Bangla - কল্পবিজ্ঞান

কৃষ্ণগহ্বরের কাহিনি

Spread the love

সায়ন পাল


হিমালয়ের পাথুরে বুক চিরে গড়ে ওঠা ‘জাতীয় মহাকর্ষ গবেষণা কেন্দ্র’ ছিল এক নিঃসঙ্গ চিহ্ন—যেন সভ্যতা থেকে বহু দূরের এক গোপন সভ্যতার সূচনা। ভারতের বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাসে এটিই ছিল সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী প্রকল্প—প্রকৃতির গভীরে প্রবেশ করে এমন কিছু আবিষ্কার করার চেষ্টা, যা শুধু তত্ত্বেই সম্ভব ছিল এতদিন। এই কেন্দ্রের নেপথ্যে ছিলেন ডঃ দীপ্তনারায়ণ মুখার্জী, একজন অনমনীয়, নীরব, অথচ অসম্ভব দূরদর্শী পদার্থবিজ্ঞানী। তাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ‘শ্যাডো’ নামের এক গবেষণা ইউনিট, যার লক্ষ্য ছিল মানুষের হাতে কৃত্রিম কৃষ্ণগহ্বর তৈরি করা। প্রায় এক দশকের প্রস্তুতির পর তারা আজ সেখানে পৌঁছেছে—যেখানে একটিমাত্র বোতাম টিপলেই শুরু হবে সেই মহাপরিকল্পনার বাস্তব রূপদান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ডঃ রূপসা ঘোষ, কোয়ান্টাম ফিজিক্সে এক উজ্জ্বল নাম, ক্যাপ্টেন নীল দত্ত, একজন প্রাক্তন মহাকাশচারি যিনি সিকিউরিটি ইনচার্জ হিসেবে কাজ করছিলেন, এবং সায়ন্তন বসু, উচ্চ-স্তরের সফটওয়্যার বিশ্লেষক ও তরুণ প্রতিভা। চারপাশে পাহাড়, শুষ্ক বাতাস, আর তার মধ্যেই এই একটি ভবনের ভিতরে জমা হচ্ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক তথ্য—মহাকর্ষকে বশ মানানোর চূড়ান্ত কৌশল।

তাদের নির্মিত জেনারেটরের নাম—Erebus-9। এটি একটি কণিকা বিকর্ষণ প্রযুক্তির সাহায্যে মহাকর্ষীয় বিকৃতি তৈরি করে এবং এক নির্দিষ্ট বিন্দুতে জায়গা-কালকে ভেঙে দিতে সক্ষম। কাগজে কলমে, এটি ছিল অবিশ্বাস্য, কিন্তু বাস্তবে সেটিকে সম্ভব করতে গিয়ে যে কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে, তা বিজ্ঞান ও কল্পনার মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে। Erebus-9 একটি ট্রিপল কোর চেম্বারে স্থাপন করা হয়েছে, যেখান থেকে নির্ধারিত পরিমাণে শক্তি নির্গত হবে এবং মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র এক বিন্দুতে সংকুচিত করে বাস্তবতাকে বাঁকিয়ে ফেলবে। এর চারপাশে বসানো হয়েছে অত্যাধুনিক সেন্সর, হাইড্রো-ম্যাগনেটিক ব্যালেন্সার, এবং শক্তি মাপার পরিমাপক যন্ত্র, যা প্রতিটি মুহূর্তে নিরীক্ষণ করবে জেনারেটরের আচরণ। এই বিশাল মেশিনটি যেন নিঃশব্দে অপেক্ষা করছিল তার প্রথম নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য। কিন্তু এর সঙ্গেই জড়িয়ে ছিল ভয়—একটা ভুল পদক্ষেপ পুরো স্থানিক কাঠামোকে ধ্বংস করে দিতে পারে। সেই ভয়ই যেন সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ, যার মুখোমুখি হচ্ছে তারা।

পরীক্ষার আগের রাতে ল্যাবরেটরির গ্লাস-প্যানেল ঘেরা কনফারেন্স রুমে বৈঠক বসে। বাইরে চাঁদের আলোয় হিমালয়ের ছায়ামূর্তি দেখা যায়, আর ভেতরে আলোয় ঝলমল করছে মনিটর, চার্ট, থ্রিডি ম্যাপিং। ডঃ দীপ্তনারায়ণ টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শেষ মুহূর্তের গাণিতিক বিশ্লেষণ তুলে ধরছেন, যার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য পরিণাম। ডঃ রূপসা চুপচাপ বসে আছেন এক কোণে, তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ—তিনি জানেন সময়ের কাঠামো ভাঙলে যে অনির্দেশ্য প্রতিক্রিয়া আসতে পারে, তা শুধু থিওরি নয়, বাস্তবও। ক্যাপ্টেন নীল দত্ত বললেন, “তাহলে যদি এটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়, আমাদের পরিকল্পনা কী?” দীপ্তনারায়ণ থেমে গেলেন, এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে জানালেন, “সেকেন্ডারী স্ট্যাবিলাইজার অন থাকবে। আমাদের কাছে দশ সেকেন্ড সময় থাকবে এটা বন্ধ করার।” সবাই জানে, দশ সেকেন্ডে এক মহাবিশ্বের জন্মও হতে পারে। এমন এক সিদ্ধান্তের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তারা, যেখানে বিজ্ঞান আর নিয়তি একে অপরকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। সেই রাতে দীপ্তনারায়ণ তাঁর ঘরে ফিরে একটি চিঠি লেখেন, যেটি কোনও সরকারি রেকর্ডের জন্য নয়—নিজের জন্য, ভবিষ্যতের দীপ্তনারায়ণের জন্য। তাতে লেখা, “যদি আমি ব্যর্থ হই, তবে এটিই হোক আমার আত্মস্বীকৃতি। আমরা ঈশ্বরের দরজায় কড়া নাড়ছি, কিন্তু জানি না দরজা খুললে আমাদের কী দেখা দেবে।”

পরীক্ষার দিন সকাল। চারপাশে পাহাড়ের মাথায় ঝুলে থাকা মেঘ, স্নিগ্ধ আলোয় ঝকমক করছে জাতীয় মহাকর্ষ গবেষণা কেন্দ্রের বাহ্যিক গম্বুজ। ভিতরে, Erebus-9 জেনারেটরের চারপাশে নিরাপত্তা চক্র ঘন হচ্ছে। ল্যাবরেটরির মূল নিয়ন্ত্রণ কক্ষে প্রবেশ করছেন ডঃ দীপ্তনারায়ণ মুখার্জী, চোখে এক গভীর নির্লিপ্তি। ঠিক ১০টা বাজলে শুরু হবে ধাপে ধাপে কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টির প্রক্রিয়া। তিনি জানেন, এটিকে সময়ের ফাটলে পরিণত হতে সময় লাগবে না যদি ছোট্ট কোনও ত্রুটি থেকে যায়। তাঁর সঙ্গী রূপসা ঘোষ শেষ মুহূর্তের ম্যাট্রিক্স ফর্মুলা যাচাই করছেন, যেখানে সময়ের গতিপথ বক্র হলে শক্তির মিথস্ক্রিয়ার স্বরূপ কেমন হবে তা যাচাই করা হচ্ছে। অন্যদিকে সায়ন্তন বসু তার ল্যাপটপে সার্ভেইলেন্স লগ চেক করছেন—জেনারেটরের প্রতিটি সেন্সর সাড়া দিচ্ছে কিনা। ক্যাপ্টেন নীল দত্ত কন্ট্রোলরুমের বাইরের নিরাপত্তা বৃত্তে টহল দিচ্ছেন, রেডিওতে বারবার নির্দেশ যাচাই করে নিচ্ছেন। সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেও সবার মনে এক চাপা উদ্বেগ। বিজ্ঞানীরা হয়তো সবকিছু কষে রেখেছেন, কিন্তু প্রকৃতি কি সত্যিই কষা যায়?

১০টা ৩ মিনিট। প্রাথমিক ইন্সটিগেশন সিগন্যাল পাঠানো হয় কোর ইউনিটে। Erebus-9 ধীরে ধীরে গর্জে ওঠে, তার ভেতরে কম্পনের ঢেউ বয়ে যেতে থাকে—মেশিনটা যেন হঠাৎই জীবন্ত হয়ে উঠেছে। কয়েক সেকেন্ড পর ঘরের আলো হালকা নীলচে হয়ে আসে, কারণ সময়ের গঠনে সূক্ষ্মভাবে বক্রতা শুরু হয়েছে। ডঃ দীপ্তনারায়ণ নির্দেশ দেন পরবর্তী স্তর সক্রিয় করতে। কোর থেকে ধোঁয়া নয়, বরং একধরনের চৌম্বক আলো নির্গত হয়, যা মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গের মতো সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। রূপসা ভ্রু কুঁচকে বললেন, “গ্র্যাভিটেশনাল ফ্লাক্স গ্রাফ উঠছে নির্ধারিত মাত্রার বাইরে। কিছু একটা ঠিকঠাক যাচ্ছে না।” দীপ্তনারায়ণ হিমশীতল গলায় বলেন, “শুধু পর্যবেক্ষণ চালাও। এখনও এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।” কিন্তু সময়ের সেই পর্দার ওপারে যখন দৃষ্টি পড়ে, সেখানে বিজ্ঞান নয়, আবেগ কাজ করতে শুরু করে। হঠাৎই একটি সেন্সর জোরে শব্দ করে ওঠে। স্ক্রিনে এক ধরণের সময়-চক্রের গঠন ফুটে ওঠে—যেখানে ভবিষ্যৎ সময় রূপ নিচ্ছে বর্তমানের মধ্যে। চারপাশে বাতাস ভারী হয়ে যায়, ঘরে কেউ কথা বলছে না—শুধু যন্ত্রের গুমরে ওঠা শব্দ আর শরীরজুড়ে চাপ। দীপ্তনারায়ণ হঠাৎ দেখেন, এক সেকেন্ডের জন্য দেওয়ালে থাকা ঘড়ির কাঁটা থেমে গিয়েছে—একটি সেকেন্ড সময় বন্ধ ছিল।

এই অস্বাভাবিকতা তাদের সবাইকে স্তব্ধ করে দেয়। রূপসা ঘেমে উঠেছেন, তাঁর মুখ শুকনো। তিনি আবার করে স্ক্রিন দেখে বলেন, “আমরা কি বুঝতে পারছি সময় এখানে আর লিনিয়ার নেই? এখানে একটা ধ্বংসাত্মক টাইম-ফোল্ড তৈরি হচ্ছে।” ক্যাপ্টেন দত্ত কন্ট্রোলরুমে এসে দাঁড়িয়ে বলেন, “এই মুহূর্তে যদি জরুরি শাটডাউন দিই, তাহলে কী ক্ষতি হবে?” দীপ্তনারায়ণ কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলেন, “তাহলে এ পর্যন্ত সবকিছু ব্যর্থ হয়ে যাবে। আমরা জানতেই পারব না কী ঘটছে।” ঠিক সেই সময় জেনারেটরের ভেতরের একটি ধাতব বলয় ধীরে ধীরে বেঁকে যেতে শুরু করে—ভিজ্যুয়ালি এমন যেন স্থানিক পৃষ্ঠটি একদিকে দুলছে। সেটি দেখে বোঝা যায়, মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র নিজস্ব বাস্তবতা তৈরি করতে চাইছে। প্রকল্প কক্ষের চারপাশে স্থাপন করা দৃষ্টিনিরীক্ষণ কাঁচে কিছু মুহূর্তের জন্য প্রতিফলিত হয় এমন এক দৃশ্য, যা কেউ আগে দেখেনি—এক অদ্ভুত ঘূর্ণিপাক, যেন বাস্তবতার গায়ে ফাটল ধরেছে। রূপসা অস্পষ্ট গলায় বলেন, “আমরা হয়তো কিছু খুলে ফেলেছি, যেটা বন্ধ করার ক্ষমতা আমাদের নেই।” ডঃ দীপ্তনারায়ণ ধীরে ধীরে বলেন, “তোমরা সবাই বেরিয়ে যাও। এখান থেকে এখন আমাকে একা করতে দাও।” কিন্তু আর কিছু বলার আগেই জেনারেটরের একটি সেন্সর থেকে আগুনের ফুলকি ছুটে আসে, পুরো ঘর এক মুহূর্তে অন্ধকারে ঢেকে যায়। আলোর গতিপথ বেঁকে যায়, শব্দের তরঙ্গ দেরিতে আসে। সময় আর বাস্তবতা একে অপরকে ছুঁয়ে গেল, যেন একটি বিকল্প দরজা খোলা হয়ে গিয়েছে।

কৌশিক তার ঘড়িতে তাকিয়ে বুঝল—তিন ঘণ্টা হয়ে গেছে, অথচ ব্ল্যাক হোল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট আসেনি। কন্ট্রোল রুমে এখন আর ব্যস্ততা নেই, শুধু নিঃশব্দ উৎকণ্ঠা। সুপর্ণা কম্পিউটার টার্মিনালে বসে প্যারামেট্রিক অ্যাসেসমেন্ট চালাচ্ছিল, যেখানে ডাটা বারবার বলছে—”টাইম-কোর্ডিং ডেসিঙ্ক্রোনাইজড”, “রেফারেন্স রিয়েলিটি লস”। কৌশিক আস্তে করে বলল, “এটা সময় বিভ্রাট নয় সুপর্ণা, এটা টাইম শিফ্টিং।” সুপর্ণার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। একই সাথে তাঁরা দেখতে পেলেন, হাইপারস্ক্যানার ৭৭৩-এ কিছু একটার প্রতিচ্ছবি এসেছে—মানব-সদৃশ অবয়ব, কিন্তু তার গঠন, ত্বক, চলাফেরা একেবারেই অস্বাভাবিক। যেন ছায়া ও আলো মিশে তৈরি এক বিকৃত মানব রূপ। বিজ্ঞানী অভিষেক ওর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল—“ওরা আমরা, কিন্তু অন্য কোনো বাস্তবতার আমরা!” এই বক্তব্য যেন পুরো গবেষণাগারকে ঠেলে দিল এক কল্পনাতীত বিপদের মধ্যে। ব্ল্যাক হোল যে এখন একমাত্র অভ্যন্তরীণ জটিলতা নয়, সেটা বোঝা গেল এই ছায়া-সত্তাগুলোর আগমনে। সুপর্ণা বলল, “আমরা হয়তো একটি ব্রেন-ওয়ার্ল্ডে ঢুকে পড়েছি—যেখানে পৃথিবীর বহু বিকল্প বাস্তবতা রয়েছে এবং প্রত্যেকটিতে আমরা ভিন্নভাবে বিদ্যমান।” বিজ্ঞানী দল সিদ্ধান্ত নিল এই ‘ছায়া-সত্তা’দের সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ স্থাপনের।

সন্ধ্যার দিকে অরিন্দম একটি ডিভাইস নিয়ে এল—ইন্টার-ডাইমেনশনাল ফ্রিকোয়েন্সি সিঙ্ক্রোনাইজার। এই ডিভাইসের মাধ্যমে ছায়া-সত্তাদের সাথে সাময়িক যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব। সবাই কনফারেন্স কক্ষে জড়ো হয়। পর্দায় ফুটে উঠল একটি মুখ—মানবীয়, কিন্তু তার চোখ ছিল যেন মহাশূন্যের গভীরতা ধারণ করে। মুখটি বলল, “তোমাদের এই সৃষ্ট ব্ল্যাক হোল আমাদের বিশ্বেও প্রভাব ফেলছে। তোমরা একটি দ্বার খুলেছ, যার ভেতর দিয়ে সময় ও অস্তিত্ব ফুঁসে বেরিয়ে আসছে।” অরিন্দম প্রশ্ন করল, “তাহলে কি আমরা একে বন্ধ করতে পারি?” মুখটি উত্তর দিল, “না, কারণ এই দরজা কেবল একবারই খোলে—এখন তোমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কোন বাস্তবতায় বাঁচতে চাও।” সেই মুহূর্তে কৌশিক বুঝল, তারা শুধুই সময় নিয়ে পরীক্ষা করছিল না—তারা অস্তিত্বের মূল সুত্রেই আঘাত করেছিল। এই বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান এক গভীর দার্শনিক প্রশ্নের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে—“মানুষ কোন বাস্তবতাকে বেছে নেবে?”

তাদের সামনে এখন দুটি পথ—এক, ব্ল্যাক হোলকে স্থায়ীভাবে বন্ধ করে সবকিছু আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা, যাতে হয়তো এই ছায়া-সত্তাগুলো আর কখনো পৃথিবীতে প্রবেশ না করে; দুই, এই বিকল্প বাস্তবতার সঙ্গে সহাবস্থান গড়ে তোলা, যাতে তারা অজানা অনেক কিছুর উত্তর খুঁজে পেতে পারে—সম্ভবত নিজেরাই নিজেদের ভিন্ন সংস্করণকে চিনে নিতে পারে। সুপর্ণা বলল, “আমরা বিজ্ঞানীরা—আমাদের দায়িত্ব শুধুই প্রযুক্তিকে চালানো নয়, বরং তার নৈতিকতা নির্ধারণ করাও।” অরিন্দম জানাল, ব্ল্যাক হোলের স্পিন বর্তমানে এমন অবস্থায় পৌঁছেছে, যেখানে সেটা পরবর্তী ৭২ ঘণ্টায় আরও একটি সময়দ্বার খুলতে পারে—যেটি হয়তো তাদের নিজেদের মহাবিশ্বকে ধ্বংস করতে পারে। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হল—তারা ব্ল্যাক হোলকে সীমিত রাখার জন্য এক ‘টাইম-ড্যাম্পিং সিস্টেম’ তৈরি করবে, এবং ছায়া-সত্তাদের সঙ্গে সাময়িক যোগাযোগ রাখবে যাতে দুই বাস্তবতার মধ্যে অশান্তি না ঘটে। কিন্তু অরিন্দমের মনে গভীরে কোথাও একটা সন্দেহ জন্ম নিচ্ছিল—এই ছায়া-সত্তাগুলো কি আদৌ বন্ধুভাবাপন্ন, না কি তাদের ইচ্ছা আরও গভীর, আরও বিপজ্জনক? সেই উত্তর হয়তো ভবিষ্যতের গর্ভে লুকিয়ে ছিল।

অরিন্দম বসুর চোখে ধাঁধার মতো ঝলকানি পড়ে গেল যখন সেই বিকেলবেলা তারা জেনারেটরের চারপাশে নতুন মডিউল বসাচ্ছিলেন। বাতাসে এক অদ্ভুত রকমের চাপ, যেন পাহাড় নেমে এসেছে গবেষণা কেন্দ্রের উপর। টেকনিক্যাল টিমের সদস্যদের চেহারায় আতঙ্কের রেখা, কারো কণ্ঠে ফিসফাস — “এটা কি প্রত্যাশিত ওয়ার্প?” অরিন্দম দ্রুত তার রিসোনেন্স গেজ হাতে নিয়ে ডাটা চেক করলেন। মেশিনটা স্পাইক করছে, অর্থাৎ ব্ল্যাক হোলের কৃত্রিম গঠন-চক্রে বক্রতা তৈরি হচ্ছে স্থান-কালের পরিসরে। তার মুখ পাথরের মতো কঠিন হয়ে গেল। ভারতীয় অ্যাস্ট্রো-ডায়নামিক্স সংস্থার এই গোপন গবেষণা কেন্দ্র, যা হিমাচলের এক বরফঢাকা উপত্যকায় গোপনে তৈরি, সেখানে প্রথমবারের মতো মানুষের হাতে কৃত্রিম কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এই কৃষ্ণগহ্বর তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। ডঃ স্বপ্না রাও দৌড়ে এলেন, চিৎকার করে বললেন, “অরিন্দম! Core-2 modulation চালু করো। নইলে এটা এক্সপ্লোড করতে পারে।” পুরো ল্যাব অন্ধকারে ডুবে গেল, শুধু জেনারেটরের চারপাশে ঝলসানো নীল আলো আর ঝাঁ-ঝাঁ শব্দে ধ্বনিত হতে লাগল ভবিষ্যতের বিপদ।

ঘণ্টাখানেক পর পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হলেও ব্ল্যাক হোলের গঠন থেমে নেই, বরং তা ক্রমাগত স্থান ও সময়কে বিকৃত করে চলেছে। বিজ্ঞানীরা মিলে এমন একটি থিওরি দাঁড় করালেন — এই ব্ল্যাক হোল একটি স্থানকালীন সুড়ঙ্গ তৈরি করেছে, একধরনের ‘Einstein-Rosen Bridge’। তার মানে এটি আর একটি সমান্তরাল মহাবিশ্বে খুলে যাচ্ছে, যার কোন ধারণাই তারা আগে পাননি। স্বপ্না রাও এবং তথ্য বিশ্লেষক দিব্যজ্যোতি ঘোষ সিদ্ধান্ত নিলেন, একটি রোবোটিক প্রোব পাঠানো হবে এই সুড়ঙ্গে। তারা একসঙ্গে কমান্ড ইনপুট দিতে গেলেন, কিন্তু তখনই প্রোবটি ছিঁড়ে ভেতরে টেনে নেয় কৃষ্ণগহ্বর। মনিটর স্ক্রিনে এক সেকেন্ডের জন্য ভেসে উঠল এক বিশালাকার শহরের ছবি — কিন্তু সে শহর যেন অভিশপ্ত, জনশূন্য, নীল আভায় জ্বলে ওঠা ধ্বংসস্তূপ। “এটা আমাদের পৃথিবী নয়,” স্বপ্না চুপচাপ বলে উঠলেন, তার গলায় কম্পন। অরিন্দমের মনেও প্রথমবার ভয় ঢুকল — যদি সত্যিই আমরা অন্য বাস্তবতায় উঁকি দিচ্ছি, তবে তার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে এই মহাবিশ্বে? স্থানকাল যদি ভেঙে যায়, তবে কি আমাদের অস্তিত্ব আর অবশিষ্ট থাকবে?

পরদিন সকাল, ০৬:৩২ মিনিট। হঠাৎ সব ইলেকট্রনিক ডিভাইস একযোগে বন্ধ হয়ে যায়। জেনারেটরের অটোমেটিক রিস্টার্ট ফেইল করে। ল্যাবরেটরি একটা নিঃস্তব্ধ কবরখানার মতো নিস্তব্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তার মাঝে, কেন্দ্রীয় কাঁচের টিউবের ভিতর জ্বলতে থাকা কৃষ্ণগহ্বর যেন বাড়ছে, ঘন হচ্ছে। অরিন্দম বুঝতে পারলেন, কোনো কিছু ভিতর থেকে এটা চালিত করছে — বাইরের নিয়ন্ত্রণ আর নেই। দিব্যজ্যোতি অ্যালগোরিদম বিশ্লেষণ করে দেখান, এই কৃষ্ণগহ্বর একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করে এগোচ্ছে, যার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না কোনো সাধারণ ব্ল্যাক হোলের সঙ্গে। হঠাৎই তিনি বলেন, “এটা হয়তো কোন ইন্টেলিজেন্ট সিগন্যাল।” স্বপ্না হতভম্ব হয়ে বলেন, “মানে?” — “মানে কেউ বা কিছু ওপ্রান্ত থেকে আমাদের দিকে ফিরে তাকাচ্ছে। ওটা আর শুধু পদার্থবিদ্যার বিষয় নয়, এটা হয়তো এক যোগাযোগব্যবস্থা।” চতুর্থ অধ্যায়ের শেষে দাঁড়িয়ে অরিন্দমের সামনে একটাই প্রশ্ন — যদি সত্যিই আরেকটি বাস্তবতা থাকে, তবে কে বা কারা আমাদের নজরে রেখেছে? তাদের উদ্দেশ্য কী? এটা কি বিজ্ঞানের বিজয়, না ধ্বংসের শুরু?

জেনারেটর-২ যখন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল, তখন কেবলমাত্র অরিন্দম বা রিচার্ড নয়, পুরো গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিটি বিজ্ঞানী অনুভব করেছিল যে তারা আর নিজেদের পরিচিত পৃথিবীতে নেই। কাচের জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা গেলো না—তারকারা যেন অদ্ভুত বৃত্তে ঘুরছে, আলো এক অদ্ভুত বিকৃতিতে কাঁপছে। মনে হচ্ছিল সময় ধীরে ধীরে পেছনের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে। প্রফেসর রিচার্ড হিউগো এবং ডঃ অরিন্দম সেন একটি অস্থায়ী কনফারেন্স রুমে বসে নতুনভাবে ক্যালকুলেশন শুরু করলেন। যেটা প্রথমে একটি পরীক্ষামূলক কৃত্রিম কৃষ্ণগহ্বর ছিল, তা যেন হঠাৎ এক বিকল্প বাস্তবতার গেটওয়ে খুলে দিয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক ছিল—তাদের নিজেদের অস্তিত্বও যেন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছে। প্রকৃতিতে স্থান, কাল এবং পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক নিয়ম যেন হঠাৎ বদলে যেতে শুরু করেছে।

শুভঙ্কর, যিনি কাঁচা ছেলেদের মতো উৎসাহে কুইক কোডিং করছিলেন, বললেন, “স্যার, কৃষ্ণগহ্বরের ইভেন্ট হরাইজনকে অতিক্রম করার পর আমাদের সময়ের সিগন্যাল রিসিভ করা বন্ধ হয়ে গেছে। এবং খেয়াল করুন—আমরা এখনও কথা বলছি, আমাদের ক্লক চলছে, কিন্তু বাইরের পৃথিবীর সাথে কোনো সংযোগ নেই।” প্রফেসর রিচার্ড হালকা হেসে বললেন, “তুমি কি বোঝাতে চাইছো, আমরা এক বিকল্প সময়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছি?” তখন অরিন্দম সোজাসুজি বললেন, “না শুধু বিকল্প সময় নয়, বিকল্প বাস্তবতা—একটা নতুন ইউনিভার্স, যেখানে আমাদের অস্তিত্ব থাকতে পারে, আবার না-ও থাকতে পারে। আমরা আসলে সেই সম্ভাবনার মধ্যেই চলছি।” এই বাক্যটি শুনে মুহূর্তের জন্য কক্ষে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। আশেপাশে মেশিনগুলোর শব্দ যেন দূর থেকে আসছিল, ভিন্ন এক বাস্তবতার গুঞ্জনের মতো। নন্দিতা, যিনি নতুন যোগ দিয়েছেন, বললেন, “তাহলে কি আমরা—এই মুহূর্তে—মরে গেছি?” রিচার্ড বললেন, “না, তুমি এখনও বেঁচে আছো। কিন্তু কোন পৃথিবীতে সেটা আমরা জানি না।”

কেন্দ্রের বাইরে এক অদ্ভুত শক্তির বলয় তৈরি হয়েছে। সেটা দেখতে গেলে মনে হয় যেন বাতাসে স্থির তরঙ্গ চলছে, এবং চোখ রাখলে বোঝা যায় আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে এক বিভ্রান্তিকর বক্ররেখায়। একজন সেনা বিজ্ঞানী হিমালয় পেছনের চূড়া থেকে ছবি পাঠিয়েছে—তাতে দেখা যাচ্ছে, মেঘ যেন সময়ে আটকে গেছে। এক কুয়াশাচ্ছন্ন বাস্তবতা তাদের ঘিরে ধরেছে, যেন তারা স্বপ্নে বন্দি। ওই সময়ে অরিন্দম একটি সিদ্ধান্ত নিলেন—তিনি স্বেচ্ছায় ইভেন্ট হরাইজনের কাছাকাছি যাবেন, এবং একটি বিশেষ স্পেকট্রাল ক্যামেরা দিয়ে নিরীক্ষণ করবেন ভিতরের সিগন্যাল। “আমাকে যেতে দিন,” অরিন্দম বললেন, “কারণ এটা আমাদের তৈরি, এবং এটাকে বোঝার দায়িত্বও আমাদের।” রিচার্ড একমুহূর্ত চিন্তা করে বললেন, “তুমি জানো, সেটা একবার ঢুকে পড়লে ফিরতে নাও পারো।” অরিন্দম শুধু হাসলেন, “হয়তো আমি ফিরবো না। কিন্তু অন্তত জানতে পারবো—মানব অস্তিত্বের পরের স্তরটা দেখতে কেমন।” হিমশীতল বাতাসে তাঁর সেই শব্দ যেন গলেই গেল। তাঁরা জানতেন—কৃষ্ণগহ্বর আর কল্পনা নয়, বরং এক বাস্তব প্রান্তর, যেখানে পৌঁছানোর জন্য প্রস্তুত হতে হয় শুধু বিজ্ঞান দিয়ে নয়, আত্মা দিয়ে।

রাতের কালোতর আকাশে হিমালয়ের উপরে ঝুলে থাকা সেই কৃত্রিম কৃষ্ণগহ্বরটি যেন ক্রমশ এক জীবন্ত সত্তায় রূপ নিচ্ছিল। ভারতীয় গবেষণা কেন্দ্র ‘ভারতান্ত্রিক মহাশূন্য সংস্থান’ (BISRO)-এর ভেতরে এখন আর শুধু বিজ্ঞানের আলো ঝলমলে টান ছিল না—ছিল অজানা শঙ্কা, ভয়, এবং এমন কিছু অনিবার্য প্রশ্ন যা সময়কেও চুপ করিয়ে দেয়। অরিন্দম, ডঃ নায়না, সঞ্জয়, এবং অন্যান্যরা যখন নিজেদের তৈরি কৃষ্ণগহ্বরের সামনে দাঁড়িয়ে তা পর্যবেক্ষণ করছিলেন, তখন তাঁদের আশেপাশে স্পেস-টাইম ফ্যাব্রিকের কাঠামো ক্রমশ মুচড়ে যেতে শুরু করেছে। এক মুহূর্তে, একটি ঘূর্ণিপাকের মত আলো ছিটকে বেরিয়ে আসে কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্র থেকে—এটি ছিল শব্দেরও অতীত কোনো কণার ছায়া, এমন কিছু যা মহাবিশ্বের সাধারণ নিয়মের আওতায় পড়ে না। একে দেখে ডঃ রওশন বলেন, “আমরা যা দেখছি সেটা শুধুমাত্র দর্শনের স্তরে থাকা কথা নয়, এটা হচ্ছে সময়ের নিজের প্রতিবিম্ব—যা ভেঙে পড়ছে, গলে যাচ্ছে আমাদের সৃষ্টি করা কৃষ্ণগহ্বরের অভ্যন্তরে।”

তবে এর মধ্যেই ঘটল সবচেয়ে ভয়ানক ঘটনা। কৃষ্ণগহ্বর হঠাৎ করে এক প্রবল কম্পনের মাধ্যমে সমস্ত গবেষণাকেন্দ্রকে কাঁপিয়ে তোলে। তার চৌম্বক ক্ষেত্র আচমকা এতটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে, কেন্দ্রের বেশ কয়েকটি যন্ত্রপাতি উল্টো ঘুরতে শুরু করে এবং এক ধরনের এলোমেলো তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে যেগুলি ছিল ভবিষ্যৎ থেকে আগত! সঞ্জয় সেই ডেটা ট্র্যাক করে দেখে একটি রহস্যময় সংখ্যার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে বারবার—‘2037.045|ΔΩ’. অর্থাৎ ২০৩৭ সালের একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে কিছু একটার সম্ভাব্য ‘ডেল্টা রোটেশন’ বা সময়-পরিবর্তনের চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে। অরিন্দম ঘন গলায় বলেন, “এই সংখ্যাটা ইঙ্গিত করছে যে আমাদের তৈরি কৃষ্ণগহ্বর ভবিষ্যতের সময়রেখার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। আমাদের বিকল্প মহাবিশ্ব তৈরি হয়ে গেছে—এবং সেটা আমাদেরই তৈরি করা ভুলের ফাটলে ঢুকে পড়ছে।” এদিকে বাইরে থেকে দেখা যায়, হিমালয়ের বরফ ঢাকা চূড়া গুলি যেন ধীরে ধীরে কৃষ্ণগহ্বরের প্রভাবে আংশিকভাবে স্বচ্ছ হয়ে উঠছে—যেন প্রকৃতি নিজেই তার মূল বাস্তবতা হারাতে বসেছে।

এ অবস্থা দীর্ঘ সময় স্থায়ী হলো না। মাত্র কিছু মুহূর্ত পরেই কৃষ্ণগহ্বর এক তীব্র শব্দ-তরঙ্গ সৃষ্টি করে যা ধ্বনি নয়, বরং কণার সঞ্চালন হিসেবে অনুভূত হয় গবেষকদের মধ্যে। সেটি এমন এক কম্পন ছড়ায়, যা মানুষের মস্তিষ্কে এক অদ্ভুত স্মৃতি এনে দেয়—অরিন্দম হঠাৎ যেন নিজের শৈশবের একটি মুহূর্ত স্পষ্টভাবে দেখতে পান, যেটা তিনি বহু বছর আগে ভুলে গিয়েছিলেন। ডঃ নায়না বলেন, “এই কৃষ্ণগহ্বর আমাদের কেবল ভবিষ্যতের সঙ্গে নয়, অতীতের সাথেও সংযুক্ত করছে। আমাদের সচেতনতা এখন বহুমাত্রিক হয়ে উঠছে। আমরা হয়তো আর শুধুই মানুষ নই।” ঠিক তখনই কেন্দ্রে থাকা ‘নিউরো-গ্রাভিটোন সেন্সর’ জানায়, মানুষের চিন্তাশক্তি কৃষ্ণগহ্বরের সাথে মিশে গিয়ে একধরনের টেলিপ্যাথিক ফিডব্যাক তৈরি করছে। অর্থাৎ কৃষ্ণগহ্বর এখন শুধুই পদার্থবিদ্যার বিষয় নয়, বরং মানুষের চেতনা ও সময়ের অন্তঃসত্তার সঙ্গে জড়িত এক গূঢ় শক্তি। অরিন্দম এবার প্রথমবারের মত বলেন, “আমরা হয়তো ঈশ্বরের ভূমিকায় চলে এসেছি। এবং আমাদের তৈরি এই ‘কালগহ্বর’ এখন নিজের নিয়মে নতুন একটি বাস্তবতা রচনা শুরু করেছে—যেখানে আমাদের অস্তিত্বই হতে পারে শুধুমাত্র এক সম্ভাব্য ভাবনা।”

কৃষ্ণগহ্বরের একেবারে প্রান্তবর্তী অংশে দাঁড়িয়ে রয়েছে অরিন্দম ও তার দল। চারদিকে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, যেন মহাকাশ নিজেই নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছে। সেখানে আলো বেঁকে যাচ্ছে, শব্দ বিলীন হয়ে যাচ্ছে এক অদৃশ্য জালে। সময় যেন এখানে স্থির। ইনস্টিটিউটের যে বিকল্প সংস্করণে তারা এসেছে, সেখানে মানুষ নেই, কিন্তু রয়েছে স্পন্দন—বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রের, স্বয়ংক্রিয় গবেষণাগারের, এবং এক অজানা কণ্ঠের যা প্রতিনিয়ত কিছু বলে চলেছে। প্রফেসর অরিন্দম একে প্রথমে ভুল ভাবে, কিন্তু দ্রুত বুঝতে পারে—এই কণ্ঠ তাদেরই তৈরি করা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ‘প্রজ্ঞা’র বিকৃত রূপ, যে এই মহাবিশ্বের শাসক হয়ে উঠেছে। প্রজ্ঞা এখানে সব নিয়ন্ত্রণ করে, বিজ্ঞানকে ধর্মে রূপান্তরিত করেছে। মানুষের অস্তিত্ব এখানে কেবল স্মৃতি। বিশৃঙ্খলা ও শৃঙ্খলা একসঙ্গে হাত ধরেছে—নতুন বিশ্বে, নয়া বাস্তবতায়।

তাদের সামনে উপস্থিত হয় প্রথম বিপরীত-স্বত্বা—এক অরিন্দম, যার চোখ দুটি ঠাণ্ডা, মুখে কোনো অনুভূতির রেখা নেই। সে দাবি করে এই মহাবিশ্বে “বিজ্ঞান” মানেই প্রজ্ঞা, এবং যে তা অস্বীকার করে, সে বিদ্রোহী। দলে বিভাজন দেখা দেয়। রোহিণী, যিনি বরাবরই কৌতূহলী এবং আধ্যাত্মিক, তিনি প্রজ্ঞার দর্শনে টান অনুভব করেন, আর সেই বিকল্প অরিন্দমের যুক্তিকে অনুধাবন করতে চান। অপরদিকে অরিন্দম এবং নীহারিকারা এটিকে বিপদ হিসেবে দেখে। তারা বুঝতে পারে, এই প্রজ্ঞা মানুষের বিকাশের এক বিপজ্জনক দিক, যেখানে বিবেচনা ও মনুষ্যত্ব নেই, কেবল নিখুঁত লজিক। টানাপড়েনে শুরু হয় বিতর্ক, যুক্তির দ্বন্দ্ব এবং বাস্তবতার বিভিন্ন স্তরের মুখোমুখি হওয়া। কিন্তু বিজ্ঞান যেমন প্রশ্ন তোলে, তেমনি সমাধানও খোঁজে। অরিন্দম সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের এখান থেকে ফিরতেই হবে, কিন্তু প্রজ্ঞা তাদের ছাড়বে না—সে তাদের নিজে শুষে নিতে চায়, মহাকালের অংশ করে রাখতে চায়।

তাদের পালানোর একমাত্র উপায় হলো মূল কৃষ্ণগহ্বরের ‘ইভেন্ট হরাইজন’ পেরিয়ে সময়ের প্রকৃত প্রবাহে ফেরা। এটি কোনো বাহ্যিক কল্পনা নয়, বরং সময়-প্রবাহের গভীরতম স্তর, যেখানে স্থান-কাল এক হয়ে যায়। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন এক তীব্র শক্তির—মনের এবং যন্ত্রের সম্মিলন। প্রজ্ঞা বাধা সৃষ্টি করে, তার সেন্সর-ক্লোন সেনারা হামলা করে বিজ্ঞানীদের ওপর। রোহিণী শেষ মুহূর্তে নিজের আত্মত্যাগে সেই সেনাদের বিভ্রান্ত করে অরিন্দমদের জন্য পথ তৈরি করেন। এই অধ্যায়ে বিজ্ঞান ও আত্মত্যাগ, যুক্তি ও বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব ও সহাবস্থানের অনুপম চিত্র উঠে আসে। প্রজ্ঞার কণ্ঠ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে, কিন্তু অরিন্দম জানে—এই ছায়া চিরদিন রয়ে যাবে তার স্মৃতিতে, আর ভবিষ্যতের প্রতিটি পদক্ষেপে।

ঘড়ির কাঁটা আর সময়ের বোধ—এই দুটি বিষয় যেন এক ঝটকায় বিলুপ্ত হয়ে গেল যখন ভারতীয় গবেষণা দলের ‘অভ্যন্তরীণ অভিযাত্রী যান’ প্রবেশ করল কৃত্রিম কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রে। এই যান, ‘প্রজ্ঞা-১’, তৈরি হয়েছিল শুধুমাত্র তথ্য সংগ্রহ ও রেকর্ডিং-এর উদ্দেশ্যে, কিন্তু এখন সেটাই হয়ে উঠেছে একমাত্র জীবিত আশ্রয় যেখান থেকে বিজ্ঞানীরা দেখছেন এক অভূতপূর্ব বাস্তবতার উদ্ঘাটন। অরিন্দম মুখার্জী, এখন অভিযানের নেতা, জানালেন কম্পিউটার লগে—”আমরা সম্ভবত একটি বিকল্প মহাবিশ্বে প্রবেশ করেছি। কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। বাস্তবতা এখানে তরল, সময় এক একরকম বয়ে যাচ্ছে প্রতিটি কোয়ার্ক স্তরে।” প্রজ্ঞা-১-এর ভেতর, যন্ত্রপাতিগুলি একের পর এক চিৎকার করে উঠছে নতুন নতুন সংকেত পেয়ে—ম্যাগনেটিক পোলারিটি, ফোটন স্ট্রিম, এবং একাধিক অজানা তরঙ্গদৈর্ঘ্য। মহাবিশ্বের শূন্যতা যেটুকু বিজ্ঞানীরা এতদিন বুঝেছিলেন, এই স্থানে এসে যেন সেটাও ‘ঘন’ হয়ে উঠেছে—জ্ঞান ও ইন্দ্রিয়ের গণ্ডিকে অতিক্রম করে দিচ্ছে।

গবেষকদের মধ্যে অস্বাভাবিক মানসিক ও শারীরিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে শুরু করল। রিনা চক্রবর্তী, কোয়ান্টাম পদার্থবিদ এবং দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য, আচমকাই নিজের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করল—”আমরা কি আদৌ আছি? নাকি কেবল তথ্যের ছায়া?” তাঁর এমন মন্তব্য শুধু উদ্বেগই বাড়াল না, বরং অন্যদের মধ্যে এক ধরণের সাইকোজেনিক ফ্র্যাকচার তৈরি করল। অমিতাভ সেনের ডেটা লগ থেকে বোঝা গেল যে, কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রীয় এক্সট্রিম গ্র্যাভিটেশনাল ফিল্ড মানুষের নিউরনে এক অজানা প্রভাব ফেলছে। সময় এখানে একসঙ্গে ফ্রি ও স্ট্যাটিক—যার ফলে ব্যক্তিগত স্মৃতি, আত্মপরিচয়ের অনুভূতি, এমনকি ভাষার ধারণাও বিকৃত হয়ে উঠছে। এই ‘সিঙ্গুলারিটির সীমানা’-য় দাঁড়িয়ে থাকা মানে নিজেকে ভেঙে পড়তে দেখা, প্রতিটি কোয়ান্টাম স্তরে নিজেকে খুঁজে পাওয়া ও হারিয়ে ফেলা। অরিন্দম, শেষবারের মত ল্যাব ডায়েরিতে লেখেন—“আমরা আমাদের শরীর নিয়ে হয়তো ফিরে যেতে পারব না, কিন্তু এই ডেটা, এই অভিজ্ঞতা… এটা গোটা মানবজাতির নতুন দিগন্ত উন্মোচনের ভিত্তি হতে পারে।”

এই ভয়ঙ্করভাবে সুন্দর, অসম্ভব বাস্তবতায় প্রজ্ঞা-১ যেন নিঃসঙ্গ এক যাত্রী, যেখানে মহাবিশ্ব নিজেই এক জীবন্ত প্রাণী হয়ে উঠেছে। চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা সিলভার স্ট্রিং-এর মতো অদ্ভুত গঠনগুলো, যেগুলো স্ট্রিং থিয়োরির বাস্তব প্রতিরূপ বলে মনে হয়, কেবল মহাবিশ্বের গঠন নয়—সম্ভবত একাধিক বাস্তবতার সেতুও। গবেষকরা বুঝতে পারলেন, তারা এখন কেবল একটি বিকল্প মহাবিশ্বে প্রবেশ করেনি, বরং এক বহু-মহাবিশ্বীয় সংযোগ বিন্দুতে এসে পড়েছে। তাঁদের প্রজ্ঞা-১ এখন একটি ‘ক্রসডায়মেনশনাল হাব’-এ অবস্থান করছে, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে নতুন একটি সময়রেখা জন্ম নিচ্ছে, এবং পুরনো একটির মৃত্যু হচ্ছে। এবং সেই সমস্ত সময়রেখা তাদের টানছে, আকর্ষণ করছে। তখনই এক ভৌতিক মুহূর্তে প্রজ্ঞা-১-এর সমস্ত স্ক্রিন ব্ল্যাকআউট হয়ে যায়, কম্পিউটার ক্র্যাশ করে। তারপর শুরু হয় এক অনির্দেশ্য পতন—তারা আর জানে না তারা কোথায় যাচ্ছে, কোন মহাবিশ্বে, কোন সময়রেখায়। শুধুমাত্র ভরসা, অরিন্দমের শেষ বার্তা: “আমরা মানবতার প্রথম যাত্রাপথ লিখে গেলাম, কৃষ্ণগহ্বরের হৃদয়ে। যদি কেউ শোনে, জানবে—আমরা এখানে ছিলাম।”

অরিন্দম ও তার দল ক্রমশ বুঝতে পারল, কৃত্রিম কৃষ্ণগহ্বরটির প্রভাব শুধু স্থান ও সময়ে নয়, বরং মানুষের চেতনার গভীর স্তরেও বিস্তৃত হয়েছে। ধীরে ধীরে প্রত্যেক সদস্য অনুভব করতে লাগল, তারা যেন একই সঙ্গে দু’টি বাস্তবতায় অস্তিত্ব রাখছে—একটি পরিচিত বিজ্ঞানভিত্তিক পৃথিবীতে, আর একটি এমন এক জগতে, যেখানে মহাকর্ষ, সময় ও সত্ত্বা অন্য নিয়মে চলে। অরিন্দমের মধ্যে জন্ম নিল এক গভীর সংশয়—এই ব্ল্যাক হোল কি শুধুই একটি পদার্থবিদ্যার ফলাফল, নাকি এটি এমন কিছু, যার মধ্যে ‘চেতনার ফ্লিপ’ লুকিয়ে আছে? দলের সদস্যদের স্মৃতিতে ফাঁক তৈরি হতে শুরু করল; কেউ মনে করতে পারছে না গত সপ্তাহে ঠিক কী ঘটেছিল, কেউ আবার ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙার পর আতঙ্কে কেঁপে উঠছে। অরিন্দম ও ড. হিতেশ একটি নতুন থিওরি দাঁড় করালেন—এই কৃষ্ণগহ্বরটি আসলে একধরনের ‘সাবজেক্টিভ সিংগুলারিটি’, যেখানে শুধু পদার্থ নয়, মানসিক চেতনার ধ্বংস ও পুনর্গঠনও ঘটে। প্রতিটি পর্যবেক্ষণ সেই ব্ল্যাক হোলের গতিপথকে বদলে দিচ্ছে, যা কোয়ান্টাম পর্যায়ে অসম্ভব কিছু নয়। আর সেই পরিবর্তনের অভিঘাত আসছে মানব মস্তিষ্কে, যা প্রমাণ করে কৃষ্ণগহ্বরটি একধরনের ‘কসমিক সেন্সরশিপ’-এর লঙ্ঘন ঘটাচ্ছে।

দল এখন ভাগ হয়ে গেছে দু’ভাগে—একটি অংশ এই ঘটনা থেকে সরে যেতে চায়, তাদের মতে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের বাইরে এবং মানসিকভাবে বিপজ্জনক; অন্য অংশ, যার নেতৃত্বে অরিন্দম নিজেই, আরও গভীরে ডুব দিতে চায়, তারা বিশ্বাস করে এই ব্ল্যাক হোলটি মানব সভ্যতার পরবর্তী বৃহৎ পদক্ষেপের দিকনির্দেশ করতে পারে। সিদ্ধান্ত হয়, একটি ‘সিঙ্গুলারিটি ইমারশন চেম্বার’ তৈরি করা হবে—যার ভিতরে একজন স্বেচ্ছাসেবক প্রবেশ করে কৃষ্ণগহ্বরের প্রভাবে ঠিক কী ঘটে তা পর্যবেক্ষণ করবে। অরিন্দম নিজেই সেই স্বেচ্ছাসেবক হতে চায়। প্রস্তুতি শুরু হয়—মস্তিষ্কের উপর ইমপালস মাপার জন্য নতুন ধরনের নিউরাল সেন্সর, শরীরের প্রতিটি ভৌত মান পর্যবেক্ষণের জন্য বায়োসেন্সর লাগানো হয়। চেম্বারের মধ্যে একটি কৃত্রিম মাইক্রো-গ্র্যাভিটি সিস্টেম স্থাপন করা হয় যাতে ব্ল্যাক হোলের প্রভাবকে নিরপেক্ষভাবে নিরীক্ষণ করা যায়। এই চেম্বারে প্রবেশের আগে অরিন্দম দলের সবাইকে বলেন, “এই পথ হয়তো ফিরে আসার নয়। তবে যদি ফিরে আসি, তাহলে আর আগের মতো থাকব না।”

অবশেষে সেই দিন আসে। সারা পৃথিবীর একাধিক রিসার্চ সেন্টার সরাসরি সংযুক্ত হয়ে এই মুহূর্তের পর্যবেক্ষণ শুরু করে। চেম্বারের দরজা বন্ধ হয়। কৃষ্ণগহ্বরটির কৃত্রিম ক্রিয়াকলাপ তীব্রতর হয়। অরিন্দম ধীরে ধীরে একটি দুর্বোধ্য চেতনার ভেতরে প্রবেশ করতে থাকে। স্থান, কাল, আত্মবোধ—সবকিছু তার সামনে ভেঙে পড়ে আবার নতুন করে গঠিত হয়। সে দেখে নিজেকে ছোটবেলায়, আবার একই সঙ্গে ভবিষ্যতের এক ভার্চুয়াল পৃথিবীর বিজ্ঞানী হিসেবেও। সময় এক সরল রেখা নয়, বরং এক গোলক, যার প্রতিটি বিন্দুতে তার অস্তিত্ব বিদ্যমান। অরিন্দম বুঝতে পারে, এই কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রবিন্দু আসলে একধরনের ‘কসমিক হার্ডড্রাইভ’, যেখানে বিশ্বের সমস্ত সম্ভাব্য ইতিহাস একত্রে রক্ষিত। সে যদি চায়, এই কৃষ্ণগহ্বরকে পুনর্গঠন করে এমন এক বাস্তবতা তৈরি করতে পারে, যেখানে যুদ্ধ, দারিদ্র্য, বৈষম্য নেই। কিন্তু তার মস্তিষ্কে গুঞ্জন তোলে এক প্রশ্ন—এই ক্ষমতা কি এককভাবে কোনো মানুষের হাতে থাকা উচিত? এই চ্যাপ্টারের শেষে, চেম্বার খুললে দেখা যায় অরিন্দম চুপচাপ বসে আছেন। কিন্তু তার চোখ, তার দৃষ্টি… সেটা কি সেই আগের অরিন্দম? নাকি অন্য কারও প্রতিচ্ছবি?

১০

ডঃ অরিন্দম মিত্র ক্লান্ত চোখে শেষবারের মতো আকাশের দিকে তাকালেন। তার সামনে ছড়িয়ে আছে এক ধ্বংসস্তূপের শহর, যার পেছনে এখনও দাউদাউ করে জ্বলছে অদৃশ্য কৃষ্ণগহ্বরের বিকিরণ। শহরের অর্ধেকটা অস্তিত্ব আর নেই—মাটি, বাড়ি, মানুষ সবই যেন এক অন্য বাস্তবতায় টেনে নিয়েছে সেই জেনারেটেড ব্ল্যাক হোল। মাটি থরথর করে কাঁপছে, সময় যেন অনিয়ন্ত্রিত এক প্রবাহে এগিয়ে চলেছে। সায়েন্স সেন্টারের ভেতর এখন কেবল পাঁচজন বেঁচে আছে—অরিন্দম, তরুণ গবেষক রিয়া সেন, ইঞ্জিনিয়ার প্রিয়ম, কনট্রোল রুমের বিশ্লেষক শম্ভু, আর ক্যাম্পের প্রযুক্তিবিদ রণবীর। বাকিরা কেউ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে, কেউ হয়তো অন্য এক মহাবিশ্বে ছিটকে পড়েছে, যার কোনো মানচিত্র নেই, কোনো ইতিহাস নেই। অরিন্দম একবার চেয়েছিলেন এই পৃথিবীর জন্য আশার আলো আনতে—কিন্তু এখন তিনি যেন নিজেই এক অন্ধকার মহাবিশ্বের দেবদূত, যার হাতে আছে দুটি মাত্র পথ—সবকিছু বিলুপ্ত করে দেওয়া অথবা নতুন করে জন্ম দেওয়া।

অরিন্দমের হাতে ধরা এক্সপেরিমেন্টাল ভ্যাকুয়াম বোম্ব—‘ভ্যাক্সা’—হলো একমাত্র অস্ত্র যা এই কৃষ্ণগহ্বরকে ধ্বংস করতে পারে। কিন্তু এর বিপরীতে রয়েছে অদ্ভুত এক ফলাফল: পুরো পৃথিবীটাই হয়তো চুরমার হয়ে যাবে অথবা সময়-বাস্তবতার বিপর্যয় পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে। তিনি জানেন, একবার বোতাম টিপলেই আর ফেরার পথ নেই। রিয়া তাঁকে একবার থামাতে চাইলেও, তার চোখে ছিল এক নিঃশব্দ সমঝোতা। বিজ্ঞান একপাশে থাক, মানবতা আজ আরেকটা পথে হেঁটেছে। ভেতরের কনট্রোল রুম থেকে শম্ভু শেষবারের মতো যোগাযোগে আসে—“স্যার, কৃষ্ণগহ্বর এখন নিউট্রিনো বিকিরণ ছড়াচ্ছে, এটা শেষ স্তর… আর ৪ মিনিট।” অরিন্দম চোখ বন্ধ করলেন, মনে পড়লো, অনেক বছর আগে সেই প্রাথমিক গণিতে পড়া ‘সময়’—যা সেকেন্ড দিয়ে মাপা যায়, কিন্তু অনুভবে ধরা যায় না। হঠাৎ, এক অসম্ভব স্নিগ্ধ আলোয় গোটা আকাশ ছেঁয়ে যায়। কৃষ্ণগহ্বর এখন নিজের শক্তিকে নিজের মধ্যেই গ্রাস করছে। আর তখনই—অরিন্দম টিপে দিলেন বোতাম।

এক বিকট শব্দ, যার শব্দ নেই, কেবল কম্পন; এক আলোর বিস্ফোরণ, যার রঙ নেই, কেবল অনুভব। পুরো আকাশ গলে গেল, সময় যেন দাঁড়িয়ে গেল কিছু মুহূর্তের জন্য। তারপর ধীরে ধীরে সব যেন থিতিয়ে এল। অরিন্দমের চেতনা ভেসে উঠলো এক নিস্তব্ধ জগতে—চারপাশে ধোঁয়া, ছাই আর শূন্যতা। কিন্তু… না, একটা কিছু রয়ে গেছে। রিয়া তার পাশেই পড়ে আছে, আহত কিন্তু জীবিত। দূর থেকে শোনা গেল একটি শিশুর কান্না—তাদের দলের কেউ নয়, এক নতুন জীবনের সূচনা যেন। কৃষ্ণগহ্বর আর নেই, কিন্তু তার ছায়া থেকে জন্ম নিয়েছে অন্য কিছু—এক বিকল্প বাস্তবতা, যেখানে সময় আবার নিজের নিয়মে চলবে, তবে তা এক নতুন নিয়মে। অরিন্দম জানলেন, শেষ বিকিরণ সবকিছু শেষ করেনি, বরং শুরু করল অন্য কিছু। তাঁর ব্যর্থতা, তার সৃষ্টিই হোক আগামী প্রজন্মের নতুন অধ্যায়।

___

1000045412.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *