঈশিতা থমকে যায়। তার ভেতরে কিছু একটা নড়ে ওঠে—হয়তো বহুদিন গলায় জমে থাকা সুরের বেদনা। অয়ন এবার চোখ তুলে তাকায়, মুখে না বলেও যেন এক অনুরোধ থাকে চোখে। ঈশিতা চুপচাপ বসে পড়ে, তার খাতা বন্ধ করে, দু’চোখ বন্ধ করে গেয়ে ওঠে, “আজি এ বসন্তে…।” গানের প্রতিটি শব্দ যেন মাটির ঘ্রাণ, প্রতিমার গায়ে লাগা রঙ আর ওয়ার্কশপের ঘর্মাক্ত বাতাসের সঙ্গে মিলেমিশে যায়। অয়ন কাজের হাত থামিয়ে চেয়ে থাকে মেয়েটির দিকে, যেভাবে কেউ চেয়ে থাকে শৈশবের হারিয়ে যাওয়া গানের দিকে। মধুমিতা বসু একসময় চোখ মুছতে মুছতে বলেন, “এই গান অনেকদিন শুনিনি… আমার স্বামী এই গান শুনে প্রতিমার চোখ আঁকতেন।” মুহূর্তটা ভারী হয়ে ওঠে, অথচ কেমন যেন শান্তির। ঈশিতা চোখ মেলে দেখে, অয়নের চোখে এক গভীর নিরবতা, যেন কোনো প্রাচীন বেদনার জলছবি। অয়ন বলে না কিছুই, কিন্তু সে জানে—ঈশিতা তার শিল্পের জগতে যে সুরের জানালা খুলে দিল, তা আর কোনো দিন বন্ধ হবে না।

গান শেষ হলে ঈশিতা ধীরে বলে, “এই গান আমি গাই বাবার জন্য। উনি বলতেন, গান আর মাটির গন্ধ মিলে গেলে ঈশ্বর নেমে আসেন।” অয়ন তাকিয়ে থাকে, বলে, “আমার মা গান ছেড়ে দিয়েছিলেন বাবার মৃত্যুর পর, কিন্তু আজ মনে হল, সেই সুর ফিরে এল।” ঈশিতা বুঝতে পারে, এই মানুষটা যতটা চুপচাপ, তার হৃদয়ে জমে থাকা সুর ততটাই স্পন্দিত। তারা তিনজন কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে—একটা অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য, যেখানে গানের রেশ, কাদার ঘ্রাণ আর প্রতিমার চোখের অলিখিত ভাষা মিলেমিশে একধরনের আত্মিক যোগাযোগ তৈরি করে। ঈশিতা অনুভব করে, তার কবিতার খাতায় আজ হয়তো কোনো শব্দ লেখা হবে না, কিন্তু তার হৃদয়ে জন্ম নিচ্ছে এক অক্ষরহীন কবিতা—যার ছন্দ তৈরি হয়েছে অয়ন বসুর নিঃশব্দ সুর, মধুমিতার দৃষ্টিতে জমে থাকা স্নেহ আর প্রতিমার গায়ে লাগা আঙুলের কাঁপুনিতে। এই শহরের এক কোণায়, হয়তো আজ, সত্যি সত্যিই ঈশ্বর নেমে এসেছেন—মাটির শরীরে, সুরের হৃদয়ে, আর দুই মানুষের নিঃশব্দ মিলনের মধ্যে।

সেদিন আকাশে ছিল সোনালি আলোর এক নরম ছায়া, আর কুমোরটুলির গলির মাথায় বসেছিল হালকা বাতাস। অয়ন প্রতিমার কাজ শেষে ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঘর থেকে বেরোতেই দেখল, ঈশিতা রাস্তার ধারে একটা ছোট্ট চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে আছে, হাতে তার চিরচেনা খাতা আর পায়ের কাছে রাখা ছোট একটি ক্যামেরা। চোখে চশমা না, চুল খোলা, ঠোঁটে যেন স্বাভাবিক এক তৃপ্তির রেখা। অয়ন একটু থেমে বলে, “আজ এখানে?” ঈশিতা হেসে জানায়, “আজ কোনো কাজ নেই, শুধু একটু কথা বলা।” অয়ন একটু দ্বিধায় দাঁড়ায়, তারপর পাশে বসে পড়ে, আর দোকানদারকে বলে, “দু কাপ চা দাও দাদা, একটা কম চিনির।” ঈশিতা একটু অবাক হয়, “তুমি চিনি কম খাও?” অয়ন মুচকি হেসে বলে, “মিষ্টির বদলে যদি কথা পাওয়া যায়, তাহলে চিনির দরকার পড়ে না।” কথাটা শুনে ঈশিতা প্রথমবার একটু থেমে তাকায় ছেলেটার দিকে—এই মাটির মানুষটা ধীরে ধীরে যেন তার মনকে অন্য এক ব্যঞ্জনায় ছুঁয়ে দিচ্ছে।

চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠতে থাকে, আর তারা দুজন কথা বলে—ছোট ছোট গল্পে, শিল্প নিয়ে ভাবনায়, পরিবার আর পথের বাঁকে। ঈশিতা জানায়, তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। কথাটা বলে সে কিছুক্ষণ চুপ থাকে, যেন শুনতে চায় অয়ন কী প্রতিক্রিয়া দেয়। অয়ন কিন্তু ভাঙে না মুখ, শুধু বলে, “বিয়ে তো শিল্পের মতোই, না? অনেক পরিকল্পনা, কাঠামো, তারপর রং-মাটি-রেখা মিশে একটা অবয়ব। শুধু কখনও কখনও সেই অবয়ব বেঁচে থাকে না।” ঈশিতা চমকে তাকায়—এটা কি শুধুই একটি শিল্পীর কথা? না কি তার অভ্যন্তরের কোন গোপন অনুভব? সে ধীরে বলে, “যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছে, তিনি শিল্প ভালোবাসেন, গ্যালারি চালান। কিন্তু…” কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে যায়। অয়ন আর কিছু জিজ্ঞেস করে না, শুধু চায়ের শেষ চুমুক দিয়ে তাকিয়ে থাকে সামনের গলির দিকে, যেখানে শিশুরা প্রতিমার ভাঙা কাঠামো নিয়ে খেলছে। সেই দৃশ্য দেখে সে বলে, “শিল্প অনেক সময় খেলনার মতো হয়, যদি তা বোঝা না যায়। শুধু দেখার জন্য রাখলে, তার প্রাণ শুকিয়ে যায়।”

ঈশিতা এবার বলে, “তুমি কী বোঝো শিল্প দিয়ে?” অয়ন বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দেয়, “শিল্প মানে একটা জীবন। সেটা কখনো মায়ের মুখ, কখনো প্রিয় মানুষের চুলের গন্ধ, কখনো ছোটবেলার ভাঙা খেলনা। শিল্প কেনা যায় না, তৈরি হয়—মন দিয়ে, দেহ দিয়ে, সময় দিয়ে।” এই কথাগুলো ঈশিতার মনে গেঁথে যায়। সে ভাবতে থাকে, যে মানুষ এত গভীরভাবে অনুভব করতে পারে, সে কীভাবে এত নিঃশব্দে বেঁচে থাকে? তার আশেপাশে কি কেউ নেই যে এই ভাষা বুঝবে? ঈশিতা হঠাৎ বলে ফেলে, “তোমার পাশে বসলে মনে হয়, শহরের সব শব্দ থেমে যায়। তুমি জানো কীভাবে নীরবতা দিয়ে কথোপকথন করতে হয়।” অয়ন হালকা হেসে তাকায়, “তুমি জানো কীভাবে কবিতাকে স্পর্শ করতে হয়।” একটা মুহূর্তের জন্য চোখাচোখি হয়, চায়ের কাপ খালি হয়ে যায়, আর সময় যেন নীরবে তাদের চারপাশে মণ্ডিত হয় এক অদৃশ্য অনুভবে। ঈশিতা আজ বুঝে যায়, শিল্প শুধু সৃষ্টি নয়—কখনো কখনো সেটা হয় সম্পর্কের সূক্ষ্ম সেতু, যেখানে চায়ের কাপের ফাঁকে ফাঁকে গড়ে ওঠে এক অদেখা কাব্য, আর তা কখন যে মনের গভীরে গেঁথে যায়, কেউ বুঝতে পারে না।

দিনটা ছিল অদ্ভুতভাবে আলোকিত—রোদ ছিল, কিন্তু ঝাপসা; বাতাস ছিল, কিন্তু উষ্ণ। কুমোরটুলির ঘরে তখন প্রতিমার গায়ে রঙ লাগানোর শেষ ধাপ চলছিল। অয়ন ব্রাশ হাতে প্রতিমার বাহুর আঙুলে আলতো রঙ তুলছিল, আর ঈশিতা এক কোণে বসে তার খাতায় কিছু লিখছিল চুপচাপ। আজ তারা কেউই খুব একটা কথা বলছিল না, কিন্তু এক অদ্ভুত বোঝাপড়া, এক নিঃশব্দ সখ্যতা চারপাশে ছড়িয়ে ছিল। ঈশিতা প্রায় প্রতিদিনই আসছিল এখন—প্রথমে কাজের সূত্রে, তারপর নিছক আগ্রহে, আর এখন… হয়তো একটা অদ্ভুত টানেই। তার মনে হচ্ছিল, এই ঘরের প্রতিমার চোখ, কপালের সিঁদুর, বাহুর বক্রতা—সব যেন কিছু বলছে তাকে, যেসব কথার মানে সে নিজেও জানে না। হঠাৎই অয়ন বলে ওঠে, “আজ মুখের ওপর চন্দনের ফোঁটা পড়বে। তোমার ইচ্ছে থাকলে তুমি দিতে পারো।” ঈশিতা প্রথমে চমকে যায়, তারপর জিজ্ঞেস করে, “আমি? আমি কি পারি?” অয়ন হালকা হেসে বলে, “তুমি কবিতা লেখো, মানে রঙ বোঝো। তুমি পারবে।” সেই মুহূর্তে ঈশিতা একটু থেমে, ধীরে ধীরে প্রতিমার কাছে গিয়ে চন্দনের আঙুলে একটুকরো রেখা টেনে দেয় তার কপালে। টানটা সামান্য কাঁপা হলেও, অয়ন বলে, “এই টানটাই সব। শিল্প কখনও নিখুঁত হয় না, কিন্তু অনুভব ঠিক থাকলে সে নিজের পথ পায়।”

এই প্রথম ঈশিতা অনুভব করে, সে অয়নের সৃষ্টির অংশ হয়ে গেছে। তার মনে পড়ে, কিছুদিন আগে সে এক কবিতা লিখেছিল—“প্রতিমার শরীরে ছুঁয়ে গেলে / শব্দেরা পাথরের মতো জমে যায়।” সে এখন নিজেই সেই মুহূর্তের ভেতরে। কাজ শেষ হলে তারা দুজন একসাথে বসে পড়ে, আর ঈশিতা বলে, “তুমি জানো? আমি আজকাল কবিতা লিখতে পারছি না, শব্দেরা যেন নিজে থেকেই কাঁপে।” অয়ন বলে, “তুমি তো কবিতার ভেতরেই আছো এখন। তাই আর লেখার দরকার হচ্ছে না।” কিছুক্ষণ তারা চুপ করে বসে থাকে, আর তখন অয়ন তাকে একটা অর্ধসমাপ্ত মূর্তির দিকে দেখিয়ে বলে, “ওটা আমার প্রথম প্রতিমা, যেটা বিকোয়নি। কেউ নেয়নি, কারণ মুখটা সামান্য বেঁকে গিয়েছিল। কিন্তু ওটাই আমার সবচেয়ে প্রিয়।” ঈশিতা মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে ভাবে, সেই অযত্ন, সেই অসম্পূর্ণতাই তো সবচেয়ে বাস্তব। হয়তো ভালোবাসাও তেমন—একটু বেঁকে থাকা, একটু অসম্পূর্ণ, কিন্তু সবচেয়ে গভীর।

এরপর হঠাৎ করে ঈশিতা বলে, “আমার কবিতার প্রথম খাতাটা কোথাও হারিয়ে গিয়েছিল অনেক বছর আগে। আজকে মনে হচ্ছে, সেই হারানো খাতাটা এই মাটির গন্ধেই লুকিয়ে ছিল।” অয়ন একটু চমকে তাকায় তার দিকে, “তুমি চাও তো, তোমার লেখা একখানা লাইন প্রতিমার পায়ের কাছে মাটির সঙ্গে রেখে দিই?” ঈশিতা অবাক হয়, “তুমি তা করবে?” অয়ন বলে, “হ্যাঁ, যেন সে তোমার শব্দ পায়ে নিয়ে সারা শহর ঘুরে বেড়াতে পারে।” ঈশিতা তার খাতা খুলে একটি পাতা ছিঁড়ে দেয়—তাতে লেখা, “যে ভালোবাসে, সে পায়ের ধূলোর মতো থেকে যায়, চিরকাল।” অয়ন সেটি মূর্তির পায়ের নীচে আস্তে করে রাখে, আর তার ওপরে ছড়িয়ে দেয় একমুঠো মাটি। সেই মুহূর্তে ঈশিতার চোখে জল চলে আসে—কারণ এই প্রথম সে অনুভব করে, কারও শিল্পে নিজেকে রেখে যাওয়া কেমন অনুভব। আর সেই ধূলোর নীচেই জন্ম নেয় এমন এক দাগ, যা সময়ের কোনো বাতাসেই মুছে যায় না।

কুমোরটুলির গলিপথে শরতের রোদ যেন ধূলোর পর্দা ভেদ করে এসে পড়ে, আর সেই আলোয় দীপ্ত হয়ে ওঠে রুদ্রর ঘরের কাজের টেবিল। প্রতিমার চোখ আঁকার কাজটি আজ তার হাতে। চারপাশ নিস্তব্ধ, যেন মাটির মধ্যে গেঁথে থাকা এক গভীর কান্নার মতন। আর এই নিস্তব্ধতা ভেঙে, হঠাৎ করে, রুদ্রর দরজায় কড়া নাড়ে অনুরাধা। হাতে তার খোলা খাতা, ভেতরে লেখা একটি নতুন কবিতা—এক বৃষ্টি ভেজা বিকেলের কথা, যেখানে একজন মৃৎশিল্পী আর একজন কবি একে অপরের সান্নিধ্যে ধরা দেয়। কবিতাটি পড়ে রুদ্র কিছু বলে না, শুধু চেয়ে থাকে মেয়েটির চোখে—যেখানে একটা অনিশ্চিত যন্ত্রণা আর গভীর আকর্ষণের মিশ্রণ। অনুরাধা বুঝতে পারে, এই নৈঃশব্দ্যই সবচেয়ে সত্যি ভাষা, যা বলার নয়, শুধু অনুভব করার।

পরের কিছুদিন দুজনেই খুব নিয়মিত দেখা করতে থাকে। কাজের ব্যস্ততার ফাঁকে, জলখাবারের সময়, এমনকি সন্ধ্যাবেলার আলো-আঁধারিতেও তারা একে অপরের সান্নিধ্যে আসে। রুদ্র শেখায় কীভাবে চোখ আঁকতে হয়, অনুরাধা শেখায় কীভাবে শব্দ বুনে দিতে হয় অনুভূতির গর্ভে। কিন্তু সময়টা যেন বিষময় হতে শুরু করে। রুদ্রর মা, যিনি সব বোঝেন চুপচাপ চোখে, একদিন বলেন—“তুই তো জানিস, মাটি দিয়ে প্রতিমা গড়ি, আর এই শহর তো মানুষকে গড়ে ভাঙে।” রুদ্র বুঝতে পারে, বাস্তবের দড়ি তার স্বপ্নকে টেনে নিচে নামিয়ে আনছে। অনুরাধার বিয়ের তারিখ ধার্য হয়েছে মহালয়ার পরে, এবং এখন তাদের প্রতিটি মুহূর্তই যেন পিছন থেকে গোনা শুরু করেছে—যেন কারও শ্বাস ফেলার আগেই সময় তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

এক সন্ধ্যায়, দুজনে চুপ করে বসেছিল প্রতিমার গায়ে তুলির শেষ টান দিতে দিতে। হঠাৎ রুদ্র বলে ওঠে—“তুই চাইলে তোর জন্য লড়তে পারি, অনুরাধা।” মেয়েটির চোখ ঝলকে ওঠে, কিন্তু তারপরে যেন এক অনন্ত ক্লান্তি তাকে ঘিরে ফেলে। “না রুদ্র,” সে ধীরে বলে, “আমার জন্য কারও স্বপ্ন ভেঙে যাক, আমি চাই না। তুমি আমার এই মুহূর্তের শিল্প, আর আমি তোমার সেই কবিতা—যা কখনও প্রকাশ পাবে না, কিন্তু থাকবে তোমার মনের খাতার পাতায়।” কথাগুলো বলেই অনুরাধা উঠে দাঁড়ায়, আর ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় কুমোরটুলির সেই আলোকিত গলিতে। রুদ্র তখন বুঝে যায়—শিল্প যেমন স্থায়ী, তেমনি কিছু প্রেমও হয় চিরকালীন, শুধু তার রূপটি হয় অদৃশ্য।

কুমোরটুলির গলিগুলো আজ যেন আরও বেশি ঘনিয়ে এসেছে, যেন দেয়ালগুলো হঠাৎ করে গুঞ্জন তুলছে, গোপন কিছু বলতে চাইছে। শ্রেয়সী সকালে কবিতার খাতা হাতে নিয়ে গিয়েছিল রণদীপের কর্মশালায়, যেখানে মাটির প্রতিটি টুকরো তাঁর হাতে জেগে ওঠে জীবনের মতো। কিন্তু আজ সে কাজ করতে পারেনি, কিছুতেই নয়। শ্রেয়সীর চোখে আজ ছিলো অদ্ভুত এক দ্বন্দ্ব, যেন নিজের মনকে আর বোঝাতে পারছে না—যে অনুভব সে লুকিয়ে রেখেছে এতদিন, তা আর চেপে রাখা যাচ্ছে না। রণদীপও লক্ষ করেছিল তা, কিন্তু তিনি কিছু বলেননি, শুধু এক পলক চেয়ে ছিলেন, যেমন করে মাটির চোখহীন মুখে তিনি প্রথম ছুঁয়ে দেন চোখের রেখা—নির্বাক, গভীর। হঠাৎ করে শ্রেয়সী বলে ওঠে, “তুমি জানো তো, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে,” কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে কোনো গর্ব বা আনন্দ ছিল না, ছিল যেন এক চাপা হাহাকার। রণদীপ থেমে যায়, হাতে ধরা গড়নের কাঠামোটা একপাশে রেখে, চুপ করে বলে, “জানি, অনেক দিন ধরেই জানি। কিন্তু এটা তোমার ইচ্ছা?” শ্রেয়সী উত্তর দিতে পারে না, শুধু চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন মেঘ জমে উঠেছে সেই দৃষ্টিতে। বাইরে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়, টিনের চালে ঝমঝম শব্দ, আর সেই শব্দের মধ্যে শ্রেয়সী বলে, “তুমি যদি আগেই কিছু বলতে…” বাক্যটা শেষ হয় না।

সন্ধ্যায় দুজনেই একসঙ্গে বসেছিল গঙ্গার ধারে, নৌকার ঘাটে। জল রঙিন হয়ে উঠছিল সোনালী আলোয়, ঢেউ গড়িয়ে আসছিল ছন্দের মতো। শ্রেয়সী ধীরে ধীরে তার খাতাটা খুলে রণদীপকে শোনাতে থাকে কিছু নতুন লেখা—কবিতাগুলো যেন আজ আর কল্পনার নয়, যেন এক বাস্তব অনুভবের ফসল। প্রতিটি ছত্রে যেন লুকিয়ে আছে এক নির্ভীক স্বীকারোক্তি, প্রেমের, আকাঙ্ক্ষার, দুঃখের। রণদীপ শুনছিল চুপচাপ, আর তার হাতের রেখাগুলো যেন অনিচ্ছাকৃতভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছিল শ্রেয়সীর খাতার পাতাগুলো, সে বুঝতে পারছিল—এই মেয়েটি তার মাটির মতোই, সহজ অথচ গভীর, গড়ে তুলতে গেলে যেমন সময় লাগে, যেমন ধৈর্য লাগে। সে বলল, “তোমার শব্দগুলো যেন আজ আমায় গড়ে দিল,” শ্রেয়সী হেসে বলল, “তোমার হাতেই তো সব গড়ে ওঠে।” কিন্তু সেই হাসির নিচে ছিল বিষাদের একটা রেখা, যা সে লুকাতে পারছিল না। রণদীপ ধীরে বলল, “তুমি জানো তো, আমি কোনোদিন কারও পথ আটকে দাঁড়াতে পারি না। কিন্তু আমি চাই তুমি নিজেকে প্রশ্ন করো—তোমার শিল্প কি তোমার থেকে দূরে যেতে দেবে তোমায়?” শ্রেয়সী চুপ করে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে থাকল, কোনো উত্তর দিল না।

বাড়ি ফিরে গিয়ে রাতে শ্রেয়সী জানাল তার মাকে—সে বিয়ে নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে চাইছে না এই মুহূর্তে। মায়ের চোখে পড়ে গেল তার কণ্ঠে প্রথমবার এক নতুন দৃঢ়তা, যেটা আগে ছিল না। শ্রেয়সী জানে, বাস্তবতার চাপ বড়ো—মেয়েদের জীবন এত সহজ নয়, বিশেষ করে শিল্পী হলে। কিন্তু সে এটাও জানে, শিল্প তার কাছে শুধু এক্সপ্রেশন নয়, আত্মার প্রশান্তি। এবং রণদীপ শুধু একজন শিল্পী নয়, এক সহযোদ্ধা, যাকে পাশে রেখে সে নিজের পথটা আঁকতে পারে, নিজের ক্যানভাসটা তৈরি করতে পারে। সেই রাতে তার লেখা একটি নতুন কবিতা সে ফেসবুকে পোস্ট করল, যার শেষ লাইন ছিল—”যদি মাটি কথা বলে, তবে আমি শুনব তাকে, কবিতার মতো।” আর ঘুমাতে যাওয়ার আগে সে একবার তাকাল ফোনের স্ক্রিনে—রণদীপের নামটাতে তখনো কোনো নতুন মেসেজ নেই, কিন্তু মনে মনে সে জানে, কিছু না বলেও অনেক কিছু বলা হয়ে গেছে আজ।

কুমোরটুলির গলির শেষপ্রান্তে সেদিন এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এসেছিল। প্রতিমাগুলো যেন চোখে জল নিয়ে তাকিয়ে ছিল, মৃণাল নিজের কাজ শেষ করে বসেছিল মাটির স্তূপের পাশে, কবিতার খাতা একপাশে রাখা। তৃষার বিয়ের দিন এগিয়ে আসছিল, এবং প্রতিদিনই সে যেন আরেকটু দূরে সরে যাচ্ছিল। অথচ সেই দূরত্বের মাঝেও একটা অদৃশ্য সেতু ছিল—যেটা গড়ে উঠেছিল দু’জনের শিল্পের গভীরতা থেকে। তৃষা সেদিন মৃণালের স্টুডিওতে এসে চুপ করে বসেছিল, সে কিছু বলেনি, কেবল মাটির গন্ধটা গায়ে মেখে বসেছিল অনেকটা সময়। মৃণাল কিছু জিজ্ঞেস করেনি, জানতো সব প্রশ্নের উত্তর তাকেই খুঁজে পেতে হবে। হঠাৎ সে উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল—“এই দেবীমূর্তির চোখ এমন বেদনায় ভরা কেন, মৃণাল?” শিল্পী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিল—“কারণ এই বছর দেবী হয়তো নিজেই কিছু ফেলে রেখে যাচ্ছেন।” তৃষার চোখ ছলছল করে উঠেছিল, কিন্তু সে সামলে নিয়েছিল নিজেকে। দু’জনেই জানত, এই শিল্পের শহরে তারা যেন একটা অসমাপ্ত কবিতা হয়ে যাচ্ছে।

সন্ধ্যা হয়ে এলে, কুমোরপাড়ার আলো জ্বলে উঠলো—তবে মৃণালের ঘরে সেদিন আলো নিভে ছিল। সে তার খাতা খুলে একের পর এক লাইন লিখছিল, প্রতিমার গায়ে যেন সেই লাইনগুলো ছায়া ফেলছিল। তৃষা চলে যাবার আগে একটি কবিতা উপহার দিয়েছিল তাকে—’মাটির মানুষ’—যেখানে সে লিখেছিল, “তোমার হাতের ছোঁয়ায় আমি মাটি হয়ে উঠি, আর সেই মাটির গন্ধেই আমি শ্বাস নিই, যদিও অন্য কারও ঘরে বাঁধা আমার ভবিষ্যৎ।” মৃণাল সেই কবিতাটি পড়ে নিজের তৈরি এক ক্ষুদ্র প্রতিমার ভেতরে গুঁজে রেখেছিল। তৃষা হয়তো আর কখনো ফিরে আসবে না, কিন্তু তার এই কবিতাটি যেন দেবীর চোখের অশ্রু হয়ে গলে মিশে ছিল। তৃষার অনুপস্থিতি মৃণালের শিল্পে আরও তীক্ষ্ণতা এনেছিল—তাঁর প্রতিমার মুখাবয়ব এত জীবন্ত হয়েছিল যে শিল্পী সমাজ অবাক হয়ে তাকিয়েছিল তাঁর কাজের দিকে। কিন্তু কেউ জানত না, সেই শিল্পের পেছনে ছিল এক অনুচ্চারিত প্রেম, এক অপ্রাপ্তির আকুতি।

মৃণাল প্রতিদিন প্রতিমার চোখের দিকে তাকিয়ে কাটাত। সে যেন সেখানে খুঁজত তৃষার মুখ, তার অপ্রকাশিত বেদনা। একদিন সকালে যখন তৃষার বিয়ের দিন ছিল, তখন মৃণাল একটি মৃৎশিল্প তৈরি করছিল, খুব ছোট একটি মুখ—যা অনেকটাই তৃষার মতো দেখতে। সে বলেছিল—”তুমি যেখানেই যাও, আমি তোমাকে আমার শিল্পে গড়ে রাখব, তোমার ছায়া থাকবে আমার আঙুলে, আমার কবিতার ছন্দে।” ঠিক তখনই বাইরে থেকে উৎসবের ঢাকের শব্দ ভেসে এসেছিল, দূরে দূরে আলোকসজ্জা, কিন্তু মৃণালের ঘরে ছিল কেবল নিঃশব্দতা। সে জানত, সেই উৎসব তৃষাকে নিয়ে যাবে এক নতুন জীবনে, আর সে থাকবে তার মাটির পৃথিবীতে, একলা, কিন্তু শিল্পে পূর্ণ। তৃষার মতো মানুষরা চলে যায়, কিন্তু শিল্প তাদের ধরে রাখে—চিরকালীন প্রেমের মতো। এই সত্যটা বুঝে মৃণাল আবার মাটি ছুঁয়ে চোখ বুজেছিল, যেন তৃষার অস্তিত্বকে অনুভব করছিল, শেষবারের মতো।

সপ্তমীর সকালে কুমোরটুলির গলিগুলো যেন বর্ণবহুল স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। প্রতিমার চোখে শেষ তুলির আঁচড়, শিল্পীদের মুখে ধুলোমাখা ক্লান্তি আর গর্বের ছায়া। নির্জন কোণটায় বসে রয়েছে কাব্য, হাতে তার ছোট্ট নোটবুক, যেখানে সে কবিতার রূপরেখা লিখছে—প্রতিমার চক্ষুদান ঘিরে এক গভীর অনুভবের কবিতা। হঠাৎ তার চোখ পড়ে মাটির মূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অলোর দিকে। মেয়েটি চুপচাপ তাকিয়ে আছে একটি প্রতিমার মুখের দিকে, যেন কোনো গভীর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। কাব্য এগিয়ে আসে, তার চোখে প্রশ্ন—‘তুমি ঠিক আছো তো?’ অলোর ঠোঁটে মৃদু হাসি, কিন্তু চোখে অস্থিরতা। সে বলে, ‘আমার বাবা আমার বিয়ের তারিখ এগিয়ে এনেছেন। নবমীর দিন রিং পরানো হবে। আমি কলকাতার বাইরে চলে যাব।’ এই বাক্য যেন কাব্যের বুকে আগুনের গোলা ছুঁড়ে দেয়। এতদিন যে অনুভব সে নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল, আজ যেন তা ফেটে বেরিয়ে আসতে চায়। কিন্তু তার ঠোঁট নীরব, আর তার চোখে শুধু বোঝা যায়—যাওয়ার আগে এই মেয়েটিকে আরও একবার ছুঁয়ে দেখা, অনুভব করা, এবং বিদায় জানানো তার দরকার।

দিন গড়িয়ে আসে নবমী। প্রতিমার প্রতিটি গাত্রদেশে আলোর খেলা, দেবীর চোখে যেন জীবন্ত দৃষ্টি। কুমোরটুলির ভেতরে সেদিন ছিল এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতা। অলোর বাবার গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে গলির মুখে। মেকআপ করা মুখ, সোনার গয়নায় ঝলমল করা অলোর চোখে জল জমে, যা সে লুকোতে চেষ্টা করে। কাব্য চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে তার পাশেই, হাতে একটি ছোট বাক্স। সে বলে, ‘এটা তোমার জন্য। আমার লেখা কিছু কবিতা আর তোমার আঁকা কিছু স্কেচ। আমরা একসঙ্গে এক শিল্প সৃষ্টি করেছিলাম, এটা তার স্মারক।’ অলো বাক্সটা নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। এরপর এক মুহূর্তে সে কাব্যের গালে এক নরম চুমু খায়, যেন সমস্ত না-বলা শব্দের ব্যাখ্যা। তারপর গাড়িতে উঠে পড়ে, এবং ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় শহরের কোলাহলে। কাব্য চুপচাপ তাকিয়ে থাকে গাড়িটার পেছনে, যেন তার হৃদয়ের একটা অংশ চলে গেল অনেক দূরে, যেখানে সে পৌঁছাতে পারবে না।

রাতের কলকাতা তখন কাশফুলের ছায়ায় মাখামাখি। গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে কাব্য তার নোটবুক খুলে বসে, হাতে কলম। আকাশে ফুলঝুরির মত আতশবাজি ফুটছে, কিন্তু তার চোখ স্থির এক খোলা পাতায়। সেখানেই সে লিখে ফেলে একটি নতুন কবিতা—একটি বিদায়ের কবিতা, যেখানে নেই করুণ সুর, আছে কেবল মায়ার রঙ। ‘তুমি এসেছিলে মাটির ঘ্রাণে, চলে গেলে আগুনের আলয়ে…’ কবিতাটি যেন তার হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনের প্রতিচ্ছবি। সে জানে, অলোর সঙ্গে তার মিলন কখনও হয়নি, কিন্তু তার সৃষ্টি অলোর ছোঁয়ায় চিরস্থায়ী হয়েছে। শিল্পই তাদের সাক্ষাৎ, শিল্পই তাদের শেষ আলিঙ্গন। এই অমাধ্যরাত্রিতে, কাব্য যেন বুঝে গেল—প্রেম শুধু মিলন নয়, প্রেম কখনও কখনও সৃষ্টির গভীরতম মুহূর্তে এক নীরব প্রতিশ্রুতি।

১০

পূজোর ষষ্ঠীর সকালে কুমোরটুলি যেন অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় জেগে উঠেছিল। দিনের আলো গিয়ে পড়েছিল প্রতিমার চোখে—যেখানে এখন শুধু জীবন্ত স্পন্দন। সুব্রতর হাতের কাজ শেষ, মৃণালিনীর কবিতার ছাপ তার প্রতিটি তুলির ঘুরপাকে। অথচ আজ তাদের মধ্যে দূরত্ব, এক অভিমানের দেয়াল। আগের রাতেই সুব্রত জেনেছে—মৃণালিনীর বিয়ে নিশ্চিত। নামজাদা শিল্পপতি অরিত্র সেনের সঙ্গে, যিনি বিদেশে থাকেন, যাঁর শিল্প বাণিজ্য আর প্রতিষ্ঠানের ছায়ায় এখন মৃণালিনীর পরিবার। অথচ সেই মেয়েটিই কাল রাতের ঝড়ে কাঁপতে কাঁপতে এসে বলেছিল—”আমি তোমার সঙ্গে পালাতে চাই না সুব্রত, কিন্তু তোমার সঙ্গে কিছুটা জীবন কাটাতে চাই—এই কুমোরটুলির মাটি, রঙ আর কবিতার ভিতরে।” সুব্রত সেই কথার উত্তর দেয়নি, শুধু তার মাটির প্রতিমার চোখে জলরেখা এঁকেছিল—যা মৃণালিনী লক্ষ করেছিল নিঃশব্দে।

সপ্তমী, অষ্টমী আর নবমীর ভিড়ে তারা দূরত্ব রেখেই কাজ করেছে। চারপাশে উৎসব, ঢাকের আওয়াজ, প্রসাদ, বাচ্চাদের হাসি—কিন্তু তাদের দুজনের মধ্যে অনুচ্চারিত কিছু বেদনা হেঁটে বেড়িয়েছে। নবমীর রাতে মৃণালিনী শেষবার কবিতার খাতা রেখে যায় সুব্রতের ছোট ঘরে। সেখানে লেখা ছিল—”তুমি যে মাটি দিয়ে তৈরি করো দেবী, আমি সেই চোখে দেখি নিজেকে। কিন্তু মাটি তো শুকিয়ে যায় একদিন, রঙ উধাও হয়। তুমি পারবে কি আমায় স্মরণে রাখতে, সেই প্রতিমার মতো?” সুব্রত চুপচাপ খাতা খুলে রেখে আবার হাত লাগায় প্রতিমার শেষ স্পর্শে। এরপরের দিন—বিজয়া দশমী। ভোরের আগে অঞ্জলি, তারপর বিসর্জনের আয়োজন।

দশমীর সকাল। মৃণালিনী এসেছিল শাড়ি পরে, মাথায় সিঁদুর, চোখে বিদায়ের বিষণ্ণতা। পাড়ার মেয়েরা মায়ের সিঁদুর খেলে ব্যস্ত, কিন্তু মৃণালিনী এক কোণে দাঁড়িয়ে কেবল তাকিয়ে ছিল সেই প্রতিমাটির দিকে—যেটি তাদের শেষ কাজ, যেটি যেন তাদের সম্পর্কের প্রতিচ্ছবি। আর তখনই সুব্রত সামনে এসে দাঁড়ায়। হাতে ধরা কবিতার খাতা। বলে, “তোমার প্রতিমার চোখে আমি কবিতা পড়েছি। তুমি না থাকলেও, সে থেকে যাবে। কারণ, শিল্পে প্রেম মরে না, সে শুধু রঙ পাল্টায়।” মৃণালিনী চোখের জল চেপে হাসে। তারপর বিসর্জনের শোভাযাত্রা শুরু হয়। প্রতিমা ওঠে গাড়িতে। মৃণালিনী ফিরে যায় তার ভবিষ্যতের জীবনের দিকে—কিন্তু পেছনে ফেলে যায় এক খাতা, এক নাম, এক প্রতিমা—যা রয়ে যায় কুমোরটুলির ক্যানভাসে, অমলিন।

***

 

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *