Bangla - প্রেমের গল্প

কোয়ার্ক ক্যাফের প্রেম

Spread the love

স্বপ্ননীল রায়


(১)

প্রথম দিনের সকালের সেই মুহূর্তটা অদ্রিজার কাছে অনেকটা অচেনা রাস্তা ধরে হাঁটার মতো ছিল। নতুন কাজ, নতুন প্রোজেক্ট, নতুন অফিস—সবকিছুই যেন একসাথে এসে তার কাঁধে বসে পড়েছিল। কো-ওয়ার্কিং স্পেসের কাচ-ঘেরা ফ্লোরে পা রাখা মাত্রই সে এক অদ্ভুত গন্ধ টের পেল—কফির তাজা গন্ধ, প্রিন্টারের কালি, আর ল্যাপটপের তাপে তৈরি হওয়া ধাতব উষ্ণতার মিশ্রণ। চারপাশটা আধুনিক সাজে সাজানো—ছোট ছোট ডেস্ক, হালকা রঙের দেয়াল, গাছপালা দিয়ে সাজানো কোণ, আর টেবিলের ওপরে খোলা ডায়েরি ও টেক-গ্যাজেটের মেলা। অদ্রিজার হাতে তখন একটা ফাইল আর একটা ল্যাপটপ ব্যাগ, মুখে স্বাভাবিক ভদ্র হাসি। সে একে একে ডেস্কগুলো দেখছিল, যেখানে বিভিন্ন বয়সের মানুষ তাদের কাজে ব্যস্ত—কেউ ফোনে কথা বলছে, কেউ একসাথে ব্রেইনস্টর্ম করছে, কেউ বা একদৃষ্টিতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আঙুল চালাচ্ছে কিবোর্ডে। ঠিক তখনই ম্যানেজার অভীক বসু তাকে তার সিট দেখিয়ে দিলেন—“এই যে, এটাই তোমার ডেস্ক। প্রোজেক্টের জন্য তুমি আর ঋত্বিক একসাথে কাজ করবে।” অদ্রিজা মাথা নাড়ল, আর চোখ রাখল পাশের চেয়ারে বসা সেই ছেলেটার দিকে। শান্ত, মনোযোগী মুখ, কানে হেডফোন, সামনে ল্যাপটপ খুলে বসা। তার উপস্থিতি এমনভাবে ধরা দিল যে মনে হলো, সে চারপাশের সব শব্দ বন্ধ করে শুধু নিজের জগতে ডুবে আছে।

ঋত্বিক প্রথমে প্রায় খেয়ালই করেনি যে তার পাশের সিটে কেউ বসে গেছে। অদ্রিজা ব্যাগ নামিয়ে চেয়ারে বসে আস্তে করে একটা কলম নামিয়ে রাখতেই সে সামান্য মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। কালো ফ্রেমের চশমার আড়ালে তার চোখ একবার অদ্রিজার মুখের দিকে পড়ে আবার স্ক্রিনে ফিরে গেল। অদ্রিজার মনে হলো, যেন এক ঝলকেই কিছু বোঝা গেল তার—এই ছেলে বেশি কথা বলে না। তবে তবুও, চোখে একটা নরম কৌতূহল লুকিয়ে আছে। হেডফোন খুলে সে সংক্ষেপে বলল, “হাই, আমি ঋত্বিক।” কণ্ঠস্বরটা ছিল মৃদু, কিন্তু স্পষ্ট। অদ্রিজা একটু হাসল, জবাব দিল, “অদ্রিজা। আজ প্রথম দিন।” এভাবেই শুরু হলো তাদের প্রথম আলাপ। খুব একটা বাড়তি কিছু বলা হলো না, শুধু নাম আর একটুখানি পরিচয়। কিন্তু সেই ক্ষণস্থায়ী কথোপকথনেই যেন অদৃশ্যভাবে কিছু তৈরি হতে শুরু করল—একটা অদ্ভুত টান, যা দুজনেই স্পষ্টভাবে বুঝতে পারল না, কিন্তু অনুভব করল। এরপর তারা দুজনেই কাজে ডুবে গেল, যেন বাইরের শব্দ আর মানুষের ভিড় মিলেমিশে হালকা হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে অদ্রিজা একপাশ থেকে চেয়ে দেখত ঋত্বিক কীভাবে মনোযোগ দিয়ে স্ক্রিনে কোড লিখছে, আর ঋত্বিকও অজান্তেই খেয়াল করছিল অদ্রিজা যখন কাগজে নোট নিচ্ছে বা ল্যাপটপে দ্রুত টাইপ করছে।

পুরো দিনটা এভাবেই কেটে গেল—কাজ, মিটিং, আর ছোট ছোট দৃষ্টির আদানপ্রদান। খুব বেশি কথা হয়নি, তবুও যেন অনেক কিছু বলা হয়ে গেছে। অফিস শেষে যখন সবাই একে একে বেরোতে শুরু করল, অদ্রিজা ব্যাগ গোছাতে গোছাতে মনে মনে হাসল—প্রথম দিনের অচেনা উত্তেজনার ভেতরেও আজ একটা আলাদা সান্ত্বনা আছে। পাশের ডেস্কে বসা ছেলেটা এখনও ল্যাপটপে মগ্ন, কিন্তু মাঝে মাঝে এক ঝলক চোখ তুলে তাকায়। অদ্রিজা বুঝতে পারল, এই দৃষ্টিগুলো নিছক কাকতালীয় নয়। বাইরে তখন শহরের আলো জ্বলে উঠছে, রাস্তা ভর্তি গাড়ি আর মানুষের ব্যস্ততা। কিন্তু সেই ভিড়ের ভেতরে অদ্রিজার মনে হচ্ছিল—আজকের দিনটা আলাদা, আজ তার জীবনে নতুন কোনো অধ্যায় শুরু হলো। ঋত্বিকের কাছেও এই দিনের শেষে অদ্ভুত এক অনুভূতি রয়ে গেল। নতুন সহকর্মী অদ্রিজার মুখে সে এক ধরনের উজ্জ্বলতা দেখেছে—যেন কোনো গোপন গল্প লুকিয়ে আছে, যা ধীরে ধীরে সে জানতে চাইবে। দুজনেই হয়তো এখনো বুঝতে পারছে না, কিন্তু তারা জানে—কো-ওয়ার্কিং স্পেসের এই প্রথম পরিচয় একদিন অনেক বড় কিছুর সূচনা হয়ে দাঁড়াবে।

(২)

অভীক বসু যখন মিটিং রুমে দাঁড়িয়ে তাদের নতুন প্রোজেক্টের খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা করছিলেন, তখন অদ্রিজা আর ঋত্বিক দুজনের চোখেই একইরকম কৌতূহল খেলে গেল। প্রোজেক্টটা বড় ক্লায়েন্টের, যেখানে মার্কেটিং আর টেকনোলজির মিশ্রণ দরকার। অভীক একসময় বললেন, “অদ্রিজা কনটেন্ট ও প্রেজেন্টেশনের দায়িত্ব নেবে, আর ঋত্বিক টেকনিক্যাল সাপোর্ট ও ডেভেলপমেন্ট সামলাবে। তোমাদের দুজনকে একসাথে কাজ করতে হবে, টিমওয়ার্ক ছাড়া এই প্রোজেক্ট দাঁড়াবে না।” কথা শেষ হতেই দুজনেই হালকা মাথা নাড়ল, যেন একে অপরকে নতুনভাবে স্বীকার করল। মিটিং শেষে যখন তারা তাদের ডেস্কে ফিরে এল, তখন প্রথমবার অদ্রিজা কিছুটা খোলামেলা ভাবে ঋত্বিককে জিজ্ঞেস করল, “তুমি আগে এরকম প্রোজেক্ট করেছ?” ঋত্বিক চশমাটা ঠিক করে বলল, “হ্যাঁ, তবে এত বড় স্কেলে নয়। আর তুমি?” অদ্রিজা হেসে জবাব দিল, “আমার জন্যও নতুন অভিজ্ঞতা। দেখি, একসাথে কতটা পারি।” কথাগুলোতে ছিল না কোনো ভান, বরং ছিল একটা সরল আগ্রহ। সেই মুহূর্ত থেকে তারা বুঝল, শুধু কাজের প্রয়োজনে নয়, বরং বোঝাপড়ার একটা সেতু গড়ে তুলতে হবে। এবং ঠিক সেখান থেকেই শুরু হলো তাদের কথোপকথনের আসল অধ্যায়।

প্রথম কয়েকদিন কাজের অজুহাতে তারা খুব কাছাকাছি এল। কখনো অদ্রিজা প্রশ্ন করত—“এই কোডটা একটু ব্যাখ্যা করবে? আমি ধরতে পারছি না।” ঋত্বিক ধৈর্য ধরে বোঝাত, কখনো স্ক্রিন শেয়ার করে, কখনো কাগজে আঁকিয়ে। আবার ঋত্বিকও কনটেন্ট নিয়ে সমস্যায় পড়লে অদ্রিজাই তাকে সাজেশন দিত—কোন শব্দ ব্যবহার করলে ক্লায়েন্ট বেশি প্রভাবিত হবে, কোন ভিজ্যুয়াল আইডিয়া প্রেজেন্টেশনে ব্যবহার করা যায়। এর মধ্যেই কফি তাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠল। রাত বাড়তে থাকলে অফিসের ভেন্ডিং মেশিন থেকে দুটো কফির কাপ নিয়ে অদ্রিজা ফিরে আসত, এক কাপ ঋত্বিকের সামনে ঠেলে দিত, যেন নিঃশব্দে বলছে—“চল, আরেকটু জেগে থাকি।” এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই ধীরে ধীরে এক অদ্ভুত আরাম তৈরি করতে লাগল। অফিসের ভিড়ের মধ্যে তারা ছিল সহকর্মী, কিন্তু ডেস্কের নীরবতায় তারা যেন একে অপরের গল্প শুনতে শুরু করল। ঋত্বিক প্রথমবার হেসে বলল, “তুমি একেবারে অদ্ভুতভাবে নোট নাও। মনে হয় কেউ কবিতা লিখছে।” অদ্রিজা খিলখিলিয়ে হেসে জবাব দিল, “তুমি-ই বা কম? তুমি কোড লিখছো নাকি গানের লিরিক্স, সেটা বোঝা মুশকিল।” এই হালকা মজা-মশকরা তাদের দূরত্ব কমিয়ে দিল, আর অফিসের অন্যরা টের পেতেও পারল না যে নীরবতার আড়ালে আস্তে আস্তে এক সম্পর্কের বীজ বোনা হচ্ছে।

দিন গড়ানোর সাথে সাথে প্রোজেক্টও আকার নিতে লাগল, আর সেই সাথে তাদের বোঝাপড়াও গভীর হলো। অদ্রিজা মাঝে মাঝে ঋত্বিককে অবাক করে দিত তার সাহসী আইডিয়ায়—“প্রেজেন্টেশনে আমরা যদি একটা ছোট ভিডিও ঢুকিয়ে দিই, যেখানে ইউজার এক্সপেরিয়েন্স সরাসরি ফুটে উঠবে, তাহলে কেমন হয়?” ঋত্বিক প্রথমে ভুরু কুঁচকালেও পরে হাসতে হাসতে বলত, “তুমি সবসময় এমন জিনিস ভাবো যেটা আমার মাথায় আসে না, তবে চেষ্টা করলে হয়তো করা সম্ভব।” আবার ঋত্বিক যখন নতুন কোনো টেকনিক্যাল সমাধান বের করত, অদ্রিজা সত্যিই মুগ্ধ হয়ে যেত—“তুমি এত তাড়াতাড়ি এই বাগ ফিক্স করলে কীভাবে? আমি তো ভেবেছিলাম একদিন লেগে যাবে।” এই পারস্পরিক প্রশংসা ও আস্থাই তাদের সম্পর্ককে ধীরে ধীরে ভিন্ন মাত্রা দিল। অফিস শেষে তারা দুজনেই কখনো কখনো একসাথে বেরোত, যদিও সেটা কেবলমাত্র কাজের কথা বলার জন্য—কফি শপে বসে নোট গুছিয়ে নেওয়া, কিংবা কোনো নতুন আইডিয়া ট্রাই করার জন্য। কিন্তু ভেতরে ভেতরে দুজনেই অনুভব করছিল, এ সম্পর্কটা শুধু সহকর্মীর সম্পর্ক নয়, বরং এক অদ্ভুত টান, যা বোঝানো যায় না। হয়তো নামহীন সেই টানই তাদের ধীরে ধীরে একে অপরের দিকে টেনে নিচ্ছিল, আর তারা দুজনেই অপেক্ষা করছিল সেই মুহূর্তটার জন্য, যখন কাজের সীমারেখা ভেঙে যাবে, আর সামনে আসবে নতুন এক পৃথিবী।

(৩)

ডেডলাইনের কড়া চাপ যেন পুরো অফিসের বাতাসকে ভারী করে তুলেছিল। দিন যত এগোচ্ছে, ম্যানেজারের মেইল আর ক্লায়েন্টের মেসেজ যেন প্রতি ঘণ্টায় এসে তাদের মনে করিয়ে দিচ্ছিল—সময় খুব কম, কাজ অনেক বাকি। দিনের বেলা অফিসজুড়ে ভিড় আর ব্যস্ততা থাকলেও রাত নামতেই একে একে সবাই চলে যেতে লাগল। ভেতরে রইল শুধু গুনগুন করা এসির শব্দ, কয়েকটা লাইটের হলুদ আভা, আর মাঝেমধ্যে কফি মেশিনের বীপ। সেই নির্জন পরিবেশের ভেতরেও দুটো ডেস্ক আলোকিত হয়ে থাকল—অদ্রিজা আর ঋত্বিকের। দুজনেই মাথা নিচু করে ল্যাপটপে মগ্ন, মাঝে মাঝে কলমের খটখট বা মাউসের ক্লিক ভাঙছিল নীরবতা। অদ্রিজার চোখে একটু ক্লান্তির ছাপ দেখা যাচ্ছিল, তবুও সে থামছিল না। আর ঋত্বিকের ঠোঁট শক্তভাবে চেপে রাখা, যেন সংকল্প করেছে—আজই কিছুটা এগোতে হবে। তাদের মধ্যে কথাবার্তা খুব কম হচ্ছিল, কিন্তু সেই নীরবতা অস্বস্তিকর নয়; বরং এক ধরনের অদ্ভুত স্বস্তি তৈরি করছিল। রাত যত গড়াতে থাকল, ততই তারা টের পেতে লাগল, এই একসাথে রাত জাগা মানেই শুধু কাজ নয়—এখানে আছে এক নিঃশব্দ সঙ্গ, যা বাইরে কোথাও পাওয়া যায় না।

মাঝে মাঝে তারা দুজনেই ছোট ছোট বিরতি নিত। অদ্রিজা উঠে দাঁড়িয়ে জানলার কাছে যেত, কাচের ওপারে তাকিয়ে দেখত শহরের রাত—রাস্তার আলো, ট্যাক্সির হেডলাইট, কোথাও কোথাও রাতজাগা মানুষদের ছুটোছুটি। সে আস্তে করে বলল, “এই শহরটাকে আমি রাতেই বেশি ভালোবাসি, জানো? দিনের ভিড়ের থেকে অনেক শান্ত।” ঋত্বিক এক মুহূর্তের জন্য হাত থামিয়ে তার দিকে তাকাল। আলো-আঁধারের ভেতর অদ্রিজার চোখে এক ধরনের স্বপ্নিল ঝলক ছিল, যেটা তাকে অজান্তেই টেনে নিল। একটু পরে সে হেসে জবাব দিল, “আমার কাছে রাত মানে কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ। তবে তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে হয়তো আমি ভুল ভাবছিলাম।” অদ্রিজা হাসল, আর সেই হাসির ভেতরে একটা উষ্ণতা ছড়িয়ে গেল, যা ঋত্বিক চেপে রাখতে পারল না। আবার কাজ শুরু হলো—কোড, কনটেন্ট, আর কফির ফাঁকে ফাঁকে তাদের কথোপকথনও একটু একটু করে বাড়তে লাগল। ঋত্বিক মাঝেমধ্যে মজা করে বলত, “তুমি এত কফি খাও, একদিন তোমার নাম কফি-অদ্রিজা হয়ে যাবে।” অদ্রিজা সাথে সাথে জবাব দিত, “আর তুমি হলে রাতের ডেভেলপার—কারণ দিনের আলোতে তোমাকে কখনো দেখাই যায় না।” এভাবেই চাপের ভেতরেও তারা হেসে উঠছিল, আর সেই হাসির ফাঁকে সম্পর্কটা ধীরে ধীরে অন্যদিকে গড়াতে লাগল।

ঘড়ির কাঁটা যখন রাত দুটো ছুঁল, অফিসে আর কাউকে দেখা যাচ্ছিল না। টেবিলে ছড়ানো কাগজ, ফাঁকা কফির কাপ আর ল্যাপটপের আলোয় তাদের মুখ ভাসছিল। কাজ এগোচ্ছিল, কিন্তু তার থেকেও বেশি এগোচ্ছিল তাদের বোঝাপড়া। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল কয়েক মিনিটের জন্য, পুরো ফ্লোর ডুবে গেল আধো অন্ধকারে। শুধু জানলার বাইরে শহরের আলো ভেসে আসছিল। সেই মুহূর্তে তারা দুজনেই একে অপরের দিকে তাকাল, চোখে এক অদ্ভুত স্পর্শহীন স্বীকৃতি। বিদ্যুৎ ফিরতেই তারা আবার কাজে মন দিল, তবে ভেতরে ভেতরে দুজনেই অনুভব করছিল—এ রাতটা আর আগের মতো নয়। এটা শুধুই প্রোজেক্ট শেষ করার রাত নয়, বরং একসাথে সময় কাটানোর অজুহাত, যেখানে নীরবতা কথার থেকেও বেশি কিছু বলছে। যখন অবশেষে ভোরের আলো ফোটার আগে তারা কাজ থামাল, তখন দুজনেই ক্লান্ত অথচ অদ্ভুত সুখে ভরে উঠেছিল। বেরোনোর সময় অদ্রিজা আস্তে বলল, “আজ রাতটা অন্যরকম ছিল।” ঋত্বিক শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি দিল, কিন্তু তার চোখে স্পষ্ট ছিল সেই অঘোষিত অনুভূতি—যা ধীরে ধীরে প্রেমে রূপ নেওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে।

(৪)

সেই রাতে কাজের চাপ একটু হালকা ছিল, তাই ডেডলাইনের টানটান উত্তেজনার বদলে অফিসজুড়ে ছড়িয়ে ছিল এক অলস নির্জনতা। ঘড়ির কাঁটা তখন বারোটার কাছাকাছি, পুরো ফ্লোর প্রায় খালি, শুধু কয়েকটা আলো আর দূরে কোথাও ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের শব্দ। অদ্রিজা হঠাৎ উঠে দাঁড়াল, চোখ কচলাতে কচলাতে বলল, “চল, একটু কফি খেয়ে আসি। ল্যাপটপের আলোয় বসে বসে মাথাটা ঝিমঝিম করছে।” ঋত্বিক কোনো আপত্তি করল না, বরং নিজের ওয়ার্কস্টেশন লক করে চুপচাপ তার পেছন পেছন হাঁটল। অফিস ক্যাফেটা তখন প্রায় ফাঁকা, কয়েকটা টেবিল ফাঁকা পড়ে আছে, আর ভেন্ডিং মেশিনের পাশে ঝুলছে ঝিম ধরা আলো। তারা দুজন এক কোণের টেবিলে বসল, হাতে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ। কফির সুবাস যেন রাতটাকে নতুন করে সাজিয়ে দিল। কয়েক মিনিট তারা চুপচাপ কফি চুমুক দিল, তারপর ধীরে ধীরে কথা শুরু হলো। প্রথমে ছিল অফিস, প্রোজেক্ট আর কোড নিয়ে আলোচনা। কিন্তু কথার স্রোত যখন একটু হালকা হলো, তখন হঠাৎ অদ্রিজা নিজের জীবন নিয়ে বলতে শুরু করল। “জানো, আমি যখন বললাম আমি কর্পোরেট লাইনে আসব, তখন বাড়িতে ভীষণ ঝামেলা বাঁধল। আমার মা-বাবা চেয়েছিলেন আমি পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করি। কিন্তু আমি স্বাধীন হতে চেয়েছিলাম—নিজের টাকা, নিজের সিদ্ধান্ত, নিজের জীবন।” তার গলায় কোনো অভিমান ছিল না, বরং ছিল এক ধরনের দৃঢ়তা। ঋত্বিক মন দিয়ে শুনছিল, চোখে একরকম প্রশংসা ভেসে উঠছিল।

কিছুক্ষণ নীরব থেকে ঋত্বিক হঠাৎ বলল, “আমারও প্রায় একইরকম লড়াই ছিল, যদিও ভিন্নভাবে। আমি দুর্গাপুরে বড় হয়েছি। সেখানে বড় হওয়া মানেই সবাই ধরে নেয়—ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে চাকরি, তারপর বিয়ে আর সংসার। কিন্তু আমি জানতাম আমি শুধু সেফ জব করতে চাই না, আমি চাই কিছু আলাদা তৈরি করতে। তাই কলকাতায় চলে আসি। প্রথম কয়েক মাস ভীষণ কষ্টে কেটেছে—ভাড়া, খাওয়া, পড়াশোনা, সব সামলানো কঠিন ছিল। একা লাগত, কিন্তু এখন মনে হয় ঠিকই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।” বলেই সে কফির কাপটা নামিয়ে টেবিলের ওপর হাত রাখল। অদ্রিজা তার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল, “তুমি জানো, আমরা আসলে একই লড়াই লড়েছি, শুধু রাস্তাগুলো আলাদা। তুমি দুর্গাপুর থেকে শহরে এসেছ নিজের স্বপ্নের জন্য, আর আমি লড়েছি বাড়ির সঙ্গে আমার স্বাধীনতার জন্য।” এই মুহূর্তে দুজনের মধ্যে কোনো কাজের চাপ ছিল না, ছিল কেবল নিঃশব্দ বোঝাপড়া। একে অপরের চোখে তারা নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখল—সংগ্রাম, স্বপ্ন আর এক অদ্ভুত সাহস।

ধীরে ধীরে কথোপকথন হালকা হাসি-ঠাট্টায় মিশে গেল। অদ্রিজা বলল, “তুমি জানো, আমি স্কুলে থাকতে নাটকে অভিনয় করতাম, আর এখন বসে বসে কোড নিয়ে লড়ছি।” ঋত্বিক মজা করে বলল, “অভিনেত্রী হতে পারতে, এখনো সময় আছে—আমি তোমার প্রথম দর্শক হবো।” অদ্রিজা হেসে উঠল, আর সেই হাসি রাতের নির্জনতাকে আলোকিত করে তুলল। আবার ঋত্বিক নিজের কলেজ জীবনের কিছু দুষ্টুমি শোনাল—কীভাবে সে আর তার বন্ধুরা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখতে যেত, কিংবা মাঝরাতে চুপিচুপি হোস্টেল থেকে বেরিয়ে ফুটপাথে চা খেতে যেত। অদ্রিজা হেসে চোখে জল এনে ফেলল, বলল, “তুমি একেবারে অদ্ভুত, কখনো ভাবিনি তোমার ভেতরে এত গল্প আছে।” তারা বুঝতেই পারল না, কফির কাপ কতবার খালি হলো, কিংবা ঘড়ির কাঁটা কখন ভোরের দিকে গড়াল। হাসি, মজা আর গল্পের ফাঁকে তাদের সম্পর্কটা যেন অদৃশ্যভাবে বদলে যাচ্ছিল। সেই টেবিল, সেই কফির গন্ধ, আর সেই রাত—সবকিছু মিলে যেন গড়ে তুলছিল এক গোপন জায়গা, যেখানে তারা দুজনেই নিরাপদ, মুক্ত আর অদ্ভুতভাবে একে অপরের কাছে। আর যখন ক্যাফের আলো নিভে যাওয়ার সময় হলো, তখন তারা দুজনেই নিঃশব্দে বুঝে গেল—এই বন্ধুত্বের ভেতর আসলে আরও গভীর কিছু জন্ম নিচ্ছে।

(৫)

সেই দিনটা ছিল একেবারে সাধারণ—সকাল থেকে ব্যস্ততা, মিটিং, প্রেজেন্টেশন আর ক্লায়েন্টের কল। সন্ধে গড়িয়ে রাত নামতেই অফিসের ভিড় ধীরে ধীরে কমতে লাগল। অদ্রিজা আর ঋত্বিক তখনও ব্যস্ত নিজেদের প্রোজেক্ট নিয়ে। রাত প্রায় সাড়ে দশটা বাজে, দুজনেই ভাবল এবার বাড়ি ফেরা দরকার। অফিস বিল্ডিংয়ের লিফটে পা রাখতেই হঠাৎ আলো টিমটিম করে উঠল, আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সব অন্ধকার হয়ে গেল। বিদ্যুৎ চলে গেছে। প্রথমে একেবারে নিস্তব্ধতা, তারপর কোথাও থেকে হালকা শব্দ—মনে হলো লিফট আটকে গেছে। অদ্রিজা কেঁপে উঠল, “ওহ গড! বিদ্যুৎ গেল?” তার গলায় ভয় মিশে ছিল। ঋত্বিক শান্ত গলায় বলল, “চিন্তা কোরো না, জেনারেটর চালু হবে, কয়েক মিনিটের ব্যাপার।” কিন্তু শব্দহীন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা সহজ ছিল না। চারপাশে পিচ কালো অন্ধকার, শুধু ফোনের স্ক্রিনের ক্ষীণ আলো মাঝে মাঝে তাদের মুখে পড়ে যাচ্ছিল। অদ্রিজা অজান্তেই ঋত্বিকের হাতের কাছে সরে এল, আর হালকা করে তার বাহুতে ছোঁয়া লাগল। স্পর্শটা ছিল খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু সেই অন্ধকার আর নীরবতায় সেটা যেন হঠাৎ করে অদ্ভুত এক আবেগ জাগিয়ে তুলল।

ঋত্বিক টের পেল, অদ্রিজা তার হাতটা আঁকড়ে ধরেছে। সে চমকে উঠল, আবার নিজেকে সামলে নিল। আসলে ভয় পেলে কেউ কাউকে এভাবে আঁকড়ে ধরতে পারে—এটাই স্বাভাবিক। তবু ভেতরে ভেতরে সে অনুভব করল, এই ছোঁয়াটা শুধু ভয়ের নয়, এর ভেতরে লুকিয়ে আছে এক অন্যরকম টান। অদ্রিজার হাতের উষ্ণতা, তার দ্রুত শ্বাস, আর নিস্তব্ধ পরিবেশে হৃদস্পন্দনের আওয়াজ—সব মিলিয়ে মুহূর্তটা অবর্ণনীয় হয়ে উঠেছিল। কিছু বলতে গিয়েও ঋত্বিক থেমে গেল, কারণ তার মনে হচ্ছিল এই নীরবতাই অনেক কিছু বলে দিচ্ছে। অদ্রিজাও হয়তো সেটা টের পাচ্ছিল। সে আস্তে করে ফিসফিস করে বলল, “তুমি আছো তো? আমি একদমই অন্ধকার সহ্য করতে পারি না।” ঋত্বিক খুব শান্তভাবে জবাব দিল, “আমি আছি। ভয় পেয়ো না।” কথাগুলো ছিল সাধারণ, কিন্তু সুরের ভেতরে অদ্ভুত এক আশ্বাস মিশে ছিল। তারা দুজনেই বুঝতে পারছিল, লিফটের ভেতরে এই কয়েক মিনিট যেন তাদের সম্পর্কের সীমারেখা নড়বড়ে করে দিচ্ছে। এটা আর শুধু সহকর্মীর বন্ধুত্ব নয়, এখানে জন্ম নিচ্ছে অন্য এক অনুভূতি, যা স্বীকার করা যায় না সহজে, কিন্তু অস্বীকারও করা যায় না।

মিনিট দশেক পর অবশেষে আলো জ্বলে উঠল, লিফট আবার চলতে শুরু করল। অদ্রিজা দ্রুত হাতটা সরিয়ে নিল, যেন কিছুই ঘটেনি। তারা দুজনেই মুখে কিছু বলল না, শুধু চোখাচোখি হলো একবার, আর সেই চোখাচোখিতেই লুকিয়ে রইল হাজারো কথা। বিল্ডিংয়ের বাইরে বেরিয়ে আসার পরও পরিবেশে এক ধরনের অস্বস্তিকর নীরবতা ছিল, কিন্তু সেটা বিরক্তিকর নয়—বরং যেন অদ্ভুত মিষ্টি। ঋত্বিক ট্যাক্সি ডাকতে গিয়ে একবার পিছনে তাকাল, অদ্রিজা তখনও তার দিকে তাকিয়ে ছিল। দুজনের ঠোঁটে এক হালকা হাসি খেলে গেল, যেটা কথা বলার থেকেও বেশি কিছু প্রকাশ করে ফেলল। সেদিন বাড়ি ফেরার সময় তারা দুজনেই বারবার সেই মুহূর্তটা মনে করল—অন্ধকার, হাতের ছোঁয়া, আর সেই অদ্ভুত টান। তারা কেউই জোরে জোরে উচ্চারণ করতে পারল না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে দুজনেই জানল—এটা আর শুধু প্রোজেক্ট পার্টনারশিপ নয়, কিছু গভীর, কিছু নিষিদ্ধ অথচ অপ্রতিরোধ্য আবেগ ধীরে ধীরে জন্ম নিচ্ছে।

(৬)

সকাল থেকেই অফিসজুড়ে এক ধরনের ব্যস্ততা ছড়িয়ে ছিল। নতুন এক গুরুত্বপূর্ণ ক্লায়েন্ট আসছেন, তাই সবার ভেতর উত্তেজনা। মিটিংরুম সাজানো হয়েছে, প্রেজেন্টেশনের শেষ রিহার্সাল চলছে। অদ্রিজা খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তার অংশটা প্রস্তুত করছিল, তার চোখে-মুখে সেই স্বাভাবিক উজ্জ্বলতা, যেটা তাকে আলাদা করে তোলে। ঋত্বিক পাশ থেকে সব দেখছিল, আর ভেতরে ভেতরে গর্ব অনুভব করছিল। কিন্তু এই গর্বের স্রোতের ভেতরেই হঠাৎ এক অচেনা অনুভূতি ঢুকে পড়ল, যখন দেখল সহকর্মী সুহানি ঠাট্টা করে বলছে, “দেখেছো? অদ্রিজা তো একেবারে আমাদের টিমের শোস্টপার। ক্লায়েন্ট মিটিং মানেই এখন ওর ওপর ফোকাস থাকবে।” কথাটা হালকা মজার ছলে বলা হলেও ঋত্বিকের মনে কেমন যেন বিঁধল। মিটিং শুরু হতেই সেই শঙ্কা আরও বেড়ে গেল। ক্লায়েন্ট ছিলেন মধ্যবয়সী কিন্তু প্রাণবন্ত স্বভাবের, তিনি অদ্রিজার প্রেজেন্টেশন মন দিয়ে শুনছিলেন, আর বারবার তার দিকে ঝুঁকে প্রশ্ন করছিলেন। তার চোখেমুখে যে আগ্রহ, সেটা শুধু প্রফেশনাল ছিল না, যেন তার আত্মবিশ্বাসী হাসি আর ভঙ্গিমায় তিনি ব্যক্তিগতভাবেও আকৃষ্ট হচ্ছিলেন। ঋত্বিক একবার অদ্রিজার দিকে তাকাল, দেখল সে স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে, হেসে জবাব দিচ্ছে, অথচ এই দৃশ্য তার বুকের ভেতর হঠাৎ যেন অদৃশ্য আগুন জ্বালিয়ে দিল।

ঋত্বিক বুঝতে পারছিল, আসলে কিছুই ভুল হচ্ছে না। অদ্রিজা তার কাজ করছে, ক্লায়েন্ট তার প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে—এটাই স্বাভাবিক। তবু কেন জানি ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি আর অজানা হিংসা দানা বাঁধছিল। সুহানির হালকা মজাগুলো, ক্লায়েন্টের অদ্রিজার দিকে বারবার তাকানো, আর সেই আত্মবিশ্বাসী হাসি—সবকিছু মিলিয়ে তার মনে হচ্ছিল, সে যেন ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাচ্ছে। সে কখনো ভাবেনি, অদ্রিজা তার কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বন্ধুত্ব? না, সেটা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি হাসি, প্রতিটি কথোপকথন, প্রতিটি রাত জাগা কাজের মুহূর্ত—সব তার ভেতরে অদ্রিজাকে অন্যরকম জায়গায় বসিয়ে দিয়েছে। এখন অন্য কারো দৃষ্টি সেখানে গিয়ে পৌঁছালে কেন যেন অসহনীয় লাগে। মিটিং শেষ হওয়ার পর সবাই যখন করতালি দিল, অদ্রিজা সন্তুষ্টির হাসি নিয়ে তার ফাইল গুছাচ্ছিল। তখনও ঋত্বিকের মনে কেমন একটা অস্থিরতা কাজ করছিল। সে নিজের মনে বলতে লাগল, “আমি কি তবে সত্যিই হিংসে করছি? ও তো আমার সহকর্মী, বন্ধুই শুধু… কিন্তু যদি শুধু বন্ধু হতো, তবে কি এই অস্থিরতা এত গভীর হতো?”

মিটিং শেষে লাঞ্চ ব্রেকে সুহানি আবার মজা করে বলল, “অদ্রিজা, আজ তো একেবারে তুমি শো চুরি করলে। ক্লায়েন্ট তো চোখ সরাতেই পারছিল না তোমার থেকে।” বাকিরা হেসে উঠলেও ঋত্বিক চুপ করে রইল। তার মুখে হাসি ছিল না, বরং ভেতরে ভেতরে অদৃশ্য এক টানাপোড়েন চলছিল। সে চেষ্টা করছিল নিজের অনুভূতিকে চাপা দিতে, কিন্তু মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে। সেদিন সন্ধের পর অফিস ফাঁকা হলে অদ্রিজা যখন তার কাছে এসে হালকা করে বলল, “কেমন লাগল আজকের প্রেজেন্টেশন?”—ঋত্বিক কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো বলে ফেলে—“ভালো লেগেছে, কিন্তু ভালো লাগার থেকেও বেশি আমি হিংসে করেছি।” তবে মুখে শুধু বলল, “দারুণ ছিল।” অদ্রিজার চোখে কৃতজ্ঞতার ঝিলিক দেখা গেল, কিন্তু ঋত্বিক জানত, এই ঝিলিক শুধু প্রফেশনাল সফলতার আনন্দ, এর ভেতরে তার অনুভূতির কোনো প্রতিফলন নেই। তবু সেই রাতে বাড়ি ফিরে ঋত্বিকের মনে একটাই কথা বারবার ঘুরপাক খেতে লাগল—অদ্রিজা তার কাছে কেবল সহকর্মী নয়, আরও অনেক বেশি কিছু। আর সেটা স্বীকার না করলেও, তার ভেতরের হিংসা আজ তাকে সত্যিটা স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিল।

(৭)

সেদিন রাতটা ছিল চরম চাপের। ডেডলাইন সামনে, অথচ প্রোজেক্টের কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়ে তর্ক চলছিল থেমে থেমে। অফিসে তখন প্রায় সবাই চলে গেছে, শুধু অদ্রিজা আর ঋত্বিক বসে আছে আলো-আঁধারি ফ্লোরে। টেবিলের উপর ছড়িয়ে আছে ল্যাপটপ, প্রিন্টআউট আর কফির খালি কাপ। অদ্রিজা প্রমাণ করতে চাইছিল, তার কনটেন্টের লজিকটাই সঠিক, কিন্তু ঋত্বিকের মতে সেটা টেকনিক্যালি কার্যকর হবে না। কথা থেকে কথায় স্বর একটু চড়ে উঠল, দুজনের চোখে ক্লান্তি আর স্নায়ুর টান স্পষ্ট। “তুমি সব সময় ভাবো তুমি ঠিক,” অদ্রিজা হঠাৎ রেগে গিয়ে বলে ফেলল। ঋত্বিকও চুপ করে রইল না, উত্তর দিল গম্ভীর গলায়, “কারণ আমি জানি কোনটা কাজ করবে আর কোনটা করবে না।” দুজনেই বুঝছিল, এটা কাজের ঝগড়া হলেও এর ভেতরে জমে থাকা চাপ আর অজানা আবেগ মিলেমিশে এক অস্থির পরিবেশ তৈরি করছে। অদ্রিজার চোখ লাল হয়ে উঠছিল রাগে, কণ্ঠ কেঁপে যাচ্ছিল। সে একসময় ল্যাপটপ বন্ধ করে একপাশে সরে গিয়ে বসল, আর হঠাৎ করেই তার চোখ ভিজে উঠল। অশ্রু গড়িয়ে পড়ল গালে, যেন দিনের পর দিন জমে থাকা ক্লান্তি আর চাপে বাঁধ ভেঙে গেছে।

ঋত্বিক প্রথমে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার রাগও তখনো কমেনি, কিন্তু অদ্রিজাকে কাঁদতে দেখে বুকের ভেতর কেমন যেন ভেঙে গেল। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে চুপচাপ তার পাশে বসে পড়ল। “শোনো, আমি চেঁচিয়ে বলার জন্য সরি… আমি সত্যিই তোমাকে হেয় করতে চাইনি।” কথাগুলো বলার সময় তার গলায় অপরাধবোধ স্পষ্ট হচ্ছিল। অদ্রিজা মাথা নিচু করে বসেছিল, চোখের জল মুছছিল হাতের পিঠ দিয়ে। ঋত্বিক আস্তে করে তার হাতটা ধরে বলল, “এভাবে ভেঙে পড়ো না, প্লিজ। তুমি জানো না, তোমার চেষ্টা আর পরিশ্রম আমি কতটা অ্যাপ্রিশিয়েট করি।” সেই মুহূর্তে অদ্রিজার চোখ ঋত্বিকের দিকে উঠল—চোখজোড়া ভিজে, কিন্তু ভেতরে লুকানো ভরসার আভা দেখা যাচ্ছিল। এই চোখের ভাষা ঋত্বিককে কাঁপিয়ে দিল ভেতর থেকে। এতদিন ধরে যে টান অদৃশ্য সুতোর মতো তাদের জড়িয়ে রেখেছিল, আজ মনে হচ্ছিল সেটাই ফেটে বেরোচ্ছে। অদ্রিজা ঠোঁট কাঁপিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু শব্দ আটকে গেল। ঋত্বিক আর নিজেকে সামলাতে পারল না, হাত বাড়িয়ে তার গাল ছুঁয়ে বলল, “তুমি জানো না তুমি আমার কাছে কতটা…” বাকিটা আর শেষ করতে হলো না।

সেই মুহূর্তটাই যেন ভেঙে দিল সব বাঁধা। অদ্রিজা ধীরে ধীরে চোখ বুজে ফেলল, আর ঋত্বিক তার দিকে ঝুঁকে এল। চারপাশে নিস্তব্ধতা, শুধু মৃদু আলো আর হৃদস্পন্দনের শব্দ। তাদের ঠোঁট একে অপরকে ছুঁল—প্রথমবার। সেটা খুব দীর্ঘ নয়, খুব প্রকাশ্যও নয়, কিন্তু তার ভেতরে জমে থাকা আবেগের তীব্রতা ছিল অসীম। যেন দিনের পর দিন অদৃশ্যভাবে ঘনীভূত হওয়া অনুভূতিগুলো এক নিমেষে বাইরে বেরিয়ে এলো। চুম্বনের পর দুজনেই স্থির হয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড, তারপর আস্তে আস্তে দূরে সরে এল, কিন্তু চোখের দৃষ্টি আর মিলন ভাঙল না। অদ্রিজার গালে তখনও অশ্রুর রেখা, কিন্তু ঠোঁটে এক অদ্ভুত শান্তির হাসি ফুটে উঠেছিল। ঋত্বিক তার হাত শক্ত করে ধরে রাখল, আর সেই মুহূর্তে তারা দুজনেই বুঝল—এই সম্পর্ক আর আগের জায়গায় নেই। কাজের অজুহাত, বন্ধুত্ব কিংবা কৌতূহল—সব ছাড়িয়ে এক অনিবার্য আবেগ আজ তাদের দুজনকে প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে।

(৮)

চুমুর পরের দিন সকালটা যেন দুজনের কাছে অদ্ভুত অচেনা হয়ে এল। অফিসের করিডরে যেদিকে তাকায়, সেদিকেই যেন চোখে পড়ে একে অপরকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা। অদ্রিজা ডেস্কে বসে ল্যাপটপ চালু করল, কিন্তু তার চোখের সামনে কোডের লাইনগুলো কেবল ভেসে যাচ্ছে—গত রাতের স্মৃতিটাই ঘুরেফিরে মাথায় আসছে। সেই মুহূর্তের আবেগ, স্পর্শের উষ্ণতা, আর সেই চুমুর নিঃশব্দ ভাষা তাকে বিচলিত করে তুলছিল। কাজ করতে গিয়ে মাঝে মাঝেই তার মনে হচ্ছিল, ঋত্বিক পাশে বসেই আছে, অথচ আজ যেন অনেক দূরে সরে গেছে। অদ্রিজা ভেবে পাচ্ছিল না, এটা কি কেবল রাত জাগার ক্লান্তিতে তৈরি হওয়া এক মুহূর্তের আবেগ, নাকি আসলেই তার ভেতরে কোনো গভীর সম্পর্কের শুরু? তার স্বাধীনতা, তার নিজের জীবন নিয়ে যে লড়াই, তার মাঝখানে নতুন এক অনুভূতি ঢুকে পড়ায় সে বিভ্রান্ত বোধ করছিল। এদিকে ঋত্বিকও নিজের মতো করে অস্বস্তি নিয়ে দিন কাটাচ্ছিল। কাজের মাঝেই যখন চোখে চোখ পড়ে যেত, সে দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে নিত, যেন চুপচাপ নিজের ভেতরের অস্থিরতাকে আড়াল করতে চাইছে। তার মাথায় বারবার ঘুরছিল, “আমি কি ভুল করেছি? নাকি এটাই আমাদের শুরু?”

ধীরে ধীরে অফিসে তাদের মধ্যে সেই আগের সহজতা যেন মিলিয়ে যাচ্ছিল। লাঞ্চের সময় যেখানে একসাথে বসে খাওয়ার অভ্যাস ছিল, আজ তারা আলাদা টেবিলে বসতে শুরু করল। টিম মেম্বাররা কিছুই টের পাচ্ছিল না, কিন্তু অদ্রিজা আর ঋত্বিক দুজনেই ভেতরে ভেতরে অনুভব করছিল, এক অদ্ভুত দ্বিধা তাদের গ্রাস করেছে। অদ্রিজা বারবার নিজেকে বোঝাচ্ছিল—“না, এটা শুধু কাজের চাপের ফল। আমি কাউকে এত দ্রুত জীবনের ভেতর ঢুকতে দিতে চাই না।” অথচ তার ভেতরের আরেকটা অংশ বলছিল, “কিন্তু এত সহজে কি ভুলে থাকা যায়? ওর হাসি, ওর সান্ত্বনা, ওর পাশে দাঁড়ানোর ভরসা—এসব কি সত্যিই কেবল এক রাতের আবেগ?” অন্যদিকে ঋত্বিকের ভেতরে তীব্র দ্বন্দ্ব চলছিল। সে ভেবেছিল, এক মুহূর্তের আবেগ হয়তো পরের দিন সবকিছু আরও সহজ করে দেবে, কিন্তু তার উল্টো হলো। প্রতিটা মুহূর্তে অদ্রিজার প্রতি তার আকর্ষণ আরও বেড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু সেটা প্রকাশ করার সাহস পাচ্ছিল না। সে ভাবছিল, যদি অদ্রিজা এটা নিয়ে অস্বস্তি বোধ করে, যদি ভেবে নেয় এটা কেবল একটা ভুল? তখন তাদের বন্ধুত্ব, তাদের টিমওয়ার্ক সবকিছু ভেঙে যাবে। এই ভয়ের কারণেই সে আরও চুপ হয়ে যাচ্ছিল, আর সেই চুপ হয়ে যাওয়াটাই অদ্রিজার কাছে ঠান্ডা দূরত্বের মতো লাগছিল।

তবে তাদের ভেতরের আবেগ যতই অস্বস্তি তৈরি করুক, ভাগ্যের খেলাটা যেন তাদের বারবার একসাথে ফেলে দিচ্ছিল। ডেডলাইনের কারণে আবারও রাতে অফিসে আটকে থাকতে হচ্ছিল দুজনকে। চারপাশ ফাঁকা হয়ে গেলেও তারা এবার আর একে অপরের সঙ্গে খুব একটা কথা বলল না। অদ্রিজা মাথা নিচু করে কাজ করছিল, ঋত্বিক দূরে সরে গিয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে ছিল। তবুও মাঝে মাঝে একে অপরের নিঃশ্বাসের শব্দ, বা কফির কাপে হাতের ছোঁয়া তাদের মনে করিয়ে দিচ্ছিল—তাদের মধ্যে যে কিছু ঘটেছিল, সেটা ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। বরং সেই নীরবতা তাদের আরও টেনে আনছিল, যদিও মুখে কেউ কিছু বলছিল না। গভীর রাতের নিস্তব্ধতায় যখন লিফটের শব্দ ভেসে এলো, তখন দুজনের চোখে একসাথে তাকিয়ে পড়ল এক মুহূর্তের জন্য, আর সেই দৃষ্টি যেন হাজারো অনুচ্চারিত প্রশ্ন করে গেল—“আমরা কি সত্যিই দূরে সরে যাব? নাকি এই দ্বিধার ভেতর দিয়েই একদিন নিজেদের উত্তর খুঁজে নেব?” সেদিন রাতটা শেষ হলো কোনো কথা ছাড়াই, কিন্তু তাদের মনের ভেতরে এক অদ্ভুত প্রতীক্ষা রয়ে গেল—এই দ্বিধা, এই দূরত্ব হয়তো সাময়িক, হয়তো একদিন এর মধ্য দিয়েই সত্যিকারের সম্পর্কের জন্ম হবে।

(৯)

ভবনের কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে তখন শহরের আলো ঝিলমিল করছে। রাত অনেক হয়েছে, তবু ভেতরে নিস্তব্ধতার মাঝে শুধু দুইজন মানুষ—অদ্রিজা আর ঋত্বিক—তাদের ল্যাপটপে চোখ রেখে কাজ শেষ করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। পরের দিনই বড় প্রেজেন্টেশন, তাই কোনো ফাঁক রাখা যাবে না। একে অপরের সঙ্গে না বললেও বোঝা যাচ্ছিল, দুজনের ভেতরেই এক ধরনের চাপ কাজ করছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একসাথে কাজ করতে করতে যখন অবশেষে সব ফাইল সেভ হলো, স্লাইডশো নিখুঁত মনে হলো, তখন দুজনের মুখে স্বস্তির নিশ্বাস ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু সেই স্বস্তির পরেই যেন এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এলো। অফিস ফ্লোরে তখন আর কেউ নেই, শুধু তাদের ল্যাপটপের আলো আর কফির শেষ কাপের গন্ধ। টেবিল গুছাতে গিয়েও অদ্রিজা বারবার ঋত্বিকের দিকে তাকাচ্ছিল, চোখে এমন কিছু যা কথায় বলা সম্ভব নয়। ঋত্বিকও চেয়ারের হাতল ঘুরিয়ে বসে ছিল, তার দৃষ্টি আটকে ছিল অদ্রিজার দিকে। এতদিন ধরে তারা যতটা কাছাকাছি এসেছে, তবু যেন কোনো অদৃশ্য দেয়াল তাদের আলাদা করে রেখেছিল। আজ রাতের সেই নীরবতা আর একাকীত্বে, দেয়ালটা ভেঙে পড়ার অপেক্ষায়।

“সব শেষ… অবশেষে আমরা পারলাম,” অদ্রিজা হালকা হাসি দিয়ে বলল, কিন্তু তার কণ্ঠে এক অদ্ভুত কাঁপুনি ছিল। ঋত্বিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আস্তে করে উত্তর দিল, “হ্যাঁ, প্রোজেক্ট শেষ হলো… কিন্তু আমার মনে হয় না আজ রাতটা এত সহজে শেষ হবে।” অদ্রিজার হাত থেমে গেল ফাইল গুছানোর মাঝেই। সে ধীরে ধীরে চেয়ারে বসে পড়ল, আর দু’জনের মাঝে হাওয়ায় জমে থাকা টান আরও ঘন হতে লাগল। অনেকদিন ধরে লুকিয়ে রাখা, অব্যক্ত আবেগের স্রোত যেন হঠাৎ ফেটে বেরোতে চাইছিল। অদ্রিজা আস্তে করে বলল, “ঋত্বিক, জানো তো… আমি সব সময় ভেবেছি কাজটাই আমাদের একসাথে রেখেছে। কিন্তু প্রতিদিন তোমার সঙ্গে সময় কাটিয়ে, তোমার সঙ্গে লড়াই করে, হাসি ভাগ করে… আমি বুঝতে পারছি, এটা শুধু কাজ নয়।” কথাটা শেষ হতে না হতেই তার চোখে জল এসে গেল, যেন এই স্বীকারোক্তির ভেতরেই একটা মুক্তি লুকিয়ে ছিল। ঋত্বিক চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর এক ধাপ এগিয়ে এসে অদ্রিজার হাত ধরে ফেলল। তার চোখে দৃঢ়তা, কণ্ঠে কোমলতা—“আমি অনেকদিন ধরে এটা বলতে চাইছিলাম, কিন্তু সাহস পাইনি। সত্যিটা হলো—আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।”

সেই মুহূর্তে চারপাশের সবকিছু মিলিয়ে যেন কেবল তারা দুজনেই থেকে গেল। নীরব অফিস, বাইরে শহরের ম্লান আলো, আর ভেতরে দুটি হৃদয়ের তীব্র ধুকপুকানি। অদ্রিজা আর কিছু না বলে ঋত্বিকের কাঁধে মাথা রেখে দিল, যেন এতদিনের সব দ্বিধা একসাথে ভেঙে গেল। তাদের চোখে চোখ পড়তেই আবারও সেই আবেগের ঢেউ ছুটে এলো। এবার আর কোনো দ্বিধা রইল না, তারা একে অপরের ঠোঁটে ঝুঁকে পড়ল—এবারের চুম্বন দীর্ঘ, স্পষ্ট, মুক্ত। কোনো লুকোচুরি নয়, কোনো বাধা নয়, শুধু খোলা আকাশের নিচে তাদের প্রেমের অকপট স্বীকারোক্তি। অদ্রিজা ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বলল, “হ্যাঁ, এটা প্রেম… আমি তোমাকে ভালোবাসি।” ঋত্বিকের হাত শক্ত করে ধরা, চোখ ভিজে উঠল, সে উত্তর দিল, “আমি জানতাম, কিন্তু আজ শুনে মনে হচ্ছে সবকিছু পূর্ণ হলো।” সেই রাতে আর কাজের চাপ, প্রেজেন্টেশনের দুশ্চিন্তা, বা শহরের ব্যস্ততা তাদের মনে ছিল না। ছিল শুধু একে অপরকে খুঁজে পাওয়ার উচ্ছ্বাস, আর সেই স্বীকারোক্তির শান্তি। অফিসের ফাঁকা ফ্লোরে দুজন মানুষ দাঁড়িয়েছিল, যারা অবশেষে নিজেদের ভেতরের প্রেমকে জেনে নিয়েছে, মেনে নিয়েছে, আর প্রকাশ করেছে। সেই শেষ রাতটাই তাদের জীবনের নতুন শুরু হয়ে রইল।

(১০)

প্রেজেন্টেশনের দিন সকালটা যেন অন্যরকম আলোয় ভরে উঠেছিল। অফিস ভবনের কনফারেন্স রুমে একে একে আসন ভরতে শুরু করল ক্লায়েন্ট, সিনিয়র ম্যানেজার আর টিম লিডরা। পরিবেশে চাপা উত্তেজনা, কেউ কারও দিকে খুব একটা কথা বলছে না। অদ্রিজা আর ঋত্বিক নিজেদের প্রস্তুতি নিয়ে একে অপরের দিকে একবার তাকাল, আর দুজনের চোখে ভেসে উঠল আগের রাতের প্রতিশ্রুতির ছাপ। ল্যাপটপে স্লাইড চালু হতেই রুম জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল নিখুঁত পরিকল্পনা, সঠিক ব্যাখ্যা আর নির্ভুল প্রেজেন্টেশন। ঋত্বিক যখন টেকনিক্যাল অংশগুলো বোঝাচ্ছিল, তখন অদ্রিজা কনটেন্ট আর conceptual দিকগুলো দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরছিল। দুজনের কণ্ঠের ওঠানামা, একে অপরকে সম্পূর্ণ করে দেওয়ার মতো পারফেক্ট টিমওয়ার্ক, সবাইকে মুগ্ধ করে ফেলল। প্রেজেন্টেশন শেষ হওয়ার পর যখন ক্লায়েন্ট হাততালি দিয়ে বলল—“This is exactly what we needed”—তখন তাদের টিম মেম্বাররা একে অপরের দিকে হেসে তাকাল, আর অভীক বসু গর্বিত দৃষ্টিতে মাথা নাড়ল। ঋত্বিক আর অদ্রিজার ভেতরে এক গভীর স্বস্তি ছড়িয়ে পড়ল, তবে তার থেকেও বেশি আনন্দ ছিল, এই সাফল্যটা একসাথে ভাগ করে নেওয়ার। তারা দুজনেই জানত, এই মুহূর্তটা শুধু প্রফেশনাল জয়ের নয়, একে অপরকে নতুনভাবে পাওয়ারও প্রতীক।

বিকেলের দিকে কাজের চাপ ধীরে ধীরে কমে এলো। টিম মেম্বাররা সবাই বাইরে চলে গেল, আর অফিস ক্যাফেতে হালকা সঙ্গীত বাজছিল। জানলার ধারে ছোট গোল টেবিলে বসে ছিল অদ্রিজা আর ঋত্বিক, সামনে দুটো ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ। তারা দুজনেই ক্লান্ত, তবে সেই ক্লান্তির মাঝেই এক অদ্ভুত প্রশান্তি ছিল। অদ্রিজা কাপটা হাতে নিয়ে বলল, “আমরা হয়তো শুধু কাজের জন্য একসাথে হয়েছিলাম, কিন্তু আজ আমি বুঝতে পারছি, আমাদের সম্পর্কটা ওর থেকেও অনেক বড়।” ঋত্বিক তার দিকে তাকিয়ে একটু থেমে উত্তর দিল, “হ্যাঁ, আজ আর কোনো সন্দেহ নেই। এই বন্ধন রাত জাগা বা প্রোজেক্ট শেষ করার জন্য নয়। আমি চাই, প্রতিটা সকাল, প্রতিটা সন্ধ্যা তোমার সঙ্গে ভাগ করতে।” কথাটা বলার সময় তার কণ্ঠে এত আন্তরিকতা ছিল যে অদ্রিজার চোখ ভিজে উঠল। সে হেসে ফেলল অশ্রুভেজা চোখেই, তারপর আস্তে করে বলল, “প্রতিশ্রুতি দাও, আমরা শুধু কাজ নয়, জীবনের প্রতিটা অধ্যায় একসাথে লিখব।” ঋত্বিক হাত বাড়িয়ে তার হাতটা শক্ত করে ধরল। “প্রতিশ্রুতি দিলাম,” সে বলল, “যেভাবে এই কফির গন্ধ আমাদের রাতগুলোকে উষ্ণ করেছে, সেভাবেই আমাদের ভবিষ্যতও উষ্ণ আর মিষ্টি হবে।”

সেই মুহূর্তে ক্যাফের জানলার বাইরে সন্ধ্যার আলো ধীরে ধীরে নেমে আসছিল। শহরের কোলাহল ভেসে আসছিল দূর থেকে, কিন্তু ভেতরে শুধু দুজন মানুষের নিঃশব্দ প্রতিশ্রুতি বাজছিল আরও জোরে। কফির উষ্ণ ধোঁয়া তাদের মুখে ছুঁয়ে যাচ্ছিল, আর মনে হচ্ছিল যেন এই কাপটাই তাদের সম্পর্কের প্রতীক—শুরুটা গাঢ়, তীব্র, কিন্তু শেষটা উষ্ণ আর প্রশান্ত। অদ্রিজা আর ঋত্বিক বুঝতে পারছিল, এই পথটা সহজ হবে না; কাজের চাপ, সময়ের অভাব, জীবনের অজস্র বাঁধা তাদের আসবেই। কিন্তু আজ তারা দুজনেই জানত, একসাথে থাকলে কোনো চাপ, কোনো অন্ধকারই ভয়ঙ্কর হবে না। তাদের চোখে তখন শুধু ভবিষ্যতের ছবি—একসাথে হাঁটা, একসাথে লড়াই, আর একসাথে প্রতিটা সাফল্য উদযাপন করা। সেদিন সেই ক্যাফের টেবিলেই তারা নিজেদের সম্পর্কের নতুন নাম দিল—প্রেম, প্রতিশ্রুতি, আর জীবনের সঙ্গ। কফির কাপে শেষ চুমুক নিয়ে তারা দুজনেই হাসল, আর মনে মনে জানল, “কোয়ার্ক ক্যাফের প্রেম” কেবল একটা কাহিনি নয়, বরং তাদের জীবনের আসল শুরু।

(শেষ)

1000055430.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *