তপতী ঘোষাল
১
ঝাড়গ্রামের পাতাঝরা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলেছে একটা পুরনো জিপ, যার ইঞ্জিনের গর্জন আর পেছনের চাকার কাদামাখা ঝাঁকুনিতে ভেসে যাচ্ছে অরণ্যের শান্তি। বসন্তের শেষ সপ্তাহ, গাছগুলো যেন নিজেদের সবুজ পোশাক খুলে রেখেছে – পাতাগুলো শুকিয়ে পড়ে আছে মাটিতে, যার উপর গাড়ির টায়ার টেনে দিচ্ছে সরু দাগ। জিপের ভিতর বসে থাকা স্পেনীয় গবেষক ড. লুইস রডরিগেজ জানালার বাইরে তাকিয়ে হঠাৎ চমকে উঠলেন—একটা কালো কুড়ুলের মতো আকৃতির কিছু খুব দ্রুত রাস্তা পেরিয়ে গেল। পাশে বসা স্থানীয় গাইড গঙ্গা হাঁসদা বলল, “এইসব কিছু না স্যার… সাপেরা এই সময় খুব সক্রিয় থাকে।” লুইসের ঠোঁটে অদ্ভুত একটা হাসি ফুটে উঠল। সে বহুদিন ধরেই ভারতের আদিম সম্প্রদায়, বিশেষত সাপ-ভিত্তিক ধর্মবিশ্বাস নিয়ে গবেষণা করছে। কিছুদিন আগে কলকাতায় এক পুরাতাত্ত্বিক সম্মেলনে শুনেছিল—ঝাড়গ্রামের গভীর জঙ্গলে এখনো একটা প্রাচীন নাগতান্ত্রিক সম্প্রদায় আছে, যারা “নাগিনী” নামের এক নারী-দেবীর উপাসনা করে। বহু বছর আগে ব্রিটিশরা এই এলাকায় এসে অনেক উপাসনালয় ধ্বংস করলেও নাকি এই সম্প্রদায় বেঁচে থেকেছে অরণ্যের গর্ভে। সে এসব গল্পের সত্যতা যাচাই করতেই এসেছে এখানে। তার সঙ্গে এসেছে কলকাতার একজন সাংবাদিক, মৌলি সেনগুপ্ত, যিনি চেয়েছেন পুরো অভিযানের একটি তথ্যচিত্র বানাতে। গাড়ি থেমে যায় একটা খড়ের ছাউনির মতো চায়ের দোকানে, যেখানে কয়েকজন স্থানীয় বৃদ্ধ বসে বিড়ি খাচ্ছিল। লুইস তাদের মধ্যে একজনকে জিজ্ঞাসা করল, “আপনারা কি ‘নাগিনী’ নামক কারোর কথা শুনেছেন?” মুহূর্তেই দোকান নিস্তব্ধ। এক বৃদ্ধ হেসে বলল, “ওসব গল্প স্যার, শুনতে ভালো লাগে। জঙ্গলের ভেতরে গেলে অনেক সময় নিজের ছায়াকেও সাপ বলে মনে হয়।” কিন্তু গঙ্গা পেছনে ফিসফিস করে বলল, “সবাই জানে, কিন্তু কেউ কিছু বলে না। একটা সীমার ভেতরে গেলে… ফিরে আসা যায় না।” লুইস মৃদু গলায় বলল, “তবে আমাদের যেতেই হবে।”
দুপুর গড়াতে গড়াতে তারা পৌঁছে এক গহীন জায়গায়, যেখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই, শব্দ নেই, এমনকি পাখিও ডাকছে না। জিপ ফেলে তারা পায়ে হাঁটা শুরু করে। গঙ্গা হাঁসদা পথ দেখাতে দেখাতে বলল, “এই দিকটায় সরকারি কোনো মানচিত্র নেই। অনেকেই ভাবে এখানে ‘অরণ্যদেবী’ থাকে। আসলে সেটা ওই ‘নাগিনী’-র নামই।” হাঁটতে হাঁটতে তারা পৌঁছাল এক নদীর ধারে। সেখানে পাথরের উপর খোদাই করা ছিল একটি নারীমূর্তি, যার গলা থেকে কোমর পর্যন্ত পেঁচিয়ে রয়েছে এক ফণীমনসা। পায়ের নিচে পড়ে আছে তিনটি মানুষের মূর্তি—কেউ হাত জোড় করেছে, কেউ কাঁদছে, আর একজন কেবল তাকিয়ে আছে দেবীর দিকে। লুইস মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। “এই ধরনের দেবীচিত্র শুধু মেক্সিকোর কিছু উপজাতি ধর্মে দেখেছিলাম,” সে বলল। মৌলি ছবি তুলছিল, কিন্তু তার চোখে একটা ভয় জমে উঠছিল। অরণ্য যেন একটু একটু করে গিলে নিচ্ছিল তাদের। হঠাৎ গঙ্গা থেমে বলল, “আর এক পা যদি এগোন, তবে আমি আর আপনাদের নিয়ে যেতে পারব না।” লুইস বলল, “আমরা এখানে এসেছি সত্য জানার জন্য, আর ফিরবো না যতক্ষণ না ‘নাগিনী’-কে দেখছি।” গঙ্গা মাথা নত করে চুপ করে রইল। হঠাৎ পেছনে শুকনো পাতার উপর কিছুর চলার শব্দ। তিনজনেই একসাথে ঘুরে তাকাল, কিন্তু কিছু দেখা গেল না। তখনই একটা হালকা ফিসফিস আওয়াজ ভেসে এল—একটি নারী কণ্ঠ, যেন বাতাসের সঙ্গে মিশে বলছে, “যে দেখে, সে ভুলে যায় নিজেকে।” গঙ্গা মুহূর্তে মাটিতে বসে পড়ে মন্ত্র জপ শুরু করে দিল। মৌলি ঘেমে উঠেছে, ক্যামেরা হাতে ধরে রেখে এক পা পিছিয়ে গেল। কিন্তু লুইস এগিয়ে গেল সামনে, নদীর পাড়ে একটা বাঁশঝাড়ের দিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল এক নারী। তার মাথায় খোঁপা, সাদা সুতোর মতো পোশাক, গলায় একগুচ্ছ সাপের খোলস। আর তার চোখ—হাজার বছর ঘুম না ভাঙা গভীর অন্ধকারের মতো! সে ধীরে ধীরে তাকিয়ে বলল, “তুমি এখানে এসেছো… কিন্তু তুমিই জানো না, তুমি কোথায় দাঁড়িয়ে।” তারপর সব অন্ধকার।
জ্ঞান ফিরলে লুইস নিজেকে আবিষ্কার করল এক পাথরের ঘরে, যার ছাদ থেকে ঝুলছে শূন্য সাপের খোলস। বাইরে ঘন বৃষ্টির শব্দ, আর কুয়াশার মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে আগুনের লাল আলো। মৌলি তার পাশে ছিল, চোখে আতঙ্ক। “তারা আমাদের নিয়ে এসেছে কোথায়?” সে ফিসফিস করে বলল। তখনই দরজায় দাঁড়াল সেই নারী—যার নাম অশ্মতী, যার চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হয় যেন কারো অতীত মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। সে বলল, “তোমাদের প্রশ্নের উত্তর আছে, কিন্তু তার আগে দিতে হবে প্রমাণ। এই অরণ্য তোমাদের চিনে ফেলেছে।” মৌলি চিৎকার করে উঠল, “তুমি কে? তুমি মানুষ তো?” অশ্মতী কেবল একবার তাকিয়ে বলল, “আমি যা, তা বললে তোমরা বিশ্বাস করবে না। তবে জানো, তোমাদের দেখা শুরু হয়েছে—এখন চক্র পূর্ণ হতে বাধ্য।” লুইস কাঁপা গলায় বলল, “তুমি কি ‘নাগিনী’?”
অশ্মতী তাকিয়ে রইল, তারপর ধীরে ধীরে হাসল—একটা বিষাক্ত, অথচ মায়াময় হাসি। বাইরে বজ্রপাতের আলোয় কেঁপে উঠল অরণ্য। আর ঘরের কোণ থেকে ভেসে এল ফিসফিস আওয়াজ—মনে হল, শত শত সাপ তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। অরণ্যের ভিতরে অজানা এক খেলায় আটকে পড়েছে লুইস ও মৌলি—যেখানে সময় নেই, পথ নেই, কেবল রহস্য আর বিষের গন্ধ ছড়িয়ে আছে চারপাশে।
২
অরণ্যের ভেতরকার সেই পাথরের ঘরে রাত কাটানোর পর সকালে ঘুম ভাঙতেই লুইস টের পেল—এখানকার সময়ের গতি যেন অন্যরকম। পাখির ডাক নেই, আলো যেন ঠিক সূর্য থেকে আসছে না, বরং কোনও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে, যা স্নায়ুতে অদ্ভুত চাপ সৃষ্টি করে। ঘর থেকে বেরিয়ে সে দেখে, মৌলি একটি কাঠের বেঞ্চে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে গভীর হতাশা, ঠোঁটে শুকনো ভাব। লুইস তার পাশে বসে বলল, “তুমি কেমন আছো?” মৌলি ঘাড় নাড়ল, “ভালো নেই… মনে হচ্ছে যেন কেউ আমাদের মনটা রোজ একটু একটু করে পড়ে ফেলছে।” লুইস বুঝতে পারছিল, তারা কেবল দেহে নয়—মনেও বন্দি। কিছুক্ষণ পর দরজার ছায়ায় দেখা দিল সেই মুখোশধারী গোষ্ঠীর একজন সদস্য, যাকে গঙ্গা আগেরদিন “নাগভৃত্য” বলে চিনিয়েছিল। সে ইশারায় জানাল—তাদের এখন নিয়ে যাওয়া হবে “পূজার স্থানে”। অশ্মতী তখনো দৃশ্যপটে অনুপস্থিত। তাদের দুই চোখ কাপড়ে ঢেকে, হাত বাঁধা অবস্থায় হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হল ঘন জঙ্গলের আরও গভীরে, যেখানে বাতাসে ধূপ ও চন্দনের গন্ধ মিশে আছে সাপের কাঁচা কাঁচা বিষের মতো। পা পড়ে যাচ্ছে কাদায়, মাঝে মাঝে বেয়ে আসা জলে—তারা বুঝতে পারছিল, নিচে সরীসৃপ কিছুর উপস্থিতি।
চোখের কাপড় খোলার পর তারা যা দেখল, তা বাস্তবের চেয়েও বেশি অলৌকিক—একটি বিশাল গোল বেদী, যার চারপাশে পাথরের ফণা তোলা সাপখোদাই করা। তার কেন্দ্রে ছিল একটি আগুনের গর্ত, যেখানে ধূপ, তুলসীপাতা, আর সাপের খোলস পোড়ানো হচ্ছিল। সেখানে দাঁড়ানো ছিল পূজনাথ—এক লম্বা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ, যার মাথায় কাঁচা পেঁচানো কাপড়, গলায় হাড়ের মালা, আর চোখে ভয়ঙ্কর এক নিষ্ঠা। তার চারপাশে আরো দশজন মুখোশধারী দাঁড়িয়ে, এবং বেদীর এক প্রান্তে বসে ছিল অশ্মতী—আজ তার পরনে কালো রঙের দীর্ঘ পোষাক, যার কিনারা সাপের খোলস দিয়ে সেলাই করা। পূজনাথ এক দীর্ঘ মন্ত্রোচ্চারণের শেষে বলল, “তোমরা এসেছো বহিরাগত হয়ে, কিন্তু এই ভূমির শক্তিকে না জেনে স্পর্শ করলে সে নিজেই প্রতিশোধ নেয়। এখন তার বিচার তোমাদের নিজের হাতে।” লুইস কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু অশ্মতী তাকে থামাল। “এই বিচার একটি খেলা,” সে বলল, “একটি পরীক্ষা—যেখানে তোমার মনে যা গোপন, তা ফণা তুলে সামনে আসবে। যদি পারো… তবে বাঁচবে।” সেই মুহূর্তে ঘন ঝাঁকুনির সঙ্গে ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটি বড় অজগর—তার চোখ লাল, মাথা যেন কয়েক ইঞ্চি চওড়া। মৌলি ভয় পেয়ে পেছনে সরলেও লুইস একপলকের জন্যও না নড়ে তাকিয়ে রইল সাপটির চোখে।
সেই রাতের খেলা ছিল “নাগ-পরীক্ষা”। একটি বৃত্তাকার মাটির পরিখা, তার চারপাশে বসানো কয়েকটি ছোট ছোট সাপ, মাঝখানে রাখা একটি সোনার খাঁচা—যার ভিতরে একটি নীলচে আলো উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে। অশ্মতী বলে, “এই আলো সত্তার প্রতীক। যারা সত্য বুকে ধারণ করে, তারা ইচ্ছেমতো আলোয় প্রবেশ করতে পারে। যারা মিথ্যার ভার বহন করে, তাদের শরীরেই সাপ ছুটে আসে।” পূজনাথ বলল, “এই খেলায় আমরা প্রশ্ন করব, উত্তর দিবে মন। মিথ্যা বললেই সাপ বেরিয়ে আসবে।” লুইস প্রথমে কিছুটা সংশয় বোধ করলেও বুঝতে পারল—এটা কোনও যাদুবিদ্যা নয়, বরং এক মনস্তাত্ত্বিক প্রতিপালন। এইসব রীতির মধ্যে দিয়ে তারা বহিরাগতদের ভয় ও গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করে। প্রশ্ন শুরু হল—“তুমি কি এসেছো শুধু গবেষণার নামে ধর্মকে অপমান করতে?” “না।” লুইস বলল দৃঢ়ভাবে। “তুমি কি নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবো আমাদের চেয়ে?”—“না।” “তুমি কি ভয় পাচ্ছো এখন?” লুইস থেমে গিয়ে বলল, “হ্যাঁ।” সেই মুহূর্তে অশ্মতীর ঠোঁটে সামান্য হাসি ফুটে উঠল। তার চোখে সেই প্রথম দেখা দিল অদ্ভুত স্নিগ্ধতা। খেলা শেষ হল, এবং মৌলি বলল, “এটা কি তোমাদের সত্য জানার পথ?” অশ্মতী চোখ তুলে বলল, “না। এ শুধু শুরু।” বাইরে তখন অরণ্যে গর্জে উঠেছে হাওয়া। পূজনাথ বলল, “তোমাদের মনে রাখা হোক—এই অরণ্য একবার যার চিনে ফেলে, তাকে সহজে মুক্তি দেয় না।” সেই মুহূর্তে দূর থেকে ভেসে এলো আরেকটি ভয়াল আওয়াজ—ফিসফিস নয়, যেন হাজার হাজার ফণা একসাথে কাঁপছে পাতার নিচে। আর অশ্মতীর চোখে… আগুনের ছায়া।
৩
ঝাড়গ্রামের গহীন অরণ্যের বুকে দিনের আলো যেন থমকে গেছে। যেদিন থেকে ড. লুইস ও মৌলি নাগভৃত্যদের হাতে ধরা পড়েছে, সেদিন থেকেই সময়, শব্দ আর স্বাভাবিক বাস্তবতা যেন বদলে গেছে। সাপের খোলসে ছাওয়া কর্দমাক্ত পথ ধরে তারা এবার প্রবেশ করল এক দীর্ঘ পাথুরে সুড়ঙ্গের মধ্যে—যার গা ঘেঁষে অদ্ভুত সব প্রতীক, সাপের ফণা, নারীদেহের মূর্তি, এবং ত্রিশূলের মতো ছাপ খোদাই করা। কুয়াশা, ধূপ ও কিছু পচা জড়িবুটি পোড়ানোর গন্ধে পথ হয়ে উঠছিল দমবন্ধ। সুড়ঙ্গের শেষে এসে হঠাৎ করেই খুলে গেল এক বিশাল গুহামুখ—আর ঠিক তার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল এক বিরাট প্রাচীন মন্দির, যার গম্বুজ ঢেকে রয়েছে বুনো লতাপাতায়, এবং যার প্রতিটি স্তম্ভে ফণা তোলা সাপের ভাস্কর্য। এক ঝলকে দেখে মনে হয় যেন পুরো মন্দিরটাই তৈরি সাপ দিয়ে, যারা জড়িয়ে আছে স্তম্ভে, গম্বুজে, দরজার কপাটে—আর সবকিছুর কেন্দ্রে বসে আছেন এক দেবী-মূর্তি, যার মাথায় সাপের মুকুট, হাতে নাগদণ্ড, আর চোখে অদ্ভুত শূন্যতা। এই ছিল নাগমন্দির—প্রাচীন, উপেক্ষিত, অথচ জীবন্ত।
মৌলি ফিসফিস করে বলল, “এটা তো ইতিহাসের বাইরের কিছু… এটা তো যেন অন্য সময়ের মধ্যে ঢুকে পড়া।” লুইস মন্ত্রমুগ্ধের মতো বলে উঠল, “আমি এমন কিছু কল্পনাও করিনি… এটা ভারতীয় নারীতান্ত্রিক ও সর্পপূজার এক অনন্য নিদর্শন!” সেই সময় অশ্মতী এগিয়ে এল। আজ তার মুখে এক ধরনের গম্ভীরতা—কোনও আবেগ নেই, কেবল কর্তৃত্ব। সে বলল, “এই মন্দির শুধু প্রার্থনার স্থান নয়, এটা আত্মদর্শনের আয়না। এখানে মানুষ তার নিজেকে চেনে—সে যে মুখ লুকিয়ে রাখে বাইরের জগতে, তা এখানে ধরা পড়ে।” সে লুইসকে নিয়ে চলল মন্দিরের ভিতরের কক্ষে, যেখানে রাখা ছিল একটি আয়না—কিন্তু তা রূপোর তৈরি নয়, বরং গাঢ় কালো পাথরের, যার মধ্যে তাকালেই মানুষ নিজের ‘অন্যরকম’ প্রতিবিম্ব দেখতে পায়। লুইস আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখল—নিজেকে, কিন্তু তার মুখ বিষাদে পরিপূর্ণ, হাতে রক্তের দাগ, আর চোখে অপরাধবোধ। সে চমকে উঠল। “এটা কী দেখাচ্ছে?” প্রশ্ন করতেই অশ্মতী বলল, “তোমার ভিতরের সত্য—যেটা তুমি স্বীকার কর না, কিন্তু জানো। এখানকার সবকিছু তোমার মনের ছায়া দেখে। এটাই নাগতন্ত্র—ভয়, আকর্ষণ আর আত্মত্যাগের মিশ্র ধর্ম।” সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল, যেন তার চোখেও আয়নার ভিতর কিছু খেলে যাচ্ছে—হয়তো নিজের অতীত, হয়তো ভবিষ্যতের দ্বিধা।
গভীর রাতে, মন্দিরের চত্বর নিস্তব্ধ। দূর থেকে শোনা যায় বনজ্যোৎস্নার মধ্যে সাপের ফিসফিসানি। লুইস মেঝেতে বসে, একটি পুরনো তালপাতার পুঁথি পড়ছিল। পুঁথির অক্ষর ছিল সংস্কৃত, কিন্তু আঁকা ছিল চিত্র—নারী ও সাপের মিলন, আগুনের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষ, এবং অন্ধকারে বসে থাকা এক নারী যাকে শত শত সাপ অভ্যর্থনা করছে। অশ্মতী হঠাৎ তার পাশে এসে বসে বলে, “তুমি জানো, আমাদের বিশ্বাস—একজন নারী শুধু মাতৃত্ব বা সংসারের প্রতীক নন। তিনি রক্ষকও, আবার সংহারকর্ত্রীও। এই দেবী—নাগিনী—তিনি সেই নারীর রূপ, যিনি পুরুষের অহংবোধকে বিষে ডুবিয়ে দেন, যদি সে সীমা লঙ্ঘন করে।” লুইস জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি তাকে বিশ্বাস করো? তুমি কি এই দেবীর অংশ?” অশ্মতী ধীরে মাথা নাড়ে। “আমার জন্ম এই সম্প্রদায়ের মধ্যে। ছোট থেকে শিখেছি, কিভাবে সাপকে বিশ্বাস করতে হয়, কিভাবে বিষকে নিজের শরীরে ধারণ করতে হয়, কিভাবে ভয়কে জয় করে নিষ্ঠা তৈরি করতে হয়। কিন্তু… আমার ভিতরে একটা প্রশ্ন জাগে বারবার—এই পথটা কি আমার নিজের পছন্দের ছিল?” লুইস চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারা দুইজন তখন এক প্রাচীন মন্দিরের মাঝে বসে, দুই আলাদা সংস্কৃতি থেকে আসা, কিন্তু একই প্রশ্নে আটকে—“আমি কে?” বাইরে মেঘ গর্জে উঠছে, যেন অরণ্যের ভিতর কিছু জেগে উঠছে ধীরে ধীরে। আর মন্দিরের ভিতর, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লুইস অনুভব করল—সে যত দূরে এসেছে, ততই হারিয়ে ফেলছে নিজের ফেরা-জানার পথ।
৪
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরছিল সেই রাতে, অরণ্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকা নাগমন্দিরের উঠোনজুড়ে যখন প্রস্তুতি চলছিল এক “বিচারসভা”-র। রাতের অন্ধকার যেন এখানে আরও কালো, আরও ঘন। দীপ্তি দিচ্ছিল কেবল শালগাছের ডালে ঝোলানো সিঁদুরমাখা প্রদীপ, আর মাঝে মাঝে হালকা ঝলকে জ্বলে উঠছিল চিতা কাঠের আগুন। বেদীর উপর বসেছিলেন পূজনাথ—গম্ভীর, ধূসর দাড়ির এক প্রাচীন পুরুষ, যার কপালে আঁকা ছিল তিনটি সাপের মাথা। তার সামনে সাজানো ছিল ধূপ, চিতা ছাই, পেঁচানো কুন্ডলিনীর প্রতীক ও একটি সর্প-রূপী খাঁড়া। মুখোশধারী “নাগভৃত্য”রা অদ্ভুত ছন্দে মন্ত্রোচ্চারণ করছিল, যেন তারা সময়ের এক প্রাচীন দরজাকে ধাক্কা দিচ্ছিল। ড. লুইস ও মৌলি মন্দিরচত্বরের এক পাশে বসে, চোখের সামনে যা ঘটছে তা বিশ্বাস করতে পারছিল না। পূজনাথ ঘোষণা করলেন, “আজ এই বহিরাগতরা আমাদের পবিত্র ভূমিতে পা রেখেছে। তারা দেখেছে যা দেখার নয়, শুনেছে যা শোনার নয়, আর প্রশ্ন করেছে যা প্রশ্নযোগ্য নয়। এখন তাদের বিচার হবে। কারণ, এই অরণ্য কেবল প্রকৃতি নয়—এ এক দেবতা, যিনি অপমান সহ্য করেন না।” তখনই অশ্মতী ধীরে সামনে এগিয়ে এল। তার মুখে ছিল না কোন ভয় বা দ্বিধা—তবে তার চোখে এক অস্পষ্ট দ্বন্দ্ব স্পষ্ট। সে বলল, “তাদের যদি বিচার করতেই হয়, তবে হোক এক পরীক্ষা দিয়ে। একটা পরীক্ষা যা মানুষকে পরখ করে মন ও শরীর দুদিক থেকেই।”
পূজনাথ কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথা নাড়লেন। “হোক তবে নাগ-অগ্নি পরীক্ষা,” তিনি ঘোষণা দিলেন। চত্বরের মাঝখানে আগুন জ্বালানো হল, আর তার চারপাশে রাখানো হল চারটি তামার কুণ্ড—প্রতিটিতে ছিল জীবন্ত সাপ। লুইসকে দাঁড় করানো হল বেদীর ঠিক সামনে। একজন মুখোশধারী তার হাতে তুলে দিল একটি খোলা কাঁচের পাত্র—ভেতরে এক ফণি সাপ, চোখ জ্বলজ্বল করছে। “এটি ‘ভৃকুটিনাগ’—যদি তুমি সত্য মন থেকে আমাদের সম্মান করো, তবে এ তোমায় ছোবল দেবে না। যদি তোমার অন্তরে ভয় বা অবিশ্বাস থাকে, তবে তুমি আজই এই ভূমির শেষ বহিরাগত হবে।” মৌলি চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু অশ্মতী তার মুখ চেপে ধরে রাখল। সে বলল, “এটা কোনও খেলা নয়—এটা এক বিশ্বাসের পরীক্ষা।” লুইস ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে সেই সাপটিকে স্পর্শ করল। মুহূর্তটা ছিল স্থির—বাতাস থেমে গেল যেন, সাপটি ফণা তোলে, তারপর তার হাত বেয়ে একপাশে চলে যায় এবং কোনও আঘাত না করেই হারিয়ে যায় অন্ধকারে। চত্বরের লোকেরা হঠাৎ নতজানু হয়ে ধ্বনি তোলে, “জয় কৃষ্ণনাগিনী, জয় অগ্নিপথ!” পূজনাথ ঠোঁট চেপে বললেন, “তবে তার শরীর পবিত্র, কিন্তু মন এখনও প্রশ্নবিদ্ধ। তাকে শুদ্ধ করতে হবে আরও।” এরপর মৌলির জন্য আনা হল ‘আত্মানাগ-সংঘ’ নামক আরেক অনুষ্ঠান—যেখানে এক অদ্ভুত ধোঁয়ার ঘরে বসে থাকতে হয়, যেখানে প্রতিটি শ্বাসে থাকে ভেষজ ধূপ, যা মনের গোপন ভয় ও স্মৃতি তুলে আনে। মৌলি সেই ধোঁয়ার মধ্যে ঢুকে বসতেই চোখ বন্ধ করল, আর তার স্মৃতিতে ফিরে এলো শৈশবে দেখা একটি স্বপ্ন—সাপের ছোবল থেকে মৃত মায়ের মুখ, এক চাপা চিৎকার, আর এক নারী কণ্ঠ বলছে, “ভয় পেলে হারবি।” সে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল এবং ঘর থেকে পড়ে বেরিয়ে এল—চোখজোড়া অশ্রুতে ভরা, কিন্তু মনে যেন এক বোঝা নামল।
পূজনাথ তাদের দু’জনের দিকেই কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “এই দুই বহিরাগত এখন পবিত্র বলে মানা যাবে, তবে এরা এখনও চক্রে ঢোকেনি। অরণ্যের দেবী এখনো তাদের সত্যতা যাচাই করেননি।” সেইসময় অশ্মতী বলল, “তাদের আমি নিয়ে যাব চক্রমণ্ডপে। যেখানে শুধু দেবীর কৃপায় মানুষ প্রবেশ করে, এবং যেখানে কেউ প্রবেশ করলে আর আগের মতো ফেরে না।” তার চোখে সেই সময় এক অদ্ভুত শীতলতা—যা ভালোবাসা ও ভয় দুটোই হতে পারে। পূজনাথ সম্মতি দিলেন। পূর্ণিমার রাতে অশ্মতী ড. লুইস ও মৌলিকে নিয়ে যাবে সেই “চক্রমণ্ডপ”-এ, যেখানে সাপের চোখ, আগুনের আলো, আর আত্মার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। পূজনাথ ধীরে পেছনে ফিরলেন, মুখে চাপা হাসি—যেন তিনিও জানেন, এই পরীক্ষার শেষে কিছুই আর আগের মতো থাকবে না। বাইরে তখন বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে সাদা ধোঁয়া, আর দূরের কোন অদৃশ্য ঝোপ থেকে শোনা যাচ্ছে সাপের গন্ধ নেওয়ার শিস। এই বিচারসভা ছিল শুরু—এক গভীর যাত্রার, যেখান থেকে ফেরা মানে শুধু দেহে নয়, মনে পুনর্জন্ম।
৫
মন্দিরের দক্ষিণ কোণের একটি ছোট পাথরের কুঠুরিতে সেই রাতে বসে ছিল অশ্মতী—নিঃশব্দ, একা। তার সামনে রাখা ধূপের কুণ্ডি থেকে ধোঁয়া ধীরে ধীরে উঠছে, আর চোখের সামনে যেন সেই ধোঁয়ার ভেতর খেলা করছে কিছু পুরনো দৃশ্য—অপ্রকাশিত, অপরাধবোধে ঢাকা, অথবা এমন কিছু যা বলাও নিষিদ্ধ। সে ধীরে ধীরে এক পুরনো কাপড়ের খামে হাত রাখল। তার ভিতরে রাখা কিছু স্মৃতি—একটা ধুলোমাখা তোলা ছবি, যেখানে একটি শিশু—ছোট অশ্মতী, মাথায় পেঁচানো কাপড়, কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা, পেছনে পূজনাথ দাঁড়িয়ে, গম্ভীর চোখে চেয়ে। অশ্মতী হঠাৎ যেন সময়ের ভারে থমকে যায়। তার নিজের জন্ম নিয়ে সে যা জানে তা কেবল কিছু কণ্ঠস্বর—“তাকে বাঁচানো হয়েছিল চক্রের দিন,” “সাপের কামড়ে কেউ টিকতে পারে না, কিন্তু ও পেরেছিল,” “ওকে দেবীর দান বলে মানা হয়।” এইসব শুনে বড় হওয়া, এই বিশ্বাসে গড়ে ওঠা যে, সে শুধুমাত্র একজন নারী নয়—একটি মাধ্যম, একটি প্রতীক, যাকে দিয়ে কাজ চালায় দেবীর ইচ্ছা। কিন্তু আজ, এত বছর পর লুইসের প্রশ্ন, তার চোখের গভীর সুধাকর্ষণ, মৌলির সাহসিকতা—সব মিলিয়ে তার ভিতরে একটা কাঁপুনি শুরু হয়েছে। প্রথমবার সে নিজের মধ্যে প্রশ্ন তোলে—“এই পথ কি আমার নিজের ছিল? নাকি আমার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে দেবীত্বের বোঝা?”
সেই মুহূর্তেই কুঠুরির দরজায় ধাক্কা পড়ে। অশ্মতী চমকে উঠে দরজা খোলে। বাইরে দাঁড়িয়ে লুইস—চোখে ঘুম নেই, গলায় একটা অপরাধী কুণ্ঠা। “আমি জানি, এখন কথা বলার সময় নয়, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি… তুমি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি বন্দি। আমরা তো কেবল দেহে বন্দি, তুমি মনেই আটকে আছো।” অশ্মতী তার দিকে চেয়ে রইল। তারপর ধীরে বলে উঠল, “তুমি কি জানো, এই সম্প্রদায়ে নারীদের কীভাবে তৈরি করা হয়? কীভাবে একটা মেয়েকে ‘নাগিনী’ বানানো হয়?” লুইস চুপ করে রইল। অশ্মতী উঠে দাঁড়িয়ে চলতে লাগল মন্দিরের পিছনের দিকে, যেখানে একটা পুরনো স্নানঘাট। সেখানে চাঁদের আলোয় দেখা যাচ্ছিল পাথরের ওপর খোদাই করা কয়েকটি মূর্তি—সকলেই নারী, ফণীমনসা হাতে, চোখে ক্লান্তি। “এই নারীরা কেউ নিজের ইচ্ছেতে আসেনি,” অশ্মতী বলল, “তাদের বেছে নেওয়া হয়েছে, কারণ তারা বেঁচে ছিল মৃত্যুর মুখ থেকে। আমি তিন বছর বয়সে এক বিষধর সাপের কামড়ে পড়েছিলাম। পুরো শরীর অসাড় হয়ে গিয়েছিল। তখন পূজনাথ আমাকে দেখে বলেছিল—‘এই মেয়ে দেবীর দান। একে তৈরি করতে হবে।’ তারপর থেকে যা কিছু হয়—জাগরণ, নিদ্রা, স্পর্শ, স্মৃতি—সব নিয়ন্ত্রিত। প্রেম, ভয়, প্রশ্ন—সব নিষিদ্ধ।” লুইস তার পাশে বসে পড়ে বলল, “কিন্তু তুমি আজ প্রশ্ন করছো, বলছো, স্মৃতি ঘাটছো—এটাই তো প্রমাণ, তুমি এখনও স্বাধীন। কোথাও না কোথাও।”
অশ্মতী তার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “তুমি জানো, লুইস, আমার ভয় কী জানো?” সে দৃষ্টি ফিরিয়ে চাঁদের আলোয় নিজের হাতের দিকে তাকাল, “ভয় হয়, যদি আমি একদিন সত্যিই দেবী হয়ে উঠি, যদি সত্যিই আমার ভিতর বিষ জন্ম নেয়—তবে আমি মানুষ হিসেবে আর বাঁচতে পারব না। আমার স্পর্শে যদি মানুষ মরতে শুরু করে, আমার চোখে যদি শুধু শাস্তি থাকে?” লুইস তার হাত চেপে ধরল। “কিন্তু যদি তোমার ভিতরে দেবী থাকে, তাহলে মানুষও আছে। আমরা শুধু আমাদের জন্ম দিয়ে তৈরি হই না, আমরা তৈরি হই আমাদের প্রশ্ন আর প্রতিবাদ দিয়ে।” সেই মুহূর্তে দূরে কোথাও একটা সাপের ফিসফিস আওয়াজ। অশ্মতী হঠাৎ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “তুমি জানো না, পূজনাথ কী পরিকল্পনা করেছে। সে শুধু তোমাদের পরীক্ষা নিচ্ছে না, সে চায় আমি তোমাদের ভিতর থেকেও নির্বাচন করি—কে থাকবে, কে মরবে। সে জানে, আমার সিদ্ধান্তেই হবে দেবীর অনুমোদন।” লুইস চমকে উঠল। “তুমি কি আমাদের সঙ্গে পালাতে চাও?” অশ্মতী মাথা নাড়ল, “না… এখনও না। আমি জানি না আমি দেবী, না বিদ্রোহী। কিন্তু আমি জানি, এই প্রশ্নটা—আমি কে—এর উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত আমি কিছুই পাল্টাতে পারব না।” রাত গভীর হচ্ছিল, ধীরে ধীরে অরণ্য ঠান্ডা হয়ে উঠছিল, কিন্তু সেই রাতে অশ্মতীর ভিতরে যে আগুন জ্বলে উঠেছিল, তা আর সহজে নিভে যাওয়ার নয়।
৬
পূর্নিমার চাঁদ তখন অরণ্যের মাথায় ঝুঁকে পড়েছে। ঝাড়গ্রামের গভীর অরণ্যের মধ্যে মন্দির চত্বর আলোয় জ্বলছে, কিন্তু সেই আলো যেন জাগতিক নয়—এ যেন এক অন্যজগৎ থেকে আসা। রাতের ঠিক বারোটায় শুরু হবে সেই বহুল প্রতীক্ষিত “চক্রমণ্ডপের যাত্রা”—যেখানে যাবেন কেবল তিনজন: অশ্মতী, ড. লুইস ও মৌলি। সেখানেই পরীক্ষা হবে ‘অভ্যন্তরীণ বিষ’-এর, যেখানে আত্মা ও শরীর আলাদা হয়ে পড়বে ধোঁয়ায়, মন্ত্রে ও সাপের উপস্থিতিতে। পূজনাথের আদেশে মন্দিরের ভেতরের বেদিতে আগুন জ্বালানো হয়েছে, তামার ঘন্টি বাজছে নির্দিষ্ট ছন্দে, আর মুখোশধারী “নাগভৃত্য”রা এক অদ্ভুত সুরে গান গাইছে—যেখানে প্রতিটি শব্দ যেন কোনও মন্ত্র, আর প্রতিটি শব্দের মাঝে শোনা যাচ্ছে সাপের ফিসফিসানি। অশ্মতীর পরনে ছিল গাঢ় কালো রঙের পোশাক, তার কপালে অঙ্কিত তিনটি সাপের প্রতীক—যা সে নিজেই এঁকেছে, নিঃশব্দে, একটি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। সে জানত আজকের রাত শুধু ড. লুইস বা মৌলির জন্য নয়—এ রাত তার নিজেরও। চক্রে প্রবেশ মানেই সব হারানোর সম্ভাবনা, অথবা নতুনভাবে জন্ম নেওয়া।
চক্রস্থলে পৌঁছানো মাত্রই মৌলি কেঁপে উঠল—কারণ সেখানে বাতাস স্থির, কিন্তু গন্ধ ভারী। মাটির মাঝে আঁকা এক বিশাল গোল চক্র, যার চারপাশে ছোট ছোট ঘেরাটোপের মতো বসানো সাপের কুণ্ডলী। তার মাঝে রাখা একটি ধাতব থালা—ভিতরে কিছু অদ্ভুত তরল, যার রঙ গাঢ় বেগুনি। অশ্মতী বলল, “এই তরল পানের পরই শুরু হবে মূল পরীক্ষা। এটা এক ধরনের ‘তান্ত্রিক বিষ’—যা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে না, বরং চেতনায় ঢুকে পড়ে। তুমি যা লুকিয়ে রাখো, তা সে তুলে আনে সামনে।” লুইস থেমে গেল। “আমরা তাহলে আমাদের ভিতরের… সবচেয়ে ভয়ংকর দিকের সামনে দাঁড়াব?” অশ্মতী মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, আর সেটা দেখে যদি কেউ নিজেকে অস্বীকার করে, তার চেতনা আর কখনও ফিরবে না।” তিনজনেই মাটিতে বসে, একে একে থালা থেকে সামান্য পান করল। এরপর শুরু হল ধোঁয়া—নাগভৃত্যরা চারপাশে আগুন জ্বালাল, তাতে পোড়ানো হচ্ছিল সাপের খোলস, কনচের গুঁড়ো ও কালোজিরে। ধোঁয়ার মধ্যে ধীরে ধীরে চারপাশ মিলিয়ে যেতে লাগল—রাত, আলো, শব্দ সব যেন এক অদ্ভুত বৃত্তে ঢুকে পড়ল।
প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল মৌলির—সে হঠাৎ চোখ খুলে দেখে, তার সামনে দাঁড়িয়ে তার মৃত মা। কিন্তু তার চোখে ছিল রাগ, ঠোঁটে ভর্ৎসনা—“তুমি কেন ফিরে গেছ, মৌলি? আমি তো বলেছিলাম ভয় পেলে মরবি!” তারপর মা বদলে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল একজন মুখোশধারী দেবীতে—যার চোখ সাপের মতো, আর জিহ্বা ফণা তুলছে। মৌলি চিৎকার করতে গেল, কিন্তু গলা বন্ধ। লুইস তখন দেখছিল, এক অন্ধকার কক্ষে সে বন্দি, আর চারপাশে ছড়ানো মৃতদেহ। তার হাতে রক্তমাখা ছুরি, মুখে শোক। সে কাঁদছে—একটা মেয়ের ছবি সামনে, নাম ‘এলেনা’। সে ফিসফিস করে বলল, “আমি তো তাকে বাঁচাতে পারিনি… আমি তো গবেষণার নামে পালিয়ে এসেছিলাম।” অশ্মতী তখন মূর্তির দিকে তাকিয়ে দেখছে নিজেকে—কিন্তু তার চোখ নেই, কেবল অন্ধকার। সে হাঁটছে, আর প্রতিটি পায়ে পড়ে সাপ বেরিয়ে আসছে মাটি থেকে। হঠাৎ তার সামনে পূজনাথ, বলছে, “তুই আমাদের সম্পদ, কিন্তু যদি তুই প্রশ্ন করিস, তবে তোর শরীরও আমরা ফিরিয়ে নেব। তুই আর নিজস্ব কিছু পাবি না।” ধোঁয়ার ভিতর থেকে অশ্মতী চিৎকার করে উঠে বলল, “আমি মানুষ… আমি কেবল দেবী নই!” সেই মুহূর্তেই ধোঁয়া ছিঁড়ে চিৎকার ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ঝড়ের মতো আলো ছুটে এসে ছিটকে ফেলে তিনজনকে মাটিতে। ধীরে ধীরে সবকিছু আবার স্পষ্ট হতে লাগল। মৌলি উঠে বসে, চোখে জল। লুইস ঘামে ভিজে গেছে, কিন্তু চোখে একরকম মুক্তির স্পষ্ট ছায়া। আর অশ্মতী? সে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে চক্রের মাঝখানে—যেখানে কিছু একটা চিহ্ন পড়ে আছে মাটিতে। সাপের মতো, কিন্তু মানুষের মতো—একটি অর্ধেক খোলস, অর্ধেক ছায়া।
৭
অরণ্যের গভীর রাতের এক প্রহরে, তিন জন অভিযাত্রী—অশ্মতী, ড. লুইস, এবং মৌলি—চক্রের মাঝে বসে ছিল। সেই অদ্ভুত পরীক্ষার পর থেকে তাদের হৃদয়ে যেন এক ধরনের অস্থিরতা বাসা বেঁধেছিল। বাতাসের নীরবতা যেন ক্রমশ শব্দের ভেতর ছড়িয়ে পড়ছিল, আর প্রতিটি ছায়া যেন তাদের কাঁধে হাত রেখে বলছিল, “এখান থেকে আর ফিরে যাওয়া কঠিন।” অশ্মতী ধীরে ধীরে বলে উঠল, “আমাদের পথ এখন বিভক্ত। এই চক্রের শক্তি আমার মাঝে প্রবাহিত হচ্ছে, আর আমি বুঝতে পারছি, এর বাইরে যেতে চাইলে আমাদের মন, শরীর আর আত্মাকে একত্রিত করতে হবে।” ড. লুইস, যিনি গবেষকের মতো বাস্তববাদী ছিলেন, কাঁধ সরিয়ে বলল, “এই সব অলৌকিক কাহিনী না বললেও চলতো, কিন্তু আমরা যে জায়গায় আটকা পড়েছি, তা বিজ্ঞানও ব্যাখ্যা করতে পারছে না। আমাদের কেবল একমাত্র উপায়—এই চক্র ভেঙে ফেলা।” মৌলি কাঁপতে কাঁপতে বলল, “কিন্তু চক্র ভাঙলে? আমরা কি হারিয়ে যাব না?” অশ্মতী তাকিয়ে বলল, “হারিয়ে যাওয়া আর মুক্তি পাওয়ার মাঝের পার্থক্য খুব সূক্ষ্ম। আমি যদি একা যাই, তাহলে হয়তো আমি হারাব। কিন্তু তোমরা দুজনের সাহায্যে আমি আশা করি আমরা চক্রকে ভাঙতে পারব।”
চতুর্দিকে গভীর অন্ধকার, যেখানে সাপেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তারা তিনজন মাটির ওপর চিহ্নিত কিছু অক্ষরে মনোনিবেশ করল—একটি প্রাচীন তন্ত্র-রেখা যা চক্রকে স্থির বা ভাঙতে সক্ষম। অশ্মতী বলল, “এই রচনাটির মাঝখানে ‘অমৃত’ নামে একটি শক্তি আছে, যেটা আমাদের মুক্তির চাবিকাঠি। কিন্তু এই শক্তি পেতে আমাদের নিজেদের ভয়, দ্বিধা ও গোপন ক্ষতগুলোকে মেনে নিতে হবে।” সবাই চুপ করে নিজের নিজের অতীতের ভয় ও অপরাধবোধ নিয়ে ডুবে গেল। হঠাৎ ড. লুইসের চোখ জ্বলে উঠল, সে মুখ খুলল, “আমার অপরাধ শুধু একবারের নয়, বরং বারবার মানুষের উপর করেছি—জীবজন্তুদের জীবন নিয়ে পরীক্ষা, আমার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করেছি প্রকৃতির থেকে। হয়তো এই চক্র তার শাস্তি।” মৌলি, কাঁপতে কাঁপতে বলল, “আমার ভয়, আমার ভাঙ্গা সম্পর্ক আর নিঃসঙ্গতার ছায়া আমাকে পিছনে টেনে ধরে। এই চক্রকে ভাঙতে হলে আমাকে এগিয়ে যেতে হবে।” তারা একত্রে হাত ধরে সেই প্রাচীন তন্ত্রের পাঠ শুরু করল, আর সাথে সাথে জঙ্গলের চারপাশ থেকে সাপের ফিসফিসানি বেড়ে গেল। মুহূর্তে মনে হল—তারা যেন এক এক করে নিজেদের শেকল ভেঙে ফেলছে, আর অশ্মতীর চোখে দীপ্তি ফিরে আসছে।
কিন্তু ঠিক তখনই, মাটির নিচ থেকে এক বিশাল ফণা তুলল সাপের একটি ঝাঁক, যাদের মধ্য থেকে বেরিয়ে এল পূজনাথ, তার মুখে কঠোর এক হাসি। “চক্র ভাঙবে? না, আমার ছায়ায় এই অরণ্য বেঁচে থাকবে চিরকাল। তোমাদের মুক্তি নয়, বরং নতুন বন্দিত্ব।” সে একটি মন্ত্র উচ্চারণ করল, আর চারপাশে অন্ধকার যেন ঘনিয়ে এলো, বাতাসের গতি বদলে গেল। সাপেরা তাদের চারপাশে সাঁতার কাটতে লাগল, আর চক্রের রেখাগুলো ফেটে যেতে লাগল। অশ্মতী চিৎকার করে লড়াই করতে লাগল, লুইস ও মৌলিও তার পাশে দাঁড়ালো। এক অদ্ভুত যুদ্ধ শুরু হল—একটু আগের ভয় আর সন্দেহ তাদের শক্তিতে পরিণত হলো, আর তারা চক্রের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য একসাথে লড়ল। সেই যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া মানুষ আর দেবীর মিশেল, প্রেম আর ঘৃণা, বিশ্বাস আর দ্বন্দ্ব সব কিছুই তাদের শরীরে ও মনের মধ্যে ফুটে উঠল।
অবশেষে চক্রের ভেতর থেকে এক আলো ফুটে উঠল—সাপের চোখের মতো ঝলমল করে, যা তাদের দিকে ছুটে আসল। সবাই একে অপরের হাত শক্ত করে ধরল, আর সেই আলো যেন তাদের আত্মাকে আলোকিত করল। চক্রের অন্ধকার ভেঙে, তারা মুক্তি পেল। পূজনাথ অন্ধকারের গর্ভে হারিয়ে গেলেন, আর অরণ্যের শান্তি ফিরতে শুরু করল। কিন্তু তিনজনের মনে একটি জাগ্রত সত্য দাঁড়ালো—অরণ্য থেকে পালানোর মধ্যেই বাঁচার আর হারানোর খেলা লুকিয়ে আছে। তাদের যাত্রা শেষ হয়নি, বরং নতুন অধ্যায়ের শুরু।
৮
অরণ্যের গাঢ় অন্ধকার যেন তাদের ভিতর থেকে এক এক করে ভয়কে জাগিয়ে তুলছিল। চক্র ভেঙে গেলেও, তারা বুঝতে পারছিল এই যাত্রা এখনও শেষ হয়নি। প্রতিটি গাছ, প্রতিটি ছায়া যেন তাদের পিছনে লুকিয়ে থাকা এক অদৃশ্য চোখের মতো নজর রাখছে। অশ্মতী, লুইস আর মৌলি মন্দিরের ভেতর থেকে বেরিয়ে যখন অরণ্যের পথ ধরল, তখন বাতাসে ভেসে আসছিল অজানা এক সুর—যা তাদের মনে করিয়ে দিচ্ছিল, “অন্ধকার শুধু বাইরে নয়, তোমাদের মধ্যে।”
অশ্মতী ধীরে বলল, “আমাদের কাছে এখন শুধু মুক্তি নয়, বরং নতুন প্রশ্ন এসেছে। আমি যা বিশ্বাস করতাম, তার অনেকটাই ভুল। আমাদের মুখোমুখি হতে হবে নিজেদের ভিতরের অন্ধকারের সাথে। আজ রাতে আমি শিখেছি, সত্যিই ক্ষমতা আসে নিজের ভয়কে স্বীকার করার মধ্য দিয়ে।” লুইস মাথা নেড়ে সম্মত হল, “হ্যাঁ, বিজ্ঞান যাই বলুক না কেন, এখানে যা হয়েছে তা একটি অভিজ্ঞতা যা বোঝা কঠিন। আমাদেরকে নিজের সীমা চিনতে হবে, এবং সেই সীমার বাইরে যাওয়ার সাহস রাখতে হবে।” মৌলি চুপ করে ছিল, কিন্তু তার চোখে ছিল এক নতুন দৃঢ়তা, যেন ভয়ের মধ্যেও জন্ম হয় শক্তি। তারা একসঙ্গে অরণ্যের ভিতর হাঁটতে থাকল, তাদের চারপাশে মৃদু বাতাস বয়ে যাচ্ছিল, মাঝে মাঝে সাপের ফিসফিসানি যেন তাদের পথ দেখাচ্ছিল।
হঠাৎ অশ্মতী থেমে গেল। সে এক পুরনো গাছের নিচে দাঁড়িয়ে মাটির দিকে তাকাল—যেখানে কিছু অক্ষর খোদাই করা ছিল। “এগুলো হলো আমাদের পরবর্তী পরীক্ষা,” সে বলল, “‘অন্ধকারের পাঠ’। এটা এমন এক শিক্ষা, যেখানে তোমাদের মানসিকতা, সাহস আর বিশ্বাসের গভীরতা যাচাই করা হবে।” লুইস ও মৌলি একসঙ্গে করল, “তুমি কি প্রস্তুত?” অশ্মতী চোখে অদ্ভুত এক জ্বালা নিয়ে বলল, “আমি তো একবার এই অন্ধকারে হারিয়েছি, কিন্তু এখন আমার মন দৃঢ়। আমি চাই আমার সঙ্গে তোমরাও প্রস্তুত থাকো।” তারপর তারা ধীরে ধীরে অরণ্যের আরো গভীরে প্রবেশ করল, যেখানে বাতাস ঘন, মেঘলা, আর ঝড়ের আগমন স্পষ্ট। সেখানে একটি ছোট বৃত্তাকার স্থান ছিল, যার চারপাশে জ্বলছে নীল আগুন, আর কেন্দ্রে একটি সাদা মূর্তি, যার চোখ বন্ধ। অশ্মতী বলল, “এখানে আমাদের অন্ধকারের মুখোমুখি হতে হবে। যেখানে আমরা নিজেদের ভয়, বেদনা আর লুকানো স্মৃতিগুলো নিয়ে আলোচনা করব।” তারা একে একে স্মৃতির খোলস খুলে, নিজেদের অন্ধকারের গল্প বর্ণনা করল—কীভাবে হারিয়েছে কেউ প্রিয়জন, কেউ নিজের পরিচয়, কেউ আত্মবিশ্বাস।
সেই রাত থেকে তারা বুঝল, মুক্তি আসবে কেবল নিজেদের অন্ধকারকে আলোকিত করে। আগামি অধ্যায়ে তারা আরও গভীর সত্যের মুখোমুখি হবে, যেখানে দেবীর আদর্শ আর মানুষের বাস্তবতা মিশে যাবে। মুক্তি? সেটা আসবে বা নাও আসতে পারে। কিন্তু তারা যাত্রা চালিয়ে যাবে—কারণ “কৃষ্ণনাগিনী” এর রহস্যের শেষ কোথাও নয়, বরং প্রতিটি প্রশ্নের মাঝেই নতুন গল্প।
৯
অরণ্যের সবুজ আর ধূসর ছায়া ছাড়িয়ে তারা যখন পৌঁছল সেই নির্জন গিরিখাতে, তখন সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। চারপাশে নীরবতা এমন, যেন গাছেরা পর্যন্ত শ্বাস বন্ধ করে রেখেছে। সেই নির্জন গিরিখাতের মাঝখানে একটি গুহা—পুরনো, শ্যাওলা-ঢাকা, আর মুখবন্ধে খোদাই করা এক ভয়াল মুখমণ্ডল: অর্ধেক নারী, অর্ধেক সাপ। অশ্মতী থেমে দাঁড়াল। তার মুখে কঠিন এক সংযম, গলার স্বরে গম্ভীর কম্পন: “এই গুহার ভেতরেই আছে তাকে—যার অস্তিত্ব নিয়ে কেবল কল্পনা আছে, ইতিহাস নয়। তিনি ‘কৃষ্ণনাগিনী’—প্রাচীন দেবীর সর্বশেষ রূপ, যিনি এখন আর মূর্তি নন, বরং বেঁচে আছেন চিন্তার ছায়া হয়ে। আমাদের পথ এখানেই শেষ নয়, কিন্তু সত্যের শুরু এখান থেকে।” ড. লুইস একটু পিছিয়ে এল। “তুমি কি বলতে চাইছো, আমরা একটি সত্তার মুখোমুখি হতে যাচ্ছি, যে… জীবিত?” মৌলি ফিসফিস করে বলল, “বা হয়তো তিনি আমাদের মনেরই এক ভয়ঙ্কর ছায়া।” গুহার প্রবেশপথে পা রাখতেই, বাতাস হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে গেল, নিঃশব্দে ঝিরঝিরে কাঁপন ছড়িয়ে পড়ল মেরুদণ্ড বেয়ে।
গুহার ভিতরে আলো প্রায় অদৃশ্য। তারা যখন প্রবেশ করল, এক অদ্ভুত অনুরণন ঘুরে বেড়াচ্ছিল দেওয়ালের গায়ে—একটি কণ্ঠস্বর, কিন্তু শব্দ নয়; এক আহ্বান, কিন্তু ব্যাখ্যাতীত। হঠাৎ করেই সামনে দেখা গেল এক আধারে ভাসমান একটি চেহারা—এক নারী অবয়ব, যার দেহ অর্ধেক নারী আর অর্ধেক সাপের কুণ্ডলী। মাথার চারদিকে ছড়িয়ে আছে জীবন্ত ফণা, তার চোখ কালো—না, বলা ভুল—চোখ যেন দুইটি গভীর কূপ, যেখানে তাকালে কেউ নিজের স্মৃতি হারিয়ে ফেলে। তিনজন থমকে দাঁড়ালো। অশ্মতী প্রথম এগিয়ে গেল। “তুমি কি তিনি?” প্রশ্ন করতেই কণ্ঠস্বর এলো—না, মুখ নড়ল না, কিন্তু শব্দ বাজল তাদের মাথার ভেতর, “আমি একা নই, আমি হাজার বছর ধরে সকল নারীর জমে থাকা অভিমান, আশক্তি ও রূপান্তরের প্রতিচ্ছবি। আমি জন্মেছিলাম প্রতারণার থেকে, রক্ষা করেছিলাম নির্যাতনের বিরুদ্ধে, আর এখন আমি আছি তোমাদের প্রশ্নের উত্তর হয়ে।” লুইস ফিসফিস করে বলল, “তাহলে তুমি দেবী নও, মানুষও নও?” সেই কণ্ঠ হাসল, ঠাণ্ডা এক শব্দে, “আমি দেবীও, আমি অভিশাপও। আমি তোমাদের প্রতিফলন। অশ্মতী—তুমি আমার ছায়া।”
এই কথায় যেন সময় থেমে গেল। অশ্মতীর চোখ বিস্ফারিত। “ছায়া মানে?” “তুমি জন্মেছিলে চক্রের ভিতর, কিন্তু তোমার মন সবসময় বৃত্তের বাইরে ছিল। তুমি প্রশ্ন করো, সেই কারণেই তুমি নির্বাচিত।” কৃষ্ণনাগিনী বলল। “তুমি যদি আমাকে মেনে নাও, তবে তুমি চক্রের রক্ষক হবে; আর যদি অস্বীকার করো, তবে চক্র ভেঙে যাবে, আর এই অরণ্য, এই বিশ্বাস, সব ধ্বংস হবে।” মৌলি চিৎকার করে উঠল, “তাহলে তো তুমি আমাদের মুক্তি চাও না, তুমি চাও অশ্মতীকে বন্দি রাখতে।” গুহা গর্জে উঠল, যেন অরণ্য প্রতিধ্বনি দিল। কৃষ্ণনাগিনী বলল, “বিনাশেই জন্ম। তুমি নিজেকে উদ্ধার করতে চাও, অশ্মতী? তবে আমাকে গ্রহণ করো, বা ধ্বংস করে দাও—তোমার ইচ্ছায়।” অশ্মতী সেই মুহূর্তে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল কৃষ্ণনাগিনীর সামনে। তার চোখে জল, তবু দৃষ্টি অমলিন। সে হাত বাড়িয়ে দিল—না গ্রহণ করতে, না প্রতিহত করতে—বরং ছুঁতে, বুঝতে। কৃষ্ণনাগিনীর চোখ ধীরে ধীরে আলো ছড়াল, আর সেই আলো অশ্মতীর চোখে ঢুকে পড়ল।
এক ঝড়ের মতো বিস্ফোরণ। আলো, অন্ধকার, সাপের ফণা, নারীর চিৎকার, নদীর গর্জন—সব মিলেমিশে এক মুহূর্তে থেমে গেল।
১০
আলো ঝলক দিয়ে মিলিয়ে গেল। সময় থেমে গেল এক অপার্থিব স্তব্ধতায়। চোখ খুলতেই অশ্মতী নিজেকে এক বিরল পরিসরে দেখতে পেল—চারপাশে নেই অরণ্য, নেই গুহার প্রাচীন দেয়াল, কেবলমাত্র অসীম সাদা আকাশ আর নির্জনতা। তার সামনে বসে কৃষ্ণনাগিনী, এবার আর বিভ্রমের মতো নয়, বাস্তবের মতো স্পষ্ট। তবে তার মুখে এবার কোনো ভয় বা রাগ নেই, বরং এক অদ্ভুত শান্তি। অশ্মতী থমকে গিয়ে বলল, “তুমি আমাকে নিজের ছায়া বলেছিলে। তাহলে কি আমার ভাগ্য নির্ধারিত?” কৃষ্ণনাগিনী মৃদু হেসে বলল, “তুমি যা দেখেছ, তা তোমার শক্তির উৎস নয়—তোমার নিজের চিন্তাভাবনাই তোমার পথ। আমি কেবল একটি প্রতীক, তোমার দ্বিধা, তোমার সম্ভাবনা। তুমি যদি চাও, আমায় গ্রহণ করতে পারো; আর যদি না চাও, আমাকে ছেড়ে দাও। কিন্তু মনে রেখো, চক্র কখনো পুরোপুরি ভাঙে না—এ কেবল রূপান্তরিত হয়।” অশ্মতী ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করল, নিজের ভিতরে নেমে গেল। সে দেখতে পেল তার ভিতরে একদিকে জমে আছে ভয়—নাগভৃত্যের নিয়ন্ত্রণ, পূজনাথের শাসন, নিজেকে হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা। কিন্তু সেই অন্ধকারের মধ্যেই জন্ম নিচ্ছে আলো—প্রেম, প্রতিবাদ, প্রশ্ন, নিজের ইচ্ছার স্বাধীনতা।
ঠিক তখনই দৃশ্যপট বদলে গেল। অশ্মতী নিজেকে দেখতে পেল মন্দিরের উঠোনে, তার চারপাশে জড়ো হয়েছে শত শত মুখোশধারী ভক্ত। গুজব ছড়িয়ে পড়েছে—নতুন ‘নাগিনী’ ফিরে এসেছে চক্রবিন্দু ভেদ করে। কিন্তু এবার সে আর পূজনাথের ছায়ায় নয়, নিজস্ব শক্তির উৎস হয়ে উঠেছে। ড. লুইস আর মৌলি তার পাশে, চোখে শ্রদ্ধা, কিন্তু ভয়হীন। পূজনাথ নেই—সে নিজেই যেন মিলিয়ে গেছে চক্রের ভাঙনে। অশ্মতী সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি আজ থেকে আর কারও উপাস্য নই। আমি নিজের প্রতিনিধি। আমি দেবীও, মানুষও—আমি নারী, যার ভিতরে বহমান বিষ ও অমৃত—উভয়ই।” চত্বর নিস্তব্ধ, তারপর যেন গাছেরা পর্যন্ত হাততালি দেয় পাতায় পাতায়। ভক্তরা নিজেদের মুখোশ খুলে ফেলে, একে একে সবাই মাটিতে নতজানু হয় না, বরং দাঁড়িয়ে থাকে সম্মান সহকারে—যেন এক নবজন্মের সাক্ষী।
লুইস কাঁধে হাত রাখে অশ্মতীর। “তুমি তো এই সম্প্রদায়কে নতুন পথ দেখালে। কিন্তু তুমি নিজে?” অশ্মতী একটু হাসে, “আমার পথ শুরু হলো আজ। আমার ভিতরের কৃষ্ণনাগিনীকে আমি অস্বীকার করিনি, আবার অন্ধভাবে মেনেও নিইনি। আমি তাকে রূপান্তর করেছি।” মৌলি সামনে এসে বলে, “তাহলে এখন কী হবে আমাদের?” অশ্মতী আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, “নতুন চক্র শুরু হয়েছে—এই অরণ্যে, এই মানুষদের মধ্যে। এখন আর কোনো পূজনাথ থাকবে না, থাকবে না অন্ধ উপাসনা। থাকবে শিক্ষা, প্রশ্ন, বিশ্বাস ও প্রতিফলন।” ড. লুইস একটা পুরনো চিঠি বের করে বলে, “তোমার কথা আমি দুনিয়াকে জানাবো। তারা জানবে, প্রকৃতি কেবল রহস্য নয়, বিপ্লবও।” তারা তিনজন ধীরে ধীরে অরণ্য ছাড়তে লাগল। কিন্তু পিছনে থেকে সাঁই সাঁই শব্দে বয়ে চলল এক ফিসফিসানি—যা হয়তো বাতাসের, হয়তো কোনো পুরনো নাগের… অথবা নতুন চক্রের শুরুস্বর।
_শেষ_




